18-01-2019, 11:52 AM
পর্ব ৬- সত্যবাবুর গল্পঃ
অনুরাধাঃ
মৃত্যুঞ্জয়ের স্ত্রী অনুরাধা। অসম্ভব সুন্দরী। আর এই রুপের জন্যই অনুরাধার যোগ্য পাত্র পাওয়া যায়নি। অনুরাধা মেদিনীপুরের রাজবাড়ীর মেয়ে। ওনার বাবা ওনার জন্য বহু সুপুরুষ ও উচ্চ বংশের পাত্রর সন্ধান করেছিলেন। কিন্তু তারা কেউ ই অনুরাধার রুপ ও ব্যক্তিত্বর সামনে দাঁড়াতে পারেন নি। প্রত্যেকের ই একটি ই অভিযোগ ছিল “এত গুনবতি ও রূপবতী স্ত্রীর থেকে তারা কখনই স্বামীর সম্মান পাবেন না”। তাদের অভিযোগ যথার্থই ছিল। অনুরাধা নিজের সময়ের থেকে কয়েক শতাব্দী এগিয়ে ছিলেন। ওনার রুপ, গুন এইসবকে ছাপিয়ে যা বেশি নজরে পড়ত টা হোল ওনার আধুনিকতা, যা সত্যি ই সেই সময়ের কোন পুরুষের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলোনা। বউএর দ্যুতি তে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে কোন সুপুরুষ ই টাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করতে চাননি। মেয়ের বিবাহের দুশ্চিন্তায় রাজাবাবু বহু পণ্ডিতের পরামর্শ নেন। অবশেষে ঠিক হয় যে অনুরাধার জন্য স্বয়ংবর সভার আয়জন করা হবে এবং তিনি নিজেই নিজের যোগ্য পাত্র কে বেছে নেবেন।
সেই মত পরের মাসে লগ্ন দেখে সয়ংবরের দিন স্থির হয়। রাজবাড়িতে বহু রাজকুমার ও রাজার আগমন ঘটে। সভাগৃহে প্রবেশ করেই অনুরাধা নিজের হাতে লেখা কিছু কাগজের টুকরো সমস্ত প্রতিযোগীর হাতে তুলে দেন। এই কাগজের টুকরো তে জ্যোতিষ শাস্ত্রের কিছু শক্ত প্রশ্ন লেখা ছিল। মাত্র তিন জন সথিক উত্তর দিতে পারেন বাকিদের বিদায় হয়ে যায়। এবং এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে মৃত্যুঞ্জয় বাবু ও ওই ৩ জনের একজন। এরপর অনুরাধার নির্দেশে ৩ টি সম আকৃতির লোহার থাম ওখানে রাখা হয়, এবং প্রতিযোগী দের তা তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। একজন প্রতিযোগী ব্যর্থ হন ও তার বিদায় ঘটে। এরপর আসে শেষ পরীক্ষার ক্ষন। অনুরাধা ওনাদের দুজনকেই বলেন “আপনারা দুজনেই আমার স্বামী হওয়ার যোগ্য কিন্তু আমি দেখতে চাই আপনারা আমায় ঠিক কি উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারেন”। এতে অপর প্রতিযোগী খুব খুশি হন এবং ওনাকে একটি হিরের আংটি বাড়িয়ে দেন। মৃত্যুঞ্জয় বাবু ওনার সামনে গিয়ে বলেন “আমি গরিব ব্রাম্ভনের ছেলে, আমি কোন দামী উপহার দিতে পারবো না। আমি একজন চিকিৎসক তাই বলতে পারি এই মুহূর্তে আপনার খুব ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি আপনাকে ওষুধ উপহার হিসেবে দিচ্ছি। আর আমি সারাজীবন আপনার সেবা করতে পারি”। অনুরাধা দেবী বিগলিত হয়ে যান এবং মৃত্যুঞ্জয় কেই নিজের স্বামী হিসেবে বেছে নেন।
জমিদার বাড়ীতে মৃত্যুঞ্জয় ও অনুরাধাঃ
“কি দাদা কতটা পড়লেন?” সুবীর বাবু কিছুটা চমকে গেলেন কথাটা শুনে। পেছন ঘুরে দেখেন এক অতি সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে তার পাঞ্জাবি ও পাজামা। পাঞ্জাবি পাজামা হলেও ড্রেস টা প্রচণ্ড অভিজাত, সাধারনত এই ধরনের কারুকার্য করা কাপড় এখন আর খুব একটা পাওয়া যায়না। ভদ্রলোক কে দেখেই মনে হয় যে অত্যন্ত কেতা দুরস্ত মানুষ। কাপড়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই শরীর দিয়ে ভুর ভুর করে আতরের গন্ধ আসছে। এই গন্ধ টা সুবীর বাবুর প্রচণ্ড অচেনা। সাধারনত এখনকার যুগে আর এই ধরনের আতর ব্যবহার হয়না। যাই হোক সুবীর বাবু শুধু একদৃষ্টি তে ওই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়েই থাকলেন।
“কি দাদা উত্তর দিলেন না যে। কতটা পড়লেন?”
সুবীর বাবুঃ আপনি কে? এখানে কিভাবে এলেন?
ভদ্রলোকঃ আপনি তো অদ্ভুত লোক মশাই, এই প্রশ্ন টা তো আমার করা উচিত। আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? এখানে কেন? কখন এসেছেন?
সুবীর বাবুঃ এই মানে আমি সুবীর। ইতিহাসের গবেষক। এই বাড়িটা নিয়ে কিছু গবেষণা করতে এখানে এসেছি। এই ৫ মিনিট হোল। আপনি কে?
ভদ্রলোকঃ আমি এই বাড়ীর ই ছেলে এখানেই থাকি। আমার নাম সত্য।
সুবীর বাবুঃ তা আপনি এই বাড়ী তে থাকেন? এটা তো দেখে একবার ও মনে হলনা থাকার যোগ্য বলে।
সত্য বাবুঃ আরে না এখানে থাকিনা। এই বাড়ীর পেছনে আমরা একটা বাড়ী করেছি। সেখানেই থাকি।
সুবীর বাবুঃ ওহ। আচ্ছা এখানে কি কেউ আসে। যা অবস্থা বাড়ীটার। আমার তো ওপরে উঠতেই ভয় লাগছিল।
সত্য বাবুঃ কেন আসবেনা। সবাই আসে। ভয় পেলে কি চলবে। আপনার কতটা পড়া হোল। দেখি।
সত্য বাবু নিজের থেকেই টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে একবার ডায়েরি তার দিকে উকি মারলেন।
সত্য বাবুঃ ও অনেকটাই তো পড়ে ফেলেছেন দেখছি। আপনি তো মশাই খুব পড়াকু লোক মশাই। এত দ্রুত এতটা কি করে পড়ে ফেললেন।
সুবীর বাবুঃ তা বলতে পারেন। আসলে একটা উদ্যেশ্য নিয়ে এসেছি তো। আর সত্যি বলতে খুব ভালো করে খুঁজে দেখলাম এই ডায়েরি তা ছাড়া আর কিছুই নেই।
সত্য বাবুঃ যা বলেছেন মশাই, এই ডায়েরি টা। এটাই তো সব। এরজন্যই তো আপনাদের মত লোক এখানে আসে। আর আমরা রোজ উকি মেরে যাই কেউ এসেছে কিনা, কেউ ডায়েরি টা পরছে কিনা টা দেখার জন্য। জানেন সুবীর বাবু আমি কিন্তু জানতাম আপনি এখানে আসবেন।
সুবীর বাবুঃ ও আপনাকে বোধ হয় রামকিঙ্কর বাবু বলে রেখেছিল না।
সত্য বাবুঃ কে রামকিঙ্কর? না না কেউ বলেনি। আপনি যে আসবেন তা এই ডায়েরি তেই লেখা রয়েছে। (গলা টাকে একটু নিচু করে) মশাই একে যা তা ডায়েরি ভাববেন না। এর নাম অভিশপ্ত ডায়েরি। আজ এত বছর ধরে এটা এই টেবিল এ পড়ে আছে। কত মানুষ এসেছে তারা পড়েছে, এবং ডায়েরি তা তাদের হাতে করে এখান থেকে চলে গেছে। কিন্তু দেখুন আবার এই টেবিল এ এসেছে, আবার অন্য কেউ পড়েছে। এর আগে এটা গেছিল কোনও এক কলেজ স্টুডেন্ট এর কাছে, যাই হোক আবার ফিরে এসেছে।
সুবীর বাবু এবার একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। ভালো করে একবার সত্য বাবুর দিকে তাকালেন, বিশেষ করে ওনার পোশাক তার দিকে। মনে মনে ভাবলেন লোক তা উন্মাদ নয়তো। এই পোড়ো বাড়ীতে একটা পাগলের খপ্পরে পড়লে আর জ্যান্ত ফিরে যেতে হবেনা। হথাত সত্য বাবু বলে উঠলেন
সত্য বাবুঃ আপনি ভুল ভাবছেন সুবীর বাবু, আমি একদম সুস্থ। আমি পাগল নই, আমার মাথার একদম ঠিক আছে। আমার পোশাক দেখে যদি একটু অন্যরকম মনে হয় তাহলে আমার সত্যি ই কিছু বলার নেই।
সুবীর বাবুঃ আরে মশাই কি যে বলেন, আপনি আমায় লজ্জায় ফেলে দিলেন। আপনার ই বাড়ীতে বসে আপনার সম্বন্ধে আমি এরকম ভাববো।
সত্য বাবুঃ আসলে আমার শরীরে যতই হোক জমিদারি রক্ত, তাই এই পোশাক তা ছাড়তে পারিনি। হাঁ যে ব্যাপারে কথা বলছিলাম, ডায়েরি। এই ডায়েরি তা সত্যি ই অভিশপ্ত, অন্তত আমরা যারা এই বাড়ীতে বাস করি তাদের প্রত্যেকের ই তাই বিশ্বাস। আপনি একবার যখন এটা পড়তে শুরু করেছেন, আপনাকে শেষ অবধি এটা পড়েই তবে যেতে হবে।
সুবীর বাবুঃ (পরিস্থিতি তা কিছুটা স্বাভাবিক করার জন্য একটু হেসে) এব্যাপারে কিন্তু আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন, আমি কিন্তু খুব নামকরা পাঠক।
সত্য বাবুঃ তাহলে তো জমে ক্ষীর মশাই, আমি আবার খুব নাম করা কথাকার। গল্প বলা আমার অন্যতম শখ। এই ডায়েরি তা আমি কয়েক হাজার বার পড়েছি। এটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আমি বরং গল্প তা বলি আপনি শুনুন।
সুবীর বাবুঃ এতো মেঘ না চাইতেই জল। নিশ্চয় নিশ্চয়, আপনি গল্প শুরু করুন, আমি শুনছি।
সত্য বাবুঃ হাঁ শুরু তো করব। কিন্তু আগে একটা প্রশ্ন করি আপনাকে। মশাই আপনার সভ্যসমাজবর্জিত বাংলা সাহিত্য পড়ার অভ্যাস রয়েছে কি?
সুবীর বাবুঃ কি সভ্যসমাজবর্জিত? সে আবার কি জিনিষ?
সত্য বাবুঃ এই মরেছে এই ধরনের জিনিষ আপনার পড়া নেই। আচ্ছা বাৎস্যায়ন এর লেখা মানে কামসুত্র গোছের কিছু লেখা নিশ্চয় পড়েছেন?
সুবীর বাবুঃ (প্রচণ্ড জোরে হেসে) ওহ আপনি তাহলে যৌনতা নির্ভর বাংলা সাহিত্যর কথা বলছেন তাইতো। এতো ছোট বেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে কত পড়েছি। কি যেন একটা বাংলা ম্যাগাজিন বেরত, তাতে ধারাবাহিক ভাবে এই লেখাগুলো আসত। কলেজ কলেজ এ পড়া কালীন প্রচুর পড়তাম।
সত্য বাবুঃ ব্যাস ব্যাস বুঝে গেছি। এতেই চলবে। আসলে এই ডায়েরি তা যৌনতা ছাড়া অসমাপ্ত। আর যে অভিশাপের কথা আপনাকে বললাম তা আসলে যৌন অভিশাপ। (আবার গলাটা একটু আসতে করে) মশাই এই বাড়ীর কোনায় কোনায় যৌনতা লুকিয়ে আছে। কান পাতুন ঠিক শুনতে পাবেন। কি পাচ্ছেন নারী পুরুষের সম্ভোগের আনন্দ, নারীর চরম শীৎকার, পাচ্ছেন কি শুনতে।
এর আগের বার সুবীর বাবুর সত্য বাবুকে পাগল মনে হলেও এবার মনে হলনা। উনি বুঝে গেছেন এটা আসলে গল্প বলার স্টাইল, এইভাবে উনি একটা যৌন পরিবেশ তৈরি করতে চাইছেন। ছোট বেলায় দাদু যখন গল্প বলতেন ঠিক এইভাবে আগে একটা আবেশ তৈরি করতেন।
সুবীর বাবুঃ এই মুহূর্তে তো পাচ্ছিনা। তবে মনে হয় আসতে আসতে ঠিক পেয়ে যাবো। আপনি বরং গল্প তা শুরু করে দিন।
সত্য বাবুঃ আপনি এই মুহূর্তে ডায়েরি তার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে আছেন, যার নাম জমিদার বাড়ী তে মৃত্যুঞ্জয় ও অনুরাধা। দক্ষ প্রশাসক দেবেন্দ্রর অনুরোধ ফেলে না দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় ঠিক করেন যে তিনি সুতানুটি আসবেন। যতই হোক উনি তো ডাক্তার মানুষ, রোগীর সেবা করাই ওনার প্রধান ধর্ম। পরের দিন ভোর বেলা উনি ও ওনার রুপসি স্ত্রী অনুরাধা দেবেন্দ্রর সাথে সুতানুটি এর দিকে রওনা হন। প্রায় ৮ ঘণ্টা পর ওনারা সুতানুটির কাছাকাছি এক গ্রাম দেবেশ নগরে পৌঁছান। তখন সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে। গ্রামের অবস্থা দেখে মৃত্যুঞ্জয় অনুরাধা দুজনেই শিউরে ওঠেন। পুরো গ্রাম জুড়ে লাশের মিছিল। কেউ কেউ হয়ত বেঁচে আছেন, কিন্তু তাদের অবস্থা এতটাই করুন যে যেকোনো সময় ই তাদের মৃত্যু হতে পারে। এই অবস্থা দেখে মৃত্যুঞ্জয় ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। কোনও এক মুমূর্ষু রোগীর কাছে গিয়ে ভালো করে তাকে পরীক্ষা করেন। এভাবে গোটা গ্রামেই প্রায় শতাধিক রোগীর উনি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। ডাক্তারের চোখে রোগ আর কতক্ষন লুকিয়ে থাকে। মৃত্যুঞ্জয় বুঝে যান এই অজানা রোগ টি আসলে কি, কি এর ওষুধ। সেই মত মৃত্যুঞ্জয় আদেশ করেন হাজার রকম গাছ গাছালি, জড়িবুটি ইত্যাদি জোগাড় করতে। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল বাহিনী কে পাঠানো হয় আশেপাশের সমস্ত গ্রামে ওইসব জোগাড় করতে। ঠিক হয় পরের দিন দুপুর থেকেই সমস্ত প্রজা ও রাজাবাবুকে মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে তৈরি ঔষধ সেবন করানো হবে। সেই মত ২-৩ ঘণ্টার মধ্যেই সব উপাদান জোগাড় হয়ে যায় এবং মৃত্যুঞ্জয় নিজের জীবনের হয়ত শ্রেষ্ঠ আবিস্কার টি করে ফেলেন। সম্পূর্ণ ঔষধ টি বানাতে বানাতে ভোর হয়ে যায়। অনুরাধা ও দেবেন্দ্র সারারাত ওনার সাথে জেগে থাকেন। এরপর শুরু হয় ঔষধ সেবন। ভোর রাত থেকেই জমিদার বাড়ীর সামনে ভিড় হয়ে যায় শুরু হয় ১ সপ্তাহ ধরে লাগাতার চিকিৎসা।
অনুরাধাঃ
মৃত্যুঞ্জয়ের স্ত্রী অনুরাধা। অসম্ভব সুন্দরী। আর এই রুপের জন্যই অনুরাধার যোগ্য পাত্র পাওয়া যায়নি। অনুরাধা মেদিনীপুরের রাজবাড়ীর মেয়ে। ওনার বাবা ওনার জন্য বহু সুপুরুষ ও উচ্চ বংশের পাত্রর সন্ধান করেছিলেন। কিন্তু তারা কেউ ই অনুরাধার রুপ ও ব্যক্তিত্বর সামনে দাঁড়াতে পারেন নি। প্রত্যেকের ই একটি ই অভিযোগ ছিল “এত গুনবতি ও রূপবতী স্ত্রীর থেকে তারা কখনই স্বামীর সম্মান পাবেন না”। তাদের অভিযোগ যথার্থই ছিল। অনুরাধা নিজের সময়ের থেকে কয়েক শতাব্দী এগিয়ে ছিলেন। ওনার রুপ, গুন এইসবকে ছাপিয়ে যা বেশি নজরে পড়ত টা হোল ওনার আধুনিকতা, যা সত্যি ই সেই সময়ের কোন পুরুষের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলোনা। বউএর দ্যুতি তে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে কোন সুপুরুষ ই টাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহন করতে চাননি। মেয়ের বিবাহের দুশ্চিন্তায় রাজাবাবু বহু পণ্ডিতের পরামর্শ নেন। অবশেষে ঠিক হয় যে অনুরাধার জন্য স্বয়ংবর সভার আয়জন করা হবে এবং তিনি নিজেই নিজের যোগ্য পাত্র কে বেছে নেবেন।
সেই মত পরের মাসে লগ্ন দেখে সয়ংবরের দিন স্থির হয়। রাজবাড়িতে বহু রাজকুমার ও রাজার আগমন ঘটে। সভাগৃহে প্রবেশ করেই অনুরাধা নিজের হাতে লেখা কিছু কাগজের টুকরো সমস্ত প্রতিযোগীর হাতে তুলে দেন। এই কাগজের টুকরো তে জ্যোতিষ শাস্ত্রের কিছু শক্ত প্রশ্ন লেখা ছিল। মাত্র তিন জন সথিক উত্তর দিতে পারেন বাকিদের বিদায় হয়ে যায়। এবং এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে মৃত্যুঞ্জয় বাবু ও ওই ৩ জনের একজন। এরপর অনুরাধার নির্দেশে ৩ টি সম আকৃতির লোহার থাম ওখানে রাখা হয়, এবং প্রতিযোগী দের তা তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। একজন প্রতিযোগী ব্যর্থ হন ও তার বিদায় ঘটে। এরপর আসে শেষ পরীক্ষার ক্ষন। অনুরাধা ওনাদের দুজনকেই বলেন “আপনারা দুজনেই আমার স্বামী হওয়ার যোগ্য কিন্তু আমি দেখতে চাই আপনারা আমায় ঠিক কি উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারেন”। এতে অপর প্রতিযোগী খুব খুশি হন এবং ওনাকে একটি হিরের আংটি বাড়িয়ে দেন। মৃত্যুঞ্জয় বাবু ওনার সামনে গিয়ে বলেন “আমি গরিব ব্রাম্ভনের ছেলে, আমি কোন দামী উপহার দিতে পারবো না। আমি একজন চিকিৎসক তাই বলতে পারি এই মুহূর্তে আপনার খুব ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি আপনাকে ওষুধ উপহার হিসেবে দিচ্ছি। আর আমি সারাজীবন আপনার সেবা করতে পারি”। অনুরাধা দেবী বিগলিত হয়ে যান এবং মৃত্যুঞ্জয় কেই নিজের স্বামী হিসেবে বেছে নেন।
জমিদার বাড়ীতে মৃত্যুঞ্জয় ও অনুরাধাঃ
“কি দাদা কতটা পড়লেন?” সুবীর বাবু কিছুটা চমকে গেলেন কথাটা শুনে। পেছন ঘুরে দেখেন এক অতি সুদর্শন পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে তার পাঞ্জাবি ও পাজামা। পাঞ্জাবি পাজামা হলেও ড্রেস টা প্রচণ্ড অভিজাত, সাধারনত এই ধরনের কারুকার্য করা কাপড় এখন আর খুব একটা পাওয়া যায়না। ভদ্রলোক কে দেখেই মনে হয় যে অত্যন্ত কেতা দুরস্ত মানুষ। কাপড়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই শরীর দিয়ে ভুর ভুর করে আতরের গন্ধ আসছে। এই গন্ধ টা সুবীর বাবুর প্রচণ্ড অচেনা। সাধারনত এখনকার যুগে আর এই ধরনের আতর ব্যবহার হয়না। যাই হোক সুবীর বাবু শুধু একদৃষ্টি তে ওই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়েই থাকলেন।
“কি দাদা উত্তর দিলেন না যে। কতটা পড়লেন?”
সুবীর বাবুঃ আপনি কে? এখানে কিভাবে এলেন?
ভদ্রলোকঃ আপনি তো অদ্ভুত লোক মশাই, এই প্রশ্ন টা তো আমার করা উচিত। আপনি কে? কোথা থেকে এসেছেন? এখানে কেন? কখন এসেছেন?
সুবীর বাবুঃ এই মানে আমি সুবীর। ইতিহাসের গবেষক। এই বাড়িটা নিয়ে কিছু গবেষণা করতে এখানে এসেছি। এই ৫ মিনিট হোল। আপনি কে?
ভদ্রলোকঃ আমি এই বাড়ীর ই ছেলে এখানেই থাকি। আমার নাম সত্য।
সুবীর বাবুঃ তা আপনি এই বাড়ী তে থাকেন? এটা তো দেখে একবার ও মনে হলনা থাকার যোগ্য বলে।
সত্য বাবুঃ আরে না এখানে থাকিনা। এই বাড়ীর পেছনে আমরা একটা বাড়ী করেছি। সেখানেই থাকি।
সুবীর বাবুঃ ওহ। আচ্ছা এখানে কি কেউ আসে। যা অবস্থা বাড়ীটার। আমার তো ওপরে উঠতেই ভয় লাগছিল।
সত্য বাবুঃ কেন আসবেনা। সবাই আসে। ভয় পেলে কি চলবে। আপনার কতটা পড়া হোল। দেখি।
সত্য বাবু নিজের থেকেই টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে একবার ডায়েরি তার দিকে উকি মারলেন।
সত্য বাবুঃ ও অনেকটাই তো পড়ে ফেলেছেন দেখছি। আপনি তো মশাই খুব পড়াকু লোক মশাই। এত দ্রুত এতটা কি করে পড়ে ফেললেন।
সুবীর বাবুঃ তা বলতে পারেন। আসলে একটা উদ্যেশ্য নিয়ে এসেছি তো। আর সত্যি বলতে খুব ভালো করে খুঁজে দেখলাম এই ডায়েরি তা ছাড়া আর কিছুই নেই।
সত্য বাবুঃ যা বলেছেন মশাই, এই ডায়েরি টা। এটাই তো সব। এরজন্যই তো আপনাদের মত লোক এখানে আসে। আর আমরা রোজ উকি মেরে যাই কেউ এসেছে কিনা, কেউ ডায়েরি টা পরছে কিনা টা দেখার জন্য। জানেন সুবীর বাবু আমি কিন্তু জানতাম আপনি এখানে আসবেন।
সুবীর বাবুঃ ও আপনাকে বোধ হয় রামকিঙ্কর বাবু বলে রেখেছিল না।
সত্য বাবুঃ কে রামকিঙ্কর? না না কেউ বলেনি। আপনি যে আসবেন তা এই ডায়েরি তেই লেখা রয়েছে। (গলা টাকে একটু নিচু করে) মশাই একে যা তা ডায়েরি ভাববেন না। এর নাম অভিশপ্ত ডায়েরি। আজ এত বছর ধরে এটা এই টেবিল এ পড়ে আছে। কত মানুষ এসেছে তারা পড়েছে, এবং ডায়েরি তা তাদের হাতে করে এখান থেকে চলে গেছে। কিন্তু দেখুন আবার এই টেবিল এ এসেছে, আবার অন্য কেউ পড়েছে। এর আগে এটা গেছিল কোনও এক কলেজ স্টুডেন্ট এর কাছে, যাই হোক আবার ফিরে এসেছে।
সুবীর বাবু এবার একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। ভালো করে একবার সত্য বাবুর দিকে তাকালেন, বিশেষ করে ওনার পোশাক তার দিকে। মনে মনে ভাবলেন লোক তা উন্মাদ নয়তো। এই পোড়ো বাড়ীতে একটা পাগলের খপ্পরে পড়লে আর জ্যান্ত ফিরে যেতে হবেনা। হথাত সত্য বাবু বলে উঠলেন
সত্য বাবুঃ আপনি ভুল ভাবছেন সুবীর বাবু, আমি একদম সুস্থ। আমি পাগল নই, আমার মাথার একদম ঠিক আছে। আমার পোশাক দেখে যদি একটু অন্যরকম মনে হয় তাহলে আমার সত্যি ই কিছু বলার নেই।
সুবীর বাবুঃ আরে মশাই কি যে বলেন, আপনি আমায় লজ্জায় ফেলে দিলেন। আপনার ই বাড়ীতে বসে আপনার সম্বন্ধে আমি এরকম ভাববো।
সত্য বাবুঃ আসলে আমার শরীরে যতই হোক জমিদারি রক্ত, তাই এই পোশাক তা ছাড়তে পারিনি। হাঁ যে ব্যাপারে কথা বলছিলাম, ডায়েরি। এই ডায়েরি তা সত্যি ই অভিশপ্ত, অন্তত আমরা যারা এই বাড়ীতে বাস করি তাদের প্রত্যেকের ই তাই বিশ্বাস। আপনি একবার যখন এটা পড়তে শুরু করেছেন, আপনাকে শেষ অবধি এটা পড়েই তবে যেতে হবে।
সুবীর বাবুঃ (পরিস্থিতি তা কিছুটা স্বাভাবিক করার জন্য একটু হেসে) এব্যাপারে কিন্তু আপনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারেন, আমি কিন্তু খুব নামকরা পাঠক।
সত্য বাবুঃ তাহলে তো জমে ক্ষীর মশাই, আমি আবার খুব নাম করা কথাকার। গল্প বলা আমার অন্যতম শখ। এই ডায়েরি তা আমি কয়েক হাজার বার পড়েছি। এটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আমি বরং গল্প তা বলি আপনি শুনুন।
সুবীর বাবুঃ এতো মেঘ না চাইতেই জল। নিশ্চয় নিশ্চয়, আপনি গল্প শুরু করুন, আমি শুনছি।
সত্য বাবুঃ হাঁ শুরু তো করব। কিন্তু আগে একটা প্রশ্ন করি আপনাকে। মশাই আপনার সভ্যসমাজবর্জিত বাংলা সাহিত্য পড়ার অভ্যাস রয়েছে কি?
সুবীর বাবুঃ কি সভ্যসমাজবর্জিত? সে আবার কি জিনিষ?
সত্য বাবুঃ এই মরেছে এই ধরনের জিনিষ আপনার পড়া নেই। আচ্ছা বাৎস্যায়ন এর লেখা মানে কামসুত্র গোছের কিছু লেখা নিশ্চয় পড়েছেন?
সুবীর বাবুঃ (প্রচণ্ড জোরে হেসে) ওহ আপনি তাহলে যৌনতা নির্ভর বাংলা সাহিত্যর কথা বলছেন তাইতো। এতো ছোট বেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে কত পড়েছি। কি যেন একটা বাংলা ম্যাগাজিন বেরত, তাতে ধারাবাহিক ভাবে এই লেখাগুলো আসত। কলেজ কলেজ এ পড়া কালীন প্রচুর পড়তাম।
সত্য বাবুঃ ব্যাস ব্যাস বুঝে গেছি। এতেই চলবে। আসলে এই ডায়েরি তা যৌনতা ছাড়া অসমাপ্ত। আর যে অভিশাপের কথা আপনাকে বললাম তা আসলে যৌন অভিশাপ। (আবার গলাটা একটু আসতে করে) মশাই এই বাড়ীর কোনায় কোনায় যৌনতা লুকিয়ে আছে। কান পাতুন ঠিক শুনতে পাবেন। কি পাচ্ছেন নারী পুরুষের সম্ভোগের আনন্দ, নারীর চরম শীৎকার, পাচ্ছেন কি শুনতে।
এর আগের বার সুবীর বাবুর সত্য বাবুকে পাগল মনে হলেও এবার মনে হলনা। উনি বুঝে গেছেন এটা আসলে গল্প বলার স্টাইল, এইভাবে উনি একটা যৌন পরিবেশ তৈরি করতে চাইছেন। ছোট বেলায় দাদু যখন গল্প বলতেন ঠিক এইভাবে আগে একটা আবেশ তৈরি করতেন।
সুবীর বাবুঃ এই মুহূর্তে তো পাচ্ছিনা। তবে মনে হয় আসতে আসতে ঠিক পেয়ে যাবো। আপনি বরং গল্প তা শুরু করে দিন।
সত্য বাবুঃ আপনি এই মুহূর্তে ডায়েরি তার একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে আছেন, যার নাম জমিদার বাড়ী তে মৃত্যুঞ্জয় ও অনুরাধা। দক্ষ প্রশাসক দেবেন্দ্রর অনুরোধ ফেলে না দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় ঠিক করেন যে তিনি সুতানুটি আসবেন। যতই হোক উনি তো ডাক্তার মানুষ, রোগীর সেবা করাই ওনার প্রধান ধর্ম। পরের দিন ভোর বেলা উনি ও ওনার রুপসি স্ত্রী অনুরাধা দেবেন্দ্রর সাথে সুতানুটি এর দিকে রওনা হন। প্রায় ৮ ঘণ্টা পর ওনারা সুতানুটির কাছাকাছি এক গ্রাম দেবেশ নগরে পৌঁছান। তখন সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে। গ্রামের অবস্থা দেখে মৃত্যুঞ্জয় অনুরাধা দুজনেই শিউরে ওঠেন। পুরো গ্রাম জুড়ে লাশের মিছিল। কেউ কেউ হয়ত বেঁচে আছেন, কিন্তু তাদের অবস্থা এতটাই করুন যে যেকোনো সময় ই তাদের মৃত্যু হতে পারে। এই অবস্থা দেখে মৃত্যুঞ্জয় ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। কোনও এক মুমূর্ষু রোগীর কাছে গিয়ে ভালো করে তাকে পরীক্ষা করেন। এভাবে গোটা গ্রামেই প্রায় শতাধিক রোগীর উনি পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। ডাক্তারের চোখে রোগ আর কতক্ষন লুকিয়ে থাকে। মৃত্যুঞ্জয় বুঝে যান এই অজানা রোগ টি আসলে কি, কি এর ওষুধ। সেই মত মৃত্যুঞ্জয় আদেশ করেন হাজার রকম গাছ গাছালি, জড়িবুটি ইত্যাদি জোগাড় করতে। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল বাহিনী কে পাঠানো হয় আশেপাশের সমস্ত গ্রামে ওইসব জোগাড় করতে। ঠিক হয় পরের দিন দুপুর থেকেই সমস্ত প্রজা ও রাজাবাবুকে মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে তৈরি ঔষধ সেবন করানো হবে। সেই মত ২-৩ ঘণ্টার মধ্যেই সব উপাদান জোগাড় হয়ে যায় এবং মৃত্যুঞ্জয় নিজের জীবনের হয়ত শ্রেষ্ঠ আবিস্কার টি করে ফেলেন। সম্পূর্ণ ঔষধ টি বানাতে বানাতে ভোর হয়ে যায়। অনুরাধা ও দেবেন্দ্র সারারাত ওনার সাথে জেগে থাকেন। এরপর শুরু হয় ঔষধ সেবন। ভোর রাত থেকেই জমিদার বাড়ীর সামনে ভিড় হয়ে যায় শুরু হয় ১ সপ্তাহ ধরে লাগাতার চিকিৎসা।