04-06-2020, 12:31 PM
১০
মাঝে মাঝে জীবনটা বড় অদ্ভূত মনে হয়। কলেজের দিনগুলোর মতন জীবনটা কেন ফিরে আসে না? কেন মনে হয়, এ পৃথিবীতে আনন্দ আর সুখ বলে কিছু নেই। আমারও তো কিছু পাবার ছিল। কিছু প্রত্যাশা ছিল। জীবনকে ঘিরে ধরে শুধু ব্যাথা আর বেদনা। পুরোনো কলেজ জীবনের, বিশ বছরের সেই উদ্দামতাকে যখন ফিরিয়ে আনতে চাই, জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলতে চাই, তখুনি বাঁধা বিপত্তিগুলো আবার ফিরে ফিরে আসে। নারী যেন আমার জীবনে অংশভাগিনী হতে চেয়েও পারে না। কেউ আমাকে ভালবাসতে চায়, সেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অন্য নারী। আবার যখন সেই নারীকেই আমি ফিরে পেতে চাই, তখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তার নিজের স্বামী। এ যেন জীবন সঙ্গিনীকে পাবার সমস্ত সুযোগই ব্যর্থ। আমার জীবনকে রমনীয় করে তোলবার জন্য সত্যি বোধহয় কোন নারী নেই। নেই কোন সঙ্গিনী।
পুরোনো দিনের কথা আর বর্তমান এই দুটোকে মেলাতে গিয়ে মনটা ভীষন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিল। নতুন করে কার প্রেমে যে পড়ব, সেটাই ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আবিষ্ট মন, স্পর্ষকাতর মন আমার সিদ্ধান্তকে একজায়গায় এনে ফেলতে পারছে না। কখনো বিদিশার মুখটা আমি চোখের সামনে দেখছি, কখনো শুক্লার মুখটা সেখানে ভেসে উঠছে। দুজনেই যদি আমার প্রেয়সী হয়, তাহলে কাছে পাওয়ার জন্য কার প্রতি আমার সুতীব্র আকুলতা জেগে উঠবে, সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি কি শুক্লার আশাটাকে মেনে নেব? না বিদিশাকে এখনো ভরসা দিয়ে যাব। যতক্ষণ না ওর ডিভোর্সটা সম্পন্ন না হচ্ছে, ততদিন অপেক্ষা করে যাব। কোন একজনেরই একনিষ্ঠ প্রেমিক হয়ে ওঠার জন্য আমি এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই দুজনের মধ্যে কোনো একজনকে বেছে নিতে পারছি না। বড্ড কঠিন অবস্থা হয়ে উঠেছে আমার। দুজনের মুখদুটোকে শুধু চিন্তা করে পীড়াদায়ক চিন্তারাশি আমার বুক ঠেলে উঠে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এমন এক দূরঅবস্থা। আমার মনের দুশ্চিন্তাটাকে আমি কাউকে জানাতেও পারছি না। সত্যিই কি করুন এক পরিস্থিতি।
ডায়েরীর পাতাটা খুলে ভাবছিলাম কিছু একটা লিখব। উপন্যাসটা হঠাৎই এমন একটা জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে যেন এগোতেই চাইছে না। অতীত ভুলে এখন বর্তমানটাই আমার চোখের সামনে। শুক্লা বিদিশা দুদুটো মেয়ে হঠাৎই এসে হাজির হয়েছে আমার জীবনে। তারা আমার সান্নিধ্য পেতে চাইছে, অথচ কি করে সমস্যা কাটিয়ে উঠব, ভেবে কোন কূলকিনারা পাচ্ছি না। বিদিশার জন্যও কষ্ট হচ্ছে আবার শুক্লার জন্যও মনটা ভীষন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আমার অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ আমার খেয়াল হল, শুভেন্দু বিদিশাকে বলেছে, ‘দেবের বাড়ীতে এক্ষুনি তুই যাস না। ওর সাথে দেখা করবার জন্য আমার বাড়ীটাই বেস্ট।’ আমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে নিজের বাড়ীতেও ডেকে নিয়ে গেছে। বিদিশাকেও সেখানে আমন্ত্রণ করেছে। তারমানে শুভেন্দু এটা জানতো, ওর বাড়ীতে এসব সমস্যার কথা উঠবে না, বিদিশাও আমাকে কিছু বলবে না। বিদিশাকে শুভেন্দুই হয়তো বারণ করে রেখেছিল আগে থেকেই। ‘এই মূহূর্তে দেবকে এসব কিছু বলার দরকার নেই।’
শুভেন্দু আমার কাছে সত্যি কথাটা বলেও পরে ওটা মিথ্যে বলে আমার মনটাকে হাল্কা করার চেষ্টা করে। শুভেন্দু হয়তো জানতো, আমি চিন্তায় পড়ে যাব বিদিশাকে নিয়ে। মন অস্থির হয়ে উঠবে। বিদিশার ফিরে আসার খবরটা আমার মনকে সেভাবে নাড়া হয়তো দেবে না। ও আমার কাছে ফিরে এলেও, সেটা কোন খুশীর খবর হয়ে উঠবে না।
ভাবছিলাম, শুভেন্দুরই বা বিদিশাকে নিয়ে এত আগ্রহ কেন? ও যখন সব আগে থেকেই জানে। জেনেও বিদিশার সাথে আমাকে আবার মেলানোর চেষ্টা করছে। বিদিশার কথা ভেবে শুভেন্দু এটা করেছে? না আমার কথা চিন্তা করে আমাকে ধৈর্য রাখতে বলছে। অতীতের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল, সেদিন কিন্তু বিদিশার প্রতি শুভেন্দু এতটা দয়ালু হয়নি। মিনুর বাড়ীতে ওই ঘটনাটা ঘটে যাবার পর দোষ দেখেছিল বিদিশারই। আমাকে বলেছিল, ‘বিদিশা এটা ঠিক করেনি। সত্যি মিথ্যে যাচাই না করে তোর দোষ দেখল বিদিশা। এটা কি ও ঠিক করল?’
মিনুর বাড়ীতে হঠাৎই ঘটে যাওয়া সেদিনের সেই ঘটনাটা। আমার বাড়ীতে তার কিছুদিন আগেই সৌগত এসে হাজির। কলিংবেল টিপতেই দেখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, একগাল হাসি। বিয়ের কার্ড নিয়ে এসেছে, বাবুর ফূর্তী যেন আর ধরে না। ওকে বললাম, ‘কি রে সৌগত তুই?
সৌগত বলল, ‘সামনের মাসের দশ তারিখে আমার বিয়ে, তোকে কার্ডটা দিতে দেরী হয়ে গেল। অবশ্য কোন বন্ধুদেরই এখনো কার্ড দিইনি। বলতে পারিস, তোর কাছেই প্রথম এলাম। তুই ফার্স্ট।’
সৌগতকে ঘরে ডেকে বসালাম। বললাম, ‘এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করছিস? তোর কি বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি রে শালা। এই তো সবে আমরা কলেজ পাশ করলাম। ‘
সৌগত বলল, ‘তাও নয় নয় করে তিনবছর তো হয়ে গেল। বাড়ীতে সবাই হূটোপাটি করছে। আমিও তাই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম।’
আমি বললাম, ‘তাও চব্বিশ বছরে বিয়ে? আমি তো ভাবতেই পারছি না।’
সৌগত বলল, ‘সেদিক থেকে বিয়েটা একপ্রকার একটু তাড়াতাড়িই হচ্ছে। আসলে আমার বউটা খুব সুন্দরী। ওদের বাড়ীর লোকেরাও আমাকে পছন্দ করেছে। ওরাই চটজলদি বিয়েটা সেরে নিতে চাইছে। আর আমিও ভেবে দেখলাম, বউ যা সুন্দরী। বিয়ে করে নেওয়াই ভালো। পরে যদি হাত ফসকে ছিটকে যায়।’
বলেই হাসতে লাগল সৌগত।
ওকে বললাম, তোর বউয়ের বয়স কত?
সৌগত বলল,কুড়ি।
আমি বললাম, ‘সেকিরে তাহলে তো একেবারে কচি খুকী।’
সৌগত বলল, চারবছরের ডিফারেন্স, তাই বা কম কি? আমি তো বলব, সেদিক দিয়ে আমি খুব লাকি।’
সৌগতকে উইশ করলাম। বললাম, ভালো ভালো। বিয়েটা তাহলে কর। আমরা সবাই একটু ফূর্তী করি। কলেজ পাশ করার পরে, সেভাবে তো আর কারুর সাথে দেখাই হয় না। তোর বিয়েতে না হয় সবাই মিলে আনন্দ করা যাবে। ’
সৌগত বলল, ‘বিদিশার খবর কি?’
আমি বললাম, ‘ভালোই আছে। মাঝে মধ্যে আসে। দেখা সাক্ষাত হয়। এখনো প্রেম করে যাচ্ছি। তবে তোর মত এত তাড়াতাড়ি বিয়ে? ওটা এখনো ভাবিনি।’
সৌগত বলল, আমি তো বলব, বেশী দেরী করা উচিৎ নয়। জানিস তো, কোথাথেকে কখন কি হয়ে যায়। আজকাল কোন কিছুর উপরেই আমার কোন ভরসা নেই।’
মনে হল, শুক্লার ব্যাপারে সৌগতর মনে হয়তো কিছু খেদ আছে। প্রেমটা ভেঙে গেল বলে, আমাকেও ও সাবধান করছে।
সৌগত নিজেই বলল, ‘আমি কিন্তু শুক্লার সাথে ব্যাপারটা সহজ করে নিয়েছি। ওকে ফোনও করেছি, কথাও বলেছি। বিয়েতেও শুক্লাকে আসতে বলব। আশাকরি ও না বলবে না।’
আমি বললাম, তোর আর শুক্লার ব্যাপারটা বড় অদ্ভূত। কি যে হল তোদের দুজনের মধ্যে। কিছুই বুঝতে পারলাম না। অথচ তোদের প্রেমটা-
সৌগত বলল, ‘প্রেম মানে তো লাভ। আমি মনে করি লাভ ইস নট পার্মানেন্ট। যে কোন মূহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। আমার আর শুক্লার ব্যাপারটাও তাই হয়েছে। এরকম ঘটনা আর কারুর জীবনেও ঘটতে পারে। ভালবাসা, প্রেম, যেকোন মূহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।’
কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সৌগত বলল, ‘তোর আর বিদিশার ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। তোদের প্রেম হল, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রেম। একে অপরকে অঙ্গীকার করে বসে আছিস। চটকরে এ প্রেম ভাঙা খুব কঠিন। সেদিক দিয়ে তুই আবার আমার থেকে একটু লাকি বলতে পারিস।’
আমি বললাম, ‘বিদিশা আসলে আমাকে একটু বেশী বিশ্বাস করে। ও জানে চট করে দেব, ওর বিশ্বাসটাকে ভাঙবে না।’
সৌগত এবার আমার মুখের দিকে তাকালো, আমাকে বলল, ‘বিশ্বাস থাকতে থাকতে, তুইও বিয়েটা করে নে দেব। বলাতো যায় না। কখন কি থেকে কি হয়ে গেল। আমার কেন জানি, প্রেমটেম ওগুলোকে আর চিরস্থায়ী বলে মনে হয় না। জীবনে প্রেম ভালোবাসার এগুলোর কোন দাম নেই। সব বেকার জিনিষ।’
-তুই একথা বলছিস সৌগত? তুই না-
সৌগত বলল, ‘হ্যাঁ আমিই বলছি। প্রেম আমার জীবনে টেকেনি বলে বলছি না। মেয়েদের মন বোঝা খুব কঠিন। কখন তোকে কি অবস্থায় ওরা ফেলে দেবে,তুই ঠাওরও করতে পারবি না। লেজে গোবরে এক হয়ে যাবি। শেষ পর্যন্ত হতাশায় তোর চুল ছিঁড়তেও তোকে হতে পারে। এরা ভীষন অবুঝ। সত্যি কথাটা শপথ করে বললেও বিশ্বাস করতে চায় না।’
আমি বললাম, ‘বিয়ে যাকে করছিস, তাকেও তো তোকে ভালবাসতে হবে। নইলে সেটাও তো টিকবে না। প্রেম মানে তো প্রেম। হয় বিয়ের আগে, নয়তো বিয়ের পরে। সেই একই তো কথা।’
সৌগত বলল, ‘জানি, সেটাও জানি। বিয়ের পরে ভালবাসা না টিকলে সেখানেও লবডঙ্কা। সবই জানি। সেই জন্যই তো এবারে একেবারে দেখেশুনেই বিয়ে করছি। একেবারে পার্মানেন্ট হিসেবে টিকে যাবে ও। তোকে গ্যারান্টী দিয়ে বলছি।’
দেখলাম শুক্লার থেকে নিজের বউয়ের ওপরেই ওর ভরসাটা এখন অনেক বেশী। কিভাবে আস্থা অর্জন করল ও, আমার জানতে ভীষন ইচ্ছে করছিল। সৌগত বলল, ভেবে দেখলাম, নিজের প্রেম করার থেকে বাড়ীর লোকজনের পছন্দমত বিয়ে করাই অনেক ভাল। তাছাড়া মেয়েটা সুন্দরী। স্বভাব চরিত্রও ভালো। অন্য মেয়েদের মত অত প্যাঁচালো নয়।’
সৌগত বলল, বিদিশাকে তো আলাদা করেই নেমতন্নটা করতে হবে। তুই বরঞ্চ ওকে একটা ফোন কর। বল সৌগত যাচ্ছে, তোমাকে বিয়ের নেমতন্ন করতে। এখন যদি যাই? বিদিশা বাড়ী থাকবে তো? তুইও আমার সাথে যেতে পারিস।’
বিদিশাদের বাড়ীর ল্যান্ডফোন নম্বরে বিদিশাকে তক্ষুনি পেয়ে গেলাম। সৌগতর বিয়ের খবরটা শুনে ও কিছুটা অবাক হল, আমাকে বলল, তুমি আসছ সাথে? তাহলে দুজনেই এসো। আমি বাড়ীতেই আছি।’
সেদিন বিদিশার বাড়ীতে আমার অবশ্য আর যাওয়া হয় নি। সৌগতর বাড়ী থেকে হঠাৎই তারকিছু পরেই একটা ফোন চলে এসেছিল। ওকে বেরিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। আমাকে বলল, বিদিশাকে আমি কার্ড পৌঁছে দেবো। তুই চিন্তা করিস না। বরযাত্রী হিসেবে তোদের জন্য আলাদা গাড়ীর ব্যবস্থা করেছি। সব কালকে ফোন করে তোকে বলছি। তুই, বিদিশা, শুভেন্দু সব একই গাড়ীতে যাবি। তোদের গাড়ীটা ঠিক আমার গাড়ীর পেছনে পেছনে থাকবে। তোদের কোন অসুবিধা হবে না। ব্যারাকপুরে বিয়ে। কলকাতা থেকে যেতে একঘন্টা মতন লাগবে।’
যতক্ষণ আমার কাছে বসেছিল সৌগত, কথায় কথায় এটাও আমাকে বলেছিল, ‘আমার কেন জানি না দেব, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি যেন একটা খুব ভুল করে ফেলেছি।’
ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কি ভুল করেছিস তুই?’
সৌগত সেই সময় মিনুর প্রসঙ্গটা তুললো। আমাকে বলল, ‘মিনুর জন্য তোকে বোধহয় সেই হ্যাপাটা এখনো পোয়াতে হচ্ছে? সেই ওর বোনকে গান শেখানোর ব্যাপারটা? ভীষন বেয়ারা মেয়ে। একবার কারুর পিছু নিলে, সহজে তাকে ছাড়তে চায় না।’
ওকে হেসে বললাম, ‘না না, সেতো কবেই আমি সেই পাট তুলে দিয়েছি। এখন আর ওর বোনকে গান শেখাতে যাই না। সেই প্রথম প্রথম কদিন গিয়েছিলাম, তারপরে যাওয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি।’
সৌগত বলল, ‘কলেজ ছাড়ার পরে আর মিনুদের বাড়ী আর যাসনি?’
ওকে বললাম, ‘শ্যামল মিত্রর এক ছাত্রের কাছে আমি কিছুদিন তালিম নিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল মিনুর বোন রীনাকে ওখানে পাঠিয়ে দেবার। কিন্তু মিনু রাজী হল না। গোঁ ধরে বসে থাকলো। আমার কি ওখানে যেতে আর ইচ্ছে করে? তুই তো বিদিশার ব্যাপারটা জানিস। ও পছন্দ করে না রীনাকে গান শেখাতে আমি যাই বলে। সেই শেষ দিন থেকে মিনুর প্রতি বিদিশার একটা বিতৃষ্মা। বিদিশা মিনুকে সহ্য করতে পারে না। নাম শুনলেই ক্ষেপে ওঠে। আমি যে মিনুর বাড়ীতে এখন যাই না। সেটা ওকে বললেও অবিশ্বাস করে ওঠে। বলে সত্যি বলছ তো? কি জানি তোমার কথা বিশ্বাস করলেও। মিনুকে আমার একদম বিশ্বাস হয় না।’
সৌগত বলল, ‘লাস্ট কবে গিয়েছিলিস মিনুর বাড়ীতে?’
আমি বললাম, ‘তাও নয় নয় করে মাস ছয়েক তো হয়ে গেল। এখন যাওয়া একদমই বন্ধ করে দিয়েছি।’
সৌগত বলল ভালো, এইজন্যই তো মিনুকে আমি বিয়েতে নেমতন্ন করতে চাই না। ওখানে বিদিশাও আসবে। মিনুকে দেখলে বিদিশা একেবারেই চটে যাবে। কি করতে কি করে বসবে মিনু। ওকে বোঝা খুব মুশকিল।’
সৌগত এরপরে চলে গেল। ভাবিনি মাস ছয়েক পরে হঠাৎই মিনুর আবার দর্শন পাবো। সেদিনই সন্ধেবেলা মিনুর হঠাৎই আবির্ভাব ঘটল আমার বাড়ীতে। সাথে ওর বোন রিনাকেও নিয়ে এসেছে। বেশ সেজেগুজে এসেছে মিনু। আমাকে বলল, দেব, তোর জন্য একবাক্স মিষ্টি নিয়ে এসেছি। রীনা খুব ভালোভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। তুই ওর গানের গুরু। ওকে ভাল করে আশীর্ব্বাদ কর।’
রীনা মাথা হেট করে, ঝুঁকে প্রনাম করল আমাকে। ওকে বললাম, ‘থাক থাক আর প্রনাম করতে হবে না। তা গান টান কি গাইছ? নাকি ছেড়ে দিয়েছে সব?’
রীনা ঘাড় নেড়ে বলল, এখনো গাইছি, ছেড়ে দিই নি এখনো। তবে আপনাকে খুব মিস করি। আপনি তো আর আমাদের বাড়ী আর আসেন না। আসুন না একদিন।’
ঠিক সেভাবে ওকে জোর দিয়ে বলার মতন আমার আর কিছু ছিল না। মিনু আমাকে পটানোর জন্য ওর বোনকে সাথে করে নিয়ে এসেছে, সেটাও বুঝতে পারলাম। পাছে আমি না বলে ফেলি, মিনু আগে থেকেই রীনাকে বলল, ঠিকই যাবে। তুই ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? এখন দেবদার সময়ের খুবই অভাব। দেবদার এখন অনেক দায়িত্ব। চাকরী করতে হবে। বিয়ে করে বউকে খাওয়াতে হবে। তোর জন্য ভাড়ী দেবদার দরদ? তবে তুই বলছিস যখন, ঠিকই যাবে। কি ‘দেব’ যাবি না?’
আমি রীনার সামনে মিনুকে সেভাবে কিছু বললাম না। শুধু বললাম, ‘যাব একদিন। এই সামনে সৌগতর বিয়ে। ওর বিয়েটা হয়ে যাক। তারপরে সময় করে একদিন যাব। তোমাদের বাড়ী যাবার পথে কলেজেও একবার ঘুরে আসব।’
মিনু জানতো, আমি শুধুই ওর বোনকে সান্তনা দিচ্ছি। যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই আমার। আমাকে বলল, সৌগতর বিয়েতে যাবি নিশ্চই? তোকে কার্ড দিয়েছে। কই আমাকে তো দিল না?’
আমি বললাম, ‘হয়তো পরে দেবে। এখনও অবধি আমাকে ছাড়া কাউকেই কার্ড দেয় নি ও।’
মিনু যেন পরিকল্পনা করেই এসেছিল। আমাকে বলল, ‘কাল বাড়ীতে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। তোকে কিন্তু আসতে হবে।’
হঠাৎ কিসের অনুষ্ঠান, কিছুই আমি জানি না। বেশ ভ্যাবাচাকা খেযে গেলাম। মিনু বলল, ‘আসলে রীনা ভালভাবে পাশ করেছে তো। তাই কজন বন্ধুবান্ধবদের বাড়ীতে ডাকছি। তুই ও আসবি, একটু আনন্দ আর হৈহুল্লোর হবে।’
আমি প্রায় মুখের ওপরেই না বলতে যাচ্ছিলাম। মিনু বলল, ‘কেন বিদিশা রাগ করবে তোর ওপর? আমি যদি ওকেও বাড়ীতে ডাকি।’
বেশ অবাক হলাম মিনুর কথা শুনে। বিদিশাকে ও বাড়ীতে আসতে বলবে। আর বিদিশাও ওর কথাশুনে একডাকে ছুটে যাবে। কখনোই সেটা সম্ভব নয়। মিনুকে বললাম, ‘শুধু শুধু বিদিশাকে কেন বলতে যাবি? ও তোর ওখানে যাবে না।’
মিনু একটা গম্ভীর মতন হয়ে গেল। আমাকে বলল, ‘তাহলে তুই আসবি তো?’
আমি বললাম, ‘কথা দিতে পারছি না। তবে চেষ্টা করব।’
রীনাকে নিয়ে মিনু একটু পরে চলে গেল। আমাকে বলে গেল, ‘রীনার কথা ভেবে অন্তত আয়। তোকে কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন তোকে আমার বাড়ীতে আসতে বলব না।’ রীনাও বলল, হ্যাঁ দেবদা আপনি এলে কিন্তু খুব ভাল লাগবে সবার।
আজ মনে পড়ে সেদিন কিন্তু মিনুর বাড়ীতে আমি গিয়েছিলাম। বিদিশা যাইনি। বিদিশাকে বলেই আমি মিনুর বাড়ীতে গিয়েছিলাম। মনে মনে একটু অসুন্তষ্ট হয়েছিল বিদিশা। ওকে বলেছিলাম। বোনটা ভালভাবে পাশ করেছে,তার জন্যই বাড়ীতে একটা পাটি দিচ্ছে মিনু। রীনা যদি আমাকে সেভাবে না বলতো, আমি হয়তো ওর বাড়ীতে যেতাম না।
পরের দিন মিনুর বাড়ীতে বেশ কিছু ঘন্টা আমি ছিলাম। ও কিন্তু একবারও বুঝতে দেয় নি ওর অভিসন্ধিটা। আমার কাছ থেকে বিদিশার ফোন নম্বরটা নিয়েছিল, বিদিশাকে ফোনও করেছিল, অথচ আমাকে বিদিশা সেকথা বললেও মিনু একবারও তা বলেনি।
বিদিশা ভাবতেই পারেনি, মিনু ওকে ফোন করবে। ফোনটা যখন করেছে, বিদিশার মা ধরেছিল। মিনু নিজের পরিচয় দেয় নি। বিদিশা এসে ফোনটা ধরতেই ওকে ঠেস মেরে বলেছিল, ‘কালতো দেব আসছে আমার বাড়ীতে। তুমি আসবে নাকি?’
আমাকে একনাগাড়ে কতকিছু বলে গেল বিদিশা। মিনুর বাড়ী থেকে ফেরার পর ফোন করে আমাকে বলল, ‘সখ মিটেছে তোমার? আঁশ মিটেছে? ধন্যি মেয়ে বাপু। এখনো তোমার পিছন ছাড়ে না।’
সেদিন বিদিশার মুখে ওই কথা শুনে মিনুর ওপরে আমিও খুব চটে গিয়েছিলাম। ভাবিনি আরো কত পরিকল্পনার জাল বিস্তার করে রেখেছে মিনু। তার কিছুদিন পরেই ঘটল আর একটি মারাত্মক ঘটনা।
সেদিন ছিল রবিবার। মা বলল, সোদপুরে আমার বড়মামার বাড়ীতে যাবে। বাড়ীতে রান্না সব করাই আছে। শুধু ভাতটা ফুটিয়ে নিলেই হবে। বিদিশাকে ফোন করলাম। বিদিশা বলল, ‘বাড়ীতে একা রয়েছ বলে আমাকে ডাকছ? কি করবে তুমি?’
আমি বললাম, ‘কেন এর আগে যখন একা ছিলাম, তুমি বুঝি কোনদিন আসোনি আমার বাড়ীতে? মা, এই একটু পরেই বাড়ী থেকে বেরোবে। তারপরে সারাদিন আমি শুধু একা। এই মূহূর্তে একজনকে আমার খুব দরকার। বিদিশা ছাড়া আর কারুর নাম এই মূহূর্তে মনে করতে পারছি না।’
মাঝে মাঝে জীবনটা বড় অদ্ভূত মনে হয়। কলেজের দিনগুলোর মতন জীবনটা কেন ফিরে আসে না? কেন মনে হয়, এ পৃথিবীতে আনন্দ আর সুখ বলে কিছু নেই। আমারও তো কিছু পাবার ছিল। কিছু প্রত্যাশা ছিল। জীবনকে ঘিরে ধরে শুধু ব্যাথা আর বেদনা। পুরোনো কলেজ জীবনের, বিশ বছরের সেই উদ্দামতাকে যখন ফিরিয়ে আনতে চাই, জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলতে চাই, তখুনি বাঁধা বিপত্তিগুলো আবার ফিরে ফিরে আসে। নারী যেন আমার জীবনে অংশভাগিনী হতে চেয়েও পারে না। কেউ আমাকে ভালবাসতে চায়, সেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অন্য নারী। আবার যখন সেই নারীকেই আমি ফিরে পেতে চাই, তখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তার নিজের স্বামী। এ যেন জীবন সঙ্গিনীকে পাবার সমস্ত সুযোগই ব্যর্থ। আমার জীবনকে রমনীয় করে তোলবার জন্য সত্যি বোধহয় কোন নারী নেই। নেই কোন সঙ্গিনী।
পুরোনো দিনের কথা আর বর্তমান এই দুটোকে মেলাতে গিয়ে মনটা ভীষন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিল। নতুন করে কার প্রেমে যে পড়ব, সেটাই ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আবিষ্ট মন, স্পর্ষকাতর মন আমার সিদ্ধান্তকে একজায়গায় এনে ফেলতে পারছে না। কখনো বিদিশার মুখটা আমি চোখের সামনে দেখছি, কখনো শুক্লার মুখটা সেখানে ভেসে উঠছে। দুজনেই যদি আমার প্রেয়সী হয়, তাহলে কাছে পাওয়ার জন্য কার প্রতি আমার সুতীব্র আকুলতা জেগে উঠবে, সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি কি শুক্লার আশাটাকে মেনে নেব? না বিদিশাকে এখনো ভরসা দিয়ে যাব। যতক্ষণ না ওর ডিভোর্সটা সম্পন্ন না হচ্ছে, ততদিন অপেক্ষা করে যাব। কোন একজনেরই একনিষ্ঠ প্রেমিক হয়ে ওঠার জন্য আমি এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই দুজনের মধ্যে কোনো একজনকে বেছে নিতে পারছি না। বড্ড কঠিন অবস্থা হয়ে উঠেছে আমার। দুজনের মুখদুটোকে শুধু চিন্তা করে পীড়াদায়ক চিন্তারাশি আমার বুক ঠেলে উঠে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এমন এক দূরঅবস্থা। আমার মনের দুশ্চিন্তাটাকে আমি কাউকে জানাতেও পারছি না। সত্যিই কি করুন এক পরিস্থিতি।
ডায়েরীর পাতাটা খুলে ভাবছিলাম কিছু একটা লিখব। উপন্যাসটা হঠাৎই এমন একটা জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে যেন এগোতেই চাইছে না। অতীত ভুলে এখন বর্তমানটাই আমার চোখের সামনে। শুক্লা বিদিশা দুদুটো মেয়ে হঠাৎই এসে হাজির হয়েছে আমার জীবনে। তারা আমার সান্নিধ্য পেতে চাইছে, অথচ কি করে সমস্যা কাটিয়ে উঠব, ভেবে কোন কূলকিনারা পাচ্ছি না। বিদিশার জন্যও কষ্ট হচ্ছে আবার শুক্লার জন্যও মনটা ভীষন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আমার অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ আমার খেয়াল হল, শুভেন্দু বিদিশাকে বলেছে, ‘দেবের বাড়ীতে এক্ষুনি তুই যাস না। ওর সাথে দেখা করবার জন্য আমার বাড়ীটাই বেস্ট।’ আমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে নিজের বাড়ীতেও ডেকে নিয়ে গেছে। বিদিশাকেও সেখানে আমন্ত্রণ করেছে। তারমানে শুভেন্দু এটা জানতো, ওর বাড়ীতে এসব সমস্যার কথা উঠবে না, বিদিশাও আমাকে কিছু বলবে না। বিদিশাকে শুভেন্দুই হয়তো বারণ করে রেখেছিল আগে থেকেই। ‘এই মূহূর্তে দেবকে এসব কিছু বলার দরকার নেই।’
শুভেন্দু আমার কাছে সত্যি কথাটা বলেও পরে ওটা মিথ্যে বলে আমার মনটাকে হাল্কা করার চেষ্টা করে। শুভেন্দু হয়তো জানতো, আমি চিন্তায় পড়ে যাব বিদিশাকে নিয়ে। মন অস্থির হয়ে উঠবে। বিদিশার ফিরে আসার খবরটা আমার মনকে সেভাবে নাড়া হয়তো দেবে না। ও আমার কাছে ফিরে এলেও, সেটা কোন খুশীর খবর হয়ে উঠবে না।
ভাবছিলাম, শুভেন্দুরই বা বিদিশাকে নিয়ে এত আগ্রহ কেন? ও যখন সব আগে থেকেই জানে। জেনেও বিদিশার সাথে আমাকে আবার মেলানোর চেষ্টা করছে। বিদিশার কথা ভেবে শুভেন্দু এটা করেছে? না আমার কথা চিন্তা করে আমাকে ধৈর্য রাখতে বলছে। অতীতের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল, সেদিন কিন্তু বিদিশার প্রতি শুভেন্দু এতটা দয়ালু হয়নি। মিনুর বাড়ীতে ওই ঘটনাটা ঘটে যাবার পর দোষ দেখেছিল বিদিশারই। আমাকে বলেছিল, ‘বিদিশা এটা ঠিক করেনি। সত্যি মিথ্যে যাচাই না করে তোর দোষ দেখল বিদিশা। এটা কি ও ঠিক করল?’
মিনুর বাড়ীতে হঠাৎই ঘটে যাওয়া সেদিনের সেই ঘটনাটা। আমার বাড়ীতে তার কিছুদিন আগেই সৌগত এসে হাজির। কলিংবেল টিপতেই দেখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, একগাল হাসি। বিয়ের কার্ড নিয়ে এসেছে, বাবুর ফূর্তী যেন আর ধরে না। ওকে বললাম, ‘কি রে সৌগত তুই?
সৌগত বলল, ‘সামনের মাসের দশ তারিখে আমার বিয়ে, তোকে কার্ডটা দিতে দেরী হয়ে গেল। অবশ্য কোন বন্ধুদেরই এখনো কার্ড দিইনি। বলতে পারিস, তোর কাছেই প্রথম এলাম। তুই ফার্স্ট।’
সৌগতকে ঘরে ডেকে বসালাম। বললাম, ‘এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করছিস? তোর কি বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি রে শালা। এই তো সবে আমরা কলেজ পাশ করলাম। ‘
সৌগত বলল, ‘তাও নয় নয় করে তিনবছর তো হয়ে গেল। বাড়ীতে সবাই হূটোপাটি করছে। আমিও তাই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম।’
আমি বললাম, ‘তাও চব্বিশ বছরে বিয়ে? আমি তো ভাবতেই পারছি না।’
সৌগত বলল, ‘সেদিক থেকে বিয়েটা একপ্রকার একটু তাড়াতাড়িই হচ্ছে। আসলে আমার বউটা খুব সুন্দরী। ওদের বাড়ীর লোকেরাও আমাকে পছন্দ করেছে। ওরাই চটজলদি বিয়েটা সেরে নিতে চাইছে। আর আমিও ভেবে দেখলাম, বউ যা সুন্দরী। বিয়ে করে নেওয়াই ভালো। পরে যদি হাত ফসকে ছিটকে যায়।’
বলেই হাসতে লাগল সৌগত।
ওকে বললাম, তোর বউয়ের বয়স কত?
সৌগত বলল,কুড়ি।
আমি বললাম, ‘সেকিরে তাহলে তো একেবারে কচি খুকী।’
সৌগত বলল, চারবছরের ডিফারেন্স, তাই বা কম কি? আমি তো বলব, সেদিক দিয়ে আমি খুব লাকি।’
সৌগতকে উইশ করলাম। বললাম, ভালো ভালো। বিয়েটা তাহলে কর। আমরা সবাই একটু ফূর্তী করি। কলেজ পাশ করার পরে, সেভাবে তো আর কারুর সাথে দেখাই হয় না। তোর বিয়েতে না হয় সবাই মিলে আনন্দ করা যাবে। ’
সৌগত বলল, ‘বিদিশার খবর কি?’
আমি বললাম, ‘ভালোই আছে। মাঝে মধ্যে আসে। দেখা সাক্ষাত হয়। এখনো প্রেম করে যাচ্ছি। তবে তোর মত এত তাড়াতাড়ি বিয়ে? ওটা এখনো ভাবিনি।’
সৌগত বলল, আমি তো বলব, বেশী দেরী করা উচিৎ নয়। জানিস তো, কোথাথেকে কখন কি হয়ে যায়। আজকাল কোন কিছুর উপরেই আমার কোন ভরসা নেই।’
মনে হল, শুক্লার ব্যাপারে সৌগতর মনে হয়তো কিছু খেদ আছে। প্রেমটা ভেঙে গেল বলে, আমাকেও ও সাবধান করছে।
সৌগত নিজেই বলল, ‘আমি কিন্তু শুক্লার সাথে ব্যাপারটা সহজ করে নিয়েছি। ওকে ফোনও করেছি, কথাও বলেছি। বিয়েতেও শুক্লাকে আসতে বলব। আশাকরি ও না বলবে না।’
আমি বললাম, তোর আর শুক্লার ব্যাপারটা বড় অদ্ভূত। কি যে হল তোদের দুজনের মধ্যে। কিছুই বুঝতে পারলাম না। অথচ তোদের প্রেমটা-
সৌগত বলল, ‘প্রেম মানে তো লাভ। আমি মনে করি লাভ ইস নট পার্মানেন্ট। যে কোন মূহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। আমার আর শুক্লার ব্যাপারটাও তাই হয়েছে। এরকম ঘটনা আর কারুর জীবনেও ঘটতে পারে। ভালবাসা, প্রেম, যেকোন মূহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।’
কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সৌগত বলল, ‘তোর আর বিদিশার ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। তোদের প্রেম হল, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রেম। একে অপরকে অঙ্গীকার করে বসে আছিস। চটকরে এ প্রেম ভাঙা খুব কঠিন। সেদিক দিয়ে তুই আবার আমার থেকে একটু লাকি বলতে পারিস।’
আমি বললাম, ‘বিদিশা আসলে আমাকে একটু বেশী বিশ্বাস করে। ও জানে চট করে দেব, ওর বিশ্বাসটাকে ভাঙবে না।’
সৌগত এবার আমার মুখের দিকে তাকালো, আমাকে বলল, ‘বিশ্বাস থাকতে থাকতে, তুইও বিয়েটা করে নে দেব। বলাতো যায় না। কখন কি থেকে কি হয়ে গেল। আমার কেন জানি, প্রেমটেম ওগুলোকে আর চিরস্থায়ী বলে মনে হয় না। জীবনে প্রেম ভালোবাসার এগুলোর কোন দাম নেই। সব বেকার জিনিষ।’
-তুই একথা বলছিস সৌগত? তুই না-
সৌগত বলল, ‘হ্যাঁ আমিই বলছি। প্রেম আমার জীবনে টেকেনি বলে বলছি না। মেয়েদের মন বোঝা খুব কঠিন। কখন তোকে কি অবস্থায় ওরা ফেলে দেবে,তুই ঠাওরও করতে পারবি না। লেজে গোবরে এক হয়ে যাবি। শেষ পর্যন্ত হতাশায় তোর চুল ছিঁড়তেও তোকে হতে পারে। এরা ভীষন অবুঝ। সত্যি কথাটা শপথ করে বললেও বিশ্বাস করতে চায় না।’
আমি বললাম, ‘বিয়ে যাকে করছিস, তাকেও তো তোকে ভালবাসতে হবে। নইলে সেটাও তো টিকবে না। প্রেম মানে তো প্রেম। হয় বিয়ের আগে, নয়তো বিয়ের পরে। সেই একই তো কথা।’
সৌগত বলল, ‘জানি, সেটাও জানি। বিয়ের পরে ভালবাসা না টিকলে সেখানেও লবডঙ্কা। সবই জানি। সেই জন্যই তো এবারে একেবারে দেখেশুনেই বিয়ে করছি। একেবারে পার্মানেন্ট হিসেবে টিকে যাবে ও। তোকে গ্যারান্টী দিয়ে বলছি।’
দেখলাম শুক্লার থেকে নিজের বউয়ের ওপরেই ওর ভরসাটা এখন অনেক বেশী। কিভাবে আস্থা অর্জন করল ও, আমার জানতে ভীষন ইচ্ছে করছিল। সৌগত বলল, ভেবে দেখলাম, নিজের প্রেম করার থেকে বাড়ীর লোকজনের পছন্দমত বিয়ে করাই অনেক ভাল। তাছাড়া মেয়েটা সুন্দরী। স্বভাব চরিত্রও ভালো। অন্য মেয়েদের মত অত প্যাঁচালো নয়।’
সৌগত বলল, বিদিশাকে তো আলাদা করেই নেমতন্নটা করতে হবে। তুই বরঞ্চ ওকে একটা ফোন কর। বল সৌগত যাচ্ছে, তোমাকে বিয়ের নেমতন্ন করতে। এখন যদি যাই? বিদিশা বাড়ী থাকবে তো? তুইও আমার সাথে যেতে পারিস।’
বিদিশাদের বাড়ীর ল্যান্ডফোন নম্বরে বিদিশাকে তক্ষুনি পেয়ে গেলাম। সৌগতর বিয়ের খবরটা শুনে ও কিছুটা অবাক হল, আমাকে বলল, তুমি আসছ সাথে? তাহলে দুজনেই এসো। আমি বাড়ীতেই আছি।’
সেদিন বিদিশার বাড়ীতে আমার অবশ্য আর যাওয়া হয় নি। সৌগতর বাড়ী থেকে হঠাৎই তারকিছু পরেই একটা ফোন চলে এসেছিল। ওকে বেরিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। আমাকে বলল, বিদিশাকে আমি কার্ড পৌঁছে দেবো। তুই চিন্তা করিস না। বরযাত্রী হিসেবে তোদের জন্য আলাদা গাড়ীর ব্যবস্থা করেছি। সব কালকে ফোন করে তোকে বলছি। তুই, বিদিশা, শুভেন্দু সব একই গাড়ীতে যাবি। তোদের গাড়ীটা ঠিক আমার গাড়ীর পেছনে পেছনে থাকবে। তোদের কোন অসুবিধা হবে না। ব্যারাকপুরে বিয়ে। কলকাতা থেকে যেতে একঘন্টা মতন লাগবে।’
যতক্ষণ আমার কাছে বসেছিল সৌগত, কথায় কথায় এটাও আমাকে বলেছিল, ‘আমার কেন জানি না দেব, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি যেন একটা খুব ভুল করে ফেলেছি।’
ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কি ভুল করেছিস তুই?’
সৌগত সেই সময় মিনুর প্রসঙ্গটা তুললো। আমাকে বলল, ‘মিনুর জন্য তোকে বোধহয় সেই হ্যাপাটা এখনো পোয়াতে হচ্ছে? সেই ওর বোনকে গান শেখানোর ব্যাপারটা? ভীষন বেয়ারা মেয়ে। একবার কারুর পিছু নিলে, সহজে তাকে ছাড়তে চায় না।’
ওকে হেসে বললাম, ‘না না, সেতো কবেই আমি সেই পাট তুলে দিয়েছি। এখন আর ওর বোনকে গান শেখাতে যাই না। সেই প্রথম প্রথম কদিন গিয়েছিলাম, তারপরে যাওয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি।’
সৌগত বলল, ‘কলেজ ছাড়ার পরে আর মিনুদের বাড়ী আর যাসনি?’
ওকে বললাম, ‘শ্যামল মিত্রর এক ছাত্রের কাছে আমি কিছুদিন তালিম নিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল মিনুর বোন রীনাকে ওখানে পাঠিয়ে দেবার। কিন্তু মিনু রাজী হল না। গোঁ ধরে বসে থাকলো। আমার কি ওখানে যেতে আর ইচ্ছে করে? তুই তো বিদিশার ব্যাপারটা জানিস। ও পছন্দ করে না রীনাকে গান শেখাতে আমি যাই বলে। সেই শেষ দিন থেকে মিনুর প্রতি বিদিশার একটা বিতৃষ্মা। বিদিশা মিনুকে সহ্য করতে পারে না। নাম শুনলেই ক্ষেপে ওঠে। আমি যে মিনুর বাড়ীতে এখন যাই না। সেটা ওকে বললেও অবিশ্বাস করে ওঠে। বলে সত্যি বলছ তো? কি জানি তোমার কথা বিশ্বাস করলেও। মিনুকে আমার একদম বিশ্বাস হয় না।’
সৌগত বলল, ‘লাস্ট কবে গিয়েছিলিস মিনুর বাড়ীতে?’
আমি বললাম, ‘তাও নয় নয় করে মাস ছয়েক তো হয়ে গেল। এখন যাওয়া একদমই বন্ধ করে দিয়েছি।’
সৌগত বলল ভালো, এইজন্যই তো মিনুকে আমি বিয়েতে নেমতন্ন করতে চাই না। ওখানে বিদিশাও আসবে। মিনুকে দেখলে বিদিশা একেবারেই চটে যাবে। কি করতে কি করে বসবে মিনু। ওকে বোঝা খুব মুশকিল।’
সৌগত এরপরে চলে গেল। ভাবিনি মাস ছয়েক পরে হঠাৎই মিনুর আবার দর্শন পাবো। সেদিনই সন্ধেবেলা মিনুর হঠাৎই আবির্ভাব ঘটল আমার বাড়ীতে। সাথে ওর বোন রিনাকেও নিয়ে এসেছে। বেশ সেজেগুজে এসেছে মিনু। আমাকে বলল, দেব, তোর জন্য একবাক্স মিষ্টি নিয়ে এসেছি। রীনা খুব ভালোভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। তুই ওর গানের গুরু। ওকে ভাল করে আশীর্ব্বাদ কর।’
রীনা মাথা হেট করে, ঝুঁকে প্রনাম করল আমাকে। ওকে বললাম, ‘থাক থাক আর প্রনাম করতে হবে না। তা গান টান কি গাইছ? নাকি ছেড়ে দিয়েছে সব?’
রীনা ঘাড় নেড়ে বলল, এখনো গাইছি, ছেড়ে দিই নি এখনো। তবে আপনাকে খুব মিস করি। আপনি তো আর আমাদের বাড়ী আর আসেন না। আসুন না একদিন।’
ঠিক সেভাবে ওকে জোর দিয়ে বলার মতন আমার আর কিছু ছিল না। মিনু আমাকে পটানোর জন্য ওর বোনকে সাথে করে নিয়ে এসেছে, সেটাও বুঝতে পারলাম। পাছে আমি না বলে ফেলি, মিনু আগে থেকেই রীনাকে বলল, ঠিকই যাবে। তুই ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? এখন দেবদার সময়ের খুবই অভাব। দেবদার এখন অনেক দায়িত্ব। চাকরী করতে হবে। বিয়ে করে বউকে খাওয়াতে হবে। তোর জন্য ভাড়ী দেবদার দরদ? তবে তুই বলছিস যখন, ঠিকই যাবে। কি ‘দেব’ যাবি না?’
আমি রীনার সামনে মিনুকে সেভাবে কিছু বললাম না। শুধু বললাম, ‘যাব একদিন। এই সামনে সৌগতর বিয়ে। ওর বিয়েটা হয়ে যাক। তারপরে সময় করে একদিন যাব। তোমাদের বাড়ী যাবার পথে কলেজেও একবার ঘুরে আসব।’
মিনু জানতো, আমি শুধুই ওর বোনকে সান্তনা দিচ্ছি। যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই আমার। আমাকে বলল, সৌগতর বিয়েতে যাবি নিশ্চই? তোকে কার্ড দিয়েছে। কই আমাকে তো দিল না?’
আমি বললাম, ‘হয়তো পরে দেবে। এখনও অবধি আমাকে ছাড়া কাউকেই কার্ড দেয় নি ও।’
মিনু যেন পরিকল্পনা করেই এসেছিল। আমাকে বলল, ‘কাল বাড়ীতে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। তোকে কিন্তু আসতে হবে।’
হঠাৎ কিসের অনুষ্ঠান, কিছুই আমি জানি না। বেশ ভ্যাবাচাকা খেযে গেলাম। মিনু বলল, ‘আসলে রীনা ভালভাবে পাশ করেছে তো। তাই কজন বন্ধুবান্ধবদের বাড়ীতে ডাকছি। তুই ও আসবি, একটু আনন্দ আর হৈহুল্লোর হবে।’
আমি প্রায় মুখের ওপরেই না বলতে যাচ্ছিলাম। মিনু বলল, ‘কেন বিদিশা রাগ করবে তোর ওপর? আমি যদি ওকেও বাড়ীতে ডাকি।’
বেশ অবাক হলাম মিনুর কথা শুনে। বিদিশাকে ও বাড়ীতে আসতে বলবে। আর বিদিশাও ওর কথাশুনে একডাকে ছুটে যাবে। কখনোই সেটা সম্ভব নয়। মিনুকে বললাম, ‘শুধু শুধু বিদিশাকে কেন বলতে যাবি? ও তোর ওখানে যাবে না।’
মিনু একটা গম্ভীর মতন হয়ে গেল। আমাকে বলল, ‘তাহলে তুই আসবি তো?’
আমি বললাম, ‘কথা দিতে পারছি না। তবে চেষ্টা করব।’
রীনাকে নিয়ে মিনু একটু পরে চলে গেল। আমাকে বলে গেল, ‘রীনার কথা ভেবে অন্তত আয়। তোকে কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন তোকে আমার বাড়ীতে আসতে বলব না।’ রীনাও বলল, হ্যাঁ দেবদা আপনি এলে কিন্তু খুব ভাল লাগবে সবার।
আজ মনে পড়ে সেদিন কিন্তু মিনুর বাড়ীতে আমি গিয়েছিলাম। বিদিশা যাইনি। বিদিশাকে বলেই আমি মিনুর বাড়ীতে গিয়েছিলাম। মনে মনে একটু অসুন্তষ্ট হয়েছিল বিদিশা। ওকে বলেছিলাম। বোনটা ভালভাবে পাশ করেছে,তার জন্যই বাড়ীতে একটা পাটি দিচ্ছে মিনু। রীনা যদি আমাকে সেভাবে না বলতো, আমি হয়তো ওর বাড়ীতে যেতাম না।
পরের দিন মিনুর বাড়ীতে বেশ কিছু ঘন্টা আমি ছিলাম। ও কিন্তু একবারও বুঝতে দেয় নি ওর অভিসন্ধিটা। আমার কাছ থেকে বিদিশার ফোন নম্বরটা নিয়েছিল, বিদিশাকে ফোনও করেছিল, অথচ আমাকে বিদিশা সেকথা বললেও মিনু একবারও তা বলেনি।
বিদিশা ভাবতেই পারেনি, মিনু ওকে ফোন করবে। ফোনটা যখন করেছে, বিদিশার মা ধরেছিল। মিনু নিজের পরিচয় দেয় নি। বিদিশা এসে ফোনটা ধরতেই ওকে ঠেস মেরে বলেছিল, ‘কালতো দেব আসছে আমার বাড়ীতে। তুমি আসবে নাকি?’
আমাকে একনাগাড়ে কতকিছু বলে গেল বিদিশা। মিনুর বাড়ী থেকে ফেরার পর ফোন করে আমাকে বলল, ‘সখ মিটেছে তোমার? আঁশ মিটেছে? ধন্যি মেয়ে বাপু। এখনো তোমার পিছন ছাড়ে না।’
সেদিন বিদিশার মুখে ওই কথা শুনে মিনুর ওপরে আমিও খুব চটে গিয়েছিলাম। ভাবিনি আরো কত পরিকল্পনার জাল বিস্তার করে রেখেছে মিনু। তার কিছুদিন পরেই ঘটল আর একটি মারাত্মক ঘটনা।
সেদিন ছিল রবিবার। মা বলল, সোদপুরে আমার বড়মামার বাড়ীতে যাবে। বাড়ীতে রান্না সব করাই আছে। শুধু ভাতটা ফুটিয়ে নিলেই হবে। বিদিশাকে ফোন করলাম। বিদিশা বলল, ‘বাড়ীতে একা রয়েছ বলে আমাকে ডাকছ? কি করবে তুমি?’
আমি বললাম, ‘কেন এর আগে যখন একা ছিলাম, তুমি বুঝি কোনদিন আসোনি আমার বাড়ীতে? মা, এই একটু পরেই বাড়ী থেকে বেরোবে। তারপরে সারাদিন আমি শুধু একা। এই মূহূর্তে একজনকে আমার খুব দরকার। বিদিশা ছাড়া আর কারুর নাম এই মূহূর্তে মনে করতে পারছি না।’