Thread Rating:
  • 9 Vote(s) - 2.22 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
হাতটা রেখো বাড়িয়ে (Writer: ইশরাত জাহান)
#21
 পর্ব -১৫




রাত এগারোটা। শুদ্ধ বসে আছে একটা ল্যাপটপ নিয়ে। তার সামনেই বইয়ের স্তূপ সাজিয়ে বসে আছে ধারা। তার কোলের উপর একটা মোটা বই। বইয়ের গভীরে তার দৃঢ় মনোযোগ। তার খোলা রেশমী কালো চুলগুলো কাঁধ জুড়িয়ে এসে পড়েছে সামনে। সেদিকে ধারার ভ্রুক্ষেপ নেই। শুদ্ধ'র দেখে ভালো লাগলো। যেই স্বপ্নটা ধারাকে নিয়ে সে দেখেছে, সেই স্বপ্নের রেশ ধীরে ধীরে এখন ধারার মনেও সঞ্চারিত হচ্ছে। এতদিনে ধারাও তার পড়াশোনার দিকে ভালোমতোই ঝুঁকে গেছে। মন দিয়ে নিচ্ছে সে পরীক্ষার প্রস্তুতি। শুদ্ধ খানিক গলা খাকারি দিয়ে ধারাকে ডেকে বলল,

'কি ব্যাপার ধারা? আজকে দেখি আপনি একবারও ঘুমে ঝিমাচ্ছেন না। এতো রাত হবার পরেও!'

ধারা স্মিত হেসে বলল,
'আজকে আমি দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম। আপনি তো আপনার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তাই দেখেননি। তাছাড়াও এখন পড়াটা অনেকটাই ধরতে পারছি বলে পড়ে ভালো লাগছে।'

'এমনভাবেই যদি পড়তে থাকেন না তাহলে দেখবেন আপনি ইনশাআল্লাহ ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাবেন।'

'চান্স পাবো কিনা আমি শিওর বলতে পারছি না। কিন্তু আমার ভয় লাগছে। বাবা আর কাকা এখনও কিছু জানে না। বাবা তো আমাকে আর পড়াতেই চায়নি। একারণেই তো বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আর এখন তাকে না বলেই আমি পড়ালেখা শুরু করে দিয়েছি তার উপর বিভাগ পরিবর্তন করে....না জানি বাবা শুনলে কি করে!'

ধারাকে আশ্বাস দিয়ে শুদ্ধ বলল,
'ধারা, এতো ভয় পাবেন না। আপনি কোন ভুল করছেন না। প্রতিটা কাজের দুটি অংশ থাকে। ঠিক অথবা ভুল। যতক্ষণ আপনার বিবেক জানে আপনি কোন ভুল করছেন না ততক্ষণ তা নিয়ে কখনো শঙ্কিত হবেন না। আপনার বাবাকে আপনি সবটা খুলে বলবেন। আপনাকে আমি পড়ালেখা করাবো। আপনার যতদূর ইচ্ছা আপনি পড়বেন। বলেছি না! সবসময় মনে রাখবেন আমি আপনার পাশে আছি।'

ধারা নানা শঙ্কায় থেকেও একটা ভরসার হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলো। শুদ্ধ বলল,
'একবার ইউনিভার্সিটিতে গেলে এসব কিছুই আর তখন আপনার মনে থাকবে না। ইউনিভার্সিটির লাইফটা যে কি না দেখলে মিস করবেন।'

'আপনি খুব মিস করেন বুঝি?'

'হুম। খুব! এতোবছর বন্ধুদের সাথে থাকতে থাকতে বন্ধুগুলা একদম আপনের থেকেও বেশি হয়ে যায়। আমরা যে একসাথে কত আড্ডা মজা করতাম! সেগুলো মনে পড়লে আপনাআপনিই মন ভালো হয়ে যায়। আমার তো অনেকগুলো ফ্রেন্ড ছিল। আপনার কয়জন ফ্রেন্ড ধারা?'

ধারা মনে মনে কিছু ভাবলো। তার আসলে কোন ফ্রেন্ড নেই। এই কথাটা যে শুনে সেই অবাক হয়। এখন এটা শুদ্ধ জানলে নিশ্চয়ই তাকে এ নিয়েও ক্ষ্যাপাবে। এদিকে ধারা মিথ্যাও বলতে চায় না। তাই বলল, 'আমি বলবো না।'

শুদ্ধ অবাক হয়ে বলল, 'কেন?'

'এমনিই।'

'এমনিই মানে?'

'এমনিই মানে এমনিই।'

শুদ্ধ ধারার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল, 'আপনি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন?'

শুদ্ধ ঝুঁকে পড়ায় ধারার মাথাও কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিল। শুদ্ধ একদম তার চোখের মধ্যে তাকিয়ে আছে। একটা ঢোক গিলে ধারা কাঁচুমাচু করতে লাগলো। শুদ্ধ যেভাবে ধারার মনের সব কথাই বুঝে যায় না জানি আবার এবারো বুঝে ফেলে। ধারাকে সেই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিলো লোডশেডিং। হঠাৎ চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় শুদ্ধ তার ভ্রু কুঁচকানো দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অন্ধকার দেখে চমকে সোজা হতে যেতেই শুদ্ধ'র মাথার সাথে জোরে একটা বারি খেলো ধারা। শুদ্ধ ব্যাথাটা চেঁপে গিয়ে সোজা হয়ে বসলো। অন্ধকারে না বুঝে আবারো সেখান থেকে সরতে গিয়ে আবারো শুদ্ধ'র মাথার সাথে আরেকটা বারি খেলো ধারা। শুদ্ধ এবার বলেই ফেললো,
'ছোটবেলায় মাথায় শিং গজাবার মজাটাকে আপনি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন তাই না ধারা! আমার মাথায় শিং গজাবার চান্স থেকে বাঁচিয়ে কৃতার্থ করলেন।'

কপালে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে ধারা বলল,
'আপনি এখন খোঁচা না মেরে কোন লাইট নিয়ে আসুন।'

শুদ্ধ গিয়ে নিচ থেকে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে নিয়ে আসলো। ধারার সামনে রেখে দিলে আবার বই খুলে পড়তে বসলো ধারা। আর শুদ্ধ ব্যস্ত হলো তার নিজের কাজে। শ্রাবণ মাস চলে যাবার পরপর বৃষ্টিরও বহুদিন হলো কোন হদিস নেই। ভ্যাপসা গরমে বৈদ্যুতিক ফ্যান ছাড়া কোন উপায় নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই গরমে ধারা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেলো। কিছুতেই পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারলো না। শুদ্ধ বলল,
'কারেন্ট তাড়াতাড়ি আসবে বলে তো মনে হয় না। আজকে আর পড়তে হবে না ধারা। আপনি শুয়ে পড়ুন।'

ধারা গলা থেকে তার নীল রঙের ওড়নাটা একটু আলগা করে একটা খাতা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলল, 'এই গরমের মধ্যে শুয়েই কি হবে! ঘুম তো আর আসবে না। যেই গরম!'

শুদ্ধ খেয়াল করলো আসলেই খুব গরম। রুমের মধ্যে টিকে থাকা মুশকিল। একবার বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে ধারার হাত ধরে টেনে বলল,
'চলনে বাইরে যাই।'

ধারা কিছু বলার আগেই শুদ্ধ তাকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে এলো। বাইরে ভরা পূর্ণিমা। চাঁদের আলো নারকেল গাছের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে প্রবেশ করে উঠোনে আলো রেখার নকশা তৈরি করেছে। কৃত্রিম আলোর ছুটি হওয়ায় জোৎস্না যেন আজ পূর্ণ রূপে প্রকাশ পেয়েছে। শুদ্ধ রান্নাঘরের বেড়ার গায়ের সাথে টাঙানো একটা শীতল পাটি নিয়ে আসে। তারপর উঠোন পেরিয়ে ধারাকে নিয়ে চলে এলো পুকুর পাড়ে। ধারা অভিভূত হয়ে গেলো। সামান্য চাঁদের আলোও যে কতো সুন্দর হতে পারে এই মুহুর্তে এইখানে না দাঁড়ালে কেউ বুঝতে পারবে না। আকাশের হাজারও তারকারাজির মাঝখানে হীরকখণ্ডের ন্যায় জ্বলজ্বল রত একটা পূর্ণ চাঁদ। যার স্থবির প্রতিবিম্ব পড়েছে পুকুরের স্বচ্ছ জলে। সেই আলোয় উজ্জ্বলতা পেয়েছে পুকুরের মাঝে জন্ম নেওয়া পদ্ম ফুলের দল। আহা, কি সুন্দর!

পাড় ঘেঁষে জন্মানো ঘাসের উপরে শুদ্ধ হাতের শীতল পাটি টা বিছিয়ে দিলো। তার উপরে ধারাকে বসতে বলে নিজেও বসে পড়লো সে। হালকা শীতল হাওয়া বইছে বলে তাদের দুজনেরই প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনে জ্যোৎস্না বিলাসের পর শুদ্ধ'ই প্রথমে ডেকে উঠলো,
'ধারা!'
ধ্যান ভঙ্গ হয়ে ধারা জবাব দিল,
'হুম?'
'একটা গান শুনান তো!'
'আমি গান পারি না।'
'গান কেউই পারে না। আবার পারে সবাই। কি সুন্দর পরিবেশ দেখেছেন? শুনান না একটা গান।'
ধারা লজ্জা পেয়ে বলল,
'উহুম! আমারটা ভালো হয় না।'
'আহা! শুনান না একটা। আপনাকে তো স্টেজে পারফর্ম করতে বলছি না! অতো ভালো হওয়া লাগবে না। আপনি যেমন পারেন গাইবেন। প্লিজ শুনান না একটা গান।'
ধারা বিব্রত হতে হতে বলল, 'আপনি কিন্তু হাসতে পারবেন না।'
'আচ্ছা।'
ধারা সামনে তাকিয়ে হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে আস্তে আস্তে গাইতে লাগলো,
'আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী
সাথী মোদের ফুল কুঁড়ি,
লাল পরী, নীল পরী.....

এতটুকু গাইতেই শুদ্ধ বহু কষ্টে হাসি চেঁপে রেখে হঠাৎ ফস করে হেসে ফেললো। ধারা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, 'আপনাকে কিন্তু আমি বলেছিলাম আপনি হাসতে পারবেন না। আপনি হাসলেন কেন? আমি কিন্তু আগেই বলেছিলাম আমি ভালো গাইতে পারি না।'
শুদ্ধ হাসি থামাতে থামাতে বলল,
'আপনার গাওয়াতে কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা হলো গানে।'
'কেন? গানে কি সমস্যা?'
'এমন একটা সুন্দর পরিবেশে, পাশে এমন একটা হ্যান্ডসাম ছেলে থাকলে যে কিনা সম্পর্কে আপনার হাজবেন্ড হয় সেখানে কি কেউ এমন গান গায়!'
ধারা পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বলল, 'তাহলে কেমন গান গায়? আপনিই বলে দিন।'
শুদ্ধ কিছুটা থেমে বলল, 'আচ্ছা ধারা আপনাকে এই পর্যন্ত কয়টা ছেলে লাভ লেটার দিয়েছে?'
ধারা দ্রুত জবাব দিয়ে ফেললো, 'একটাও না।'
শুদ্ধ চরম আশ্চর্যের স্বরে বলল, 'কি বলেন! আপনাকে তো বইয়ের পরিভাষায় সাংঘাতিক সুন্দরীই বলা যায়। আর আপনি কিনা কোন লাভ লেটার পাননি?'
ধারা ভ্রুকুটি করে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। তার ঠিক ছয় ইঞ্চি দূরত্বেই বসে আছে ছেলেটা। গায়ে পাতলা একটা সাদা শার্ট। হাতা কনুইয়ের কাছে ফোল্ড করে রাখা। বাতাসে গোছানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উঠছে। মুখে একটা দুষ্ট হাসি। যার মূলে আছে শুধু ধারাকে ক্ষ্যাপানো। ধারা গভীর অতীতে ঝাঁপ দিয়ে দেখলো ক্লাস ফোর এ থাকতে তাকে তার কলেজেরই একটা ছেলে খাতায় আই লাভ ইউ লিখে দিয়েছিল। তা দেখে ধারা সেটাকে নোংরা কথা ভেবে এতোটাই জোরে জোরে কেঁদেছিল যে ছেলেটা হেড মাস্টারের কাছে বিচার যাওয়ার ভয়ে আর কোনদিন ধারার সামনেই আসেনি। কিভাবে যেন এই কথাটা ধীরে ধীরে পুরো কলেজে ছড়িয়ে যায়। তারপর থেকে প্রাইমারী থেকে হাইকলেজ, সব ছেলেদের মাথাতেই এটা গেঁথে যায় এই মেয়েকে আর যাই হোক প্রপোজ করা যাবে না। তারপর কলেজেও ধারার নিরামিষ মার্কা স্বভাবের জন্য সব ছেলেরা তার থেকে দূরে দূরেই থাকতো। একারণেই হয়তো আজ পর্যন্ত তার কাছে কোন লাভ লেটার আসেনি। কিন্তু এই কথাটা মরে গেলেও খোঁচারাজকে জানানো যাবে না। তাই ধারা তার কথা কাঁটাতে শুদ্ধকে উল্টা প্রশ্ন করলো, 'আমারটা বাদ দিন। আপনি কয়টা লাভ লেটার পেয়েছেন?'
মাথার নিচে একটা হাত রেখে পাটিতে শুয়ে পড়ে শুদ্ধ বলল, 'কতগুলো! বেশিরভাগই ইউনিভার্সিটিতে থাকতে।'
ধারা প্রশ্নটা করেছিল এমনি এমনিই। শুদ্ধ'র উত্তর শুনে আকাশ থেকে পড়ে বলল, 'আপনাদের ওখানে মেয়েরাও লাভ লেটার দেয়?'
'আপনি শহরের মেয়েদেরকে কি ভাবেন? ওদের মনে যেটা থাকে সেটা ওরা প্রকাশ করে দেয়। অবশ্য সবাই না।'

'তারপর? আপনি একসেপ্ট করেছেন কয়টা?'

শুদ্ধ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
'বিশেষ একজনের অপেক্ষায় আছি। সে করলেই একসেপ্ট করবো।' 

ধারার হঠাৎ ই কেন যেন খুব লজ্জা করতে লাগলো। আস্তে আস্তে মাথা নিচু করে ফেললো সে। ঠিক তখনই তার বাম কাঁধে কারো উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পড়তেই পুরো পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলো ধারা। পেছন থেকে উঠে বসে শুদ্ধ ধারার কানে কানে গাইতে লাগলো,

"এখন অনেক রাত
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস,
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!
ছুঁয়ে দিলে হাত,
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা
চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়!
কেন যে অসংকোচে অন্ধ গানের কলি
পাখার ব্লেড-এর তালে সোজাসুজি কথা বলি!
আমি ভাবতে পারিনি, 
তুমি বুকের ভেতর ফাটছো আমার
শরীর জুড়ে তোমার প্রেমের বীজ!
আমি থামতে পারিনি,
তোমার গালে নরম দুঃখ,
আমায় দুহাত দিয়ে মুছতে দিও প্লিজ!"

শুদ্ধ'র গান থেমে যাওয়ার পরও ধারা সেভাবেই জমে রইলো। তার শরীরের প্রতিটি লোম যেন দাঁড়িয়ে গেছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সম্পূর্ণ নতুন একধরণের মাতাল শীহরণে তার মন হয়ে উঠেছে আন্দোলিত। মাথার উপরে পূর্ণিমার চাঁদ, তার উপচে পড়া জ্যোৎস্না, পুকুর ছুঁয়ে ভেসে আসা শীতল হাওয়া, তার উপরে কানের কাছে এমন গান, স্পেশালি শুদ্ধ'র ওমন জড়ানো গলার স্বর....সরল অনুভূতি এলেমেলো না হয়ে কি পারে!

ধারা ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। আর সঙ্গে সঙ্গেই চলে এলো কারেন্ট। নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা আস্তে আস্তে বলল,
'বাড়িতে যাবেন না? কারেন্ট চলে এসেছে।'
শুদ্ধ বসে থেকেই তার সহজ ভঙ্গিতে বলল, 'হুম, দেখলাম তো। আচ্ছা ধারা! আমার গান কেমন হয়েছে বললেন না তো!'
কিছু না বলে মৃদু হেসে বাড়ির দিকে চলে যেতে লাগলো ধারা। শুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 
'সাবধানে ধারা! আপনি পড়ে যাচ্ছেন।'
অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে নিজের পায়ের দিকে লক্ষ করে ধারা বিভ্রান্ত স্বরে বলল,
'কোথায়?'
মুচকি হেসে দু হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে শুদ্ধ বলল,
'প্রেমে!'



চলবে********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 2 users Like Bangla Golpo's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#22
DARUN
[+] 1 user Likes saibalmaitra's post
Like Reply
#23
(27-05-2024, 04:23 PM)saibalmaitra Wrote: DARUN


ধন্যবাদ আপনাকে উৎসাহিত করার জন্য।
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#24
পর্ব -১৬


সকাল থেকেই শুদ্ধদের বাড়িতে একটা জমজমাট ভাব। শহর থেকে শুদ্ধ'র কিছু ফ্রেন্ড এসেছে। সবগুলোই মেয়ে। সকাল দশটা নাগাদ রূপনগর গ্রামে পৌঁছেছে তারা। সারাদিন থেকে আবার সন্ধ্যার পরে চলে যাবে। সবকিছু আগে থেকেই পূর্বপরিকল্পিত ছিল। তারা সবাই শহুরে, কখনো গ্রাম দেখেনি। শুদ্ধদের বাড়িতে আসার ইচ্ছে সেই ইউনিভার্সিটি লাইফ থেকেই ছিল। অবশেষে একটা শক্ত পরিকল্পনা করে চলেই এসেছে সবাই। প্রায় চার পাঁচটা মেয়ে। সবার পরনেই আধুনিক পোশাক। সাথে সুন্দরীর খেতাব তো আছেই। সকাল থেকেই তাদেরকে বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছে ধারা। খোদেজার সাথে রান্না বান্নায় সাহায্যর সাথে সাথে তার আড়চোখের দৃষ্টি শুধু সেদিকেই যাচ্ছে। একটু আগে খোদেজা বলেছিল ধারাকে, মেহমানদের ট্যাং গুলিয়ে শরবত বানিয়ে দিতে। ধারা কিছু ফলমূল কেটে সাথে শরবতের গ্লাস নিয়ে ট্রে সমেত গেলো শুদ্ধ'র ফ্রেন্ডদের কাছে। শুদ্ধ ওদের সাথেই বসে খোশগল্পে মজেছে। এদের মধ্যে সবাই যে শুদ্ধ'র ভালো ফ্রেন্ড এরকম নয়। কেউ কেউ ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড আর ভালো ক্লাসমেট সূত্রেও আছে। ধারা সেখানে গিয়ে শুনতে পেলো শুদ্ধ বলছে,
'তোরা একা চলে এলি কেন? রাকিব, শিহাব, তুহিন ওদেরকেও সাথে নিয়ে আসতি।'

শুদ্ধ'র সবথেকে ভালো ফ্রেন্ড তিশা বলল,
'কেন? ওদেরকে নিয়ে আসতে হবে কেন? ঐ হারামীগুলা যে এর আগে একা একা বেড়িয়ে গেলো! তখন আমাদের আনছিলো? ওরা ছেলেরা ছেলেরা একা বেড়িয়ে গেছে এখন আমরা মেয়েরা মেয়েরা একা বেড়াবো। আমরা মেয়েরাও কোন কিছুতে কম না।' 

শুদ্ধ মৃদু হাসলো। তিশা বলে উঠলো,
'তুই হাসবি না। তুই হইলি গিয়া আরেকটা হারামী। একা একা বিয়ে করে ফেললা! আমাদের খবর দিছিলা?'

'খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে হয়ে গেছে রে। কাহিনী আছে অনেক। তোরা বুঝবি না।'

'তুই তোর কাহিনী নিয়া চুপ থাক! তোর বউরে ডাক। গল্প করি।'

ধারা ট্রে হাতে ওদের সামনে গিয়ে নামিয়ে রাখলো। তিশা আর বাকি সবাই আরো একবার ভালো মতো দেখে নিলো তাদের সামনে দাঁড়ানো উনিশ বছরের সুন্দরী মেয়েটিকে। তিশা একটু এগিয়ে এসে শুদ্ধকে চোখ মেরে ফিসফিসিয়ে বলল,
'বউ তো দেখি ভালোই সুন্দর। দিন তো মনে হয় ভালোই কাটছে!'

শুদ্ধ ওঁকে থামিয়ে বলল, 'ধ্যাৎ! চুপ কর তো।'
তিশা চুপ হয়ে গেলো। ধারা শুধু বিস্ময় চোখে ও'র সামনের মেয়েগুলোকেই দেখতে লাগলো। একেকটার চাইতে একেকটা সুন্দর। চলন বলনও অন্যরকম। সবাই দেখতেই কতো স্মার্ট! পোশাক আশাকেও ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। ধারা খেয়াল করলো এদের মধ্যে সবচাইতে বেশি সুন্দরী মণিকা নামের ছিপছিপে গড়নের মেয়েটা ধারাকে একদম পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। তাকানোর ধরণটাও একটু অদ্ভুত। ধারা ভাবতে লাগলো, এই এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে, এই সবগুলোই কি শুদ্ধ'র ফ্রেন্ড? একটা মানুষের এতো ফ্রেন্ড থাকে? ছেলেদের এতো মেয়ে বন্ধু থাকার কি দরকার? আর দেখো, এদের সাথে কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে! হাসি যেন আর বাঁধ মানছে না। আর আমার সাথে যখন কথা বলে তখন একটা কথার মধ্যে দুইটাই থাকে খোঁচা। 
শুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 
'তোরা দেখ আশেপাশে ঘুরে ঘুরে। আমি একটু দুই মিনিটের জন্য আসছি।'

শুদ্ধ চলে গেলে বাকি সবাইও ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুদ্ধদের বাড়ি দেখতে লাগলো। ধারা শুধু আড়াল থেকে নজর রাখতে লাগলো মেয়েগুলোর উপর। এর মধ্যে মণিকা নামের মেয়েটিকে দেখলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বারবার ঠিকঠাক করছে। তার পাশে থাকা মেয়েটি ও'র কান্ডে ক্লান্ত হয়ে বলল, 
'আর কতক্ষণ লাগাবি? চল বাইরে যাই।'
'দাঁড়া, আর এক মিনিট। দেখ তো আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?'
'ভালোই লাগছে।'
মণিকা দুষ্টুমি করে চোখ মেরে বলল,
'হট লাগছে?'
'আরে বাবা হ্যাঁ।'
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মণিকা বলল,
'আচ্ছা, আমি কি আগে দেখতে কম হট ছিলাম? শুদ্ধ'র আমার প্রতি ইন্টারেস্ট না জন্মিয়ে এই গ্রামের মেয়েটার ভেতর এমন কি পেলো?'

পাশের মেয়েটি বলল, 'তুই যথেষ্ঠ হট ছিলি আর আছোস। যার বিয়ে যার সাথে লেখা তার সাথেই হবে। এগুলা নিয়ে ভেবে লাভ নাই এবার চল তো৷ তোর প্রেজেন্ট বয়ফ্রেন্ডও কি কম হ্যান্ডসাম নাকি!'

'তা ঠিক। তবে শুদ্ধ'র ব্যাপারটাই আলাদা। এখন আর কি করার! চল বাইরে যাই।'
মণিকা চলে গেলে ধারা পেছন থেকে মেয়েটার দিকে তাকিয়েই রইলো। মণিকার পরনে ব্লু টপস আর হোয়াইট জিন্স। চুলগুলো কার্লি করা। দেখতেই কতো স্মার্ট লাগে। আর অপরদিকে ধারা....! ধারা মুখ ফুলিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার পরনে গোলাপি রঙের ছাপা তোলা থ্রি পিছ। মাথার চুল গুলো বেণি করা। একদম সাধারণ। ধারা আরেকবার পেছন থেকে মণিকার দিকে তাকিয়ে নিজের চুলের বেণিটা খুলে ফেললো৷ তার রেশমীর মতো লম্বা সোজা চুলগুলো হঠাৎ ছাড়া পেয়ে বাতাসে তাল মেলাতে লাগলো। সেভাবেই বাইরে চলে এলো ধারা। বাইরে এসে দেখলো তিশা শুদ্ধকে বলছে,
'ঐ, এখানেই আর কতক্ষণ থাকবো? আশপাশটা তো দেখলামই। তোর খামারে নিয়ে চল৷ আমাদের ব্যাচের সবার থেকে ডিফারেন্ট তুই কি করতাছোস ঐটা দেখতে হবে না!'

শুদ্ধ বলল, 'এখনই যাবি?'

'হুম। আমি গাড়ি ড্রাইভারকে বলে আসি।'

শুদ্ধ হাসতে হাসতে বলল, 'গাড়িতে যাবি? তুই কি এখনও শহরে আছোস ফাজিল? পায়ে হেঁটে যেতে হবে ক্ষেতের উপর দিয়ে। ঐখানে গাড়ি নিলে গ্রামবাসী তোদের ধরে পিটাবে।'

ওরা সবাই যাবার জন্য রওনা হলো। তিশা ধারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, 'আরে ধারা! তুমিও চলো। বুঝতে পারছি তুমি অনেকবার গিয়েছো, তোমার নতুন করে দেখবার কিছু নেই। তাতে কি হয়েছে? আমাদের সাথেও না হয় দেখলে আরেকবার।'

ধারা কি বলবে ভেবে পেলো না। কারণ সে তো এর আগে কখনো শুদ্ধ'র খামারে যায়নি। সত্যি বলতে তার কখনো মাথাতেই আসেনি এটা। শুদ্ধ জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে ধারার দিকে তাকিয়ে রইলো। সত্যিই ধারার যাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি বোঝার জন্য। নয়তো কোন কিছুর জন্যই শুদ্ধ ধারাকে জোর করতে চায় না। তিশা ওরা একটু এগিয়ে গেলে শুদ্ধ ধারার কাছে এসে মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করলো, 'ধারা, আপনি যাবেন?'
ধারা বলল, 'হুম।'
ধারার সত্যিই যেতে মন আছে নাকি নেই ভেবেই শুদ্ধ আবারো বলল, 'আপনার যেতে ইচ্ছা না করলে থাক। আমি তিশাকে কিছু একটা বলে বোঝাতে পারবো৷'
ধারার কিঞ্চিৎ রাগ হলো। বলল, 'কেন? আমি যেতে পারবো না কেন?'
'না মানে আপনার যদি অসুবিধা হয়ে থাকে তাই বললাম।'
'আপনার ফ্রেন্ডদের যদি অসুবিধা না হয় তাহলে আমার হবে কেন? তাদের মধ্যে একজন যেতে না চাওয়ায় তখন দেখলাম তাকে খুব বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিচ্ছেন। আর এখন আমাকে এটা বলছেন কেন? আমি যাবোই।'
ধারা হনহনিয়ে গিয়ে তিশাদের পিছু নিল। শুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ তো ধারার ভালোর জন্যই বলেছিল। এতে এমন রাগ করার কি হলো?

গ্রামের পথে নামতেই সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে এই শহুরে চালচলনের মেয়েগুলোকে দেখতে লাগলো। তাদের পোশাকগুলোই বেশি আকর্ষণ করছে গ্রামবাসীদের। ধারা তখন চুল ছেড়ে আসলেও পথে নামতেই মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিয়ে নিলো। সে বউ মানুষ। আবার কে দেখে কি বলে! ওরা গ্রামের ক্ষেতের আল ধরে হেঁটে যেতে লাগলো। মাটি দিয়ে বানানো একদম সরু যাবার মতো একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা। শুদ্ধ আর ধারার অভ্যাসের কারণে তেমন অসুবিধা না লাগলেও তিশাদের বেশ অসুবিধা লাগলো। একেকজন হাঁটতে গিয়ে বারবার একেক দিকে কাত হয়ে যায়। এই বুঝি বারবার পাশের ধানের ক্ষেতে পড়তে গিয়েও বেঁচে যায়। ওদের কান্ড দেখে ধারার কিঞ্চিৎ হাসি পেলো। শুদ্ধ বারবার উদ্গ্রীব হয়ে বলতে লাগলো, 'সাবধানে যাস।' ধারার হাসি গায়েব হয়ে গেলো। আল পেরিয়ে সামনে এলো ছোট্ট একটা গর্তের মতো। পানি জমে ডোবার মতো হয়ে রয়েছে। তার উপরে একটা ছোট্ট গাছের গুঁড়ি ফেলে যাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মণিকা দেখেই বলল,
'অসম্ভব! এটার উপর দিয়ে যাবো কিভাবে? পা দিলেই তো মনে হয় পড়ে যাবো। আমি বাবা পারবো না।'
বাকিদেরও একই মত। শুদ্ধ বলল, 'এছাড়া তো উপায় নেই। একটু চেষ্টা কর, পারবি। মাত্র দু কদম ফেললেই তো হয়ে যাবে। এই দেখ এই যে, মাটি থেকে এক পা গাছের গুঁড়িতে ফেলবি তারপর আবার আরেক পা ওপারের মাটিতে। সিম্পল।'
শুদ্ধ একবার করে দেখালোও। কিন্তু শহুরে মানুষ, জীবনেও যা চোখে দেখেনি তা কি আর তাদের বোধগম্য হবে! ধারার কাছেও এটা কিছুই লাগলো না। এমন ছোট গর্তের উপর গাছের গুঁড়ি দিয়ে পার তো সে কতোই হয়েছে। সেদিন নেহাত অনেক লম্বা সাঁকো ছিল বলে তার পা পিছলে গিয়েছে। আজকেরটা তো সে অনায়াসেই পার হতে পারবে।
সবার আবারো একই কথা শুনে শুদ্ধ গাছের গুঁড়ি পার হয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, 'আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে আয়। তাহলে তো আর পড়বি না।'
সবাই তাই করলো। শুদ্ধ'র হাত ধরে সবাই আল্লাহ আল্লাহ করতে লাফিয়ে টাফিয়ে চিৎকার করতে করতে অবশেষে একে একে সবাই পার হতে লাগলো। মুখ আংশিক ভার হয়ে গেলো ধারার। এমন লাফানোর কি আছে? হাত না ধরে কি আর পার হওয়া যেতো না! একে একে যখন সবার শেষ হয়ে গেলো তখন খুশিমুখে শুদ্ধ'র দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো ধারা। কিন্তু শুদ্ধ'র নজরে তা পড়ার আগেই সে ঘুরে গেলো। ধারার মুখ ফুলে গেলো। আসল কথা ধারার অভ্যেস আছে, সে পারবে ভেবেই শুদ্ধ'র খেয়ালেই আসেনি আবারো হাত ধরার কথা। তার উপরে ধারা সকাল থেকেই যেভাবে উল্টো রিয়্যাক্ট করছে। তাই আর তাকে আজ বেশি ঘাটছে না শুদ্ধ। কিন্তু ধারার মনে তো তখন চলছিল অন্য কিছু। সে মুখ ফুলিয়ে গটগট করে গাছের গুঁড়ি পেরিয়ে গেলো। আবারো সামনে পড়লো ক্ষেতের আল। আর শুরু হলো একেকটা মেয়ের নাচানাচি। শুদ্ধ বারবার বলতে লাগলো, 'সাবধানে যাস।'
আর ধারা মনে মনে মুখ ভেংচি দিতে লাগলো।

অবশেষে ওরা গিয়ে শুদ্ধ'র খামারে পৌঁছালো। বিস্ময় নিয়ে সেখানটায় তাকিয়ে রইলো সবাই। সবথেকে বেশি বিস্মিত হলো ধারা। সম্পূর্ণ অন্যধরণের উৎকৃষ্ট অত্যাধুনিক ব্যবস্থায় চলছে কৃষিকাজ। একটা অংশে দেখতে পেলো গাছের উপরে কেমন যেন নেট দিয়ে ঘরের মতো প্রস্তুত করা। একেকটা গাছের সোজাসুজি ঝুলছে একেকটা সরু দড়ি। এই দড়ি বেঁয়ে গাছগুলো সব উপরে চলে যাবে। আর দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। এই ব্যবস্থার ফলে খুব অল্প জায়গার মধ্যেই অধিক গাছ ফলনের সুযোগ পাচ্ছে। আরেক অংশে দেখলো সব গাছের গোড়ায় গোড়ায় সোজাসুজি গিয়ে একটা সরু পাইপের মতো স্থাপন করা। সেই পাইপ থেকে গাছের গোড়ায় গোড়ায় আস্তে আস্তে টিপটিপ করে পানি পড়ছে। এটাকে বলে ড্রিপ ইরিগেশন। এর ফলে পানি সেচের ঝামেলা তো নেই ই বরং পানি খুব সাশ্রয় হচ্ছে। ওরা সবাই ঘুরে ঘুরে শুদ্ধ'র নতুন ধরণের খামার দেখতে লাগলো। ধারা অধিক অবাক হলো ধান ক্ষেতে গিয়ে। একটা বড় ট্রাক্টরের মতো একদম ভিন্ন ধরণের গাড়ি ক্ষেতের উপর দিয়ে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আর তার থেকে অটোমেটিক ধানের চারা কাঁদা পানিতে রোপন হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন, যে কাজটা করতে একজন কৃষককে অনেক সময় নিয়ে একটা একটা করে বিভিন্ন স্থানে রোপন করতে হতো সেটা নিমিষেই খুব দ্রুত একসাথে অনেকগুলো চারা রোপন হচ্ছে। এমন যন্ত্র ধারা এর আগে কখনো দেখেনি। শুধু ধারা কেন এই গ্রামের কেউই হয়তো দেখেনি। কৃষিতে যে আজকাল প্রযুক্তির প্রয়োগে কতো পরিবর্তন এসেছে তা শিক্ষার অভাবে তাদের এখনো চক্ষুগোচর হয়নি। ধারা যখন বিস্ময় নিয়ে সবটা দেখছিলো তখন তিশা এসে ধারার পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলল,
'সবকিছু শুদ্ধ কতো সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে তাই না ধারা! ও আসলেই একটা জিনিয়াস। নিজের উপর আত্মবিশ্বাসের জোরেই সবার থেকে ভিন্ন পথে হাঁটা দিয়ে তা সম্ভবও করে তুলছে। ইনশাআল্লাহ ও পারবে। তোমার ভাগ্য যে কতোটা ভালো তা তুমি জানো না ধারা। শুদ্ধ'র মতো একটা হাজবেন্ড সচরাচর পাওয়া যায় না। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে কতো মেয়েরা ও'র পেছনে ঘুরেছে! বড়লোক থেকে বড়লোকের মেয়েরা ওঁকে পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ও কারো ডাকেই সাড়া দেইনি। সবসময় নিজের লক্ষে স্থির হয়ে থেকেছে। শুধু বলতো সব বিয়ের পর, বিয়ের পর। বউয়ের সাথেই প্রেম করবো। পাগল একটা! আজকালকার দিনে এমন ছেলের কথা কখনো শুনছো? আমার বন্ধুটা খুব ভালো। ওঁকে কখনো হারাতে দিয়ো না ধারা। সবসময় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখো। ভাগ্য কিন্তু বারবার সুপ্রসন্ন হয় না।'
-----------

তিশা ওরা সবাই সন্ধ্যা হবার আগেই চলে গেলো। বাড়ি নিরিবিলি হয়ে গেলো আবার। তবুও ধারা সেদিন আর পড়ায় মনোযোগ বসাতে পারলো না। বারবার নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আয়নায় দেখতে লাগলো সে। ওর মাথায় শুধু মণিকার চেহারাটাই ভাসতে লাগলো। একসময় রাতের খাবারের ডাক পড়লো। ধারা সকালে বেশি করে রুটি বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল৷ সেই রুটিগুলোই গ্যাসের চুলায় বসে বসে ভাজছে খোদেজা। গরম গরম খাবার জন্যই এখন শুদ্ধ আর ধারাকে খেতে ডেকেছে সে। চুমকি ঘুমিয়ে পড়েছে বহু আগেই। রাতের খাবার আর খেতে উঠবে বলে মনে হয় না। ধারা ভাবনা মুখে খেতে বসলো৷ খোদেজা শুদ্ধ'র প্লেটে দুটো রুটি আর ধারার প্লেটে দুটো রুটি দিয়ে বলল সামনের পিরিচে রাখা ভাজি দিয়ে খেতে। ধারা নিজের পিরিচের ভাজির অর্ধেক অংশই কমিয়ে রাখলো৷ রুটিও একটা রেখে দিলো। সে এমনিতেও খুব বেশি একটা খায় না। শুদ্ধ দেখে বলল, 'আপনি তো দেখি সবই রেখে দিচ্ছেন ধারা। আপনি একদম বাচ্চাদের মতোন। খেতেই চান না। সব সময় বেশি বেশি করে খাবেন।'
ধারা নিজের ভাবনা থেকেই হঠাৎ ফট করে বলে উঠলো, 'আপনি আমাকে বাচ্চাদের মতোন বললেন কেন? আমি কি দেখতে হট না?'

শুদ্ধ সবে তখন রুটির একটুকরো ছিঁড়ে মুখে দিতে যাচ্ছিল। ধারার কথা শুনে থেমে গিয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শব্দ করে হেসে ফেললো সে। ধারা থতমত খেয়ে গেলো। কি বলে ফেললো সে এটা? খোদেজা অন্যদিকে ফিরে রুটি ভাজছিলো বলে ধারার কথা শুনতে পায়নি। হঠাৎ শুদ্ধকে ওমন হাসতে দেখে বারবার উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো কি হয়েছে? কি হয়েছে? শুদ্ধ বলবে কি! সে নিজের হাসিই থামাতে পারছে না। উদ্ভটের মতো কথাটা বলে ফেলায় ধারা প্রথমে যতোটা না বিব্রত হয়েছিল এখন আবার সম্পূর্ণ অন্য কারণে তার মুখ ঝুলে গেলো। শুদ্ধ এতো হাসছে কেন? সে কি আসলেই হট না?



চলবে*********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#25
পর্ব -১৭


শুদ্ধ'র হাসি ধারার কানে এখনও বাজছে। নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা মনে মনে নিজেকে একটা ধমক দিলো। এইসব কি ভাবছে সে! এমনিতেই মুখ দিয়ে বেফাঁস কথাটা বলে দিয়ে এখন যা ভাবা উচিত তা না ভেবে আরও স্টুপিডের মতো চিন্তা করছে। ধুর! মাথাটাই বুঝি আজকাল খারাপ হয়ে যাচ্ছে ধারার। এসব কেমন ধরণের চিন্তা! লজ্জায় তার ইচ্ছা করছে মাটির সাথে মিশে যেতে। সে রক্তিম মুখে একবার আস্তে আস্তে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে এক ছুটে সেখান থেকে চলে এলো। শুদ্ধ আসার আগেই বাতি নিভিয়ে, কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমের আশ্রয় নিয়ে তবেই সে ব্যাপারটার সেখানে ধামাচাপা দিতে সক্ষম হলো।

সকালে ধারার ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বেলা উঠে গেলো। ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলো শুদ্ধ রুমে নেই। গায়ের সুতি ওড়নাটা চাদরের মতো পেঁচিয়ে বারান্দায় চলে এলো ধারা। সকালের নরম আলো স্নিগ্ধতার সাথে ছুঁয়ে দিলো তাকে। বারান্দার কাঠের রেলিংয়ে হাত রেখে নিচে তাকিয়ে দেখলো, খোদেজা খোয়াড় থেকে হাস মুরগীগুলোকে ছেড়ে দিয়ে বাসী ভাত খাওয়াচ্ছে। খানিকবাদেই ঘর থেকে শুদ্ধ বেড়িয়ে এলো। তার হাতে একটা কাস্তে আর একটা ছোট চটের বস্তা। তা নিয়ে সে যাচ্ছে নিজের ক্ষেত খামারের দিকে। ধারা অপলক সেদিকে তাকিয়ে রইলো। কোন সাধারণ মানুষও প্রথম দেখায় হয়তো এটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবে না যে এমন উচ্চশিক্ষিত একটা ছেলে রোজ কাস্তে হাতে ক্ষেতে যায়। যেখানে চেষ্টা করলেই একটা ভালো চাকরি পেতে পারে সে। আচ্ছা, স্বপ্নের শক্তি কি আসলেই এতো বেশি হয়? প্রয়োজনে মানুষকে সমাজের সাধারণ ধারণারও বিপরীতে নিয়ে যেতে পারে সে? ব্যতিক্রম থেকে ব্যতিক্রম ধারণাও সম্ভবপর হয় এই স্বপ্নের জোরেই! শুদ্ধ'র একটা শক্ত স্বপ্ন আছে৷ নিজের উপর আত্মবিশ্বাস আর পূর্ণ প্রচেষ্টার জোরে সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের পথেও নেমে পড়েছে সে। তার চাক্ষুষ প্রমাণ তো ধারা গতকাল নিজের চোখেই দেখলো৷ সবকিছু কতো সুন্দর ছিল! সেখানে একটা স্বপ্নের ছোঁয়া ছিল, পরিশ্রমের রেশ ছিল, আত্মবিশ্বাসের বাস্তব সাক্ষ্য ছিল। অনিন্দ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী শুদ্ধকে নিরীক্ষণ করতে গিয়ে    
পরনির্ভরশীল, ভীতু, ব্যক্তিত্বহীন ধারা হঠাৎ নিজের গভীরে হাঁতড়ে বেড়ালো। তার মনের কোন গোপন অংশেও কি ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে এমন স্বপ্ন দেখার আহ্বান! একটা সুন্দর চেষ্টার মাধ্যমে সেও কি পারলেও পারতে পারে কিছু একটা। 
__________________________________________

শুদ্ধ'র বন্ধু ফাহিমের একটা নিজস্ব রুম আছে প্রাইভেট পড়ানোর। তার পাশের রুমেই তার থাকার সমস্ত ব্যবস্থা। মূলত বাসাটি হলো দু কামরার। এক রুম থাকার জন্য রেখে আরেক রুমে কাঠের বেঞ্চ পেতে স্টুডেন্ট পড়ানোর ব্যবস্থা রেখেছে ফাহিম। এগুলো হলো আগের ব্যবস্থা। প্রায় ছয় মাস হয়ে গেলো ফাহিম স্টুডেন্ট পড়ানো ছেড়ে দিয়েছে। নেহাত বন্ধুর অনুরোধের জোরেই ধারাকে পড়াতে রাজী হয়েছে সে। সামনের কাঠের বেঞ্চিটিতে বসে আছে ধারা। তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফাহিম। শুদ্ধ দরজার বাইরে সিমেন্টের বাঁধানো বসার জায়গায় বসে আছে। এখানেই রোজ ধারার পড়া শেষ হবার অপেক্ষা করে সে। ধারা ইংরেজির গ্রামার অংশের একটা টপিক নিয়ে ফাহিমের থেকে বুঝে নিচ্ছিলো। বোঝানো শেষ হলে ফাহিম বলল, 'আপনি তো খুব ভালোই প্রোগ্রেস করছেন ভাবী।'
ধারা কি বলবে ভেবে পায় না। স্যার ধরণের মানুষের মুখে ভাবী ডাকটা একটু অপ্রস্তুত কর। এখন এটা নিয়ে তো আবার কিছু বলা যায় না। ফাহিম বলতে থাকে,
'এভাবেই যদি চেষ্টা করতে থাকেন তাহলে একটা হোপ রাখাই যায় ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার। আরো ভালো মতো চেষ্টা করুন ভাবী। যদি চান্সটা পেয়ে যান না আমার বন্ধুটা বেজায় খুশি হবে। কি কি সে না করছে আপনাকে পড়ানোর জন্য! আমি তো প্রথমে রাজীই হতে চাইনি পড়ানোর জন্য। আসলে আমার সময় নেই বলে। শুদ্ধ আমাকে এতোটাই অনুরোধ করেছে যে আমি আর না রাজী হয়ে পারেনি। তার উপর ও যেই প্রোজেক্টে হাত দিয়েছে এর জন্য তো ও'র নিজেরই অফুরন্ত সময়ের প্রয়োজন। তবুও তার থেকে সময় বের করে রোজ আপনাকে দুই ঘন্টার জন্য শহরে নিয়ে আসে। আবার যতক্ষণ পড়া শেষ হয় বাইরে বসে অপেক্ষাও করে। সিরিয়াসলি বউয়ের পড়ালেখার জন্য কোন স্বামীকে আমি এতো খাটতে দেখিনি। শুদ্ধ আমার কলেজ লাইফের বন্ধু৷ আমরা একসাথেই এডমিশনের প্রিপারেশন নিয়েছিলাম। বিশ্বাস করেন ভাবী, আমি ও'র নিজের এডমিশনের সময়েও ওঁকে এতোটা ব্যাকুল দেখিনি। শুদ্ধ অনেক সাপোর্টিভ। ও পাশে থাকলে ইনশাআল্লাহ আপনি চান্স পেয়ে যাবেন।'

ফাহিমের কথা শুনে ধারা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে শুদ্ধকে দেখতে লাগলো। কিভাবে চোখে মুখে একটা ক্লান্তিহীন ছাপ নিয়ে দু ঘন্টা যাবৎ বসে আছে লোকটা। ধারার ঠোঁটে একধরনের আবেগ্লাপুত হাসি ফুটে উঠে।

ফাহিমের ওখান থেকে বেড়িয়ে এসে ধারা আর শুদ্ধ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। দুজনেই চুপচাপ। মুখে কোন কথা নেই। ধারা আড়চোখে একবার শুদ্ধ'র দিকে তাকায়। শুদ্ধ'র গায়ে নীল রঙের চেকশার্ট। মাথার ঘন চুলগুলো পরিপাটি হয়েই আছে। দু তিন দিন যাবৎ শেভ না করায় গালে গজিয়েছে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ধারা সন্তর্পণে সেদিকটায় তাকিয়েই থাকে। আচ্ছা, খুব কি আহামরি দেখতে ছেলেটা? তবুও সবার জন্য এতো নজরকাড়া কেন? আসল ব্যাপারটা হলো শুদ্ধ'র ব্যক্তিত্বে। আর ব্যক্তিত্বের রূপের মতো ভয়ংকর সুন্দর আর কিছু হয় না। তার কথার মধ্যে জড়তা নেই, দৃষ্টির মধ্যে কোন সংকোচ নেই। সে স্পষ্ট আর স্বচ্ছ। তার সাধারণ কথা শুনতেও শান্তি লাগে। সেখানে প্রবল অনুপ্রেরণার জোয়ার থাকে। বিশেষ করে সে যখন জড়তাহীন, সংকোচবিহীন, স্পষ্ট স্বরে 'ধারা' বলে ডেকে উঠে...সেই ডাকের মধ্যেই ভরসা, আস্থা, বিশ্বাস খুঁজে পায় ধারা। সেই ডাকটাও কতো সুন্দর, সুমধুর। মনে হয় কেউ একজন আছে। সবসময় আছে।

হঠাৎ একটা গোলা আইসক্রিমের ভ্যান নজরে পড়ায় শুদ্ধ ডেকে উঠলো, 'ধারা!'
ধারার প্রাণ জুড়ে একধরনের শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। আবারো সেই ডাক! 
শুদ্ধ বলতে থাকলো, 'গোলা আইসক্রিম খাবেন?'
প্রশ্ন তো করলো ঠিকই কিন্তু ধারা কিছু বলার আগেই তার হাত টেনে ভ্যানের কাছে নিয়ে গেলো শুদ্ধ। আইসক্রিমওয়ালা কমলা ফ্লেভারের দুটো গোলা আইসক্রিম দিলো তাদের। ধারা এর আগে কখনো গোলা আইসক্রিম খায়নি। আইসক্রিম পেয়ে আনন্দের সাথে খেতে লাগলো সে। হঠাৎ শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো ধারা। বলল,
'আপনার ঠোঁট, জিভ কেমন কমলা রঙের হয়ে গেছে!' 
শুদ্ধ বলল, 'আমারটা একার হয়েছে? আপনারটাও হয়েছে। দেখুন।'
এই বলে শুদ্ধ ধারাকে ভ্যানের সাথের ছোট্ট আয়নাটায় দেখালো। তারা দুজনেই বাচ্চাদের মতো জিভ বের করে আয়নায় দেখতে লাগলো আর খিলখিল শব্দে হাসতে লাগলো। সোজা হয়ে উঠতে গিয়েই ধারা একটা বারি খেলো শুদ্ধ'র মাথার সাথে। শুদ্ধ কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেই সুযোগ না দিয়ে ইচ্ছে করে মাথা দিয়ে আরেকটা বারি দিয়ে ধারা বলল, 'আপনাকে কৃতার্থ করলাম। মাথায় শিং গজাবার হাত থেকে বাঁচিয়ে।'

শুদ্ধ হেসে ফেললো। সাথে ধারাও। আইসক্রিম খাওয়া হয়ে গেলে শুদ্ধ ধারাকে সামনে হাঁটতে বলে আইসক্রিমওয়ালাকে বিল পরিশোধ করতে লাগলো। ধারা খানিক এগিয়ে গিয়ে শুদ্ধ এখনো আসছে না বলে বারবার পেছনে ফিরে দেখতে লাগলো। রাস্তা সম্পূর্ণ ফাঁকা। ভাংতি না থাকায় শুদ্ধ'র দেরি হচ্ছিল। হঠাৎ ধারার পাশ ঘেঁষে একটা পিকআপ ভ্যান গাড়ি দ্রুত চলে গেলো। ধারা রাস্তার একটু বেশিই কাছ ঘেঁষে দাঁড়ানোয় ড্রাইভার গাড়ি থেকে মাথা বের করে তার সাইডে না যাওয়ায় মুখ খিচে একটা গালি দিলো। ধারা কিছুই বললো না। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দূর থেকে দৃশ্যটা চক্ষুগোচর হলো শুদ্ধ'র। গাড়িটা ওদের থেকে খানিক সামনে গিয়েই থেমে গেলো। শুদ্ধ ধারার কাছে গিয়ে বলল,
'ঐ লোকটা আপনাকে গালি দিলো আপনি কিছু বললেন না কেন? আর সে আপনাকে গালি দিলোই বা কেন? আপনি তো তার গাড়ির সামনে গিয়ে পড়েননি। আপনি কিছু বললেন না কেন তাকে?'

ধারা বিমর্ষ মুখে বলল, 'না থাক! দোষটা বোধহয় আমারই ছিল। আমি হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় গাড়ির কাছে চলে গিয়েছিলাম।'

'ধারা, সব দোষ সবসময় নিজের ঘাড়ে নিয়ে যাবেন না৷ রাস্তা যথেষ্ঠ প্রশস্ত। তার উপর পুরো ফাঁকা। আপনি হঠাৎ করে উদয় হননি। আগে থেকেই ছিলেন। সে তার গাড়ি নিয়ে আগে থেকেই সাইড হয়ে যায়নি কেন? আর আপনি কি রাস্তার মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন? সাইডেই তো ছিলেন। তাহলে? দোষটা তার। তার ভুলের কারণে আজ একটা এক্সিডেন্টও হয়ে যেতে পারে। তবুও নিজের ভুল না বুঝে সে উল্টো আপনাকেই গালি দিয়ে গেলো। ড্রাইভারটা ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। যান গিয়ে তাকে একটা ধমক দিয়ে আসুন।'

ধারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, 'থাক না। শুধু শুধু আবার ঝামেলা করার কি দরকার?'

'ঝামেলার কিছু নেই। আপনি জাস্ট তার কথার জবাব দিবেন।'

ধারা নার্ভাস হয়ে গেলো। অভ্যাসবশত কপালের কার্ণিশ ঘষার জন্য হাত উঠানোর জন্য নাড়াতেই শুদ্ধ খপ করে ধারার সেই হাত ধরে ফেললো। শক্ত করে সেই হাত চেঁপে ধরে বলল,
'ভয় পাবেন না ধারা। সবকিছুর জন্যই সবসময় আপনার দোষ থাকে না। যতদিন পর্যন্ত এভাবে সবটা সহ্য করে যাবেন, ততদিন এই পৃথিবীবাসী সব দোষ আপনার উপর চাপিয়ে দেবে। এখানে দোষটা আপনার ছিল না। অন্যের উপর বিশ্বাস করার আগে নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে শিখুন। আপনাকে কেউ একজন শুধু শুধুই গালি দিয়ে যাবে আর আপনি সেটা সহ্য করবেন কেন? যান, গিয়ে তার জবাব দিয়ে আসুন।'

গুটিগুটি পায়ে ধারা লোকটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। নার্ভাস চোখে একবার পেছনে ফিরে তাকালোও শুদ্ধ'র দিকে। শুদ্ধ নিজের মতো স্থির থেকেই দেখতে লাগলো ধারা কি করে? পিকআপ গাড়িটার সামনে ড্রাইভারটা দাঁড়িয়ে ছিল। ধারা গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই কপাল ভাঁজ করে ড্রাইভারটা জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ধারা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, 'আপনি আমাকে গালি দিলেন কেন?'
এতক্ষণ পর এসে এই কথা তোলায় লোকটা খানিক অবাক হলো। তার খশখশে গলায় কুৎসিত ভঙ্গিমা করে বলল, 'গাড়ির সামনে আইয়া দাঁড়ায় থাকো কে? গায়ে হাওয়া লাগানির আর কোন জায়গা পাও না!'
লোকটার কথা বলার ধরণ এতো বিশ্রী। শুনলেই রাগ চড়ে যাবার কথা। ধারা আবারো কাঁপা গলায় কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো। চোখ বন্ধ করে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে গলার জোর বাড়িয়ে বলল,
'আমি গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম নাকি আপনি গাড়ি নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। এতো বড় ফাঁকা রাস্তার মধ্যে আপনি আমার সাইড দিয়েই গাড়ি নিলেন কেন? অপর সাইড দিয়েও তো যেতে পারতেন। আরেকটু হলে তো আপনি গাড়ি আমার উপরেই উঠিয়ে ফেলতেন। দোষটা আপনার।'

ধারার সাথে যে আরেকজন আছে এটা ড্রাইভারটি বুঝতে পারেনি। একা একটা মেয়েকে দেখে তার গলা একটু বেশিই চড়ে গেলো। সে চোখ গরম করে বলল, 'এই মাইয়া, বেশি কথা বলবা না!'

'কেন? আমি কি ভুল কিছু বলেছি? দোষও আপনি করলেন তারউপর গালিও আমাকে দিলেন! এই রাস্তার পাশে একটা সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। চলুন সামনের ট্রাফিক পুলিশ বক্সে গিয়ে দেখা যাক দোষটা কার। বাকিটা না হয় পুলিশই দেখবে।'

পুলিশের কথা শুনতেই লোকটা ঘাবড়ে গেলো। আমতা আমতা করতে লাগলো সে। ধারা বারবার তাড়া লাগিয়ে বলল, 'কি হলো চলুন, আপনার যা ইচ্ছা আপনি রাস্তার মধ্যে একজনকে বলে যাবেন। আর সে চুপচাপ শুনবে? এর হেনস্তা এখন পুলিশই করবে।'

লোকটা ভয় পেয়ে গেলো। শত চেষ্টা করেও যখন ধারাকে থামাতে পারলো না তখন শেষমেশ গালি দেবার জন্য ধারার কাছে বারবার মাফ চাইতে লাগলো। আর সাথে এটাও বলল এরকম সে আর কখনো করবে না। এরপর যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি নিয়ে কেটে পড়লো। ধারার ভীষণ আনন্দ অনুভব হলো। নিজের উপর কিছুটা যেন বিশ্বাস খুঁজে পেলো সে। হাসিমুখে পেছন ঘুরে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো ধারা। শুদ্ধ'র মুখে সন্তুষ্টির হাসি। ধারা যেভাবে সিসিটিভি ক্যামেরা আর ট্রাফিক পুলিশের কথা বলে ব্যাপারটা সামলালো তাতে শুদ্ধও অবাক, সাথে মুগ্ধ।

বাড়ি ফিরেই শুদ্ধ খোদেজার কাছে বসে বসে আজকের সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। ধারা যে আস্তে আস্তে কিভাবে পাল্টাচ্ছে তা খোদেজাকেও জানিয়ে রাখলো সে। ধারার উন্নতিতে ছেলের মুখে এতো আনন্দ দেখে খোদেজার প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। খোদেজা ভেবে পায় না এতো আনন্দ কি তার ছেলে কখনো নিজের সাফল্যতেও হয়েছিল! খোদেজা মনে মনে প্রার্থনা করলো তার ছেলের এই সুখ সবসময় বজায় থাকুক। মায়ের প্রার্থনা করা মুখ দেখে শুদ্ধ বলল,  
'তোমার দোয়া কখনোই বিফলে যায় না আম্মা।'

কথাটা বলেই মিষ্টি করে হাসলো শুদ্ধ। শুদ্ধ হাসতেই তার বাম গালে টোল পড়লো। আর সেই টোল দেখে খোদেজার বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠলো। সাধারণত ছেলের মুখের হাসি দেখলে মায়েরা আনন্দিত হয়। কিন্তু খোদেজার ক্ষেত্রে হয় বিপরীত। তার ছেলে হাসলেই তার গালে টোল পড়ে। আর সেই টোল চোখে পড়লে খোদেজার মুখের হাসি থেমে যায়। মনে পড়ে যায় সেই অপ্রিয় সত্য।


চলবে*******
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#26
পর্ব ১৮



সেদিনের মতো আজ ভরা পূর্ণিমা না হলেও আকাশে মেঘের লুকোচুরির আড়ালে থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে অর্ধচন্দ্রটি। পুকুরের ওপাশে একরাশ অন্ধকার। ঝোপের মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে একঝাঁক জোনাকির দল। তাদের মৃদুমন্দ আলোতে সৃষ্টি করেছে নজরকাড়া পরিবেশ। শুদ্ধ বসে আছে পুকুরপাড়ে বানানো বাঁশের মাচায়। পাশে ধারাও। ঘরের মধ্যে বিদ্যুৎ আছে। তবুও ইচ্ছে করেই ধারাকে নিয়ে বাইরে এসেছে শুদ্ধ। ধারা আজ দুপুরে খাবার পর থেকে একটানা পড়েছে। পরীক্ষা নিকটে। বলাবাহুল্য পড়ার চাপ একটু বেশিই। তাই পড়তে পড়তে ধারার একঘেয়েমি দূর করতেই তাকে নিয়ে বাইরে আসা। অল্প সময়ের হাওয়া বদল মনের ক্লান্তি দূর করতে পারে। বসে থাকতে থাকতে শুদ্ধ ধারাকে বলল,
'ধারা, আমি এখন ফোন দেখে দেখে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো। এগুলো পূর্ব বছরের প্রশ্নব্যাংক। দেখি আপনি কতগুলো পারেন। এটাই প্রমাণ করবে আপনার প্রিপারেশন কেমন?'

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলো ধারা। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ফোন ঘেঁটে সাধারণ জ্ঞানের অংশ থেকে প্রথম প্রশ্নটি করলো। ধারা সঠিক উত্তরটাই দিলো। এরপর আরো কিছু প্রশ্ন করলেও ধারা বলতে পারলো। মাঝের একটা আইকিউ থেকে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না। আরেকটা ভুল বলল। এরপর আরেকটা প্রশ্ন করলে ধারা কিছু বলছে না দেখে শুদ্ধ অপশন চারটি বলল। ধারা একটা উত্তর বলে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে শুদ্ধর প্রতিক্রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ মাথা নেড়ে ইতিবাচক ইশারা দিয়ে মুচকি করে হাসলো। ধারা আনন্দিত হয়ে উঠলো। তার থেকেও বেশি খুশি হলো শুদ্ধ। পনেরো টা প্রশ্নের মধ্যে বারোটারই সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে ধারা। যেখানে বেছে বেছে শুদ্ধ কঠিন প্রশ্নগুলোই করেছিল। খুশির জোরে হঠাৎ করে ওরা দুজন একটা হাই ফাইভও করে ফেললো। শুদ্ধ উৎফুল্ল হয়ে বলল,
'ধারা, আপনি খুব ভালো করছেন। আমার মনে হয় আপনি পারবেন।'

ধারা মৃদু হেসে মাথা নিচু করলো। শুদ্ধ বলল,
'আপনার পরীক্ষার সময় তো আপনাকে নিয়ে ঢাকায় যেতে হবে৷ তারপর দুইদিন থেকে আবার ফেরত চলে আসবো। এর জন্য আমার কাজগুলো আগে থেকেই গুছিয়ে রাখতে হবে। একবার চান্স পেয়ে গেলে তো আবারো যেতে হবে তারপর তো একেবারে ভর্তি করে আপনাকে হলে রাখার ব্যবস্থা করেই আসতে হবে।'

কথাটা বলতে বলতেই শুদ্ধ'র গলার আওয়াজ হঠাৎ কমে এলো। ধারা উদ্গ্রীব হয়ে বলল,
'রেখে আসতে হবে মানে?'
শুদ্ধ জোর করে একটু হেসে বলল, 'ঢাকায় থেকেই তো আপনাকে পড়তে হবে। রোজ রোজ তো আর আপনি গ্রাম থেকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারবেন না। ইউনিভার্সিটির কাছেই হলে থাকবেন। মন দিয়ে পড়ালেখা করবেন।'

ধারার কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেলো। কি বলবে না বলবে সে ভেবে না পেয়ে মাথা নিচু করে বলল, 'আচ্ছা, আপনিও তো দূরে থেকে পড়ালেখা করেছেন। এভাবে দূরে থাকতে আপনার খারাপ লাগেনি?'

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে শুদ্ধ মুখে হাসি টেনে সামনে দৃষ্টি নিয়ে বলল, 'কখনো কখনো বড় কিছু অর্জনের জন্য ছোট ছোট এই অনুভূতিগুলোকে আড়াল করতে হয় ধারা। আপনি সেখানে গিয়ে পড়বেন, খুব বড় হয়ে একদিন ফিরে আসবেন। ফিরে তো আসবেনই। এই যে আমিও তো এসেছি। সেই দিন পর্যন্ত থেকে যায় শুধু আপনজনদের নিরন্তর অপেক্ষা।'

এরপর ধারার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে শুদ্ধ বলল, 'এখন কোন ধরণের দূর্বল অনুভূতিকে মনে জায়গা দিবেন না। আপনার সামনে এখন সফলতার দরজা খোলা। কঠিন হলেও আপনাকে সেই পথে যেতে হবে৷ আপনাকে আমি একজন সফল মানুস হিসেবে দেখতে চাই ধারা। তার জন্য যা করা দরকার আমি করবো৷ আপনি শুধু মনে সাহস রাখবেন। ভেঙে না পড়ে নিজের উপর বিশ্বাস রাখবেন। নিজের জন্য, আমার জন্য এই চেষ্টাটা আপনি করবেন তো ধারা?'

আনত দৃষ্টি তুলে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো ধারা। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে আশ্বাসের সাথে চোখের পলক ফেলে সে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। শুদ্ধও খুশি হলো। ধারা বলল,
'আমার রেস্ট নেওয়া হয়ে গেছে। চলুন ভেতরে গিয়ে পড়তে বসি। আপনিই তো বলেছেন, পরীক্ষা এসে পড়েছে, সময় নষ্ট করা এখন একদমই উচিত হবে না।'

ধারার আগ্রহ দেখে শুদ্ধ'র ভালো লাগলো। হেসে বলল, 'চলুন।'

ধারা মাচা থেকে নেমে আগে আগেই যেতে যেতে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, 'আচ্ছা, আমি যদি পারি আপনি আমাকে কি দিবেন?'

শুদ্ধ মাচার ওপরে আরও আয়েশ করে বসে আড়চোখে চেয়ে বলল, 

'আন্ধার রাইতে আইসো কন্যা একলা দীঘির পাড়,
তোমায় আমি দিমু একখান নীল জ্যোৎস্নার হার।'

ধারা নিজের লজ্জা আড়াল করে পেছনে ফিরে মৃদু হেসে বলল, 'বাহ! আপনি তো ভালোই ছন্দ বানাতে পারেন।'
শুদ্ধও ঠোঁট চেঁপে খানিক হাসলো। তারপর মাচা থেকে নেমে ধারার পাশে এসে কথা কাটিয়ে ব্যগ্র দিয়ে বলল,
'চলুন, চলুন, পড়তে বসবেন না! চলুন।'
ঠোঁট ফুলিয়ে ধারা শুদ্ধ'র সাথে সাথে গেলো। রুমে গিয়ে বিছানায় বই নিয়ে বসলো ধারা। রাত গভীর হতে লাগলো। ধারা মনোযোগী হয়ে পড়লো বইয়ে। পড়তে পড়তে একসময় বই থেকে মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো শুদ্ধ ধারার একটা বই কোলে নিয়ে হাতে কলম ধরেই বালিশের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীরে একটা ক্লান্তির ছাপ। ধারার ভীষণ মায়া লাগলো। ধারার এই এডমিশনের চক্করে শুদ্ধ এতোটাই খাটছে যে ধারার মাঝে মাঝে মনে হয় পরীক্ষাটা তার না, আসলে শুদ্ধ'র। প্রতিদিন সাথে করে ধারাকে শহরে নিয়ে যাওয়া, যতক্ষণ ধারা পড়বে ততক্ষণ ধারার সাথে বসে থাকা, এমনকি ধারা ঘুমিয়ে গেলেও গভীর রাত পর্যন্ত জেগে ধারার জন্য মনে রাখায় সহজ করে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরমালা তৈরি করা, রাত বিরাতে ধারার জন্য ঘন ঘন নিচ থেকে চা বানিয়ে নিয়ে আসা সবই তো লোকটা বিনা ক্লান্তিতে, বিনা বিরক্তিতে করে আসছে। এর সাথে তার নিজের কাজ তো আছেই। সব অর্থেই ধারার চেয়ে যেন দ্বিগুণ খাটছে শুদ্ধ। ধারার এক মামাতো বোনের বিয়ের পর ধারা দেখেছিল কিভাবে এতো ভালো ছাত্রী হওয়ার পরও তার স্বামী তাকে পড়তে দেয়নি। বাড়ির বউয়ের বাইরে গিয়ে পড়ালেখা তারা পছন্দ করে না বলে। তারপর পাশের বাসার রেশমি আপুর সময়ও তো দেখলো, তার স্বামী অবশ্য নিষেধাজ্ঞা করেনি তবে পড়ালেখার জন্য সময় ব্যয় করায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন এতোটাই খিটখিট করতো যে শেষমেশ আপুটা সংসারের শান্তির জন্য নিজের পড়ালেখা ছেড়ে দিল। তার স্বামীও তখন ছিল নিশ্চুপ। আর এতো এতো উদাহরণের মধ্যে শুদ্ধ যা করছে তা সত্যিই ধারণার অতীত।

ধারা বই রেখে উঠে দাঁড়ালো। শুদ্ধ'র কাছে গিয়ে তার কোল থেকে বই সরিয়ে, হাত থেকে কলম ছাড়িয়ে ঠিক করে রাখলো। তারপর গায়ে একটা কাঁথা দিয়ে ঢেকে শুদ্ধ'র ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রদ্ধার সাথে মৃদু হাসলো। 
__________________________________________

ধারার পরীক্ষার মাত্র দুইদিন আগে ফাহিম অসময়ে শুদ্ধকে আর্জেন্ট ডেকে পাঠালে শুদ্ধ ভাবলো হয়তো ধারার পরীক্ষা বিষয়ক কোন আলাপ করতেই ডেকেছে। কিন্তু গিয়ে দেখলো ব্যাপারটা ভিন্ন। ফাহিম খুবই উশখুশ করে কথাটা বলল, 'দোস্ত, কথাটা কিভাবে বলবো আমি বুঝতে পারছি না।'
শুদ্ধ বলল, 'তুই এতো ভাবছিস কেন? কি বলবি বল!'
ফাহিম গড়িমসি করে বলল,
'খুব প্রয়োজন না হলে তোকে বলতাম না রে। আমার খুব আর্জেন্ট এখন টাকার প্রয়োজন। তুই যদি তোর টাকাটা আমাকে এখন দিতে পারতি তাহলে খুব ভালো হতো।'
টাকার কথা শুনে শুদ্ধ'র মুখ শুকিয়ে গেলো। ফাহিম বলতে লাগলো, 'তোর সাথে তো আমার আট হাজার টাকার ডিল হয়েছিল ধারার পড়া নিয়ে। তুই না হয় সাত হাজারই দিস৷ কিন্তু টাকাটা আমার এখনই প্রয়োজন রে শুদ্ধ। বিশ্বাস কর, দরকার বলেই এভাবে চাইছি। নয়তো এমন হঠাৎ তোকে তাড়া দিতাম না।'
শুদ্ধ একটা হাসি টেনে বলল, 'আরে দূর! তুই এতো সংকোচ করছিস কেন? আমরা আমরাই তো। তোকে আমি তোর ফুল টাকাটাই দিবো। কম কেন দিবো? তুইও তো ধারার পেছনে কম কষ্ট করোস নাই। এতো ব্যস্ত থাকার পরেও সময় বের করেছিস। আমি তোকে দিয়ে দেবো। টেনশন নিস না।'

শুদ্ধ'র থেকে আশ্বাস পেয়ে ফাহিম স্বস্তির হাসি দিয়ে চলে গেলো। ফাহিম যেতেই চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেলো শুদ্ধ'র কপালে। ফাহিমকে শুদ্ধ কিছু মাস পর সমস্ত টাকা দিবে বলে ঠিক করেছিল। কিন্তু টাকাটা তো ফাহিমের এখনই প্রয়োজন। হঠাৎ করে এতোগুলো টাকার ব্যবস্থা শুদ্ধ কিভাবে করবে বুঝতে পারলো না। ইতিমধ্যেই সব টাকা সে তার প্রজেক্টে লাগিয়ে দিয়েছে। তার উপর বিয়েতেও কম টাকা খরচ হয়নি। মাসের মধ্যবর্তী সময় চলছে। হাতে এখন একপ্রকার টাকা নেই বললেই চলে। ধারাকে নিয়ে ঢাকায় আসা যাওয়া করতেও তো কতো টাকা লাগবে! শুদ্ধ কি করবে কিছু খুঁজে পেলো না। এতোগুলো টাকার ব্যবস্থা হঠাৎ কোথা থেকে করবে? হঠাৎ ই তার নজর পড়ে হাতের ফোনটির দিকে। এই আড়াই মাস আগেই টাকা জমিয়ে পনেরো হাজার টাকা দিয়ে শখ করে ফোনটা কিনেছিল৷ ফোনটার স্ক্রিনে একবার মায়ার সাথে হাত বুলালো শুদ্ধ। পরক্ষনেই তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ধারাকে তার এখন সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পেছনে ফিরে তাকাবার এতো সময় কই! ফোন তো এর কাছে অতি সামান্যই।



চলবে*********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#27
পর্ব -১৯


বাড়ি ফিরে যেতেই শুদ্ধ শুনতে পেলো ধারার দাদী অসুস্থ। ধারার বাবা খোদেজাকে ফোন করে দাদীকে দেখতে আসার জন্য ধারাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। শুদ্ধ'র কপালে খানিক চিন্তার ভাঁজ পরলো। আগামীকাল পরীক্ষা। আর আজকেই যদি ধারাকে মধুপুর গ্রামে যেতে হয় তাহলে কিভাবে কি করবে? অপরদিকে দাদী অসুস্থ। না গিয়েও তো পারা যাবে না। যেখানে ধারার বাবা নিজ থেকে খোদেজাকে ফোন করে বলেছে৷ রুমে গিয়ে দেখলো ধারা শুদ্ধ'র আসার অপেক্ষায় বসে আছে৷ এখনও ব্যাগ গোছানো শুরু করেনি। শুদ্ধ বলল,
'ধারা, যাওয়াটা তো প্রয়োজনই। একটা কাজ করেন, সব একসাথেই গুছিয়ে ফেলেন। পরীক্ষা তো আগামীকাল বিকাল সাড়ে তিনটায়। আমরা সকাল সকালই ঢাকার জন্য রওয়ানা হয়ে যাবো৷ আপনি ওখান থেকেই সকালে বাস স্ট্যান্ডে চলে আসবেন। আমি আগে থেকেই সেখানে থাকবো৷ আমিও আপনার সাথে যেতে পারতাম কিন্তু আমার এদিকে আরও কিছু কাজ আছে। ঢাকায় যাওয়ার আগে সেগুলোও মিটাতে হবে। আপনি সময়মতো এসে পড়বেন, ঠিকাছে?'

শুদ্ধ'র কথায় সায় দিয়ে ধারা মাথা দুলালো। শুদ্ধ বলল,
'আর শুনুন, আপনার বাবাকে বলা নিয়ে বেশি ভাববেন না। যেহেতু সেখানে যাচ্ছেন জানাতে তো তাকে হবেই। আপনার বাবা যদি একটু রাগও করে বেশি মন খারাপ করবেন না। একটু ইগনোর করার চেষ্টা করবেন। যদিও আমার মনে হয় না, সম্পূর্ণ পরীক্ষার প্রিপারেশন নিয়ে ফেলেছেন জানতে পারলে আপনার বাবা বেশি কিছু বলবে। ঠিক মতো যাবেন ধারা। আমি আমাদের পরিচিত এক অটোচালককে ঠিক করে রেখেছি। সে সোজা আপনাকে আপনাদের বাড়িতে দিয়ে আসবে।'

ধারা ব্যাগ গুছানো শুরু করলে শুদ্ধ আবারো পাশ থেকে বলল,
'আপনার পড়া তো সব কমপ্লিট করাই, তবুও আমি যেই ইম্পর্টেন্ট নোটগুলো বানিয়ে দিয়েছিলাম সেগুলো নিয়ে যান। বারবার শুধু সেগুলোতে হালকার উপর একটু চোখ বুলাবেন। এখন বেশি চাপ নিতে হবে না। নতুন কিছুও আর পড়তে হবে না। যা পড়েছেন এখন তাই যথেষ্ঠ।'

ধারা আবারো মাথা নাড়ালো। ব্যাগ গুছানো হয়ে গেলে শুদ্ধ আবারো বলতে শুরু করলো,
'আজকে আর বেশি রাত পর্যন্ত জাগবেন না ধারা। তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়বেন। আর নিজের খেয়াল রাখবেন। ঠিকমতো খাবার খাবেন। একটু পর পর পানি খাবেন। বুঝেছেন?'

হাতের কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসলো ধারা। মানুষটা আজকে এতো বকবক করছে! ধারা বলল, 'বুঝেছি। খুব ভালো মতোই বুঝেছি। আপনি এতো ভাববেন না। আমি নিজের খেয়াল রাখবো।'

শুদ্ধ স্মিত হাসলো। একটুপর অটো চলে এলে ধারা চলে গেলো। শুদ্ধ'র খানিক খারাপ লাগলো বটে তবে সে ব্যাকুল হয়ে কালকের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ভালো মতো কালকে ধারার পরীক্ষাটা দেওয়া হয়ে গেলেই শুদ্ধ'র স্বস্তি।
__________________________________________

বাড়ি ফিরে নিজের বাবার শক্ত গম্ভীর মুখটা দেখতেই ধারার মুখের ভাব পাল্টে গেলো। কোনমতে বাবার সামনে থেকে চলে এসে নিজের রুমটায় ঢুকে পড়লো সে। এতদিন বাদে ধারা এই বাড়িতে থাকতে এসেছে বলে ভীষণ খুশি হলো আসমা। রাতুলও বড় বোনের আসায় আনন্দিত হলো। ধারা ও'র ব্যাগ থেকে রাতুলের জন্য একটা ঘড়ি বের করে বলল তার দুলাভাই দিয়েছে। গতমাসেই রাতুলের জন্য পছন্দ হওয়ায় কিনে রেখেছিল শুদ্ধ। পড়ার চাপে নিজের বাপের বাড়ি এতদিন না আসায় ধারা দিতে পারেনি। এরপর দাদীর কাছে গিয়ে বসতেই জমিরন বিবি অসুস্থ গলায় বিরক্তি ভাব নিয়ে বললেন,
'প্রত্তম আইসাই নিজের রুমটার মইধ্যে ঢুকলি! কই দাদীরে দেখতে আইবো তা না! তুই জীবনেও কিছু শিখতে পারলি নারে ধারা। এমন যদি শ্বশুরবাড়িত করোস, পরের বাড়ির ভাত দুইদিনও খাইতে পারবি না।'

ধারা চুপ করে রইলো৷ মাথা নিচু করে বসে রইলো দাদীর পাশে। তখন আজিজ সাহেব এসে দাঁড়ালেন সেই রুমে। জমিরন বিবি হঠাৎ খুকখুক করে কাশতে লাগলো। আজিজ সাহেব তার স্বভাবগত গম্ভির স্বরে দ্রুত বললেন,
'ধারা, তোমার দাদীকে ফ্লাক্স থেকে গরম পানি ঢেলে খাইয়ে দাও।'

আজিজ সাহেবের কথা শেষ হতে না হতেই ধারা যত দ্রুত সম্ভব উঠে দাঁড়ালো। তার বাবা কোন কিছুতেই বিলম্ব একদমই পছন্দ করেন না। আর এই তাড়াহুড়োর চক্করে ধারা সবসময়ই একটা না একটা গড়মিল করে ফেলে। বিশেষ করে তার বাবা যখন সামনে থাকে। যেমনটা এই মুহুর্তে করলো। আজিজ সাহেবের সামনে কোন কাজ করতে গেলে সেটাতে যাতে কোন ভুল না হয় এই প্রয়াসে ধারা এতোটাই নার্ভাস হয়ে পড়ে যে সেই মুহুর্তে তার মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। দাদীর জন্য ফ্লাক্স থেকে পানি ঢালতে গিয়ে সে কাঁপা হাতে কিছুটা গরম পানি জমিরন বিবির হাতে ফেলে দেয়। ধারা ঘাবড়ে যায়। যদিও ছিটকে আসা পানির পরিমাণ ছিল খুব অল্পই এবং পানি খুব বেশি গরম ছিল না যার দরুন জমিরন বিবির হাত খুব বেশি জ্বলে না। তবুও সেই হালকা জ্বালাতেই জমিরন বিবি কঁকিয়ে উঠে বলেন, 'আজিজ রে তোর মাইয়ারে কি আনছোস আমারে মারতে! কি করলো!'

আজিজ সাহেব বিরক্ত হয়ে বলল, 'তুমি কি কোন কাজই ঠিকমতো করতে পারো না ধারা!'

এই বলে আজিজ সাহেব চলে যান। ধারাও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ সে মুহুর্তে তার আর বলা হয়ে ওঠে না আগামীকাল পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা। সে ভেবে নেয় রাতে বলবে। কিন্তু সেই রাতে আর আজিজ সাহেবের দেখা পাওয়া যায় না। গ্রামের এক ঝগড়া সুলভের মাতব্বরীতে যেতে হয় তাকে। ধারা অপেক্ষা করতে থাকে। গভীর রাত হয়ে গেলে অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঘুমিয়েও যায়। ঘুম ভেঙে সকালের আলো দেখতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। খুব বেশি বেলা হয়নি। তার বাস সকাল নয়টার। এর আগে যে করেই হোক ধারাকে সবটা বলতে হবে তার বাবাকে।

শুদ্ধ সকাল সাতটা নাগাদই চলে আসে বাস স্ট্যান্ডে। তার আশেপাশের একটা হোটেল থেকেই সকালের নাস্তা করে নেয়। উত্তেজনায় খুব একটা খেতেও পারে না শুদ্ধ। আধপেটেই পুনরায় চলে আসে বাস স্ট্যান্ডে। বাস আসতে এখনও অনেক দেরী। বাস সমিতির কি একটা ঝামেলার কারণে একদম সকালের বাস বন্ধ থাকায় শুদ্ধকে নয়টার বাসেরই টিকিট কাটতে হয়। এতেই পরীক্ষা শুরুর আগে অনয়াসেই পৌঁছানো যাবে। শুদ্ধ একটা কাঠের বেঞ্চিতে বসে। তবুও স্থির হতে পারে না। একটু পরপরই ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় যেন কাটছেই না। কখন আসার সময় হবে ধারার?

ধারার বাবা সকালে হাটতে বেড়িয়ে এখনো ফিরে আসেনি। ধারা আছে শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। আবহাওয়া খুব বেশি গরম না হওয়ার ফলেও খুব করে ঘামছে সে। গলা বারবার শুকিয়ে আসছে৷ কিভাবে যে কথাটা বাবার কাছে শুরু করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না ধারা। তবুও বলতে তো তাকে হবেই। বাইরে দৃষ্টি রেখে সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার পায়চারি করতে থাকে। জমিরন বিবি এখন বেশ খানিকটা সুস্থ। ঠান্ডা, জ্বর রাতের মধ্যেই কমে গেছে। রোদের মধ্যে মোড়া পেতে এখন বসে আছে সে। একসময় আজিজ সাহেব গম্ভীর মুখে বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। ধারা নিজেকে একটু ধাতস্থ করে যেই না কিছু বলতে যাবে তার আগেই আজিজ সাহেব রাতুল বলে ডেকে একটা হুংকার ছাড়েন। আজিজ সাহেবের রাগের সাথে সেই বাড়ির সকলেই পরিচিত। সকাল সকাল এমন হুংকার শুনে রান্নাঘর থেকে আসমা, জমিরন বিবি দুজনেই ছুটে আসেন। ধারা হঠাৎ বুঝতে পারে না কি হয়েছে? রাতুল শঙ্কিত হয়ে দ্রুত বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়। আজিজ সাহেব মেঘের গর্জনের চাইতেও গম্ভীর মুখে বলেন,
'তুমি আগামীকাল কলেজ থেকে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলে?'
রাতুল ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। আজিজ সাহেব প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলে রাতুল আস্তে আস্তে মাথা নাড়ায়। আজিজ সাহেব বরফের মতো শীতল কণ্ঠে বলেন,
'কেন?'
রাতুল নিশ্চুপ হয়ে থাকে। কোন উত্তর না পেয়ে আজিজ সাহেব গর্জন করে বলেন, 'বলো কেন?'
রাতুল ভয়ে কেঁদে ফেলে। আজিজ সাহেব বলতে থাকেন, 'তোমার স্যারের সাথে আজকে সকালে আমার দেখা হয়েছিল। তুমি কলেজের ক্রিকেট বোর্ডে নাম লিখিয়েছো। সেখান থেকে আবার ক্লাস বাদ দিয়ে আরেক কলেজে খেলতেও গেছো। তোমাকে কি কলেজে পাঠাই ক্লাস করতে নাকি ক্রিকেট খেলতে? ক্রিকেট খেলে তোমার কি লাভটা হবে শুনি? যে ক্লাসের থেকে তোমার ক্রিকেট বড় হয়ে গেলো?'

রাতুল কাঁদতেই থাকে। আজিজ সাহেবের চিৎকার সেখানে উপস্থিত সকলের রক্ত ঠান্ডা করে দেয়। জমিরন বিবি নাতির পক্ষে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই আজিজ সাহেব থামিয়ে বলেন,
'আম্মা, আপনি আজকে কিছু বলবেন না। এতো কিছু হয়ে গেলো আর আমি কিছুই জানতে পারলাম না। অনেক বড় হয়ে গেছো? আমাকে জানানোর দরকার মনে হলো না! এতো সাহস এর হলো কিভাবে? আমার কাছে না জিজ্ঞেস করে কাজ করে! এতো বাড় বেড়ে গেছে! এতো বড় আস্পর্ধা?'

এই বলে অগ্নিশর্মা আজিজ সাহেব টেবিল থেকে স্টিলের জগ হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। বিকট আওয়াজ তুলে পানি সহ জগটা ঝনঝন করতে করতে ধারার পায়ের কাছে এসে পড়ে। বাবাকে জমের মতো ভয় পাওয়া ধারা এমন রূপ দেখে মুখের সমস্ত শব্দ হারিয়ে ফেলে। হাতের ফোনটা বারবার ভ্রাইবেট হতে থাকে আর ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ভয়ে আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে ধারা।

সময় গড়াতে থাকে। এদিকে ধারা এখনও আসছে না দেখে শুদ্ধ উদ্গ্রীব হয়ে উঠে। স্মার্ট ফোনটা বিক্রি করে সদ্য কেনা সস্তা বাটন ফোনটা দিয়ে ধারার ফোনে ননস্টপ কল করে যায় শুদ্ধ। ধারা ফোন তুলছে না দেখে আরও বিচলিত হয়ে উঠে। বাস ছাড়ার সময় হয়ে যায়। শুদ্ধ অনেক বলে কয়ে বাসকে পাঁচ মিনিটের জন্য আটকে রাখে। তারপর আবারও বলে বলে দুই মিনিট। মূলত ছেলেটার এতো ব্যাকুলতা দেখেই বাস চালক দশ মিনিটের মতো অপেক্ষা করে। তারপর আর সম্ভব না বলে আফসোস করে চলে যায়। সময় নষ্ট না করে শুদ্ধ আবারও সেকেন্ড বাসের টিকিট কেটে রাখে৷ আর ধারাকে লাগাতার ফোন করতে থাকে। এতক্ষণ ফোন রিং হলেও এখন ওপাশ থেকে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। মুখের রং পাল্টে যায় শুদ্ধ'র। সে আরও দু তিনবার ফোন করে। সেই একই কথা শোনা যায়। দেখতে দেখতে দ্বিতীয়, তৃতীয় বাসটাও চলে যায়। এখন আর ঢাকার বাসে উঠলেও পরীক্ষার আগে যাওয়া কোন পক্ষেই সম্ভব হবে না। শুদ্ধ ধপ করে বসে পড়ে বেঞ্চে। একসময় ঘড়ির কাটায় বেজে উঠে তিনটা ত্রিশ। শুদ্ধ তখনও পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসেই থাকে সেই কাঠের বেঞ্চে।


চলবে**********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#28
পর্ব -২০


সারাটা দিনই বাস স্ট্যান্ডে পড়ে রইলো শুদ্ধ। বাড়ি ফিরে যাবার কোন ইচ্ছা বোধ হলো না। রাতের বেলা তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। পাশের চায়ের স্টলের এক বুড়ো লোক শুদ্ধ'র গায়ের জ্বর দেখে নিজের ঝুপড়ি মতো ঘরটায় আশ্রয় দিলো। নিজের দূর্বল হাতের সেবায় জ্বর নামানোর প্রয়াসও করলো। শেষ রাতের দিকে জ্বর নেমে গেলো বটে তবে ভেতরে ভেতরে ভীষণ নেতিয়ে রইলো। যতোটা না শরীরে, তার চাইতেও বেশি মনে৷ সকাল নাগাদ সে ফিরে এলো নিজ বাড়িতে। খোদেজা তখন দাওয়ায় কুলো পেতে মড়া চাল বাছতে বসেছিল। শুদ্ধ'র এমন উদ্ভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে চিন্তামুখে প্রশ্ন করলো,
'কিরে মাহতাব, এতো তাড়াতাড়িই চলে আসলি যে! রাতের বাসে রওনা দিছিলি? বউ কই?'
শুদ্ধ আস্তে করে মায়ের পাশে বসে পড়ে। ফ্যাকাসে একটা হাসি দিয়ে বলে, 'ধারা পরীক্ষা দিতে আসে নাই আম্মা।'
খোদেজা অবাক হয়ে বলল, 'আসে নাই মানে?'

কথা বলতে বলতে শুদ্ধ'র গলা হঠাৎ ধরে এলো। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে শুদ্ধ ধরা গলায় বলল, 'আমি ধারার উপর ভরসা করেছিলাম। ও আমার ভরসা রাখতে পারে নাই আম্মা। রাখতে পারে নাই!' 

কথাটা বলতে বলতে শুদ্ধ'র চোখ বেঁয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। যে অশ্রুতে মিশে থাকে এক বুক হাহাকার।

এরপর সময় গড়ায়, দিনের পরের দিন যায়। শুদ্ধ ধারার প্রসঙ্গে আর একটা কথাও বলে না। নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ব্যস্ত করে ফেলে কাজে। খোদেজা ধারাকে নিয়ে যখনই কিছু বলতে যায় শুদ্ধ পাশ কাটিয়ে যায়। এমনিতেও যথেষ্ঠ সময় অপচয় করে ফেলেছে সে। নিজের কাজ ব্যতীত এখন আর অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে চায় না। ধারাকে নিয়ে তো একদমই না। খোদেজা বিচলিত বোধ করে। ওদের সম্পর্কটা কি কোনদিনও ঠিক হবে না?
__________________________________________

আসমা বেশ কিছুদিন ধরেই দুশ্চিন্তায় ভুগছে। দুশ্চিন্তা তার মেয়েটাকে নিয়ে। ধারাকে নিয়ে। ধারা আজকাল শুধু বিষন্ন হয়ে থাকে৷ ঠিকমতো খায় না। রাত হলেই তার রুম থেকে শুধু কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। বেশ কিছুদিন এই কান্নার শব্দ ধারার রুমের বাহিরে শুনেছে আসমা। ধারাকে এ নিয়ে খোলাখুলি কিছু জিজ্ঞাসা করলেও ধারা কিছু বলে না। নানা কথায় পাশ কাটিয়ে যায়। এমন না যে ধারা সবসময়ই হাসি খুশি থাকা মেয়ে। সে চুপচাপ স্বভাবেরই। বাড়িতেও খুব একটা কথা বলে না। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। হঠাৎ কি এমন হলো আসমা ভেবে পায় না। শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার পরও তো ঠিকই ছিল। তারপরই হঠাৎ কি হলো! আসমা মনে মনে মেয়ের জন্য একবুক প্রার্থনা করে আল্লাহ'র কাছে। মেয়েটার জন্য তার ভারী কষ্ট হয়। কখনো কারো কথার বাইরে যায় না ধারা। তবুও এ বাড়ির সবার তার প্রতি শত শত অভিযোগ। এখানে মেয়েটাকে দেখলে মনে হয় যেন প্রাণটা হাতে নিয়ে ঘুরে। একটু মন খুলে কথা বলতেও যেনো কত সংকোচ। আর হবেই বা না কেন? এ বাড়ির পরিবেশটাই এমন। আসমা গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হাতের কাজ সেড়ে ধারাকে খুঁজতে যায়। 

ছাদের কোণে স্টিলের দোলনায় বসে আছে ধারা। আজ তিন, চারদিন হয়ে গেলো ধারা এ বাড়িতে। সেদিন সেই যে শুদ্ধ পরীক্ষার দিন ধারাকে অনবরত ফোন করেছিল তারপর থেকে আর একটা ফোনও করেনি। ধারারও আর শুদ্ধ'র সামনে দাঁড়ানোর মতো কোন মুখ ছিলো না। তাই শত ইচ্ছার পরও সেও ফোন করতে পারেনি। আর না পেরেছে ও বাড়িতে ফিরে যাবার কথা ভাবতে। সে যা করেছে তার পর আর কিভাবেই বা শুদ্ধ'র সামনে দাঁড়াবে ধারা! তবুও কিছুটা সাহস সঞ্চার করে ধারা গতকাল রাতে শুদ্ধকে ফোন করেছিল। একবার, দুইবার তারপর বারবার। কিন্তু শুদ্ধ তার ফোন ধরেনি। একবারের জন্যও না। ভাবনার ভেতরেই যা ছিল আদৌও তাই ঘটার পরও যন্ত্রণা বহুগুণে বৃদ্ধি পেলো। দিনের আলোয় ছাদে নিরিবিলি বসেও ধারা এতক্ষণ সেই নিরর্থক প্রয়াসই করছিল। তখন আসমা এলো তার পেছনে। ধারার কাঁধে হাত রাখার পর ধারা মাথা ঘুরাতেই দেখলো মেয়ের কানে ফোন আর চোখে অনবরত ঝরে পড়া অশ্রুমালা। আসমা আঁতকে উঠে বলল,
'কি হয়েছে ধারা?'
ধারা মায়ের কোমর জাপটে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, 'আমি এমন কেন হলাম মা? কেন এমন হলাম? দাদী আমাকে নিয়ে যা যা বলে ঠিকই বলে। আমাকে এক্ষুনি রূপনগরে নিয়ে যাও মা।'
__________________________________________

খোদেজা মাটির চুলায় রান্না চড়িয়েছে। চারপাশে এলোমেলো হয়ে আছে রান্নার সরঞ্জাম। কাজে তার মন নেই। সর্বক্ষণ উদ্গ্রীব ছেলের জন্য। তার প্রিয় মাহতাবের জীবনে একটার পর একটা এসব কি হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। আজ গরমটা যেন একটু বেশিই। রোদের তেজ কমার নামই নিচ্ছে না। খোদেজা আঁচল দিয়ে একবার কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে নেয়। ঠিক সেই সময় তার উঠোনে এসে হাঁক পারে এক ফকির বাবা। রান্না ঘর থেকে উঁকি দিয়ে খোদেজা দেখে নোংরা একটা লম্বা জামা গায়ে এলোমেলো চুল বড় বড় নখের এক লোক এসে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে একটা কাপড়ের পুটলী ঝুলানো। গলায় আর হাতে অনেকগুলো তাবিজ। খোদেজা বাইরে বেড়িয়ে এলে ফকির বেশের লোকটি বলে,
'এক গ্লাস পানি খাওয়াও মা।'
লোকটাকে বেশভূষায় খোদেজার সাধারণ মনে হয় না। সে এসব ফকির তাবিজে বিশ্বাসী। অপরিচিত লোকটাকে গন্য করে সে ভেতর থেকে পরিষ্কার এক গ্লাসে পানি নিয়ে আসে। ফকির লোকটা খোদেজার ঘরের দাওয়ায় বসে সময় নিয়ে পানি খায়। তারপর খোদেজার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
'তুই নিশ্চয়ই কোন অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস। সমস্যার সমাধান এখনই না করলে সামনে তোর ঘোর বিপদ।'
খোদেজার মনের দুশ্চিন্তা তার চেহারায় স্পষ্ট। শুধু ফকির বাবা না যে কেউ দেখলেই বুঝে যাবে। কিন্তু এতটুকু তেই ফকির লোকটার প্রতি খোদেজার বিশ্বাস পাকা পোক্ত হয়ে যায়। তার ছেলের জীবনে এতো ঝামেলা হচ্ছে বলে সে একবার ভাবে যদি এর কোন সমাধান ফকির বাবার কাছে থাকে! তাই খোদেজা অনুরোধের সুরে বলে, 'আপনি ঠিকই বলতাছেন। আমার ছেলেটার জীবনে কিচ্ছু ঠিক হইতাছে না। একটার পর একটা অশান্তি হইতাছে। আপনের কাছে কি এর কোন সমাধান আছে?'
ফকির লোকটা গাম্ভীর্য্যের ভাব ধরে থম মেরে খোদেজার সব কথা শুনে বলে,
'হুম, বুঝতে পারছি। চিন্তা করিস না। একটা তাবিজ দিলেই ঠিক হইয়া যাইবো। আমি এক্ষুনি প্রস্তুত কইরা দিতাছি। তাবিজের দাম পাঁচশো টাকা। এইটা লাগাইলে তোর পোলার সব বালা মুছিবত কাইটা যাইবো।'
খোদেজা রাজী হয়ে যায়। পুকুরপাড় দিয়ে ক্ষেত থেকে তখন ফিরছিল শুদ্ধ। উঠোনে মায়ের সাথে ফকির বেশের লোকটাকে দেখেই তার কিঞ্চিৎ বিরক্তি হয়। তার মা আবার এসব মিথ্যা ভন্ডামীর চালে পড়ছে! শুদ্ধ ভেবে নেয় লোকটার সামনে গিয়েই একটা আচ্ছা মতো ধমক লাগাতে হবে। সে দ্রুত পা চালায়।

এইদিকে ফকির লোকটা তার পুটলি থেকে একটা তাবিজ আর কালো সুতা বের করে বলে, 
'কাজটা কিন্তু অতো সহজ না। এর জন্য তোর পোলার জন্ম তারিখ, সাল আর মায়ের নাম মানে তোর নাম বলতে হবে। শোন, মায়ের নামটা কিন্তু একদম আসল টা বলবি। যেটা বাপ মায়ের দেওয়া। ডাক নাম টুক নাম কিন্তু হইবো না।'
খোদেজা কেমন যেন ইতস্তত বোধ করলো। আস্তে আস্তে করে শুদ্ধ'র জন্ম তারিখ বলল। আর মায়ের নামের জায়গায় খুব সময় নিয়ে বলল, 'নুরুন্নাহার।'

ফকির লোকটির দৃষ্টি হঠাৎ খোদেজার পাশে গেলো। দেখলো একটি ছেলে অবাক মুখে খোদেজার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফকির লোকটির দৃষ্টি অনুসরণ করে খোদেজাও তাকালো সেদিকে। দেখে তার হুঁশ উড়ে গেলো। বাড়িতে পুরুষের উপস্থিতি দেখে এই ফাঁকে কেটে পড়লো ফকির লোকটি। দ্রুত দু কদম খোদেজার দিকে এগিয়ে এলো শুদ্ধ। সন্ধিগ্ন চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
'আম্মা, তুমি আমার মায়ের নামের জায়গায় তোমার নাম না বলে নুরুন্নাহার বললে কেন?'

প্রশ্ন শুনে খোদেজার গলা শুকিয়ে এলে। চেহারাটা মুহুর্তের মধ্যেই ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো তার।

চলবে***********।
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#29
আপেডেটের অপেক্ষায় আছি
Namaskar  Good Job  Namaskar
[+] 1 user Likes ojjnath's post
Like Reply
#30
(01-06-2024, 11:21 PM)ojjnath Wrote: আপেডেটের অপেক্ষায় আছি

পেয়ে যাবেন সময় মতোন গল্প।
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#31
পর্ব -২১




শাহেদ আর রুনার ছেলে তামিমের বয়স আড়াই বছর। প্রচন্ড চঞ্চল। তাকে সামলানো ভারী মুশকিল। রুনার একা একা কষ্ট হয়। শাহেদ থাকে সারাদিন অফিসে। এদিকে রুনারও এবার মাস্টার্স চলছে। বাচ্চা হওয়ায় মাঝে দু বছর গ্যাপ নিয়েছিল। শহরে আত্মীয় স্বজনও কেউ নেই যে বাচ্চাকে প্রয়োজনে কারো কাছে রেখে যেতে পারবে। তাই সবদিক বিবেচনায় নিয়েই তারা ছেলের জন্য একজন আয়া রেখেছেন। মহিলার বয়স ভালোই। কর্মজীবনে নার্স ছিলেন। এখন রিটায়ার্ডের পর ভালো স্যালারী যাচাইয়ে বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ নিয়েছে। তার নাম ফাতেমা। রুনার খুব সুবিধা হয়েছে তাকে রেখে। আজ রুনা একটু বিশেষ কাজে বাইরে বেড়িয়েছিল। বাসায় ফিরে এসে দেখে তার আদরের ছেলেটা সোফার উপর বসে বসে খেলছে। রুনা গিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। রুনা ফিরে আসায় ফাতেমা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাচ্চাকে মায়ের কাছে রেখে বাথরুমে গেলো। শাহেদ আবার ফোন করেছিলো কিনা দেখার জন্য রুনা ফোন বের করতেই তার উপর হামলে পড়লো তার ছেলে৷ রুনা স্মিত হেসে ফোন থেকে ছেলেরই কিছু মজার ভিডিও ছেড়ে দিয়ে তার হাতে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে বাচ্চাটির পাশে বসলো ফাতেমা৷ ফোন পেয়ে এলোপাথাড়ি কিছু টিপাটিপি করে ফোনটা রেখে আবারও খেলনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তামিম৷ সোফার উপর পড়ে থাকা ফোনের স্ক্রিনের উপর একটা ছবি দৃশ্যমান হয়েছিল। সেটা দেখে ফাতিমা বলল, 'বাহ! মেয়েটা তো ভারী সুন্দর। এটা কার বিয়ের ছবি রুনা?'

বয়সে ছোট হওয়ায় ফাতিমা রুনাকে নাম ধরেই ডাকে। এতে করে রুনারও কোন আপত্তি না থাকায় সে কিছু বলে না। ফাতিমার প্রশ্নে রুনা বলল, 'আমার ভাসুরের মেয়ে। ও'রই বিয়ের ছবি। আরও আছে দেখুন।'

ফাতেমা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে একটার পর একটা ছবি দেখতে থাকে। সবগুলোই ছিল ধারার বিয়ের ছবি। কিছু ছিল এ বাড়িতে থাকাকালীনই আর কিছু ছিল শ্বশুরবাড়িতে প্রথম যাওয়ার পর নিয়ম রীতি পালনের ছবি। ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবিতে ফাতিমার দৃষ্টি আঁটকে যায়। ভ্রুকুটি করে সে বেশ খানিকক্ষণ গভীরভাবে কিছু একটা নিয়ে ভাবতে থাকে৷ হঠাৎ কিছু অনুধাবন করতে পেরে তার ঠোঁটের কোনে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠে। ফোনটা রুনার দিকে ফিরিয়ে ফাতেমা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে বলে উঠে, 'তোমার ভাসুরের মেয়ের পাশে এই মহিলাটা তোমাদের কি হয় রুনা?'
শাহেদের থেকেই রুনা জানতে পেরেছিল ইনি ধারার শ্বাশুড়ি হন। শাহেদও প্রথম বাড়িতে গিয়ে ধারার থেকে ছবি দেখেই চিনেছিল। সেই কথাটাই রুনা ফাতেমাকে বলার আগেই সে অনবরত কথার সুরে বলে যেতে থাকেন,
'তাকে তো আমি চিনি। অনেক আগের কথা। সম্ভবত আরো ছাব্বিশ সাতাশ বছর আগে আমাদের দেখা হয়েছিল। আমি তখন সরকারি হাসপাতালের নার্স ছিলাম। তার নামটাও যেন কি? হ্যাঁ...হ্যাঁ মনে পড়েছে খোদেজা। সেই অনেক বছর আগে খোদেজা যা করেছিল তারপরও কি আর ওঁকে না চিনে পারি!'

রুনা জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
'কি করেছিলেন উনি?'

ফাতিমা একটু থামলো। ফিরে গেলো সেই ছাব্বিশ বছর আগের ঘটনায়। যেই ঘটনা এতদিন শুধু গুটিকয়েক মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। 

খোদেজা আর নুরুন্নাহার ছিল বাল্যকালের সখী। তাদের বেড়ে উঠা একসাথেই। বড় হতেই নুরুন্নাহারের সম্পর্ক গড়ে উঠে পাশের গ্রামের এক যুবকের সাথে। কিশোরী বয়সে আবেগের বশবর্তী হয়ে নুরুন্নাহার একটা ভুল করে বসে। নিজের বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে সেই ছেলেকে। শুধুমাত্র একজনের উপর ভরসা রেখে পাড়ি জমায় অচেনা যান্ত্রিক শহর ঢাকায়। মেয়ে পালিয়ে যাবার মতো কলঙ্ক নুরুন্নাহারের বাবা মায়ের গায়ে লাগতেই পুরো গ্রাম তাদেরকে দেখে ছি ছি করে। মূলত এই ভয়েই এরপর খোদেজার বাবা মা খোদেজার জন্য যত দ্রুত সম্ভব সম্বন্ধ দেখে খোদেজার বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের পর কিছু বছর খুব ভালোই কাটছিল খোদেজার। এরপরই তার স্বামীর এক বড় অসুখ দেখা দেয়। আস্তে আস্তে অবস্থা খারাপের দিকে গেলে বেশ কিছু জমি বিক্রি করে মোটা অঙ্কের অর্থ সম্বল করে খোদেজা একা একাই স্বামীর চিকিৎসার জন্য ঢাকায় গিয়ে বাসা ভাড়া নেয়। সেখানে থেকে তার স্বামীও টুকটাক কাজ করতে থাকে। ভাগ্য খোদেজার সুপ্রসন্ন ছিল না। কিছুমাস সুস্থ থাকার পর তার স্বামীর অবস্থা আবারও খারাপ হতে থাকে। একদিন হাসপাতালেই মৃত্যু নামক ভয়াবহ থাবা তার স্বামীকে কেড়ে নিলে খোদেজা একা হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে কিছু প্রতিবেশীর সাহায্য নিয়ে সেখানেই দাফন কাজ সমাধা করতে হয় খোদেজাকে। স্বামীর মৃত্যুর পর খোদেজা এক প্রকার ভেঙেই পড়ে সেই সময়৷ তার পরে একদিন হাসপাতালের কেবিন থেকে তার স্বামীর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে গেলে খোদেজার হঠাৎ দেখা হয় নুরুন্নাহারের সাথে। হাসপাতালের করিডোরে নয় মাসের ভরা পেট নিয়ে নুরুন্নাহারকে পড়ে থাকতে দেখে সে। নুরুন্নাহারের অবস্থা দেখে খোদেজা আঁতকে উঠে। তার চাইতেও বেশি শঙ্কিত হয় নুরুন্নাহারের কাহিনী শুনে। পালিয়ে বিয়ে করে ঢাকায় কিছুদিন সংসার করার পরেই নুরুন্নাহারের স্বামী তাকে একটা বস্তি মতন জায়গায় নিয়ে কোন এক আত্মীয়ের বাসায় তাকে একা কিছুদিন রাখার কথা বলে নুরুন্নাহারকে একা ফেলে চলে যায়। কিছুদিন যাবার পরই নুরুন্নাহার বুঝতে পারে কত বড় প্রতারকের খপ্পরে পড়েছে সে৷ এটা তার স্বামীর কোন আত্মীয়ের বাড়ি নয়। দেহ ব্যবসার কারখানা। নিজের মন ভরে যাওয়ার পর কিছু টাকার বিনিময়ে যেখানে তাকে বিক্রি করে গেছে তার ভালোবাসার মানুষটি। সবটা উপলব্ধি করতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে নুরুন্নাহার। সকলের পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করে তাকে ছেড়ে দেবার জন্য। সেখান থেকে পালানোর অনেক অনেক চেষ্টা করে সে। কিন্তু পারে না। ততদিনে তার নামের সাথে পতিতা শব্দও যোগ হয়ে যায়। নুরুন্নাহার থেকে নাম হয়ে যায় কমলা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই জীবনই এরপর মেনে নিতে হয় নুরুন্নাহারকে। তারপর একদিন হঠাৎ তার মধ্যে আরেকটা অস্তিত্ব আসে যার সঠিক পিতৃপরিচয় নুরুন্নাহারের অজানা। এরপরে সবটাই তো খোদেজার সামনে। নুরুন্নাহারের মুখ থেকে সবটা শুনে খোদেজার চোখ থেকে দরদর করে পানি ঝরতে থাকে। এত কিছু হয়ে গেছে নুরুন্নাহারের সাথে! খোদেজা তো জন্মের পর থেকেই শ্যামলা। কিন্তু নুরুন্নাহারের গায়ের রং ছিল ফর্সা। হাসলে তার বাম গালে কতো সুন্দর টোল পড়তো! তাকিয়েই থাকতে মন চাইতো শুধু। আর আজ সেই নুরুন্নাহারের কি অবস্থা! জীর্ণ রোগা শরীর। কালো হয়ে গেছে যেন একদম। দেখে চেনাই যায় না। নুরুন্নাহার খোদেজার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

'আমি যেই ভুল করছিলাম তার শাস্তি আমি পাইয়া গেছি খোদেজা৷ আমি জানি না আমার পোলা হইবো নাকি মাইয়া। আমি শুধু চাই আমার সন্তান ভালো থাকুক। ঐ নোংরা জায়গায় আর না যাক। একটা স্বাভাবিক জীবন পাক। ঐ জায়গা থিকা আমি যে কেমনে হাসপাতালে আইছি তা আমিই জানি৷ ওইখানে থাকলে আমার বাচ্চাটা বাঁচতো না রে।' 

এরপরে নুরুন্নাহারের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ হয়ে যায়। বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তাকে। তার ডেলিভারি ফাতেমা নামের একটি নার্স করে। বাচ্চা সুস্থ জন্ম নিলেও নুরুন্নাহার মারা যায়। ডাক্তার বা নার্স কেউই প্রথমে নুরুন্নাহারের আসল পরিচয় না জানলেও তার মৃত্যুর পরে কথাটা কিভাবে যেন ছড়িয়ে যায়। মা তো মরে গেছে, এখন এই পতিতার ছেলেকে নিয়ে ডাক্তাররা কি করবে তার চিন্তায় পড়ে যায়। মায়ের মৃত শরীরটাট পাশে হাত পা নাড়িয়ে চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক দেখছিল বাচ্চাটি। খোদেজার কেমন যেন মায়া লাগলো বাচ্চটির জন্য। আচ্ছা বাচ্চাটি তো বাকি বাচ্চাদের মতোই নিষ্পাপ। তার গায়ে কি লেখা আছে তার জন্ম ইতিহাস? খোদেজা আলতো করে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাটি তার স্বচ্ছ ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে খোদেজার দিকে। হঠাৎ এক হাত দিয়ে খোদেজার শাড়ির আঁচল শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে সে। খোদেজার তখন আচমকা কি যেন হয়। স্বামীহীন নিঃসঙ্গ জীবনে সে হঠাৎ করেই বেঁচে থাকার টান অনুভব করে। তার মাতৃত্ব জাগ্রত হয়। সে ঠিক করে এই বাচ্চাকে সে মানুষ করবে, তার পরিচয়ে। সেখানে উপস্থিত এক বড় ডাক্তার আর নার্সরা অবাক হয়ে যায় খোদেজার কথায়। একটা পতিতার ছেলেকে কে নিতে চায়! খোদেজার উদার মনের পরিচয় বড় ডাক্তারকে মুগ্ধ করে। শিক্ষিত হয়েও এমন জন্ম পরিচয়ের মতো এই ধরণের সেনসিটিভ ব্যাপার সমাজের মানুষের কাছে কতোটা প্রভাব ফেলে তা সে ভালো করেই জানে। আর সেদিকে খোদেজা গ্রামের মেয়ে হয়েও যেভাবে সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে বের হয়ে বাচ্চাটিকে আপন করে নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বড় ডাক্তার খোদেজার অনেক প্রশংসা করলেন আর ছেলের নামটাও তিনিই রেখে দিলেন৷ এই ছেলে একদিন নিজের কর্ম দিয়ে নিজের জন্মের কালো ইতিহাসটাকে পৃথিবীর কাছে উপেক্ষিত করে তুলবে এই আশায় নাম রাখলেন 'শুদ্ধ'।

ফাতেমা একবুক শ্বাস নিয়ে হাসপাতালে খোদেজার সেদিনকার কাজের কথাটা খুলে বলল। সবটা শুনে রুনার মুখ হতভম্ব হয়ে গেলো। সে তৎক্ষনাৎ প্রশ্ন করলো,
'উনার কি আর কোন ছেলে আছে?'
ফাতেমা বলল, 'না। তার স্বামী যখন মারা গিয়েছিল তখন তো সে খালিই ছিল। এখন যদি আবারও বিয়ে না করে থাকে তবে সেই পালক ছেলে ছাড়া তো আর কোন ছেলে আছে বলে মনে হয় না।'
রুনার যা বোঝার সে বুঝে যায়। এরপর শাহেদ অফিস থেকে ফিরে এলে তাকেও সবটা খুলে বলে। সবটা শুনে শাহেদের মাথার রগ রাগে দপ দপ করতে থাকে। শেষমেশ একটা পতিতার ছেলে হলো তালুকদার বাড়ির জামাই! ঘৃণায় তার গা গুলিয়ে উঠে। সে তৎক্ষনাৎ আবার অফিসে ফিরে যায় ছুটির আবেদন নিয়ে। ছুটি মঞ্জুর হয়, তবে পাঁচ ছয় দিন পর৷ এমন একটা ব্যাপার, ফোনেও সব খুলে বলা যাবে না। সে চাতকের মতো অপেক্ষা করতে থাকে কবে এই মাঝের দিনগুলো পার হবে। এই বিয়ে তার আগের থেকেই পছন্দ ছিল না। তার উপর এতো বড় ধোঁকা! এবার সে এর একটা হেনস্তা করেই ছাড়বে।
__________________________________________

খোদেজার মুখে সব সত্যিটা শোনার পর থেকে শুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে আছে। কিছুক্ষণের জন্য সবকিছুই যেন থমকে যায় তার কাছে। সে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পায় না। তার সমস্ত পৃথিবীটাই আজ যেন মিথ্যা হয়ে গেলো। খোদেজাও নিশ্চুপ হয়ে আছে। সবটা শোনার পর শুদ্ধ'র প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য বারবার আড়চোখে দেখছে শুদ্ধকে। খোদেজা কখনই চায়নি এই সত্যটা শুদ্ধ'র সামনে আসুক। গ্রামবাসীও কেউ কিছু জানে না। খোদেজা যখন ছোট্ট শুদ্ধকে নিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিল তখন সবাই শুদ্ধকে তার নিজের ছেলে বলেই বিশ্বাস করে নিয়েছিল। এতদিন কেউ কিছু জানেনি। সামনেও কাউকে জানাতে চায়নি খোদেজা। কিন্তু শুদ্ধ'র মতো বিচক্ষণ ছেলের সামনে মিথ্যা বলাটাও মুশকিল। যেখানে শুদ্ধ কিছু আঁচ করতে পেরেছে। তাই খোদেজাকে আজ সবটা সত্যি বলতেই হলো। শুদ্ধ তার ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। সত্য বড়ই কঠিন। তবে শুদ্ধও শক্ত ছেলে। ভেতরের অবস্থা যাই হোক বাইরে থেকে নিজেকে সামলে নিল সে। নিজের কাজে এর কোন প্রভাব পড়তে দিল না। শুধু আগের চাইতে আরও বেশি নিশ্চুপ হয়ে পড়লো। শুদ্ধ আর এ নিয়ে কোন কথা বলল না। খোদেজাও আর কিছু তুললো না। শুধু ভেতরে ভেতরে ছেলের জন্য কষ্ট পেতে লাগলো। দুই দিন বাদে ধারা ফিরে এলো। সেদিন সেই মুহুর্তেই ধারা রূপনগরে চলে আসতে চাইলেও মেয়েকে পাঠাতে আসমার দুইদিন লেগে যায়। ফিরে এসে শুদ্ধ'র এমন চেহেরা দেখে ধারার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ধারার জন্য কষ্ট শুদ্ধ'র মধ্যে আগের থেকেই ছিল, নিজেকে নিয়ে সত্যটা জানতে পেরে তথাপি সেই যন্ত্রণা আরও বেশি বৃদ্ধি পেলো। নতুন যন্ত্রণার প্রাবল্যতা এতো বেশি ছিল যে পূর্ব আঘাত তার কাছে হয়ে উঠলো গৌণ। আর এদিকে ধারা ভেবে নিল এই সবটাই বুঝি ধারার জন্যই। তার জন্যই আজ শুদ্ধ'র এমন বেহাল দশা। তার মুখে হাসি নেই, কথা নেই, কোন আনন্দ নেই। শুদ্ধ তার সাথে কথা বলে না। এই যন্ত্রণা ধারাকে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো। শুধুমাত্র একটি মানুষের নিরবতায় ধারার মনে হলো পুরো পৃথিবীটাই বুঝি শব্দহীন হয়ে গেছে। এই শব্দহীন পৃথিবীর নিস্তব্ধতা ধারাকে আঘাত দেয়। মনে মেঘ জমায়। প্রতি রাতে বৃষ্টি নামায়। এখন শুধু মনে হয় পুরো পৃথিবী এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক, যতো মূল্যই শোধ করতে হয় হোক, শুধু এই মানুষটা একটু কথা বলুক। টোল পড়া হাসি দিয়ে আরেকবার মুগ্ধ করুক। আরো একবার তার সেই ভরাট স্পষ্ট গলায় 'ধারা' বলে ডেকে উঠুক। কিন্তু তা আর হয় না। ধারা সারাদিন শুদ্ধ'র পিছে পিছে ঘুরে। সুযোগ খুঁজে কথা বলার। কিন্তু আগের মতো তা আর হয় না। একদিন রাতে ধারা একা সব রান্না করলো। খাবার বেড়ে দিয়ে বসে পড়লো খোদেজার পাশে। শুদ্ধ তখনই বাড়ি ফিরে আসায় খোদেজা তাকেও বসতে বললো। শুদ্ধ'র মন তখন ভালো ছিল না। খেতে ইচ্ছে করছে না বলে সে না করে আবার বাইরে চলে গেলো। ধারা ভেবে নিলো শুদ্ধ বুঝি তাকে এখন এতোটাই ঘৃণা করে যে সে রান্না করেছে বলে সেই খাবার পর্যন্তও খেতে চায় না। ধারাও আর সে রাতে খেলো না। খোদেজার সামনে কোনমতে ঠোঁট চেঁপে কান্না আটকিয়ে খাবার ফেলে ছুটে উপরের রুমে চলে এলো ধারা। বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বালিশে মুখ লুকিয়ে ভেঙে পড়লো অঝোরে কান্নায়।
__________________________________________

মাঝ রাতে পায়ে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই খোদেজার ঘুম ভেঙে যায়। চমকে উঠে বসতেই দেখে শুদ্ধ তার পা টিপে দিচ্ছে। খোদেজা বারণ করে পা সরিয়ে নিতে নিতে বলে, 'আরে আরে কি করছিস?'
শুদ্ধ পা সরাতে দেয় না। জোর করে নিজের কাছে রেখে পা টিপে দিতে থাকে। খোদেজা অপলক শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে থাকে। মলিন মুখে বলে,
'মাহাতাব, আমাকে মাফ করে দিস বাবা।'
শুদ্ধ ঝট করে খোদেজার দিকে তাকায়। করুণ গলায় অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, 'আম্মা...তুমি আমার কাছে মাফ চাইছো আম্মা! তুমি তো আমার জীবনটাকে সুন্দর করে দিয়েছো। তুমি আমার জন্য যা যা করেছো! তুমি এতো ভালো কেন আম্মা?'

শুদ্ধ'র চোখে পানি জমতে থাকে। শুদ্ধ'র মুখে আম্মা ডাক শুনে খোদেজার মন ভরে যায়। ঠিক এই ভয়টাই সে এতদিন পাচ্ছিলো। খোদেজা ভেবেছিল শুদ্ধ যদি জানতে পারে খোদেজা তার আসল মা না তাহলে হয়তো আর আগের মতো ভালোবাসবে না। খোদেজার মনের ভাব বুঝতে পেরে শুদ্ধ বলতে থাকে,
'আমি কিন্তু তোমাকে এর জন্য কৃতজ্ঞতার কথা বলতে পারবো না। কারণ কৃতজ্ঞতা তো বলা হয় বাইরের মানুষকে। তুমি তো আমার নিজের মা। মাকে কি কেউ ধন্যবাদ বলে, বলো? সত্য যাই হোক। আমার কাছে কোন ম্যাটার করে না। আমি জন্মের পর থেকে তোমাকেই আমার মা বলে জেনে আসছি। তুমি আগে যেমন আমার আম্মা ছিলা তেমন সবসময়ই আমার আম্মা থাকবা। আমি আর কিছু জানি না। আমি আর কিছু জানতে চাই না।'

বলতে বলতে শুদ্ধ খোদেজার পা পেঁচিয়ে কাঁদতে থাকে। খোদেজা আবেগ্লাপুত হয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ সময় এভাবেই কাটে। নিরবে চলতে থাকে মাতা পুত্রের অনুভূতির আদান প্রদান। কিছু সময় পর স্বাভাবিক হলে শুদ্ধ বলে, 'আম্মা একটা কাজ কিন্তু তুমি ঠিক করো নাই। আমার বিয়ের আগে তুমি ধারার পরিবারকে বললে না কেন এই সত্যিটা?'
খোদেজা আঁতকে উঠে। বলে,
'এইসব কি বলতাছোস মাহতাব? এইসব কথা কেউ বলে! যেই জিনিসটা কেউ জানে না, দরকার কি তা আবার জানানোর৷ তুই আবার ধারাকে কিছু বলতে যাইস না।'
'না আম্মা। তুমি ভুল কথা বলছো। তারা আমার কাছে তাদের মেয়ে দিচ্ছিলো। বিয়ের আগে তাদের পুরো অধিকার ছিল ছেলে সম্পর্কে সবটা জানার। এভাবে সত্য গোপন রাখাও এক প্রকার ঠকানো৷ এই কাজটা একদম ঠিক হয়নি। তোমার তাদেরকে বলা উচিত ছিল৷ আর ধারাকে তো আমি বলবোই। ধারা আমার স্ত্রী। ও'র সবটা জানা প্রয়োজন।'

খোদেজা বিচলিত হয়ে উঠে। আবার কি না কি ঝামেলা হয়ে যায় এই কারণে সে শুদ্ধকে থামানোর জন্য বলে, 'আচ্ছা ঠিকাছে শুধু ধারা জানবে। কিন্তু ধারাকে আমি বলবো৷ আমি নিজে সবটা খুলে বলবো। তুই কিছু বলবি না। ঠিকাছে?'

শুদ্ধ সায় দেয়।

সকাল হতেই কি একটা কাজে আবুল আসে শুদ্ধ'র কাছে। শুদ্ধকে বাড়িতে পায় না। সে আরো আগেই তার কাজে বেড়িয়ে পড়েছে। খোদেজা ধারাকে পাঠায় দেখার জন্য৷ ধারা গিয়ে দেখে আবুল কারেন্ট বিলের কাগজ দেখাতে এসেছে শুদ্ধকে। কি একটা হিসাবে তার গড়মিল লাগছে, বুঝতে পারছে না। ধারা আবুলকে বুঝিয়ে দেয়। সবটা বোঝার পর আবুল কাগজ জমা দেওয়ার আগে একটা ছবি তুলে নেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করে৷ কাগজটা টেবিলের উপর রেখে আবুল ছবি তোলার জন্য ফোন বের করে। আবুলের ফোনের দিকে তাকিয়ে ধারা অবাক হয়। এটা তো শুদ্ধ'র ফোন। আবুলের কাছে কি করছে? আর শুদ্ধ'র হাতেও তো আজকাল একটা বাটন ফোন ছাড়া আর কোন ফোন দেখা যায় না। মনে খটকা লাগলেও মুখ খুলে আর প্রশ্নটা করা হয় না ধারার। আবুল চলে যায়। ব্যাপারটা সারাদিন ভাবায় ধারাকে৷ এর উত্তর পায় সে রাতে। শুদ্ধ বাড়িতে ছিল না। ফাহিমের কল আসে তার কাছে। ধারা রিসিভ করতেই প্রশ্ন করে,
'আপনার পরীক্ষা কেমন হয়েছে ভাবী?'

ধারা কি বলবে ভেবে পায় না। আমতা আমতা করতে থাকে। ফাহিম উত্তরের তোয়াক্কা না করে বলতে থাকে, 
'নিশ্চয়ই ভালো হয়েছে। শুদ্ধ যেমন করে খেটেছে না ভালো হয়ে কি পারে! রেজাল্ট আসা পর্যন্ত বেশি চিন্তা করবেন না ভাবী। দেখবেন ভালোই হবে। আর ভাবী, শুদ্ধকে আমার হয়ে একটু সরি বলে দিবেন। বলবেন আমি অনেক লজ্জিত। এমন হঠাৎ করে টাকার প্রয়োজন না হলে আমি শুদ্ধকে কখনোই এমন ইমারজেন্সি ভাবে আমার বেতন দিতে বলতাম না। আট হাজারের মতো টাকা! শুদ্ধ'রও নিশ্চয়ই হঠাৎ করে ম্যানেজ করতে খুব কষ্ট হয়েছে! আমার ভীষণ খারাপ লাগছে।'

ফাহিম আরো কিছু বলতে থাকে৷ ধারার কানে যায় না। আস্তে আস্তে ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ফেলে সে। এই মুহুর্তে সে বাকরুদ্ধ। শুদ্ধ'র ফোন কেন আবুল ভাইয়ের কাছে তা সবটাই বুঝতে পারে সে। শুদ্ধ তার জন্য নিজের ফোন বিক্রি করে ফেলেছে আর সে....! ধারা হঠাৎ হাঁটুতে মুখ রেখে ডুকরে কেঁদে উঠে নিজের হাত কামড়ে ধরে। নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে এই মুহুর্তে শেষ করে ফেলতে পারলেই বুঝি তার মিলতো অনুতপ্তের এই উত্তপ্ত আগুনে যন্ত্রণাদায়ক ভাবে দগ্ধ হওয়া থেকে মুক্তি।

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#32
 পর্ব -২২



আজিজ তালুকদার থম মেরে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখে কোন কথা নেই। কপালে চিন্তার ভাঁজ। তবে তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে আসলে কি ভাবছে। শাহেদ অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে। কথার মাঝখানে সে এক দু'বার আজিজ সাহেবের প্রতিক্রিয়া বোঝারও চেষ্টা করলো। কিন্তু বুঝতে পারলো না। এতো বড় সত্যিটা জানার পর আজিজ সাহেবের কি মত তা শাহেদের জানা দরকার। মানুষকে নিজের কথার আয়ত্বে আনতে পারা তার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আজিজ সাহেবের মতো শক্ত মানুষকেও সে ম্যানিপুলেট করার ক্ষমতা রাখে। তারই প্রচেষ্টায় শাহেদ বিরতিহীন ভাবে বলে যেতে লাগলো,
'ভাইজান, এই ছেলে কতো বড় চতুর বুঝতে পারছেন? এতো বড় সত্যি আমাদের থেকে লুকিয়ে রাখছে৷ আর লুকোবেই না কেন! জানে তো সত্যিটা জানলে আর তালুকদার বাড়ির মেয়ে পাবে না। আমার তো মনে হয় এরা শুধু মিথ্যাবাদীই নয় এর সাথে লোভীও। ছি ছি আমি ভাবতেও পারছি না। শেষমেশ কিনা একটা পতিতার ছেলে!'

শেষের কথাটা শুনে আজিজ সাহেব দাঁতে দাঁত চেঁপে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আসমা আর জমিরন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সত্যটা গ্রহণ করতে তাদেরও কষ্ট হচ্ছে। শাহেদ বলে,

'আমাদের তালুকদার বাড়ির একটা মান সম্মান আছে। আমাদের বাপ দাদার আমলেও কোনদিন এমন ঘটনা ঘটে নাই। তারা কেউ উচ্চবংশীয় সম্বন্ধ ছাড়া আত্মীয়তা করতেন না। সবাই সম্মানের চোখে তাদেরকে দেখতো। এই ঘটনা যদি জানাজানি হয় আমাদের বংশের এতোদিনের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। লোকে শুনলে থু থু ছিটাবে, একটা পতিতার ছেলের সাথে কিনা তালুকদার বাড়ির একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে! আমার ভাবতেই গা গুলাচ্ছে ভাইজান। আপনি কিভাবে এমনটা করতে পারলেন! বিয়ে দেওয়ার আগে একটু তো ভালোমতো খোঁজ খবর নিয়ে নিবেন। একটা মাত্র মেয়ে আমাদের। কই একটু দেখে শুনে বড় ঘরে বিয়ে দিবেন তা না দিলেন তো দিলেন একটা ছোট ঘরে বিয়ে। তাও সবটা মেনে নিয়েছিলাম যাক বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন আর কি করার! কিন্তু এখন আবার এই কি কাহিনী বের হয়ে এলো! না জানি আরো কতো কেচ্ছা কাহিনী আছে এদের ভেতরে। আপনি রাগের মাথায় এই বিয়েটা দিয়ে যে কতো বড় ভুল করলেন! এর থেকে ভালো ছিল মেয়েকে কেটে গাঙে ভাসিয়ে দেওয়া।'

শাহেদ একটু থামলো। বোঝার চেষ্টা করলো আজিজ সাহেবকে আবার বেশি বেশি বলে ফেলছে কিনা! নিজেকে একটু ধাতস্থ করে বলল,
'ভাইজান, একটু ভেবে দেখেন। এই খবর যদি সমাজে ছড়ায় তাহলে আমাদের মুখে কেমন কালিটা লাগবে। মানুষ হাসবে। এতদিনের সব সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে। এই যে আপনি যে সামনে নির্বাচনে দাঁড়াবেন, এই খবর জানাজানি হলে আর জীবনেও চেয়ারম্যান হতে পারবেন! মান সম্মান বলতে আর কিছু থাকবে না। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী জয়নাল খাঁ তো তখন আরও আকাশে উঠবে। ভাইজান, একটু ভালো মতো ভেবে দেখেন। সবাই জানতে পারলে কি অবস্থাটা হবে আমাদের বংশের। এখনও সময় আছে। এই খবর জানাজানি হবার আগেই এর দফারফা করে ফেলেন। আমাদের ধারা দেখতে শুনতে গ্রামের মধ্যে সেরা। ও'র জন্য এরপর একটা উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে খুব বেশি সময় লাগবে না। অন্তত আর যাই হোক একটা পতিতার ছেলের কাছে আমাদের মেয়েকে আর রাখা যাবে না।'

শাহেদ খুব বেশি চিল্লাপাল্লা করতে থাকে। আজিজ সাহেব এখনও চুপ হয়ে আছেন। আসমা সেই নিশ্চুপতায় শঙ্কিত বোধ করেন। না জানি এবার কি হয়!
__________________________________________

আকাশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে আছে। রোদের তাপে খুব একটা জোর নেই। একটা শঙ্খ চিল ডানা মেলে শুদ্ধ'র মাথার উপরের আকাশ দিয়ে গোল গোল চক্কর দিচ্ছে। শুদ্ধ'র সেদিকে কোন নজর নেই। সে গভীর মনোযোগের সাথে ভ্রুকুটি করে একটা সরু বাঁশের মাথায় রশি দিয়ে খুঁটি বাঁধছে। বাড়ির পাশে একটা লম্বা পেঁপে গাছ হয়েছে। তার আগা ভর্তি শুধু পেঁপে। খালি হাতে নাগাল পাওয়া দুষ্কর। তাই এই ব্যবস্থা। ধারা এসে সেই সময় দরজা পাশে দাঁড়ায়। শুদ্ধকে দেখতেই তার চোখের কোণে পানি জমে। গতকাল রাতে শুদ্ধ'র ফোন বিক্রির ব্যাপারটা জানতে পারার পর থেকে ধারা স্থির হতে পারছে না। বাঁশের খুটি বাঁধা হলে সেই দড়ি কাটবার জন্য শুদ্ধ একটা কাঁচির প্রয়োজন অনুভব করে। কাঁচি ঘরের সামনে 'ওডা'র উপরেই রেখে ছিল শুদ্ধ৷ ধারার সামনে দিয়ে সেটা আনতে গেলে ধারা অস্ফুট স্বরে শুদ্ধকে কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই শুদ্ধ না তাকিয়েই চলে আসে। পুনরায় পেঁপে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে নিজের কাজে মন দেয়। ধারাও তৎক্ষণাৎ শুদ্ধ'র পেছন পেছন চলে এসে ভেজা গলায় বলে উঠে,
'আমি জানি আমি অনেক বড় ভুল করেছি। আপনাকে অনেক বড় আঘাত করেছি। ক্ষমা চাইবার মতোও আমার কোন মুখ নেই.....

রশি বাঁধা থেকে শুদ্ধ'র হাত থেমে যায়। তবে সে পেছনে ঘুরে না। ধারার কণ্ঠ কান্নামাখা। তার চোখ ভর্তি পানি। বুকে ভীষণ যন্ত্রণা। একটু থেমে সে বলতে থাকে,

'আমার মায়ের প্রথমেই দুটো মেয়ে হয়। সবসময় ছোট থেকে দেখে এসেছি রাতুল হওয়ার আগ পর্যন্ত পরপর দুটো মেয়ে হওয়ায় মাকে কতোটা কথা শুনতে হতো। অপয়া শব্দটাও নামের সাথে লেগে গিয়েছিল। একটা ছেলে জন্ম না দিতে পারায় দাদী কতো কিছুই না বলতো! ছোট থেকেই তাই সবসময় চাইতাম আমার নিজের কাজের জন্য যেন বাড়িতে কোন ঝামেলা না হয়। মেয়ে হয়েছে বলে আবারও যেন কোন কথা না শুনতে হয় আমার মাকে। সবসময় সবার মন রক্ষা করে চলার চেষ্টা করতাম। কারো কথার বাইরে যেতাম না। কাউকে কোন অভিযোগ করার সুযোগ দিতে চাইতাম না। অন্তত আমার কারণে কারো যেন কোন সমস্যা না হয় সেই চেষ্টা করতাম। কিন্তু এরকম ভাবে সবার মন যুগিয়ে চলতে চলতে আমি কবে কখন এরকম হয়ে গেলাম আমি নিজেও জানি না। হয়ে গেলাম আমি এমনই। আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমি তার মান রাখতে পারিনি। আপনাকে প্রচুর আঘাত করেছি। আমাকে প্লিজ মাফ করে দিবেন। এরকম চুপ করে থাকবেন না। আপনি কথা না বললে আমার খুব ক.......'

ধারা আর ও'র কথা শেষ করতে পারলো না। ও'র কথার মাঝেই হঠাৎ সেই বাড়ির উঠোনে আজিজ সাহেবের ডাক শোনা গেলো। তার সাথে আছে শাহেদও। হঠাৎ নিজের বাপ চাচার আগমনে ধারা অবাক হয়ে গেলো। শব্দ পেয়ে খোদেজাও বেড়িয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। শাহেদ ধারার অবাক মুখের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
'ধারা, চল! তোকে আর এই ছোট ঘুপচি ঘরে থাকতে হবে না। তোকে আমরা নিতে এসেছি। এই
ছেলে যে তোর শ্বাশুড়ির আসল ছেলে না তা কি তুই জানিস!'

ধারা হতভম্ব হয়ে গেলো। খোদেজা কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে কোন সময় না দিয়েই আজিজ সাহেব এবার ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলেন,
'এই কাজটা আপনি ঠিক করেননি। এভাবে একটা পতিতার ছেলের সাথে আপনি আমার মেয়ের বিয়ে করিয়ে নিলেন!'

আজিজ সাহেবের কথা শুনে ধারা স্তব্ধ। সেই বাকরুদ্ধ ধারাকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ দেওয়ার আগেই আজিজ সাহেব মেয়ের হাত খপ করে ধরলেন। নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা কিছু বলার জন্য অস্ফুট স্বরে 'বাবা' বলে ডাকতেই আজিজ সাহেব তাকে টেনে নিজের সাথে নিয়ে যেতে লাগলেন। ধারা অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে অপর হাত শুদ্ধ'র দিকে বাড়ানোর চেষ্টা করে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নড়লো না। তার বুকে একধরনের চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হলো, তবুও বাইরে তার আঁচ পড়তে দিলো না। ধারাকে নিয়ে চলে গেলে খোদেজা শুদ্ধ'র কাছে এসে বিচলিত স্বরে বলল,
'এইটা কি হইলো মাহতাব? তুই বউরে আটকে রাখলি না কেন?'
শুদ্ধ কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পেছনে ঘুরে বলল, 'রাখা তাকে যায়, যে থাকতে চায়। ধারার নিজস্ব কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই। সে তাই করবে, যা তাকে করতে বলা হবে।'
__________________________________________

রাতুল একটা সমস্যা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে আছে। কলেজ থেকে ক্রিকেট খেলে সে উপজেলা পর্যায়ে খেলার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এদিকে বাবা বলে দিয়েছে ক্রিকেট খেলে সময় নষ্ট করা যাবে না। ক্রিকেট রাতুলের খুব প্রিয়। বাবাকে সে ভয় পায় সত্য। কিন্তু ক্রিকেটও ছাড়ার কথা ভাবতে পারছে না। কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে সে শুদ্ধকে ফোন দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে করলো। তার দুলাভাই ভীষণ বুদ্ধিমান। এটা সে প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিল৷ রাতুল মাঝে মধ্যেই তার কাছে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের জন্য ফোন দেয়। রাতুল নিশ্চিত, সব সমস্যার মতো এই সমস্যার সমাধানও তার দুলাভাইয়ের নিকট থাকবে। এই ভেবে সে বাড়িতে সবসময় থাকা ফোনটা হাতে নেয়। শুদ্ধ'র নাম্বার বের করে তাতে কল দেয়। হঠাৎ শুদ্ধ'র ফোনে ধারাদের বাড়ি থেকে কল এসেছে দেখে শুদ্ধ অবাক হয় না। সে জানে কে হবে? এর আগেও রাতুল এই নাম্বার দিয়ে অনেকবার ফোন করেছে। শুদ্ধ কল রিসিভ করে ফোন কানে নেয়। রাতুল খুশিমনে কিছু কথা বলার পর যখনই তার সমস্যার কথা তুলতে যাবে তখনই তাদের বাসায় আগমন ঘটে তার বাবা আর চাচার। সাথে ধারাও। বাড়িতে তাদের পা পড়তেই একধরনের হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। আজিজ সাহেবের মাথা প্রচুর গরম। হঠাৎ আকস্মিক কোলাহলে ভয় পেয়ে রাতুল ঝট করে ফোন কান থেকে নামিয়ে সেই সোফার উপরে ফেলে রেখেই সেখান থেকে চলে যায়। ধারার অবস্থা একদম পর্যুদস্ত। আসমা আর জমিরন উদ্বিগ্ন হয়ে এগিয়ে আসে। আজিজ সাহেব ধারার কাছে এসে দায় ছাড়া স্বরে বলতে থাকে,
'ধারা, তোমার বিয়ে ওখানে দিয়ে আসলেই অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। তবে ব্যাপার না। এখনও সব ঠিক করা যাবে। তুমি ঐ ছেলেকে ছেড়ে দিবে।'

ধারা ঝট করে ও'র বাবার মুখের দিকে তাকায়। অশ্রু জমা স্তব্ধিত দুটি চোখ অপলক চেয়েই রয়। আজিজ সাহেব বলতে থাকেন,
'কালকে সকালে আমি উকিলকে আসতে বলবো। তার সাথে কথা বার্তা হবে। কিভাবে কি করতে হবে জানা যাবে। তারপর তুমি ঐ ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।'

ধারা ক্ষণবিলম্ব না করেই দ্রুত বলে উঠে, 'না।'

কখনো হয়তো মেয়ের মুখে না শব্দটা শুনেনি বলেই আজিজ সাহেব সাথে সাথেই কথাটা ধরতে পারেন না। উত্তর 'হ্যাঁ' মনে করে তিনি মাথা দুলিয়ে উঠতেই হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পান। দ্রুত ঘুরে বলে উঠেন,
'কি?'
বাবার দিকে তাকিয়ে ধারা স্পষ্ট করে বলে,
'আমি তাকে ছাড়তে পারবো না।'

আজিজ সাহেব মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে বলেন,

'কেন?'

ধারা বিনা দ্বিধায় বলল,
'আমি শুদ্ধকে ভালোবাসি।'

এই পুরো কথোপকথনটিই ফোনের ওপার থেকে শুনলো একজন। শুনে পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো সে। শরীরের প্রতিটি লোমকূপের এক শিহরিত অদৃশ্য কম্পন একদম স্থির করে ফেললো তাকে।

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#33
 পর্ব -২৩


কানে ফোন নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুদ্ধ। এই মুহুর্তে কর্ণগোচর হওয়া প্রতিটা কথাই কি সত্যি? কিছুক্ষণের জন্য তার সবকিছু কল্প ভ্রম বলে মনে হলো। কিন্তু না, চোখের সামনেই তো একটা নীল রঙের পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে। হিমেল হাওয়া গায়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে চলে যাচ্ছে। স্বপ্ন তো রঙিন রঙের হয় না। গরম, ঠান্ডা, কোন ব্যাথার অনুভুত হয় না। তার মানে সবই বাস্তব! যেই ধারা নিজের কোন ক্ষুদ্র পছন্দ অপছন্দের কথা তার পরিবারের কাছে বলতে পারে না, সেই ধারা কিনা শুদ্ধ'র জন্য আজ নিজের বাবার কথার বিরুদ্ধে গেলো! অবশেষে সে নিজের মতামত সবার সামনে উপস্থাপন করতে পারলো! ফোনের ওপাশ থেকে আরো অনেক কথা হতে লাগলো। আজিজ সাহেব বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন,
'তোমার মাথা ঠিক আছে? কি বলছো জানো!'
আজিজ সাহেবের ক্ষুব্ধ গলায় ধারা খানিক কেঁপে উঠলো। চোখ বন্ধ করে একটু গভীর শ্বাস টেনে কম্পিত স্বরে বলল,
'জানি। আমার মাথা পুরো ঠিক আছে। আমি আমার মনের কথাই বললাম।'

'ঐ ছেলে একটা পতিতার সন্তান! আর তুমি তার কাছে থাকতে চাইছো!'

ধারা এবার অধৈর্য স্বরে বলে উঠলো,
'তাতে কি হয়েছে বাবা? উনি তো কোন ভুল করেননি। সে তো ঠিক আছে। এখন তার আসল মা কে তাতে কি আসে যায়!'

'ঐ ছেলে আমাদেরকে ঠকিয়েছে। বিয়ের আগে কেন বললো না সত্যিটা?'

'শুদ্ধ যদি জানতো তাহলে অবশ্যই বলতো। শুদ্ধ কখনো কাউকে ঠকাতে পারে না। উনি খুব ভালো মানুষ। তাকে আমি বিশ্বাস করি৷ আর যদিও বা সত্যটা লুকানো থাকে তবুও এই সত্য জানা না জানায় আমার কিছু যায় আসে না। যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে আমি তাকে চিনি, জানি। আমি জানি সে কতোটা ভালো। সে ভালো থাকলেই আমার কাছে যথেষ্ঠ। তার আশেপাশের ব্যাপার আমার কাছে ম্যাটার করে না। প্রত্যেকটি মানুষেরই একটা নিজস্ব আলাদা ব্যক্তিত্ব থাকে৷ জন্ম পরিচয়ে কি হয়? আসল পরিচয়টা তো তার ভেতরের গুণগুলো দিয়েই হয়। তার নিজের কর্ম দিয়ে হয়। আর শুদ্ধ'র সেখানে কোন খাদ নেই।'

আজিজ সাহেব আসমার দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, 'তোমার মেয়ের কি হয়েছে? পাগল হয়ে গেলো নাকি!'

শাহেদ উদ্গ্রীব হয়ে ধারার কাছে এসে বলল,
'ধারা, কি বলছিস তুই এগুলো? আমরা তোর ভালোর জন্যই যা করার করছি।'

ধারা কেঁদে ফেলে বলল, 'আমি শুধু তার কাছেই ভালো থাকবো। আর কোনভাবেই না।'

আজিজ সাহেব হুংকার ছেড়ে বললেন,
'বিয়ে করে এই মেয়ের আস্পর্ধা বেড়ে গেছে! বড়দের সামনে কিসব কথা বলে যাচ্ছে।'

ধারা কাঁদতে লাগলো। শাহেদ মোলায়েম স্বরে বলল, 'কাঁদে না ধারা। দেখ, আমি বুঝতে পারছি। এতোদিন তুই ও বাড়িতে ছিলি তাই এভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত হওয়ায় তোর একটু মায়া লাগছে। ব্যাপার না। আস্তে আস্তে দেখবি সব ভুলে যাবি। একটু সময় যেতে দে।'

আজিজ সাহেব বললেন, 'ধারা, আমি যা বলছি তুমি তাই করবে। পৃথিবীর ভালো মন্দ তুমি এখনও জানো না। এতো বড়ও হয়ে যাও নি।'

ধারা বলল, 'যদি বড়ই না হয়ে থাকি তাহলে আমাকে বিয়ে কেন দিয়েছিলেন বাবা? আমি এমন কি বড় অন্যায় করে ফেলেছিলাম! এখন যখন আমি আমার স্বামীর কাছে থাকতে চাইছি তখন বলছেন তাকে ছেড়ে দিতে! যখন ইচ্ছা সবাই বলবেন বিয়ে করতে, যখন ইচ্ছা বলবেন ছেড়ে দিতে....এভাবে কিভাবে হয় বাবা? আমার নিজেরও তো কিছু ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে।'

আজিজ সাহেব গর্জে উঠে বলে উঠলেন,
'ব্যাস! অনেক বেশি বলে ফেলেছো। এখানেই থেমে যাও। তুমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে না। না মানে না। আর একটাও কথা না। আসমা, তোমার মেয়েকে ভেতরে নিয়ে যাও।'

আজিজ সাহেব খুব বেশি ক্ষেপে আছেন। শঙ্কিত হয়ে আসমা দ্রুত ধারাকে ধরে রুমে নিয়ে যেতে চায়। ধারা যেতে চায় না। সে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, 'না বাবা। আপনি এটা করতে পারেন না। আমি শুদ্ধ'র কাছেই থাকতে চাই। আমি তাকে ছাড়বো না। কোনদিনও ছাড়বো না।'

আজিজ সাহেব ভ্রুকুটি করে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। ধারাকে ভেতরে নিয়ে গেলে শাহেদ এসে ভাইকে বলে, 'ভাইজান, ধারাকে নিয়ে এতো মাথা 
ঘামাবেন। বাচ্চা মানুষ তো৷ আবেগী হয়ে পড়েছে। একটু সময় গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। আমরা যা ঠিক করেছি আপনি সেদিকে মনোযোগ দেন। ধারাকে এখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঐ ছেলেকে ডিভোর্স দেওয়াতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব এই ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে পারলেই হলো।'

আজিজ সাহেব আর কোন জবাব দেন না। একবার শাহেদের দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি গটগটিয়ে রুমে চলে যান।

রুমে বসে ধারা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। জীবনের সমস্যাগুলো যেন কমার নামই নিচ্ছে না। একের পর এক জট লেগেই যাচ্ছে, লেগেই যাচ্ছে। ধারা অসহায় বোধ করে। শুদ্ধ'র কথা খুব বেশি মনে হতে থাকে তার। ঠিক তখনই তার ফোনটা বেঁজে উঠে। সে উঠায় না। বারবার বাজতেই থাকে৷ শেষমেশ বিরক্ত হয়ে নাম না দেখেই কানে তুলে বলে, 'হ্যালো!'

ওপাশ থেকে একটা স্পষ্ট ভরাট গলায় কেউ বলে উঠে, 'ধারা!'
একমুহূর্তের জন্য ধারা থমকে যায়। মন প্রাণ জুড়ে এক শীতল শিহরণ বয়ে যায়। সেই চেনা ডাক! আজ কতদিন পর ধারা শুনতে পেলো শুদ্ধ'র সুমিষ্ট সুস্পষ্ট কন্ঠস্বর। ধারা চোখ বন্ধ করে ফেলে। আত্মায় পানি ফিরে আসে তার। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। শুদ্ধ আবারো ডেকে উঠে, 'ধারা, শুনছেন?'

আর সময় নষ্ট না করে ধারা চটজলদি বলতে থাকে, 'শুদ্ধ....শুদ্ধ, প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন। আমি আর কখনোই এমন করবো না। আমার উপর আর রাগ করে থাকবেন না। আমাকে ক্ষমা করে দিন।'

শুদ্ধ ধারাকে থামিয়ে বলল, 'কিসের জন্য ক্ষমা চাইছেন আপনি?' 
'ঐ পরীক্ষার ব্যাপারটার জন্য....
শুদ্ধ আবেগ্লাপুত থেকেই মৃদু হেসে বলল, 
'আপনি এখনও ঐ ব্যাপারেই পড়ে আছেন! যেখানে এতো বিরাট কিছু হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে এতো বড় একটা সত্য বেড়িয়ে এসেছে....
শুদ্ধ'র কথার মাঝেই ধারা বলে উঠলো, 'ঐ সবে আমার কিছু যায় আসে না।'
শুদ্ধ একটু নাক টেনে আবারো হাসলো। বলল,
'আপনি আজকে আমাকে অবাক করে দিয়েছেন ধারা। আপনি আজ আপনার বাবার সামনে যা বললেন।'
শুদ্ধ একটু থামে। ধারা অবাক হয়৷ শুদ্ধ কিভাবে জানলো? ধারার মনের ভাব বুঝতে পেরে শুদ্ধ বলে, 'আমি শুনেছি। সবটাই শুনেছি। আমি তখন আপনাদের বাড়ির ফোনে অন স্পিকারে ছিলা। আপনি আজকে যা বললেন, আপনি শিওর তো?'
'হুম।'
'সত্যি?'
'এর থেকে বেশি শিওর আমি আমার জীবনে আর কখনো হইনি।'
'এই কথা জানাজানি হলে আপনাকেও অনেক কথা শুনতে হবে। পারবেন তো ধারা আমার সাথে থাকতে?'
ধারা ক্ষণবিলম্ব না করেই বলল, 'পারবো।'
'ভেবে চিন্তে দেখবেন ধারা। এতো তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই।'
'ভাবাভাবির আর কোন প্রশ্নই উঠে না। আমার মন কি চায় আমি জানি।'
শুদ্ধ'র ঠোঁটের কোনায় তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। সে নরম কণ্ঠে বলে, 'এতো কনফিডেন্ট!'
ধারা বলে, 'আপনিই তো বলেছিলেন, নিজের উপর সবসময় বিশ্বাস রাখতে।'
শুদ্ধ কণ্ঠ স্বাভাবিক করে টেনে বলে, 'হুম! আমি আরও অনেক কিছু বলেছিলাম তা কি মনে আছে?
'কি?'
'এই যে, যাই হয়ে যাক সবসময় ঠিকমতো খাওয়া....

ওপাশ থেকে হঠাৎ শুদ্ধ'র কথা থেমে যায়। ধারা কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখে তার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। ধারা একটু বিরক্তির সাথে ফোনটা ঝাঁকি দেয়। বাড়িতে আবারো শাহেদ আর আজিজ সাহেবের জোরালো গলার আওয়াজ শোনা যায়। প্রসঙ্গ ঐ একই। শুদ্ধ'র থেকে ধারাকে ছাড়িয়ে নেওয়া। শুদ্ধ'র সাথে কথা বলে যা একটু মনটা হালকা হয়েছিল, বাবা চাচার সেই কথা শুনতে পেরে ধারা আবারো কাঁদতে থাকে। বালিশে মুখ গুঁজে অশ্রু লুকায়। সে রাতে আর ধারা খেতে আসে না। আসমা অনেক ডাকাডাকি করে। কিন্তু লাভ হয় না। ধারার সাথে ঘুমাতে জমিরন বিবিকে পাঠানো হয়। ধারার অবস্থা ভালো না। রুমে একা ঘুমোতে দেওয়া ঠিক হবে না। ধারাদের বাড়িটা পাকা দোতলা ধরণের। নিচ তলা পুরো কম্প্লিট হলেও দোতলায় শুধু ভেতরের টুকু ঠিক করা হয়েছে। বাইরের কাজ এখনো বাকি। বেলকনিতেও গ্রিল লাগানো হয়নি। সেই খোলা বারান্দায় অন্ধকারের মধ্যে বসে বসে ধারা আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদে। একটা সময় ছিল যখন ও বাড়িতে ধারার যেতে ইচ্ছে করেনি। বিয়ের আগের রাতটিতেও ঠিক এভাবেই বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদেছিল ধারা। তবুও ধারাকে যেতে হয়েছিল। আর এখন একটা সময় যখন ধারা ও বাড়িতে যাবার জন্যই কাঁদছে। আগে অচেনা যেই পুরুষটির কথা ভাবনায় এনে ধারা ভয় পেতো, আজ তার বিরহেই ধারা ব্যাকুল। তাকে একটি বার চোখের দেখা দেখার জন্যই তার মন উৎকণ্ঠিত। সময় কিভাবে পাল্টায়! ধারা ধীর পায়ে উঠে নিজের রুমের দিকে তাকায়। কতো সুন্দর পাকা ঘর, নজরকাড়া দেয়ালের রং, আরামদায়ক বিছানা, বিভিন্ন প্রসাধনী। তবুও ধারার মন টানছে সেই একছেয়ে টিনের বেষ্টন, কাঠের পাটাতন, সাধারণ বিছানা, আর সেই অসাধারণ মানুষটির প্রতি। তার নিজের চিরচেনা রুমটিই আজ তার বড় অচেনা ঠেকে। এই কক্ষে সব থেকেও নেই। বড্ড খালি। ভালোবাসা শুন্য। ধারার ইচ্ছা করে ছুটে এখান থেকে বেড়িয়ে পড়তে। 

জমিরন বিবি অনেকক্ষণ যাবৎ ধারার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ধারাকে এমন উদাস মনে রুমের দেয়ালে নজর বুলাতে দেখে তিনি খেঁকিয়ে উঠে বলেন, 'এই ছেমড়ি, ঘুমাইলে ঘুমা। নইলে বাত্তি নিভাইয়া বইয়া থাক। এই আলোতে আমার ঘুম আহে না।'

ধারা লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। পাশ ফিরে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করে৷ যাতে ঘুমন্ত দাদীর অসুবিধা না হয়। রাত গভীর হতে থাকে৷ একসময় ঘুমিয়ে যায় ধারা। মাঝ রাতে হঠাৎ একটা শক্ত হাত তার মুখ চেঁপে ধরে। ধারার ঘুম ভেঙে যায়। মুখ দিয়ে অস্ফুট আতর্নাদ করতে গিয়েও সে ব্যর্থ হয়। স্পষ্ট করে তাকিয়েও অন্ধকারে একটা মানুষের অস্পষ্ট অবয়ব ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
 

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#34
পর্ব ২৪



কিছু বুঝে উঠার আগেই ধারাকে টেনে বারান্দায় নিয়ে আসা হলো। অস্পষ্ট অবয়বটিতে চাঁদের আলো পড়তেই ধারা হতভম্ব হয়ে গেলো। সামনের মানুষটির মুখে সেই সুন্দর টোল পড়া হাসি ফুটে উঠতেই ধারা ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে। পৃথিবীর সবচাইতে প্রশান্তিময় জায়গাটিতে স্থান পেয়েই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো৷ শুদ্ধ আলতো করে ধারার মাথায় হাত রাখলো। কাঁদতে দিলো ধারাকে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা শুদ্ধকে ছেড়ে উদ্গ্রীব হয়ে বলে উঠলো,
'আপনি এখানে এতো রাতে কিভাবে এলেন?'
শুদ্ধ একবার মিথ্যা আফসোসের ভঙ্গি করে বারান্দার সিমেন্টের উঁচু বেদির সাথে হেলান দিয়ে বসে বলল,
'ভেবেছিলাম তো পাইপ বেঁয়ে উঠে একটা ঝাক্কাস হিরোর মতো এন্ট্রি নেবো। কিন্তু তা আর হলো কই! আমার শ্বশুড় মশাই যে আমার জন্য বাড়ির পেছনে একটা মই ফেলে রেখেছেন। শেষমেশ শ্বশুরবাড়ির কদর রাখার জন্য সেই মই বেঁয়েই চলে এলাম। আর এই যে ম্যাম, আপনি আপনার বেলকনির রুমের দরজা আটকিয়ে ঘুমান না কেন? বুঝলাম আজকে আমি এসেছি। কিন্তু রোজ রোজ তো আর শুধু জামাই আসবে না। মাঝে মধ্যে চোরও চলে আসতে পারে।'

ধারা অপলক তাকিয়ে রইলো শুদ্ধ'র দিকে। আজ কতদিন পর তারা এভাবে স্বাভাবিক হয়ে কথাবার্তা বলছে মনে করার চেষ্টা করলো। ধারা খুব ভালো মতোই জানে শুদ্ধ তার মনের ভার কমানোর জন্যই এমন মজা করে কথা বলছে। নয়তো শুদ্ধ'র মনেও যে কতোটা দুশ্চিন্তার বন্যা বইছে তা আন্দাজ করা খুব একটা কঠিন না। শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে ধারা আবেগ্লাপুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ ধারার হাত টেনে নিজের সামনে বসাতে বসাতে বলল,
'বসুন এখানে। কি অবস্থা করেছেন নিজের চেহারার! এতো কাঁদতে হয়?'
এই বলে শুদ্ধ ধারার চোখের পানি মুছে দিলো। তারপর বলল, 'নিশ্চয়ই কিছু খাননি! আর আমিও তো কথাটা তখন ফোনে শেষই করতে পারলাম না। তখনই বুঝেছি আজকে আর আপনার খাওয়া হয়েছে! সকালেও যেমন তেমন খেয়েছেন। দুপুরের আশা তো ছেড়েই দিলাম। আরবএখন রাতেও না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। আপনাকে নিয়ে কি যে করি না ধারা!'

শুদ্ধ হাতের ব্যাগটা থেকে একটা বাটার নান বের করলো। নিজের হাতে ধারার মুখের দিকে বাড়িয়ে ধরলো। ধারা শুদ্ধ'র চোখে চোখ রেখেই একটা কামড় বসালো নানে। তার চোখে আবারও পানি চলে এলো। শুদ্ধ খুব যত্ন করে ধারাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। হঠাৎ ধারা শুদ্ধ'র একটা হাত ধরে বলল,
'আপনি আমার উপর আর রাগ করে নেই তো?'

শুদ্ধ মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,
'না। আপনি আজ এতোই বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছেন যে আপনার পূর্বের দূর্বলতার কথাগুলো আর মনে পড়ছে না।'
তারপর ধারার ধরে রাখা হাতটা শুদ্ধ তার দু হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, 'জানেন ধারা, আজকে আমি আপনার থেকেও একটা জিনিস শিখেছি। যে, আমাদের কখনো আশা হারাতে নেই। যেটা আমি আপনার ক্ষেত্রে করেছিলাম। এই কথাটা আজকে আপনি প্রমাণ করেছেন। আমিও কিছুদিন আগেই আম্মার থেকে এই সত্যিটা জেনেছিলাম৷ বলাবাহুল্য আমিও ভেতর থেকে খুব নড়ে গিয়েছিলাম৷ কিন্তু আপনি আজ যেই কথাগুলো আপনার বাবাকে বলেছেন সেই কথাগুলো আজ আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে। ধন্যবাদ ধারা। ধন্যবাদ!'

'আপনি যদি এতটুকুর জন্যই বারবার এভাবে ধন্যবাদ জানান তাহলে আমি কি করবো? আমার তো তাহলে ধন্যবাদ বলতে বলতে মুখে ফেনা উঠে যাবে। কারণ আপনি আমার জন্য যা যা করেছেন!'

শুদ্ধ হেসে ফেললো। সাথে ধারাও। তার চোখে এখনও পানি চিকচিক করছে আর ঠোঁটে হাসি। কিছুক্ষণ এভাবেই কাটার পর শুদ্ধ বলল,
'ধারা, এমন কিন্তু আর কখনো করবেন না। সময় মতো খাওয়া দাওয়া করবেন। নিজের ঠিকমতো খেয়াল রাখবেন। খাওয়া ছেড়ে দেওয়া কখনো কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। যদি হতো তাহলে পৃথিবীর সব মানুষই ছেড়ে দিতো৷ কিন্তু আসল ব্যাপারটা কি জানেন? খাবার খাওয়াও আমাদের জন্য এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষের জীবনের বেশিরভাগ সমস্যাই মুখে এই খাবার জোটানোর চক্করেই সৃষ্টি হয়। এখন আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি যেখানে সবকিছুই এতো হুটহাট হচ্ছে যে সবার জন্যই এতোকিছু মেনে নেওয়া কষ্টকর। আমাদের সবাইকে একটু সময় দেওয়া উচিত। সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি আমরা ঠিক থাকি।'

ঐ প্রসঙ্গ উঠতেই ধারার মন আবারো খারাপ হয়ে গেলো। তা লক্ষ করে শুদ্ধ নিজের স্বাভাবিক গলায় বলল, 'এই যে মিসেস ধারা, আপনি যেন আমাকে একদিন কি বলেছিলেন আপনার খেয়াল আছে?'
ধারা অবাক হয়ে মাথা তুলে বলল, 'কি?'
'এই যে আপনি কোনদিন আমার প্রেমে পড়বেন না। কতো জোর গলায় বলেছিলেন মনে আছে? আপনি আপনার কথা রাখবেনই রাখবেন। শেষমেশ এটা কি হলো ধারা? আপনি তো আপনার কথা রাখতে পারলেন না!'
ধারা লাজুক হাসি দিয়ে অন্যদিকে তাকালো। শুদ্ধ বলল, 'কথা না রাখাটা আমি একদম পছন্দ করি না। আর আপনি সেই কাজটাই করলেন। এখন কিন্তু এর জন্য আপনাকে পানিশমেন্ট পেতে হবে।'

ধারা সরু চোখে তাকিয়ে বলল, 'আচ্ছা তাই! কি এর পানিশমেন্ট?' 

শুদ্ধ তার টোল পড়া গালটি ধারার মুখের সামনে এগিয়ে দিলো। আঙ্গুল দিয়ে গালে দুটো টোকা দিয়ে ইশারা করে ঠোঁট চেঁপে দুষ্ট হাসি হাসতে লাগলো। ধারা ভীষণ লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। হৃদস্পন্দন বহু গুণে বেড়ে গেলো তার। আরেকবার চোখ তুলে তাকালো সামনে। শুদ্ধ'র সেই টোল পড়া গাল! ধারার বহুদিনের আকর্ষণ। ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো তার গালদুটো।
ওদিকে শুদ্ধ তাড়া দেবার গলায় বলে উঠলো,
'তাড়াতাড়ি! যতো দেরি করবেন পানিশমেন্ট কিন্তু তত দ্বিগুণ হবে।'
রক্তিম মুখে ধারা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। শুদ্ধ'র আরেকটু কাছে আসতেই মুখের হাসি প্রসারিত হলো শুদ্ধ'র। নিজেকে শুদ্ধ'র আরো একটু কাছে এগিয়ে নিতেই লজ্জায় হেসে ফেলে ধারা এক দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে এলো। শুদ্ধ পেছন থেকে 'আরে!' বলে উঠে ধারাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েও পারলো না। ধারার পাতলা ওড়নাটা তার হাতের তালুতে এসেও চলে গেলো নাগালের বাইরে। 
__________________________________________

আজিজ সাহেব এবং শাহেদ দুজনে ড্রয়িং রুমে বসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করছেন। এতো দিনেও তারা ধারাকে রাজী করাতে পারেনি। এটাই তাদের আলোচনার মুখ্য বিষয়। রাতুল কলেজে গেছে। আসমা আর জমিরন বিবি বসে আছে রান্নাঘরে। ঠিক তখনই বাইরে থেকে ধারা ঘরে ঢুকলো। তার কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো। আজিজ সাহেব ভ্রু কুঞ্চিত করলেন ধারাকে দেখে। ধারা যে এতক্ষণ বাড়িতে ছিল না সেটাই তো জানতো না সে। তাই ধারাকে থামিয়ে বলল,
'কোথায় গিয়েছিলে?'
ধারা দাঁড়িয়ে পরে বিনীতভাবে বলল,
'আমি ভর্তি হতে গিয়েছিলাম বাবা।'
'ভর্তি হতে গিয়েছিলে মানে? কোথায় ভর্তি হতে গিয়েছিলে?'
'কলেজে। অনার্সের জন্য এপ্লাই করে আসলাম। সাবজেক্ট হিসেবে বাংলা নিয়েছি।'
শাহেদ চোখ কপালে তুলে দাঁড়িয়ে বলল,
'বাংলা নিয়েছিস মানে? তোর মাথা ঠিক আছে? তুই আমাদেরকে না জিজ্ঞেস করে এপ্লাই করতে গেলি কেন? আর করেছিসই যখন সাইন্সের কোন সাবজেক্ট নিলি না কেন?'
ধারা বিনয়ের সাথে উত্তর দিলো,
'আমি যখন বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম তখন আপনারা কেউ বাসায় ছিলেন না কাকা। আজকেই এপ্লাইয়ের লাস্ট ডেট ছিল। তাই আমাকে যেতে হয়েছে৷'
আজিজ সাহেব গম্ভীরমুখে বললেন,
'বাংলা নিলে কেন?'
'সাইন্স পড়তে আমার ভালো লাগে না বাবা। যেটা পড়তে আমার ভালো লাগে না সেটা নিয়ে পড়ে আমি ভালো কিছু করতে পারতাম না। তাই যেটা ভালো লাগে সেটা নিয়েছি।'
'দুনিয়া তোমার ভালো লাগা দিয়ে চলবে না। চলবে সেটা দিয়েই যেটা বেস্ট।' 
'সাবজেক্ট কখনো বেস্ট হয় না। বেস্ট হয় মানুষের চেষ্টা। একটা মানুষের চেষ্টা আর অধ্যাবসায়ই একটা সাবজেক্টের মধ্য দিয়ে তার সফলতা নিয়ে আসে।'
শাহেদ বলল, 'এইসব হাবিজাবি কথা তোকে কে বলেছে? এইসব বইয়ের পাতাতেই মানায়। আসল জীবনে এমন কিছু হয় না। প্রাক্টিকেল হও।'
'শুদ্ধ বলেছে কাকা। আর যেখানে কথা প্রাক্টিকেল হবার, আসল জীবনে আমরা যদি প্রয়োগ করি তাহলেই হবে।'
আজিজ সাহেব বললেন, 'ঐ ছেলেই তোমার মাথা নষ্ট করেছে। পাগল হয়ে গেছো তুমি! তোমাকে ঐ ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়াই আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ছিল।'
ধারা স্মিত হেসে বলল, 'এর জন্য আপনার কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো বাবা। আপনার এই ভুলটি আমার জীবন সাজিয়ে দিয়েছে।'

এই বলে ধারা সেখান থেকে চলে এলো। আজিজ সাহেব কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। শাহেদ থামিয়ে বলল, 'বাদ দেন ভাইজান, এখন এর থেকেও বড় সমস্যা আমাদের মাথার উপরে আছে। আগে সেটাতে মনোযোগ দিতে হবে। ধারাকে যে করেই হোক ঐ ছেলের থেকে আলাদা করতে হবে। দেখেছেন তো সঙ্গদোষে কতোটা অধঃপতন হয়েছে আমাদের ধারার। এখন সবথেকে জরুরী কি জানেন? এভাবেই ওদের দুজনকে দেখা করতে দেওয়া যাবে না। কয়েকদিন দূরে দূরে থাকলেই ধারার মাথা থেকে ঐ শুদ্ধ নামের ভূত নেমে যাবে। তারপর ঠিকমতো বোঝালেই আমাদের ধারা ঠিক বুঝে যাবে। এরপর তাই করবে যা আমরা করতে বলবো।'
আজিজ সাহেব কিছু বললেন না। কপালে ভাঁজ ফেলে কিছু একটা ভাবতে লাগলোন।

ধারা রুমে এলে আসমাও তার পেছন পেছন চলে এলো। ধারাকে বিছানায় বসিয়ে বলল,
'ধারা, এসব কি হচ্ছে আমাকে বুঝিয়ে বলতো।'
ধারা বলল, 'মা, যেই সাবজেক্ট আমি ঠিকমতো বুঝি না সেটা নিয়ে আমি কিভাবে পড়বো বলো তো!'

'আমি সাবজেক্টের কথা বলছি না। তোর সিদ্ধান্তের কথা বলছি। তুই যে তোর বাপ চাচার বিরুদ্ধে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতাছোস তুই জানোস তো তুই কি করতে যাইতাছোস?' 

ধারা মায়ের হাত ধরে বলল, 'জানি মা। খুব ভালো করেই জানি। মা, শুদ্ধ অনেক ভালো মানুষ। তার মতো মানুষ শুধু আমি কি, আমি নিশ্চিত তুমিও তোমার জীবনে কোনদিন দেখোনি। সে আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার অনেক যত্ন করে। আজ পর্যন্ত উনি আমার জন্য কি কি করেছে তুমি ভাবতেও পারবে না মা। তার কাছে আমি অনেক ভালো থাকবো৷ তার মতো ভালো আমাকে কেউ রাখতে পারবে না।'

আসমা অনেককিছু বলবেন বলে ভেবে এসেছিলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। শুদ্ধ'র কথা বলার সময় ধারার মনে যে খুশি, আনন্দের ঝলক ফুটে উঠছিলো, এতোটা খুশি সে তার মেয়েকে আজ পর্যন্ত কখনও দেখেননি। একটা মায়ের এর চাইতে বেশি আর কি চাই! ধারা শুদ্ধকে নিয়ে আরও অনেক কিছু বলে যেতে লাগলো তার মাকে। আসমা শুধু নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন মেয়ের মুখের দিকে। তার চোখে পানি চলে এলো। আর কিছু বললেন না। শুধু দোয়া করলেন তার মেয়ে যেটাতে সুখী হবে সেটাই যেন হয়।
__________________________________________

রাত অনেক হয়েছে। ধারা এখনো জেগে আছে। বসে বসে শুধু বারবার বারান্দার দরজায় চোখ বুলাচ্ছে। রোজ রাতেই শুদ্ধ আসে। এই রাতের বেলাতেই শুধু সবার চোখের আড়ালে দেখা হয় তাদের। নয়তো পুরো দিনেই চলতে থাকে নিরবিচ্ছিন্ন দূরত্ব। এই রাত হওয়ার জন্যই তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ধারা। জমিরন বিবি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই৷ ধারা একবার সেদিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এভাবে বেশিক্ষণ লাইট জ্বালিয়ে বসে থাকলে দাদীর ঘুম ভেঙে যেতে পারে। ধারা লাইট বন্ধ করে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। হঠাৎ তার চোখ আবারো বারান্দার দরজায় পড়লো। দরজা খোলা। শুদ্ধ অনেকবার ধারাকে নিষেধ করেছে এভাবে দরজা খোলা রেখে না ঘুমাতে। সে আসলে ফোনে মেসেজ করবে। ধারা সে কথা রাখতেই দরজা বন্ধ করে দিল। ছিটকিনিটা লাগাতেই হঠাৎ পেছন থেকে জমিরন বিবি বলে উঠলো,
'কিরে! আজকে দরজা লাগায় রাখতাছোস কেন? তোর ভাতারে আজকে দেহা করতে আইবো না?'

দাদীর গলা শুনে ধারা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। মুহুর্তেই আত্মা শুকিয়ে এলো তার। দাদী দেখি সব জেনে ফেলেছে। এখন কি হবে?

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#35
পর্ব -২৫




পেছন থেকে দাদীর গলা শুনে ধারার চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠলো। দাদীকে ধারা খুব ভালো মতোই চিনে। না যেন এখনই চেচাঁমেচি করে সবাইকে জানিয়ে দেয়! ধারা একটা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো। জমিরন বিবির মুখের ভাব বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু এর পরেই ধারাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ করে জমিরন বিবি হেসে উঠে বললেন, 'কিরে ছেড়ি! সোয়ামীর লগেই তো দেহা করোছ কোন নাগরের লগে তো আর না! এতো ডরানির কি আছে?'

দাদীর হাসি শুনে ধারা ঝট করে মাথা তুলে তাকালো। তার দাদী হাসছে! সত্যি? 
জমিরন বিবি হাসি থামিয়ে বললেন, 'হোন ছেমড়ি, সাবধানে থাকিস। তোর বাপ চাচায় যা শুরু করছে! দেইখা ফেললে কিন্তু মেলা ঝামেলা করবো। একটা কথা মনে রাখবি, বিয়ার পর কিন্তু মাইয়া গো স্বামীই সব। স্বামী ভালা হোক খারাপ হোক হের লগেই থাকতে হইবো। ঐ বাড়িই এহন তোর বাড়ি। এইয়া সব পর। আমার পোলাগুলার মাথার তার ছিড়া গেছে। বেশি পইড়া বেশি বুঝা শিখখা গেছে। ওগো লইয়া ভাববি না। স্বামী যা কইবো তাই করবি। বুঝছোস?'

ধারা খুশির সাথে ছলছল চোখে মাথা দুলিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরলো। দাদী তার পক্ষে থাকবে এটা ধারা কখনো আশা করেনি। জমিরন বিবিরও প্রথম থেকেই তার দুই ছেলের সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি। তিনি আগেকার দিনের মানুষ। তালাক শব্দের সাথে ততোটা অভ্যস্ত নন। তার নাতনী স্বামী বাড়ি ছেড়ে আসবে তারপর তাদের তালাক হবে ভাবতেই রুহু কেঁপে উঠে জমিরনের। তিনি বিশ্বাস করেন বিয়ের পর মেয়েদের স্বামী বাড়িই সব। যাই হয়ে যাক তাদের সেখানেই থাকা উচিত। তাই নিজের নাতনীর সংসার বাঁচাতে মনে প্রাণে চান ধারা আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাক। আবার সব ঠিক হোক। তাই বলেই তো মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে ধারা শুদ্ধ'র গোপন সাক্ষাৎ সম্পর্কে অবগত হয়েও তিনি কাউকে কিছু বলেননি। 

ধারা দাদীকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। কিছুক্ষণ পর জমিরন বিবি বললেন, 'ছাড় ছেমড়ি, এতো জোরে ধরছোস কে? মাইরা লাইবি নাকি! এতো কান্দন লাগবো না এহন। ঘুমায় থাক। নইলে তোর ভাতারে আইলে তার লগে পিরিতি আলাপ করবি কেমনে?'
ধারা চোখের পানি মুছে দাদীকে ছেড়ে হেসে ফেললো। জমিরন বিবি বললেন,
'তোমরা কি মনে করছো? বুড়া মানুষ দেইখা
রাইতের আন্ধারে কি হয় আমি কিছু টের পাই না। এই চুল কি পাকছে বাতাসে?'
ধারা লজ্জা পেলো। জমিরন বিবি বললেন,
'হইছে আর শরম পাইতে হইবো না। এমন দিন আমাগোও গেছে।'
এরপর তিনি মাথায় ঘোমটা টেনে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ করার আগে বললেন,
'আর একটা কথা, তোর সোয়ামী রাতের বেলা খালি হাতেই হউরবাড়ি আইয়া পড়ে কেন? জানে না হের একটা দাদী হাউড়িও আছে। হেরে কবি আমার লেইগা মিডা পান নিয়া আইতে। জমিরন বিবিরে খালি হাতে পডানি যাইবো না।'

এই বলে দাদী চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। খুশির সাথে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ধারা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো।
__________________________________________

সকাল বেলা তালুকদার বাড়ির সবাই একসাথেই টেবিলে খেতে বসলো। ধারার মন ভীষণ চঞ্চল হয়ে আছে। আজ শাহেদ বাড়িতে থাকবে না। তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে। এদিকে আজিজ সাহেবও কি একটা কাজে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকবেন। এই সুযোগে ধারা আজ শুদ্ধ'র সাথে দেখা করবে। ঘুরতে যাবে তারা দুজন। হাতে তো সারাটা দিন আছেই৷ আসমাকে ধারা বলে রেখেছে। জমিরন বিবিও জানেন। অতএব তেমন কোন সমস্যা হবে না। এখন শুধু সময় যাওয়ার অপেক্ষা। কখন সবাই ঘর থেকে বেড়োবে! শাহেদ আর আজিজ খাওয়া বাদ দিয়ে জমিয়ে আলোচনায় নেমেছে। সামনের নির্বাচনই মূল প্রসঙ্গ। হঠাৎ তারা কথায় কথায় ধারার বিয়ের প্রসঙ্গে চলে এলো। তারপর তাদেরকে আলাদা করা নিয়ে। ধারার ভেতরে যেই খুশিটা ছিল তা নিমেষেই মিলিয়ে গেলো। শাহেদ শুদ্ধ'র ব্যাপারে যা না তা বলতে লাগলো। ধারার গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইলো না। ইচ্ছা করলো সব বাদ দিয়ে এক ছুট কাঁদতে। এতো ভালো মানুষটা! তবুও তাকে নিয়ে রোজ কতো খারাপ কথা শুনতে হয় ধারাকে। ধারার ভীষণ কষ্ট লাগে। ওদেরকে আলাদা করা নিয়ে খোলামেলা এমন কঠিন কঠিন কথা হতে লাগলো যা ধারার পক্ষে শোনা খুবই কষ্টকর। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগলো। আজিজ সাহেব তা দেখে বললেন, 
'এসব কান্নাকাটি করে লাভ নেই। তুমি তাই করবে যা আমি বলবো।'

ধারা কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই আসমা টেবিলের নিচ দিয়ে ধারার হাত ধরে থামিয়ে দিলো। আজিজ সাহেব আর শাহেদ চলে গেলে ধারা খাওয়া বাদ দিয়ে উঠতে গিয়েও উঠলো না। কান্না সমেত খেতে লাগলো। শুদ্ধ বলেছে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে। শুদ্ধ'র কথা সে ফেলবে না।
__________________________________________

দিনটা সুন্দর। মেঘলাটে ভাব। আকাশ পরিষ্কার হলেও রোদের তেজ নেই। মৃদুমন্দ বাতাস মন ফুরফুরে করে রাখে। শুদ্ধ অনেকক্ষণ ধরে স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তাটিতে বাইক নিয়ে ধারার জন্য অপেক্ষা করছে৷ তার গায়ে হাতা ফোল্ড করে পড়া ব্রাউন কালারের একটা চেক শার্ট। এবং হোয়াইট জিন্স। হাতে একটা সাধারণ কালো বেল্টের ঘড়ি। বাইকটা তার নয়। আজকের সারা দিনের জন্য এক বন্ধুর থেকে ম্যানেজ করেছে। রাস্তাটা নির্জন। তেমন কারো চলাফেরা নেই। মাঝে মধ্যে এক দুটো যান বাহন চলাচল করছে৷ খানিক পর ধারা এলো। ধারাকে দেখে শুদ্ধ হাসিমুখে কিছু বলার আগেই হঠাৎ তাকে আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠলো ধারা। শুদ্ধ অবাক হলো৷ ধারার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, 'কি হয়েছে ধারা? আপনি কাঁদছেন কেন?'
ধারা কাঁদতে কাঁদতে বলল, 'আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যেতে চাই না শুদ্ধ। আমাকে তোমার সাথেই নিয়ে চলো। যতো সময়ই যাক না কেন? কিচ্ছু ঠিক হবার না। আমি আমার বাড়ির লোকদের চিনি। আমার আর ভালো লাগছে না।'

শুদ্ধ ধারার মাথা তুলে কপালের সামনে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে বলল, 'ধারা, এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আমি একবার বলেছি না সব ঠিক হয়ে যাবে যদি আমরা ঠিক থাকি। হার মেনে নিলে কি করে হবে?'

'কিন্তু শুদ্ধ, আমরা তো স্বামী স্ত্রীই না? আমরা যদি একসাথে থাকতে চাই তাহলে আমার পরিবারের নিষেধ আমাদের মানতে হবে কেন?'

'সেটাই তো ধারা। আমরা স্বামী স্ত্রী। এখন যদি আপনার ও বাড়ি থেকে চলে আসতে হয় তাহলে আসতে হবে লুকিয়ে৷ আমাদের একটা হালাল সম্পর্ক। আমরা কেন লুকিয়ে পালিয়ে আসবো? সমস্যা থেকে ভাগলে সেটা কখনোই ঠিক হবে না। সারাজীবন এর বোঝা টেনে যেতে হবে। তাই না ভেগে সমস্যার সামনাসামনি হয়ে তার সমাধান করতে হবে। আর আমরা যদি এখন এমন একটা স্টেপ নেইও তাহলে আপনার পরিবার হয়তো আপনার সাথে কোনদিন আর যোগাযোগও রাখবে না। আমার মূল ভয়টা এদিকেই।'

ধারা কেঁদে বলল, 'না রাখলে না রাখুক। আমার দরকার নেই।'

শুদ্ধ ব্যগ্র দিয়ে বলল, 'এটা কেমন কথা ধারা! আপনাকে আমি পরিবারের সামনে নিজের মতটা প্রকাশ করতে বলেছি। তাদের বিরোধিতা করতে তো বলেনি। বাবা মা আমাদের জন্য অনেক ইম্পর্টেন্ট। তাদের মনে কখনো কষ্ট দিবেন না। যাই হোক না কেন, সেটা আপনার পরিবার। আপনি এই পর্যন্ত বড় হয়েছেন তাদের জন্যই। একটা পূর্ণাঙ্গ পরিবার পাওয়াও অনেক ভাগ্যের ব্যাপার ধারা। এভাবে তাকে হেলাফেলা করবেন না। তাদেরকে আপনার পয়েন্ট অফ ভিউটা বোঝান। একবার ব্যর্থ হলে আরেকবার বোঝান। বারবার বোঝান। তবুও তাদেরকে রাজী করিয়ে তারপর আসুন। আমি চাই না আমার কারণে আপনার পরিবারের সাথে আপনার সম্পর্ক খারাপ হোক৷ আপনি পারবেন না ধারা?'

ধারা অপলক শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে রইলো। তার বাড়ির লোক শুদ্ধকে শত অপছন্দ করলেও শুদ্ধ কতোটা শ্রদ্ধার সাথে তাদের নিয়ে কথা বলছে। তাদেরকে সমর্থন করছে। শুদ্ধ তো শুদ্ধই। ধারা তো বুঝে। না জানি তার পরিবার কবে বুঝবে! কবে শুদ্ধ'র জন্ম পরিচয়ের চাইতে তার ব্যক্তিত্বটা তাদের কাছে বড় হবে! ধারা আলতো করে মাথা দুলিয়ে বলল সে পারবে। শুদ্ধ মৃদু হেসে বলল,
'আপনি অযথাই এতো ভয় পাচ্ছেন। আপনি যদি না চান তাহলে আপনাকে কিভাবে আমার থেকে আলাদা করবে? আইনের নিয়মকানুন বলেও তো একটা কথা আছে৷ নাকি আপনি আবার ততোদিনে আমাকে না চাইবেন।'

শেষের কথাটা শুদ্ধ মজা করে বলেছিল৷ ধারা চোখের পানি মুছতে মুছতে কপট রাগ নিয়ে শুদ্ধ'র গায়ে মৃদু বারি দিয়ে বলল,
'তোমার মনে হয় আমি এমনটা করবো!'

শুদ্ধ ঠোঁট চেঁপে হেসে বলল, 'মনে তো অনেক কিছুই হয়৷ কিন্তু সব তো আর বলতে পারি না। বাই দা ওয়ে, আপনি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? আজকে আপনি আসার পর থেকে আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন।'

ধারা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ঘুরে বলল, 
'ইশ! মোটেও না।'
শুদ্ধ ধারার সামনে এসে বলল, 'মোটেও না মানে! এই মাত্রই তো আবার বললেন। সোজা সাপ্টা বললেই হয়, আপনার মধ্যে আজকাল বউ বউ ফিলটা খুব ভালো করেই জাগছে। সমস্যা নেই, আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।'

'তাহলে আপনি আমাকে আপনি আপনি করেন কেন?'

'সেটা তো বলি আপনি বলেন বলে। ইকুয়ালিটি!'

'আমি বললেই আপনাকে বলতে হবে! অনেক ওয়াইফরা তো হাজবেন্ডদের 'আপনি' করে বলেই। এর জন্য কি হাজবেন্ডরাও 'আপনি' বলে? এমন ভাবে আপনি আপনি করতে থাকেন যেন মনে হয় আপনি নিজের বউয়ের সাথে না কোন অ্যান্টির সাথে কথা বলছেন।'

ধারার ভোতা মুখের কথা শুনে শুদ্ধ'র খুব হাসি পেলো। সে মুচকি হেসে বলল,
'আমার তো সেটাই মনে হয়।'

ধারা আকাশ থেকে টপকে পড়ার মতো করে বলল, 'সেটাই মনে হয় মানে? আমি অ্যান্টির মতো? একটা ঊনিশ বছরের মেয়েকে আপনার অ্যান্টির মতো মনে হয়? এটা আপনি বলতে পারলেন!'

কপট রাগ দেখিয়ে ধারা শুদ্ধ'র থেকে মুখ ঘুরিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ পেছন থেকে ধারার কানের কাছে মুখ নিয়ে মুচকি হেসে বলল, 'আচ্ছা সরি! ভুল বলেছি। আপনাকে অ্যান্টির মতো লাগে না। বউয়ের মতোই লাগে। আর এখন থেকে আমি আমার বউয়ের মতো করেই কথা বলবো। সহ্য করতে পারবে তো?'

লজ্জায় ধারার গালদুটো লাল হয়ে এলো। সে দ্রুত কথা কাটিয়ে ঘুরে বলল, 'এখন সারাদিন কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন? আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন না?'

এই বলে ধারা বাইকের কাছে এসে দাঁড়ালো। শুদ্ধ বাইকে উঠতে উঠতে অলস ভঙ্গিতে বলল,
'বাহ! ভালো সুবিচার করলে। আমাকে প্রথমে রাজী করিয়ে এখন নিজেই পাল্টি মেরে নিলে। এখনও 'আপনি!'

ধারা পেছনে বসতে বসতে রক্তিম মুখে খুবই সময় নিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, 'আস্তে চালিয়ো।'

শুদ্ধ একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে জোরে বাইক স্টার্ট দিলো। মাঝে যতোটুকুও বা দূরত্ব ছিল সবটা পূরণ হয়ে ধারা একদম আকস্মিক শুদ্ধ'র গায়ে লেপ্টে পড়লো। কপালে হাত দিয়ে ভাবলো, এই ছেলে এখনই যা শুরু করেছে। এখনও তো সারাটা দিনই বাকি। না জানি তখন কি করে!

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#36
ek ratei purota porlam, ek kothay onoboddo
[+] 1 user Likes sahid77777's post
Like Reply
#37
(14-07-2024, 04:35 AM)sahid77777 Wrote: ek ratei purota porlam, ek kothay onoboddo

আর এগোবে  না গল্প?
[+] 1 user Likes Sonalirkotha's post
Like Reply
#38
(02-08-2024, 01:31 AM)Sonalirkotha Wrote: আর এগোবে  না গল্প?


আগাবে এবং শেষ পর্যন্ত যাবে।
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#39
 পর্ব-২৬
 

পথ যেন শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলছে বাইক। পথের ধারের বৃক্ষরাজির দলকে একের পর এক পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলছে তারা। নতুন পিচ ঢালা প্রশস্ত রাস্তা। নির্জন। কোলাহল মুক্ত। সমানে শিহরিত করা হাওয়াও যেন আনন্দের সাথে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাদের। ধারার ভীষণ ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে এই পথ আর না ফুরাক। পৃথিবীর স্থলভূমিকে কেন্দ্র করে তারা অনন্ত কাল এভাবেই ঘুরতে থাকুক। উদ্দেশ্যহীন। দল ছাড়া পাখির মতো। নেই কোন চিন্তা। নেই কোন খোঁজ। সামনের মানুষটির কাঁধে হাত রেখে ধারা একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। শুদ্ধ'র গায়ের সুগন্ধি পারফিউমের ঘ্রাণ তার নাকে লাগছে। মাথা নিচু করে ধারা হেসে ফেললো। কখনো কি সে ভেবেছিল এভাবে কোনদিন একটা ছেলের সাথে তার বাইকে ঘোরা হবে! তার একঘেয়েমি, পানসে জীবনে কখনো কি এমন প্রেমময় ভাবনায় সে বিভোর হয়েছিল? অথচ আজ তাই হচ্ছে। স্বপ্নের মতো, কিন্তু স্বপ্ন নয়। সত্যি। পৃথিবীর দৃশ্যমান চন্দ্র, সূর্যের মতোই সত্যি।

শুদ্ধ বাইকের মিররে একবার ধারার দিকে তাকালো। ধারার গায়ে গাড় নীল রঙের একটা থ্রি পিছ। চুলগুলো খোলা। মুখে অতিরঞ্জন কোন প্রসাধনী নেই। হয়তো চোখে হালকা কাজল লাগিয়েছিল। চোখের পানিতে তাও ধুয়ে মুছে গেছে। তবুও তাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। ঘন কালো পল্লববিশিষ্ট চোখ জোড়া নিচে নামানো। ফর্সা গালদুটোয় কেমন যেন লাল আভা ছড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই কিছু ভেবে লজ্জা পাচ্ছে৷ মেয়েটা এতো লাজুক! শুদ্ধ'র চোখ ফেরাতে মন চায় না। তবুও ফেরাতে হয়। সামনে পথ যে বাকি।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই বাইকে ব্রেক কষলো শুদ্ধ। ধারা খানিক অবাক হয়ে বলল,
'এখানেই নামবো।'
শুদ্ধ বাইক থেকে নামতে নামতে বলল,
'হুম।'
ধারা নামলো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো জায়গাটা সুন্দর। দু ধারে সারি বেঁধে দাঁড়ানো সুপারি গাছ। প্রশস্ত রাস্তার পরে একটা সরু স্বচ্ছ পানির জলধারা চলে গেছে। তার ধারে সবুজ ঘাসে ভরা। শুদ্ধ গিয়ে সেখানে বসলো। ধারাও পেছন পেছন অনুসরণ করলো তাকে। আস্তে করে গিয়ে বসলো তার পাশে। শুদ্ধ হঠাৎ হেসে উঠলো। ধারা বলল,
'হাসছো কেন?'
'এখানে বসার পর হঠাৎ মনে হলো তোমাকে গান গাইতে বলবো। কিন্তু এরপরই মনে পড়ে গেলো তোমাকে গান গাইতে বলায় গতবার যা গেয়েছিলে, কি যেন? আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী...!
শুদ্ধ শব্দ করে হাসতে লাগলো। ধারা কপট রাগ নিয়ে ও'র হাতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল,
'এমন করলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। আমি কিন্তু চলে যাবো?'
'আচ্ছা! কিভাবে? আমি তো আর একঘন্টার আগে কোন বাইক চালাচ্ছি না।'
ধারা একটু ভাব নিয়ে বলল,
'আমি একাই বাইক চালিয়ে চলে যাবো। তুমি থাকবে এখানে বসে।'
'তাই! তুমি চালাতে পারো?'
'না পারলে না পারলাম। এক্সিডেন্ট করে পড়ে থাকবো একা একা।'
শুদ্ধ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, 'ধারা, এইসব কি ধরণের কথা!'
শুদ্ধ'র এমন রুক্ষ কণ্ঠ শুনে ধারার চেহারার ফাজলামো ভাব চলে গেলো। শুদ্ধ নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
'মজার ছলেও খারাপ কথা মুখ দিয়ে বের করতে হয় না ধারা। তুমি একা একা বিপদে পড়ে থাকবে এমনটা আমি ভাবতেও পারি না। তোমাকে আর দূরে রাখতে ইচ্ছা করে না ধারা। তোমার জন্য অনেক ভয় হয়।'
শুদ্ধর কণ্ঠটা কেমন যেন শোনায়। ধারার একটা হাত শুদ্ধ নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, 'একবার এই ঝামেলাটা মিটে যাক। তোমাকে আমি আর দূরে রাখবো না। তৎক্ষনাৎ একদম নিজের কাছে নিয়ে যাবো। একটুর জন্যও আর চোখের আড়াল হতে দিবো না। আমরা সবসময় একসাথে থাকবো ধারা।'

ধারা বিস্ময়বিমূঢ় দৃষ্টিতে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, শক্ত মনোবলের ছেলে। তার মুখে কখনও কোন ভয়ের কথা শুনেনি ধারা। এই প্রথম শুনলো। তাও আবার তাকে নিয়ে। ধারার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে শুদ্ধ'র হাতটা নিজের দু হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, 'আমার কিচ্ছু হবে না শুদ্ধ। তুমিই তো শিখিয়েছো ভয় না পেতে। শুধু তোমার হাতটা বাড়ানো থাকলে আমি এখন যে কোন কঠিন মুহুর্তেরই মোকাবেলা করতে পারবো। কারণ আমি তো জানি, আমি যদি দূর্বলও হয়ে পড়ি আমার পেছনে একটা শক্ত হাত আছে। যে আমাকে কখনো ভেঙে পড়তে দিবে না।'

ধারার হাতে ঈষৎ চাপ প্রয়োগ করে শুদ্ধ মৃদু হাসলো। ঘাসের মধ্যে ফুটে থাকা একটা নাম না জানা নীল রঙের ফুল ছিঁড়ে ধারার কানে গুঁজে দিলো। ধারা বলে উঠলো,
'বাহ! ফুলটা তো খুবই সুন্দর।'
শুদ্ধ স্মিত হেসে বলল, 'আমার সামনে যে মেয়েটি আছে তার থেকে না।'
ধারা লাজুক মুখে চোখ নামিয়ে ফেললো।

সারাদিনটা জুড়েই ও'রা ঘোরাঘুরি করলো। দূর থেকে দূরে। চেনা থেকে অচেনায়। কখনো জনশূন্যে, কখনো জনারণ্যে। সকাল থেকে দুপুর হলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। শুদ্ধ ধারাকে কিছুটা কেনাকাটাও করে দিল। সেখান থেকে একটা রেস্টুরেন্টে গেলো তারা। মাঝের একটা খালি টেবিল দেখে বসে খাবার অর্ডার করলো। খানিক বাদে খাবার চলে এলো। স্যান্ডউইচ, মিট বল, আর চকলেট শেক। খাবারের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে ধারা বলল,
'আচ্ছা, এটা কি আমাদের ফার্স্ট ডেট হলো?'
শুদ্ধ মৃদু হেসে বলল, 'বাহ! মিসেস ধারা, আপনি ডেটও বোঝেন?'
'এক্সকিউজ মি! আপনি কি আমাকে ইনসাল্ট করছেন?'
'করলাম। কেন সমস্যা?'
ধারা দাঁত চেপে বলল, 'আমিও না সব মনে রাখবো। তুমি যে আমাকে বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত কতগুলা খোঁচা মেরেছো সব একদিন সুদে আসলে তোমাকে ফেরত দেবো।'
শুদ্ধ মিট বল খেতে খেতে বলল,
'তুমিও তো আমাকে ছাড়োনি। কি যেন নাম দিয়েছো....খোঁচারাজ!'
ধারার মুখ ঝুলে গেলো। স্ট্রিপ দিয়ে মিল্ক শেক টেনে আড়চোখে ভাবতে লাগলো ধারা তাকে খোঁচারাজ বলে এটা শুদ্ধ জানলো কিভাবে? ধারা তো কখনো সামনাসামনি বলেনি! ধারার মুখের অবস্থা দেখে শুদ্ধ ঠোঁট চেঁপে হেসে বলল,
'যেভাবে রাগের চোটে বিরবির করতে দূর থেকেও স্পষ্ট শোনা যেত।'
কথাটা শুনে ধারার বিষম উঠে গেলো। ধারা তো আরও কতো কথাই এভাবে বলেছে সব কি শুদ্ধ শুনে ফেলেছে! শুদ্ধ বলে উঠলো,
'আরে আরে কি করছো! আস্তে আস্তে খাও। তা কি যেন বলছিলে! এটা ফার্স্ট ডেট হলো কিনা? ফার্স্ট যেহেতু এভাবে বেড়িয়েছি। সেহেতু ফার্স্টই তো বলা যায়।'
শুদ্ধ'র কথা শুনে ধারা উৎসুক হয়ে বলল,
'জানো, আমি যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়তাম তখন আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে মিলি করে নাম, একবার ক্লাস বাঙ্ক করে ও'র বয়ফ্রেন্ডের সাথে ফার্স্ট ঘুরতে বেড়িয়েছিল। ও'র বাবা তখনই নতুন একটা বেকারী শপ দিয়েছিল। সেটা কোথায় মিলি সঠিক করে চিনতো না। বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ও সেই শপেই পেস্ট্রি খেতে যায়। গিয়ে দেখে ও'র বাবা। সোজা ধরা খেয়ে যায়। এই খবর আমাদের ক্লাসে একদম হাইলাইট হয়ে ছিল। তার থেকেই আমি শুনেছি শুধু ফার্স্ট ডেট! ফার্স্ট ডেট! এতো হাসি পায় ঐ ঘটনা মনে পড়লে! কথায় আছে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। মিলির অবস্থাটা হয়েছিল ঠিক সেরকম।'
কথাটা বলে ধারা তুমুল হাসিতে ভেঙে পড়লো। শুদ্ধও হাসলো। হঠাৎ শুদ্ধ'র চোখ ধারার পেছনে কাউন্টারের দিকে গেলো। হাসতে হাসতে ধারা যখনই স্যান্ডউইচে একটা কামড় বসাতে যাবে ঠিক তখনই শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে পেছনে দৃষ্টি রেখেই বলল, 'আচ্ছা ধারা, তোমার বাবারও কি কোন রেস্টুরেন্ট আছে?'
ধারা স্যান্ডউইচে মুখ ভরে বলল, 'কই না তো!'
'তাহলে তোমার বাবা এখানে কি করছে?'
শুদ্ধ'র কথা শুনে ধারা পেছনে ঘুরে তাকালো। মুহুর্তেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। তার বাবা আজিজ তালুকদার কাউন্টারে দাঁড়িয়ে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের সাথে হাত মেলাচ্ছে। খাবার ধারার গলায় বেজে যাবার উপক্রম হলো। ধারা দ্রুত সামনে ঘুরে শুদ্ধকে কিছু বলার চেষ্টা করলো। খাবারে মুখ ভরে থাকায় তার কথা স্পষ্ট বোঝা গেলো না। শুদ্ধ কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে রইলো। ধারা কোনমতে দ্রুত খাবার গিলে বলল, 'হয়তো বাবার পরিচিত কেউ। তুমি তাড়াতাড়ি এখান থেকে যাও! এখান থেকে যাও!'
ধারার অস্থিতিশীলতা দেখে শুদ্ধ আরো বিভ্রান্ত বোধ করলো। কোথায় যাবে? কি বলছে? 
শুদ্ধ ফিসফিসিয়ে বলল, 'আমি আবার কোথায় যাবো?'
ধারা হন্তদন্ত হয়ে বলল, 'অন্য কোন টেবিলে গিয়ে বসো। পেছনে ঘুরে বসো।'
শুদ্ধ উঠে দাঁড়ালো। কি করবে না করবে বুঝতে না পেরে একটা মেয়ের সামনে টেবিলে বসে পড়লো। ধারা ঢুকে গেলো তার টেবিলের নিচে। আজিজ সাহেব তাদেরকে আর দেখতে পেলো না। যদি পেতো তাহলে হয়তো এই পাবলিক প্লেসেই কোন হট্টগোল বাঁধিয়ে ফেলতো। তার বাবার রাগ ধারা চেনে। টেবিলের নিচে বসে ধারা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিচ দিয়ে শুদ্ধ কোথায় দেখার জন্য তাকিয়েই তার মুখ ভোতা হয়ে গেলো। দেখলো শুদ্ধ একটা মেয়ের সাথে টেবিলে বসে আছে। দৃশ্যটা চক্ষুগোচর হতেই ধারা ভুলবশত উঠতে গেলেই মাথায় বারি খায়। দাঁত কিড়মিড় করে মাথা ডলতে ডলতে দেখতে থাকে তাদেরকে। শুদ্ধ পেছন ফিরে বসায় তাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মেয়েটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শুদ্ধ'র মতো একটা ছেলেকে দেখে মেয়েটা আহ্লাদে গদগদ হয়ে কথা বলার চেষ্টায় আছে। আর শুদ্ধও দেখো, আর কোন সিট পেলো না। একটা মেয়ের সাথেই বসতে হলো! বাবার জন্য যেই আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন রূপান্তরিত হয়ে বর নিয়ে জেলাসিতে চলে গেলো। ধারা কটমট করে তাকিয়ে রইলো। ফার্স্ট ডেট তো তাদের ছিল। অথচ হচ্ছে কি দেখো! ধারা এদিকে এতো কষ্ট করে টেবিলে বসে আছে আর তার বর মহাশয় আরামে চেয়ারে বসে মেয়েটার সাথে হাসি গল্প করছে।

কিছুক্ষণ পর আজিজ সাহেব চলে গেলে ধারা নিচ থেকে উঠে বসে। শুদ্ধও ফিরে আসে নিজের জায়গায়। বুকের শার্ট টা নাড়িয়ে বাতাস করতে করতে বলে, 'হায় রে! কি একটা অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য ভালোই! বিয়ের পরেও একটা প্রেম প্রেম ফিলিংস পাচ্ছি। সেই লুকিয়ে ছুপিয়ে দেখা করা।'
এই বলে শুদ্ধ মৃদু হাসলো। ধারা টেবিলের উপর দু হাত রেখে গুমোট মুখে বলল, 
'সুন্দর ছিল?'
শুদ্ধ অবাক হয়ে বলল, 'কে?'
'ঐ মেয়েটা!'
'কি যেন এতো কি খেয়াল করেছি নাকি!'
'ও আচ্ছা, আপনার সামনে বসা ছিল আর আপনি দেখেনিই নি না?'
শুদ্ধ সরল গলায় বলল,
'হ্যাঁ, মোটামুটি সুন্দরই।'
ধারা হাত নামিয়ে দ্রুত বলে উঠলো,
'ও, তার মানে এতো ভালো করেই খেয়াল করেছেন! তা এতো কি কথা বলছিলেন মেয়েটার সাথে?'
'কি বলো ধারা! হঠাৎ করে অভদ্রের মতো মেয়েটার সামনে বসে পড়েছি কিছু তো একটা বলতেই হয়, না?'
'হেসেছিলেন?'
'সৌজন্যতার হাসি।'
'গালে টোল পড়েনি তো আবার?'
'না।'
'তাহলে ঠিক আছে।'
শুদ্ধ কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে থাকে। এতক্ষণে ঠোঁট প্রসারিত করে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি ফুটে উঠে ধারার।

এরপর আর খুব বেশি ঝুঁকি নেয় না তারা। রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে শুদ্ধ ধারাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। উৎফুল্ল হয়ে বাড়িতে ফিরে ধারা দেখে তার বাবা আর কাকা এখনও ফেরেনি। শুদ্ধ তাকে আজ অনেকগুলো রঙের কাঁচের চুড়ি কিনে দিয়েছে। রুমে গিয়ে সর্বপ্রথম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ধারা সেটাই ব্যাগ থেকে বের করে দেখতে থাকে। পেছন থেকে জমিরন বিবি এসে বলে,
'কি রে কেমন আনন্দ করলি তোরা?'
ধারা কোন জবাব দেয় না। শুধু মুচকি হাসে। জমিরন বিবি বলতে থাকেন,
'এমনেই হাসিখুশি থাকবি। অতো বেশি চিন্তা করোন লাগবো না। যা হওয়ার হইতে থাক। তুই না চাইলে তো আর তোগো আলাদা করতে পারবো না। এমন টুকটাক ঝামেলা সবখানেই হয়। আমার যহন নতুন নতুন বিয়া হইলো তহন তোর দাদার লগেও আমার বাপের ছোডো খাডো একটা গ্যাঞ্জাম হইছিলো। বাপজানে আমার লগে কতা কইলেও আগের মতো হেই সহজ ভাবটা ছিলো না। হের পর যহন তোর বাপে আমার পেটে আইলো নাতি পাইয়া আমার বাপে যে কি খুশি হইলো! পেছনের সব ভুইলা গেছিলো।'

জমিরন নিজের কালের কথা জমিয়ে গল্প করে কিছুক্ষণ পর চলে গেলো। ধারাও আগ্রহের সহকারে শুনছিল দাদীর কথা। জমিরন বিবি চলে যাওয়ার পর বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়েই হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। এমন একটা বুদ্ধি যার পর তার বাবা নিজে শুদ্ধকে ডেকে ধারাকে তার হাতে তুলে দেবে। ধারা ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#40
 পর্ব-২৭
 

সকাল বেলা। সবাই বসে আছে নাস্তার টেবিলে। ডিম ভাজি, ডাল ভুনা, আর গরম গরম রুটি তে মজে আছে তারা। শাহেদ আর আজিজ সাহেবের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। ঠিক সেই সময় ধারা হঠাৎ খাবার ফেলে দৌঁড়ে বেসিনের দিকে ছুটে গেলো। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। ধারা বমি করছে। হঠাৎ করে কি হলো তার? আসমা বেগম মেয়ের পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন। ধারা একটু নিজেকে সামলিয়ে পর্যুদস্ত চেহারায় চেয়ারে বসলো। আসমা ধারার কপালে গলায় হাত লাগিয়ে দেখলেন। জ্বর নেই। অন্য কোন অসুস্থতার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তবুও এমন হলো কেন বুঝতে পারলেন না। আসমা বলল, 'কিছুই তো ঠিকমতো খাইতে পারলি না। আবার একটু পরে খাইয়া নিস।'
ধারা মাথা নেড়ে বলল, 'না, আমি খেতে পারবো না। খাবারে কেমন যেন গন্ধ লাগে।'

আসমা ঝট করে জমিরন বিবির দিকে তাকালেন। ধারা আস্তে আস্তে উঠে রুমের ভেতর চলে গেলো। জমিরন বিবি আসমাকে বললেন,
'বউ, তোমার মাইয়া তো মনে হয় পোয়াতি হইছে।'
কথাটা শাহেদ আর আজিজ সাহেবের মাথায় বাজ ফেললো। শাহেদ বলল,
'আম্মা, আপনি কিসব কথা বলেন?'
জমিরন বিবি খেঁকিয়ে উঠে বললেন,
'ক্যা? আমি কি কিছু বুঝি না। সব কি খালি তোরাই বুঝোস? আমার চোখ কখনো ভুল দেহে না। ও'র লক্ষণ সব আগের তনেই আমার ঠিক লাগতাছিলো না। এহন যা বোঝা গেলো ও'র পেটে বাচ্চাই আইছে।'

শাহেদ আর আজিজ সাহেবের কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠলো। তারা একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। সেদিন সারাটা দিন তাদের অস্থিরতায় কাটতে লাগলো। আসমা মেয়ের কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে যেই উত্তর পেলো তাতে সেই সন্দেহ আরো পাকাপোক্ত হয়ে গেলো৷ তারা মেনেই নিলো ধারা প্রেগন্যান্ট। আজিজ সাহেব এবং শাহেদের মুখ একদম ভোঁতা হয়ে রইলো। ধারার ভীষণ হাসি পেলো। রুম থেকে উঁকিঝুকি দিয়ে সে তাই দেখতে লাগলো। শাহেদ ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা অস্থির হয়ে পায়চারী করতে করতে বলল,
'এটা কি হলো? আমি মানতেই পারছি না।'
আজিজ সাহেব চেয়ারে থম মেরে বসে আছেন। জমিরন বিবি পাশ থেকে বলে উঠলেন, 
'মাইয়া বিয়ার পর সাড়ে তিন মাসের মতোন জামাইয়ের ধারে ছিল৷ অস্বাভাবিক কিছু তো না। না মানতে পারার কি আছে?' 

শাহেদ আজিজ সাহেবের কাছে গিয়ে বলল,
'ভাইজান, এখন কি হবে?'
তারপর আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাইলে তার কথার মর্মার্থ বুঝতে পেরে আজিজ সাহেব দ্রুত বলে উঠলেন, 
'চুপ! তোমার মাথা ঠিক আছে? এখন কি এর জন্য পাপ মাথায় নিবো আমরা! আল্লাহ যখন দিছে এই বাচ্চা আমরা ফেলতে পারি না। যার জন্ম হওয়ার তার তো হতেই হবে।'

'তাহলে এখন কি করবেন? ধারাকে আবার ঐ ছেলের কাছে পাঠাবেন?'
এই প্রশ্নের উত্তরে আজিজ সাহেব চুপ করে রইলেন। তার হঠাৎ নিরবতা শাহেদের পছন্দ হলো না। 

বাড়ির পরিবেশ অস্বাভাবিক থাকলেও ধারার অনুকূলেই রইলো। সবাই নিরব থাকলেও মনে মনে কি সিদ্ধান্ত তৈরি হচ্ছে তা যেন স্পষ্টই পরিস্ফুট হতে লাগলো। ধারা সারাদিন কিছু না খেয়ে বিছানায় শুয়ে রইলো। আর আজিজ সাহেব আর শাহেদের কপাল থেকে চিন্তার ভাঁজ সরলো না।

পরদিন সকাল বেলা হুট করেই জমিরন বিবির শরীর ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। এদিকে বাড়িতে কোন পুরুষ নেই। সবাই সকাল সকাল বেড়িয়ে গেছে। ধারা আর আসমা কি করবে কিছু বুঝতে পারলো না। এদিকে জমিরন বিবির হাত পা ও ভীষণ ঠান্ডা হয়ে আসছে। ধারা বারবার মালিশ করে দিতে লাগলো। হাসপাতালে নেওয়া দরকার। আজিজ সাহেব আর শাহেদ কারো নাম্বারেই ফোন ঢুকছে না। ধারা দৌঁড়ে রাস্তার মাথায় গেলো। গাড়ির কোন দেখা নেই। সময়ও কেটে যাচ্ছে। কোন উপায়ান্তর না পেয়ে ধারা শুদ্ধকে ফোন দিলো। কিছুক্ষণ পর শুদ্ধ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সেখানে উপস্থিত হলো। এসে জানালো গতকাল বিকেল থেকে ঝড় বৃষ্টি হওয়ায় সারারাত কারেন্ট না থাকায় একটা অটোতেও চার্জ নেই। কারেন্ট না আসার আগ পর্যন্ত কোন অটো পাওয়া যাবে না। সে নিজেও খুব কষ্ট করে একজনের কাছ থেকে বাইকে লিফট নিয়ে অর্ধেক পথ এসেছে। আর বাকি পথ দৌঁড়িয়ে। হাসপাতাল এখান থেকে ভালোই দূরে। কি করে জমিরন বিবিকে এখন হাসপাতালে নেওয়া যায় এটাই সবথেকে বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। ধারা বারবার আতঙ্কিত হয়ে জমিরন বিবির মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। জ্ঞানহীন জমিরন বিবি নিথর হয়ে পড়ে আছেন। শুদ্ধ ধারার কাঁধে হাত রেখে বলল, 'তুমি চিন্তা করো না ধারা। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।'
শুদ্ধ আবারো কোন গাড়ির খোঁজে বেড়িয়ে পড়লো। খানিক বাদে ফিরে এলো একটা ভ্যান নিয়ে। ধারা যখন দেখলো সাথে কোন চালক নেই তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কার ভ্যান এটা?'
শুদ্ধ বলল, 'আমি জানি না। রাস্তার পাশে সেই সকাল থেকে দাঁড়া করা ছিল। কোন মানুষ দেখতে পাইনি। আমি পাশের একটা দোকানদারকে বলে রেখে নিয়ে এসেছি। আসল মালিক আসলে সে জানাবে ইমারজেন্সির জন্য নেওয়া হয়েছে।'
'ভ্যানচালক না থাকলে এটা চালাবে কে?'
'আমি চালাবো। ধারা এতো কথা বলার এখন সময় নেই। দাদীকে এখন আগে হাসপাতালে নিতে হবে।'

এরপর শুদ্ধ নিজে ভ্যান চালিয়ে জমিরন বিবিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সাথে গেলো আসমা আর ধারাও। হাসপাতালে গিয়ে বাঁধলো আরেকটা বিপত্তি। ডাক্তার জানালো জমিরন বিবির প্রেশার অত্যন্ত লো হয়ে গেছে। পাশাপাশি তার শরীরে রক্ত অনেক কম। রক্ত দিতে হবে। এদিকে তার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। পাওয়া খুবই দুস্কর। ধারা আর আসমা চিন্তিত বোধ করলো। শুদ্ধ ওষুধ কিনতে গিয়েছিল। এসে যখন শুনলো রক্তের কথা তখন সবাইকে আশ্বাস দিয়ে জানালো তারও রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। চিন্তার কোন কারণ নেই। এরপর ডাক্তার রক্ত নেওয়ার ব্যবস্থা করলো। শুদ্ধ জমিরন বিবিকে রক্ত দিল। একটু আশ্বস্ত বোধ করলো সবাই। ডাক্তার জানালো চিন্তার আর কোন কারণ নেই। বিকেল নাগাদই জমিরন বিবিকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে তারা। দুপুর হয়ে এলে শুদ্ধ গিয়ে বাইরে থেকে কিছু খাবার কিনে এনে আসমা আর ধারাকে দিলো। আসমা শুধু একটু পর পর শুদ্ধকেই দেখতে লাগলো। ধারা এক বিন্দুও মিথ্যা বলেনি ছেলেটাকে নিয়ে। এই ছেলেটার সবকিছুই মুগ্ধ করার মতো। আসমা ভীষণ স্বস্তি বোধ করলো। তার মেয়ে আসলেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে একটু একলা সময় দেওয়ার জন্য আসমা উঠে কেবিনের ভেতর চলে গেলো। ধারা আর শুদ্ধ রয়ে গেলো বাইরে। পাশাপাশি বসা। ধারা ছলছল চোখে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে বলল,
'থ্যাংক্স!'
শুদ্ধ ধারার দিকে কিছুক্ষণ সরু চোখে তাকিয়ে বলল, 'কিসের থ্যাংক্স? আমার আর তোমার মধ্যে কোন থ্যাংক্সের জায়গা নেই। আমি তোমার জন্য কিছু করবো না তো কে করবে? হুম? তোমার উপর আমি কখনোই কোন সমস্যা আসতে দিবো না। একবার বলেছি না! আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। সবসময়! কখনো নিজেকে একা ভাববে না। আমরা দুজন মিলেই তো এক।'

ধারা আর কিছু বলতে পারলো না। একটা প্রশান্তির ছাপ নিয়ে শুদ্ধ'র কাঁধে মাথা রেখে বসে রইলো। এই দৃশ্য কেবিনের দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো আসমা। তার মনে এতোদিন যতটুকুও বা খুঁত খুঁত ভাব ছিল সব একদম দূর হয়ে গেলো। তার চোখেও হঠাৎ কেন যেন পানি চলে এলো। খুশির জল।

বিকেল বেলা জমিরন বিবিকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। তার শরীর এখন খানিকটা ভালো। শহরে গাড়ির কোন অভাব নেই। শুদ্ধ একটা অটো ঠিক করে আসমা আর জমিরন বিবিকে পাঠিয়ে দিলো। আর বলে দিল এর পরের অটোতেই ধারা শুদ্ধ আসছে। ভ্যানের আসল মালিক দুপুরে এসে তার ভ্যান নিয়ে গেছে। শুদ্ধও সাথে অনেকটা বকশিশ দিয়ে দিয়েছে তাকে। অটোর অপেক্ষায় শুদ্ধ আর ধারা যখন হাসপাতালের বাইরে তখন শুদ্ধ হঠাৎ করে কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,
'ও...একটা কথা। আমার কিন্তু কানে এসেছে আপনার বাড়িতে আপনি কি বলেছেন। কিভাবে সম্ভব? আমি তো নির্দোষ।'
ধারা একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে শুদ্ধ'র হাতে মৃদু বারি দিয়ে বলল, 'উফ! এটা কি সত্যি নাকি? আমি তো নাটক করেছি। আর নাটকটা কাজেও লেগেছে। সবাই সত্যি বিশ্বাস করে ফেলেছে। আর আমার মনে হয় আমাকে খুব শীঘ্রই আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবে। সব কিন্তু আমার অভিনয়ের দক্ষতার জন্যই। আমি যে কি ভালো নাটক করেছি আর সবার মুখের অবস্থা যা দেখার মতো ছিল না!'
ধারা হাসতে লাগলো। শুদ্ধ সিরিয়াস হয়েই বলল, 
'ধারা, আপনি এটা ঠিক করেননি। এভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে....
শুদ্ধ আর কিছু বলতে পারলো না। তার আগেই তাদের পেছন থেকে আজিজ সাহেব হুংকার ছেড়ে ডেকে উঠলেন, 'ধারা!'
ধারা কেঁপে উঠে পেছনে তাকালো। সাথে শুদ্ধও। আজিজ সাহেব এখানে কিভাবে আসলো? শাহেদ আর আজিজ সাহেব গিয়েছিলেন আজ এক রাজনীতি সংক্রান্ত মিটিংয়ে। এর জন্যই তাদের ফোন বন্ধ ছিল। মিটিং শেষে বিকেলে বাড়ি ফিরে কাউকে না দেখে পাশের বাসা থেকে জানতে পারে তার মা অসুস্থ হওয়ায় তাকে সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেকারণেই তারা সরাসরি এখানে চলে আসে। আর এসে ধারাকে শুদ্ধ'র সাথে দেখে রাগান্বিত মুখে এগিয়ে আসতেই ধারার কথাগুলো শুনতে পান। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ধারার হাত খপ করে ধরে বলেন, 
'তোমার এতো বড় সাহস নাটক করে তুমি আমাদেরকে বোকা বানাও! আবার মানা করা সত্ত্বেও তুমি এই ছেলের সাথে দেখা করো!'

আজিজ সাহেব ভীষণ ক্ষেপে আছেন। ধারা আতঙ্ক স্বরে কিছু বলতে চাইলে আজিজ সাহেব তার সুযোগ না দিয়ে ধারাকে টেনে নিয়ে একটা অটোতে বসিয়ে স্টার্ট দিতে বলেন। পরিস্থিতি খুবই বেগতিক হওয়ায় শুদ্ধও সাথে সাথে অন্য অটোতে ধারাদের বাড়িতে যায়। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আজিজ সাহেব ধারার হাত ছেড়ে দিয়ে বলেন,
'তুমি এতো বড় মিথ্যা কথা বলতে পারো আমি স্বপ্নেও ভাবেনি। তুমি এতোটা নিচে নেমে গেছো ধারা!'

ধারা অঝোরে কাঁদতে লাগলো। চেঁচামেচি শুনে আসমা দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। ততক্ষণে শুদ্ধও পৌঁছে গেছে সেখানে। শাহেদ ক্ষুব্ধ হয়ে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। আজিজ সাহেব বলতে লাগলেন, 'তুমি প্রেগন্যান্টের নাটক করে ঐ ছেলের কাছে ফিরে যেতে চেয়েছো! আমাদের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছো! যাও তাহলে চলে ও'র কাছে। আমাদের সাথে তোমার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না। আমরা ভুলে যাবো আমাদের একটা মেয়ে ছিল।'

ধারা কাঁদতেই লাগলো। শুদ্ধ'র সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু করতে হচ্ছে। আজিজ সাহেবের সাথে শাহেদও যুক্ত হলো। রুঢ় থেকে রুঢ় কথা শোনাতে লাগলো ধারাকে। আজিজ সাহেব বললেন,
'তোমার ভালোর জন্যই এসব করছিলাম। কিন্তু বুঝলে তো আর না। বুঝলে কারটা? ঐ ছেলেরটা। একটা পতিতার ছেলের জন্য তোমার এতো টান! কে শিখিয়েছে তোমায় এসব? ঐ ছেলে? অবশ্য একটা পতিতার ছেলের থেকে আর বেশি কিই বা আশা করা যায়।'

শুদ্ধ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। এতো চেঁচামেচি শুনে ধারাদের প্রতিবেশিরা বাড়ির বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলো। আজিজ আরো অনেক কথা বলতে লাগলেন,
'পতিতার ছেলের স্বভাব চরিত্র আর কতই বা ভালো হবে। যতোই সেসব থেকে দূরে থাকুক না কেন শরীরে আছে তো সেই পতিতার রক্তই। নষ্ট রক্ত।'

ধারা শক্ত হয়ে বলে উঠলো, 'বাবা! আপনি আমাকে এতক্ষণ যা বলার বলেছেন। দোষ আমি করেছি, মিথ্যা আমি বলেছি৷ আপনি আমাকে বলবেন। আমার স্বামীকে আপনি এভাবে বলতে পারেন না।'

আজিজ সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। ধারা বলতে লাগলো,
'বারবার শুদ্ধকে পতিতার ছেলে পতিতার ছেলে বলে কি বোঝাতে চান বাবা? আপনি এটা কেন ভুলে যান, শুদ্ধ যদি পতিতার ছেলে হয় তাহলে আপনার মেয়েও একটা পতিতার ছেলেরই স্ত্রী। আমার স্বামীর পরিচয়ই এখন আমার পরিচয়। তার সম্মানই আমার সম্মান। তার নামের সাথে যতো বদনাম যোগ হবে সব আমার নামের সাথেও হবে। আপনি সবার সামনে এইসব কথা বলে শুধু তাকে ছোট করছেন না, আপনার মেয়েকেও করছেন। শুদ্ধ কখনো চুপচাপ নিজের অসম্মান সহ্য করার মতো ছেলে না। সে নিজেকে যেমন বিশ্বাস করতে জানে তেমন নিজেকে নিজে সম্মানও করতো জানে। সে স্পষ্ট কথার ছেলে। তবুও আজ আপনি তাকে এতো খারাপ খারাপ কথা বলার পরেও সে কেন চুপ করে আছে জানেন বাবা? কারণ সে আমাকেও সম্মান করে বলে। আমার পরিবারকে সম্মান করে বলে, আপনাকে সম্মান করে বলে।'

বলতে বলতে ধারা আবারও কেঁদে ফেললো। বলল, 'আমি বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়েছে। শুদ্ধও আমাকে সেটাই বলছিল। সে আমাকে এসব করতে শিখিয়ে দেয়নি বাবা। সে কখনো ভুল কিছু করে না। আমি বাধ্য হয়ে এই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি। কারণ আমি অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছি এই দোটানার মধ্যে থাকতে থাকতে। আমি শুদ্ধকেও ছাড়তে পারবো না আর আপনাদের সাথে চিরদিনের মতো সম্পর্ক ছিন্নও করতে পারবো না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি পারছি না আর আপনাদের এই বিরোধ সামলাতে। আসলে আমার না এখন মরে যাওয়া উচিত। তাহলেই আর দুজনের মধ্যে একজন বেঁছে নেওয়ার চক্করে আটকা থাকতে হবে না।'

শুদ্ধ ধারাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গম্ভীরমুখে বলল, 'এসব কি কথা আপনি বলছেন ধারা? আচ্ছা ঠিকাছে। প্রয়োজনে আমরা আলাদা হয়ে যাবো। দোটানা কেটে যাবে। একটা দিক অন্তত ঠিক হয়ে যাবে। তবুও আপনি এসব ভাববেন না।'

ধারা ও'র বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, 
'দেখেছেন বাবা, শুদ্ধ কখনো আমাকে ছাড়ার কথা বলেনি। আমি মারাত্মক ভুল করার সময়ও বলেনি, আপনাদের এতো এতো অপমানেও বলেনি। বলল কখন? যখন আমার কোন ক্ষতির কথা শুনলো। আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কষ্টের চাইতে আমার ক্ষতি হবার কষ্ট তার কাছে বেশি তীক্ষ্ণ।'
একটু থেমে ধারা নিচের ঠোঁট কামড়ে খুব কষ্ট করে বলল, 'সে আমাকে খুব ভালোবাসে বাবা। আমিও তাকে খুব ভালোবাসি। আমরা দুজন একসাথে খুব সুখে থাকবো। বাবা....বাবা, আমাকে তার কাছে যেতে দিন।'
ধারা আকুতির সাথে একবার বাবার হাত ধরলো আবার পরক্ষণেই বাবার পা পেঁচিয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
'আমাকে হাসিমুখে যেতে দিন বাবা। আমি আমার পরিবার আর স্বামী দুটোকেই চাই। আপনি তো আমার ভালো চান তাই না বাবা, আমি সেখানেই ভালো থাকবো। পায়ে পড়ি বাবা, যেতে দিন।'

ধারার অবস্থা দেখে শুদ্ধ'র চোখে পানি চলে এলো। জমিরন বিবি অনেকক্ষণ ধরেই রুম থেকে সবার কথাগুলো শুনছিলেন। তার গায়ে জোর নেই। বিছানা থেকে উঠতে কষ্ট হয় তাই আসতে পারছিলেন না। ধারার আকুতি শুনে আর না এসে পারলেন না। আস্তে আস্তে উঠে দেয়াল ধরে ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন,
'আজিজ!'

শাহেদ কাছে গিয়ে ধরতে যাওয়ার জন্য বলল,
'আম্মা, আপনি আবার উঠে আসতে গেলেন কেন? আপনি অসুস্থ।'
জমিরন বিবি শাহেদের হাত না ধরে বললেন,
'অসুস্থ তবুও তো বাড়ি ফিরা প্রত্তম আমারে দেখতে গেলি না। তোরা বইলি তোগো মান সম্মানের হিসাব কষতে।'
এই বলে জমিরন বিবি শুদ্ধকে ডেকে বললেন,
'নাত জামাই, আমারে নিয়া একটু ঐ চেয়ারে বসাও তো।'
শুদ্ধ হাত ধরে জমিরন বিবিকে চেয়ারে বসালো। জমিরন বিবি বসার পর বললেন,
'আজিজ, এই যে আমারে এহন ভালা দেখতাছোস এইয়া কার লেইগা জানোস? এই যে পতিতার পোলা কইয়া চিল্লাইতাছোস যারে হের লেইগাই। বউ আমারে সব কইছে। তোরা কেউ আছিলি না সেই সময়। তোরা তো ছিলি তোগো ক্ষমতার পেছনে। এই পোলাই ছুইটা আইসা আমারে হাসপাতালে নিয়া গেছে। তাও আবার কেমনে জানোস? ভ্যান চালাইয়া। নিজে চালায় নিয়া গেছে। আর তোরা হইলে কি করতি? তোগো ইজ্জত যাইতো গা ভ্যান চালাইলে। তোরা থাকতি তোগো মান সম্মানরে লইয়া। কিন্তু এই পোলা হেয়া ভাবে নাই। হের কাছে জীবন বাঁচানি আগে। আর কি জানি কইলি তহন? নষ্ট রক্ত! আমার শরীর আজকে বহুত খারাপ হইয়া পড়ছিলো। আমার নাত জামাই আমারে রক্ত দিছে। নষ্ট রক্তের লেইগা তোরা সম্পর্ক রাখবি না। তোর মায়ের গায়েও তো তাইলে এহন সেই নষ্ট রক্ত। এহন কি তোরা তোগো মায়রেও ফালায় দিবি। রক্তের আবার নষ্ট পঁচা কি রে? আল্লাহ দেয় নাই এই রক্ত? কালকে ধারার বাচ্চার কথা শুইনা কইলি আল্লাহ যহন বাচ্চা দিছে তহন আমরা ফেলতে পারবো না। এই ছেলেরেও তো আল্লাহই বানাইছে। তাইলে ওয় আলাদা হইলো কেমনে? জাত পাত দিয়া কিছু হয় না রে আজিজ। মানুষটাই আসল। এই ছেলে হীরার টুকরা। হারাইতে দিস না। আমরা তো সব আমগো মাইয়ার লেইগাই করতে চাই। মাইয়া যেনে ভালো থাকবো হেই খানেই আমগো শান্তি। চোখ থিকা ঐ পর্দা ডা খোল।' 

অনেক কথা বলে ফেলায় জমিরন বিবি হাঁপিয়ে উঠলেন। মায়ের কথার প্রভাব আবার না আজিজ সাহেবের উপর পড়ে এই জন্য শাহেদ দ্রুত কিছু তাকে বলতে চায়। আজিজ সাহেব এতক্ষণ একদম চুপ করেই ছিলেন। শাহেদকে 'ভাইজান' বলে মুখ খুলতে দেখেই ধমকে উঠে বললেন,
'তুমি চুপ থাকো! তোমার কথাতেই আমার মাথা খারাপ হয়েছিল।'

এরপর তিনি ধারার দিকে তাকালেন। মেয়েটা এখনও কেমন পায়ে ধরে বসে আছে। তার হঠাৎ ভীষণ মায়া হয়। আজিজ সাহেব গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। কখনো আবেগী কথাবার্তা বলেননি। তাই তার বলতে খুব সমস্যা হলো। খুব সময় নিয়ে তিনি মেয়ের মাথায় হাত রেখে শুধু এতটুকুই বলতে পারলেন,

'মন দিয়ে স্বামীর সংসার করিস মা।'

ধারা তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply




Users browsing this thread: 1 Guest(s)