Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব-২৭
সকাল বেলা। সবাই বসে আছে নাস্তার টেবিলে। ডিম ভাজি, ডাল ভুনা, আর গরম গরম রুটি তে মজে আছে তারা। শাহেদ আর আজিজ সাহেবের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। ঠিক সেই সময় ধারা হঠাৎ খাবার ফেলে দৌঁড়ে বেসিনের দিকে ছুটে গেলো। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। ধারা বমি করছে। হঠাৎ করে কি হলো তার? আসমা বেগম মেয়ের পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন। ধারা একটু নিজেকে সামলিয়ে পর্যুদস্ত চেহারায় চেয়ারে বসলো। আসমা ধারার কপালে গলায় হাত লাগিয়ে দেখলেন। জ্বর নেই। অন্য কোন অসুস্থতার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তবুও এমন হলো কেন বুঝতে পারলেন না। আসমা বলল, 'কিছুই তো ঠিকমতো খাইতে পারলি না। আবার একটু পরে খাইয়া নিস।'
ধারা মাথা নেড়ে বলল, 'না, আমি খেতে পারবো না। খাবারে কেমন যেন গন্ধ লাগে।'
আসমা ঝট করে জমিরন বিবির দিকে তাকালেন। ধারা আস্তে আস্তে উঠে রুমের ভেতর চলে গেলো। জমিরন বিবি আসমাকে বললেন,
'বউ, তোমার মাইয়া তো মনে হয় পোয়াতি হইছে।'
কথাটা শাহেদ আর আজিজ সাহেবের মাথায় বাজ ফেললো। শাহেদ বলল,
'আম্মা, আপনি কিসব কথা বলেন?'
জমিরন বিবি খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
'ক্যা? আমি কি কিছু বুঝি না। সব কি খালি তোরাই বুঝোস? আমার চোখ কখনো ভুল দেহে না। ও'র লক্ষণ সব আগের তনেই আমার ঠিক লাগতাছিলো না। এহন যা বোঝা গেলো ও'র পেটে বাচ্চাই আইছে।'
শাহেদ আর আজিজ সাহেবের কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠলো। তারা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। সেদিন সারাটা দিন তাদের অস্থিরতায় কাটতে লাগলো। আসমা মেয়ের কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে যেই উত্তর পেলো তাতে সেই সন্দেহ আরো পাকাপোক্ত হয়ে গেলো৷ তারা মেনেই নিলো ধারা প্রেগন্যান্ট। আজিজ সাহেব এবং শাহেদের মুখ একদম ভোঁতা হয়ে রইলো। ধারার ভীষণ হাসি পেলো। রুম থেকে উঁকিঝুকি দিয়ে সে তাই দেখতে লাগলো। শাহেদ ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা অস্থির হয়ে পায়চারী করতে করতে বলল,
'এটা কি হলো? আমি মানতেই পারছি না।'
আজিজ সাহেব চেয়ারে থম মেরে বসে আছেন। জমিরন বিবি পাশ থেকে বলে উঠলেন,
'মাইয়া বিয়ার পর সাড়ে তিন মাসের মতোন জামাইয়ের ধারে ছিল৷ অস্বাভাবিক কিছু তো না। না মানতে পারার কি আছে?'
শাহেদ আজিজ সাহেবের কাছে গিয়ে বলল,
'ভাইজান, এখন কি হবে?'
তারপর আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলে তার কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে আজিজ সাহেব দ্রুত বলে উঠলেন,
'চুপ! তোমার মাথা ঠিক আছে? এখন কি এর জন্য পাপ মাথায় নিবো আমরা! আল্লাহ যখন দিছে এই বাচ্চা আমরা ফেলতে পারি না। যার জন্ম হওয়ার তার তো হতেই হবে।'
'তাহলে এখন কি করবেন? ধারাকে আবার ঐ ছেলের কাছে পাঠাবেন?'
এই প্রশ্নের উত্তরে আজিজ সাহেব চুপ করে রইলেন। তার হঠাৎ নিরবতা শাহেদের পছন্দ হলো না।
বাড়ির পরিবেশ অস্বাভাবিক থাকলেও ধারার অনুকূলেই রইলো। সবাই নিরব থাকলেও মনে মনে কি সিদ্ধান্ত তৈরি হচ্ছে তা যেন স্পষ্টই পরিস্ফুট হতে লাগলো। ধারা সারাদিন কিছু না খেয়ে বিছানায় শুয়ে রইলো। আর আজিজ সাহেব আর শাহেদের কপাল থেকে চিন্তার ভাঁজ সরলো না।
পরদিন সকাল বেলা হুট করেই জমিরন বিবির শরীর ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। এদিকে বাড়িতে কোন পুরুষ নেই। সবাই সকাল সকাল বেড়িয়ে গেছে। ধারা আর আসমা কি করবে কিছু বুঝতে পারলো না। এদিকে জমিরন বিবির হাত পা ও ভীষণ ঠান্ডা হয়ে আসছে। ধারা বারবার মালিশ করে দিতে লাগলো। হাসপাতালে নেওয়া দরকার। আজিজ সাহেব আর শাহেদ কারো নাম্বারেই ফোন ঢুকছে না। ধারা দৌঁড়ে রাস্তার মাথায় গেলো। গাড়ির কোন দেখা নেই। সময়ও কেটে যাচ্ছে। কোন উপায়ান্তর না পেয়ে ধারা শুদ্ধকে ফোন দিলো। কিছুক্ষণ পর শুদ্ধ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সেখানে উপস্থিত হলো। এসে জানালো গতকাল বিকেল থেকে ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় সারারাত কারেন্ট না থাকায় একটা অটোতেও চার্জ নেই। কারেন্ট না আসার আগ পর্যন্ত কোন অটো পাওয়া যাবে না। সে নিজেও খুব কষ্ট করে একজনের কাছ থেকে বাইকে লিফট নিয়ে অর্ধেক পথ এসেছে। আর বাকি পথ দৌঁড়িয়ে। হাসপাতাল এখান থেকে ভালোই দূরে। কি করে জমিরন বিবিকে এখন হাসপাতালে নেওয়া যায় এটাই সবথেকে বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। ধারা বারবার আতঙ্কিত হয়ে জমিরন বিবির মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। জ্ঞানহীন জমিরন বিবি নিথর হয়ে পড়ে আছেন। শুদ্ধ ধারার কাঁধে হাত রেখে বলল, 'তুমি চিন্তা করো না ধারা। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।'
শুদ্ধ আবারো কোন গাড়ির খোঁজে বেড়িয়ে পড়লো। খানিক বাদে ফিরে এলো একটা ভ্যান নিয়ে। ধারা যখন দেখলো সাথে কোন চালক নেই তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কার ভ্যান এটা?'
শুদ্ধ বলল, 'আমি জানি না। রাস্তার পাশে সেই সকাল থেকে দাঁড়া করা ছিল। কোন মানুষ দেখতে পাইনি। আমি পাশের একটা দোকানদারকে বলে রেখে নিয়ে এসেছি। আসল মালিক আসলে সে জানাবে ইমারজেন্সির জন্য নেওয়া হয়েছে।'
'ভ্যানচালক না থাকলে এটা চালাবে কে?'
'আমি চালাবো। ধারা এতো কথা বলার এখন সময় নেই। দাদীকে এখন আগে হাসপাতালে নিতে হবে।'
এরপর শুদ্ধ নিজে ভ্যান চালিয়ে জমিরন বিবিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সাথে গেলো আসমা আর ধারাও। হাসপাতালে গিয়ে বাঁধলো আরেকটা বিপত্তি। ডাক্তার জানালো জমিরন বিবির প্রেশার অত্যন্ত লো হয়ে গেছে। পাশাপাশি তার শরীরে রক্ত অনেক কম। রক্ত দিতে হবে। এদিকে তার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। পাওয়া খুবই দুস্কর। ধারা আর আসমা চিন্তিত বোধ করলো। শুদ্ধ ওষুধ কিনতে গিয়েছিল। এসে যখন শুনলো রক্তের কথা তখন সবাইকে আশ্বাস দিয়ে জানালো তারও রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। চিন্তার কোন কারণ নেই। এরপর ডাক্তার রক্ত নেওয়ার ব্যবস্থা করলো। শুদ্ধ জমিরন বিবিকে রক্ত দিল। একটু আশ্বস্ত বোধ করলো সবাই। ডাক্তার জানালো চিন্তার আর কোন কারণ নেই। বিকেল নাগাদই জমিরন বিবিকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে তারা। দুপুর হয়ে এলে শুদ্ধ গিয়ে বাইরে থেকে কিছু খাবার কিনে এনে আসমা আর ধারাকে দিলো। আসমা শুধু একটু পর পর শুদ্ধকেই দেখতে লাগলো। ধারা এক বিন্দুও মিথ্যা বলেনি ছেলেটাকে নিয়ে। এই ছেলেটার সবকিছুই মুগ্ধ করার মতো। আসমা ভীষণ স্বস্তি বোধ করলো। তার মেয়ে আসলেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে একটু একলা সময় দেওয়ার জন্য আসমা উঠে কেবিনের ভেতর চলে গেলো। ধারা আর শুদ্ধ রয়ে গেলো বাইরে। পাশাপাশি বসা। ধারা ছলছল চোখে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে বলল,
'থ্যাংক্স!'
শুদ্ধ ধারার দিকে কিছুক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে বলল, 'কিসের থ্যাংক্স? আমার আর তোমার মধ্যে কোন থ্যাংক্সের জায়গা নেই। আমি তোমার জন্য কিছু করবো না তো কে করবে? হুম? তোমার উপর আমি কখনোই কোন সমস্যা আসতে দিবো না। একবার বলেছি না! আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। সবসময়! কখনো নিজেকে একা ভাববে না। আমরা দুজন মিলেই তো এক।'
ধারা আর কিছু বলতে পারলো না। একটা প্রশান্তির ছাপ নিয়ে শুদ্ধ'র কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো। এই দৃশ্য কেবিনের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো আসমা। তার মনে এতোদিন যতটুকুও বা খুঁত খুঁত ভাব ছিল সব একদম দূর হয়ে গেলো। তার চোখেও হঠাৎ কেন যেন পানি চলে এলো। খুশির জল।
বিকেল বেলা জমিরন বিবিকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। তার শরীর এখন খানিকটা ভালো। শহরে গাড়ির কোন অভাব নেই। শুদ্ধ একটা অটো ঠিক করে আসমা আর জমিরন বিবিকে পাঠিয়ে দিলো। আর বলে দিল এর পরের অটোতেই ধারা শুদ্ধ আসছে। ভ্যানের আসল মালিক দুপুরে এসে তার ভ্যান নিয়ে গেছে। শুদ্ধও সাথে অনেকটা বকশিশ দিয়ে দিয়েছে তাকে। অটোর অপেক্ষায় শুদ্ধ আর ধারা যখন হাসপাতালের বাইরে তখন শুদ্ধ হঠাৎ করে কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
'ও...একটা কথা। আমার কিন্তু কানে এসেছে আপনার বাড়িতে আপনি কি বলেছেন। কিভাবে সম্ভব? আমি তো নির্দোষ।'
ধারা একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে শুদ্ধ'র হাতে মৃদু বারি দিয়ে বলল, 'উফ! এটা কি সত্যি নাকি? আমি তো নাটক করেছি। আর নাটকটা কাজেও লেগেছে। সবাই সত্যি বিশ্বাস করে ফেলেছে। আর আমার মনে হয় আমাকে খুব শীঘ্রই আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবে। সব কিন্তু আমার অভিনয়ের দক্ষতার জন্যই। আমি যে কি ভালো নাটক করেছি আর সবার মুখের অবস্থা যা দেখার মতো ছিল না!'
ধারা হাসতে লাগলো। শুদ্ধ সিরিয়াস হয়েই বলল,
'ধারা, আপনি এটা ঠিক করেননি। এভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে....
শুদ্ধ আর কিছু বলতে পারলো না। তার আগেই তাদের পেছন থেকে আজিজ সাহেব হুংকার ছেড়ে ডেকে উঠলেন, 'ধারা!'
ধারা কেঁপে উঠে পেছনে তাকালো। সাথে শুদ্ধও। আজিজ সাহেব এখানে কিভাবে আসলো? শাহেদ আর আজিজ সাহেব গিয়েছিলেন আজ এক রাজনীতি সংক্রান্ত মিটিংয়ে। এর জন্যই তাদের ফোন বন্ধ ছিল। মিটিং শেষে বিকেলে বাড়ি ফিরে কাউকে না দেখে পাশের বাসা থেকে জানতে পারে তার মা অসুস্থ হওয়ায় তাকে সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেকারণেই তারা সরাসরি এখানে চলে আসে। আর এসে ধারাকে শুদ্ধ'র সাথে দেখে রাগান্বিত মুখে এগিয়ে আসতেই ধারার কথাগুলো শুনতে পান। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ধারার হাত খপ করে ধরে বলেন,
'তোমার এতো বড় সাহস নাটক করে তুমি আমাদেরকে বোকা বানাও! আবার মানা করা সত্ত্বেও তুমি এই ছেলের সাথে দেখা করো!'
আজিজ সাহেব ভীষণ ক্ষেপে আছেন। ধারা আতঙ্ক স্বরে কিছু বলতে চাইলে আজিজ সাহেব তার সুযোগ না দিয়ে ধারাকে টেনে নিয়ে একটা অটোতে বসিয়ে স্টার্ট দিতে বলেন। পরিস্থিতি খুবই বেগতিক হওয়ায় শুদ্ধও সাথে সাথে অন্য অটোতে ধারাদের বাড়িতে যায়। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আজিজ সাহেব ধারার হাত ছেড়ে দিয়ে বলেন,
'তুমি এতো বড় মিথ্যা কথা বলতে পারো আমি স্বপ্নেও ভাবেনি। তুমি এতোটা নিচে নেমে গেছো ধারা!'
ধারা অঝোরে কাঁদতে লাগলো। চেঁচামেচি শুনে আসমা দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। ততক্ষণে শুদ্ধও পৌঁছে গেছে সেখানে। শাহেদ ক্ষুব্ধ হয়ে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। আজিজ সাহেব বলতে লাগলেন, 'তুমি প্রেগন্যান্টের নাটক করে ঐ ছেলের কাছে ফিরে যেতে চেয়েছো! আমাদের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছো! যাও তাহলে চলে ও'র কাছে। আমাদের সাথে তোমার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না। আমরা ভুলে যাবো আমাদের একটা মেয়ে ছিল।'
ধারা কাঁদতেই লাগলো। শুদ্ধ'র সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু করতে হচ্ছে। আজিজ সাহেবের সাথে শাহেদও যুক্ত হলো। রুঢ় থেকে রুঢ় কথা শোনাতে লাগলো ধারাকে। আজিজ সাহেব বললেন,
'তোমার ভালোর জন্যই এসব করছিলাম। কিন্তু বুঝলে তো আর না। বুঝলে কারটা? ঐ ছেলেরটা। একটা পতিতার ছেলের জন্য তোমার এতো টান! কে শিখিয়েছে তোমায় এসব? ঐ ছেলে? অবশ্য একটা পতিতার ছেলের থেকে আর বেশি কিই বা আশা করা যায়।'
শুদ্ধ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। এতো চেঁচামেচি শুনে ধারাদের প্রতিবেশিরা বাড়ির বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো। আজিজ আরো অনেক কথা বলতে লাগলেন,
'পতিতার ছেলের স্বভাব চরিত্র আর কতই বা ভালো হবে। যতোই সেসব থেকে দূরে থাকুক না কেন শরীরে আছে তো সেই পতিতার রক্তই। নষ্ট রক্ত।'
ধারা শক্ত হয়ে বলে উঠলো, 'বাবা! আপনি আমাকে এতক্ষণ যা বলার বলেছেন। দোষ আমি করেছি, মিথ্যা আমি বলেছি৷ আপনি আমাকে বলবেন। আমার স্বামীকে আপনি এভাবে বলতে পারেন না।'
আজিজ সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। ধারা বলতে লাগলো,
'বারবার শুদ্ধকে পতিতার ছেলে পতিতার ছেলে বলে কি বোঝাতে চান বাবা? আপনি এটা কেন ভুলে যান, শুদ্ধ যদি পতিতার ছেলে হয় তাহলে আপনার মেয়েও একটা পতিতার ছেলেরই স্ত্রী। আমার স্বামীর পরিচয়ই এখন আমার পরিচয়। তার সম্মানই আমার সম্মান। তার নামের সাথে যতো বদনাম যোগ হবে সব আমার নামের সাথেও হবে। আপনি সবার সামনে এইসব কথা বলে শুধু তাকে ছোট করছেন না, আপনার মেয়েকেও করছেন। শুদ্ধ কখনো চুপচাপ নিজের অসম্মান সহ্য করার মতো ছেলে না। সে নিজেকে যেমন বিশ্বাস করতে জানে তেমন নিজেকে নিজে সম্মানও করতো জানে। সে স্পষ্ট কথার ছেলে। তবুও আজ আপনি তাকে এতো খারাপ খারাপ কথা বলার পরেও সে কেন চুপ করে আছে জানেন বাবা? কারণ সে আমাকেও সম্মান করে বলে। আমার পরিবারকে সম্মান করে বলে, আপনাকে সম্মান করে বলে।'
বলতে বলতে ধারা আবারও কেঁদে ফেললো। বলল, 'আমি বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়েছে। শুদ্ধও আমাকে সেটাই বলছিল। সে আমাকে এসব করতে শিখিয়ে দেয়নি বাবা। সে কখনো ভুল কিছু করে না। আমি বাধ্য হয়ে এই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। কারণ আমি অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছি এই দোটানার মধ্যে থাকতে থাকতে। আমি শুদ্ধকেও ছাড়তে পারবো না আর আপনাদের সাথে চিরদিনের মতো সম্পর্ক ছিন্নও করতে পারবো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি পারছি না আর আপনাদের এই বিরোধ সামলাতে। আসলে আমার না এখন মরে যাওয়া উচিত। তাহলেই আর দুজনের মধ্যে একজন বেঁছে নেওয়ার চক্করে আটকা থাকতে হবে না।'
শুদ্ধ ধারাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গম্ভীরমুখে বলল, 'এসব কি কথা আপনি বলছেন ধারা? আচ্ছা ঠিকাছে। প্রয়োজনে আমরা আলাদা হয়ে যাবো। দোটানা কেটে যাবে। একটা দিক অন্তত ঠিক হয়ে যাবে। তবুও আপনি এসব ভাববেন না।'
ধারা ও'র বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
'দেখেছেন বাবা, শুদ্ধ কখনো আমাকে ছাড়ার কথা বলেনি। আমি মারাত্মক ভুল করার সময়ও বলেনি, আপনাদের এতো এতো অপমানেও বলেনি। বলল কখন? যখন আমার কোন ক্ষতির কথা শুনলো। আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কষ্টের চাইতে আমার ক্ষতি হবার কষ্ট তার কাছে বেশি তীক্ষ্ণ।'
একটু থেমে ধারা নিচের ঠোঁট কামড়ে খুব কষ্ট করে বলল, 'সে আমাকে খুব ভালোবাসে বাবা। আমিও তাকে খুব ভালোবাসি। আমরা দুজন একসাথে খুব সুখে থাকবো। বাবা....বাবা, আমাকে তার কাছে যেতে দিন।'
ধারা আকুতির সাথে একবার বাবার হাত ধরলো আবার পরক্ষণেই বাবার পা পেঁচিয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
'আমাকে হাসিমুখে যেতে দিন বাবা। আমি আমার পরিবার আর স্বামী দুটোকেই চাই। আপনি তো আমার ভালো চান তাই না বাবা, আমি সেখানেই ভালো থাকবো। পায়ে পড়ি বাবা, যেতে দিন।'
ধারার অবস্থা দেখে শুদ্ধ'র চোখে পানি চলে এলো। জমিরন বিবি অনেকক্ষণ ধরেই রুম থেকে সবার কথাগুলো শুনছিলেন। তার গায়ে জোর নেই। বিছানা থেকে উঠতে কষ্ট হয় তাই আসতে পারছিলেন না। ধারার আকুতি শুনে আর না এসে পারলেন না। আস্তে আস্তে উঠে দেয়াল ধরে ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন,
'আজিজ!'
শাহেদ কাছে গিয়ে ধরতে যাওয়ার জন্য বলল,
'আম্মা, আপনি আবার উঠে আসতে গেলেন কেন? আপনি অসুস্থ।'
জমিরন বিবি শাহেদের হাত না ধরে বললেন,
'অসুস্থ তবুও তো বাড়ি ফিরা প্রত্তম আমারে দেখতে গেলি না। তোরা বইলি তোগো মান সম্মানের হিসাব কষতে।'
এই বলে জমিরন বিবি শুদ্ধকে ডেকে বললেন,
'নাত জামাই, আমারে নিয়া একটু ঐ চেয়ারে বসাও তো।'
শুদ্ধ হাত ধরে জমিরন বিবিকে চেয়ারে বসালো। জমিরন বিবি বসার পর বললেন,
'আজিজ, এই যে আমারে এহন ভালা দেখতাছোস এইয়া কার লেইগা জানোস? এই যে পতিতার পোলা কইয়া চিল্লাইতাছোস যারে হের লেইগাই। বউ আমারে সব কইছে। তোরা কেউ আছিলি না সেই সময়। তোরা তো ছিলি তোগো ক্ষমতার পেছনে। এই পোলাই ছুইটা আইসা আমারে হাসপাতালে নিয়া গেছে। তাও আবার কেমনে জানোস? ভ্যান চালাইয়া। নিজে চালায় নিয়া গেছে। আর তোরা হইলে কি করতি? তোগো ইজ্জত যাইতো গা ভ্যান চালাইলে। তোরা থাকতি তোগো মান সম্মানরে লইয়া। কিন্তু এই পোলা হেয়া ভাবে নাই। হের কাছে জীবন বাঁচানি আগে। আর কি জানি কইলি তহন? নষ্ট রক্ত! আমার শরীর আজকে বহুত খারাপ হইয়া পড়ছিলো। আমার নাত জামাই আমারে রক্ত দিছে। নষ্ট রক্তের লেইগা তোরা সম্পর্ক রাখবি না। তোর মায়ের গায়েও তো তাইলে এহন সেই নষ্ট রক্ত। এহন কি তোরা তোগো মায়রেও ফালায় দিবি। রক্তের আবার নষ্ট পঁচা কি রে? আল্লাহ দেয় নাই এই রক্ত? কালকে ধারার বাচ্চার কথা শুইনা কইলি আল্লাহ যহন বাচ্চা দিছে তহন আমরা ফেলতে পারবো না। এই ছেলেরেও তো আল্লাহই বানাইছে। তাইলে ওয় আলাদা হইলো কেমনে? জাত পাত দিয়া কিছু হয় না রে আজিজ। মানুষটাই আসল। এই ছেলে হীরার টুকরা। হারাইতে দিস না। আমরা তো সব আমগো মাইয়ার লেইগাই করতে চাই। মাইয়া যেনে ভালো থাকবো হেই খানেই আমগো শান্তি। চোখ থিকা ঐ পর্দা ডা খোল।'
অনেক কথা বলে ফেলায় জমিরন বিবি হাঁপিয়ে উঠলেন। মায়ের কথার প্রভাব আবার না আজিজ সাহেবের উপর পড়ে এই জন্য শাহেদ দ্রুত কিছু তাকে বলতে চায়। আজিজ সাহেব এতক্ষণ একদম চুপ করেই ছিলেন। শাহেদকে 'ভাইজান' বলে মুখ খুলতে দেখেই ধমকে উঠে বললেন,
'তুমি চুপ থাকো! তোমার কথাতেই আমার মাথা খারাপ হয়েছিল।'
এরপর তিনি ধারার দিকে তাকালেন। মেয়েটা এখনও কেমন পায়ে ধরে বসে আছে। তার হঠাৎ ভীষণ মায়া হয়। আজিজ সাহেব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কখনো আবেগী কথাবার্তা বলেননি। তাই তার বলতে খুব সমস্যা হলো। খুব সময় নিয়ে তিনি মেয়ের মাথায় হাত রেখে শুধু এতটুকুই বলতে পারলেন,
'মন দিয়ে স্বামীর সংসার করিস মা।'
ধারা তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।
চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব-২৮
শুদ্ধ সেদিন রাতটা সে বাড়িতে কাটিয়ে তার পরেরদিন সকালেই ধারাকে নিয়ে রূপনগর ফিরে এলো। আজিজ সাহেব সন্তুষ্ট মনেই মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের বিদায় দিয়েছেন। বাড়ি ফিরতেই ধারার মন জুড়িয়ে গেলো। আজ কতদিন পর সে দেখতে পেলো সেই প্রিয় বাড়ির দৃশ্য। সবকিছু এখনও সেই মায়া ময়, স্নিগ্ধ। সেই ছোট্ট দোচালার ঘর। টিনের বারান্দা। বাড়ির সামনের হাস মুরগীর খোঁয়াড়। পাশ দিয়ে সারি বেঁধে লাগানো সুপারি গাছ। পুকুরের স্বচ্ছ টলমল জলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে শুভ্র রাঁজহাসের দল। পাশের বাড়ি থেকে নাজমা ভাবির হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। ধারা চোখ বন্ধ করে প্রাণভরে সবটা শুষে নেয় যেন। খোদেজা আর চুমকি শুদ্ধ আর ধারাকে বাড়ির উঠোনে দেখেই একপ্রকার দৌঁড়ে ছুটে আসে তাদের দিকে। অনেকদিন পর মায়ের মতো শ্বাশুড়ি খোদেজার দেখা পেয়ে ধারা সর্বপ্রথম তাকে জড়িয়ে ধরে। খোদেজা ছলছল চোখে বলে,
'এসেছো বউ! আমি রোজ তোমার লেইগা রাস্তার ধারে পথ চাইয়া থাকতাম। এই বুঝি কোনদিন মাহতাব তোমারে নিয়া আসে। কাল রাতে যহন শুদ্ধ ফোন দিয়া বলল তোমারে নিয়া আসার কথা, আমি কি যে খুশি হইছিলাম। তোমারে ছাড়া এই বাড়ি যে খালি খালি লাগে মা।'
ধারা আবেগ্লাপুত গলায় বলল,
'হুম মা এসেছি। নিজের বাড়ি ছেড়ে বেশিদিন কি আর দূরে থাকা যায়!'
চুমকি ছটফট করে ধারার হাত ধরে বলল,
'নতুন ভাবী, তোমাকে যে আমার কতো মনে পড়ছে এই কয় দিন জানো! তুমি না থাকলে একদমই এখন আর ভালো লাগে না। এভাবে আর কখনো বেশিদিন থাকবা না ঠিকাছে?'
ধারা হাসিমুখে মাথা দুলায়। শুদ্ধ একটু আদুরে গলায় বলে উঠে,
'আম্মা, এখন কি তোমার বউ পাওয়ার খুশিতে এদিকেই দাঁড়ায় থাকবা? পা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে তো! তোমার ছেলের দিকেও একটু তাকাও।'
খোদেজা মজার ছলে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
'তোরে আর কি দেখমু? তোরে তো রোজই দেখি। আজকে বউ অনেকদিন পর আইছে এখন খালি বউরে দেখমু।'
শুদ্ধ মেকি অভিমানের গলায় বলল,
'বাহ! ভালো। বউ পেয়ে ছেলের প্রতি এতো অবহেলা! আচ্ছা ঠিকাছে। আমিও কয়দিনের জন্য কোথাও থেকে আসি। তারপর যদি আমার কদর সবার হয়!'
খোদেজা বলল, 'হইছে হইছে এখন আর ঢং করা লাগবো না। তোরা ভেতরে গিয়া বস। চুমকি ওগো লেইগা দুই গ্লাস শরবত বানায় দিস।'
রুমে এসেই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো শুদ্ধ। ধারা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে লাগলো। শুদ্ধ শুয়ে শুয়েই বলল,
'যাওয়ার সময় তো বাবা তোমাকে এক কাপড়েই নিয়ে গেলো। আসার সময় এতো বড় স্যুটকেস আনলে কিভাবে? টানতে টানতে দফা রফা হয়ে গেছে আমার।'
ধারা বলল, 'আরে! আমার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ছিল ওখানে। সে সব কিছুই একসাথে গুছিয়ে নিয়ে এসেছি।'
'প্রয়োজনীয় জিনিস তাহলে আগে আনো নি কেন?'
'কি জানি! হয়তো তখনও এই ঠিকানাই পারমানেন্ট সেটা খেয়ালে আসেনি।'
'এখন মনে হয়?'
এই কথার উত্তরে ধারা কিছু বলল না। শুদ্ধ'র কাছে বিছানায় বসে আস্তে ধীরে বলল,
'আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, সত্যিই সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে। আমরা আবার একসাথে হতে পেরেছি। সব কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।'
শুদ্ধ শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
'স্বপ্ন না ম্যাডাম, সত্যি। এই যে আপনার সামনে আমি বসে আছি। ভালো করে তাকিয়ে দেখুন।'
ধারা শুদ্ধ'র মজার মধ্যে না ঢুকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
'ভর্তি পরীক্ষাটা না দিয়ে তোমাকে আমি খুব আঘাত করেছি তাই না?'
শুদ্ধ সেই কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল,
'ধুর! তোমাকে আমি বলেছি না সেই কথা আমি কবেই ভুলে গেছি। তুমি এরপর অনেক কিছু করেছো। এতেই আমি অনেক সন্তুষ্ট। নিজে নিজে গিয়ে সাবজেক্ট চয়েজ দিয়ে ন্যাশনালে ভর্তি হয়েছো। আমার ভীষণ ভালো লেগেছে যে তুমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছো। আর ধারা ন্যাশনাল বলে মন খারাপ করো না। শিক্ষার জন্য একটা ভালো প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ, অপরিহার্য নয়। চেষ্টা আর পরিশ্রম যদি পরিপূর্ণ থাকে তাহলে তুমি ন্যাশনালে পরেও সেসব অর্জন করতে পারবে যেটা ইউনিভার্সিটি থেকে হয়। আর আমি তো বলেছি, সবকিছুতে সবসময় আমি তোমার পাশে আছি। তোমাকে আমি কোনকিছুতেই পিছিয়ে থাকতে দিবো না।'
ধারা শুদ্ধ'র হাতের উপর হাত রেখে বলল,
'জানি। এটা আমি খুব ভালো করেই জানি। জানো, একটা সাধারণ মেয়ে সমাজের নিয়ম রীতি, মানুষের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির জন্য অনেকটা দূর্বল হয়েই থাকে। একটা মেয়েকে ছোট থেকেই তার স্বামীর উপর সব কিছু ছেড়ে দেওয়ার মতো করেই সবসময় বড় করা হয়। এমতাবস্থায় কোন মেয়ে যদি ভালো স্বামী পায় তাহলে এর থেকে সুন্দর তার জীবনে আর কিছু হয় না। একটা ভালো স্বামী একটা মেয়ের জন্য তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। যে তাকে সবসময় সাপোর্ট করবে, তার স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবে, তার ইচ্ছা অনুভুতিকে গুরুত্ব দিবে। সর্বোপরি তার নিজস্ব সত্তাটার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেবে। ভালো মানুষ হতে পারলেও সবাই ভালো স্বামী হতে পারে না। কিন্তু তুমি পেরেছো। তুমি ভালো মানুষ আর ভালো স্বামী দুটোই। আজ যদি আমার ভাগ্যে আর সাধারণ পাঁচটা মেয়ের স্বামীর মতোই স্বামী পড়তো তাহলে তো বোঝাই যাচ্ছে আমার সাথে কি হতো? কিন্তু এমনটা হয়নি। আমি তোমার মতো স্বামী পেয়েছি। তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার।'
শুদ্ধ'র চোখে মুখে একটা প্রশান্তির ছাপ ফুটে উঠলো। সে মিষ্টি হাসির সাথে বলল,
'জানো ধারা, আমার জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের মতো এটাও অনেক বড় অর্জন। দুনিয়াশুদ্ধ মানুষের কাছে ভালো হয়েও কোন লাভ নেই যদি একটা পুরুষ তার স্ত্রীর কাছেই ভালো না হতে পারলো। হাদীসেও তো আছে, সেই পুরুষই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। আজকে তুমি আমাকে আমার জীবনের সেই গুরুত্বপূর্ণ সার্টিফিকেট টা দিলে।'
শুদ্ধ ধারার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, 'স্বামী স্ত্রীকে একে অপরের পরিপূরক বলা হয় কেন? কারণ তারা দুজন মিলে আসলে এক। তাদের দুজনের অর্ধেক অর্ধেক অংশ মিলেই একটা বেটার ভার্সন হয়। একটা পরিপূর্ণ অংশ। এখন যদি আমার একটা অংশ (স্ত্রী) পিছিয়ে থাকে তাহলে আমি কিভাবে সামনে আগাবো? আমাকে তো তাকে নিয়েই এগোতে হবে তাই না! একসাথে। হাতে হাত মিলিয়ে। আমরা দুজন মিলেই তো এখন এক। যখন আপনি পিছিয়ে যাবেন তখন আমি হাত বাড়াবো। আর যখন আমি পিছিয়ে যাবো তখন আপনি হাত বাড়াবেন।
তবেই না আমরা যেতে পারবো সামনে! হতে পারবো জীবনে সফল।'
ধারা আর কি বলবে ভেবে পায় না। শুধু একদৃষ্টিতে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে থাকে। সত্যিই তার চিন্তা ভাবনার কোন তুলনা হয় না। তার সব কথাই মুক্তোর মতো সুন্দর। কিছুক্ষণ এভাবেই নিশ্চুপে কাটার পর হঠাৎ শুদ্ধ ধারার কাঁধে হাত উঠিয়ে দিয়ে বলে,
'আচ্ছা ধারা, তোমার মাথায় এই প্রেগন্যান্টের কথাটা বলার আইডিয়া কিভাবে এলো?'
ধারা উৎফুল্ল হয়ে বলতে নিলো,
'ও... সেইটা? সেটা তো আমি দাদীর.....
ধারা আর বলতে পারলো না। শুদ্ধ নিজের মতো করে বলতে লাগলো, 'এটা তো মিথ্যাই ছিল, না? আর এদিকে আমি তো ভেবেছিলাম....
ধারা সরু চোখে তাকিয়ে দ্রুত বলে উঠলো,
'কি ভেবেছিলে?'
শুদ্ধ একটা ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বলল,
'আমি ভেবেছিলাম আপনি না আবার আমার ঘুমন্ত আমিটার সুযোগ নিয়ে.....
ধারা শুদ্ধ'র হাতটা ও'র কাঁধ থেকে সরিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে আবার বিছানায় ফেলে বলল,
'তুমি ভীষণ পাজী।'
শুদ্ধ শোয়া থেকে উঠতে উঠতে বলল,
'আচ্ছা! বউয়ের মন না পাওয়া পর্যন্ত তাকে ছুঁয়েও দেখলাম না। আর আমি এখন পাজী হয়ে গেলাম? এমন কঠিন পণ নেওয়া হাজবেন্ড আর কোথাও পাবে?
ধারা কিছু না বলে চলে যেতে লাগলে শুদ্ধ পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
'তুমি তোমার পানিশমেন্ট কিন্তু এখনও পূরণ করলে না। সময় কিন্তু যাচ্ছে মানে দ্বিগুণ থেকে দ্বিগুণ হচ্ছে।'
ধারা সেদিন নিজ হাতে সব রান্না করলো। খোদেজাকে পাশেও ঘেঁষতে দিলো না। শুদ্ধ রইলো পাশে। একপ্রকার জোর করেই, সাহায্যের নাম করে। যতটুকু না সাহায্য করলো তার চাইতে বেশি জ্বালালো। একটা হাত পাখা নিয়ে জোরে জোরে বাতাস করতে লাগলো। মাটির চুলার রান্না। আগুনের তাপে ধারার মুখ এমনিতেই হয়েছিল রক্তিম। তার উপরে শুদ্ধ'র হাত পাখার বাতাসে তার বেঁধে রাখা চুলগুলো সামনে দিয়ে বারবার চোখের উপর এসে পড়ছিল। ধারা একবার গরম চোখে তাকায়। শুদ্ধ চুপ করে গিয়ে আবার পরক্ষণেই সেই একই কান্ড শুরু করে দেয়। কখনো আবার ধারার কেটে রাখা তরকারী লুকিয়ে রাখে। ধারা রাগ হয়, শুদ্ধ মজা পায়। ধারার রাগে টুমটুমে মুখটা দেখতে তার বেশ লাগে।
একসময় এভাবেই তাদের মিষ্টি খুনসুটি চলতে চলতে রান্না শেষ হয়। তারপর দুপুরে খাওয়াও। অনেকদিন পর সবাই একসাথে মাদুর বিছিয়ে খেতে বসে। অনেকদিন পর সেই পুরনো সুন্দর মুহুর্তগুলো কাটিয়ে ধারার চোখ আবারও অশ্রুসিক্ত হয়। জীবন সুন্দর। খুব সুন্দর।
__________________________________________
রাতের বেলা। শুদ্ধ রুমে এসে দেখে কেউ নেই। ধারাকে ফোন লাগায়। একটুপর ফোন রিসিভ করে ধারা ঘুমু ঘুমু গলায় বলে,
'হ্যালো, আমি নিচে মা আর চুমকির সাথেই ঘুমিয়ে পড়েছি।'
শুদ্ধ দ্রুত বলে উঠে, 'মানে কি?'
'মানে কিছুই না। তুমি এতো রাত করে বাইরে ছিলে কেন? আমার একা একা ভয় লাগছিল তাই মার সাথে ঘুমিয়ে পড়েছি। আর এখনো মানে বুঝতে না পারলে পুকুর পাড়ে আসো।'
শুদ্ধ আর কিছু বলবে তার আগেই ধারা ফোন কেটে দিল। অগত্যা বিভ্রান্ত মুখেই শুদ্ধকে পুকুর পাড়ে যেতে হলো। গিয়ে দেখলো ধারা সেই বাঁশের মাচার উপর একটা আকাশী রঙের শাড়ি পড়ে পা উঠিয়ে বসে আছে। শুদ্ধ অবাক হয়ে কাছে গিয়ে বলল, 'তুমি না বললে তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো? এতো রাতের বেলা একা একা এখানে কি করছো? আমি তো প্রথমে দেখে কোন পেত্নী ভেবে বসেছিলাম।'
ধারা খুব ভালোভাবেই বুঝলো শুদ্ধ তাকে ক্ষেপাচ্ছে। তাই সেই ফাঁদে না পড়ে বলল,
'পেত্নীই যখন ভেবেছিলে তাহলে আসলে কেন? পেত্নী যদি ঘাড় মটকে দিতো?'
শুদ্ধ ধারার পাশে বসতে বসতে বলল,
'এতো সুন্দরী পেত্নী কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারিনি। আজ হঠাৎ শাড়ি পড়লে যে!'
ধারা স্মিত হেসে বলল,
'আলমারি গোছানোর সময় হঠাৎ সামনে এলো তাই আর লোভ সামলাতে পারিনি। পড়ে নিয়েছি। জানো, এই বাড়ির মধ্যে আমার সবচাইতে প্রিয় জায়গা কোনটা? এই পুকুর পাড়টা। রাতের বেলা এখানে বসতে যে আমার কি ভালো লাগে! আজকেও দেখো একদম গোল একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। কত সুন্দর!'
শুদ্ধ তাকিয়ে দেখলো, আসলেই সুন্দর। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে চারদিকে। পুকুরের পানি চিকচিক করছে সেই শুভ্রতার ছোঁয়ায়।
শুদ্ধ বলে উঠলো, 'আজকে তোমার ঘুম পাচ্ছে না? এমনিতে তো সন্ধ্যা হতে না হতেই ঘুমের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকো।'
'না পাচ্ছে না।'
'পড়তে বসালেই পেতো।'
ধারা বিরক্তির সাথে শুদ্ধ'র দিকে তাকায়। সে কতো সুন্দর করে আজ সেজেছে। কিন্তু শুদ্ধ তাকে কেমন লাগছে সেটা তো একবারও বলছেই না। আরও উল্টো কথা বলছে। যখন দেখলো শুদ্ধ'র সেদিকে কোন হুঁশ ই নেই তখন নিজ থেকেই বলল, 'আমি আজকে সম্পূর্ণ একা একা শাড়ি পড়েছি।'
শুদ্ধ আড়চোখে ধারার দিকে তাকালো। মেয়েটা আজকে খুব করে সেজেছে যেন। এবং এই মুহুর্তে শুদ্ধ'র মুখ থেকে কি শুনতে চাইছে সেটাও খুব করে বুঝলো সে। তবুও বলল না। প্রিয়সীকে আরেকটু ক্ষেপিয়ে দেওয়ার জন্যই বলল,
'হুম বুঝতে পারছি। এজন্যই তো পেত্নী বলেছি।'
ধারা মুখ ভার করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। ধারা সত্যি সত্যি রাগ করেছে ভেবে শুদ্ধ তৎক্ষনাৎ কানে হাত দিয়ে আস্তে করে বলল,
'সরি! তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।'
ধারা নিজের হাসি সংযত করে গম্ভীর হয়ে বলল, 'শুধু সরি বললেই সব মাফ হয়ে যায় নাকি?'
শুদ্ধ মুখ ঝুলিয়ে বলল, 'তাহলে আর কি করতে হবে?'
ধারা বলল, 'উঠে দাঁড়াও। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই জায়গাটুকুর মধ্যে আকাশের তারা গুনে আমাকে বলো। এটাই তোমার পানিশমেন্ট।'
শুদ্ধ করুন মুখে বলল, 'সত্যি করতে হবে?'
'হুম।'
কি আর করার শুদ্ধ বউয়ের রাগ ভাঙাতে পুকুরের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তারা গুনতে থাকে। ধারা ঠোঁট চেপে হেসে আস্তে আস্তে শুদ্ধ'র পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ হাত উঁচু করে তারা গোনার পর শুদ্ধ মাথা চুলকে ঈষৎ হেসে বলে, 'এভাবে তারা গুনতে থাকলে তো আমার সারাজীবন এখানেই কেটে যাবে ধারা।'
শুদ্ধ হাসতেই তার গালে টোল পড়ে। ধারা দু পা উঁচু করে এক প্রকার লাফিয়েই শুদ্ধ'র গালে একটা চুমু দিয়ে উঠে। শুদ্ধ অবাক হয়ে তাকায়। ধারা বলে, 'আমি আমার পানিশমেন্ট উহ্য রাখি না।'
কথাটা বলেই একটা রহস্যময়ী হাসি দিয়ে শুদ্ধ'র অবাকের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়ে ধারা এক ধাক্কায় শুদ্ধকে পুকুরে ফেলে দিলো। তারপর নিজেও আস্তে আস্তে নেমে গেলো পুকুরে। শুদ্ধ'র হতভম্ব দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে, বুকে প্রেমের জোয়ার ভাসিয়ে দিয়ে একদম তার কাছাকাছি চলে গিয়ে অধরে অধর ছোঁয়ালো। জোনাকিরা ঘুরে ঘুরে আলো ছড়ালো। ফুলেরা বাতাসে সুগন্ধী মিশিয়ে দিলো
আর নির্লজ্জ চাঁদও বেহায়া দৃষ্টিতে পড়তে লাগলো এক যুগলের ভালোবাসার গল্প।
চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব-২৯
ভোরের সূর্যটা আকাশের বুকে নিজেকে স্পষ্ট রূপে প্রকাশ করতেই তার এক ছটাক আলো জানালা গলিয়ে ধারার মুখ বরাবর পড়লো। আলোর আবির্ভাবে সদ্য ভেঙে যাওয়া ঘুম থেকে চোখ পিটপিট করে তাকালো ধারা। কারো লোমশ বুকে নিজের মাথাটা আবিষ্কার হতেই ধারা মাথা উঁচু করে দেখে নিলো তাকে। শুদ্ধ চোখ বন্ধ করে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সকালের নরম রোদে পরিস্ফুট হওয়া তার ঘুমন্ত মুখটি দেখতেই গতকাল রাতের কথা স্মরণে এনে লজ্জাবতী গাছটির মতো গুটিয়ে গেলো ধারা। ঠোঁটে লজ্জার হাসি ফুটে উঠতেই চোখ তুলে তাকাতেই পারলো না আর তার দিকে। শুদ্ধ'র ঘুম ভাঙার আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো সে। দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করে সেই সকাল আর শুদ্ধ'র সামনাসামনি হলো না। খোদেজা রান্নাঘরে বসে রুটির জন্য আটা মাখছিলো। ধারা গিয়ে সেই কাজে হাত লাগালো। বসে বসে গোল গোল রুটি বানাতে লাগলো সে। ঘুম ভাঙার পর থেকেই শুদ্ধ লক্ষ করলো ধারা তার সামনে আসছে না। আর এলেও কিছুক্ষণ পর পর হুটহাট চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। তাকে খুঁজতে খুজতে শেষমেশ যখন রান্নাঘরে এসে দেখা মিললো তার, তখন শুদ্ধও একটা ব্রাশ হাতে নিয়ে দরজার সামনে বসে বসে দাঁত মাজতে লাগলো। আর আড়চোখে দেখতে লাগলো ধারাকে। ধারার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের থ্রি পিছ। ছোট ছোট ফুল তোলা সুতি ওড়নাটা দিয়ে মাথায় ঘোমটা তুলে রুটি বানাচ্ছে সে। অর্ধ প্রকাশিত চেহারার যতটুকুই বা বের হওয়া তার সম্পুর্ণে লাজুকতার লাল আভা স্পষ্ট। খোদেজা ধারার পাশ থেকে শুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
'কিরে মাহতাব তুই দুয়ারে বইসা আছোস কি করতে? তাড়াতাড়ি কল থিকা মুখ ধুইয়া আয়।'
ধারা একবার আড়চোখে শুদ্ধ'র দিকে তাকায়। তার রুটি বানানো শেষ। তাই উঠে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতর যে যাবে তার উপায় নেই। মানুষটা দরজার সামনেই বসা। খোদেজার কথার প্রতিউত্তরে শুদ্ধ ধারার দিকে তাকিয়ে বলে,
'কলে যেতে ইচ্ছা করছে না আম্মা। আলসেমি লাগছে। কেউ যদি এক মগ পানি এনে দিতো!'
খোদেজা ধারাকে বলে, 'বউ, কলপাড়ে বালতিতে পানি চাবানোই আছে। তুমি একটু এক মগ পানি এনে মাহতাবরে দাও তো।'
ধারা খানিক কাঁচুমাচু করে পানি আনতে যায়। শুদ্ধ মনে মনে খুশি হয়। এবার ধারা কি করে তার সামনে না এসে থাকবে তাই দেখার। কলপাড়ে গিয়ে ধারা দেখে চুমকিও মুখ ধুতে এসেছে। তার ধোয়া প্রায় শেষ৷ ধারা তাই তার হাতেই এক মগ পানি শুদ্ধ'র কাছে পাঠিয়ে দিয়ে অপর পাশ দিয়ে ঘরে চলে যায়। খোদেজার বিছানায় কিছু জামাকাপড় এলোমেলো হয়ে পড়েছিল৷ তাই ভাঁজ করে ঠিকমতো আলনায় সাজিয়ে রাখতে থাকে ধারা। শুদ্ধ ততক্ষণে মুখ ধুয়ে এসে ধারার পেছন পেছন ঘুরতে থাকে। ধারা লজ্জায় জবুথবু হয়ে দেখেও না দেখার ভান করে নিজের কাজ করতে লাগলো। শুদ্ধ পেছন পেছন বলতে থাকে,
'কালকে রাতে কি সত্যিই তোমার মাথায় পেত্নী চেঁপেছিল নাকি! আজকে তো দেখি আবারো সেই আগের মতো লাজুকলতা হয়ে গেছে আমার বউটা। আমার দিকে কি আজকে একটুও তাকাবে না?'
ধারা কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে তার আরক্তিম লাজুক মুখটার দিকে তাকিয়ে শুদ্ধ মুচকি হেসে বলল,
'বুঝলাম না আমাকে দেখে এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?'
শুদ্ধ ধারার পেছন পেছন হাঁটছিল। ধারা হঠাৎ পেছনে ঘুরে তাকানোয় ধাক্কা খেতে খেতেও বেঁচে গিয়ে শুদ্ধ দুই হাত উঁচু করে অদ্ভুত ভাঁবে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, 'ওপস!'
ধারা শাসনের সুরে বলল, 'তোমার আজকে কাজ নেই। যাচ্ছো না কেন?'
শুদ্ধ বিছানার উপর বসতে বসতে মেকি আফসোসের ভঙ্গিতে বলল,
'কি কপাল আমার! অন্যের বউরা মাঝেমধ্যে তার জামাইকে আরো কাজে যেতে বারণ করে। আর আমার বউ আমাকে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দেয়।'
ধারা কোমরে এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ'র অভিনয় দেখতে লাগলো। তখন চুমকি এলো গরম গরম রুটি আর আলু ভাজির বাটি নিয়ে। শুদ্ধ'র সামনে রাখার পর শুদ্ধ খেতে শুরু করে। চুমকি তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে কিছুটা বিভ্রান্তকর দেখায়। মাথা চুলকে গভীর কোন ভাবনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে সে। শুদ্ধ রুটির টুকরো মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
'কিরে তোর আবার কি হলো?'
ধারাও একই প্রশ্ন করলো। বলল, 'কি ভাবছো চুমকি?'
চুমকি ধারার দিকে তাকিয়ে উদ্গ্রীব স্বরে বলল,
'আচ্ছা নতুন ভাবী, তোমার কখনও এমন হইছে যে তোমার মনে হচ্ছে তুমি স্বপ্ন দেখতাছো কিন্তু আসলে এতোটাই বাস্তব বলে মনে হয় যে ঐটারে স্বপ্ন বলে মনে হয় না। কিন্তু আসলে স্বপ্নই।'
শুদ্ধ খেতে খেতে বলে, 'পাগলের মতো কি বলতাছোস এগুলা?'
চুমকি জোর গলায় বলে, 'না ভাই সত্যি। এমনটাই লাগতাছে আমার। দেখো, কালকে রাতে আমার এমন লাগলো মনে হইলো যে রাতের বেলা ঘুম ভাইঙ্গা দেখলাম তুমি নতুন ভাবিরে কোলে কইরা বাইরে থেকে নিয়া আসতাছো। এখন বলো এটা কি সম্ভব? এতো রাতে তোমরা এমন করবা কেন?
মনে তো হয় স্বপ্নই দেখছি। কিন্তু এতো আবার স্পষ্ট লাগতাছে....
চুমকির কথা শুনে শুদ্ধ'র বিষম উঠে যায়। ধারা বিছানার খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সেও পুরো সোজা হয়ে যায়। চুমকি হন্তদন্ত হয়ে বলে, 'আরে আরে মাহতাব ভাই পানি খাও, পানি খাও!'
শুদ্ধ নিজেকে ধাতস্থ করে বলে, 'তুই আসলেই একটা বেকুব চুমকি। কোথায় কি বলতে হয় না কিচ্ছু বুঝিস না। ঐটা স্বপ্নই ছিল। এখন যা!'
চুমকিকে আবার বিভ্রান্ত দেখায়। বিভ্রান্ত মনেই সে চলে যায়। চুমকি যেতেই শব্দ করে হেসে উঠে শুদ্ধ। ধারা শাসনের চোখে শুদ্ধ'র দিকে তাকালে শুদ্ধ হাসি থামিয়ে ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বলে,
'আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমার কি দোষ? আমি কি এবার তোমাকে পানিতে ফেলেছিলাম? তুমি ফেলছো। তুমিই তো আমাকে পুকুরে ধাক্কা দিয়ে কিস.....
শুদ্ধকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে তার সামনের অর্ধেক রুটিটা দ্রুত তুলে ধারা সম্পূর্ণ শুদ্ধ'র মুখে পুরে দেয় বেলাজ ছেলেটার কথা বলার রাস্তা আটকায়। আর নিজেকে লাজুকতার অথৈ অম্বরে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে চলে যায়।
__________________________________________
দুদিন বাদেই আসবে হেমন্ত। কার্তিকের অবস্থা এখন যাই যাই। মাঠ জুড়ে শুধু সোনালী ধানের ঝিলিক। পাকা ধানের সৌন্দর্যে ভরে আছে বাংলার প্রকৃতি। শালিকের উড়ন্ত পাখার সাথে ভেসে আসা খোলা হাওয়ায় দুরন্ত ধানের শিখা নজর কাড়ে। আশেপাশের কিছু ক্ষেতে ধান কাটা শুরুও হয়ে গেছে। কাটা ধান সারি সারি ভাবে বিছিয়ে রাখা। ক্ষেতে আসার পর ধারা কিছুক্ষণ ধানক্ষেতের আলের উপর দাঁড়িয়ে সেই সৌন্দর্যে চোখ মেলে তাকায়। তার পরনে একটা সাধারণ সুতি থ্রি পিছ। হাতে খাবারের স্টিলের টিফিন বাক্স। সে যাচ্ছে শুদ্ধ'র কাছে। শুদ্ধ আজকাল বড্ড বেশি ব্যস্ত থাকে। সারাদিনটা এই ক্ষেতে খামারেই কেটে যায় তার। কখনো কখনো দুপুরে বাড়িতে গিয়ে খাবারের অবকাশও হয় না। মাঝে মাঝে খোদেজা খাবার নিয়ে আসে। আজ ধারা এসেছে। শুদ্ধ'র জন্য নিজ হাতে খাবার নিয়ে আসার তার বহুদিনের শখ। ক্ষেত পেরিয়ে শুদ্ধ'র কাছে পৌঁছে ধারা দেখে শুদ্ধ কিছু লোককে সার হাতে নিয়ে কি যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে। লোকগুলো চলে গেলে ধারা পেছন থেকে গিয়ে শুদ্ধ'র কানের কাছো 'ভো' করে উচ্চ শব্দ করলো। শুদ্ধ চমকালো না। পেছনে ফিরে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করলো। ধারা হতাশ গলায় বলল,
'ভয় পেলে না কেন?'
শুদ্ধ মৃদু হেসে বলল, 'ভয় পাবো কেন? তোমার কণ্ঠ কি আমি চিনি না!'
ধারা মুখ ভার করে ঘুরিয়ে বলল, 'একটু অবাকও তো হলে না! এই যে আমি আসলাম তোমার জন্য খাবার নিয়ে।'
শুদ্ধ ধারার হাত ধরে কাছে টেনে বলল, 'আমার বউ আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে তাতে অবাক হবো কেন? অন্য কারো বউ যদি নিয়ে আসতো তাহলে অবাক হতাম।'
ধারা শুদ্ধ'র হাতে হালকা বারি দিতেই শুদ্ধ হেসে ফেললো। ধারা শুদ্ধ'র হাত টেনে ছায়া দেখে একটা গাছের নিচে বসলো। টিফিন বক্স খুলতে খুলতে ধারা বলল, 'অনেকগুলো পদ নিয়ে এসেছি। কোনটা দিয়ে আগে খাবে?'
'তুমি খাইয়ে দাও। যা দিবে তাই খাবো।'
কথাটা বলেই শুদ্ধ চোখ বন্ধ করে হা করলো। ধারা ঠোঁট চেঁপে একটু হেসে টিফিন বক্স থেকে একটা কাঁচা মরিচ বের করলো। শুদ্ধ'র মুখে দিতেই কামড় দেওয়ার পর শুদ্ধ হকচকিয়ে চোখ মেলে তাকালো। ধারা মুখে হাত দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। শুদ্ধ সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
'আচ্ছা! আমিও দেখাচ্ছি মজা।'
ধারা হুটোপুটি করে উঠে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ'র হাত থেকে বাঁচতে সামনে দৌঁড় লাগালো। পেছনে ছুটলো শুদ্ধও। ধানের আল ধরে হাসতে হাসতে এলোপাথাড়ি দৌঁড়াতে লাগলো তারা। একসময় ধারার নাগাল পেয়ে যায় শুদ্ধ। খপ করে ধারার হাত ধরে ফেলে তাকে কোলে তুলে নেয়। ধারা ছোটার জন্য খানিক ছটফট করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে এই মুহুর্তে মাঠে কেউ না থাকলেও দূরে একটা বুড়ো দাদুকে চোখে পড়ছে। বুড়ো দাদুটি ওদের দিকে তাকিয়ে আবার মিটিমিটি হাসছেও। ধারা লজ্জা পেয়ে বলল, 'প্লিজ আমাকে নামাও। ঐ বুড়ো দাদুটা দেখছে।
শুদ্ধ বলল, 'দেখলে দেখুক। তখন এমন করলে কেন? এখন কেমন লাগে?
শুদ্ধ সহজে নামাবে না বুঝে ধারা লজ্জায় দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো। শুদ্ধ মুচকি হেসে ধারাকে কোলে নিয়েই একটা ঘূর্ণন দিলো।
খাওয়া শেষে শুদ্ধ বোতলের পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। বাতাসের আবির্ভাব থাকলেও রোদের তাপ ভালোই। সামনে ধূ ধূ করা খোলা প্রান্তর। তাতে ফলানো সোনা রঙা পাকা ধান। ওরা দুজন গাছের ছায়ার নিচে সবুজ ঘাসের উপর বসা থাকলেও সূর্যের বিকিরিত রশ্মির উত্তাপ থেকে মুক্তি নেই। শুদ্ধ'র কপাল থেকে দর দর করে ঘাম ঝরতে থাকে। সকাল থেকে অনেকটা খাটনি গেছে তার। ধারা তার ওড়না দিয়ে শুদ্ধ'র মুখের ঘাম মুছে দেয়। মিষ্টি করে হাসে শুদ্ধ। ধারা জিজ্ঞেস করে,
'আচ্ছা, তুমি যা চাইছিলে তেমনটা কি এখন হয়েছে?'
শুদ্ধ সামনের ধানের ক্ষেতে দৃষ্টি মেলে ধরে বলে,
'উহুম! এখনও হয়নি। তবে হবে। সামনের বছর এই ক্ষেতে সোনা ফলবে ধারা।'
শুদ্ধ'র চোখে স্বপ্ন চিকচিক করে উঠে। তার প্রতিফলন ফুটে ধারার মধ্যেও।
চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব-৩০
মৌসুম পাল্টাতে দেরি লাগে না। সময়ের স্রোতে এক ঋতুর বিদায় হতে না হতেই আরেক ঋতুর আগমন হয়। হেমন্তের পরে শীত চলে এলো। বাংলা ক্যালেন্ডারের পৌষ মাস। গাছের আদ্র পাতা থেকে গড়িয়ে পড়া টুপটাপ শিশিরের শব্দ অবচেতনে মন জুড়ায়। চারপাশটা ধোঁয়ার মতো কুয়াশায় জড়ানো। তার সাথে হিম লাগানো অনুভূতি তো আছেই। সকালের নরম রোদ গায়ে লাগিয়ে চুমকি, ধারা, শুদ্ধ বসে আছে উঠোনের রান্নাঘরের সামনে। মাটির তপ্ত আগুনের চুলোয় চালের গুঁড়ো, নারকেল আর খেজুর গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা বানাচ্ছে খোদেজা। একটার পর একটা ধোঁয়া ওঠা গরম গরম পিঠা তুলে দিচ্ছে একেকজনের পাতে। ধারা এতক্ষণ খোদেজাকে সব সামগ্রী এগিয়ে দিচ্ছিল। খোদেজার কথায় এখন সবার সাথে সেও খেতে বসেছে। শীতের সকালে চুলোর পাশে সদ্য জেগে উঠা রোদের মধ্যে বসে বসে গরম গরম পিঠা খেতে ভালোই লাগছে। চুমকি সাধারণত এতো সকালে উঠে না। আর যদি তা হয় শীতের সকাল তাহলে তো প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু আজ পিঠার নাম শুনতে ঠিকই ঘুম থেকে উঠে খেতে বসেছে। একটার পর একটা পিঠা গোগ্রাসে গিলে চলেছে সে। শুদ্ধ চুমকির দিকে তাকিয়ে বলল,
'আস্তে আস্তে খা চুমকি। তোর পিঠা পালিয়ে যাচ্ছে না। একবার গলায় আটকালে তখন বুঝবি!'
শুদ্ধ'র কথায় চুমকি ফিচেল করে হাসে। শুদ্ধ পিঠা খেতে খেতে হঠাৎ ঘরের দিকে তাকিয়ে খোদেজাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
'আম্মা, ঘরের তো দেখি বেহাল অবস্থা! এদিক ওদিকে খুলে পড়ছে।'
খোদেজা বলল, 'তাইলে আমি তোরে কি কই! ঘরের অবস্থা পুরাই খারাপ হইয়া যাইতাছে। আর কতদিনই বা ভালো থাকবো! সেই আমার শ্বশুর আমলের বাড়ি। এতদিন যে টিকছে তাই বেশি। ঘরের এখনই কিছু একটা করা দরকার। নইলে কবে জানি ঘর মাথার উপর ভাইঙ্গা পড়বো।'
'ঘর ঠিক করতে হলে তো একেবারে পুরো ভেঙে নতুন করে গাঁথুনি দিয়েই বানাতে হবে। যেই পুরনো ঘর! এর উপর দিয়ে নতুন কোন কাজ করলেও টিকবে না। এখন এই সময় নতুন করে ঘর উঠাতে হলেও তো একটা বড় বাজেট থাকতে হবে। কিভাবে কি করি! আচ্ছা ঠিকাছে, আমি দেখবো নে কি করা যায়।'
শুদ্ধ সবে একটা পিঠা খেয়েছে। চুলো থেকে সদ্য নামানো আরেকটা ভাপা পিঠা খোদেজা শুদ্ধ'র বাটিতে দিতে চাইলেই শুদ্ধ মানা করে উঠে। বলে,
'আম্মা আর দিয়ো না। আমার সময় নেই। এখন খেতে পারবো না। ক্ষেতে যেতে হবে।'
খোদেজা খানিক বিরক্ত হয়। শুদ্ধ'র বারণ না শুনে পিঠাটা তার বাটিতে রেখে বলে,
'চুপচাপ খা তো! একটা পিঠায় কি হয়? এই সাত সকালে তোর ক্ষেতে যাবার কারণডা কি শুনি!'
শুদ্ধ দ্রুত পিঠা মুখে নিতে নিতে বলে,
'কি বল আম্মা! কত কাজ এখন! নতুন বোরো ধান লাগিয়েছি। সেগুলো দেখতে হবে না!'
শুদ্ধ পিঠা অর্ধেক খেয়ে রেখে ভেতরে তৈরি হতে চলে যায়। শুদ্ধ চলে গেলে খোদেজা ধারার দিকে তাকিয়ে বলে,
'দেখছো বউ মাহতাবের কান্ড কারখানা? কি দরকার এইসব কাজ ও'র করার? খায়া না খায়া এগুলার পেছনে পইরা রইছে। এতো কষ্ট কইরা পড়ালেখা করলি কই একটা ভালো দেইখা চাকরি কর। আরামে থাক। তা না এই কাজ নিয়া লাইগা আছে। তাও নইলে বুঝলাম করছোস যখন ফলের খামারই খালি করতি, এই ধান টান লাগানির কি দরকার ছিলো? কতো পরিশ্রমের কাজ! আমরা তো চাল কিননাই খাই। তবুও এগুলা করা কি প্রয়োজন বলো তো! তুমিও তো কিছু বলতে পারো বউ।'
খোদেজা যে শুদ্ধ'র জন্য খুব বেশি চিন্তা করে তা ধারা বোঝে। কিন্তু ধারা এটাও বোঝে, শুদ্ধ'র নিজস্ব একটা ভাবনা আছে৷ বিস্তৃত একটা পরিকল্পনা আছে৷ নিগূঢ় কিছু চিন্তা আছে৷ যার অনেককিছুই হয়তো ধারা বোঝে না। কিন্তু ধারা এটা জানে, এই ধান শুদ্ধ'র জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ধান নিয়ে তার বিশেষ গুরুতর একটা পরিকল্পনা আছে। তাই খোদেজার কথায় স্মিত হেসে ধারা বলল,
'যে যেটা করে শান্তি পায় তাকে সেটা আমরা করতে দেই মা। ফলের বাগানটা তো আছেই। আপনার ছেলে সংসার তো ভালো মতোই চালাচ্ছে। যদি না পারতো তাহলে না হয় আমরা বলতে পারতাম। এখন যখন সব ঠিকঠাক মতোই চলছে তখন সে করুক যা সে করতে চায়। আপনার ছেলেকে তো আমরা চিনিই মা৷ সে ভুল কিছু কখনো করবে না। যাই করবে সফল হবেই।'
ধারার শেষের কথায় খোদেজা একটু আশস্ত হয়। ধারা পাশে তাকিয়ে দেখে ঘর থেকে বেড়িয়ে শুদ্ধ তার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ তার মুখের মিষ্টি হাসিই বলে দিচ্ছে এতক্ষণ ধারার সব কথাই শুনেছে সে। ধারাও মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে শুদ্ধকে আশস্ত করে। ভরসা পেয়ে শুদ্ধ নিজের কাজে যাবার জন্য পা বাড়ায়।
শুদ্ধ যাওয়ার একটু পরই পাশের বাড়ি থেকে আবুলের মা হন্তদন্ত হয়ে খোদেজাকে ডাকতে আসে। খোদেজার তখন পিঠা বানানো প্রায় শেষের দিকেই। আবুলের মায়ের তোতলানো কথা আর দূর থেকে গরুর গগনবিদারী চিৎকার থেকে খোদেজা বুঝতে পারে আবুলদের গাভির বাচ্চা প্রসবের সময় হয়েছে। বাড়িতে আর কেউ নেই। আবুলের মা একা একা ঘাবড়াচ্ছে বলেই দ্রুত খোদেজাকে ডাকতে এসেছে। খোদেজা তড়িঘড়ি করে আবুলের মায়ের সাথে গেলো। ধারাও পেছন পেছন অনুসরণ করলো তাদের। আবুলদের গোয়াল ঘরে গিয়ে ধারা দেখলো তাদের লাল গাভিটি মোটা পেট নিয়ে অস্থির হয়ে ছটফট করছে আর একটু পর পর গলা চরিয়ে ডেকে উঠছে। খোদেজা আর আবুলের মা কিছু ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ধারা স্তম্ভের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অপলক দৃষ্টিতে গাভিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গাভির অস্থিরতা ধারার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে এক ধরণের কম্পন সৃষ্টি করে। গাভির বাচ্চা প্রসবের সম্পূর্ণ দৃশ্যটি ধারা দেখলো।
ধারার জীবনে এই প্রথম। এর আগে সে আর কখনো দেখেনি। তাই বলেই হয়তো এতো অদ্ভুত অনুভুতি তার হচ্ছে। খোদেজা আর আবুলের মায়ের কাছে এটা তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ধারার চোখ ছলছল করে উঠলো। আবার ছোট বাছুরটির দিকে তাকিয়ে মুখে মৃদু হাসিও ফুটে উঠলো। দেখলো একটুপরই মা গাভিটি ক্লান্ত শরীর নিয়ে সদ্য জন্মানো বাচ্চাটির শরীর জিভ দিয়ে চেটে আদর করে দিচ্ছে। দৃশ্যটি ধারার মনে অদ্ভুত সুখানুভূতির সৃষ্টি করলো। সে আস্তে করে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে এলো। সোফায় বসে শুদ্ধকে ফোন লাগালো। ফোন অনেকক্ষণ বাজার পরও ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। ধারা আর ফোন দিলো না। রেখে দিলো। নিশ্চয়ই শুদ্ধ ফোন টং ঘরের মধ্যে রেখে দিয়ে বাইরে কাজ করছে। নয়তো ধারার কল দেখলে ঠিকই ধরতো। শুদ্ধ আজকাল সত্যিই বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারাদিনটায় আর দেখাই পাওয়া যায় না। ধারা ভীষণ মিস করে তাকে। ফোনে শুদ্ধ'র একটা ছবি বের করে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। এতো ব্যস্ততার পরও কি শুদ্ধ তার খেয়াল রাখছে না? রাখছে। আরও বেশি রাখছে। যেখানে নিজের জন্য একমুহুর্ত দম ফেলবারও সময় পাচ্ছে না সেখানে ধারার পড়ালেখা, প্রয়োজনীয়তা, সবকিছুর খুব বেশি করেই খেয়াল রাখে শুদ্ধ। ধারাকে নানা জিনিস শেখায়। নানা বই পড়ায়, নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করায়। জীবনে সফল হতে কি প্রয়োজন না প্রয়োজন সব খুঁটিনাটির বিষয়ে বিজ্ঞ করে তুলে ধারাকে। এই তো কয়েকমাস আগেই ধারাকে একটা ইংলিশ স্পোকেন কোর্সে ভর্তি করিয়ে ইংরেজি বলায় তুখোড় করেছে ধারাকে। ইংরেজি ভালো মতো বুঝতে না পারা ধারাই এখন কতো দ্রুত স্মুথলি ইংরেজি বলতে পারে। তার উপর ধারার চর্চায় আরো দক্ষ করতে সেসময় টায় কিভাবে শুদ্ধ তার সাথে রোজ নিয়ম করে পুরো এক ঘন্টা ইংরেজিতে কথা বলতো তা মনে করে ধারা এক দমক হাসে। শুদ্ধ'র সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্তই ধারার কাছে তার জীবনের শুদ্ধতম মুহুর্ত বলে অনুভূত হয়।
__________________________________________
সন্ধ্যের পর ধারা সোফায় বসে বসে শুদ্ধ'র ল্যাপটপে একটা রোমান্টিক মুভি দেখছিলো। সেসময় শুদ্ধ এলো রুমে। শুদ্ধকে দেখে আনন্দিত হয়ে ধারা যখনই বিগলিত হয়ে তার সাথে বসে শুদ্ধকে মুভি দেখার অফার করতে যাবে ঠিক তখনই শুদ্ধ বলে উঠলো,
'এটা কি ধারা? সন্ধ্যে হয়ে গেছে তুমি এখনও পড়তে বসোনি!'
ধারা শুদ্ধ'র কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
'একটুপরই বসবো। দাঁড়াও। খুব সুন্দর একটা মুভি দেখছি। এতো রোমান্টিক! আসো তুমিও দেখো। তোমারও ভালো লাগবে।'
ধারা উৎফুল্ল হয়ে আবারো ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি দিলো। শুদ্ধ ল্যাপটপ নামিয়ে দিয়ে বলল,
'না। এখন না। এখন পড়তে বসো ধারা।'
ধারা শুনলো না। আবারো ল্যাপটপ খুলে দেখতে লাগলো। শুদ্ধ এবার ধারার কোল থেকে ল্যাপটপ নিয়ে গিয়ে বলল,
'আমিও আজকাল ব্যস্ত থাকি। আর তোমার পড়ারও কোন খেয়াল রাখতে পারি না। আর তুমিও একদমই সিরিয়াস থাকো না ধারা। কয়দিন পর না তোমার ফার্স্ট সেমিস্টারের পরীক্ষা। কতটুকু প্রিপারেশন হয়েছে? দেখি।'
ধারা দেখাতে পারলো না। সত্যি বলতে কিছুদিন যাবৎ তার পড়া তেমন হয়নি। শুদ্ধ বুঝতে পেরে বলল,
'জানি, কিছুই হয়নি। হবেই বা কিভাবে! সারাদিন বসে বসে রোমান্টিক মুভি দেখো। আগে একটা রোমান্টিক মুভির নামও জানতে না। আর এখন রোমান্টিক মুভি ছাড়া আর কিছুই বোঝো না। পড়ালেখার আর কোন খবর নেই। বই নিয়ে আসো। তোমার প্রিপারেশন আজকে অর্ধেক করিয়ে দেবো।'
গালে হাত রেখে ধারা অলস ভঙ্গিতে বসে রইলো। এই মুহুর্তে পড়তে বসতে তার একদমই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু না বসেও উপায় নেই। শুদ্ধ যখন পড়ার নাম নিয়েছে তখন না পড়িয়ে ছাড়বে! শুদ্ধ আবারও তাগাদা দিলো ধারাকে। অনিচ্ছা নিয়েই ধারাকে উঠতে হলো। এক গাঁদা বই নিয়ে বসতে হলো শুদ্ধ'র সামনে। শুদ্ধ একটা একটা করে বই নিয়ে দেখতে লাগলো। কিছু অনুশীলন বের করে পড়তে বলল ধারাকে। তারপর আবার আরেকটা বই নিয়ে দেখতে লাগলো। এদিকে ধারার একেবারেই পড়ার মুড নেই। তার ইচ্ছে করছে শুদ্ধকে নিয়ে ঐ মুভিটা এখন সম্পূর্ণ দেখতে অথবা শুদ্ধ'র সাথে একান্তে কিছু গল্প করতে, সময় কাটাতে। আর ইচ্ছে করবেই বা না কেন! সারাদিন পর দেখা পেলো মানুষটার। কিন্তু না! মহাশয়ের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো বেশ একটা স্যার স্যার ভাব নিয়ে বসেছে ধারাকে পড়াতে। কিছুক্ষণ পড়ার পরই ধারা গড়িমসি করতে লাগলো। আর চাইলো না পড়তে। পৃথিবীর যাবতীয় ইনোসেন্ট ভাব মুখে এনে বলল,
'আজকে না হয় এতটুকুই থাক। কালকে থেকে পড়ি? কাল থেকে সত্যিই পড়বো৷ প্রমিজ!'
শুদ্ধ বলল, 'না। এখন মানে এখনই। তোমার পড়ায় এমনিতেই অনেক ঢিলামি এসে পড়েছে। আমারই দোষ। আমিই খেয়াল করিনি। আজকে অনেকক্ষণ পড়াবো।'
ধারা বিরক্তি ভাব নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। আবারো একটু বই পড়ার পরই মুখ তুলে উৎফুল্ল হয়ে বলল, 'জানো? আজকে আবুল ভাইদের গাভির একটা বাছুর হয়েছে। দেখতে কি কিউট!'
শুদ্ধ ধারার বইয়ের দিকে চোখ রেখেই আস্তে করে বলল, 'ভালো।'
'আমার না এতো ভালো লেগেছে! গাভিটাকেও খুব খুশি লাগছিল। বাছুরটা খুবই সুন্দর হয়েছে দেখতে। জানো, আমি না আজকে একটা কথা ভেবেছি।'
'কি?'
ধারা শুদ্ধ'র দিকে খানিক এগিয়ে একটু আহ্লাদি স্বরে বলল, 'আমাদেরও যদি এমন একটা ছোট্ট কিউট বাবু হয় তাহলে কতো সুন্দর হবে তাই না!'
'হুম।'
ধারা উত্তেজিত হয়ে বলল, 'তাই না! আমিও সেটাই ভাবছিলাম। আমরাও খুব শীঘ্রই একটা বাবু নেবো।'
শুদ্ধ বই থেকে মুখ তুলে বলল,
'আমি শীঘ্রইয়ের কথা কখন বললাম? আমাদেরও বাবু হবে। কিন্তু এখন না। এখন হলে তোমার পড়ালেখার অনেক ডিস্টার্ব হবে। তাই আগে তোমার পড়ালেখা সম্পূর্ণ শেষ হবে তারপর।'
ধারা পুরো ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। কি বলে কি শুদ্ধ! পড়ালেখা শেষ হবার পর মানে? ধারা আঙ্গুল দিয়ে গুনতে লাগলো অনার্সের পর মাস্টার্স আর সাথে অল্প স্বল্প সেশনজট মেলালে পড়ালেখা শেষ হতে লাগবে আরো ছয় বছর। তার মানে আরো ছয় বছর পর! ধারা উদ্গ্রীব হয়ে দ্রুত বলে উঠে, 'ছয় বছর পর কতো দেরি হয়ে যাবে জানো...
ধারাকে থামিয়ে শুদ্ধ বলল,
'ধারা, এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় না। পড়তে বসার পর পড়া নিয়েই থাকতে হবে। এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে।'
ধারা আবারো খানিক পড়ার চেষ্টা করে। আবারো প্রচুর বোরিং ফিল হয়। সে শুদ্ধ'র দিকে তাকায়। শুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে ধারার বই দাগিয়ে যাচ্ছে। কতো সুন্দর লাগছে তাকে। কাঁচা হলুদ রঙের শার্ট, খানিক এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ধারা খানিক শুদ্ধ'র কাছে ঘেঁষে বসে৷ দু হাত দিয়ে শুদ্ধ'র গলা পেঁচিয়ে ধরে। শুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ধারাকে ইশারা করে। ধারা মুচকি হেসে বলে,
'এখন আমি আর পড়বো না। এখন আমি শুধু তোমাকে দেখবো। সারাদিন ধরে দেখিনি। আমার বুঝি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয় না।'
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল, 'এতো রোমান্টিক কথাবার্তা বলে লাভ নেই। পড়ার থেকে আজকে তুমি রেহাই পাচ্ছো না ম্যাডাম। যথেষ্ঠ ফাঁকিবাজি করে ফেলেছো। যা যা দাগিয়ে দিয়েছি আজ সব পড়বে। তারপরই উঠতে পারবে।'
ধারার মুখ ফুলে গেলো। সে দ্রুত সোজা হয়ে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, 'আচ্ছা ঠিকাছে আমিও পড়বো না। আমিও দেখি তুমি জোর করে আমাকে কিভাবে পড়াও।'
'তুমি পড়বে না?'
'না, পড়বো না।'
'সত্যিই তো?'
ধারা শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে একটা তীর্যক হাসি দিয়ে বলল, 'হ্যাঁ সত্যি। আর তুমিই এখন নিজেই আমাকে বলবে যে, ধারা থাক! আর পড়া লাগবে না। দেখতে চাও?'
এই বলে ধারা ও'র মাথার চুলগুলো খুলে দিয়ে শুদ্ধ'র কাঁধে দু হাত রেখে ও'র কাছে যেতে লাগলো। শুদ্ধ খানিক ঢোক গিলে ইতস্তত করে বলল,
'ধারা, ভালো হবে না কিন্তু! পড়তে বসো।'
ধারা শুনলো না। মুখ টিপে হাসতে লাগলো। হঠাৎ শুদ্ধ ধারার পায়ে স্কেল দিয়ে আস্তে করে একটা বারি দিলো। ধারা বিস্ফোরিত গলায় বলল,
'তুমি আমাকে মারলে?'
শুদ্ধ ও'র শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল,
'পড়তে বসে বাঁদরামি করলে তো মারবোই। পড়ো! রাত এগারোটার আগে তুমি উঠতে পারবে না।'
ধারা মুখ ফুলিয়ে বসে বলল,
'পড়বো না। পড়বো না। পড়বো না।'
শুদ্ধ স্কেল দিয়ে পুনরায় আরেকটা বারি দিলো। ধারা আবারো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে শেষমেশ রাগে জেদে একদম রাত এগারোটা পর্যন্ত একনাগাড়ে পড়েই ঘুমানোর জন্য ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। শুদ্ধ মিটিমিটি হেসে ধারার বইগুলো গুছিয়ে রেখে ঝটপট বিছানায় শুয়ে ধারাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ধারা যে আজ ভীষণ ক্ষ্যাপা ক্ষেপেছে! এই রাগ ভাঙানো সহজ নয়। শুদ্ধ ধরতেই ধারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলো। শুদ্ধ ছাড়লো না। ধারা চেষ্টা সচল রেখে বলল, 'এখন আমাকে ধরেছো কেন? ছাড়ো! পড়ানো তো শেষ। এখন কি? আর আসবা না আমার কাছে।'
শুদ্ধ মুচকি হেসে বলল, 'ইশ! বললেই হলো! এতক্ষণ যে কষ্ট করে পড়ালাম এখন তার পারিশ্রমিক নিতে এসেছি। আমি কোন মাগনা কাজ করি না।'
ধারা শুদ্ধ'র হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় থেকে বলল,
'আমি বলছিলাম আমাকে পড়াতে? পড়াইছো কেন? আমি কোন পারিশ্রমিক দিবো না।'
'আমি তো নিবোই।'
এই বলে শুদ্ধ ধারাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
শেষ রাতের দিকে হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে দ্রুত উঠে বসলো শুদ্ধ। যা মনে হচ্ছে বৃষ্টি আরো অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এই দিনে তো বৃষ্টি নামার কথা না! ক্ষেতে এই সবেই নতুন বোরো ধান লাগানো হয়েছে। অ-দিনের এই বৃষ্টি যে কতো মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে তা ভাবনার বাহিরে নয়। শুদ্ধ'র মুখ শুকিয়ে গেলো। তখনই সে ছাতা মাথায় দিয়ে ক্ষেতের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো। ধারা শুদ্ধ'র বেড়িয়ে যাওয়ার দিকে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ'র শুকিয়ে যাওয়া মুখটা বারবার আঘাত হানতে লাগলো তার বুকে। কিছুক্ষণ পর ফজরের আযান দিলে ধারা জায়নামাজ নিয়ে তৎক্ষনাৎ নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলো।
চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব-৩০
মৌসুম পাল্টাতে দেরি লাগে না। সময়ের স্রোতে এক ঋতুর বিদায় হতে না হতেই আরেক ঋতুর আগমন হয়। হেমন্তের পরে শীত চলে এলো। বাংলা ক্যালেন্ডারের পৌষ মাস। গাছের আদ্র পাতা থেকে গড়িয়ে পড়া টুপটাপ শিশিরের শব্দ অবচেতনে মন জুড়ায়। চারপাশটা ধোঁয়ার মতো কুয়াশায় জড়ানো। তার সাথে হিম লাগানো অনুভূতি তো আছেই। সকালের নরম রোদ গায়ে লাগিয়ে চুমকি, ধারা, শুদ্ধ বসে আছে উঠোনের রান্নাঘরের সামনে। মাটির তপ্ত আগুনের চুলোয় চালের গুঁড়ো, নারকেল আর খেজুর গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা বানাচ্ছে খোদেজা। একটার পর একটা ধোঁয়া ওঠা গরম গরম পিঠা তুলে দিচ্ছে একেকজনের পাতে। ধারা এতক্ষণ খোদেজাকে সব সামগ্রী এগিয়ে দিচ্ছিল। খোদেজার কথায় এখন সবার সাথে সেও খেতে বসেছে। শীতের সকালে চুলোর পাশে সদ্য জেগে উঠা রোদের মধ্যে বসে বসে গরম গরম পিঠা খেতে ভালোই লাগছে। চুমকি সাধারণত এতো সকালে উঠে না। আর যদি তা হয় শীতের সকাল তাহলে তো প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু আজ পিঠার নাম শুনতে ঠিকই ঘুম থেকে উঠে খেতে বসেছে। একটার পর একটা পিঠা গোগ্রাসে গিলে চলেছে সে। শুদ্ধ চুমকির দিকে তাকিয়ে বলল,
'আস্তে আস্তে খা চুমকি। তোর পিঠা পালিয়ে যাচ্ছে না। একবার গলায় আটকালে তখন বুঝবি!'
শুদ্ধ'র কথায় চুমকি ফিচেল করে হাসে। শুদ্ধ পিঠা খেতে খেতে হঠাৎ ঘরের দিকে তাকিয়ে খোদেজাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
'আম্মা, ঘরের তো দেখি বেহাল অবস্থা! এদিক ওদিকে খুলে পড়ছে।'
খোদেজা বলল, 'তাইলে আমি তোরে কি কই! ঘরের অবস্থা পুরাই খারাপ হইয়া যাইতাছে। আর কতদিনই বা ভালো থাকবো! সেই আমার শ্বশুর আমলের বাড়ি। এতদিন যে টিকছে তাই বেশি। ঘরের এখনই কিছু একটা করা দরকার। নইলে কবে জানি ঘর মাথার উপর ভাইঙ্গা পড়বো।'
'ঘর ঠিক করতে হলে তো একেবারে পুরো ভেঙে নতুন করে গাঁথুনি দিয়েই বানাতে হবে। যেই পুরনো ঘর! এর উপর দিয়ে নতুন কোন কাজ করলেও টিকবে না। এখন এই সময় নতুন করে ঘর উঠাতে হলেও তো একটা বড় বাজেট থাকতে হবে। কিভাবে কি করি! আচ্ছা ঠিকাছে, আমি দেখবো নে কি করা যায়।'
শুদ্ধ সবে একটা পিঠা খেয়েছে। চুলো থেকে সদ্য নামানো আরেকটা ভাপা পিঠা খোদেজা শুদ্ধ'র বাটিতে দিতে চাইলেই শুদ্ধ মানা করে উঠে। বলে,
'আম্মা আর দিয়ো না। আমার সময় নেই। এখন খেতে পারবো না। ক্ষেতে যেতে হবে।'
খোদেজা খানিক বিরক্ত হয়। শুদ্ধ'র বারণ না শুনে পিঠাটা তার বাটিতে রেখে বলে,
'চুপচাপ খা তো! একটা পিঠায় কি হয়? এই সাত সকালে তোর ক্ষেতে যাবার কারণডা কি শুনি!'
শুদ্ধ দ্রুত পিঠা মুখে নিতে নিতে বলে,
'কি বল আম্মা! কত কাজ এখন! নতুন বোরো ধান লাগিয়েছি। সেগুলো দেখতে হবে না!'
শুদ্ধ পিঠা অর্ধেক খেয়ে রেখে ভেতরে তৈরি হতে চলে যায়। শুদ্ধ চলে গেলে খোদেজা ধারার দিকে তাকিয়ে বলে,
'দেখছো বউ মাহতাবের কান্ড কারখানা? কি দরকার এইসব কাজ ও'র করার? খায়া না খায়া এগুলার পেছনে পইরা রইছে। এতো কষ্ট কইরা পড়ালেখা করলি কই একটা ভালো দেইখা চাকরি কর। আরামে থাক। তা না এই কাজ নিয়া লাইগা আছে। তাও নইলে বুঝলাম করছোস যখন ফলের খামারই খালি করতি, এই ধান টান লাগানির কি দরকার ছিলো? কতো পরিশ্রমের কাজ! আমরা তো চাল কিননাই খাই। তবুও এগুলা করা কি প্রয়োজন বলো তো! তুমিও তো কিছু বলতে পারো বউ।'
খোদেজা যে শুদ্ধ'র জন্য খুব বেশি চিন্তা করে তা ধারা বোঝে। কিন্তু ধারা এটাও বোঝে, শুদ্ধ'র নিজস্ব একটা ভাবনা আছে৷ বিস্তৃত একটা পরিকল্পনা আছে৷ নিগূঢ় কিছু চিন্তা আছে৷ যার অনেককিছুই হয়তো ধারা বোঝে না। কিন্তু ধারা এটা জানে, এই ধান শুদ্ধ'র জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ধান নিয়ে তার বিশেষ গুরুতর একটা পরিকল্পনা আছে। তাই খোদেজার কথায় স্মিত হেসে ধারা বলল,
'যে যেটা করে শান্তি পায় তাকে সেটা আমরা করতে দেই মা। ফলের বাগানটা তো আছেই। আপনার ছেলে সংসার তো ভালো মতোই চালাচ্ছে। যদি না পারতো তাহলে না হয় আমরা বলতে পারতাম। এখন যখন সব ঠিকঠাক মতোই চলছে তখন সে করুক যা সে করতে চায়। আপনার ছেলেকে তো আমরা চিনিই মা৷ সে ভুল কিছু কখনো করবে না। যাই করবে সফল হবেই।'
ধারার শেষের কথায় খোদেজা একটু আশস্ত হয়। ধারা পাশে তাকিয়ে দেখে ঘর থেকে বেড়িয়ে শুদ্ধ তার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ তার মুখের মিষ্টি হাসিই বলে দিচ্ছে এতক্ষণ ধারার সব কথাই শুনেছে সে। ধারাও মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে শুদ্ধকে আশস্ত করে। ভরসা পেয়ে শুদ্ধ নিজের কাজে যাবার জন্য পা বাড়ায়।
শুদ্ধ যাওয়ার একটু পরই পাশের বাড়ি থেকে আবুলের মা হন্তদন্ত হয়ে খোদেজাকে ডাকতে আসে। খোদেজার তখন পিঠা বানানো প্রায় শেষের দিকেই। আবুলের মায়ের তোতলানো কথা আর দূর থেকে গরুর গগনবিদারী চিৎকার থেকে খোদেজা বুঝতে পারে আবুলদের গাভির বাচ্চা প্রসবের সময় হয়েছে। বাড়িতে আর কেউ নেই। আবুলের মা একা একা ঘাবড়াচ্ছে বলেই দ্রুত খোদেজাকে ডাকতে এসেছে। খোদেজা তড়িঘড়ি করে আবুলের মায়ের সাথে গেলো। ধারাও পেছন পেছন অনুসরণ করলো তাদের। আবুলদের গোয়াল ঘরে গিয়ে ধারা দেখলো তাদের লাল গাভিটি মোটা পেট নিয়ে অস্থির হয়ে ছটফট করছে আর একটু পর পর গলা চরিয়ে ডেকে উঠছে। খোদেজা আর আবুলের মা কিছু ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ধারা স্তম্ভের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অপলক দৃষ্টিতে গাভিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গাভির অস্থিরতা ধারার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে এক ধরণের কম্পন সৃষ্টি করে। গাভির বাচ্চা প্রসবের সম্পূর্ণ দৃশ্যটি ধারা দেখলো।
ধারার জীবনে এই প্রথম। এর আগে সে আর কখনো দেখেনি। তাই বলেই হয়তো এতো অদ্ভুত অনুভুতি তার হচ্ছে। খোদেজা আর আবুলের মায়ের কাছে এটা তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ধারার চোখ ছলছল করে উঠলো। আবার ছোট বাছুরটির দিকে তাকিয়ে মুখে মৃদু হাসিও ফুটে উঠলো। দেখলো একটুপরই মা গাভিটি ক্লান্ত শরীর নিয়ে সদ্য জন্মানো বাচ্চাটির শরীর জিভ দিয়ে চেটে আদর করে দিচ্ছে। দৃশ্যটি ধারার মনে অদ্ভুত সুখানুভূতির সৃষ্টি করলো। সে আস্তে করে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে এলো। সোফায় বসে শুদ্ধকে ফোন লাগালো। ফোন অনেকক্ষণ বাজার পরও ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। ধারা আর ফোন দিলো না। রেখে দিলো। নিশ্চয়ই শুদ্ধ ফোন টং ঘরের মধ্যে রেখে দিয়ে বাইরে কাজ করছে। নয়তো ধারার কল দেখলে ঠিকই ধরতো। শুদ্ধ আজকাল সত্যিই বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারাদিনটায় আর দেখাই পাওয়া যায় না। ধারা ভীষণ মিস করে তাকে। ফোনে শুদ্ধ'র একটা ছবি বের করে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। এতো ব্যস্ততার পরও কি শুদ্ধ তার খেয়াল রাখছে না? রাখছে। আরও বেশি রাখছে। যেখানে নিজের জন্য একমুহুর্ত দম ফেলবারও সময় পাচ্ছে না সেখানে ধারার পড়ালেখা, প্রয়োজনীয়তা, সবকিছুর খুব বেশি করেই খেয়াল রাখে শুদ্ধ। ধারাকে নানা জিনিস শেখায়। নানা বই পড়ায়, নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করায়। জীবনে সফল হতে কি প্রয়োজন না প্রয়োজন সব খুঁটিনাটির বিষয়ে বিজ্ঞ করে তুলে ধারাকে। এই তো কয়েকমাস আগেই ধারাকে একটা ইংলিশ স্পোকেন কোর্সে ভর্তি করিয়ে ইংরেজি বলায় তুখোড় করেছে ধারাকে। ইংরেজি ভালো মতো বুঝতে না পারা ধারাই এখন কতো দ্রুত স্মুথলি ইংরেজি বলতে পারে। তার উপর ধারার চর্চায় আরো দক্ষ করতে সেসময় টায় কিভাবে শুদ্ধ তার সাথে রোজ নিয়ম করে পুরো এক ঘন্টা ইংরেজিতে কথা বলতো তা মনে করে ধারা এক দমক হাসে। শুদ্ধ'র সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্তই ধারার কাছে তার জীবনের শুদ্ধতম মুহুর্ত বলে অনুভূত হয়।
__________________________________________
সন্ধ্যের পর ধারা সোফায় বসে বসে শুদ্ধ'র ল্যাপটপে একটা রোমান্টিক মুভি দেখছিলো। সেসময় শুদ্ধ এলো রুমে। শুদ্ধকে দেখে আনন্দিত হয়ে ধারা যখনই বিগলিত হয়ে তার সাথে বসে শুদ্ধকে মুভি দেখার অফার করতে যাবে ঠিক তখনই শুদ্ধ বলে উঠলো,
'এটা কি ধারা? সন্ধ্যে হয়ে গেছে তুমি এখনও পড়তে বসোনি!'
ধারা শুদ্ধ'র কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
'একটুপরই বসবো। দাঁড়াও। খুব সুন্দর একটা মুভি দেখছি। এতো রোমান্টিক! আসো তুমিও দেখো। তোমারও ভালো লাগবে।'
ধারা উৎফুল্ল হয়ে আবারো ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি দিলো। শুদ্ধ ল্যাপটপ নামিয়ে দিয়ে বলল,
'না। এখন না। এখন পড়তে বসো ধারা।'
ধারা শুনলো না। আবারো ল্যাপটপ খুলে দেখতে লাগলো। শুদ্ধ এবার ধারার কোল থেকে ল্যাপটপ নিয়ে গিয়ে বলল,
'আমিও আজকাল ব্যস্ত থাকি। আর তোমার পড়ারও কোন খেয়াল রাখতে পারি না। আর তুমিও একদমই সিরিয়াস থাকো না ধারা। কয়দিন পর না তোমার ফার্স্ট সেমিস্টারের পরীক্ষা। কতটুকু প্রিপারেশন হয়েছে? দেখি।'
ধারা দেখাতে পারলো না। সত্যি বলতে কিছুদিন যাবৎ তার পড়া তেমন হয়নি। শুদ্ধ বুঝতে পেরে বলল,
'জানি, কিছুই হয়নি। হবেই বা কিভাবে! সারাদিন বসে বসে রোমান্টিক মুভি দেখো। আগে একটা রোমান্টিক মুভির নামও জানতে না। আর এখন রোমান্টিক মুভি ছাড়া আর কিছুই বোঝো না। পড়ালেখার আর কোন খবর নেই। বই নিয়ে আসো। তোমার প্রিপারেশন আজকে অর্ধেক করিয়ে দেবো।'
গালে হাত রেখে ধারা অলস ভঙ্গিতে বসে রইলো। এই মুহুর্তে পড়তে বসতে তার একদমই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু না বসেও উপায় নেই। শুদ্ধ যখন পড়ার নাম নিয়েছে তখন না পড়িয়ে ছাড়বে! শুদ্ধ আবারও তাগাদা দিলো ধারাকে। অনিচ্ছা নিয়েই ধারাকে উঠতে হলো। এক গাঁদা বই নিয়ে বসতে হলো শুদ্ধ'র সামনে। শুদ্ধ একটা একটা করে বই নিয়ে দেখতে লাগলো। কিছু অনুশীলন বের করে পড়তে বলল ধারাকে। তারপর আবার আরেকটা বই নিয়ে দেখতে লাগলো। এদিকে ধারার একেবারেই পড়ার মুড নেই। তার ইচ্ছে করছে শুদ্ধকে নিয়ে ঐ মুভিটা এখন সম্পূর্ণ দেখতে অথবা শুদ্ধ'র সাথে একান্তে কিছু গল্প করতে, সময় কাটাতে। আর ইচ্ছে করবেই বা না কেন! সারাদিন পর দেখা পেলো মানুষটার। কিন্তু না! মহাশয়ের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো বেশ একটা স্যার স্যার ভাব নিয়ে বসেছে ধারাকে পড়াতে। কিছুক্ষণ পড়ার পরই ধারা গড়িমসি করতে লাগলো। আর চাইলো না পড়তে। পৃথিবীর যাবতীয় ইনোসেন্ট ভাব মুখে এনে বলল,
'আজকে না হয় এতটুকুই থাক। কালকে থেকে পড়ি? কাল থেকে সত্যিই পড়বো৷ প্রমিজ!'
শুদ্ধ বলল, 'না। এখন মানে এখনই। তোমার পড়ায় এমনিতেই অনেক ঢিলামি এসে পড়েছে। আমারই দোষ। আমিই খেয়াল করিনি। আজকে অনেকক্ষণ পড়াবো।'
ধারা বিরক্তি ভাব নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। আবারো একটু বই পড়ার পরই মুখ তুলে উৎফুল্ল হয়ে বলল, 'জানো? আজকে আবুল ভাইদের গাভির একটা বাছুর হয়েছে। দেখতে কি কিউট!'
শুদ্ধ ধারার বইয়ের দিকে চোখ রেখেই আস্তে করে বলল, 'ভালো।'
'আমার না এতো ভালো লেগেছে! গাভিটাকেও খুব খুশি লাগছিল। বাছুরটা খুবই সুন্দর হয়েছে দেখতে। জানো, আমি না আজকে একটা কথা ভেবেছি।'
'কি?'
ধারা শুদ্ধ'র দিকে খানিক এগিয়ে একটু আহ্লাদি স্বরে বলল, 'আমাদেরও যদি এমন একটা ছোট্ট কিউট বাবু হয় তাহলে কতো সুন্দর হবে তাই না!'
'হুম।'
ধারা উত্তেজিত হয়ে বলল, 'তাই না! আমিও সেটাই ভাবছিলাম। আমরাও খুব শীঘ্রই একটা বাবু নেবো।'
শুদ্ধ বই থেকে মুখ তুলে বলল,
'আমি শীঘ্রইয়ের কথা কখন বললাম? আমাদেরও বাবু হবে। কিন্তু এখন না। এখন হলে তোমার পড়ালেখার অনেক ডিস্টার্ব হবে। তাই আগে তোমার পড়ালেখা সম্পূর্ণ শেষ হবে তারপর।'
ধারা পুরো ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। কি বলে কি শুদ্ধ! পড়ালেখা শেষ হবার পর মানে? ধারা আঙ্গুল দিয়ে গুনতে লাগলো অনার্সের পর মাস্টার্স আর সাথে অল্প স্বল্প সেশনজট মেলালে পড়ালেখা শেষ হতে লাগবে আরো ছয় বছর। তার মানে আরো ছয় বছর পর! ধারা উদ্গ্রীব হয়ে দ্রুত বলে উঠে, 'ছয় বছর পর কতো দেরি হয়ে যাবে জানো...
ধারাকে থামিয়ে শুদ্ধ বলল,
'ধারা, এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় না। পড়তে বসার পর পড়া নিয়েই থাকতে হবে। এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে।'
ধারা আবারো খানিক পড়ার চেষ্টা করে। আবারো প্রচুর বোরিং ফিল হয়। সে শুদ্ধ'র দিকে তাকায়। শুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে ধারার বই দাগিয়ে যাচ্ছে। কতো সুন্দর লাগছে তাকে। কাঁচা হলুদ রঙের শার্ট, খানিক এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ধারা খানিক শুদ্ধ'র কাছে ঘেঁষে বসে৷ দু হাত দিয়ে শুদ্ধ'র গলা পেঁচিয়ে ধরে। শুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ধারাকে ইশারা করে। ধারা মুচকি হেসে বলে,
'এখন আমি আর পড়বো না। এখন আমি শুধু তোমাকে দেখবো। সারাদিন ধরে দেখিনি। আমার বুঝি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয় না।'
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল, 'এতো রোমান্টিক কথাবার্তা বলে লাভ নেই। পড়ার থেকে আজকে তুমি রেহাই পাচ্ছো না ম্যাডাম। যথেষ্ঠ ফাঁকিবাজি করে ফেলেছো। যা যা দাগিয়ে দিয়েছি আজ সব পড়বে। তারপরই উঠতে পারবে।'
ধারার মুখ ফুলে গেলো। সে দ্রুত সোজা হয়ে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, 'আচ্ছা ঠিকাছে আমিও পড়বো না। আমিও দেখি তুমি জোর করে আমাকে কিভাবে পড়াও।'
'তুমি পড়বে না?'
'না, পড়বো না।'
'সত্যিই তো?'
ধারা শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে একটা তীর্যক হাসি দিয়ে বলল, 'হ্যাঁ সত্যি। আর তুমিই এখন নিজেই আমাকে বলবে যে, ধারা থাক! আর পড়া লাগবে না। দেখতে চাও?'
এই বলে ধারা ও'র মাথার চুলগুলো খুলে দিয়ে শুদ্ধ'র কাঁধে দু হাত রেখে ও'র কাছে যেতে লাগলো। শুদ্ধ খানিক ঢোক গিলে ইতস্তত করে বলল,
'ধারা, ভালো হবে না কিন্তু! পড়তে বসো।'
ধারা শুনলো না। মুখ টিপে হাসতে লাগলো। হঠাৎ শুদ্ধ ধারার পায়ে স্কেল দিয়ে আস্তে করে একটা বারি দিলো। ধারা বিস্ফোরিত গলায় বলল,
'তুমি আমাকে মারলে?'
শুদ্ধ ও'র শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল,
'পড়তে বসে বাঁদরামি করলে তো মারবোই। পড়ো! রাত এগারোটার আগে তুমি উঠতে পারবে না।'
ধারা মুখ ফুলিয়ে বসে বলল,
'পড়বো না। পড়বো না। পড়বো না।'
শুদ্ধ স্কেল দিয়ে পুনরায় আরেকটা বারি দিলো। ধারা আবারো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে শেষমেশ রাগে জেদে একদম রাত এগারোটা পর্যন্ত একনাগাড়ে পড়েই ঘুমানোর জন্য ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। শুদ্ধ মিটিমিটি হেসে ধারার বইগুলো গুছিয়ে রেখে ঝটপট বিছানায় শুয়ে ধারাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ধারা যে আজ ভীষণ ক্ষ্যাপা ক্ষেপেছে! এই রাগ ভাঙানো সহজ নয়। শুদ্ধ ধরতেই ধারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলো। শুদ্ধ ছাড়লো না। ধারা চেষ্টা সচল রেখে বলল, 'এখন আমাকে ধরেছো কেন? ছাড়ো! পড়ানো তো শেষ। এখন কি? আর আসবা না আমার কাছে।'
শুদ্ধ মুচকি হেসে বলল, 'ইশ! বললেই হলো! এতক্ষণ যে কষ্ট করে পড়ালাম এখন তার পারিশ্রমিক নিতে এসেছি। আমি কোন মাগনা কাজ করি না।'
ধারা শুদ্ধ'র হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় থেকে বলল,
'আমি বলছিলাম আমাকে পড়াতে? পড়াইছো কেন? আমি কোন পারিশ্রমিক দিবো না।'
'আমি তো নিবোই।'
এই বলে শুদ্ধ ধারাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
শেষ রাতের দিকে হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে দ্রুত উঠে বসলো শুদ্ধ। যা মনে হচ্ছে বৃষ্টি আরো অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এই দিনে তো বৃষ্টি নামার কথা না! ক্ষেতে এই সবেই নতুন বোরো ধান লাগানো হয়েছে। অ-দিনের এই বৃষ্টি যে কতো মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে তা ভাবনার বাহিরে নয়। শুদ্ধ'র মুখ শুকিয়ে গেলো। তখনই সে ছাতা মাথায় দিয়ে ক্ষেতের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো। ধারা শুদ্ধ'র বেড়িয়ে যাওয়ার দিকে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ'র শুকিয়ে যাওয়া মুখটা বারবার আঘাত হানতে লাগলো তার বুকে। কিছুক্ষণ পর ফজরের আযান দিলে ধারা জায়নামাজ নিয়ে তৎক্ষনাৎ নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলো।
চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
08-08-2024, 11:52 PM
(This post was last modified: 08-08-2024, 11:53 PM by Bangla Golpo. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
পর্ব-৩০
মৌসুম পাল্টাতে দেরি লাগে না। সময়ের স্রোতে এক ঋতুর বিদায় হতে না হতেই আরেক ঋতুর আগমন হয়। হেমন্তের পরে শীত চলে এলো। বাংলা ক্যালেন্ডারের পৌষ মাস। গাছের আদ্র পাতা থেকে গড়িয়ে পড়া টুপটাপ শিশিরের শব্দ অবচেতনে মন জুড়ায়। চারপাশটা ধোঁয়ার মতো কুয়াশায় জড়ানো। তার সাথে হিম লাগানো অনুভূতি তো আছেই। সকালের নরম রোদ গায়ে লাগিয়ে চুমকি, ধারা, শুদ্ধ বসে আছে উঠোনের রান্নাঘরের সামনে। মাটির তপ্ত আগুনের চুলোয় চালের গুঁড়ো, নারকেল আর খেজুর গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা বানাচ্ছে খোদেজা। একটার পর একটা ধোঁয়া ওঠা গরম গরম পিঠা তুলে দিচ্ছে একেকজনের পাতে। ধারা এতক্ষণ খোদেজাকে সব সামগ্রী এগিয়ে দিচ্ছিল। খোদেজার কথায় এখন সবার সাথে সেও খেতে বসেছে। শীতের সকালে চুলোর পাশে সদ্য জেগে উঠা রোদের মধ্যে বসে বসে গরম গরম পিঠা খেতে ভালোই লাগছে। চুমকি সাধারণত এতো সকালে উঠে না। আর যদি তা হয় শীতের সকাল তাহলে তো প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু আজ পিঠার নাম শুনতে ঠিকই ঘুম থেকে উঠে খেতে বসেছে। একটার পর একটা পিঠা গোগ্রাসে গিলে চলেছে সে। শুদ্ধ চুমকির দিকে তাকিয়ে বলল,
'আস্তে আস্তে খা চুমকি। তোর পিঠা পালিয়ে যাচ্ছে না। একবার গলায় আটকালে তখন বুঝবি!'
শুদ্ধ'র কথায় চুমকি ফিচেল করে হাসে। শুদ্ধ পিঠা খেতে খেতে হঠাৎ ঘরের দিকে তাকিয়ে খোদেজাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
'আম্মা, ঘরের তো দেখি বেহাল অবস্থা! এদিক ওদিকে খুলে পড়ছে।'
খোদেজা বলল, 'তাইলে আমি তোরে কি কই! ঘরের অবস্থা পুরাই খারাপ হইয়া যাইতাছে। আর কতদিনই বা ভালো থাকবো! সেই আমার শ্বশুর আমলের বাড়ি। এতদিন যে টিকছে তাই বেশি। ঘরের এখনই কিছু একটা করা দরকার। নইলে কবে জানি ঘর মাথার উপর ভাইঙ্গা পড়বো।'
'ঘর ঠিক করতে হলে তো একেবারে পুরো ভেঙে নতুন করে গাঁথুনি দিয়েই বানাতে হবে। যেই পুরনো ঘর! এর উপর দিয়ে নতুন কোন কাজ করলেও টিকবে না। এখন এই সময় নতুন করে ঘর উঠাতে হলেও তো একটা বড় বাজেট থাকতে হবে। কিভাবে কি করি! আচ্ছা ঠিকাছে, আমি দেখবো নে কি করা যায়।'
শুদ্ধ সবে একটা পিঠা খেয়েছে। চুলো থেকে সদ্য নামানো আরেকটা ভাপা পিঠা খোদেজা শুদ্ধ'র বাটিতে দিতে চাইলেই শুদ্ধ মানা করে উঠে। বলে,
'আম্মা আর দিয়ো না। আমার সময় নেই। এখন খেতে পারবো না। ক্ষেতে যেতে হবে।'
খোদেজা খানিক বিরক্ত হয়। শুদ্ধ'র বারণ না শুনে পিঠাটা তার বাটিতে রেখে বলে,
'চুপচাপ খা তো! একটা পিঠায় কি হয়? এই সাত সকালে তোর ক্ষেতে যাবার কারণডা কি শুনি!'
শুদ্ধ দ্রুত পিঠা মুখে নিতে নিতে বলে,
'কি বল আম্মা! কত কাজ এখন! নতুন বোরো ধান লাগিয়েছি। সেগুলো দেখতে হবে না!'
শুদ্ধ পিঠা অর্ধেক খেয়ে রেখে ভেতরে তৈরি হতে চলে যায়। শুদ্ধ চলে গেলে খোদেজা ধারার দিকে তাকিয়ে বলে,
'দেখছো বউ মাহতাবের কান্ড কারখানা? কি দরকার এইসব কাজ ও'র করার? খায়া না খায়া এগুলার পেছনে পইরা রইছে। এতো কষ্ট কইরা পড়ালেখা করলি কই একটা ভালো দেইখা চাকরি কর। আরামে থাক। তা না এই কাজ নিয়া লাইগা আছে। তাও নইলে বুঝলাম করছোস যখন ফলের খামারই খালি করতি, এই ধান টান লাগানির কি দরকার ছিলো? কতো পরিশ্রমের কাজ! আমরা তো চাল কিননাই খাই। তবুও এগুলা করা কি প্রয়োজন বলো তো! তুমিও তো কিছু বলতে পারো বউ।'
খোদেজা যে শুদ্ধ'র জন্য খুব বেশি চিন্তা করে তা ধারা বোঝে। কিন্তু ধারা এটাও বোঝে, শুদ্ধ'র নিজস্ব একটা ভাবনা আছে৷ বিস্তৃত একটা পরিকল্পনা আছে৷ নিগূঢ় কিছু চিন্তা আছে৷ যার অনেককিছুই হয়তো ধারা বোঝে না। কিন্তু ধারা এটা জানে, এই ধান শুদ্ধ'র জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ধান নিয়ে তার বিশেষ গুরুতর একটা পরিকল্পনা আছে। তাই খোদেজার কথায় স্মিত হেসে ধারা বলল,
'যে যেটা করে শান্তি পায় তাকে সেটা আমরা করতে দেই মা। ফলের বাগানটা তো আছেই। আপনার ছেলে সংসার তো ভালো মতোই চালাচ্ছে। যদি না পারতো তাহলে না হয় আমরা বলতে পারতাম। এখন যখন সব ঠিকঠাক মতোই চলছে তখন সে করুক যা সে করতে চায়। আপনার ছেলেকে তো আমরা চিনিই মা৷ সে ভুল কিছু কখনো করবে না। যাই করবে সফল হবেই।'
ধারার শেষের কথায় খোদেজা একটু আশস্ত হয়। ধারা পাশে তাকিয়ে দেখে ঘর থেকে বেড়িয়ে শুদ্ধ তার দিকেই তাকিয়ে আছে৷ তার মুখের মিষ্টি হাসিই বলে দিচ্ছে এতক্ষণ ধারার সব কথাই শুনেছে সে। ধারাও মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করে শুদ্ধকে আশস্ত করে। ভরসা পেয়ে শুদ্ধ নিজের কাজে যাবার জন্য পা বাড়ায়।
শুদ্ধ যাওয়ার একটু পরই পাশের বাড়ি থেকে আবুলের মা হন্তদন্ত হয়ে খোদেজাকে ডাকতে আসে। খোদেজার তখন পিঠা বানানো প্রায় শেষের দিকেই। আবুলের মায়ের তোতলানো কথা আর দূর থেকে গরুর গগনবিদারী চিৎকার থেকে খোদেজা বুঝতে পারে আবুলদের গাভির বাচ্চা প্রসবের সময় হয়েছে। বাড়িতে আর কেউ নেই। আবুলের মা একা একা ঘাবড়াচ্ছে বলেই দ্রুত খোদেজাকে ডাকতে এসেছে। খোদেজা তড়িঘড়ি করে আবুলের মায়ের সাথে গেলো। ধারাও পেছন পেছন অনুসরণ করলো তাদের। আবুলদের গোয়াল ঘরে গিয়ে ধারা দেখলো তাদের লাল গাভিটি মোটা পেট নিয়ে অস্থির হয়ে ছটফট করছে আর একটু পর পর গলা চরিয়ে ডেকে উঠছে। খোদেজা আর আবুলের মা কিছু ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ধারা স্তম্ভের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে অপলক দৃষ্টিতে গাভিটির দিকে তাকিয়ে থাকে। গাভির অস্থিরতা ধারার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে এক ধরণের কম্পন সৃষ্টি করে। গাভির বাচ্চা প্রসবের সম্পূর্ণ দৃশ্যটি ধারা দেখলো।
ধারার জীবনে এই প্রথম। এর আগে সে আর কখনো দেখেনি। তাই বলেই হয়তো এতো অদ্ভুত অনুভুতি তার হচ্ছে। খোদেজা আর আবুলের মায়ের কাছে এটা তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ধারার চোখ ছলছল করে উঠলো। আবার ছোট বাছুরটির দিকে তাকিয়ে মুখে মৃদু হাসিও ফুটে উঠলো। দেখলো একটুপরই মা গাভিটি ক্লান্ত শরীর নিয়ে সদ্য জন্মানো বাচ্চাটির শরীর জিভ দিয়ে চেটে আদর করে দিচ্ছে। দৃশ্যটি ধারার মনে অদ্ভুত সুখানুভূতির সৃষ্টি করলো। সে আস্তে করে সেখান থেকে নিজের রুমে চলে এলো। সোফায় বসে শুদ্ধকে ফোন লাগালো। ফোন অনেকক্ষণ বাজার পরও ওপাশ থেকে রিসিভ হলো না। ধারা আর ফোন দিলো না। রেখে দিলো। নিশ্চয়ই শুদ্ধ ফোন টং ঘরের মধ্যে রেখে দিয়ে বাইরে কাজ করছে। নয়তো ধারার কল দেখলে ঠিকই ধরতো। শুদ্ধ আজকাল সত্যিই বড্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সারাদিনটায় আর দেখাই পাওয়া যায় না। ধারা ভীষণ মিস করে তাকে। ফোনে শুদ্ধ'র একটা ছবি বের করে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। এতো ব্যস্ততার পরও কি শুদ্ধ তার খেয়াল রাখছে না? রাখছে। আরও বেশি রাখছে। যেখানে নিজের জন্য একমুহুর্ত দম ফেলবারও সময় পাচ্ছে না সেখানে ধারার পড়ালেখা, প্রয়োজনীয়তা, সবকিছুর খুব বেশি করেই খেয়াল রাখে শুদ্ধ। ধারাকে নানা জিনিস শেখায়। নানা বই পড়ায়, নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করায়। জীবনে সফল হতে কি প্রয়োজন না প্রয়োজন সব খুঁটিনাটির বিষয়ে বিজ্ঞ করে তুলে ধারাকে। এই তো কয়েকমাস আগেই ধারাকে একটা ইংলিশ স্পোকেন কোর্সে ভর্তি করিয়ে ইংরেজি বলায় তুখোড় করেছে ধারাকে। ইংরেজি ভালো মতো বুঝতে না পারা ধারাই এখন কতো দ্রুত স্মুথলি ইংরেজি বলতে পারে। তার উপর ধারার চর্চায় আরো দক্ষ করতে সেসময় টায় কিভাবে শুদ্ধ তার সাথে রোজ নিয়ম করে পুরো এক ঘন্টা ইংরেজিতে কথা বলতো তা মনে করে ধারা এক দমক হাসে। শুদ্ধ'র সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্তই ধারার কাছে তার জীবনের শুদ্ধতম মুহুর্ত বলে অনুভূত হয়।
__________________________________________
সন্ধ্যের পর ধারা সোফায় বসে বসে শুদ্ধ'র ল্যাপটপে একটা রোমান্টিক মুভি দেখছিলো। সেসময় শুদ্ধ এলো রুমে। শুদ্ধকে দেখে আনন্দিত হয়ে ধারা যখনই বিগলিত হয়ে তার সাথে বসে শুদ্ধকে মুভি দেখার অফার করতে যাবে ঠিক তখনই শুদ্ধ বলে উঠলো,
'এটা কি ধারা? সন্ধ্যে হয়ে গেছে তুমি এখনও পড়তে বসোনি!'
ধারা শুদ্ধ'র কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
'একটুপরই বসবো। দাঁড়াও। খুব সুন্দর একটা মুভি দেখছি। এতো রোমান্টিক! আসো তুমিও দেখো। তোমারও ভালো লাগবে।'
ধারা উৎফুল্ল হয়ে আবারো ল্যাপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি দিলো। শুদ্ধ ল্যাপটপ নামিয়ে দিয়ে বলল,
'না। এখন না। এখন পড়তে বসো ধারা।'
ধারা শুনলো না। আবারো ল্যাপটপ খুলে দেখতে লাগলো। শুদ্ধ এবার ধারার কোল থেকে ল্যাপটপ নিয়ে গিয়ে বলল,
'আমিও আজকাল ব্যস্ত থাকি। আর তোমার পড়ারও কোন খেয়াল রাখতে পারি না। আর তুমিও একদমই সিরিয়াস থাকো না ধারা। কয়দিন পর না তোমার ফার্স্ট সেমিস্টারের পরীক্ষা। কতটুকু প্রিপারেশন হয়েছে? দেখি।'
ধারা দেখাতে পারলো না। সত্যি বলতে কিছুদিন যাবৎ তার পড়া তেমন হয়নি। শুদ্ধ বুঝতে পেরে বলল,
'জানি, কিছুই হয়নি। হবেই বা কিভাবে! সারাদিন বসে বসে রোমান্টিক মুভি দেখো। আগে একটা রোমান্টিক মুভির নামও জানতে না। আর এখন রোমান্টিক মুভি ছাড়া আর কিছুই বোঝো না। পড়ালেখার আর কোন খবর নেই। বই নিয়ে আসো। তোমার প্রিপারেশন আজকে অর্ধেক করিয়ে দেবো।'
গালে হাত রেখে ধারা অলস ভঙ্গিতে বসে রইলো। এই মুহুর্তে পড়তে বসতে তার একদমই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু না বসেও উপায় নেই। শুদ্ধ যখন পড়ার নাম নিয়েছে তখন না পড়িয়ে ছাড়বে! শুদ্ধ আবারও তাগাদা দিলো ধারাকে। অনিচ্ছা নিয়েই ধারাকে উঠতে হলো। এক গাঁদা বই নিয়ে বসতে হলো শুদ্ধ'র সামনে। শুদ্ধ একটা একটা করে বই নিয়ে দেখতে লাগলো। কিছু অনুশীলন বের করে পড়তে বলল ধারাকে। তারপর আবার আরেকটা বই নিয়ে দেখতে লাগলো। এদিকে ধারার একেবারেই পড়ার মুড নেই। তার ইচ্ছে করছে শুদ্ধকে নিয়ে ঐ মুভিটা এখন সম্পূর্ণ দেখতে অথবা শুদ্ধ'র সাথে একান্তে কিছু গল্প করতে, সময় কাটাতে। আর ইচ্ছে করবেই বা না কেন! সারাদিন পর দেখা পেলো মানুষটার। কিন্তু না! মহাশয়ের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তো বেশ একটা স্যার স্যার ভাব নিয়ে বসেছে ধারাকে পড়াতে। কিছুক্ষণ পড়ার পরই ধারা গড়িমসি করতে লাগলো। আর চাইলো না পড়তে। পৃথিবীর যাবতীয় ইনোসেন্ট ভাব মুখে এনে বলল,
'আজকে না হয় এতটুকুই থাক। কালকে থেকে পড়ি? কাল থেকে সত্যিই পড়বো৷ প্রমিজ!'
শুদ্ধ বলল, 'না। এখন মানে এখনই। তোমার পড়ায় এমনিতেই অনেক ঢিলামি এসে পড়েছে। আমারই দোষ। আমিই খেয়াল করিনি। আজকে অনেকক্ষণ পড়াবো।'
ধারা বিরক্তি ভাব নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। আবারো একটু বই পড়ার পরই মুখ তুলে উৎফুল্ল হয়ে বলল, 'জানো? আজকে আবুল ভাইদের গাভির একটা বাছুর হয়েছে। দেখতে কি কিউট!'
শুদ্ধ ধারার বইয়ের দিকে চোখ রেখেই আস্তে করে বলল, 'ভালো।'
'আমার না এতো ভালো লেগেছে! গাভিটাকেও খুব খুশি লাগছিল। বাছুরটা খুবই সুন্দর হয়েছে দেখতে। জানো, আমি না আজকে একটা কথা ভেবেছি।'
'কি?'
ধারা শুদ্ধ'র দিকে খানিক এগিয়ে একটু আহ্লাদি স্বরে বলল, 'আমাদেরও যদি এমন একটা ছোট্ট কিউট বাবু হয় তাহলে কতো সুন্দর হবে তাই না!'
'হুম।'
ধারা উত্তেজিত হয়ে বলল, 'তাই না! আমিও সেটাই ভাবছিলাম। আমরাও খুব শীঘ্রই একটা বাবু নেবো।'
শুদ্ধ বই থেকে মুখ তুলে বলল,
'আমি শীঘ্রইয়ের কথা কখন বললাম? আমাদেরও বাবু হবে। কিন্তু এখন না। এখন হলে তোমার পড়ালেখার অনেক ডিস্টার্ব হবে। তাই আগে তোমার পড়ালেখা সম্পূর্ণ শেষ হবে তারপর।'
ধারা পুরো ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। কি বলে কি শুদ্ধ! পড়ালেখা শেষ হবার পর মানে? ধারা আঙ্গুল দিয়ে গুনতে লাগলো অনার্সের পর মাস্টার্স আর সাথে অল্প স্বল্প সেশনজট মেলালে পড়ালেখা শেষ হতে লাগবে আরো ছয় বছর। তার মানে আরো ছয় বছর পর! ধারা উদ্গ্রীব হয়ে দ্রুত বলে উঠে, 'ছয় বছর পর কতো দেরি হয়ে যাবে জানো...
ধারাকে থামিয়ে শুদ্ধ বলল,
'ধারা, এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় না। পড়তে বসার পর পড়া নিয়েই থাকতে হবে। এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে।'
ধারা আবারো খানিক পড়ার চেষ্টা করে। আবারো প্রচুর বোরিং ফিল হয়। সে শুদ্ধ'র দিকে তাকায়। শুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে ধারার বই দাগিয়ে যাচ্ছে। কতো সুন্দর লাগছে তাকে। কাঁচা হলুদ রঙের শার্ট, খানিক এলোমেলো চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ধারা খানিক শুদ্ধ'র কাছে ঘেঁষে বসে৷ দু হাত দিয়ে শুদ্ধ'র গলা পেঁচিয়ে ধরে। শুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ধারাকে ইশারা করে। ধারা মুচকি হেসে বলে,
'এখন আমি আর পড়বো না। এখন আমি শুধু তোমাকে দেখবো। সারাদিন ধরে দেখিনি। আমার বুঝি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয় না।'
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল, 'এতো রোমান্টিক কথাবার্তা বলে লাভ নেই। পড়ার থেকে আজকে তুমি রেহাই পাচ্ছো না ম্যাডাম। যথেষ্ঠ ফাঁকিবাজি করে ফেলেছো। যা যা দাগিয়ে দিয়েছি আজ সব পড়বে। তারপরই উঠতে পারবে।'
ধারার মুখ ফুলে গেলো। সে দ্রুত সোজা হয়ে বসে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, 'আচ্ছা ঠিকাছে আমিও পড়বো না। আমিও দেখি তুমি জোর করে আমাকে কিভাবে পড়াও।'
'তুমি পড়বে না?'
'না, পড়বো না।'
'সত্যিই তো?'
ধারা শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে একটা তীর্যক হাসি দিয়ে বলল, 'হ্যাঁ সত্যি। আর তুমিই এখন নিজেই আমাকে বলবে যে, ধারা থাক! আর পড়া লাগবে না। দেখতে চাও?'
এই বলে ধারা ও'র মাথার চুলগুলো খুলে দিয়ে শুদ্ধ'র কাঁধে দু হাত রেখে ও'র কাছে যেতে লাগলো। শুদ্ধ খানিক ঢোক গিলে ইতস্তত করে বলল,
'ধারা, ভালো হবে না কিন্তু! পড়তে বসো।'
ধারা শুনলো না। মুখ টিপে হাসতে লাগলো। হঠাৎ শুদ্ধ ধারার পায়ে স্কেল দিয়ে আস্তে করে একটা বারি দিলো। ধারা বিস্ফোরিত গলায় বলল,
'তুমি আমাকে মারলে?'
শুদ্ধ ও'র শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বলল,
'পড়তে বসে বাঁদরামি করলে তো মারবোই। পড়ো! রাত এগারোটার আগে তুমি উঠতে পারবে না।'
ধারা মুখ ফুলিয়ে বসে বলল,
'পড়বো না। পড়বো না। পড়বো না।'
শুদ্ধ স্কেল দিয়ে পুনরায় আরেকটা বারি দিলো। ধারা আবারো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে শেষমেশ রাগে জেদে একদম রাত এগারোটা পর্যন্ত একনাগাড়ে পড়েই ঘুমানোর জন্য ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। শুদ্ধ মিটিমিটি হেসে ধারার বইগুলো গুছিয়ে রেখে ঝটপট বিছানায় শুয়ে ধারাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ধারা যে আজ ভীষণ ক্ষ্যাপা ক্ষেপেছে! এই রাগ ভাঙানো সহজ নয়। শুদ্ধ ধরতেই ধারা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করলো। শুদ্ধ ছাড়লো না। ধারা চেষ্টা সচল রেখে বলল, 'এখন আমাকে ধরেছো কেন? ছাড়ো! পড়ানো তো শেষ। এখন কি? আর আসবা না আমার কাছে।'
শুদ্ধ মুচকি হেসে বলল, 'ইশ! বললেই হলো! এতক্ষণ যে কষ্ট করে পড়ালাম এখন তার পারিশ্রমিক নিতে এসেছি। আমি কোন মাগনা কাজ করি না।'
ধারা শুদ্ধ'র হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় থেকে বলল,
'আমি বলছিলাম আমাকে পড়াতে? পড়াইছো কেন? আমি কোন পারিশ্রমিক দিবো না।'
'আমি তো নিবোই।'
এই বলে শুদ্ধ ধারাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
শেষ রাতের দিকে হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে দ্রুত উঠে বসলো শুদ্ধ। যা মনে হচ্ছে বৃষ্টি আরো অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এই দিনে তো বৃষ্টি নামার কথা না! ক্ষেতে এই সবেই নতুন বোরো ধান লাগানো হয়েছে। অ-দিনের এই বৃষ্টি যে কতো মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে তা ভাবনার বাহিরে নয়। শুদ্ধ'র মুখ শুকিয়ে গেলো। তখনই সে ছাতা মাথায় দিয়ে ক্ষেতের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিলো। ধারা শুদ্ধ'র বেড়িয়ে যাওয়ার দিকে উদ্বিগ্ন মুখে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ'র শুকিয়ে যাওয়া মুখটা বারবার আঘাত হানতে লাগলো তার বুকে। কিছুক্ষণ পর ফজরের আযান দিলে ধারা জায়নামাজ নিয়ে তৎক্ষনাৎ নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলো।
চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
(02-08-2024, 01:31 AM)Sonalirkotha Wrote: আর এগোবে না গল্প?
আগাবে এবং শেষ পর্যন্ত যাবে।
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
14-09-2024, 10:48 PM
পর্ব-৩১
নামাজ শেষে এক দীর্ঘ মোনাজাত দিলো ধারা। মনের সবটুকু আকুতি নিংড়ে প্রকাশ করলো সৃষ্টিকর্তার দরবারে। মোনাজাত শেষ করে বাইরে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টির তেজ অনেকটাই কমে গেছে। শুধু ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। একবার আবেগ্লাপুত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ধারা একটা চাদর গায়ে দিয়ে ক্ষেতের উদ্দেশ্যে বের হলো। সকালের আলো ধীরে ধীরে ফুটতে শুরু করছে। মাটির রাস্তা, ফসল সব ভেজা। ধানক্ষেতের আল ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো ধারা। উঁচু ভিটির উপর শুদ্ধ'র করা দীর্ঘ ফলের বাগানটার পরেই তার ধানক্ষেত, ঢাল হয়ে নিচে নেমে গেছে। সেখানে বৃষ্টির পানি জমে গেছে অনেকটা। ফলের বাগানের শেষের মাথায় আর ধানক্ষেতের শুরুর আগে উঁচু ভিটির উপরই টিন দিয়ে বানানো একটা ছোট্ট টং ঘরের মতো। সেখানে সব প্রয়োজনীয় জিনিস রাখা হয়। মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্য সেখানে একটা টেবিল আর ছোট্ট চৌকি পাতা। ধারা গিয়ে দেখলো টং ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর মাথা রেখেই বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে শুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়েছে। ধারা গিয়ে আস্তে করে শুদ্ধ'র পাশে দাঁড়ায়। মৃদু হেসে শুদ্ধর গায়ে হাত দিয়ে তাকে ডেকে তুলে। শুদ্ধ পিটপিট করে চোখ খুলতেই তাকে হাত বাড়িয়ে দরজা দিয়ে বাইরেটা দেখায় ধারা। ধারার ইশারা বরাবর তাকিয়ে শুদ্ধ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। বৃষ্টি শেষে সোনা রাঙা রোদ উঠতে শুরু করেছে। আকাশ পরিষ্কার। মেঘ পুরোপুরি কেটে গেছে। নয়তো আবহাওয়া যেমন দেখা যাচ্ছিল মনে হচ্ছিল নিম্নচাপের মতো বৃষ্টি বোধহয় সারাদিনই থাকবে। শুদ্ধ উত্তেজিত হয়ে দ্রুত বাইরে বেড়িয়ে আসে। রোদের মিষ্টি তাপ মন ভরিয়ে গায়ে মাখায়। ফসলের জমিতে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। তার নতুন ধানের ক্ষেতে পানি জমে গেছে। চারাগুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে। শুদ্ধ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। ধারা হঠাৎ পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখলে শুদ্ধ ফিরে তাকায়। একটা ভরসা মাখা হাসি দিয়ে ধারা শুদ্ধ'র মাথায় একটা লাল গামছা বেঁধে দিয়ে হাতে একটা কোদাল তুলে দেয়। তারপর আরেকটা কোদাল নিজের হাতে নিয়ে জমির পানির দিকে ইশারা করে। শুদ্ধ কোদাল হাতে ধানক্ষেতে নেমে যায়। মাটি কেটে পানি বের হবার লাইন বানিয়ে দিতে থাকে। এই শীতের মধ্যে ধারাও তার আনাড়ি হাতে যতটুকু পারে করে। শেষমেশ নিজেদের সবটুকু জমির পানি বের হয়ে যাবার ব্যবস্থা করার পর ধারা ক্লান্ত হয়ে স্বস্তি মুখে উঠে দাঁড়ায়। কাজ শেষ হয়ে গেছে ভেবে যখনই সে শুদ্ধ'র দিকে পেছনে ফিরে তাকায় দেখে শুদ্ধ থেমে নেই। নিজেদের ক্ষেতের কাজ শেষ করে এখন সে আশেপাশে অন্যদের ক্ষেতেরও ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। যাতে তাদের ফসলেরও ক্ষতি না হয়। ধারা সেদিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।
সেদিনের বৃষ্টিতে শুদ্ধ'র সেই উদাস চেহারায় ধারা বুঝতে পারলো এই ধান শুদ্ধ'র জন্য তার ধারণার থেকেও বেশি ঠিক কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোন সাধারণ বোরো ধান নয়। বোরো মৌসুমে লাগানো এই বোরো ধান নিয়েই শুদ্ধ তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টায় নেমেছে। বৃষ্টির পর থেকে শুদ্ধ তার পরিশ্রমের মাত্রা আরও দ্বিগুণ করে দেয়। হতাশ না হয়ে বৃষ্টিতে যতোটুকু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তার উদ্যমী মনোভাব আর পরিশ্রমে সবটা পুষিয়ে দেয়। এরপর থেকে ধারাও নিয়মিত ক্ষেতে আসা যাওয়া করতে লাগলো। শুদ্ধ'র কাজ ধান লাগানো নয়। তার হাতে আরো অনেক কাজ থাকে। এসবের জন্য সে কিছু লোক রেখেছে। শুদ্ধ'র কাজ শুধু তত্ত্বাবধায়ক করা। কিন্তু সে এখানেই থেমে থাকে না। অন্যদের সাথে সেও সমানতালে লেগে যায় ধান চাষের কাজে। এই কাজ যখন সে করে খুব উপভোগ নিয়েই করে। তার চোখে মুখে তখন এক অন্য ধরণেরই ঝিলিক ফুটে উঠে। স্বপ্ন পূরণের ঝিলিক। লক্ষে পৌঁছাবার প্রত্যাশা, অপেক্ষা...ঘিরে থাকে শুদ্ধ'র মুখশ্রীতে। প্রকৃত অর্থে পরিশ্রমী কি তা শুদ্ধকে তখন দেখলে বোঝা যায়। ধারা খুব আনন্দ নিয়ে উপভোগ করে এই দৃশ্যগুলো। শুদ্ধ'র স্বপ্ন খুব দামী। দামী তার চেষ্টাগুলোও। সেগুলো কেউ দেখলে নিজে থেকেই অনুপ্রাণিত হয়। যেমনটা হয় ধারাও। রোজ দুপুরে সে শুদ্ধ'র জন্য খাবার নিয়ে আসে। সাথে থাকে নিজেরটাও। শুদ্ধ'র সাথেই মাঠে বসে খাবার পর্ব সাড়ে ধারা। তারপর বিকেলে শুদ্ধ'র বাড়ি ফেরার সময় হওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই থেকে যায় সে। কাজ শেষে দুজনে একসাথেই বাড়ি ফেরে। খোদেজার কাছ থেকে আজকাল নকশী কাঁথা সেলাই করা শিখছে ধারা। একটা কাঁথা সেলাইয়ে হাতও দিয়েছে। খাওয়া শেষে মাঠ ভরা হলুদ সর্ষে ফুলের পাশে রোদে বসে ধারা কাঁথা সেলাই করে আর শুদ্ধ'র কাজ দেখে। কখনো কখনো ধারার হাত থেকে কাঁথা কেড়ে নিয়ে শুদ্ধ বই ধরিয়ে দেয়। ধারার আর কি করার! শুদ্ধকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের স্বপ্নের রাস্তায় হাঁটতে তাকেও পড়তে হয় বই। আস্তে আস্তে ধানের চারা বেড়ে উঠে। উত্তরিয়া হাওয়ায় নিরন্তর দোল খেয়ে চোখের সামনে বৃদ্ধি পেতে থাকে শুদ্ধ'র পরিশ্রমের ছোঁয়া। ধারা নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। কখনো নিজের ওড়না দিয়ে ক্লান্ত শুদ্ধ'র ক্লান্তি মুছে দেয়। কাজের চাপে অসময়ে ঘুমিয়ে পড়া শুদ্ধ'র অবশ্রান্ত দেহের উপর চাদর টেনে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে আনমনে মৃদু হেসে উঠে। কখনো ছিঁলে যাওয়া শুদ্ধ'র মেহনতী হাতের দিকে তাকিয়ে তার চোখ ছলছল করে উঠে। সে কিছু বলে না। শুধু শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে রাখে। ধীরে ধীরে চারা থেকে ধান গাছ হয়। সবুজে সবুজে ছেঁয়ে যায় সমগ্র। শুদ্ধ একটা কাকতাড়ুয়া বানিয়ে ধানক্ষেতের মাঝে বসায়। কাকতাড়ুয়ায় গায়ে শুদ্ধ'র একটা সাদা টিশার্ট পড়িয়ে দিয়ে ধারা সেখানে বড় বড় অক্ষরে লিখে দেয়, 'শুদ্ধ'র থেকে সাবধান'। ধারার কান্ড দেখে শুদ্ধ শুধু হাসে। একটা ছোটখাট সংসার বসে যায় তাদের, সেই ছোট্ট টিনের টং ঘরটিতে। হিমশীতল হাওয়ার সাথে সাথে হলুদ শর্ষে ফুলের মাঠ জুড়ে বইতে থাকে তাদের প্রেমের অবাধ হাওয়াও। কখনো হলুদ রঙে ছেঁয়ে যাওয়া মাঠ জুড়ে প্রজাপতির মতো চলতে থাকে তাদের খুনসুটি মাখা নিরন্তর ছোটাছুটি।
এমনই এক দিনের ঘটনা। ধান ক্ষেতের পাশে বসে শুদ্ধ কৃষি সম্পর্কিত একটা বই পড়ছিল। ধারা তখন কিছু রাজহাঁসকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে শুদ্ধ'র সামনে নিয়ে আসলো। বই বন্ধ করে শুদ্ধ বলল,
'কি করছো ধারা? যদি ঠোকর দেয়!'
ধারা একটা রাজহাঁস ধরে কোলে নিয়ে বলল,
'দিবে না। এদের সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ হয়ে গেছে।'
'তাই!'
'হুম।'
হাতের রাজহাঁসটা নিজের দিকে উঁচু করে ধারা বলতে লাগলো, 'বলো বলো হাসু বাবু, আমরা এখন ফ্রেন্ড না?'
শুদ্ধ বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে হেসে বলল, 'হাস্যকর!'
ধারা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
'ভালো। আমারটা তো তবুও হাস্যকর আর তোমারটা বিরক্তিকর।'
'কোনটা?'
'এই যে সারাদিন বই পড়াটা। হাসলে মানুষের হার্ট ভালো থাকে। বিরক্তি হওয়ায় কোন বেনিফিট পাওয়া যায় না। তাই তোমারটা চাইতে বেটারটা আমারই।'
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল, 'গুড লজিক! চালাক হয়ে গেছো বহুত।'
ধারা একটা ভাব নিয়ে বলল, 'আমি জানি।'
ধারা রাজহাঁসটির সাথে খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। শুদ্ধও একটা ধবধবে সাদা রাজহাঁস কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। নিজের হাতের রাজহাঁসকে ধারার দিকে বাড়াতেই সেটি তার লম্বা গলা বাড়িয়ে ধরলো ধারার দিকে। ধারা ভয় পেয়ে এক কদম পিছিয়ে গেলো। তা দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো শুদ্ধ। ধারা চোখ ছোট ছোট করে তার হাতের রাজহাঁসটিও শুদ্ধ'র দিকে বাড়ালো। শুদ্ধও একটু পেছালো। ধারা খিল খিল করে হেসে উঠলো। এরকম খানিক খুনসুটির পর ধারা ও'র হাতের ফোন নিয়ে ক্যামেরার টাইমার সেট করে বলল,
'আসো রাজহাঁসগুলোকে নিয়ে ছবি তুলি। কি সুন্দর! তুমি তোমারটা ধরে রাখবা। আমি আমারটা ধরে রাখবো।'
এই বলে একটা উঁচু জায়গা দেখে ফোন রেখে দিয়ে ধারা শুদ্ধ'র পাশে রাজহাঁস নিয়ে দাঁড়ালো। একটু ভালো মতো পোজ দিয়ে যখনই ঠিক হতে যাবে তখনই শুদ্ধ হঠাৎ নিজের কাঁধ দিয়ে ধারাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। ধারাও চোখ বড় বড় করে শুদ্ধকে একইভাবে ধাক্কা দেয়। একটার পর একটা দুজনের এমন ধাক্কাধাক্কির মাঝে শুদ্ধ হঠাৎ ধারার কাঁধে হাত রেখে তাকে নিজের একদম কাছে ঘেঁষে দাঁড় করায়। ধারা ভ্রু কুঁচকে শুদ্ধ'র দুষ্টুমি ভরা মুখটির দিকে তাকায়। একের পর এক এভাবেই তাদের খুনসুটি মাখা মুহুর্তগুলো ক্যামেরায় বন্দী হতে থাকে। ছবি তোলা শেষে একটা জলের ডোবার কাছে গিয়ে দুজনে হাতের রাজহাঁসগুলো উড়িয়ে ছেড়ে দিলো। রাজহাঁসগুলো তাদের শুভ্র ডানা ঝাপটে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে বেড়ালো। ধারা আগে আগে চলে যেতে লাগলে পেছন থেকে দৌঁড়ে গিয়ে ধারার কাঁধে হাত তুলে দিয়ে হাঁটতে লাগলো শুদ্ধ। মাঠ ভরা চারিদিকে এখন সর্ষে ফুলের ছড়াছড়ি। তার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় কিছু ফুল ছিঁড়ে শুদ্ধ ধারার কানে গুঁজে দিল। ধারা লাজুক হেসে শুদ্ধকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরাতেই আবারো ধারাকে ধরে ফেললো সে। পাশ দিয়ে খড়কুটোর স্তুপ নিয়ে যাওয়া একটা ইঞ্জিন চালিত গাড়ি দৌঁড়ে ধরে হাঁপিয়ে উঠে দুজনেই গা এলিয়ে দিয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। সাদা তুলোর পেজোর মতো মেঘ ভেসে বেড়ানো নীল আকাশের দিকে স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইলো তারা।
সময় গড়াতে লাগলো। শীত পেরিয়ে বসন্তের হাওয়ার গুঞ্জন শুরু হলো। সবুজ ধানের রং পাল্টে সোনালী রং ধারন করতে লাগলো। একসময় সেই সুদিন এসে ধরা দেয়। শুদ্ধ পেরে যায় যা সে করতে চেয়েছিল। অবশেষে একটা নতুন জাতের ধান সে উদ্ভাবন করে ফেলে। তার ক্ষেত উপচে ভরা, উচ্চ ফলনশীল ধান তারই সাক্ষ্য দেয়। সমগ্র গ্রামবাসীকে তাক লাগিয়ে দেয় সে ধান। এতো অল্প জায়গার মধ্যে এতো ঘন, এতো অধিক ফলনের ধান তারা আগে কখনো দেখেনি। অন্যন্যা ধানের শীষে যেখানে ১৫০-১৬০টি দানা থাকে সেখানে এই ধানের শীষে ৭০০-৭৫০ টির মতো দানা। মাত্র এক বিঘা জমিতেই ধান হবে ৪৩ মণের মতো। যা সাধারণ ধানের তুলনায় তিনগুণ। তারউপরে এই গাছ অন্যান্য গাছের তুলনায় অনেক শক্ত ও মজবুত। যার ফলে ঝড় বৃষ্টিতেও সহজে হেলে পড়ে না। পোকামাকড়ের সংক্রমণও খুব কম। আর অধিক ফলনশীল। কৃষকদের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। এতো বছর ধরে তারা ধান চাষ করে আসছে। এমনটা তো কখনো দেখেনি! শুদ্ধ'র আনন্দ আর দেখে কে! পুরো বাচ্চাদের মতো মাঠ ভরে নেচে, গেয়ে, খুশিতে লাফাতে থাকে সে। বারবার ধারার কাছে এসে দেখাতে থাকে সে পেরেছে। তার এতোদিনের পরিশ্রম সার্থক। খুশিতে ধারার চোখে পানি ভরে আসে। মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে শুধু শুদ্ধ'র পাগলামি দেখতে থাকে। শুদ্ধ'র উদ্ভাবিত সেই নতুন জাতের ধান তাদের জীবনের মোড় অভাবনীয় ভাবে ঘুরিয়ে দেয়।
চলবে,
[বি: দ্র: বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার এক কৃষকের উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের স্বরূপ এখানে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।]
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব-৩২
দূর দূরান্ত থেকে লোকজন শুদ্ধ'র ক্ষেতের ধান দেখতে আসলো। ধানের ফলন দেখে তারা সবাই বিস্মিত। খবর পেয়ে কৃষি বিভাগ থেকেও লোক আসলো। তারাও খুব প্রশংসা করলো। কিছু ধান সংগ্রহ করে পাঠানো হলো গবেষণাগারে। এ নিয়ে কিছু পত্র পত্রিকায় লেখালেখিও হলো। যেমনটা দেখা যাচ্ছে প্রতিবার এই ধানের ফলন যদি এমনই হয় তাহলে কৃষকদের জন্য ব্যাপক লাভজনক হবে এই ধান। উৎপাদনে খরচ কম। সারের অধিক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। খুবই উচ্চ ফলনশীল। ধান কাটার পর দেখা গেলো অনুমানের চাইতেও পরিমাণ বেশি। রান্না করে দেখলো এই ধানের ভাতও সুস্বাদু। অন্য চালের তুলনায় চিকন। শুদ্ধ ধান বিক্রি করে মাত্র এক বিঘাতেই পাঁচ লাখের মতো আয় করলো। মোট দেঢ় বিঘার মতো সে এই ধান চাষ করেছিলো। লাভ হলো প্রচুর। কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেলো। শুদ্ধ অনেকের মাঝে বিনা টাকায় ধানের বীজ দিতে লাগলো। সে চায় সবাই এই ধান লাগিয়ে সফল হোক। কৃষকদের দারিদ্র্যতা ঘুচে যাক। কৃষি অধিদপ্তর থেকেও এই পরিকল্পনা করা হলো। তারা ধান গবেষণায় পাঠিয়েছে। মোক্ষম ফলাফল আসলে তারা এই ব্যাপারে আরো বিশদ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তাদের এখন দেখার বিষয় এই ধান সব মৌসুমেই চাষ করা সম্ভব কিনা। আর প্রতিবারই এরকম বাম্পার ফলন হবে কিনা। যদিও এবার এই ধান চাষ তাদের পর্যবেক্ষণে ছিল না তাই ঠিক করা হলো পরেরবার শুদ্ধকে এই ধান আবারো চাষ করিয়ে তারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণে রাখবে। যদি ফলাফল আশাজনক ভাবে হয় তাহলে এই ধানের বীজ বাংলাদেশের সকল কৃষকদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে। আর এই ধান চাষের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। তার আগেই শুদ্ধ একটি কৃষি ক্লাব গঠন করে সপ্তাহে একদিন গ্রামের সাধারণ কৃষকদেরকে কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার আর অধিক ফলনের চাষাবাদের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে শেখাতে থাকে। শুদ্ধ'র নাম অনেকটা ছড়িয়ে যায়। অনেক স্থান থেকে ইন্টারভিউও নিতে আসা হলো তার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন শিক্ষিত যুবকের কৃষিতে হাত আর নতুন উদ্ভাবন সাধারণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেললো। সেবছর শুদ্ধ'র ফলের খামারেও ব্যাপক লাভ হলো। ব্যাংক থেকে নেওয়া লোন ধীরে ধীরে শোধ করে দিল সে। তার উপরে খানিক সঞ্চয়ও হতে লাগলো। সবাই বলতে লাগলো শুদ্ধ'র সোনার কপাল। কিন্তু এই সোনার কপাল অর্জনের পেছনে কতোটা আত্মত্যাগ আর পরিশ্রমের ছাপ আছে তা বোধগম্য হলো খুব কম লোকেরই। এরপরের সময়গুলো খুব দ্রুত কাটতে লাগলো। এর মাঝে অনেককিছুই পরিবর্তন হলো। পরিবর্তন হলো তাদের জীবনধারাও। গ্রামে তাদের সেই দোচালা ঘর পুরনো হতে হতে একসময় থাকার অযোগ্য হয়ে পড়লো। শহুরে শাখায় সেই সময় শুদ্ধ'র কাজের চাপও ভীষণ বাড়তে লাগলো। ধারার কলেজে যেতে সুবিধা আর শুদ্ধ'র কাজ সবকিছু সার্বিক বিবেচনায় নিয়েই তারা মূল শহরের মধ্যে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলো। শুদ্ধ'র মস্তিষ্ক তুখোড়। সাথে সে প্রচন্ড পরিশ্রমীও। কাজ এবং কাজের পদ্ধতি দুটোই সে ভালোমতো বোঝে। তার বিচক্ষণ ভাবনার সাথে সে সঠিক পন্থাই অবলম্বন করতে থাকে। আস্তে আস্তে তার কাজের পরিধি বাড়তে লাগলো। লাভের অংশ দিয়ে সে ফলের খামারের পরিসর আরও বৃদ্ধি করলো। আরও নানাজাতের ফলের চাষ বাড়ালো সেই সাথে আরও লোক নিয়োগ করলো। বিচক্ষণতার সাথে অর্থের সঠিক প্রয়োগ ঘটানো শুদ্ধ জানতো। তথাপি শুধু লাভ বৈকি আর ক্ষতি তার হলো না। এরপর সে নিজের পুঁজি আর ব্যাংক থেকে আরও কিছু লোন তুলে সে তার খামারের টাটকা ফলের রস প্যাকেটজাত করার একটি ছোটখাট ফ্যাক্টরি তৈরির সিদ্ধান্ত নিল। যেখানে কোন ভেজাল মেশানো হবে না। দেশের মানুষ যেন নির্ভেজাল বিশুদ্ধ ফলের রস গ্রহণ করতে পারে সেই সম্পূর্ণ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই মুহুর্তে একা তার পক্ষে এতো বড় উদ্যেগ নেওয়া সম্ভব না। তাই সে অন্য একজনের সাথে শেয়ারে এই প্রজেক্টে নামার প্রস্তুতি নেয়। আর সেই অন্য একজন আর কেউ নয় বরং ধারার ছোট চাচা শাহেদ। সেদিনের পর থেকে সময়ের সাথে সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কে সব ঠিক যায়। যেই শাহেদ শুদ্ধ'র পরিকল্পনাকে নিছক বেকুবের কাজ ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবতো না, এখন সেই শাহেদই শুদ্ধ'র কাজের গতি আর সাফল্য দেখে নিজ থেকেই সেধে শুদ্ধ'র ফ্যাক্টরিতে থার্টি পার্সেন্ট শেয়ার হিসেবে থাকার অফার দেয়। শুদ্ধও মুচকি হেসে পেছনের সব ভুলে সব স্বাভাবিক করে নেয়। একটার পর একটা সুযোগ এসে শুদ্ধ'র হাতে ধরা দিতে থাকে। সাফল্য ত্বরান্বিত হয়। এরপরে কেটে যায় আরো একটি বছর।
__________________________________________
সিএনজি থামতেই ধারা মাথা বের করে আশপাশটা দেখে নিলো। আকাশ আজকে একদম ঝকঝকে। মেঘের ছিটেফোটাও নেই। রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সুন্দর। আর সুন্দর হবেই বা না কেন? আজ যে ধারার জীবনের একটা বিশেষ দিন। আজ তারা তাদের নতুন বাসায় উঠবে। অবশেষে শহরের মাঝে তাদের সম্পূর্ণ নিজের একটা বাসা হয়েছে। শুদ্ধ'র পরিশ্রমের টাকায় কেনা নতুন ফ্লাট। তাদের নতুন ঠিকানা। ধারা সিএনজি থেকে নেমে দাঁড়ায়। তার পরনে ধবধবে সাদা রঙের সেলোয়ার কামিজ আর গাড় নীল রঙের ভারী ওড়না। চোখের সামনের লোহার গেইট টার পরেই ছয় তলায় একটা বিশাল বিল্ডিং। তার ঠিক চার তলাতেই ধারাদের ফ্লাট। শুদ্ধ বলেছে। ধারা হাত উঠিয়ে অনুমান করে ঠিক এই অংশটুকুতেই হয়তো তাদের ফ্লাটটা হবে। বিল্ডিংটা এতো সুন্দর। নিশ্চয়ই তাদের ফ্লাট আরো সুন্দর হবে। চুমকি আর খোদেজা ইতিমধ্যেই লোহার গেইটের মধ্যে ঢুকে গেছে। শুদ্ধ ঢুকতে গিয়ে দেখে ধারা না এসে উপরে তাকিয়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুদ্ধ গিয়ে ধারার হাত ধরে টেনে তার সম্বিৎ ফিরিয়ে দ্রুত ভেতরে নিয়ে যায়। লিফট দিয়ে চার তলায় পৌঁছানোর পর তারা সবাই বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মালপত্র আগেই নিয়ে আসা হয়েছে। শুধু তাদের আসাই বাকি ছিল। শুদ্ধ চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেয়। ভেতরের দিকে তাকিয়ে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। সব ঝকঝকে, নতুন। একদম পরিপাটি ভাবে সাজানো। মেঝের সাদা টাইলসগুলো গ্লাসের মতো চকচক করছে। বাসা সবারই খুব পছন্দ হয়। শুদ্ধ এতদিন কাউকে আসতে দেয়নি। একেবারে সব একসাথে দেখাবে বলে। খোদেজা আল্লাহ'র নাম নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলে চুমকিও উৎফুল্ল হয়ে লাফাতে লাফাতে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ধারা যখনই ভেতরে যাবার জন্য এক পা বাড়াতে যাবে তার আগেই শুদ্ধ হাত ধরে আটকে দেয়। ধারা অবাক হয়ে তাকাতেই শুদ্ধ মিষ্টি করে হেসে বলে,
'এভাবে না। একসাথে। ডান পা আগে দিবা আর বিসমিল্লাহ বইলো।'
ধারা মৃদু হেসে শুদ্ধ'র হাত ধরে। তারপর বিসমিল্লাহ বলে দুজনে একসাথে পা বাড়ায়, তাদের নতুন ঠিকানায়, নতুন যাত্রায়। ভেতরে ঢুকে ধারা আনন্দের সাথে বাসার আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে সোফা সেট বসানো। ভেতরে চারটা বেডরুম। একটা গেস্টরুম। মাঝে ডাইনিং হল। আর একটা সুন্দর রান্নাঘর। ধারা একটু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়। এতদিন সেই দু কামরার ভাড়া বাসায় থাকতে তার দম বন্ধের মতো লাগতো। গ্রামে অর্ধপাকা পুরনো ঘর থাকলেও ভেতরে খোলামেলা ছিল। যখন তখন বাইরে বরে হতো। তাজা হাওয়া নিতো। সেখানের ব্যাপারটাই ছিল আলাদা। এরপর তাদের যেতে হয় শহরের ভাড়া বাসায়। সেখানে জায়গাও ছিল কম। আর গ্রামের মতো ওমন বেরও হওয়া যেত না। সর্বক্ষণ ঘরের মধ্যেই ধাকতে হতো। গ্রামের সেই বাড়িটাকে ধারা ভীষণ মিস করতো। গ্রামের সেই সুন্দর দিনগুলোও স্মৃতিতে এসে তাকে উদাস করে তুলতো। শুধু ভাবতো আবার কবে ফিরে যাবে সেখানে। ফিরে যাবার অপেক্ষায় ধারা অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতো। কিন্তু জীবনের তাগিদেই তাদের আর সেখানে ফেরা হয় না। জীবন চলমান। আর প্রচন্ড পরিবর্তনশীল। আমাদের অগোচরেই ইচ্ছার বিপরীতে কখন কোন পরিবর্তন স্থায়ীভাবে ঘটে যায় আমরা টেরও পাই না। শুধু হঠাৎ করে ঠাওর হলে অবাক হয়ে রই। ধারা ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর আবার মাথা থেকে মন খারাপের সব কথা ঝেড়ে ফেলে। আজ সে ভীষণ খুশি। কারণ এই বাসাটাও খুব স্পেশাল। শুদ্ধ'র নিজের অর্জনের প্রতিচ্ছবি এটি। তাদের নিজেদের বাসা। গ্রামের বাড়িটাও তাদের হলেও সেটা ছিল দাদা শ্বশুর আমলের বাড়ি। আর তারপরেরটা তো ছিল ভাড়া বাসাই। কিন্তু এইবারের টার অনুভূতিই আলাদা। শুদ্ধ'র নিজের টাকায় কেনা এটা তাদের বাসা। চোখের সামনে একটু একটু করে গড়ে উঠা এই গৃহ। এই অনুভূতি...বর্ণনাতীত।
মালপত্র আগের থেকে এনে গোছানো হলেও অনেককিছুই আবার গোছানোর মতো থেকে যায়। নতুন বাসায় কাজ কি কম! ধারা কোমরে ওড়না বেঁধে সব ঠিক করতে নেমে যায়। এতদিনে সেও পাকা গৃহিণীর মতো হয়ে গেছে। সেই নড়বড়ে অপটু ধারা নিজের সংসার এখন নিজেই সামলায়। খোদেজার এখন এতে একটু বিশ্রাম হয়। ধারা সেই সারাটাদিন ধরে সব গোছগাছ করে। খোদেজাও সাথে সাহায্য করে। সব ঠিকঠাক হতে হতে রাত হয়ে যায়। সব কাজ শেষ হলে ক্লান্ত হয়ে নিজের বেডরুমে ঢোকে ধারা। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় আয়েশ করে বসতেই হালকা গোলাপি রঙের একটা ফর্মাল শার্ট প্যান্ট গায়ে শুদ্ধ আসে। তার হাতে কিছু একটা প্যাকেটের মতো দেখা যায়। ভেতরে এসেই আশেপাশে চোখ বুলিয়ে শুদ্ধ বলতে থাকে,
'কি দরকার ছিল তোমার এসব করার? আমি সারাদিন বাইরে ছিলাম। তুমি শুধু শুধু একা একা এগুলো করতে গেলে কেন? একটা লোক রেখেই তো করানো যেতো।'
ধারা বিছানায় হেলান দিয়ে বলল,
'নিজেদের কাজ করতে আবার লোক রাখতে হবে কেন? আর আমি তো সব একা করিনি। মাও সাহায্য করেছে।'
শুদ্ধ বিছানায় বসতে বসতে বলল,
'খেয়েছো কিছু?'
ধারা মাথা নাড়ালো। হাতের প্যাকেটটা খুলতে খুলতে শুদ্ধ বলল, 'জানতাম এই শুনবো। বিরিয়ানী নিয়ে এসেছি। তোমার না পছন্দ! হা করো।'
ধারা মিটিমিটি হেসে মুখ হা করলো। শুদ্ধ নিজের হাতে একটু একটু করে ধারাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। খাওয়ার মাঝখানে শুদ্ধ বলল,
'এতটুকু কি হা করো! বড় করে হা করো।'
শুদ্ধ'র কথামতো ধারা বড় করে হা করলো। খাবার ধারার মুখে দিতেই ধারা একটা কামড় দিলো শুদ্ধ'র আঙ্গুলে। আচমকা এমন হওয়ায় শুদ্ধ আঁ করে চেঁচিয়ে উঠলো। ধারা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। শুদ্ধ বাম হাত থেকে বিরিয়ানীর প্যাকেট বিছানায় রেখে 'তবে রে' বলে ধারাকে কাতুকুতু দিতে থাকে। ধারা হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ে। একসময় খাওয়া শেষ হলে হাত ধুয়ে এসে শুদ্ধ আবারো ধারার সামনে বিছানায় বসে। সেই প্যাকেটটা আবারো টেনে নিয়ে ধারাকে বলে তোমার হাতটা দাও তো। ধারা মজা করে বলে,
'কিভাবে দেবো? কেটে?'
'আমি মজা করছি না। সিরিয়াস।'
ধারা হাসি সংযত করে শুদ্ধ'র দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। শুদ্ধ প্যাকেট থেকে একটা লাল রঙের বক্স বের করে তার মধ্য থেকে দুটো সোনার বালা বের করে ধারার দুই হাতে পড়িয়ে দেয়। ধারা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,
'এগুলো কি?'
শুদ্ধ স্বাভাবিক স্বরে বলে, 'চুড়ি।'
'সোনার?'
শুদ্ধ মৃদু হেসে বলে,
'না রূপার।'
'আমি মজা করছি না। সিরিয়াস।'
'আমিও সিরিয়াস।'
'তুমি কিনেছো?'
'না আমাদের পাশার বাসার ভাই কিনে দেয়েছে।'
ধারা মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করলো। ধারার দেখাদেখি শুদ্ধও অবিকল তেমন শব্দ করলো। ধারা বলল,
'কবে কিনলে?'
'আজকে।'
'এটা কিনতেই বাইরে গিয়েছিলে?'
'হুম।'
ধারা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বলল, 'শুধু শুধু এখন এই সোনার চুড়ি কিনতে গেলে কেন? কতো দাম হবে! এমনিতেই নতুন ফ্লাট রেখেছো। তোমার ফ্যাক্টরিও সবেই চালু হলো। তারউপরে তোমার ব্যাংকের লোন এখনো বাকি। তা শোধ না করেই আগে ফ্লাট কিনে ফেললে। এখন আবার এসব...কি দরকার ছিল!'
শুদ্ধ ধারার হাত ধরে স্পষ্ট গলায় বললো,
'দরকার ছিল। তার জন্যই কিনেছি। একটা নিজের ঘরের যেমন প্রয়োজন ছিল তেমনই প্রয়োজন ছিল নিজের বউয়ের অলংকার কেনার। আমার জন্য দুটোর গুরুত্বই এক। তোমাকে বিয়ের সময় তেমন কিছুই দিতে পারিনি। নতুন নতুন বিয়ের পর মেয়েরা কতোকিছু কিনে, একের পর এক নতুন ড্রেস কিনে, সাজসরঞ্জামের জিনিস কিনে। কিন্তু তোমাকে আমি তেমন কিছুই দিতে পারতাম না। তোমার কোন শখ আহ্লাদই আমি তেমন পূরণ করতে পারিনি। তুমিও কখনো এর জন্য কোন অভিযোগ করোনি৷ কখনো মুখ ফুটে কিছু বলোনি আমার এটা লাগবে ওটা লাগবে।'
কথাটা বলতে বলতে শুদ্ধ'র কেমন গলা ধরে এলো। শুদ্ধ'র কথার মাঝেই ধারা বাধা দিয়ে বলে উঠলো,
'কারণ তুমি আমাকে কখনো সেই সুযোগই দাওনি। আমার যা যা প্রয়োজন ছিল সব না বলতেই তো তুমি এনে দিতে।'
শুদ্ধ মাথা নাড়িয়ে বলল, 'ওতটুকুতে কিছু হয় না। তোমাকে ওভাবে দেখতে আমার কতো খারাপ লাগতো জানো? আমার তখন ছিল না। এখন যখন আছে, এখন যখন পারছি, আমাকে করতে দাও। আমি করতে চাই। আমার বউকে আমি সব কিছু দিয়ে সাজিয়ে রাখতে চাই। তুমি বারণ করতে পারবে না। বারণ করলেও আমি শুনবো না। এটা আমার শখ। আমার ইচ্ছা।'
ধারার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে বলল,
'জানো, এই পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে সুখী মেয়ে আমি। আমার থেকে বেশি সুখী আর কোন মেয়ে হতে পারবে না। কারণ কোন মেয়ে আরেকটা শুদ্ধ পাবে না।'
শুদ্ধ হেসে ফেললো। ধারার হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল,
'তুমি চিন্তা করো না ধারা। লোন আমি আস্তে আস্তে শোধ করে ফেলতে পারবো। প্রোফিট হচ্ছে। আর ফ্লাট আগে একারণেই কিনেছি কারণ ভাড়া বাসায় তোমাদের সবার কষ্ট হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম। তাই টাকা জমতেই কিনে ফেলেছি। লোনেরও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।'
ধারা উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার হাত নেড়ে নেড়ে সোনার চুড়ি দেখতে লাগলো। শুদ্ধ পেছন থেকে দেখতে লাগলো সেই দৃশ্য। জানালার কাছে গিয়ে ধারা চাঁদের দিকে মুখ করে দু হাত উঁচু করে ধরলো। শুদ্ধ এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
'কি করছো?'
ধারা বলল, 'চাঁদের আলোতে দেখছি কেমন লাগে। চাঁদটা কতো সুন্দর লাগে তাই না!'
শুদ্ধ পেছন থেকে ধারাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে থুতনি রেখে বলল, 'ইশ, কে বলেছে! আমার বউয়ের থেকে বেশি না।'
ধারা লজ্জা পেয়ে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে রইলো। খানিক পর শুদ্ধ বলল, 'আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পড়। এমনিতেই আজকে তোমার অনেক খাটাখাটনি গেছে। তোমার না কয় দিন পর একটা এক্সাম আছে? সিট পড়েছে এইবার কোথায়?'
ধারা যেই কলেজের নাম বলল তা শুদ্ধ শুনে বলল, 'এটা তো আমাদের এখান থেকে অনেক দূরে। পরীক্ষা শেষ হবার পর আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে। আচ্ছা তুমি পরীক্ষা দিতে যেয়ো। আসার সময় আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।'
ধারা মাথা দুলালো।
ধারার পরীক্ষার দিন এসে পড়লে সেদিন শুদ্ধ তার কাজে আটকা পড়ে গেলো। তবুও ঝটপট কাজ শেষ করে পরীক্ষার কেন্দ্রে পৌঁছাতে তার একটু দেরি হয়ে যায়। তখনও সেখানে কিছু শিক্ষার্থী বাসায় ফেরার তোর জোড় করছিলো। মোটামুটি মানুষ ছিল। শুদ্ধ ভেবে নিলো তার মধ্যে ধারাও আছে। চারিদিকে একটু একটু করে অন্ধকার নামতে শুরু করলো। শুদ্ধ ধারাকে পেলো না। বিশাল বড় ক্যাম্পাস। সে ভাবলো অন্য কোথাও আছে। খুঁজে দেখলো তবুও পেলো না। ফোন করে দেখে ফোন বন্ধ। শুদ্ধ'র খানিক অস্থির বোধ হলো। এদিকে মাগরেবের আযান পড়ে গেছে। আস্তে আস্তে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেলো। শুদ্ধ আরও দুই ঘন্টা যাবৎ পুরো ক্যাম্পাস তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। ধারাকে আর পেলো না মানে পেলোই না। শুদ্ধর বুকের মধ্যে ধড়ফড় করতে লাগলো।
চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব-৩৩
আরেকটু খোঁজাখুঁজির পর শুদ্ধ শঙ্কিত মনে বাসায় ফিরে এলো। তার মাথা ভীষণ ঘামছে৷ কি করবে বুঝতে পারছে না। দরজা খোলাই ছিল। অবিশ্রান্ত শরীর নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো সোফায় বসে টিভিতে একটা কমেডি শো দেখে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে ধারা। শুদ্ধ'র শিরদাঁড়া বেঁয়ে একটা স্বস্তির অনুভুতি বয়ে গেলো। পরক্ষনেই তার প্রচন্ড রাগ হলো৷ সে শক্ত মুখ করে ধারার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
'ধারা, ভেতরে আসো।'
শুদ্ধ'র আওয়াজ পেয়ে পাশে ঘুরে ধারা কিছু বলার আগেই শুদ্ধ গটগট করে নিজের রুমে চলে গেলো। পেছন পেছন গেলো ধারাও। ধারা রুমে ঢুকতেই শুদ্ধ দরজা ভিজিয়ে দিয়ে থম ধরা গলায় ধারাকে প্রশ্ন করলো,
'তুমি বাসায় আসছো কখন?'
ধারা স্মিত হেসে বলল, 'সন্ধ্যার একটু পরেই। অনেকক্ষণ হয়েছে।'
শুদ্ধ গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলল,
'তোমাকে যে আমি বলছিলাম আমি তোমাকে নিতে আসবো সেটা কি তোমার মনে ছিল না?'
ধারা নরম গলায় বলল, 'তোমার আসতে দেরি হচ্ছিল। তাই আমি ভাবলাম তুমি আর আসবে না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছিল আর কতগুলো মেয়েও আমাদের এখানের ছিল। তাই তাদের সাথে আমিও চলে এসেছি।'
'মাত্র ত্রিশ মিনিটের মতো কি দেরি হলো আর তুমি নিজে নিজে ভেবে নিলে আমি আসবো না! তুমি জানো তোমার কলেজে গিয়ে আজ দুই ঘন্টা যাবৎ আমি কিভাবে খুঁজেছি! আমার কতো টেনশন হচ্ছিল!'
'শুদ্ধ, আমি ইচ্ছে করে তো আর কিছু করিনি। পরিস্থিতিতে এমন হয়ে গেছে। আর.....
ধারার কথায় শুদ্ধ বাঁধা দিয়ে বলল,
'কথার মাঝে কথা বলবে না। আগে আমার কথা শেষ করতে দাও।'
'কথা না বললে আমি নিজেরটা এক্সপ্লেইন করবো কিভাবে?'
শুদ্ধ খুব চেচাঁমেচি করতে লাগলো। ধারা বিরক্ত হয়ে বলল, 'শুদ্ধ আস্তে কথা বলো৷ মা শুনবে।'
শুদ্ধ নিজের মতো করেই বলে যেতে লাগলো,
'তুমি আমার জন্য দাঁড়ালে না কেন?'
'বললাম না, আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না। আজকাল তো আবার তুমি খুব বেশি ব্যস্ত থাকো। তোমার কোন সময়ই হয় না।'
'হ্যাঁ থাকি ব্যস্ত। কাজের জন্যই থাকি। অকাজে তো আর থাকি না। তাই বলে কি কখনো এমন হয়েছে তোমার কাছে আসার কথা বলেছি কিন্তু আসিনি? শুধু শুধু তো একটা পিন্চ মারা কথা বলে দিলে। আমি যে আজকে দু ঘন্টা যাবৎ কিরকম অবস্থায় পড়েছিলাম সেটা তো আর তুমি বুঝবে না।'
'তুমি কিন্তু এখন ওভাররিয়্যাক্ট করছো!'
'আমি ওভাররিয়্যাক্ট করছি! আর তুমি কি করেছো? বাসায় যখন একা একাই আসছিলে আমাকে ফোন করে তা জানালে না কেন?'
ধারা মুখ ভার করে বলল,
'আমি ফোন নিয়ে যাইনি।'
'বাহ! ফোন নিয়ে যাওনি! তাহলে ফোনটা সাথে রাখো কেন? যখন দরকারে পাওয়াই যাবে না। আমি কতবার কল করছি জানো? ফোন নাও তো নাওনি আবার বন্ধ করেও রেখে গেছো।'
'চালু করে রাখলেও আর কি হতো? চুমকি গেছে বেড়াতে। মা স্মার্ট ফোন রিসিভ করতে পারে না। বাজলে শুধু শুধু অস্থির হতো। তাই বন্ধ করে রেখেছিলাম।'
'তাহলে বাসায় আসার পর ফোন অন করে জানালে না কেন?
'তোমাকে কল করিনি? একশোবার কল করে ফেলেছি। তোমার নিজের ফোনই তো বন্ধ।'
শুদ্ধ জোর গলায় বলল, 'অসম্ভব। আমার ফোন আমি সবসময় অন রাখি। তোমার মতো অফ করে রেখে মানুষকে টেনশনে ফেলি না। এখনও অন ই আছে।'
এই বলে ধারাকে দেখানোর জন্য শুদ্ধ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো ফোন সত্যিই বন্ধ। চার্জ শেষ হয়ে কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। শুদ্ধ টেনশনের মধ্যে আর খেয়াল করেনি। ধারার কথাই সত্যি দেখে শুদ্ধ খানিক মিইয়ে গেলো। ধারা সেদিকে তাকিয়ে হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, 'খুব তো চেঁচাচ্ছিলে! এখন দোষটা কার। শুধু কি আমারই? এবার বুঝলে দোষটা কার!'
শুদ্ধ খানিক ইতস্তত করে দূর্বল না হয়ে বলল, 'এখন এতটুকুতেই আমার দোষ হয়ে গেলো? দোষটা তোমার।'
ধারাও পুরো ক্ষেপে গিয়ে বলতে লাগলো,
'তোমার দোষ।'
'না তোমার দোষ।'
'তোমার দোষ।'
শুদ্ধ বলল, 'এখন তো স্বীকার করবেই না। আমার আজকে কি অবস্থা হয়েছিল তা আমিই জানি। আমার জায়গায় তুমি থাকলে না সেখানেই অজ্ঞান হয়ে থাকতে।'
'আমার অজ্ঞান হওয়া নিয়ে আর কিছু বলবে না।'
'আমি তো বলবোই।'
ধারা আরো কাছে এগিয়ে বলল, 'ভালো হবে না বলে দিচ্ছি! আর একবার বললে কিন্তু আমি তোমাকে.....
শুদ্ধ এক পা এক পা করে এগিয়ে এগিয়ে ধারাকে পেছনে নিতে নিতে বলল, 'কি করবে? বলো কি করবো?'
ধারা বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না। আমতা আমতা করতে লাগলো। শুদ্ধ'র মুখে বিজয়ের হাসি ফুটতে শুরু করলো। ধারা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জোরে শ্বাস টেনে বলল,
'তোমার সাথে কথা বলার কোন মানে হয় না।'
'ওকে, আমার সাথে আর কথা বলবা না?'
'আচ্ছা, মনে থাকে যেন।'
এই বলে ধারা পেছনে মুখ ঘুরে দাঁড়ালো। শুদ্ধও নিজের মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
রাতের বেলা খাবার সময় হলে সবাই ডাইনিং টেবিলে বসলো। সবাই বলতে শুদ্ধ, ধারা আর খোদেজা। শুদ্ধ আর ধারা আজ পাশাপাশি বসেনি। বসেছে একে অপরের বিপরীত প্রান্তে। মুখোমুখি। দুজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। দুজনেই রাগে গজ গজ করছে। খোদেজা চুপচাপ খেতে লাগলো। খেয়াল করলো খাবারের সময়ে আজ পরিবেশটা অন্য দিনের তুলনায় একদম শব্দশুন্য। কারো মুখেই কোন কথা নেই। নয়তো অন্য দিন তো দুজনে কতো হাসি মজা করে। আজ পুরো ভিন্ন। খাবারেও দুজনের মন নেই। একটু খাচ্ছে আবার শুধু নাড়াচাড়া করছে আর একটু পর পর শুধু একে অপরের দিকে রাগী চোখে তাকাচ্ছে। মূল ধ্যান মূলত তাদের সেখানেই। খোদেজা বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। তাই সেও আর কোন কথা না বলে চুপচাপ নিজের খাবার খেয়ে প্লেট রান্নাঘরে নিয়ে রাখতে গেলো। খোদেজা যাবার পর শুদ্ধ পানি ঢালার জন্য জগ কাত করতেই বেখেয়াল বশত পানি ছিটকে পড়লো তার কোলে। শুদ্ধ থতমত খেয়ে উঠলো। ধারা নিজের খাবারের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে করে হেসে উঠলো। শুদ্ধ থম মেরে বলল,
'তুমি হাসলে কেন?'
ধারা শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে বলল,
'আমার মুখ, আমার হাসি, আমার ইচ্ছা।'
এই বলে আরও শব্দ করে হাসতে লাগলো ধারা।
শুদ্ধ দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো। কিছু খাবার প্রায় শেষের দিকে। একটি বাটিতে এক পিছ বেগুন ভাজা অবশিষ্ট ছিল। ধারা নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো। অনভ্যাস বশত শুদ্ধও সেদিকে হাত বাড়িয়ে ফেললো। দুজনের হাত একসাথেই পড়লো বাটিতে। শুদ্ধ বলল,
'আমি আগে হাত দিয়েছি। তুমি বাড়ালে কেন? বেগুন ভাজা আমি নেবো।'
'ইশ! বললেই হলো! আমি আগে হাত দিয়েছি। তাই আমি নেবো।'
ধারা নিজের দিকে বাটি টেনে নিলো। শুদ্ধও আবার বাটি নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
'আগে হাত আমার গেছে। বাটি ছিল মাঝখানে। তোমার হাতের চাইতে আমার হাত লম্বা। দুজনে যদি একসাথেও বাড়িয়ে থাকি লজিক্যালি আমার হাতই আগে যাবে। অতএব বেগুন ভাজা আমার।'
'তুমি না বেগুন খাও না! বেগুন খেলে তোমার শরীরে চুলকানি হয়।'
সত্যি বলতে শুদ্ধ ভুলেই গিয়েছিল যে তার বেগুন খেলে চুলকায়। ধারার কথায় খেয়াল হলো। কিন্তু এখন এতদূর এসে হেরে যাওয়াও তো যায় না। তাই নিজের গাঁট বজায় রেখে বলল,
'আমার শরীর নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমারটা আমি বুঝবো। এমনিতেও চোখের সামনে কতো চুলকানি সহ্য করি। বেগুনের চুলকানিতে আর কি!'
শুদ্ধ যে কথাটা ধারাকে মিন করে বলেছে তা অনুধাবন করতে পেরে ধারার মুখ হা হয়ে গেলো। সে বিস্ফোরিত মুখে বলল,
'আমি চুলকানি!'
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল, 'যাক! তোমার বোঝার লেভেলটা অন্তত ভালো।'
ধারা রান্নাঘরের দিকে মুখ করে বিচার দেওয়ার ভঙ্গিতে কাঁদো কাঁদো মুখ করে জোরে ডেকে উঠলো,
'মা!'
শুদ্ধ বলে উঠলো, 'হ্যাঁ! কিছু হলে তো শুধু এটাই পারো। ম্যাঁ!'
শুদ্ধ ধারার মতো করে মুখ ভেঙিয়ে ডেকে দেখালো। ধারা রাগে গজগজ করতে করতে বলল, 'এমন করছো না! এখন এই বেগুন আমিই খাবো।'
ধারা বাটি টেনে ধরলো। শুদ্ধও বাটি টেনে ধরে বলল, 'কোনদিনও না। আমি খাবো।'
দুজনে বাটি ধরে টানাটানি করে চেঁচাতে লাগলো। খোদেজা তখন ওদের মাঝখান থেকে বাটিটা উঠিয়ে নিয়ে বলল,
'কি শুরু করলি তোরা? কতক্ষণ ধইরা সহ্য করতাছি। একটু প্লেট ধুইতে রান্নাঘরে গিয়া আর টিকতে পারলাম না। তোদের দুজনের কারোরই খাওয়া লাগবো না। এই বেগুন ভাজা আমিই নিয়ে গেলাম।'
খোদেজা বেগুন নিয়ে গেলে দুজনেই হা করে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর আবার একে অপরের দিকে চোখ পড়তেই দুজনের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।
ধীরে ধীরে ঘড়ির কাটা এগোতে লাগলো। রাত হলো গভীর। নিঝুম। নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। ধারা আর শুদ্ধ ঘুমানোর জন্য বিছানায় উঠে দুজনে দুজনকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চাদর টেনে বিছানার দু প্রান্তে শুয়ে রইলো। কেউ কারো দিকে ফিরেও তাকালো না। তারপর শুরু হলো তাদের চাদর নিয়ে টানাটানি। ধারা এই নিজের দিকে চাদর টেনে নেয়। আবার শুদ্ধও ছাড়ে না। শক্ত করে ধরে রাখে। দুজনে দাঁত খিচে চাদর নিয়ে যুদ্ধ শুরু করলো। কেউ কারো থেকে কম না। একসময় শুদ্ধ জোরে চাদর নিয়ে টান দিতেই ধারার হাত হঠাৎ আলগা হয়ে গেলো। ফলস্বরূপ আচমকা চাদর নিয়ে বিছানা ছেড়ে নিচে পড়ে গেলো শুদ্ধ। ধারা উঠে বসলো। শুদ্ধ নিজেকে ধাতস্থ করে মেঝে থেকে উঠে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে বলল,
'এটা কি হলো?'
'কি হলো?'
'তুমি ভালো মতো শোও না কেন? শুধু নড়াচড়া করো।'
'আমি নড়াচড়া করি? নড়াচড়া করার মতো জায়গাটা কোথায়? এমনিতেও তো জায়গা পাই না। এতো বড় খাট তবুও সব জায়গা তো তুমিই দখল করে রাখো। এই যে এই এতটুকু জায়গার মধ্যে আমাকে শুতে হয়।'
'আচ্ছা! আর ঘুমানোর পর যে তুমি আমার উপর ঠ্যাং তুলে রাখো তার বেলা?'
'আর তুমি যে শুধু নাক ডাকো তার বেলা?'
শুদ্ধ বিছানায় উঠে তেড়ে এসে বলল,
'একদম মিথ্যা কথা বলবে না।'
ধারাও পুরো তেজের সাথে বলে,
'মিথ্যা হলে হোক, আমি তো একশোবার বলবো।'
'তাহলে আমিও বানিয়ে বলবো তুমি ঘুমের মধ্যে মুখের লালা দিয়ে বিছানা ভাসিয়ে ফেলো। ছি! ছি! মানুষ শুনলে কি বলবে!'
ধারা রাগে দুঃখে জ্বলে উঠে বলল, 'ভালো হবে না কিন্তু!'
'অবশ্যই ভালো হবে।'
ওদের কথা কাটাকাটির মাঝে হঠাৎ খোদেজা রুমের দরজা খুলে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
'আহ! থামবি তোরা! তোদের চেঁচামেচিতে ঘরে থাকা যাইতাছে না। ঘুমাবো কেমনে?'
খোদেজার ধমকে দুজনেই পুরো ভেজা বিড়ালের মতো চুপসে রইলো। চেহারায় নির্দোষ নির্দোষ ভাব ফুটিয়ে রইলো তারা। শুদ্ধ বলল,
'সরি আম্মা। ধারা এতো জোরে জোরে কথা বলছিল যে যার কারণে তোমার এমন লেগেছে। আর হবে না।'
ধারা মুখ হা করে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে আবার খোদেজাকে বলল, 'হ্যাঁ মা, আর হবে না। শুদ্ধকে আমি বুঝিয়ে দেবো। শুধু শুধু সে চেঁচামেচি করে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো।'
শুদ্ধ বলল, 'আমি চেঁচামেচি করেছি নাকি তুমি করেছো?'
'জ্বি না। তুমি করেছো।'
'না তুমি করেছো।'
খোদেজা আবারও মাথায় দু পাশে হাত উঠিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
'চুপ! আর একটা কথাও কেউ বলবি না। নয়তো এখন আমার থেকে খারাপ কেউ হইবো না। তোদের দুইজনের আজকে হইছে কি বলতো? তোদের একসাথেই রাখা যাইবো না। তাইলে তোরা নিজেদের ঘুম তো বাদ আর আমারেও ঘুমাতে দিবি না। হ্যাঁ রে মাহতাব, আজকে তোরও কি হইছে বলতো? তুইও কি পোলাপান হইয়া গেলি। আমি বউরে নিয়া যাইতাছি। এখন থিকা বউ আমার কাছেই ঘুমাবো। একসাথে হইলেই তোগো খালি ঝগড়া আর ঝগড়া। এখন আলাদা থাইকা শান্তিতে থাক।'
খোদেজার কথা শুনে ওদের দুজনেরই মুখের হাওয়া বেড়িয়ে গেলো। দুজনে কিছু বুঝে উঠার আগেই খোদেজা ধারার হাত ধরে নিজের সাথে নিয়ে গেলো। ধারাকে নিয়ে গেলে শুদ্ধ একটু উপরে উপরে ভালো থাকার ভাব ধরে বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর বারবারই শুধু নড়াচড়া করতে লাগলো সে। উঠে বসলো। পানি খেলো। তারপর আবার শুয়ে পড়লো। একশোবার এপাশ ওপাশ করেও আর ঘুম আসলো না। বারবার শুধু চোখ যেতে লাগলো দরজার বাইরে, খোদেজার রুমের দিকে।
চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব -৩৪
ঘড়ির কাটা বারোটার ঘরে ছুঁই ছুঁই। নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। রাস্তায় একটি কালো বিড়ালের মিঁউ মিঁউ ডাক ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। এমন সময় একটা লম্বাকৃতির কালো ছায়া খোদেজার রুমের বাইরে দেখা যায়। ছায়াটা খুবই আস্তে আস্তে দরজার কাছে এগোতে থাকে। ছায়াটা মূলত শুদ্ধ'র। পা টিপে টিপে মায়ের রুমে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে সে। খোদেজার রুমের দরজা সবসময় খোলাই থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। রুমের লাইট বন্ধ। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুদ্ধ কিছু ঠাওর করতে পারে না। আরো একটু স্পষ্ট করে দেখার চেষ্টায় শুদ্ধ দরজার কাছে এগোতেই দরজা তার ধাক্কায় ক্যাত করে শব্দ হলে শুদ্ধ দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে আসে। শব্দ পেয়ে ঝট করে শোয়া থেকে উঠে বসে ধারা। খোদেজা নির্লিপ্ত থেকে একটু জোরে জোরেই বলে,
'ও কিছু না বউ। তুমি শুইয়া থাকো। মনে হয় কোন বিড়াল ছিল। আজকাল বড্ড জ্বালানি শুরু করছে।'
ধারা শুয়ে পড়লো। তারও একদমই ঘুম আসছে না। বারবার মন শুধু বাইরে যেতে চাইছে। বাইরের শব্দটা যে শুদ্ধ'র ছিল সেটা সেও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু শ্বাশুড়ির সামনে তো আর কিছু বলতে পারে না! তাই সে চুপচাপ শুয়ে রইলো। খোদেজার কথা স্পষ্টই শুনতে পায় শুদ্ধ। মা তাকে বিড়াল বলেছে রাগে দুঃখে শুদ্ধ খোদেজার দরজার সামনে গিয়ে শুধু পায়চারি করতে থাকে। ধারা একটু মাথা উঠিয়ে দেখতে নেয়। কিন্তু খোদেজার ঠান্ডা চোখের দৃষ্টি দেখে আবারো দ্রুত শুয়ে পড়ে। দরজার ওপাশে শুদ্ধ'র পায়ের খটখট শব্দ বাড়তে থাকে। খোদেজা বলল,
'এমন হাঁটাহাটি কইরা লাভ নাই। বউরে আর পাবি না। বউ আমার কাছেই থাকবো। চুপ কইরা যাইয়া ঘুমায় থাক।'
শুদ্ধ হাঁটা থামিয়ে বলল,
'আম্মা, এটা কিন্তু ঠিক না। তুমি আমার বউকে নিয়ে আসবা কেন? আমার বউ আমার কাছে থাকবে।'
'এই কথা ঝগড়ার করার সময় খেয়াল ছিল না! একসাথে হইলে যখন তোমরা ঝগড়াই করবা তাইলে আলাদাই থাকো। বউ আমার কাছেই ঘুমাবো আর তুমি যাইয়া তোমার রুমে ঘুমাওগা।'
'না তাহলে আমিও এখানেই ঘুমাবো। আমার একা একা ভয় লাগে।'
'মাইর খাবি এখন। ছাব্বিশ বছর একলা একলা ঘুমাইছিলি কেমনে? এখন তোর ভয় লাগে! যা এদিক থিকা!'
শুদ্ধ মেঝেতে বসে পড়ে বলে, 'না, আমি যাবো না। আমি এখানেই বসে থাকবো।'
খোদেজা নির্লিপ্ত স্বরে বলে, 'তাইলে থাক সারারাত ঐখানেই বইসা৷ তোর যেমন ইচ্ছা।'
তারপর ধারার দিকে ফিরে খোদেজা বলে,
'তুমিও কিন্তু আবার ও'র মতো কইরো না বুঝছো! চুপচাপ ঘুমায় থাকো।'
শ্বাশুড়ির হুকুম শুনে ধারা চটজলদি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কাঁথা মুড়ি দেয়। শুদ্ধ মুখ গোমড়া করে সেখান থেকে উঠে নিজের রুমে চলে আসে৷ অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। রাত আরও গভীর হয়। একসময় ধারা আস্তে আস্তে মাথা থেকে কাঁথা সরায়। একটু উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করে খোদেজাকে। খোদেজার চোখ বন্ধ। অপরপাশ ফিরে শুয়ে আছে সে। ঘুমে পুরো কাতর। ধারা আস্তে করে গা থেকে কাঁথা সরায়, একটু একটু করে উঠার চেষ্টা করে। ঠিক তখনই খোদেজার কাশির শব্দ শুনলে আবারও ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তারপর দেখে খোদেজার ঘুম ভাঙেনি। এমনিই ঘুমের ঘোরে কেশে উঠেছিল। ধারা আবারও আরেক দফা উঠার চেষ্টা করে। খুবই আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে পা ফেলে উঠে দাঁড়ায়। পা টিপে টিপে বিছানা ছেড়ে এগোতে থাকে। খোদেজা দরজার মুখোমুখি শোওয়া। ধারা শুয়েছিল তার বিপরীত পাশে। তাই স্বাভাবিকই ধারার খোদেজাকে অতিক্রম করেই যেতে হবে। অন্ধকারে খুব সাবধানে এগোতে থাকে ধারা। এমনসময় খোদেজা পাশ ফিরতেই ধারা দ্রুত মেঝেতে বসে পড়ে। আস্তে আস্তে মাথা উঠিয়ে দেখে খোদেজা ঘুমিয়েই আছে। তারপর খুবই ধীরে ধীরে দরজা ফাঁক করে বেরোতেই কার সাথে যেন হঠাৎ ধাক্কা খায়। অন্ধকারে দুজনেই চমকে উঠে। ধারা চিৎকার দিতে দিতেও থেমে যায়। শুদ্ধ মুখ চেঁপে ধরে৷ ধারা নিজেকে ধাতস্থ করে ফিসফিস করে বলে,
'ওহ তুমি! আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।'
শুদ্ধও অভিমানের স্বরে বলে,
'আসছো তাহলে! আমি তো ভাবছি আর আসবেই না। কি না কি একটু রাগারাগি হয়েছে তার জন্য তুমিও এভাবে মার সাথে চলে যাবা! আমার কথা একটুও ভাবলে না?'
ধারা মোলায়েম স্বরে বলল,
'আমি কি ইচ্ছে করে গিয়েছি! মা ই তো আমাকে টেনে নিয়ে গেলো। আমারও তো যেতে ইচ্ছে করছিল না। ঘুমও আসছিল না এতক্ষণ।'
'আর আমার বুঝি খুব ঘুম আসছিল! এজন্যই তো এখানে দশবার চক্কর দিয়ে ফেললাম।'
ধারা শুদ্ধকে সাবধান করে বলল, 'আস্তে কথা বলো। মা আবার ঘুম থেকে উঠে যেতে পারে। আমাদেরকে একসাথে মা দেখলে আবারও রাগ করবে।'
'এদিকে আসো।' বলে শুদ্ধ ধারাকে বারান্দায় নিয়ে আসলো। দুজনে পাশাপাশি মেঝেতে বসলো। কেউ কোন কথা বলল না। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। দুজনেই চুপচাপ। ইতস্তত করতে লাগলো। কি বলবে না বলবে ভেবে পেলো না। শুধু আড়চোখে বারবার একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো। একসময় শুদ্ধই নিরবতা ভেঙে আস্তে আস্তে বলতে লাগলো,
'আচ্ছা সরি! আমারই ভুল হয়েছে। আমি আজকে তোমার সাথে খুব বেশি রাগারাগি করেছি তাই না!'
ধারা আস্তে করে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে বলল,
'না, ঠিকই আছে৷ তুমি তো আমার জন্যই চিন্তায় এমন করেছো। ভুলটা আমারই। আমিই তোমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলাম। আমার কোন ভাবে তোমাকে ইনফর্ম করা উচিত ছিল।'
শুদ্ধ জোর গলায় বলল,
'আরে না। তোমার ভুল কিভাবে হয়? তুমি তো আর ইচ্ছা করে করোনি! তোমার কাছে তো আর ফোন ছিল না। জানাবে কিভাবে? তারপরে তো আমার ফোনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর যা করেছো ভালোই করেছো৷ সাম হাউ যদি আমি কোথাও আটকে যেতাম তাহলে তো তোমাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। আমিই শুধু শুধু ওভাররিয়্যাক্ট করে ফেলেছি।'
'না, ভুলটা আমারই। আমার জন্যই এতোকিছু হয়েছে।'
'আরে না, আমার ভুল।'
'না আমার ভুল।'
আবারও কথা তর্কে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে শুদ্ধ ধারা দুজনেই একসাথে হেসে উঠলো৷ দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ সবকিছুই লুকিয়ে দেখছিল খোদেজা। ওদের মধ্যে সবকিছু আবার ঠিক হয়ে গেছে দেখে মুচকি হেসে আবার নিজের রুমে চলে যায় সে। খোদেজার উপস্থিতি তারা কেউই টের পায়নি। দুজনে নিজের মতো করেই কথা বলে যেতে থাকে। শুদ্ধ মৃদু হেসে মাথা চুলকে বলল,
'কি যে করি না আমরা! আজকে কি ঝগড়াটাই না করলাম।'
ধারা মাথা নিচু করে স্মিত হেসে বলল, 'হুম।'
শুদ্ধ বলল, 'তবে যাই বলো, আমি প্রথম প্রথম তোমার সাথে অনেক চেচাঁমেচি করে ফেলেছি। আমার এটা ঠিক হয়নি। তোমার নিশ্চয়ই খুব খারাপ লেগেছিল! কতো সবকিছু ঠিক রাখার চেষ্টা করি। তবুও সবকিছু জীবনে স্মুথলি যায়-ই না। ছোটখাট দুঃখকর ব্যাপার গুলো ঘটেই যায়।'
ধারা বলল, 'ছোট ছোট দুঃখ জীবনে থাকা ভালো। কখনো পরিপূর্ণ সুখী হতে নেই। ঐ যে কথায় আছে না বেশি সুখ কপালে সয় না। সুখের পাল্লা বেশি ভারী হয়ে গেলে স্রোতের মতো দুঃখ জীবনের দিকে ধেয়ে আসে। প্রকৃতি ভারসাম্য পছন্দ করে। সুখের আধিক্য যতো বেশি হবে তাকে ঘাটতি করা দুঃখের পরিমাণ ততোই বড় হবে। আমার মাঝে মাঝে খুব ভয় হয় শুদ্ধ। আমি খুব বেশি সুখী হয়ে গেছি। কিছু হবে না তো!'
শুদ্ধ হেসে ধারাকে হাত দিয়ে আগলে বলল, 'ধুর! কিছুই হবে না। তুমি বেশি বেশি ভাবো। আমি আছি না!'
শুদ্ধ'র ভরসামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে ধারা বিচলিত মুখেই স্মিত হাসে। শুদ্ধ'র কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রাখে। আর মনে মনে কামনা করে এই সময় কখনোই না ফুরাক।
চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব -৩৫
একটা কালো রঙের কাক সেই কখন থেকে রেলিংয়ের উপর বসে গলা ছেড়ে কা কা করে ডেকে যাচ্ছে। ধারা বারান্দার টবগুলোতে পানি দেওয়া অবস্থাতেই আড়চোখে একবার কাকটার দিকে তাকায়৷ ধারার চোখের দৃষ্টিতে হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক ধারা তাকাতেই কাকটা তার গলার আওয়াজ কমিয়ে ফেললো। আরো দু একবার ক্ষীণ স্বরে কা কা করে পুরোপুরিই চুপ হয়ে গেলো। ঠিক তখনই ভেতর থেকে শুদ্ধ'র গলার আওয়াজ শোনা যায়। ধারার নাম ধরে অনবরত ডেকে যাচ্ছে সে। সকালের উদীয়মান সূর্যের দিকে একবার তাকিয়ে ধারা পানি দেওয়া বন্ধ করে রুমের মধ্যে ঢোকে। শুদ্ধ কাঠের আলমারির সামনে দাঁড়ানো। কবাট খুলে তখন থেকে কি যেন খুঁজে চলেছে। ধারা পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করে 'কি?'
শুদ্ধ খোঁজা চালিয়ে রেখেই বলল,
'আমার কালো রঙের টাই টা কোথায়? খুঁজে পাচ্ছি না।'
ধারা দ্বিতীয় তাকের শার্টের স্তুপটা একটু উঁচু করতেই কালো রঙের টাই টা বেরিয়ে এলো। শুদ্ধ একগাল হেসে ফেলে বলল, 'ও এখানে ছিল! দেখেছো আমার চোখেই পড়েনি।'
শুদ্ধ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের উপর টাই পেঁচাতে থাকে। ধারা পেছনে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসে। শুদ্ধকে আজ অন্যদিনের চাইতে একটু বেশিই এক্সাইটেড লাগছে। আর হবেই বা না কেন? আজ শুদ্ধ একটা ইয়াং এচিভমেন্ট ইভেন্টে এই প্রথম ইনভাইটেড। যেই ইভেন্টে এইবার প্রধান আকর্ষণই মূলত শুদ্ধ। শুদ্ধ'র মতো আরো অনেকেই আছে। তবে সাধারণের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করা উঠতি সাফল্যের অধিকারী শুদ্ধ'র কাজের দক্ষতাই এখন অধিক আলোচিত। শুধু শুদ্ধ একা নয়, শুদ্ধ'র পুরো পরিবারই সেখানে আমন্ত্রিত। অতএব ধারা আর বাকি সবাইও যাবে। তবে শুদ্ধকে বেরোতো হচ্ছে একটু আগেই। ফ্যাক্টরিতে তার কিছু জরুরী কাজ আছে। সদ্য চালু হওয়া এই ফ্যাক্টরিতে এখন নানাবিধ প্রয়োজনীয়তা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন উপায় নেই। শুদ্ধ ঠিক করলো ফ্যাক্টরি থেকে সে যথাসময়ে ইভেন্টে পৌঁছে যাবে। ধারাকে বলে দিয়েছে যেন সোজা ইভেন্টে চলে যায় তারা।
ধারা অনেকক্ষণ ধরেই শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে ছিল। শুদ্ধ'র মুখের খুশির আমেজটা দেখতে তার ভালো লাগছে। তার থেকেও বেশি ভালো লাগছে, শুদ্ধ তার লক্ষ্যে ধীরে ধীরে পৌঁছাতে পারছে দেখে। ধারা নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে এই অসাধারণ মানুষটির সাফল্যের দ্বারে পৌছানোর অসাধারণ যাত্রাটি নিজের চোখে দেখতে পারছে বলে। টাই বাঁধতে গিয়ে শুদ্ধ বারবার তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। ধারা সেটা খেয়াল করে মৃদু হেসে শুদ্ধ'র হাত ছাড়িয়ে নিজে টাই বেঁধে দিতে লাগলো। শুদ্ধ হড়বড় করে বলতে লাগলো,
'ধারা, আমি কিন্তু ফ্যাক্টরির কাজ শেষ হলেই সেখানে পৌঁছে যাবো। তোমরা তার আগেই বেড়িয়ে পড়ো কিন্তু। আর....
শুদ্ধ'র কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অবিকল তার মতো করে ধারা বলতে লাগলো,
'আর একদমই লেট করবে না, সাবধানে যাবে, নিজেদের খেয়াল রাখবে। এই তো?'
শুদ্ধ হেসে ফেললো। ঠোঁট চেঁপে হেসে বলল,
'উহুম! আরো আছে। যাবার আগে খেয়াল করে ফোনটা সাথে করে নিয়ে যেয়ো।'
শুদ্ধ মানিব্যাগ পকেটে ঢুকিয়ে বের হওয়ার জন্য এগোলো। ধারা পেছন পেছন যেতে যেতে বলল,
'আমি মাকে নিয়ে একা একা যেতে পারবো। তুমি চিন্তা করা বন্ধ করো। একটা নতুন এড্রেস খুঁজে যাওয়া আর এমন কি! আমি পারবো।'
দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শুদ্ধ বলল,
'হুম, অবশ্যই পারবে। আমি যখন থাকবো না তখন তো তোমাকে একা একাই সব করতে হবে।'
মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো ধারার। এক আকাশ অভিমান নিয়ে সে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে বলল, 'এমন কথা আর কক্ষনো বলবে না। তোমাকে ছাড়া আমি কিচ্ছু পারবো না।'
ধারার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি কেঁদে ফেলবে। শুদ্ধ হেসে ফেলে বলল,
'আচ্ছা ঠিকাছে বলবো না৷ আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। এখন একটু হাসো প্লিজ! আমাকে এভাবে গোমড়া মুখে বিদায় দিবে?'
ধারা ঠোঁট প্রসারিত করে একটু হাসলো। ধারার কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু দিয়ে চলে গেলো শুদ্ধ। ধারা দাঁড়িয়ে রইলো। সিঁড়ি দিয়ে যতক্ষণ শুদ্ধ'র ছায়াটা পর্যন্তও দেখা গেলো ততক্ষণ।
__________________________________________
একটা ক্যাব ভাড়া করে যথাসময়েই ধারা, খোদেজা আর চুমকি ইভেন্টে পৌঁছে গেলো। খোদেজার আসার একদমই ইচ্ছে ছিল না। প্রচন্ড সংকোচ হচ্ছে। এতো বড় বড় মানুষের ভেতর সে অর্ধমূর্খ মানুষ আর কি করবে! কিন্তু তার ছেলে সেই কথা শুনলে তো! ঠিকই জোর করে মাকে রাজী করিয়ে ছেড়েছে। নয়তো মাকে ছাড়া সে যাবে না। চুমকি ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে আছে৷ এতো সুন্দর সাজ সজ্জা সে আগে কখনো দেখেনি। প্রবেশ দ্বারেই বেলুন দিয়ে রাউন্ড করে গেট সাজানো। এতো এতো বেলুন! চুমকির ইচ্ছে হলো দু একটা বেলুন ছুটিয়ে নিয়ে রেখে দিতে। অনেক কষ্টে সে তার ইচ্ছেটাকে সংযত করলো। অনেক মানুষ পাস দেখিয়ে ঢুকছে। ধারা সবাইকে নিয়ে ঢুকলো। কিন্তু হলের ভেতরে গেলো না। গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো৷ তাদেরকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে শুদ্ধই এখনও আসেনি। নিশ্চয়ই কোন কাজে আবার আটকা পড়ে গেছে। শুদ্ধকে ফোন লাগালো ধারা। কিছুক্ষণ বাজতেই শুদ্ধ রিসিভ করলো৷ তাড়াহুড়োর গলায় বলল,
'ধারা, তোমরা কি পৌঁছে গেছো?'
ধারা বলল, 'হ্যাঁ, তুমি কোথায়? কখন আসবে? আর তোমার আশেপাশে এতো শব্দ কেন?'
শুদ্ধ একটা সিএনজি ডেকে উঠতে উঠতে বলল,
'এই তো আমি রাস্তায়। মাত্র সিএনজিতে উঠলাম। একটুপরই এসে পড়বো।'
'তুমি সবে গাড়িতে উঠলে? এতক্ষণ ফ্যাক্টরিতেই ছিলে! তাড়াতাড়ি আসো। আমরা দাঁড়িয়ে আছি।'
'আচ্ছা, আমি আসছি। ফোন রাখছি, কথা কিছু শোনা যাচ্ছে না৷ তোমরা ভেতরে গিয়ে বসো। দাঁড়িয়ে থেকো না।'
শুদ্ধ ফোন কেটে দিলো। ধারা ভেতরে গেলো না। দাঁড়িয়ে রইলো। অনেকক্ষণ পর আবার শুদ্ধকে ফোন দিলো। শুদ্ধ তখন সিএনজিতে। আশেপাশে শুধু গাড়ির হর্নের শব্দ। ফোনের আওয়াজ শুদ্ধ শুনতে পেলো না। একটু পর পর গাড়ি জ্যামে আটকে পড়ছে। শুদ্ধ বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলো। এমন হতে থাকলে তার নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে। শুদ্ধ সিটের সাথে ঠেস দিয়ে বসে তাড়াতাড়ি পৌছানোর অপেক্ষা করতে লাগলো।
রাস্তায় এখন পুরোই রমরমা অবস্থা। শুধু গাড়ি আর গাড়ি। সবারই আগে যাবার তাড়া। একটা বড় ট্রাক সবাইকে পেছনে ফেলে দ্রুত গতিতে এগোতে লাগলো। প্রশস্ত রাস্তার মাঝখানে দাপট দিয়ে চলতে লাগলো সেটি। একসময় নিজের থেকে ক্ষুদ্র একটি সিএনজির পেছনে পড়ে তাদের গতিতে স্লোথ এসে পড়লো। বারকয়েক হর্ন বাজিয়ে সড়ে যেতে বলল। সিএনজি চালকের সাইড দিতে একটু দেরি হতে লাগলো। কিন্তু সেই দেরি সহ্য হলো না সেই বৃহদাকার ট্রাক চালকের। বৃহত্তর কেন ক্ষুদ্রতরকে পরোয়া করবে? কতোই না অবলীলায় সিএনজিটাকে ধাক্কা মেরে নিজের জায়গা বানিয়ে চলে গেলো ট্রাকটি।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো শুদ্ধ এখনও আসলো না। ধারা আর খোদেজা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলো৷ এর মাঝে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোক এসে ভেতরে বসার জন্য অনুরোধ করে গেছে তাদের৷ তারা যায়নি। একসময় ইভেন্ট শুরুও হয়ে গেলো। অনেকে এসে শুদ্ধ'র কথা জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু ধারা কিছু বলতে পারলো না। বারবার শুদ্ধকে ফোন করতে লাগলো ধারা। কিন্তু না আর ফোন রিসিভ হলো আর না কোন খবর পেলো। ধারা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। একসময় খবর এলো। কিন্তু সেটা শুদ্ধ'র ফিরে আসার নয়, তার এক্সিডেন্টের।
__________________________________________
ধারা পাগলপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালে এসে পৌঁছালো। নিঃশ্বাসটাও যেন আটকে আছে তার। তার পেছনে আছে খোদেজা আর চুমকি। কাঁদতে কাঁদতে তাদের অবস্থাও খারাপ। হাসপাতালে এসে ওরা জানতে পারলো এক্সিডেন্টের সময় সিএনজি চালক ছিটকে গাড়ির বাইরে পড়ে গিয়েছিল। সে খানিক আহত হয়েছে। আর তেমন কিছু হয়নি। কিন্তু শুদ্ধ'র অবস্থা খুব বেশি খারাপ। তাকে আইসিউতে শিফট করা হয়েছে। একটা ডাক্তার সেখান থেকে বের হয়ে আসলে ধারা তোতাপাখির মতো বুলি আউড়ে শুদ্ধ'র কথা জিজ্ঞেস করলো। ডাক্তার কপালে একটা চিন্তার ছাপ ফুটিয়ে বলল,
'এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম।'
ডাক্তারের মুখে এই কথা শুনে ধারার পুরো পৃথিবী ঘুরে উঠলো। মেঝেতে পড়ে গিয়ে তার কপালের কার্নিশ কেটে গেলো। গল গল করে রক্ত বেরোতে লাগলো সেখান থেকে। তার নিথর শরীরটা টেনে একটা বেডে শুইয়ে দিয়ে একজন নার্স ব্যান্ডেজ করে দিলো। একটু পর জ্ঞান ফিরে আসলে, চোখ খুলেই সে সবার আগে শুদ্ধ'র কথা জিজ্ঞেস করলো। দ্রুত বেগে উঠে বসতেই কপালের তীক্ষ্ণ ব্যাথাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। কিন্তু তাতে তার কোন ভ্রুক্ষেপই হলো না। শরীরের যন্ত্রণার চাইতে মনের যন্ত্রণাই যে তাকে অধিক কাবু করে রেখেছে। যখন সে জানতে পারলো শুদ্ধ'র অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি সে আবারো পাগলের মতো কান্নাকাটি করতে লাগলো। মাথার ব্যান্ডেজ টান দিয়ে খুলে ফেলে, দু হাত দিয়ে গাল খামছে ধরলো। কখনো আবার দাঁত দিয়ে হাত কামড়ে ধরলো। শুদ্ধকে ছাড়া এক মুহুর্তের জন্যও বেঁচে থাকার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না। বারবার শুধু আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলো। কেউই তাকে শান্ত করতে পারলো না। ডাক্তারদের পা পেঁচিয়ে ধরে শুধু তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য আকুতি করতে লাগলো। ডাক্তার বলল তাদের যতটুকু করার তারা করেছে। এখন চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলেই কিছু একটা বলা যাবে। জ্ঞান না ফিরলে পেশেন্টের কোমায় যাবারও সম্ভাবনা আছে। ধারার বুক চিরে যাবার মতো যন্ত্রণা হতে লাগলো। অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো সে। ধারার এই অবস্থা ডাক্তার নার্স সহ সবার চোখেই পানি এনে দিলো। এমন ভাবে বেশিক্ষণ চলতে থাকলে হয়তো এই মেয়েটিই মারা যাবে। একটুপর পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে সে। খোদেজার হয়েছে আরেক যন্ত্রণা। ছেলের দুঃখে সে কি কাঁদবে ছেলের বউকে সামলানোর জন্য তাকেই শক্ত থাকতে হলো। ধারার মাথাটা বুকে চেঁপে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো সে। হাসপাতালে এসে শুদ্ধ'র যেই রক্তমাখা মুখটা দেখেছিল সেটা বারবার তার মস্তিষ্কে আঘাত করে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করতে লাগলো। তার ছেলে মাহতাব। জন্ম না দিলেও তার নিজের ছেলের থেকেও সে বেশি। পুরো পৃথিবীর কাছে এই মাহতাব বিচক্ষণ, দূরদর্শি, গুছিয়ে কথা বলার মানুষ হলেও মায়ের কাছে সে ছিল নিতান্তই বাচ্চাসুলভ। যখন যা মনে আসতো অবলীলায় বলে দিতো। কতো শ্রম আর মেধায় এই ছেলেই কতো কিছু করে ফেললো৷ আর আজ কেমন নিথর হয়ে পড়ে আছে দেখো! খোদেজার বুকের মধ্যেটা মোচড় দিয়ে উঠে।
মাঝখান থেকে কেটে গেলো সতেরো ঘন্টা। শুদ্ধ'র জ্ঞান ফেরার কোন হদিশ নেই। ধারার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলো। বারবার নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলতে লাগলো সে। এর মাঝে অনেকবারই জ্ঞান হারিয়েছে। তাকে সামলানো ভারী মুশকিল হয়ে উঠলো। বারবার শুদ্ধ'র কাছে যাবার জন্য পাগলামো করতে লাগলো। উপায় না পেয়ে জোর করে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করা হলো তাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওষুধ তার কাজ শুরু করে দিলো। শুদ্ধ'র কাছে যাবার জন্য ছটফট করতে করতে আস্তে আস্তে অবশ হয়ে আসতে লাগলো তার শরীর। ক্লান্ত চোখগুলো ঝাপসা হবার আগে সে শুধু একটা কথাই শুনতে পেলো,
'শুদ্ধ'র জ্ঞান ফিরেছে।'
চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব -৩৬
প্রায় দুই তিন ঘন্টা পর ধারার ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে হাসপাতালের সিলিং চোখে পড়তেই প্রথমে ঠাওর করতে পারে না সে আসলে কোথায়? সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। তার উপর বেশ কয়েক জায়গায় আঘাতের যন্ত্রণা। তবুও দীর্ঘ এক ঘুমের ফলে এখন শরীর একটু ভালো। সিলিং থেকে চোখ সরিয়ে পাশে নিতেই হাসপাতালের বেডের স্ট্যান্ডে ঝুলে থাকা এক পরিত্যক্ত স্যালাইনের নল দেখেই ধারার পূর্বের সকল কথা মনে পড়ে যায়। ক্ষণবিলম্ব না করেই সে গায়ের থেকে সাদা চাদর সরিয়ে অস্ফুট স্বরে শুদ্ধ বলে ডেকে উঠে দ্রুত বেগে শুদ্ধ'র কেবিনে যায়। একটা ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় দরজাটা খুলতেই শুদ্ধ'র দু চোখ আস্তে করে ধারার দিকে যায়। ধারা যেন হঠাৎ থমকে যায়। এতক্ষণের ঘূর্ণিপাকের মতো উদ্বেলিত হওয়া তার সমস্ত অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ যেন এক নিমিষেই বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক যেমন প্রকৃতির এক ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের পরে সমুদ্র যেভাবে শান্ত হয়। মিনিট খানেকের মতো ধারা কিছু বলতে পারে না। নড়তেও পারে না। শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থাকে তার প্রাণের সঞ্চার, প্রশান্তির আধার, জীবনের স্বস্তিদায়ক সেই দৃষ্টিযুগলের দিকে। পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই থমকে যায় তার কাছে। আর অন্য কিছু তার দৃষ্টিতে আসে না। আসে শুধু একটা দরজা, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা তার ভালোবাসা আর তাদের মধ্যকার ক্ষুদ্র দূরত্ব। ধারা অপলক তাকিয়ে থেকে বশীকরণের মতো আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। ধারাকে দেখে শুদ্ধ তার বা হাতের কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলগুলো বিছানা থেকে আস্তে আস্তে তোলার চেষ্টা করে। শুদ্ধ'র বেডের কাছে এসে নিজের হাতটা আস্তে আস্তে শুদ্ধ'র আলতো উঁচু করে দেওয়া হাতের নিচে রেখে আঁকড়ে ধরে ধারা। তারপরই হঠাৎ মেঝেতে বসে পড়ে। শুদ্ধ'র আঁকড়ে ধরা হাতটায় একটা চুমু দিয়ে নিজের মুখের কাছে নিয়ে কেঁদে উঠে ধারা। মৃত্যু থেকে বেঁচে ফেরা স্বামীর হাত ধরে তার শব্দহীন কান্না সেখানে উপস্থিত সকলের মন ছুঁয়ে দেয়। অন ডিউটিতে থাকা হেড ডক্টর চশমা খুলে নিজের চোখ মুছে। নার্সেরাও আবেগ্লাপুত হয়। কখন যেন অজান্তেই মনে প্রাণে তারাও চাইছিলো মেয়েটি তার স্বামী ফিরে পাক। এখন যখন তা পূর্ণ হলো তখন মেয়েটির সাথে সাথে তারাও একধরনের প্রশান্তি খুঁজে পায়৷ মাথায় হাতে ব্যান্ডেজ পেঁচানো শুদ্ধ ধারাকে মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করে কাঁদার। তার অবস্থা এখন একটু ভালো। আউট অফ ডেঞ্জার। সেই ঘন্টাখানেক আগে যখন তার জ্ঞান ফিরেছিলো তখন থেকেই ধারাকে খুঁজে চলছিলো সে৷ এখন যখন সেই কাঙ্খিত মুহুর্তটি এলো তখন ধারার সাথে সেও খানিক আবেগ্লাপুত হয়ে পড়লো। শুদ্ধ'র বারণ শুনে ধারা ঝটপট চোখের পানি মুছে মুখে হাসি টেনে উঠে দাঁড়ালো। তার শুদ্ধ বেঁচে ফিরেছে। সে আর কাঁদবে কেন? শুদ্ধ শোওয়া থেকে বসার চেষ্টা করলো। কষ্ট হলো, পারলো না। ডাক্তার নিষেধ করলো। কিন্তু শুদ্ধ শুনলো না। খোদেজা শুদ্ধকে ধরে পেছনে বালিশ দিয়ে বসার জন্য সাহায্য করতে চাইলো। হঠাৎ শুদ্ধ কেমন আতঙ্কগ্রস্ত স্বরে বলে উঠলো,
'একি! আমি আমার পা নাড়াতে পারছি না কেন?'
একরাশ বিস্ময় নিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকালো ধারা। ডাক্তার কেমন যেন ইতস্তত করে সঙ্গে সঙ্গেই ফিচেল হেসে উঠে বলল,
'আরে ও তেমন কিছু না। ছোটখাটো মাইনর ইনজুরি। তোমার এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে! এখনই তো তুমি হাঁটতে পারবে না। হাত পা নাড়াতে একটু তো সমস্যা হবেই। তুমি টেনশন নিয়ো না। কিছুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।'
ডাক্তারের কথায় শুদ্ধ খানিক আশ্বস্ত হলো। আশ্বস্ত হলো ধারাও। কিন্তু এরপরই ডাক্তার তাকে একা ডেকে যা বলল তা পুরোই স্তম্ভিত করে রেখে দিলো তাকে।
__________________________________________
হাসপাতালে পনেরো দিন কাটানোর পর শুদ্ধ বাড়িতে ফিরে আসলো, হুইল চেয়ারে। ধারা হুইলচেয়ারে শুদ্ধকে টেনে রুমে নিয়ে এলো। হাত দিয়ে ধরে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাকে। শুদ্ধ কিছুই বললো না। কেমন যেন বিষন্ন হয়ে রইলো। ধারা মুখে হাসি টেনে বলল,
'খাবে কিছু? তোমার জন্য স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসি?'
শুদ্ধ আস্তে করে মাথা নেড়ে না করলো। ধারার মধ্যে মন খারাপের ছায়া নেমে আসতে চাইলেও সে তাতে গা করলো না। আবারও হাসি টেনে রুমের পর্দাগুলো আরেকটু সরিয়ে দিতে দিতে বলল, 'আজকে আবহাওয়া খুব সুন্দর তাই না! দেখো, আকাশটা কতো সুন্দর লাগছে।'
শুদ্ধ আস্তে করে বলল, 'আমি হাঁটতে পারবো কবে ধারা?'
ধারার হাত থেমে গেলো। নিজেকে সামলিয়ে ধারা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল, 'কটা দিন একটু রেস্ট নিতেই হাঁপিয়ে উঠছো! তুমিও না! আমি তোমার জন্য জুস নিয়ে আসছি।'
ধারা দ্রুত সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো। আস্তে করে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুদ্ধ। সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনে ধারা দরজা মুখে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার মুখে মেঘের ছায়া নেমে আসলো। ধারার মনে পড়ে গেলো সেদিন ডাক্তার তাকে নিজের চেম্বারে ডেকে কি বলেছিল,
'শুদ্ধ'র পা নাড়াতে না পারা কোন মাইনর ইনজুরির কারণে না। শুদ্ধ সামনে ছিল বলে তখন মিথ্যা বলতে হয়েছে। এক্সিডেন্টের কারণে ও'র মস্তিষ্কে আঘাতের ফলে মস্তিষ্ক থেকে নার্ভে সংকেত প্রেরণে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে ও'র দুই পায়ের নিচের অংশ সম্ভবত প্যারালাইজড হয়ে গেছে৷ তবে এটা চিরস্থায়ী নাকি সাময়িক সেটা ও'র রিপোর্ট দেখে এখনই বলা যাচ্ছে না। যদি সাময়িক সময়ের জন্যও হয়ে থাকে তবুও সেটা ঠিক হতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হবে। যার ফলে শুদ্ধ হাঁটতে পারবে না। সময় লাগবে। চিকিৎসা নিতে হবে। ভেঙে পড়া যাবে না। কিন্তু এই সময় টায় বেশিরভাগ পেশেন্টই ভেঙে পড়ে। প্যারালাইসিসের কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্যাঘাত ঘটে। তারা হাঁটতে পারে না। যার ফলে পেশেন্ট মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যেহেতু আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যাবে কিনা সেটা আগের থেকেই গ্যারান্টি দিয়ে বলা সম্ভব না তাই তারা খুব হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ভেবেই নেয় যে তারা আর কোনদিন হাঁটতে পারবে না। জীবনের প্রতি বিস্বাদ ভাব এসে পড়ে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। এবং অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে যায়। তাই এই সময় পেশেন্টকে অবশ্যই প্রচুর মানসিক সাপোর্ট আর যত্নে রাখতে হয়। হাল না ছেড়ে দিতে উৎসাহিত করতে হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত। এর উপর ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থাও আছে। আমরা ভালো কিছুর আশা রাখতে পারি৷ কিন্তু তার আগে পেশেন্টের নিজের মনোবল থাকা অনেক প্রয়োজন। তার নিজের চেষ্টা আর মনের জোরই তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। মানসিক শক্তি ছাড়া এই অসুস্থতা কাটিয়ে উঠা বেশ কঠিন।
পেশেন্ট যদি হাল ছেড়ে দেয় তবে এই কেসে ট্রিটমেন্টও আর কোন কাজে আসে না।'
ডাক্তারের কথা মনে করে ধারা আরেকবার পেছনে ফিরে শুদ্ধ'র দিকে তাকায়। দেখে শুদ্ধ নিরব হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। ধারার বুক চিড়েও একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
একে একে শুদ্ধ'র দিনগুলো হুইলচেয়ারেই কাটতে থাকে। কাজের চাপে আটকে থাকা শুদ্ধ'র এখন অবসরের অবকাশ নেই। সারাটা দিন বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। আর কিই বা সে করবে! সামান্য হুইলচেয়ারে বসতে হলেও তার অন্যের সাহায্য লাগে। এমনকি এখান থেকে ওখানে যেতে হলেও ডাকতে হয় অন্যদের। সাহায্য নিতে হয় হুইলচেয়ারের। পা দুটো তো প্রায় অচল। সবকিছু হুট করেই কেমন যেন পাল্টে যায়। নিজের পায়ে হাঁটতে না পারায় সে না ফ্যাক্টরিতে যেতে পারে আর না তার ফলের খামারে। সব কাজে শ্লথ তৈরি হয়। হতে থাকে ক্ষতি। এই তো সবেই পরিপূর্ণ সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। একের পর এক সুযোগ এসে ধরা দিচ্ছিল তাকে। যা সে যথাযথ কাজেও লাগাচ্ছিল। কিন্তু এই উঠতি সাফল্যের মাঝেই হঠাৎ এই দূর্ঘটনা নেমে এসে জীবনটাকে যেন নিচের দিকে টেনে ধরলো। সবকিছু থেমে গেলো। শুদ্ধ'র কিছু করার থাকে না। শুধু সারাক্ষণ বিষন্ন মনে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকে। কখনো কখনো হুইলচেয়ার টেনে জানালার কাছে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে এখন আর সেই নজরকাড়া টোল পড়া হাসি দেখা যায় না। আগের মতো তার মুখে আর সেই দুষ্টুমির ঝিলিক খেলা করে না। সবকিছুই নিরব, নির্লিপ্ত। শুদ্ধকে এই অবস্থায় দেখে সবথেকে বেশি যন্ত্রণায় ভোগে ধারা। যেই শুদ্ধ সবসময় নিজের কাজে মশগুল থাকতো, সবসময় কিছু না কিছু নতুন করার চেষ্টায় থাকতো আজ সেই উদ্যমি, পরিশ্রমী শুদ্ধ উদাস হয়ে বসে আছে হুইলচেয়ারে। যার মুখের প্রতিটি শব্দই এক আকাশ অনুপ্রেরণা বহন করতো আজ সেই হয়ে আছে হতাশায় বিবর্জিত। এই দৃশ্য ধারার জন্য যে ঠিক কতোটা অসহনীয় তা শুধু উপরওয়ালাই জানেন। তবুও সে নিজেকে সামলে সবকিছু স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আগের মতো সবকিছু আর তেমন সহজ হয় না। আর না আগের মতো থাকে তাদের সম্পর্ক। শুদ্ধ'র মেজজ আজকাল কেমন যেন খিটখিটে হয়ে গেছে। হয় বেশি কথাই বলে না, মনমরা হয়ে থাকে। নয়তো অল্পতেই রেগে যায়। পায়ের ব্যায়ামও করতে চায় না। চেষ্টা ছেড়ে দেয়। নিজেকে অন্যের উপর বোঝা মনে করে। কষ্ট পায়। মন খারাপ করে। জীবনটাই যেন বিস্বাদ বোধ হয় তার।
__________________________________________
অন্যদিনের মতোই সকালের পরে জানালার কাছে হুইলচেয়ারে বসে ছিল শুদ্ধ। দৃষ্টি আকাশের দিকে নিবদ্ধ। সেই দৃষ্টিতে কোন আশা নেই, স্বপ্ন নেই। আছে শুধু হতাশা। ধারা দরজা ঠেলে সেই সময় ভেতরে প্রবেশ করে। রুমে কারো প্রবেশের শব্দে শুদ্ধ খানিক হকচকিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। ধারা এসে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে একবার মিষ্টি করে হেসে বিছানার উপর পরে থাকা শুদ্ধ'র কাপড় চোপড় গোছাতে থাকে। বালিশের দিকে চোখ যেতেই হঠাৎ ধারার গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে। রাতের অন্ধকারে দৃষ্টি আড়াল করে শুদ্ধ কিভাবে তাকে বলেছিল, তার মতো অচলকে ছেড়ে দিয়ে ধারাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে। শুধু কি গতকালই! এর আগেও তো শুদ্ধ কতবার কতো ভাবে ধারাকে এই কথাগুলো বলেছে। প্রতিবারের মতোই ধারা বিরক্ত হয়েছে। কখনো কখনো এড়িয়ে গেছে। ধারার ভাবনায় ছেদ ঘটে বাইরে থেকে ভেসে আসা আওয়াজে। শুদ্ধ জানালা দিয়ে সেদিকটায় তাকিয়ে বলে,
'এমন শব্দ কিসের?'
ধারা স্মিত হেসে বলল, 'আমাদের বিল্ডিংয়ের পাশে বাচ্চাদের খেলার ছোটখাট একটা পার্ক তৈরি হচ্ছে। বিকেলে তোমাকে নিয়ে সেখানে যাবো কেমন? ঘুরে দেখো ভালো লাগবে।'
'আমি গিয়ে কি করবো? হাঁটতে তো আর পারবো না!'
ধারা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কি বলবে খুঁজে পায় না। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য কিছু বলতে শুদ্ধ'র দিকে তাকাতেই দেখে শুদ্ধ হুইল ঘুরিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। ধারা জিজ্ঞেস করলো,
'কোথায় যাচ্ছো?'
শুদ্ধ বলল, 'গরম লাগছে। গোসল করবো।'
'আচ্ছা আমি এই কাপড়গুলো ভাঁজ করেই তোমাকে করিয়ে দিচ্ছি।'
শুদ্ধ বাথরুমের দিকে এগোতে এগোতে নির্লিপ্ত স্বরে বলল, 'আমি পারবো।'
আস্তে করে পেছনে ঘুরে গেলো ধারা। চোখের পানি আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো। কারণ যতোটা সে জানে ততোটা শুদ্ধও জানে সে একা পারবে না।
দুপুরের পর খোদেজা চুমকিকে নিয়ে রূপনগরে গেলো। পরদিন সকালেই চলে আসবে। রান্নাঘরের ময়লার ঝুড়ি পুরো ভরে গেছে। বাসায় আর কেউ না থাকায় ধারাকেই সেটা ফেলতে নিচে যেতে হলো। শুদ্ধ ছিল তখন ঘুমিয়ে। হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ আসায় তার ঘুম ভেঙে গেলো। সে ধারার নাম ধরে ডেকে উঠলো। কোন সাড়া পেলো না। এদিকে তার যাওয়া প্রয়োজন। সে বারবার একে একে ধারা, খোদেজার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকতে লাগলো। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। বেগ বৃদ্ধি পেলে শুদ্ধ নিজে নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠার চেষ্টা করলো। খুব কষ্ট হলো। প্রথম চেষ্টাতেই পারলো না। খুব কষ্টে বিছানার ধারে রাখা হুইলচেয়ারটি হাত দিয়ে টেনে নিয়ে নিজের পা টেনে টেনে বসার চেষ্টা করলো। পারলো না। হঠাৎ হুইলচেয়ার নিয়েই বিছানা ছেড়ে মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে গেলো। খালি মেঝে থেকে উঠার জন্য শুদ্ধ পাগলের মতো চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু কারো সাহায্য ব্যতিত পারলো না। শুদ্ধ'র চোখ ফেটে জল বেরোতে লাগলো। নিজের অসহায়ত্বে চিৎকার করতে লাগলো সে। ততক্ষণে বাসায় ফিরে সেই চিৎকার শুনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রুমে ছুটে আসলো ধারা। শুদ্ধকে মেঝেতে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে তাকে তাড়াতাড়ি তুলতে নিলো। শুদ্ধ কোনমতে শুধু বলল,
'আমাকে তাড়াতাড়ি বাথরুমে নিয়ে চলো।'
শুদ্ধকে নিজের কাঁধে আশ্রয় দিয়ে দ্রুত শুদ্ধকে বাথরুমে নিয়ে গেলো ধারা। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে গেলো।
__________________________________________
এই ঘটনাটা শুদ্ধ'র মনে গভীর দাগ কাটলো। তারপর থেকে আর ভালো মন্দ একটি কথাও বলেনি সে। পুরোটা সময় থম মেরে হুইলচেয়ারে একা একা বসে রইলো রুমে। একদম মূর্তির মতো স্তব্ধ। শুদ্ধ'র যাতে আর অপ্রস্তুত বোধ না হয় তাই ধারাও আর ইচ্ছে করে তার সামনে এলো না। ধীরে ধীরে রাত গভীর হলো। শুদ্ধ'র অবস্থানের কোন পরিবর্তন হলো না। একনাগাড়ে অন্যমনষ্ক দৃষ্টি ভেঙে হঠাৎ তার চোখ পড়লো সামনের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। হুইলচেয়ারে বসা নিজের প্রতিবিম্ব চোখে পরতেই তার দুপুরের পরের সেই ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। একদৃষ্টিতে আয়নার দিকেই তাকিয়ে রইলো সে। তার চোখ রক্তিম হতে লাগলো। হাতল ধরা হাতের মুঠি হতে লাগলো শক্ত থেকে শক্ত। হঠাৎ সে হাতের কাছের ভারী একটা শোপিজ তুলে আয়নার দিকে ছুঁড়ে মারলো। মুহুর্তের মধ্যে বিকট শব্দ তুলে আয়নাটি ভেঙে চুরমার হয়ে নিচে ঝনঝনিয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলো শুদ্ধ। হাতের কাছে যাই পেলো হাত দিয়ে নিচে ছুঁড়ে মারলো। হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিৎকার করে এলোপাথাড়ি ছুটতে থেকে রুমের মধ্যে ধ্বংসলীলা চালাতে লাগলো। বিছানার চাদর টেনে ফেলে দিলো। কাঁচের জগ, গ্লাস যা পেলো তাই ভাঙতে লাগলো। একটা ফুলদানি তুলে দরজার দিকে মারতে গিয়েই হঠাৎ থমকে গেলো শুদ্ধ। দরজা মুখে শান্ত মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ধারা। তাকিয়ে আছে শুদ্ধ'র দিকে। শুদ্ধ'র প্রলয়কারী হুংকার মুহুর্তেই থেমে গিয়ে ফুলদানি ধরা হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে এলো।
চলবে,
[গত পর্বের শুরুতেই কাকের ডাক আর পরে দূর্ঘটনার ফলে অনেকে কাকের ডাকটাকে অর্থবহ ভেবে বসেছেন। এটা আমি কুসংস্কার অর্থে লিখিনি। শুধু একটা শহুরে জীবনের সাধারণ সকালের বর্ণনা স্বরূপ লিখেছিলাম। প্রকৃত অর্থে কাকের ডাক দ্বারা যে কুসংস্কার বোঝায় এটা আমি ঠিক জানতাম না। নয়তো এরকমটা লিখতাম না। তাই প্লিজ এই বিবরণে বিভ্রান্ত হবেন না। একটা পাখি প্রজাতির জীব শুধুমাত্র কালো রঙের আর কণ্ঠ খুব একটা ভালো নয় বলে তার ডাক খারাপ বার্তা বহন করবে এমনটা ভাবা নিশ্চয়ই ঠিক না।]
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
Posts: 516
Threads: 28
Likes Received: 538 in 299 posts
Likes Given: 381
Joined: Jun 2022
Reputation:
51
পর্ব ৩৭-শেষ
অশ্রু মাখা চোখযুগল নামিয়ে আস্তে করে হাতের ফুলদানিটা মেঝেতে রেখে দিলো শুদ্ধ। কাঁচের ভাঙা টুকরোগুলো পেরিয়ে ধীরে ধীরে শুদ্ধ'র পাশে এসে দাঁড়ালো ধারা। শুদ্ধ মাথা নিচু করে রইলো। কোন কথা বলল না৷ ধারা শুধু তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। এর আগেও তাদের জীবনে অনেক কঠিন সময় এসেছে, অনেক বাঁধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবুও শুদ্ধ কখনো ভেঙে পড়েনি। হাল ছেড়ে দেয়নি। নিজের উপর পূর্ণ আস্থা, বিশ্বাস সবসময়ই ছিল তার। যার জোরে সে সবকিছু জয় করেছে৷ কিন্তু আজ সেই আত্মবিশ্বাসী, স্পষ্টভাষী, শক্ত মনোবলের অধিকারী শুদ্ধই ভেঙে পড়েছে। তার আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরেছে৷ হাল ছেড়ে দিয়েছে সে। ধারা শান্ত মুখে শুধু অপলক দেখতে লাগলো সেই শুদ্ধকে। দৃষ্টি লুকিয়ে শুদ্ধ ভাঙা ভাঙা গলায় আতর্নাদের মতো করে বলতে লাগলো,
'আমি আর এভাবে থাকতে পারছি না ধারা। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করছে না। এভাবে অন্যের উপর বোঝা হয়ে বেঁচে থেকে কি লাভ? সামান্য নিজের কাজটুকুও আমি নিজে করতে পারছি না। এখান থেকে ওখানে যেতে হলেও আমাকে অন্যদের ডাকতে হয়৷ এমনকি বাথরুমেও আমি একা একা যেতে পারি না। অসহায়ের মতো পড়ে থাকি। কাপড় নষ্ট করে ফেলি। সেইসব তোমাকে পরিষ্কার করতে হয়। আমি আর এসব দেখতে পারছি না। সহ্য হচ্ছে না। তোমার ঘেন্না হয় না?'
ধারা শুদ্ধ'র হুইলচেয়ারের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে জোর গলায় বলল,
'না হয় না। কারণ আমি জানি আজ যদি আমি আপনার জায়গায় থাকতাম তাহলে আপনিও আমার জন্য এসব করতেন। ঘেন্না করে দূরে সরে থাকতেন না। আমরাই তো আমাদের জন্য সবসময় থাকবো তাই না! এখানে এমন কথা কেন আসবে?'
শুদ্ধ মাথা নেড়ে বলল, 'না ধারা। তুমি আমার কথা শোন। তুমি এখনো ইয়াং। তোমার পুরো জীবনটাই এখনো পড়ে আছে। আমার পেছনে তুমি তোমার জীবনটা নষ্ট করো না। আমার জীবনটা তো নষ্ট হয়েই গেছে। আমার দ্বারা আর কিছু হবে না। আমি আর কিছু পারবো না। কোন কাজও করতে পারবো না, সংসারও করতে পারবো না। তুমি কেন এভাবে পড়ে থাকবে? এখানে থেকে তোমার আর কিচ্ছু হবে না। তুমি নিজের জীবনটা নিয়ে ভাবো। একটা জীবন কিন্তু আর বারবার ফিরে পাবে না। এটাকে নষ্ট করো না। এখান থেকে চলে যাও। আমাকে নিয়ে ভেবো না। নতুন করে জীবন শুরু করো।'
ধারা কপট রাগ নিয়ে বলল,
'তুমি যদি আরেকবার এই কথাটা বলো তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না বলে দিচ্ছি। আমাকে ছুঁয়ে বলো তো, এখন যদি তোমার জায়গায় আমি থাকতাম তাহলে তুমি কি আমাকে ছেড়ে দিতে? নতুন করে জীবন শুরু করতে! এখন বলো? এখন চুপ করে আছো কেন? যেটা তুমি করতে না সেটা আমাকে করতে বলছো কেন? আর এমন কিই বা হয়েছে তুমি হাঁটতে পারছো না বলে, যার জন্য তোমাকে আমার ছেড়ে যেতে হবে! আমার তো কোন সমস্যা মনে হচ্ছে না। তুমি জানো, এক্সিডেন্টের পর তোমার অবস্থা কতোটা খারাপ ছিল! তোমার বাঁচার সম্ভাবনা পর্যন্তও ছিল না। আমি কতোটা ভয় পেয়েছিলাম! আল্লাহ'র কাছে শুধু পাগলের মতো একটা জিনিসই চাইছিলাম, আল্লাহ যেন তোমাকে বাঁচিয়ে দেন। আল্লাহ সেটা আমাকে দিয়েছে। আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই। তুমি যে বেঁচে আছো আমি এতেই অনেক খুশি। এই আমার কাছে অনেক। এখন তুমি কোন অবস্থায় আছো তাতে আমার কোন যায় আসে না। তুমি শ্বাস নিচ্ছো, এই পৃথিবীতে আছো, আমার কাছে আছো এর থেকে বেশি আর আমার কিছু চাওয়ার নেই। তুমি থাকা মানেই আমার পুরো পৃথিবী থাকা। তুমি যে আমার জন্য আমার জীবনে ঠিক কি অর্থ বহন করো সেটা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। কোনদিন হবেও না। তোমাকে আমি ভালোবাসি শুদ্ধ। তোমাকে ছাড়া থাকবো কি করে?'
কথাগুলো বলতে বলতে ধারার গলা ধরে এলো। চোখে পানি চলে এলো। শুদ্ধ'র অবস্থাও একই। শুদ্ধ অসহায়ের মতো ভরসা হারা গলায় বলল,
'এমনটা কেন হলো ধারা? এমনটা হবার কি খুব দরকার ছিল? ব্যাংকের লোন এখনও বাকি। আর এদিকে আমার সব কাজ প্রায় বন্ধের মতো। সামনে কিভাবে কি হবে আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছি না৷ কতো কষ্ট করে আমি সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিলাম। আর আজ সব এলোমেলো হয়ে গেলো। আমার সব স্বপ্ন নষ্ট হয়ে গেলো ধারা। আমার এতো দিনের পরিশ্রম সব খারাপ হয়ে গেলো। আমার বাকিটা জীবন শুধু এই হুইলচেয়ারেই বোধহয় কাটবে। আমি আর কোনদিন হাঁটতে পারবো না। কিচ্ছু করতে পারবো না। আমিও ফেইল হয়ে গেলাম। সব শেষ হয়ে গেলো ধারা৷ সব শেষ হয়ে গেলো।'
ধারার চোখে পানি চলে এলো। হুইলচেয়ারের হাতলে রাখা শুদ্ধ'র হাতের উপর দু হাত রেখে ধারা পাশ থেকে বলল,
'কিচ্ছু শেষ হয়নি শুদ্ধ। সব ঠিক হয়ে যাবো দেখো। শুধু একটু সময়ের প্রয়োজন। তুমি আবার হাঁটতে পারবে৷ তার জন্য তোমাকে চেষ্টা করতে হবে। মনের জোর রাখতে হবে। তুমি হাঁটতে পারবে।'
শুদ্ধ কান্না মাখা গলায় অস্ফুট স্বরে বলল,
'আমি পারবো না।'
ধারা জোর দিয়ে বলল, 'তুমি পারবে। অবশ্যই পারবে। তোমার নিজের উপর বিশ্বাস না থাকলেও আমার আছে৷ তোমার উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে শুদ্ধ। তুমি চেষ্টা করলেই পারবে। তুমি ভেঙে পড়তে পারো না৷ এতো দূর এসে তুমি হাল ছাড়তে পারো না। যেই শুদ্ধ আমার মতো মানুষকে নিজের উপর বিশ্বাস রাখা শিখিয়েছে আজ সেই শুদ্ধ এভাবে ভেঙে পড়তে পারে! একটা স্বাভাবিক সিস্টেমের বিপরীতে গিয়ে অন্যদের মতের তোয়াক্কা না করে যেই শুদ্ধ এমন ব্যতিক্রমী পথে হেঁটে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে সেই শুদ্ধ কি আজ এভাবে হাল ছেড়ে দিতে পারে! যে মানুষটা সবাইকে শক্ত থাকতে শেখায়, সবাইকে অনুপ্রাণিত করে, স্বপ্ন দেখতে বলে সেই মানুষটার মুখে কি এমন হেরে যাওয়া কথা মানায় বলো? তুমি তো হারতে কখনো শেখোনি! তোমার মনোবলে জাদু আছে শুদ্ধ। এই জাদুটা তুমি তৈরি করেছো। তুমি যা স্থির করো সেটা তুমি করেই ছাড়ো। আমি তো এমন একটা শুদ্ধকেই চিনি। এমন শুদ্ধকেই জানি। আমার জানাটা তো ভুল হতে পারে না। আমি সেই শুদ্ধটাকেই আবার দেখতে চাই। সবসময় দেখতে চাই। আমাকে দেখাবে না?'
শুদ্ধ কাঁদতে লাগলো। শুদ্ধ'র চোখের পানি মুছে দিয়ে অনেকদিন আগে একবার ধারাকে বলা শুদ্ধ'র কথা অবিকল শুদ্ধ'র মতো করেই ধারা বলতে লাগলো,
'কাঁদবেন না শুদ্ধ। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি পাশ করুন বা ফেল করুন, ভালো করুন, খারাপ করুন আমি সবসময় আপনার সাথে আছি। সবসময়!'
অশ্রুসিক্ত চোখে শুদ্ধ ধারার দিকে আলতো করে তাকালো। তারপর ধারার ভরসা মাখা মুখের দিকে শুধু তাকিয়েই রইলো।
পরদিন সকাল সকাল ধারা শুদ্ধকে নিয়ে বাইরে বের হলো। হুইলচেয়ার টেনে একটা নিরিবিলি ফাঁকা রাস্তায় এনে থামলো ধারা। শুদ্ধ ধারার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বুঝতে পারলো না। ধারা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে শুদ্ধ'র পায়ের দিকে ইশারা করে বলল,
'ডাক্তার বলেছে তোমাকে অবশ্যই নিজ থেকে হাঁটার চেষ্টা করতে হবে। পায়ের ব্যায়াম করতে হবে। তুমি আস্তে আস্তে পা মাটিতে রেখে হাঁটার চেষ্টা করো তো!'
শুদ্ধ কয়েকবার চেষ্টা করলো। পারলো না। একসময় ক্লান্ত মুখে বলল, 'হবে না ধারা। ডাক্তার রোগীর মন রাখার জন্য এরকম বলেই। আমি তো বুঝি, আমি কেমন পারছি! আমি পারবো না।'
শুদ্ধ'র ভরসা হারা নত মুখের সামনে ধারা তার ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরলো। সেই হাতের অনুসরণে ধারার মুখের দিকে শুদ্ধ তাকাতেই একটা ভরসা মাখা হাসি দিলো ধারা। শুদ্ধ আস্তে করে ধারার হাতের মধ্যে নিজের হাতটা রাখলো। ধারা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। আস্তে আস্তে কাঁপা কাঁপা পায়ে খুব কষ্ট করে হুইলচেয়ার থেকে মাটিতে পা রাখলো শুদ্ধ। ধারার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ালো সে। এক কদম সামনে ফেলার চেষ্টা করতেই পড়ে যেতে নিলো শুদ্ধ৷ ধারা দু হাত দিয়ে ধরে সামনে নিলো। শুদ্ধ'র একটা হাত নিজের কাঁধের উপর তুলে নিয়ে তাকে হাঁটাবার চেষ্টা করতে লাগলো। পাশাপাশি থেকে শুদ্ধকে বারবার পড়ে যাওয়া থেকে সামলাতে লাগলো সে। এগিয়ে চললো সামনে।
এরপর থেকে সত্যিকার অর্থেই ধারা শুদ্ধ'র পাশে থেকে সবটা সামলালো। ছায়ার মতো সবসময় সাথে থেকে শুদ্ধকে উৎসাহিত করলো, ভরসা দিলো, ভেঙে পড়তে দিলো না। তার শরীর ও মনের যত্ন রাখার পাশাপাশি তার কর্মজীবনেরও দেখভাল করলো। শুদ্ধকে হুইলচেয়ারে করে তার কর্মক্ষেত্রে নিয়ে যেতে লাগলো। কখনো ঘরে কখনো বাইরে যেভাবে শুদ্ধ'র একটু সুবিধা হয় সেভাবে ব্যবস্থা করলো। শুদ্ধ'র থেকে কাজ বুঝে নিয়ে তার অনুপস্থিতে মাঝে মধ্যে ধারাই সামলে নিতে থাকলো সেসব। যেখানে শুদ্ধকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ধৈর্য্যের সাথে যতক্ষণ সময়ই লাগুক ধারা নিয়ে যেতো। যা সে একা একা সামলাতে পারতো তা একাই করতো। শুদ্ধ শুধু অবাক হয়ে দেখতে থাকে ধারাকে। এই মেয়েটাই একদিন সামান্য কিছুতেই ভড়কে যেতো, নার্ভাস হয়ে পড়তো, কিছু পারতো না। আর আজ সেই মেয়েটাই কিভাবে শক্ত হাতে ঘরে ও বাহিরে সবকিছু সামলে চলছে! কতো বড় দায়িত্ব নির্ভয়ে মাথা পেতে নিয়ে নিয়েছে। তার উপর পুরো দস্তর শুদ্ধ'র শরীরের যত্ন রাখা তো আছেই। না সে হাল ছেড়ে দিচ্ছে আর না শুদ্ধকে ছাড়তে দিচ্ছে। একটা কথা আছে না, "নারীকে তুমি যাই দিবে তা সে বহুগুণে তোমাকে ফিরিয়ে দেবে।" সেই কথার যথাযথ বাস্তব প্রয়োগ ঘটালো ধারা। শুদ্ধ একসময় এই ধারাকে আত্মবিশ্বাসী, সাহসী, নির্ভয়া করেছিল। আজ সেই রূপ দিয়েই ধারা শুদ্ধ'র জীবনটাকে এলোমেলো হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখলো। ধারার দূর্বল হাতটাকে শুদ্ধ শক্ত করে তুলেছিল বলেই আজ সে সেই শক্ত হাতে শুদ্ধকে আঁকড়ে ধরতে পারলো। দূর্বল হতে দিলো না।
পাঁচ বছর পর,
শুদ্ধ ধারা বসে আছে একটা অ্যাওয়ার্ড ফাংশনে। খোদেজা আসেনি। বরাবরের মতোই এমন অপছন্দনীয় জায়গায় না আসার জন্য সে শুদ্ধ ধারার আড়াই বছরের মেয়েকে দেখভালের বাহানা দিয়ে বাসায় থেকে গেছে। এই বছর সেরা কৃষি উদ্যেক্তার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে শুদ্ধ। সে এখন একজন পরিপূর্ণ সফল মানুষ। সফল কৃষি উদ্যেক্তা, দক্ষ ব্যবসায়ী, এবং একজন মোটিভেশনাল স্পিকার। অসংখ্য গবেষণা চালানোর পর তার উদ্ভাবিত নতুন প্রজাতির ধান এখন কৃষি বিভাগ থেকেই স্বীকৃত। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে এখন সেই ধান চাষের ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। কৃষকদের দারিদ্র্যের জীবনে অনেকাংশেই পরিবর্তন এনে দিয়েছে এই ধান। ধানের সাথে সাথে শুদ্ধ'র নাম এখন সমগ্র দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। তরুণ সমাজের কাছে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শুদ্ধ। সে যে একজন পতিতার ছেলে এই খবরও এখন আর এতো লুকিয়ে ছাপিয়ে নেই। সবাই জানে সত্য। শুদ্ধই জানিয়েছে। তবুও তাকে এই ব্যাপারে খুব একটা সমলোচিত হতে হয়নি। কারণ শুদ্ধ তার ক্ষুদ্র জীবনে এতো কিছুই করেছে যে তাকে নিয়ে বলার মতো আরো অনেক কিছুই আছে। তার জন্ম পরিচয় এখন আর অতো মুখ্য নয়। সেই দূর্ঘটনার ছয় মাসের মাথাতেই শুদ্ধ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠে। আবার হাঁটতে পারে। ধারার যত্ন, সাহায্য আর নিজের মনোবলের জোরে ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে। তারপর ধীরে ধীরে অর্জন করে জীবনের কাঙ্খিত সাফল্য। আল্লাহ দিলে এখন আর তার জীবনে কোনকিছুরই অভাব নেই। সফলতার চূড়ান্ত ধাপে পদার্পণ করে ফেলেছে সে। এই পাঁচ বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। চুমকির বিয়ে হয়েছে। শুদ্ধ ধারার জীবনে পরীর মতো ছোট্ট একটি রাজকুমারী এসেছে। কাজের পরিসর আরো বেড়েছে। জীবনের ধরণ বদলে গেছে। রূপনগরের জন্যও অনেক কিছু করেছে শুদ্ধ। সেখানকার কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেছে। গ্রামের মানুষগুলো শুদ্ধকে নিয়ে অনেক গর্ববোধ করে। রূপনগরে অবিকল পূর্বের মতোই নতুন করে অর্ধপাকা দোচালা টিনশেডের বাড়ি বানিয়েছে সে। প্রতি মাসে এক সপ্তাহ তারা সেখানে গিয়ে কাটিয়ে আসে। তাদের সেই প্রিয় রূপনগরে। সাদা শার্টের উপর কালো স্যুট পড়ে অ্যাওয়ার্ড নেওয়ার সময় শুদ্ধ তার সাফল্যের পুরো কৃতিত্ব তার মা আর স্ত্রীকে দিয়ে দিলো। তার আজকের এতোদূর আসার পেছনে তাদের অবদানও তুলে ধরলো। শুদ্ধ অ্যাওয়ার্ড নিয়ে যাবার পর হোস্ট শুদ্ধ'র প্রশংসার পর ধারারও ভীষণ প্রশংসা করলো। তখন শুদ্ধ আলোচনার ভেতরে ছিল বলেই তার দূর্ঘটনার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার মধ্যকার সময়ে ধারার কৃতিত্ব সবারই টুকটাক নজরে ছিল। একজন আদর্শ স্ত্রী হিসেবে ধারাকে আখ্যায়িত করলো। তারপর কিছু বলার জন্য স্টেজে আসার অনুরোধ করলো ধারাকে। পাশে বসা শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে একবার স্মিত হেসে খুবই সুন্দর মেরুন রঙের একটা ভারী শাড়ি গায়ে ধারা স্টেজে উঠে আসলো। এই ধারাও এখন আর সাধারণ কেউ নয়। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে এখন সে একটা স্বনামধন্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে আছে। মাঝে মধ্যে টুকটাক লেখালেখিও করে। যেই মেয়েটি আগে নিজে থেকে কোন কথাও বলতে পারতো না আজ সেই মেয়েটিই নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, মতামত অকপটে তুলে ধরে তার লেখায়। জিপিএ ফাইভ না পেলে জীবনে আর ভালো কিছু হবে না, এই ধারণাকে সে ভুল প্রমাণিত করেছে। ধারার বাবা কাকাও এখন তাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। সবাই আগ্রহ করে ধারার বক্তব্য শোনার জন্য বসে থাকে। ধারা হোস্টের জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে মাউথ স্পিকারটা ঠিক করে সবার দিকে তাকিয়ে একবার মৃদু হাসলো। তারপর আস্তে করে বলতে শুরু করলো,
'খুব সাধারণ একটি মেয়ে ছিলাম আমি৷ গ্রামের আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ে যেমন হয়, হয়তো তার থেকেও আরেকটু বেশিই সাধারণ। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা, অন্যের উপর নির্ভর হয়ে থাকা, ভয় পাওয়া, ঘাবড়ে যাওয়া ছিল আমার চিরাচরিত স্বভাব। এমন একটা সময় ছিল যখন আমার আগে পিছে শুধু অন্ধকারই চোখে পড়তো। নিজের বলতে কোন স্বপ্ন ছিল না। কোন লক্ষ্য ছিল না। একটা গন্তব্যহীন নাবিকের মতো অথৈ সমুদ্রে শুধু ভাসছিলাম। সেই সময় শুদ্ধ নামের এই মানুষটা আসে আমার জীবনে। তারপর হুট করেই একটা জাদুর মতো আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনটা রঙিন বানিয়ে দেয়।'
ধারা মাথা নিচু করে মৃদু থামে। পেছনের কথা মনে আসায় খানিক আবেগী হয়ে উঠে। শুদ্ধ'র দিকে এক পলক তাকায়। ধারাকে ভরসা দিতে চোখের পলক ফেলে শুদ্ধ মিষ্টি করে হাসে। নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা আবারো বলা শুরু করে,
'তাকে নিয়ে আর নতুন করে কি বলবো? সে একজন অসাধারণ মানুষ। তার থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। শিখেছি কিভাবে নিজের লক্ষ্যে অটল থাকতে হয়, নিজের স্বপ্নের পেছনে লাগামহীন লেগে থাকতে হয়। স্বপ্ন কি? এটাও আমি তার থেকে শিখেছি। তার এই স্বপ্নের পথটা সহজ ছিল না। সাত বছর লেগে গেছে। তবে অবশেষে সে তার পরিশ্রম আর চেষ্টা দিয়ে তা অর্জন করেই ছেড়েছে। যেভাবে সে অনেক বছর আগে অর্জন করেছিল আমার মনটাকেও। সে আমার জন্য অনেক করেছে। অনেক! আমি আগে এরকম একদমই ছিলাম না।
সে তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব দিয়ে আমার সেই নড়বড়ে স্বভাবের আপাদমস্তক পুরোটাই পাল্টে দেয়। আমার নিজের সাথে নিজের পরিচয় করায়, স্বপ্ন দেখাতে শেখায়, নিজের হয়ে কথা বলতে শেখায়। আমার জীবনটা গুছিয়ে দিতে, এই পৃথিবীতে লড়াই করার মতো যোগ্য বানাতে সে তার ভালোবাসা আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার সাথে সবসময় ছায়ার মতো লেগে ছিল। আমি কি করেছি না করেছি তা কমবেশি অনেকেই জানে। কিন্তু সে আমার জন্য যে কতোটা করেছে তা সকলেরই অজানা৷ আমার জীবনে তার কৃতিত্ব বর্ণনাতীত। আজ এই যে আমি এতগুলো লোকের সামনে স্টেজে দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলে যাচ্ছি, এটাও তারই জন্য। নয়তো আমি তো আগে আমার ফ্যামিলির লোকের সামনেও ঠিক মতো কথা বলতে পারতাম না। আমি খুব অসাধারণ কিছু করেছি বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু সে যা করেছে তা সাধারণ ছিল না। মেয়েরা এমনই। সংসারের জন্য তারা যেকোন কিছু করতে পারে। তারা একটা বৃক্ষের মতো। সেই বৃক্ষকে একটা নতুন জায়গায় বেড়ে উঠার সময় আপনি তাকে যতো যত্ন দিবেন, সে ততোটাই বড় হয়ে আপনার সংসারটাকে নিজের ছায়াতলে আগলে রাখবে৷ কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েরাই সেই যত্ন, সেই সহযোগীতাটা পায় না। সেই বর্ণনাতীত যত্নটা আমি পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম বলেই হয়তো প্রয়োজনে আমি আমার পরিবারের জন্য কিছু করতে পেরেছি৷ একটা সংসার, একটা সম্পর্ক, একটা বন্ধন তো এমনই হওয়া উচিত তাই না! যেখানে দুজন, দুজনের শক্তি হয়ে থাকবে। যখন একজন দূর্বল হয়ে পড়বে তখন আরেকজন শক্ত থাকবে, আবার যখন সে দূর্বল হয়ে পড়বে তখন অপরজনকে শক্ত থাকতে হবে। দুজন দুজনের দিকে নিজেদের সহযোগিতার হাতটা বাড়িয়ে রাখবে, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে। যখন আপনি এই বিশ্বাসটা পাবেন যে আপনার যাই হয়ে যাক, আপনার পেছনে একটা ভরসার হাত সবসময় বাড়ানো আছে, তখন আপনি কখনো পুরোপুরি ভেঙে পড়তে পারবেন না। জীবনে যতোই ঝড় ঝাপ্টা আসুক আপনি তার মোকাবেলা করতে পারবেন। একটা সংসারের জন্য দুজনকেই দুজনের দিকে সমান ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। একে অপরের স্বপ্নকে নিজের মনে করে চলতে হবে, আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা দিতে হবে, ভালোবাসায় রাখতে হবে। দুজনকেই। শুধু যেকোন একজনকে না। দেখবেন, যেই সমস্যাই থাক একদিন ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। সংসার সুন্দর হবে। জীবনে প্রকৃত সুখ আসবে। তাই শুধু অর্ধেকটা না। এবার থেকে পুরোটাই বলুন,
"সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে
গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে।"
****সমাপ্ত****
[শেষ হয়ে গেল গল্পটা! কেমন যেন মনে হচ্ছে না। হয়তো হবে যখন অভ্যাসবশত প্রতিদিনের মতো আবারও হঠাৎ করে লিখতে বসে যাবো। তখন হয়তো খেয়ালে আসবে, আরে! এই গল্প তো শেষ। গল্পটা শুরু করার সময় ভেবেছিলাম খুব বেশি বড় করবো না। খুবই অল্প পর্বে সংক্ষেপের মধ্যে পুরো কাহিনীটা তুলে ধরবো। কিন্তু পারলাম না। এই গল্পটা লিখতে বসলে কেন যেন সংক্ষেপে আনতে পারি না। লেখা শুধু বেরোতেই থাকে, বেরোতেই থাকে। ফুরাবার নাম নেয় না। যার ফলে একটার পর একটা পর্ব বাড়তে থাকে আর গল্প হতে থাকে বড় থেকে বড়। হয়তো মাঝে মধ্যে এতো দীর্ঘ দীর্ঘ বর্ণনা দিয়ে পাঠকদেরকেও বিরক্ত করে ফেলেছি। তাই দুঃখিত! কোন ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা করবেন, কেমন? সম্পূর্ণ গল্পটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন লাগলো জানাবেন। শীঘ্রই নতুন গল্প নিয়ে ফিরে আসবো। ততদিন ভালো থাকবেন আর পাশে থাকবেন।]
~সুপ্তি লেখিকা
===========================
পড়তে থাকুন চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।
Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.
( Post By- Kam Pagol)
•
|