Thread Rating:
  • 9 Vote(s) - 2.22 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
হাতটা রেখো বাড়িয়ে (Writer: ইশরাত জাহান)
#1
Heart 
কবুল বলে ফেলার পরও ধারার ঠিক বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, শুধুমাত্র এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ পায়নি বলে তার বাবা আজ তার সত্যি সত্যিই বিয়ে দিয়ে দিলো। আর তাও নাকি গ্রামের একটা চাষার সাথে। হ্যাঁ, ঠিক এই কথাটাই তো পাশের বাসার এক কাকী বৌ সাজানোর সময় ধারার কানে কানে বলল, ধারার যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে নাকি ক্ষেত খামারে কাজ করে। ধারা আর কিছু ভাবতে পারছে না। তার মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পাশেই ধারাকে কেন্দ্র করে সবাই হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে। একটুপরই শেরোয়ানী গায়ের একজনকে নিয়ে আসা হলো। বিনা সঙ্কোচে অধিকার প্রাপ্তির সুরে বসিয়ে দেওয়া হলো ধারার পাশে। নতুন জামাইয়ের আগমনে ঠিক তখনই ঘরে থাকা অল্প বয়সী মেয়ে ছেলেদের সে কি হৈ হুল্লোড়! পাশেই একটা শক্তপোক্ত পুরুষ অবয়ব। যে নাকি এখন থেকে ধারার স্বামী নামেই জানা যাবে। অথচ যাকে এখনও এক নজরের জন্য দেখেনিও পর্যন্ত ধারা। তবুও ধারা চোখ তুলে তাকালো না। তাকালো না তো তাকালোই না। একটুপরে একটি সুকারুকার্য আয়না রাখা হলো তাদের সম্মুখে। বর কনের যে এবার পরিপূর্ণ অধিকারের সহিত নিজ নিজ জীবনসঙ্গীর মুখ দেখার পালা। পাশের পুরুষটি হয়তো আয়না মুখে চোখ রেখেছে অনেক আগেই। সময় নিচ্ছে শুধু ধারা। শেষমেশ যখন দাদী খালাদের জোড়াজুড়িতে স্বচ্ছ দর্পণে তার ভেজা পাঁপড়ির আনত দৃষ্টি মেলে ধরলো তখন ঝাপসা চোখে একটা বাদামী মুখের অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছু অবলোকন হলো না।

ধারার বাবা আজিজ তালুকদার। গ্রামের একজন সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি। কথাবার্তা বলেন খুব কম। কিন্তু যা একবার বলেন তা ফিরিয়ে নেওয়ার সাধ্যি কারো নেই। শিক্ষা এবং সমৃদ্ধিতে মধুপুর গ্রামের যে কয়েকটি পরিবার এগিয়ে তাদের মধ্যে ধারাদের পরিবার একটি। আজিজ তালুকদার ইন্টার পাশের পর বিএ তে ভর্তি হয়েছিলেন। দুই বছর যাওয়ার পর কিছু পুঁজি যোগাড় করে নেমে পড়েন ব্যবসায়। এবং সফলও হন। মাঝখান থেকে ছুটে যায় পড়ালেখা। শহরে তার বড় কয়েকটি দোকান আছে। ছোট ভাই শাহেদ মাস্টার্স পাশ। একটুর জন্য বিসিএসে টেকেননি। তারপরও একটা বড় সরকারি চাকরির পদে কর্মরত আছেন। চাকরি সূত্রে বর্তমানে পরিবার নিয়ে আছেন চট্রগ্রামে। ছোট ভাইকে পড়ালেখায় দীক্ষিত করার অবদান সম্পূর্ণ আজিজ তালুকদারের। শাহেদের তাই একান্তই মান্য ব্যক্তি তিনি। শিক্ষিত এবং বড় চাকরিজীবী ছোট ভাইয়ের পড়ামর্শ আজিজ তালুকদারও সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। পরিবারের জন্য কাজের চাপে নিজের শিক্ষা গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়নি। তাই শিক্ষাকে তিনি কদর করেন। চেয়েছিলেন ছেলে মেয়েগুলোকেও একই ভাবে গড়ে তুলবেন। শিক্ষা দীক্ষায় এরা বড় হবে। এবং সেই শিক্ষাটা অবশ্যই হতে হবে সেরা। এ প্লাস পাওয়া ছাড়া শিক্ষার কোন দাম থাকে নাকি! এই চিন্তাটাই ধারার মাথায় নেমে আসে বিশাল চাপ হয়ে। ছোট থেকেই শুনে এসেছে পরীক্ষার ফলাফল মানে অবশ্যই এ প্লাস। আর সেটাও হতে হবে সাইন্স থেকে। বাবার কথা মতই সাইন্স নিয়েছিল ধারা। কিন্তু সাইন্সের সাবজেক্টগুলো একটু কমই বোধগম্য হয় তার। তার উপর বাবার আদেশ ইন্টারে এ প্লাস পেতেই হবে। তিনি গ্রামে সবার কাছে বড় মুখে বলেছেন তার মেয়ে পরীক্ষায় অবশ্যই এ প্লাস পাবে। বিশেষ করে তার সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জয়নাল খাঁ-কে শুনিয়ে। যার ছেলেও কিনা এবার ধারার সাথেই পরীক্ষা দেবে। মেয়ে যেন এ প্লাসই পায় এই জন্য অসুস্থতার বাহানা দিয়ে ইন্টারে এক বছর মেয়েকে গ্যাপও দেওয়ান তিনি। গ্রামে তার মুখটা যে করেই হোক রাখতে হবে। এই সব কিছুই প্রেশার হয়ে উঠে ধারার কাছে। মনে সৃষ্টি করে প্রচন্ড ভয়। এতকিছুর পরও যদি এ প্লাস না পায়! প্রচন্ড ভয়, নার্ভাস আর প্রেশারে পরীক্ষায় খারাপ করে বসে ধারা। একটুর জন্য আসে না কাঙ্খিত ফলাফল জিপিএ ফাইভ। অপরদিকে জয়নাল খাঁ-য়ের ছেলের এ প্লাস পাওয়ার খবর ছড়িয়ে যায় পুরো গ্রামময়। রাগে, ক্ষোভে, অপমানে আজিজ তালুকদার সেদিনই বাড়ির মধ্যে ঘোষণা দেন এই মেয়ের পড়ালেখা দিয়ে কিছু হবে না। একে অতি শীঘ্রই বিয়ে দেওয়া হোক। যেই সম্বন্ধ এরপর আসবে তার সাথেই দিয়ে দেওয়া হবে। গ্রামে মেয়েদের ষোল বছর মানেই প্রাপ্তবয়স্ক। সেদিক বিবেচনায় ধারা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়েছে আরো আগেই। কিছুদিন পরপরই তাই তাদের বাড়িতে বিয়ের সমন্ধ নিয়ে লোকের আসা যাওয়া চলতো। তাই রেজাল্ট পাওয়ার দু দিন পরই যখন তাদের পাশের গ্রাম রূপনগর থেকে একটা সম্বন্ধ আসে তখন ধারার বাবা জেদের বশবর্তী হয়ে সেটাতেই হ্যাঁ বলে দিয়ে আরো দুই দিন দেখা সাক্ষাৎ, কথা বার্তা চালিয়ে সাত দিনের মাথাতেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। এতদিন তো তিনি সব সম্বন্ধ না বলে রাখতেন কারন মেয়ে নিয়ে তার আশা ছিল। এখন তো অপদার্থ মেয়ে তার সব আশাই ভেস্তে দিল।

এসব ভাবতে ভাবতেই বাসর ঘরে বসে বসে চোখের জলে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে ধারার। অশ্রু যেন থামার নামই নিচ্ছে না। কান্নার দমকে তার ক্লান্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে বারংবার। চোখ মুখ হয়ে উঠেছে রক্তিম। গভীর বেদনায় জর্জরিত ধারা শুধু একটি কথাই ভাবছে, কি থেকে কি হয়ে গেল! এ প্লাস না পাওয়ার এতো বড় শাস্তি যে তার বাবা তাকে দেবে তা হয়তো কখনোই ভাবতে পারেনি সরল মনের ধারা। বাবাকে সে জমের মতো ভয় পায়। তাই তো এর বিপরীতে টু শব্দটিও করতে পারেনি সে। ধারারই বা আর কি করার ছিল! সে তো তার সাধ্য মতোই চেষ্টা করে ছিল। কিন্তু পরীক্ষার হলে অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের দরুণ সে ভালো করার মতো প্রশ্নের উত্তরেও ভালো করতে পারেনি। যার পরিবর্তে আজ তার জীবনে এই পরিবর্তন নেমে আসলো। 

দরজা খুলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতেই শুদ্ধ দেখলো, ফুল দিয়ে সাজানো বিছানার ঠিক মাঝ বরাবর বসে লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিতা তার সদ্য বিবাহিতা নব বধু হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে। কম্পিত শরীরের ভাঁজে তার সুন্দর মুখশ্রীটুকুও ঢাকা পড়ে গেছে। রুমে কারো প্রবেশের আভাস পেতেই চট করে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়িয়ে পড়লো ধারা। খাটের গা ঘেঁষে একদম পাশুটে মেরে দাঁড়িয়ে রইল। ভয়ে আতঙ্কে তার মুখ জমে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখের সামনে দাঁড়ানো সাদা পাঞ্জাবী পরণের এই উজ্জ্বল গাত্রের রোগা, লম্বা ছেলেটাই কি তবে তার স্বামী! ছেলেটা একটু এগিয়ে এসে ভরাট গলায় ধারাকে প্রশ্ন ছুড়লো,

'কি হলো আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন?'

ধারা কিছু বলতে পারলো না। কান্নার চোটে তার গলা হয়ে উঠেছে অবরুদ্ধ। ছেলেটি আবারো বলল,

'কি হলো বলুন।'

ধারা এবারও কিছু বলতে পারলো না। তার কান্নাটা বরঞ্চ আরো একটু যেন বাড়লো। শুদ্ধ বিরক্তবোধ করলো। ভ্রু কুঁচকে চুপচাপ কিছুক্ষণ সন্ধিগ্ন চোখে ধারার দিকে তাকিয়ে থেকে স্পষ্ট স্বরে বলল,

'আপনার কি বিয়েতে মত ছিল না?'

ভয়ার্ত চোখে একবার শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে বহু কষ্টে ধারা কাঁপা কাঁপা শরীরে মাথা দুলালো। ধারার মাথা দুলানো দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেলো শুদ্ধ'র। বলল,

'বিয়েতে মত ছিল না তাহলে বিয়ে করেছেন কেন?'

শুদ্ধর কণ্ঠে স্পষ্ট রাগ। ধারা আরো ঘাবড়ে গেলো। কোনমতে আমতা আমতা করে বলল,

'বাবা বলল তাই...!'

'বাবা বলল তাই মানে? বাবাকে আগে না করেননি?'

কাঁদতে কাঁদতে ধারা আবারো দু দিকে মাথা দুলালো। এবার সত্যিই ভীষণ রাগ লাগছে শুদ্ধ'র। ঝাঁঝালো স্বরে বলল,

'বাবা বলল আর ওমনিতেই বিয়ে করে নিলেন! এখন আবার বিয়ে করে মরা কান্না জুড়ে বসেছেন। এখন কি আশা করছেন, সিনেমার মতো আমি আপনাকে এসে বলবো, 'কোন অসুবিধা নেই। আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। আপনি আপনার মতো থাকবেন, আমি আমার মতো থাকবো।' এই?'

ধারা এমনিতেই ভয় পেয়ে ছিল। শুদ্ধ'র ধমকের চোটে ভয় পেয়ে ও'র কান্না আরো বাড়তে লাগলো। বিরক্ত স্বরে শুদ্ধ বলল, 

'প্লিজ! সর্বপ্রথম আপনার এই কান্নাটা বন্ধ করুন। এই কান্নাটা কি বিয়ের আগে কাঁদতে পারেননি? বিয়ের আগে বাবাকে না করলেন না কেন?'

শুদ্ধ'র কঠিন চোখের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে বাঁচতেই এদিক ওদিক তাকাতেই ধারার হঠাৎ নজর পড়ল পাশের টেবিলে থাকা একটা ল্যাপটপের দিকে। কান্নার মধ্যেই বড্ড অসময়ে এমন অসংলগ্ন চিন্তা আসতেও ধারার দেরি হলো না, আচ্ছা চাষারাও কি আজকাল ল্যাপটপ চালায়?

কোন উত্তর না পেয়ে শুদ্ধ পুনরায় বলল, 'আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করছি।'

চমকে উঠে ভাবনা থেকে ফিরে এসে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ধারা বলল, 'আমি আমার বাবাকে খুব ভয় পাই তাই আর...!

উত্তর শুনে প্রচন্ড বিরক্ত আর রাগান্বিত শুদ্ধ বলতে লাগলো,

'বাবার কথায় যেহেতু বিয়ে করে ফেলেছেন তাহলে বাবার কথায় নিশ্চয়ই সংসারটাও করে ফেলবেন। তাহলে এখন আমার কাছে আসায় এভাবে কুঁকড়ে যাচ্ছেন কেন?'

কথাটা বলতেই বলতেই ধারার দিকে দ্রুত এক কদম এগিয়ে যায় শুদ্ধ। পিছিয়ে যেতেও ধারা আর পিছুতে পারলো না। তার আগেই শরীরের সমস্ত ভার নিয়ে হেলে পড়ে সামনের ছেলেটার বুকে। ধারার স্পর্শ পেতেই আঁতকে উঠে শুদ্ধ। মেয়েটার গায়ে দেখি সাংঘাতিক জ্বর।

চলবে----

 
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 2 users Like Bangla Golpo's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#2
Heart 
 পড়তে থাকুন নতুন কিছু ।
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#3
Heart 
 পড়তে থাকুন নতুন কিছু।
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 2 users Like Bangla Golpo's post
Like Reply
#4
Eki post 3 bar korsen. But nice story.
[+] 1 user Likes Saj890's post
Like Reply
#5
(26-04-2024, 03:35 PM)Saj890 Wrote: Eki post 3 bar korsen. But nice story.



Oo sorry
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#6
পর্ব -০২

 

অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিক। সকালটা আষ্টেপৃষ্ঠে কুয়াশার চাদরে মোড়া। রাস্তাঘাট শুনশান। থেমে থেমে ডেকে উঠছে পাখিরা। এমনই এক দিনে ধারা যাচ্ছিল কোচিংয়ে। গ্রাম থেকে বেড়িয়ে শহরে প্রবেশমুখে স্টেডিয়ামের পরেই তার কোচিং সেন্টার। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। তাই সকালের হিমবাহুকে ঠেলে সাতটার আগেই বেড়িয়ে পড়তে হয় রাস্তায়। চারিপাশে বিরাজ করছে নিরবতা। মাঝেমধ্যে আবছা ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে টুংটাং করে বেজে উঠছে একটা দু'টা সাইকেলের ঘন্টা। কুয়াশার মধ্যে তাকালেও চোখে পড়ে অস্পষ্ট দৃশ্য। ধারার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের থ্রি পিছ। তার উপরে পেঁচিয়ে নিয়েছে নীল রঙের শাল চাদর। কাঁধে ব্যাগ। মোড়ের মাথাতেই অটোরিকশা ছেড়ে দিয়েছে সে। মোড় থেকে কোচিং সেন্টারের দূরত্ব হাঁটা পথে চার মিনিট। কিন্তু এই চার মিনিটের দূরত্ব গাড়িতে গেলেই হয়ে যায় এক্সট্রা পাঁচ টাকা। গাড়ি চালকদের যতসব টাকা কামানোর ধান্দা। এতটুকু রাস্তার জন্য আবার বারতি পাঁচ টাকা দিতে হবে কেন? অনর্থক খরচ। তাই ধারা প্রতিদিন মোড়ের মাথাতেই নেমে পড়ে। পায়ে হেঁটে চলে যায় বাকি পথ। হাঁটতে হাঁটতে ধারা লক্ষ করলো অন্য দিনগুলোর চাইতে আজ যেন কুয়াশার আধিক্য একটু বেশিই। তার সাথে পাল্লা দিয়ে নিস্তব্ধতাও। পাঁচ হাত দূরত্বের কোন দৃশ্যও স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্তও কোন লোকজনের আলাই বালাই নেই। পিচ ঢালা রাস্তায় পাতা থেকে ঝরে পড়া শিশির বিন্দুর শব্দও যেন কান পাতলে শ্রবণেন্দ্রিয় হয়। ধারার মনে একটু অস্বস্তিপূর্ণ অনুভুতি নাড়া দিল। হাঁটার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিল সে। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে কানে এলো কতগুলো কুকুরের শব্দ। তাদের বিকট ভয়ংকর চিৎকারে মুহুর্তের মধ্যেই যেন খান খান হয়ে ভেঙে গেলো নিরবতা। দল সমেত পায়ের খুড়ের শব্দ জানান দিল এদিকেই দৌড়ে আসছে তারা। শিরদাঁড়া বেঁয়ে একধরণের শীতল শিহরণ নেমে গেল ধারার। কুকুর প্রচন্ড ভয় পায় সে। আতঙ্কিত হয়ে হঠাৎ কি করবে বুঝতে না পেরে সে ফাঁকা প্রশস্ত রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথায় দৌড়ে গেলো। গিয়েই বুঝলো কত বড় ভুলটাই না করে ফেলেছে। ঠিক তখনই কুয়াশা ভেদ করে চার পাঁচ টা কুকুরের হৃষ্ট পুষ্ট শরীর দৃশ্যমান হয়। ধারার দিকেই দুর্নিবার গতিতে ধেয়ে আসছে কুকুরগুলো। আতঙ্কে ধারার শরীর জমে যায়। কোন দিকে সরে যাবার জন্য শক্তিও যেন পায় না সে। কাঁধের ব্যাগ আর চাদর খুলে পড়ে গেছে অনেক আগেই। তবুও এত শীতে ঘাম ছুটে যায় তার। ঘেউ ঘেউ শব্দ করে কুকুরগুলো যখন ধারার অনেক কাছে চলে আসে তখন চোখ বন্ধ করে কানে দু হাত নিয়ে একটা জোরে চিৎকার দিয়েই শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে অবশ হয়ে পড়ে ধারা। ঠিক তখনই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ধারার হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ধারা তখন জ্ঞান শুন্য। কুকুরগুলোও তাকে অতিক্রম করে চলে গেছে অনেক আগেই। শুধু নির্জন রাস্তায় একজন জ্ঞান হারা সুন্দর তরুণীকে নিয়ে বিপাকে পড়ে যায় ছেলেটা। হাতের উপর ভর দিয়ে ধরে রাখা মেয়েটির সুন্দর চেহারা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছেলেটা একবার আশেপাশে ঘুরে তাকালো। সাহায্যের জন্য ডাকার মতো কেউ নেই। এদিকে মেয়েটাকে ছাড়তেও পারছে না। অচেনা একটা মেয়েকে আবার নিশ্চয়ই কোলেও উঠানো যায় না। এখন উপায়? পানি-ই বা কোথায় পাবে? মেয়েটার জ্ঞান যে ফেরাতে হবে। ছেলেটা ধারাকে ধরে রাখা ডান হাত মৃদু ঝাঁকিয়ে এক দুবার ডাকলোও তাকে৷ কাজ হলো না। হঠাৎ ছেলেটার চোখ পড়ল তাদের মাথার উপরের শিউলি গাছটার দিকে। ডালে ডালে শিশির ভেজা অজস্র ফুলের সমারোহ নিয়ে কি সুন্দর নিজেকে সজ্জিত করে রেখেছে গাছটা! কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থেকে ডান হাতেই ধারাকে রেখে বাম হাতটা দিয়ে গাছের একটা ডাল চেঁপে ধরলো সে। হাতের বলপ্রয়োগে মুহুর্তেই আন্দোলন সৃষ্টি করলো পুষ্পশাখায়। একটা মৃদু স্নিগ্ধ ঝঙ্কার তুলে যত্নে জমানো শিশির বিন্দু নিয়ে ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো শুভ্র মাতাল শিউলি ফুলের দল। এ যেন স্নিগ্ধ প্রভাতে মুগ্ধ ছন্দে ঘুমন্ত রাজকন্যার উপর চলছে বিরতিহীন অনিন্দ্য ফুল বর্ষণ। নিজের কোমল মসৃণ ত্বকে বিন্দু বিন্দু জল আর ফুলের শীতল স্পর্শ পেতেই খানিকবাদে কেঁপে উঠে ধারার ঘন চোখের পল্লব। পিটপিট করে চোখের পাতা খুলতেই দেখতে পায় তার মুখের সামনেই কালো জ্যাকেট পরিধেয় করা একটা ছেলের বিরক্তি মাখা মুখ তাকে বলছে,
'এই যে মিস, এবার তো উঠুন। সিনারি টা সিনেমাটিক হলেও সিচুয়েশানটা কিন্তু একদমই সিনেমাটিক না। আমার হাত খুলে পড়ে যাচ্ছে। ট্রাস্ট মি।'

ঝট করে ধারা চোখ মেলে তাকালো। গায়ে তার একটা পাতলা কাঁথা। ঘামে ভিজে শরীরের অবস্থা হয়ে উঠেছে জবজবে। মাথাটা ভীষণ ভার লাগছে। হঠাৎ মাথায় কয়েক মাস আগের একটা স্মৃতি আসলো কেন তার? একটা মুখ কোথাও দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছিল বলে, এই কারণেই কি? ধারা পাশ ঘুরে সোজা হয়ে শুয়ে নিলো। হঠাৎ ঠাওর করতে পারলো না সে আসলে আছে টা কোথায়! বিচলিত দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরতেই হঠাৎ তার নজর একটা ছবির দিকে গিয়ে আটকে গেলো। বিছানা ছেড়ে আস্তে ধীরে নেমে আসলো সে। ধীর পায়ে টিনের বেড়ার গায়ে ঝুলানো ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা ছেলের ছবি। কালো কোট আর ক্যাপ মাথায় দিয়ে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার মুহুর্তের। ছবির নিচে টাইপিং করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা মাহতাব ইসলাম শুদ্ধ। এই ছেলেটাকেই তো কোথায় দেখেছে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে ধারার। হঠাৎ তার মনে পড়লো এটাই সেই শীত সকালে স্টেডিয়ামের কাছে শিউলি গাছের নিচের সেই বিরক্তি মুখো ছেলেটা। এবং ইনি-ই কাল রাতের সেই ব্যক্তি। যার সাথে কিনা ধারার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের কথা মনে পড়তেই ব্যথিত মনে পাশের আয়নায় চোখ পড়তেই ধারা চমকে উঠে। কাল রাতে জ্ঞান হারাবার আগ পর্যন্তও তো তার গায়ে লাল বেনারসি শাড়ি ছিল। সাথে অনেক প্রসাধনীও। কিন্তু এখন তো দেখছি গায়ে শুধু একটা পাতলা সুতি শাড়ি। ধারার শাড়ি পাল্টে দিয়েছে কে? ঐ লোকটাই?

তখনই রুমে গটগটিয়ে প্রবেশ করে শুদ্ধ। ধারার কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখ দেখেই বুঝে যায় কি ভাবছে সে। তাই এসেই বলতে থাকে,
'এতো অবাক হবার কি আছে? আপনার স্বামী তো আপনাকে ছুঁতেই পারে তাই না! নাকি এটাও ভাবেননি। বাবা বলেছে আর ওমনিই বিয়ে করে নিয়েছেন।'

শুদ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ধারা হতবিহ্বল। 
__________________________________________

খোদেজা আজ মহাখুশি। তার একমাত্র ছেলের বিয়ে যে সে এমন ভালো ঘরে দিতে পারবে তা হয়তো কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। 
ছেলের জন্মের আগেই তার স্বামী মারা যায়। স্বামী ছাড়া একা হাতে ছেলেকে মানুষ করা সহজ ছিল না। কিন্তু এই কঠিন কাজটাই তিনি সম্ভব করেছিলেন। বরং ভালো মতোই করেছেন। যুবতী বয়সেই বিধবা হওয়ায় সবাই যখন তাকে দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন তিনি এর পরিবর্তে প্রথম স্বামীর স্মৃতি নিয়েই বাকি জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। তা যতই কঠিন হোক না কেন। এ কারণেই গ্রামের মানুষও তাকে একপ্রকার সমীহ করে। ছেলেকে মানুষ করেছেন এখন একটা ভালো সম্বন্ধ দেখে বিয়েও দিতে পেরেছেন। তিনি এখন দুশ্চিন্তামুক্ত। তার উপর এতো বড় ঘরের মেয়ে! মেয়েটাকে একদিন রাস্তায় অটোর মধ্যে দেখেছিল খোদেজা। দেখেই তিনি মেয়েটাকে পছন্দ করে বসেন তার একমাত্র ছেলের জন্য। মেয়ে তো দেখতে মাশাআল্লাহ! এর পরপরই এই মেয়ের ঠিকানা বের করে ফেলে একটা ঘটকের সাহায্যে প্রস্তাব পাঠিয়ে দেন খোদেজা। তখনও তিনি জানতেন না মেয়েদের অবস্থা এতো ভালো। যখন জানলেন তখন একপ্রকার চমকেই গিয়েছিলেন। আরো বেশি চমকান যখন জানতে পারেন মেয়ের বাবা রাজী হয়ে গেছেন। নয়তো আশা তো একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিল খোদেজা। তাই আর দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন তিনি। গ্রামের কম বেশি সব মহিলারাই আজ তার ছেলের বৌকে দেখতে এসেছে। বৌ দেখে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। খোদেজার বুক গর্বে উঁচু হয়। তখন পাশের বাসার হাসুর মা এসে খোদেজাকে মনে করায় নতুন বৌকে দিয়ে কিছু নিয়ম কানুন পালন করা বাকি আছে। খোদেজার পছন্দ হয় না। এত নিয়ম কানুনের ভারে পাছে তার ছেলের বৌটার কষ্ট না হয়। কিন্তু উপায় নেই। গ্রামের মহিলাদের সামনে একটা কথা বললে দশটা কথা বানাবে। মনের বিরক্তি মনেই রেখে খোদেজা অন্যদের ব্যবস্থা করতে বলে নিজেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

গ্রামের মহিলাগুলো যখন নিয়ম পালনের যোগাড় যন্ত্রে ব্যস্ত তখন এক কোণে একটু হাফ ছেড়ে দাঁড়ায় ধারা। এতক্ষণ একটানা বসে থাকতে থাকতে তার কোমর ধরে এসেছে। পরনে তার একটা সিল্কের কমলা রঙের শাড়ি। মাথার ঘোমটা টা আরো একটু টেনে নিয়ে যখনই একটু সোজা হয়ে দাঁড়ায় তখন হঠাৎ সেখানে এসে দাঁড়ায় শুদ্ধ। কোন হেঁয়ালি না করেই বলে,

'কিছু ভেবেছেন?'

শুদ্ধ'র এমন আকস্মিক আগমনে ধারা চমকে উঠে। এতটুকু সময়ের অভিজ্ঞতাতেই এই লোকটাকে কিছুটা ভয়ই পায় ধারা। আবারও না কিছু বলে বসে তাই দ্রুতই মৃদু স্বরে উত্তর দেয়,

'কি?'

'কি বলবেন?'

ধারা অবাক হয়ে বলে, 'কি বলবো?'

শুদ্ধ ঠান্ডা ভাবেই বলে, 'আপনি তো বিয়েতে রাজি না। তাই আমাদের একসাথে থাকারও কোন মানে হয় না। আজকে তো নিয়ম অনুসারে আপনার সাথে আমার আপনাদের বাড়ি যাবার কথা। আমি ঠিক করেছি আমি এখন কিছু একটা বাহানা দিয়ে যাবো না। আপনি একাই যাবেন। আপনাকে আনতে যেতেও আমি যাবো না। ততক্ষণে নিশ্চয়ই আত্মীয় স্বজনরাও সব কমে যাবে। বিয়ের আগে কিছু বলতে পারেননি, এখন বলবেন। বলবেন, আপনার এই বিয়েতে মত ছিল না। আমার সাথে থাকা আপনার পক্ষে সম্ভব না।'

ধারা স্তব্ধীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শুদ্ধ বলতে লাগলো, 'মনে রাখবেন প্লিজ, আমি কিন্তু আপনাদের বাড়িতে যাবো না। আপনি আপনার বাবাকে আপনার সমস্যাটা খুলে বলবেন।'

মূর্তির মতো অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে ধারা বলার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। যতটা সহজ ভাবে লোকটা বলল পারতপক্ষেই কি ধারার জন্য সবটা এতোটাই সহজ?

চলবে**********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 2 users Like Bangla Golpo's post
Like Reply
#7
পর্ব-৩


মাটির খোলা পাত্র জুড়ে পানিতে সাঁতরে বেড়াচ্ছে একটা কালসেটে মাঝারি সাইজের মাছ। নিজের ক্ষুদ্র লেজের ক্ষমতা দেখিয়ে কম্পন সৃষ্টি করে তুলছে পানিতে। কখনো পাতিলের এই প্রান্তে দেখা যাচ্ছে তো আবার ছুট দিয়ে নিমিষেই পালিয়ে যাচ্ছে অপর প্রান্তে। এই ক্ষুদ্র পরিসর ভেদ করে বৃহত্তরে গমনের জন্যই যেন তার যত কারসাজি। এর আঞ্চলিক নাম টাকি মাছ। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য পুকুর থেকেই ধরে আনা হয়েছে। আর আনা হবেই বা না কেন! নতুন বৌকে আজ এই মাছ দিয়েই যে ভবিষ্যৎ সংসার পালনের দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। ধারা আনত মুখে কলের পুতুলের মতো চুপচাপ বসে আছে মাটির পাতিলটির সামনে। একটা মোটা গড়নের মহিলা তার খসখসে গলায় ধারাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
'শোন বউ, এহন এই মাছটা তোমারে হাত দিয়া ধরতে হইবো। তাও কিন্তু এক খাবায়। এক খাবাতেই যদি তুমি এই মাছরে ধরতে পারো তাইলেই বোঝা যাইবো যে তুমি সংসার খুব ভালো মতো সামলাইতে পারবা। আর যদি না পারো হের মানে হইবো তোমারে দিয়া কিছু হইবো না। 
আমড়া কাঠের ঢেঁকি 
পারে না কিছুই মেকি।'

উপস্থিত সবাই সেখানে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বিরক্তিতে খোদেজার কপাল কুঁচকে গেলো। এইসব কোন কথা! এইসব নিয়ম কানুন পালন হতো তাদের জমানায়। ভুলেও কোনটায় ব্যর্থ হলে একেকজনের কথা শুনতে শুনতে কান পঁচে যেত। এখন কি আর সেই সব দিন আছে। আজকাল মেয়েদের দিয়ে এসব কি না করালেই নয়! কিন্তু কে বলবে এইসব কথা? খোদেজা যদি এখন কিছু বলে সবাই বলবে খোদেজা আদিখ্যেতা করছে। তাই এখন মুখে কুলুপ এটে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। শুদ্ধ সেখানে ছিল না। এই মাত্রই একটা জরুরী কাজের জন্য বাইরে বেড়োবার প্রয়োজনে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। জোবেদা যেতে দিল না। পথ আটকালো। দু মিনিট দাঁড়িয়ে দেখে যেতে বলল নিয়মটা। এসব কুসংস্কারের প্রতি আগ্রহ শুদ্ধ'র কোন কালেই ছিল না। তবুও দাঁড়াতে হলো মায়ের জোরাজুরিতে। ধারার তখন নার্ভাসে জমে যাবার অবস্থা। কতগুলো চোখ একসাথে বিদ্ধ হয়ে আছে তার দিকে! মহিলাটার কথাগুলো গুরুতর ভাবেই নিয়ে ফেলেছে ধারা। সত্যিই যদি মাছটা প্রথম চেষ্টাতেই ধরতে না পারে! তখন? কপালের কার্ণিশ বেঁয়ে তার এক ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ল। ভীতিগ্রস্ত মুখেই দ্রুত পানিতে একটা থাবা দিয়েই সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। হাতে একধরনের শীতল অস্তিত্বের অনুভূতি পেতেই চোখ খুলে দেখলো তার হাতের তালুর মধ্যেই বদ্ধ হয়ে পড়েছে মাছটা। মাছটা সবার সামনে উঁচু করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ধারা। উপস্থিত সবাইও যেন স্বস্তি পেলো। শুধু সেখানে উপস্থিত একজনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। 
__________________________________________

আসমা সকাল থেকেই ভীষণ ব্যস্ত। মেয়ের বিয়ে মানে যে কত শত কাজ তা গ্রামের মহিলাদের থেকে ভালো আর কে বুঝে। আজকে মেয়ে আর মেয়ের জামাই আসবে তাদের বাড়ি। রান্না বান্নার হিড়িক লেগেছে তাই। নিয়ম অনুযায়ী আজকে বৌ ভাত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ধারার বাবাই বলেছে শুধু শুধু অনর্থক ঝামেলা করার কোন দরকার নেই। আসল কারণ হলো তিনি চান বিয়ের এই হৈ চৈ তাড়াতাড়ি মিটে যাক। যতটুকু করার প্রয়োজন ছিল ততটুকুই তিনি করেছেন। যেগুলো না করলেও হয় সেগুলো বাদ যাক। ধারাকে আনতে যেতে শুধু কিছু লোক পাঠিয়েছেন। বিয়ের পর তো প্রথম মেয়েকে বাবাকেই আনতে যেতে হয়। সেটাও যায়নি আজিজ সাহেব। আসমার চিন্তা হয়। না জেনো ধারার শ্বশুর বাড়ির লোক খারাপ ভেবে বসে! কিন্তু এসব কথা কাউকে বোঝাবে কে? আসমার কথার কোন গুরুত্ব এই বাড়িতে নেই। এই সংসারে আসমার অবস্থান অনেকটা গাছের মতো। যে যা বলবে চুপচাপ শুধু খেটে যাবে। নিজের থেকে কোন মতামত দিবে না। আসমার ভীষণ ক্লান্ত লাগে। সব কিছু এমন ভাবে তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো! ইচ্ছা হয় একটু বসে মেয়ের সাথে কথা বলার। কিন্তু সেই উপায় এই মুহূর্তে নেই। আসমার শ্বাশুড়ি জমিরন বিবি দাওয়ার উপরই বসে আছেন। কোন ভুল হলে তার কথা থেকে ছাড় পাওয়া মুশকিল। জমিরন বিবির বয়স প্রায় আশি'র কোঠায় পৌঁছেছে। তবুও তেজ যেন এতটুকুও কমেনি। এখনও সংসারের ব্যাপারে ছেলেদের পরে তারই একরত্তি শাসন চলে। শ্বাশুড়ির কাছে আসমা এখনও সেই নতুন বৌটির মতোই। আসমা একবার সেদিকে তাকিয়ে বটি নিয়ে কামরাঙা কাটতে বসলো। অর্ধেক কাটা হতেই সেই কামরাঙার উপর এসে হামলা চালায় ধারার ভাই রাতুল। এই বার ক্লাস সেভেনে উঠেছে সে। মেয়েদের মতো টক খাওয়ার ভীষণ পাগল। দাদীর একপ্রকার চোখের মণিই সে। রাতুল যখন একের পর এক কামরাঙার টুকরো মুখে তুলে গোগ্রাসে গিলছে তখন তাতে বাধা দেয় আসমা। বলে,
'সব এখনই খেয়ে ফেলবি! তোর বোনের জন্য কাটতাছি এগুলা। ধারা কত পছন্দ করে! ধারা আগে আসুক। ও'র খাওয়ার পর থাকলে তারপর খাস।'

দাওয়া থেকে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে শুকনো খনখনে গলায় খেঁকিয়ে উঠেন জমিরন বিবি। বলতে থাকে,
'পোলাডা কতখন পর আইয়া একটা জিনিস খাইতে চাইতাছে হেইডাতেও তোমার আপত্তি! কেমন মা তুমি?'

আসমা বলে, 'আম্মা, কামরাঙা আর গাছে নাই। গাছ থেকে মাত্র পাইড়া আনছি। এই চারটাই ছিল।'

'তাতে কি হইছে? মাইয়া কি তোমার দশ বছর পরে আইতাছে? এতদিন খায় নাই। শ্বশুরবাড়ি গেলো তো মাত্র একদিন ধইরা। পোলারেই খাওয়াও। এই পোলাই পরে কামাই কইরা খাওয়াইবো। আমাগো বংশের বাতি। মাইয়া কোন কামে দিবো না। হেরা হলো পরের আমানত। বুঝছো?'

আসমা কি বুঝলো কে জানে! কারণ বোঝার আগেই ভেতর থেকে খবর এলো ধারা এসে পড়েছে। আসমা আর রাতুল দুজনেই খুশি মনে বাড়ির ভেতর ছুটে গেলো। জমিরন বিবিও প্রসন্ন মুখে ভেতর ঘরে উঁকি দিলেন। প্রকৃতপক্ষে ধারার বিয়ে হওয়ায় সবথেকে বেশি খুশি তিনিই হয়েছেন। তার মতে, মাইয়া মানুষ সেয়ানা হইলে কলঙ্ক ছায়ার মতো পেছন পেছন ঘুরতে থাকে। আর একবার যদি কোন কলঙ্ক লাইগা যায় তাইলে সেই মাইয়ার বিয়ে দিতে বাপের দফা রফা অবস্থা হয়। এর জন্য মাইয়া মাইনষের বিয়ে তাড়াতাড়িই হইয়া যাওয়াই ভালো। জমিরন বিবি তো আরো কত আগের থেকেই চাচ্ছিলেন ধারার বিয়ে হয়ে যাক। তার ছেলেগুলা বেশি বোঝে বলেই এতদিন তার কথা শুনেনি। আজ অবশেষে তার প্রার্থনা কবুল হলো। সন্তুষ্টি চিত্তে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি লাঠি হাতে খটখট করতে করতে ভেতরের দিকে চললেন।
_________________________________________

শুদ্ধদের বাড়ির পাশেই একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুরের স্বচ্ছ জল দেখলেই চক্ষু শীতল হয়। পাড় ঘেঁষে চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ বৃক্ষের দল। পানির মাঝখানে কিছু কচুরিপানা নিজেদের মধ্যে বেগুনী রঙের ফুল ধারণ করে হয়ে আছে স্থির ভাসমান। ঘাটের পাশেই একটা হিজল গাছ। ডালের ভারে পুকুরের উপর হেলে আছে যেন। সেই গাছের গুঁড়িতে বসেই আনমনে পানির দিকে তাকিয়ে আছে শুদ্ধ। তার হাতে একটা ছোট্ট তেঁতুল গাছের ডাল। বেখেয়ালি ভাবে সেই ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে পুকুরের পানিতে ফেলছে সে। তখন সেখানে কচুরিপানার উপর দুটো সাদা বক এসে বসলো। দেখে মনে হচ্ছে জোড়া বক। এদিক ওদিক তাকিয়ে মাছের খোঁজ করছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুদ্ধ। আর পাঁচটা ছেলেদের মতো বিয়ে নিয়ে তারও অনেক শখ আহ্লাদ ছিল। এই জীবনে কখনো অন্য মেয়েদের দিকে তাকায়নি। এতো এতো সুযোগ পেয়েও জড়ায়নি কোন প্রেমের সম্পর্কে। নিজের সবটুকু ভালোবাসা শুধু স্ত্রীর জন্যই বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। ভেবেছিল বিয়ের পর নিজের বউকে প্রচুর ভালোবাসবে। কখনো কোন অভিযোগের সুযোগ দিবে না। কিন্তু এখন সব ভিন্ন। এ কারণেই ধারার উপর প্রচুর রাগ হয়েছিল তার। ধারার যদি বিয়েতে মত নাই ছিল সেটা সে তার বাবাকে খুলে বলল না কেন? ধরে বেঁধে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া এক কথা। কিন্তু ধারা তো তার বিয়ের জন্য বাবাকে কোন বারণই করেনি। দোষটা তাহলে হলো কার? শুধু ধারার একটু সাহসের অভাবের জন্যই আজ দু দুটো জীবন এলোমেলো হয়ে পড়লো। 

ছেলেকে অন্যমনষ্ক হয়ে ঘাটপারে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে খোদেজা। পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, 'কিরে মাহতাব, এই ভরদুপুর বেলা ঘাটপাড়ে বইসা আছোস কেন?'

শুদ্ধ বলল, 'এমনিই আম্মা।'

'বউ'র সাথে কথা হইছে?'

এই প্রশ্নের উত্তরে শুদ্ধ ঘুরিয়ে বলল, 'তুমি এদিকে কি করো? নামাজ পড়বে না?'

'তা পড়বো। তুই বউ'র সাথে গেলি না কেন বল তো? বউরে একা একাই পাঠায় দিলি। কি ভাববে ঐ বাড়ির লোকজন! বললি যে তোর নাকি দরকারী কাজ আছে। বউ গেছে দু দিন হয়ে গেলো। কই তোর কোন দরকারী কাজ তো দেখতাছি না। বসেই তো আছোস।'

'আমার ওখানে কোন প্রয়োজন নেই। তাই যাই নি।  
কাজ আছে। তুমি বুঝবে না।'

খোদেজা বাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, 'ঠিকই বলছোস। তোদের ব্যাপার স্যাপার আমি আসলেই বুঝি না। কি জানি বাপু!'

খোদেজা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই পুকুরের পান্না ঘেঁষে একটা মাছ লাফিয়ে উঠলো। খোদেজাকে দেখার জন্য ডাকতে গিয়েও শুদ্ধ ডাকতে পারলো না। ও'র হঠাৎ ধারার মাছ ধরার কথা মনে পড়ে গেলো। ধারা গ্রামের মেয়ে। মাছ ধরা নিয়ে তার অপটু হবার কথা না। তবুও মাছ ধরার আগে এতোটা নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল কেন সে? আড়াআড়ি ভাবে বুকে দু হাত গুঁজে চিন্তামগ্ন শুদ্ধ ভাবতে লাগলো, ব্যাপারটা কি?
__________________________________________

জমিরন বিবির প্রথম থেকেই খটকা লাগছিল। সময় যতটা গড়াতে লাগলো মনের খুতখুত ভাবটা আরো বাড়তে লাগলো তার। ধারার মতিগতি ঠিক লাগছে না তার কাছে। প্রথমে তো জামাই ছাড়া একা একাই এসে পড়লো শ্বশুড় বাড়ি থেকে। তার উপর মুখটা এই দুই দিন যাবৎ এমন ভাবে ভার করে রেখেছে যেন পৃথিবীর সব দুঃখ তার মাথার মধ্যে এসে ভর করেছে। আজকে তো জামাইয়ের নিতে আসার কথা। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। কই এখনও তো আসছে না! ব্যাপারটা কি?
শেষের ব্যাপারটা শুধু জমিরনের নয় সকলের মাথাতেই এসেছে। সাঁঝ হয়ে আসছে তবুও তো তাদের মেয়েকে নিতে জামাই আসছে না। একসময় আজিজ তালুকদারকেই বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাতে হলো। মেয়ে দুই দিন ধরে এসেছেন। এখনও পর্যন্ত কোন কথাও বলেননি তিনি মেয়ের সাথে। তার রাগ এখনও কমেনি। কিন্তু এখন কথা আর না বললেই নয়। অগত্যা আর কোন উপায় না দেখে তিনি মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। বাবা ডেকে পাঠিয়েছে শুনেই ধারার ঘাম ছুটে গেলো। এই দুই দিন ধরে এই চিন্তাতেই সারা রাত ঘুম হয়নি তার। লোকটা তো বার বার করে বলেই দিয়েছে সে আসবে না। এখন এই কথাটা বাবাকে কিভাবে বলবে ধারা? তার উপর যদি কেউ শুনে যে ধারার ও বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি করে বিয়েতে রাজী না থাকার কথা বলার জন্যই এসব হচ্ছে তাহলে তো ধারা বোধহয় আজকে আস্তই থাকবে না। ভয়ে ও'র ইচ্ছা করছে কোথাও নির্জনে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে। ছোট থেকেই পড়ালেখার উপরই ছিল ধারা। পড়ালেখা ছাড়া প্রেম, ভালোবাসা, ছেলে কোনকিছুতেই কখনো নজরও দেয়নি। আজ পর্যন্ত কোন রোমান্টিক গান খেয়াল করে শুনেছে কিনা তাতেও সন্দেহ। সব সময় শুধু জানতো ওকে পড়তে হবে, অনেক পড়তে হবে। অন্য কিছু নিয়ে ভাববার আর সময় কই! বিয়ে ব্যাপারটা সব সময়ই ছিল ও'র সমস্ত চিন্তা ভাবনার বাইরে। সাধারণত মেয়েরা চৌদ্দ পনেরো তো পড়লেই বিয়ে নিয়ে তাদের ভাবনা কাজ করে। কত রং বেরঙের স্বপ্নও সাজায়। কিন্তু এসব নিয়ে কখনোই কিছু ভেবে দেখেনি ধারা। তাই জীবনে হঠাৎ করেই এই বিয়ে নামক পরিবর্তনে ধারা ঘাবড়ে যায়। মানতে পারেনি। নেহাৎ সেকারণেই হয়তো বাসর রাতে একটু বেশিই ভেঙে পড়েছিল সে। এ কারণে লোকটা এভাবে বলে দিবে সে আর ধারাকে নিতে আসবে না! ধারাকে সবটা মিটমাট করে নিতে হবে। আদৌও কি এতো ক্ষমতা আছে ধারার? সবার মতো সেও জানে যাই হয়ে যাক তার আশ্রয় এখন ঐ শ্বশুরবাড়িই। তাকে সেখানেই থাকতে হবে। কিন্তু ঐ লোকটা তো ধারাকে নিতেই আসবে না।

নত মুখে আস্তে আস্তে ধারা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গোমড়া মুখে আজিজ সাহেব প্রশ্ন করেন,

'তোমার স্বামী এখনও আসছে না কেন? কারণ কি?'

ধারার গলা শুকিয়ে আসে। এমনিতেও বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক মতো কথাও বলতে পারে না সে। আর আজকে তো...!
অনেকক্ষণ হয়ে যায় ধারা কিছু বলে না। এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে জমিরন বিবি পেছন থেকে খেঁকিয়ে উঠে,
'আমি তোরে আগেই কইছিলাম আজিজ, কিছু একটা ঘাবলা আছে। তোর মাইয়া এমন চুপ কইরা আছে কে জিগা। জামাই আসার সময়ও আসলো না আবার এহনও আসতেছে না এর কারণডা কি?'

ধারা মাথা নিচু করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবা এমনিতেও অনেক রাগী। তার উপর আজকে দাদীও আছে। কি বলবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে। আসমা মাথায় ঘোমটা টেনে মেয়ের দিকে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। আসলেই কি কিছু হয়েছে? ধারা এমন করছে কেন? মেয়ের জন্য মনে মনে আসমা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলো। সব যেন স্বাভাবিকই থাকে। নয়তো আজ তার মেয়ের কপালে কি আছে কেউ জানে না।'

জমিরন বিবি বলেই যেতে লাগলেন, 'আমি আগেই বুঝছি কিছু একটা হইছে। জামাই নাইলে আসবো না কেন? নিশ্চয়ই এই মাইয়াই কিছু করছে। ওরই দোষ। এমন অকর্মা মাইয়া। দুই দিনও সব ঠিক রাখতারলো না! এই ধারা কস না কেন? ঐ বাইত্তে আবার কি কান্ড কইরা আইছোস যে তোরে নিতে পর্যন্ত কেউ আসতাছে না।'

মায়ের কথায় আজিজ সাহেব খুব একটা কান দেন না। তার মায়ের স্বভাবই ছোট খাট বিষয় নিয়ে হৈ চৈ করা। তবে আজকের ব্যাপারটা ফেলে দেবার মতো না। তাই মাকে না থামিয়ে তিনি মেয়েকে শীতল কন্ঠে বললেন,

'তোমাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন আসছে না?'

ধারার শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভয়ের চোটে চোখের কার্ণিশে জলও জমতে শুরু করছে তার। গলা দিয়ে যেন কোন আওয়াজও বের হতে চাচ্ছে না। বার বার হাত দিয়ে ডান চোখের পাশ টা ঘঁষছে ধারা। আজিজ তালুকদার আগের থেকেও গম্ভীর ভাবে বললেন,

'কি হলো বলছো না কেন?

আরো একবার কপালের কার্ণিশটা ঘষে ধারা কাঁপা কাঁপা গলায় কোনমতে বলল,
'বাবা! ঐ...সে...আসলে....আসবে...

ধারাকে চমকে দিয়ে ঠিক তখনই পেছন থেকে স্বল্প পরিচিত একটা স্পষ্ট ভরাট কণ্ঠস্বর হঠাৎ ডেকে উঠলো,

 'ধারা!'

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 2 users Like Bangla Golpo's post
Like Reply
#8
পর্ব-৪




একটু রাত হতে না হতেই চারিদিক নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু ধারে ধানের ক্ষেত। তার মধ্যে থেকে মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে একটা দুটো শেয়ালের দল। এমন একটা পরিবেশে গ্রামের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে শুদ্ধ আর ধারা। আজ বিকেলে শুদ্ধকে ও বাড়িতে দেখেই সবাই আনন্দে আটখানা হয়ে যায়। যাক অবশেষে তাদের জামাই এসেছে। আজিজ সাহেব খানিক কুশল বিনিময় করেই সেখান থেকে চলে যান। সবথেকে বেশি খুশি হয় আসমা। জমিরন বিবিও একটু স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলেন। হতভম্ব হয় থাকে তো শুধু ধারা। নিজের চোখকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্বাসই হয় না তার। আরো বেশি চমকে উঠে যখন শুদ্ধ ধারার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

'যাবেন না ধারা? আপনাকে আমি নিতে এসেছি।'

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য কথাই বন্ধ হয়ে যায় ধারার। হুঁশ তো ফিরে তখন, যখন জামাইকে এখনও বসতে দিচ্ছে না বলে জমিরন বিবি ধমক লাগায়। এরপর শুরু হয় গ্রামীণ সংস্কৃতির জামাই আদর। শুদ্ধকে না খেতে আসতেই দিল না আসমা আর জমিরন। অগত্যা এই অবেলায় খানা পিনার পর্ব সমাধা করতে হয় শুদ্ধকে। খাওয়া দাওয়া করে ফিরতে ফিরতেই হয়ে যায় রাত। সম্ভবত সাতটা আটটা বাজে। কিন্তু গ্রামের রাস্তায় তো এতটুকু রাত মানেই অনেক। তাই রাস্তায় বেড়িয়ে আর কোন গাড়ির দেখা পেলো না তারা। একটা ভ্যান পেয়েছিল সেটা শুধু মেইন রাস্তাটুকুই পার করে দিয়ে গেছে তাদের। এখনও অর্ধেকের মতো পথ বাকি। হয়তো হাঁটা পথেই আজ পার করতে হবে। দুজনেই চুপচাপ। ধারার সমস্ত ধ্যান রাস্তা দেখে হাঁটায়। যেই অন্ধকার! শুদ্ধ খানিকটা অন্যমনষ্ক। কিছু একটা যেন গভীরভাবে মনে মনে ভাবছে সে।

শুদ্ধ'র ভাবনায় ছেদ ঘটে হঠাৎ একটা ধপাস জাতীয় শব্দে। পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে ধারা রাস্তার পাশে বসে আছে। ভালো করে লক্ষ করে দেখলো আসলে বসে আছে না, পড়ে গেছে। রাস্তার পিচ উঠে গর্ত হয়ে ছিল। সেখানে পানি জমে কাঁদার মতো পিচ্ছিল হয়ে আছে। গর্তটা রাস্তার একদম কিনারে। এতো সাবধানে হেঁটেও কিভাবে যেন সেখানেই পা পড়ে যায় ধারার। আর তারপর ধপাস। শুদ্ধ দ্রুত ধারার দিকে এগিয়ে গেলো। ধারা মনে করলো এই বুঝি লোকটা আবারও কথা শুনাবে। কিন্তু ধারার ধারণা ভুল করে শুদ্ধ ঝুঁকে নরম স্বরেই বলল,

'পড়ে গেলেন কিভাবে?'

কাঁচুমাচু মুখে ধারা একবার শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে উঠার চেষ্টা করে। কিন্তু উঠতে যেতেই আবারও পা পিছলে পড়ে যায়। শুদ্ধ বলে, 

'এভাবে হবে না। দেখি আপনার হাত দিন। আমার হাত ধরুন।'

শুদ্ধ'র বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে ধারা আস্তে করে নিজের হাত দেয়। ধারার হাতও কাঁদায় পড়েছিল বিধায় তার হাতও পিচ্ছিল হয়ে আছে। শুদ্ধ শক্ত করে ধারার হাত চেঁপে ধরে বলল, 'এবার উঠুন।'

এবারও উঠতে যাবার সময় পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে যেতে নিল ধারা। কিন্তু এবার আর শুদ্ধ পড়তে দিলো না। শক্ত করে হাতটা আগলে ধরে রাখলো। 
ধারা উঠে দাঁড়াল। দু পা কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেছে তার। শাড়ি উঁচু করে একবার পায়ের দিকে তাকালো সে। শুদ্ধ দেখে বলল, 

'এদিকে আসুন।'

রাস্তার ধারেই ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে মাটির আল দিয়ে পানি যাওয়ার জন্য ড্রেনের মতো বানানো হয়েছে। ধারার হাত ধরে শুদ্ধ সাবধানে পা ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে যেয়ে সেখানেই নিয়ে গেলো তাকে। স্বচ্ছ পানির ধারার কাছে ধারাকে দাঁড় করিয়ে বলল, আপনার শাড়ির পাড় উঁচু করুন। ধারা খানিকটা উঁচু করলো। বুঝতে পারলো না লোকটা কি করতে চাইছে। আগ বাড়িয়ে কিছু বললোও না। ধারাকে মাটির আলের উপর দাঁড়া রেখে শুদ্ধ নিজের দু হাত একত্রিত করে পানি তুলে ধারার পায়ে দিতে লাগলো। ধারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শুদ্ধ'র দিকে। এই লোকটাকে একদমই বুঝতে পারছে না ধারা। সাধারণ ব্যাপারে রাগ হয়ে যায় আর এখন রাগ করার ব্যাপারেও রাগছে না। বলল যে, ধারাদের বাড়িতে যাবে না। কিন্তু সঠিক সময়েই গিয়ে উপস্থিত হলো। বাঁচিয়ে দিলো ধারাকে। আল্লাহ রক্ষা করেছে যে গিয়েছে। নয়তো আজ ধারার যে কি হতো! 

আল থেকে নেমে রাস্তায় উঠতে গিয়েই আবার ধারার জুতো ছিঁড়ে গেলো। ধারা থতমত খেয়ে একবার আড়চোখে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। শুদ্ধ ঠায় দাঁড়িয়ে ধারার পায়ের দিকেই তাকিয়ে আছে। ধারা ছেঁড়া জুতো টেনেই হাঁটতে নিলে থামিয়ে বলল, 'নিন, আমার জুতো পড়ুন।'
এই বলে খালি পা হয়ে নিজের জুতো জোড়া খুলে দিল। শুদ্ধ'র বড় বড় জুতোর মধ্যে নিজের ছোট পা গলিয়ে দিয়ে ধারা মনে মনে নিজের ভাগ্যের উপর ভীষণ বিরক্ত হলো। সব দূর্ঘটনা কি আজকেই ঘটতে হলো!  

কিছুটা পথ পেড়িয়ে গিয়ে আবারও শুদ্ধ খেয়াল করলো ধারা পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। জিজ্ঞেস করলো, 'আপনার পায়ে কি হয়েছে? এভাবে হাঁটছেন যে!'
ধারা মনে মনে একটা ঢোক গিললো। পায়ে তার কাঁটা বিঁধেছে অনেক আগেই। হয়তো যখন পড়ে গিয়েছিল তখনই। এতক্ষণ কিছু বলেনি। কি আর বলবে! একটার পর একটা সমস্যা তো তার সাথে লেগেই আছে। শুদ্ধ জিজ্ঞেস করায় মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বলল, 'পায়ে কাটা বিঁধেছে।'
বলেই ভীত ভীত চোখে একবার আস্তে করে শুদ্ধ'র প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করলো। শুদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়ে ভ্রু কুঁচকে সোজা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ধারাকে তাকাতে দেখে থমথমে গলায় বলল,

'আমার জুতা খুলুন।'

ধারা ঘাবড়ে গিয়ে ঝটপট জুতা খুলে দিল। তাকে নিয়ে একটু হাঁটতে গিয়েই এতো এতো সমস্যা হচ্ছে। এইবার বুঝি লোকটা নিজের জুতা নিয়ে তাকে মাঝ রাস্তায় ফেলে চলেই যাবে। জুতো খুলে পাশে সরে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল ধারা। শুদ্ধ গটগট করে নিজের জুতো পড়ে নিল। ধারা মাথা নিচু করেই রইলো। হঠাৎ ধারাকে চমকে দিয়ে শুদ্ধ ধারাকে কোলে তুলে নিল। ভূত দেখার মতই চমকে উঠলো ধারা। এরকম কিছু একটা শুদ্ধ করবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। ধারার বড় বড় হয়ে যাওয়া অপলক চক্ষুযুগল এখন শুদ্ধ'র দিকেই নিবদ্ধ। কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই এই একগুঁয়ে, নাক উঁচু লোকটার। কুঞ্চিত ভ্রুদ্বয় সামনের দিকে তাক করেই নিজ গতিতে হেঁটে যাচ্ছে সে। সত্যিই কি এই এতোটা পথ এভাবেই পায়ে হেঁটে ধারাকে কোলে করে নিয়ে যাবে লোকটা?

বাড়ি পৌছাতেই খোদেজা ছেলের সাথে ভীষণ রাগ দেখালো। ধারা নতুন বউ। এভাবে রাত করে বাড়ি ফেরাটা মোটেও ঠিক হয়নি তাদের। বিশেষ করে রাস্তার মাথার ঐ বটগাছটার নিচের জায়গাটা একদমই ভালো না। গতবছর ওখান থেকেই তাদের গ্রামের রহিমার উপর জ্বীনের আছর হলো। শুদ্ধদের বাড়িটা পুরনো দোচালা ঘরের মতো। নিচের তলার চারিপাশে ইট দিয়ে ঘেরাও করা। দু পাশে বারান্দা। মাঝখানে রুম। সাধারণত গ্রামের বাড়িগুলো যেরকম হয়। মাঝের থেকে উপরের দিকে একটা সরু কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে। মাঝখানের বেড়াগুলো টিনের। মেঝে পাকা। আর উপরের তলাটা সম্পূর্ণই টিনের। মেঝে কাঠের। উপরের তলায় বড় অংশ জুরে ঐ একটাই রুম। সেখানেই শুদ্ধ থাকে। রুমের বাইরে কাঠ দিয়েই ঘেরাও করে ছোট বারান্দার মতোই বানানো হয়েছে। সেখানে গাঢ় লাল, হলুদ, সবুজ রং করায় চকচক করছে। খোদেজার শ্বশুরের আমলের ঘর। এককালে তাদের অবস্থাও ভালোই ছিল। তার স্বামী মারা যাবার পরই সব থেমে যায়। এখন আশা আছে তার ছেলে তাদের সংসার বড় করে তুলবে। ধারা খোদেজার রুমে একাই বসা ছিল। খোদেজা গেছে ছেলের পেছন পেছন। তখন সেখানে আসলো পনের বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটার নাম চুমকি। শুদ্ধ'র মামাতো বোন। স্বভাব চঞ্চল। বাবা মা দুজনেই মারা যাওয়ায় এখন শুদ্ধদের সাথেই থাকে। মেয়েটি
এসেই ধারাকে জাপটে ধরে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, 'কেমন আছো নতুন ভাবী?'

ধারা স্মিত হেঁসে মাথা নাড়িয়ে বলে সে ভালো আছে। হঠাৎ তার চোখ যায় খোদেজার রুমের দেয়ালে। সেখানেও শুদ্ধ'র রুমের মতো কালো কোট, ক্যাপ পড়া শুদ্ধ'র একটা ছবি। ধারা চুমকিকে জিজ্ঞাসা করে, 'আচ্ছা চুমকি ওটা কার ছবি?
চুমকি বলল, 'মাহতাব ভাইয়ের।'
'আসল?'
'হুম।'
'না মানে ছবিটা কি কোন ইডিট করা হয়েছে?'
'না তো। এইটা তো শুদ্ধ ভাইয়ের সেদিনের ছবি যেদিন ভাইয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সব পড়ালেখা শেষ করে ফেলেছিল।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা শুনে ধারা অবাক হয়। বলে, তোমার ভাইয়া পড়ালেখা করেছে? কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে?'

এরপর চুমকির থেকে সে যা শুনতে পায় তার সারমর্ম অনেকটা এই, 'শুদ্ধ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট থেকে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে গ্রাজুয়েশন কম্প্লিট করেছে। গ্রাজুয়েট হওয়ার পর প্রথাগত চাকরীর পেছনে না ছুটে ভিন্ন কিছু করতে চাইছে। সে কৃষি উদ্যেক্তা হতে চায়। পড়ালেখা শেষ করার পর দেঢ় বছর যাবত সে এসব নিয়েই আছে।

চুমকির কথা শুনে ধারা সত্যিই অবাক না হয়ে পারলো না। তাদের গ্রামের মধ্যেও কেউ কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা দিতে পারেনি। আর সেখানে শুদ্ধ....! আর ধারা কিনা ভেবেছিল শুদ্ধ হয়তো কোন অশিক্ষিত মূর্খ চাষা হবে।
ধারাকে ভাবনায় মগ্ন দেখে চুমকি বলল,

'কি হয়েছে ভাবী? খারাপ লাগছে? তোমার শরীর এখন কেমন? জ্বর পুরোপুরি সেড়েছে?'

ধারা অবাক হয়। তার জ্বর এসেছিল সেটা মেয়েটা জানলো কি করে? সেটা মুখ খুলে প্রশ্নও করে সে চুমকিকে। চুমকি বলে, 'আরে! ঐ যে বিয়ের দিন রাতে তোমার জ্বর এসেছিল না? মাহতাব ভাই তো আমাকে মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। বলল যে তোমার শাড়িটা পাল্টে দিতে। বাবা রে বাবা! যে জ্বর তোমার এসেছিল! গায়ে হাত দিলে মনে হচ্ছিল যেন হাত পুড়ে যাবে। তারপর ভাইয়াই তো সারারাত তোমার কপালে জ্বল পট্টি দিয়ে মাথায় পানি ঢেলে রাতের মধ্যেই জ্বর কমিয়েছে। আমি তো ছিলাম অর্ধেক রাত পর্যন্তই। তারপর আমাকে ঘুমানোর জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। আর বলেছে এই কথা যেন কাউকে আর না বলি। বুঝছো ভাবী ভাইয়া এমনিতে খুব ঠান্ডা মেজাজের। সবসময় স্পষ্ট কথা বলে। যা মনে আছে বলে দিবে। হেঁয়ালি কথাবার্তা ভাইয়া একদমই পছন্দ করে না। আর নড়বড়ে স্বভাব তো আরো না। ভাইয়ার মতে সবাইকে নিজের ভেতরে নিজেকে নিয়ে স্ট্রং হতে হবে। নড়বড়ে হওয়া চলবে না। মাহতাব ভাইয়া না খুব ভালো।'

ধারা শুধু অবাকের উপর অবাকই হচ্ছে। শুদ্ধ ওর শাড়ি পাল্টায়নি। তবুও সেদিন সকাল বেলা এমনভাবে বললো যেন সেই পাল্টিয়েছে। আবার ধারাকে টিটকারিও করলো। এতো অদ্ভুত কেন লোকটা?

শুদ্ধ বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকে নিজের রুমের দিকে যেতে নিলেই খোদেজা ডাক দিল। বলল,
'মাহতাব, রুমে যাইসা না। তুই যাওয়ার পর আবুলে তোর রুমের পাশের ওদের গাছের ডালপালা গুলা কাটছিল। একটা ডালে বারি খেয়ে তোর একটা কাঠের জানলা ছুইটা গেছে। গাছে মৌ পোকের বাসা ছিল। রুমে অনেকগুলা ঢুকছে। আজকের রাত নিচেই থাক। বৌ আমার বিছানায় ঘুমাক। তুই বারান্দার ঐ ছোট চৌকিটায় ঘুমাস। কালকে জানলা ঠিক কইরা নিস। শুদ্ধ থেমে গেলো। একবার ধারার দিকে তাকিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে মাঝ রুমের মোড়ায় বসে পড়লো। খোদেজা নিজে নিজেই বিরবির করতে লাগলো,
'উফ! একটা বিয়ের পর কত টুকিটাকি কাজ যে পইরা থাকে। খতম হওয়ার নামই নেয় না। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ে ধারাকে একটা তালা দিয়ে বলে,
'বৌ, তুমি একটু ঐ তালাটা মাইরা রাখো তো। ভালো করে মাইরো। অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস আছে ঐটার মধ্যে। ওগুলা অন্য আরেক সময় ধরবো।'

ধারা গিয়ে দরজা আটকিয়ে তালা মেরে দেয়। তিন চার বারের মতো তালা টেনে চেকও করে যে ভালো মতো লেগেছে কিনা। তারপরও আবার পাশ দিয়ে যাওয়া চুমকিকে ডেকে বলে,
'চুমকি দেখো তো, তালাটা ঠিকমতো লেগেছে কিনা!'
চুমকি একবার হাত দিয়ে তালা টেনে দেখে বলে, 
'হ্যাঁ লেগেছে ভাবী।'

এই পুরো ব্যাপারটাই তীক্ষ্ণ চোখে দূর থেকে পরখ করে শুদ্ধ। তারপর হাতের ল্যাপটপটায় পটাপট টাইপ করে ধারা লিখে নিচে আন্ডারলাইন দিয়ে লেখে,

ধারা:
১. ভীতু।
২. কনফিডেন্স নেই বললেই চলে।
৩. পরনির্ভরশীল।



চলবে*********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 2 users Like Bangla Golpo's post
Like Reply
#9
পর্ব-৫

    

সকালের সোনালী রোদ্দুর জানালার ফাঁক গলিয়ে ধারার মুখে পড়তেই ধারার ঘুম ভেঙে গেল। ঘন পল্লব বিশিষ্ট চোখজোড়া খুলতেই লাফিয়ে উঠলো। অনেক বেলা হয়ে গেছে! এতক্ষণ কিভাবে ঘুমিয়ে রইলো সে? ঝটপট বিছানা থেকে নেমে মাথার এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিল। ফ্রেশ হয়ে এসে বাইরে বেড়িয়ে দেখলো বাড়িতে কেউ নেই। উঠোনের কোণায় চোখে পড়লো শুদ্ধকে। একটা নাম না জানা গাছের চারা নিয়ে কি যেন করছে সে। শুদ্ধদের বাড়ির সামনেই একটু বা দিকে মাটির রান্নাঘর। রান্নাঘরের সামনেই টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া ডিপ কলের গোসলখানা। এর পর থেকে পাশের বাড়িগুলোর সীমানা শুরু। ডান দিকে বড় বড় মেহগনি গাছ দাঁড়িয়ে জঙ্গলের মতো হয়ে আছে। তারপরেই স্বচ্ছ পানির পুকুর। শুদ্ধ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ধারা একবার রান্নাঘরের ভেতর উঁকি দিল। শুদ্ধ নিজের কাজে মগ্ন থেকেই বলল, 'আম্মা গেছে পাশের বাড়ি। চুমকি গেছে কলেজে। পাবেন না কাউকে এখন।'

ধারা একটু থতমত খেয়ে গেলো। এই লোকটার কি কোনভাবে মানুষের মন পড়ে ফেলার ক্ষমতা আছে? ধারা যখনই যা ভাবে সবটা কিভাবে ঠিকঠাকই বলে দেয়! ধারা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ ধারাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে চলে গেল। ফিরে এলো একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। ধারার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, 'এর মধ্যে দুটো থ্রি পিছ আছে। শাড়ি পড়ায় যেহেতু অভ্যস্ত নন পড়তে হবে না।'

ধারা এবারও অবাক হলো। সারাক্ষণ শাড়ি পড়ে থাকতে তার সত্যিই অসুবিধা লাগছিল। বিয়ের আগে তো তেমন পড়া হয়নি। কিন্তু এই কথাটা তো সে কাউকে বলেনি। তাহলে জানলো কি করে? 

শুদ্ধ বলে উঠলো, 'শাড়ি পড়ে যেভাবে হাঁটেন দেখলেই বোঝা যায়। এটা মুখ ফুটে বলতে হয় না।'

ধারা এবার সাংঘাতিক চমকে উঠে ব্যাগটা ধরে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। এই লোকটার থেকে সাবধানে থাকতে হবে। এ তো দেখছি সে যা ভাবে সবই ধরে ফেলে। শুদ্ধ চলে যেতে নিয়েও আবার দাঁড়িয়ে ধারাকে বলল, 'গোসলখানা এদিকে। সাবধানে যাবেন। দেখবেন, আবার অজ্ঞান হয়ে যান না যেন! আপনি তো আবার কথায় কথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কুকুর দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তারপর আবার আমাকে আপনার শাড়ি পাল্টে দিতে হবে আর আপনি জ্ঞান ফিরে আকাশ থেকে টপকে পড়ার মতো এক্সপ্রেশন দিবেন।' 

শুদ্ধ চলে যেতে নিল। ধারা ঝট করে ঘুরে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। এই লোকটা এমন কেন? ধারা এখন ভালো মতই জানে সেদিন রাতে শুদ্ধ তার শাড়ি পাল্টায়নি। তবুও এখনও এমন ভাবে বলছে যেন সেই করেছে। ধারা দ্রুত বলে উঠল,
'আমি জানি আপনি সেদিন আমার শাড়ি পাল্টাননি। চুমকি বলেছে।'

শুদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছনে ধারার দিকে ঘুরে ঠোঁটের রেখা প্রসারিত করে মৃদু হাসির ঝলক তুলে বলল,
'বাহ! আপনাকে কেউ বলল আর আপনি সত্যিই নিজের থেকেই বিশ্বাস করে ফেলেছেন! অবিশ্বাস্য! না মানে এইবার আপনাকে কেউ বলে দেয়নি যে এটা বিশ্বাস যায় কি করা যায় না? একা একাই বিশ্বাস করে ফেললেন? ইমপ্রেসিভ!'

শুদ্ধ চলে গেল। আর সেদিকে তাকিয়ে ধারা সরু চোখে তাকিয়ে রইলো। দু তিন বাক্যের একটা কথাতেও ধারাকে কয়বার ঠান্ডা ভাবে খোঁচা মেরে দিল লোকটা। খোঁচা মারার একটা সুযোগও ছাড়তে চায় না। খোঁচা মারার রাজা যেন! এর নাম শুদ্ধ না রেখে খোঁচারাজ রাখা উচিত ছিল। ধারা বিরবির করে বলে উঠলো, 'খোঁচারাজ!'

একটু পর ধারা শুদ্ধ'র দেওয়া একটা থ্রি পিছ পরিধেয় করে আরেকটা থ্রি পিছ আর গামছা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। সকালে উঠার পর থেকেই কেমন যেন ভ্যাবসা গরম লাগছে। ভাবলো গোসলটা তাড়াতাড়িই করে নেয়া যাক! কিন্তু গোসলখানার সামনে যেতেই ধারা থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। গ্রামের বাড়ির কল। বেড়ার গায়ে দরজায় শুধু একটা কাপড়ের পর্দা ঝুলানো। বাড়ির আশেপাশের মানুষ জন একটু পরপরই এই আসছে আর যাচ্ছে। কেউ খাবার পানি নিতে আসে, কেউ জামা কাপড় ধুতে আসে। ধারার ভীষণ সঙ্কোচ হতে লাগলো৷ গ্রামে হলেও ওদের নিজেদের বাড়িটা পাকা দালানের। ঘরের মধ্যেই পাকা বাথরুম, গোসলখানা। ছোট বেলা থেকেই তাই ব্যবহার করে আসছে সে। এখন হঠাৎ করে এমন খোলা গোসলখানায় গোসল করতে ধারার কেমন যেন লাগছে। গোসল করার সময় যদি কেউ এসে পড়ে! গ্রামের মহিলাদের কাছে এসব তো আবার কোনও ব্যাপারও না। এরা একজনের গোসলের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে। যদিও মেয়েরা মেয়েরাই। তবুও ধারার তো অভ্যেস নেই এসবের। ও'র ভীষণ অস্বস্তি হয়। শুদ্ধ বাড়ির পাশে ঐ চারাটা লাগিয়ে ক্ষেতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ধারাকে এভাবে কলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হয়তো কিছু বুঝতে পারলো। ক্ষেতে যাওয়া বাদ দিয়ে তাই সে ধারার কাছে এসে বলল, 
'ধারা, কোন সমস্যা?'

হঠাৎ শুদ্ধ'র কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ধারা খানিকটা চমকে উঠলো। তাকিয়ে বলল, 
'না। কিছু না।'

শুদ্ধ একবার গোসল খানার দিকে তাকিয়ে কিছু ভেবে বলল, 'আপনার ওড়নাটা দেখি, দিন তো।'

ধারা ও'র গায়ের ওড়নাটা হাত দিয়ে চেঁপে ধরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, 'কি?'

ধারা কি ভেবেছে বুঝতে পেরে শুদ্ধও একটু লজ্জাবোধ করে দ্রুত বলল, 'আরে! আপনার হাতের ওড়নাটার কথা বলেছি। যেটা গোসলের পর পড়বেন। গায়ের ওড়নার কথা বলিনি।'

ধারা ভীষণ লজ্জা পেলো। আনত মুখে হাতের সুতি ওড়না টা শুদ্ধ'র হাতে দিল। ওড়না নিয়ে শুদ্ধ টিনের বেড়ার পর্দা ভালো মতো টেনে দিয়ে তার উপর আবার ওড়না দিয়ে দিলো। পর্দার কোনা টেনে টিনের বেড়ার গায়ে আটকে দিলো যাতে বাতাসে না উড়ে যায়। তারপর ধারাকে বলল,
'এখন বাইরে থেকে কিছুই দেখা যাবে না। আপনি যান। কেউ আসবে না। আসলে আমি মানা করে দিবো। আপনার গোসল না হওয়া পর্যন্ত আমি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো।'

'না থাক! আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে....!'

ধারাকে থামিয়ে দিয়ে শুদ্ধ আবারও বলল,

'আপনি যান।'

ধারা আর কিছু বলল না। গোসলখানার ভেতরে গিয়ে হাতের জামা কাপড় টিনের বেড়ার উপরে রেখে দিল। বেড়া ভালোই উঁচু করে দেওয়া। বাইরে থেকে তাকালে শুধু ধারার চোখ দেখা যাবে এমন। মাথার উপর খোলা আকাশ। দিনের আলোতে ভেতরটা একদম ফকফকে উজ্জ্বল। ধারার জন্য এমন পরিবেশ একেবারেই নতুন। ও'র ভীষণ লজ্জা হতে লাগলো। নিজেকে অনাবৃত করে লাজুক মুখে ওঁ একবার বাইরে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। হাতে একটা ডাল নিয়ে আনমনেই লোকটা নিচের দিকে তাকিয়ে মাটিতে আঁকিবুঁকি করছে। তখন থাকতে মানা করলেও শুদ্ধ থেকে যাওয়ায় ধারার কাছে ভালোই লেগেছে। একটু আশ্বস্ত তো হতে পারলো। এরপর অনেকটা সময়ই কেটে যায়। ধারা যখন বসে বসে বালতি থেকে মগ দিয়ে গায়ে পানি ঢালছিল তখন হঠাৎ ও'র কানে আসে কারো পায়ের শব্দ। মনে হচ্ছে যেন গোসল খানার দিকেই এগিয়ে আসছে সে। ধারা খেয়াল করলো অনেকক্ষণ ধরেই শুদ্ধ'র কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এতক্ষণ তো তবুও গাছের ডালের নাড়াচাড়ার খানিক শব্দ আসছিল। এখন তো ঐ পায়ের শব্দ ছাড়া সবই নিশ্চুপ। শুদ্ধ কি তবে চলে গেল? কে আসছে কে জানে! পায়ের শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। আতঙ্কে জমে গিয়ে ধারা সিমেন্টের পাকা থেকে ভেজা জামাটাই গায়ে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক তখনই ও'র কানে আসে শুদ্ধ'র কণ্ঠ। শুদ্ধ কাউকে বলছে,
'ভাবী, প্লীজ এখন যাবেন না। ধারা গোসল করছে। একটু পরে আসুন।'

পাশের বাড়ির বড় বউ নাজমা কাঁধ থেকে কলসিটা নামিয়ে রেখে বলল, 'তাতে কি হইছে ভাই? আমি কি পুরুষ মানুষ নাকি! আমি গেলে কি অসুবিধা? পানিটা যাইয়া নিয়া আসি গা। বেশিক্ষণ লাগবো না।'

কথাটা বলে নাজমা আবারও কলসি নিয়ে এগোতে নিল। শব্দ পেয়ে ধারা জামা পেঁচিয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। শুদ্ধ তাড়াতাড়ি নাজমাকে আটকে বলল, 'না ভাবী। একটু পরে আসুন প্লীজ। ধারা লজ্জা পায়। আসলে ও'র অভ্যেস নেই তো। আপনি না হয় কলসটা রেখে যান। দরকার পড়লে আমি গিয়ে পানি ভরিয়ে আপনাকে দিয়ে আসবো।'

নাজমা ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বলল, ' ও...বুঝলাম এখন ভাই, তুমি তাইলে দাঁড়ায় দাঁড়ায় বউরে পাহাড়া দিতাছো। বউরে একলাই একলাই দেখবা। অন্য কাউরে আর দেখতে দিবা না!'

ভেতর থেকে ওদের কথা শুনে ধারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। শুদ্ধ আর কি বলবে? এখন যে করেই হোক নাজমার গোসলখানায় যাওয়া আটকাতে হবে। অন্য ভাবে কিছু বললে আবার সেটা নিয়ে মাইন্ড করে বসতে পারবে। তাই নাজমার কথাতেই তাল মিলিয়ে মুখের হাসি প্রসারিত করে লাজুক ভাব ধরলো। নাজমা দুষ্টুমির ছলে বলতেই লাগলো, 
'আচ্ছা তাইলে আমি যাই। তোমার আর আমারে কষ্ট কইরা পানি ভইরা দিতে হইবো না। আমি কলস নিয়াই যাই। দেবর গো দিয়া কি আর এতো কাজ করাইতে পারি! তুমি না হয় তোমার বউরেই পাহাড়া দাও।'

নাজমা চলে যাওয়ার পর আরো দু তিন জন মহিলা এলো। সবাইকেই একইভাবে আটকালো শুদ্ধ। শেষমেশ সবাইকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে শুদ্ধ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ধারা মৃদু হাসলো। না! মানুষটা কথা দিয়ে কথা রাখে। ধারাকে একা ফেলে যায়নি। একে বিশ্বাস করাই যায়।




চলবে*******
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#10
পর্ব-৬




চুমকি সন্ধ্যা থেকেই বই নিয়ে ঘুমে ঢুলছে। তার ইচ্ছা করছে এখন একটা বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে। এই মুহুর্তে যদি সে একটু ঘুমাতে পারতো তাহলে তার চাইতে শান্তির ব্যাপার বোধহয় পৃথিবীতে আর অন্য কিছু হতো না। কিন্তু এই শান্তির ব্যাপারটা এখন সংঘটিত হতে দেওয়া যাবে না। মাহতাব ভাই যদি দেখে চুমকি পড়া বাদ দিয়ে ঘুমাচ্ছে তাহলে চুমকির খবর আছে। তাও যদি এক দু দিন এরকম হতো! চুমকির তো প্রতিদিনই পড়তে বসলেই ঘুম পায়। সে ঝিমিয়ে পড়ে আবারো মাথা ঝাঁকি দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকায় বইয়ের দিকে। এই চোখ বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না। খোদেজা সিমেন্টের মেঝেতে বসে বটি দিয়ে কচুর লতি বেঁছে রাখছিল। কাজের প্রতি দৃষ্টি থাকলেও তার মন খানিকটা অন্যমনষ্ক। আজকেই সে জানতে পেরেছে তার ছেলের বউ বিয়েতে রাজী ছিল না। বাপে জেদের বশে বিয়ে দিয়েছে। প্রথম থেকেই খোদেজার একটু কেমন কেমন যেনই লাগছিল। সবকিছু কেমন যেন স্বাভাবিক লাগছিল না ওদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের ভেতর। শুদ্ধ'র রুমের জানালাটা ভেঙেছে আজ কতদিন হলো। তবুও শুদ্ধ'র মধ্যে ওটা মেরামতের কোন লক্ষণও নেই। স্বামী স্ত্রী আলাদা ঘুমাচ্ছে। তবুও দুজনের মধ্যে কারো কোন গরজ নেই। দুজনেই স্বাচ্ছন্দ্যে নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব সহ আরো নানা কারণেই খোদেজার খটকা লাগছিল। একারণে আজ নিজ থেকেই খোদেজা একজন মিস্ত্রী ডেকে জানালা ঠিক করিয়েছে। তারপর নিজের সন্দেহ আর চেঁপে না রাখতে পেরে কথায় কথায় শুদ্ধকে সবটা জিজ্ঞাসাই করে বসে খোদেজা। শুদ্ধ স্পষ্ট কথার ছেলে। কথার মধ্যে কোন মিথ্যা, হেঁয়ালিপানা, ছলচাতুরী, ভাণ টান রাখা তার স্বভাবে নেই। তাই সে সবটা খুলেই বলে তার মাকে। তাছাড়া ভবিষ্যতেও এ নিয়ে ও'র মায়ের সাহায্যের প্রয়োজন হতে পরে এটা ভেবেই শুদ্ধ বলে দেয়। কথাটা শোনার পর থেকেই খোদেজার ভালো লাগছে না। একটাই ছেলে তার। কত শখ করে পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিল সেটাতেও হয়ে গেলো গড়মিল। মেয়েটার উপরও রাগ হচ্ছে না। মেয়েটার কি দোষ? বাপ মা চাইলে কি আর মাইয়া মানুষ না করতে পারে! মাইয়াটার চেহারাটাই এতো নিষ্পাপ যে তাকালে খোদেজা রাগ বা বিরক্তি অন্য কিছুই ভাবতে পারে না। তার শুধু রাগ হয় নিজের ভাগ্যের উপর। সবটা কি স্বাভাবিক হতে পারতো না!

শুদ্ধ নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে রাস্তায় দাঁড়ানো আবুলের সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছিল। ধারা একগাদা জামা কাপড়ের স্তূপ নিয়ে রুমের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলো। জামাগুলো তার নিজেরই। রুমের জানালা যেহেতু ঠিক হয়ে গেছে তাই খোদেজা বলেছে তার জামাকাপড় সব লাগেজ থেকে বের করে শুদ্ধ'র রুমে গিয়ে গুছিয়ে রাখতে। 
কিন্তু কতক্ষণ ধরে এভাবেই জামা কাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধারা। শুদ্ধ'র কোন টেরও নেই। সে তো বারন্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলায় ব্যস্ত। এখন ধারা জামাকাপড় গুলো কোথায় রাখবে সেটা তো জিজ্ঞেস করে নিতে হবে নাকি! সে বারান্দাতেও যেতে পারছে না। নিচে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না। ধারা বুঝতে পারলো এভাবে হবে না। শুদ্ধকে ডাকতে হবে। কিন্তু ডাকবে কিভাবে এটাই বুঝতে পারছে না। ধারা কিছুক্ষণ মৃদু মৃদু স্বরে শুনুন শুনুন বলে ডাকলো। কিন্তু শুদ্ধ শুনলো না। এরপর মুখ দিয়ে কিছু অদ্ভুত আওয়াজ করলো শুদ্ধ'র ধ্যান পাওয়ার জন্য। তাতেও কাজ হলো না। এরপর কি করবে না করবে বুঝতে না পেরে টি টেবিলে রাখা একটা স্টিলের বাটি মেঝেতে ফেলে দিল। ঝনঝন আওয়াজ পেয়ে শুদ্ধ দ্রুত ভেতরে চলে এলো। এসে বলল,

'কি হয়েছে?'

ধারা বলল, 'বাটি পড়ে গেছে।'

শুদ্ধ দুষ্টমির ছলে বলল, 'ও...আমি তো ভাবলাম আপনিই পরে গেছেন।'

ধারা সরু চোখে তাকালো। লোকটার মুখটা লম্বাটে। হালকা ফর্সা মুখে কুচকুচে কালো ঘন ভ্রু সবসময় একটা ব্যক্তিত্বের আভা ধরে রাখে। চেহারার মধ্যেই একধরণের স্পষ্ট ভাব বিরাজমান। কোন সঙ্কোচ নেই, কোন জড়তা নেই। সবকিছু যেন পানির মতো স্বচ্ছ। আর এই পানির মতো স্বচ্ছতায় সারাক্ষণ শুধু ধারাকে খোঁচা মারার ফন্দি। শুদ্ধ বলল,
'পড়েছে কিভাবে? ধাক্কা খেয়েছিলেন টেবিলের সাথে?'

'না মানে...আমি ইচ্ছে করে ফেলেছি।'

শুদ্ধ অবাক হয়ে বলল, 'কেন?'

'আপনাকে ডাকার জন্য।'

'কেন আমার নাম কি দোষ করেছিল?'

'এটা তো আর শহর না গ্রাম। আমি নাম ধরে ডাকলে অন্যরা খারাপ বলতে পারে।'

'অন্যদের খারাপ বলার কি আছে! আমি তো নিজেই আপনাকে বলছি আমার নাম ধরে ডাকতে। নয়তো এভাবেই যদি আপনি আমার সুন্দর নামটাকে ইগনোর করে এরকম দূর থেকে শুধু শুনুন, শুনুন করতে থাকনে তাহলে না জানি কবে আমি আমার নিজের নামই গুলিয়ে ফেলি আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে ফেলি, আমার নাম হচ্ছে 'শুনুন।'

কথাটা বলে শুদ্ধ হেসে দিল। ধারা এই প্রথমবার খেয়াল করলো শুদ্ধ যখন হাসে তখন ও'র বাম গালে একটা সুন্দর ডিম্পল ভেসে উঠে। ধারা অনেক মেয়েদের গালে ডিম্পল দেখেছে কিন্তু নাটক সিনেমা ছাড়া বাস্তবে এভাবে কোন ছেলের গালে এমন সুন্দর ডিম্পল দেখেনি। তাই শুদ্ধ'র হাসিতে ও'র এই কথাটাই প্রথম মাথায় এলো, বাহ! সুন্দর তো!

রাতের খাবার শেষে ধারা রুমে আসতেই শুদ্ধ জিজ্ঞাসা করলো,
'আচ্ছা, ধারা আপনাকে নাকি এ প্লাস না পাওয়ার কারণে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে?'
প্রশ্নটা শুনতেই ধারা মাথা নিচু করে ফেলল। এমনিতেই শুদ্ধ'র রুমে আসায় কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছিল। রাত তো এখনও বেশি হয়নি। এতো তাড়াতাড়ি রুমে আসার কোন ইচ্ছা ছিল না ধারার। কিন্তু ধারার শ্বাশুড়িই বলল, রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে। সত্যি বলতে একপ্রকার খেয়ালেই ছিল না ধারার যে আজ থেকে আবারও এই রুমেই ধারাকে থাকতে হবে। সে তো বেশ ভালোই ছিল শ্বাশুড়ি আর চুমকির সাথে ঘুমাতে। 

ধারা বলল, 'আপনি জানলেন কি করে?

'সেদিন যখন আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম আপনার ভাই কথায় কথায় বলেছিল। আমি তো শুনে প্রচুর অবাকই হয়েছিলাম তখন।'

ধারা আর কিছু বলল না। মাথা নিচু করেই রইলো।
ধারাকে চুপ করে থাকতে দেখে ল্যাপটপের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুদ্ধ বলল,
'আপনার তখন কিছু বলা উচিত ছিল ধারা।'

প্রসঙ্গ পাল্টাতে ধারা বলল,
'আচ্ছা আপনি নাকি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন? আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি....'

ধারাকে সম্পূর্ণ কথা শেষ না করতে দিয়েই শুদ্ধ বলে উঠলো, 'চমৎকার! আপনার হাজবেন্ড কি কাজ করে সেটা না জেনেই আপনি বিয়ে করে ফেলেছেন ধারা!'

ধারার ইচ্ছা করলো নিজের মাথায় একটা বাড়ি দিতে। আজ শুদ্ধকে একটু হেসে কথা বলতে দেখে সেও ফ্রি মাইন্ডে প্রশ্নটা করে ফেলেছে। কিন্তু ধারা এটা কিভাবে ভুলে গেলো, ইনি তো খোঁচারাজ। খোঁচা না মেরে কথা বললে তো উনার পেটের ভাত হজম হবে না। নাও ধারা, এবার সুযোগ করে দিয়েছো যখন ইচ্ছে মতো খোঁচা খাও!
শুদ্ধ বলতে থাকলো, 'আপনার ভাগ্য ভালো যে আপনার বাবা রাগ করে কোন পাগলের সাথে আপবার বিয়ে দিয়ে দেননি। নয়তো আমাকে দেখে তো শুধু কান্নাকাটি করেছেন পাগল বরকে দেখলে তো বোধহয় নির্ঘাত খুনই হয়ে যেতেন।'

ধারা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঠোঁট চেঁপে শুদ্ধ'র কথাগুলো হজম করতে লাগলো। আর শুদ্ধ'র কথার ভাঁজে ভাঁজে পেছনে হাত নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে মনে মনে গুণতে লাগলো, 'এক নাম্বার খোঁচা, দুই নাম্বার খোঁচা, তিন নাম্বার খোঁচা....।'

শুদ্ধ বকবক করতেই লাগলো। আর ধারার আঙ্গুলের সংখ্যাও বাড়তেই লাগলো। একসময় পেটের সব কথা বের করে একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়ালো শুদ্ধ। আর ধারা নিজের আঙ্গুলগুলো সামনে এনে দেখলো মোট সাতটা খোঁচা। বাহ! সাত মিনিটের কথায় খোঁচারাজ মহাশয়ের সাতটা খোঁচা। খারাপ কি!

ল্যাপটপটা বন্ধ করে শুদ্ধ গিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো৷ ধারা এবার আবারও সঙ্কোচে পড়ে গেলো। শুদ্ধ'র পাশেই কি ঘুমাতে হবে? অন্য কোন উপায় কি আর নেই? কি করবে না করবে কিছু বুঝতে পারলো না। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে শুধু কাঁচুমাচু করতে লাগলো। সেদিকে তাকিয়ে একটা ডেম কেয়ার ভাব নিয়ে শুদ্ধ বলল,

'একসাথে ঘুমাতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমার নিজের উপর কন্ট্রোল আছে। আপনার যদি মনে হয় আমার সাথে ঘুমালে আপনার নিজের উপর কন্ট্রোল থাকবে না তাহলে আপনি আলাদা ঘুমাতে পারেন।'

কথাটা শুনে কিছুক্ষণ ব্যাক্কেল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ধারা। তারপর কটমট করে একটা বালিশ নিয়ে শুদ্ধ'র পাশে শুয়ে পড়লো। অন্ধকারে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো শুদ্ধ।
__________________________________________

সাঁঝের ছায়া নামতেই খোদেজা ব্যস্ত হয়ে পড়লো হাঁস মুরগী নিয়ে। একটু পরই মাগরিবের আযান দিবে। অন্ধকার নেমে পড়বে চারদিকেই। খোদেজা মুরগীগুলোকে ধান খেতে দিয়ে পুকুর থেকে হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে এলো। চুমকি ঘরের দাওয়ায় বসে চিরুনী দিয়ে উকুন মারছিলো। তার মাথার বড় বড় চুলগুলো মাঝখানে সিঁথি করে সামনে এনে রাখা। সেদিকে একবার তাকিয়ে খোদেজা ধমক লাগিয়ে দিলো। বলল,
 'ঐ মাইয়া, তোর কি আক্কেল পছন্দ বলতে কিছু নাই। সন্ধ্যার কালে এমন চুল ছাইড়া দাওয়ায় বইসা আছোস! খারাপ জিনিস আইসা যখন ধরবো তখন বুঝবি।'

চুমকি ভয় পেয়ে গেলো। এইসব জিনিস প্রচন্ড ভয় পায় সে। তারউপর আজকে কলেজে তার বান্ধবীরা মিলে ভূতের গল্প করছিল। চুমকির বান্ধবীর ফুফুকে নাকি অনেক বছর আগে মাঝরাতে পানিতে ভাসা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সবাই বলে তাকে নাকি খারাপ জিনিসই মেরেছে। চুমকি তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় দিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেলো। তখন ধারা এলো দরজার সামনে। দেখলো খোদেজাকে খানিক বিচলিত দেখাচ্ছে। এই মহিলাটাকে ধারার ভীষণ ভালো লাগে। এতো মায়া নিয়ে কথা বলে যে ধারার বড্ড আপন লাগে। খোদেজাকে এমন চিন্তিত দেখে ধারা বলল, 'কি হয়েছে মা?'

খোদেজা ধারার দিকে তাকিয়ে বলল,
'আর বলো না মা, একটা হাস পাইতাছি না। কম দেখতাছি। এদিকে বেলাও পইরা যাইতাছে। আমি নামাজ পড়তে যাবো নাকি এগুলা নিয়াই ঘুরবো! নিশ্চয়ই ডোবার ধারে কোন ঝোপের মধ্যে গেছে।'

ধারা বলল, 'আপনি যান মা। আমি গিয়ে ওটা খুঁজে আনছি। আর বাকি গুলো তো খোঁয়াড়ে ঢুকেই গেছে।'

'না না থাক! তোমার যাওয়া লাগবো না।'

'সমস্যা নেই মা। আমি পারবো। আপনি যান।'

খোদেজা আর আপত্তি করলো না। ঘরের পেছনে শুকনো পাতা পড়ে আছে। সেগুলোকেও একটা ব্যাগে ভরে রান্নাঘরে নিয়ে আসা দরকার। এখন সে এসবের পেছনে থাকলে সত্যিই দেরি হয়ে যাবে। খোলা চুলগুলোকে হাত খোঁপা করে ধারা হাঁস খুঁজতে খুঁজতে পুকুরের অপর প্রান্তে চলে গেলো। পুকুরটা অনেক বড়। সেটা পেরোলেই আবার একটা ছোট্ট ডোবা। তারপরেই বাঁশের ঘন ঝাড়। আলো যেন এদিকে প্রবেশ করা অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য স্থানের তুলনায় এদিকে একটু বেশিই আঁধার হয়ে এসেছে। হাঁস সহজে খুঁজে পেলো না ধারা। অনেকটা দেরি হয়ে গেলো। অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়। শেষমেষ যখন দেখা পেলো তখন দেখলো ডোবার ধারে পাশের বাসার লোকেরা ডাঁটার বীজ বুনে যেই একটা নেট দিয়ে ঘেরাও করে দিয়েছিল, তারই মধ্যে পা আটকে বসে আছে হাঁসটা। ধারা গিয়ে নেট থেকে হাঁসটার পা ছুটিয়ে দিলো। এতক্ষণ বদ্ধকর এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই হাঁসটা প্যাক প্যাক করতে করতে তুমুল বেগে বাড়ির দিকে ছুট লাগালো। ধারা মৃদু হেঁসে আবার উল্টো দিকে হাঁটা দিলো। চারিদিক আধো আলো আধো অন্ধকারের সমাহার। আলোকে অতিক্রম করে অন্ধকারের আধিক্য হওয়ার তোড়জোড় যেন একটু বেশিই। ধারা নিজের মনে পথ দেখে দেখে বাড়ির দিকেই আসছিল। হাত খোঁপাটা কখন যেন খুলে গিয়ে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার চুলের রাশি। বাঁশ ঝাড়ের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ ই পেছন থেকে একটা শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিল তাকে। অথচ এখন গরমের দিন। ধারার একটু কেমন যেন লাগলো। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তার কেমন যেন মনে হচ্ছে তার পেছন পেছন কেউ যেন আসছে। এই বুঝি তাকালেই সে দেখতে পাবে। ধারার একবার মনে হলো পেছনে তাকায়। আবার তাকানোর কথা ভাবতেই একধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। শেষমেশ সে আর তাকালো না। দ্রুত পা চালিয়ে একপ্রকার ছুটেই চলে এলো বাড়িতে। খোদেজা তখন খোয়াড়ের দুয়ার আটকাচ্ছিল। শুদ্ধ সবেই বাজার থেকে এসেছে। ধারাকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে পুকুর পাড় থেকে আসতে দেখে দুজনেই অবাক। খোদেজা এগিয়ে এসে ধারার হাত ধরে বলল,
'কি হয়েছে মা, তুমি এমন করতাছো কেন?'

শুদ্ধও ভ্রু কুঞ্চিত করে ধারার দিকে তাকিয়ে রইলো। পুকুর পাড়ের দিকে তাকিয়ে ধারা একবার ঢোক গিলে বলল, 'বাঁশ ঝাড়ের নিচ দিয়ে যখন আসছিলাম আমার মনে হচ্ছিল আমার পেছনে কেউ আছে। অথচ আমার যাওয়ার সময় কেউ সেখানে ছিল না। কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল।'

শুদ্ধ ফট করে বলে দিলো,
'আপনার মনে হচ্ছিল তো? তাই ওটাকে কোন পাত্তাও দিয়েন না। কারণ আপনি নিজেই নিজের কিছু বুঝতে পারেন না। সেটা ভালো মন্দ হোক বা অন্যকিছু। একটা কাজ করুন চুমকিকে না হয় সেখানে নিয়ে যান। তারপর চুমকি যদি বলে হ্যাঁ এটা ভয় পাওয়ার মতোই তখন না হয় ভয় পাবেন।'

ধারার চোখে পানি চলে আসলো। প্রচন্ড রাগও উঠলো তার। ধারা কতটা ভয় পেয়েছে তার সত্ত্বেও এই মুহুর্তে এরকম নিষ্ঠুর কথা কি না বললেই নয়! ছলছল চোখেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে ধারা গটগট করে ভেতরে চলে গেলো। খোদেজা সেদিকে তাকিয়ে শুদ্ধকে বলল,

 'এইসব কি মাহতাব? তুই সবসময় মাইয়াটার সাথে এরকম করে কথা বলোস কেন? বউ এমনিতেই ভয় পাইয়াছিল তুই তার উপর আবার রাগিয়ে দিলি।'

মাটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে শুদ্ধ বলল
'আমি ইচ্ছে করেই ধারার সাথে এভাবে কথা বলি আম্মা। যাতে ও'র রাগ হয়, জেদ চাপে। ও নিজের জন্য হয়ে একটু হলেও স্ট্যান্ড নেয়। যে যা বলে সব যেন শুধু চুপচাপ শুনেই না যায়। আর দেখলো তো আজকে একটু হলেও ও ক্ষেপে গিয়েছে। আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়েছে। আর আজকে এভাবে বলার পেছনে আরেকটা কারণও আছে। ধারা সত্যিই ভয় পেয়েছে। এখন অন্যকিছুও হতে পারে আবার পরিবেশটাই এমন ও'র মনের ভুলও হতে পারে। কিন্তু ভয়টা ও'র ভেতরে সারা রাত গেঁথে থাকতো। মস্তিষ্ক বারবার এটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকতো। এই যে এখন আমি ওকে কটাক্ষ করে কথা বললাম তাই এখন ও'র মাথা গরম হয়ে থাকবে। ও'র বারবার আমার কথাটাই মনে পড়বে আর রাগ লাগতে থাকবে। বাঁশ ঝাড়ে ভয়ের ব্যাপারটা ততোটা মাথায় আসবে না। 
দুটো অনুভূতি কখনো একসাথে একই মুহুর্তে অনুভব হয় না। রাগান্বিত মনে কখনো আনন্দ লাগে না, ব্যথিত মন কখনো অশরীরী ভয় পায় না। ঘৃণিত মনে কখনো ভালোবাসা অনুভূত হয় না। মন জিনিসটা বড্ড অদ্ভুত। এখানে একটা অনুভূতির উপস্থিতিতে আরেকটা অনুভূতিকে তার জায়গা ছাড়তে হয়। বিয়ের পর পর ও'র সাথে রুক্ষ হয়ে কথা বলতাম রাগের কারণে। কিন্তু এখন ইচ্ছে করেই এটা চালিয়ে গেছি ও'র ভালোর জন্যই।'

খোদেজা সন্ধিগ্ন চোখে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্ট হাসির রেখা টেনে বলে,
'কেন? প্রথমদিকে রাগ কইরা যখন এমনে কথা বলছোস। তোর মাথায় এতো রাগ ছিল তাইলে এখন অন্য কারণে এমন করতাছোস কেন? ধারার জন্য এতো কেন চিন্তা তোর?'

শুদ্ধ ঝট করে মায়ের দিকে তাকালো। আর তখনই মাগরিবের আযান পড়ে গেলো।


চলবে***********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#11
পর্ব-৭
  

এশা'র নামাজের পর খোদেজা তার রুমে শুদ্ধকে ডেকে পাঠালো। শুদ্ধ এসে বসতেই নিজের জমানো প্রশ্নের ঝুড়ি মেলে ধরলো খোদেজা। 
বলল,
'তখন মাগরেবের আযান দিয়ে ফেলছিল বলে তোরে আর ভালোমতো ধরি নাই। এবার বল, তোর মনে কি আছে? ধারা ওর বাবার ভয়ে বিয়ে করছে। ধরলাম তুই ভালো মানুষ এরজন্য মেয়েটারে এভাবেই মাইনা নিছোস। ওরে নিজের কাছেই রাখছোস। কিন্তু ও'র জন্য এতো কেন চিন্তা করতাছোস এখন? ও'র কিসে ভালো হইবো না হইবো তাতে তোর কি?'

শুদ্ধ মৃদু হেসে বলল,
'আম্মা, কি শুরু করলে বলো তো!'

খোদেজা নাছোড়বান্দা। সবটা জেনেই ছাড়বে সে আজ। বলল,
'না। তুই আমারে সরাসরিই এখন বলবি। এতদিন তোদের সম্পর্ক নিয়া অনেক দোটানায় কাটাইছি। আমি আর ওই খুতখুতে ভাব নিয়া থাকতে চাই না। এখন যা হইবো পরিষ্কার ভাবেই আমি জানতে চাই। তোর মনে কি চলতাছে তুই আমাকে সব বলবি।'

মেঝের দিকে দৃষ্টি সরিয়ে শুদ্ধ আনমনে একটু হাসলো। কিছুক্ষণ চোখের দৃষ্টি ওঠানামা করিয়ে স্পষ্ট স্বরেই বলল,
'ধারা আমার স্ত্রী, আম্মা। আমি তো ওঁকে ভালোবাসবোই। এখানে নতুন করে হঠাৎ হুট করে ভালোবাসা না ভালোবাসার কিছু না। এতদিন, কখনো কোন মেয়ের দিকে আমি ফিরে তাকাইনি। পড়তে গিয়ে কত মেয়ের কত ভালোবাসার প্রস্তাব পেয়েও আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। নিজের ভেতরকার ভালোবাসাটা শুধুমাত্র নিজের স্ত্রীর জন্যই বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। কারণ এখানে শুধুমাত্র তারই অধিকার। সেই অধিকার আমি নষ্ট করতে চাইনি। বিয়ের সময় যেই মুহুর্তে আমি ধারাকে কবুল বলে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি ঠিক সেই মুহুর্তেই আমি আমার মনের জায়গাটা ধারাকে দিয়ে দিয়েছি। এখন এখানেই ও'র একরত্তি রাজত্ব। বিয়ের পর ধারার ভয়ের কারণে নিজের অনিচ্ছায় বিয়ের কথা শুনে প্রচন্ড রাগ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম ধারা যেহেতু এখন আমার স্ত্রী তাই শুধু ও'র গুণগুলোই না ও'র দূর্বলতাগুলোও এখন সব আমার। আর ধারা তো শুধু এই ব্যাপারেই না, সব ব্যাপারেই ও এমন। ও'র নিজের প্রতি কোন কনফিডেন্স নেই, নিজে থেকে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।, যে যা বলে শুধু তাই শুনে। এটা তো একটা সমস্যাই না? আর আমার স্ত্রীর সমস্যা গুলোও এখন আমার সমস্যাই। আর আমি আমার সমস্যাগুলোকে দূর করতে চাই। আমি চাই আমার স্ত্রী আমার সাথে সাথে চলুক। আমার পেছনে নয়। জীবনসঙ্গী তো একেই বলা হয় তাই না আম্মা?'

খোদেজার ভালো লাগলো ছেলের কথা শুনে। তবুও বলল, 'তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু মাহতাব, ধারা তো মন থেকে এই বিয়ে করে নাই। তোর কি হবে তাহলে বাবা? তোরও তো একটা সংসার দরকার। এভাবে কতদিন চলবে?'

'আম্মা, আমি নিজেকে ধারার উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চাই না। আমি চাই এই ব্যাপারটা ও নিজ থেকে বুঝুক। ও নিজ থেকে আমার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করুক। শুধু মাত্র ওর বাবা আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে বলে, সমাজের নিয়ম অনুযায়ী আমার সাথে থাকতে হবে বলে থাকবে এমনটা চাই না। আমি চাই, ধারা সম্পূর্ণ মন থেকে আমার কাছে থাকতে চায় বলে ও থাকুক। আমাকে ভালোবেসে থাকুক। এটাই তো প্রকৃত সংসার হয়, তাই না আম্মা? আর এর জন্য যতদিন লাগবে লাগুক। আমি চেষ্টা চালিয়ে যাবো।'

খোদেজা প্রশান্তির সাথে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মাথায় হাত বুলিয়ে মন খুলে দোয়া করলো। যাক! তার ছেলে আর বাকি সবার মতো হয়নি। ছেলেকে সে সঠিকভাবেই মানুষ করতে পেরেছে। গর্বে তার বুক ভরে উঠলো। সেখানে উপস্থিত আরেকজনও শুদ্ধ'র বলা সম্পূর্ণ কথা শুনলো। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে এক মুহুর্তের জন্য বিস্ময়ে জমে গেলো যেন ধারা। 

রাতে যখন শুদ্ধ ঘুমাতে নিজের রুমে এলো তখন বিছানার উপর নত মাথায় বসে বসে ধারা মৃদু স্বরে বলল,
'দেখুন, আপনার শুধু শুধু এত কিছু করতে হবে না। আপনি যদি স্বামীর অধিকার চান তাহলে আমি দিতে রাজী আছি। আমার কোন আপত্তি নেই।'

কোন উত্তর না দিয়ে বালিশ টেনে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে শুদ্ধ মৃদু হাসলো।
__________________________________________

সকাল সকাল উঠোনে একটা মোড়া টেনে জমিরন বিবি রোদ পোহাতে বসেছেন। তার হাতে একটা মাঝারি সাইজের থালা। সেখানে দুধ নারকেলের মাঝ থেকে উঁকি দিচ্ছে ছোট ছোট সেমাই পিঠা। কাল রাতে বানানো হয়েছিল। এখন ঠান্ডা হয়ে জমে গিয়ে উপরে একধরনের ঘন সরের সৃষ্টি হয়েছে। জমিরন বিবি একটা চামচ দিয়ে নাড়া দিয়ে সরটা ভেঙে দিল। কিছুক্ষন এভাবেই নাড়াচাড়া করে এক চামচ মুখে দিয়েই তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন রান্নাঘরে তরকারি কাটারত আসমাকে উদ্দেশ্য করে। 

'এইয়া কি বউ? পিডায় একটুখানিও মিডা দাও নাই। এয়া কি ছাই বানাইছো? এগুলা মুখে দেওয়ান যায়! নাকি আমি বুড়া মানুষ দেইখা আমারে না খাওয়ানির মতলব করছো! বুঝি বুঝি, আমি সবই বুঝি।'

আসমা বেগুন কাটা বাদ দিয়ে একবার উঁকি দিয়ে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালেন। তার শ্বাশুড়ির ডায়াবেটিস আছে। মিষ্টি খাওয়া একেবারেই নিষেধ। বুড়ো মানুষ এটা বুঝতে চান না। শুধু মিষ্টি খাওয়ার ফরমায়েশ করেন। এজন্যই একটু মিষ্টি কম দিয়েই তার পিঠা বানায় আসমা। এখন এটা বুঝিয়ে বললেও তার শ্বাশুড়ি বুঝবে না। তাই ছোটখাট ভাবেই বললেন,
'মনে ছিল না আম্মা। ভুলে কম হইয়া গেছে।'

'হ! বিয়ার পর তোনই তো তোমার খালি ভুলই হয় তাই না! তোমার ভুলের লেইগাই তো তোমার বড় মাইয়াডা মরছিল মনে আছে? ছয় বছরের মাইয়াডা ডায়রিয়া হইয়া কেমনে ছটফট করতাছিলো। আর তুমি মূর্খের মতন ও'র মুখে পানি দেওয়ান যাইবো না জাইনাও পানি খাওয়াইলা। হেয়ার কতক্ষণ পরই তো মারা গেলো। আমি তো কই তোমার হেই পানি খাওয়ানোতেই তোমার মাইয়া মরছে।'

আসমার বুকের মধ্যে ছ্যাৎ মেরে উঠলো। মুহুর্তের মধ্যে তার বড় মেয়ের মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। তার শ্বাশুড়ি আগেকার দিনের মানুষ। তখন ডায়রিয়া হলে পানিকে মনে করা হতো বিষ। রোগী পানির জন্য পাগল হয়ে গেলেও তাকে পানি খেতে দেওয়া হতো না। তার মেয়েটাকেও দেওয়া হয়নি। পানির জন্য কেমন পাগলের মতো ছটফট করতো মেয়েটা। অপরদিকে আজিজ সাহেবও বাড়িতে ছিলেন না। ব্যবসার কাজে শহরে আটকা পড়েছিলেন। আসমা একা একা আর কতদিকে সামলাবেন। ধারাও ছিল তখন একদম কোলের শিশু। মা হয়ে পানি খাওয়া নিয়ে মেয়ের এই আকুতি আসমা দেখতে পারেনি। এক গ্লাস পানি নিয়ে মেয়ের মুখের সামনে দিতেই মেয়েটা চুম্বকের মতো আঁকড়ে ধরেছিল গ্লাসটা। যেন মরুভূমির বালি সহস্র বছর পর পানির দেখা পেয়েছে। এই দৃশ্য দেখেই ক্রোধে ফেটে পড়ে জমিরন। ছো মেরে নিয়ে যায় পানির গ্লাস। শুধু জমিরনই নন। আশেপাশের আরো অনেকেই ডায়রিয়া রোগীকে পানি খাওয়ানোর জন্য বকাবকি করেন আসমাকে। আসমাও আর এরপর মেয়েকে পানি খাওয়ানোর মতো দুঃসাহস করেননি। কোন ছেলে জন্ম না দিতে পেরে পরপর দুটা মেয়েকে জন্ম দেওয়ার জন্য এমনিতেও আসমাকে অপয়া নামে জানা যেত। এখন যুগ উন্নত হয়েছে। গ্রামে স্যালাইন এসেছে। এখন পানি জাতীয় খাবারই হয়েছে ডায়রিয়া রোগীদের পথ্য। কিন্তু জমিরন বিবি এসবে বিশ্বাস করেন না। তিনি আজও আসমার বড় মেয়ের মৃত্যুর দোষ আসমার ঘাড়েই তুলে দেন। আসমা লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোনের পানি মুছে তিনি আরেক পিরিচ পিঠা নিয়ে আজিজ তালুকদারের কাছে যান। আজিজ তালুকদার গেস্ট রুমে বসা ছিলেন। তার কাছে দুজন লোক এসেছে। আগামী বছর তার চেয়ারম্যানে দাঁড়ানোর ইচ্ছা। সব ঠিক থাকলে হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। এখন থেকেই তার কাছে লোকের আসা যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। আসমা পিঠা হাতে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে রইলেন। লোকগুলো চলে গেলে তারপর ভেতরে ঢুকলেন। হাতের পিঠার থালা আজিজ সাহেবের সামনে রেখে আস্তে করে বললেন,
'বলছিলাম যে ধারার সাথে আপনার আর কথা হয়েছে?'
ধারার নাম শুনতেই আজিজ সাহেবের কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

'কথা বলার এতো কি আছে?'

'না মানে...যদি একটু বলতেন। বিয়ের তো কতদিন হয়ে গেলো। এখনও তো তেমন কোন কথা ওর সাথে বলেননি।'

'তোমার মেয়ে কোন গর্বের কাজ করে রাখেনি যে ক্ষণে ক্ষণে তার সাথে ফোন করে কথা বলতে হবে। যতটুকু প্রয়োজন তা কি আমি করছি না! কত আশা ছিল এই মেয়ে নিয়ে। কত কিছু করলাম, কতগুলো প্রাইভেট টিচার রাখলাম, কোচিংয়ে ভর্তি করালাম তবুও পরীক্ষায় এ প্লাসই আনতে পারলো না। ঐ জয়নালে কি ওর ছেলের জন্য এর থেকে বেশি করছিল তবুও তো ঠিকই ওর ছেলে এ প্লাস পেয়েছে।'

'বলছিলাম যে যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন এসব ভেবে আর লাভ কি? মাঝে মাঝে একটু ফোন করে কথা বললেই তো হয়!'

'তোমার কথা বলতে ইচ্ছা করলে তুমি করো। আমাকে এসবের মধ্যে টেনো না।'

পিঠা না খেয়েই আজিজ সাহেব উঠে চলে গেলেন।
__________________________________________

চুমকি সবেই কলেজ থেকে ফিরেছে। ভাতের থালা হাতে নিয়েই সে বাইরে চলে এলো। তার মধ্যে আছে শুধু দুরন্তপনা। কোনদিকে দাঁড়িয়ে একটু স্থির হওয়া যেন তার স্বভাবে নেই। সে গ্রোগাসে ভাত গিলছে আর গভীর মনোযোগ নিয়ে শুদ্ধ'র কাজ দেখছে। শুদ্ধ'র পরনে সবুজ রঙের একটা শার্ট আর ব্লু জিন্স। উদ্দেশ্য ছিল তার বাইরে বেরোবারই। হঠাৎ পরিবর্তন করে হাতে একটা দা উঠিয়ে নিয়েছে। কতোগুলো বাঁশকে টুকরো টুকরো করে রাখছে পুকুর পাড়ে একটা মাচা বানাবে বলে। দক্ষিণ দিকের পুকুর। দাঁড়ালেই দক্ষিণা হাওয়ায় প্রাণ জুড়ে যায়। মাচা বানিয়ে বসার একটা ব্যবস্থা করলে খারাপ হবে না। শুদ্ধদের বাড়িতে দরজার বাইরেই ইট দিয়ে বাঁধানো বসার ব্যবস্থা করা। গ্রাম এলাকায় যেটাকে 'ওডা' বলে সনাক্ত করা হয়। খোদেজা সেখানেই বসে নকশি কাঁথা সেলাই করতে বসেছিল। একটু পর ধারাও এসে খোদেজার সামনে বসলো। চুমকির দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
'চুমকি তুমি প্রথমে খাও তারপর বাইরে গিয়ে ঘুরো। এভাবে ঘুরে ঘুরে খেয়ে তো মজা পাবে না?'

খোদেজা বলল, 'ও'র কি আর সেদিকে কোন হুঁশ আছে? শুধু শরীরই বড় হইতাছে। স্বভাব এখনও হাফ প্যান পড়া পোলাপানের মতো।'

চুমকি ঝটপট খেয়ে নিয়ে প্লেট ওডার উপর রেখে দিয়েই আবার বাইরে চলে গেলো। খোদেজা সেদিকে তাকিয়ে একটা ধমক লাগিয়ে নিজেই এটো প্লেটটা নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। চুমকি পুকুর পাড়ের কাছ থেকে ডেকে উঠলো,

'নতুন ভাবী, এদিকে আসো।'

ধারা একটু ইতস্তত বোধ করলো। তবুও ধীর পায়ে সেদিকটায় গেলো সে। শুদ্ধ তাকে ভালোবাসে এটা জানার পর থেকেই তাকে দেখলে কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি হয় তার। তার সামনে আসলেই আপনাআপনি একটা কাঁচুমাচু ভাব চলে আসে। গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। পুকুর পাড়ে এখনও কিছু কিছু জায়গা জুড়ে কাঁদা হয়ে আছে। ধারা গিয়ে চুমকির পাশে দাঁড়ালো। শুদ্ধ একপলক তার দিকে তাকিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দিল। চুমকি বলল,
'নতুন ভাবী জানো, আমি না ছোটবেলায় শুধু গাছের উপর চড়ে বসে থাকতাম। একবার নাকি গাছের ডালের উপরেই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম।'

কথাটা বলে চুমকি নিজের মনেই খানিক হাসলো। ধারা বলল, 'আমিও খুব ভালো গাছে উঠতে পারি।'
চুমকি পুলকিত হয়ে বলল, 'সত্যি!'

ধারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই শুনলো শুদ্ধ পাশ থেকে বলছে, 'বিশ্বাস করলাম না।'

ধারা ভ্রু কুঁচকে বলল, 'বিশ্বাস না করার কি আছে? সত্যি!'

শুদ্ধ নিজের কথায় অনড়। নিজের কাজে মগ্ন থেকেই সে বলল, 'উহুম।'

'আরে! আমি সত্যিই উঠতে পারি। আমি সত্যি বলছি।'

'কি জানি!'

ধারা ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলো। কি মুশকিল! সে বলছে সে পারে তবুও কেন বিশ্বাস করছে না। শেষমেশ একটা মুখ ভেংচি দিয়ে চুমকির দিকে তাকিয়ে শুদ্ধকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
'বেশ! আমি এখনই গাছে উঠে দেখাচ্ছি আমি উঠতে পারি কি না! তারপর নিশ্চয়ই খোঁচামারা লোকেদের খোঁচা দিয়ে কথা বলা বন্ধ হবে।'

এই কথা বলে গায়ের ওড়নাটা শক্ত করে কোমড়ের সাথে বেঁধে ধারা গাছে উঠার প্রস্তুতি স্বরূপ গোড়ায় পা দিতেই খোদেজা দূর থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আসতে লাগলো,
'না না বউ থাক! এই বিকেল বেলা তোমার আর গাছে উঠা লাগবো না। এই সময়ডা ভালো না।মাহতাবের কথায় কান দিয়ো না তো!'

খোদেজার কথা শুনে ধারা ওড়না ঠিক করে নিজের পা গাছের থেকে সরিয়ে নিলো। ধারার গাছে উঠা বন্ধ হয়ে গেছে দেখে চুমকিও সেখান থেকে চলে গেল। শুদ্ধ বলল,
'দেখেছেন, আমি জানতাম আপনি পারেন না। এর জন্যই আম্মার বাহানায় এখন ঠিকই সরে এলেন।'

'জ্বি না। আপনি ভুল। বাহানার জন্য না। আমি মায়ের কথার সম্মান দিতে উঠিনি। আপনি যেহেতু এভাবে মানবেনই না। দাঁড়ান আমি এখনই উঠে দেখাচ্ছি।'

'না না থাক! এতো জোর করে উঠতে হবে না। তারপর আবার গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙে বসলে আপনার বাবা বলবে তার মেয়েকে আমরা আঘাত দিয়েছি। আপনি তো আবার বাবার কথায় উঠেন আর বসেন। বাবার কথায় মাথা হেলিয়ে পরে আপনিও সেটাই বলবেন।'

ধারার মুখ ভার হয়ে গেলো। খোদেজা বলে উঠলো, 'এই মাহতাব তুই চুপ কর তো! নিজে এমন ভাব ধরোস যেন নিজে সব পারোস। সামান্য একটা লুঙ্গি পরতে পারে না তার আবার বড় বড় কথা!'

ধারা কৌতূহলী হয়ে বলল, 'লুঙ্গি!'

'হ্যাঁ লুঙ্গি! ছোটবেলায় '.ির পর যখন লুঙ্গি পরতে হইতো মাহতাবে লুঙ্গি সামলাইতেই পারতো না। একবার হইলো কি ও'র চাচী, মামীদের সামনে ও'র লুঙ্গি খুইলা পইরা গেলো। সবাই মিলে এতোই ক্ষ্যাপাইছে যে আমার ছেলেটা এর পর থিকা লুঙ্গি পরতেই ভয় পায়! সামলাইতে পারে না।'

শুদ্ধ অসহায়ের মতো মায়ের দিকে তাকিয়ে করুণ মুখে বলল, 'মা!'

খোদেজা পাত্তা না দিয়ে বলল, 'কি হয়েছে! আমি কোন মিথ্যা কথা বললাম?'

কথাটা বলে খোদেজা নিজের কাজে চলে গেলো। ধারা খেয়াল করলো আসলেই তো এতদিন হয়ে গেলো গ্রামের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও শুদ্ধকে তো আজ অব্দি কখনো লুঙ্গি পড়তে দেখা যায়নি! এমনকি ক্ষেতে যাওয়ার সময়ও সে পুরনো ট্রাউজার পড়ে যায়। শেষমেশ কিনা এতো স্ট্রং ছেলের লুঙ্গি ভীতি! কথাটা ভাবতেই ধারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে আসার উপক্রম। শুদ্ধ ঠোঁটে মৃদু রসাত্মক হাসি ফুটিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে ধারা হাসির মাঝেই বলল,

'উফ! আমি আমার হাসি থামাতেই পারছি না।'

শুদ্ধ ফট করে বলে বসলো,
'একটা কাজ করুন, আপনার বাবাকে একটা ফোন করুন। জিজ্ঞাসা করুন, কিভাবে হাসি থামাতে হয়। বাবা বললে হয়তো পারবেন।'

ফস করে ধারার হাসি থেমে গেলো। রাগে গা পিত্তি জ্বলে গেলো তার। মুখ ফুলিয়ে বলল,
'আপনার সমস্যাটা কি বলুন তো! খোঁচা মেরে কথা না বললে কি আপনার ভালো লাগে না। সবসময় শুধু আমার পেছনে লেগে থাকেন! আচ্ছা যান ঠিকাছে, আপনি সবসময় বলেন না যে আমি নিজ থেকে কিছু করতে পারি না, কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারি না! এখন আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, আপনার মতো খোঁচারাজের প্রেমে আমি জীবনেও পড়বো না। পড়বো না মানে পড়বো না।'

কথাটা বলে দ্রুত পেছনে ফিরে হনহন করে হাঁটতে গিয়েই কাঁদায় পা পিছলে পড়ে গেলো ধারা। মুহুর্তের মধ্যেই শুদ্ধ শব্দ করে হেসে উঠে কাঁদা পানিতে মাখামাখি হয়ে বসে থাকা ধারার সামনে এসে ঝুঁকে বলল,

'এটা কি হলো ধারা? পড়বো না পড়বো না বলতে বলতেই পড়ে গেলেন!'

চলবে*********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 2 users Like Bangla Golpo's post
Like Reply
#12
পর্ব-৮


 

লাল রঙের একটা গামছা দিয়ে ধারা দ্রুতগতিতে মাথা মুছে চলেছে। একটু আগেই সে গোসল সেড়েছে। এই অবেলায় সন্ধ্যা পানে গোসলে অবশ্যই শরীর ঠান্ডা হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তার ক্ষেত্রে হয়েছে বিপরীত। তার মাথা প্রচন্ড গরম। মেজাজ সপ্তম ডিগ্রীতে চড়ে আছে। খোঁচারাজের উপর রাগ তো তার আছেই, তার সাথে সাথে আছে নিজের উপরেও। কত সুন্দর করে খোঁচারাজের খোঁচার উত্তরে ভাব নিয়ে একটা কথা বলেছিল আর শেষে কিনা কি হলো! পা পিছলে পড়ে গিয়ে কাঁদায় মাখামাখি হলো। আর তারপর উনার গা জ্বালা হাসি তো ফ্রিতে কপালে জুটেছেই। মান ইজ্জত আজ ঐ পুকুর পাড়ের কাঁদার সাথেই লুটোপুটি খেলো। ধুর! দাঁত কিড়মিড় করে মাথা মুছতে মুছতে ধারা বিড়বিড় করতে লাগলো, 'কি মনে করে সে নিজেকে! সবসময় শুধু আমার পেছনে পড়ে থাকা! আর এতো চালাক! প্রত্যেকটা কথা যেন মাথার মধ্যে সাজিয়ে রাখে৷ সেদিন রাতে শোবার কথা নিয়ে করলো? যে 'আপনার যদি মনে হয় আমার পাশে ঘুমালে আপনার নিজের উপর কন্ট্রোল থাকবে না তাহলে আপনি আলাদা ঘুমাতে পারেন!' এখন এরকম একটা কথা বলার পর কেউ কিভাবে আলাদা ঘুমাতে পারে? আর যদি আমি ঘুমাতাম তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াতো? তাকে দেখলে আমার নিজের উপর কন্ট্রোল থাকে না! হুহ! নেহাৎ হাসলে একটু সুন্দর লাগে...আচ্ছা ঠিকাছে একটু না অনেকটাই সুন্দর লাগে। তাতে কি হয়েছে? সে কি সবার মাথা কিনে নিয়েছে?'

এভাবেই কখনো নিজের রাগ ঝেড়ে, শুদ্ধ'র বলা কথা নকল করে, আবার নিজের মনেই কথার কাটাকাটি করে বারন্দায় দাঁড়িয়ে ধারা একমনে মাথা মুছতে মুছতে বিড়বিড় করতে লাগলো। রুমের ভেতরে বুকে দু হাত গুঁজে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ধারার রাগে গজগজ করার এই সুন্দর দৃশ্যটি উপভোগ করতে লাগলো শুদ্ধ। তার মুখে মিটিমিটি হাসি বিরাজমান। ধারা খুব শান্ত শিষ্ট, লাজুক প্রকৃতির মেয়ে। কথা বার্তাও বলে যেন নিজের ভেতরটা আড়ালে রেখে। খুব কম। আজ যেন নিজের ভেতরটা সম্পূর্ণ মেলে ধরেছে সে। যেটা মনে আছে সরাসরি প্রকাশ করছে। রাগ দেখাচ্ছে, অভিমান করছে, ঝগড়ার সুরে কথা বলছে। শুদ্ধ'র দেখে ভালো লাগলো। ভীষণ ভালো লাগলো। মুখের কাছে হাত নিয়ে একটু খুকখুক করে কেশে ধারার ধ্যান কেড়ে নিল শুদ্ধ। কটমট করে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে ধারা গামছাটা বারান্দার রশির উপর রেখে দিয়েই ভেতরে চলে এলো। শুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে আসতেই তার মাথায় আসলো একটা বুদ্ধি। খোঁচারাজের লুঙ্গি ভীতির সুযোগ নিয়ে যদি তাকে একটু জব্দ করা যায় তাহলে তো ব্যাপারটা মন্দ হয় না। যেই ভাবা সেই কাজ! কিছুক্ষণ পরই আবার রুমে গিয়ে ধারা দেখলো শুদ্ধ নেই। এক মিনিট সময়ও নষ্ট না করে শুদ্ধ'র সব কয়টা জিন্স, ট্রাউজার নিয়ে একটা পানি ভরা বালতিতে চুবিয়ে রাখলো ধারা। কাঁথা সেলাইয়ের জন্য খোদেজা পাশের বাড়ির থেকে যে আধো পুরনো লুঙ্গি এনে রেখেছিল। তারই একটা রেখে দিল সামনে। কাজ শেষ হতেই নিজের বুদ্ধিতে পুলকিত হয়ে উঠলো ধারা। প্রসন্ন মুখে ভাবতে লাগলো, 'ব্যাস! খোঁচারাজ, আজকে এই ধারা তোমাকে দেখাবে কয়টা ধানে কয়টা চাল হয়। সবসময় শুধু আমাকে জব্দ করা! আজকে তোমার পালা। সব কাজ শেষ। এখন শুধু তোমার পরনের প্যান্টটাই ভিজিয়ে দেওয়ার পালা!'

রাত গাঢ় হতে লাগলো। আর ধারা রইলো সুযোগের অপেক্ষায়। কখন শুদ্ধ'র পরনের ট্রাউজারটা ভিজিয়ে দিতে পারবে! অন্যদিকে ব্যস্ত থেকেও সদা দৃষ্টি মেলে ধরে রাখলো শুদ্ধ'র দিকেই। কিন্তু আফসোস এমন কোন সুযোগই ধারার কাছে এলো না। পাশের বাড়ির আবুল যখন শুদ্ধ'র সাথে আলাপের জন্য সামনের বারান্দায় বসে ছিল। তখন তাদের দুজনকে শরবত দেওয়ার বাহানাতেও ধারা একটা গ্লাস ইচ্ছে করে শুদ্ধ'র হাঁটুর উপর ফেলতে চাইলো। কিন্তু হলো না। পায়ে হোচট খেয়ে সেই গ্লাস ভুলে পড়লো আবুলের উপর। প্লান তো ভন্ডুল হলোই। তারউপর নিজের কাজের জন্য লজ্জিত হয়ে ধারা দ্রুত বারবার আবুলকে সরি বলে একপ্রকার দৌঁড়েই সেখান থেকে চলে এলো। তারপর যখন রাতের খাবার সময়ও সবাই একসাথে খেতে বসলো, তখনও শুদ্ধকে পানির জগ দেবার বাহানা করে ধারা জগটা কাত করে শুদ্ধ'র পা বরাবর ফেলে দিল। সঠিক সময়ে পা সরিয়ে নেওয়ায় সেবারও বেঁচে গেল শুদ্ধ। জগ সহ ই মেঝেতে পড়ে গেল ধারা। পানি পড়ে মেঝে তলিয়ে গেলো। ধারা এবারও অসফল। উপস্থিত সবাই বিস্মিত। আজ বারবার ধারার হাত থেকে এমন পানি পড়ছে কেন? খোদেজা উদ্বিগ্ন মুখে বলল,
'বৌ, তোমার শরীরটা কি খারাপ লাগতাছে? মাথা ঘুরায়?'

ধারা লজ্জিত মুখে বলল, 'না মা, আমি ঠিক আছি। ঐ একটু হাত ফসকে যাচ্ছে বারবার!'
 
এই বলে একটা ন্যাকড়া নিয়ে ধারা মেঝে মুছতে লাগলো। চুমকি খেতে খেতে বলল,
'ভাবী, তোমার হাতে কি তেল ভরানো?'

শুদ্ধ হেসে বলল, 'তোর ভাবীর মনে হয় তখন কাঁদায় পড়ে গিয়ে চোখে সমস্যা হয়ে গেছে চুমকি? মাথাতেও হতে পারে। সেটা হলে আবার একটু চিন্তার বিষয়ই।'

ধারা সরু চোখে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। যতবারই প্লান ভন্ডুল হোক ধারা হার মানবে না। এই খোঁচারাজকে আজকে একটা শিক্ষা তো ধারা দিয়েই ছাড়বে। মনে মনে আবারও কিছু একটা ভাবলো সে। এবার আর ধারা তার প্লানে বিফল হবে না। এবার করেছে একদম মোক্ষম প্লান। শুদ্ধ না ফেঁসে পারবেই না। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে শুদ্ধ একবার দরজার সামনে রেখে দেওয়া বালতির পানি দিয়ে হাত মুখ ধোয়। সেই সুবিধা মতোই ধারা ওডা'র উপরের বাঁশের সাথে ফিক্সড করে একটা পানি ভর্তি মগ রেখে দিয়েছে। তার হাতলের দড়ি বেঁধে সেট করেছে সিঁড়ির কাছে। অন্ধকারে এর মধ্যে পা বেজে একটু নাড়া লাগলেই মগ উপর হয়ে সব পানি পড়বে সোজা শুদ্ধ'র মাথার উপর। তারপর নিশ্চয়ই খোঁচারাজকে পরনের ট্রাউজারটা পাল্টে আর কোন প্যান্ট খুঁজে না পেয়ে শেষমেশ লুঙ্গিই পড়তে হবে! তার চেহারাটা তারপর হবে একদম দেখার মতো! কল্পনায় ভাবতেই নিজের মনে লাফিয়ে উঠলো ধারা। এইবার কিছুতেই ফেইল হওয়া যাবে না। রাতে ঘুমানোর সময় হলে ধারা বারবার শুদ্ধকে তাগাদা দিতে লাগলো বাইরে গিয়ে হাত মুখ ধোবার জন্য। শুদ্ধ যতই বলে একটু পরে যাবে, ধারা যেন ততোই নাছোড়বান্দা। শুদ্ধ'র খানিক খটকা লাগলো। তবুও তা পাত্তা না দিয়ে সে গিয়ে ভালো মতোই হাত মুখ ধুয়ে আসলো। ফিরে আসতেই ধারা চোখ কপালে তুলে ফট করে জিজ্ঞেস করে ফেললো,
'একি! আপনি এমন শুকনো কেন?'
শুদ্ধ বুঝতে না পেরে বলল, 'কোথায় শুকনো? আমার মুখ তো ভেজাই। এই যে!'

এই বলে সে ধারার দিকে আঙ্গুল দিয়ে এক ফোঁটা পানি ছুঁড়ে মারলো। ধারা সেদিকে খেয়াল না করে তৎপর হয়ে বলল, 'আপনার শরীর তো শুকনো!'

'আমি কি গোসল করতে গিয়েছি যে সব ভেজা থাকবে! শরীর তো শুকনো থাকবেই।'

এই বলে শুদ্ধ চলে গেলো। বিরক্তিতে ধারা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুই বুঝতে পারলো না। এইবারের প্লানটাও কিভাবে কাজ করলো না! সে নিজে গিয়ে একবার সেই জায়গায় দাঁড়ালো। পা দিয়ে দড়িটা খোঁচা দিতে লাগলো। দেখলো দড়িটা অনেক টাইট হয়ে আছে। নড়ছে না। বোধহয় ভালো মতো দড়িটা সেট করতে পারেনি। আরো কিছুক্ষণ দড়িটা নিয়ে টানাটানি করার পর শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ধারা পা দিয়ে দড়িটা একবার জোরেই টান দিল। আর সাথে সাথে পানি ভর্তি মগের সব পানি তার মাথার উপর পড়লো। মুখ হা হয়ে গিয়ে ধারা নিজের ভেজা শরীর নিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আর তারপরই কানে ভেসে এলো শুদ্ধ'র কান ফাঁটানো হাসির আওয়াজ। হাসতে হাসতে শুদ্ধ পেছন থেকে বেড়িয়ে এলো। সে মূলত সন্দেহ বশতই ধারার পেছন পেছন এসেছিল ধারা এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন বোঝার জন্য। কিন্তু এসে যে এমন একটা দৃশ্য দেখবে তা স্বপ্নেও ভাবে নি। হাসতে হাসতে শুদ্ধ বলল,
'আপনি আমাকে ভেজাবার জন্য এসব কিছু করেছেন! কিন্তু কেন?'

ধারা কিছু না বলে গটগটিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আজকে সন্ধ্যার পর এই নিয়ে তার দু বার জামা পাল্টানো হলো। আর যার জন্য এসব করেছে তার হলো না কিছুই। আবারও গামছা নিয়ে ধারা মাথা মুছতে লাগলো। মুখে তার আমাবস্যার অন্ধকার। শুদ্ধ রুমে এসে খেয়াল করলো তার একটা প্যান্টও আলমারিতে নেই। নিচে বাথরুমে গিয়ে দেখলো সব একটা বালতিতে ভেজানো। তারপর আবার রুমে এসে খেয়াল করলো বিছানার উপর একটা লুঙ্গি রাখা। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে শুদ্ধ'র বিচক্ষণ মস্তিষ্ক এবার ধারার উদ্দেশ্য ধরতে পারলো। আবারও এক দমক হেসে উঠে শুদ্ধ বলল,
'সিরিয়াসলি আপনি আমাকে লুঙ্গি পরানোর জন্য এতক্ষণ এতো কিছু করেছেন? আই কান্ট বিলিভ!  
শেষমেশ কি হলো সেই আপনার নিজের উপরেই পানি পড়ে গেলো।'

ধারা ছোট ছোট চোখ করে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। শুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামিয়ে বলল,
'আচ্ছা ঠিকাছে, আপনার যেহেতু আমাকে লুঙ্গি পরানোর এতোই ইচ্ছা তাহলে আমি এমনিই পরছি। আপনাকে এর জন্য এতো কিছু করতে হবে না।'

ধারা উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলে উঠলো, 'সত্যি!'

'হুম।'

ধারা হাসিমুখে বিছানা থেকে লুঙ্গিটা তুলে শুদ্ধ'র দিকে বাড়িয়ে ধরলো। শুদ্ধ লুঙ্গিটা হাতে নিয়ে নিল। ধারা আবারও বলল, 'আপনি কি সত্যিই পরবেন?'

শুদ্ধ নিজের হাসি চেঁপে রেখে বলল,
'হ্যাঁ, সমস্যা কি? ভয় তো পাই অন্যদের সামনে থাকলে। আপনার সামনে আমার লুঙ্গি খুলে যাওয়া নিয়ে কিসের ভয়! আপনি তো আমার বউ ই। আপনার কাছে আর লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আপনার যদি কোন সমস্যা না থাকে তাহলে আমারও কোন সমস্যা নেই।'

ধারার মুখের হাসি সব এক নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, শুদ্ধ যখনই লুঙ্গি পরার জন্য প্রস্তুত হতে নিলো ঠিক তখনই একটা 'না' বলে চিৎকার দিয়ে ধারা দ্রুত চোখ বন্ধ করে পেছনে ঘুরে বলল,

'প্লিজ! লুঙ্গি পরবেন না।'


চলবে********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#13
পর্ব-৯

 
ধারার এহেম আতঙ্কিত রূপ দেখে শুদ্ধ হেসে ফেললো। শুদ্ধকে জব্দ করতে গিয়ে যে ধারা নিজেই জব্দ হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরেই গোমড়ামুখে চলে যেতে নিল ধারা। পেছন থেকে 'ধারা' বলে ডেকে খপ করে তার হাত ধরে ফেলল শুদ্ধ। ধারা ফিরে তাকাতেই স্মিত হেসে শুদ্ধ বলল,
'সরি!'
ধারা অবাক মুখে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে রইলো। শুদ্ধ বলতে লাগলো,
'আই অ্যাম সরি ধারা! এতক্ষণের সবকিছুর জন্য।'

ধারা নরম হয়ে গেলো। ধারার হাত থেকে গামছাটা নিয়ে শুদ্ধ বলল,
'আপনার মাথা মোছা হয়নি। চুল থেকে পানি পড়ছে। ধরতে গেলে এই নিয়ে তিনবার আপনার মাথা ভেজানো হয়ে গেলো। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। দিন, আমি আপনার মাথা মুছে দিচ্ছি।'

এই বলে শুদ্ধ'ই ধারার মাথা মুছে দিতে লাগলো। ধারার খানিক লজ্জা অনুভুত হলো তবুও কিছু বলতে পারলো না। কিছুক্ষণ পর কিছু বলতে গিয়েও শুদ্ধ থেমে গিয়ে বলল, 'এক সেকেন্ড!'
তারপর ধারাকে কিছু বলতে না দিয়েই কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেলো। ক্ষণকাল পরে ফিরে এলো দু কাপ রং চা নিয়ে। ধারা তখন কাঠের বারান্দায় নিচে হেলান দিয়ে বসে আছে। শুদ্ধ তার পাশে বসে ধারার দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বলল, 'নিন, গরম গরম রং চা। যদিও এই পরিবেশে দুধ চা টাই হতো বেটার। কিন্তু বাসায় দুধ ছিল না।'

ধারা মৃদু হেসে চায়ের কাপ হাতে নিল। কাপে একবার চুমুক দিতে না দিতেই শুদ্ধ বলল,
'আপনিও যে এতো ঝগড়ুটে হতে পারেন সেটা আজ দেখলাম।'

শুদ্ধ মনের সুখে চায়ের কাপে একের পর এর চুমুক দিচ্ছে। থেমে গেছে শুধু ধারা। লাজুক মুখে মাথা নিচু করে ধারা ভাবতে লাগলো, সত্যিই তো আজকের মতো এমনটা তো ধারা কখনোই করেনি! আজ হঠাৎ কি হয়ে গিয়েছিল তার? এই প্রথম নিজেকে কিছুটা খোলামেলা লাগলো ধারার। মনে হচ্ছে কোন একজন বিশেষ কারো কাছে তার নিজস্ব সব জড়তা, রাখ ঢাক কেটে গেছে। ধারার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে শুদ্ধ বলে উঠলো,
'আরে! খাচ্ছেন না কেন? চা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।'
শুদ্ধ'র কথা শেষ হতে না হতেই আকাশে মৃদু আলোর ঝলক উঠে গর্জে উঠলো। শুদ্ধ সেদিকে তাকিয়ে আশাবাদী মুখে বলল,
'বৃষ্টি টা নামলে ফসলের জন্য ভীষণ ভালো হতো। দোয়া করুন ধারা যাতে বৃষ্টি হয়।'

ধারা বলল, 'আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?'

'করুন।'

'শহরে এতো বছর পড়ালেখা করে আপনি গ্রামে এসে এসব করছেন কেন?'

শুদ্ধ মৃদু হেসে বলল, 'স্বপ্ন বুঝেন ধারা? স্বপ্ন! আমার একটা স্বপ্নই ছিল এটা। ইচ্ছে ছিল ব্যতিক্রম কিছু একটা করার। বাবা ছিল না। অনেক ছোট থেকেই আমাকে আমাদের জমিগুলো দেখাশোনার কাজে নামতে হয়েছে। অনেক কাছ থেকে কৃষকদের ফসলের প্রতি মায়া, টান, যত্নগুলো দেখেছি। মাঝে মাঝে ফসল নষ্টে তাদের আহাজারিও দেখেছি। কৃষক আর ফসলের মধ্যে একটা অন্যরকমই সম্পর্ক থাকে। ভালোবাসা, বিরহ এই সম্পর্কের মধ্যেও বিদ্যমান। ইচ্ছে ছিল তাদের নিয়ে কিছু করার। এই সম্পর্কটা অটুট থাকুক। আধুনিক জীবনের ছোঁয়ায় মানুষ কৃষি বিমুখী না হয়ে উঠুক। ফসলের উপর যদি পরিশ্রম দেওয়া যায় তাহলে খুব কমই নিরাশ হতে হয়। প্রয়োজন শুধু কিছু সঠিক পন্থা অবলম্বনের। যদি আধুনিক কিছু যন্ত্রপাতি আর ব্যবস্থার প্রয়োগ করা হয় তাহলে কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য আসবেই। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকেরা বেশিরভাগই হয় মূর্খ। তারা অধিক উৎপাদনের উপায়, সারের সঠিক ব্যবহার, ফসল রক্ষা করা, যোগান দেওয়া এগুলো সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করে অনেক ছাত্রকেই দেখেছি সরকারি চাকুরীর পেছনে ছুটতে। আমি ভাবলাম এতদিন কৃষি নিয়ে এতো কিছু শিখলাম আমার জ্ঞানটাকে আমি কৃষির পেছনেই লাগাই। ঐ যে বললাম না, ব্যতিক্রম কিছু করার ইচ্ছা ছিল! যেমনটা ভেবে রেখেছে সেটাই যদি হয় তাহলে খারাপ হবে না।'

'আচ্ছা, কৃষি উদ্যেক্তা ব্যাপারটা না আমি ঠিকমতো বুঝতে পারলাম না। আপনার কাজের ধরণটা কি?'

'আমি কৃষি ব্যাংক থেকে একটা বড় অঙ্কের লোন নিয়ে বিশাল পরিমাণের জমি লিসে নিয়েছি। সেখানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাল্টা, কমলা, লেবু, টমেটো, ড্রাগন ফল, বারোমাসি আমের চাষাবাদ করছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডিপ ইরিগেশনের ব্যবস্থা করে পানি সেচের ঝামেলা দূর করেছি। এতে আমার পানিও সাশ্রয় হচ্ছে। রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে এক ধরণের জৈবসার নিজেরাই প্রস্তুত করে ফসলে ব্যবহার করি। এতে করে আমার খরচ কম, প্রোফিট বেশি হচ্ছে। এখন সামনে গ্রিন হাউজের মাধ্যমে চাষাবাদের ব্যবস্থা করতে চাইছি। এতে করে খুব অল্প জমিতেই আমি অধিক পরিমাণে ফসল উৎপাদন করতে পারবো। এতক্ষণ যেটা বললাম, এটা আসলে আমার ব্যকআপ। আমার মূল চেষ্টা আরেকদিকে। এই যে বললাম আমি জমি লিসে নিয়েছি। কিছুটা আমাদের নিজেদেরও আছে। এই জমিগুলোকে আমি দুইভাবে ভাগ করেছি। একভাগে এতক্ষণ যেগুলো বললাম সেগুলো হচ্ছে। আরেকভাগে ধান চাষ করবো। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে একদম কম খরচে একধরনের নতুন প্রজাতির উচ্চ ফলনশীল ধান উদ্ভাবনের চেষ্টা করছি আমি। এই ধানটা উদ্ভাবনে যদি সাকসেস হই না আমার সব কষ্ট সার্থক। এই সব কাজের জন্য আমি বেশিরভাগ বেকার ছেলেদেরই ঠিক করেছি। তাদেরকে এসব শিখিয়ে কৃষির প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে চাই। এতে করে আমাদের রূপনগরের বেকারত্বের সংখ্যাও হ্রাস পাবে। যেমনটা ভেবে রেখেছি তেমনটাই যদি করতে পারি তাহলে শুধু রূপনগরের না আমাদের দেশের কৃষকরাও ধান চাষে অনেক লাভবান হবেন।'
 
ধারা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনে বলল,
'আপনি যেটা করতে চাইছেন তা হলে আসলেই খুব ভালো হবে। কিন্তু সফলতা প্রসঙ্গে ব্যাপারটা বোধহয় আসলেই একটু রিস্কি হয়ে যায়।'

মৃদু হেসে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে শুদ্ধ বলল, 'আমি জানি সেটা। এতো বড় লোন, তারপর এতোগুলো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হবে! তবে আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে। আমার মনে হয় আমি পারবো। বলতে পারেন প্রথম থেকেই আমার নিয়তই ছিল এই লাইনে আসার। একটা কৌতূহল কাজ করতো। একারণেই আমি অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাই না করে এডমিশনের সময় শুধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ই বেছে নিয়েছিলাম। জানেন ধারা, তখন আমার শিক্ষক, বন্ধু থেকে শুরু করে অনেকেই অনেক ভাবে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল মেডিকেলে, বুয়েটে ট্রাই করার। বলতো, আমি ভালো ছাত্র ছিলাম চেষ্টা করলেই পারবো। তারপর যখন গ্রাজুয়েট হয়ে বেরোলাম তখনও সবাই বলেছে চাকুরীর জন্য ট্রাই করতে, এসবের কোন ভবিষ্যত নেই। আমি জানি মুখ ফুটে না বললেও আম্মাও আমার কাজটা নিয়ে খুব একটা প্রসন্ন নন। সবার মতো তিনিও আশা করেন আমি একটা সিকিউর বড় চাকরি করি। কিন্তু আমি আমার স্বপ্নটাকে উপেক্ষা করতে পারবো না। আমি সবসময় আমার ইচ্ছাশক্তিটাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। কারণটা কি জানেন, আপনার যেটা স্বপ্ন, যেটা ইচ্ছা, সেই রাস্তায় গিয়ে যদি আপনি হেরেও যান তবুও মনে কোন আফসোস থাকবে না। আর যদি অন্যের কথা শুনে নিজের পছন্দের রাস্তা ত্যাগ করেন তাহলে সারাজীবন একটা আফসোসের সাথে কাটাতে হবে। সবসময় শুধু মনে হবে, হয়তো আমি আরেকটু চেষ্টা করলেই পারতাম! হয়তো আমি সফল হতাম! আমি কেন ছেড়ে দিলাম! আফসোস জিনিসটা খুব খারাপ ধারা। এটা মানুষের জীবনের সমস্ত আনন্দটাকে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আমি আমার নিজের ইচ্ছেটাকেই প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। আমার পরিপূর্ণ চেষ্টা আমি করবো। তারপরও যদি অসফল হই। তাহলে খারাপ লাগবে, খুব কষ্ট হবে। কিন্তু আফসোস থাকবে না। কারণ আমি আমার মনেরটা শুনেছি। যেখানে আমার আনন্দ লাগে সেখানে আমি আমার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। এখন বাকিটা আল্লাহ ভরসা! আমার কোন আফসোস নেই।'

ধারা মুগ্ধ হয়ে শুদ্ধ'র সবটুকু কথা শ্রবণেন্দ্রিয় করে মিষ্টি করে হেসে বলল, 'একটা কথা বলবো? আমার মনে হয়, আপনি পারবেন।'

শুদ্ধ হেসে ফেলে বলল, 'ধন্যবাদ, এই অধমের উপর এতো বিশ্বাস রাখার জন্য। আমার কথা বাদ দিন। আপনার কথা বলুন। আপনি সামনে কি করবেন? কোথায় ভর্তি হবেন?'

নিজের পড়ালেখা বিষয়ক কথা উঠতেই ধারার মুখটা মলিন হয়ে যায়। শুদ্ধ'র তা দৃষ্টিগোচর হওয়ার আগেই হঠাৎ বৃষ্টি নেমে সেখানে লোডশেডিং হবার জন্য সেই আলাপটা সেখানেই থেমে যায়।
__________________________________________

শাহেদ এসেছে বাড়িতে। দেশে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে ধারার বিয়েতে সে আসতে পারেনি। এখন অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় চলে এসেছে। শাহেদ এসেছে সকালে। চট্রগ্রাম থেকে গতকাল রওনা করেছিল। আসা পর থেকেই বাড়িতে একপ্রকার গমগমে অবস্থার সৃষ্টি করে ফেলেছে সে। তার মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। প্রসঙ্গ ধারার বিয়ে। প্রকৃতপক্ষে ধারাকে শাহেদ অত্যন্ত ভালো জানে। ধারার নাম রাখা থেকে শুরু করে সাবজেক্ট চয়েজ পর্যন্ত সবকিছু শাহেদেরই করা। ধারার বিয়ে ভাইজান রাগ করে এরকম একটা ঘরে দিয়ে দিয়েছে এটা সে একদমই মানতে পারছে না। তার নিজস্ব রেপুটেশনেও ব্যাপারটা অত্যন্ত বাঁধছে। সে চতুর প্রকৃতির লোক। মানুষকে তার কথার আয়ত্তে এনে ফেলতে পারে। সে যদি সেসময় উপস্থিত থাকতো তাহলেও একটা কিছু করতে পারতো। কিন্তু তা তো আর সম্ভব হয়ে উঠতে পারেনি। বাড়ি এসেই কতক্ষণ জমিরন বিবির সাথে এ নিয়ে কথা কাটাকাটি করেছেন। আজিজ তালুকদার বাড়িতে ছিলেন না। কিছুক্ষণ আগেই ফিরে এসেছেন। বড় ভাইজানকে শাহেদ সম্মান করে। একারণেই তার সামনে হৈ চৈ না করে থম মেরে বসে আছে। আজিজ সাহেবের মুখের অবস্থাও খানিক গুরুগম্ভীর। শাহেদ আর থাকতে না পেরে বলল,

'ভাইজান, আপনি এইটা কি কাজ করলেন? আমি এখনও ভাবতে পারছি না। ধারার বিয়েটা আপনি কিভাবে এমন করে দিতে পারলেন!'

আজিজ সাহেব কিছু বললেন না। গম্ভীর হয়ে মুখটা সামনের দিকেই নিবদ্ধ করে রাখলেন। শাহেদ বলতে লাগলো,

'ভাইজান, আপনি মানেন আর না মানেন, এই কাজটা কিন্তু আপনি একদমই ঠিক করেননি।' 

'আমি কি করবো! এতকিছু করলাম ও'র জন্য। আম্মায় এতো চিল্লাচিল্লি করার পরও কখনো ওরে দিয়ে একটা কাজ করতে দেইনি। যখন যা দরকার সব এনে দিয়েছি। শুধু বলছি, তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করো, একটা ভালো রেজাল্ট করো। কিন্তু শেষমেশ কি করলো? জয়নালের পোলা এ প্লাস পাইলো কিন্তু ও পাইলো না।'

বলতে বলতে আজিজ সাহেব থেমে গেলেন। তার কন্ঠে মেয়ের জন্য একরাশ অভিমান ঝরে পড়লো। শাহেদ বলল,
'বুঝলাম ধারা এ প্লাস পায়নি, আপনার রাগ উঠেছে। রাগটা তো আমারও উঠেছিল। আরে! এখনকার দিনে এ প্লাস ছাড়া কোন দাম আছে নাকি! আমি নিজেও তো সব পরীক্ষায় সেরাটাই করেছি। কিন্তু তাই বলে আপনি মেয়েটার এভাবে বিয়ে দিয়ে দিবেন। আচ্ছা, বুঝলাম আপনার দিতে ইচ্ছা হয়েছে আপনি দিবেন। একটা ভালো ঘর দেখেই বিয়ে দিতেন। ভালো নাম ডাক আছে, অবস্থা আছে এমন দেখেই দিতেন। তা না! আপনি এই কার সাথে বিয়ে দিলেন বলেন তো! কি আছে ছেলেদের? আমাদের সাথে কি ওরা যায়? একটা ভালো ঘরে দিতেন, গ্রামে আমাদের মান সম্মানটাও আরো বাড়তো। ধারার ভবিষ্যৎটা নিয়েও তো একটু ভাববেন ভাইজান। দেখতে শুনতে সবদিক দিয়ে এই গ্রামের মধ্যে ধারার মতো আরেকটা মেয়ে কেউ খুঁজে পাবে? একটা ভালো পরিবারে বিয়ে দিলে আজকে সবকিছুই কতো সুন্দর হতে পারতো। আমি আরও কত কিছু ভেবে রেখেছিলাম যে আমি দেখে শুনে একটা বড় চাকরিজীবী ছেলের সাথে ধারার বিয়ে দেবো। আমার জন্যও তো একটু অপেক্ষা করতে পারতেন। আমাদের বাড়িতে আর কোন মেয়ে কি আর আছে! একটাই মেয়ে, তার বিয়েটাও কিনা আপনি ভাইজান এইভাবে দিয়ে দিলেন।'

আজিজ সাহেব আর কিছু বললেন না। চুপ করে থেকে শাহেদের কথা শুনতে লাগলেন। এই প্রথম তার মনে হল, কিছু না ভেবেই হুট করে ধারার সেখানে বিয়ে দেওয়া তার আসলেই উচিত হয়নি।

চলবে*********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#14
পর্ব-১০


 

খোদেজা রান্নাঘরে বসে বটি দিয়ে তরকারি কুটছে। তার সামনেই জ্বলন্ত মাটির চুলা। সেখানে পাতিলে করে কাঁচা কলা সিদ্ধ হচ্ছে। তা দিয়েই আজকে দুপুরে খাবার জন্য ভর্তা করা হবে। ধারা আর শুদ্ধ'র আজকে দাওয়াত আছে, ধারার বাপের বাড়ি। ধারার ছোট চাচা বিয়েতে ছিলেন না। শুদ্ধকে দেখেননি। তিনি তার ভাতিজির জামাইকে দেখতে চান। সেই সুবাদেই আজ দাওয়াত দেওয়া হয়েছে তাদের। এই ফাঁকে পরিচয়ও হবে। এজন্যই আজ দুপুরে খাবারে ভারী আয়োজন রাখেননি খোদেজা। ছেলে, বৌ দুজনই চলে যাবেন। খাবে তো শুধু চুমকি আর সে। তাই ভাত, ভর্তা, বেগুন ভাজা আর একটু ডাল দিয়েই রান্নার পাটটা তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলার নিয়ত তার। কিন্তু তা হবে বলে মনে হচ্ছে না। পাশের বাড়ির মকবুল আর তার বৌ এসেছে খোদেজার কাছে। আজ সকালেই ছোটভাই আবুলের সাথে তার লেগেছে তুমুল ঝগড়া। সেই ঝগড়ার পুরো বর্ণনা আর এর পেছনে মূল দায়ী যে আবুলই তাই সাজিয়ে গুছিয়ে তারা শুনিয়ে যাচ্ছে খোদেজাকে। খোদেজা মনোযোগ দিয়েই ওদের দুজনের কথা শুনছে আর কাজ করছে। ধারা গেছে গোসলে। তাই শুদ্ধও গোসলখানার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের দাওয়াতের জন্যই আজ সকাল সকাল গোসল করা ধারার। ধারা গোসলে ঢুকেছে অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। শুদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠে বলল,
'ধারা, আর কতক্ষণ? তাড়াতাড়ি করুন। আমাদের আপনাদের বাড়িতেও তো যেতে হবে।'

ভেতর থেকে ধারা চেঁচিয়ে বলল,
'এই তো হয়ে গেছে। আর একটু....!'

কিছুক্ষণ পর ধারা ব্লাউজ পেটিকোটের উপর একটা হলুদ শাড়ি কোনরকমে পেঁচিয়ে বের হয়ে এলো। ভেজা জামা কাপড়ের বালতি হাতে নিয়েই বললো, 'হয়ে গেছে, চলুন।'

যাবার জন্য এক পা বাড়িয়েও দিল ধারা। কিছুক্ষণ ধারার দিকে তাকিয়ে থেকে শুদ্ধ দ্রুত বলে উঠলো, 'এক মিনিট! দাঁড়ান।'

ধারা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, 'কি হলো?'

'আপনার এই অবস্থা কেন? শাড়ি শুধু পেঁচিয়েই রেখেছেন, পড়েননি কেন? আপনি শাড়ি পরতে পারেন না?'

'পারি তো। কিন্তু শাড়িটা দেখছেন না! একদম নতুন শাড়ি, এখনও ভাঁজও ভাঙা হয়নি। পরতে গেলে ফুলে থাকবে। কল পাড় একদম ভিজে আছে। এখানে কিভাবে পরবো? তাই এখন কোনমতে প্যাচ দিয়ে রেখেছি। রুমের ভেতর গিয়ে পরবো। চলুন।'

আবারও ধারাকে থামিয়ে শুদ্ধ বলল,
'দাঁড়ান, দাঁড়ান। যাবেন না। রান্নাঘরের সামনে মকবুল ভাই আর তার বৌ দাঁড়িয়ে আছে।'

ধারা থেমে গিয়ে কিছুটা ভেবে বলল,
'ও! কিন্তু এখন আর কি করবো? কলপাড়ও তো একদম ভেজা। কুচি ঠিক করে পরতে গেলেই শাড়ি পুরো ভিজে যাবে।'

'আপনি এখানেই শাড়ি নিয়ে এসেছেন কেন? এখন গোসল করে একটা থ্রি পিছ পরতেন তারপর না হয় ভেতরে গিয়ে শাড়ি পরতেন।'

'ঠিকই। কিন্তু তখন তো আর এতকিছু ভাবিনি। আর আমি কি জানতাম এখানে কোন লোক এসে পরবে। এখন কি করবো? আচ্ছা দাঁড়ান।'

এই বলে ধারা ভেতরে গিয়ে মাথা টাথা ঢেকে আরো ভালো মতো শাড়ি পেঁচিয়ে বের হয়ে বলল,
'এইবার হয়েছে? এখন চলুন।'

'কোথায় হয়েছে? আপনার সাইডে কোমড় বের হয়ে আছে?'

ধারা লজ্জা পেয়ে চমকে উঠে তাড়াতাড়ি সেখানে তাকিয়ে শাড়ি টেনে ঢেকে নিল। শুদ্ধ বলল,
'আপনি একটা কাজ করুন। গোসলখানার ভেতরে যান। শাড়ি পরে তারপর বাইরে আসুন। দেরি হলে হোক।'

'আপনাকে তো বললামই, কলপাড় পুরো ভেজা। আমি একা একা এখানে কিভাবে শাড়ি পরবো? এভাবেই চলুন। এখন তো ভালোমতো ঠিক করেছিই। তারা তো রান্নাঘরে দাঁড়ানো। আমি তাড়াতাড়ি ওটার সামনে দিয়ে চলে যাবো। সমস্যা নেই।'

শুদ্ধ বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বলল,
'আপনার সমস্যা না থাকলেও আমার সমস্যা আছে। আমি কাউকে এভাবে আমার বৌকে দেখতে দেবো না।'

এই বলে শুদ্ধ ধারার হাত টেনে গোসলখানার ভেতরে নিয়ে এলো। ধারা হতবাক। এতক্ষণ ভেবেছিল শুদ্ধ হয়তো ধারা অন্যদের সামনে লজ্জা পাবে ভেবে বলছে। আর এখন এটা কি শুনলো! আর কিভাবেই না দ্বিধাহীন লোকটা লজ্জাশুন্য কণ্ঠে কতই না অনায়াসে আমার বৌ বলে দিলো। মুহুর্ত গড়াতেই একদম লজ্জাবতী গাছটির ন্যায়ই গুটিয়ে গেলো ধারা। বুকের মধ্যকার অপ্রতিরোধ্য ধুকপুক ধ্বনি বৃদ্ধি পেলো কয়েকগুণ। শুদ্ধ বলল,
'দেখুন, হিরোদের মতো আমি শাড়ি পরাতে পারি না। কোনদিন দেখিওনি কিভাবে পরে। আমি শাড়িটা ধরে রাখছি। আপনি আপনার মতো পরুন। কোন হেল্প লাগলে আমি চেষ্টা করবো।'

ধারা ধীরে ধীরে শাড়ি পরতে লাগলো। শুদ্ধ শাড়ি পানি থেকে ভেজানো থেকে বাঁচিয়ে রেখে যতটুকু সম্ভব ধরে রাখলো। বিপত্তিটা বাঁধলো কুচি ঠিক করতে গিয়ে। কুচি ঠিক করতে গিয়ে শুদ্ধ ঠিক করার থেকে বেশি আরো গুলিয়ে ফেললো। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অতিষ্ট হয়ে উঠলো ধারা। শুদ্ধকে যতোই বলল 'আপনি ছেড়ে দিন, হবে না। আমিই দেখছি।' শুদ্ধ ততই নাছোড়বান্দা। এর শেষ সে দেখেই ছাড়বে। এতো এতো কঠিন কাজ সে করেছে। শাড়ি পরানো এমন কি জিনিস যে সে পারবে না! আজকে শাড়ি পরানো সে শিখেই ছাড়বে। ধারার মনে হলো, আজকে বোধহয় ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পরবে। শুদ্ধ তখন একদম সিরিয়াস মুডে। তার সমস্ত ধ্যান শাড়ির কুচির দিকে। মনে হচ্ছে কোন জটিল যুদ্ধ পরিচালনার কাজে আছে সে। শাড়ির একপ্রান্ত শুদ্ধ'র হাত ফসকে ভেজা জায়গায় পরতে নিলে ধারা অনুযোগের স্বরে বলে উঠলো,
'কি করছেন কি? এভাবে কেউ শাড়ি ধরে! এজন্যই বলছিলাম, আগে ভেতরে গিয়ে নেই।'

তখন বাইরে দিয়ে পাশের বাড়ির নাজমা কলপাড়ে আসছিল। ভেতর থেকে হঠাৎ এই কথাটা তার কানে আসলো। এই কথার মানে নাজমা কি বুঝলো কে জানে! মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হঠাৎ জোরে জোরে হেসে উঠলো সে। শুদ্ধ ধারা দুজনেই চমকে উঠলো। নাজমা বলতে লাগলো, 'এইবার বুঝলাম মাহতাব ভাই। ভেতরে ভেতরে তাইলে এই চলে! এই কারণেই আমাদের কাউরে ভেতরে ঢুকতে দেন না।'

ধারার গাল লজ্জায় লালবর্ণ ধারণ করলো। শুদ্ধ কি করবে না করবে বুঝতে না পেরে মাথা চুলকে একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বলল, 'ভাবী, আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন কিছু না।'

নাজমা দুষ্টমির ন্যায় বলে উঠলো, 'আমি আবার কখন বললাম আমি কিছু ভাবতাছি? চোরের মনে পুলিশ পুলিশ।' 

নাজমা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। শুদ্ধ ধারা বিব্রত হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। নাজমা বলল,
'চালায় যান দেবরজি, চালায় যান। আমরা ভাবী মানুষ কি আর দেবরের সোহাগের সময় বাধা হইতে পারি! আমি চললুম।'

নাজমা চলে গেলে শুদ্ধ, ধারা দুইজনই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর বাকিটুকু ঝটপট করে ফেলে অবশেষে শাড়ি পরা সম্পন্ন হলো ধারার। সব শেষ হতেই ধারা বলল,
'এইবার হয়েছে? এখন যাবো?'

শুদ্ধ হুম বলতে গিয়েও থেমে গিয়ে বলল, 'এক সেকেন্ড!' তারপর ধারার আঁচলটা টেনে দু হাত দিয়ে মাথায় একটা ঘোমটা পরিয়ে হেসে বলল, 'এইবার একদম পার্ফেক্ট!'

শুদ্ধ মুখের হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ধারার দিকে। ধারা তখন একটা হলুদ পরী। কাঁচা হলুদ আবরণে মুড়িয়ে থেকে, প্রভাত স্নানের স্নিগ্ধ সুভাস মুখরিত মুখমন্ডলে সকালের সোনালী রোদের লুটোপুটি খেলা তার ফর্সা মসৃণ ত্বকটিকে হলুদাভ করে তুলেছে। এই অনিন্দ্য হলুদ সুন্দরীটি তখন নিজ জ্ঞাত শুন্য। সামনের পুরুষটির গালের টোল পরা হাসিই যে তার ধ্যান কেড়ে রেখেছে।
__________________________________________

শুদ্ধ ধারার মধুপুর গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর বারোটা বেজে গেলো। জামাই মেয়েকে একসাথে দেখে প্রসন্ন মুখে এগিয়ে গেলো আসমা। একে একে সবাইকে ডেকে নিয়ে আসলো সেখানে। শুদ্ধ শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে সালাম করার পর পরিচিত হলো শাহেদের সাথে। আসমা ওদের দুজনকে ভেতরে বসিয়ে চলে গেলেন খাবারের আয়োজনে। শাহেদ গভীর মনোযোগের সাথে তার সামনে বসা ছাব্বিশ কি সাতাশ বছরের যুবকটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। না! জামাই হিসেবে দেখতে শুনতে খারাপ না। এখন মেয়ে যেহেতু দিয়েই ফেলেছে তাই আর কি করার! ধারা বলল,
'ছোট চাচা, কাকী আর তামিম ভালো আছে? তাদেরকেও নিয়ে আসলেন না কেন?'

'আরে ধারা, আমি কি আর বেশি দিনের ছুটি এনেছি। তামিম কত ছোট না! আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে কি আর এতো জার্নি করা যায়! আবার যখন বেশি দিনের ছুটিতে আসবো তখন নিয়ে আসবো। একসময় যাস আমাদের ওখানে বেড়াতে। তুই আর শু...শু কি যেন নাম!'

শুদ্ধ স্পষ্ট স্বরে বলল, 'শুদ্ধ।'

'কি?'

শুদ্ধ আবারও বলল, 'শুদ্ধ।'

'ঐ...যাস শুদ্ধকে নিয়ে বেড়াতে চট্টগ্রামে।'

ধারা মাথা দুলিয়ে বলল, 'আচ্ছা।' 
শাহেদ বলল, 'আমি শুদ্ধকে নিয়ে একটু হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। তুই থাক এখানে। আর শোন, ফ্যান বন্ধ করে দে। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। তোরও ঠান্ডা লাগবে।'

শাহেদের কথা অনুযায়ী ধারা উঠে ফ্যান বন্ধ করে দিলো। অথচ ধারার নাক মুখে ঘাম জমে আছে। তারা এই মাত্রই বাইরে থেকে এসেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার গরম লাগছে। তবুও ধারা কিছু বলল না। শুদ্ধ খানিক অবাক হলো।

শাহেদ শুদ্ধকে নিয়ে বসার ঘরে সোফায় গিয়ে বসল। এবার শুদ্ধকে সরাসরি বলল, 'আচ্ছা শুদ্ধ, তুমি কি কাজ করো? বাড়ির কেউ তো দেখলাম তোমার কাজের ব্যাপারে ঠিকমতো গুছিয়ে বলতেই পারছে না।'

শুদ্ধ ও'র সমস্ত কাজের ধরণটা, কি করতে চায় সবটা শাহেদকে বুঝিয়ে বলতে লাগলো। কিন্তু সবটা একদম মাথার উপর দিয়ে গেলো শাহেদের। এতে করে লাভটা কি সে বুঝতে পারলো না। শুদ্ধ তবুও ধৈর্য্যের সাথে শাহেদকে বোঝাতে লাগলো। শাহেদ বারবারই বারবারই শুদ্ধকে কথার মাঝে থামিয়ে বলতে লাগলো, 'এসব বাদ দাও। তুমি নাকি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলে! রেজাল্ট অনেক ভালো! একটা কাজ করো বিসিএসে ট্রাই করো। একটা ভালো সরকারি চাকরি একবার পেয়ে গেলে তোমার আর ধারার দুজনেরই লাইফ সেট হয়ে যাবে। বিসিএসের জন্যই প্রিপারেশন নাও।'

শাহেদের সাথে শুদ্ধ একমত হলো না। সুস্পষ্ট এবং তার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সাথে সে নিজের অভিমতটাই প্রকাশ করতে লাগলো। প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করলো শাহেদ। শুদ্ধ'র কোন কথাই না বুঝে শেষমেশ একটা কথাই তার বোধগম্য হলো, ছেলে তো দেখি বেয়াদব! বড়দের পরামর্শ শোনে না।

শাহেদ আর শুদ্ধ'র কথার আসর ভাঙলো আসমার ডাকে। টেবিলে খাবার সাজানো হয়েছে। ছেলেদের আগে খেতে দেওয়া হয়েছে। রাতুল গিয়ে বসলো ঠিক শুদ্ধ'র পাশে। এই অল্পদিনের আলাপেই দুলাভাইকে ভারী পছন্দ হয়েছে তার। প্রথম দিনেই তো কি সুন্দর রাতুল আর তার এক ক্লাসমেটের নিত্যদিনের ঝগড়ার কি সুন্দর সমাধান বলে দিয়েছেন তার দুলাভাই। সমাধানটা খুব সুন্দর কাজেও লেগেছে। সেদিন থেকেই শুদ্ধ তার পছন্দের। শুদ্ধ'র বলা সব কথাই রাতুলের কাছে কোন বিজ্ঞানীর থেকে কম লাগে না। আসমা ধারাকেও বলল তাদের সাথেই খেতে বসে যেতে। ধারা গড়িমসি করছিল। বলল পরেই খাবে। আজিজ সাহেব এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। আস্তে করে তিনি পাশ থেকে বললেন,
'বসতে বলছে যখন বসো।'
ধারা ঝট করে বাবার দিকে তাকালো। তার বাবা আজ কতদিন পর তার সাথে কথা বলল। মনটাই ভালো হয়ে গেলো ধারার। সে তাড়াতাড়ি শুদ্ধ'র পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। খাবার দাবারের একটা হুলস্থূল কান্ড ঘটিয়ে রেখেছে আসমা। কি নেই টেবিলে! বেগুন ভাজা থেকে শুরু করে চিংরি মাছ ভুনা, ইলিশ মাছ ভাজা, রুই মাছের কালিয়া, মুরগির রোস্ট, গরুর ঝাল মাংস, পায়েস, পোলাও আরো কত কি! আসমা ব্যস্ত হয়ে পড়ল শুদ্ধকে আপ্যায়নে। শ্বাশুড়ির মন রক্ষার্থে শুদ্ধও খুব বেশি আপত্তি করলো না। ধারার চিংড়ি মাছ পছন্দ। প্রথমেই সে হাত বাড়ালো চিংড়ির বাটির দিকে। ধারার বাবা বলল, 'এটা ঝাল বেশি হয়েছে। খেয়ো না। ইলিশ মাছ নাও।'

ধারা আর নিলো না। ইলিশ মাছ ভাজাই নিলো। শুদ্ধ খেয়াল করলো ঝাল অতো বেশিও না যে খাওয়া যায় না। আর তাছাড়া সবাই তো খাচ্ছে। আরো কয়েকবার ধারার কিছু বিষয় শুদ্ধকে অবাক করলো। দেখতে দেখতে একে একে সবার খাওয়াই শেষ হয়ে এলো। এখন শুধু টেবিলে আছে ধারা, শুদ্ধ আর শাহেদ। শুদ্ধ'র প্লেটে আসমা খাবারের পাহাড় বানিয়ে তুলেছিল বলেই শুদ্ধ পিছিয়ে গেছে। শাহেদ পায়েস খাচ্ছে। ধারার খাওয়াও মোটামুটি শেষ। খাওয়া শেষে ধারা যখন পায়েস নেওয়ার জন্য চামচ দিয়ে নিজের প্লেটের দিকে অগ্রসর হলো তখনই শাহেদ বলল, 'ধারা, নিস না পায়েস। মিষ্টি বেশি হয়ে গেছে। তোর টেস্ট নষ্ট হয়ে যেতে পারে। একটা কাজ কর হাত ধুয়ে আয়। তারপর দই খা।'
শুদ্ধ একবার ধারাকে কথায় কথায় বলতে শুনেছিল মিষ্টি জাতীয় খাবার তার বেশি পছন্দ। শাহেদ বলায় নিজের প্লেটের দিকে বাড়িয়ে নেয়া পায়েসের চামচও ধারা রেখে দিল। সে একবার নিজের থেকে টেস্ট করেও তো দেখতে পারতো এতটুকু মিষ্টি সে খেতে পারে কিনা! শুদ্ধ হতবাক হয়ে রইলো। শাহেদ চলে যাওয়ার পরই শুদ্ধ ডাকলো, 'ধারা!'
ধারা পাশ ফিরে বলল, 'হুম?'
'আপনি কোথায়?'
শুদ্ধ'র হঠাৎ এমন প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে ধারা বিভ্রান্ত স্বরে বলল, 'এই যে।'

শুদ্ধ আফসোসের সহিত বলল, 'আপনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না।'


চলবে*******
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 3 users Like Bangla Golpo's post
Like Reply
#15
অনেক অনেক সুন্দর গল্প
প্লিজ ভাই গল্প টা শেষ করবেন
আর নিয়মিত আপডেট দিবেন
[+] 1 user Likes subnom's post
Like Reply
#16
(23-05-2024, 02:06 AM)subnom Wrote: অনেক অনেক সুন্দর গল্প
প্লিজ ভাই গল্প টা শেষ করবেন
আর নিয়মিত আপডেট দিবেন

ধন্যবাদ আপনাকে উৎসাহিত করার জন্য।
আর চেষ্টা করবো।
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#17
পর্ব -১১



রাত গভীর। আশেপাশে সবকয়টা বাড়ির বাতি নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। বাইরের ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ধারার ভীষণ অস্থির বোধ হচ্ছে। বিকেলে সেই যে শুদ্ধ ধারাকে এই বাড়িতে ফিরিয়ে এনে রেখে গেছে আর তার কোন পাত্তা নেই। এমনকি ফেরার সময় পুরো রাস্তায় ধারার সাথে কোন ধরণের কোন কথাও বলেনি সে। সারাটা পথ গম্ভীর হয়েই থেকেছে। এত রাত হয়ে গেল, মানুষটা এখনো বাড়ি ফিরে এলো না যে! খোদেজা আর চুমকিও রুমের বাতি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। ধারা একবার ভাবলো শ্বাশুড়িকে ডেকে তুলেই না হয় বলা যাক কথাটা। ভাবা মতো কাজ করবার জন্য অগ্রসর হতেই ধারা কাঠের সিঁড়িতে ঠকঠক পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। দ্রুত গতিতে রুমে প্রবেশ করেই শুদ্ধ ধারার কাছে এসে কোন ভালো মন্দ না বলেই সরাসরি বলে উঠলো, 'ধারা, আপনি কোথায় ভর্তি হবেন না হবেন কিছু ঠিক করেছেন?'

ধারা সংকুচিত হয়ে ধীরে ধীরে বলল, 'বাবা তো কিছু বলেনি আমি আর পড়বো কিনা?'

'এখানে আপনার বাবার বলার কি আছে? আপনি পড়তে চান কি চান না সেটা বলুন।'

ধারা মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। শুদ্ধ আশাহত হয়ে বিরক্তি মাখা গলায় বলল,
'ধারা, এইসব কি আমাকে একটু বোঝাতে পারেন। আপনার কোন ধারণা আছে আপনি নিজের সাথে কি করছেন! আপনার কান্ডকারখানা দেখে আমি জাস্ট শকড হয়ে থাকি। আপনাকে যে যা বলে আপনি তাই করেন। আপনার নিজের কোন আলাদা চিন্তা ভাবনা নেই, নিজের কোন ইচ্ছা নেই, নিজের কোন সিদ্ধান্তও নেই। সামনের জন উঠতে বললে উঠেন আর বসতে বললে বসেন। আপনি একটা পসেসড বডির মতো হয়ে আছেন। শরীরটা তো আপনারই। কিন্তু এর ভেতরকার ইচ্ছা, ভাবনা, চালনাশক্তি সব অন্যদের হাতে। আপনি সবাইকে এতো কেন ভয় পান ধারা? তারা তো আপনার আপনজনই। কোন ভুল হলে হয়তো আপনার উপর রাগ করবে, বকা দিবে। মেরে তো আর ফেলবে না! আপনি কেন এতো আতংকিত হয়ে নিজের সবকিছু অন্যদের উপর ছেড়ে দেন!'

ধারা একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে শুদ্ধ'র এই প্রশ্নবিদ্ধ নজর থেকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে। যেই প্রশ্নের আদৌও কোন সুস্পষ্ট উত্তর ধারার কাছে নেই। নিজের নজরকে লুকাতেই আশেপাশে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে ধারা বারবার ডান হাত দিয়ে কপালের কার্ণিশটা ঘষতে লাগলো। শুদ্ধ এই ব্যাপারটা আগেও অনেকবার লক্ষ করেছে। ধারা যখনই অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে যায় সে তার হাত দিয়ে কপালের কার্ণিশ ঘষতে থাকে। শুদ্ধ সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম স্বরে বলল,
'ধারা, এভাবে নিচে তাকিয়ে থাকবেন না। তাকান আমার দিকে। তাকান বলছি!'

ধারা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে তাকালো শুদ্ধ'র দিকে। শুদ্ধ দু হাত দিয়ে ধারার বাহু ধরে বলতে লাগলো, 'আপনার কোন ধারণাও নেই ধারা, আপনি নিজেই নিজের সাথে কত বড় অন্যায় করছেন! এভাবে শুধু সবার কথা মেনে চললে আপনার নিজের বলে কোন ব্যক্তিত্ব থাকবে না। আপনি জানেন, আপনার যে নিজের বলে কোন সত্তা নেই! কোন অস্তিত্ব নেই! আপনার দিকে তাকালে শুধু অনেকগুলো মানুষের ছায়া দেখতে পাই। পাই না শুধু একটা 'আমি'কে দেখতে, একটা ধারাকে দেখতে। আপনি কোথায় ধারা? কোথায় আপনি? আমি আপনাকে দেখতে চাই। একটা ধারাকে দেখতে চাই।'

ধারার চোখ থেকে টপ করে একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়লো। শুদ্ধ সেই জল হাত দিয়ে মুছে দিয়ে বলল, 'কাঁদবেন না ধারা। শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি পাশ করুন বা ফেল করুন, ভালো করুন, খারাপ করুন আমি সবসময় আপনার সাথে আছি। সবসময়!'

ধারা কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে রইলো। এমন ভাবে কখনো তো কেউ বলেনি তাকে! সবাই শুধু তার থেকে তার সেরাটাই চেয়েছে। এর থেকে কম সব অগ্রহণযোগ্য। 

কিছুক্ষণ পর ধারা একটু স্বাভাবিক হলে শুদ্ধ বলল,
'আচ্ছা ধারা, আপনার রেজাল্ট তো মোটামুটি ভালোই ছিল। একটুর জন্যই এ প্লাস মিস হয়েছে। সাইন্সের সাবজেক্টগুলোতেই কম মার্ক পেয়েছেন আপনি। আপনি বেশি ভালো পারেন কোন সাবজেক্টগুলো?'

'আমি বেশি ভালো পারি বাংলা। বাংলার গল্প, কবিতাগুলো আমার খুব ভালো লাগে। ইংরেজিও ভালো পারি। সাইন্সের সাবজেক্টগুলোও মোটামুটি পারি কিন্তু ওগুলো আমার পড়তে ভালো লাগে না।'

'হুম বুঝেছি। ধারা, আমার কথাটা এবার মনোযোগ দিয়ে শুনুন, আমি এতক্ষণ আপনাকে নিয়েই ভেবেছি। সব খোঁজ খবর নিয়েছি। আপনি একটা কাজ কেন করেন না! আপনি এডমিশন টেস্ট দিন।'

ধারা ঝট করে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে বলল,
'এডমিশন টেস্ট মানে? ইউনিভার্সিটিতে?'

'হুম।'

ধারার কথাটা হজম হলো না। ধারা গ্রামের মেয়ে। ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞানও নেই তার। শুধু জানে এটা খুব একটা বড় কিছু। অনেক যোগ্যতার প্রয়োজন সেখানে পড়তে হলে। দেশের সেরাদের সাথে লড়াই করতে হয়। ধারা সাধারণ মেয়ে হয়ে এতো কিভাবে পারবে? সম্ভবই না!
ধারা ভড়কে যাওয়া গলায় বলল,
'কি বলেন! আমি কি পারবো নাকি!'

'অসম্ভবের মতো তো কিছু বলিনি। আর আমি তো বলছি না আপনি দিলেই পারবেন। কিন্তু একটা চেষ্টা তো করা যেতে পারে। আমি এ নিয়ে অনেক খোঁজ খবর নিয়েছি। এমনিতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্কুলার বের হয়ে ফরম ফিল আপও হয়ে গেছে। শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এটারও এতো দিনে হয়ে যাবার কথাই ছিল কিন্তু এই বছর এমন রাজনৈতিক গোলযোগের জন্য ঢাকায় ঝামেলা হওয়ায় এটার ফরম ফিল আপ স্থগিত করে রাখা হয়েছিল। আর মাত্র কয়দিনই এখন বাকি আছে এটার লাস্ট ডেটের। আপনি এখানেই দিবেন। এখানে অনেকগুলো ইউনিট। পরবর্তীতে যেন বাংলা সাবজেক্টটা পাওয়া যায় এরকম একটা ইউনিটে দিবেন।'

'বাংলা সাবজেক্ট! সাইন্সের কোন সাবজেক্ট নেই?'

'আছে। কিন্তু আপনিই তো বললেন আপনার সাইন্সের সাবজেক্ট ভালো লাগে না। আর যেটা ভালো লাগে না সেটা পড়ে কখনোই ভালো কিছু করতে পারবেন না। বাংলা আপনার ভালো লাগে যেহেতু বাংলা নিয়ে পড়বেন, ভালো রেজাল্টও করতে পারবেন।'

'বাবা আর কাকা কখনোই রাজী হবে না। তারা তো সাইন্স ছাড়া অন্য কিছু শুনতেই পারে না। আর্টসের কিছু শুনলেই নাক সিটকায়।'

'ধারা, সাইন্স, কমার্স, আর্টস কোনটাই কোন থেকে ফেলনা কিছু না। কিছু মানুষ জাস্ট এগুলোর মধ্যে একটা সস্তা, দামীর মাত্রা টেনে রেখেছে। পৃথিবীর সবাইকেই তো আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে না। সবকিছুরই প্রয়োজন সমাজের আছে। পৃথিবীর অন্য দেশ গুলোতে গিয়ে দেখুন সাবজেক্ট নিয়ে ওখানে এমন বদ্ধ ধারণা নেই। বাড়াবাড়িও নেই। যার যেটায় ইন্টারেস্ট, পছন্দ, সে সেটা নিচ্ছে। আমাদের দেশেই শুধু কিছু মূর্খ জাতির দল এইভাবে কমার্স, আর্টসকে তাদের চিন্তা দিয়ে নগন্য বানিয়ে রেখেছে। আপনি বাংলা অথবা যদি মানবিক বিভাগের অন্য কোন সাবজেক্ট পান সেটা পড়েও ভবিষ্যতে ভালো কিছু করতে পারবেন। শুধু সেটাই করুন যেটা আপনার ভালো লাগে।'

ধারা কিছুই বললো না। বিভ্রান্ত বোধ করতে লাগলো। ধারাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুদ্ধ ধারার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
'ধারা, এতো ভয় পাবেন না। আপনার বাবা আর কাকা নাকি আপনার এ প্লাসই নিশ্চিত করবার জন্য এক বছর গ্যাপ দিয়ে আপনাকে ফার্সট ইয়ারেরই দুই বছর রেখেছিল? একটা স্টুডেন্ট হিসেবেও কি আপনি বুঝেননি এক একটা বছরের কতটা গুরুত্ব! তখনও কি আপনার কিছু বেঠিক মনে হয়নি ধারা।
একবার তো একটু নিজের মনের মতো করে দেখুন, সব ভালোই হবে। নিজেকে এতো ছোট মনে করবেন না ধারা। চেষ্টা করতে তো কোন অসুবিধা নেই। হয়তো আপনিও পারবেন। এতো বড় ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারবেন। তখন দেখবেন আপনার বাবাও আপনার উপর প্রাউড ফিল করবে। আমার একটা বন্ধু আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইউনিভার্সিটিতে থার্ড, ফোর্থ ইয়ারে থাকাকালীন ও এডমিশন কোচিংয়ের কিছু ক্লাস করাতো। এখন অবশ্য একটা অনলাইন বিজনেসের পাশাপাশি একটা জবের প্রিপারেশন নিচ্ছে। এখন আমাদের শহরেরই আছে। ওকে আমি বলবো আপনাকে পড়াতে। আর তাছাড়া আমি তো আছিই। আপনার যা সাহায্য লাগে আমি করবো। আমি পাশে আছি। শুধু নিজের উপর আপনি একটু বিশ্বাস রাখুন ধারা।'

ধারার কাঁধে হাত রেখে শুদ্ধ পরম ভরসা মাখা গলায় বলল, 'আমরা একটা চেষ্টা করি ধারা? বলুন ধারা, করবেন তো!'

ধারা দ্বিধান্বিত চোখে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে রইলো।
__________________________________________

ভোর হতে না হতেই শুদ্ধ ধারাকে ডেকে তুললো। বাইরে তখনও অন্ধকার। ভোরের আলোও ঠিকমতো ফুটেনি। ধারাকে বেশ কয়েকবার ডাকতে হলো শুদ্ধকে। পিটপিট করে হালকা চোখের পাপড়ি খুলতেই ধারা দেখলো শুদ্ধ তাকে ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে। ধারাকে চোখ মেলতে দেখেই শুদ্ধ প্রসন্ন মুখে বলে উঠলো, 
'ধারা উঠুন, পড়তে বসবেন না?'
ধারা চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে বলল,
'এতো সকালে! এখনও তো দেখি সকালও হয়নি ঠিক মতো।'
'আমাদের হাতে তো খুব বেশি সময় নেই। মাত্র দুই মাসের মতন আছে। আমরা এমনিতেও পিছিয়ে আছি।'
শুদ্ধ এমন ভাবে 'আমরা' 'আমরা' বলতে লাগলো যেন শুধু ধারা না ধারার সাথে সেও পরীক্ষা দেবে। তারই প্রস্তুতি শুরু করবে এখন দুজন। ধারা নিচে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসলো। তার ঘুম এখনও কাটেনি। বারবার হাই তুলে তারই জানান দিচ্ছে সে। ধারা ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলল,
'আজকে না হয় থাক! গতকালই তো মাত্র ঠিক করলাম এডমিশন দেবো। কালকে থেকে একদম ধুমছে পড়বো। আজকে এখন একটু ঘুমিয়ে থাকি।'
'জ্বি না। আজকে থেকেই আমরা পড়া শুরু করবো। এখন থেকেই করবো। এভাবে কালকে কালকে করতে থাকলে সেই 'কাল' আর কোনদিনও আসবে না।'
'আমি পড়বো যে, কি দেখে পড়বো? বই কি এখনও কেনা হয়েছে?'
'হ্যাঁ হয়েছে।'
'আপনি বই কিনলেন কখন? এতো সকালেই দোকান খুলে ফেলেছিল?'
'আমি কালকে রাতেই বই কিনে এনেছিলাম। তারপরই আপনার সাথে কথা বলেছি।'
'তার মানে আপনি আগে থেকেই বুঝেছিলেন আমি রাজী হয়ে যাবো।'
ঠোঁট চেঁপে হেসে শুদ্ধ ধারার গাল টেনে বলল,
'হ্যাঁ, বুঝেছিলাম। কারণ আপনি যে আমার লক্ষ্মী বউ।'
এভাবে বাচ্চাদের মতো গাল টেনে দেওয়ায় ধারা হতবাক হয়ে গেলো। শুদ্ধ তাড়া দিয়ে বলল,
'নিন, পড়া শুরু করুন। আমি আমার বন্ধুর থেকে কিছু ইম্পর্টেন্ট টপিক দাগিয়ে এনেছি। সেখান থেকেই শুরু করুন।'
ধারা সাধারণ জ্ঞানের একটা বই নিয়ে পড়া শুরু করলো। আর শুদ্ধ আরেকটা বই নিয়ে পড়া কম করার জন্য শুধু ইম্পর্টেন্টগুলো দাগিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর কিছু একটা ধারাকে বোঝানোর জন্য সামনে তাকাতেই দেখে ধারা বালিশের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমে বেহুঁশ। আবারও তাকে ডেকে তুলে পড়তে বসালো শুদ্ধ। কিছুক্ষণ পড়ার পর আবারও একটু পরপরই ঘুমে ঝিমাতে লাগলো ধারা। আর তাকে ডেকে তুলতে তুলতে ক্লান্ত হলো শুদ্ধ। তবুও সেই একই অবস্থা। পরীক্ষার পর রেজাল্ট অব্দি দীর্ঘসময় আর কিছু পড়া হয়নি বলে সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস এমনিতেই পেয়ে বসেছে ধারাকে। তার উপর তার যেই গাঢ় ঘুম! রাতে একবার ঘুমালে কোলে করে তুলে নিয়ে গেলেও বোধহয় টের পাবে না। এই মেয়েকে কিভাবে শুদ্ধ সকালে উঠিয়ে পড়াবে তা ভেবেই মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলো শুদ্ধ। ধারা তখন আবারও মাথা হেলিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে। কিছুসময় এভাবেই পার হবার পর হঠাৎ শুদ্ধ চেঁচিয়ে উঠলো, 

'ধারা, আপনার বাবা এসেছে।'

ধড়ফড় করে উঠে বসে পড়লো ধারা। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে যখন বুঝলো এটা শুদ্ধ'র মজা ছাড়া আর কিছু না তখন সরু চোখে তাকালো শুদ্ধ'র দিকে। শুদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
'আমার শ্বশুর মশাইটাকে আমি এই মুহুর্তে অনেক মিস করছি। এই মুহুর্তে একমাত্র তিনি থাকলেই হয়তো আপনার ঘুম তাড়াতে পারতো।'
ধারা সেই কথায় পাত্তা না দিয়ে হাই তুলতে লাগলো। শুদ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর সদ্য কল থেকে আনা এক জগ ঠান্ডা পানি নিয়ে ফিরে এলো সে। বিছানার পাশে টেবিলে রেখে আবারও ধারার একটা বই নিয়ে বসলো। জগের দিকে তাকিয়ে ধারা বলল,
'শুধু শুধু এক জগ পানি আনতে গেলেন কেন? এতো সকাল সকাল কি আর এতো পানির পিপাসা পাবে!'
শুদ্ধ বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, 'পানি খাবার জন্য আনিনি?'
'তাহলে?'
'এরপর থেকে আপনি যতবার ঝিমাবেন ততবার আপনার মাথায় পানি ঢালা হবে, সেই জন্য এনেছি।'
শুদ্ধ'র কথা শুনে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো ধারার। কি বলে লোকটা!



চলবে*****"
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#18
পর্ব -১২



শ্রাবণের শেষ সপ্তাহ। সকালে ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়লো বাইরের তুমুল বর্ষণ। টিনের চালের বৃষ্টির অপূর্ব ঝমঝম শব্দ কানে শ্রুতিমধুর আবেশ সৃষ্টি করে। ঘুমু ঘুমু চোখে বারান্দার বৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ধারা একবার চোখ বুলালো ফাঁকা রুমটিতে। শুদ্ধকে দেখা যাচ্ছে না। এমনিতে তো আজকাল পড়া শুরু করার পর থেকে প্রতিদিন ভোর হতে না হতেই ধারাকে উঠিয়ে দেয়। আজ হঠাৎ ব্যতিক্রম হলো কেন? ধারা একটা হাই তুলে উঠে বসলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলো আসলেই অনেক বেলা হয়ে গেছে। বাইরে বৃষ্টি বলে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। দেরি হয়ে গেছে বুঝতে পেরেও ধারার মধ্যে তাড়াহুড়োর কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সকালে ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টি দেখা প্রকৃতির একটা সুন্দর সারপ্রাইজ। চারপাশটা কেমন যেন হিমেল আবরণে জড়িয়ে আছে। ধারা গায়ের পাতলা কাঁথাটা টেনে পা থেকে গলা পর্যন্ত আষ্টেপৃষ্ঠে মুড়িয়ে রাখলো। এভাবে ঘুমু ঘুমু ভাবটা নিয়ে হালকা উষ্ণতাটা ধারার ভালো লাগছে। এভাবেই আপাদমস্তক কাঁথায় পেঁচিয়ে ধারা হাঁটুতে মুখ ভার দিয়ে রেখে বারান্দায় তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ পৃথিবীর সেরা শ্রুতিমধুর শব্দগুলোর একটি। এতদিন নিজেদের পাকা দালানে বসে বসে এই শ্রুতিমধুর ধ্বনি থেকে ধারা বঞ্চিত ছিল। আহ! কি সুন্দর!
তার এই সুন্দর মুহুর্তে ব্যাঘাত ঘটালো ফোনের কর্কশ রিংটোন। তার ছোট কাকী রুনা ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে অনেক কথাই হলো তার সাথে। ধারার বিয়েতে উপস্থিত না থাকতে পারায় রুনা ভীষণ দুঃখ প্রকাশ করলো। কাকীর সাথে কথা শেষ হলে ধারা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। কুঁচকানো জামা কাপড় হাত দিয়ে ঠিক করে এলোমেলো চুলগুলোকে হাত খোঁপা করে নিল সে। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ধারা নিচে নেমে দেখলো খোদেজা বারান্দায় টিনের ফুটো দিয়ে টুপটুপ করে পড়া বৃষ্টির পানির জায়গায় জায়গায় মগ, পাতিল, ছোট ছোট বাটি পেতে রাখছে। বড় বড় বালতিগুলো সব বাইরে পাতা। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য। মাঝের চৌকিতে চুমকি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। শুদ্ধ একটা মোড়ার উপর পা তুলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বসে ল্যাপটপ চালাচ্ছে। খোদেজা মগ, বাটিগুলো ঠিক ঠিক জায়গায় রাখতে রাখতে বলল, 

'সেই রাইত থিকা বৃষ্টি নামছে। তবুও এতক্ষণে একটু জোরও কমে নাই। আজকে মনে হয় সারাদিনই বৃষ্টি থাকবো রে মাহতাব। ঘর দুয়ার বৃষ্টিতে সব ভাইসা যাইবো মনে হইতাছে।'

শুদ্ধ ল্যাপটপের থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল,
'ভেসে গেলে যাবে আম্মা। আমরা একটা কলা গাছের ভেলা বানিয়ে ভাসতে ভাসতে ঘুরবো।'

খোদেজা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
'ফাইজলামো করিস না তো!'

মায়ের দিকে তাকিয়ে শুদ্ধ হাসতে লাগলো। স্বভাবতই তার গাল ডেবে গেলো। প্রতিবারের মতোই একটা ধাক্কা খেলো ধারা। ছেলেদের গালের টোলও যে এতো সুন্দর হয় তা শুদ্ধকে না দেখলে বোঝা সম্ভব না। কাঁঠের সিঁড়িতে ধারাকে ওমন থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খোদেজা বলল, 'বউ, ওইখানে দাঁড়ায় আছো কেন? আসো, নিচে আসো।'

ধারা নিচে নেমে এলে খোদেজা বলল,
'তুমি তো মনে হয় এখনও মুখ ধোও নাই না? এই বৃষ্টির ভিতরে আর কলপাড়ে যাবা কেমনে! একটা কাজ করো দরজার সামনে পাতা বালতি থিকাই বৃষ্টির পানি দিয়া মুখ ধুইয়া ফেলো। খোদেজার কথা মতোই করলো ধারা। টুথ ব্রাশ নিয়ে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করে ধারা মগ দিয়ে বালতি থেকে পানি তুলে মুখ ধুয়ে নিল। বাইরে বৃষ্টির যা তেজ! পায়ের কাছটায় বৃষ্টির ছাটে ভিজে আসলো ধারার। ফিরে এসে দেখলো শুদ্ধ'র নজর এখনো ল্যাপটপেই। আজ ইচ্ছে করেই ধারাকে এতো বেলা করে ঘুমাতে দিয়েছে শুদ্ধ। গতকাল অনেক রাত পর্যন্তই পড়েছে ধারা। তাই আজ এই বৃষ্টির দিনে একটু ছাড় না হয় দেওয়াই যাক! খোদেজা চৌকির কাছ দিয়ে যাবার সময় চুমকির গায়ের কাঁথা টেনে বলল,
'ঐ মাইয়া, উঠ! আর কত ঘুমাবি? তাড়াতাড়ি উঠ।'

চুমকি একবার চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে খোদেজা চলে যাবার পর আবারো কাঁথা টেনে ঘুমিয়ে পড়লো। শুদ্ধ বলল,
'আম্মা কিছু খেতে দাও। খিদে লাগছে তো! গরম গরম ভাত দাও।'

খোদেজা বলল, 'এই বৃষ্টির মধ্যে আমি গরম গরম ভাত পাবো কই? গতাকালের দোকান থেকে আনা পাউরুটি আর কলা আছে। তোমরা সবাই তা দিয়াই কাজ সাইরা নাও বাপু। আমার পান্তা ভাতেই হবে।'

এই বলে খোদেজা পাউরুটি আর কলা বের করে ধারা আর শুদ্ধকে দিলো। চুমকিরটা রেখে দিলো পরে উঠে খাবে বলে। শুদ্ধ পাউরুটিতে কামড় বসাতে বসাতে তার মাকে বলল, 'আম্মা, তুমিও একটা পাউরুটি খেয়ে নাও। পান্তা ভাত খাওয়া লাগবে না।'

'তা না হয় খাইলাম একটা। দুপুরে কি খাবি? আজকে তো চুলায় রান্না করা যাইবো না কোনমতেই। রসুইঘরের চালা একদিকে কাইত হইয়া বৃষ্টির পানি সব ঢুকতাছে। মাটির চুলা ভিজ্জা রইছে। আগুন ধরবো না। তোরে কয়বার বলছিলাম রসুইঘরের চালটা আগে ঠিক কইরা নে। কবে বৃষ্টিতে ভাইঙ্গা পড়ে! দেখলি তো, আমার কথাই সত্যি হইলো। এদিকে সিলিন্ডারের গ্যাসও শেষ। ঘরের মধ্যে যে রান্না করবো তারও উপায় নাই। এখন বল, কি হইবো?'

শুদ্ধ মোড়া থেকে পা নামিয়ে বলল, 'আচ্ছা বেশ! দোষটা যেহেতু আমারই। আজকের রান্নাটাও আমিই করবো।'

'করবি টা কেমনে?'

'তোমার না একটা আলগা ছোট মাটির চুলা আছে আম্মা! গতবছর চুমকি বায়না ধরায় বানিয়ে দিয়েছিলে। ঐটা তো চুমকি ঘরের মধ্যেই রেখে দিয়েছিল। ঐটা বের করো।'

'কি জানি বাপু! আমি বুঝি না তোর কাজ কারবার।'

'আহা আম্মা! তুমি বের করো তো। তারপর দেখো আমি কি করি। শর্টকাটে আজকে আমি খিচুড়ি রান্না করবো। সাথে ডিমভাজা। বৃষ্টির মধ্যে খিচুড়ি ডিম ভাজা দারুণ হবে।'

খোদেজা চৌকির তলা থেকে মাটির আলগা চুলাটা বের করে আনতে গেলো। ধারা এতক্ষণে জিজ্ঞাসা করলো,
'আপনি রান্নাও করতে পারেন?'
'হ্যাঁ।'
'কি বলেন!'
'এতো অবাক হবার কি আছে?খাওয়াটা কি শুধু মেয়েদের কাজ? ছেলেরা কি খায় না? তাহলে তারা রান্না করতে পারবে না কেন? মেসে থাকতে তো আমার রান্না আমিই করে খেতাম। আজকে আমার রান্না খেয়ে দেখবেন। মনে হয় না অতোটাও খারাপ রান্না করি।'

ধারা সত্যিই অবাক হয়েছিল। গ্রামে তো সে এতদিন এই দেখে এসেছে। ছেলেরা রান্না করা তো দূর! রান্নাঘরের নাম থেকেও একশ মাইল দূরে থাকে। নিজেদের বাড়িতেও তো এতদিন এমনটাই দেখে এসেছে ধারা। মেয়েলি কাজে হাত লাগানো নাকি পুরুষদের জন্য শোভা পায় না। আজকে শুদ্ধ'র মুখে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী কথা শুনে অবাক না হয়ে ধারা কিভাবে পারে! 

ততক্ষণে খোদেজা চুলা নিয়ে চলে এসেছে। শুদ্ধ'র সামনে রেখে বলল, 'শুধু এই চুলা দিয়েই কি হবে আমি কিছু বুঝতাছি না কিন্তু। রান্নাঘর থিকা লাকড়ি আনবি কেমনে? এই বৃষ্টির মধ্যে আনতে গেলে তো সবই ভিজা যাবো। আর এই ঘরের মধ্যে তুই চুলা ধরাবিই কেমনে?'

'ওটা আমি ব্যবস্থা করে নেবো।'

এই বলে শুদ্ধ উঠে বারান্দায় গেলো। একটা বহু পুরনো ভাঙা চেয়ার পড়ে ছিল অনেক আগে থেকেই। সেটাকেই একটা দা দিয়ে কয়েক টুকরো করলো। নিজের রুমে গিয়ে একটা ব্যাগে ভরে পুরনো কাগজপত্র নিয়ে এলো সাথে করে। সেগুলো সহ চুলোটাকে বাতাসের প্রবাহের বিপরীতের বারান্দায় নিয়ে এমনভাবে রাখলো যাতে ধোয়া সব বাইরে চলে যায়। এর জন্য ঘরের দরজাও সম্পূর্ণ খুলে দিল। বাইরে তখন একনাগাড়ে বৃষ্টি ঝড়েই যাচ্ছে। খোদেজা দরজার ধারে গিয়ে বৃষ্টির পানি দিয়েই চাল ডাল ধুয়ে আনলো। ধারা বসে বসে বটি দিয়ে পেঁয়াজ মরিচ কেটে দিলো। চুমকি ততক্ষণে এমন শোরগোলের আওয়াজ পেয়ে ঘুম ছেড়ে উঠে বসলো। ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই উৎফুল্ল হয়ে বিছানা থেকে নেমে আসলো সে। শুদ্ধ'র সামনে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল, 'মাহতাব ভাই, আজকে কি আমরা চড়ুইভাতি করতাছি?'

শুদ্ধ হেসে বলল, 'হ্যাঁ রে চুমকি। এটাকে একটা ছোট খাটো চড়ুইভাতি বলাই যায়। কি বলেন ধারা?'

ধারা থতমত খেয়ে উঠলো। শুদ্ধ যে হঠাৎ করে তার নাম উচ্চারণ করবে এটা সে ভাবতে পারেনি। শুদ্ধ বলল, 'আপনি তো এমনভাবে চমকে গেলেন যেন আমি ভূত দেখার কথা বললাম। বাই দা ওয়ে, আপনি না একদিন বাঁশ ঝাড়ের নিচে কি দেখেছিলেন! আপনার ঐ ভূত বন্ধু এসে আবার দেখা দিয়েছিল?'

খানিক শাসনের চোখে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো ধারা। চুমকি ভূতের কথা শুনে ভয় পেয়ে বলল,
'বাবা গো! তুমি কি দেখছিলা ভাবী? আমি হইলে তো সেইখানেই অজ্ঞান হইয়া যাইতাম।'

খোদেজা পেছন থেকে বলে উঠলো, 'ঐ ছেমড়ি, তুই পরে অজ্ঞান হইস। এখন যাইয়া আগে মুখ ধুইয়া আয়। বইসা বইসা সবার কাছে মুখের গন্ধ ছড়াইতাছে।'

গাল ফুলিয়ে মুখ ধুতে গেল চুমকি। শুদ্ধ মাটির চুলায় কয়েকটা লাকড়ি ঢুকিয়ে কাগজের টুকরো দিয়ে আগুন ধরালো। মুহুর্তের মধ্যে ধোঁয়ায় ছেয়ে গেলো ঘর। সবাই কাশতে আরম্ভ করে দিলো। খোদেজা কাশতে কাশতে বলল, 'ঐ মাহতাব, তুই ওঠ। কি যে করতাছোস!'

শুদ্ধ বলল, 'আম্মা, আমি বলছি না আজকে আমি একা রান্না করবো। কোন লেডিস হাত দিবে না। তোমরা চৌকির উপর পা তুলে বসো তো।'

শুদ্ধ চুলায় সব মশলাপাতি কষিয়ে চাল ডাল দিয়ে দিলো। ধারা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে শুদ্ধ'র রান্না দেখতে লাগলো। মহা আনন্দে চুলার সামনে বসে রইলো চুমকি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার এখনই খেতে ইচ্ছে করছে। বাইরে তখনও ঝড়ছে অবিরাম শ্রাবণ ধারা। টিনের চালে ঝমঝম শব্দ। ভেজা মাটির গা বেঁয়ে পুকুরের দিকে নেমে যাচ্ছে বৃষ্টির জল। আর ঘরের ভেতর চলছে চারটে মানুষের একটুপর পর হাসি ঠাট্টা। এভাবেই গল্প, হাসি, মজায় একসময় ওদের খিচুড়ি রান্না শেষ হলো। রান্না শেষ হতেই খোদেজা বলল, 'নে এবার তোরা হাত মুখ ধুয়ে নে। আর যে গোসল করবি কর।' 
খোদেজার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই চুমকি এক দৌড়ে বাইরে চলে গেলো। খোদেজা চেঁচিয়ে উঠে বলল, 'কি করতাছোস চুমকি? এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজিস না। ঠান্ডা লাইগা যাইবো। পুকুর থিকা তাড়াতাড়ি কয়টা ডুব দিয়া আইয়া পড়। বৃষ্টিতে ভিজিস না বেশি।'

খোদেজার কথাগুলো বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশে গিয়ে তেমনভাবে চুমকির কানে পৌঁছালো না। আর যদিওবা পৌছালো সে তেমন গা করলো না। চুমকি তো তখন মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজছে। শুদ্ধ তার মাকে বলছে, 'থাক আম্মা। ভিজুক। প্রতিদিন তো আর ভিজে না। মাঝে মাঝে একটু আধটু ভিজলে সমস্যা হয় না।'

খোদেজা তাই চুপ হয়ে গেলো। চুমকি বৃষ্টি ভেজা অবস্থায় হঠাৎ দৌঁড়ে গিয়ে দরজায় দাঁড়ানো ধারাকে টেনে আনলো বৃষ্টিতে। ধারার সামনে শুদ্ধ দাঁড়িয়ে ছিল। ধাক্কা লাগায় ধারার সাথে সেও চলে এলো বাইরে। বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ধারার দিকে তাকিয়ে বলল, 'আরে!'
ধারা পুরো ভিজে গিয়ে জবুথবু হয়ে বলল, 'আমি কি ইচ্ছে করে আপনাকে এনেছি নাকি! ধাক্কা লেগেছে। আর আপনিই তো এই মাত্র বললেন, একটু আধটু ভিজলে কিছু হয় না। তাহলে সমস্যা কি?'
শুদ্ধ ভিজে যাওয়া মাথার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলল, 'ধারা, আপনি কিন্তু চালাক হয়ে যাচ্ছেন।'
ধারা আর চুমকি একে অপরের দিকে তাকিয়ে খানিক ঠোঁট চেঁপে হাসলো। ওরা তিনজন উঠোনে দাঁড়িয়ে শ্রাবণের ঝরিয়ে দেওয়া আনন্দের উল্লাসে মেতে উঠলো। দৌড়াতে গিয়ে চুমকি কাঁদায় পিছলে পড়ে গেলো। তা দেখে হাসিতে ফেটে পড়লো ধারা শুদ্ধ। খানিকবাদে দরজার কাছে দাঁড়ানো খোদেজাকেও টেনে নিয়ে এলো শুদ্ধ। খোদেজা মিথ্যা রাগের ভাণ ধরে বলল,
'আরে আরে কি করোস কি? তোরা ভিজ। আমার কি আর সেই সময় আছে!'
শুদ্ধ শুনলো না। মাকে টেনে নিয়ে এলো নিজেদের কাছে বাইরে। পানি ছিটিয়ে ছিটিয়ে আজ মাকেও নিজেদের সাথে বাচ্চা বানিয়ে দিল তারা। 

গোসল শেষে দুপুর হলে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে একসাথে খেতে বসলো সবাই। খোদেজা সবার প্লেটেই খিচুড়ি বেড়ে দিল। গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি। তার সাথে ডিম ভাজা। দেখেই যেন সবার পেটে খিদে মোচড় দিয়ে উঠলো। চুমকি হঠাৎ বাঁধ সাধলো। সে হাত দিয়ে খাবে না। তার ভালো লাগছে না। তাকে খাইয়ে দিতে হবে। বিরক্ত হবার ভাণ ধরেও খোদেজা শেষমেশ চুমকির আর্জিতে ধরা দিলো। নিজের প্লেট থেকে খাইয়ে দিতে লাগলো চুমকিকে। চুমকি তো ভীষণ খুশি। শুদ্ধ বলে উঠলো, 'আম্মা, শুধু কি চুমকিকেই খাইয়ে দিবা? আমাকেও একটু দেখো।'

এই বলে শুদ্ধ মায়ের কাছে গিয়ে মুখ হা করে রইলো। আনন্দের সাথে খাইয়ে দিতে লাগলো খোদেজা। ধারা হাসিমুখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। দৃশ্যটা এতোটাই সুন্দর! ধারাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খোদেজা বলল, 'বউ, তুমিও হা করো তো! তুমি বাদ যাবা কেন? শ্বাশুড়ি হইছি তাতে কি হইছে! ওরা যেমন তুমিও আমার কাছে ওমনই। নাও হা করো।'
খোদেজা এক নলা ধারার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ধারাও মুখ হা করে খোদেজার হাত দিয়ে খেলো। সবকিছু ভীষণ ভালো লাগতে লাগলো তার। এমন মুহুর্ত সে খুব কমই দেখেছে। তাদের বাড়িতে তো সবাই সবসময় একপ্রকার গম্ভীর হয়েই থাকে। সবকিছু চলে কড়া নিয়মের সাথে। তাদের কাছে ডাইনিং টেবিল আছে। দুপুরে খাবার জন্য দশ আইটেম থাকে। থাকে না শুধু এতো আনন্দ। এতো হাসি ঠাট্টা। ধারার চোখ ছলছল করে উঠলো। ঠিক তখনই তার মনে পড়লো তার ছোট কাকী তার বিয়ের ছবি দেখতে চেয়েছিল। সকালেই চেয়েছিল। খাওয়া শেষ করেই সে তার কাছে যেই ছবিগুলো ছিল সেই সব ইমুতে পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু সে কি আর জানতো এই ছবিগুলোই একদিন তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে!

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#19
পর্ব -১৩



আজ রোদের তেজ বড়ই বেশি। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকাও দুষ্কর। হাসুর মা ভেবেছিল ঘরে থাকা মসুরের ডালগুলো সব বের করে উঠোনে রোদ দিবে। কিন্তু সকাল থেকে বাড়ির যেই অবস্থা তার জন্য সব কিছুই যেন থেমে গেছে। তার ছেলে মনিরের বউ রোকসানা সকাল থেকেই কেঁদে যাচ্ছে। সে নাকি মনিরের ফোনে কোন মেয়ের সাথে মনিরের ঘনিষ্ঠ ছবি দেখেছে। মনিরকে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে সে স্পষ্ট করে তো কিছু বলছেই না তার উপরে চেঁচামেচি, গালাগালি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে। বাড়ির পরিবেশটাই যেন কেমন পাল্টে গেছে। হাসুর মা মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাসুও বাড়িতে নেই। এই সমস্যার সে কি করবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। খোদেজা এসেছিল প্রতিবেশী হাসুর মার কাছে রান্নার জন্য কিছু সরিষা চাইতে। এসে দেখলো মনির বউয়ের সাথে কি নিয়ে যেন চেঁচামেচি করে বাইরে চলে গেলো। হাসুর মাও ঘরের সামনের খুঁটির সাথে উদাস মনে হেলান দিয়ে রয়েছে। মনিরের কথার ধরন দেখে খোদেজা ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পারলো। তাই আর কিছু না ঘেঁটে চুপচাপ সেখান থেকে চলে এলো সে। নিজের দাওয়ায় এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বেলা বোঝার চেষ্টা করলো। তার ছেলে আর ছেলের বৌ গেছে শহরে। না জানি আসতে আসতে কতক্ষণ লাগে!

গ্রামের পথে আসতেই শুদ্ধ খেয়াল করলো সরকারি দপ্তর থেকে কিছু লোক এসে পাকা সড়কে কিছু ফিতা নিয়ে কি যেন মাপামাপি করছে। এই সড়কের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া অঞ্চলে মাঝে আরেকটা রাস্তা পাকা করা হবে। তারই পরিকল্পনা চলছে। শুদ্ধ উপলব্ধি করলো রূপনগর আর তাদের আশেপাশের গ্রামগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া খুব ভালো মতোই লেগেছে। গ্রামের মধ্যে পাকা রাস্তা ঘাট, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কলেজ, কলেজ ইত্যাদি সবই আছে। গ্রামটি শহরের কাছ ঘেঁষে হওয়াতেই সব সুযোগ ভালো মতো পাচ্ছে তারা। এই তো বছর কয়েক আগেও তো শুদ্ধ যখন উচ্চ শিক্ষার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়েছিল তখনও তো এই গ্রামের অবস্থা এতোটা ভালো ছিল না। রাস্তাঘাট ছিল কাঁচা। বর্ষাকালে বৃষ্টি এলে রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে হাঁটার মতো অবস্থাও থাকতো না। আজ সেখানে সবকিছু কতো সুন্দর! কিন্তু শুধু রাস্তাঘাট পাঁকা হলেই কি তাকে উন্নত বলা যায়? আসল উন্নতি তো তখন হবে যখন এই গ্রামের মানুষের চিন্তা চেতনার দুয়ার হবে বিস্তৃত, অজ্ঞতা মুক্ত ও কুসংস্কারহীন। সেই উন্নতি রূপনগরে কতটা হয়েছে তা ঠিক শুদ্ধ'র জানা নেই। 

অটো থামিয়ে অটোচালক অন্যদের সাথে কথা বলে জানতে পারলো, এই রাস্তা দিয়ে যেতে হলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে৷ শুদ্ধ ভীষণ বিরক্তবোধ করলো। এমনিতেই ধারাকে নিয়ে তার বন্ধুর কাছে দুই ঘন্টার মতো পড়িয়ে তারপর এসেছে। সাধারণত রোজ বিকেলেই শহরে ধারাকে নিয়ে বন্ধুর কাছে প্রাইভেট পড়াতে যায় শুদ্ধ। আজ তার বন্ধুর বিকেলে কিছু কাজ থাকায় সেই পড়া বিকেলে না পড়িয়ে সকালেই পড়িয়ে দিয়েছে। রূপনগর থেকে মূল শহর খুব বেশি দূরে নয়। অটোরিকশায় যেতে সময় লাগে চল্লিশ মিনিট। যদিও রোজ আসা যাওয়ার জন্য একটু সমস্যাই। তবুও তার বন্ধুকে রাজী করিয়ে যে দুই মাস তার কাছে ধারাকে একা পড়াতে পারছে তাই বেশি। অটোতে বসে থাকতে থাকতে গরমে ঘাম ছুটে যাচ্ছে শুদ্ধ ধারার। অটো থেকে একবার মাথা বের করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে শুদ্ধ ধারাকে বলল,
'চলুন ধারা নেমে যাই। এখানে কতক্ষণ বসে থাকতে হয় না হয়! দেরি হয়ে যাবে। এখান থেকে আমাদের বাড়ি গ্রামের ছোট পথে গেলে খুব বেশি দূরে নয়। তবে যাওয়ার সময় একটা ছোট সাঁকো পরে। আপনি সাঁকো দিয়ে যেতে ভয় পান না তো!'

সাঁকো দিয়ে অনেকবার যাওয়া আসা হলেও ধারার সাঁকো তে একেবারেই যে ভয় লাগে না তা বলা যায় না। তবুও সেই কথাটা সে শুদ্ধকে বলল না। আবার না খোঁচারাজ কোন কথায় পরে এ নিয়ে খোঁচা দিয়ে বসেন! তাই শুদ্ধ'র কথায় হেসে মাথা দুলিয়ে সে সায় দিলো। অটো থেকে নেমে পড়ে গ্রামের শর্টকাট পথ ধরলো তারা। একেকজনের বাড়ির উপর দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই তাদের কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো শুদ্ধ'র সাথে থাকা অচেনা সুন্দরী মেয়েটিকে। ধারার সংকোচ হতে লাগলো। অবশেষে সব বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে যখন তারা মরা খালের কাছে চলে এলো তখনই একটু স্বস্তি হলো ধারার। কিন্তু তা বেশিক্ষণ টিকলো না। সামনে চওড়া খাল। তার উপর দিয়ে সোজা চলে গেছে বাঁশের নড়বড়ে লম্বা সাঁকো। শুদ্ধই আগে চড়লো সাঁকো তে। তারপর ধারা। দুজন মানুষের কদম পড়তেই সাঁকো দুলতে শুরু করে দিলো। পায়ের নিচে শুধু একটাই বাঁশ। তাকেই আশ্রয় করে যেতে হবে ওপারে। ধরে ধরে হাঁটার জন্য পাশ দিয়ে উপরে আরেকটা বাঁশকে আড়াআড়ি ভাবে স্থাপন করা হয়েছে। সেটাই ভালো মতো হাত দিয়ে ধরে রেখে সাবধান সাঁকো পার হতে লাগলো তারা। সাঁকো টা কেমন যেন পিচ্ছিল হয়ে আছে। বোধহয় একটু আগেই কেউ ভেজা পায়ে পার হয়েছিল। ধারা খুব আস্তে আস্তে পার হতে লাগলো। বুকের মধ্যে হৃদস্পন্দন কিছুটা হলেও বেড়ে গেছে তার। যদিও খালে পানি একদম নেই বললেই চলে। পানির নিচ থেকে আঠালো মাটিও চোখে পড়ছে। খানিক শঙ্কিত মুখে সেদিকেই বারবার চোখ দিচ্ছিল ধারা। এখানে একবার কেউ যদি পড়ে একেবারে কাঁদায় নাস্তানাবুদ হয়েই উঠতে হবে তার। ভাবতে ভাবতেই পা পিছলে গেলো ধারার। সে নিজে পড়লো তো পড়লোই সাথে করে বাঁচার জন্য সামনের শুদ্ধ'র শার্ট খামছে ধরায় তাকেও নিয়ে পড়লো। ঝপ করে একপ্রকার বিকট শব্দ হলো খালের সেই কাঁদা পানিতে। খানিক নাকানিচুবানি খেয়ে দুজনেই সোজা হয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো পানিতে। কাঁদায় মাখামাখি ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে তারা। শুদ্ধ বলল,

'এটা কি হলো ধারা?'

হাত দিয়ে চুলের কাঁদা পরিষ্কার করতে করতে ধারা বলল, 'আমি কি জানি! আমি কি ইচ্ছে করে করেছি?'

'আপনার সাঁকো তে সমস্যা হলে সেটা আমাকে আগে বলবেন না!'

'বললে কি হতো? সেই তো আপনি আবার আমাকে পরে এটা নিয়েও ঠাট্টা করতেন। তাই বলিনি।'

'ঠাট্টার ভয়ে কাঁদায় মাখামাখি হওয়া আপনার বেশি উপযোগী মনে হলো? কি অদ্ভুত! আচ্ছা, আপনার কি কোন পড়ে যাওয়ার রোগ আছে? এই নিয়ে আপনি আমার সামনেই ঠিক কয়বার পড়লেন বলুন তো?'

চোখে ঠাট্টার ভাব ফুটিয়েই শুদ্ধ ধারার দিকে তাকিয়ে রইলো। ধারা মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বলল, 'ঐ যে শুরু হয়ে গেল! খোঁচারাজ ইজ ব্যাক।' 

ধারা তাড়াহুড়ো করে উঠার চেষ্টা করতেই আঠালো মাটির চুম্বকে আবার বসে পড়লো। সামনে আগানো তো দূর! এক পা তুলতে গেলে আরেক পা দেবে যায়। এ দেখি মহা সমস্যা!
খানিক এমন ভাবেই চেষ্টা মেষ্টা চালিয়ে ধারা ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,
'এ মা! এ তো উঠাই যাচ্ছে না। এভাবে কি কাঁদার মধ্যেই আটকে থাকবো নাকি! এখন কি হবে?'

শুদ্ধ নির্বিকার গলায় বলল, 'কি আর হবে? এখানেই একটা সংসার পেতে বসবো। দুই তিনটা বাচ্চা কাচ্চা পয়দা করবো। তারাও এই কাঁদার মধ্যেই মনের আনন্দে লুটোপুটি খেলবে। আমাদের কাঁদায় মাখানো সুন্দর লুটোপুটি সংসার। দারুণ হবে কিন্তু! কি, দারুণ না ধারা?'

ধারা কটমট করে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে বসে রইলো শুদ্ধ। ধারা আবারো এক দমক হুটোপুটি করে উঠার চেষ্টা করলে শুদ্ধ বলল, 'এমন ভাবে উঠলে কোনদিনও উঠতে পারবেন না ধারা।'

এই বলে শুদ্ধ খুব আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। এক পা সাবধানে সামনে বাড়িয়ে আবার অনেকক্ষণ পর আরেক পা বাড়ালো। তারপর ধারার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
'এভাবে উঠুন।'
শুদ্ধ'র হাত ধরে ধারা এরপর সাবধানেই খাল থেকে উঠে এলো। এরপর রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যেকজনই তাদের দুজনকে দেখলো মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো। এমন ভরদুপুরে দুজন কাঁদায় মাখা মানব মানবীকে দেখলে যে কারোরই অবাক হবার কথা। বাড়ির কাছে আসলে খোদেজা ওদের দুজনকে দেখে ভূত দেখার মতই চমকে উঠলো। তারপর সব ঘটনা শুনে হাসতে হাসতে বলল,
'আগে গোসল করে পরিষ্কার হয়ে নে তোরা। তারপর বাকিটা শুনবো। কি যে করিস না তোরা।'

চুলায় রান্না বসানো ছিল তার। তাই তাড়াতাড়িই সরতে হলো তাকে। খোদেজা রান্নাঘরে চলে গেলে শুদ্ধ ধারা চলে এলো পুকুর পাড়ে। সকালে শহরে যাবার আগে দুজনেই গোসল সেরে জামাকাপড় পুকুড় পাড়ে তারের উপর রোদে শুকাতে দিয়েছিল। গোসলে ঢোকার আগে তা সেখান থেকে নেবার জন্য দুজনে যখন একসাথেই হাত বাড়ালো তখন শুদ্ধ বলে উঠলো,

'আপনি এখন জামাকাপড় নিচ্ছেন কেন? গোসলখানায় এখন আমি যাবে।'

'ইশ! বললেই হলো। আমি আগে জামাকাপড় নিতে এসেছি তাই আমি যাবো।'

'জ্বি না। আপনি আগে না। আমরা দুজনে একসাথেই নিয়েছি।'

'তাহলে আপনি আগে যেতে চাচ্ছেন কেন?'

'কারণ দোষটা আপনার। আপনি আমাকে টেনে না ধরলে তো আর আমি খালে পড়তাম না।'

'আচ্ছা! আর আপনি যদি ঐ শর্টকাটে না আসতে চাইতেন তাহলে আমরা কেউই খালে পরতাম না। তাই মূল দোষটা আপনার।'

'বললেই হলো! আমি তো আপনাকে আগে জিজ্ঞাসা করেই নিয়েছিলাম সাঁকোর ব্যাপারে। কিন্তু আপনিই তখন হিরো সাজার জন্য...ওপস! সরি, হিরোইন সাজার জন্য কিছু বলেননি আর আমাদেরকে খালে পড়তে হয়েছিল।'

যুক্তিতে হেরে যাবার মুখোমুখি হতেই ধারা কথা ঘুরিয়ে বলল,
'তাতে কি হয়েছে? এমনিতে তো কত বড় বড় কথা বলেন। লেডিস ফার্স্ট, এটা জানেন না? তাই আমিই আগে যাবো।'

পাশের টলমলে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময়ী হাসি ঠোঁটে চেঁপে শুদ্ধ ধারাকে জিজ্ঞেস করলো, 'ধারা, আপনি সাঁতার পারেন?'
নিজের ঠাঁট বজায় রেখেই ধারা দ্রুত জবাব দিল,
'হ্যাঁ।'
'সিরিয়াসলি?'
'হ্যাঁ।'
'শিওর তো?
বারবার একই প্রশ্ন করায় ধারা কপট বিরক্তের স্বরে বলল,
'আরে হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ! এখন এইটাও কি আপনাকে করে দেখাতে হবে?'
শুদ্ধ নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
'তাহলে তো মন্দ হয় না।'
কথার সারমর্ম বোধগম্য না হতেই এক সেকেন্ডের মধ্যেই ধারাকে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌছে দিয়ে শুদ্ধ এক ধাক্কায় পুকুরে ফেলে দিল তাকে। তারপর নিজেও ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে পানিতে গিয়ে পড়লো।


চলবে*********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply
#20
পর্ব -১৪


পুকুরের স্বচ্ছ টলমলে পানি থেকে মাথা তুলে নিজেকে ধাতস্থ করে ধারা হতভম্ব গলায় বলল,

'এটা কি হলো?'

মাথার ভেজা চুলগুলোকে হাত দিয়ে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে নির্বিকার গলায় শুদ্ধ বলল,
'আপনাকে পানিতে ফেলে দিলাম।'

'কেন?'

'এভাবে আগে-পরে যাওয়া নিয়ে ধাক্কাধাক্কি না করে একটা সঠিক সমাধানেই যাওয়া ভালো নয় কি? কাঁদায় মাখামাখি যেহেতু দুজনে একসাথে হয়েছি, কাঁদা থেকে ছাড়াছাড়িও তো দুজনের একসাথেই হওয়া উচিত, তাই না?

'এটা কোন কথা! কিভাবে করতে পারলেন আপনি এটা?'

'আপনি আরেকবার উঠে পাড়ে গিয়ে দাঁড়ান। আমি আবার ধাক্কা দিয়ে দেখাচ্ছি কিভাবে করলাম। বুঝতে পারছি, ধাক্কাটা দেওয়া নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হয়েছে। একারণেই আপনি আরেকবার চাইছেন। নো প্রবলেম! স্পেশালি আপনার জন্য, শুধু আপনার জন্য আমি আরেকবার আমার ধাক্কা দেওয়ার স্টাইলটা আপনাকে দেখাতেই পারি।'

ধারা রাগে গজগজ হয়ে একদৃষ্টিতে শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে রইলো। দুজনের মধ্যকার দূরত্ব মাত্র এক হাত। শুদ্ধ নিজেকে পানির উপর ভাসিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
'এভাবে তাকিয়ে আছেন যে! প্রেমে টেমে পড়ে গেলেন না তো আবার?'

ধারা মুখ ঘুরিয়ে একটা ভাব নিয়ে বলল,
'কোনদিনও না। আমার সিদ্ধান্ত পাকা করাই আছে।'

শুদ্ধ হেসে বলল, 'আহারে! আপনার জন্য আমার সত্যিই বড় আফসোস হয়। জীবনের প্রথম একটা সিদ্ধান্ত নিলেন সেটাও নাকি ঠিকমত রাখতে পারবেন না।'

'কেন? রাখতে পারবো না কেন?'

'শুদ্ধ সারাক্ষণ কোন মেয়ের চোখের সামনে থাকবে আর তার প্রেমে সে পড়বে না এমনটা তো কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। বলা তো যায় না, হয়তো ইতিমধ্যেই আপনি আমার প্রেমে পড়ে গেছেন।'

ধারা ভাব নিয়ে বুকে আড়াআড়ি ভাবে দু হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে বলল, 'ভুল ধারণা আপনার।'

ধারার কথা শেষ হতে না হতেই শুদ্ধ হঠাৎ বলে উঠলো,
'আরে ধারা! আপনার পেছনে তো একটা সাপ।'

ধারা 'ও মাগো!' বলে লাফিয়ে উঠে শুদ্ধ'র একদম কাছে ঘেঁষে দাঁড়ালো। সেই কান্ড দেখে শব্দ করে হেসে উঠলো শুদ্ধ। দুপুরের সোনা রাঙা রোদের ঝিলিকে তার টোল পড়া গালের হাসি ধারার মনে এক সুভাসিত মাতাল হাওয়ার পরশ বুলিয়ে গেলো। শুদ্ধ বলল,
'আপনার ভীতু অভ্যাসটা বোধহয় কখনোই যাবে না তাই না ধারা? নাকি এটাও জানেন না, মানুষ যেমন সাপকে ভয় পায় তেমন সাপও মানুষকে ভয় পাও। এমন পুকুরের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষের কাছ দিয়ে সাপ কখনো এসে বসে থাকবে না।'

ধারা মুখ ফুলিয়ে বলল, 'জানি আমি।'

'জানেন যদি তাহলে এমন করে আমার বুকে লাফিয়ে আসলেন কেন? নাকি চোখের সামনে এমন একটা হ্যান্ডসাম ছেলেকে দেখে হুঁশ থাকে না! আমার তো সন্দেহ হচ্ছে, সাপের ভয় পাওয়া একটা বাহানাই না ছিল! আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাওয়া।'

রাগে দুঃখে ধারা পারলে তখন নিজের চুল নিজে ছিড়ে। সাথে শুদ্ধরটাও। সে এক ঝাটকায় শুদ্ধর থেকে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু বাঁধ সাধলো তার অবাধ্য চুল। শুদ্ধ'র শার্টের বোতামের সাথে এমনভাবে পেঁচিয়ে গেছে যে ধারাকে আবারো টান খেয়ে শুদ্ধ'র কাছেই থাকতে হলো তাকে। শুদ্ধ সেখানে তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভাণ ধরে বলল,
'কোন ফাঁকে আবার এটাও করে রেখেছেন! হায় আল্লাহ! আরও কত কি যে দেখবো!'

'আপনি কি একটু চুপ থাকবেন! আমাকে আমার চুলটা ছাড়াতে দিন। নয়তো আমি কিন্তু আপনার বোতাম সহই ছিঁড়ে নিয়ে যাবো!' 

'কি দিন চলে এলো ভাই! একা একটা ছেলেকে দেখে মেয়েরা কিভাবে থ্রেট দেয়।'

ধারা অতি দ্রুত বোতাম থেকে নিজের চুল ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। এতক্ষণ চোখের সামনে নিজের বউয়ের রাগে গজগজ মূর্তিরূপ শুদ্ধ বেশ ভালোই উপভোগ করছিলো। ধারার এমন রূপ খুব কমই দেখা যায়। এমনিতে তো মেয়েটা এতোটাই শান্ত যে, যে যাই বলুক কারো সাথে তাকে কখনো রাগ করতেও দেখা যায় না। তাই এমন সুযোগ যখনই শুদ্ধ'র হাতে আসে তার সঠিক ব্যবহার না করে শুদ্ধ ছাড়ে না। তাড়াহুড়োয় ধারা ঠিকমতো চুল ছাড়াতে পারলো না। বরং আরও পেঁচিয়ে যেতে লাগলো। চুলে টান পড়ে ব্যাথা হতে লাগলো তার। তা দেখে শুদ্ধ ধারাকে থামিয়ে দিল। ধারার মাথাটা দু হাত দিয়ে আস্তে করে সোজা রেখে নিজে ছাড়িয়ে দিতে লাগলো তার চুল৷ খুব সাবধানে। যাতে এতটুকুও ব্যাথা না পায় ধারা। অপলক সেই যত্নবান শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে রইলো ধারা। এমনিতে তো মানুষটা কতো ভালো। ধারার কত টা খেয়াল রাখে। শুধু মাঝেমধ্যেই ওমন হুটহাট শয়তানীটা চেঁপে বসে। ধারাকে শুধু রাগিয়ে দেয়। কিন্তু সত্যিই কি ধারার রাগ হয়? নাকি মিছে রাগের আশ্রয়ে অন্তরের কোন এক গোপন কোণে মনে মনে এই মুহুর্তগুলোর জন্যই অপেক্ষা করে থাকে তার অবচেতন মন। 
__________________________________________

দুপুরের খাবার শেষে খোদেজা একটা কাঁথা নিয়ে সেলাই করতে বসলো। শুদ্ধ ধারাও তখন সবেই খেয়ে উঠেছে। এখনও রুমে যাওয়া হয়নি তাদের। তখন সদর দরজা ঠেলে ভেতরে আসে তার আরেক প্রতিবেশী আমেনার মা আর নাইওর আসা তার মেয়ে। এসে খোদেজার পাশে বসে কথায় কথায় সকল পাড়া প্রতিবেশীর দৈনিক বিবাদের ফিরিস্তি খুলে দেয়। পাশের বাসার মনির আর রোকসানার কথায় আসতেই তার গলার স্বর খাদে নেমে যায়। তারা সবটা জানে না। বাড়ির পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করে নিজ মনেই কিছু মনগড়া কারণ ধরে নিয়েছে তারা। তারই সূত্রে ইনিয়ে বিনিয়ে সে খোদেজাকে বলতে লাগলো,
'বুঝছো খোদেজা, মাইনষের ব্যাপার স্যাপার আমি না একদমই বুঝতে পারি না। আমরাও সোয়ামীর ঘর কইরা আসতাছি। কই আমরা তো কোনদিন এমন করি নাই। মনির একটু কি না কি রাগারাগি করছে হের লেইগা দিনভর মনিরের বউ কান্নাকাটি লাগায় দিছে। আসলে দোষটা মনিরেরও আছে। এরাই প্রথমে লাই দিয়া বউগো মাথায় উঠায় রাখে। পরে আর শাসন করতে পারে না। দেখো না, ঐ বাড়ির আবুলের কান্ডকারখানা। ও'র বউয়ের প্রথম বাচ্চা হইলো মতোন কি করলো? বউয়ের বাচ্চা হইছে দেইখা সে যায় কলস নিয়া পানি আনতে, আবার কিনা উঠান ঝাড়ু দেয়। কি জানি বাপু, এমন মাইগ্যা স্বভাব আমাগো ঘরের ব্যাডা গো ভিতরে নাই। কি কস আমেনা?'

মায়ের তাল পেয়ে মেয়েও মুখ বেঁকিয়ে বলতে লাগলো, 'হ গো মা৷ এইসব আমাগো ভিতরে নাই। আমার ভাইরে দেখছেন খোদেজা চাচী? সে তো এক গ্লাস পানিও ঢাইলা খাইতে পারে না। আবার নাকি এগুলা করবো? আজ পর্যন্ত রান্না ঘরের সীমানাতে পারাও দিয়া দেখে নাই। বাইরে থিকা আইসা শার্ট খুইলা সেখানেই রাইখা দিবো। আজ পর্যন্তও ধুইয়া দেখছে কি না সন্দেহ। কিছু বললে বলবে সে কি 'মাইগ্যা' নাকি যে মেয়েদের কাজ করবে। তার আবার তেজ আছে।'

কথা শেষ করে আমেনা আর তার মা দুজনেই তৃপ্তির সাথে হাসলো। তাদের ছেলে আর ভাই যে ভবিষ্যতে বউ পাগল হবে না এতেই তাদের প্রশান্তি। শুদ্ধ এতক্ষণ সবটাই শুনছিল। তাদের হাসির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে স্মিত হেসে বলল, 
'আমেনা আপা, আপনার মায়ের কথা বাদই দিলাম। তিনি আগেকার দিনের মানুষ। কিন্তু আপনি নাকি এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন? কলেজে তো আমাদের মানুষের লিঙ্গভেদ পড়িয়েছিল, কাজেরও লিঙ্গভেদ আছে কি না কখনো পড়িয়েছিল কি? আপা, বেয়াদবী নিবেন না। আপনি যা বললেন আমি তার সাথে ঠিক একমত হতে পারলাম না। আপা শুনুন, মানুষের মধ্যে জেন্ডার আছে। কাজের কোন জেন্ডার থাকে না। যেটা থাকে সেটা হলো ক্ষমতা। আসল কথা হলো কে কি করতে পারে, কার কতোটুকু ক্ষমতা আছে। আর কোন কাজ করতে না পারা কখনোই কোন গর্বের বিষয় হতে পারে না। আপনার ভাই কোন গর্বের কাজ করছে না আপা। তাকে এখনই সময় থাকতে উচিত দুই গালে দুইটা ঠাস করে চটকানা দেওয়া। আর বলা, নিজেদের কাজ নিজে করায় কোন মাইগ্যা স্বভাব হতে পারে না। তাহলে যদি একটু সঠিক পথে আসে।'

আমেনা আর তার মায়ের মুখ থমথমে হয়ে উঠলো। শুদ্ধকে বলার মতো কোন যুৎসই জবাব তারা খুঁজে পেলো না। ধারা শুধু মুখ হা করে শুদ্ধ'র কথা শুনতে লাগলো। কি করে এতো বড়দের সামনে কত সুন্দর ভাবে শুদ্ধ তার নিজের ধারণা রেখে দিলো! ঠিক তখনই বাইরে থেকে ভীষণ হট্টগোলের আওয়াজ এলো। সবাই বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখলো হাসুদের বাড়িতে ভীষণ ঝামেলা হচ্ছে। রোকসানা বাবার বাড়ি যাবার জন্য ব্যাগ পত্র গুছিয়ে ফেলেছে। মনির তাকে আটকাবে তো দূর উল্টো আরও এই হুমকি দিচ্ছে যে রোকসানা যদি আজ এই বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তাহলে আর কোনদিনও ফেরত আসতে পারবে না। সিদ্ধান্ত তার। এই নিয়ে ভীষণ চেঁচামেচি হচ্ছে। শুদ্ধ মনিরকে আটকাতে গেলো। রোকসানা খুব চেঁচামেচি করছে। অপরদিকে মনিরও থামছে না। মনিরকে শুদ্ধ শান্ত করে নিয়ে গেলো সেখান থেকে। তার সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারলো মনিরের কয়েকমাস আগে একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে। যদিও এখন বর্তমানে নেই। মনির সেসব ছেড়ে দিয়েছে। তবুও কিভাবে যেন ঐ ছবিটা রয়ে গিয়েছিল ফোনে। তাই দেখে ফেলেছে রোকসানা। সে এ নিয়ে রোকসানাকে কোন কৈফিয়ত দিতে রাজী না বলেই তাকে কিছু বোঝাচ্ছে না। মেয়ে মানুষ কেন এতো ঔদ্ধত্য হবে? 

সবটা শুনে মাথা দুলিয়ে আফসোসের সাথে শুদ্ধ বলল, 'তুমি কি এটা কোন ঠিক কাজ করেছো মনির ভাই? কিভাবে পারলে ভাবীকে এতো বড় ধোঁকা দিতে! দোষটা আগে হোক পরে হোক, এখন থাকুক আর নাই বা থাকুক অন্যায় তো তুমি করেছোই। আর এ নিয়ে তুমি ভাবীর কাছে মাফ না চেয়ে উল্টো তার সাথেই গালাগালি করছো?'

মনির বলল, 'আরে এগুলা তো আগে করছি। এখন তো বাদ দিয়া দিছি। তাইলে এখন ওয় এমন শুরু করছে কেন? ওরে আমার সব কিছু কইতে হইবো? শুনো মাহতাব, মাইয়া মাইনষের বেশি বুঝোন ভালো না।'

শুদ্ধ স্মিত হেসে বলল, 'আজকে এই কাজটা যদি তুমি না করে ভাবী করতো তাহলে কি তুমি তাকে ছেড়ে কথা বলতে মনির ভাই? একই বিষয় ছেলে আর মেয়ের ক্ষেত্রে আলাদা হয়ে যাবে কেন বলতে পারো? ভাবীর চেঁচামেচিকে তোমার বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে? এর পেছনের যন্ত্রণাটাকে কি তুমি উপলব্ধি করতে পারছো না? আচ্ছা মনির ভাই, তোমার মনে আছে? একবার যে তুমি তোমার দোকানে অনেক বড় লস খেলে। তোমাদের ফসলও সেবার বেশি হলো না। একপ্রকার অভাবেই ডুবে গিয়েছিলে তোমরা। তখনও কি ভাবী তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিল? নাকি তখনই ছেড়ে গিয়েছিল যখন তুমি একবার অনেক অসুস্থ হয়ে গেলে? ছেড়ে যায়নি তাই তো! কিন্তু আজ একটা মেয়ের সাথে তোমার ছবি দেখে রোকসানা ভাবী তার বাপের বাড়ি চলে যেতে চাইলো। তবুও কি তুমি কিছু বুঝতে পারছো না মনির ভাই? সব কষ্ট সহ্য করতে পারলেও ভাবী এই কষ্টটা সহ্য করতে পারছে না। বুঝতে পারছো এটা মেয়েদের কাছে কতো ভয়ানক কষ্টের ব্যাপার! বিয়ের পর একটা মেয়ে তো তার স্বামীর উপর বিশ্বাস করেই তার আপন সব কিছু ছেড়ে আসে। বিনিময়ে চায় একটু ভরসা, বিশ্বস্ততা। আমরা কি সেই বিশ্বস্ততা টা তাদেরকে দিতে পারি না? যেই মেয়ে আমাদের জন্য তার সবকিছু ছেড়ে দিল আমরা কি তার জন্য শুধু এতটুকু ছাড়তে পারি না? পারি না একটু অন্য মেয়েদের দিকে না নজর দিয়ে থাকতে? নিজেদের একটু সামলে রাখতে কি পারি না বলো? মনির ভাই, তোমার না একটা ছোট মেয়ে আছে? বিয়ে হওয়ার পর তার সাথে কখনোও কল্পনাতেও এরকম হওয়া তুমি মানতে পারবে?'

মনির এতক্ষণ চুপ করে অপরাধীদের মতো শুদ্ধ'র বলা প্রতিটা কথা শুনছিল। বয়সে ছোট একটা ছেলের থেকে এসব শোনা তার জন্য ভীষণ লজ্জিত একটা ব্যাপার। সত্যি বলতে নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত বোধ তার আগেও হচ্ছিল। কিন্তু নিজের নকল পুরুষত্ব বোধের গায়ে লাগছিল বলেই নিজের দোষের রাগ রোকসানার উপরেই ঝেড়ে দিচ্ছিল। মূলত রোকসানাকে বাপের বাড়ি যাওয়া থেকে আটকাবার জন্যই এরকম হুমকি দিয়েছিল সে। তবুও মুখ ফুটে মাফ চাইতে পারেনি।
শুদ্ধ'র শেষের কথাটায় হঠাৎ মনিরের বুক কেঁপে উঠলো। সে ঝট করে কম্পিত দৃষ্টিতে তাকালো শুদ্ধ'র দিকে। শুদ্ধ স্মিত হেসে বলল, 'কি, নিজের মেয়ের বেলায় খারাপ লাগলো তো শুনতে? ভাবীও তো তেমনই একজনের মেয়ে মনির ভাই। মেয়ের জন্য ভালোবাসা সব বাবারই এক। তুমি যখন অন্যের মেয়েকে ভালো রাখতে পারবে ঠিক তখনই নিজের মেয়েকেও অন্যের কাছে ভালো থাকার আশা করতে পারবে। পরকীয়া খুবই জঘন্য একটা ব্যাপার। কোন ব্যাখা দিয়েই তুমি এটাকে জাস্টিফাই করতে পারবে না। যেটা অন্যায় সেটা অন্যায়ই। তুমি অনেক বড় একটা ভুল করেছো। ভাবী যদি তোমাকে আর কখনো মাফ নাও করে তবুও আমি তাকে কোন দোষ দিতে পারবো না। আঘাতটা যখন বিশ্বাসের উপর এসে হয় তখন বাদবাকি সবকিছুই ঠুনকো হয়ে যায়। ভাবীর কাছে গিয়ে মাফ চাও মনির ভাই। যতটুকু দিয়ে মাফ চাওয়া যায় সবটুকু দিয়েই। সে তোমার বউ। তাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখো। ভয় পাইয়ে নয়।'

মনির অনুতপ্ত মুখে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। উঠোনে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করা রোকসানার হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে হঠাৎ কেঁদে ফেললো। কান্নার শব্দটা বাইরে থেকেও শোনা গেলো। রোকসানাও যে ঠান্ডা হয়ে গেছে ভিতরের নিরবতা তাই প্রকাশ করলো। একটা প্রশান্তির হাসি নিয়ে পকেটে দু হাত গুঁজে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো শুদ্ধ। ধারা এতক্ষণ অবাক, মুগ্ধ, স্থবির সব অনুভূতি একসাথে নিয়েই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুদ্ধ'র কথা শুনছিলো। মনির চলে যাওয়ার পরই ধারা শুদ্ধকে এই প্রথম নাম ধরে ডেকে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,

'শুদ্ধ, আপনি সত্যিই শুদ্ধ।'




চলবে********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 1 user Likes Bangla Golpo's post
Like Reply




Users browsing this thread: 1 Guest(s)