09-02-2023, 08:56 PM
পর্ব- বারো
চোখ বন্ধ করে কি যেন একটা ভাবছিলাম আমি, হয়তো ভাবনার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছিলাম একটু একটু করে। ভয় একটাই আমার তো সাঁতার জানা নেই যদি ডুবে যাই! হাত গুলো ভুল বশত অবস হয়ে আসে তবে কেমন করে হাত পা নাড়িয়ে নিজেকে উপরে ভাসিয়ে নিতাম আমি। কিছুই করতে পারতাম না শুধু বোকা বোকা খোলা চোখে তাকিয়ে দেখতাম ভাবনার উত্তাল সাগরে নিজের সলিল সমাধি। আমিই হয়তো পৃথিবীর প্রথম কেউ যে কি না নিজের মৃত্যু নিজেই প্রত্যক্ষ করে গিনেসরেকর্ড বুকে নাম তুলতাম। আহা! ভাবনারা আসলেই কত সহজ সরল ভাবলেশহীন, কর্মে না হোক মর্মে হলেও নিজের অপ্রাপ্তির হিসেবে চোখ বুলাতে বুলাতেও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে দ্বিধাবোধ করে না। তবে আমার যে ডুবে মরে হবে না? ঐ যে আমাকে ভাসিয়ে উপরে তোলার জন্য একজন পাশে আছে একদম আঠার মতই লেগে আছে। কিন্তু নির্মম সত্য বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি কেন জানি ওকে কখনো স্বীকার করে নিতে পারেনি আবার কখনো মুখ ফুটে আমার জীবনে ওর অস্তিত্বের অস্বীকার করতে পারে নি। সেটার করার সাধ্য সাহস বা শক্তি কোনটাই কোনকালেই যে ছিল না আমার। বাহিরে যতটা প্রদর্শন করতাম সবটাই তো মনের অহং বোধে জন্মানো মিথ্যে অহংকারের আস্ফালন মাত্র। ওকে অস্বীকার করতে গেলে সবার আগে আমার নিজের অস্তিত্ব কে অস্বীকার করতো হবে সেটাও কি কখনো হয়?
চোখ মেলে তাকালাম, হাতের শক্ত মুঠোতে আবদ্ধ থাকা মুঠোফোন টা চোখের সামনে ধরে আবার আনলক করলাম। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে কথার কিছুকাল আগে পাঠানো ছোট্ট বার্তাটা,
এখনো জেগে আছিস!
এজন্যই আমি বলি আমাকে যদি আমার থেকেও বেশি কেউ চিনে থাকে তবে সেটা আমার মা আর ঐ আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ কথা। আমি মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন আমার চোখ দেখে শ্বাসের শব্দ শুনেও মা বলে দিতে পারে আমার কি হয়েছে কি বলতে চাই। আর কথা ও তো আমার নীরবতার মাঝেও শব্দ যন্ত্রে না সৃষ্টি হওয়া শব্দ গুলো খুঁজে নিতে পারে। আর সেই কথার কাছে আমি জেগে আছি নাকি ঘুমিয়ে সেটা জানা বিশেষ দুরূহ কোন কাজই নয়।
গত কয়েকটা বছরে আমার নিজের জন্য সময় বলতে ঐ গভীর রাতটুকুই যে বেঁচে থাকে আমার কাছে। সেই রাতটাই নিজের মত করে কাটাতে পারি আর তাই সেটা ঘুমিয়ে নষ্ট করার মত উচ্চাভিলাসী হওয়া কখনো কল্পনাতেও ভাবতে পারি না। ফলস্বরূপ চোখের নিচের কালো কালির মত দাগটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। নিদ্রাহীন রাতের স্বাক্ষী হিসেবে জেগে উঠা ব্রর্ণের দাগগুলো মিলিয়ে যাবার আগে ছোপছোপ কালো দাগ রেখে গিয়েছে মুখ জুড়ে৷ রাতটাও যে শুধু আমার হয়ে থাকে না মাঝে মাঝে, চোখ বন্ধ করতেই কত কি ভেসে উঠে বন্ধ চোখের সামনে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা একটা সংসার দাঁড় করানো, মায়ের অসুখ, ভাই বোনের পড়ালেখার খরচ সবকিছু গুছিয়ে নিজেকে গুছাবার জন্য সময় বাঁচানো বড্ড কঠিন কাজ। তাই বুঝি এখন চাইলেও ঠিকমত আয়েশ করে ঘুমোতে পারি না সময়ে অসময়ে স্বপ্ন বা দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায়।
কথা অপেক্ষা করছে ওকে ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে দিই,
এইতো, না মানে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হঠাৎ ভেঙে গেল আর কি।
কথা যেন মোবাইলটা হাতে নিয়ে আমার রিপ্লাইয়ের অপেক্ষাই করছিলো। সাথে সাথেই উত্তর এলো,
এতো অজুহাত দাঁড় করাতে হবে না আমার সামনে বুঝেছিস। ভালো লাগছে না রে চা খাবি?
এতো রাতে চা খাবার বায়না শুনতেই আমার পিলে চমকে উঠলো, মেয়েটা পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি? আর এখন চা ই বা পাবে কোথায়? হোটেলের রেস্টুরেন্ট তো সেই কখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চারদিকের সবকিছু ভীষন রকমের শান্ত হয়ে আছে। আচ্ছা ও এখনো জেগে আছে কেন? হয়েছে টা কি? কোন সমস্যা হলো না তো আবার? আবার চোখজোড়া বন্ধ করে নিলাম, কল্পনায় ডুব দিলাম...
এইতো বিশাল বিছানায় ওরা তিনজনে শুয়ে আছে শান্ত হয়ে, না না দুজন শান্ত হয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে তবে একপাশে শুয়ে থাকা একজনের শরীর বড্ড চঞ্চল। বারবার এপাশ ওপাশ করছে, একবার ডান পা ভাজ করছে তো আরেকবার বা পা। একবার সোজা হয়ে শুয়ে থাকছে তো পরক্ষণেই কাত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজের দিকে। এত বড় বিছানায় কেউ কারও কাছে নেই, নাহ এবারও ভুল করলাম দুজন কাছাকাছিই আছে আরেকজন কিছুটা দূরে। ওদের দুজনের মাঝে কাব্যের দেয়াল। কাব্যকে নিজের বুকের কাছে নিয়ে কিছুটা একপাশে সড়ে এসেছে কথা, অন্য পাশটায় নিঃসঙ্গ দীপু দা। দীপুদার জন্য মনটা হাহাকার করে উঠলো কেন জানি। ওদের মাঝের এই দূরত্ব টা আমার জন্যই কি? তা হলে কি তখন আমার জন্যই কাব্যকে নিজের কাছে রাখার জেদ করছিলো কথা! নইলে তো ওরা নিজেদের মত করে কিছুটা সময় কাটাতেই পারতো কিন্তু সেখানে এখন আমি হয়তো ঢুকে পড়েছি অনাকাঙ্ক্ষিত একজন হয়ে৷ আমার হঠাৎ আগমনে ওদের মাঝে একটা দূরত্ব তৈরী হয়ে গিয়েছে, আমি কি কথা কে ছিনিয়ে নিতে চাইছি? মাথাটা ঝিমঝিম করছে আর কিছু ভাবতে পারছি না। আবারও টুং করে মোবাইলটা বেজে উঠলো, কথার মেসেজ এসেছে
কিরে বোবা হয়ে গেলি নাকি? রুম থেকে বের হ আমি আসছি...
মেয়েটার বুঝি এবার সত্যি সত্যিই মাথাটা গিয়েছে, কিন্তু কেন জানি ওর আদেশের সুরে বলা কথাটা এড়িয়ে যেতে পারি না। তবে কিছুক্ষণ আগেই যে আমি আমার মনকে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম সেগুলোর উত্তর কি কখনো খুঁজে পাবো? তবে মন কিছু বলতে চাইছে খুব এলোমেলো ভাবেই,
ভাবনাটা ভুল ছিল না, প্রশ্নটা ভুল ছিল, প্রশ্নটা শুধু উত্তর দিয়েছিল, হয়তো ছোট ছিল, আর হ্যাঁ ভাবনাধারায় এমন একটা প্রশ্ন উঠে এসেছে যে মন উত্তর দিলেও কিছুই বোঝা যাবে না....
আমি কখনোই নিজের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি নি, তাই এবারও আমার সিদ্ধান্ত নেবার প্রশ্নই উঠে না। বিছানা ছেড়ে উঠে গায়ে থাকা টিশার্টের উপর একটা শার্ট চাপিয়ে নিলাম। বাইরে শীত শীত একটা ভাব এসে গিয়েছে। দরজা খুলে বের হতেই দেখি কথাদের রুমের দরজাটা খুলে গেল, গায়ে একটা শাল জড়িয়ে ও বেড়িয়ে এসেছে।
কৌতূহলী মনের চাপা স্বরে বলে উঠলাম,
এতো রাতে চা পাবি কোথায়? হঠাৎ চা খাবার সখ জাগলো কেন রে তোর?
শালের আড়াল থেকে হাতটা বের করতেই দেখি ছোট্ট একটা ফ্লাক্স আছে ওর হাতে,
চা আমার কাছেই আছে, খেতে যখন আমি চেয়েছি তোর এত টেনশন কিসের? চল নিচে ঐ খোলা জায়গাটাতে গিয়ে বসি।
বেশ হিমেল হাওয়ার ঝাপটা গায়ে এসে লাগছে। লিফট ধরে আমরা নিচে নেমে এগিয়ে গেলাম হোটেলের বাইরে খোলা সাজানো বাগানের দিকে। মাঝখানটাতে জোড়ায় জোড়ায় চেয়ার আর টেবিল পাতা রয়েছে। চারিদিকে সমান্তরালে রঙিন বাতি জ্বলছে ল্যাম্পপোস্টে। বাতাসের সাথে থেকে থেকে হালকা কুয়াশা উড়ে আসছে আমাদের দিকে। নিশাচর ফুলেরা একে একে পাপড়ির আবরণ ভেদ করে ফুটিয়ে তুলছে নিজেদের আর মাতাল করা গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। আজ্ঞাবহ বাতাসের দলের ঘাড়ে চেপে ফুলের সুঘ্রাণ যখনি নাসিকাগ্রে নিজেদের জানান দিয়ে যায় তৎক্ষণাৎ মস্তিষ্কের স্নায়ু তন্ত্রের উদ্দীপনা গ্রন্থির হরমোন নিঃসরণে সমস্ত দেহ জুড়ে অবাক করা ভালোলাগা ছুটে বেড়াতে থাকে। চোখ বন্ধ করে হারিয়ে যেতে মন চায় সেই মায়ার জগতে। চারদিক টা ভীষন রকমের নীরব নিস্তব্ধ হয়ে আছে, পৃথিবীর বুকের বেশির ভাগ জীব গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন গোটা কয়েক নিশাচর প্রাণী ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এসেছে জীবনের প্রয়োজনে। দূর থেকে মাঝে মাঝে কুকুরের হাঁকডাক শুনা যাচ্ছে। এক জোড়া চেয়ারে বসে পড়লাম আমরা, কথা দুখানা ছোট্ট কাপে চা ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দেয়।
এতো রাত জাগিস কেন? চোখের নিচে যে কালির আস্তরণ পড়ে গিয়েছে সে খেয়াল আছে! তবু তো এ কদিন তবু একটু নিয়ম মানিস দেখছি।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথার দিকে ফিরে তাকাই আমি,
না মানলেই তো আবার বকাবকি করবি, তারচেয়ে ভালো তোর মন মতই চলি। তুই জানিস তো ঐ রাতটুকুই তো আমার মত করে পাই তাই এত সহজে ঘুম আসে না যে।
মুচকি একটা হাসি দিয়ে,
ঘুম যেন আসে তার একটা ব্যবস্থা করতে হয় দেখি তাহলে! আন্টি কে বলবো নাকি?
বোকা বোকা চোখে আমি কথার দিকে তাকিয়ে থাকি,
কিসের ব্যবস্থার কথা বলছিস রে তুই?
চেয়ারটা নিয়ে কথা কিছুটা আমার দিকে সরে আসে,
আমাকে নিয়ে যাবি তোর সাথে? অনেক দূরে....
হঠাৎ এমন কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে পড়ি,
কি হয়েছে রে তোর?
মুখের গম্ভীর ভাবটা দূরে সরিয়ে দিয়ে খিল খিল করে হাসতে থাকে,
ভয় পেলি নাকিরে! না না তোকে আমাকে নিয়ে কোথাও যেতে হবে নারে। চাইলেও কি এখন আর যেতে পারবো নাকি? হয়তো পারতাম তবে এখন তো আরেকজন আছে ওকে রেখে কিভাবে যাবো বলতো? কাব্য না থাকলে ঠিক কোথাও হারিয়ে যেতাম মনের খেয়ালে। কিন্তু ও যে আমার নিজের অংশ ওকে রেখেও যেত পারবো না আবার নিয়েও যেতে পারবো না। নিজের কথা ভাবতে গিয়ে ওকে আমি অবহেলা করতে পারবো না।
আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে, কত সহজে ওত কঠিন কঠিন কথা গুলো বলে গেল এক নিঃশ্বাসে। ওর হয়তো আমার কাছে কোন প্রত্যাশা নেই নইলে ওমন করে বলতো না। সত্যিই আমি কারও প্রত্যাশা পূরণের মত করে হয়েই উঠিনি হয়তো,
তুই যাবি আমার সাথে? তোকে আর কাব্যকে নিয়ে দূরে চলে যাবো, নিজেদের মত করে থাকবো। আমার কাছে তুই যতটুকু ইম্পর্ট্যান্ট কাব্যও ততটুকু।
হাত বাড়িয়ে আমার মাথায় একটা চাটি মারে,
ধুর বোকা! তুই চলে গেলে আন্টির কি হবে? আর তোর ভাই বোন ওদের কে দেখবে। তোর উপর তো অনেকের দায়িত্ব আছে রে। আর চাইলে কি আর সব হয় রে, যখন সুযোগ ছিল তখন....
তাতে কি? বাকিদের মত তোদের দায়িত্ব টাও নিতে পারবো। আগে হয়তো ভয় পেয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলাম এবার আর সেটা হবে না। তোর হাতটা আর ছাড়তে চাই না কখনো।
তোর মাথাটা পুরো গেছে। কি আবোলতাবোল বকছিস বলতো, আমি কি ওমন কিছু বলেছি কখনো তোকে? এই যে এখন তুই আমার পাশে আছিস এমন করেই সবসময় থাকিস তাতেই হবে।
(হোটেলের চারতলার বারান্দা থেকে নিচে বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকা একজোড়া চোখ হঠাৎ করেই সরে গেল মনে হলো)
তোর বলতে হবে কেন! আমি কি বুঝি না? হু আগে অবুঝের মত অনেক কিছু করেছি তবে এখন আর সেটা হবে না। আমি চাই আজীবন তোর পাশে থেকে বাকিটা পথ চলতে।
বুঝেছি বুঝেছি তুই এখন অনেক বুঝদার হয়ে গেছিস। (চেয়রটা আমার দিকে আরও সরিয়ে এনে আমার গা ঘেসে বসে) এখন আর কিছু বলতে হবে না। আমার না ইচ্ছে করছে কারও কাঁধে মাথা রেখে চুপটি করে বসে থাকতে আর আকাশের বুকে জ্বল জ্বল করতে থাকা তারা গুনতে।
হঠাৎ করেই গুমোট হয়ে যাওয়া পরিবেশটা পাল্টাতে কথাকে ঠেস দিয়ে বলে উঠলাম,
তাহলে যাই আমি দীপু দা কে গিয়ে পাঠিয়ে দেই।
রাগে জ্বল জ্বল করতে থাকা রক্তিম চোখের চাহনিতে আমাকে ভস্ম করার অভিপ্রায়ে ঝাঁজিয়ে উঠলো,
তোর ইচ্ছা না হলে তুই চলে যা না, কে বসে থাকতে বলেছে? তোকে পন্ডিতি করতে বলিছি কি?
রাগে লাল হয়ে যাওয়া গাল দুটো দেখে আমি আর নিজের ভেতরে চেপে রাখা হাসিটা আর ধরে রাখতে না পেরে ফিক করে হেসে দিলাম। খানিকের মাঝেই ব্যাপারটা কি সেটা বুঝতে পেরে দু হাত বাড়িয়ে তেড়ে আসলো আমাকে মারার জন্য। আমি বা হাত বাড়িয়ে কথাকে জড়িয়ে নিলাম নিজের সাথে। আমার উষ্ণ আলিঙ্গনে নিজেকে খুঁজে পেয়ে আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে প্রশান্তি হাসি ফুটায় নিজের মুখে,
এবার ঠিক আছে কি ম্যাডাম!
শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করে আর একহাতে ওর গায়ে জড়ানো শালটাতে আমাকেও জড়িয়ে নেয়। আমার কাঁধে মাথা রেখে স্নিগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে আর আমি তাকিয়ে আছি কথার সন্তুষ্টি মাখা শ্রী বদনের দিকে। সত্যিই মেয়েটা খুব অল্পতেই খুশি হয়ে যায়, আর ওকে পাশে পেয়ে আমার মনে হচ্ছে
I'm the happiest man in the world.
★★★★★
গত হয়ে যাওয়া মাসটা খুব চাপের মাঝেই কেটেছে। ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য দম ফেলার সময় পাওয়াটাই যেন অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। এমনিতে মায়ের শাসনে টুকটাক ছাড় পেলেও এ কটা দিন সেটাতেও যেন অবরোধ লেগেছিল। সত্যি বলতে মা নিজেও অপারগ, কারণ বাবা আমাকে কিছু না বললেও সেটার প্রভাব ঠিকই মায়ের উপর পড়বে। বাবাকে আমি বাঘের মত ভয় পাই, তাই যা আবদার সব মায়ের কাছে। বাবাকে খুব কম সময়ই কাছে পেয়েছি জীবনে। ব্যবসা সামলানো সেই সাথে কিছুটা রাজনৈতিক দলের সাথে উঠাবসা আর সেই সুবাদে এলাকার অনেক কর্মকাণ্ডে যোগসাজশের কারণে বাড়িতে আমাদের জন্য আলাদা করে সময় দেয়ার মত পরিস্থিতি হয়তো তেমন ছিল না। তবে একে বারেই যে সময় দিতো না সেটাও আবার না। তবে আমার কাছে সেই সময় টুকু কমই ছিল। তাই আবদার গুলো মায়ের কাছেই করতাম তবে সেগুলো পূরণ তো বাবাই করে দিতো। হয়তো রাতে মায়ের কাছে কিছু স্পেশাল একটা খেতে চাইলাম আর সকালে ঘুম থেকে উঠে সেটা মাথার কাছে পেতাম।
তবে মা প্রায় সময় ঠেস দিয়ে বলে যে ছোট থাকতে আমি নাকি বাবার ন্যাওটা ছিলাম খুব। হয়তো আমাকে নিয়ে মা কোন আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে দিন কয়েকের জন্য কিন্তু আমার কান্না কাটির জন্য বেড়ানোটা বেশি দিনের হতো না৷ কারণ আমি নাকি বাবা বাবা বলে কান্না করতে করতে জ্বর উঠিয়ে ফেলতাম৷ বাধ্য হয়ে মাকে ফিরে আসতে হতো আর যেই কিনা বাসায় এসে হাজির হতো সাথে সাথে আমারও জ্বর কমে যেত অদ্ভুত ভাবে। সেই আমিই নাকি বড় বড় হতে হতে বাবাকে ভয় পেতে পেতে একটা দূরত্ব তৈরী করে ফেলেছি। তবে বাবা তার বাবা হবার কর্তব্য ঠিকি করে যেত, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, শপিং করা, আমার টিউশন কোচিং এ খবর নেয়া, কোথায় যাচ্ছি কার সাথে মিশছি সে সবের খেয়াল রাখা সবই করে যেত।
দেখতে দেখতে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল আবার এদিকে কাকার বিয়ের তোড়জোড়। নতুন বছরের প্রথম মাসেই কাকার বিয়ে। একদিকে পরীক্ষার টেনশন অন্যদিকে বাড়িতে বিয়ের উদ্দীপনা। দুটোই মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে আমার মস্তিষ্কে। তবে একটা দিকে ভালোই হয়েছে বিয়ের আনন্দের মাঝে পরীক্ষার চাপটা কিছুটা হলেও কম কাজ করেছে মনের মাঝে। তবে একটা চাপ তো আছেই, আসলে আমার তো পরীক্ষা দিতে হয় দুবার একবার পরীক্ষার হলে তো আরেকবার আন্টির কাছে। আর এটাও ঐ শাঁকচুন্নির জন্য, এটা তার মস্তিষ্ক প্রসূত বুদ্ধি এতে করে তাড়াতাড়ি ভুল গুলো পয়েন্ট আউট করা যায়। তবে শাঁকচুন্নির পঁচা বুদ্ধি টার জন্য হলেও প্রতিদিন আন্টির হাতে মজাদার রান্না খেতে পারি, হালকা পেটুক হওয়াতে ঐটুকুতেই আমার প্রশান্তি। তবে আমাদের পড়াশোনার চেয়ে খুনসুটি আর ঝগড়া হয় বেশি মাঝে মাঝে সেটা হাতাহাতি পর্যায়ে চলে যায়।
ইদানীং কথার সাথে মারামারি টা কমই হয়। মা সাবধান করে দিয়েছে এখন যত ঝগড়াঝাঁটি সব মুখে মুখেই যেন থাকে আমি যেন কথার গায়ে হাত না তুলি। আমরা দুজনই বড় হচ্ছি তাই ওর গায়ে যেন হাত না তুলি। আজকাল কথাও যেন একটু শান্ত হয়ে গিয়েছে হয়তো আন্টিও আমার মায়ের মত ওকেও সাবধান করে দিয়েছে। তবুও এখনো মাঝে মাঝে আমাদের খুনসুটি হাতাহাতি পর্যায়ে চলেই যায় তবে সেটা ক্ষান্ত হয় মা কিংবা আন্টির মিষ্টি ধমকে।
সেদিন নতুন হবু কাকির সাথে মোবাইলে কথা হলো কিছুক্ষণ, আমি প্রথমে বুঝতে পারি নি কার সাথে কথা বলছি। আমি পড়তে বসেছিলাম হঠাৎই মা কানের কাছে মোবাইলটা ধরে বললো কথা বলতে। কিন্তু আমি পড়লাম মহা ফ্যাসাদে কার সাথে কথা বলবো কি বলবো সেটাই তো জানি না, এমনিতেও আমি অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে বেশ ইতস্তত বোধ করি। তবে ওপাশ থেকে প্রথমেই "ছোটবাবু" ডাকটা শুনেই বিপরীতের মানুষটাকে আমার বেশ পরিচিত ছিল। বাসায় অন্যান্য কাকিরা আমাকে ছোটবাবু বলেই ডাকে। মূহুর্তের মাঝেই আমার মনের মাঝে চলতে থাকা অস্বস্তি ভাবটা কেটে গেল। মা আগেই বলেছিল নতুন কাকি যেহেতু বাসার সবার ছোট তাই আমরা যেন ছোটমা বলেই ডাকি৷ সেই মোতাবেক আমি ছোটমা বলেই সম্বোধন করলাম নতুন কাকি কে, গলার স্বরের উচ্ছাসে বেশ বুঝতে পারছি তিনি কতটা আপ্লুত হয়েছে আমার ডাকে। সেদিন খুব বেশি কথা হয় নি টুকটাক কথার বলার পরই ফোনটা মা কে ধরিয়ে দিয়েছিলাম, সত্যি বলতে বলার মত তেমন কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আজ শেষ পরীক্ষা ছিল, পরীক্ষা বলতে থিউরি কোন বিষয় ছিল না ওটা জাস্ট একটা অ্যাসাইনমেন্ট মাত্র। দেখতে দেখতে একটা বছর চলে গেল, আর কয়েকদিন পরেই নতুন শ্রেণিতে প্রমোশন হয়ে যাবে সবার। আপাতত কয়েকদিনের জন্য সবকিছু থেকে ছুটি। নো ক্লাস নো কোচিং নো টিউশনি একদম মুক্ত বাতাসে উড়ে বেড়ানো পাখির মত স্বাধীনতা। তবুও মনটা কেমন খচখচ করছে কারণ এ কটা দিন অনেকের সাথে দেখা হবে না যে। তাই তো এই স্বাধীনতা সুখের চেয়ে কষ্ট দেয় বেশি। প্রতিদিন একসাথে দিনের বেশিরভাগ সময় কাটানোতে অভ্যস্ত জীবন একলা হতে ভয় পায়।
অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছি দোলন মেয়েদের দলটার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। সেটা কোন উদ্দেশ্যে করছে সেটা তো আমার অজানা নয়। দোতলার বারান্দা থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দোলনের হাবভাব সবটাই আমার নজরবন্দী। ও বারবার ইনিয়ে বিনিয়ে কথার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে হয়তো কিছু বলতে চায়। কিন্তু কথা বাকি বান্ধবীদের সাথে গল্পে মশগুল তাই দোলন কে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না। মাঝে মাঝে হাতের ইশারায় বলার চেষ্টা করছে একটু পরে কথা বলবে। তবে দোলন যেন নাছোড়বান্দা, এখনো আশেপাশেই অপেক্ষায় রয়েছে। আমার ওর এই কাজগুলো একদম পছন্দ না বিশেষ করে কথার সাথে ওকে সহ্যই করতে পারি না। বাকিদের সাথে কি হলো সেটা দেখতেও যাই না।
নিচ থেকে হঠাৎ কথা উপরের দিকে তাকাতেই আমাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। আমি ইশারায় বুঝিয়ে দেই তেমন কিছু না, সাথে সাথেই একটা মিষ্টি হাসি ছুড়ে দেয় আমার দিকে আর ইশারায় বলে দেয় আমি যেন অপেক্ষা করি। হয়তো একসাথেই বের হবে কলেজ থেকে।
সবাই বেড়িয়ে যাবার পর আমি কথার সাথে ওদের বাসায় চলে যাই। আন্টি পিঠা বানিয়েছে সেটা খাবার জন্যই কথা আমাকে নিয়ে এসেছে। ওর এমন একটা ভাব যেন ও না বলবে আন্টি আমাকে পিঠা দিবে না। তবে গুড়ের শিরায় ভেজানো আলুর পুলি, মুগের পুলি আমার কত পছন্দের সেটা তো কথার জানা তাই ওর সাথে করেই আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি হয়তো আজ না এলেও কাল পরশু আসতাম। পিঠা খাওয়া শেষে আমি বাসায় চলে আসি, ঘুরে ঢুকতে যাবো তখনি হঠাৎ একজন কে দেখে আমি একটু থমকে দাঁড়াই। খেয়াল করলাম একটা মেয়ে বড়মাদের ঘর থেকে বেড়িয়ে আরেক কাকির ঘরের দিকে যাচ্ছে। পেছন থেকে দেখার কারণে বুঝতে পারছি না কে এটা, তবে এটা বুঝতে পারছি যে ওকে আগে কখনো দেখে নি আমাদের বাসায়। তাহলে কার সাথে এলো সে? আমার কৌতূহলী মন সহজে শান্ত হবার নয় তাই টেবিলে কোনমতে হাতে থাকা ফাইলটাকে ছুড়ে দিয়েই মা কে খুঁজতে চলে গেলাম। খুঁজতে খুঁজতে মাকে পেলাম সেই কাকির ঘরের, আমাকে দেখতে পেয়েই বলল
কিরে কলেজ থেকে কখন আসলি? দেরি হলো কেন?
মাত্রই, আন্টির ওখানে গিয়েছিলাম তো তাই। (বিছানায় বসা মেয়েটাকে দেখতে পেলাম এবারও মুখটা দেখা যাচ্ছে না পাশে আরেকজন বয়স্ক মতো একজন বসে আছে, ইশারায় মা কে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম)
মা আমাকে তার কাছে ডেকে বললো,
বাবা প্রণাম করো উনি তোমার নতুন কাকির বাবা আর সাথে তোমার কাকির কাকাতো বোন এসেছে।
এবার আমি মেয়েটাকে দেখতে পেলাম, টিয়ে রঙের লং ফ্রক পড়া, বব কাটিং চুল, চড়া রঙে রাঙানো ঠোঁট আর চোখে গোল গোল চশমা। দাদুকে প্রণাম করতে করতে আরেকবার ওরদিকে ফিরে তাকালাম। আমাদের বয়সীই হবে কিংবা একটু ছোট, আমার দিকে তাকিয়েই মৃদুভাবে একটা হাসি দিতেই ওর গজদন্ত আমার চোখের সামনে প্রকাশিত হলো। তাতেই তো আমার মনের ঘন্টা বাজতে শুরু করে দিলো, আমি বুঝি সেই অপরিচিতা জনের উপর ক্রাশ খেয়ে গেলাম। নাকি তার থেকেও বেশি কিছু, যাকে বলে
Love at first sight.