06-05-2023, 09:24 PM
(This post was last modified: 09-05-2023, 08:44 AM by Bumba_1. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
|| ৩ ||
মানুষের জীবন সীমিত পরিসরের গণ্ডিতে বাঁধা। নানান স্বপ্ন, আশা প্রত্যাশার বিভিন্ন কল্পনা নিয়েই মানুষ বাঁচে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে জীবনের নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু সময় তো কারোর জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের মূল্য দিতে পারলে এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই করা সম্ভব। যে সময় চলে যায় সেই সময়কে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। তাই সময়ের মূল্যায়ন করে তার প্রকৃত সদ্ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। সময় হলো জীবনের সর্বাধিক মূল্যবান একটি মুদ্রা। এই মুদ্রাটি কীভাবে ব্যয় করা হবে সেই বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে যদি অপরকে নির্ধারণ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই সময়ের মায়াজালে চিরজীবনের মতো আটকা পড়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে হয়।
উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্যে প্রথম উক্তিটি যদি নন্দনার বিবাহ পরবর্তী জীবনের জন্য হয়, তাহলে দ্বিতীয়টি অবশ্যই পরিস্থিতির শিকার হয়ে তার কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য যথাযথ .. যা ক্রমশ প্রকাশ্য। নন্দনাদের শরিকের বাড়ি ছিলো। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় বাবাকে হারায় সে, তার দু'বছর পর মা। বাবা-মা দু'জনকে হারিয়ে একমাত্র সন্তান নন্দনা তাদের অংশের সম্পত্তি তার সেজো কাকার কাছে বিক্রি করে দিয়ে ওখানকার পাঠ চুকিয়ে দিয়েছিলো। বাপের বাড়ির দিকের আত্মীয়দের সঙ্গে সেই অর্থে কোনো যোগাযোগ না থাকলেও, তার জেঠুর মেয়ে বন্দনার সঙ্গে যোগাযোগটা রয়ে গিয়েছিলো নন্দনার। পরবর্তীতে এই সিরিজে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠবেন।
যাইহোক, নন্দনার পড়াশোনা বেশিদূর না এগোলেও, ওর মধ্যে শিল্পসত্তা ছিলো ভরপুর। কিন্তু কোনো জিনিসটাই নন্দনার জীবনে স্থায়ী হয়নি .. কোনোটা নিজের ইচ্ছাতে আবার কোনোটা হয়তো পরিস্থিতির চাপে। তবে নন্দনার একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিলো .. যে সখগুলো সে নিজে থেকে মেটাতে পারেনি বা মেটাতে চায়নি সেগুলো তার একমাত্র পুত্রসন্তান বাপ্পার ইচ্ছে থাক বা না থাক, জোর করে তার উপর চাপিয়ে দিতো সে। যাক সে কথা, দেখতে দেখতে নন্দনা আর চিরন্তনের বিবাহের দশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। গত সপ্তাহেই ওদের বিবাহবার্ষিকী ছিলো। প্রতি বছর এই দিনটিতে নন্দনা যেন নতুন করে পুলকিত হয় তাদের দাম্পত্যের বিশুদ্ধ ভালোবাসায়। কিছু আনন্দ এবং অবশ্যই কিছু বেদনার স্মৃতি তাদের ভালোবাসাকে যেন অধিকতর অনুরক্ত ও সমৃদ্ধ করে। নন্দনার জীবনে এই দিনটি অতি মূল্যবান। সে জানে তার পাশে চিরন্তন থাকলে জীবনের সব অভিজ্ঞতাই তার জন্য সহজ হবে। নন্দনা চায় তার জীবনে বারে বারে ফিরে আসুক সুন্দর এই বিশেষ দিনটি। শুভ হোক তাদের দুজনের বিবাহবার্ষিকী।
তবে এখন আর সে আগের মতো চঞ্চলা চকিত হরিণী, সেই ছিপছিপে তরুণীটি নেই। এখন সে বছর পঁয়ত্রিশের গৃহকর্মে নিপুণা এক নারী .. যে তার স্বামী এবং সন্তান নিয়ে সুখে, স্বাচ্ছন্দ্যে ঘর-সংসার করছে। তাই এমতাবস্থায় তাকে নাম ধরে না ডেকে, তার নামের পাশে 'দেবী' শব্দ ব্যবহার করাটাই যুক্তিযুক্ত। একদা নিয়মিত নাচের অভ্যাস থাকা নন্দনা দেবীর হঠাৎ করে নাচ ছেড়ে দেওয়ার ফলস্বরূপ বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই উনার শরীরের নিম্নভাগে চর্বি জমতে থাকে এবং আস্তে আস্তে চেহারা কিঞ্চিত হলেও ভারীর দিকে যেতে থাকে।
মুখশ্রী ডানাকাটা পরীদের মতো না হলেও, মধ্য যৌবনা নন্দনা দেবীর গভীর কালো চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে থাকলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। ঈষৎ বোঁচা নাক, পুরু ঠোঁট এবং বোঁচা নাকের উপর একটি রিমলেস চশমা তার সমগ্র মুখমন্ডলের মধ্যে কোথাও যেনো একটি আদুরে অথচ কামুকী ভাবের সৃষ্টি করেছে। হাসলে গালে পড়া দুটো টোল নন্দনার মুখের ইউএসপি বলা চলে। মাঝারি উচ্চতার নন্দনা দেবীর গায়ের রঙ দুধে আলতা না হলেও ফর্সার দিকেই বলা চলে। কুচকুচে কালো রঙের ঘন, কিঞ্চিত কোঁকড়ানো চুল কাঁধের নিচ পর্যন্ত সুন্দর করে ছাঁটা। তবে নন্দনা দেবীর শরীরের সবথেকে উত্তেজক অঙ্গগুলির মধ্যে একটি হলো ওর ভরাট স্তনজোড়া .. তার পীতাভ শুভ্র দুটি স্তন যেন একে অপরের জায়গা দখল করে পরস্পর চাপাচাপি করে আছে। স্তনজোড়া এতটাই প্রবৃদ্ধ এবং বর্তুল যে সে-দুটির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম মৃণালতন্তুও সম্ভবত প্রবেশ করানো যায় না। মাঝেমধ্যে কোমরের কিছুটা নিচে শাড়ি বাঁধলে ঈষৎ চর্বিযুক্ত তলপেটের মাঝখানে গভীর নাভির গর্তটার দিকে একবার চোখ চলে গেলে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না সহজে। কলাগাছের কান্ডের মতো দুটো ফর্সা সুগঠিত উরু আর নাচ ছেড়ে দেওয়ার পর বেশ কিছুটা চর্বি জমে নন্দনা দেবীর মাংসল নিতম্বজোড়া যেনো বৃহদাকার উল্টানো কলসির রূপ ধারণ করেছে।
★★★★
বাপ্পার তখন আট বছর বয়স। জন্মের পর থেকে তার বাবা যে জুটমিলে কাজ করতো, সেই ফ্যাক্টরি সংলগ্ন ক্যাম্পাসে কেটেছে তার শৈশবকাল। ক্যাম্পাসটি আনুমানিক কুড়ি একর জমির উপর অবস্থিত। ওখানে একতলা দোতলা মিলিয়ে প্রায় ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশটা বিভিন্ন পদাধিকারী অফিসার্সদের কোয়ার্টার এবং বেশ কয়েকটি বাংলো তো ছিলোই। তার সঙ্গে কম্পাউন্ডের অন্য প্রান্তে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার, দারোয়ানদের কোয়ার্টার, বাগানের মালি এবং সুইপারদের জন্য কোয়ার্টার পৃথকভাবে বানানো হয়েছিলো। এছাড়াও তিন কামরার একটি বড়োসড়ো রিক্রিয়েশন ক্লাব, দুটি প্রমাণ সাইজের ফুটবল আর ক্রিকেট খেলার মাঠ এবং বিস্তৃত ফল ও ফুলের বাগান ছিলো .. যেখানে বিকেল হলেই তার সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিদিন খেলতে যেত বাপ্পা। এছাড়াও কম্পাউন্ডের পশ্চিমপ্রান্তে একটি বড়োসড়ো সুইমিংপুল ছিলো। ওখানে অবশ্য শুধু কোম্পানির এমপ্লয়িজ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ঢোকার অনুমতি ছিলো।
অত বড় কম্পাউন্ডের এত সংখ্যক পরিবার, তাই ওখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকতো। যদিও ওখানকার পরিবারগুলোর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই অবাঙালি ছিলো। তবুও বাপ্পাদের ক্যাম্পাসের সেরা উৎসব ছিলো দুর্গাপুজো এবং হোলি। দুর্গাপুজোর ওই চারটে দিনের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতো বাপ্পা এবং তার বন্ধুরা। কোথা দিয়ে যে ওই চারটে দিন অতিবাহিত হয়ে যেতো সেটা বোঝাই যেত না। ষষ্ঠীর দিন পুজোয় কেনা নতুন জামাকাপড় পড়ে মাঞ্জা দেওয়া থেকে শুরু করে, অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি, ষষ্ঠী থেকে নবমী .. ওই চার দিন দুপুরে ও রাতে রিক্রিয়েশন ক্লাবে পাত পেড়ে মহাভোজ খাওয়া এবং সবশেষে দশমীর বিকেলে সিঁদুরখেলা। এইসব আনন্দ বাপ্পার স্মৃতি থেকে কোনোদিনও বিলুপ্ত হওয়া সম্ভবপর নয়।
যেহেতু সাহেবি আমলের কোম্পানি এবং সেই সময়ও মালিকদের অর্থাৎ দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের একাংশ বিদেশি ছিলেন .. তাই কুৎসিত হোক, কালো হোক, মোটা হোক, বেঁটে হোক - অধঃস্তন কর্মচারীরা সম্পূর্ণ স্বদেশী ঊর্দ্ধতন অফিসারদের 'সাহেব' এবং তাদের স্ত্রীদের 'মেমসাহেব' বলে সম্মোধন করতো .. এটাই ওখানকার রীতি রেওয়াজ ছিলো।
মাড়োয়ারি মালিক ঝুনঝুনওয়ালার অপর পার্টনার, অর্থাৎ কোম্পানির আরেক শেয়ারহোল্ডার ম্যাকেঞ্জি সাহেব বিদেশে থাকলেও তার দুই প্রতিনিধি এই ক্যাম্পাসেই থাকতেন। তারা যদিও কেউই বিদেশী ছিলেন না। দুজনেই গোয়ানিজ খ্রিষ্টান ছিলেন .. একজনের নাম ছিলো রবার্ট ডিসুজা, অপরজনের প্রমোদ গঞ্জালভেস। কমার্শিয়াল ম্যানেজারের মতো গালভরা ডেজিগনেশনের অধিকারী হলেও সেই অর্থে কোনোদিনও অফিস যেতে দেখা যেত না রবার্টকে। দুজনের বয়সই আনুমানিক পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি ছিলো। প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা, গৌরবর্ণ এবং সুঠাম চেহারার অধিকারী রবার্টের মাথার সামনের দিকটায় চুল না থাকলেও পেছনের দিকে কয়েকগাছি চুল পানিটেল করে বাঁধা থাকতো সর্বদা। থুতনি আর নিচের ঠোঁটের মাঝামাঝি একটা ত্রিভুজাকৃতি দাড়ি তার মুখমণ্ডলে স্মার্টনেস তো আনতে পারেইনি, উল্টে একটা কদাকার ভাব সৃষ্টি করেছিলো। এদিকে পেশায় এই কোম্পানির ডাক্তার কুমড়ো পটাশের মতো চেহারার শ্যামবর্ণ প্রমোদ ছিলো খর্বকায়। ফোলা ফোলা দুটো গালের উপর অসংখ্য বসন্তের দাগ তার মুখটাকে অতিশয় বীভৎস করে তুলেছিলো। নিন্দুকেরা বলতো দুটোই নাকি বদ চরিত্রের মানুষ এবং প্রমোদ নাকি চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো একটা মৃত্যু বা হত্যার কেসে ফেঁসে গিয়ে পালিয়ে এসে ম্যাকেঞ্জির সৌজন্যে এখানে আস্তানা গেড়েছে। যাক সে কথা, লোকে তো কত কথাই বলে .. সব কথা না ধরাই ভালো।
★★★★
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সেকেন্ড সেমিফাইনাল হচ্ছিলো অস্ট্রেলিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে। ছোট্ট বাপ্পা তার মায়ের সঙ্গে বসে খেলা দেখছিলো। বাপ্পার বয়স বছর আটেক হবে। খেলা দেখার উৎসাহ সে তার মা নন্দনা দেবীর কাছ থেকেই পেয়েছে। এইটুকু বয়সে ক্রিকেট খেলার সমস্ত নিয়মাবলীর সম্পর্কে যে তার পক্ষে ধারণা থাকা সম্ভব নয়, এ কথা বলাই বাহুল্য। ঠিক তেমনি এই বয়সে তার কোনো ফেভারিট দল বা ফেভারিট প্লেয়ারও ছিল না। একজন ভারতীয় হিসেবে ভারতীয় দলকে সাপোর্ট হয়তো অবশ্যই করতো, সে কথা আলাদা।
যে সময়কার কথা বলা হচ্ছে সেই সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল এখনকার মতো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে গিয়ে অতি সাধারন মানের একটি ক্রিকেটবিশ্বের দল হয়ে যায়নি। যাইহোক .. কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ, ইয়ান বিশপ সমৃদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফাস্ট বোলিং অ্যাটাকের সামনে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং লাইনআপ যথেষ্ট চাপে পড়ে গিয়ে ৫০ ওভারে মাত্র ২০৭ রান তুলতে সক্ষম হয়। বাচ্চাদের বরাবর জমকালো জার্সি আকৃষ্ট করে। এই যেমন ধরা যাক উজ্জল লাল, গাঢ় নীল, টকটকে হলুদ .. এই জাতীয় রঙের জার্সি। অস্ট্রেলিয়ার জার্সির ঝলমল করতে থাকা হলুদ রঙটা বাপ্পার খুব পছন্দের ছিলো। তাই পছন্দের দল না থাকলেও ওই ম্যাচে মনে মনে অস্ট্রেলিয়াকে সাপোর্ট করছিলো সে।
দ্বিতীয় ইনিংসে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করতে নামলো তখন এক সময় ওদের স্কোর ছিলো ১৬৫/২ .. ক্রিজে ব্যাট করছিলো শিবনারায়ন চন্দ্রপাল আর ওদের ক্যাপ্টেন রিচি রিচার্ডসন .. হাতে প্রচুর ওভার বাকি। সেই সময় স্বভাবতই ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় একপ্রকার নিশ্চিত মনে হচ্ছিলো। বাপ্পা দেখলো তার মাতৃদেবী নন্দনা বেশ খুশি খুশি মুখ করে টিভি দেখছে। রান্নাঘর থেকে কিছুক্ষণ আগে ভেজে নিয়ে আসা মায়ের হাতের তৈরি প্রন-পাকোরা খেতে খেতে দু'জনে একসঙ্গে টিভিতে খেলা দেখছিলো। সেই সময় হঠাৎ করেই গ্লেন ম্যাকগ্রা আউট করে দিলো শিবনারায়ন চন্দ্রপালকে। তারপরেই শুরু হলো শ্যেন ওয়ার্নের ম্যাজিক বোলিং .. একটার পর একটা উইকেট পরতে থাকলো। বাপ্পা লক্ষ্য করলো টিভি স্ক্রিনে কি সুন্দর একটা গাবলু-গুবলু সাহেব হলুদ জার্সি পড়ে উইকেট নিয়ে চলেছে। তার শিশু মনে একটা আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। সে লাফিয়ে উঠে হাততালি দিয়ে উল্লাস করতে থাকলো। নন্দনা দেবী কিন্তু তার ছেলেকে বারকয়েক সতর্ক করেছিলো - "ভালো হচ্ছেনা কিন্তু বাপ্পা, একদম লাফালাফি করবি না .. মেরে পিঠের চামড়া তুলে দেবো।" সেই কথায় কর্ণপাত না করে বাপ্পা নিজের আনন্দ-উল্লাস জারি রাখলো। এক সময় জেতার অবস্থায় থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২০২ রানে অলআউট হয়ে গেলো .. অস্ট্রেলিয়া ৫ রানে জিতে ফাইনালে পৌঁছে গেলো।
ব্যাস .. নন্দনা দেবীর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো তার ছেলের উপর - "খুব মজা না? খুব মজা? তোকে তখন বারবার বারণ করছিলাম লাফালাফি না করতে .. নাচানাচি না করতে .. কেন শুনিস নি আমার কথা?" তার মাতৃদেবীর এইরূপ ভাব পরিবর্তনে বাপ্পা আর কি বলবে .. কতটুকুই বা বয়স! গুছিয়ে ঠিকমতো কথা বলার বয়সও হয়নি। সে শুধু বললো "বা রে .. আমার বুঝি পছন্দ অপছন্দ থাকতে নেই? আমি ওই পচা, কালো কালো দেখতে দৈত্যের মতো প্লেয়ারগুলোকে একদম পছন্দ করি না আর ওদের জার্সির রঙটাও খারাপ .. কিরকম ম্যাড়মেড়ে মেরুন রঙের।"
এইটুকু বয়সে বাপ্পা বুঝতে পারেনি তার মাতৃদেবীর ওই কালো হুমদো চেহারার নিগ্রোগুলোকেই বেশি পছন্দ, থুড়ি ওদের খেলা দেখতেই বেশি ভালো লাগে। বুঝতে পারলে কখনোই হয়তো বলতো না কথাগুলো। নন্দন দেবী রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো - "কি .. এত বড় কথা? এইটুকু ছেলের আবার পছন্দ-অপছন্দের কি আছে? আমি যাকে ভালো বলবো, তাকেই ভালো বলতে হবে। এটা আমার বাড়ি, এটা আমার টিভি .. বুঝেছিস? আমি যা বলবো, তাই শুনতে হবে।"
বেচারা বাপ্পা কোনোদিন যা করে নি, সেদিন সেটাই করলো। সেও তর্ক জুড়ে দিলো - "আমিও তো তোমারই ছেলে মা .. তাহলে এই বাড়ি আর টিভি তো আমারও হলো .. বলো, হলো তো?"
তার ছেলের এই কথাটা ঘৃতাহুতির মতো কাজ করলো। "এত বড় আস্পর্ধা? ক'দিন কিছু বলিনি বলে তোর বড্ড সাহস বেড়েছে তাই না? দাঁড়া আজ তোকে বাড়ি থেকে বের করে দেবো, তারপর দেখি তোকে কে বাঁচায়!" যেমন কথা তেমন কাজ। "ভুল হয়ে গেছে মা আর এইরকম বলবো না কোনোদিন .. হলুদ জার্সির প্লেয়ারগুলো পচা, মেরুন জার্সির প্লেয়ারগুলোই ভালো .." বাপ্পার এইরূপ হাজার অনুনয়-বিনয় সত্বেও তার হাত ধরে বাড়ি থেকে বের করে ভেতর থেকে দরজা আটকে দিলো তার মাতৃদেবী নন্দনা। তখন রাত প্রায় সাড়ে ন'টা বাজে। ঘটনাটি এখনো পর্যন্ত পড়ে অনেকের মজা লাগলেও সেই পরিস্থিতিতে অত রাতে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর, বাপ্পার যে কিরূপ মনের অবস্থা হয়েছিল, সেটা একমাত্র সে নিজেই অনুধাবন করতে পারে।
চিরন্তন বাবুর বি-শিফ্ট ডিউটি চলছিলো। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে দশ'টা বেজে যায়, অর্থাৎ তখনো প্রায় এক ঘন্টা দেরি। যদিও তাদের উঁচু পাঁচিল ঘেরা কম্পাউন্ড এবং কম্পাউন্ডের মেইন গেটে সব সময় দু'জন সিকিউরিটি গার্ড বিদ্যমান থাকে। তবুও বয়স তো নিতান্তই অল্প, তার উপর রাত বাড়ছিলো, তাই এতক্ষণ বাড়ির বাইরে একা একা কি করে কাটাবে সেটা ভেবেই কূল-কিনারা পাচ্ছিলো না ছোট্ট বাপ্পা।
তবে এইরকম বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা এর আগেও ঘটেছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা সামাল দিয়েছে বাপ্পার এক পাঞ্জাবী আঙ্কেল। আসলে ওদের কোয়ার্টারের পাশের কোয়ার্টারে একজন পাঞ্জাবী ব্যক্তি এসেছে মাস'দুয়েক হলো। উনার স্ত্রী এবং সন্তানাদি দেশের বাড়িতে থাকতো, লোকটা একাই (সেও চিরন্তন বাবুর সঙ্গে একই অফিসে কাজ করতো) থাকতো কোয়ার্টারে। ভদ্রলোকের নাম ছিলো হার্জিন্দার সিং। যদিও নন্দনা দেবী একদমই পছন্দ করতো না ওই ব্যক্তিকে, তার পেছনে অবশ্য কারণ ছিলো। মাসখানেক আগে চিরন্তন বাবুর অফিসের উইভিং ডিপার্টমেন্টের মাগীকলে রেশমা নামের এক মহিলা সুইসাইড করে। না না, মাগীকল কোনো গালাগালি বা অশ্লীল শব্দ নয়। সাহেবদের আমল থেকে জুটমিলে মহিলাদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগ ছিলো। যেখানে মহিলারা মেশিন চালিয়ে চট সেলাই করতো। সেই বিভাগকে "মাগীকল" বলা হতো। তবে এখন আর সেসব নেই, অনেক বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। যাইহোক, পরবর্তীতে কানাঘুষো শোনা যায় এবং তার বাড়ির কাজের মাসি মালতির কাছ থেকে নন্দনা দেবী জানতে পারে রেশমার আত্মহত্যার পেছনে পাঞ্জাবী লোকটির হাত আছে। ওর সঙ্গে নাকি অবাধ মেলামেশা ছিলো রেশমার। একসময় রেশমা গর্ভবতী হয়ে পড়লে, হার্জিন্দার তার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। ফলস্বরূপ আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয় কুমারী রেশমাকে। যদিও এইসব কথা চিরন্তন বাবু একেবারেই বিশ্বাস করতে চাইতো না। যাক সে কথা, অন্যান্য বারের মতো এবারও হর্জিন্দার আঙ্কেল বাপ্পাকে ওনার বাড়িতে ঢুকিয়ে নিয়ে গেলো।
মুন্ডা পাঞ্জাবী হার্জিন্দার মাথায় পাগড়ী ব্যবহার করতো না। লম্বা-চওড়া চেহারার হার্জিন্দারের ব্যাকব্রাশ করা চুল, চওড়া গোঁফ আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখলে আপাত দৃষ্টিতে হ্যান্ডসাম মনে হলেও লোকটার কোটরে ঢোকা ধূর্ত শিকারির মতো চোখের দিকে তাকালে যে কেউ ভয় শিউরে উঠতো।
চিরন্তন যথারীতি সাড়ে দশ'টা নাগাদ ডিউটি থেকে ফিরলো। তাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে নিজের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে এলো হার্জিন্দার। লোকটা চিরন্তনকে সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করে বাপ্পাকে তার বাবার হাতে দিয়ে বললো "ইয়ে তো বিলকুল ছোটা বাচ্চা হ্যায়, ভাবিজিকো বলিয়ে থোরা গুসসা কম করনে কে লিয়ে। মুঝে লাগতা হ্যায় .. ভাবিজি ইসকো ঘরমে ঘুসনে নেহি দেঙ্গে। আজ আপকা লাড়কা আমার সঙ্গেই থাক, হামি ওকে খাইয়ে দেবো .."
চিরন্তন হেসে বললো, "অবশ্যই ঢুকতে দেবে .. ভেতরে গিয়ে এমন একটা গল্প দেবো! তবে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে .. সাক্ষী হিসেবে সঙ্গে থেকে আপনি শুধু আমার হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাবেন .. তাহলেই হবে।"
তারপর চিরন্তন বাড়িতে ঢুকে নন্দনা কিছু বলার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো "আমাদের ক্যাম্পাসের পাশে হসপিটালের যে মর্গটা রয়েছে, জানোই তো ওখানে সন্ধ্যা নামলেই শিয়াল আর খটাসের (একপ্রকার গন্ধগোকুল জাতীয় প্রাণী) আগমন হয়। জানো আজ কি হয়েছে? একটু আগেই বাপ্পাকে একটা শিয়াল ধরতে এসেছিল। হার্জিন্দর ভাই না থাকলে যে কি হতো! তবে আমি বাপ্পাকে আচ্ছা করে বকে দিয়েছি .. এত রাতে কেউ বাইরে বের হয়? নিশ্চয়ই তুমি কাজে ব্যস্ত ছিলে আর সেই সুযোগে তোমার চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়েছে, তাই না?"
"জি ভাবিজি .. ভাইসাব বিলকুল সাহি বোল রাহে হ্যায়। আগার আজ হাম নেহি রেহতে, তো অনর্থ হো যাতা.." বাপ্পার হার্জিনদার আঙ্কেল পেছন থেকে চিরন্তনের কথায় সায় দিয়ে উক্তি করলো।
"কি বলছো কি? ওকে শিয়ালে ধরতে এসেছিল? বাচ্চাদের জন্য, শুধু বাচ্চাদের কেন বড়দের জন্যেও জায়গাটা দিন দিন ননসেফ হয়ে যাচ্ছে .. আমি কালকেই গিয়ে হসপিটাল সুপারের সঙ্গে কথা বলবো .." এই বলে ছুটে এসে বাপ্পাকে জড়িয়ে ধরে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো তার মা নন্দনা দেবী। তারপর মুখে কিছুটা হাসি এনে কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিতে হর্জিন্দার আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বললো "আজ রাতের মেনুতে আলুর পরোটা আর মাংসের কিমা দিয়ে চানা মশালা বানানো হয়েছে .. আমাদের এখানেই না হয় রাতের খাবারটা খাবেন।"
"জি ভাবিজি জরুর .. আপকি হাতো সে বানায়ে হুয়ে খানা আপ জ্যায়সে হি স্বাদিস্ট হোঙ্গে .. মেরা মতলব জিন কি মান মে ইতনি মিঠাস হ্যায়, উনকি বানায়ে হুয়ে ভোজন তো জরুর টেস্টি হোঙ্গে .. লেকিন আপ সায়দ 'আনসেফ' বোলনা চা রাহি থি, উসকি জাগা 'ননসেফ' নিকাল গয়ি .." বিনয়ের অবতার হয়ে কথাগুলো বললো হার্জিন্দার সিং।
"আপনি আবার আমার ইংরেজির ভুল ধরতে বসলেন? অনেক রাত হলো এখন ডিনার করতে হবে তো .." মুখ বেঁকিয়ে উত্তর করলো নন্দনা দেবী।
ডিনার শেষে হার্জিন্দার বিদায় নেওয়ার পর নন্দনা ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে গেলে চিরন্তন বাবু তার ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, "মা'কে চিনিস তো .. তোর মা কিন্তু রাতে ঘুমানোর সময় সব কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করবে তোকে .. তখন যদি মায়ের আদর খেয়ে সব সত্যি কথা বলে দিস, তাহলে বাপ-বেটা দুজনকেই কিন্তু সারারাত বাড়ির বাইরে কাটাতে হবে .. কথাটা যেন মনে থাকে।"
★★★★
চিরন্তন বাবু পেশায় জুট-ইন্সপেক্টর ছিলো। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ঊনষাটখানা (এখন যদিও অর্ধেকের বেশি বন্ধ হয়ে গিয়েছে) জুটমিলে তো বটেই, এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও যেসব রাজ্যে চটকল অবস্থিত, সেখানে জুটের কাঁচামাল ইনস্পেকশনের জন্য চিরন্তনকে মাঝেমধ্যেই বাইরে যেতে হতো। সেটা অনেক সময় দিন পনেরো বা তার অধিক হয়ে যেত। কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি অথবা ক্রিসমাসের ছুটি থাকলে বাপ্পা তার বাবার সঙ্গে বারকয়েক গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাপ্পার পড়াশোনার জন্য সে আর তার মাতৃদেবী চিরন্তন বাবুর সঙ্গে যেতে পারতো না। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, তারা ক্যাম্পাসের অন্তর্গত বাংলো-কোয়ার্টারে থাকতো।
তবে এবারের অফিস-ট্যুরটা একটু বেশি দিনের জন্যই ছিলো .. প্রায় মাস খানেকের জন্য অফিসের কাজে চিরন্তনকে হায়দ্রাবাদ যেতে হয়েছিলো। বাপ্পার তখন ক্লাস ফোরের হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা শুরু হবে ক'দিন পর, তাই স্বভাবতই সে আর তার মা থেকে গিয়েছিলো। চিরন্তন বাবুর যাওয়ার আগের দিন রাতে বিছানায় তার স্বামীর বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে অনুযোগের সুরে নন্দনা দেবী বলেছিলো "জুট ইনফেক্টর তো নয়, যেন নাবিকের চাকরি করো তুমি! বছরের অর্ধেক সময় বাড়িতে, তো অর্ধেক সময় বাড়ির বাইরে .. ধুর ভাল্লাগে না .."
"আরে ওটা 'ইনফেক্টর' নয় 'ইন্সপেক্টর' হবে। এতদিন হয়ে গেলো, এখনো নিজের স্বামীর ডেজিগনেশনটা ঠিক করে বলতে পারলে না! ঘুমিয়ে পড়ো, কাল ভোরবেলা উঠতে হবে তো .." নন্দনা দেবীর কপালে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলো চিরন্তন বাবু। তবে এবারে অফিসের কাজে যাওয়ার জন্য তার দীর্ঘ অনুপস্থিতি যে তার স্ত্রী নন্দনার জীবন পুরোপুরি বদলে দেবে, সেটা দু'জনের কেউই কল্পনা করতে পারেনি।
আগামী শনিবার পরবর্তী পর্ব আসবে
সঙ্গে থাকুন এবং পড়তে থাকুন