17-11-2023, 11:38 AM
ufff, ki likheche dada!!!!
Adultery পদ্ম নাগের বিষ
|
17-11-2023, 11:38 AM
ufff, ki likheche dada!!!!
17-11-2023, 03:06 PM
অসাধারণ গল্প। সেই লেখনি।
17-11-2023, 08:43 PM
আপডেট কি আরও দেরি হবে?
18-11-2023, 04:36 PM
আপডেট চাই দাদা।
18-11-2023, 08:47 PM
update kobe pabo?
19-11-2023, 04:33 AM
Update din please
19-11-2023, 09:48 AM
আজকে কী আপডেট পাবো দাদা
19-11-2023, 03:50 PM
Henry দাদা আপনার গল্পের একটা সুন্দর গাঁথুনী আছে,
তাই আমি বলবো আপনি শেরা
19-11-2023, 07:40 PM
হেনরী, সাগ্রহে নতুন পর্বের অপেক্ষা করছি. বলাই বাহুল্য, প্রথম থেকেই তোমার লেখার গুণমুগ্ধ ছিলাম. আর তোমার সঙ্গে রয়েছি. শুভেচ্ছা রইলো.
19-11-2023, 10:16 PM
দারুণ
20-11-2023, 06:22 PM
?????
20-11-2023, 08:50 PM
পদ্ম নাগের বিষ থেকে ও সাংঘাতিক বিষের খেলা আসছে আর তা হল কামনা। সকল বিষের মত অল্পে তে এ মঙ্গলকারী, সংসার গড়ে তোলে; অতিরিক্ত হলে সংসার তছনছ করে। পিকলু প্রাণ তো ফিরে পাবে, কিন্তু তার জীবন কী আগের মত থাকবে, দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। বলতে বাধা নেই, সংসার টা থাকলেই খুশি হব।
21-11-2023, 12:06 AM
Update please!!!!!!!
21-11-2023, 03:16 AM
সাগ্রহে অপেক্ষা করবো। অনুরোধ রইলো যদি পারো font size টা default না রেখে size 4 বা 5 রেখো।
21-11-2023, 09:39 AM
পর্ব ৬
মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে আমি আর বাইতে পারলাম না সারা জনম উজান বাইলাম ভাটির নাগাল পাইলাম না। মজিদ আলি কাঁপা গলায় গানটা গাইছে আর জাল থেকে মাছগুলো ছাড়িয়ে ডিঙিতে ছুঁড়ে ফেলছে। একটু ছোট মাছ হলেই ছুঁড়ে দিচ্ছে নদীর বুকে। শম্ভুর জাল তখনও নদীতে। গোটানো হতে বাকি। ও শুনছিল মজিদের কাঁপা গলার গান। মজিদ বললে--কি গো ভীমনাগের পো, জাল কি আজ তুইলিবি লাই লা কি? ---তোমার গান শুইনে তো চাচা, জাল ফেইলে রেখে শুধু শুনতে মন চায়। মজিদ হেসে বলল---দে দিখি, বিড়ি দে। শম্ভু মজিদের ডিঙ্গিতে একটা বিড়ি ছুঁড়ে দিল। মজিদ বিড়িটা ধরিয়ে বললে---জানিস আমার আব্বা কি কইতো, বিড়ির আগুন মনের আগুন নিভায়। আব্বা যেত গেরামে গেরামে গান করতে। বোষ্টমদের সাথে তাল মিলাইতো। তারা গায় ঠাকুর দেবতার গান, আমার আব্বা জাইনতো মাঝি জেবনের গান। শুইনবি লা কি আরেকটা? ---শুনাও। জালটা ততখুনে আরেকটু রসু। মজিদ বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে চোখ বুজে গাইতে লাগলো, ওর হাতের জ্বলন্ত বিড়িটাকে অবহেলা করে। বিড়ি পুড়তে পুড়তে ওর মনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো ভাটিয়ালি সুরের গান--- সদ্য ফুটা কুঁড়ির ভিতর ভ্রমর গান তুইলে কামে ভরা দেহের ভিতর পাঁজরটা যায় ফুইলে হাজা মজা এক পুকুর ভিতর সাঁতারায় শিং মাছে নদীর ভিতর আসমান ডুইবে জেবন সংসার মাঝে নির্বিবাদী নর সাইথে মিলল যখুন নারী কাল নাগিনী বুকে তখুন নাইমছে লোনা বারি... জালটা গোছাতে লাগলো শম্ভু। পড়ন্ত বেলা। খুব করে তিনটা তো বাজবেই। ফিরে মাছ ভাত রাঁধবে সে। ষষ্ঠীটাকে আসতে বলেছিল। তার নাকি সকাল থেকে জ্বর। শম্ভু দেখল আজ জালে উঠেছে পার্শে, খয়রা, বড় সাইজের তেলাপিয়াও। সরবেড়িয়া হাটে যদি ষষ্ঠী সন্ধেবেলা বেচে আসতে পারে ভালো দাম পাবে। নৌকা নিয়ে ও যখন ফিরল ঘাটে, তখন দ্বিপ্রহর তিনটে। ঘাট বলতে ওর নিজস্ব। দাদু সনাতন মাঝির বাপ ঠাকুর্দা বানিয়েছিল বসত লাগোয়া নদীর এক অংশে বড় শিরীষ গাছের কাছটা, বড় বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে। সে গুঁড়ি অনেক ক্ষয়ে গেছে। কয়েকটা বন্যার সময় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঐ ঘাটেই সে তার নৌকা ভেড়ালো। কাদা মাখা গায়ে ঠোঁটে জ্বলন্ত বিড়িটা চেপে মাছের বালতি হাতে, কাঁধে জাল ফেলে নিজের ঘরের দিকে ফিরতেই চমকে উঠল শম্ভু। কালনাগিনীর ঘাট থেকেই ওর দু' চালা ঘর দেখা যায়। বেশী তো দূর নয়, পঞ্চাশ গজেরও কম হবে। একটা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে চালার সামনে। কয়েকজনের জটলাও রয়েছে তার পাশে। মাঝে মধ্যমনি ষষ্ঠীপদটিকেও দেখতে পাচ্ছে শম্ভু। কাছে আসতেই ষষ্ঠী বলল---এই যে শম্ভু আইসছে দিদিমণি, ভীমনাগ বেদের পো। শম্ভু লক্ষ্য করল ফর্সা উজ্জ্বল রঙের এক শাড়ী পরিহিতা শহুরে দিদিমণি। সঙ্গে একটা আটপৌরে শাড়িতে বয়স্কা মহিলা। দেউলবাড়ির মণ্ডল পাড়ার একটা ছেলেও সঙ্গে আছে। শম্ভু খানিকটা বিব্রত হয়ে বলল---কি হছে এখুন? ষষ্ঠী বললে---শহুর থিকা দিদিমণি আসছে। তার ফুলের মত বাচ্চাটারে সাপে কাইটছে রে শম্ভু। শম্ভু বিরক্ত হল। এখন সে আয়েশ করে রাঁধবে। কোনো কাজে তার মন নেই। সাপে কাটা রুগীতো দেখবারই ইচ্ছে নেই তার। সে তো ঠিকই করে নিয়েছে; দাদুর মত ডিঙি বেয়ে মাছ ধরবে। ইচ্ছে হলে সরবেড়িয়া হাটে বেচে আসবে। তাই বললে---আমি এখুন চিকিচ্ছা কইরি লা। বলে দে ষষ্ঠী। হাসপাতালের ডাক্তারটার লিগে দেখাইতে। ---ডাক্তার পাইরবে লাই রে শম্ভু। সে জন্য তো তোর কাছটা আইসছে। তু লা দেইখলে কি হবে বাচ্চাটার! দেউলবাড়ির মন্ডল পাড়ার ছেলে বলতে সরলার ভাসুরের ছেলে ভগীরথ। সে কাকুতি করে বলল---শম্ভু একটু দিখতে তো পারিস রুগীটারে। শহর থিকে এদ্দুর আসসে, শুধু তোরে দেখাইবে বইলে। রমা লক্ষ্য করল সুঠাম কৃষ্ণবর্ণের এই দীর্ঘদেহী যুবকের উস্ক খুস্ক চুল আর দাড়িতে ঢাকা মুখমন্ডল সহ সর্বাঙ্গে একটা বন্য ভাব আছে। কিন্তু চোখের মধ্যে একটা মাদকতা মেশানো, যেখানে মনে হয় এই একাকী বেদে যুবকেরও একটা লুক্কায়িত মানবতা রয়েছে গোপনে। আসলে রমা প্রায়শই মানুষের চোখ দেখে তাকে বোঝার চেষ্টা করে, এটা রমার নিছকই অভ্যাস। পীযুষের চোখে যেমন সে বুদ্ধিদীপ্ততা, নীতিবাগ্মীতা খুঁজে পায়, তেমন অনিমেষের অসভ্য চোখকেও সে চিনে ফেলেছিল অবলীলায়। কিন্তু এই যুবকটি একেবারে নতুন, চেহারা যেন লৌহমানব। অথচ চোখ দুটি ভাসা ভাসা, একটা সরলতা মেশানো প্রগাঢ় মানবিক অনুভূতি নীরবে খেলা করে। সে অনুরোধ করে বললে---দেখুন ভাই, আমার একমাত্র ছেলে। আমি এতদূর থেকে এসেছি বিশেষ কোনো আশা নিয়ে নয়। কিন্তু ছেলের জন্য শেষ চেষ্টাটুকু করে যেতে চাই। আপনি একটিবার আমার ছেলেটিকে দেখে মতামত দিলে আমরা চলে যাবো। শম্ভু রমার মুখের দিকে না তাকিয়ে বললে---রুগী কোথা দেখতেছি লা তো। রুগীরে উঠানে শুয়াও। আমি গা ধুয়ে আসতেছি। সরলা কপালে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করল। বললে---দিদিমণি, ভীমনাগ বেদের ব্যাটা যখুন, ক্ষমতা আছে কিন্তু তার। যদিও রমার বিশেষ কোনো আস্থা নেই। ড্রাইভার গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দিল। ভগীরথ আর ষষ্ঠীপদ পিকলুর জ্ঞানহীন দেহটা নামিয়ে শম্ভুর হোগলা জঙ্গলে গ্রাস হতে চলা মাটির উঠোনে শুইয়ে দিল। ড্রাইভার বললে---দিদিমণি, আমাকে পয়সা মিটিয়ে দেন। আমার তো আর কোনো কাজ নেই। রমা বুঝতে পারছিল না ড্রাইভারকে ছেড়ে দেবে কিনা। সত্যিই এই বেদেটা কিছু করতে পারবে নাকি? তেমন অত্যাশ্চর্য কিছু না ঘটলে তো তাদের কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে যেতে হবে। ষষ্ঠী অভয় দিয়ে বললে---দিদিমণি শম্ভু যখন রাজি হছে, তখুন ডাইভার ভাইরে ছাইড়ে দেন। কম করে কাইল সকালের আগে কিছু হবে লাই। ড্রাইভার চলে গেল। সেই সাথে ভগীরথও চলে গেল তার গ্রামে। তার গ্রামটা যে এখান থেকে প্রায় তিন-চার কিমি দূরে। যাবার সময় রমা ওকে ধন্যবাদ জানালো। ভগীরথ সরলাকে বললে---কাকী একবার ঘরটায় ঘুইরে যাবে গো। শম্ভু স্নান করল কলতলায়। মাত্র দুটো লুঙ্গি তার। একটা ভিজলে আরেকটা বদলে নেয়। গা'টা মুছে, মাটির দেয়ালে আটকে রাখা আয়নাটায় তাকিয়ে চিরুনি দিল সে। মনে মনে গুনগুন করে গাইতে লাগলো মজিদের গাওয়া গানের শেষ দু' কলি--- নির্বিবাদী নরের সাইথে মিলল যখুন নারী কাল নাগিনী বুকে তখুন নাইমছে লোনা বারি...
21-11-2023, 09:40 AM
উঠানে শুয়ে থাকা তের-চৌদ্দ বছরের ছেলেটার মুখ দেখে মায়া হল শম্ভুর। গা'টার রঙ তার মায়ের মত ফর্সা। পায়ের দংশন স্থানকে দূর থেকে দেখে রোগীর কাছে আসতে না আসতেই বললে---দিখে তো মনে হয় গোখরো কাইটছে।
তারপর শম্ভু পিকলুর মাথাটা নিজের কোলে রাখলো। একবার মা মনসার নাম করে কপালে হাত ছোঁয়ালো। এ তার বাপ-দাদার বেদে সংস্কৃতি। ঠিক ডাক্তারের কায়দায় বুকের কাছে হাত ঠেকিয়ে, হাতের পালস টিপে দেখল শম্ভু। জীবন আছে। ক্ষত স্থানে একটা ছোট ফলের মত কিছু ঘষতে লাগলো খানিক। সাদা হয়ে গেল জায়গাটা। তারপর রমার দিকে তাকিয়ে মুখের মধ্যে একরাশ হতভম্বতা এনে বললে---মনে হইল তিনবার কামড় দিছে। ঘরে সাপ ঢুকলো কি কইরে দিদিমণি? কলকাতা শহুরে তো বিষাক্ত সাপ থাইকবার কথা লয়। ষষ্ঠী বললে---আমি যে কলকাতা শহুরে মাস্টার বাবুটারে সাপ বিক্রি করি; তার কাছে সাপটা ছিল। কাচের বাক্সটা হতে বার হছে কখন, কেউ বুঝতে পারে লাই। তবে শম্ভুর মুখে গাম্ভীর্য দেখে ষষ্ঠী বুঝতে পারছে কিছু একটা সমস্যা আছে। শম্ভু বেদে তার আশৈশব বন্ধু, কত সাপে কাটা রুগী সে দেখেছে, শম্ভুর এমন চিন্তিত আর গম্ভীর মুখ কখনো দেখেনি সে। সচরাচর শম্ভু খুব তাচ্ছিল্যের সাথে রুগী দ্যাখে, যেন সাপে কাটা রুগী সারানো তার কাছে নস্যি। সেই শম্ভুই এমন কপাল কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করছে ক্ষতস্থান। ফলত ষষ্ঠীপদও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলল---কি কস শম্ভু? শম্ভু ঈষৎ চিন্তিত। গম্ভীর হয়ে রয়েছে তার মুখ। বড্ড ভারী উষ্ণ গলায় বললে---পচুর বিষ ঢাইলছে দিদিমণি। কি কইরে হল, এ তো সাধারণ ব্যাপারটা আছে লাই। সাপটার শিকার লা হলে এ কামড় দেয় লাই। কি আশ্চর্য! রমার বিস্ময় বাড়ছে। ডাক্তাররা যেখানে দীর্ঘ চিকিৎসার পর যেসব কিছু রিপোর্ট করেছে, এ গেঁয়ো বেদে এক লহমায় সে সব বলে দিচ্ছে! রমা বললে---আমরাও তো সেটা বুঝতে পারছি না ভাই। ডাক্তাররাও বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। ষষ্ঠীর দিকে তাকালো এবার শম্ভু। জিজ্ঞেস করল---বাবুর ঘরে তুই দিছিস সাপটারে লিশ্চয়? কুত্থেকে পেলি? ষষ্ঠী বুঝল পদ্মের কথাটা ধরা পড়ে যেতে পারে। মোটেই এখুনি বলা যাবে না। সাংঘাতিক হয়ে যাবে। সে তাই বলল---হ' দিছি। সিটা ধইরেছিলাম মাতলার পাড়ে বাদাবন হতে। বড় ছিল কিনা। শম্ভু বলল---বড় হলেই বিষ ঢাইলবে বেশি; কুথাটা ঠিক লয়। এ ঘটনা আমি আমার জেবনে একবারই দিখছি। শম্ভুর মনে পড়ল তার তখন সাত-আট বছর বয়স। বাঁকুড়া থেকে এক সাপে কাটা আদিবাসী ছেলেকে আনা হয়েছিল তার ঘরে। এতদূর থেকে রোগী এসেছে ঘরে! তার বাপ ভীমনাগ বেদেও বিশ্বাস করতে পারেনি। কোনো না কোনো ভাবে খবর পেয়েছিল তারা। তা নাহলে ভীমনাগ যতই সাপে কাটায় চিকিৎসা করতে পারদর্শী হোক, দু-তিন গ্রাম লোক ছাড়া কেউ তাকে তেমন চেনে না। হয়ত লোকমুখে খবর ছড়িয়ে আরো কিছু দূরবর্তী জায়গা থেকে রুগী আসতো, যেমন বসিরহাট কিংবা ভাঙড় থেকেও রুগী এসেছে দু একবার। সেভাবেই এ অঞ্চলের কেউ পরিচিতি থাকায় বাঁকুড়া থেকে এসেছে! ভীমনাগ বিস্মিত হয়েছিল সেদিন। পরে অবশ্য ভীমনাগ বেদে বুঝেছিল সে রোগী আসার কারণ আছে। শম্ভুর মনে আছে সে রোগীর জ্ঞান ছিল না। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছিল। ছ' মাস তার বাড়িতে ফেলে রেখে চিকিৎসা করেছিল তার বাপ ভীমনাগ বেদে। শম্ভু তার বাপকে অত দরদ নিয়ে কখনো চিকিৎসা করতে দেখেনি কোনোদিন। জিজ্ঞেস করতে বাপ তাকে বলেছিল, 'মানুষটা সাপের শিকার লা রে শম্ভু, মানুষরে ভয় পায়ে সাপ কামড়ায়, কিন্তু ভুল কইরে যদি সাপটা মানুষটারে শিকার ভেবে লেয়, তারে মারাত্বক বিষ ঢালে, এর চিকিচ্ছা হাজারে একটা হয় রে শম্ভু; শিখে রাখ, লাইগতে পারে।' বাপের সাথে প্রতিদিন নদীর চরে গিয়ে, সুন্দরী-গরান জঙ্গলে গিয়ে জড়ি বুটি, শিকড়-বাকড় সব সংগ্রহ করত সে। রাতে কাছ থেকে দেখত বাপ কিভাবে চিকিৎসা করে। বাপ যখন গেল, তারপর থেকে শম্ভু দশ-বারো বছর একাই বিশ-পঁচিশটা রুগীকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু কোনোদিন সে ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখেনি। শম্ভু লুঙ্গির গাঁট খুলে একটা বিড়ি ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরল। ষষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে বললে---আগুনটা দে দিখি। ষষ্ঠী লাইটার এগিয়ে দিল শম্ভুর দিকে। শম্ভু বিড়ি ধরিয়ে বললে---দিদিমণি জ্ঞান ফিরাইতে আজ রাইতটা রয়ে যাতে হবে। আমারে এখুন বার হতে হবে জঙ্গলটায়, ওষুধ পত্তর তৈরি কইরতে হবে। রমার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সরলার মুখে আনন্দচ্ছল হাসি। যদিও বা জ্ঞান ফিরবে আদৌ কিনা রমা এখনো সন্দিহান, তবু এই প্রথমবার কেউ তাকে ভরসা দিল পিকলুর জ্ঞান ফিরতে পারে। ষষ্ঠী বলল---দিদিমণি, তা হইলে আজ রাইতটা জালি ঘরে দুটা খেয়ে লিবেন। কাঁসার ভালো থালা বাটিরে দিব। সরলা প্রতিবাদ করে বললে---দিদিমণি বামুন ঘরেরটা আছে, তুই তারে খাওয়াইবি? ষষ্ঠীর মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে গেল। রমা মৃদু হেসে বলল---না না, ভাই আমি জাত-পাত মানি না। তবে রাতে আর ভাত খাবো না। কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে আছে খেয়ে নেব। আমার ছেলেটাকে তোমরা বাঁচাও, শুধু এটুকু প্রার্থনা তোমাদের কাছে। ---সে ক্ষমতা তো শুধু শম্ভুটার আছে দিদিমণি। সে যতক্ষুন আছে কিছু তো একটা হবে। কি কস শম্ভু। শম্ভু অবশ্য কিছু একটা ভাবছে। আর জানলা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ছে আপন মনে। সকলেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রমা দেখতে পাচ্ছে শেষ বিকেলের গোধূলি আভায় ওর এলোমেলো চুল দাড়িতে ভর্তি কুচকুচে কালো কঠোর মুখটা বিষন্ন ভাবুক। হাতের পেশল শরীরে শিরা উপশিরা টানটান। চাবুকের মত শরীরে যেন পরতে পরতে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা। কিছুক্ষন থেমে শম্ভু বললে---দিদিমণি, বাটনাটা বাইটতে পারেন? বাটনা! মানে শিল-নোড়া! রমা কখনো বাটনা বাটেনি। ওসব তার বাপের বাড়িতে মাকে দেখেছে। রান্নার জন্য মিক্সি মেশিনে মশলা করে নেয় রমা। এমনকি চাঁপাও আজকালকার মেয়ে, বাটন বাটা ওর দ্বারাও হয় না। সরলা বরং বললে---দিদিমনি পারবে নাই। আমি বাইটে দিব। বল কি কইরতে হবে। শম্ভু একটা ঝুলি খুলে কিছু শকুনো কাঠের টুকরো, শিকড় আর শুকনো হরিতকীর মত দেখতে কিছু ফল মাটিতে ঢেলে দিল। তারপর বললে---এগুলা তেল দিয়া বাইটতে হবে। তবে সরিষার তেল দিয়া লয়। একটা শিশিতে করে কিছু সবুজ তেল রাখা। ঐটা শিলে ঢেলে দিল শম্ভু। বললে---মাসি, দের লা কইরে কাজ শুরু কইরে দেন। সারা সন্ধে এমনই নিস্তব্ধ অরণ্যশঙ্কুল নদীতীরের মাটির দোচালা ঘরে পিকলুর শুশ্রূষা নিয়ে কাটলো রমার। আসলে রমার নয়, রমা শুধু বিষন্ন মুখে দেখতে লাগলো শম্ভুর নানা চিকিৎসা পদ্ধতি। রমা জানে না আসলেই কোনো বুজরুকী কিনা, তবে শম্ভুর তৎপরতায় সে দেখতে পাচ্ছে, যদিও এটি বুজরুকী হয়, তবে সেই বুজরুকীতে শম্ভুর গভীর বিশ্বাস রয়েছে। রমা আরেকটি জিনিস লক্ষ্য করল, এ পর্যন্ত বেদেটি কোনো মন্ত্রচ্চারণ, জলপোড়া, তাবিজ-কবচ এসব কিছুই করেনি। পিকলুর হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত পায়ে ওই আঠালো সবুজ বাটনটা লাগিয়ে দিয়েছে শম্ভু। তার ওপর কিছু পাতা চাপিয়ে একটা ময়লা পাতলা কাপড় দিয়ে মৃদু করে বেঁধে দিয়েছে। ঠিক কামড়ের দাগ তিনটির মধ্যবর্তী স্থানে তিনটে সূচ গাঁথা। তার সাথে অনবরত পিকলুর বুকে তেল মালিশ করছে শম্ভু। ওর শক্ত দীর্ঘ হাতের থাবায় পিকলুর নরম বুকের পাঁজর দেখা যাচ্ছে। রাত্রি ন'টা পর্যন্ত একই ভাবেই শম্ভু রয়ে গেল পিকলুর চিকিৎসায়। মাঝে রমাকে বললে---দিদিমণি, কিছু খাবার হলে খেয়েলেন। ঘুম পাইলে ঘুমিয়েটা লিবেন ইখানটা। দো চালায় আমার সাপঘরটা আছে। সিখানটা আমি শুয়ে পইড়বো। খেতে তো ইচ্ছে নেই রমার। তবু পেটের ভেতর অস্বস্তি হচ্ছে। সেই সকালে ভাত খেয়ে বেরিয়েছিল। শুকনো কিছু স্নাক্স সরলা মাসির সাথে ভাগ করে খেলো ও। পীযুষকে ফোন করে সবটা জানাতে চেয়েছিল রমা। কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক বলে কিছু নেই। সুন্দরবনের এক অচেনা আদিম অরণ্য যেন। গ্রীষ্মের দিন হলেও রাতে ফুরফুরে নদীর বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকছে। ছোট তক্তাপোষের মত খাটে পিকলুকে মাঝে রেখে সরলা মাসি আর রমা ঘুমিয়ে পড়ল রাত্রি এগারোটা নাগাদ। ক্লান্তিতে শুয়ে পড়তেই ওদের সকলের চোখে ঘুম এসে গেছে। পীযুষের অবশ্য ঘুম আসছে না। রমা একা একা ছেলেটাকে নিয়ে বাইরে আছে। ষষ্ঠীর ফোন নম্বরটা ছিল। আসলে পীযুষের অভ্যাস জরুরী নম্বর না হলে সেভ করে না। ষষ্ঠী তার মত করে যখন ইচ্ছে হত সাপ দিয়ে গেছে। পীযুষ বাড়ি না থাকলে ফিরে গেছে। ফলত নম্বরটা একটা কাগজের টুকরোতে লিখে গেছিল ষষ্ঠীপদ। সে কাগজের টুকরো আদৌ গচ্ছিত আছে কিনা তাও মনে নেই পীযুষের। ভোরবেলা ও নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে বেরোবে। দেউলবাড়ি জায়গাটা যেহেতু গুগল মানচিত্রে দেখাচ্ছে। সেখানে গেলেই নিশ্চই একটা সুরাহা হবে। ++++++
21-11-2023, 09:41 AM
আশ্চর্য! রহস্য! নাকি কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তি! নাকি নিছকই প্রাচীন বেদেদের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা! জানা নেই রমার। কিন্তু আশ্চর্য তো বটেই। মধ্যরাতে সেই আশ্চর্য রমার চোখের সামনে ঘটল। তখন রাত্রি আড়াইটে। অকস্মাৎ অস্পষ্ট শব্দ কানে এলো রমার। কেউ যেন ডাকছে তাকে। প্রথমটা মনে হল, 'রমা' বলে তাকে কেউ আহ্বান করছে। পরক্ষনে বুঝতে পারলো 'রমা' নয় 'মা' বলেই কেউ ডাকছে। এবং সেই ডাক তার ঘুমঘোরে স্বপনে। কিন্তু এ কি! এ শব্দ তো স্বপ্নের মধ্যে নয়! ঘুম ভেঙে গেছে তার। এখন সেই শব্দ আরো স্পষ্ট। স্পষ্টতই পিকলু তার পাশে আড়ষ্ঠ গলায় বিড়বিড় করছে, শব্দটি পরিষ্কার 'মা'।
রমা ঘুরে পড়ল পিকলুর দিকে,---পিকলু! পিকলু! বলে ঠেলা দিল রমা। এখনও যেন মনে হচ্ছে পিকলু তাদের লেক টাউনের বাড়িতে ঘুমিয়ে রয়েছে। আর ঘুমের মধ্যে কোনো ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে মাকে ডাকছে। খানিক ঠেলা দিতেই চোখ মেলে তাকালো পিকলু। কি আশ্চর্য! রমা আনন্দে কেঁদে ফেলবে। সরলাও উঠে পড়েছে। পিকলু মায়ের দিকে তাকিয়ে, অস্পষ্ট, জড়ানো জিভে সে কিছু বলতে চায়। তার প্রথম শব্দ আবারও 'মা'। সরলা গিয়ে ডেকে আনলো শম্ভুকে। ঝিম ধরা পদ্মের নেশা থেকে সে আজ বহুদিন দূরে। এখন হালকা ঘুম হয় তার। সেও এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছিল; মজিদ চাচা গান গাইছে, পিকলুর মত একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে নিয়ে সে নদীতে মাছ ধরা শেখাচ্ছে। ঠিক যেভাবে তার দাদু সনাতন মাঝি কিংবা মা কমলা তাকে নদী চিনিয়েছিল। শিশুটির গলায় সে শুনতে পাচ্ছে 'বাপ' ডাক। ঘুম ভাঙতে সামনে সে সরলাকে দেখতে পেল। একি তার বত্রিশ বছরের যৌবনের অচেতন ইচ্ছার স্বপ্ন গ্রাস! শম্ভুরটির স্বপ্ন হলেও রমারটি বাস্তব। পিকলুর মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছে রমা। লম্ফের আলোতে রমার ফর্সা কোমল মুখটায় লাল আভা। মুখে উছ্বলতা। একজন মায়ের সবচেয়ে সুখী সময়, তার অসুস্থ সন্তানের সুস্থ হয়ে ওঠা। পিকলু আধো আধো কথা বলছে। সেই কথায় জড়তা আছে। তবে বোঝা যায়। রমা বুঝতে পারছে। সে কোথায়, কি হয়েছে তার, তার ভয় করছে, এইসব বলছে পিকলু। মায়ের কাছে মুখ লুকোতে চায় তার সদ্য কৈশরে পা দেওয়া চৌদ্দ বছরের ছেলে। যে কিনা কৈশরের দেহজ চাহিদায় সবসময় এখন বড়দের মত হতে চাইতো। রমা পিকলুর কপালে চুমু এঁকে দিল। শম্ভু এসে পিকলুর পাশে বসতে পিকলুর বিস্ময়ের অন্ত নেই। সেই অস্পষ্ট স্বরে সে বললে--এ কে মা? ---তুই অসুস্থ ছিলি সোনা। তোকে এই কাকুটা ভালো করেছে। রমা শম্ভুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে চরম বিস্ময়ে, আশ্চর্যতায়, শ্রদ্ধায়, মুগ্ধতায়। কি এক চরম ভুল করতে যাচ্ছিল সে। এই গ্রামীন বেদেকে বিশ্বাস না করে যদি সে আজও হাসপাতালের বেডে পিকলুকে ফেলে রাখতো! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল রমার। এই দীর্ঘদেহী কৃষ্ণবর্ণ পেশীবহুল সুঠাম চেহারার বেদে যুবকটিকে, এখন তার ঈশ্বর মনে হচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে ঈশ্বর এমনই থাকেন, লোকচক্ষুর আড়ালে, কোনো এক বন্যা কবলিত নদীর ধারে দু' চালা মাটির ঘরে। ভোরের দিকে একটা স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে যাচ্ছে নদীর বুক চিরে এই হোগলা, গোলপাতা, গরানের জঙ্গল দিয়ে। শম্ভুকে জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করতে হবে কিছু গাছের বীজ, শিকড়, জড়ি-বুটি। সে তাই বেরিয়েছে তার ডিঙিতে করে কালনাগিনী পেরিয়ে ঠিক উল্টো দিকের গভীর জঙ্গলে। ওদিকে বনবিবির বাহনের দেখা পাওয়া যায়। শম্ভু সেসব পরোয়া করে না। বেদে আর সুন্দরবনের দুঃসাহসিক জেলে রক্ত তার গায়ে। মা কমলাকে দেখেছে সে জেলে বাড়ির মেয়ে হয়ে কি সাহসটাই না রাখতো। যাবার সময় রমাকে বলে গেছে---দিদিমণি, জ্ঞানটা ফিইরছে মানে বিষটা নামে লাই, সারা গায়ে বিষটা আছে। বাচ্চারে এখন প্যারালাইসটা হছে। এ বাচ্চা হাঁইটতে, চইলতে আরো পাঁচ-ছ মাস লাইগবে। বিষ তো আর কম ঢাইলে লাই গোখরাটা। পাঁচ-ছ মাস চিকিচ্ছা কইরলে আপনার বাচ্চাটা ঠিক হবে। রমার বিশ্বাস জন্মেছে শম্ভুর ওপর। যে লোক তার ছেলের জীবন বাঁচাতে পারে তার ওপর বিশ্বাস না করে উপায় আছে। তাই রমা বলেছিল--ভাই, আপনি কলকাতায় আমাদের বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করবেন। আপনার থাকা খাবার সব ব্যবস্থা করে দেব। কোনো সমস্যা হবে না। আপনি যত টাকা চাইবেন... শম্ভুকে এই টাকার কথাটা বলা বোধ হয় ঠিক হয়নি রমার। খানিকটা রেগে গিয়ে বলেছিল---দিখেন দিদিমণি, টাকা আমি লেই, সে চিকিচ্ছা যখুন আমার কাজটা আছে। আমি ঠিক কইরেছি আর বেদের কাজ কইরব লা। আপনার ছেলার লগে আমি কইরছি, বাচ্চা ছেলা বইলে। আর সবচেয়ে বড়টা হইল, আমি এই ঘটনা জেবনে একবার দিখছি, তখুন আমি সাত-আট বছরের। আমার বাপ বাঁকুড়ার একটা আদিবাসী ছেলার জেবন বাঁচাইছিল ছ মাস চিকিচ্ছা কইরে। সে ঘটনাও আপনার ছেলাটার মতন ছিল, পচুর বিষ ছিল তার গা'রে। আরেকটা কথা মনে রাইখবেন আপনারা বড়লোকটা আছেন বইলে শম্ভু বেদেরে পয়সার লালসা দিবেন লাই। ষষ্ঠীপদ শম্ভুর গরম মাথা বাগে আনতে বলেছিল---দিদিমণিটা কি বুঝে কয়েছে এসবটা, সেটা লা বুঝে তু বড় রাগ করিস শম্ভু। শম্ভুর মাথা ঠান্ডা হল তখন। বলল---বাচ্চারে লয়ে আমার দু' চালা ঘরে রয়ে যাতে হবে দিদিমণি। শহুরে গিয়া চিকিচ্ছা হবে লাই। যখুন তখুন জড়ি বটি বানাইতে লাইগবে, জঙ্গলটাই হল রুগীর দাওয়াই। আপনারা শহুরের লোক আছেন কষ্টটা হবে, দিখেন যদি ছেলাটারে বাঁচাইতে চান। রমা বুঝতে পারছিল রাতের বেলা নদীর ওপর দিয়ে বাতাস বইলেও দুপুরে গ্রীষ্মের তীব্র গরম এখানে। মাটির এই দোচালা ঘরে পিকলুকে নিয়ে থাকাটা বড্ড কষ্টকর তার এবং পিকলু উভয়ের পক্ষে। রমা নিজেও এসি কিংবা বৈদ্যুতিক ফ্যানে অভ্যস্ত। পিকলুটা তো একেবারেই গরম সহ্য করতে পারে না। কলেজ হোক বা খেলে বাড়ি ফিরলেই ও এসি চালিয়ে দেয়। সেই তাদেরকে যে করে হোক এখানে থেকে যেতে হবে। সকালবেলা সরলা চলে গেল দেউলবাড়িতে তার শ্বশুরের ভিটেতে। সেখান থেকে হয়ে ও কলকাতা ফিরে যাবে। পীযুষ পৌঁছল ঠিক ন'টা নাগাদ। ষষ্ঠীপদ স্যারকে দেখতে পেয়ে আহ্লাদিত হয়ে বললে---সার, আমাদের গেরামটা খুঁজে পেলেন কি কইরে? পীযুষের এখন বিশেষ কথা বলবার মত মানসিকতা নেই। সে জানে না পিকলু কেমন আছে। পিকলুর হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায়নি তো! মন্দ কথাটা কাল রাত থেকে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে বারবার। বললে---তোমার দিদিমণি কোথায়? ষষ্ঠী ডাক ছাড়লো---দিদিমণি বাইরে আসেন, সার আসছে। রমা বেরিয়ে এলো তৎক্ষনাৎ। পীযুষকে দেখতে পেয়ে তার মনের ভেতর চাপা উচ্ছাস বার হয়ে এলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। পীযুষও চমকে উঠল, এ ক'দিনে ভেঙে পড়া রমার মুখে মৃদু হাসি দেখে। বললে---হয়েছে তোমার ওঝা দেখানো? চলো এবার। রমা বললে---ভেতরে আসবে না? পীযুষ কিছুটা বিরক্তি সহকারেই এই মাটির হাভাতে ঘরে ঢুকল। পেছন পেছন ষষ্ঠীপদও সঙ্গ দিল। চমকে উঠল হারপেটোলজিতে পোস্ট ডক্টরেট, জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ডঃ পীযুষ মৈত্র। সত্যিই কি ও স্বপ্ন দেখছে না! তক্তাপোষের রুক্ষ শীতল পাটিতে শায়িত পিকলু তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। জড়তা যুক্ত স্বরে বলে উঠছে---বাবা! এ কেমন করে সম্ভব! পিকলু কথা বলছে! পীযুষ পিকলুর মাথার কাছে বসে ছেলের মাথায় হাত রাখল। পায়ে হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ময়লা একটা কাপড়ের ব্যান্ডেজ। তিনটে সূচ সকালে বার করে নিয়েছে শম্ভু। ফলত ঐ জায়গাটি স্বাভাবিক হয়ে আছে। বিস্ময়ে তাকালো পীযুষ একবার রমার দিকে, একবার ষষ্ঠীপদর দিকে। রমা বললে---আজ ভোর রাতে জ্ঞান ফিরেছে পিকলুর। যদি এখানে না আনতাম কি ভুলটাই না করতাম। পীযুষের সকল চিকিৎসা বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি আস্থা কি মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না ওর। তীব্র বিষ নিউরোটক্সিন, মাত্রাতিরিক্ত বিষ প্রয়োগ, সময়মত এন্টি ভেনাম না দেওয়া! সবকিছুর পরও তার ছেলে জীবিত! এক গেঁয়ো বেদের চিকিৎসায় এত ক্ষমতা! পীযুষ যে তার যুক্তিবিদ্যার কাছে হেরে যাচ্ছে সেটা রমাও বুঝতে পারছে। বললে---ও কিন্তু কোনো তাবিজ, কবচ কিছুই প্রয়োগ করেনি দেখো। শুধু আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা যাকে বলে তাই করেছে। পীযুষের মুখে যেমন একরাশ বিস্ময়, তেমনই তীব্র আনন্দ, বললে---রমা, এ কি করে সম্ভব হল? যা যা হয়েছে পীযুষকে সবটা গুছিয়ে বলল রমা। এ ও জানালো পিকলুকে সুস্থ করে তোলার চিকিৎসা চালাতে তাদের থেকে যেতে হবে। পীযুষ বললে---সবটাই বুঝলাম। চোখের সামনে যা দেখছি তাকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারি না। কিন্তু এমন পরিবেশে থাকবে কি করে তোমরা? রমা বললে---ছেলের জন্য আমাকে থাকতেই হবে। যত কষ্টই হোক। পীযুষ খানিক স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। পিকলু অস্পষ্টভাবে বললে---বাবা, আমরা বাড়ি কবে যাবো? পীযুষ ছেলের কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে---যাবো বাবা, যাবো। তুই সুস্থ হয়ে ওঠ, আর কটা দিন পর। তারপর নিয়ে যাবো তোকে। শম্ভুর উঠোনে এসে দাঁড়ালো পীযুষ। বন্য সুন্দরবনের অসামান্য প্রকৃতির কোলে এই নদী তীরবর্তী জায়গাটা। কদিন থেকে বেড়ানোর জন্য ঠিক আছে। কিন্তু বসবাসের জন্য! একটা সিগারেট ধরিয়ে ষষ্ঠীকে বললে---ষষ্ঠীপদ, এখানে গরম কেমন হয়? ---সার। আমরা গেরামের জল জঙ্গলের লোক। আমাদের তেমুন কষ্ট হয় লা। কিন্তু দিদিমণির কষ্ট হবে। শহুরের মানুষ কিনা। তবে সার রাতে শম্ভুর ঘরটাতে বাতাস হু হু কইরে ঢুকে। ----হুম্ম। কিন্তু তোমাদের ঐ শম্ভু বেদেটি কোথায়? ---সে জঙ্গলে গিছে ওষুধ আইনতে। জড়ি বুটি, শিকড় সব তো জঙ্গল হতে লিয়ে আসে সে। ---লোকটা কি ভালো? মানে নেশা টেশা কিছু করে না তো? ষষ্ঠী শম্ভুর আজকাল দিশি মদের নেশার কথাটা চেপে গেল। বললে---নেশা টেশা শম্ভুর কিছু লাই। লোক ভালো সে। বয়সটা কম, যুবক ছোকরাটা আছে। বিড়িটা খায় আরকি। মেয়েছেলে লিয়ে তার কুনো.... পীযুষ ষষ্ঠীপদর কথা শেষ হবার আগে বললে---এখানে বাথরুম, স্নানের কি আছে? ---কলতলা আছে সার। দিদিমণির জন্য ঘিরে দিব। পীযুষ সিগারেট শেষ করে বললে---দেখো ষষ্ঠীপদ, আমি তোমাকে চিনি। তোমার ঐ শম্ভু বেদেকে চিনি না। অবশ্য সে আমার ছেলেকে সুস্থ করেছে মানতেই হবে তার ক্ষমতা। তবে তুমি তোমার দিদিমণি এখানে যেহেতু থাকবে, বাথরুম, একটা রান্নাঘর, যা যা তার প্রয়োজনে লাগবে তৈরি করে দিও। টাকা পয়সা আমি তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। আর কাছে কোনো বাজার আছে? ---বাজার বইলতে সার, সরবেড়িয়াতে আছে, সে হাট যারে বলে আরকি। তবে দেউলবাড়ী কাছে দেবীপুরে বড় বাজার আছে। ---কতটা এখান থেকে? ---এখান থিকা চার-পাঁচ কিমি। সামান্যটা আছে সার। রমার লিস্ট মত কিছু জিনিস ছাড়াও একটা মিক্সি মেশিন, গ্যাস স্টোভ, বালিশ, বেডকভার, ম্যাট্রেস থালাবাসন, সাবান-শ্যাম্পু তেল, চাল, ডাল, এসকল জিনিস কিনে দিয়ে গেল পীযুষ। এখানে এখনো বিদ্যুতায়ন হয়নি। তবে পীযুষ লক্ষ্য করল দেউলবাড়িতে কিছু অবস্থাপন্ন বাড়িতে সোলার প্যানেল বসানো আছে। এখুনি এই সোলার প্যানেল বসানো অসম্ভব। একটা ইলেট্রনিক্সের দোকানে ইনভার্টার ব্যাটারির অর্ডার করে দিল পীযুষ। গ্রাম্য দোকান; তাই অর্ডার করলে মেলে। ষষ্ঠীকে টাকা পয়সা দিয়েও গেল পীযুষ, সময়মত যেন ব্যাটারিটা নিয়ে গিয়ে ফিট করে দেয় শম্ভুর বাড়িতে। পীযুষ দুপুরের আগেই ফিরে গেল। পরের সপ্তাহে শনিবার ও আসবে। এর মাঝে ষষ্ঠীর হাতে রমা আর পিকলুর পোশাক পরিচ্ছদ পাঠিয়ে দেবে বলে জানিয়েছে সে। বাসন্তী হাইওয়ে ধরে গাড়িটা ছুটছে। স্টিয়ারিং ধরা পীযুষের হাতে। মনের মধ্যে অনেককিছুই ধন্দ তৈরি হচ্ছে তার। কি করে একজন সামান্য বেদে এই দুঃসাধ্য করে তুলতে পারে। শুধু কি আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার মাধ্যমে! আয়ুর্বেদ পঞ্চভূতের মত বাতিল তত্বে বিশ্বাস করে। আজকের কোয়ান্টাম ফিজিক্সে যার কোনই মূল্য নেই। রমা আসলে যা বলল তাতে কি একে প্রাচীন মেডিসিনাল সায়েন্স বলা চলে? প্রাচীন মেডিসিনাল সায়েন্স দিয়ে অবশ্য কিছু দীর্ঘমেয়াদি রোগ সারানো সম্ভব। কিন্তু সাপে কাটা রোগী, ক্যানসার, স্ট্রোক, হার্টের রোগ সারানো কি সম্ভব! ভাবনার তরঙ্গ পীযুষের মস্তিষ্কে খেলা করতে লাগলো। মনে হল আজকের দিনেও ভারতবর্ষে লৌকিক অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে গেছে, যা জেনারেল বিজ্ঞানের আড়ালেই। সবটা বুজরুকী নয়।
21-11-2023, 09:42 AM
শম্ভু বাড়ি ফিরল বারোটা নাগাদ। ঘরের ভেতরে গ্যাস স্টোভ জ্বলছে। রমা ওতে রান্না করছে। নিজের দো চালায় ওঠার সময় লক্ষ্য করল ঘরময় জিনিস ভর্তি। চালের বস্তাটাও কেউ এনে রেখে গেছে। তার ছোট তক্তাপোশে শীতলপাটির বদলে ম্যাট্রেস, বেডশীট। সবচেয়ে অবাক হল তক্তাপোশে পিকলুর মাথার কাছে রাখা বড় স্ট্যান্ড ফ্যানটা দেখে। হেসে বললে---দিদিমণি, আমার গরীব ঘরে তো জিনিস পত্র ছাড়াই দিছেন। কিন্তু ই পাখাটা ঘুইরবে কি কইরে? কারেন্ট এ সাত গেরামের কুত্থাও লাই।
রমা হেসে বললে---আমার স্বামী এসেছিলেন। তিনি এসব এনে রেখেছেন। আর একটা ব্যাটারি অর্ডার করেছেন কাছেপিঠে কোথায় দোকানে। ওতেই ফ্যানটা চলবে। শম্ভু ফ্যানের ব্লেডটা হাতে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। নজর পড়ল ওর এমন কেরামতি দেখে পিকলু হাসছে। শম্ভু বললে---কি ছেলা? এখুন কেমুন লাইগছে? পিকলু হাসছে, কথায় জিভ আটকে গেলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। বলল---কাকু, ওটা এভাবে ঘোরে না! ---আরে জানি রে বাপ জানি। কারেন্ট লাগে তার জইন্যে। সে জইন্যই তো তুর মা'রে বইললি কারেন্ট লা লিয়ে পাখা লাগাইছেন কেন? রমা বললে---শম্ভু ভাই, তুমি আজ নিজে হাত পুড়িয়ে রান্না করো না। এখানেই খেয়ে নিও। শম্ভু হলদে দাঁত বের করে হেসে বললে---দিদিমণি, আমি বারো বছর লিজের জইন্য রাঁধছি। মাঝে বে কইরেছিলাম কিছুদিন। বউটা রাঁধে দিছিল যা। রমা বললে---ওমা! তুমি বিয়ে করেছিলে? তোমার বউ কোথায়? ---ভেগেছে। আমার লাকি বিষ আছে। সে বিষ লিতে লা পেরে ভেগেছে। রমা হাসলো। বলল---বয়স কত তোমার? কমই তো মনে হয়। আরেকটা বিয়ে করছ না কেন? শম্ভু থলে থেকে শিকড়, বাকড় ঢেলে মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে বলল---দিদিমণি, এগুলা একটু কাইল রোদে দিতে হবে। শুকলে বাইটতে হবে। আপনার সে মিশিনে হবে লাই। বাটনা শিখে লিতে হবে। রমা হেসে বললে---ঠিক আছে আমি করে দেব। চলবে। |
« Next Oldest | Next Newest »
|