Thread Rating:
  • 32 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance অনুভূতিতে_তুমি
#21
#পর্ব_১৩

নির্ঝর ঘুম থেকে উঠেছে অনেকক্ষণ আগে। ফ্রেশও হয়েছে তবে বসে আছে ঘরের কোনে। কিছুই করার নেই এভাবে বসে থাকা ছাড়া । হঠাৎ করেই গাড়ির আওয়াজ পেলো সে। কে এলো এতো সকালে! নির্ঝর উঠে বেলকনির দিকে গেল। আজকের আকাশ অনেকটা পরিষ্কার। বেশ সুন্দর চারদিক।  বেলকনিতে আসতেই নির্ঝরের মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। 

চোখ দুটো গেল বাড়ির গেটের কাছে। মেহুর গাড়ি এটা,‌ মেহু নামছে গাড়ি থেকে। গাড়ির পিছনের সিটের দরজা খুলে নামাল অর্ণব কে। তারা কি তাহলে তাকে দেখতে এসেছে। নির্ঝর প্রথমে ভাবল ডাক দিবে কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ভাবনা বদলে দিল। ইচ্ছে করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে রইল। একটু অসুস্থতার ভাব! দেখাই যাক না মেহু কি তার সেবা করবে কি না! চিন্তা করবে কি না তার জন্য! 
.
নীলিমা নির্ঝরের জন্য খাবার বানাতে ব্যস্ত। ছেলেটার অসুস্থতা তার মা কেও অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছে। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গেছে এ ক'দিনে। ছেলের চিন্তায় ঠিক মতো ঘুমাতেও পারছে না। এর মাঝেই নাকি আবার বিয়ে। মশকরা হচ্ছে নাকি। বিয়ে বললেই কি হয়ে যায়। কতো কাজকর্ম থাকে বিয়েতে। কে দেখবে এসব? দুদিন পরেই মেহমান এসে হাজির হবে বাড়িজুড়ে। ছেলেটা কি তখন একটু শান্তিমতো বিশ্রাম নিতে পারবে। কিভাবে নিবে, এই বাড়িতে তো তখন আর শান্তি থাকবে না। নির্ঝরের ড্যাড কে বলে যে অন্য কোথায় থাকার ব্যবস্থা করবে তাও হবে না। আত্নীয়রা ভাববে তাদের অপমান করছি। উফ সব জ্বালা যন্ত্রণা যেন একা নিয়েই বসে আছে নীলিমা! 
রিদুয়ান চৌধুরী বসার ঘরে সোফায় বসে চা খাচ্ছে। নীলিমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বার বার নিক্ষেপ করছে তার দিকে। কিন্তু উনার কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে পারছেন না। এসব যেন তার রাগ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে! 

কলিং বেল বেজে উঠল। একজন এসে দরজা খুলে দিল। নীলিমা রান্না ঘর থেকেই উঁকি দিয়ে সামনে তাকাল। একটা ছোট বাচ্চার পা দেখা যাচ্ছে। নীলিমা একটু ভালো করে উঁকি দিয়ে তাকাল। রিদুয়ান চৌধুরী ততোক্ষণে উঠে দাঁড়ালো। হাসি মুখে বলে উঠে,

"মেহেরিন যে!

নীলিমার কানে কথাটা যেতে দেরি হলো না। এর মানে মেহেরিন আর অর্ণব এসেছে। সে আর না উঁকি দিয়ে খাবার বানানোতে মনোযোগ দিলো। 

মেহেরিন হেসে বলে উঠে,
"অর্ণব নির্ঝর কে দেখতে চেয়েছে, তাই এসেছি!

"বেশ ভালো তো। ড্যাডি অসুস্থ অর্ণব কি না দেখে থাকবে নাকি! 

মেহেরিন হেসে পাশে তাকাল। নীলিমা রান্না ঘরে কাজ করছে।রিদুয়ান চৌধুরী হাত বাড়িয়ে দিল অর্ণবের কাছে। অর্ণব চট করে পিছু হটে গেল। মেহেরিন অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

"তুমি যাও ড্যাডির ড্যাডি সাথে যাও,আমি আসছি ঠিক আছে! 

অর্ণব মাথা নাড়ল। এসে হাত ধরল রিদুয়ানের। রিদুয়ান তাকে নিয়ে সিঁড়িতে দিকে পা বাড়াল। মেহেরিন এসে দাঁড়াল রান্না ঘরে। নীলিমা নিজেকে কাজেই ব্যস্ত রাখছে। মেহেরিন পাশে দাঁড়িয়ে নীলিমা'র দিকে তাকিয়ে বলে,

"রেগে আছেন আমার উপর! 

নীলিমা অবাক হয়ে কাজ থামাল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল মেহেরিন'র দিকে। মেহেরিন হেসে বলল,

"আমি আপনার রাগ টা আজ আরেকটু বাড়াতে এসেছি। আমার মনে হয় এখনকার কথাটা এই রাগের কারণে আপনি বুঝতে পারবেন। 

নীলিমার অবাক এবার চরম শিখরে উঠলো। তার দৃষ্টি এখনো মেহেরিন'র মাঝে। মেয়েটার মুখটা হাসিমাখা। সে এখন এসেছে তাকে রাগাতে। হেসে হেসে কথা বলবে মনে হচ্ছে। এভাবে তাকে রাগানোর ধরণ টা কিছুটা আহ্লাদী আহ্লাদী মনে হচ্ছে তার। মেহেরিন নীলিমা'র হাত থেকে ছুড়িটা নিল। নীলিমা ক্যাপসিকাম কাটছিল। মেহেরিন সেটা কাটতে কাটতে বলল,

"আপনার রেগে থাকা টা স্বাভাবিক! ছেলের এমন অসুস্থতা অথচ আমি চাইছি এই অবস্থায় বিয়ে হোক। এতে আপনার ছেলে সুস্থতার বদলে আরো অসুস্থ হবার সম্ভাবনা বেশি আমি জানি কিন্তু কথা এটা না। কথা হলো... ( বলেই ছুরি চালানো থামিয়ে দিল। নীলিমা'র চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ) বিয়ের পর নির্ঝর অর্ণব আর আমি এই বাড়িতে থাকবো না। 

নীলিমা'র রাগ এবার মাথায় চড়লো। তার মুখেও রাগের আভাস দেখা যাচ্ছে। কি বলছে এই মেয়ে! বিয়ের পর এখানে থাকবে না মানে! ছেলে বিয়ের পর ছেলের বউ এখানে থাকবে না তো কোথায় থাকবে? মেহেরিন ঠোঁটে কিঞ্চিত হাসি দেখা গেল। সে বলে উঠে,

"আপনি রেগে যাচ্ছেন, আমি জানি সেটা। কিছু বলতে পারছেন না বলে আপনার হাত কাঁপছে। অতিরিক্ত রাগের কারনেই এমনটা হয়। আমি মনে করি এখন আপনি আমায় পুরোটা বলার সুযোগ দিবেন। দিবেন না! 

নীলিমা'র মুখ এবার ফুটল, শান্ত গলায় বলে উঠে,
"কি বলতে চাও!

"বেশি কিছু বলবো না, আপনি তো জানেন অর্ণবের অবস্থা। মূলত অর্ণবের কারণেই আমরা এখানে থাকবো না। এতো তাড়াতাড়ি অর্ণব এই বাড়িতে মানিয়ে নিতে পারবে না। ওর কষ্ট হবে, এতো বছর ধরে আমি চিকিৎসা করে ওর যা উন্নতি করেছি তা হয়তো নিমিষেই চলে যাবে। এখন আপনি বলুন এখানে আমার কি করা উচিত. 

নীলিমা মেহেরিন'র চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেহেরিন হেসে বলল,

"দ্বিধায় পড়ে গেলেন তো। না কথাটা এভাবে নিবেন না। সহজ ভাবে নিন। আপনিও একজন মা, আমিও একজন মা। কিন্তু মা'র মমতা আমার চেয়ে আপনি বেশি বুঝেন। ছেলের অসুস্থতার কারণে চাইছেন না এখন বিয়েটা হোক, এতে আপনার ছেলে অসুস্থ হয়ে যাবে তাহলে আপনিই বলুন আমি কিভাবে চাইবো আমার ছেলে অসুস্থ হোক। আমি কি তার ভালো চাইবো না! 

নীলিমা চোখ সরিয়ে ফেলেন। চুলোয় থাকা নির্ঝরের জন্য স্যুপ টা প্রায় হয়ে এসেছে। নীলিমা তা নেড়ে একটা বাটিতে উঠাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মেহেরিন সবজি কাটায় ব্যস্ত‌। 

নীলিমা স্যুপের বাটি আর এক গ্লাপ পানি একটা ট্রে তে করে এনে মেহেরিন'র সামনে ধরে। তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

"এসব উপরে নিয়ে যাও, আমি তোমাদের জন্য নাস্তা বানাবো। 

মেহেরিন নীলিমার হাত থেকে ট্রে টা নিয়ে বের হতে নিবে নীলিমা তখন বলে উঠে,

"একজন মা আমি, মায়ের মন অনেক ভালো মতো বুঝি। তাই চাই না আমার জন্য অন্য কারো সন্তানের কোন ক্ষতি হোক। তোমার যেটা ভালো মনে হয় তুমি সেটাই করো! 

মেহেরিন পিছনে ঘুরে নীলিমা'র দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

"একজন ভালো মা আপনি! 

অতঃপর সামনে ঘুরে নির্ঝরের ঘরের দিকে পা বাড়ায়! 
.
নির্ঝর কে দেখে ড্যাডি বলে চট করে বিছানায় চড়ে বসে অর্ণব। নির্ঝর উঠে বসে অর্ণবের মাথায় হাত নাড়ে। অর্ণব নির্ঝরের ব্যান্ডেজ করা হাত টা ধরে বলে,

"ড্যাডি! 

"কিছু না ড্যাডি একটু চোট পেয়েছে, ডাক্তার বলেছে তোমার ড্যাডি অনেক তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। তখন আবার অর্ণব কে কোলে নিতে পারবে! 

নির্ঝরের কথাটা মনে হয় পছন্দ হলো না অর্ণবের। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিদুয়ান হেসে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। নির্ঝর অর্ণবের মলিন মুখ খানা দেখে বলে উঠে,
"আমার অর্ণবের হাসি মাখা মুখটা কোথায় দেখি, কোথায় আছে! 

বলেই অর্ণবের পেটের দিকে হাত বাড়ায়। অর্ণব দূরে সরে হেসে দেয়। নির্ঝর হাত ধরে অর্ণব কে কাছে কেনে তার পেটে শুড়শুড়ি দিতে থাকে। খিলখিলিয়ে হাসি অর্ণব। 
.
অর্ণবের হাসির আওয়াজ ঘরের বাইরে থেকেই মেহেরিন পেলো। বুঝতে পারে না এই লোকটার সাথে কেন অর্ণব বেশ হাসিখুশি থাকে। ঘরের মধ্যে প্রবেশ ঘটল তার। প্রথম চোখাচোখি টা নির্ঝরের সাথেই হলো। নির্ঝর কে দেখে আচমকা মুচকি হাসল সে। নির্ঝর ও হাসল তার হাসি দেখে। অর্ণব বিছানায় বসে জোরে বলে উঠে,

"মাম্মি! 

"অর্ণব, ড্যাডি অসুস্থ। তাকে জ্বালাতন করো না। 

নির্ঝর বলে উঠে,
"কে বললো অর্ণব জ্বালাতন করে। অর্ণব তো গুড বয় তাই না অর্ণব! 

অর্ণব জোরে জোরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। মেহেরিন স্যুপের বাটি টা টেবিলের কাছে রেখে বলল,

"আন্টি পাঠিয়েছে, বলেছে খেয়ে নিতে! 

বলেই অর্ণব কে সড়ালো বিছানা থেকে। বলে উঠে,

"ড্যাডি এখন খাবে, অর্ণব! উনাকে বিরক্ত করো না! 

নির্ঝর চোট টা পেয়েছিল বা হাতে। মেহেরিন নির্ঝরের খাটের উপর একটা ছোট সাইজের টুল রেখে তাতে খাবার রেখে দিল। নির্ঝর চামচ দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। অর্ণব পাশে বসা ছিল। কি মনে করে নিজের কাঁধের ব্যাগ টা খুলল সে। ব্যাগ থেকে বিভিন্ন রুঙের কলম বের করল। সেই আঁকা ছবি টাও বের করে দেখাল নির্ঝর কে। অর্ণব কিছু বলার আগেই নির্ঝর বলে উঠে,

"মাঝখানে অর্ণব, এটা মাম্মি আর এটা ড্যাডি! 

বলেই তাকাল অর্ণবের দিকে। অর্ণব একগাল হেসে মাথা নাড়ল। নির্ঝরের ব্যান্ডেজ করা হাতে কলম দিয়ে আঁকাআঁকি শুরু করেছে অর্ণব।  কি আঁকছে এসব। মেহেরিন একবার বারণ করল কিন্তু নির্ঝর না করল, করছে করুক না। যা করছে ড্যাডির জন্য'ই তো করছে। 

ইচ্ছে করেই বিষম খেলো নির্ঝর। মেহেরিন কি করবে তার জন্য দেখার জন্য। সে যা ভাবল মেহু তার চেয়েও বেশি কিছু করল। পানির গ্লাস টা তার মুখের কাছে এসে ধরল। অর্ণব উঠে তার পিঠের মাঝে হাত বোলাতে লাগল। এই ছোট্ট ছোট্ট হাতে খানিকটা শুড়শুড়ি লাগতে লাগলো নির্ঝরের। সে মুখ টিপে হেসে দিল। মেহেরিন উষ্ণ গলায় বলল,

"ঠিক আছেন! 

নির্ঝর মাথা রেখে কিঞ্চিত হাসল। এই আদর নিতে ভালোলাগছে তার! ইশ কোথায় ছিল এই ভালোবাসা। 
.
রাতে একা ঘরে বসে আছে নির্ঝর। তাকিয়ে আছে হাতের দিকে। নির্ঝর কি কি জানি একেছে। ইংরেজি শব্দে Daddy ও লিখেছে। বাহ ! বেশ ভালো লাগছে। অসুস্থ হলে সবাই যত্ন করলে সে যত্ন নিতে ভালো লাগে। কিন্তু এর মাঝে এই ছোট্ট হৃদয়ের ভালোবাসা নির্ঝর কে অভিভূত করল। 
বাইরে থেকে শীতল হাওয়া বয়ে আসছে। এটা বৃষ্টির পূর্বাভাস। ইদানিং বৃষ্টির প্রকোপ বেড়েছে।‌ এই বাতাসে কিছু একটা উড়ছে। তার কানে আওয়াজ আসছে। নির্ঝর পাশে তাকিয়ে দেখে বিছানার পাশে থাকা টেবিল একটা কাগজ উড়ছে। কাগজের উপর কিছু একটা রেখে আটকে দেওয়া হয়েছে। নির্ঝর কাগজ টা হাতে নিয়ে দেখে এটা অর্ণবের আঁকা ছবি। ছবি টা দেখে অজান্তেই হেসে দিল সে। ভেবে নিল এই ছবিটা ফ্রেম বানিয়ে রেখে দিবে! 
.
আজ ২৬শে বৈশাখ! কথামতো মেহেরিন আর নির্ঝরের গায়ে হলুদ! মেহেরিন'র পরিবার থেকে শুধু সে আর অর্ণব। আর সঙ্গে এসেছেন মিস মারিয়া এবং ডঃ রাহেলা! এছাড়া আর কেউ নেই। নির্ঝর আর মেহেরিন'র গায়ে হলুদ পাঁচতারা হোটেলে আয়োজন করা হয়েছে। দু'জনের গায়ে হলুদ একসাথেই হবে। মেহেরিন একটা হলুদ রঙের লেহেঙ্গা পড়ে অনুষ্ঠানে সব প্রবেশ করল। নির্ঝরের হাত ছেড়ে মাম্মি ডেকে দৌড়ে মেহেরিন'র কাছে এলো অর্ণব। তার হাতে নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল। নির্ঝর মেহেরিন'কে দেখে ভড়কে গেল। অনেকটা মিষ্টি লাগছে তাকে দেখতে।‌ তার মুখের এই স্নিগ্ধতা এই প্রথমবার চোখে পড়ল নির্ঝরের! 

প্রেস মিডিয়া সবাই উপস্থিত ছিল এই গায়ে হলুদে‌‌। খুব ধুমধাম করেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। অনুষ্ঠান শেষে মেহরিন আর অর্ণব বাড়ি আসার জন্য রওনা হলো। মেহেরিন খান বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল। পুরো বাড়ি আজ আলোতে রঙ্গিন। অনেকদিন পর বাড়ি কে রঙিন সাজে দেখল সে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিরু দি'র বিয়ের কথা। খুব ধুমধাম করেই হয়েছিল সেই বিয়ে। টানা সাত দিন অনুষ্ঠান লেগেছিল খান বাড়িতে। বাড়ির প্রথম মেয়ের মেয়ে উপলক্ষে কোন কমতি রাখেন নি শুভ্র খান। কিন্তু ছোট মেয়ের বিয়েতে নিজের জায়গার ঠাঁই টুকু পেলো না সে। তার আগেই মাথা রাখার হাত টা চলে গেল মেহেরিন'র! 

মেহেরিন আজ সারারাত ঘুমালো না, কোন ঘুমের ঔষধ ও খেলো না। মাঝরাত অবদি পুরো ঘর শুধু ঘুরে ঘুরে দেখেছে অর্ণব। মেহেরিন দেখছে অর্ণব কিছুটা হলেও গ্রোথ করছে। এসব বিষয়ে তার সবসময় অনিহা থাকলেও আজ তা নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেহেরিন। অনুষ্ঠানে আজ অনেকেই ছেলেকে নিয়ে অনেক কটুক্তি করেছে। কিছুটা হলেও সে খবর মেহেরিন পেয়েছে।‌ বুঝে না মানুষের সমস্যা টা কি কোথায়? কেন এতো আগ্রহ তাদের! 

নির্ঝরের এক্স গার্লফ্রেন্ড'র কিছু কথা কানে এসেছে মেহেরিন! হ্যাঁ কথার কথাই ভাবছে, শুনলো সে নাকি সুইসাইড অ্যাডেন্ট করতে গিয়েছিল। কি জানি হায়, এতোটাই ভালোবাসতো নির্ঝর কে। কিন্তু নির্ঝর বোধহয় কথা কে ভালোবাসে নি। ভালোবাসলে কি আর তাকে বিয়ে করার কথা ভাবতো। ছেলেদের ভালোবাসাও অনেক আজব। তারা যখন কাউকে ভালোবাসে তখন সবটা উজাড় করে দেবে কিন্তু তাকেই যখন ভুলে যাবে তখন এমনভাবে ভুলে যাবে যেন গাছ থেকে পরগাছা তুলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আজ পর্যন্ত যত পুরুষ মানুষ দেখলো তারা বেশির ভাগই তেমন আবার কিছু আলাদাও আছে। এই এক তার বাবা। মা মারা যাবার পরও দ্বিতীয় বিয়ে করে নি। কেন করেনি, মেয়েদের কথা ভেবে। হুম তবে আরেকটা কারন ও ছিল। তার হলো নিজের স্ত্রীর মতো গভীর ভালোবাসা।

"আমার বাবা তার অতীত নিয়েই কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বলে আর বিয়ে করে নি। মাঝে মাঝে মাঝরাতে বাবা'র রুমে এলেই দেখতাম মায়ের ছবি হাতে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কতোটা ভালোবাসলে একটা লোক এমন করতে পারে। এমনকি মরবার আগেও বলে গেল অধরার পাশে যেন করবটা দেওয়া হয়। নিজের স্ত্রীর শেষ স্মৃতি মানে আমাকে আরর নিরু দি কে কতোটা আগলে রেখেছে তা কি এমনে এমনে। আবার কিছু পুরুষ মানুষ ও আছে যারা নিজের স্ত্রীর ঝুলন্ত লাশ দেখেও তার পাশ থেকে নিজের বাচ্চা টাকে সরিয়ে আনেন না। কতোটা অমানুষ হলে মানুষ এমনটা করে। এটা কি অন্য কারোর সন্তান। তার'ই তো সন্তান। 
 
হ্যাঁ মেহেরিন মনে করে তার দি'র মৃত্যুর পিছনে তার জিজুর হাত আছে। কারণ সেদিন দরজা খোলা ছিল, মেহেরিন খোলা দরজা'ই পেয়েছিল। এর মানে তার আগে নিশ্চিত কেউ এসেছিল বাড়িতে। আর এটা জিজু ছাড়া কেউ না। কিন্তু যথাযথ প্রমাণ না থাকায় কিছুই করতে পারে নি সে। 

এসব ভেবে তার মন বিষণ্ন হয়ে গেল। ক্লান্ত লাগতে শুরু করল তার। আগামীকাল অনেক কাজ আছে। বিয়ের কাজ, যদিও তার বাড়িতে মেহমান কেউ নেই। পুরো বাড়িতে সে একা আর অর্ণব। আর বলতে মিস মারিয়া! অর্ণবের জন্য বেশি অপরিচিত মানুষ বাড়িতে রাখে না সে। 

মেহেরিন ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখে অর্ণব মেঝেতে পরে ঘুমাচ্ছে। কখন ঘুমাল ও! ইশ খেয়াল করে নি তো। 

চট করে উঠে অর্ণব কে কোলে তুলল। অর্ণব ঘুমের ঘোরেই ডেকে যাচ্ছে,

"ড্যাডি, ড্যাডি! 

মেহেরিন অর্ণবের কপালে চুমু খেয়ে বলল,

"এই তো কাল এসে পড়বে তোমার ড্যাডি! 
.
সারারাত না ঘুমিয়েই কাটাল মেহেরিন। ভোরের দিকেও দু চোখের পাতা এক করল না সে। ইজি চেয়ারে বসে অর্ণব কে দেখছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অর্ণব। মেহেরিন উঠে দাঁড়াতে গেল। হুট করেই পরে গেল। মাথা ঘুরছে তার, ক্লান্ত লাগছে খুব। মেঝেতে বসে খাটে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। 

ঘুম ভাঙল অনেক বেলা করে তবুও কারো ডাকে। মেহেরিন তাকিয়ে দেখল মিস মারিয়া! মিস মারিয়া মেহেরিন কে জিজ্ঞেস করল,

"ঠিক আছেন ম্যাম!

মেহেরিন'র চোখ মিনিমিনি করতে লাগল। পাশ থেকে অর্ণব গালে হাত রেখে বলল,
"মাম্মি! 

মেহেরিন'র ঘুমের রেশ তখনো কাটে নি। তবুও বলে উঠে,
"মাম্মি ঠিক আছে অর্ণব! 

অর্ণব হেসে মেহেরিন'র মাথায় হাত বোলাল। মেহেরিন'র ঘুম এখন কিছুটা হলেও কেটেছে। মেহেরিন ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে যাবার সময় হয়ে গেছে। মিস মারিয়া কে বলল অর্ণব কে যেন তৈরি করে নিয়ে আসে। অতঃপর মেহেরিন উঠে দাঁড়ায়। এখন কিছুটা হলেও ভালো লাগছে তার। ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এলো মেহেরিন। সময় হয়ে গেছে, এখনি বেরুতে হবে। 

অর্ণব কালো রঙের একটা স্যুট পড়ে মেহেরিন'র সামনে এসে দাঁড়াল। মেহেরিন হেসে বলে উঠে,

"বাহ বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে তো আমার অর্ণব সোনা কে!

"মাম্মি! 

মেহেরিন হেসে চোখের কাজল অর্ণবের কানের পাশে লাগিয়ে দিল। অতঃপর গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। মেহেরিন হোটেলে গিয়েই সাজবে তাই আর তৈরি হয় নি! 

গাড়িতে থাকা অবস্থায় একবার নির্ঝরের কল এসেছিল। মেহেরিন কল রিসিভ করে বলেছিল সে আসছে। হোটেলে এসে পৌছাবার পর মিস মারিয়া'র কাছে অর্ণব কে দিয়ে মেহেরিন তৈরি হতে চলে গেল। কিন্তু এর আগে একবার নির্ঝরের সাথে দেখা করার দরকার ছিল। মেহেরিন নির্ঝরের ঘরের দিকে আগাল সেখানে সে তৈরি হচ্ছে। এসময় তার ফোনে একটা মেসেজ এলো। মেহেরিন ফোন বের করে তা চেক করতে করতে নির্ঝরের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দরজা খোলাই ছিল। মেহেরিন দরজায় একবার টোকা দিয়ে দরজা খুলে সামনে তাকাতেই থমকে গেল। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কথা নির্ঝরের অনেক কাছে তার কলার হাতে দাঁড়িয়ে আছে আর নির্ঝরের হাত কথার হাতে। মেহেরিন কে দেখে নির্ঝর হতবাক হয়ে গেল। কি হতে চলেছে এখন। মেহু কি করবে? ভুল বুঝবে না তো তাকে।  নির্ঝর কিছু বলতে নিলো কিন্তু তার আগেই মেহেরিন চলে গেল। অতঃপর... 

#চলবে....
[+] 3 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#22
#পর্ব_১৪

মেহেরিন দরজায় একবার টোকা দিয়ে দরজা খুলে সামনে তাকাতেই থমকে গেল। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কথা নির্ঝরের অনেক কাছে তার কলার হাতে দাঁড়িয়ে আছে আর নির্ঝরের হাত কথার হাতে। মেহেরিন কে দেখে নির্ঝর হতবাক হয়ে গেল। নির্ঝর মেহু কে কিছু বলবে তার আগেই মেহেরিন চলে গেল।‌ নির্ঝর যেন স্থির হয়ে গেল। এদিকে কথা আবারো রাজ্যের কান্না জুড়ে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে নির্ঝরের অনেকটা কাছে চলে এলো সে। 

নির্ঝর কে অবাক করে দিয়ে মেহেরিন আবারো এলো। এসেই হাত দিয়ে পুরো দরজা খুলল। নির্ঝর আর কথা তাকিয়ে দেখছে মেহেরিন কে। মেহেরিন মুখে কিঞ্চিত হেসে বলে উঠে,

"আপাতত আর ৩ ঘন্টা, এরপর উনি আমার সম্পত্তি? তখন চাইলেও হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারবে না তাই এখন দেখে নিতেই পারো কিন্তু.. যদি তোমাদের প্রেম বিরহ শেষ হয়ে থাকে তাহলে বের হয়ে যেতে পারো। নিজের হবু বরের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর অধিকার আমারও আছে কিন্তু! 

কথা অবাক হয়ে মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ঝর কথার হাত টা ছেড়ে দিল। মেহেরিন দরজার সাথে হেলান দিয়ে বলে,

"হাত টা ছাড়ো! 

কথা ধীরে ধীরে হাত ছাড়ল। মেহেরিন দরজা ছেড়ে দিয়ে দরজার দিকে ইশারা করল। কথা নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে রইল। নির্ঝর সরে দাঁড়াল। কথা চোখের পানি মুছতে মুছতে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। মেহেরিন ঘরে ঢুকতেই নির্ঝর বলে উঠে,

"মেহু, আসলে..

"আমার কিছু জানার ইচ্ছে নেই। একটু আগেও বলেছি ৩ ঘন্টা পর আপনি আমার সম্পত্তি। উপভোগ করুন এতোটুকু সময় কেননা এরপর কিছু করার আগেও আপনাকে একশবার ভাবতে হবে। প্রত্যেকটা কাজের কৈফিয়ত দিতে হবে আমায়! 

বলেই মেহেরিন দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। অতঃপর বলে উঠে,

"কাউকে কখনো কষ্ট দিয়ে নিজে সুখে থাকা যায় না নির্ঝর! অন্য কে ঠিক যতটা নিবেন নিজেও ততোটা ফেরত পাবেন। হোক সেটা দুঃখ বা ভালোবাসা! 

নির্ঝর‌ মলিন ভাবে মেহেরিন'র দিকে তাকাল। মেহেরিন চলে গেল। এই প্রথমবার তার খারাপ লাগছে কথার জন্য। ঠিক তো কথার কোন দোষ ছিল না। সে তো শুধু ভালোই বেসেছিল তাকে। নির্ঝর কিছুক্ষণ বসে রইল চুপ করে। অস্বস্তি লাগতে শুরু করল তার। দাঁড়িয়ে গেল নির্ঝর, অতঃপর চলে গেল বাইরের দিকে। 

কথা ততোক্ষণে গাড়ির কাছে চলে এলো। নির্ঝর দৌড়ে কথার গাড়ির কাছে গেল। কথা গাড়ির দরজা খুলতেই নির্ঝর পেছন থেকে কথা কে ডাক দিল। নির্ঝরের আওয়াজে কথার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। গাড়ির দরজা বন্ধ করে নির্ঝরের কাছে ছুটে এলো সে। নির্ঝর কে দেখে তার মুখের হাসি যেন শেষ'ই হচ্ছিল না। 

নির্ঝর হাঁপাতে লাগল। কথা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,

"ততুমি আমার কাছে এসেছ নির্ঝর! 

নির্ঝর দম নিয়ে বলে,
"হ্যাঁ তোমার সাথে কথা ছিল আমার।

"বলো, কি বলতে চাও তুমি! তোমার কথা শোনার জন্য'ই তো এতোদিন পাগল হয়ে ছিলাম আমি।

"কথা! 

নির্ঝরের গলার স্বরে কথা থমকে গেল। কি বলতে চায় নির্ঝর তাকে। নির্ঝর শীতল গলায় বলে উঠে,

"সরি!

"সসরি! শুধু সরি!

"হ্যাঁ কথা মানে, এটা আমার আরো আগে বলা উচিত ছিল। আমি জানি নিরপরাধ হয়েও শাস্তি পাচ্ছো তুমি। তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে কিন্তু...

কথা গলা ততোক্ষণে ভারী হয়ে আসছিল। চোখের শুকিয়ে যাওয়া অশ্রু যেন আবারো জেগে উঠলো। ভারী গলায় বলে উঠে,

"তুমি আমাকে ভালোবাসো না নির্ঝর! 

নির্ঝর কথার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা এখন আবার কাঁদবে। সে এসেছিল সরি বলতে কিন্তু এখন যদি সে আবারো কাঁদে তাহলে তো কিছুই হবে না। নির্ঝর চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখ বন্ধ করে উষ্ণ গলায় বলে উঠে,

"না! 

কথা এরকম কিছু শোনার ইচ্ছা না করলেও তার মন বলছিল এমন কিছুই হবে। নির্ঝরের কথার সাথে সাথে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরল তার। নির্ঝর শীতল গলায় বলে উঠে,

"প্লিজ কেঁদো না কথা। আমি চাই নি তুমি কাঁদো!

কথা মুহূর্তে'ই চোখের জল মুছে ফেলল। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে উঠে,

"তাহলে কাকে ভালোবাসতে, মেহেরিন কে! 

বলেই উপরে তাকাল কথা। নির্ঝর তাকিয়ে দেখল হোটেলে'র বেলকনিতে থেকে দেখা যাচ্ছে মেহেরিন কে। নির্ঝর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেখানে। কথা বলে উঠে,

"কনগ্রেচুলেশন তোমায়! 

বলেই কথা চলে গেল। নির্ঝর আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। সে মুখ ফিরিয়ে তাকাল উপরের দিকে। মেহেরিন চলে গেছে। পেছন থেকে কারো দৌড়ানোর আওয়াজ আসছে। ফরহাদ ওরা সবাই আসছে। আরিফ এসে বলে উঠে,

"কিরে নির্ঝর, তুই এখানে? আর আমরা পুরো দুনিয়া খুঁজছি। চল দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। তৈরি হতে হবে তোকে! 

বলেই টেনে নিয়ে গেল তিনজন! 
.
লেহেঙ্গা টা নির্ঝর পছন্দ করলেও মেহেরিন কে যে তার পছন্দে এতোটা মানাবে সে ভাবে নি। খুব সুন্দর লাগছে মেহেরিন কে। তারচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে তার হাত ধরে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে আসা অর্ণব কে। কালো রঙের স্যুট পড়ে তাকে অসাধারণ লাগছে। নির্ঝর উঠে দাঁড়াল। তার এক হাত ব্যান্ডেজ করা। তবুও সাদা রঙের শেরোয়ানি তে চমৎকার লাগছে তাকে। শেরোয়ানি'র মাঝে সোনালি রঙের কারুকাজ করা। 

সামনে এগিয়ে এসে হাত ধরল মেহেরিন'র। তাকে বসাল তার পাশে। অর্ণব এসে বসল নির্ঝরের কোলে। নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,

"ড্যাডি! 

নির্ঝর হেসে তার কপালে চুমু খেল। নীলিমা আর রিদুয়ান এসে অভিনন্দন জানাল তাকে। অতঃপর অনেক ধুমধাম করে বিয়ে পড়ানো হলো। বিয়ে পড়ানোর পর সব কাপল এসে দাঁড়িয়ে নাচতে লাগল। ফরহাদ, আরিফ, ঈশান সবাই মিলে নাচতে লাগল। নীলিমা আর রিদুয়ান ও নাচছে গানের তালে। 

চারদিক ডিম লাইট জ্বালানো। বর কনে বাদে বাকি সবাই নাচছে। অর্ণব নির্ঝরের কোলে বসে আশপাশ দেখছে। তার পাশে বসে আছে মেহেরিন। হুট করেই দরজা খোলার শব্দ এলো। কেউ এসেছে এই সময়। কিন্তু কে এলো এই সময়ে। দরজার আওয়াজে সবাই তাকাল দরজার দিকে। লাইটের আলো জ্বললো তার উপর। সুদর্শন একজন পুরুষ! সবাই অবাক হলো তাকে দেখে।মেহেরিন দাঁড়িয়ে গেল তাকে দেখে। নির্ঝর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেহেরিন'র দিকে। 

মেহেরিন নিম্ন স্বরে বলে উঠে,
"নিরব! 

নিরবের নাম শুনে নির্ঝর ফিরে তাকায় তার দিকে। সে হেটে এখানেই আসছে। তার হাতে একটা ফুলের তোরা। মেহেরিন'র সামনে এসে দাঁড়াল সে। ফুলের তোরা টা এগিয়ে দিলো মেহেরিন'র সামনে। সমস্ত লাইট জ্বলে উঠলো। নির্ঝর এবার উঠে দাঁড়াল। মেহেরিন হেসে তোরা টা হাতে নিল। সাদা রঙের গোলাপে ভর্তি তোরা টা। নির্ঝর তাকিয়ে রইল মেহেরিন'র হাসির দিকে। হাসি টা অন্য কারোর জন্য দেখে ভালো লাগছে না তার। নিরব হেসে বলল,

"দেরি করে ফেললাম নাকি আমি!

"না ঠিক সময়ে এসেছিস! ( নির্ঝর কে উদ্দেশ্য করে.. ) নির্ঝর চৌধুরী মেঘ! আমার হাসবেন্ড! 

নিরব নির্ঝরের দিকে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে গেল তার। নির্ঝরের কাছে এই ভঙ্গির কারণ জানা নেই। অতঃপর নিরব হেসে হাত বাড়িয়ে দিল। নির্ঝর ও হাত বাড়িয়ে দিল তার। দুজনেই হ্যান্ডশেক করল। নিরব হেসে বলল,

"কনগ্রেচুলেশন!

"ধন্যবাদ! 

অতঃপর নিরব অর্ণবের দিকে তাকাল। অর্ণবের মাথায় হাত রাখল। অর্ণব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। নিরব বলে উঠে,

"ভালো আছো অর্ণব!

অর্ণব মাথা নাড়ল! 

মেহেরিন নির্ঝরকে বলল,
"ও নিরব! আমার খুব পুরনো বন্ধু আর বিজনেস অ্যাডভাইজার! 

"ওহ! 
.
ফরহাদ এসে মেহেরিন আর নির্ঝর কে টেনে নিয়ে গেল নাচার জন্য। নিরব অর্ণব'র হাত ধরে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। নির্ঝর এক হাত মেহেরিন'র কোমরে রাখল। মেহেরিন দু হাত রেখেছে নির্ঝরের কাঁধে। Janam Janam Janam Sath col na yahi... গানটা বাজছে। দুজন নাচছে গানের তালে। 

নির্ঝর এক হাত দিয়ে মেহেরিন কে ঘুরিয়ে নিল। উল্টো করে ‌জরিয়ে ধরল তাকে। মেহেরিন'র কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

"তোমার বন্ধুর হয়তো আমাকে পছন্দ হয় নি।

"তাই নাকি! 

"হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলোতো?

"আমি কিভাবে বলবো?

"বাহ রে তোমার বন্ধু তুমি জানবে না।

"কিন্তু অপছন্দ তো আপনাকে করে। তাই আপনার'ই জানা উচিত কেন? তাই নয় কি!

নির্ঝর আর কথা বাড়াল না। শুধু মনে মনে ঠিক করে নিল সে জেনে ছাড়বে। 

অর্ণব নিরবের হাত ছেড়ে দৌড়ে এলো নির্ঝরের কাছে। হেসে বলল,

"ড্যাডি, ম্যামি! 

দুজনেই হেসে সরে দাঁড়াল। গানের টিউন চেঞ্জ হলো।   অর্ণব লাফিয়ে নামতে লাগল। মেহেরিন আর নির্ঝর হেসে তার চারদিক ঘুরতে লাগল! 

#চলবে....
[+] 3 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#23
#পর্ব_১৫

নিয়ম অনুযায়ী আজকের দিন টা মেহেরিন আর নির্ঝর চৌধুরী বাড়িতেই থাকবে। অতঃপর আগামীকাল তারা খান বাড়িতে পৌঁছাবে যেটা মেহেরিন নির্ঝরের নামে করে দিয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে অনেক রাত করেই সবাই বের হয়। নিরব মেহেরিন কে বিদায় দিয়ে চলে যায়। অতঃপর নির্ঝর আর মেহেরিন গাড়িতে চড়ে। তাদের মাঝখানে বসে অর্ণব!

চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মেহেরিন'র কোলেই ঘুমিয়ে পড়ে অর্ণব। মেহেরিন অর্ণব কে কোলে নিয়েই নামে। নীলিমা ঘরের বউ আর ছেলেকে বরণ করে ঘরে ঢুকায়। মেহেরিন কে নিয়ে যায় নির্ঝরের ঘরে।‌ পুরো ঘরটা চারদিকে ফুল ছড়িয়ে আছে। ফুলের গন্ধে মো মো করছে চারদিক। বিছানার মাঝে লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে আছে। মেহেরিন ঘরে ঢুকে গেলেও নির্ঝর এখনো পারে নি। সবাই আটকে রেখেছে তাকে টাকার জন্য। নির্ঝর কাজিন আর বন্ধুরা মিলে ফন্দি এঁটেছে। বেচারা নির্ঝর ভাঙা হাত নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফরহাদ বলে উঠে,

"টাকা ছাড়! 

"আমার কাছে কোন টাকা নেই।

ঈশান বলে উঠে,
"আজকের দিনে কিপ্টামি ছাড়!

নির্ঝরের এক কাজিন বলে,
"ভাবি কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি টাকা দাও আর চলে যাও।

আরিফ বলে উঠে,
"টাকা ছাড়া কিন্তু ঘরে ঢুকতে দেবো না।

নির্ঝর হেসে বলে,
"আচ্ছা! 

বলেই উল্টো পথে হাঁটা ধরল। সবাই অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল নির্ঝরের দিকে। ফরহাদ নির্ঝরের হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো দরজার কাছে।‌ সবাই একসাথে চেঁচিয়ে বলল,

"কিপ্টা! 

"?

"টাকা দে!

"বললাম তো টাকা নেই, আর আজ রাতে ঘরে না ঢুকলেই কিছু হবে না। এরপর থেকে সারাজীবন আমার সাথেই থাকবে।

বলেই নির্ঝর আবারো চলে যেতে নিল। সবাই ঘিরে ধরল ওকে। নির্ঝরের কাজিন বলে উঠে,

"টাকা না দিয়ে তুই বের হ তো দেখি। একটা হাত ভাঙা আছে একটা পা কিন্তু এখন ভেঙে দেবো।

"তোরা তো রীতিমতো হুমকি দিচ্ছিস এবার।

ফরহাদ নির্ঝরের ঘাড়ে হাত রেখে বলে,
"না এসব ছোট খাটো ব্যাপারে কোন কাজ হবে না। কিছু বড় একটা করতে হবে।

নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে বলে,
"কি?

ফরহাদ চেঁচিয়ে দরজার কাছে যেতে যেতে বলে,
"ভাবি ভাবি.. দেখো তোমার বর কেমন কিপ্টামি কর....

তার আগেই নির্ঝর মুখ চেপে ধরে ফরহাদের। 
"আরে আরে কি করছিস ভাই..

সাথে সাথে সবাই চেঁচিয়ে উঠলো...
"ভাবি...

নির্ঝর বলে উঠে,
"আরে আরে দিচ্ছি, দিচ্ছি, টাকা দিচ্ছি! তোরা থাম সবাই! 

তৎক্ষণাৎ থেমে গেল সবাই। জোরে জোরে হেসে উঠলো। নির্ঝর ফরহাদের দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে টাকা বের করে গুনতে লাগল। ঈশান চট করে টাকা গুলো ছিনতাই করে দৌড়। তার পিছু পিছু সবাই দৌড়। নির্ঝর চেয়েও কাউকে আটকাতে পারল না। তার সব টাকা নিয়ে সবাই উধাও!

নির্ঝর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে ঢুকবে এখন! দরজা দিকে হাত বাড়াতেই তার হাত কাঁপতে লাগল। নির্ঝর নিজের হাত ঝাড়া দিল। ব্যাপার কি হাত কাঁপছে কেন তার। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল হাতের দিকে। হুট করেই মনে পড়ল তার হার্টবিট বাড়ছে। আশ্চর্য! কি হচ্ছে এসব। কেমন অন্য এক অনুভূতি! 

নির্ঝর মাথা ঝাকালো। ধুর! কি ভাবছে এইসব। এমন তো কিছু না। এই বিয়েটা শুধু'ই ১ বছরের জন্য! এরপর মেহু চলে যাবে তাকে ছেড়ে। এর মানে, এখন তার এসব ভাবা একদম নিরর্থক! 

কিন্তু ভাবলে সমস্যা কি? হুট করেই কথাটা মাথায় চক্কর দিল। নির্ঝর হাত দিয়ে নিজের মাথায় বাড়ি মারল। বলতে লাগল,

"পাগল হয়ে গেছিস নির্ঝর! 

হুট করেই দরজা খোলার শব্দ এলো। দরজা ভেতর থেকে খুলছে। নির্ঝর তাকিয়ে দেখল মেহেরিন দরজার অপাশে দাঁড়ানো। নির্ঝর পা থেকে মাথা অবদি দেখতে লাগাল তাকে। চোখ আটকে গেল তার চোখে। তার হরিণী চোখের মায়াজালে আটকে গেল নির্ঝর। ঘোর কাটল মেহুর আওয়াজে,

"নির্ঝর! 

আনমনে বলে উঠে,
"হুম! 

"ডাকছিলেন আমায়!

"হুম!

"কেন?

নির্ঝরের হুশ ফিরল। বলে উঠে,
"কই নাতো! তোমায় ডাকি নি আমি।

"এই যে বললেন হ্যাঁ! 

"না মানে কিছু না। তো তুমি এখানে কিছু বলবে!

"হুম! আসলে...

বলেই মেহেরিন ঘরের ভিতর চলে গেল। নির্ঝর গেলো তার পিছু পিছু। নির্ঝর তাকিয়ে রইল পুরো ঘরের দিকে। নিজের ঘর এটা চিনতেই তার কষ্ট হচ্ছে। কি চমৎকার লাগছে পুরো ঘর। মেহেরিন কিছু বলতে নিবে, নির্ঝর তখন'ই বলে উঠে,

"এক রুমে ঘুমাবে, এই তো। তুমি চিন্তা করো না আমি পাশের রুমেই ঘুমাবো। তোমরা দুজন থাকো এখানে।

বলেই নির্ঝর দরজার দিকে আগাতে নেয়। মেহেরিন তখন বলে উঠে,

"না! 

নির্ঝর দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকায় মেহেরিন'র দিকে..
"হুম!

"মানে আপনি এই রুম থেকে বের হবেন না। এখানেই থাকবেন।

"তোমার সাথে!

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
"আমাদের সাথে! 

বলেই ইশারা ঘরে বিছানার দিকে। নির্ঝর তাকিয়ে দেখে বিছানার অর্ণব ঘুমিয়ে আছে। নির্ঝর বলে উঠে,

"ওহ তাই তো। তোমাদের সাথে!

মেহেরিন দুই হাত বাহুতে গুঁজে বলে,
"কিন্তু তার আগে একটা কাজ করতে হবে।

"কি কাজ? 

"বিছানার এই ফুল সরানোর কাজ। অর্ণব এসবের মাঝে ঘুমাতে পারবে না।

"কিন্তু আমার হাত তো..

"আপনাকে করতে বলি নি। আপনি অর্ণব কে নিয়ে সোফায় বসুন। ঘুমের মাঝে হামাগুড়ি খাওয়া ওর অভ্যাস। পরে গেলে আরেক বিপত্তি! 

নির্ঝর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল। অতঃপর অর্ণব কে নিয়ে এসে বসল সোফায়। তাকিয়ে দেখতে মেহুর কাজ। 

মেয়েটা খুব চটপটে! দ্রুতই নিজের সাজগোজ খুলে ফেলল। সোফায় থাকা একটা শাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে। দ্রুত বের ও হয়ে গেল। নির্ঝর অবাক হয়ে দেখতে লাগল। ভেজা চুল গুলোই খোঁপা বেঁধে নিল। বিছানার সব ফুল সরালো তাও খুব যত্ন করে। লাল টকটকে শাড়িতে মেহুকে"ই একটা ফুটন্ত ফুল লাগছিলো। মনে হচ্ছিল এক ফুল সরাচ্ছে আরেক ফুল কে! 

নির্ঝরের কাছে এসে অর্ণব কে কোলে তুলে শুইয়ে দিল বিছনায়। আবার জাগালো তাকে। তার পোশাক পাল্টে দিয়ে আবারো বিছনায় দিতেই অর্ণব ঘুম। শুধু একটি নজর নির্ঝর কে দেখে ড্যাডি বলে ডাক দিল।

নির্ঝর মেহেরিন কে না বলেই বাইরে গেল। মেহেরিন অর্ণব কে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে নির্ঝর উধাও। কথাটা এতো মাথায় নিলো না। অর্ণবের দু পাশে কোল বালিশ রেখে ফোন নিয়ে চলে এলো বেলকনিতে। কোন ইম্পর্ট্যান্টে মেসেজ থাকতে পারে তার জন্য!

খানিকক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দে পেছনে তাকাল মেহেরিন। তোয়ালে নিয়ে এক দিয়ে মাথা মুছছে সে। অন্য হাত টা ব্যান্ডেজ করা। বাসর রাতে কোন ছেলে এমন ও থাকে তার জানা ছিল না। 

নির্ঝর অর্ণবের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মেহুর কাছে এলো। মেহেরিন বলে উঠে,

"চেঞ্জ করতে গিয়েছিলেন।

"হুম ভাবলাম আমার সুযোগ তাই! ফরহাদ হেল্প করল।

"ওহ!

"খাবে কিছু?

"না আমার ক্ষিদে নেই।

"তো,‌ঘুমাবে না।

"হুম দেরি হবে, আপনি গিয়ে শুয়ে পড়ুন অর্ণবের পাশে।

"কোন পাশে ঠিক বলোতে!

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নির্ঝর হেসে বলল,
"না মানে ডান পাশে নাকি বা পাশে! 

"যে পাশে ইচ্ছে হয় গিয়ে শুয়ে পড়ুন।

"আচ্ছা! 

বলেই নির্ঝর এক পা আগাল। আবারো এক পা পিছিয়ে এসে বলল,
"তুমি কিন্তু একটা মতবলবাজ মেয়ে!

মেহেরিন কথাটা শোনার পর থমকে গেল। এটা নিরু দি বলতো। নির্ঝর বলে উঠে,
"না মানে.. তোমার সাথে এক রুমে থাকতে বললে তো তাই। নিশ্চিত এর মাঝে কোন মতলব আছে বলে মনে হচ্ছে।

মেহেরিন ফোনের দিকেই তাকিয়ে,
"কোন মতলব নেই, বাড়ি ভর্তি মেহমান! কেউ দেখে ফেললে হাজারো কথা উঠতো তাই!

"ওহ আচ্ছা!

"হুম!

নির্ঝর মাথা নেড়ে এবার দুই পা আগালো। কিন্তু পরক্ষণেই দুই পা পিছিয়ে আবারো এলো। মেহেরিন নির্ঝরের আসাটা অনুভব করল। তবুও কিছু বলল না। নির্ঝর'ই কিছুক্ষণ পর বলে উঠে,

"আচ্ছা তোমার ঘুমাতে কতোক্ষণ লাগবে।

"অনেকক্ষণ!

"আর কতোক্ষণ এখন তো প্রায় মাঝরাত! ভোর অবদি জাগবে।

"জানি না!

"আচ্ছা তুমি কি আজ ঘুমাবে না।

"জানি না!

"আচ্ছা! 

বলেই নির্ঝর আগাল। এবারও পিছুতে যাবে তখন'ই মেহেরিন ফিরল। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

"সমস্যা কি বলুন তো!

"সমস্যা আমার না তোমার হবে।

"মানে!

"মানে হলো! 

বলেই নির্ঝর মেহেরিন'র কাছে এলো। হুট করেই মেহেরিন'র চুলের খোঁপা টা খুলে দিল। মেহেরিন একটু অবাক হলো। নির্ঝর বলে উঠে,

"ভেজা চুল বেঁধে রাখলে চুল নষ্ট হয়ে যাবে। তবে তোমার চুল গুলো সুন্দর! 

মেহেরিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নির্ঝরের দিকে। শীতল বাতাস বয়ে গেল। মেহেরিন'র ভেজা চুল গুলো এসে তার মুখে বাজল। নির্ঝর হেসে মেহেরিন'র চুল গুলো কানে গুঁজে দিয়ে মেহেরিন'র চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

"আর বিশেষ ভাবে তোমার হরিণী চোখ নজরকাড়ানো! 

মেহেরিন সেই হরিণী চোখের পাতা ফেলে ফেলে নির্ঝর কে দেখতে লাগল। নির্ঝর হেসে বলল,

"গুড নাইট মেহু! 

বলেই নির্ঝর চলে গেল। মেহেরিন সেদিকেই তাকিয়ে রইল। নির্ঝর এসেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর তৎক্ষণাৎ ঘুমে ঢোলে পড়ল। মেহেরিন রুমে এসে দেখে নির্ঝর আর অর্ণব দুজন দুটো কোলবালিশ আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মেহেরিন ঘরের বাতি নিভালো। এসে আবার দাঁড়াল বেলকনিতে। আজ রাতেও রাত জাগা পাখি হয়ে জেগে থাকবে সে। ঘুম আসবে না আজ রাতেও। আর মেহেরিন ঘুমাতেও চায় না। রাতের আকাশের তারা গুনেই আজকের রাত টা পার করবে সে! আকাশ টা আজ পরিষ্কার। খুব সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে আজ আকাশে। হয়তো আকাশ টাও জানতো আজ রাত তার সঙ্গী হবে চাঁদ! এই চাঁদের সাথে গল্প করেই শেষ হবে এই রাত..

#চলবে....
[+] 3 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#24
#পর্ব_১৬

হাতে যন্ত্রণা হবার কারণে খুব ভোরে ঘুম ভাঙর নির্ঝরের। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখে অর্ণব ঘুমের ঘোরে তার হাতের উপর হাত রেখেছে। নির্ঝর আধশোয়া হয়ে অর্ণবের থেকে নিজের হাত টা সরালো খুব সাবধানে, যাতে অর্ণবের ঘুম না ভাঙে। অতঃপর বিছনার ওপাশে তাকাল। ওপাশটা খালি দেখে নির্ঝরের ঘুমের ঘোর কেটে গেল। রুমের এপাশ ওপাশ তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না। ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে দেখে ৫.৩৫ বাজে। এতো ভোরে কি তবে উঠে পড়ে মেহু! 

নির্ঝর বিছানা ছেড়ে নামল। ওয়াশরুমের দিকে গিয়ে দরজা নক করলো। না ভেতর থেকে কোন সাড়া পাচ্ছে না তার মানে মেহু ওয়াশরুমে নেই। নির্ঝর বিছানার কাছে এসে ভাবতে লাগল। নির্ঝর বিছানা ছেড়ে উঠে যাবার কারণে অর্ণব গড়াগড়ি করতে করতে বিছানার কিনায় এসে পড়ে। নির্ঝর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বিছানার দিকে তাকায়। অর্ণব আবারো হামাগুড়ি খাচ্ছে। এখন'ই পড়ে যাবে নিচে। নির্ঝর চট করেই ধরে ফেল অর্ণবের হাত খানা। তাকে উপরে শুয়ে দিয়ে বিছানার পাশে কোলবালিশ টা রাখে!

"মেহু ঠিক'ই বলেছে, ছেলেটা ঘুমের মাঝে একটু বেশিই হামাগুড়ি খায়। আরেকটু হলেই পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেত তখন কি হতো! 

চাপা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
"কিন্তু মেহু, এই মেয়ে টা আবার কোথায় গেল। আমার তো মনে হচ্ছে না রাতে একবারের জন্য হলেও এই রুমে এসেছিল সে। রুমে যখন আসে নি তখন কোথায় থাকবে... বেলকনিতে!

নির্ঝর উঠে বেলকনির দিকে এলো। অনেকটা অবাক হলো দেখে, লাল শাড়ি পড়া একটা মেয়ে বেলকনির এক কোনায় মেঝেতে বসে আছে। খুব গুটিয়ে বসে আছে সে। দুই হাটু উঠিয়ে তার মাঝে হাত রেখে দেওয়ালের মাথা ঠেকিয়ে। পরক্ষনেই নির্ঝর বুঝল সে ঘুমাচ্ছে। নির্ঝর ধীরে ধীরে তার দিকে আগাল। নিচে বসল তার পাশে। চুলে পুরো মুখ ঢেকে আছে তার। নির্ঝর হাত দিয়ে তার চুল গুলো সরিয়ে মুখ টা দেখতে চাইলো। এতেই নড়েচড়ে উঠলো সে। নির্ঝর ঘাড়বে গেল। না সে চায় না এই মেয়ে উঠে যাক। এভাবে স্থির ভাবে তাকে দেখতে ভালো লাগছে তার। 

কখন থেকেই এই মেয়ে এই মেয়ে করে যাচ্ছে। একটা নাম কি তার প্রাপ্য নয়? কি নাম দেবে তার। হুমায়ূন আহমেদ'র গল্পে পড়া একটা নাম মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নিশিকন্যা! হ্যাঁ এই নামটা মিলে যায় তার সাথে। এই নিশিকন্যা এখানে সারারাত জেগে ছিল। হয়তো শেষ রাতে দু চোখের পাতা এক করবার সৌভাগ্য হয়েছিল তার। তাইতো এতো গভীর ঘুমে আছে সে। 

নির্ঝরের খুব ইচ্ছে করল তার এই নিশিকন্যা কে ছুঁয়ে দেখতে। তাকে দেখতে মনে হচ্ছে একটা সদ্য আঁকা ছবি! তবে এই ছবিতে মনে হচ্ছে প্রাণ আছে। সাধারণত ছবির সৌন্দর্য তার সামনে দাঁড়িয়ে নিতে হয়। আবার খুব সুন্দর ছবি হলে ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু তার কি মনোভাব এটা এখনো ঠিক করতে পারছে না। হাতটা এগিয়ে মুখের কাছে নিতেই গরম নিঃশ্বাস পড়ল হাতে। সরিয়ে নিল হাত টা। না কাউকে এভাবে ছোঁয়া যায় না। এ তো আর ছবি না যে দেখলে দোষ হবে না। ইশ্ খুব আফসোস হচ্ছে কেন একটা ছবি হলো সে। বিভিন্ন রঙের তুলি দিয়ে আঁকা একটা ছবি। সে ছবি ছুঁয়ে দেখতে কারো অনুমতির প্রয়োজন পড়ত না। 

তার পাশে খুব সাবধানে বসে পড়ল নির্ঝর। অতঃপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকালো আকাশের দিকে। ভোর হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো।‌‌ পাখিরাও জেগে গেছে, তাদের ভোরের গানও শুরু হয়ে গেছে। নির্ঝরের ইচ্ছে করল পাখি গুলোকে গিয়ে বলে আসতে তাদের গান যেন একটু নিচু স্বরে গায়। নাহলে যে এই নিশিকন্যা জেগে যাবে ঘুম থেকে। 

শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। নির্ঝরের নিশিকন্যার চুল গুলো আবারো এলোমেলো হয়ে গেল। তবে নির্ঝর আর সেটা সরালো না। সে খুব বড় করে হামি ছাড়ল। আবারো ঘুম ঘুম পাচ্ছে তার। খেয়াল করল নিশিকন্যার মাথা রাখার জন্য একটা ঠাঁই চাইছে। নির্ঝর আরেকটু ঠেসে বসল তার সাথে। সে মাথা রাখল তার কাঁধে। নির্ঝর মুখ টিপে হাসল যাতে শব্দ না হয়। এ কেমন অনুভূতি! মেহুর কাছে আসলে মনে হতো তার হার্টবিট এতো জোরে বাড়ছে যে সে হার্কফেল করবে। কিন্তু এখন যে সে তার এতো কাছে, তখনই তার মন শান্ত হয়ে গেল। কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে সবকিছু! সময় কেন থমকে যাচ্ছে না এখানে। মনে হয় এভাবেই সারাটি জীবন পার করতে রাজি সে! আকাশের দিকে তাকাতেই চোখ দুটো বুজে আসল তার। মনে হচ্ছে ঘুমের রাজ্য থেকে সব ঘুম এসে জড়ো হলো তার চোখে। মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়ল নির্ঝর! 
.
"এতো কষ্ট করে বাসর ঘর সাজালাম আমরা, আর এই দুজন দেখছি এখানে বসেই সারারাত পার করে দিল। 

ঈশান সবে ঘুম থেকে উঠেছে। ফরহাদের কথা শুনে দুই হাত উপরে উঠিয়ে টান টান করতে করতে বলে,

"নিশ্চিত সারারাত বসে গল্প করেছে দুজন। 

আরিফ অর্ণব'কে কোলে করে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে হেসে দিল। ব্যাপারটা বেল লজ্জাজনক। ফরহাদ কি মনে করে একটা ছবি তুলল তার ফোনে। অর্ণব বলে উঠে,

"মাম্মি, ড্যাডি! 

আরিফ অর্ণব কোল থেকে নামিয়ে বলে,
"দেখলে অর্ণব তোমার ড্যাডি, মাম্মি'র কাহিনী। দুজন এখানে একসাথে সারারাত কাটালো তোমাকে একা রেখে! 

অর্ণব আরিফের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর মেহেরিন'র কাছে গিয়ে ডাকতে লাগল,

"মাম্মি, মাম্মি! 

মেহেরিনের কানে এতোক্ষণ সবার গুনগুন শব্দ কানে এলেও নিছক স্বপ্ন ভেবে ঘুমের ঘোরে ছিল। কিন্তু অর্ণবের গলার স্বর পেয়ে চোখ খুলল সে। মিটিমিটি চোখে সামনে তাকিয়ে দেখল সবাই এখানে। তার সামনে দাঁড়ানো অর্ণব! মেহেরিন ভ্রু কুঁচকালো। এবার স্পষ্ট দেখতে পারছে সে। সবাই তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে! মেহেরিন বুঝতে পারল না সবাই হাসছে কেন। 

পরক্ষনেই অনুভব করল সে কারো ঘাড়ে মাথা দিয়ে আছে। মুহুর্তেই মেহেরিন মাথা উঠালো। পাশে তাকিয়ে নির্ঝর কে দেখে ভড়কে গেল সে। এ কি করে হয়? উনি এখানে এলো কখন? মেহেরিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নির্ঝরের দিকে। তবে কি তার ঘাড়েই মাথা রেখে এতোক্ষনে ঘুমিয়েছিল সে! 
সবার হাসির রহস্য উদঘাটন করল মেহেরিন এতোক্ষণে! একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

"গুড মর্নিং ভাইয়া! 

"হাম এখন তো তোমাদের গুড মর্নিং'র সময়। আমাদের জন্য তো বেড মর্নিং!

"এভাবে বলছেন কেন? 

আরিফ বলে উঠে,
"বলব না কেন? তোমাদের এতো ভালোবাসা দেখে হিংসে হচ্ছে কেন আগে আমরা বিয়ে করলাম না।‌

"হিংসে না করে একটা বিয়ে করে ফেলুন দেখি। তাহলে আর ভালোবাসার অভাব হবে না! 

ফরহাদ হেসে দিল মেহেরিন'র কথা শুনে! 

ঈশান বলে উঠে,
"অর্ণব বাইরে এসে তোমাদের খোঁজ না করলে তো আমরা জানতেই পারতাম না, তোমরা দুজন এখানে। 

মেহেরিন অর্ণবের দিকে তাকাল। তার মুখটা মলিন হয়ে আছে। ঘুম থেকে উঠে মাম্মির চেহারা দেখতে না পেয়ে বেচারা ভয় পেয়েছিল। অতঃপর বাইরে এসে মাম্মি কে খুঁজছিল বোধহয়। আর তখন'ই ফরহাদ তারা সবাই রুমে এসে দেখল বেলকনিতে এরা দুজন ঘুমিয়ে আছে।‌

মেহেরিন উঠে দাঁড়াল। অর্ণবের কপালে চুমু খেয়ে তাকে কোলে তুলে নিল। ফরহাদ বলে উঠে,

"আরে উঠে পড়ে যে, মনে হচ্ছে আমরা ডিস্টার্ব করেছি তোমাদের।

"না ভাইয়া, ঠিক সময়ে এসেছেন।

আরিফ বলে উঠে,
"তুমি তো উঠে গেলে, এখন এই হাত ভাঙার কি করব! 

মেহেরিন হেসে বলল,
"যা ইচ্ছে করুন!

বলেই মেহেরিন চলে গেল। ঈশান উঠে এক মগ জল এনে ঢেলে দিলে নির্ঝরের গায়ে। নির্ঝর হতচকিয়ে উঠলো! বেশ ভয় পেয়েছে সে। তাকে এভাবে দেখে সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। কেবল নির্ঝর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল! 
.
দুপুরের দিকে খাবার দাবারের পর নির্ঝর আর মেহেরিন এসে উঠল খান বাড়িতে। মেহেরিন অনেক অবাক হয়েছে নির্ঝরের কাহিনী দেখে। মেয়েরাও হয়তো বিয়ে করলে বাপের বাড়ি থেকে এতো জিনিস আনে না যা নির্ঝর এনেছে। পুরো এক গাড়ি ভর্তি জিনিসপত্র। নির্ঝরের ঘরের সব কিছু মনে হয় সাথে নিয়ে এসেছে। মেহেরিন কিছু বলতে গিয়েও বলল না। 

মিস মারিয়া মেহেরিন, নির্ঝর আর অর্ণব কে দেখে অনেক খুশি হলো! মেহেরিনরের পাশের রুমটা ঠিক করা হয়েছে নির্ঝরের জন্য। নির্ঝরের জিনিসপত্র সেই ঘরে সেট নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অর্ণব কে মিস মারিয়া'র কাছে রেখে এসব দেখছে মেহেরিন। কি এসব! অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস এনেছে নির্ঝর! যেমন তার ঘরের কোলবালিশ! এটা কি? এসব আনার কি কোন দরকার ছিল। কিছু ম্যাগাজিন, জামাকাপড়, গিটার এরকম আরো অনেক কিছু! মেহেরিন দেখল বাক্স ভরে বিয়ারের বোতল ঢুকছে। সে চোখ বড় বড় করে বলল,

"এসব ঢুকবে না এই বাড়িতে! 

নির্ঝরের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। সে চেয়ে রইল মেহেরিন'র দিকে। মেহেরিন মুখ ঘুরিয়ে বলল,

"আমি যখন বলেছি না তখন না! 

বলেই চলে যেতে নিবে তখন দেখল আরেক সার্ভেন্ট আইসক্রিম"র বাক্স নিয়ে ঢুকছে। মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর মুখটা মলিন করে ফেলল। মেহেরিন আইসক্রিম'র বাক্স খুলে দেখল তাতে বিভিন্ন রকমের আইসক্রিম! তবুও খান্ত হলে না সে। আইসক্রিম'র বাটি খুলে দেখল আসলেই আইসক্রিম কি না। নির্ঝর বিষণ্নভাবে বলল,

"এগুলো সত্যি আইসক্রিম! 

"এগুলোও আনতে হয়!

"আমার এগুলো ভালো লাগে তাই এনেছি!

সার্ভেন্ট কে উদ্দেশ্য করে বলল,
"এগুলো নিয়ে ভেতরে ফ্রিজে রেখে দাও কিন্তু একটা বিয়ারের বোতল যেন ঘরে না ঢুকে!

নির্ঝর বলে উঠে,
"বিয়ারের বোতল আনতে পারব না এটা কি কোথায় লেখা ছিল নাকি।

"আনতে পারবেন তা কি কোথায় লেখা ছিল নাকি।

"মেহু!

"কোনমতে না!

বলেই বেরিয়ে গেল মেহেরিন। সার্ভেন্টও মালকিনি'র  আদেশ মতো বাইরে যেতে নিল। নির্ঝর তখন হুট করেই এক বোতল বিয়ার নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল! 

রিসেপশনের অনুষ্ঠান মেহেরিন আপাতত দিতে চায় না। অর্ণব এতো কিছু সামলাতে পারবে না সে জানে।
নির্ঝর নিজের ঘরে এসে মুখ হাত টা ধুয়ে বিছনায় সবে বসল। ধপাস করে শুয়ে পড়ল বিছানায়! ঘরের জিনিসপত্র ঘরে আনায় এখন ঘর টাকে নিজের ঘরের মতোই লাগছে। এমনকি তার ঘরের নকল ফুলের গাছ টাও এনেছে নির্ঝর! এছাড়া একটা আসল ফুল গাছও এনেছি। আর তা হলো বেলি ফুলের গাছ। এ ফুল খুব প্রিয় নির্ঝরের। গাছ টা তার বাড়ির বাগানে ছিল। সেখান থেকেই নিয়ে এসে বেলকনিতে রেখেছে। মেহেরিন'র নজর এখনো গিয়ে পড়ে নি তাতে। 

ঘরের দরজা টা মনে হলো খুলছে। নির্ঝর একটু উঁকি মেরে তাকাল। দেখল অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। নির্ঝর হেসে বলল,

"অর্ণ সোনা এখানে আসো! 

"ড্যাডি! 

বলেই দৌড়ে এসে পড়ল নির্ঝরের কাছে। উঠে বসে পড়ল নির্ঝরের কোলে। অর্ণব আবারো হেসে বলল,

"ড্যাডি! 

নির্ঝর হেসে অর্ণবের কপালে চুমু খেল। পকেট থেকে চকলেট'র প্যাকেট টা দিল অর্ণব কে। অর্ণব তা হাতে গুটিয়ে নিল। নির্ঝরের ঘর কে দেখতে লাগল মনোযোগ দিয়ে। নির্ঝর অর্ণবের মাথায় হাত রেখে বলল,

"অর্ণ সোনা কি ভাবছে, ড্যাডি এ ঘরে কেন?

অর্ণব মাথা নাড়লো।

নির্ঝর হেসে বলল,
"আসলে কি বলোতে অর্ণ, ড্যাডি আর অর্ণব যখন ঘুমাবে তার আগে তারা অনেক লাফালাফি করবে। নাচবে, হইচই করবে তাই না!

অর্ণব মাথা নাড়ল। 

নির্ঝর এক হাত দিয়ে অর্ণব কে জরিয়ে ধরে বলল,
"তখন যদি মাম্মি সেই ঘরে কাজ করে তাহলে তার কাজের অসুবিধা হবে না। তাই তো যখন মাম্মি কাজ করবে তখন ড্যাডি আর অর্ণ সোনা এখানে ঘুমাবে ঠিক আছে!

অর্ণব এক গাল হেসে মাথা নাড়ল। নির্ঝর অর্ণবের চকলেট'র প্যাকেট খুলে দিল। তখন গাড়ি'র শব্দ এলো। নির্ঝর অর্ণব কে‌ নামিয়ে উঠে দাঁড়াল। অর্ণবের হাত ধরে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে দেখল গাড়ি ঢুকছে বাড়িতে। এ সময় কে এলো? নির্ঝর ভ্রু কুঁচকালো। অর্ণব চকলেট মুখে রেখে বলে উঠে,

"নিলব ( নিরব ) 

বুঝতে অসুবিধা হয় না নির্ঝরের। খানিকক্ষণ পর নিরব বের হয় গাড়ি থেকে। নির্ঝর মিন মিন স্বরে বলে,
"বাড়িতে এসে পা রাখতে না রাখতে শয়তান এসে হাজির! 

নির্ঝরের কথা অর্ণব না শুনতে পেলেও তার দিকে তাকাল। নির্ঝর হেসে বলল,

"তোমার ভালো লাগে নিলব কে?

অর্ণব মাথা নেড়ে না না করল। 

নির্ঝর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
"এই তো আমার ছেলে! যা হোক ড্যাডি'র পছন্দ না তা অর্ণবের ও পছন্দ হবে না। কিন্তু..

বলেই হাঁটু গেড়ে বসল। অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল,
"যা অর্ণবের ড্যাডির পছন্দ না তা অর্ণবের মাম্মির বেশ পছন্দ!

অর্ণব দাঁত বের করে হেসে দিল! অতঃপর..

#চলবে....
[+] 3 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#25
#পর্ব_১৭

অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল,
"যা অর্ণবের ড্যাডির পছন্দ না তা অর্ণবের মাম্মির বেশ পছন্দ!

অর্ণব দাঁত বের করে হেসে দিল! অতঃপর নির্ঝর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অর্ণবের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

"চলো দেখে আসি, এই নিলব আবার কি করে? 

অর্ণবও সাথে সাথে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। নির্ঝর অর্ণবের হাত ধরে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। বসার ঘরের কাছে এসে দেখতে পায় না কাউকে। নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে বলে,

"নিলব টা গেল কোথায়? 

অর্ণব নির্ঝরের শার্ট ধরে টান দেয়। অতঃপর হাত দিয়ে ইশারা করে মেহেরিন'র বেড রুম দেখায়। নির্ঝর অবাক চোখে বলে,

"সোজা বেড রুমে চলে এসেছে! 

গম্ভীর মুখে আগায় মেহেরিন'র বেড রুমের দিকে। ভেতর থেকে কথা বলার আওয়াজ আসছে। দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে নির্ঝর তার বেশ শুনতে পারছে। নির্ঝর দরজায় আড়ি পাতল‌। নির্ঝরের দেখা দেখি অর্ণবও আড়ি পাতল।ভেতর থেকে নিরবের কথা শোনা যাচ্ছে,

"এমন একটা ডিসেশন নেওয়া কি ঠিক হয়েছে তোর!

মেহেরিন বলছে,
"তাহলে তুই বলছিস সারাজীবন কেঁদে ভাসিয়ে দিতাম।

নির্ঝর ভাবতে লাগল কার কথা বলছে। কার জন্য কাঁদবে মেহু! 

"আমি তা বলি নি মেহু!

নির্ঝর চোখ দুটো ছোট ছোট করে নিম্ন স্বরে বলে,
"মেহু বলল! 

মেহেরিন বলে উঠে,
"তা হলে কি? 

"ছেলে টা কে বেশ সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না। অর্ণবের কথা কিছু ভেবেছিস। কিভাবে মানিয়ে নিবে ওর সাথে! 

নিরবের কথায় নির্ঝর মুখ ভেংচি কাটল। অর্ণব মাথা তুলে নির্ঝর কে দেখতে লাগল। মেহেরিন বলে উঠে,

"অর্ণবের জন্য'ই এই বিয়ে করা। নির্ঝরের সাথে অর্ণব বেশ ভালো করে মানিয়ে নিচ্ছে।

"সারাজীবন থাকবি বলে ভেবে নিয়েছিস!

"না শুধু এক বছরের জন্য'ই। একবছরে অর্ণব ইনপ্রুভ করলে চলে যাবো ওকে নিয়ে। আচ্ছা তুই বল, এতোদিন তো কানাডায় ছিল। সেখানকার খবর কিছু..

নির্ঝর মুখ ঘুরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকাল। মেহেরিন আর নিরবের কথা তেমন শুনতে পারে নি সে। তবুও নির্ঝরের সাথে তাল মিলিয়ে ছিল সে‌। নির্ঝর অর্ণবের হাত ধরে সরে যায় দরজার সামনে থেকে। অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে তাকে।

দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। মেহেরিন আর নিরব বের হলো। অর্ণব মেহেরিন কে দেখে দৌড়ে তার কাছে গেল। মেহেরিন অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

" মাম্মি অফিসের কাজে একটু বাইরে যাচ্ছি অর্ণব। তুমি ড্যাডি'র সাথে থাকো! 

নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর কিঞ্চিত হাসল। মেহেরিন কে আজ অন্যরকম লাগছে। স্যুট'টা তার হাতে ঝোলানো। নির্ঝর চোখ ঘুরিয়ে তাকাল নিরবের দিকে। নিরব তাকেই দেখছিল। হুট করেই মৃদু হাসল সে। অতঃপর মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে বলল,

"আমি গাড়ি বের করছি! 

মেহেরিন মাথা নাড়ল। অর্ণব কে নিয়ে নির্ঝরের কাছে এলো। নির্ঝরের হাতের কথা জিজ্ঞেস করল। অর্ণব কে বলে গেলো নির্ঝর কে জেনো না জ্বালাতন করে। 

অফিসের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় মেহেরিন। খুব অদ্ভুত ভাবেই নির্ঝর জিজ্ঞেস করে বসে,

"কখন ফিরবে মেহু! 

মেহেরিন খানিকটা চমকে পেছনে ফিরল। তবুও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,

"রাত হবে তবে বেশি না। নিজের খেয়াল রাখবেন!

মাঝখানে অর্ণব বলে উঠে,

"টাটা মাম্মি! 

দু'জনের কথার অবশান ঘটল। মেহেরিন হাত নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দু'জনকে এক গাড়িতে করে বেরিয়ে যেতে দেখল নির্ঝর! 

------

নির্ঝরের ঘরে বিছানায় বসে ছবি একে চলেছে অর্ণব। নির্ঝর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ঘড়ির কাঁটা ৮ দিকের ছুঁই ছুঁই। ৮ টা হয়তো বেজে যাবে। ঘরটার চারদিকে চোখ বুলিয়ে হেসে দিল নির্ঝর। পুরোটা ঘর অগোছালো। এখন তার নিশ্চিত মনে হচ্ছে এটা তার'ই ঘর। পুরোটা ঘর জুড়ে খানিকক্ষণ আগেই দু বাপ ছেলে মিলে নেচেছিল! 

সন্ধ্যার সময় বেলী ফুল গাছে পানি দেবার কথাটা ভুলে গেল নির্ঝর। চট করেই তা মনে পড়ল। বিছানা ছেড়ে উঠে গেল বেলকনির দিকে। আলো না জ্বালানোর কারনে সবটা অন্ধকার! নির্ঝর আলো জ্বালিয়ে এক মনে গাছে পানি দিচ্ছে। ফুলের গন্ধে চারদিক মো মো করছে। সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সে ঘ্রাণ নিচ্ছে।

গাড়ি বাড়ির ভেতর ঢুকল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে অর্ণব‌ চট করে বিছানা থেকে নেমে দৌড় দিল। নির্ঝর ও চলল তার পিছু পিছু! মেহেরিন সবে বাড়িতে ঢুকল। তৎক্ষণাৎ কানে ভেসে আসলো মিষ্টি সেই গলায় আওয়াজ,

"মাম্মি, মাম্মি! 

এক গাল হেসে জরিয়ে ধরে অর্ণব কে। তার ছোট কপালে চুমু খেয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর মৃদু হাসল!

খাবার টেবিলে তিন জন বসে আছে। খাবার টেবিল টা অনেক বড়। তার এক কোণায় এই তিনজন দখল করে আছে। মিস মারিয়া খাবার পরিবেশন করে চলে গেছে। মেহেরিন একটু পর পর অর্ণবের মুখে খাবার দিচ্ছে আবার নিজেও খাচ্ছে। নির্ঝর আড়চোখে সবটা দেখছে। দেখতে অবশ্য ভালোই লাগছে। 

"দিন কেমন কাটলো তোমার?

"ভালো! 

আর কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। ফোনটা তখন'ই বেজে উঠলো। স্ক্রিনে মা নামটা ভেসে উঠলো। নির্ঝর টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেল। এই নিয়ে ৫ বার ফোন করেছে নীলিমা! ঘরের ছেলে দূরে থাকায় তার ঘরটা যেন শ্মশান ঘাট বলে মনে হচ্ছে। নির্ঝরের গলার আওয়াজে নীলিমা যেন প্রাণ ফিরে পেল!

"কি করছিস? খেয়েছিস! 

"খেতেই বসে ছিলাম।

"ওহ তাহলে খেয়ে নে পড়া কথা বলবো।

"না আমার খাওয়া প্রায় শেষ! তুমি কি করছো বলো!

"কিছু না।

"না না তা কি করে হয়, তুমি নিশ্চিত কিছু করছিল

"হাম, তো কি করছিলাম আমি।

"আমাকে মিস! আর কি? হুহ!

"তুই বাড়ি থেকে যাবার পর বাড়িটা পুরো শান্ত এখন জানিস।

"হাম একটু বেশিই শান্ত, তাই একদিন যেতে না যেতে ৫ বার ফোন করলে।

"আমি ফোন করি বলে তুই বিরক্ত হচ্ছিস।

"ওহ মম! তুমিও না।

নীলিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নির্ঝর ওপাশ থেকে বলে উঠে,

"ড্যাড এসেছে!

"না এখনো আসে নি।

"পুরো বাড়িতে তুমি একা কি?

"নাহ মানুষ জন তো আছে। কেন?

"থাকুক বাড়ির আসল লোক তো নেই। বাড়ির পেছনের দিক একদম যাবে না বুঝলে।

"কেন?

"আহ সেখানে একটা আম গাছ আছে।

"তো?

"আম গাছের পেত্নী তোমাকে নিয়ে যাবে আর সে আমার মম হয়ে আমার ড্যাডের সাথে সংসার করবে। একথা জানো না তুমি!

"নির্ঝর!

নির্ঝর জোরে জোরে হাসতে লাগলো! নীলিমা বুঝতে পারল ছেলে তার মন ভালো করার চেষ্টা করছে। একটা মাত্র'ই ছেলে তার। খুব আদরের ! আর যে কখনো সন্তান নেবার চেষ্টা করেনি তা না। কিন্তু সে আর মা হতে পারবে না। তো কি? এই একটা ছেলে নিয়ে কি জীবন পার করতে পারবে না।

-----

অর্ণব ঘুমিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। নির্ঝরের ঘরেই ঘুমিয়েছে তাকে জড়িয়ে ধরে। নির্ঝর একটা গল্পের বই শুনিয়েছিল তাকে। তাই শুনতে শুনতে'ই ঘুম! দরজায় কড়া নাড়ল মেহেরিন। নির্ঝর উঠে বসল। অর্ণব কে কোলে করে নিয়ে গেল নিজের ঘরে। নির্ঝর অবশ্য চেয়েছিল এখানেই থাক কিন্তু মুখে বলতে পারল না।

মেহেরিন যেতেই নির্ঝর বিছানার পাশ থেকে বিয়ারের বোতল টা বের করল। বিয়ারের বোতল টা মুখে দিতেই দরজা এবার নক ছাড়াই সরাসরি খুলে গেল। নির্ঝর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল মেহেরিন দাঁড়িয়ে আছে। নির্ঝর বিস্ফোরিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বিয়ারের বোতল টা নামিয়ে পেছনে নিল। ভাগ্যিস মেহেরিন ফোন টিপতে টিপতে ঢুকল।‌ তাই নির্ঝর কে খেয়াল ও করি নি। 

নির্ঝর হেসে বলে উঠে,

"আরে মেহু যে!

মেহেরিন এবার নির্ঝরের দিকে তাকাল।‌ অতঃপর পা বাড়িয়ে রুমে ঢুকল। নির্ঝর ধপ করেই বিছানায় বসে পড়ল। মেহেরিন ফোন ফোন টিপতে টিপতে সোফার কাছে এসে বসল। নির্ঝর বিয়ারের বোতল টা যেভাবে হোক লুকিয়ে মেহেরিন'র দিকে তাকাল‌। ঠিক তৎক্ষণাৎ মেহেরিন ও তাকাল তার দিকে। নির্ঝর নিজের হাত ধরে বলে উঠে,

"অ্যাআ আহ!

"কি হয়েছে?

"হাত টা ব্যাথা করছে খুব।

মেহেরিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
"হঠাৎ..

"হঠা..হঠা.. হঠাৎ.. না হঠাৎ না তো।

"তাহলে এতোক্ষণ তো ব্যাথা ছিল না। আপনার তো হাতে নাড়াচাড়া বারণ। কি করতে যাচ্ছিলেন

নির্ঝর চোখ মুখ শক্ত করে মেহেরিন'র দিকে তাকাল। মেহেরিন'র নির্ঝরের কাছেই আসতে লাগল। নির্ঝর চট করে উঠে মেহেরিন'র সামনে দাঁড়িয়ে গেল।‌ মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

"ব্যাথা কি খুব বেশি, ডাক্তার কে ফোন করব।

"না না এতো বেশি না।

"আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন!

"হ্যাঁ হ্যাঁ বসছি! 

নির্ঝর গিয়ে সোফায় বসল। মেহেরিন বলে উঠে,

"সোফায় বসছেন কেন? বিছানায় আরাম করে বসুন। 

"না আম.. আমি এখানে ঠিক আছি।

নির্ঝর এসে মেহেরিন'র পাশে বসল। চুল গুলো কানে গুঁজে নির্ঝরের হাত ধরল। নির্ঝর অভিনয় করে চেঁচিয়ে বলল,

"আস্তে আস্তে!

"কেন নড়াচড়া করতে গেলেন বলুন।

"দরকার ছিল তাই।

"কিসের এতো দরকার। আমি ছিলাম আমাকে বলতে পারতেন। 

"না তোমাকে বলা যাবে না।

"কেন বলা যাবে না।

"আমম এমনেই।

"মানে।

"কিছু না

"কি লুকাচ্ছেন আপনি।

মেহেরিন'র কথা শুনে নির্ঝরের মনে হলো গলা শুকিয়ে গেল। সে শুকনো ঢোক গিলে বলল,

"এভাবে বলবে না।

"আপনি এমন করছেন কেন? কি এমন জিজ্ঞেস করলাম আমি।

নির্ঝর মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। মেহেরিন নির্ঝরের দিকে তাকাতে গেলো সে আবারো মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। কারণ সে ভয় পাচ্ছ। মেহেরিন বিছানার কাছে গেলে বিয়ারের বোতল দেখলেই সর্বনাশ! না এই ভাঙা হাতেই তাকে ঘর বের করে দেয়। 

মেহেরিন উঠে দাঁড়াল। বলে উঠে,

"আপনি বসুন, আমি ঔষধ নিয়ে আসছি। ঔষধের সময় হয়ে গেছে।

নির্ঝর সাথে সাথে মেহেরিন'র দিকে ঘুরল। অতঃপর তাকাল বিছানার দিকে। ঔষধ বাক্সের পেছনেই বিয়ারের বোতল। এখন মেহেরিন সেখানে গেলে তো সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। নির্ঝর চট করে উঠে দাড়িয়ে বলে,

"আমি তো ঔষধ খেয়ে নিয়েছি

"ঔষধ খেয়েছেন!

"হ্যাঁ আমি খেয়ে নিয়েছি!

"ওহ আচ্ছা! তাহলে ঘুমিয়ে পড়ুন ঠিক আছে! আর যন্ত্রণা কি এখনো করছে না কমেছে

"না না যন্ত্রণা কমে গেছে, তুমি বরং চলে যাও। আমি এখন ঘুমাবো, খুব ঘুম পাচ্ছে আমার!

"হ্যাঁ আমি...

বলার আগেই নির্ঝর মেহেরিন কে টেনে ঘর থেকে বের করে দেয়। অতঃপর জলদি বিয়ারের বোতল টা সরিয়ে আলমারি তে রেখে দেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ইশ কতো বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছে সে। 

নির্ঝর চেঞ্জ করার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠে। আয়নার‌ সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় একবার ডানে নেয় আরেকবার বামে। আলমারির কাছে গিয়ে নাইট ড্রেস বের করে। অতঃপর ধীরে ধীরে গায়ের শার্টের বোতাম খোলে। শার্টের আর্ধেক শরীর থেকে আলাদা করার বাকি আর্ধেক আলাদা করতে পারে না সে। হাতের ব্যাথার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। এরকম আর্ধেক শার্ট পরেই বসে থাকে বিছানায়।‌ বাড়িতে থাকতে ড্যাড সাহায্য করতো কিন্তু এখন কাকে বলবে সে! এসব ভেবেই নির্ঝর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। 

দরজা খোলার শব্দ আবারো পায় নির্ঝর। দাঁড়িয়ে দেখে মেহেরিন! মেহেরিন নির্ঝর কে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয়। নির্ঝর খানিকক্ষণ মেহেরিন'র দিকে তাকানোর পর বুঝতে পেরে সাথে সাথে ঘুরে যায়। নির্ঝর চোখ বন্ধ করে বলে উঠে,

"কি শুরু করেছ কি মেহু! একটু পর পরই..

"আমার ফোন নিতে এসেছিলাম। আমাকে বের করে দিয়েছেন কিন্তু ফোন তো নিতে দেন নি!

বলেই মেহেরিন সোফার কাছ থেকে ফোন টা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

"আচ্ছা আপনার এই অবস্থা কেন? এভাবে আর্ধেক শার্ট পড়ে বসে আছেন যে।

নির্ঝর বিরক্ত হয়ে ঘুরে বলে,
"আর্ধেক শার্ট পড়ে বসে থাকি নি। খোলার চেষ্টা করছি আর এতোটুকুই সফল হয়েছি।

"কেন?

"এই! আমার হাতের কারণে। বাসায় থাকতে ড্যাড সাহায্য করতো কিন্তু এখন..

"আমি হেল্প করবো!

নির্ঝর এক পা পিছিয়ে পা জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে বলে,
"না না! 

মেহেরিন চোখ ঘুরিয়ে এগিয়ে নির্ঝরের কাছে আসতে থাকে। নির্ঝর পিছুতে পিছুতে ধপাস করে পড়ে যায় বিছানায়। মেহেরিন নির্ঝর সামনে দাড়িয়ে মুখ ভেংচি কেটে নির্ঝর হাত ধরিয়ে উঠে বসায়। অতঃপর নির্ঝরের আর্ধেক পড়া থাকা শার্ট টা খুলার চেষ্টা করে। নির্ঝর নড়াচড়া শুরু করে দেয় আর বলতে থাকে..

"মেহু ধীরে.. আমার হাত কিন্তু ব্যাথা পাবো।

"এই চুপ করুন তো। উঠে দাঁড়ান! 

নির্ঝর উঠে দাঁড়ায়। মেহেরিন নির্ঝরের শার্ট টা খুলে দিয়ে আরেকটা শার্ট তার গায়ে পড়িয়ে বোতাম লাগাতে থাকে। নির্ঝর অদ্ভুত চাহনিতে দেখতে থাকে মেহেরিন'র দিকে। মেহেরিন নির্ঝরের দিকে তাকাতেই নির্ঝর মুখ সরিয়ে নেয়। মেহেরিন শক্ত গলায় বলে উঠে,

"এতো রিয়েক্ট করার কিছু হয় নি, আপনি এতোও হট নন ঠিক আছে।

"কি? কি বললে তুমি আমায়!

"যা শুনেছেন তা!

বলেই মেহেরিন ফোন নিয়ে বের হয়ে গেল। যাবার আগে ধপাস করে দরজাও লাগিয়ে দিয়ে গেল। নির্ঝর মিন মিন করে বলল,

"আমি হট না দেখতে! 

বলেই আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। নিজেকে দেখতে লাগাল। একবার এপাশ একবার ওপাশ। ঘুরেও দেখলো খানিকক্ষণ। অতঃপর বলে উঠে,

"কোন দিক দিয়ে হট নই আমি। এই মেয়ে কি বলে গেল। চোখ নেই ওর নাকি। আজ পর্যন্ত এই কথা আমাকে কেউ বলে নি আর ও...

নিজের চুল নিজে টেনে ধপাস করে নিচে বসে পড়ল নির্ঝর। চুল এলোমেলো করে ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরল। মেহুর এই কথা তার মোটেও পছন্দ হয় নি। কিভাবে বলতে পারল সে। উঠে গিয়ে বিয়ারের বোতল টা নিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিয়ার খেতে লাগল সে। হুট করেই মনে পড়ল একটি কথা।‌ নিরব আর মেহেরিন কারো সম্পর্কে কথা বলছিল। কিন্তু কে সে? মেহেরিন'র অতীত... 

#চলবে....
[+] 3 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#26
#পর্ব_১৮

মেহেরিন দুই হাত বাহুতে গুঁজে পার্কে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি হচ্ছে পার্কের গেটের দিকে। হয়তো কারো আশার কথা। এর মাঝেই পার্ক খালি হয়ে যাচ্ছে। হবারই কথা! আকাশে যে সন্ধ্যা নেমে গেছে। গোধূলি বেলা শুরু হলো যে। মেহেরিন হাতের ঘড়ির দিকে চোখ বুলাল। "ইশ ঘন্টার কাটা ৬ দিকের ছুঁই ছুঁই। অথচ তার আসার কথা ছিল ৫ টায়।‌ এতোটা দেরি কি মানুষে করে। বেশি থেকে বেশি হলে ১০ মিনিট। পুরো এক ঘন্টা দাড় করিয়ে রাখল আমায়! টাইমসেন্স বলে কি কিছু নেই।"

রাগে কম্পিত হলো মেহেরিন'র পুরো শরীর। চট করেই ফোন টা বেজে উঠলো। চোখ বুলিয়ে দেখল অর্ণব। ফোনটা রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে অর্ণবের বিষণ্ণ স্বর এলো তার কানে,

"মাম্মি..

"কি হয়েছে অর্ণব সোনা!

"মাম্মি..

"এই তো মাম্মি এখনি এসে পড়বে! অর্ণব সোনা কি রাগ করেছে? 

অর্ণব ফোন টা রেখে উঠে গেল। ঘরের দরজা ওপাশ থেকে ধপাস করে বন্ধ করে বসে রইল। খুব রেগে আছে সে। মিস মারিয়া পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে কানের কাছে নিতেই ওপাশ থেকে মেহেরিন বলল,

"খুব কি রেগে আছে!

"জ্বি ম্যাম! কখন থেকে খেতে বলছি কিছু খাচ্ছে না। ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে।

মেহেরিন চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"আমি আসছি, তুমি একটু দেখে রাখো!

"জ্বি ম্যাম! 

ফোনটা ব্যাগে রেখে সামনে তাকাল। অনেকক্ষণ হলো বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে। অর্ণবের সাথে একটু কথাও হয় নি তার। ইশ ভারী অন্যায় হয়ে গেছে। অর্ণবের ছোট মনটা খুব কষ্ট পেয়েছে। 

মেহেরিন আবারো ঘড়ির দিকে তাকাল। পুরো ৬ টা ৩০ 
সেকেন্ড হলো। মেহেরিন ঠিক করে নিল আর মাত্র ৫ মিনিট'ই দাঁড়াবে সে। এরপর আর না। মেহেরিন বেঞ্চে এসে কঠিন মুখ করে বসে রইল। 

১ মিনিট হবার আগেই কাউকে ঢুকতে দেখা গেল। সে দৌড়ে আসছে মেহেরিন'র কাছে। তাকে চিনতে ভুল হলো না তার। উঠে দাঁড়িয়ে গেল মেহেরিন। সে এসে মেহেরিন'র সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলো। মেহেরিন সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তার দিকে। খানিকক্ষণ পর মেহেরিন'র সামনে এসে দাঁড়াল। মেহেরিন মুখ ঘুরিয়ে নিল। 

মেহেরিন'র থিতুনি তে হাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে বলে উঠে,

"মিলে হো তুম হামকো, বরে নাসিবো সে! চুরাইয়া হেই ম্যানে কিসমত কি লাকিরো সে..

এ সময় এমন গান শুনে মেহেরিন'র রাগী মুখেও হাসির রেখা দেখা দিল। সে এবার দু লাইন গান গাইতে গাইতে মেহেরিন'র হাত ধরে ঘুরিয়ে নিল।‌ অতঃপর দু'হাত তার কোমরে রেখে মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে রইল। 

মেহেরিন শীতল গলায় বলে উঠে,
"হেসেছি মানে এই না আমার রাগ কমে গেছে।

ভ্রু কুন্চিত হলো তার। বলে উঠে,
"তুমি রেগে আছো কেন? 

"এটা আবার জিজ্ঞেস করছো?

"না মানে..

মেহেরিন হাতের ঘড়ি টা তার দিকে এগিয়ে বলে উঠে,
"দেখো কয়টা বাজে, ৬ টা বাজে। আসার কথা ছিল কখন, ৫ টায়. পুরো এক ঘন্টা এখানে বসিয়ে রাখলে তুমি!

সে নিজের ঘড়ি মেহেরিন'র দিকে ঘুরিয়ে বলে উঠে,
"কোথায় এই দেখো? ৫ টাই তো বাজে। 

মেহেরিন ঘড়ির দিকে তাকাল। অতঃপর তার মুখের দিকে তাকাল। আঁধারের মাঝে উপরে জ্বলে থাকা লাল রঙের বাল্বতে তার চেহারা দেখা যাচ্ছে। মেহেরিন বাঁকা হেসে বলল,

"তুমি ঠিক কতোটা বোকা ভাবো আমায় বলো তো। আসার আগে নিজে যে ঘড়ির টাইম বদলে আসো নি তা কি আমার কাছে অস্বীকার করছো! 

সে এবার লজ্জিত হলো। লজ্জা মাখা মুখে হেসে দিল। মেহেরিন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সে হাসির দিকে। ইচ্ছে করছে আবারো তার প্রেমে পড়তে। হাসতে হাসতে উষ্ণ গলায় বলে উঠে,

"সরি! আমি বুঝতে পারি নি তুমি এতো তাড়াতাড়ি ধরে ফেলবে। খুব ভালো বুঝো তুমি আমায়। আর এজন্যই তো তোমায় এতো ভালোবাসি! 

"হয়েছে রাখো তোমার এসব। দেরি করেছ এখন শাস্তি পাবে।

"জো হুকুম মেরি জান!

"বাসায় দিয়ে আসো আমাকে।

মুখটা মলিন হয়ে গেল তার। বলে উঠে,
"আমি তো এটা আশা করি নি। এখনই তো এলাম আর এখন'ই চলে যাচ্ছো।

"যেতে হবে,‌অর্ণব এখনো কিছু খায় নি। দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আমি না যাওয়া অবদি কিছু মুখে তুলবে না সে

"এতো ছোট বাচ্চার এতো রাগ!

"কার ছেলে দেখতে হবে তো।

বিরক্তি'র ছলে কথাটা বললেও মেহেরিন তা বুঝতে পারল না। 

"হ্যাঁ তাই তো। তাহলে তুমি এখন ওর জন্য আমাদের ডেট নষ্ট করছো।

"উফ! তুমি বেশি কথা বলছো চলো তো!

বলেই মেহেরিন তার হাত ধরে টেনে গাড়ির কাছে আনল।  মেহেরিন বুঝতে পারল না তার মনে কি চলছে। সে অর্ণবের প্রতি ভারী ক্ষিপ্ত। এই ক্ষিপ্ততা এক দিনের নয়। বহু দিনের.. এতো দিনের জমিয়ে রাখা ক্ষিপ্ততা কখন যে বড় আকার ধারণ করে বিস্ফোরিত হবে তার ক্ষতি সম্পর্কে মেহেরিন'র তখনো কোন ধারণা নেই। কোন বাচ্চা'র প্রতি এতো রাগ কেউ পুষিয়ে রাখতে পারে বলে মেহেরিন'র জানা নেই।

গাড়ি ড্রাইভ করছে সে, আর তার বাহু জরিয়ে ঘাড়ে মাথা রেখে বসে আছে মেহেরিন। গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। একটু পর পর সে তাকাচ্ছে মেহেরিন'র দিকে। আর মেহেরিন সামনে আয়নার দিকে। সব লক্ষ রাখছে সে। মেহেরিন বলে উঠে,

"সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে হয় স্যার, নাহলে এক্সিডেন্ট করবেন। 

সে গাড়ির সামনের আয়নার দিকে তাকাল। মেহেরিনকে দেখে হেসে বলে উঠে,

"দু'জনে একসাথে মরলে সমস্যা হবে না ম্যাডাম।

"আমার কথা রিপিট করছো।

"কই না তো।

"হ্যাঁ হ্যাঁ করছো? 

মেহেরিন ভেংচি কেটে মুখ সরিয়ে ফেলল। সে হাত দিয়ে তার মুখ ঘুরিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকতে বলল। পক্ষান্তরে মিস মারিয়া কল করেই যাচ্ছে। মেহেরিন ফোন রিসিভ করে বলেছে সে কাছেই আছে। এসে পড়বে। এ কথা দরজার ওপাশ থেকে বলার পরও দরজা খুলল না অর্ণব। সে দৌড়ে এসে বেলকনিতে দাঁড়াল। ছোট ছেলের মন টা মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। 

গাড়ি টা এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াল। মেহেরিন বিদায় দিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নিলে সে হুট করেই মেহেরিন'র হাত ধরে তার কাছে টানল।‌ মেহেরিন অবাক চোখে তাকাল। কপালে ভাঁজ পারল তার। সে চোখের পাতা ফেলে ফেলে তাকিয়ে রইল মেহেরিন'র ঠোঁটের দিকে। বুঝতে অসুবিধা হলো না কি তাইছে সে। মেহেরিন হাত মুচরাতে মুচরাতে বলে,

"কোন মতে না! ছাড়ো আমায়। এভাবেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।

"আর দু মিনিট হলে কিছু হবে না।

"দু মিনিট! ( হেসে ) আমি ৩০ সেকেন্ড ও দেরি করছি না। দেখো ছাড়ো আমায় বলছি।

সে টুক করে হাতটা ছেড়ে দেল। বলে উঠে,

"যাও দিলাম! 

মেহেরিন হেসে যেই না গাড়ির দরজা খুলতে যাবে অমনি বুঝতে পারল গাড়ি লক করা। সে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে বাঁকা হেসে তাকাল মেহেরিন'র দিকে।

"যাও যাও এখন.. 

মেহেরিন একটু কাছে এসে যেই না আনলক করতে নিবে অমনি সে গাড়ির চাবি খুলে ফেলল‌। এক হাত দিয়ে তা দূরে সরিয়ে ফেলল। মেহেরিন অসহায় দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষেপ করল। কিন্তু তার মন গলল না।

"আহ ছেড়ে দাও না।

"হুম হুম না। তোমার জন্য আজ আমার ডেট নষ্ট হয়েছে।

"আমার জন্য! দেরি করে এসেছিলে তো তুমি।

সে চোখ ছোট ছোট করে মেহেরিন'র দিকে তাকাল। মেহেরিন'র চুল গুলো কানে গুঁজে দিয়ে হাত রাখল তার গালে। অতঃপর ধীরে ধীরে তার কাছে যেতে লাগল। মেহেরিন চোখ বন্ধ করে নিল‌। সে মেহেরিন'র কাছে আসছে। তার শ্বাস পড়ছে মেহেরিন'র উপর। দুজনেই খুব কাছাকাছি! হুট করেই তখন মেহেরিন'র ফোনটা বেজে উঠল। দুজনেই লাফিয়ে উঠলো। সে সিটে হেলান দিয়ে কপালে হাত দিল। মেহেরিন এই সুযোগ গাড়ির চাবিটা হাতে নিয়ে গাড়ি আনলক করে বেরিয়ে গেল। অতঃপর বাইরে দাঁড়িয়ে টা টা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতে নিল।

ঠিক তখনই গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে। গাড়ির উপর এক হাত রেখে মেহেরিন কে ডেকে বলল,

"মেহেরিন! কিছু কি ভুলে যাচ্ছো না তুমি!

মেহেরিন দাঁতে দাঁত চেপে পিছনে ফিরল। সে গাড়ি থেকে একটু সামনে এসে দাঁড়াল। মেহেরিন দৌড়ে এসে জরিয়ে ধরল তাকে। সেও খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরল। অতঃপর তাকাল উপরের দিকে। বেলকনিতে দাঁড়ানো অর্ণব সব দেখছিল। তার কাছে মনে হয় এই অর্ণবের কোন সমস্যা নেই।আর বাকি ৫ টা বাচ্চার মতো না হলেও অনেকটা চালাক সে। আর এই চালাকি তার পছন্দ না। অর্ণব কে সহ্য হয় না তার। 

পরক্ষণে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ণবের মনে হয় এই লোকটা পঁচা। সে এসেছে তার থেকে তার মাম্মি কে কেড়ে নিতে। এসবের মাঝে মেহেরিন, যে কি না অন্ধের মতো শুধু ভালো বেসেই গেল। মুখ তুলে তাকাল তার দিকে। বলে উঠে,

"কখনো এই ভালোবাসা কমতে দিও না। আজ পর্যন্ত যাকে যাকে ভালোবেসেছি সবাইকে হারিয়েছি। তুমি হারিয়ো না। 

সে মেহেরিন'র কপালে চুমু খেয়ে বলল,
"কখনো না। আমার আর তোমার ভালোবাসা মাঝে কাউকে আসতেও দেবো না। 

বলেই উপরের দিকে তাকাল। মেহেরিন'র কাছে মনে হলো এই একটা মানুষ যাকে ভরসা করে বেঁচে থাকবে সে। তার হাত ধরেই বাকিটা পথ চলবে কি। কিন্তু এই দরুন পরিস্থিতি হবে কে জানতো। সে তো পথ চলতে শুরু করার আগেই হাত ছেড়ে চলে গেল। হায় ভালোবাসার কি নির্মম পরিহাস হলো। 

-----

চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল বালিশে। ঘুমের মাঝেই কাঁদছে সে আর বির বির করে চলছে, 
"যেও না, আমাকে ছেড়ে যেও না। 

কিন্তু সে চলে গেল। হারিয়ে গেল এই আঁধারের মাঝে। চট করে চোখ মেলে তাকাল সে। তার এই কল্পনা, স্বপ্ন, ভাবনা সবকিছু তার পুরনো ক্ষত কে জাগিয়ে তুলে। বুকে চিন চিন ব্যাথা অনুভব করছে সে। পাশে তাকিয়ে দেখল অর্ণব কে। সে এখনো ঘুমাচ্ছে।‌ কেমন একটু উল্টো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। গায়ে চাদরটা এখন আর গায়ে নেই। মেহেরিন উঠে বসল। তাকে ঠিক করেই শুইয়ে দিল। গায়ে চাদরটাও টেনে দিল। অতঃপর কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল,

"আমার সব তো এখানে। কাকে পাওয়ার মিথ্যে আশা করছি আমি। এই তো আমার জীবন। এখানেই তার শুরু আর এখানেই শেষ।

------

নির্ঝর ঘুম থেকে উঠলো বেশ বেলা করে। অনেকক্ষণ ঘুমালো আজ। অতঃপর ফ্রেস হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। তার কাছে সব কিছু শান্ত আর নিরব লাগছিল। এমনটা কেন? 
মেহেরিন'র ঘরে কড়া নাড়ল। না দরজা কেউ ঘুরল না। নির্ঝর হাত দিয়ে ধরতেই ঘরটা নিজ থেকে খুলেই গেল। নির্ঝর ভেতরে আসার পর বুঝতে পারল ঘরে কেউ নেই। ব্যাপার কি সবাই গেলো কোথায়? 

নিচ থেকে আওয়াজ আসছে। হয়তো মিস মারিয়া রান্না ঘরে কাজ করছে। নির্ঝর মাথার চুল গুলো এলোমেলো করতে করতে নিচে নামল। মিস মারিয়া নির্ঝর কে দেখে বলল,

"গুড মর্নিং স্যার! 

নির্ঝর হেসে বলল,
"গুড মর্নিং! 

মিস মারিয়া এক কাপ কফি তৈরি করে নির্ঝরের কাছে এনে রাখল। নির্ঝর কফি হাতে নিয়ে বলল,

"ম্যাম কোথায়?

"অফিসে চলে গেছেন।

"এতো সকালে..

"স্যার আপনি লেট করে উঠেছেন। অর্ণব বাবা গিয়েছিল ডাকতে কিন্তু আপনি ঘুমাচ্ছিলেন বলে ম্যাম মানা করে দিয়েছে।

"ওহ আচ্ছা! 

হুট করেই কলিং বেল বেজে উঠলো। নির্ঝর কফি মগে চুমুক দিল। মিস মারিয়া গিয়ে দরজা খুললেন। একজন ছেলে ঢুকল। নির্ঝরের ওতোটা খেয়াল করল না। কিন্তু যখন মিস মারিয়া ছেলে টাকে নিয়ে তার সামনে এনে দাঁড়াল নির্ঝর তখন ছেলেটার দিকে মনোযোগ দিলেন,
কালো রঙের একটা স্যুট পড়া। চুল গুলো বেশ পরিপাটি। আর তার সাথে ছেলেটা বিনয়ী। নির্ঝর কে দেখেই সালাম দিলো। নির্ঝর ও উওর দিলো। মিস মারিয়া বলে উঠেন,

"স্যার, এ আপনার পার্সোনাল সিকিউরিটি গার্ড।‌ সবসময় আপনার সাথেই থাকবে। আপনার কার ড্রাইভ থেকে শুরু করে সবকিছুই ও দেখবে। 

নির্ঝর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
"আহ তোমার নাম কি? 

"জ্বি, জয়নুল হোসেন!

নির্ঝর কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। অতঃপর বলে উঠে,

"তোমার নামের সাথে তোমাকে মিলাতে পারছি না। আমি তোমাকে আজ থেকে জন বলে ডাকবো ঠিক আছে তো।

"জ্বি স্যার।

"ভালো ড্রাইভ করতে পারো তো।

"জ্বি স্যার!

মিস মারিয়া মাঝে বলেন,

"স্যার, ম্যাম তার সমস্ত কিছু চেক করেই দায়িত্ব দিয়েছেন।

"আচ্ছা! 

বলেই নির্ঝর তার গাড়ির চাবি তাকে দিলেন। মিস মারিয়া আর কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করলেন। নির্ঝর না করে কফি হাতে উঠে গেল। 

সিঁড়ি দিয়ে উঠছে আর ভাবছে,
"পার্সোনাল সিকিউরিটি হিসেবে একটা ছেলে কেন ঠিক করলো। মেয়ে ঠিক করলে কি হতো। আমার পাশে একটা মেয়ে কে কি মানাতো না। মেহু এমনটা কেন করল! কিছু একটা গন্ডগোল লাগছে। 

নির্ঝর ফোন বের করে মেহেরিন কে কল করল। মেহেরিন'ও রিসিভ করল সাথে সাথে। নির্ঝর কিছু বলবে তার আগে মেহেরিন বলে উঠে,

"দেখা করছেন?

"কার সাথে?

"যাকে পাঠিয়েছি!

"ওহ হ্যাঁ দেখেছি।

"হুম খুব বিশ্বস্ত। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

"আচ্ছা মেহু!

"হুম..

"তুমি একটা মেয়ে কেন ঠিক করলে না বলো তো। আমার মতো একটা ছেলের সাথে একটা ছেলে মানাবে! 

ওপাশ থেকে কোন উওর এলো না। নির্ঝর উওরের আশায় কফি মগে চুমুক দিল। তৎক্ষণাৎ ওপাশ থেকে শীতল গলায় মেহেরিন বলল,

"অন্য মেয়েদের হাতে কি নিজের গায়ের আর্ধেক থাকা শার্ট খোলাতে চান! 

নির্ঝর সাথে সাথে বিষম খেলো। হাত থেকে ফোনটা ধপাস করে নিচে পড়ে গেল। নির্ঝর দাঁতের সাথে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে গেল।‌ এতোক্ষনে বুঝল মেহেরিন কেন এই ছেলে কে ঠিক করেছে। কপালে হাত দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

কিছু পড়ার আওয়াজ শুনে মিস মারিয়া ছুটে এলেন। 

"স্যার আপনি ঠিক আছেন তো? 

"মিস মারিয়া! হ্যাঁ আমি ঠিক আছি। আসলে আমার ফোনটা পড়ে গেছে। 

মিস মারিয়া দাঁড়িয়ে ফোন খুঁজতে লাগলেন। তা পেয়েও গেলেন। ফোনটার তেমন কিছুই হলো না! 

---

অর্ণবের কথা ভাবতে ভাবতে নির্ঝর ঘরে এসে বসল। এখন পুরোই একা লাগছে তার। মেহু অর্ণব কে তো রেখে যেতেই পারতো। নির্ঝর বিছানার পাশে ছোট টেবিলের দিকে তাকাতেই একটা কাগজ দেখতে পেল। সেটা হাতে নিয়ে দেখল তাতে বড় বড় করে লেখা,

"ড্যাডি! 

এর পাশে তার কল্পনার ড্যাডি আঁকা। নির্ঝরের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। ছোট এই অর্ণবের হৃদয়ের খানিকটা দখল করেছে সে। সকাল থেকে এই ছোট অর্ণবের মুখ টা দেখা হয় নি। হয় নি তার মুখে ড্যাডি ডাক টা শোনার। নির্ঝর উঠে দাঁড়াল। ভেবে নিল এখন অর্ণবের সাথে দেখা করতে যাবে। অর্ণব নিশ্চিত তাকে মিস করছে! 

জন কে ডেকে আনল নির্ঝর, তাকে যেন তৈরি হতে সাহায্য করে সে। অতঃপর তৈরি হয়ে বের হয়ে গেল নির্ঝর! 

#চলবে....
[+] 4 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#27
#পর্ব_১৯

বাগানে পাশেই নির্ঝর আর অর্ণব ফুটবল খেলছে। এর কাছে নারকেল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে দুজনকে দেখছে মেহেরিন‌।‌ অর্ণব কে এভাবে হাসি খুশি দেখতে খুব ভালো লাগে তার। তার এই হাসি মনে করিয়ে দেয় নিরুর কথা। নিরুর হাসিও অবিকল এমন। মা'র এই গুনটা ভালো মতোই রপ্ত করেছে অর্ণব।

অর্ণবের জন্মের পর মেহেরিন তাকে কোলে নিয়ে নিরুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। নিরুর জ্ঞান ফিরেছিল, অর্ণব কে দেখে আদর করে আবারো ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। মেহেরিন ঘাড় ঘুরিয়ে অর্ণবের দিকে তাকাল। নামটা তার'ই দেওয়া। দু বোন মিলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল ছেলে হলে নাম দিবে অর্ণব! 

মেহেরিন দাঁড়িয়ে নিরুর সাথে কাটানো দিন গুলোতে উঁকি দিচ্ছিল। তখনই গাড়ি পার্ক করার আওয়াজ এলো। নির্ঝর আর অর্ণব খেলা বন্ধ আরে পেছনে ফিরল মেহেরিন'র সাথে। কে এসেছে এখন? শাড়ি পড়া একটা ভদ্রমহিলা কে দেখা যাচ্ছে হেঁটে আসছে। অর্ণব মুখ ফুটে বলে উঠে,

"ডঃ রাহেলা! 

ডঃ রাহেলা হেসে বলেন,
"অর্ণব! 

মেহেরিন এগিয়ে এসে ডঃ রাহেলা কে জিজ্ঞেস করে,

"কেমন আছেন?

"এই তো ভালো। এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম ভাবলাম তোমাদের সাথে দেখা করি! 

অতঃপর মুখ ফিরলেন নির্ঝরের দিকে। নির্ঝর তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাথা নাড়লেন। ডঃ রাহেলা হেসে বলেন,

"নির্ঝরের কারণে এখন তো অর্ণব আর আমার কাছেই আসে না। 

অর্ণব হেসে নির্ঝরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে,
"ড্যাডি!

"হ্যাঁ হ্যাঁ জানি এটা তোমার ড্যাডি! 

মেহেরিন হেসে ডঃ রাহেলা কে ঘরে নিয়ে যান। নির্ঝর আর অর্ণব নতুন করে খেলা শুরু করে তাদের। 

ডঃ রাহেলা গরম চায়ের কাপে ফু দিয়ে চুমুক দেন। অতঃপর মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে বলেন,

"অর্ণব কে নিয়ে তো তোমার আর চিন্তা করতে হচ্ছে না মেহেরিন।

"চিন্তা করবো না কেন? 

"আহ, দেখছো না নির্ঝরের সাথে কেমন মিশে গেছে। 

মেহেরিন হেসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলে,
"নির্ঝরের সাথে মেশার সাথে সাথে সবার সাথে যদি কমফোর্টেবল হতো তাহলে চিন্তা থাকতো না।

"বেশি ভেবো না। অর্ণবের গ্রোথ দেখে মনে হচ্ছে খুব জলদিই রিকোভারি করতে পারবে সে।

"এমনটা হলে তো ভালোই।

"তুমি বেশি দুঃশ্চিন্তা করছো!

মেহেরিন হেসে চায়ের কাপে আবারো চুমুক দিল। পেছন থেকে নিরবের আওয়াজ পাওয়া গেল। দরজার সাথে হেলান দিয়ে বলে উঠে,

"দুঃশ্চিন্তা সাথে করে নেওয়া মেহুর অভ্যাস হয়ে গেছে।

"আরে নিরব যে!

"কেমন আছেন ডঃ রাহেলা?

নিরবের প্রবেশ ঘটল ঘরে। মেহেরিন'র পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল সে। ডঃ রাহেলা মুচকি হেসে বলে,

"তোমার বন্ধু কে দুঃশ্চিন্তা থেকে বাঁচানোর লোক তো এসে পড়েছে। তা এবার নিজের টা কিছু ভাবো।

নিরবের কপালে ভাঁজ পড়লো। রাহেলা হেসে উঠেন। বলেন,

"তুমি তো দেখি বুঝতেই পারছ না। আমি নির্ঝরের কথা বলছি। 

নিরবের চেহারায় বিষণ্নতা দেখা গেল। তবে এটা নিয়েই হেসে দিল সে। মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হাসার চেষ্টা করল। ডঃ রাহেলা মাঝখানে বলে উঠেন,

"হাসলেই কি হবে নাকি। নিজের টাও কিছু ভাবো।

"না আমার তেমন কেউ নেই। 

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে তাকাল নিরবের দিকে। বলে উঠে,
"কিন্তু তুই তো বলেছিলি..

"হাম সেটা অতীত মেহু।

"তা অতীত নিয়ে কতোদিন আকড়ে থাকবে। মেহুর মতো আবারো সব শুরু করো! 

রাহেলা কথা মেহেরিন'র কানে পৌঁছাল। সে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই তার সামনে মনে হলো অতীত ভেসে উঠলো! 

-------

অতীতে...

"এই মেহেরিন চা খাবে নাকি কফি! 

মেহেরিন ফাইল থেকে উঁকি দিয়ে রান্না ঘরে তাকাল। সে রান্না করতে ঢুকেছে কিন্তু তাকে দিয়ে কিছুই হবে না। কারণ সে পারে না। তবুও চেষ্টা করবে। ইউটিউব থেকে চা বানানোর রেসিপি বের করেছে। এটা ভাবতেই হাসি পাচ্ছে মেহেরিন। মেহেরিন হালকা কেশে বলল,

"হাম চা, না কফি খাবো।

"আহ বলো না জলদি!

"তুমি বরং কফি বানাও..

"আচ্ছা!

বলেই চুলোয় পানি গরম করতে যাবে তখন'ই মেহেরিন বলে উঠে,

"বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। এই সময় এক কাপ গরম চা পেলে বেশ ভালো হতো।

"আচ্ছা তাহলে আমি চা বানাচ্ছি!

মেহেরিন মিটিমিটি হেসে এবার উঠে দাঁড়াল। রান্না ঘরে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,

"কিন্তু আমার মাথা ধরেছেন আর তুমি তো জানো মাথা ধরলে কফি না খেলে আমার মাথা ধরা কমবে না। 

সে সব কিছু থেকে সরে এসে মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে বলল,

"তুমি কি ঠিক মতো কিছু ডিসাইড করবা।

"আহ আমি কনফিউজড, সাহায্য করো। তোমার হাতের প্রথম রান্না খাবো। বিশেষ কিছু হওয়া চাই তাই নয় কি!

সে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর মুচকি হেসে বলল,

"তাহলে আমি বিশেষ কিছু বানাচ্ছি!

মেহেরিন চমকে উঠলো।দ্রুত রান্না ঘরে এলো। দেখল সে নিচে বসে কিছু একটা করতে চলেছে। মেহেরিন তার পিছনে দাঁড়িয়ে গুঁতো দিয়ে বলল,

"এই কি করছো তুমি! 

সে উঠে দাঁড়াল। সামনে ফিরে বলল,

"বিশেষ কিছু বানাবো বলে ভাবছি।

"আচ্ছা তো কি সেই বিশেষ কিছু!

সে মেহেরিন'র কোমর জরিয়ে ধরল। মেহেরিন তার ঘাড়ে দুটি হাত রেখে হাঁটতে রাখল। সে বলে উঠে,

"সেটাই ভাবছি। কি জানি তোমারে ভালো লাগবে কি না। 

"কি সেটা? 

"টেস্ট করতে চাও!

"বলোই না! 

সে মেহেরিন কে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। মেহেরিন'র বুঝতে বাকি রইল না কি হতে চলেছে। সে এই বাঁধন থেকে বের হতে চাইলো। কিন্তু ততোই আকড়ে ধরল তাকে। 

"ঠিক হচ্ছে না বলে দিলাম।

"কিছুই তো করলাম না আমি? 
বলেই মুখ টিপে হাসল। লজ্জায় মেহেরিন লাল হয়ে গেল। উষ্ণ গলায় বলে উঠে,

"দেখো আমি বলছি তুমি...

কিছু বলার আগেই সে তার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া দ্বারা আঁকড়ে ধরল তাকে। এর মাঝেই হুট করেই কলিং বেল বেজে উঠলো। সে মেহেরিন কে ছেড়ে দিয়ে সরে আসলো। বিরক্ত মুখে তাকিয়ে রইল মেহেরিন'র দিকে। মেহেরিন হাসতে হাসতে একাকার। মুখ ফুলিয়ে বলে উঠে ,

"হাসবে না একদম, কে এলো এখন? আমার রোমান্সের বারোটা বাজিয়ে দিল।

মেহেরিন হেসে দরজার কাছে যেতে যেতে বলল,
"আমার ছেলে! 

বলেই মেহেরিন এসে দরজা খুলল। অর্ণব মেহেরিন কে দেখে একগাল হেসে তাকে জড়িয়ে ধরল। 

"মাম্মি! 

তার সাথে মিস মারিয়া ও ঘরে এলো। সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে এসে এসব দেখতে লাগাল। বুঝতে পারে না এই ছেলে কেন মেহেরিন কে মাম্মি বলে ডাকে। আপন মা তো নয়। এর কি তার বোঝার ক্ষমতা নেই নাকি...

----

বর্তমানে...
"মেহু! মেহু! 

মেহেরিন'র ভাবনায় ছেদ ঘটল। সামনে তাকিয়ে দেখে ডঃ রাহেলা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিরবও তাকে দেখছে। কিন্তু এখনো সেই আওয়াজ পাচ্ছে সে। কে ডাকছে তাকে। অতঃপর আরেকটা ডাক পেলো সে..

"মাম্মি...

মেহেরিন পেছনে ঘুরল। তাকিয়ে দেখল নির্ঝর আর অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। এতোক্ষন ধরে তাহলে তারাই ডেকে যাচ্ছে তাকে। মেহেরিন এবার জবাব দিল। নির্ঝর বলে উঠে,

"আমি আর অর্ণব শাওয়ার নিতে যাচ্ছি!

"আচ্ছা! 

বলেই নির্ঝর অর্ণবের হাত ধরে পা বাড়াল। কিন্তু তার তীক্ষ্ণ চোখ খানা তখন নিরব কে দেখল। সাথে সাথে কেমন একটা বিরক্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হলো। কে জানি এই নিরব কে মেহুর সাথে দেখলে তার ভালো না। নির্ঝর মিনমিন করে বলতে লাগল,

"এই নিলব কি করছে এখানে? 

ডঃ রাহেলা মেহেরিন'র ঘাড়ে হাত রাখলেন। মেহেরিন চমকে উঠলো। ডঃ রাহেলা বলে উঠে,

"ঠিক আছো তুমি!

"হ্যাঁ আসলে ঠিক আছি..

"আচ্ছা, খেয়াল রেখো নিজের আমি আজকে তাহলে উঠছি।

"আচ্ছা আবার আসবেন।

নিরব ও সাথে সাথে উঠে পড়ে। মেহেরিন তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
"চলে যাচ্ছিস।

"হুম, আসলে পরশু মিটিং নিয়ে কিছু কাজ করার আছে। তোর সাথে আলোচনার দরকার ছিল

"হ্যাঁ তো চলে যাচ্ছিস কেন?

"আমার মনে হয় আজকে আলোচনা করার দরকার নেই। তুই রেস্ট নে।‌ আমরা আগামীকাল এই নিয়ে কথা বলবো।

অতঃপর ডঃ রাহেলা'র দিকে তাকিয়ে একসাথে বেরিয়ে পড়ে সে। পেছন থেকে মেহেরিন বলে উঠে,

"পরশু দিনের মিটিং টা কিন্তু অনেক ইম্পর্ট্যান্টে!

"আমি জানি.. 

বলেই মুচকি হাসল নিরব। অতঃপর চলে গেল তারা। মেহেরিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথায় হাত রেখে বসে পড়ল। খুব মাথা যন্ত্রণা করছে তার। সে ভাবতে চায় না এসব কিছু কিন্তু ততোই যেন তার অতীত আঁকড়ে ধরে তাকে। রাগে মেহেরিন'র ঠোঁট কাঁপছে। মাথার যন্ত্রণা তীব্র হচ্ছে। সামনে টেবিলে থাকা চায়ের কাপ গুলো রাগে উল্টে ফেলল সে। অতঃপর উঠে গেল সেখান থেকে। কিন্তু ভাঙার আওয়াজ পেয়ে মিস মারিয়া ছুটে এলেন...

----

অনেকক্ষণ ধরে মেহেরিন দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝরের বাথরুমের সামনে। বাথরুমের ভেতর থেকে অর্ণবের আওয়াজ আসছে। সে পানি দিয়ে খেলছে আর হাসছে। মেহেরিন সেখানে দাঁড়িয়ে আওয়াজ দিল,

"অর্ণব অনেক হয়েছে এবার বের হয়ে আসো। এতোক্ষণ পানির নিয়ে খেললে সর্দি লেগে যাবে। জ্বর আসবে একটা কান্ড বাধাবে তুমি! 

মেহেরিন'র আওয়াজে তেমন কোন প্রভাব হলো না। অর্ণবের হাসির শব্দ আরো জোরে পাওয়া গেল। মেহেরিন খানিকটা বিরক্ত হয়ে দরজায় কড়া নেড়ে বলল,

"অর্ণব মাম্মি রেগে যাচ্ছে! 

ভেতর থেকে এবার আর হাসির শব্দ পাওয়া গেল না। মেহেরিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। পায়ের পাতা বার বার মেঝেতে ঠেকাল। পানির আওয়াজ বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। অর্ণব এখনো বের হয়নি। 
খানিকক্ষণ পর'ই দরজা খুলল। একটা তোয়ালে পেঁচিয়ে অর্ণব বের হলো। মেহেরিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। অর্ণব মেহেরিন কে দেখে আবারো বাথরুমে ঢুকতে নিল। মেহেরিন তখনই অর্ণব কে ধরে ফেলল। তার হাত শক্ত করে ধরে বলল,

"কোথায় যাচ্ছ? 

অর্ণব মাথা নিচু করে ফেলল। মেহেরিন খেয়াল করল তার কান লাল হয়ে গেছে। মেহেরিন মুচকি হেসে বলল,

"অর্ণবের লজ্জা করছে! 

অর্ণব দ্রুত মাথা নাড়ল। মেহেরিন অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

"মাম্মির কাছে লজ্জা!

অর্ণব জোরে ডেকে উঠলো,
"ড্যাডি! 

ভেতর থেকে নির্ঝর বলল,
"আসছি! 

মেহেরিন হেসে অর্ণব কে কোলে তুলে বিছানায় রেখে বলল,

"জলদি চেঞ্জ করে বাইরে আসো। মাম্মি তোমার জন্য মিল্কশেক বানাচ্ছে ওকে।

অর্ণব দাঁত বের করে হেসে মাথা নাড়ল। মেহেরিন তার ভেজা চুল গুলো হাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে দিল। 

--- 

রান্না ঘরে মেহেরিন মিল্ক শেক বানাচ্ছে আর মিস মারিয়া কফি! উপর থেকে কারো আসার শব্দ পেয়ে মেহেরিন সিঁড়ির দিকে তাকাল।‌ দেখল অর্ণব নামছে। লাল রঙের একটা টি শার্ট আর কালো রঙের ট্রাউজার পড়া সে। এতে অবাক হবার কিছু ছিল না। কিন্তু তার পিছন পিছন যখন নির্ঝর কে একইরকম টি শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে আসতে দেখল মেহেরিন ভ্রু কুঁচকালো! 

ড্যাডি আর অর্ণব এসে ধপাস করে সোফায় বসে পড়ল। টিভি অন করল। মেহেরিন মিল্ক শেক এনে টেবিলে রাখল। তার পিছু পিছু মিস মারিয়া কফি এনে রাখল। দু'জন কে একসাথে দেখে মিস মারিয়া হেসে আবারো রান্না ঘরে গেলেন। মেহেরিন দাঁড়িয়ে দুজনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অর্ণব মিল্ক শেক'র গ্লাস হাতে নিয়ে মুখে দিয়ে মেহেরিনের দিকে তাকাল। অতঃপর নির্ঝরকে খোঁচা দিল। নির্ঝর অর্ণবের দিকে তাকালে অর্ণব হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,

"মাম্মি! 

নির্ঝর কে মেহেরিন কে বলল,
"তোমার আবার কি হয়েছে?

"এসব কি? 

বলেই সোফায় বসল। নির্ঝর তার দিকে ফিরে বলল,
"কোন সব?

"তোমার দু'জন একরকম ড্রেস!

নির্ঝর হেসে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে,

"গতকাল ড্যাডি আর অর্ণব শপিং এ গিয়েছিল আর এইরকম ড্রেস কিনেছে। তাই না অর্ণব!

অর্ণব হেসে মাথা নাড়ল । দুজনেই একসাথে হাইফাইভ করল। মেহেরিন দাঁড়িয়ে বলল,

"বাহ! আর মাম্মি! মাম্মির কথা ভুলে গেলে অর্ণব! 

নির্ঝর আর অর্ণব দু'জনেই তাকিয়ে রইল মেহেরিন'র দিকে। মেহেরিন মুখ ভেংচি কেটে চলে গেল! 

-----

নির্ঝরের চুলে কতো গুলো রঙিন কাগজ আটকে আছে। অর্ণব একটু পর পর আঠা দিয়ে এগুলো ওর মাথায় লাগাচ্ছে। এদিকে নির্ঝর কাগজের প্ল্যান বানাতে ব্যস্ত যার কারণে অর্ণবের কোন কান্ড কারখানা সে বুঝতে পারছে না। মেহেরিন হাতে স্যুট নিয়ে বের হয়েছে অফিসে যাবার উদ্দেশ্যে। বাইরে এসে এমন কান্ড দেখে সে নিরব দর্শকের মতোই তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারছে না অর্ণব কি করছে। অর্ণব কি নির্ঝর কে কোন গাছ বানাতে চাইছে নাকি। 

বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ আসল।মেহেরিন চোখের পলক ফেলে অর্ণব কে বলল,

"মাম্মি চলে যাচ্ছি অর্ণব! 

অর্ণব মেহেরিন'র দিকে না তাকিয়েই মাথা নাড়ল। মেহেরিন আবারো বলে উঠল,

"নির্ঝর অর্ণবের খেয়াল রাখবেন, আমি যাচ্ছি! 

নির্ঝরও অর্ণবের মতোই মাথা নাড়ল! মেহেরিন কিছুক্ষণ অদ্ভুত ভঙিতে তাদের কার্যকলাপ দেখল। তারা তাদের কাজের মধ্যেই আছে। সে বিদায় দিয়ে বেড়িয়ে গেল। কিন্তু মনে হলো না তার কথা কেউ শুনতে পেরেছে। 

বহু কষ্টে একটা প্ল্যান বানাতে সক্ষম হলো নির্ঝর। এটা হেসে অর্ণবের হাতে দিল সে। অর্ণব নির্ঝরের মাথার চুল ছেড়ে সেটাই উড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কলিং বেল বেজে উঠল।‌ মিস মারিয়া বাসায় নেই, বাইরে গেছে। নির্ঝর নিজেই উঠলো দরজা খোলার জন্য। সে দরজা খুলতেই দেখতে পেলো ফরহাদ, আরিফ আর ঈশান দাঁড়িয়ে আছে। তারা নির্ঝর কে দেখে হাসির বন্যা বানিয়ে ফেলল। নির্ঝর ফ্যাল ফ্যাল রয়ে চেয়েই রইল। তাদের হাসির রহস্য তার মাথায় ঢুকলো না। 

"এতো হাসির কি আছে?

"তুই কি ক্রিসমাস ট্রি সেজেছিস নাকি!

"মানে..

ফরহাদ নির্ঝর কে টেনে ঘরে নিয়ে এলো। আয়নার সামনে দাড়ঁ করালো। নির্ঝর নিজেকে নিজে দেখেই গম্ভীর ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। সবাই মিটিমিটি হাসছে। নির্ঝর চুল থেকে একটা কাগজ সরানোর পর সবাই কে উদ্দেশ্য করৈ বলে,

"এতে হাসির কি আছে, যখন তোরা বাপ হবি তখন বুঝবি!

বলেই আয়না থেকে সরে আসল। অর্ণব দৌড়াতে দৌড়াতে ফরহাদের কাছে আসল। ফরহাদ অর্ণব কে কোলে তুলে নিল। আরিফ হেসে বলল,

"অর্ণব তার ড্যাডি কে একটা ক্রিসমাস ট্রি বানাতে চেয়েছিল তাই তো অর্ণব!

অর্ণব হেসে মাথা নাড়ল। বলে উঠে,

"ড্যাডি! 

নির্ঝর হেসে অর্ণবের দিকে তাকাল। তাকে কোলে তুলে নিল সোফায় বসাল। সবাইকে বসতে বলে রান্না ঘরে চলে গেল। কিছু কোল ড্রিক আর নাস্তা এনে দিল সবাই কে। এর সাথে অর্ণবের খাবার। 

ঈশান বলে উঠে,

"মেহেরিন কোথায়? 

নির্ঝর বলে,
"হাম ঘরে হয়তো! 

আরিফ বলে উঠে,

"খানিকক্ষণ আগে দেখলাম গাড়ি নিয়ে চলে যেতে আর তুই বলছিস ঘরে! 

অর্ণব চামচে করে খাবার মুখে দিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল আর নির্ঝর অর্ণবের দিকে। কখন গেল মেহেরিন? তারা কেউই টের পেলো না। আদৌও সম্ভব এটা। বাপ ছেলের এমন চাহনিতে পুরো রুম জুড়ে হাসির শব্দ পাওয়া গেল! 

ফরহাদ, ঈশান আর আরিফ এবার কাজে লেগে গেছে।‌অর্ণবের সাথে বসে তিন জনই লেগো দিয়ে টাওয়ার বানাতে ব্যস্ত। নির্ঝর কোল্ড ড্রিক খাচ্ছে আর ওদের তিন জনকে দেখছে। এখানে অনেক গুলো মার্বেল ও পড়ে আছে। নির্ঝর ভাবতে লাগল এগুলো এভাবে পড়ে থাকলে অর্ণব হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাবে। তখন আরেক অঘটন ঘটে যাবে। সে একটা বাটি নিয়ে এগুলো একত্র করতে লাগলো।‌

সব গুলো মার্বেল'ই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নির্ঝর এগুলো একটা একটা করে টোকাতে নিল। একটা মার্বেল কোন একটা ঘরের নিচ দিয়ে ভেতরে চলে গেল। নির্ঝর উঠে সেই ঘরের দিকে তাকিয়ে রইল। স্টোররুম এইটা। এই ঘরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। এই ঘরটা কখনো দেখে নি সে। দেখবে কি করে। বাড়ির একদম শেষের দিকে এই ঘর। কখনো আসা হয় নি এই ঘরে। নির্ঝরের কৌতুহল হল। ঘরের দরজাটা খুলে প্রবেশ করল সে। ঘরটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। নির্ঝর ঘরে আলো জ্বালালো। মূহুর্তের সামনে থাকা ছবির ফ্রেম টা নজর কারল তার। মেহু আছে সেখানে। তার সাথে শুভ্র আর নিরু। কিন্তু নির্ঝর এদের কাউকেই চিনে না তবুও ধরে নিল সে। 

নির্ঝর এগিয়ে ছবিটার দিকে হাত বাড়াল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। তেমন কিছু নেই এই ঘরে। নির্ঝর চারদিকে চোখ বুলাল। আবারো একটা ছবি পেলো সে। একটা কাগজের ভিতরে সেই ছবি টা। ছবির কিছুটা অংশ বেরিয়ে আছে। নির্ঝর ‌ছবি টা বের করল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে ছবিতে। দুজনকে দেখা যাচ্ছে ছবিতে। নির্ঝর ছবিটার দিকে তাকিয়ে হুট করেই বলে উঠে,

"মেহু! 

#চলবে....
[+] 4 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#28
#পর্ব_২০

গোধূলির সময়, পুরো আকাশ লাল রঙ ধারণ করেছে। সূর্য আর্ধেক ডুবে যাচ্ছে। সমুদ্রের শেষ কিনারায় সূর্যের সেই ডুবে যাবার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে জলে। জলের ছবি টা বাতাসে দোল খাচ্ছে। মেহেরিন তার হাত ধরে দেখছে সেই ছবি। সে মেহেরিন'র হাত শক্ত করে ধরে তাকিয়ে আছে তার দিকে। পেছন থেকে একজন ফটোগ্রাফার সেই ছবি তুলছে।

নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে দেখছে সেই ছবি। মেহু কে দেখছে কিন্তু কে তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তা বুঝতে পারছে না সে। কারণ ছবি টা পুড়ে গেছে। ছবির অর্ধেক পুড়ে গেছে নাকি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। মেহু যার হাত ধরে দাঁড়িয়ে দিয়েছে তাকেই পুড়িয়ে ফেলেছে কিন্তু সম্পূর্ণ ছবি টা পুড়ায় নি। কেন পুড়ালো না। এর মানে কি? 

এর মানে কি এটাই, সেই লোকটা এই ছবির মতো তার জীবন থেকেও পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছে সে। নাকি অতীতে ঘটে যাওয়া পুরোনো কোন ক্ষত এটা! কি হয়েছিল? মেহুর অতীত কি খুব দীর্ঘ! খুব কি ভালোবাসতো সে তাকে... 

নির্ঝরের বুকে হুট করেই ব্যাথা শুরু হলো। কেন জানি কথাটা তার পছন্দ হয় নি। তার মন এই কথাটা সহ্য করতে পারে নি। নির্ঝর বুকে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। বড় বড় শ্বাস নিল। বুকের ব্যাথা টা একটু হলেও কমেছে। নির্ঝর মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। ছবিটা হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে জলদি বাইরে বেরিয়ে এলো সে। দরজা বন্ধ করে দ্রুত চলে আসে বসার ঘরে। 

-----

ফাইলে মুখ গুজে বসে আছে মেহেরিন। অফিসের ব্যস্ততায় লাঞ্চ করা হয় নি তার। অর্ণবের একটা খবর ও নেওয়া হয় নি। খাবার কি খেয়েছে সে? কি করছে এখন? 

মেহেরিন ফাইল থেকে মুখ সরিয়ে অর্ণব কে ফোন দিল। কিছুক্ষণ পর'ই অর্ণব কল রিসিভ করল। 

"মাম্মি! 

অর্ণবের গলার স্বর পেয়ে মেহেরিন'র এতোক্ষণের ক্লান্তি কেটে গেল। মেহেরিন কিঞ্চিত হেসে বলল,

"কি করছ অর্ণব! 

"খাবার খাচ্ছি! 

"ওহ আচ্ছা! ড্যাডি কোথায়?

অর্ণব ফোন টা নির্ঝরের দিকে দিল। নির্ঝর ফোন টা কানে নিয়ে বলল,

"বলো!

"অর্ণব ঠিক আছে তো!

"আমার সাথে আছে, ঠিক থাকবে না কেন?

"হুম জানি আপনার সাথেই আছে। একটু দেখে শুনে রাখবেন। রাতে ফিরতে দেরি হতে পারে।

"আচ্ছা! 

হুট করেই গাড়ির হর্ণ বাজার আওয়াজ আসল। মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

"আপনারা কি বাসায় নেই।

"হ্যাঁ আমরা বাসায়!

"তাহলে গাড়ির হর্ন বাজল যে..

"ওই ফরহাদের গাড়ি। তারা চলে যাচ্ছে।

"ওহ আচ্ছা! আমি রাখছি তাহলে..

"হুম! 

নির্ঝর ফোন রেখে সামনে তাকাল। ফরহাদ ওরা অনেকক্ষণ ধরেই হাসি বন্ধ করে রেখেছিল। নির্ঝর ফোন রাখতেই সবাই হো হো হেসে উঠলো। অর্ণব ও দাঁত বের করে হাসল। নির্ঝর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে সিটে আরাম করে বসল। ফরহাদ বলে উঠে,

"মিথ্যে বলার কি দরকার ছিল?

"এমনেই! 

ঈশান বলে উঠে,
"এভাবে এভাবে কেউ মিথ্যে কথা বলে নাকি!

নির্ঝর অর্ণবের দিকে তাকাল। পির্জা খেতে গিয়ে তার মুখে চিজ লেগে আছে। নির্ঝর টিস্যু নিয়ে তা মুছে দিল। আরিফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,

"অর্ণব এসব আনহেলদি খাবার বাইরে এসে খাচ্ছে এটা জানলে মেহেরিন রেগে যাবে তাই! 

নির্ঝরের চোখ স্থির হয়ে গেল। সে আরিফের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল। সেদিনের রাতের কথা, মেহেরিন খুব ভালো ভাবেই বলে গেছে নির্ঝর কে.. তার বিয়ার খাওয়া থেকে শুরু করে সব বাজে খাবার এর সাথে অর্ণবের বার্গার, পির্জা, আইসক্রিম ইত্যাদি ইত্যাদি এসব বন্ধ। মেহেরিন কথা গুলো ভালো ভাবে বললেও নির্ঝরের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেল। কারণ তার কথায় ধার ছিল। কিভাবে কথা বলে এ মেয়ে। একটা মেয়ের কথা শুনল কোন ছেলের এমনটা কি হতে পারে। শুধু তাই নয়, নির্ঝর যখন মেহেরিন'র সাথে কথা বলে তখন তার চোঁখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। ইদানিং এমনটা হচ্ছে। সে জোর করে তাকিয়ে থাকতে চাইলেও তাকিয়ে থাকতে পারে না। এমনটা মনে হয় তার চোখ কিছু বলতে চায় তাকে তবে সেটা শ্রবণ করার ক্ষমতা নির্ঝরের মধ্যে নেই। নির্ঝর শুকনো ঢোক গিলে তখন বলল,

"আ..আচ্ছা! 

মেহেরিন এক পা সামনে এগিয়ে আবারো সেই ধারালো কন্ঠেই বলে গেল,
"আচ্ছা বললেই হবে না, বাড়িতে এসব খাবার আসবে না। আর আমি না থাকলে বাইরে গিয়ে এসব খাবার খাওয়া তো ভুলেও চলবে না। মনে থাকবে..

নির্ঝর দ্রুত মাথা নাড়ায়। মেহেরিন কিঞ্চিত হেসে চলে যায়। নির্ঝর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। 

ফরহাদের আওয়াজে নির্ঝরের ঘোর কাটল। চোখের পলক দ্রুত ফেলে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে রইল। অর্ণবে কিট কিট হাসির শব্দ নির্ঝর পাচ্ছে। তার সামনে পানির গ্লাস টা তুলে ধরল সে। 

-----

অর্ণবের কল কেটে মেহেরিন সিটে চোখ বন্ধ করে বসল। কেবিনে কেউ আসার শব্দ পেল তখন। চোখ মেলতে ইচ্ছে করল না তবে সে চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারে এটা নিরব। তাকে চেনার নতুন উপায় ছিল তার পারফিউম। নিরব কি একটা পারফিউম বেশ কয়েকদিন ধরে ব্যবহার করছে। তবে এটার ঘ্রাণ মেহেরিন'র তেমন একটা পছন্দ হয় নি। আর হয় নি বলেই ভালো মনে থাকে। এটা কেমন কথা? 

নিরব চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
"না খেয়ে এভাবে বসে আছিস?

"ইচ্ছে করছে না।

নিরবের নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ এলো। মেহেরিন আলসেমি ছেড়ে চোখ মেলে তাকাল। বলে উঠে,

"তুই এখনো লাঞ্চ করিস নি!

"না, ভেবেছি একসাথে করব।

মেহেরিন উঠে দাঁড়াল। নিরব হেসে বলল,

"সামনেই শপিং মলে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। সেখানে চল!

মেহেরিন জবাব না দিয়েই পা বাড়াল! 

অর্ণব বাচ্চাদের প্লে গ্রাউন্ডে! নির্ঝরের হাতে বিয়ারের বোতল। এক কোনে দাঁড়িয়ে চার বন্ধু বিয়ার খাচ্ছে। সেখান থেকেই নির্ঝর অর্ণবের উপর খেয়াল রাখছে। অর্ণব পারছে না বাকি বাচ্চাদের সাথে মিশতে। তার হাতে একটা খেলনা রোবট। এটা অবশ্য তার। বাসা থেকেই এনেছে। সেটা হাতে আঁকড়ে ধরে বাকি বাচ্চাদের দেখছে সে। তার চোখ ভয়ে ছোট হয়ে আসছে। গলা শুকিয়ে আসছে তার। 

একটা বাচ্চা উঠে তার কাছে আসলো। তাকে দেখে অর্ণব ভয়ে তার রোবট টা লুকিয়ে ফেলল। বাচ্চা টা অর্ণবের হাত থেকে সেই রোবট নেবার জন্য'ই উঠেপড়ে লাগল। অর্ণব দু হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ড্যাডি বলে ডাকতে লাগল। 

ড্যাডি বলে ডাকার সাথে সাথেই তার মাথায় কেউ হাত বুলাল। অর্ণব উপরে তাকিয়ে দেখল নির্ঝর। সে আবারো তার দিকে তাকিয়ে ড্যাডি বলে ডাকতেই সেই বাচ্চা টা তার হাত থেকে রোবট টা ছিনিয়ে নিল। অর্ণব নির্ঝর কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। নির্ঝর অর্ণব কে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। ফরহাদ এসে সেই বাচ্চা কে বলল,

"তুমি ওর খেলনা কেন ছিনিয়ে নিচ্ছ, এটা কি ভাল? 

বাচ্চা টা সাথে সাথে উওর দিল,
"এটা আমার রোবট!

আরিফ বলে উঠে,
"আচ্ছা তাই নাকি, তা রোবটের গায়ে কি তোমার নাম লেখা আছে নাকি! 

বাচ্চা টা চুপ হয়ে গেল। ঈশান বলে উঠে,
"কারো জিনিস এভাবে ছিনিয়ে নেওয়া কতো বড় খারাপ কাজ জানো। আমি পুলিশ কে বললে সে তোমাকে নিয়ে যাবে। ভালো লাগবে তখন..

বাচ্চা টা আবারো বলে উঠে,
"এটা আমার রোবট!

নির্ঝর অর্ণবের কান্না থামাল। অর্ণব কাঁদো কাঁদো মুখে বাচ্চা টার দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ঝর তাকে কোল থেকে নামিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিল। কপালে চুমু খেয়ে বলল বাচ্চাটা কে উদ্দেশ্য করে বলল,

"রোবটের গায়ে তোমার নাম লেখা দেখাও। না দেখাতে পারলে আমি এখন পুলিশ কে ডেকে তোমাকে ধরিয়ে দেব। বলব একটা বাচ্চার কাছ থেকে এটা কেড়ে নিয়েছ। তাকে কাঁদিয়েছো! 

নির্ঝরের কথায় বাচ্চা টা ভয় পেয়ে গেল। রোবট টা ফেলে দিয়ে কান্না শুরু করল। আম্মু বলে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে গেল। অর্ণব এসে পড়ে থাকা সেই রোবট তুলে নিল। নির্ঝর হাত ধরে বেরিয়ে এলো সে! 

নির্ঝর এক হাত দিয়ে অর্ণব কে শক্ত করে ধরে আছে। অন্য হাত দিয়ে বিয়ার খাচ্ছে আর ঘুরছে। তার সাথে বাকি সবাইও ঘুরছে। নির্ঝর বিয়ারের বোতলে মুখ দিয়ে সামনে তাকাতেই চমকে গেল। অর্ণব সামনে তাকিয়ে জোরে বলে উঠে,

"মাম্মি! 

সবাই সামনে তাকাল। বাকি সবাইও চমকে উঠল। নিরব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের কাছে। অর্ণব নির্ঝরের হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে মেহেরিন'র কাছে চলে এলো। নির্ঝর মুখে থাকা বিয়ার খুব কষ্টে গিলল। বলে উঠল,

"মেহু! 

মেহেরিন শান্ত ভাবেই তাকিয়ে রইল নির্ঝরের দিকে। 

আর্ধেক খাওয়া বিয়ারের বোতল টা ফেলে দিয়েছে নির্ঝর। খুব খারাপ লাগছে তার। নির্ঝরের হাত ধরে অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। একবার তাকায় মেহেরিন'র দিকে তো একবার নির্ঝরের দিকে। মেহেরিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ঝরের এই চাহনি সহ্য হচ্ছে না।কেন কিছু বলছে না মেহেরিন। সে নিজ থেকেই বলে উঠল,

"সরি!

মেহেরিন দু হাত বাহুতে গুঁজে বলল,
"কেন সরি! 

"মিথ্যে বলেছিলাম,‌বাসায় ছিলাম না আমি।

মেহেরিন হুট করেই হেসে উঠল। বাকি সবাই নিরব দর্শকের মতো তাকিয়ে আছে। মেহেরিন বলে উঠে,

"ভুল শুধু এটা না আরো একটা করেছেন।

নির্ঝর কিছু না বলে অর্ণবের হাত শক্ত করে ধরে মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে নিল। মেহেরিন অর্ণবের কাছে এসে গাল হাত রেখে বলল,

"লাঞ্চ এ কি খেয়েছ? 

মেহেরিন'র কথায় অর্ণব ও নির্ঝরের মতো হুবহু মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে নিল। মেহেরিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

"আমি মানা করেছিলাম তো তাহলে কেন? 

অর্ণব হুট করে নির্ঝরের পেছনে লুকিয়ে পরল। পেছন থেকে তার শার্ট আকড়ে ধরল। নির্ঝর বলে,

"একদিন'ই খেয়েছে! 

মেহেরিন বলে উঠে,
"অর্ণব এদিকে আসো! 

অর্ণব পেছন থেকে মাথা নাড়িয়ে না না বলে। ফরহাদ এসব দেখে ফিক করে হেসে দেয়। মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকায়। 

মেহেরিন কিছু বলতে নিবে তখনই সেখানে কারো উপস্থিতি ঘটল। বাচ্চা টা নির্ঝর কে দেখিয়ে মা 
কে বলছে, এই লোক তাকে মেরেছে! 

বাচ্চার মা রাগী দৃষ্টিতে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝরের সামনে এসে অনেক কথা বলল। নির্ঝর হুট করে এমনটা হওয়ায় থতমত খেয়ে গেল। বাকি সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মহিলা টা বলছেন,

"কোন আক্কেল নেই আপনার, একটা বাচ্চা কে কিভাবে কাঁদান আপনি। এরকম লোক আমি আমার জন্মে দেখে নি আমি। কি কুৎসিত মন আপনার। একটা বাচ্চা কে কাদানোর আগে একবার ও খারাপ লাগালো না আপনার। নিজের সন্তানকে কি এভাবে কাঁদান। 

নির্ঝর কিছু বলতে নিবে তার আগে মেহেরিন বলে উঠে,

"এই যে মিসেস! একটু বেশি বলছেন না আপনি! 

মহিলা টা মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে ককর্শ গলায় বলে উঠে,

"কে আপনি? 

"ওয়াইফ হই উনার! আপনি কে আর হয়েছে কি? 

"কি হয়েছে নিজের এই বিবেকহীন হাসবেন্ড কে জিজ্ঞেস করুন। শুধু শুধু আমার বাচ্চা কে বকেছে। বলে কি না পুলিশে দেবে। কিসব কথাবার্তা এগুলো। ছোট বাচ্চা কে এসব কে বলে! 

মেহেরিন'র কপালে ভাঁজ পরল। সে নির্ঝরের দিকে তাকাল। ফরহাদ বলে উঠে,

"এসব কথা তখন বলে যখন বাচ্চা ভুল করে। আপনার উচিত আপনার বাচ্চা কে শিখানো অন্যের জিনিস না বলে কেড়ে নিতে হয় না। একে তো এসব শিখান না আবার এখানে এসেছেন একথা বলার জন্য! 

মহিলা রেগে ফরহাদের দিকে তাকাল। মেহেরিন নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,

"আপনি পুলিশে দেবার কথা বলেছেন।

নির্ঝর মাথা নাড়ল। অতঃপর বলল,

"আমি এইভাবে বলি নি। তাকে বোঝানোর জন্য বলেছি। অন্যের জিনিস ছিনিয়ে নেওয়া খারাপ কাজ। পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে...

মহিলা আবারো ককর্শ গলায় বলে উঠে,

"বাহ এতো টুকু বলায় আমার ছেলে তাহলে কাদলো। আর কিছু বলেন নি আপনি!

মেহেরিন চোখ বুলিয়ে অর্ণবের দিকে তাকাল। অর্ণব হাতের রোবট টা আকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেরিন'র মনে হলো হয়তো এই রোবট সেই বাচ্চা কেড়ে নিয়েছিল। সে চোখ বন্ধ করে শান্ত গলায় মহিলাকে বলল,

"প্রথমে আপনি নিজের কথা বলার ধরন ঠিক করুন।

"কি বললেন আপনি, আমার কথা বলার ধরন খারাপ।

"খারাপ না বাজে! নিজের বাচ্চার সামনে এভাবে কথা বললে আপনার বাচ্চা আপনার থেকে কি শিখবে! অনেক তো জ্ঞান দিচ্ছেন অন্য কে নিজে কিছু রাখুন।

মহিলা চুপ হয়ে গেল। মেহেরিন ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

"কোথায় ঘটেছে এই ঘটনা? 

"বাচ্চাদের প্লে গ্রাউন্ডে! অর্ণবের রোবট টা এই বাচ্চা কেড়ে নিয়েছিল। অর্ণব কাঁদছিল। আমরা শুধু বাচ্চা টাকে বুঝিয়ে রোবট দিতে বলেছি! 

মহিলা এবার কিছু বলতে নিবে তার আগে মেহেরিন তার সিকিউরিটি কে ডাক দিল। বলল,

"প্লে গ্রাউন্ডের সিসি টিভি ফুটেজ নিয়ে আসো। কি হয়েছিল তা দেখলেই জানা যাবে। কে কি করেছে সেখানে দেখলেই বোঝা যাবে। আসলে দোষ টা কে করেছে দেখতে হবে। 

বলেই বাচ্চাটার দিক তাকাল। বাচ্চা টা যথেষ্ট বড়! মেহেরিন'র চাহনি দেখে বাচ্চা টা মায়ের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। মেহেরিন হেসে বলল,

"মনে হচ্ছে এবার আপনার বাচ্চা'ই আপনাকে বলবে আসলে কি হয়েছিল। তার দোষ টা কোথায়? আর তা না হলে সিসি টিভি ফুটেজ তো আছে। দেখে নিবেন! 

বলেই অর্ণব কে কোলে তুলে নিল মেহেরিন। নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,

"চলুন! 

নির্ঝর এসে মেহেরিন'র পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। মহিলাটা তাদের যাবার পানে তাকিয়ে রইল! বাইরে আসতেই মেহেরিন অর্ণব কে কোল থেকে নামাল। ভ্রু কুঁচকে তাকাল নির্ঝরের দিকে। নিরব মেহেরিন'র ঘাড়ে হাত রেখে বলল,

"রাগ কমা এবার! 

মেহেরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অর্ণব এসে নির্ঝরের হাতের মাঝে নিজের হাত গুটিয়ে নিল। মেহেরিন হেসে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,

"সাবধানে বাসায় যাবেন।

নির্ঝর মাথা নাড়ল। নিরব এসে গাড়ির দরজা খুলল। মেহেরিন ভেতরে বসল। নিরব অর্ণবের মাথায় হাত রেখে বলল,

"মাম্মি কে রাগিও না অর্ণব! 

অর্ণব কঠিন মুখ করে তাকিয়ে রইল। নিরব অর্ণবের মাথার চুল এলোমেলো করে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর মুখ সরিয়ে নিল। নিরব গাড়িতে এসে বসল। অর্ণব তার মাথা ঝাঁকিয়ে চুল গুলো আরো এলোমেলো করল। সবাই ওর কান্ড দেখে হেসে দিল। 

----

অর্ণব নির্ঝরের কাঁধে চড়ে বসে আছে। নির্ঝর তাকে নিয়ে পুরো ঘরে দৌড়াদৌড়ি করছে। লাফাতে লাফাতে নির্ঝর এসে বিছানায় ধপাস করে বসল। অর্ণব খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করল। নির্ঝর তার হাসি দ্বিগুণ করার জন্য শুড়শুড়ি দিতে লাগল। দু'জনে মিলে পুরো ঘর অগোছালো করল। গাড়ির শব্দ আসার সাথে সাথে অর্ণব বিছানা থেকে নামল। মাম্মি এসেছে! কিন্তু এবার আর গাড়ির কাছে গেল না। বসার ঘরে এসে সোফার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। নির্ঝর তাকে দেখে মুচকি হাসল। সে বাড়ি থেকে বের হয়ে সদর দরজার দিকে আগাল। 

বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দেখল নিরব মেহেরিন'র মাথায় হাত রেখে চুল গুলো এলোমেলো করছে। নির্ঝর ভ্রু কুচকালো। আরেক পা এগিয়ে সামনে এলো। নিরব মেহেরিন কে এক হাত দিয়ে হাগ করল। নির্ঝর এবার চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল। মেহেরিন'র হেসে নিরব কে বিদায় দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখল নির্ঝর। পেছনে উঁকি মেরে বলল,

"অর্ণব কোথায়? 

নির্ঝর ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে বলে,
"ঘরে লুকিয়ে আছে! 

"আচ্ছা! 

বলেই মেহেরিন বাড়ির দিকে এগোয়। নির্ঝর নিরবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অতঃপর বাড়ির দিকে পা বাড়াল। হুট করেই নিরব ডাকল নির্ঝর কে। নির্ঝর পিছনে ফিরল। নিরব বলে উঠে,

"এক কাপ কফি খাবে আমার সাথে! 

নির্ঝর মিন মিন করে বলল,

"আবারো বাড়ির ভেতরে ঢোকার ধান্দা! 

নির্ঝর হেসে একটু সরে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাড়িতে আসতে বলল। নিরব হেসে বলল,

"না বাড়িতে না, অন্য কোথাও? গাড়িতে এসে বসো! 

বলেই নিরব এসে গাড়িতে বসল। নির্ঝর মিন মিন করে বলল,

"বাইরে! তার মানে একা কিছু বলবে? এর মানে তো অন্য ধান্দা। মতলব কি এই নিলবের! 

নিরব গাড়ির হর্ন বাজাল। নির্ঝর ফোন করে গাড়ির দিকে আগাল। গাড়ির ভেতর বসে মেহেরিন কে মেসেজ করে বলল নিরবের সাথে বের হয়েছে। নিরব এর মাঝেই গাড়ি স্টার্ট দিল। নির্ঝর মেসেজ শেষে ফোনটা রাখল। নিরব বলে উঠে,

"তোমার আগের স্বভাব এখনো আছে? 

নির্ঝর ভ্রু কুচকালো। বলে উঠল,

"আগের স্বভাব মানে..

নিরব হাসল। নির্ঝরের মনে হলো তাকে উপহাস করল। নির্ঝর রাগ কমানোর জন্য বাইরে তাকিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল। 

টেবিলের এক পাশে নির্ঝর আর অপর পাশে নিরব। ওয়েটার কফি দিয়েছে অনেকক্ষণ! কিন্তু নির্ঝরের খেতে ইচ্ছে করছে না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কফি মগের দিকে। নিরব কফি মগে চুমুক দিয়ে বলল,

"খেয়ে দেখো ভালো লাগবে, আমার খুব পছন্দের জায়গা এটা! 

নির্ঝর ভেংচি কেটে বিরবির করে বলল,
"এজন্য আমার পছন্দ না।

নিরব বলে উঠে,
"মেহেরিন'র ও খুব পছন্দ। আর বিশেষ করে এই কফি টা! 

নির্ঝর দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে কফি মগে হাত রাখল। নিরব হেসে বলল,

"মনে হচ্ছে তুমি বিরক্ত! 

নির্ঝর মাথা তুলে নিরবের দিকে তাকাল। নিরবের মুখ হাসি হাসি! নিরব টেবিলে হাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে বলল,

"আমাকে দেখে বিরক্ত তুমি!

অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বলে উঠল,
"না! 

নিরব চট করে বলে উঠে,
"তবে আমি বিরক্ত!

নির্ঝর একটা ধাক্কা খেল। নিরব আবারো কফি মগে চুমুক দিল। নির্ঝর বলে উঠে,

"কারণ টা কি?

"কারন আমার মনে হয় তুমি মেহু'র জন্য সঠিক না! 

নির্ঝর মিন মিন করে বলল,
"আবার মেহু! 

নিরবের কথায় নির্ঝর হেসে দিল। এবার কফি মগে চুমুক দিল সে। নিরব বলে উঠল,

"উপহাস করছো? 

"তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো বলোতো?

"তুমি ঠিক কি শুনতে চাও! 

নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিরবের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
"এই কথা তো জানো আমি ১ বছর পর চলে যাবো। তবুও এতো ভয় তোমার?

"এই ১ বছর কে ১ যুগ মনে হচ্ছে আমার।

"এতো ভয় থাকলে বিয়ে টা তুমিই করে নিতে!

নির্ঝরের কথার উওর নিরব দিল না। শুধু কফি মগে চুমুক দিয়ে অন্যপাশে তাকাল। নির্ঝর হেসে উঠলো। নিরব মুখ কঠিন করে বলে উঠলো,

"দুরত্ব বজায় রাখো মেহুর কাছ থেকে! 

নির্ঝর হাসল কিছু বলল না।নিরব ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠে,

"একবার এই ভুল করেছি, এবার না। মেহু কে এবার আমি আর কষ্ট পেতে দেবো না।

নির্ঝর মাথা ঝাঁকিয়ে আবারো কফি মগে চুমুক দিল। নিরব মুখ খুলে শ্বাস নিয়ে বলল,

"মেহুর কিছু হলে আমি তোমাকে ছাড়বো না। 

নির্ঝর এবার একটু বেশিই হাসল। উঠে দাঁড়াল। নিরবের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

"কফির জন্য ধন্যবাদ! এবার থেকে মেহুর যা পছন্দ আমার পছন্দ তাই হবে।

নিরব দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
"ইউ! 

"নির্ঝর চৌধুরী! মেহেরিন বর্ষা খান এর হাসবেন্ড! 

বলেই দাঁত বের করে হেসে চলে গেল। রাগে নিরবের শরীর কাঁপছে। সে রেগে টেবিলের কফি মগ গুলো ছুঁড়ে মেরে টেবিলে বাড়ি মারল। ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল! 

-----

সকাল সকাল মেহেরিন তৈরি হচ্ছে। ইম্পর্ট্যান্টে মিটিং আছে আজ! নির্ঝরের ঘুম আজ একটু আগেই ভাঙল। সে ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখল মেহেরিন অর্ণবের কপালে চুমু খাচ্ছে। নির্ঝর মেহু বলে ডাকায় মেহেরিন তার দিকে ফিরল। মিষ্টি একটা হাসি দিল। নির্ঝরের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। মেহেরিন বলল,

"ধন্যবাদ! রাতে অর্ণব কে নিজের কাছে রাখার জন্য। আমার অফিসের বাকি কাজটা আমি শেষ করতে পেরেছি! 

নির্ঝর তোয়ালে রেখে বলে উঠল,
"ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। অর্ণব তার ড্যাডির সাথে ঘুমিয়েছে! 

মেহেরিন হাসল। নির্ঝর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সেই হাসির দিকে। বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ আসল। মেহেরিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

"আমাকে যেতে হবে, নিজের খেয়াল রাখবেন আর..

"অর্ণবেরও!

"আসছি আমি! 

বলেই মেহেরিন দ্রুত বেরিয়ে গেল। নির্ঝর এসে বেলকনিতে দাঁড়াল। নিরব গাড়ি থেকে বের হয়েছে। মেহেরিন এসে দাঁড়াল গাড়ির সামনে। নিরব তার মাথায় হাত রেখে আবারো চুল গুলো নাড়ল। নির্ঝর রেগে হাত মুঠো করে নিল। নিরব গাড়ির দরজা খুলে মেহেরিন কে ভেতরে বসাল। অতঃপর নিজে বসার আগে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নিরব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। নির্ঝর হেসে মাথায় হাত রাখল। চুল গুলো এলোমেলো করে বলে,

"সারপ্রাইজ দিতে আবার বেশ ভালো লাগে..! 

#চলবে....
[+] 3 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#29
Fahan k kokhon story te add korben bole thik kore6en
Like Reply
#30
#পর্ব_২১

মেহেরিন সবে মিটিং রুমে প্রবেশ করল। সমস্ত ক্লাইন্ট তাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। মেহেরিন এসে চেয়ারে বসল। তার পাশের চেয়ারটাতে নিরব বসল। মেহেরিন সামনে তাকিয়ে দেখল তার বিপরীত চেয়ার টা খালি। কপালে ভাঁজ পড়ল তার। মেহেরিন তার পাশে দাঁড়ানো পিএ'র দিকে তাকাল। 

"জ্বি ম্যাম! 

"আর কারো আসার কথা? 

বলেই তার বিপরীত চেয়ারের দিকে তাকাল। পিএ চেয়ার টার দিকে তাকিয়ে বলল,

"আমি খোঁজ নিচ্ছি ম্যাম! 

মেহেরিন মাথা নাড়ল। নিরব মিটিং শুরু করার কথা বললে মেহেরিন তাকে ৫ মিনিট পর শুরু করার কথা বলল। ৫ মিটিং পর'ই মেহেরিন'র পিএ ফেরত এলো। মেহেরিন পেছনে ফিরে দেখল পিএ'র সাথে সাথে জন ও এসেছে। মেহেরিন ভ্রু কুঁনচিত করে হেসে দিল। তখন প্রবেশ ঘটল নির্ঝরের! তাকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে গেল মেহেরিন বাদে। নিরব দাঁড়িয়ে অবাক চোখে নির্ঝর কে দেখতে লাগল। তার পরনে কালো রঙের সুট! ভেতরে সাদা শার্টের মাঝে কালো টাই টা দেখা যাচ্ছে। নির্ঝর প্যান্টের প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে হালকা কেশে বলল,

"সবাইকে অপেক্ষা করানোর জন্য আমি বিশেষ ভাবে দুঃখিত! 

ক্লাইন্টের মাঝে একজন বলে উঠল,

"ইট'স ওকে স্যার! আপনি আমাদের সাথে মিটিং অ্যান্টেড করছেন এতে আমরা সকলে অনেক খুশি! 

"ধন্যবাদ! 

মেহেরিন হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

"অফিসের প্রথম দিনের প্রথম মিটিং'এ ৫ মিনিট লেট আপনি! 

মেহেরিন'র কথায় নির্ঝর বাঁকা হাসল। নিরবের দিকে তাকিয়ে বলল,

"সরি জান! 

মেহেরিন খানিকটা অবাক হলো। উপস্থিত সবাই মুখ টিপে হাসল। নির্ঝর নিজের চেয়ারের সামনে এসে সবাইকে বসতে বলল। অতঃপর নিজে চেয়ারে বসে মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে বলল,

"জ্যামের কারণে আটকে ছিলাম! 

মেহেরিন ফাইলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
"মিটিং শুরু করা যাক! 

অতঃপর মিটিং শুরু হলো। মিটিংয়ের পুরো সময়টাই নির্ঝর মেহেরিন কে দেখছিল। সেই খবর মেহেরিন'র না থাকলেও নিরবের চোখ থেকে তা আড়াল হয় নি। নিরব বেশ বুঝতে পারছে নির্ঝর তাকে দেখানোর জন্য'ই এসব করছে। কি করতে চাইছে সে? তাকে চ্যালেঞ্জ করছে, যে মেহেরিন কে তার থেকে কেড়ে নিবে! 

মিটিং শেষ হবার পর সবাই নির্ঝর কে অভিনন্দন জানাল। নির্ঝর বাইরে বের হতেই পেছন থেকে মেহেরিন ডেকে উঠল,

"মিঃ নির্ঝর চৌধুরী মেঘ! 

নির্ঝর মুখ টিপে হেসে পেছনে ফিরল। মেহেরিন হেঁটে তার সামনে এলো। নির্ঝর বলে উঠল,

"এভাবে নাম ধরে ডাকলে মানুষ ভাববে দুদিন পর'ই আমাদের ডির্ভোস হয়ে যাবে। 

"আপনি যেভাবে আজ মিটিং এ আমাকে ডাকলেন এর জন্য এই ভাবনা টা মানুষের ব্রেইনে প্রভাব ফেলবে না। 

নির্ঝর মুখ খুলে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
"বাসায় মম আছে, অর্ণব তার কাছে! 

মেহেরিন হেসে বলল,
"তা আমি জানি তবে আমি সেই কারণে আপনাকে ডাকি নি।

"তাহলে? 

মেহেরিন নির্ঝরের ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে তাকাল। বলে উঠল,

"মনে হচ্ছে এটার প্লাস্টার খোলার সময় হয়ে আছে। 

নির্ঝর উঠিয়ে নিজে দেখে বলল,

"আহ, এটার কথা তো ভুলেই গেছিলাম!

"তো যাওয়া যাক হসপিটালে! 

"হুম! 

মেহেরিন আর নির্ঝর পা বাড়াল। পেছন থেকে নিরব সবটা দেখল। নির্ঝর পেছনে তাকিয়ে নিরব কে দেখে হেসে মেহেরিন'র একটু পাশে এসে হাঁটতে লাগল। 

বাইরে এসে জন থেকে গাড়ির চাবি চাইল নির্ঝর। মেহেরিন নির্ঝরের দিকে তাকাতেই নির্ঝর গাড়ির দরজা মেহেরিন'র জন্য খুলে দিয়ে বলে উঠল,

"আমার হাত এখন ঠিক আছে,‌ড্রাইভ করতে পারবো! 

মেহেরিন কিঞ্চিত হেসে গাড়ির বসল। নির্ঝর এসে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। খানিকক্ষণ বাদেই মেহেরিন বলে উঠে,

"এতো ফরমালিটি পূরণ করার কোন দরকার নেই?

"মানে..

"এই যে সবার সামনে... ( বাকি কথা না বলে হেসে বলল ) সবাইকে দেখানোর কোন দরকার নেই আপনার আর আমার ভালোবাসার মাঝে কোন খামতি নেই! 

নির্ঝর কিছু বলতে গিয়েও কিছু বলল না। কোথাও যেন কথা আটকে গেল তার! 

-----

হসপিটালে এসে নির্ঝরের প্লাস্টার খোলা হল। নির্ঝর দাঁড়িয়ে ডাক্তার'র সাথে কথা বলে সামনে হাঁটা ধরল। তাকিয়ে দেখল মেহেরিন কোন ডাক্তারের কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। নির্ঝর এসে মেহেরিন'র পাশে দাঁড়াল। বলে উঠল,

"ডঃ ফাহান হোসেন! সাইক্রেটিস, ( মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে.. ) তোমার কি তাকে দরকার ?

মেহেরিন কিঞ্চিত হেসে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,
"সবার প্রয়োজন একদিন ফুরিয়ে যায় নির্ঝর! 

বলেই সামনের দিকে হাটা ধরল মেহেরিন। নির্ঝর কেবিনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মেহেরিন'র সাথে সাথে হাটা ধরল! 

-----

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে মেহেরিন বিছানা ঠিক করছে। আশপাশ তাকিয়ে অর্ণব কে খুঁজছে। নিশ্চিত নির্ঝরের ঘরে। আজও কি সেখানে ঘুমাবে। মেহেরিন এসে ইজি চেয়ারে বসল। তার হাতে একটা বই! তবে পড়তে ইচ্ছে করছে না। ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে অর্ণবের অপেক্ষা করতে লাগল। খানিকক্ষণ বাদেই পায়ের আওয়াজ এলো কানে। মেহেরিন প্রথমে ভাবল অর্ণব আসছে। কিন্তু তার সাথে আরেকজন ও আসছে। মেহেরিন তার পায়ের আওয়াজ ও পাচ্ছে। কে আসছে নির্ঝর! মেহেরিন চোখ মেলে দরজার দিকে তাকাল। নির্ঝরের হাত ধরে অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে দরজার দিকে। মেহেরিন অর্ণব কে দেখে হাসার চেষ্টা করলেও হাসির রেখা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কারণ নির্ঝরের হাতে বালিশ! 

অর্ণব দৌড়ে এসে বিছানার মাঝখানে উঠে বসল। এক হাত দিয়ে এপাশে বলল,

"ড্যাডি! 

আর ওপাশে হাত দিয়ে বলল,

"মাম্মি! 

মেহেরিন অবাক চোখে তাকাল নির্ঝরের দিকে। নির্ঝর মাথা চুলকিয়ে হেসে মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে বলল,

"মেহু! আসলে আমি বলেছিলাম কিন্তু..

কথা শেষ হবার আগেই অর্ণব দৌড়ে এসে নির্ঝর হাত ধরে বিছানায় এনে বসাল। অতঃপর এলো মেহেরিন'র কাছে। একগাল হেসে তাকিয়ে রইল মেহেরিন'র দিকে। মেহেরিন অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

"অর্ণব মাম্মি আর ড্যাডি, একসাথে ঘুমাবে তাই তো! 

অর্ণব হেসে জোরে জোরে মাথা নাড়ল। মেহেরিন হেসে বলল,

"ঠিক আছে ঘুমাবে কিন্তু তার আগে ওখানে থাকা দুধের গ্লাস টা শেষ করো। যাও যাও জলদি! 

অর্ণব খুশিতে দৌড়ে এসে দুধের গ্লাস টা খেতে শুরু করল। পুরো গ্লাস শেষ করল। তার ঠোঁটর উপরে খানিকটা দুধ লেগে গেলো। নির্ঝর আর মেহেরিন তার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। 

পানির পিপাসা হওয়াতে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল নির্ঝরের। অর্ণব তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। ঘরে শুধু ল্যাম্পশেডের বাতিটা জ্বলছে! নির্ঝর ধীরে অর্ণব কে সরিয়ে বিছানায় উঠে বসল। গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়ে সামনে তাকাতেই তার ভ্রু কুনচিত হলো। নির্ঝর পানির গ্লাস রেখে ফোনের আলো জ্বালিয়ে সামনে ধরল। ইজি চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছে মেহেরিন! নির্ঝর বিছানার ওপাশে তাকাল। একটা কোলবালিশ রাখা সেখানে। নির্ঝরের মনে আছে ঘুমানোর আগে মেহেরিন এসে বিছানায় শুয়ে ছিল। তাহলে কি তাদের ঘুমানোর পর'ই উঠে গেল সে। 

নির্ঝর বিছানা ছেড়ে উঠলো। ফোনের আলো জ্বালিয়ে চেয়ারের সামনে এলো। ফোনের আলোয় মেহেরিন'র মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে! তার কোলের কাছে খোলা বই রাখা। নির্ঝর বইটা বন্ধ করে টেবিলে রাখল। একটা চাদর এনে মেহেরিন'র গায়ে দিল। তার মুখের কাছে আসা চুল গুলো কানে গুঁজে দিতেই খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো সে। নির্ঝর দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। 

কিন্তু মেহেরিন'র ঘুমের এই মুগ্ধতা আকৃষ্ট করল তাকে। খুব লোভ হল একটু ছুঁয়ে দেখতে। সে হাঁটু গেড়ে বসে মেহেরিন'র গালে হাত রাখল। মেহেরিন এবারও নড়েচড়ে উঠল। তবে জাগল না। নির্ঝর কিঞ্চিত হাসল। সে হেসে উঠে যেতেই তার কানে মেহেরিন'র আওয়াজ ভাসল। সে আবারো মেহেরিন'র সামনে দাঁড়াল। ঘুমের ঘোরে কিছু বলছে সে। তার ঠোঁট জোড়া নড়ছে। নির্ঝর কান রাখল মেহেরিন'র ঠোঁটের কাছে। কাঁপা কাঁপা কিছু শব্দ এসে বাজল তার কানে। মেহেরিন বলছে,

"ছছছেড়ে যেও না আমায়। প্লিজজ ছেড়ে যেও ননা!

নির্ঝরের মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল। সে মেহেরিন'র মাথায় হাত বোলাল। মেহেরিন চুপ হয়ে গেল। নির্ঝর বিছানার কাছে না এসে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। মেহেরিন কাকে ছেড়ে না যাবার কথা বলছিল। কে সে? বার বার তার মনে উঁকি দিতে লাগল সেই কথা। রাতের অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকাতেই আর্ধেক পুড়া সেই ছবি ভেসে উঠলো। চোখ মেলে তাকিয়ে মুখ খুলে শ্বাস নিল সে! 

বরাবরের মতো অ্যালার্মের শব্দে মেহেরিন'র ঘুম'ই আগে ভাঙল। অ্যালার্ম বন্ধ করে অর্ণবের দিকে তাকাল সে। উল্টো হয়ে শুয়ে আছে সে। মেহেরিন অর্ণব কে ঠিক করে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিল। তার কপালে চুমু খেয়ে সামনে তাকাল। নির্ঝরের ঘুমিয়ে থাকা মুখখানা চোখে পড়ল তার। নিজের ঘুম ঘুম চোখে দেখতে লাগল তাকে। অতঃপর সেখান থেকে উঠে দাঁড়াল সে। তার ঘুমের রেশ এখনো কাটে নি। শাওয়ার নেবার জন্য বাথরুমে'র দিকে পা বাড়াল সে! 

মেহেরিন বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখল। ঘুমে ঢলছে সে। ঘাড় ব্যাথা করছে। ঘাড়ে হাত রেখে চোখ বন্ধ করল সে। গায়ের জামা টা খোলার উদ্দেশ্য জামার পেছনের চেইন খুলল। অতঃপর জামার হাতা খুলে দরজার দিকে তাকাল সে। সামনে নির্ঝর কে দেখতে পেয়ে তার ঘুমের ঘোর মুহূর্তে কেটে গেল। নির্ঝর অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। 

নির্ঝর মাথা ঝাঁকিয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলো। জামায় হাত রেখে তার চিৎকারের সাথে তাল মিলালো মেহেরিন। নির্ঝর ধপাস করে দরজা বন্ধ করে হুট করে মেঝেতে বসে পড়ল। এদিকে মেহেরিন মাথায় হাত রেখে ফ্লোরে বসে পড়ল। আতঙ্কিত পরিবেশ মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেল। নির্ঝর মেঝেতে বসে ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল। বিছানার কাছ থেকে আওয়াজ ভেসে আসল,

"ডড্যাডি! 

নির্ঝর ঢোক গিলে আতঙ্কিত চোখে অর্ণবের দিকে তাকাল। অতঃপর... 

#চলবে....
[+] 4 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#31
#পর্ব_২২

ভোরের আলো পর্দা ভেদ করে ঘরে উঁকি দিয়েছে। অন্ধকার ঘরটা আলোর ছোঁয়া পেয়ে আলোকিত হয়ে গেছে। নির্ঝর আলতো করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল অর্ণব ঘুমাচ্ছে। মুচরাতে মুচরাতে ওপাশে গেল। না আর ঘুম আসছে না। বিছানার থেকে পা নামিয়ে উঠে বসল। হামি ছেড়ে মাথা চুলকাতে লাগলো। তার ঘুমের রেশ এখনো চোখে। বিছানা ছেড়ে উঠল তবে। বাথরুমের দরজার দিকে এগিয়ে এলো। দরজায় হাত দিতেই দরজা খুলে গেল। মিন মিন চোখে সামনে তাকাল সে। অগোছালো মেহেরিন কে ঝাপসা ঝাপসা লাগছে দেখতে। যখন'ই স্পষ্ট ভাবে দেখার চেষ্টা করল ওমনি নির্ঝরের আক্কেল গুড়ুম। চিৎকার দিয়ে উঠলো, মেহেরিনও চেঁচাচ্ছে তার সাথে। দ্রুত দরজা আটকে দিয়ে পেছনে যেতেই ধপাস করে পড়ে গেল সে। মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে রইল। বিছানার কাছ থেকে অর্ণবের গলার স্বর পাওয়া গেল। ঘুম ঘুম চোখে ড্যাডি বলে ডাকছে সে। 

নির্ঝরের ঘুম যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। দ্রুত নিচ থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। নিজের ঘর এসে বিছানায় বসে পড়ল। এতো টুকু দৌড়াতেই হাঁফিয়ে উঠেছে সে। শরীরের অন্য রকম এক অস্থিরতা! অন্যরকম অনুভূতি! চোখ বন্ধ করতেই মেহুর সেই দৃশ্য ভেসে উঠছে। লাফিয়ে উঠল বিছানা ছেড়ে। এটা কি? কি হলো এসব? এমন ভুল কি করে করল সে? আসলেই কি এমন মানায় তাকে? বিছানায় বসে দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে লাগল কি হয়ে গেল এটা! 

মেহেরিন এখনো আতঙ্কিত অবস্থায় বসে আছে মেঝেতে। ঘোর ফেরার সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে উঠল। দ্রুত দরজা বন্ধ করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। কি রকম বোকামি এটা! চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। মন চাচ্ছে নিজের মাথা ফাটিয়ে দিতে। দরজা বন্ধ না করে বাথরুমে কিভাবে চলে এলো সে! দু হাত দিয়ে মাথার চুল টেনে ধরে চিৎকার দিয়ে উঠলো সে। এই চিৎকার কান ভেদ করল নির্ঝরের। চট করে উঠে দাড়িয়ে গেল সে! মাথা ঘুরিয়ে এপাশ ওপাশ দেখতে লাগাল। এদিকে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে বিধায় বালিশের নিচে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল অর্ণব! 

খাবার টেবিলে তিন জন বসে থাকলেও একজন'ই শুধু খেয়ে যাচ্ছে আর সে হলো অর্ণব। চামচ দিয়ে খাবার উঠিয়ে মুখে দিচ্ছে বার বার। নির্ঝরের ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে। মেহেরিন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে চামচ দিয়ে খাবার নেড়েই যাচ্ছে কিন্তু খাচ্ছে না। সাহস নেই আর মেহুর দিকে তাকানোর।‌হঠা্ৎ করেই অদ্ভুত আওয়াজ আসতে লাগাল। সামনে তাকাতেই দেখল মেহু শব্দ করে খাবার তুলছে। নির্ঝরের মনে হলো মেহু একটু পর এসব খাবার তার উপরেই না ঢেলে দেয়। সত্যি'ই কি এমনটা করবে সে। চোখের দিকে তাকাতেই মনে হচ্ছে আস্ত গিলে খাবে। গরম পানিতে সিদ্ধ করবে নাকি। করবে নাই বা কেন? ছোট কোন ভুল করে নি সে। মাথায় রাখা দরকার ছিল এটা মেহুর ঘর। নিজের ঘর ভেবে সোজা এভাবে বাথরুমে ঢুকে পড়া মোটেও উচিত হয় নি। 

নির্ঝর খাবার ছেড়েই উঠে যেতে নিল মেহেরিন শান্ত গলায় বলে উঠে,

"আচ্ছা! 

নির্ঝরের কাছে এই "আচ্ছা" কথাটা হজম হলো না। তবে কি এটা ঝড়ের পূর্বাভাস! মেহু কি এতো সহজে ছেড়ে দিবে তাকে। 

ঘরে পায়চারি করে যাচ্ছে নির্ঝর। মনে স্বস্তি নেই তার। হুট করেই ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। নির্ঝর চমকে উঠল। শুকনো ঢোক গিলে দরজার কাছে এলো। এপাশ থেকে কে জিজ্ঞেস করতেই ওপাশ থেকে মিস মারিয়া বলে উঠে,

"স্যার আমি কফি নিয়ে এসেছি! 

নির্ঝর দরজা খুলল। কফি হাতে মেহু কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিষম খেলো সে। তার পাশে দাঁড়ানো মিস মারিয়া। মেহেরিন হেসে মিস মারিয়া কে চলে যেতে বলে ঘরে ঢুকল। নির্ঝর পিছনে যেতে লাগল। কফি মগ টা টেবিলে রেখে নির্ঝরের দিকে পা বাড়াল সে। নির্ঝর মেহেরিন কে দেখে কাশতে শুরু করল। মেহেরিন হেসে পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিল তার হাতে। নির্ঝর পানি খেয়ে কাশি থামাল। মেহেরিন হেসে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। নির্ঝর চোখ বন্ধ করে বলে উঠল,

"তুমি আমাকে এই ভাবে ভয় দেখাচ্ছ কেন? 

মেহেরিন হাসি থামিয়ে কঠিন মুখে বলে উঠল,
"আমি ভয় দেখাচ্ছি, ( নির্ঝরের কলার ধরে ) সকালে আমাকে কে ভয় দেখাচ্ছিল! 

"আমি মোটেও ভয় দেখাইনি।

"তাই! ( নির্ঝরের মাথায় বাড়ি মেরে ) ম্যানারস জানেন না! 

নির্ঝর মাথায় হাত দিয়ে,
"মারছো কেন? আমি কি জানতাম নাকি!

"কি জানতেন হুম কি জানতেন! 

"আমি কি জানতাম যে তুমি ( মেহেরিন রেগে তাকিয়ে আছে, নির্ঝর তোতলাতে তোতলাতে বলে ) ততুততমি..

মেহেরিন রেগে নির্ঝরের পায়ে দিল পারা। নির্ঝর পা ধরে ধপাস করে বসে পড়ল। মেহেরিন নিচু হয়ে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,

"অসভ্য লোক একটা আপনি! 

নির্ঝর রেগে বলে উঠল,
"আমার দোষ একা কেন দিচ্ছ! তোমার দোষ ছিল না। দরজা লক না করে কেন গিয়েছিলে তুমি হুমম! 

মেহেরিন দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে রইল। চেঁচিয়ে বলে উঠে,

"আআআআ! কেন জানতো আপনি এভাবে চলে আসবেন।

"তাহলে আমি কি জানবো তুমি থাকবে। আমি প্রতিদিন যেভাবে নিজের ঘরে ঘুম থেকে উঠে যাই করি এবারও তাই করেছি! 

"প্রতিদিন যা করতো তাই করেছি হুহ! মনে ছিল না এটা কার ঘর! 

নির্ঝর চুপ হয়ে গেল। মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,
"না! 

"এখন না বাহ না! 

"আমার উপর সব দোষ দেওয়া বন্ধ কর, তোমারও মনে রাখা উচিত ছিল তোমার ঘরে আমি ছিলাম।

মেহেরিন চোখ ছোট ছোট করে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর মুখ ভেংচি কেটে উঠে দাঁড়াল। নির্ঝর নিচেই পা ধরে বসে রইল। মেহেরিন'র হাই হিল তার পায়ের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। হুট করেই নির্ঝরের চোখ পড়ল খাটের নিচে। একটা তেলাপোকা সেখানে ঘুর ঘুর করছে। নির্ঝর তাকে দেখে ভয়ে লাফিয়ে উঠল। দ্রুত খাটের উপর এসে বসে রইল। 

মেহেরিন নির্ঝরের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। নির্ঝর বালিশে মাথা গুঁজে বসে রইল। মেহেরিন জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

"কি করছেন কি? 

নির্ঝর বালিশের নিচ থেকে বলল,
"নিচে তেলাপোকা.. ( যা মেহেরিন বুঝতে পারল না। ) 

"কিহহ? 

"নিচে তেলাপোকা! 

মেহেরিন এবারও বুঝতে না পেরে চেঁচিয়ে বলল,
"কি বলছেন কি এসব? ঠিক করে বলুন!

নির্ঝর বালিশের থেকে মুখ সরালো। মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে বলল,

"নিচে তাকাও?

"ককেন? 

"তাকাও! 

মেহেরিন নিচে তাকাল। দেখল একটা তেলাপোকা তার পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করছে। মেহেরিন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। চারদিক নিস্তব্ধ দেখে নির্ঝর অবাক হলো। মেহেরিন নির্ঝরের দিকে ফিরল। নির্ঝর সাথে সাথে কানে হাত দিল। মেহেরিন জোরে চেঁচিয়ে উঠল! 

"আআআআআআআআআ! 

নির্ঝর কান থেকে হাত সরিয়ে মেহেরিন'র দিকে তাকাল। সে চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার ঠোঁটজোড়া কাঁপছে! চোখ বন্ধ করে দু হাত মুঠ করে আছে। নির্ঝর ডাক দিল,

"মেহু বেঁচে আছো! 

মেহেরিন চোখ মেলে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
"এটা সরান এখান থেকে! 

"আমি পারবো না।

"নির্ঝর! 

বলেই নিচে তাকাল, দেখল তেলাপোকা এক জায়গায় চুপ হয়ে আছে। মেহেরিন সাথে সাথে হাত দিয়ে মুখ দিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর কোলে বালিশ নিয়ে বলে উঠল,

"পারবো না। তেলাপোকা গিলে ফেলুক তোমাকে! 

মেহেরিন রেগে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর মুখ ভেংচি কেটে সরিয়ে নিল। মেহেরিন সেখানেই চোখ বন্ধ করে হাত মুঠ করে তাকিয়ে রইল। নির্ঝর আবারো মেহেরিন'র দিকে তাকাল। তার মুখটা কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। কি জানি বিরবির করছে সে। নির্ঝর মুখ টিপে হেসে উঠল। হালকা কেশে বলে উঠল,

"হাম মেহু..

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
"বেঁচে আছি! 

"আলহামদুলিল্লাহ! তা ওখানেই কি দাঁড়িয়ে থাকবে।

"এটা এখানেই আছে!

"তাই! 

বলেই নির্ঝর নিচে উঁকি মারল। তেলাপোকা দেখে নিজেই একটা ঢোক গিলল। হেসে বলে উঠল,

"মনে হচ্ছে না এটা এখান থেকে চলে যাবে।

"তাড়িয়ে দিন না এটা!

"সরি বলো! 

"কককিহ?

"সরি বলো আর বলো সকালে যা হয়েছে সব দোষ তোমার? 

"কিহহ? কি বললেন আপনি।

"যা শুনেছ তাই! এখন জলদি জলদি বলে ফেলো।

"নাহ বলবো না।

"তাহলে দাঁড়িয়ে থাকো!

বলেই নির্ঝর ওপাশ ফিরে শুয়ে রইল। মেহেরিন রেগে দাঁতে দাঁত চেপে নির্ঝরের থেকে মুখ সরিয়ে নিল। তেলাপোকার দিকে তাকাল‌। এটা এখন তার পায়ের কাছে। মেহেরিন শুকনো ঢোক গিলে বলল,

"হুশ হুশ! হুশ..

নির্ঝর জোরে জোরে হাসতে লাগল। মেহেরিন জোরে বলে উঠল,

"হাসবেন না একদম! 

তখনই তেলাপোকা ঘুরাঘুরি করতে লাগলো। মেহেরিন কাঁদো কাঁদো মুখ করে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। নির্ঝর হেসে তার দিকে ফিরল। মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,

"তাহলে.. সরি বলছো!

মেহেরিন নির্ঝরের দিকে তাকাল। বলে উঠল,
"সরি! 

"আর..

মেহেরিন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
"সব দোষ আমার ছিল! 

নির্ঝর এবার দাঁত বের করে হাসল। চুল গুলো এলোমেলো করে বলল,
"আহ তাহলে মানছো! 

"এখন আসুন! 

নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"আসছি! 

অতঃপর সে নিচে নামার জন্য পা বাড়াল। ওমনি তেলাপোকা আবারো নড়াচড়া শুরু করল। নির্ঝর লাফিয়ে বিছানার এক কোনে বসে পড়ল। মেহেরিন রেগে বলল,

"নির্ঝর! 

"দেখছ না এটা কেমন নড়ছে!

"তো আপনি কেন ভয় পাচ্ছেন।

"যদি আমাকে খেয়ে ফেলে তখন!

"হুহ তেলাপোকা খাবে হাতি, আসছে..! 

"কিছু বললে..

"হ্যাঁ বললাম, আমি আমার কথা রেখেছি। এবার আপনার পালা! 

নির্ঝর কনফিডেন্স নিয়ে বলল,
"ঠিক বলেছ! 

অতঃপর টেবিলের কাছ থেকে একটা বই উঠাল। বিছানা থেকে নেমে মেহেরিন'র কাছে গেল। মেহেরিন শুকনো ঢোক গিলে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে আছে। নির্ঝর ফিসফিসিয়ে বলল,

"নড়বে না একদম! 

মেহেরিন ভয়ে কাঁপতে লাগলো। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল সে। নির্ঝর খুব সাবধানে বই টা তার উপর ফেললো। অতঃপর হেসে বলল,

"আহ মরে গেছে! 

"সত্যি তো!

"হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি, দেখো!

মেহেরিন চোখ মেলে তাকিয়ে নিচে দেখতে লাগল। কিছু দেখতে না পেয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর বাঁকা হেসে বলল,

"তাড়িয়ে ফেলছি! 

মেহেরিন নির্ঝরের হাত চেপে ধরে লাফিয়ে চেঁচাতে লাগলো! নির্ঝর থমতম খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মেহেরিন থেমে শ্বাস নিতে লাগল। নির্ঝর বলে উঠল,

"এখন কেন চেঁচাচ্ছো?

মেহেরিন দম নিয়ে বলল,
"তখন চেঁচাতে পারি নি তাই..

"কিহহ? 

"হুম হুম! 

নির্ঝর মুখ টিপে হেসে বলল,
"ভুল করেছ, দেখো তোমার চেঁচামেচি'তে তেলাপোকা আবারো চলে এসেছে!

"কককোথায়? 

নির্ঝর মেহেরিন'র কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
"তোমার পায়ের কাছে! 

মেহেরিন চোখ বড় বড় করে নির্ঝরের দিকে তাকাল। হুট করেই জরিয়ে ধরল তাকে। শক্ত করে জরিয়ে ধরে বলল,

"তাড়িয়ে দিন তাড়িয়ে দিন! প্লিজ প্লিজ তাড়িয়ে দিন! 

নির্ঝর মিট মিট করে হাসতে লাগলো! 

#চলবে....
[+] 2 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#32
#পর্ব_২৩

"আমার মনে হয় না কাজ টা তুই ঠিক করেছিস! চৌধুরী কোম্পানিকে ৪০% শেয়ার দিয়ে আমাদের কোম্পানির আসলেই কোন লাভ হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। 

মেহেরিন শান্ত ভাবেই নিরবের প্রত্যেকটা কথা শুনছে। নিরব দাঁড়ানো শেষে এবার তার সামনে বসে বলে,
"কি ভাবছিস এতো!

"না কিছু না, তুই বল।

"এতোক্ষণ ধরে তো বলেই যাচ্ছি আমি, কিছুই কি শুনতে পাস নি। 

"পেয়েছি, তবে এটা আমার পার্সোনাল প্রোফিট ছিল।

"মেহেরিন বর্ষা খান পার্সোনাল আর প্রোফেশনাল এক করে নিচ্ছে তাহলে...

মেহেরিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল নিরবের দিকে। নিরব সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে ফাইলের দিকে চোখ বুলাল। বলে উঠে,

"চৌধুরীদের শেয়ার দেবার পর কোম্পানিতে তাদের কোন অগ্রগতি আমার চোখে পড়ছে না।

"ক্ষতিও তো আমার চোখে পড়ছে না নিরব।

নিরব ফাইল টা নিচে রেখে মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

"তোর এডভাইসার আমি! তোকে সঠিক রাস্তা দেখানো আমার দায়িত্ব।

মেহেরিন পানির গ্লাস টা উঠিয়ে নিরবের হাতে দিয়ে হেসে বলে,
"আমি জানি, নে পানি খেয়ে মাথা ঠান্ডা কর! 

পানির গ্লাস টা হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে পানি খেল নিরব। অতঃপর খালি গ্লাস টা রাখতেই মেহেরিন বলল,

"তুই আমার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড। আমার কোন কিছুই অজানা নয় তোর সব জানিস। বলছি না তুই ভুল বলছিস কিন্তু আমি বলবো আমি ভুল সিদ্ধান্ত নেই নি।

"নির্ঝর তোর জন্য ঠিক না।

"অর্ণবের জন্য ঠিক! নিজের টা নিয়ে এইবার নাহলে নাই ভাবলাম নিরব। 

নিরব আর কিছু বলার প্রয়াস করল না। মুখটা ঘুরিয়ে নিল শুধু। দরজায় নক পড়ল। মেহেরিন অনুমতি দিতেই নির্ঝর উঁকি দিল তার কেবিনে। নিরবের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বির বির করে বলল,

"এই তো দেখছি আঠার মতো লেগেই আছে, যেখানেই যাই তখনই দেখি সাথে সাথে ঘুরে! 

মেহেরিন'র ডাকে মুখ ফেরাল তার দিকে। নির্ঝর হেসে ভেতরে প্রবেশ করল। নিরবের পাশের চেয়ারে বসে বলল,

"লাঞ্চ'র টাইম হয়ে গেছে!

"আমি লাঞ্চ করে ফেলুন আমার লেট হবে

নির্ঝর ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
"লাঞ্চ এখানে করব না। মা ফোন করেছে, তিনি লাঞ্চ তৈরি করেছেন আমাদের জন্য। অর্ণব অপেক্ষা করছে! 

মেহেরিন এবার না বলল না। কিঞ্চিত হেসে নিরবের দিকে তাকিয়ে বলল,

"যাবি আমাদের সাথে,‌আমার শাশুড়ি কিন্তু খুব ভালো রাঁধুনি! 

নিরব উঠে চলে গেল বাইরে। নির্ঝর অবাক কন্ঠে বলে উঠে,

"কাহিনী কি হলো? যাবে ও!

"হুম যাবে..

"তাহলে এভাবে চলে গেল কেন? 

মেহেরিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
"রেগে আছে আমার উপর তাই, চলুন! 

------

নির্ঝর আজ বেশ কয়েকদিন পর নিজের আড্ডায় এসেছে। টেবিলের চারদিকে চারজন বন্ধু আজ একসাথে পুল গেইম খেলছে। নির্ঝর বিয়ারের বোতল টা মুখে দিয়ে লাঠি হাতে স্ট্রাইকে আঘাত করে যেই না বলে মা/র/তে যাবে অমনি হঠাৎ করেই একটা মেয়ে নির্ঝরের ঘাড়ে হাত রাখল। নির্ঝর সেই হাত অনুসরণ করে মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল। নির্ঝর হেসে বলল,

"দিশা! 

দিশা নির্ঝরের ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
"হাই হ্যান্ডসাম! 

পাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে আসছিল নির্ঝরের কানে। তাকিয়ে দেখে ফরহাদ, আরিফ আর ঈশান মুখ টিপে হাসছে। নির্ঝর তাদের দিকে রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দিশা'র হাত সরিয়ে বলে,

"কেমন আছো? 

দিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্ঝরের হাত থেকে লাঠি টা নিয়ে স্ট্রাইকে আঘাত করে বল মেরে পকেটে ফেলল। অতঃপর নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

"কিভাবে ভালো থাকি বলো, এতোবার মেসেজ করলাম তোমায় অথচ তুমি আমাকে রিপ্লাই দিলে না। ইগনোর করলে। Avoid করে দিলে আমাকে! 

নির্ঝর হাসল কিছু বলল না। পাশ থেকে ফরহাদ বলে উঠে,

"দিশা নির্ঝর এখন মেরিড! 

দিশা ভ্রু কুঁচকে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলে,
"তাতে কি? নিজের বউ কি এতো ভয় পাও তুমি যে বাকি মেয়েদের সাথে কথা বলাই অফ করে দিলে। উফ নির্ঝর কাম অন এটা তোমাকেই মানায় না! 

নির্ঝর শব্দ করে হেসে শ্বাস ফেলে বলল,
"নির্ঝর এখনো বদলায় নি দিশা, ও আগে যেমন ছিল এখন'ই তাই আছে। কারো সাধ্য নেই আমাকে বদলানোর! 

দিশা হেসে নির্ঝরের খুব কাছে এসে তার হাত দুটো নির্ঝরের ঘাড়ে রেখে বলল,

"আচ্ছা কথা বাড়ালাম না, চলো ডান্স করা যাক

নির্ঝর কিছু বলতে যাবে তখন'ই হুট করে ফোনটা বেজে উঠল তার। নির্ঝর ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল অর্ণবের কল। দিশার হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,

"আজ না দিশা আরেকদিন, আমাকে এখন যেতে হবে! ( ফরহাদ দের দিকে তাকিয়ে) বাই গাইস!

অতঃপর যেই না নির্ঝর বের হতে যাবে ওমনিই দিশা তার হাত খানা ধরে ফেলল। নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে দিশার দিকে তাকাল। দিশা মুচকি হেসে হাত খানা বাড়িয়ে নির্ঝর কে হাগ করতে চাইলো। নির্ঝর মুচকি হেসে এক হাত দিয়ে হাগ করে বলল,

"বাই! 

দিশা নির্ঝরের ঘাড়ের কাছে মুখটা নিয়ে সাদা শার্টের উপর নিজের দু খানা ঠোঁটের চুমু খেয়ে নিল নির্ঝরের অজান্তেই। অতঃপর বলে উঠল,

"বাই! 

নির্ঝর চেয়ার থেকে গায়ের স্যুট টা হাতে নিয়ে ফোন টিপতে টিপতে গাড়ির কাছে চলে গেল। নির্ঝর যেতেই দিশা বাঁকা হাসি দিল। 

বাড়ির কাছে গাড়ি থামিয়ে বের হতেই নিরবের গাড়ি চোখে পড়ল। নির্ঝর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে রাত কম হয় নি। এই ছেলেটা এখনো এখানে! নির্ঝর মুখ ভেংচি কেটে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। কলিং বেল বাজতেই অর্ণব বুঝতে পারল ড্যাডি এসেছে। নির্ঝর স্যুট টা সার্ভেন্ট'র হাতে দিয়ে অর্ণব কে জড়িয়ে ধরল। মেহেরিন আর নিরব বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। গাঢ় লাল ঠোঁটের ছাপ আড়াল হলো না তাদের চোখ থেকে। নিরব বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে সেই ঠোঁটের দিকে। সেই একই চাহনিতে মেহেরিন'র দিকে তাকাল সে। মেহেরিন'র মুখে তেমন কোন প্রভাব নেই। কিঞ্চিত হাসি রেখে নির্ঝর কে বলে উঠে,

"আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন, ডিনার করবেন।

নির্ঝর "আচ্ছা" বলে অর্ণব কে নামিয়ে রেখে ঘরের দিকে পা বাড়াল। নিরব মেহেরিন কে কিছু বলবে তার আগেই মেহেরিন ও নির্ঝরের ঘড়ের দিকে পা বাড়াল। নির্ঝর ঘরে এসে বিছানায় বসে গায়ের শার্ট টা কয়েকটা বোতাম সবে খুলল। এর মাঝেই প্রবেশ ঘটল মেহেরিন'র। সে দাঁড়িয়ে গেল। মেহেরিন হেসে নির্ঝরের সামনে এসে দাঁড়াল। বলে উঠে,

"পরের বার থেকে এসব খেয়াল রাখবেন নির্ঝর।

নির্ঝর মেহেরিন'র কথার কিছুই বুঝতে পারল না। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

"কোনসব? 

মেহেরিন নির্ঝরের হাত ধরে আয়নার সামনে দাড় করিয়ে তার ঘাড়ের শার্ট টা মুঠে করে আয়নায় দেখাল। নির্ঝর চমকে উঠল। মেহেরিন হেসে বলল,

"মনে রাখবেন, বাসায় আমার ছোট একটা ছেলে আছে। আরো অনেক সার্ভেন্ট আছে কোন ভাবে কি চাইবেন তাদের কাছে ছোট হতে। 

নির্ঝর থতমত খেয়ে বলল,
"মেহু আমি সত্যি'ই জানি না এসব কিভাবে মানে..

মেহেরিন নির্ঝরের শার্ট টা ছেড়ে দিল। নির্ঝর কে থামিয়ে দিয়ে বলল,
"থামুন নির্ঝর! আমি এক্সকিউজ চাই নি। শুধু বলছি পরেরবার থেকে দেখেট শুনে আসবেন। স্বাধীনতা পেয়েছেন ঠিক, আমার পার্সোনাল লাইফে আমি আসবো না কিন্তু সেখানে আমার অর্ণব কে টেনে আনবেন না। ও ছোট, এসব বুঝবে না কিন্তু তাই বলে তার মাথা থেকে এসব নেমে যাবে না। খুব ভালোবাসে আপনাকে, ওর ছোট মনে কষ্ট দিবেন না। 

বলেই হন হন করে বেরিয়ে গেল মেহেরিন। নির্ঝর রেগে মাথার চুল হাত দিয়ে এলোমেলো করে ধপাস করে নিচে বসে পড়ল। তার নিজের ও জানা নেই এটা কিভাবে হলো আর কখন হলো। রাগে শরীর কাঁপতে লাগলো তার। কিছু না করেও এসব অপবাদ মাখতে হচ্ছে। সহ্যের বাইরে হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব! 

-----

খাবার শেষে নিরব কে বিদায় দিয়ে মেহেরিন অর্ণব কে নিয়ে ঘরে চলে গেল। নির্ঝরের সাথে একটা কথা অবদি বলল না সে। এদিকে নির্ঝরের খাওয়া বলতে কিছুই হয় নি। নিরব চেয়ার থেকে উঠে নির্ঝর কে বলল,

"কথা আছে তোমার সাথে, বাইরে আসো! 

বলেই উঠে বাড়ির বাইরে চলে গেল। নির্ঝরও উঠে দাঁড়াল। দুই হাত প্যান্টের প্যাকেটে দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল সে। নিরব গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। নির্ঝর তার কাছে যেতেই নিরব নির্ঝরের কলার চেপে ধরে গাড়ির সাথে ঠেকাল। হুট করে এমনটা হওয়ায় নির্ঝর পিছের কাছে বেশ ব্যাথা পেল। নিরব কঠিন গলায় বলে উঠে,

"সাহস হয় কি করে তোমার এমনটা করার! 

নির্ঝর একটু জোরেই হাসল। বলে উঠল,

"আমার সাহস কিন্তু মারাত্মক! 

নিরব কলার আরো জোড়ে চেপে ধরে বলল,
"কি করেছ জানো? কিভাবে পারো এমন নোংরা কাজ করতে। একটুও লজ্জা করলো না তোমার! 

নির্ঝর কলার থেকে নিরবের হাত সরিয়ে বলল,
"তুমি কে আমাকে বলার,‌কি করবো আর কি করবো না! 

নিরব রেগে তাকিয়ে আছে নির্ঝরের দিকে। রাগে তার ঠোঁট দুটো কাঁপছে। দাঁতে দাঁত চেপে সজোরে একটা ঘুসি মারল নির্ঝরের মুখে। নির্ঝর সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে নিচে লুটিয়ে পড়ল। নিরব বলে উঠে,

"বলেছিলাম তোমাকে আমি, মেহেরিন'র কে কষ্ট দিলে আমি ছেড়ে দিবো না তোমায়! 

নির্ঝর নিরবের দিকে তাকাল। উঠে বসল। গালে হাত দিয়ে নিরবের দিকে তাকিয়ে বলল,

"এতো টুকু'ই জোর আছে তোমার! 

নিরব রেগে নির্ঝরের কলার ধরে বলে,
"you bas/tard! 

নির্ঝর হেসে বলল,
"আমি আসলেই অনেক বড় বা/স্টার্ড! পেছনে তাকিয়ে দেখো! 

নিরব ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকিয়ে দেখল বেলকনিতে মেহেরিন দাঁড়ানো। তাকে দেখে নির্ঝরের কলার ছেড়ে দিল সে। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। নির্ঝর নিরবের কলার ধরে কানে ফিসফিসিয়ে বলল,

"বললাম না অনেক বড় বা/স্টার্ড আমি... 

দাঁত বের করে হেসে দিল। মেহেরিন চলে গেল বেলকনি ছেড়ে! 

নির্ঝরের ঘরে...
মেহেরিন আইস ব্যাগ নির্ঝরের গালে ধরেছে। ব্যাথাটা খুব লেগেছে। গালের একপাশ লাল হয়ে গেছে। মেহেরিন আইস ব্যাগ ছেড়ে দিতেই নির্ঝর তা নিজের গালে ধরল। মেহেরিন নির্ঝরের সামনে ঔষধ রেখে বলল,

"খেয়ে নিবেন ব্যাথা সেরে যাবে।

বলেই উঠতে যাবে তখন নির্ঝর হেসে বলল,
"তোমার বন্ধু অনেক ভালোবাসে তোমায়..

মেহেরিন শান্ত গলায় বলল,
"ভালোবাসে বলেই সে বন্ধু!

নির্ঝর মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে বলল,
"একটু বেশিই ভালোবাসে তোমায় নাহলে আমাকে যেভাবে শাসাল! 

মেহেরিন হেসে বলল,
"তবুও যা করেছে মন থেকেই করেছে। অন্যদের মতো আমাকে দেখানোর জন্য কিছুই করে নি।

বলেই মেহেরিন বেরিয়ে যেতে নিল। দরজার কাছে আসতেই নির্ঝর বলে উঠল,
"কি বলতে চাও তুমি!

মেহেরিন নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
"এই যে, আমাকে দেখানোর জন্য আত্নরক্ষা না করে সিমপ্যাথি পাওয়ার আশা তো করে নি।

নির্ঝর একটু জোরেই বলল,
"মেহু! 

মেহেরিন মুচকি হেসে বলল,
"ভুল বলিনি, নিরব কে যেমন বুঝি আপনাকেও তেমন বুঝি! 

বলেই মেহেরিন চলে গেল। রাগে নির্ঝরের শরীর জ্বলতে লাগল। হাতের আইস ব্যাগ মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বাইরে চলে এলো সে। মেহেরিন নিজের ঘরের কাছে আসতেই নির্ঝর তার হাত টেনে ধরে দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে নিল। হুট করেই এমন কিছু হওয়ায় মেহেরিন চমকে উঠলো। নির্ঝর রেগে তার বাহু দু খানা চেপে ধরল। মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নির্ঝর তার দিকে ঝুঁকে এসে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

"এটা বলছো আমি সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য মার খেয়েছি, না বলতেই এসব বুঝে গেছ। অথচ আমি যে বলে যাচ্ছি সেই লিপস্টিক এর দাগ সম্পর্কে আমি কিছু জানি না তা কেন বিশ্বাস করছ না। 

মেহেরিন হেসে বলল,
"আমার বিশ্বাস করা না করাতে কি যায় আসে নির্ঝর! আমি বিশ্বাস করা কি খুব জরুরী? 

নির্ঝরের মুখটা মলিন হয়ে গেল। ছেড়ে দিল মেহেরিন কে। মেহেরিন বলে উঠল,

"আমি সেই সম্পর্কে কোন অভিযোগ নেই। আমি আগেও বলেছি আপনার পার্সোনাল লাইফে আমি আসছি না। কিন্তু অর্ণব কে তাতে টানবেন না। যার সাথে যা ইচ্ছা করুন কিছু বলার নেই। তবে এটা খেয়াল রাখুন একজন ভালো বাবা থেকে নিজের নামটা যেনো সরাতে না হয়। আর কিছু না হোক একজন ভালো বাবা হিসেবে থাকুন। গুড নাইট! ঘুমাতে যান! 

বলেই মেহেরিন চলে গেল ঘরের ভিতর। নির্ঝর সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। মেহেরিন'র দরজা লক করার শব্দ টা তার কানে বাড়ি গেল। মাথায় অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা হতে লাগালো। নির্ঝর এক হাত মাথায় দিয়ে অন্যহাত দেওয়ালে আকড়ে ধরল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে সে.. 

#চলবে....
[+] 3 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#33
Nirjhore carektar ta aktu ugly lagece vai. Kono josh nai
[+] 1 user Likes Raj_007's post
Like Reply
#34
#পর্ব_২৪

"ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি! আমি তোমাকে ভালোবাসি মেহেরিন! এবার তুমি বলো.. ভালোবাসবে কি আমায়? 

গাঢ় গোলাপ হাতে নিয়ে হাঁটু গেড়ে মেহেরিন কে প্রপোজ করল সে। মেহেরিন'র ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে। অনেকদিন ধরেই এটার অপেক্ষায় ছিল সে। তার ভালোবাসার প্রকাশ অবশেষে হয়েই গেল। সে কতোটা ভালোবাসে এবার বলতে পারবে তাকে। মেহেরিন বিলম্ব না করে গোলাপ টা হাতে নিয়ে তার দিকে ঝুকল। তার এলোমেলো চুল গুলো হাত দিয়ে নেড়ে বলল,

"ভালোবাসি! 

সে একটা মিষ্টি হাসির সাথে দাঁড়িয়ে গেল। জড়িয়ে ধরল তাকে। রাতের এই খোলা আকাশের নিচে তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকবে। সমুদ্রের পাশ থেকে ঢেউয়ের শব্দ ভেসে আসছে। মেহেরিন দু হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে সেই শব্দ শুনে যাচ্ছে। হুট করেই শীত লাগছে তার। সে আরো গুটিসুটি মেরে তার বুকের মাঝে ঢুকে যাচ্ছে। 

গায়ের জ্যাকেট টা খুলে মেহেরিন'র গায়ে দিয়ে দিল সে। সামনেই আগুন ধরানো হয়েছে। মেহেরিন কে সেখানে বসিয়ে গিটার হাতে নিল সে। গিটারের সুর বাজাতে লাগল তার সাথে গান ধরল সে..

"মিলে হো তুম হামকো
বডে নাসিবো সে
চুরায়া হ্যায় ম্যানে
কিসমত কি লেকেরোন সে

তেরে মহব্বত সে সাসেই মিলি হৈ
সাদা রেহনা দিল মেং কারিব হোকে

(মিলে হো তুম হামকো
বডে নাসিবো সে
চুরায়া হ্যায় ম্যানে
কিসমত কি লেকেরোন সে).....

সেই দিনের এক গান আজও ভেসে আসছে মেহেরিন'র কানে। সে যাবার পর এই গান আর কখনো শুনে নি সে।  ঘুম ঘুম চোখে সেই গান শুনছে সে। কিন্তু কে গাইছে এই গান.. মেহেরিন চোখ মেলে তাকাল। ভোরের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ তাহলে এলার্ম বাজল না কেন? বিছানার পাশে তাকিয়ে অর্ণব কে দেখতে পেলো না সে। বুঝতে বাকি রইল না এটা তার কাজ। অর্ণব প্রায়'ই এমনটা করে। মেহেরিন'র আগে সে উঠে গেলে এলার্ম বন্ধ করে দিবে। ভাবে মাম্মি হয়তো আরো ঘুমাবে। মেহেরিন মুচকি হেসে বিছানা ছেড়ে উঠলো। গানটা এখনো ভাসছে তার কানে। তার মানে এটা তার স্বপ্ন নয়, সত্যি'ই কেউ গাইছে এই গান। ঘরের দরজা খোলা। মেহেরিন গানের গলা অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে নিচে চলে এলো। বসার ঘরে নির্ঝর আর অর্ণব গান গাইছে। নির্ঝরের হাতে একটা গিটার। সে গান গাইছে আর অর্ণব তার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে। এই সোফায় উঠে লাফাচ্ছে তো এই গানের সাথে নাচছে। সব সার্ভেন্ট দাঁড়িয়ে তাদের কাহিনী দেখছে। তাদের চোখে মেহেরিন কে পড়তেই যে যার মতো চলে গেল কাজে। নির্ঝর গান শেষ করে অর্ণবের চুল গুলো নেড়ে বলল,

"পছন্দ হয়েছে! 

অর্ণব দাঁত বের করে হেসে মাথা নাড়ল। উপরের দিকে তাকিয়ে বলল,

"মাম্মি, মাম্মি! 

নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে বলে,
"মাম্মি! 

অতঃপর উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে মেহেরিন সিঁড়ি বেয়ে নামছে। অর্ণব দৌড়ে যায় তার কাছে। মেহেরিন তার কপালে চুমু খেয়ে বলে,

"গুড মর্নিং অর্ণব সোনা!

অর্ণব দাঁত বের করে হেসে বলে,
"গুড মর্নিং মাম্মি! 

মেহেরিন হেসে তার চুল গুলো এলোমেলো করে দেয়। অতঃপর তাকাল নির্ঝরের দিকে। নির্ঝর কে দেখে একগাল হাসল সে। তার হাসি দেখে নির্ঝর ও হেসে দিল। তবে এই হাসিতে অদ্ভুত কিছু ছিল না।‌ সহজ সরল একটা মিষ্টি হাসি যা প্রত্যেক সকালকেই সুন্দর করে দেয়‌। রাতের ঘটনার পর এই হাসি আশা করে নি সে মেহেরিন'র কাছে। তাই হয়তো একটু বেশিই ভালো লাগছে! 

-----

নিরব পায়চারি করে মেহেরিন'র কেবিনের বাইরে। ঢুকবে কি না এখন অবদি তা ঠিক করতে পারে নি। বুঝতে পারছে না কি হবে। এই এক পা আগাচ্ছে তো আবারো দু পা পিছিয়ে যাচ্ছে। মেহেরিন পিএ কে দিয়ে খবর পাঠালো তাকে আসার জন্য। নিরব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুকনো ঢোক গিলে ঢুকল মেহেরিন'র কেবিনে। মেহেরিন'র চোখ ল্যাপটবে।‌নিরব তার সামনে এসে চেয়ারে বসল। মেহেরিন তার হাতে একটা ফাইল ধরিয়ে দিয়ে বলল,

"একটু চেক কর এটা! 

নিরব মাথা নাড়িয়ে ফাইল টা হাতে নিল।‌ ফাইল চেক করার মাঝে তার মন নেই। তার মন মেহেরিন'র দিকে। একটু পর পর'ই তাকে দেখছে। মেহেরিন ল্যাপটব থেকে চোখ সরিয়ে নিরব কে বলে উঠে,

"আমাকে দেখতে বলি নি, ফাইল চেক করতে বলেছি।

"হুম করছি!

"এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।‌ গতরাতের কিছুই জিজ্ঞেস করব না তোকে।

"কিন্তু মেহেরিন..

"গতরাতের কিছু নিয়েই কথা হবে না।‌কোন কিছু নিয়েই না গট ইট।

"ওকে!

"যা নিজের কেবিনে গিয়ে চেক কর নাহলে এখানে বসে থেকে অস্থির হয়ে পড়বি।

নিরব বিনা বাক্যে ফাইল নিয়ে উঠে চলে গেল। 

---- 

অর্ণব কে খুঁজতে খুঁজতে মেহেরিন নির্ঝরের ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব বেলি ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছে। ঘ্রাণটা বেশ জোরালো। মেহেরিন চোখ মেলে চারদিকে তাকাল।‌‌স্বপ্ন নয় তো এসব,‌দি আসবে তাহলে এখন! কিন্তু না তা‌ তেমন কিছু হলো না। মেহেরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল! 

পা বাড়াল বেলকনির দিকে।‌ গুন গুন শব্দ ভেসে আসছে সেখান থেকে। মেহেরিন কাছে গিয়ে দেখল, নির্ঝর আনমনে বেলী ফুলে পানি দিচ্ছে। গাছটায় বেলী ফুল ফুটতে ও দেখা যাচ্ছে। মেহেরিন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল সাদা রঙের সেই বেলী ফুলের দিকে। অতীত আবারো আচমকা উঁকি দিল...

সারা বাড়ি মাথায় করে নিরু চেঁচিয়ে যাচ্ছে। শুভ্র খান সকালের পেপার পড়াতে সবে মাত্র মনোযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু নিরুর চেঁচামেচি'তে তা সম্ভব হচ্ছে না। নিরু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে মেহের মেহের বলে ডেকেই যাচ্ছে। তার আওয়াজে বাড়ির সব সার্ভেন্ট হাজির। কিন্তু যাকে খুঁজছে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কাউকে জিজ্ঞেস করেও হদিস পেলো না তার। সারা বাড়িতে খুঁজেও যখন মেহের কে পেলো না তখন ছাদে চলে এলো সে। 

মেহের এক কোনে বসে তার ছোট্ট হাত দ্বারা বেলী ফুলের মালা গাথছে। ছাদের দরজা খোলার শব্দে উঠে দাঁড়িয়ে গেল সে। নিরু কে দেখে মালা খানা নিজের পিছনে লুকিয়ে ফেলল। নিরু রেগে তার সামনে এসে দাঁড়াল। রাগে ফুঁসছে সে। চিৎকার করে বলে উঠে,

"মেহের তুই আবারো আমার গাছের ফুল ছিড়েছিস! 

মেহের দাঁত বের করে হেসে মাথা নাড়ল। নিরু রেখে নাক ফুলিয়ে বলল,

"আবার হেসে বলছিস! তোকে তো আমি..

মেহের পাশ কাটিয়ে এক দৌড় দিয়ে বলল,
"কিছুই করতে পারবে না! 

"তবে রে..

নিরুও ছুট তার পিছনে। দু বোন মিলে পুরো ছাদ দৌড়াদৌড়ি করে বাড়ির ভেতর আসলো। বাড়ির ভিতরেও তুমুল ঝড়। একপর্যায়ে মেহেরের হাত থেকে ফুলের মালা টা পড়ে গেল। আর সেই মালাটায় নিরু পাড়াও দিয়ে ফেলল। পুরো মালা নষ্ট হয়ে গেল। মেহের সেই নষ্ট মালা নিয়ে কি কান্না। নিরু দু হাত দিয়ে তাকে কোলে বসিয়েও সেই কান্না থামাতে পারছে না। অবশেষে শুভ্র খান এসে আইসক্রিম খাইয়ে শান্ত করছে তাকে... 

ঘাড়ে কারো উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠলো মেহেরিন। তার কল্পনার সমাপ্তি ঘটল। সামনে তাকিয়ে দেখল নির্ঝর তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। নির্ঝর আবারো তাকে ঝাঁকিয়ে বলল,

"মেহু!

"হুম..

"তুমি এখানে..

মেহেরিন থমথম খেয়ে গেল। কেন এসেছিল তাও মনে হচ্ছে ভুলে যাচ্ছে। খানিকটা সময় লাগিয়ে বলল,

"আসলে অর্ণব! অর্ণব কে খুঁজতে এসেছি..

"অর্ণব তো এখানে নেই।

"এখানে নেই মানে কোথায় সে! পুরো বাড়িতে খুঁজেছি আমি, কোথায় নেই ও! 

"শান্ত হও মেহু, হাইপার কেন হচ্ছো? অর্ণব মিস মারিয়ার সাথে শপিং এ গেছে।

"মিস মারিয়ার সাথে!

"হ্যাঁ, হুট করেই আমার কাছে এসে বলল মিস মারিয়ার সাথে শপিং এ যাবে। 

"ও নিজে বলল..

"হুম! 

"হঠাৎ কি হলো ছেলেটার! 
বলেই আনমনে আবারো তাকাল বেলী ফুলের দিকে। নির্ঝর শান্ত গলায় বলে উঠে,

"মেহু!

"হুম!

"ঠিক আছো তুমি!

মেহেরিন অদ্ভুত ভঙিতে হেসে বলল,
"হ্যাঁ ঠিক আছি আমি, আমার আবার কি হবে? 

"না এমনেতেই।

"আচ্ছা আমি যাচ্ছি..

বলেই চলে যেতে নিয়েও মেহেরিন আবারো পিছনে ফিরল। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বেলী ফুলের দিকে। নিরু মারা যাবার পর এই ফুল আর কখনো এই বাড়িতে আনে নি সে। এই বেলী ফুলের ঘ্রাণ তাকে বার বার নিরুর কথা মনে করিয়ে দেয়। জাগিয়ে তুলে তার পুরনো আঘাত! মেহেরিন বেলী ফুল থেকে চোখ সরিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল। শীতল গলায় বলল,

"বেলী ফুলের গাছ টা কার!

নির্ঝর মুচকি হেসে বলল,
"এটা! আমার, খুব পছন্দের। বেলী ফুলের ঘ্রাণ খুব ভালো লাগে আমার। তোমার লাগে না।

মেহেরিন কঠিন গলায় "না" বলে চলে এলো সেখান থেকে।‌ নির্ঝর খানিকটা অবাক হলো। বেলী ফুল কে ছুঁইয়ে বলতে লাগল,

"তোমাকে ভালো না লাগার কারণ কি? 

----

মাঝরাতে... 
বিছানার চাদর সরিয়ে টিপ টিপ করে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে অর্ণব। একবার এপাশ তাকিয়ে দেখল মেহেরিন ঘুমাচ্ছে। গভীর ঘুম! অর্ণব তবুও চোখের পাতা ফেলে ফেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ল্যাম্পশ্যাডের আলোয় মেহেরিন'র মুখ ভালোই দেখা যাচ্ছে।‌ অর্ণব উঠে বসে তার মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে। না মেহেরিন জাগছে না। 

অর্ণব খুব সাবধানে উঠে গেল বিছানা ছেড়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১০.৫০ বাজে। এ্যালার্ম ঘড়িটা হাতে নিয়ে ১২.০০ টার এ্যালার্ম দিল সে। অতঃপর নির্ঝরকে ফিসফিসিয়ে ডাকতে লাগল,
"ড্যাডি..

 নির্ঝরও তখনো ঘুমায় নি। অর্ণব তাকে ছুঁতেই তার দিকে তাকাল সে। চোখ টিপ দিল একটা। অর্ণব দাঁত বের করে হেসে দিল। 

রান্নাঘরে এই নিয়ে তৃতীয় বার চামচ পরার আওয়াজ এলো। নির্ঝর আর অর্ণব দু'জনেই চোখ বন্ধ করে নিল। না এই আওয়াজ উপরে পৌঁছিয়ে বলে মনে হচ্ছে না। নির্ঝর ফিক করে হেসে কেক বানানোর মিশ্রণটি তৈরি করতে লাগলো। মিশ্রণটি ঠিক আছে কি না তা দেখার জন্য চামচ দিয়ে খানিকটা নিয়ে চেখে দেখল। অতঃপর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে দিল। অবশেষে বেক করার জন্য ওভেনে রাখা হলো মিশ্রণটি। নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণবের দিকে তাকাল। তাকে কোলে উঠিয়ে টেবিলে বসাল। চকলেটের খানিকটা তার গালে মাখিয়ে দিল। অতঃপর তাকে নিচে নামিয়ে দিল। অর্ণব খানিকটা চকলেট হাতে নিয়ে নির্ঝরের পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগল। 

কেক বের করা হয়েছে। চকলেট কেক! দুজন মিলে এবার কেক ডেকোরেট করা শুরু করল। কাজ শেষ হবার পর নির্ঝর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল,

"অর্ণবের মাম্মির কেক রেডি।

অর্ণব হেসে বলল,
"মাম্মি! 

হুট করেই উপর থেকে এ্যালার্ম ঘড়ির শব্দ আসতে লাগল। দুজনেই একসাথে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাল। ১২ টা বেজে গেছে। নির্ঝর হেসে বলে উঠে,

"কাজ শুরু করা যাক।

অর্ণব হেসে জোরে জোরে মাথা নাড়াতে থাকে। 

মেহেরিন ঘুম ঘুম চোখে এ্যালার্ম ঘড়ির দিকে হাত বাড়াল। এ্যালার্ম বন্ধ করে তার পাশে হাত দিতেই খালি পেল। মেহেরিন চট করে চোখ মেলে তাকাল। অর্ণব কে আর নির্ঝর কে দেখতে না পেয়ে লাফিয়ে উঠলো সে। উঠে বসে চারদিকে খুঁজতে লাগল।

"কোথায় গেলো এই দুজন! 

চোখ পড়ল, ঘরের দরজা খোলা। বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল সে। হাটতে হাঁটতে বসার ঘরে এলো। কিন্তু এখানকার সবকিছুই অন্ধকার। মেহেরিন সাথে করে ফোনটাও আনে নি। আঁধারের মাঝেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল।

"অর্ণব! অর্ণব সোনা কোথায় তুমি? নির্ঝর আপনি কি ওর সাথে আছেন। কোথায় আপনারা?

তার কথায় শায় কেউই দিল না। শেষ সিড়ি বেয়ে নামতেই হাতের সাথে কিছু একটা বাজল। সাথে সাথে তার উপর কিছু পড়ল বলে মনে হলো। আলো জ্বলে উঠলো। মেহেরিন থমতম খেয়ে সামনে তাকাল। নির্ঝর আর অর্ণব দাঁড়ানো। অর্ণবের হাতে একটা কেক। মেহেরিন ভ্রু কুঁচকালো। অর্ণব কেক হাতে সামনে এসে বলল,

"হ্যাপি বার্থডে মাম্মি...! 

মেহেরিন হাঁটু গেড়ে বসল তার সামনে। চোখ পড়ল কেক'র উপর। মেহেরিন কেক হাতে নিয়ে দেখল তাতে লেখা, হ্যাপি বার্থডে মাম্মি! সে হেসে বলল,

"তুমি বানিয়েছ? 

অর্ণব মাথা নাড়িয়ে বলল,
"আমি আর ড্যাডি! 

মেহেরিন কেক টা টেবিলে রেখে জরিয়ে ধরল অর্ণব কে। চুমু খেলো তার কপালে। বলে উঠল,

"থ্যাংকু অর্ণব সোনা! মাম্মি খুব হ্যাপি!

অর্ণব দাঁত বের করে হাসল। নির্ঝর এসে সামনে দাঁড়াল মেহেরিন'র। মেহেরিন উঠে দাঁড়াল। নির্ঝর মুচকি হেসে বলল,

"হ্যাপি বার্থডে মেহু! 

মেহেরিন মুচকি হাসল। বলে উঠল,

"থ্যাংকু! 

অর্ণব উঠে মেহেরিন'র হাত নাড়িয়ে তাকে ডাকল। মেহেরিন অর্ণবের থিতুনিতে হাত রেখে বলল,

"কি অর্ণব সোনা! 

অর্ণব নিজের গালে হাত রেখে বলল,
"ড্যাডি! 

মেহেরিন বুঝতে পারল না। সে হেসে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝরও তেমন কিছু বুঝল না। অর্ণব আবারো গালে হাত রেখে বলল,
"ড্যাডি! 

মেহেরিন বলে উঠল,
"বুঝছি না অর্ণব!

অর্ণব হায় করে কপালে হাত রাখল। হাত দিয়ে ইশারা করে মেহেরিন কে ডাকল। মেহেরিন হাঁটু গেড়ে বসতেই অর্ণব তার গালে চুমু খেয়ে বলল,

"ড্যাডি, থ্যাংকু! 

মেহেরিন বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। নির্ঝর প্রথমে শকটা খেয়েও এবার ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগলো। অর্ণব আবারো মেহেরিন কে দেখিয়ে নির্ঝরের দিকে ইশারা করল। মেহেরিন থতমত খেয়ে বলল,

"এসব পরে অর্ণব কেক কাটবো। এসো..

বলেই অর্ণবের হাত ধরে টানতেই অর্ণব হাত গুটিয়ে নিল। এসে ধরল নির্ঝরের হাত। মেহেরিন বিরক্ত চোখে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর অর্ণব কে কোলে নিয়ে বলল,

"অর্ণব কেক কেটে নিই! 

অর্ণব নির্ঝরের গলা জড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।‌ নির্ঝর আবারো বলে উঠে,

"অর্ণব তো গুড বয় নাহ, তাহলেই অর্ণব এখন কেন রাগ করেছে? মাম্মির জন্মদিনে এমন করে অর্ণব! 

অর্ণব নড়েচড়ে উঠলো তবে মুখ ফিরাল না। গম্ভীর হয়ে রইল। মেহেরিন নির্ঝরের কাছে এসে দাঁড়াল। নির্ঝর বলে উঠল,

"মেহু, দু মিনিট দেখো অর্ণব.. 

মেহেরিন হেসে বলল,
"অর্ণব কে আমার কোলে দিন। অর্ণব মাম্মির কোলে আসো। 

অর্ণব মাথা নাড়িয়ে না করল। মেহেরিন একটু জোর করেই কোলে নিল তাকে। অর্ণব মুখটা গম্ভীর করেই রাখল। মেহেরিন হেসে বলল,

"আমার অর্ণব রাগ করলে খুব মিষ্টি লাগে দেখতে। তাই অর্ণব কে একটা মিষ্টি চুমু তো খেতেই হয় তাই না অর্ণব। 

অর্ণবের মুখে মিটিমিটি হাসি দেখা গেল। মেহেরিন হেসে তার গাল ধরে চুমু খেল। অর্ণব ফিক করেই হেসে দিল। মেহেরিন আবারো বলল,

"থ্যাংকু অর্ণব মাম্মি কে এতো সুন্দর একটা সারপ্রাইজ দেবার জন্য! 

অর্ণব উঠে মেহেরিন'র গালে চুমু খেল। অতঃপর মেহেরিন তাকাল নির্ঝরের দিকে। সে নির্ঝরের খানিকটা কাছে এসে দাঁড়াল। মুখ খুলে শ্বাস নিয়ে শুকনো ঢোক গিলে কিঞ্চিত হেসে বলল,

"ধন্যবাদ নির্ঝর! 

বলেই নির্ঝরের গালের কাছে নিজের ঠোঁট টা এগিয়ে দিল। মেহেরিন'র এভাবে কাছে আসা নির্ঝরের অস্থিরতা বাড়িয়ে দিল। মেহেরিন'র ঘন নিঃশ্বাস নির্ঝরের গালের কাছে পড়তেই তার শরীরে কাঁটার মতো বিঁধে গেল। নির্ঝর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হলো সময় তার কাছে সেখানেই থেমে গেছে। নির্ঝর শুকনো ঢোক গিলল। মেহেরিন তার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার গালের উপর ছোঁয়াতেই নির্ঝরের দম মনে হলো বন্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর কোথায় চিন চিন ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো। এ কেমন অনুভূতি, এ অনুভূতি'তে যেমন সে ভালোবাসার স্বাদ পাচ্ছে ও
তেমনি কষ্টও অনুভব করছে। এ কিরকম অনুভূতি! 

মেহেরিন নির্ঝরের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
"সরি! 

অতঃপর সামনে ফিরে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর চোখ ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে। মেহেরিন খুব সূক্ষ্ম ভাবেই বলল,

"শুধুমাত্র অর্ণবের জন্য! 

বলেই হেসে দিল। নির্ঝরের চোখ পড়ল সেই হাসির দিকে। কেন জানি এই হাসি দেখলে তার মনে এক ধরনের শান্তি অনুভব করে সে। নির্ঝরের ঠোঁটের হাসি ফুটল আর সেই হাসির কারণ হলো মেহু! 

মেহেরিন শীতল গলায় বলল,
"কেক কাটা যাক! 

নির্ঝর হেসে মাথা নাড়ল। অতঃপর এসে মোমবাতি জ্বালাল। মেহেরিন মোমবাতি ফুঁ দিতেই নির্ঝর আর অর্ণব হাত তালি দিল। মেহেরিন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। খুব আনন্দ হচ্ছে তার।

অর্ণব ছুড়ি ধরল, তার সাথে মেহেরিন হাত ধরে কেক কাটল। নির্ঝর পাশে বসে হাততালি দিল। কেক'র প্রথম অংশ অর্ণব নিয়ে তা মেহেরিন কে খাওয়ালো। লাফিয়ে নির্ঝরের কাছে এসে তাকে খাওয়ালো। মেহেরিন কেক'র নিয়ে অর্ণব আর নির্ঝর কে খাওয়ালো। নির্ঝর ও কেক হাতে নিল। তবে তা না খাইয়ে মেহেরিন'র গালে লাগিয়ে দিল। মেহেরিন হা হয়ে তাকিয়ে রইল। সুযোগটা হাতছাড়া করল না অর্ণব। মেহেরিন হেসে কেক হাতে নিয়ে দুজনের পিছনে দৌড়াতে লাগল। 

-----

মেহেরিন'র বার্থডে উপলক্ষে এবার পার্টি থ্রু করেছে নিরব। পাঁচতারা হোটেলে সমস্ত আয়োজন করেছে।   নির্ঝর আর অর্ণব পাটিতে উপস্থিত। তাদের দুজনেই মেজেন্ডা রঙের স্যুট পড়েছে। ইতিমধ্যে ফরহাদ, ঈশান আর আরিফ চলে এসেছে। তারা এসে অর্ণব কে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল। নির্ঝর দাঁড়িয়ে পুরো অ্যারেঞ্জমেন্ট দেখছে। খোলা আকাশের নিচে আয়োজন করা হয়েছে সবকিছুর। চারদিক লাইটিং করা। মেহমান ও আসতে শুরু করেছে। ঈশান ফোড়ন কেটে বলে উঠে,

"পার্টি থ্রু করেছে নিরব, মানে এই কাজটা কি তোর করার উচিত ছিল না নির্ঝর! 

নির্ঝর কিছু না বলে কঠিন মুখে তাকিয়ে রইল। ফরহাদ হেসে বলল,

"বাদ দে, বেচারা এভাবেই খুব কষ্ট পেয়েছে ‌

নির্ঝর মুখ ভেংচি কাটলো। অর্ণব তা দেখে ফিক করে হাসল। নির্ঝর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। বলে উঠল,

"অর্ণব আর তার ড্যাডি মাম্মি কে ফার্স্ট সারপ্রাইজ দিয়ে ফেলেছে। তাই না অর্ণব..

অর্ণব হেসে মাথা নাড়ল। নির্ঝর হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
"নিলব তো এখন বাসি সারপ্রাইজ দিচ্ছে! 

নির্ঝরের কথা শুনে সবাই ফিক করে হেসে দিল। অর্ণব আরিফের কোল থেকে নেমে গেল। মেহেরিন এসে পড়েছে। সে দৌড়ে চলে গেল তার কাছে। নির্ঝর পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, ‌মেজেন্ডা রঙের একটা গাউন পড়ে আসছে মেহেরিন। তার পিছনে অফিসের চার পাঁচ জন লোক। তার হাতে একটা ল্যাম্পটব আর কানে ব্লুটুথ। নির্ঝর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

"এই মেয়েটা আজকের দিনেও কাজ নিয়ে আছে! 

অতঃপর আবারো কেক কাটলো মেহেরিন। প্রথম কেক টা অর্ণব কে খাওয়ালো। এরপর কাউকেই কেক খাওয়াতে পারল না সে। নিরব এসে কেক খাওয়ালো তাকে। তার গালে লাগিয়ে দিল তা। নির্ঝর দূর থেকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে তার উপর। 

হঠাৎ করেই জন আসলো নির্ঝরের কাছে। তার হাতে একটা গিফট। নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই জন বলল,

"ম্যাম'র জন্য এসেছে! 

"কে পাঠিয়েছে?

"নাম দেওয়া নি! 

নির্ঝর গিফট হাতে নিয়ে,
"আচ্ছা যাও! 

অতঃপর গিফট নিয়ে এলো মেহেরিন'র কাছে। গিফট বক্স দেখে অর্ণব ও ছুটে আসলো। নির্ঝর মেহেরিন'র হাতে গিফট দিয়ে বলল,

"কে দিয়েছে জানা নেই, গার্ডের হাতে দিয়ে গেছে। 

মেহেরিন খানিকটা অবাক হলো। অতঃপর গিফট বক্স টা হাতে নিল। বক্সটা বেশ বড়োই। মেহেরিন এসে তা টেবিলে রাখল। অর্ণব চেয়ারে দাঁড়িয়ে গিফট টা দেখতে লাগল। গিফটের প্যাকেটিং তার বেশ পছন্দ। মেহেরিন অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল,

"গিফট টা এখন খুলতে চাও! 

অর্ণব জোরে জোরে মাথা নাড়ল। মেহেরিন হেসে অর্ণবের মাথার চুল এলোমেলো করে দিল। নির্ঝর এসে দাঁড়াল অর্ণবের পাশে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল তাকে। মেহেরিন গিফট বক্স খুলতে লাগল। প্যাকেটিং খুলতেই একটা বক্স দেখল সে। অতঃপর বক্সের মুখ খুলতেই কয়েকটা বেলুন উড়ে যেতে নিল। অর্ণব অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বেলুন গুলোর দিকে। নির্ঝর ভ্রু কুচকালো। মেহেরিন দেখল বেলুনের সাথে একটা কার্ড বাঁধা আছে। মেহেরিন বেলুন গুলো দেখে কার্ডটা ছাড়িয়ে নিতেই বেলুন গুলো আকাশে উড়ে গেল। মেহেরিন বক্সের দিকে তাকিয়ে দেখল, এক পাশে এক শুকনো গোলাপ পড়ে আছে। মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে তা হাতে নিল।‌ এমন কিছু দেখে নিরব আর নির্ঝরও অবাক। অর্ণব তো তাকিয়ে আছে সেই বেলুনের দিকে। দূর থেকে ফরহাদ ওরা বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে এখানে। 

মেহেরিন আবারো তাকিয়ে দেখল এক কোনে একটা ঘর। ঘরটা কাঠের! তুষার ঘেরা ঘরের চারদিকে। ঘরের দুয়ারের সামনে একজন মেয়ে জড়িয়ে ধরে আছে একজন ছেলেকে। মেহেরিন'র মুখের হাসি এর মাঝেই উধাও হয়ে গেল। নির্ঝর ফরহাদ কে ডেকে অর্ণবকে পাঠিয়ে দিল। তার মনে হচ্ছে কিছু একটা হচ্ছে। মেহেরিন এবার সাহস নিয়ে বক্সের দিকে তাকাল। এক কোনে আংটির বক্স দেখতে পেল। মেহেরিন'র হাত কাঁপছে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে আংটির বক্স খুলতেই তাতে একটা আংটি দেখতে পেল। মূহুর্তের তার হাত থেকে পরে গেল তা। নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। 

মেহেরিন ঘামছে, খুব ঘামছে। তার সাথে তার হাত পাও কাপছে। নিরব মেহেরিন'র ঘাড়ে হাত রেখে বলল,

"মেহু..

মেহেরিন তাকে থামিয়ে দিয়ে আবারো বক্সের দিকে হাত দিল। শেষে কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে। আর তাই হলো। একটা সাদা খাম পাওয়া গেল। মেহেরিন শুকনো ঢোক গিলে সেই খাম খুলল। খামের লেখার উপরে তাকিয়ে রইল,

"হ্যাপি বার্থডে টু ইউ মিষ্টি মেহেরিন। জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা তোমায়। কথা দিয়েছিলাম প্রতি বছর তোমার জন্মদিনে আমাকে মনে করিয়ে দেবো। আজও তার ব্যতীক্রম হলো না। আশা করি আকাশে উড়ে যাওয়া বেলুন গুলোকে দেখেছিলে তুমি। বেলুন গুলো কিন্তু হারিয়ে যাবে এই বিশাল আকাশের মাঝে... যাই হোক। সপ্তাহ খানিক পরেই আমার আর অদিতা'র রিং সেরেমনি! আমি আশা করবো তুমি সেখানে আসবে! ইতি...

আর কিছু লেখা নেই তাতে। মেহেরিন চিঠি টা হাতে মুঠিয়ে নিল। নির্ঝর তার চোখের কোনে কিঞ্চিৎ অশ্রু কণা লক্ষ্য করল। মেহেরিন সেই বেলুনের সাথে থাকা কার্ড টা খুলল। তাতে লেখা ছিল...

"এনগেজমেন্ট সেরেমনি অফ ফাহান হোসেন অ্যান্ড অদিতা আহমেদ! 

মেহেরিন এটা পড়ার পর যথেষ্ট নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করলো। তবুও সে দুর্বল হয়ে পড়ল। পড়ে যেতে নিল তখন টেবিল আকড়ে ধরল। নির্ঝর তার কাছে আসতেই নিরব মেহেরিন কে আঁকড়ে ধরল‌। নির্ঝর সেখানেই থেমে নিল। মেহেরিন'র হাত থেকে কার্ডটা পড়ে গেল। নিরব তাকে ধরে অন্য চেয়ারে বসাল। নির্ঝর নিচে থাকা কার্ড টা হাতে নিল। তাতে ফাহান হোসেন নাম দেখে ভ্রু কুচকালো সে। বির বির করে বলল,

"ফাহান হোসেন! কোথায় জানি পড়েছিলাম এই নামটা! 

বলেই চোখ ঘুরাল মেহেরিন'র দিকে। মেহেরিন দু হাতে পানির গ্লাস নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে খাওয়ার চেষ্টা করছে। নির্ঝর স্থির দৃষ্টিতে দেখছে তাকে..

#চলবে....
[+] 1 user Likes Manjarul Haque's post
Like Reply
#35
#পর্ব_২৫

"ফাহান হোসেন, ফাহান হোসেন! কোথায় জানি শুনেছি এই নামটা? কোথায় কোথায়... 

হাতে এনগেজমেন্ট 'র কার্ড নিয়ে পায়চারি করছে নির্ঝর। আর বির বির করেই যাচ্ছে। নামটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় একটা শুনেছে সে তবে মনেই করতে পারছে না। পায়চারি শেষে ইজি চেয়ারে বসল সে। চোখ বন্ধ করে চেয়ার দুলাতে দুলাতে ভাবতে লাগল নামের কথা। কিছু কিছু মনে পড়ছে তার। এই নামটা যখন শুনেছিল মেহু তার সাথেই ছিল। কিছুক্ষণ ভাবার পর চেয়ার দুলানো ছেড়ে দিল সে। মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে বলে উঠে,

"ডঃ... ডঃ ফাহান হোসেন! এই তো মনে পড়েছে.. 
মুখ খুলে শ্বাস নিল সে। কোথায় একটা স্বস্তি অনুভব করল। দাঁড়িয়ে গেল সে। তবে মুহূর্তেই মনে পড়ল এই ডঃ ফাহান হোসেন'ই কে এই ফাহান‌ হোসেন! দু'জনেই কি এক ব্যক্তি কারণ নাম তো সবার'ই এক হতে পারে। নির্ঝর ঠোঁট ভিজিয়ে গায়ের স্যুট টা খুলে বিছানায় রাখল। শার্টের হাতা ফোল্ট করতে করতে রুম থেকে বের হলো মেহুর খোঁজে। 

ঘরে এসে মেহেরিন কে পেলো না। বসার ঘরে এসে দেখে মিস মারিয়ার কোলে অর্ণব ঘুমাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করেও মেহুর খোঁজ পাওয়া গেল না। ঘুমন্ত অর্ণব কে কোলে করে ঘরে নিয়ে এলো। বিছানায় তাকে শুইয়ে দিতেই বাইরে থেকে মেঘের গর্জন শুনতে পেল। বৃষ্টি হবে বুঝি। নির্ঝর হেঁটে বেলকনির কাছে এলো। আকাশের দিকে তাকাতেই মেহুর মুখ খানা ভেসে উঠলো। হঠাৎ একটা কথা কানের কাজে বার বার বারি খেতে লাগল,

"সবার প্রয়োজন একদিন ফুরিয়ে যায় নির্ঝর..

কথাটা মেহুর ছিল। ডঃ ফাহান হোসেন'র কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা খানা বলেছিল সে। তখন কথাটার অর্থ না বুঝতে পারলেও এখন বেশ বুঝতে পারছে। মেঘের গর্জন শোনা গেল আরো একবার। অর্ণবের কাছে এসে গায়ে চাদর দিয়ে দিল। নির্ঝর ফোন করে মেহুর কাছে কল করতে লাগলো। ঘরেই ফোনের রিং বাজতে লাগলো। এর মানে কি মেহেরিন বাড়িতেই আছে। 

দৌড়ে বাগানের কাছে গেল নির্ঝর। পুরো বাগান খুঁজেও তাকে পেলো না সে। হাঁফিয়ে উপরে তাকাতেই দেখল ছাদের গ্রিলের উপর কেউ বসে আছে। নিঃসন্দেহে এই মেহু! নির্ঝর নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠল,

"এই নিশি কন্যা কে খুঁজে যাচ্ছি আর ইনি কি না উপরে বসে আছে! 

ছাদের দরজা খোলাই ছিল। রাতের এই অন্ধকারের মাঝেও পুরো ছাদ আলোকিত। নির্ঝর ধীরে ধীরে পা ফেলে মেহেরিন'র কাছে এগিয়ে গেল। মেহেরিন কে বসে থাকতে দেখে ডাক দেবার জন্য প্রস্তুত হলেও মুহূর্তেই কথা ফিরিয়ে নিল সে। কারণ মেহেরিন'র পাশে সেই শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ, তুষার ঘেরা বাড়ি আর সেই আংটির বক্স টা পড়ে আছে। কেন জানি নির্ঝরের গলা ধরে গেল। মন বলল, ডাক না দিতে। থাক না কিছুক্ষণ একা। যদি একা থাকতে ভালো লাগে তবে সেই ভালো লাগার কাছেই ছেড়ে দিক তাকে। 

নির্ঝর চোখ নামিয়ে আবারো ঘরের দিকেই হাঁটা ধরল! 

এই নিয়ে ১০ বার চিঠি টা পড়ল মেহেরিন। ফাহানের হাতের লেখা দরুন সুন্দর। একজন ডাক্তার হবার পরেও এই সুন্দর আর মার্জিত হাতের লেখা দেখে প্রথমেই মুগ্ধ হয়ে ছিল মেহেরিন। তবে এতো সুক্ষ্ম বিষয় নিয়ে ভাবার সময় তার ছিল না। ফাহান নিজেই একটা কাগজে কিছু কথা বার্তা লিখে মেহেরিন কে দিয়েছিল। যদিও সেই সব লেখা পড়ে মেহেরিন'র তেমন কোন আগ্রহ দেখা গেল না। তখন ফাহান বলে উঠে,

"একটা মজার জিনিস খেয়াল করেছিলে?

মেহেরিন দ্বিতীয় বারের মতো কাগজে চোখ বুলিয়ে বলল,
"কই না তো?

ফাহান মুচকি হেসে বলেছিল,
"আমার হাতের লেখা। একজন ডাক্তার হবার পরেও আমার হাতের লেখা কিন্তু দরুন সুন্দর! তাই না বলো..

ফাহানের এইসব অকারণ কথাবার্তা শুনে হেসে ছিল মেহেরিন। ফাহান কখনোই কাজের কথা বলে না। সবসময় অকাজের কথা বার্তা বলতো সে। তবুও সেই সব কথা শুনে বার বার হেসেছিল মেহেরিন। ফাহানের কাজ'ই ছিল তাকে হাসানো। 

মেহেরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে তাকাল। শুকিয়ে যাওয়া গোলাপটা হাতে নিল সে। মনে পড়ে এই গোলাপ দিয়েই তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল সে। গোলাপ টাকে কি যত্নেই না রেখেছে। ইশ এভাবে যদি তাদের ভালোবাসা কে যত্ন করে রাখতো। 

চোখের কোনে অশ্রু জমতে শুরু করেছে। মেহেরিন তা দমিয়ে রেখে তুষার ঘেরা বাড়ি টাকে হাতে নিল। মেহেরিন'র তুষার খুব পছন্দ। একদিন ফাহান এই বাড়ি টা মেহেরিন'র সামনে এনে রেখে বলল,

"এই নাও তোমার স্বপ্নের বাড়ি! 

মেহেরিন মুচকি হেসে খেলনা বাড়ি টা কে হাতে নিল। ফাহান তার পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

"স্বপ্ন দেখেই এতো খুশি যদি তা সত্যি হয় তখন.. তখন তো তুমি পাগল হয়ে যাবে। ( মেহেরিন'র চুল কানে গুঁজে দিয়ে গালে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে বলল...) এই পাগলি কে নিয়ে তখন আমি সংসার করব কিভাবে! 

মেহেরিন রেগে মুখ ভেংচি কাটল। বলে উঠে,
"যেমন করে এই পাগলি কে ভালোবাসো! 

ফাহান হেসে তাকে এক হাত দিয়ে জরিয়ে নিল তাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই স্মৃতি'র অবশান ঘটল। তৃতীয় বারের মতো মেঘের গর্জনে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। মেহেরিন আংটির বাক্স খানা হাতে নিল। তার হাত কাঁপতে শুরু করল। আংটির বাক্স খুলতেই একপাতা অতীত সামনে এসে হাজির হলো...

গিটার হাতে চেয়ারে বসে এক গাদা লোকের সামনে বসে গান গাইছে মেহেরিন। এই এতো লোকের মাঝে তার চোখ ছিল শুধুই সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে। ড্রিংক হাতে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ফাহান মেহেরিন'র দিকে। মেহেরিন তার লজ্জা মাখা মুখে গান গেয়ে চলছে তার জন্য। তাদের প্রিয় "মিলে হো তুম হামকো" যা দিয়ে তাদের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল সেই গান দিয়েই সম্পর্কের পরবর্তি ধাপ পেরুতে যাচ্ছিল মেহেরিন। হুম গান শেষেই আংটির বাক্স হাতে ফাহানের সামনে হাঁটু গেড়ে বিয়ের প্রপোজাল রেখেছিল সে। ফাহান মুচকি হেসে তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।‌ মেহেরিন নিজ হাতে তার অনামিকা আঙ্গুলে সেই আংটি পড়িয়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল এই বুঝি নতুন করে আবার পথচলা শুরু হবে তবে কে জেনেছিল এই ধাপ তার সম্পর্কের ইতি টানবে। 

চোখ ভিজে উঠছিল অশ্রু ভরে। বৃষ্টির পানির সাথে সাথে সেই অশ্রু গড়িয়ে কখন পড়ল টের পেল না। মেহেরিন আংটি হাতে নিল। আংটির পেছনের দিকে M ? F লেখা। মেহেরিন হাত মুঠে করে নিল। চোখ বেয়ে তার অশ্রু ঝরছে। কেন ঝরছে তার জানা নেই। 

বৃষ্টির গতি বেড়ে গেল। দমকা হাওয়া বইতে লাগলো। রাতও বেশ হয়েছে। নির্ঝরের মেহেরিন'র চিন্তা হতে লাগল। সে এবার ছাদের দিকে পা বাড়াতেই দেখল মেহেরিন দৌড়ে নামছে। তাকে দেখে অবাক হলো সে। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই মেহেরিন তার পাশ কাটিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল। 

নির্ঝর বেলকনির কাছে এসে দেখল মেহেরিন বাগানের নিচে বসে হাত দিয়ে কিছু খুঁজে চলছে। ভ্রু কুন্চিত হলো তার। মেহেরিন'র হাতের আংটি টা নিচে পড়ে গেছে। বিধায় তাই পাগলের মতো খুঁজে চলছে সে। নির্ঝর একটা ছাতা হাতে বেয়ে হয়ে এলো। মেহেরিন'র একটু কাছে থেমে দেখল নিচে বসে পাগলের মতো কিছু খুঁজে জ্বলছে। চারদিকে আলো তবুও মনে হচ্ছে আঁধারের মাঝেই কিছু খুঁজছে সে। নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা আগাতে যাবে ওমনি পায়ের কাছে সূক্ষ্ম কিছু চোখে পড়ল তার। নির্ঝর নিচ থেকে তা হাতে তুলে দেখল একটা আংটি। মেহেরিন'র দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো এই আংটি কি তবে খুঁজছে এই মেয়ে। 

মেহেরিন এই বৃষ্টির মাঝে কাকভেজা হয়ে আংটি খুঁজেই চলেছে। বৃষ্টির আর কান্না এক হয়ে গেছে তবুও হাত দিয়ে সেই কান্না মুছছে সে। হুট করেই তার সামনে এক জোড়া পা দেখল সে। মাথা তুলে তাকাতেই দেখল নির্ঝর তার মাথার উপর ছাতা ধরে আছে আর নিজে ভিজছে। নির্ঝর তার হাত খানা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

"উঠে এসো, যা নিজ থেকে হারিয়ে যায় তা খুঁজে কখনো পাওয়া যায় না। 

মেহেরিন'র চোখের পানি স্তব্ধ হয়ে গেল। ঢোক গিলে তাকিয়ে রইল তার দিকে। নির্ঝর দ্বিতীয় বারের মতো কঠিন গলায় বলল,

"মেহু, উঠে এসো! 

মেহেরিন এবার হাত বাড়াল তার দিকে। নির্ঝর সেই হাত খানা ধরে উঠাল তাকে। তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেহেরিন চোখ নামিয়ে রেখেছে। নির্ঝর তার ভেজা চুল গুলো কানে গুঁজে দিল। মেহেরিন এবার মুখ তুলে তাকাল তার দিকে। নির্ঝরের মনে হলো এই কোন নতুন এক মেহু কে দেখছে সে। ভালোবাসার কাঙাল সে! কোন এক নিরীহ রমনী যার আছে এক নজরকাড়া চোখ আর স্নিগ্ধ দু খানা ঠোট। ঠোট জোড়া অবশ্য কাঁপছে তার। 

নিজ হাত বাড়াতেই মেহেরিন জড়িয়ে ধরল তাকে। এই বুঝি এমন কারো কাঁধে মাথা রাখার জন্য মত্ত ছিল সে। 

----

পোশাক চেঞ্জ করে গুটিগুটি মেরে সোফার কোনো ঘুমিয়ে আছে মেহেরিন। নির্ঝর পা বাড়িয়ে কাছে এলো তার। ঘুমের মাঝে তার নিশি কন্যা কে একটু বেশিই মুখর লাগে বলে মনে হচ্ছে। নির্ঝর খেয়াল করল মেহেরিন শীতে কুঁকড়াছে। কুঁকড়ানোর'ই কথা! অনেকক্ষণ ভিজেছে বৃষ্টিতে। নির্ঝর বিড় বিড় করে বলে উঠলো,

"কেঁদে কেঁদে হয়রান হয়ে গেছে তাই এখন ঘুমে মগ্ন আমার নিশি কন্যা। আচ্ছা নিশি কন্যা তোমাকে কেউ বলেছে কাঁদলে তোমাকে আরো বেশি সুন্দর লাগে। সব মেয়েদের কিন্তু লাগে না। অনেক মেয়ের কান্না দেখেছি আমি তবে নিশিকন্যার কান্না এই প্রথম পাগল করল আমায়। 

নির্ঝর মেহেরিন'র মাথায় হাত রাখতেই দেখল চুল ভেজা। এই মেয়ে তো দেখছি সর্দি লাগাবে। একটা বালিশ আর চাদর আনল। মাথার তলে বালিশ দিয়ে চুল গুলো সরিয়ে দিল। গায়ে চাদর টেনে মেহেরিন'র মুখের সামনে এসে বসল। তার মাথায় হাত বুলাতে লাগল। নির্ঝর স্নিগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে মেহেরিন'র দিকে। তার উষ্ণ ঠোট খানার প্রেমে পড়ছে যেন বার বার। কি ভেবে নির্ঝর মেহেরিন'র ঠোঁটের খুব কাছে এসে গেল। তার নিঃশ্বাস পড়ছে তার মুখের উপর। চোখের পাতা নড়ছে। নির্ঝর ফিক করে হেসে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে উঠে গেল সেখান থেকে। পেছনে ফিরে একবার দেখল এই নিশি কন্যা কে। সকাল হলেই এই নিশি কন্যা আর নিশি কন্যা থাকবে না। রাতের এই কান্না, এই দুঃখ, এই ক্ষত কিছুই মনে রাখবে না সে। ততোদিন তো রাখবে না যতদিন না এই ফাহান আবারো তার পুরনো ক্ষত জাগিয়ে তুলে। আবারো নতুন একটা সকালের মাঝে নতুন একজন মেহেরিন কে দেখা যাবে। নির্ঝর জানে এমনটাই হবে। মেহেরিন জানে কিভাবে নিজেকে শক্ত রাখতে হয়। তবুও একসময় সময়ের কাছে হার মানতে হয় তাকে। সুখ বিলিয়ে দিতে হয় তার কাছে। 

নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণবের কাছে আসে। গায়ের চাদর টা ইতিমধ্যে ফেলে দিয়েছে সে। নির্ঝর আবারো তার গায়ে চাদর টেনে তার পাশে বসে পড়ে। অতঃপর  সোশ্যাল সাইটে ডঃ ফাহান হোসেন'র সম্পর্কে খোঁজ নেয়। ডঃ ফাহান হোসেন দেশের একজন ইয়ানগেস্ট সাইক্রেটিস। লন্ডন থেকে পড়াশোনা শেষে নিজ দেশে এসেই থাকছেন গত বছর যাবত। নির্ঝর তার সম্পর্কে আরো খোঁজ নিয়ে জানতে পারে মেহেরিন বর্ষা খান'র সাথে তার বিয়ের গুঞ্জন উঠেছিল। তবে তা ভেঙ্গেও গেল। কিন্তু এরপর ফাহান হোসেন'র বিয়ের কোন কথাই বলা নেই। 

নির্ঝরের মাথায় কেমন একটা চক্কর দিল। মাথায় চুল টেনে বসে রইল সে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। হঠাৎ করেই কানে অর্ণবের স্বর এলো। ঘুমের ঘোরেই "ড্যাডি" বলে ডাকছে সে। নির্ঝরের অস্থির শরীর মুহুর্তেই শান্ত হয়ে গেল। অর্ণবের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল সে। মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়ল নির্ঝর, তবে স্বপ্নের মাঝে উঁকি দিল নিশি কন্যা! 

#চলবে....
[+] 2 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#36
#পর্ব_২৬

হসপিটালে এসে ফাহানের খোঁজ নিতে এসে তাকে না পেয়ে গাড়ি নিয়ে আবারো বাড়ির দিকেই রওনা দিল নির্ঝর। তবে রিসেপশনে একটা খবর পেয়েছে সে। ফাহান আপাতত কিছুদিন ছুটিতে আছে। আর তার কারণ হলো তার বিয়ে। তার মানে এই'ই সেই ফাহান। মেহু সেদিন তার কেবিনের সামনেই দাঁড়িয়েছিল। যা ছিল‌ তা তো অতীত। মেহু না হয় এখনো ভুলতে পারে নি। তবুও ফাহান কেন এসব করছে। কেন'ই বা এসব পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে কষ্ট দিচ্ছে তাকে। 

হুট করেই গাড়ির ব্রেক কসল সে। ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে গাড়ির হেনডেলে মাথা ঠেকাল সে। কেন এতো অস্থিরতা কাজ করছে তার মধ্যে। ফোনের রিংটোন বেজে চলছে। নির্ঝর ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফোনটা হাতে নিল। মেহুর নামটা ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। নির্ঝর ফোনটা রিসিভ করে কানে দিল। ওপাশ থেকে মিষ্টি গলার স্বর নির্ঝরের মন কে শান্ত করল। নির্ঝর হেসে বলল,

"হুম বলো! 

"আপনি কি ফ্রি আছেন।

"কেন? 

"অর্ণব কে আজ ডঃ রাহেলাকে দেখানোর কথা ছিল। আমি অফিসে কাজে আটকে গেছি। আপনি যদি ফ্রি থাকেন তো..

"আচ্ছা যাচ্ছি আমি..

"নির্ঝর!

"হুম!

"ধন্যবাদ।

"ধন্যবাদ দেবার কি আছে, নিজের ছেলেকে নি..

"এজন্য না।

"তাহলে..

"... গতকালের জন্য! 

নির্ঝরের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। ওপাশ থেকে লাইন কেটে যাবার শব্দ এলো। নির্ঝর ফোনটা রেখে এখনো হাসতে লাগলো।‌ লজ্জা পেতে লাগল তার। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে আবারো গাড়ি স্টার্ট দিল সে। 

---- 

ডঃ রাহেলা অর্ণবের চেকাপ করানো শেষে নির্ঝর আর অর্ণব তার কেবিনে বসে বসল। ডঃ রাহেলা অর্ণবের সবকিছু নরমাল আছে বলেই আশ্বাস দিল। নির্ঝর হেসে অর্ণবের মাথায় হাত বোলাতেই অর্ণব দাঁত বের করে হাসল। নির্ঝর ডঃ রাহেলা কে কিছু বলবে বলে তার দিকে ফিরতেই ডঃ রাহেলার টেবিলের কোনে কার্ড দেখতে পেল। নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে সেই কার্ডের দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যাঁ এটা সেই কার্ড যা তার কাছেও আছে। ডঃ ফাহানের রিং সেরেমানির কার্ড। নির্ঝর হেসে ডঃ রাহেলা কে বলে অর্ণব কে নিয়ে বাইরে চলে এলো। অতঃপর অর্ণব কে জনের সাথে বাচ্চাদের প্লে গ্রাউন্ডে রেখে আবারো ডঃ রাহেলার কেবিনে আসল নির্ঝর! 

"আরে নির্ঝর , আবার এলে যে।

"ডঃ রাহেলা, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। 

"অর্ণবের সবকিছু তো নরমাল'ই আছে। 

"না আমি অর্ণবের ব্যাপারে কথা বলতে আসি নি।

"তাহলে..

নির্ঝর এগিয়ে এসে টেবিল থেকে কার্ড টা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসল। ডঃ রাহেলা'র সামনে কার্ড রেখে বলল,

"ডঃ ফাহান হোসেন'র রিং সেরেমানি। আপনাকেও ইনভাইট করেছে এর মানে আপনারা একে অপর কে চিনেন। আর... ( একটু দম নিয়ে বলল ) মেহু কেও চিনে মানে খুব ভালো করেই চিনে। কে এই ফাহান জানতে চাই আমি। কি করে মেহুর সাথে তার পরিচয়? কি সম্পর্ক তাদের? 

বলেই নির্ঝর একটু কঠিন মুখ নিয়েই তাকিয়ে রইল। ডঃ রাহেলা নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। পানির গ্লাস টা নির্ঝরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন,

"সিরিয়ায় মুডে আছো দেখছি, নাও পানি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করো। 

নির্ঝর ভ্রু কুচকালো। ডঃ রাহেলা আবারো একগাল হেসে বলেন,

"চিন্তা করো না, আমি তোমাকে মেহুর অতীত টা বলবো ঠিক ততোটুকু যতটুকু আমি জানি।

নির্ঝর পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঢক ঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করল। অতঃপর দম ছেড়ে আবারো বসল। ডঃ রাহেলা ভ্রু কুঁচকে আর মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

"মেহুর খুব চিন্তা করো কিন্তু তুমি!

"ডঃ রাহেলা প্লিজ!

"উহু টেনশন নিও না। আমি তো তোমাকে বললাম বলবো। তবে সবটা না কারণ সবটা আমার জানা নেই। তাই আমার কাছে আধটা শোনার পর যদি তোমার মন শান্ত না থাকে তাহলে বাকি আধটা কার কাছে শুনবে তুমি। তোমার নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে তাকে যে তোমাকে বাকি আধটা বলবে। 

নির্ঝর মাথা নেড়ে এবার শান্ত হয়ে বসল। ডঃ রাহেলা আরাম করে চেয়ারে বসলেন। চিকন ফ্রেমের চশমা টা খুলে টেবিলে রেখে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান। তার এমন ভাব দেখে মনে হলো নির্ঝর কে সে কিছুই বলবে না। নির্ঝর খানিকটা উদাসীন হলো। হুট করেই ডঃ রাহেলা বলে উঠেন,

"বেলী ফুল তোমার পছন্দ নির্ঝর! 

হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে নির্ঝর প্রথমে ধাক্কা খেল। তবুও নিজেকে সামলে বলল,

"হুম!

ডঃ রাহেলা এবার চোখ মেলে নির্ঝরের দিকে তাকালেন। নির্ঝর এবার ভালো মতো ডঃ রাহেলাকে দেখতে পেলো। চশমা খুলে ফেলায় কম বয়সী একজন মেয়ে বলে মনে হচ্ছে তাকে। ডঃ রাহেলা হেসে বলেন,

"আর মেহেরিন'র?

"ওর পছন্দ না।

"ভুল জানো। মেহেরিন'র ভারী পছন্দের ফুল হলো বেলী ফুল। বেলী ফুলের মালা গাঁথতে খুব ভালোবাসতো সে। কিন্তু নিরুর তা পছন্দ ছিল না।‌ গাছ থেকে ফুল ছেড়া মোটেও নিরুর পছন্দ ছিল না। তার কাছে গাছের ফুটন্ত ফুল গাছে থাকলেই ভালো লাগতো। এটাই ফুলের সৌন্দর্য বলে জানতো সে। 

"আচ্ছা!

ডঃ রাহেলা এবার চশমা টাকে টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে বলেন,

"এখন অবশ্য কোন বেলী ফুলের গাছ খান বাড়িতে দেখবে না। তবে চমৎকার একটা বেলী ফুলের গাছ কিন্তু ছিল সেখানে। নিরুর হাতে লাগানো সেই গাছ। সেই গাছের ফুল যেমন সুন্দর ছিল তেমনি ছিল তার ঘ্রাণ। পুরো বাড়িতে মম করতো বেলী ফুলের ঘ্রাণে।

নির্ঝর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"আপনি কখনো দেখেছিলেন সেই গাছ!

ডঃ রাহেলা চোখে চশমা পড়ে বলেন,
"এখন দেখতে স্বাভাবিক লাগছে তো আমায়।

নির্ঝর মুচকি হেসে বলল,
"হ্যাঁ।

"হ্যাঁ দেখেছিলাম তা, আর সেই গাছ দেখার পর'ই তা কেটে ফেলতে বলেছিলাম!

"কেন? 

"কারণ নিরু মারা যাবার পর মেহেরিন রাত বেরাতে সেই গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। এই নিয়ে তার বাবা শুভ্র খান আমাকে বলেছিলন। আমি জিজ্ঞেস করতেই মেহেরিন আমাকে সোজাসুজি কি উওর দিল জানো?

নির্ঝর অধীর আগ্রহে বসে আছে সেই কথা শোনার জন্য। এমন একজন শ্রোতা পেয়ে ডঃ রাহেলার বেশ ভালো লাগলো। তিনিও শীতল গলায় বলে উঠেন,

"মেহেরিন বলে উঠল সে নাকি সারারাত জেগে নিরুর সাথে কথা বলে। 

নির্ঝরের কপালে ভাঁজ পড়ল। ডঃ রাহেলা হেঁসে বলেন,

"শুনো কিসব কথা! একজন মৃত ব্যক্তির সাথে সে কি না সারারাত জেগে গল্প করে। যদিও এটা তার কল্পনা তবুও আমি তখন সেটা তাকে বোঝাতে চাই নি। শুধু জিজ্ঞেস করছিলাম"কিসব কথাবার্তা বলো তোমরা? মেহেরিন মুখটা কালো করে বলল, অনেক ধরণের কথা বলি। এই আমি সারারাত কি করেছি। গাছের ফুল গুলো কেন ছিড়লাম আমি। গাছ কি কষ্ট পায় না। এই রাতটা আজ এতো অন্ধকার কেন এরকম! 
"আর অর্ণব! তার কথা কিছু জিজ্ঞেস করো নি।

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকালো। অতঃপর অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
"অর্ণব! এই অর্ণব কে? 

তখন'ই মেহেরিন'র কথা শুনে বুঝলাম সে এখনো তার ছেলেবেলার অতীতে আটকে আছে। অর্ণব বলে কেউ যে আছে তার পৃথিবীতে এটাই সে ভুলে গেছে। 

"তারপর? 

"তারপর! তারপর আর কি? শুভ্র খান কে বলে সেই গাছ কেটে ফেললাম। মেহেরিন খুব রেগে গেল। রাগবে নাই বা কেন। নিরুর একমাত্র স্মৃতি ছিল তা। একমাত্র বলছি বলে অবাক হয়ো না। আরো অনেককিছুই ছিল। তা তাদের বাড়ির স্টোর রুমে রেখে দেবার ব্যবস্থা করলাম। বলতে গেলে নিরু কে আড়াল করে দিলাম তার থেকে। তবুও কি স্মৃতি ভোলা যায়। মায়ের আদরে যে এত্তো বড় করলো তাকে ভুলে কি করে? রাতের পর রাত তবুও জেগে থাকতো। অন্ধকার ঘরে ডুবিয়ে রাখতো নিজেকে। চেহারায় কালচে দাগ পড়ে গেল। চোখের কালো দাগ তার মুখের সৌন্দর্য নষ্ট করে দিল। তার মুখের হাসি যেন মিলিয়ে গেল। শুকিয়ে গেল দিন দিন। তার চিন্তায় শুভ্র খান অস্থির। আমি নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করলাম। ধীরে ধীরে সফল হতে লাগলাম। অর্ণবের জন্য তার গুরুত্ব বোঝালাম। নিরু মারা যায় নি, বেঁচে আছে এই অর্ণবের মাঝে এই কথা তার মাথায় ঢুকালাম। এতসব কিছু করার পর'ই স্বাভাবিক হতে লাগল সে। তবে হঠাৎ একদিন কি হলো জানো!

নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
"কি..

#চলবে....
[+] 1 user Likes Manjarul Haque's post
Like Reply
#37
#পর্ব_২৭

নির্ঝর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডঃ রাহেলা'র দিকে। নির্ঝর কে অবাক করে দিয়ে ডঃ রাহেলা একটা সিগারেট ধরালেন। নির্ঝর কে শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

"সিগারেট খাও তুমি! 

নির্ঝর মাথা নেড়ে বলে,
"নাহ! 

"ড্রিংক করো অথচ সিগারেট খাও না।

"যাদের স্ট্রেস বেশি, একাকিত্বে ভোগে, টেনশন বেশি তাদের জন্য সিগারেট প্রযোজ্য। আমার জীবনে এমন কিছু নেই তাই আমার দরকার পরে না। তবে হ্যাঁ ড্রিংক করি সেটা শখ বসত।

ডঃ রাহেলা হেসে বলেন,
"তোমাদের এই জেনারেশনের শখ ও অদ্ভুত। যদি তোমার বেশি অসুবিধা হয় তাহলে সিগারেট রেখে দিচ্ছি।‌

"না ঠিক আছে, আমার অসুবিধা নেই।

ডঃ রাহেলা সিগারেট'র একবার মুখে দিয়ে বলেন,
"এটা আমার শখ না, বলতে পারো একাকিত্বে'র সঙ্গী। দীর্ঘশ্বাস ১০ বছর সংসারের পর যখন সম্পর্কের ইতি হয়ে যায় সেই টান পোড়নে মানুষ খুব অদ্ভুত জিনিস কে নিজের সঙ্গী করে বসে। 

নির্ঝর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ডঃ রাহেলা আবারো নিজ থেকেই শুরু করলেন,

"মেহেরিন একটু একটু করে গ্রোথ করতে লাগলো। হঠাৎ একদিন ওর মনে হলো নিরুকে খু/ন করা হয়েছে। আর এই খু/ন টা তার জিজু ছাড়া আর কেউই করে নি। পুলিশের ফাইলে নতুন এক কেস এলো। যা আ/ত্ন/হ/ত্যা বলে তারা বন্ধ করে দিয়েছিল সেই কেস রি ওপেন হলো আবার। আর এটা করল মেহেরিন। শুভ্র খান ততোদিনে এসব থেকে আগ্রহ উঠিয়ে নিলেন। অর্ণব কে নিয়েই নিজের সময় কাটাতেন তিনি। ধীরে ধীরে নিজেকে বন্দী করতে থাকলেন ঘরের কোনে। 

অনেক চেষ্টা'র পরও কেস টা জিততে পারে নি মেহেরিন। যারা দুদিন আগেও মেহেরিন'র পক্ষে ছিল টাকার জোরে তার জিজুর পক্ষে রায় দিল তার। একটা কথা কিন্তু তোমার জানা নেই। মেহেরিন'র ক্ষমতা কিন্তু এখন অনেক তবে তখন তার জিজুর ক্ষমতার চেয়ে বেশি ছিল না। ক্ষমতা আর টাকার জোরে তখনকার জন্য কেস টা সেই জিতল। মেহেরিন'র মন আবারো ভাঙল। তবু সে দমে গেল না। নিজেকে তার জিজুর সমকক্ষ গড়ে তুলতে শুরু করল।

নির্ঝর কথার মাঝে বলে উঠে,
"মেহুর জিজু এখন কি দেশে আছে!

"না! আমি শুনেছিলাম শুভ্র খান মারা যাবার পরদিন'ই তার নিউ গার্লফ্রেন্ড'র সাথে দেশ ছাড়ল সে। মেহেরিন'কে আবারো একা করে দিয়ে শুভ্র খান চলে গেল। মেহেরিন এবার আগের থেকে বেশি একা হয়ে গেল। চোখ থেকে রাতের ঘুম হারিয়ে গেল। এদিকে খান কোম্পানির সমস্ত দায়িত্ব তার কাঁধে। দিনের কর্তব্য শেষে রাতের একাকিত্ব নিয়ে দিন কাটতে লাগলো। এর মাঝেই বড় হতে লাগল অর্ণব। যদিও অর্ণবের প্রতি কোন খামতি রাখতো না সে কিন্তু নিজের মন থেকে কারো খামতি'র অভাব কুঁড়ে কুঁড়ে খেত তাকে। 

এর মাঝেই অর্ণবের সমস্যা দেখা দিল। কথা বলতে চায় না সে। বোবা না তবুও কথা বলে না।‌ অপরিচিত কাউকে দেখলেই দূরে সরে যায়। ভিড়ে থাকতে মোটেও পছন্দ না তার। যেই বয়সে ছেলেমেয়েরা হইহুল্লোড় করে সেখানে অর্ণব চুপচাপ। একটা বাচ্চা থাকার পরেও খান বাড়ি কেমন শ্মশান বলে মনে হতো। আদৌও কেউ এই বাড়িতে থাকতো কি না তা বোঝা দায়। তার এই অবস্থা অর্ণবের চেয়ে বেশি মেহেরিন'র উপর প্রভাব ফেলল। মা আর ছেলের দুজনের চিকিৎসা'র দায়িত্ব এবার আমার কাঁধে! মেহেরিন কে সবক্ষণ বোঝাতাম সে নিজে না সুস্থ হলে অর্ণবের গ্রোথ কোনভাবেই সম্ভব না.. 

বলেই ট্রেসটে তে সিগারেট নিভালো ডঃ রাহেলা। নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে পুরো কথা টা শুনতে লাগল। ডঃ রাহেলা আবারো শুরু করলেন,

"তখন বর্ষাকাল, টানা তিন দিন ধরে বাইরে বৃষ্টি - বন্যা। টিভি তে দেখলাম কোথায় কোথায় পানি পুরো গ্রাম তলিয়ে নিচ্ছে। এর মাঝেই ১০ দিন ধরে জ্বরে ভুগছি আমি।‌ আমার খুব পরিচিত একজন মানুষের কাজ থেকে জানলাম ডঃ ফাহানের কথা। একজন ভালো সাইক্রেটিস কে খুব দরকার ছিল মেহেরিন'র জন্য। মনে হলো এই লোকটাই মেহেরিন'র জন্য ঠিক হবে। 

তখন রাত্রি ৯ টা ২৩ মিনিট, বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে! ডঃ ফাহান হোসেন ফোন করে জানাল সে দেশে এসেছে। আমি বললাম ভালো কথা। তো কোন হোটেলে উঠবে। ফাহান হোসেন জানাল বাইরে এতো বৃষ্টির মাঝে তার হোটেল যাওয়া সম্ভব না। কারণ এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল অনেক দূরে। তাই কাছে কোথায় ভালো কোন হোটেলে'র নাম জানা থাকলে তাকে দিতাম। আমি তাকে মেহেরিন'র ঠিকানা দিয়ে বললাম, এটা তোমার রোগীর বাড়ি। তাদের বাড়িতেই আজকের রাত টা কাটাও। আমি মেহেরিন কে কল করে জানিয়ে দিচ্ছি। সে দ্বিমত পোষণ না করে রওনা দিল মেহেরিন'র বাড়িতে..

অতীত...
বৃষ্টির কারণে মেহেরিন'র বাড়িতে যেতেও অনেক সময় লাগল ফাহানের। প্রায় রাত ১১ টা বেজে ৫ মিনিটে খান বাড়িতে প্রবেশ ঘটল তার। দাড়োয়ান তাকে কিছু জিজ্ঞেস না করেই সদর দরজা খুলে দিল। অবাক হবার কোন দরকার ছিল না কারণ ডঃ রাহেলা বলেছেন মেহেরিন কে সে বলে দিবে। মেহেরিন'র নাম উচ্চারণ করে নিজেই খানিকটা থতবত খেয়ে গেল। কোন একজনের নাম আধঘন্টা'র বেশি মনে রাখতে পারে না সে। এটা তার রোগ না। কারণ হলো তার ভাবনা। নিজের কল্পনায় অলৌকিক অনেক কিছুই ভাবে সে যার কারণে বাস্তবের সবকিছুই গুলিয়ে যায়। তবু সেখানে মেহেরিন কে মনে রাখতে পেরেছে বলে নিজে অসাধ্য সাধন করেছে বলে মনে হলো। পুরো বাড়ি এখনো আলোকিত। বাহ বৃষ্টির মাঝে এই আলোকিত বাড়ি দেখে ভালো লাগছে না হলে মনে মনে একটা ভূতের বাড়ি হবে বলেই ধারণা করেছিল সে। ভেবেছিল আঁধারে ডুবে থাকবে এই বাড়ি। 

গাড়িতে বসেই সামনে কাউকে দেখতে পেল সে। নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টিতে কেউ। ফাহান বুঝতে পারল না কে সে আর কি'বা করছে। দেখে মনে হচ্ছে একটা মেয়ে। কিন্তু এতো রাতে একটা মেয়ে কি করছে এখানে। বৃষ্টিতে ভিজছে। কোন মেয়ে এভাবে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টিতে ভিজে বলে তার জানা নেই। মেয়েরা যখন বৃষ্টিতে ভিজবে তখন সে নাচবে,‌ লাফাবে। পুরো বৃষ্টি কে উপভোগ করবে সে। কিন্তু এ তো দেখছি...যাক গে, কিন্তু এখানে তার আশা ভঙ্গ করে দিয়ে গাড়ি থেকে নামতেই সব আলো নিভে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনের আলো জ্বালিয়ে ছাতা নিয়ে বের হলো সে। বাড়ির কাছে না গিয়ে গেলো সেই মেয়েটার কাছে। ফোনের আলোয় দেখার চেষ্টা করল সেই মেয়ে কে। 

"এই যে মিস! 

বলতেই সেই হরিণী চোখ জোড়া স্থির ভাবে তাকাল ফাহানের দিকে। বৃষ্টির মাঝে এই ভাষা চোখ দেখে খানিকটা হতবাক হলো সে। তার ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠলো। মনে হচ্ছে কিছু বলবে। অপ্রত্যাশিত কিছু শুনে ভ্রু কুঁচকে গেল ফাহানের.. 

"ডঃ ফাহান হোসেন আপনি।

"জ্বি! 

"ডঃ রাহেলা আমাকে বলেছে আপনার সম্পর্কে। আসুন ভিতরে আসুন! 

বলেই পা বাড়াল মেয়েটি। ফাহান মেয়েটির পিছনে পিছনে পা বাড়িয়ে বলল,

"মেহেরিন কি তাহলে তুমি! 

মেয়েটি কথা শুনল বলে মনে হলো না। তবুও নিশ্চুপতা কে উওর হিসেবে ধরে নিল সে।‌‌ বাড়ির ভেতরে যেতেই সম্মত আলো জ্বলে উঠলো। মেয়েটা তার শীতল কন্ঠে বলে উঠল,

"এতো বৃষ্টির কারণে মেইন সুইচ বোর্ড এ সমস্যা হয়েছিল। ঠিক করা হয়েছে। 

মুহূর্তেই ফাহান একটা অবান্তর প্রশ্ন করে বসল,

"মেহেরিন, তুমি কি বৃষ্টিতে ভিজছিলে.. 

তার কথা মেহেরিন'র ওপর প্রভাব ফেলল। তার ফাহানের দিকে তাকাল। ফাহান এবার পুরোপুরি দেখতে পেল মেহেরিন কে। তার থিতুনি বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মুখে বিন্দু বিন্দু পানির রেখা। মেহেরিন খানিকটা অবাক কন্ঠে বলল,

"আপনাকে আমার নাম বলেছি আমি..

ফাহান হেসে বলল,
"হুম বলেছিলে..

মেহেরিন কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। তার মুখ দেখে মনে হলো সে নিজেই সংশয় প্রকাশ করছে। সার্ভেন্ট এসে হাজির হলো দুজন। এক তোয়ালে নিয়ে মেহেরিন কে এগিয়ে দিল। অন্যজন কে মেহেরিন ফাহান কে উদ্দেশ্য করে বলল,

"তার রুম দেখিয়ে দাও..

বলেই আনমনে হেঁটে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। 

ফাহান ফ্রেস হয়ে খাটে এসে বসেছে। কিন্তু তার ঘুম আসছে না আর না ক্লান্তি লাগছে। মোটকথা ক্লান্তি লাগছে না বলেই ঘুম আসছে না কারণ ক্লান্তিতে মানুষের শরীরে নিস্তেজ হয়ে গেলেই তার ঘুম ঘুম পায়। কিন্তু ফাহানের এখন খুব ফ্রেস লাগছে। তার মন চাইছে এই সুন্দর বাড়ি টা কে একটু ঘুরে দেখবার। ঘর ছেড়ে বের হলো সে। পুরো বাড়ি আঁধারে ঢাকা। ফাহান হাতে ফোনের আলো নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তার ঘর ছেড়ে কয়েক পা এগিয়ে ডানে মোর নিল সে। অতঃপর সেখান থেকে বরাবর হাঁটতে লাগল। 

কয়েক ঘর পেরিয়ে একটা ঘরের দরজা খোলা পেল। দরজায় উঁকি দিতেই দেখল বেলকনিতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ফাহানের মন বলল এটা মেহেরিন। তার ঘরের ল্যাম্পশেডের আলো জ্বলছে। সেই আলোয় বিছনায় একজন কে শোয়া দেখছে সে। ডঃ রাহেলার কথা অনুযায়ী মেহেরিন তার ছেলের সাথে এক রুমে থাকে তবে এই কি তার সেই ছেলে। হঠাৎ করেই মেহেরিন এদিকে ফিরল। ফাহান সাথে সাথে সরে ফেলল। ইশ বেশ ভয় পেয়েছে সে! যদি দেখে ফেলতো তখন ভাবতো চুরি টুরি করতে এসেছে বোধহয়। না আর কোন কাজ নেই গিয়ে ঘুমিয়ে পড়াই বেশ ভালো বলে মনে হলো।

ফাহান এই নিয়ে দু কাপ চা শেষ করে তার সামনে টেবিলে রাখল। মেহেরিন সবে অফিসের জন্য তৈরি হয়েছিল। ফাহান তার কাছে খবর পাঠাতেই মেহেরিন তার কাছে এলো। মুচকি হেসে তার সামনে বসল। ফাহান তৃতীয় বারের মতো চায়ের কথা বলল। মেহেরিন হেসে বলল,

"চা হয়তো খুব পছন্দ আপনার! 

ফাহান হেসে বলল,
"হ্যাঁ পছন্দ তবে , তোমাদের বাড়ির চা টা দারুন।

"আমার বাসা টাও দারুন।

"হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক বলেছ। বাড়িটা সত্যি চমৎকার! 

"রাতের অন্ধকারে কি ঠিক মতো ঘুরে দেখতে পেরেছিলেন? 

ফাহান চমকালো না। মুচকি হেসে বলল,

"না দেখা হয় নি। একা একা কে দেখাবে বলো।

মেহেরিন দাঁড়িয়ে বলল,
"আসুন আমি দেখাচ্ছি! 

হাঁটতে শুরু করল। ফাহানও তার পিছন পিছন হাটতে লাগল। মেহেরিন ফাহান কে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তাঁদের স্টাডি রুমে গেল। বুক সেলফ এ অনেক ধরনের বই দেখতে পেল ফাহান। একটা বই ফাহান হাতে নিয়ে বলল,

"বই খুব পছন্দ!

"না, এতো না।

"তবে এতো বই যে..

"আমার বাবা আর নিরু দির খুব পছন্দ! 

"ওহ আচ্ছা!
বলেই বই টা আবারো তার জায়গায় রেখে দিল। চা এসে হাজির। ফাহান চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল,

"তোমার সময় নষ্ট করবো না আমি, শুধু কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব। 

"হুম করুন! 

ফাহান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
"তোমার মা মারা যায় কখন?

"আমার জন্মের সময়।

"তোমরা ভাই বোন কয়জন?

"আমি আর নিরু দি।

"এই বাড়িতে এখন কে কে থাকে?

"আমি আমার ছেলে আর বাড়ির সার্ভেন্ট।

দ্বিতীয় বারের চুমুক দিয়ে বলল,
"তোমার দি'র ছেলে কি জানি নাম?

"অর্ণব! আর অর্ণব আমার ছেলে।

ফাহান হেসে বলল,
"তোমার দি কোথায়? 

"৩ বছর হলো মারা গেছে! 

"আর তোমার বাবা!

"১ বছর? 

"তোমার দি মারা গেল কিভাবে? 

"সবাই বলে আত্ন/হত্যা করেছে কিন্তু আমি জানি দি কে মে/রে ফেলা হয়েছে! 

"কে মেরে/ছে? 

"আমার জিজু! 

"তোমার দি'র লা/শ প্রথম কে দেখেছিল!

"আমি!

"কেন গিয়েছিলে সেখানে?

"দি কল করেছিল আমায়, আমি রিসিভ করতে পারিনি

"আর চলে গেলে!

"অনেকবার কল করেছিলো!

"গিয়ে কি দেখলে?

মেহেরিন একবার ফাহানের দিকে তাকাল। অতঃপর চোখ সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

"দি'র মৃত/দেহ ফ্যানের সাথে ঝুলছিল আর..

"আর!

"অর্ণব নিচে হামাগুড়ি খাচ্ছিল!

"কাঁদছিল না?

মেহেরিন একবার চুপ করল। অতঃপর বলে উঠে,
"না!

ফাহান খালি চায়ের কাপ টা টেবিলে রাখল। হেসে বলল,
"তোমার বাবা মারা গেল কিভাবে?

"হার্ট অ্যাটাক!

"তখন তুমি কোথায় ছিলে?

"অফিসে!

"আর অর্ণব!

"বাপির ঘরে ঘুমাচ্ছিল।

"সে দেখে নি!

"দেখেছে, বাপি হার্টের ব্যাথায় পড়ে যেতেই অর্ণবের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে মিস মারিয়া কে ডেকে এনে দেখায়। মিস মারিয়া কল করে আমাকে জানায়। হসপিটালে আসার পর জানতে পারি বাপি মারা গেছে।

ফাহানের কপালে ভাঁজ পড়লো। সব কথাই স্বাভাবিক ভাবে বলছে সে। ফাহান বলে উঠে,
"হামম! তুমি এখন যেতে পারো। আমি একটু পরেই চলে যাবো আমার হোটেলে।

"আপনি চাইলে এখানে থাকতে পারেন। সমস্যা নেই!

"যখন দরকার পড়বে, তখন থাকবো।

মেহেরিন কিছু না বলে উঠে যায়। অতঃপর দরজার কাছে এসে ফাহানের দিকে তাকিয়ে বলে,

"ডঃ ফাহান! আমি পাগল নই আর না অস্বাভাবিক। তবুও কিছু লোক বলবে আমার মানসিক সমস্যা আছে।‌রাতের পর রাত জাগা কি মানসিক সমস্যা! 

ফাহান হেসে বলল,
"মোটেও না। 

মেহেরিন কিছু না বলে চলে গেল। ফাহান খালি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল,
"তুমি অস্বাভাবিক নয়, তুমি আলাদা। তোমার কিছু একটা দরকার। যতটা স্বাভাবিক তুমি আমাকে দেখাতে চাইছো তুমি মোটেও এতো স্বাভাবিক না মেহেরিন! 

অর্ণবের সাথে দেখা করার পর মেহেরিন চলে যায়। মেহেরিন চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই ফাহান বের হয় লাকেজ নিয়ে। নিচে নামতেই অর্ণব কে চোখে পড়ে তার। অর্ণব তাকে দেখেই দূরে সরে যায়। ফাহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করাতেই অর্ণব দৌড়ে এসে মিস মারিয়া'র পিছনে লুকায়। প্রথম দেখাতেই কেন জানি অর্ণব কে পছন্দ হয় না তার। কোথায় যেন অর্ণব কে নিয়ে মনে সংশয় লেগে যায় তার। 

ফাহান এসে গাড়ি বের করে। গাড়ি ভেতর বসে গাড়ি স্টার্ট দেয় সে। গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবে অর্ণবের কথা। মেহেরিন'র প্রিয় মানুষ টা যেখানেই মা/রা যায় সেখানেই এই ছেলের উপস্থিত। কোন কারণ কি জুড়ে আছে। তবে ছেলেটার উপস্থিত তার ভালো লাগলো না। কেন লাগলো না তার জানা নেই। 


#চলবে....
[+] 2 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#38
#পর্ব_২৮


"নিরু কে তুমি দেখতে পাও এই কথা সত্য! 

ফাহানের প্রশ্নের উত্তর দিতে বিলম্ব করল না মেহেরিন। শীতল গলায় বলে উঠে,

"হুম পাই! 

"যখন নিরু আসে তখন নাকি বেলী ফুলের ঘ্রাণ পাও তুমি এটা সত্য!

"হুম।

"মাঝরাতে স্টোর রুমে বসে থাকো সেখানে তোমার দি আর বাবা'র স্মৃতি রাখা। 

"হুম থাকি।

"কেন?

"ভালো লাগে খুব।

"নিরু কে কখনো ছুঁয়ে দেখেছিলে?

"ছোঁয়ার চেষ্টা করলেই দি চলে যেত।

"তবুও ছুঁতে!

"হুম ইচ্ছে করতো খুব! 

"নিরু কখনো তার মৃত্যুর রহস্য বলে নি তোমায়?

"না বলে নি! 

"নিরুর মতো নিজের বাপি কে দেখতে পাও না।

"না!

"কেন পাও না?

মেহেরিন ফাহানের দিকে তাকাল। তার সামনে চেয়ারে বসা সে। তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে সে। তার চোখের নজর মেহেরিন'র উপর। এক পলকের জন্যও সরছে না তা। মেহেরিন হেসে বলল,

"এর কারণ আমার জানা নেই।

"তোমার দি মা/রা যাবার এতো দিন পরেও তাকে দেখতে পাও। তোমার কি মনে হয় এটা তোমার কল্পনা।

"না এটা সত্যি!

"মৃ/ত মানুষ কখনো ফিরে আসে না মেহেরিন।

"আমার দি এসেছে, আমাকে অনেক ভালোবাসতো দি। আমাকে ছাড়া কখনো সে থাকতে পারে না।

ফাহান মুচকি হেসে একটু নড়েচড়ে বসল। বলে উঠল,

"এখন বুঝতে পারলে তোমার সমস্যা কোথায়? তুমি এটা মেনে নিতে রাজি তোমার বাবা মা/রা গেছে কিন্তু নিরু যে নেই এটা তোমার মন থেকে সরাতে চাইছো না।

মেহেরিন'র চেহারায় বিরক্তের একটা ছাপ দেখা গেল। মনে হলো সে বিরক্ত। ফাহান হেসে বলে উঠে,

"আচ্ছা বাদ দাও! তোমার মনে হয় নিরু কে খু/ন করা হয়েছে তবে এটা কেন মনে হয় না বাবা কেও খু/ন করা হয়েছে।

মেহেরিন ভ্রু কুচকালো। ফাহান একটা পেপার মেহেরিন'র হাতে দিয়ে বলল,

"তোমার বাবা হার্টের কোন প্রবলেম ছিল না মেহেরিন। তবে তিনি শ্বাসকষ্টের রোগী ছিলেন। মূলত এসব রোগীরা ভয়ংকর বা অপ্রত্যাশিত কিছু চোখের সামনে দেখলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর তখন তাদের শ্বাসকষ্ট উঠে যায়। আর এই রিপোর্ট অনুযায়ী তিনি শ্বাসকষ্টের কারণেই মা/রা গেছে। এখন তুমি বলো, মিথ্যে কেন বললে! 

মেহেরিন হেসে ফেলল। মেহেরিনের ঠোঁটের কোনের হাসি ফাহানের অবাকের কারণ হলো। ভ্রু কুন্চিত হলো তার। মেহেরিন হেসে বলল,

"আপনার মনে হয়, আমার বাবা কে আমি মেরে/ছি! 

ফাহান খানিকটা থতমত খেল। অতঃপর বলে উঠে,
"তেমনটা করলে মোটিভ থাকা দরকার। 

"তা জোগাড় করেছেন।

"তেমন কিছুই পাই নি আমি...

"তা হলে এই কথা কেন বলছেন?

ফাহান ভ্রু কুঁচকে বলল,
"আমি এই কথা একবারও বলি নি মেহেরিন। কথাটা তুমিই বলেছ! 

"ইনডাইরেক্টলি তাই বলার চেষ্টা করছেন। আচ্ছা ছাড়ুন। আমার বাবা'রা আমরা দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউই ছিল না। আর তার সম্পত্তি তাই আমাদের দু'জনের অধিকার ছিল। এখন আপনি ভাববেন সব সম্পত্তি একা ভোগ করার জন্য আমি দি কে মেরে/ফেলেছি। আর এই সত্য আমার বা/বা জানে বলে তাকেও মেরে/ফেলেছি কি তাই তো! 

ফাহান কোন কথা না বলে নিশ্চুপ হয়ে মেহেরিন'র কথা শুনছে। মেহেরিন এবার উঠে দাঁড়াল। ফাহানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,

"আপনার পেশা একজন সাইক্রেটিস। তবুও একজন গোয়েন্দা হবার চেষ্টা করছেন। এখন যাই করুন না কেন তা ঠিক ভাবে করার চেষ্টা করুন। 

বলেই ফাহানের ঘর থেকে বের হতে নিলে পেছন থেকে ফাহান তাকে ডাক দিল। মেহেরিন পিছনে ফিরতেই ফাহান কপি মগে চুমুক দিয়ে মেহেরিন কে উদ্দেশ্য করে বলল,

"তা সম্ভব না, তোমার দি মা/রা যাবার আগে তার ভাগের সম্পত্তি সব তোমার জিজু নামে করে গেছে। 

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে তাকালো ফাহানের দিকে। এক পা এগিয়ে সামনে এলো সে। ফাহান উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে মেহেরিন'র সামনে এসে দাঁড়াল সে। বলে উঠল,

"তোমার বাবা মা/রা যাবার আগে তার লাস্ট কল তোমার জিজু ছিল। খোঁজ চালিয়েছি আমি। শুধু তথ্য গুলো ঠিক ছিল কি না তা নিশ্চিত হলাম। 

মেহেরিন মুখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
"এসব অনেক আগেই জানি আমি! 

"তবুও কেন মিথ্যে বললে আমায়?

মেহেরিন'র মুখ লাল হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে ধরল সে। ফাহানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

"কাকে কাকে সত্য বলবো আমি। এসব অনেক আগেই কোর্টে বলেছি। কিন্তু তা মিথ্যে বলে দোষারোপ উল্টো আমার কাছেই এসেছে।‌সবাই বলেছে আমি সম্পত্তি'র লোভে নিজের দি কে মেরে/ছি। যতদিনে প্রমাণ করলাম সম্পত্তি সব জিজুর নামে ততোক্ষণে তারা এই কাহিনী বানালো জিজু কে সম্পত্তি দেওয়ার কারণে রেগে গিয়ে দি কে মেরে/ফেলেছি আমি। এটা কি সত্যি'ই বিশ্বাস যোগ্য। মায়ের জায়গা যাকে দিয়েছিলাম তাকে খু/ন করার অভিযোগ উঠলো। কিন্তু শেষ অবদি প্রমাণ না করতে পারায় কিছুই করতে পারলো না। তবুও নিজের মন কে কিভাবে বোঝাতাম আমি। 

ফাহান কফি মগে চুমুক দিয়ে মেহেরিন'র কথা শুনেই যাচ্ছে। মেহেরিন'র গলা ততোক্ষণে ভারী হয়ে আসছিল। তার চোখের কোনে অশ্রু জমতে শুরু করেছে। তবুও মেয়েটা খুব শক্ত। এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে দেয় নি। মেহেরিন একটু দম ছেড়ে বলে উঠল,

"বাবা'র মৃতু অস্বাভাবিক, জানি আমি! আর আমার এটাই মনে হয় জিজু আছে এর পিছনে। এখন যাই হোক না কেন সত্যি টা আমি বের করেই ছাড়বো। 

বলেই ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল সে। ফাহান মুচকি হেসে বলল,

"যদিও আমি কফি এতোটা ভালো বানাই না তবুও আজকের কফি টা খুব ভালো। তুমি চাইলে ট্রাই করতে পারো। 

মেহেরিন'র কপালে ভাঁজ পড়লো। সে না বলার আগেই ফাহান তার জন্য কফি বানাতে চলে গেল। 

---- 

বাগানের এক কোনে চেয়ারে বসে ল্যাপটব টিপছে মেহেরিন। তার পাশেই অর্ণব বসে দেখতে তাকে। বাড়িতে গাড়ি ঢোকার আওয়াজ এলো। মেহেরিন পিছনে তাকিয়ে দেখল নিরব আসছে। তাকে দেখে আবারো ল্যাপটবে মুখ গুজল সে। নিরব এসে অর্ণব কে কোলে নিল। একটু আদরও করল। অর্ণবের অস্বস্তি লাগছে। তাই সে চলে এলো তার কাছ থেকে। মেহেরিন কে জড়িয়ে ধরল।‌ নিরব হতাশ হয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। মেহেরিন অর্ণবের কপালে চুমু খেয়ে বলল,

"তুমি ঘরে যাও, মাম্মি কাজ সেরে আসছে ঠিক আছে।

অতঃপর মিস মারিয়া কে ডেকে অর্ণব কে তার হাত ধরে ঘরে পাঠাল। নিরবের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবারো কাজে মনোযোগ দিল। 

"কোন খবর আছে নাকি?

"না তেমন কিছু নেই।

"ক্লাইন্টদের সাথে মিটিং ফিক্স করেছিস।

"দুদিন পর মিটিং...

"আর বলছিস কোন খবর নেই।

নিরব কিছু না বলেই অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মেহেরিন ল্যাপটব রেখে নিরবের দিকে তাকিয়ে বলল,

"কি ভাবছিস এতো?

"ডঃ ফাহান এরকম কিছু একটা নাম না তার।

"হুম কেন? 

"আজ সে এসেছিল আমার কাছে।

"ওহ আচ্ছা! তো এতে এতো টেনশন করার কি আছে।

নিরব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল মেহেরিন'র দিকে। ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠে,
"খুব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা জিজ্ঞেস করছিল তোর ব্যাপারে।

"করতে দে..

"উনি নাকি তোর চিকিৎসা করতে এসেছে, এই কি তার চিকিৎসার নমুনা।

"আচ্ছা ছাড় না এসব! 

নিরব মুখ ঘুরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেহেরিন হেসে বলল,

"আচ্ছা চা খাবি তো, তুই বস আমি নিয়ে আসছি। 

মেহেরিন কোলের ল্যাবটপ টা টেবিলে রেখে দাঁড়িয়ে গেলো। নিরব ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালো। মেহেরিন একগাল হেসে ঘরের ভেতর হাঁটা ধরল। নিরব ল্যাবটপ হাতে নিয়ে মেহেরিন'র পিছন পিছন যেতে লাগলো। 

রান্না ঘরে চা বানাচ্ছে মেহেরিন। তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ল্যাবটপ দেখার ছলে মেহেরিন কে লুকিয়ে দেখছে নিরব। কে বলবে এই মেয়ে টাকে কতো ভালোবাসে সে। সারাক্ষণ শুধু তার'ই কল্পনায় মগ্ন সে। মেহুর ভালোবাসা পাগল করেছে তাকে, মুগ্ধ করেছে। এই মুগ্ধতা যে কমবার নয়। তবে এই ভালোবাসা যে প্রকাশ করতে পারছে না সে। প্রকাশ করা কি উচিত নয়? কদিন'ই বা একা একা ভালোবেসে যাবে সে। তার এই ছোট্ট মনে তার মেহুর জন্য থাকা অনুভূতি কি আদৌও সে প্রকাশ করতে পারবে না। হুট মেহেরিন নজর তার দিকে পড়তেই তার দিকে তাকাতেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল সে। মেহেরিন ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে চা কাপে ঢেলে এনে রাখল নিরবের সামনে।
 অতঃপর তার সামনে চা রেখে আবারো রান্না ঘরের দিকে যেতেই নিরব তার হাত খানা ধরে ফেলল। মেহেরিন খানিকটা অবাক হলো। নিরব ধীরে মেহেরিন'র কাছে এসে দাঁড়াল। মেহেরিন'র গালে হাত রেখে চুমু খেল কপালে। তবে আফসোস! তার এই কল্পনা টুকু সত্যি হতে পারল না। মুহূর্তেই তার কল্পনা জগৎ ছেড়ে বের হয়ে এলো সে। মেহেরিন'র ডাকে কল্পনা ভাঙল তার। মেহেরিন তাকে রেখে অর্ণবের কাছে গেল। নিরব হেসে চায়ের কাপ টা হাতে নিল। এমন কল্পনা একবার না বহুবার দেখেছে সে। তবে শুধু কল্পনায় না, বাস্তবে মেহেরিন কে কাছে চায় সে। তার ভালোবাসার রঙে রাঙাতে চায়। তবে সব ভালোবাসা কি রঙ তুলিতে রঙিন হয়! 

ফাহান ভেবেই যাচ্ছে মেহেরিন'র সমস্যা ঠিক কোথায়? কয়েকদিন ধরেই এটা ধরার চেষ্টা করছে সে। কেন এই মেয়ে টা এতো অস্বাভাবিক। শুধু'ই কি প্রিয়জনকে হারানোর কষ্ট নাকি একাকিত্ব! 

রাত ৮ টা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ফাহান হাতে কফি মগ টা নিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে। আজকের বৃষ্টি টা সুন্দর। বৃষ্টি না ঝিরিঝিরি পড়ছে আর না বেশি জোরে। আজ আকাশও গর্জন করছে না। নিরিবিলি এক ধরনের বৃষ্টি। আকাশ থেকে কতো পানিই না ঝড়ে পড়ছে এই মাটিতে। সতেজ করছে পুরো প্রকৃতি। এমন দৃশ্য আর কদিন'ই বা দেখা যায়। ফাহান আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

"এই বৃষ্টি খুব জলদি থামবে বলে মনে হচ্ছে না! 

ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ শুনতে লাগল। হঠাৎ করেই কিভাবে মেহেরিন'র মুখটা ভেসে উঠলো তার সামনে। চোখ বন্ধ রেখেই ভ্রু কুঁচকে নিল সে। মেহেরিন'র বৃষ্টিতে ভেজা সেই রুপ ফুটে উঠছে তার সামনে। তার সারা মুখে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু পানির কণা, থিতুনি বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে সে। ফাহান চোখ মেলে তাকাল। গাড়ির চাবি টা নিয়ে বের হয়ে গেল সে। 

মেহেরিন অর্ণব কে খাওয়ানো শেষে তাকে নিজের কোলের মাঝে বসাল। অতঃপর দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। তার কানের কাছে কথা বলতে লাগল যাতে কিছুটা হলেও নিজ থেকে কথা বলে সে। হঠাৎ করেই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। নিরবের কল করার কথা ছিল। তা ভেবে না দেখেই কল রিসিভ করে কানে দিল। বলে উঠল,

"প্রেজেন্টেশন আমি তৈরি করে ফেলেছি, তুই টেনশন নিস না।

"কিসের প্রেজেন্টেশন বানালে তুমি মেহেরিন। 

অবাক হলো মেহেরিন। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল ডঃ ফাহান!

"ওহ সরি, ডঃ ফাহান। আমি ভেবেছিলাম নিরব!

"ওহ তাই বলো, নাহলে আমি ভাবছি তোমাকে আবার কি প্রেজেন্টেশন দিলাম আমি। 

"হঠাৎ করে কল করলেন, জরুরি কোন কথা?

"জরুরী তো অবশ্যই! 

"জ্বি বলুন।

"না এভাবে না, দেখা করো!

"এই বৃষ্টিতে?

"তোমার বাড়ির সামনেই আছি আমি।

"ওহ তাহলে বাড়িতে আসুন।

"না কথা এখানে বলা যাবে না।

"তাহলে...

"বাইরে আসো, আমি অপেক্ষা করছি! 

মেহেরিন কিছু বলার আগেই কল কেটে গেল। মেহেরিন মিস মারিয়া'র কাছে অর্ণব কে রেখে বাড়ির বাইরে আসলো। অতঃপর বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়ির বাইরে চলে গেল। আশপাশ তাকিয়ে ফাহানের গাড়ি দেখতে পেল সে। গাড়ির কাছে যাবার আগেই হুট করেই তার হাত ধরে টান দিল সে। মেহেরিন সামনে ঘুরে দেখল ফাহান ছাতা হাতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফাহান বলে উঠে,

"তুমি বৃষ্টিতে ভিজে কেন এসেছো, ছাতা আনতে পারো নি। 

মেহেরিন থতমত খেয়ে গেল। কিছু বলবে তার আগেই ফাহান তার হাত ধরে বৃষ্টির মাঝে চলতে শুরু করল। নিরবের গাড়ি সবেমাত্র এসে ভিড়ল মেহেরিন'র বাসার সামনে। মেহেরিন কে ডঃ ফাহানের সাথে চলে যেতে দেখে দম বন্ধ হয়ে গেল সে। কঠিন মুখ চোখ করে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। 

ফাহানের এমন হুট করেই হাত ধরাতে হতবাক মেহেরিন। শান্ত গলায় বলে উঠল,

"ডঃ ফাহান হাতটা ছাড়ুন আমার।

"ওহ সরি! 
বলেই ফাহান হাত ছেড়ে দিল। কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে মুখ টিপে হাসল সে। এক ছাতার নিচে হাঁটছে দুজন। অনেক পথ'ই হাটল। মেহেরিন বলে উঠল,

"আমরা কোথায় যাচ্ছি?

"লক্ষ্য ছাড়া হাটছি, দেখি কোথায় এসে ঢেকে!

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকে ফাহানের দিকে তাকাল। ফাহান হেসে বলল,
"সিরিয়াসলি নিয়ে ফেললে নাকি, আচ্ছা বলছি! সামনের পার্ক টা অবদি যাবো। বৃষ্টিতে হাঁটতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু একা একা হাঁটতে ভালো লাগল না বলে তোমার সঙ্গ নিলাম।

"বাসায় অর্ণব আমার অপেক্ষা করছে।

"হাম তা জানি। তোমার বেশি সময় নেবো না আমি। কিছু কথা জিজ্ঞেস করব।

"আপনারা সাইক্রেটিস রা সারাক্ষণ প্রশ্ন করা নিয়েই ভাবেন।

"প্রশ্ন হচ্ছে উওরের সন্ধান! 

মেহেরিন ফাহানের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ছাতার নিচ থেকে বেরিয়ে এলো। ফাহান বলে উঠে,

"আরে মেহেরিন বাইরে বৃষ্টি তো! ভিজে যাবে..

মেহেরিন পিছনে ফিরে বলল,
"হয়তো একটু বেশিই উওরের সন্ধানে থাকেন। তাই আপনার চোখে পড়ছে না বৃষ্টি থেমে গেছে। 

ফাহান মাথার উপর থেকে ছাতা সরিয়ে দেখল আসলেই বৃষ্টি থেমে গেছে। সে মুচকি হেসে ছাতা টা বন্ধ করে নিল।

পার্কে এসে মেহেরিন বড় গাছ টার নিচে এসে দাঁড়াল। ফাহান সামনে বরাবর ল্যাম্পপোস্ট'র নিচে দাঁড়াল। মেহেরিন দাঁড়িয়ে তার মুখ টা দেখতে পেল। তার মুখটা মলিন হয়ে আছে। ফাহান তাকিয়ে আছে তার দিকেই। মেহেরিন চোখ নামিয়ে ফেলল।‌ ফাহান বলে উঠল,

"অর্ণবে প্রিয় জিনিস তার থেকে কেড়ে নিলে কি করে সে? 

মেহেরিন শীতল গলায় বলল,
"প্রথমে প্রথমে মুখ ভার করে বসে থাকবে। চোখ মুখ সব লাল হয়ে যাবে। এর কিছুক্ষণ'র মধ্যেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করবে সে।

ফাহান হেসে বলল,
"কারো প্রিয়জন হারিয়ে গেলে সে কি করবে? 

মেহেরিন রাতের খোল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
"কাঁদবে.. কষ্ট পাবে!

"নিরু মা/রা যাবার পর তুমি কয়দিন কাঁদলে?

মেহেরিন চোখ মুখ মলিন করে তাকিয়ে রইল ফাহানের দিকে। মেহেরিন'র আবছা মুখ দেখতে পাচ্ছে সে। ফাহান এগিয়ে এসে বলতে লাগল,

"স্বীকার করতে শিখো মেহেরিন তোমার প্রিয় মানুষ গুলো নেই আর পৃথিবীতে। তুমি হারিয়ে ফেলেছ তাদের। এতে তোমার কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট। আর সেই কষ্ট যতোই নিজের মাঝে রাখবে ততোই তা কুড়ে কুড়ে খাবে তোমাকে। মানুষ কাঁদে নিজের মন হালকা করার জন্য। কেউ কাঁদলে এটা তার দুর্বলতা হবে এটা ভাবার কোন কারণ নেই। কাঁদলে মানুষের মন হালকা হয়। মানুষ নতুন করে বাঁচতে শিখে। সেই বেঁচে থাকার স্বাদ কি তুমি নিতে চাও না। 

মেহেরিন'র গলা ধরে আসছিল। মেহেরিন চোখ মুখ কঠিন করে ফেলল। সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই ফাহান তাকে টেনে গাছের সাথে আঁটকে দিল। বলে উঠল,

"পালিয়ে যাচ্ছো কেন? সবকিছু থেকে পালিয়ে গেলেই তা তোমার পিছু ছাড়বে না। সত্যি টা স্বীকার করো মেহেরিন। তোমার বোন আর বেঁচে নেই। মা/রা গেছে সে। তার ঝুলন্ত লা/শ সবার প্রথমে দেখেছিলে তুমি। তাকে বাঁচাতে পারো নি বলেই সেই আক্ষেপ তোমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নিজেকে দায়ী করছো তুমি! এমনটা কিছু না।

মেহেরিন মুখ ঘুরিয়ে নিল। তার শরীর কাঁপছে। কেঁপে কেঁপে বলে উঠল,

"এএএ..মমন এমন কিছু না।

"সত্যি কি তাই! 

মেহেরিনি মাথা নেড়ে বলল,
"হুম! 

ফাহান সরে এলো মেহেরিন'র কাছ থেকে। বলে উঠল,
"ঠিক আছে!

বলেই একা বেরিয়ে এলো পার্ক থেকে। খানিক দূর অবদি হেঁটে এলো। পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো না মেহেরিন কে। আবারো হেঁটে পার্কের কাছেই গেলো সে। দেখল গাছের নিচে ছোট বাচ্চাদের মতো হাঁটু গেড়ে বসে নিশ্চুপ ভাবে কাঁদছে মেহেরিন। ফাহান এগিয়ে এলো না। দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। সে চাইলো মেহেরিন কাদুক। কাদলে তার মন হালকা হবে।‌ বেশি কিছু না হলেও আজকের রাত টা শান্তিতে ঘুমাতে পারবে সে। 

কাঁদতে কাঁদতে মেহেরিন'র হেঁচকি উঠে এলো। ফাহানের মনে হলো এবার তাকে থামানো উচিত। সে এগিয়ে গেল মেহেরিন'র দিকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকতেই মেহেরিন কান্না থামিয়ে দিল। ফাহান বলে উঠে,

"অনেক কেঁদেছ, যথেষ্ট হয়েছে।

মেহেরিন দ্রুত দাঁড়িয়ে উঠলো। ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল সে। তার হাত কাঁপছে। ফাহান তার দিকে রুমাল টা এগিয়ে দিল। মেহেরিন তা হাত বাড়িয়ে নেবার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফাহানরে উপরে এসে পড়ল। ফাহান তাকে দ্রুত ধরে ফেলল। তার মুখ খানি দেখে চুল গুলো কানে গুঁজে দিল। কোলে তুলে নিল তাকে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার কান্না মাখা মুখটা দেখতে পেলো সে। কিছু আছে এই মুখের মাঝে। ফাহান কে আকৃষ্ট করল তা। প্রথমবারের মতো সে স্বীকার করতে বাধ্য হলো তার মনের অনুভূতি টুকু মেহেরিন'র জন্য। আর এই অনুভূতির নাম ভালোবাসা! এ কথা তার মন স্বীকার করতেই তার ঠোঁটের কোনে হাসি দেখা দিল। বির বির করে বলে উঠলো,

"তোমার সেই বৃষ্টি ভেজার দৃশ্য দেখেই আমি প্রথম তোমার প্রেমে পড়েছিলাম, তা তখন না বুঝতে পারলেও এখন ঠিক'ই বুঝছি আমি! 

ধীরে ধীরে নিজের প্রেমে পড়তে বাধ্য করালো সে মেহেরিন কে। মেহেরিন'র জীবনে এই প্রথম কোন পুরুষের ভালোবাসা পেল সে। তার জন্য এই ভালোবাসা'র দাম অনেক ছিল। সে ভাবল কেউ একজন তো আছে যে কি না তাকে ভালোবাসবে, আগলে রাখবে তাকে। নিজের সবটুকু দেবে তাকে। আর সেই মানুষটি ফাহান কে মনে হলো তার। তবে ফাহানের এতো বড় মনে ছোট একটা বাচ্চার প্রতি থাকা ক্ষোভ বাড়তে লাগলো ধীরে ধীরে আর তা পুরোপুরি ভাবেই মেহেরিন'র অগোচরে। মেহেরিন'র এই ধারণা ছিল'ই না তার ভালোবাসার মানুষটি তার জীবন'কেই ভালোবাসতে পারে নি। 

বর্তমানে...

ডঃ রাহেলা চোখের সমস্যা টা আবারো খুললেন। নির্ঝর এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখে মুখে এখনো আগ্রহ! এমন একজন শ্রোতা পেয়ে ভালো লাগছে তার। ডঃ রাহেলা শ্বাস ফেলে বললেন,

"তাদের এই প্রেম অনেকদিন ধরেই টিকেছিল। তাদের বিয়ের কথাও একবার কানে এলো। তবে হুট করেই কি হলো বুঝতে পারলাম না। তাদের দুজনের মাঝে সবকিছু আলাদা হয়ে গেল। কিন্তু তা কেন এটা আমার জানা নেই। কেটে গেল আরো কয়েকমাস। তবে একটা কথা, ফাহানের চলে যাওয়াতে মেহেরিন একবারের জন্যও কিন্তু ভেঙে পড়েনি। একদম স্বাভাবিক রেখেছিল সে নিজেকে। তবে আমি জানতাম এটা শুধুই তার দেখানো। তার চিকিৎসা তখন আমিই চালিয়ে যেতে লাগলাম। একসময় দেখলাম তার পুরো চিন্তা ভাবনা অর্ণবকে নিয়ে। অর্ণব কে নিয়েই সারাদিন তার পড়ে থাকা। মাঝে মাঝে অফিসের কাজ ছেড়ে অর্ণব কে নিয়ে তার বসে থাকা দেখে ভেবে নিলাম এবার হয়তো সত্যিই স্বাভাবিক সে। তবে অর্ণব ততোদিনেও স্বাভাবিক হয় নি। অতঃপর হঠাৎ করেই অর্ণব দেখলো তোমায়। সেদিন প্রথমবার সে নিজ থেকেই তোমাকে ডাক দিলো। হয়তো তুমি তা শুনতে পারো নি তবে মেহেরিন'র কাছ থেকে আড়াল হয় নি। অর্ণব তোমাকে নিজের ড্যাডি বলেই ভেবে নিল। মেহেরিন সমস্ত কথা এসে বললো আমায়। তারপরের সব কথা তো তোমার জানাই! 

নির্ঝর এখন তার চোখ সরালো। ঘাড়ে হাত রেখে ঘাড় নাড়াল। তার ঘাড় ব্যাথা করছে। অর্ণবের প্রথম ড্যাডি ডাকের কথাটা অফিসের কথা মনে করিয়ে দিল তাকে। সে মুচকি হাসল।‌ডঃ রাহেলা বলল,

"নির্ঝর আর ইউ ওকে!

"হুম! 

"সরি তোমাকে বিচ্ছেদের কারণটা বলতে পারছি না আমি। তবে একটা কথা বলতে পারি! 

নির্ঝর অবাক চোখে তাকাল। ডঃ রাহেলা বললেন,

"ফাহানের সাথে বিচ্ছেদের পর মেহেরিন যেভাবে অর্ণব কে আগলে রাখতে শুরু করল এতে মনে হচ্ছে তাদের বিচ্ছেদ অর্ণবের সাথে যুক্ত! 

নির্ঝর মাথা নাড়িয়ে এপাশে তাকাল। এর মাঝেই দরজায় কড়া নাড়ল। নির্ঝর পেছন ফিরিয়ে দেখল অর্ণব উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে। তাকে দেখে বলে উঠল,

"ড্যাডি! 

"অর্ণ সোনা! 

বলেই কোলে তুলে তাকে। ডঃ রাহেলা হেঁসে বলেন,
"খুব মিস করছিল অর্ণব তোমায়! 

অর্ণব হেসে মাথা নাড়ল। নির্ঝর হেসে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
"সরি সোনা। এজন্য তোমাকে আমি একটা না দুটো আইসক্রিম খাওয়াবো ঠিক আছে। কিন্তু মাম্মি কে বলবে না প্রমিস! 

বলেই হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুল এগিয়ে দিল। অর্ণব তার কনিষ্ঠা আঙ্গুল তাতে রেখে বললো,

"প্রমিস! 

ডঃ রাহেলা হেসে উঠেন। নির্ঝর অর্ণবের গাল টেনে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাথায় এখন শুধু একটাই কথা বাকি অতীত কে বলবে তাকে। হুট করেই একটা নাম এসে ঠেকল তার মাথায়। নির্ঝর নিজের মাথার চুল এলোমেলো করে বলল,

"হুম পেয়ে গেছি।

ডঃ রাহেলা বলে উঠেন,
"হোয়াইট?

"বাকি অতীত যে বলবে তাকে। তবে হ্যাঁ ডঃ রাহেলা অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। 

ডঃ রাহেলা মুচকি হাসেন। নির্ঝর তাকে বিদায় দিয়ে দরজার কাছে এসেও আবারো ডঃ রাহেলা'র দিকে তাকিয়ে বলল,

"তবে হ্যাঁ ডঃ রাহেলা , আমার দেখা মেয়েদের মধ্যে আপনি একজন যাকে সিগারেট খেলে অনেক সুন্দর লাগে। 

ডঃ রাহেলা খানিকটা অবাক হলেন। নির্ঝর দাঁত বের হেসে বলল,

"অবশ্যই একদিন নিজের এক্স হাসবেন্ড'র সামনে এভাবে সিগারেট খাবেন। দেখবেন সে নতুন করে আপনার প্রেমে পড়বে।

ডঃ রাহেলা ভ্রু কুঁচকে বলেন,
"মেয়েদের সাথে ফ্লাটিং করার অভ্যাস এখনো গেলো না তোমার নির্ঝর! 

নির্ঝর হেসে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। নির্ঝরের হাসি দেখে অর্ণবও হাসতে লাগলো। নির্ঝর মুখ ফুলালো। অর্ণব ও তার সাথে মুখ ফুলাল। নির্ঝর ফুট করে তা গালে হাত আঙুল রেখে খোঁচা দিল। অর্ণব দাঁত বের করে হেসে দিল। 

#চলবে....
[+] 1 user Likes Manjarul Haque's post
Like Reply
#39
#পর্ব_২৯

আজকের দিনটা সুন্দর! সকাল থেকেই আকাশ টা পরিষ্কার। গত দিনের বৃষ্টি থেমেছে আজ ভোরবেলা। এরপর থেকেই আকাশ দেখতে চমৎকার লাগছে। সকালটা কেমন একটা শীত শীত ভাবও আছে। নিরব বিছানা ছেড়ে বের হয়ে এলো। আজকের দিনের অনেক প্ল্যান করে রেখেছে সে। আজ তার ভালোবাসার প্রকাশ করবে সে। যাই হোক না কেন আজ তাকে তা করতেই হবে। এতো দিন তাকে ছাড়া অন্য কোন ছেলে মেহেরিন'র জীবনে ছিল না বলেই এতোটা ভাবতে হয় নি। কিন্তু ওই ফাহান এবার বেশি বেশি করছে। কেন মনে হচ্ছে বার বার এই ফাহান তার থেকে তার মেহু কে কেড়ে নিবে। 

সকাল থেকেই এর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। প্রপোজ তো করবে বিকেল বেলা আর এখন তো সবে সকাল। কিন্তু সাবধানের মার নেই। শেষ মুহূর্তে এসে যদি ভালোবাসি কথাটা বলতে না পারে তখন কি হবে। ১০৮ বার রিয়াসেল করল। যার মাঝে ১০০ বার'ই কথার মাঝে হোঁচট খেল সে। বাকি ৮ বার তাও যা একটু বলল তবে তার সেটা পছন্দ হলো না। 

শাওয়ার নিয়ে এসে গরম কফি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করল। অতঃপর ভাবতে লাগল দিনটা শুরু কিভাবে করবে। আচ্ছা গোলাপ দিয়ে কি প্রপোজ করবে নাকি জবা! নাকি কোন গিফট বা আংটি। না না এটা বেমানান লাগবে। আংটি তো বিয়ের প্রপোজালে দেয়। সেটাই কি করবে নাকি। 

"আহ আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না, যত'ই ভাবছি ততোই গুলিয়ে ফেলছি।"

হুট করেই বিছানার মাঝে লুকিয়ে পড়ল। ঘুম নেওয়া দরকার। ঘুমালে মাইন্ড ফ্রেস হবে। তখন আর সমস্যা হবে না। এই ভোর দুপুরে সূর্য উঠে গেছে মাথা বরাবর। তখন ঘুমানোর কথা ভাবাও যায় না। কিন্তু নিরব সেখানে ঘুমে মাতাল। তবে ঘুমের মাঝেই স্বপ্ন দেখলো মেহু কে নিয়ে। ঘুম তার ভালো লাগে এই একটাই কারণে। এখানে তার কল্পনার মেহু কে ভালোবাসতে পারে সে। এখানে ভালোবাসি বলতে হোঁচট খেতে হয় না। নির্ধিতায় বলা যায়। 

বিকালে গাড়ি নিয়ে বের হলো নিরব। খান বাড়ির কাছে এসে গাড়ি থামাল নিরব। ফোন বের করে মেহেরিন কে কল করতে যাবে তখনই তার সামনে দিয়ে ফাহান আর মেহেরিন'র গাড়িতে উঠলো। নিরব ফোনটা হাতে রেখে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। 

ফাহান মেহেরিন কে গাড়িতে বসিয়ে নিজে বসল। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিল। নিরব তাদের গাড়ি ফলো করতে লাগলো। সন্ধ্যা অবদি নিরব তাদের ফলো করতে লাগলো। ফাহান সন্ধ্যা অবদি মেহেরিন কে নিয়ে ঘুরল। অতঃপর ফাহান এক জায়গায় গাড়ি থামাল। মেহেরিন গাড়ি থেকে নেমে মুখ খুলে শ্বাস নিয়ে বলল,

"অবশেষে কোথায় থামলে তুমি..

ফাহান মুচকি হেসে মেহেরিন'র হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করল। অতঃপর তাকে নিয়ে হাঁটতে লাগল। মেহেরিন বিনা বাক্যে ফাহানের হাত ধরে হাঁটতে লাগল। মনে হলো কোন একটা গোলক ধাঁধা'র মাঝে তারা ঢুকে পড়েছে। চারপাশের গাছ গাছালিতে লাইটিং করা। মেহেরিন এসব দেখছে আর অবাক হচ্ছে। ফাহান মেহেরিন কে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,

"ভালো লাগল এসব!

মেহেরিন মুচকি হেসে বলে,
"খুব সুন্দর! 

"আসল সারপ্রাইজ এখনো বাকি!
বলেই মেহেরিন'র হাত ধরে দৌড়াতে থাকে সে। মেহেরিনও দৌড়াচ্ছে তার সাথে। এক পর্যায়ে ফাহান হাত ছেড়ে দেয় মেহেরিন। মেহেরিন এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়। মাথার উপরে জুড়ে লাইটিং করা। চারদিকে অন্ধকারের মাঝে এই আলো অভিভূত করল তাকে। মেহেরিন ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ হাসি রেখে এসব দেখতে থাকে। অতঃপর পিছনে ঘুরে ফাহান যেই না ফাহান কে কিছু বলতে যাবে, ওমনি সে থমকে গেল। দেখল ফাহান তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। তার হাতে লাল রঙের একটা তাজা গোলাপ। ফাহান বলে উঠল,

"ভালোবাসি তোমায় মেহেরিন! ভালোবাসবে কি তুমি আমায়? 

মেহেরিন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এদিকে ফাহান খুব নার্ভাস। কি হবে না হবে বুঝে উঠতে পারছে না। ওদিকে নিরব নিশ্চুপ ভাবে দাড়িয়ে আছে। কি হবে এখন, মেহেরিন কি স্বীকার করবে এই ভালোবাসা! দেখার জন্য অস্থির তার মন। 

মেহেরিন মুচকি হাসল। তার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। সে ফাহানের হাত থেকে ফুল টা নিয়ে ফাহানের গাল দুটো আকড়ে ধরল। অতঃপর তার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলল,

"ভালোবাসি! 

মেহেরিন'র মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনে নিরবের মলিন মুখের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল।‌ ফাহান হেসে উঠে দাঁড়াল।‌‌ মেহেরিন দুটো হাত আঁকড়ে ধরে বলল,

"তুমি জানো না আজ কতোটা খুশি আমি। 

মেহেরিন একগাল হেসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফাহান মেহেরিন'র চোখের দিকে তাকাল।‌ অতঃপর ধীরে তার দুই হাত দ্বারা তার গাল আকড়ে ধরল।‌ চুমু খেল তার ঠোঁটে। মেহেরিন হুট করে কেঁপে উঠলো। তার শরীরের জ্যাকেট আকড়ে ধরল সে।‌ ফাহান কে চুমু খেতে লাগল। 
নিরব কঠিন মুখ করে মুহূর্তে'ই সেখান থেকে চলে এলো। দ্রুত হেঁটে বের হয়ে এলো সে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।‌গাড়ির কাছে এসে গাড়ির দরজা খুলে আর ভেতরে ঢুকতে পারল ন সে। গাড়ির সামনেই ধপাস করে বসে করল। চোখের অশ্রু বাঁধ মানতে চাইছে না।‌ একসময় তা চোখ বেয়ে পড়ে গেল। মেহুর জন্য রাখা গোলাপটা জ্যাকেটে পকেট থেকে বের করল‌ সে। গোলাপের দিকে তাকিয়ে রইল নিশ্চুপ হয়ে। প্রিয় মানুষ কে হারিয়ে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। খুব দেরি করে ফেলেছে । যদি আরো আগেই মেহু কে বলে দিত ভালোবাসার কথা হয়তো আজ এই দিন দেখা লাগতো না তার। 

------

নিরব খুব জোরেই গাড়ি ব্রেক কসল। বুকের মাঝে হাত ধরল। হুট করেই কেন আজ এতো ব্যাথা হচ্ছে। অতীতের কথা খুব মনে পড়ছে আজ তার। সেই দিনের কষ্টের অনুভব আজও হচ্ছে তার। কেন তার জানা নেই, তবে কি আবারও মেহু কে হারাতে চলল সে। 
গাড়ির কাচ নামিয়ে বাইরে তাকাল সে। খান বাড়িতে এসেছে সে।‌ কিন্তু মেহুর জন্য না। মেহু এখন অফিসে। আজ এসেছে নির্ঝরের জন্য। নির্ঝর তাকে ফোন করে আসতে বলেছে। কি জন্য তাকে আসতে বলেছে তার জান নেই। তবুও খুব অস্থির সে। 

মুখ খুলে দম ফেলে গাড়ির থেমে নামল সে। বাড়ির ভিতরে যেতে নিবে অমনি পেছন থেকে নির্ঝর ডাকল। নিরব তার দিকে ফিরতেই নির্ঝর তাকে আসার জন্য ইশারা করল। নিরব তার পিছু পিছু গেল। বাগানের কাছে এসে বসল নির্ঝর। নিরব কে বসতে বলল চেয়ারে। অতঃপর কাপে চা ঢেলে তার সামনে রেখে বলল,

"তোমার টাইমসেন্স খুব ভালো! 

নিরব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে বলল,
"আমাকে ডেকেছ কেন?

"অবশ্যই ডেকেছি আর কোন কারণেই ডেকেছি।

নিরব ভ্র কুঁচকে বলল,
"কি কারণে?

নির্ঝর শব্দ করে শ্বাস ফেলল। নিরব বলে উঠল,
"অর্ণব কোথায়? 

"ঘুমাচ্ছে!

"ওহ আচ্ছা! 

নির্ঝর এবার নিরবের দিকে ঝুঁকল। নিরব ভ্রু কুচকালো। নির্ঝর বলে উঠল,

"মেহু আর ফাহানের বিচ্ছেদের কারণ কি? 

নির্ঝরের কথায় নিরবের উপর কোন প্রভাব পড়ল না। সে স্বাভাবিক ভাবেই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর মুচকি হেসে বলল,

"দেখ নিরব, আমি জানি তোমার আর আমার বনে না। তবে এটা আমার জন্য জানা খুব দরকার। আমি জানো তুমি এটা জানো! 

"আমি কেন তোমাকে বলবো! 

"কেন? তুমি চাইবে না মেহু ভালো থাকুক! 

নিরব মুখ খুলে শ্বাস নিল। নির্ঝর তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। নিরব মুখটা কঠিন করে বলল,
"এই ফাহান কে কখনোই আমার পছন্দ ছিল না। 

"তাহলে কি এই বিচ্ছেদের কারণ তুমি? তুমি বিচ্ছেদ করিয়েছিলে তাদের! 

নিরব উপহাস করে হাসল। বলে উঠল,
"মেহু যেদিন ফাহান কে স্বীকার করে নিয়েছিল সেই দিন'ই আমি মেহু থেকে দূরে গিয়েছিলাম। কিন্তু তবুও শান্ত হতে পারছিলাম না। তাই মেহুর থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। চলে গেলাম কানাডায়। ভাবলাম হয়তো মেহু কে ভুলে যাবো। কিন্তু এর মাঝেই জানতে পারলাম তারা দুজন আলাদা হয়ে গেছে। 

"কিন্তু কেন? মেহু তো খুব ভালোবাসতো না ফাহান কে! 

নিরব মুচকি হাসল। শান্ত ভাবে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,

"সব ভালোবাসার যেমন প্রকাশ হয় না তেমনি প্রকাশ করার পর সব ভালোবাসা টিকে না। ভালোবাসা কথাটা এতো সহজ সরল হলেও তা টিকিয়ে রাখা বড্ড কঠিন। অনেক টানাপোড়েন আর তিক্ততা দিয়ে এই ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে হয়। তবে সবাই সেটা পাড়ে না। মেহুর জীবনে ভালোবাসার দরকার ছিল। দরকার ছিল এমন একজনকে যে তাকে আগলে রাখবে সারাজীবন।

বলেই দম নিল নিরব। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
"মেহুর মনে হয়েছিল এই ভালোবাসা হয়তো ফাহান তাকে দেবে। কিন্তু ওই যে বললাম তিক্ততা আর টানপড়োনে সব ভালোবাসা টিকে থাকে না। 

নির্ঝর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"এই টানপোড়েন আর তিক্ততা'র কারণ কি ছিল? 

নিরব কঠিন মুখ চোখ করে বলল,
"অর্ণব! 

নির্ঝর অবাক কন্ঠে বলল,
"অর্ণ! 

নিরব শব্দ করে শ্বাস নিল। নিজের দুটো হাত একত্রে করে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,

"ফাহানের মনে হয়েছিল মেহুর জীবন থেকে তার প্রত্যেকটা প্রিয় মানুষ হারিয়ে যাবার একমাত্র কারণ অর্ণব। সে কোনভাবেই চায় নি অর্ণবের সাথে থাকতে। তাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছিল। সেদিন মেহু আমাকে কল করে সেই বিয়ের কথাই বলছিল। খুব এক্সাইটেড ছিল সে এই বিয়ে নিয়ে! হঠাৎ করেই...

অতীতে,

"কনগ্রেচুলেশন! অবশেষে বিয়ের তারিখ টা ঠিক করেই ফেললি। তবে এতো লেট কেন? 

"আসলে, সেদিন আমার আর ফাহানের প্রথম দেখা হয়েছিল। তাই...

নিরব মেহুর কথায় মুচকি হাসল। মনে মনে এই প্রার্থনা করতে লাগলো,

"যদি এমনটা হতো তোর আর ফাহানের কখনো দেখাই হতো না, তাহলে আজ তুই আমার'ই হতি মেহু! 

ওপাশ থেকে মেহেরিন বলে উঠল,
"কি ব্যাপার কথা বলছিস না যে? 

"হ্যাঁ বল! 

"বলছি দ্রুত দেশে চলে আয়। আমার বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব কিন্তু তুই'ই করবি! 

নিরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"হুম তাই তো..

হঠাৎ করেই অর্ণবের কান্না'র আওয়াজ এলো। মেহেরিন নিরব কে বলে উঠল,

"এই অর্ণব হয়তো কাঁদছে, তুই একটু লাইনে থাক আমি আসছি..

বলেই ফোন টা ঘরে বাইরে বের হলো সে। এদিক নিরব কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে ল্যাবটবের কাজে মনোযোগ দিল। মেহেরিন বাইরে এসে দেখল অর্ণব গাড়ির কাছে নিচে বসে কাঁদছে। সে দ্রুত অর্ণব কে কোলে তুলে নিল। 

"বাবা, কাঁদছো কেন? অর্ণ সোনা কি হয়েছে মাম্মি কে বলো। কেউ কিছু বলেছে তোমায়? 

অর্ণব কাঁদতে কাঁদতে হাত বাড়িয়ে সামনে দেখাল। মেহেরিন এতোক্ষণে সামনে তাকাল। ফাহানের গাড়ি দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল তার। ফাহান গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ফাহানের কানে ব্লুটুথ! গাড়ির চাকার নিচে অর্ণবের খেলনা চুরমার হয়ে গেছে। ফাহান মেহেরিন কে এভাবে দেখে হতচকিয়ে গেল। দু"কান থেকে ব্লুটুথ সরিয়ে বলল,

"মেহেরিন! 

মেহেরিন চোখ সরিয়ে নিল। ফাহান কে কিছু না বলেই ভিতরে চলে গেল। ফাহান পিছনে ফিরে দেখল। গাড়ির চাকা'র নিচে খেলনা। এটা অর্ণবের ছাড়া আর কারো নেই। এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কি না মেহেরিন তার সাথে এমন করল। 

ফাহান রেগে বাড়ির ভেতরে গেল। মেহেরিন এতোক্ষণে অর্ণব কে শান্ত করিয়ে ফেলেছে। তাকে সোফায় বসিয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। ফাহান রেগে এসে মেহেরিন'র সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,

"মেহেরিন! 

তার উচ্চস্বরে অর্ণব কেঁপে উঠলো। মেহেরিন উঠে দাঁড়াল। অর্ণব এসে লুকাল মেহেরিন'র পিছনে। ফাহান বলে উঠল,

"সমস্যা কি তোমার? এমন ব্যবহার কেন করছো তুমি!

"প্রথমে তুমি ধীরে কথা বলো, অর্ণব ভয় পাচ্ছে। 

ফাহান পিছনে ফিরে দেখল অর্ণব মেহেরিন'কে আকড়ে ধরে আছে। তার অসহ্য লাগল। সে মেহেরিন কে বলে উঠলো,

"ঘরে আসো! 

বলেই ঘরের দিকে চলে গেল। মেহেরিন মিস মারিয়া'র কাছে অর্ণব কে রেখে ঘরের দিকে গেল। তার পিছু পিছু অর্ণব ও এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। মিস মারিয়া তার পিছনে দাঁড়িয়ে তাকে ধরে রইল। ফাহান ঘরে এসে পায়চারি করছে। মেহেরিন এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

"এতোটা বোকামি কিভাবে করো তুমি! 

"আমি বোকামি করেছি! 

"তা নয়তো কি? আরেকটু হলেই গাড়ির নিচে তুমি অর্ণব কে.. ( বলেই থেমে গেল মেহেরিন! ) 

"এটা কি আমার দোষ। অর্ণব কি করছিল গাড়ির কাছে। 

"খেলছিল। বাচ্চা মানুষ! খেলতে খেলতে গাড়ির কাছে চলে এসেছিল। কিন্তু তুমি তো বাচ্চা নও। এসব খেয়াল রেখে গাড়ি চালাতে পারলে না। সেদিনও তুমি এমন করেছিলে, শপিং মলে অর্ণব কে রেখে চলেছিল। বেচারা ভয়ে এক কোনে বসে দাঁড়িয়েছিল। একটু দেখেশুনে রাখতে পারলে না তুমি ওকে। 

বলেই ফাহান কে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে এলো মেহেরিন। ফাহান নিশ্চুপ হয়ে রইল। মেহেরিন বলে উঠল,

"ফাহান! অর্ণব একটা বাচ্চা মানুষ। আর বাকি বাচ্চা'র মতো না সে। তুমি কেন ওকে একটু বেশি কেয়ার করতে পারো না বলো। এতোটা কেয়াললেস কিভাবে হয় তুমি!  

ফাহান শব্দ করে শ্বাস ফেলল। বলে উঠল,
"একটা কথা বলো তো মেহেরিন! 

মেহেরিন কিছু বললো না। শুধু বিরক্ত হয়ে দুই হাত বাহুতে গুজল। ফাহান হুট করে এসে মেহেরিন'র দুই বাহু চেপে ধরে তার দিকে ঘুরাল। বলে উঠল,
"আচ্ছা বলোতো, আমাদের সন্তান হলে তখন কাকে তুমি বেশি কেয়ার করবে।‌ অর্ণব কে নাকি তাকে...

মেহেরিন'র কপালে ভাঁজ পড়ল। ফাহানের চোখের দিকেই তাকিয়ে বুঝল সে খুব সিরিয়াস। সে শান্ত গলায় বলল,

"এসব কোন ধরণের কথা ফাহান!

"তুমি উওর দাও।

"অর্ণব আমার সন্তান ফাহান। 

ফাহান বিরক্ত হয়ে গেল। হুট করে ছেড়ে দিল মেহেরিন কে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

"আমি জানতাম, আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে! 

"ফাহান! 

"কি ফাহান‌‌ ফাহান করছো? তুমি বুঝতে পারছো তুমি তোমার পৃথিবী জুড়ে শুধু অর্ণব কে নিয়েই আছো। 

উচ্চস্বরে কথা গুলো বলল ফাহান। তার তার চোখের দিকে তাকাল। নিজেকে শান্ত রেখে ফাহানের দুই গালে হাত রেখে বলল,

"ফাহান শান্ত হও। তুমি তো জানো অর্ণবের আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কে সামলাবে তাকে।

মেহেরিন'র হাত খানা সরিয়ে দিল সে। বলে উঠল,

"আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। এই অর্ণব, অর্ণব আর অর্ণব। মেহেরিন তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাওয়া অবদি অর্ণব। তোমার সব জায়গায় তুমি অর্ণব কে চাও। একবারও ভেবে দেখেছ তোমারও একটা ভবিষ্যত আছে।

"ফাহান আমি বুঝতে পারছি তুমি খুব রেগে আছো। কিন্তু আমার কথা...

"মেহেরিন আমি রেগে নেই। রেগে নেই আমি! যা বলছি সুস্থ আর স্বাভাবিক ভাবেই বলছি। তুমি শুধু এইটা বলো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবছ কখনো। নাকি সারাজীবন ভেবেছ এই অর্ণব নিয়েই কাটিয়ে দেবো।

মেহেরিন হেসে বলল,
"আমার দুই পৃথিবী জুড়ে শুধু তোমরাই আছো ফাহান। আর কে আছে এখানে..

"মেহেরিন, আমার কথা শুনো। ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করো। বলো ভালোবাসো আমাকে।

"খুব! 

"আর কয়েকমাসের মধ্যেই বিয়ে করছি আমরা তাই না বলো। আমি কথা দিচ্ছি খুব খেয়াল রাখবো তোমার। অনেক ভালোবাসবো তোমায়। কিন্তু তুমি..

"আমি..

"তুমি যেকেনো একজন কে বেছে নাও।

"মানে..

ফাহান শ্বাস নিল। অতঃপর ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

"মানে মেহেরিন! তুমি হয়তো আমার সাথে থাকবে নাহলে অর্ণবের সাথে। আমি আর পারছি টলোরেট করতে।‌

মেহেরিন হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে কি বলবে তার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। তবুও শান্ত গলায় বলে উঠল,

"ফাহান! তোমরা কেউ আমার কাছে ওপশন নও।

"কিন্তু তোমাকে করতে হবে মেহেরিন। বেছে নাও হয়তো আমি নাহলে অর্ণব! 

মেহেরিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখের কোনে অশ্রু জমছে। ফাহান জড়িয়ে ধরল তাকে। তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,

"মেহেরিন আমি জানি তুমি অর্ণব কে খুব ভালোবাসো। কিন্তু আমি চাই না অর্ণবের সাথে আমাদের নতুন জীবন শুরু করতে। তুমি বুঝতে পারছো না আমার ভয় হয়। মনে হয় অর্ণব থাকলে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। মেহেরিন তুমি'ই‌ বলো, আমাদের নতুন জীবনে আমি থাকবো তুমি থাকবে। আর কিসের অভাব করবে তুমি। 

মেহেরিন হেসে বলল,

"অভাব করবো না ফাহান! 

ফাহান ছেড়ে দিল মেহেরিন কে। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মেহেরিন শুধু বলে উঠল,

"তখন আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো, সবকিছুই হারিয়ে যাবে। তখন আর কিসের অভাব থাকবে। 

ফাহান শব্দ করে দম ছাড়ল। মাথায় হাত রেখে বলল,
"তোমাকে বোঝাতে পারবো না আমি, আসলে তুমি বুঝতেই চাইছো না। তোমার কি মনে হয় না অর্ণব আসার আগে তোমার জীবনের সবকিছু ঠিক ছিল। সে আশার পর পর'ই সবকিছু তোমার থেকে হারিয়ে গেল তাই নয় কি! 

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকালো। উপহাসের হাসি হেসে বলল,
"ফাহান, ও একটা বাচ্চা। তুমি এমনটা ভাবতে পারো কিভাবে! এতোটা নিম্ন তোমার চিন্তা ধারা। আমি জানি তুমি ওকে পছন্দ করো না তাই বলে এভাবে ওর উপর দোষারোপ দিতে পারো না। 

ফাহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
"আমার চিন্তাধারা নিম্ন! 

"ফাহান..

"মানে তুমি বলতে চাইছো আমার চিন্তা ধারা নিম্ন। অর্ণবের জন্য তুমি আমাকে এই কথা বলছো ( চেঁচিয়ে উঠলো সে ) 

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
"দেখো মেহেরিন তুমি এভাবে আমাকে বলতে পারো না। একটা কথা শুনে রাখো, আমার অর্ণব কে ভালো লাগে না। সহ্য করতে পারি না আমি ওকে। ওর উপস্থিত আমাকে রাগিয়ে তুলে। আর এতো সিমপ্যাথি তুমি দেখাচ্ছ কেন? ও তো তোমার নিজের সন্তান ও নয়। তোমার মৃত বোনের সন্তা....

বলার আগেই ফাহান চুপ হয়ে গেল। সে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল মেহেরিন'র দিকে। তার বা গাল'টা এর মাঝেই লাল হয়ে গেছে। কি হয়েছে তা ভাবতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তার। মেহেরিন ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল। বলে উঠল,

"অর্ণব আমার সন্তান, আমার নিজ সন্তান বুঝলে তুমি! ( চেঁচিয়ে উঠলো ) 

"মেহেরিন তুমি আমাকে..

"আর একটা কথাও না। বের হও! 

"মে..

"আই সে গেট আউট! বের হও। আমি আমার জীবন বেছে নিয়েছি‌। 

ফাহান কঠিন মুখে তাকিয়ে রইল। তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। কিছু না বলেই বের হয়ে গেল সে। মেহেরিন দ্রুত'ই ধপাস করে বসে পড়ল মেঝেতে। হু হু করে কেঁদে উঠলো সে।
ফাহান দরজা দিয়ে বের হতেই অর্ণব কে দেখতে পেলো। রাগি দৃষ্টি'তে তাকাল তার দিকে। অর্ণব দ্রুত'ই লুকিয়ে পড়ল মিস মারিয়া'র আড়ালে। মিস মারিয়াও কেঁপে উঠলো সাথে সাথে। ফাহান হন হন করে হেঁটে চলে গেল। সে যেতেই অর্ণব দৌড়ে আসল মেহেরিন'র কাছে। সামনে দাঁড়াল তার। ঝাপসা ঝাপসা চোখে অর্ণব কে দেখে জড়িয়ে ধরল সে তাকে। অর্ণব তার গালে চুমু খেল। তার চোখের জল মুছিয়ে দিল। বলে উঠল,

"মাম্মি! 

মেহেরিন তাকিয়ে দেখল অর্ণবের চোখেও পানি জমতে শুরু করেছে। সাথে সাথে নিজের কান্না বন্ধ করে দিল সে। হেসে বলে উঠল,

"আহ আমার অর্ণব কাঁদছে কেন? কি হয়েছে! কিছুই হয় নি। চকলেট কেক খাবে অর্ণব। মাম্মি বানিয়ে দিবে নিজ হাতে। 

ততোক্ষণে অর্ণবের চোখ গড়িয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মেহেরিন তা মুছে দিয়ে তার মাথায় চুমু খেল। অর্ণব তার ছোট্ট কোলখানা দখল করে নিল। গুটিসুটি মেরে বসে রইল তাতে! 

--- 

নিরব হালকা কেশে বলে উঠল,
"শুধু তখন ফোনের লাইনে আমি ছিলাম বলেই সবটা জানতে পেরেছি। নাহলে হয়তো কিছুই জানতাম না আর না কখনো মেহু বলতো। এসব বলার মেয়ে সে না। তবুও নিজের জীবনে একজন কেই ভালোবেসে ছিল। এতো তাড়াতাড়ি ভালোবাসা ভুলে যাওয়া কারো পক্ষে'ই সম্ভব না। ওদের বিয়েটা হবার কথা ছিল ২৭ মে। এই দিন'ই প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের। মেহু সেই তারিখ টা চেঞ্জ করে নি। বিয়েটা সেদিন'ই করেছে। তবে ফাহান কে না তোমাকে...

নির্ঝর উঠে দাঁড়াল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ব্যাপার টা এখন পরিষ্কার। এই কারণেই বিয়ের ডেট পিছায় নি নির্ঝর। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়েও যেন শ্বাস নিতে পারছে না সে। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। নিরব এর মাঝেই উঠে দাঁড়াল। নির্ঝর কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

"আমি একবার তাকে হারিয়েছি, এবার আর না। এক বছরের কন্ট্রাক্ট শেষ হলেই মেহু কে নিজের করে নেবো আমি। 

নির্ঝর নিরবের দিকে ফিরল। শীতল গলায় বলে উঠল,

"সেটা সময় বলবে! 

নিরবের ভ্রু কুঁচকে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে হন হন করে বেরিয়ে গেল সে। নির্ঝর বুকে হাত রেখে ধপ করে বসে পড়ল নিচে। হঠাৎ করেই ব্যাথা হচ্ছে হচ্ছে খুব। নির্ঝর চোখ বন্ধ করে বসে রইল। "আহ" বলে চেঁচিয়ে উঠলো। কোথায় খুব একটা কষ্ট হচ্ছে তার। মেহেরিন'র কি তবে এতোটাই কষ্ট পেয়েছিল নাকি আরো বেশি। তার কষ্টটা অনুভব করার শক্তি নেই তার। ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে লাগল নির্ঝর। চোখ দুটো বন্ধ করতেই মেহেরিন'র হাসি মাখা মুখ ভেসে উঠলো তার সামনে! 

#চলবে....
[+] 2 users Like Manjarul Haque's post
Like Reply
#40
#পর্ব_২৯

আজকের দিনটা সুন্দর! সকাল থেকেই আকাশ টা পরিষ্কার। গত দিনের বৃষ্টি থেমেছে আজ ভোরবেলা। এরপর থেকেই আকাশ দেখতে চমৎকার লাগছে। সকালটা কেমন একটা শীত শীত ভাবও আছে। নিরব বিছানা ছেড়ে বের হয়ে এলো। আজকের দিনের অনেক প্ল্যান করে রেখেছে সে। আজ তার ভালোবাসার প্রকাশ করবে সে। যাই হোক না কেন আজ তাকে তা করতেই হবে। এতো দিন তাকে ছাড়া অন্য কোন ছেলে মেহেরিন'র জীবনে ছিল না বলেই এতোটা ভাবতে হয় নি। কিন্তু ওই ফাহান এবার বেশি বেশি করছে। কেন মনে হচ্ছে বার বার এই ফাহান তার থেকে তার মেহু কে কেড়ে নিবে। 

সকাল থেকেই এর প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। প্রপোজ তো করবে বিকেল বেলা আর এখন তো সবে সকাল। কিন্তু সাবধানের মার নেই। শেষ মুহূর্তে এসে যদি ভালোবাসি কথাটা বলতে না পারে তখন কি হবে। ১০৮ বার রিয়াসেল করল। যার মাঝে ১০০ বার'ই কথার মাঝে হোঁচট খেল সে। বাকি ৮ বার তাও যা একটু বলল তবে তার সেটা পছন্দ হলো না। 

শাওয়ার নিয়ে এসে গরম কফি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করল। অতঃপর ভাবতে লাগল দিনটা শুরু কিভাবে করবে। আচ্ছা গোলাপ দিয়ে কি প্রপোজ করবে নাকি জবা! নাকি কোন গিফট বা আংটি। না না এটা বেমানান লাগবে। আংটি তো বিয়ের প্রপোজালে দেয়। সেটাই কি করবে নাকি। 

"আহ আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না, যত'ই ভাবছি ততোই গুলিয়ে ফেলছি।"

হুট করেই বিছানার মাঝে লুকিয়ে পড়ল। ঘুম নেওয়া দরকার। ঘুমালে মাইন্ড ফ্রেস হবে। তখন আর সমস্যা হবে না। এই ভোর দুপুরে সূর্য উঠে গেছে মাথা বরাবর। তখন ঘুমানোর কথা ভাবাও যায় না। কিন্তু নিরব সেখানে ঘুমে মাতাল। তবে ঘুমের মাঝেই স্বপ্ন দেখলো মেহু কে নিয়ে। ঘুম তার ভালো লাগে এই একটাই কারণে। এখানে তার কল্পনার মেহু কে ভালোবাসতে পারে সে। এখানে ভালোবাসি বলতে হোঁচট খেতে হয় না। নির্ধিতায় বলা যায়। 

বিকালে গাড়ি নিয়ে বের হলো নিরব। খান বাড়ির কাছে এসে গাড়ি থামাল নিরব। ফোন বের করে মেহেরিন কে কল করতে যাবে তখনই তার সামনে দিয়ে ফাহান আর মেহেরিন'র গাড়িতে উঠলো। নিরব ফোনটা হাতে রেখে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। 

ফাহান মেহেরিন কে গাড়িতে বসিয়ে নিজে বসল। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিল। নিরব তাদের গাড়ি ফলো করতে লাগলো। সন্ধ্যা অবদি নিরব তাদের ফলো করতে লাগলো। ফাহান সন্ধ্যা অবদি মেহেরিন কে নিয়ে ঘুরল। অতঃপর ফাহান এক জায়গায় গাড়ি থামাল। মেহেরিন গাড়ি থেকে নেমে মুখ খুলে শ্বাস নিয়ে বলল,

"অবশেষে কোথায় থামলে তুমি..

ফাহান মুচকি হেসে মেহেরিন'র হাত নিজের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করল। অতঃপর তাকে নিয়ে হাঁটতে লাগল। মেহেরিন বিনা বাক্যে ফাহানের হাত ধরে হাঁটতে লাগল। মনে হলো কোন একটা গোলক ধাঁধা'র মাঝে তারা ঢুকে পড়েছে। চারপাশের গাছ গাছালিতে লাইটিং করা। মেহেরিন এসব দেখছে আর অবাক হচ্ছে। ফাহান মেহেরিন কে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,

"ভালো লাগল এসব!

মেহেরিন মুচকি হেসে বলে,
"খুব সুন্দর! 

"আসল সারপ্রাইজ এখনো বাকি!
বলেই মেহেরিন'র হাত ধরে দৌড়াতে থাকে সে। মেহেরিনও দৌড়াচ্ছে তার সাথে। এক পর্যায়ে ফাহান হাত ছেড়ে দেয় মেহেরিন। মেহেরিন এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়। মাথার উপরে জুড়ে লাইটিং করা। চারদিকে অন্ধকারের মাঝে এই আলো অভিভূত করল তাকে। মেহেরিন ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ হাসি রেখে এসব দেখতে থাকে। অতঃপর পিছনে ঘুরে ফাহান যেই না ফাহান কে কিছু বলতে যাবে, ওমনি সে থমকে গেল। দেখল ফাহান তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। তার হাতে লাল রঙের একটা তাজা গোলাপ। ফাহান বলে উঠল,

"ভালোবাসি তোমায় মেহেরিন! ভালোবাসবে কি তুমি আমায়? 

মেহেরিন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এদিকে ফাহান খুব নার্ভাস। কি হবে না হবে বুঝে উঠতে পারছে না। ওদিকে নিরব নিশ্চুপ ভাবে দাড়িয়ে আছে। কি হবে এখন, মেহেরিন কি স্বীকার করবে এই ভালোবাসা! দেখার জন্য অস্থির তার মন। 

মেহেরিন মুচকি হাসল। তার গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। সে ফাহানের হাত থেকে ফুল টা নিয়ে ফাহানের গাল দুটো আকড়ে ধরল। অতঃপর তার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলল,

"ভালোবাসি! 

মেহেরিন'র মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনে নিরবের মলিন মুখের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল।‌ ফাহান হেসে উঠে দাঁড়াল।‌‌ মেহেরিন দুটো হাত আঁকড়ে ধরে বলল,

"তুমি জানো না আজ কতোটা খুশি আমি। 

মেহেরিন একগাল হেসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফাহান মেহেরিন'র চোখের দিকে তাকাল।‌ অতঃপর ধীরে তার দুই হাত দ্বারা তার গাল আকড়ে ধরল।‌ চুমু খেল তার ঠোঁটে। মেহেরিন হুট করে কেঁপে উঠলো। তার শরীরের জ্যাকেট আকড়ে ধরল সে।‌ ফাহান কে চুমু খেতে লাগল। 
নিরব কঠিন মুখ করে মুহূর্তে'ই সেখান থেকে চলে এলো। দ্রুত হেঁটে বের হয়ে এলো সে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।‌গাড়ির কাছে এসে গাড়ির দরজা খুলে আর ভেতরে ঢুকতে পারল ন সে। গাড়ির সামনেই ধপাস করে বসে করল। চোখের অশ্রু বাঁধ মানতে চাইছে না।‌ একসময় তা চোখ বেয়ে পড়ে গেল। মেহুর জন্য রাখা গোলাপটা জ্যাকেটে পকেট থেকে বের করল‌ সে। গোলাপের দিকে তাকিয়ে রইল নিশ্চুপ হয়ে। প্রিয় মানুষ কে হারিয়ে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। খুব দেরি করে ফেলেছে । যদি আরো আগেই মেহু কে বলে দিত ভালোবাসার কথা হয়তো আজ এই দিন দেখা লাগতো না তার। 

------

নিরব খুব জোরেই গাড়ি ব্রেক কসল। বুকের মাঝে হাত ধরল। হুট করেই কেন আজ এতো ব্যাথা হচ্ছে। অতীতের কথা খুব মনে পড়ছে আজ তার। সেই দিনের কষ্টের অনুভব আজও হচ্ছে তার। কেন তার জানা নেই, তবে কি আবারও মেহু কে হারাতে চলল সে। 
গাড়ির কাচ নামিয়ে বাইরে তাকাল সে। খান বাড়িতে এসেছে সে।‌ কিন্তু মেহুর জন্য না। মেহু এখন অফিসে। আজ এসেছে নির্ঝরের জন্য। নির্ঝর তাকে ফোন করে আসতে বলেছে। কি জন্য তাকে আসতে বলেছে তার জান নেই। তবুও খুব অস্থির সে। 

মুখ খুলে দম ফেলে গাড়ির থেমে নামল সে। বাড়ির ভিতরে যেতে নিবে অমনি পেছন থেকে নির্ঝর ডাকল। নিরব তার দিকে ফিরতেই নির্ঝর তাকে আসার জন্য ইশারা করল। নিরব তার পিছু পিছু গেল। বাগানের কাছে এসে বসল নির্ঝর। নিরব কে বসতে বলল চেয়ারে। অতঃপর কাপে চা ঢেলে তার সামনে রেখে বলল,

"তোমার টাইমসেন্স খুব ভালো! 

নিরব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে বলল,
"আমাকে ডেকেছ কেন?

"অবশ্যই ডেকেছি আর কোন কারণেই ডেকেছি।

নিরব ভ্র কুঁচকে বলল,
"কি কারণে?

নির্ঝর শব্দ করে শ্বাস ফেলল। নিরব বলে উঠল,
"অর্ণব কোথায়? 

"ঘুমাচ্ছে!

"ওহ আচ্ছা! 

নির্ঝর এবার নিরবের দিকে ঝুঁকল। নিরব ভ্রু কুচকালো। নির্ঝর বলে উঠল,

"মেহু আর ফাহানের বিচ্ছেদের কারণ কি? 

নির্ঝরের কথায় নিরবের উপর কোন প্রভাব পড়ল না। সে স্বাভাবিক ভাবেই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর মুচকি হেসে বলল,

"দেখ নিরব, আমি জানি তোমার আর আমার বনে না। তবে এটা আমার জন্য জানা খুব দরকার। আমি জানো তুমি এটা জানো! 

"আমি কেন তোমাকে বলবো! 

"কেন? তুমি চাইবে না মেহু ভালো থাকুক! 

নিরব মুখ খুলে শ্বাস নিল। নির্ঝর তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। নিরব মুখটা কঠিন করে বলল,
"এই ফাহান কে কখনোই আমার পছন্দ ছিল না। 

"তাহলে কি এই বিচ্ছেদের কারণ তুমি? তুমি বিচ্ছেদ করিয়েছিলে তাদের! 

নিরব উপহাস করে হাসল। বলে উঠল,
"মেহু যেদিন ফাহান কে স্বীকার করে নিয়েছিল সেই দিন'ই আমি মেহু থেকে দূরে গিয়েছিলাম। কিন্তু তবুও শান্ত হতে পারছিলাম না। তাই মেহুর থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম। চলে গেলাম কানাডায়। ভাবলাম হয়তো মেহু কে ভুলে যাবো। কিন্তু এর মাঝেই জানতে পারলাম তারা দুজন আলাদা হয়ে গেছে। 

"কিন্তু কেন? মেহু তো খুব ভালোবাসতো না ফাহান কে! 

নিরব মুচকি হাসল। শান্ত ভাবে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বলল,

"সব ভালোবাসার যেমন প্রকাশ হয় না তেমনি প্রকাশ করার পর সব ভালোবাসা টিকে না। ভালোবাসা কথাটা এতো সহজ সরল হলেও তা টিকিয়ে রাখা বড্ড কঠিন। অনেক টানাপোড়েন আর তিক্ততা দিয়ে এই ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে হয়। তবে সবাই সেটা পাড়ে না। মেহুর জীবনে ভালোবাসার দরকার ছিল। দরকার ছিল এমন একজনকে যে তাকে আগলে রাখবে সারাজীবন।

বলেই দম নিল নিরব। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
"মেহুর মনে হয়েছিল এই ভালোবাসা হয়তো ফাহান তাকে দেবে। কিন্তু ওই যে বললাম তিক্ততা আর টানপড়োনে সব ভালোবাসা টিকে থাকে না। 

নির্ঝর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
"এই টানপোড়েন আর তিক্ততা'র কারণ কি ছিল? 

নিরব কঠিন মুখ চোখ করে বলল,
"অর্ণব! 

নির্ঝর অবাক কন্ঠে বলল,
"অর্ণ! 

নিরব শব্দ করে শ্বাস নিল। নিজের দুটো হাত একত্রে করে নিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,

"ফাহানের মনে হয়েছিল মেহুর জীবন থেকে তার প্রত্যেকটা প্রিয় মানুষ হারিয়ে যাবার একমাত্র কারণ অর্ণব। সে কোনভাবেই চায় নি অর্ণবের সাথে থাকতে। তাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছিল। সেদিন মেহু আমাকে কল করে সেই বিয়ের কথাই বলছিল। খুব এক্সাইটেড ছিল সে এই বিয়ে নিয়ে! হঠাৎ করেই...

অতীতে,

"কনগ্রেচুলেশন! অবশেষে বিয়ের তারিখ টা ঠিক করেই ফেললি। তবে এতো লেট কেন? 

"আসলে, সেদিন আমার আর ফাহানের প্রথম দেখা হয়েছিল। তাই...

নিরব মেহুর কথায় মুচকি হাসল। মনে মনে এই প্রার্থনা করতে লাগলো,

"যদি এমনটা হতো তোর আর ফাহানের কখনো দেখাই হতো না, তাহলে আজ তুই আমার'ই হতি মেহু! 

ওপাশ থেকে মেহেরিন বলে উঠল,
"কি ব্যাপার কথা বলছিস না যে? 

"হ্যাঁ বল! 

"বলছি দ্রুত দেশে চলে আয়। আমার বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব কিন্তু তুই'ই করবি! 

নিরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
"হুম তাই তো..

হঠাৎ করেই অর্ণবের কান্না'র আওয়াজ এলো। মেহেরিন নিরব কে বলে উঠল,

"এই অর্ণব হয়তো কাঁদছে, তুই একটু লাইনে থাক আমি আসছি..

বলেই ফোন টা ঘরে বাইরে বের হলো সে। এদিক নিরব কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে ল্যাবটবের কাজে মনোযোগ দিল। মেহেরিন বাইরে এসে দেখল অর্ণব গাড়ির কাছে নিচে বসে কাঁদছে। সে দ্রুত অর্ণব কে কোলে তুলে নিল। 

"বাবা, কাঁদছো কেন? অর্ণ সোনা কি হয়েছে মাম্মি কে বলো। কেউ কিছু বলেছে তোমায়? 

অর্ণব কাঁদতে কাঁদতে হাত বাড়িয়ে সামনে দেখাল। মেহেরিন এতোক্ষণে সামনে তাকাল। ফাহানের গাড়ি দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল তার। ফাহান গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। ফাহানের কানে ব্লুটুথ! গাড়ির চাকার নিচে অর্ণবের খেলনা চুরমার হয়ে গেছে। ফাহান মেহেরিন কে এভাবে দেখে হতচকিয়ে গেল। দু"কান থেকে ব্লুটুথ সরিয়ে বলল,

"মেহেরিন! 

মেহেরিন চোখ সরিয়ে নিল। ফাহান কে কিছু না বলেই ভিতরে চলে গেল। ফাহান পিছনে ফিরে দেখল। গাড়ির চাকা'র নিচে খেলনা। এটা অর্ণবের ছাড়া আর কারো নেই। এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে কি না মেহেরিন তার সাথে এমন করল। 

ফাহান রেগে বাড়ির ভেতরে গেল। মেহেরিন এতোক্ষণে অর্ণব কে শান্ত করিয়ে ফেলেছে। তাকে সোফায় বসিয়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলো। ফাহান রেগে এসে মেহেরিন'র সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,

"মেহেরিন! 

তার উচ্চস্বরে অর্ণব কেঁপে উঠলো। মেহেরিন উঠে দাঁড়াল। অর্ণব এসে লুকাল মেহেরিন'র পিছনে। ফাহান বলে উঠল,

"সমস্যা কি তোমার? এমন ব্যবহার কেন করছো তুমি!

"প্রথমে তুমি ধীরে কথা বলো, অর্ণব ভয় পাচ্ছে। 

ফাহান পিছনে ফিরে দেখল অর্ণব মেহেরিন'কে আকড়ে ধরে আছে। তার অসহ্য লাগল। সে মেহেরিন কে বলে উঠলো,

"ঘরে আসো! 

বলেই ঘরের দিকে চলে গেল। মেহেরিন মিস মারিয়া'র কাছে অর্ণব কে রেখে ঘরের দিকে গেল। তার পিছু পিছু অর্ণব ও এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। মিস মারিয়া তার পিছনে দাঁড়িয়ে তাকে ধরে রইল। ফাহান ঘরে এসে পায়চারি করছে। মেহেরিন এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

"এতোটা বোকামি কিভাবে করো তুমি! 

"আমি বোকামি করেছি! 

"তা নয়তো কি? আরেকটু হলেই গাড়ির নিচে তুমি অর্ণব কে.. ( বলেই থেমে গেল মেহেরিন! ) 

"এটা কি আমার দোষ। অর্ণব কি করছিল গাড়ির কাছে। 

"খেলছিল। বাচ্চা মানুষ! খেলতে খেলতে গাড়ির কাছে চলে এসেছিল। কিন্তু তুমি তো বাচ্চা নও। এসব খেয়াল রেখে গাড়ি চালাতে পারলে না। সেদিনও তুমি এমন করেছিলে, শপিং মলে অর্ণব কে রেখে চলেছিল। বেচারা ভয়ে এক কোনে বসে দাঁড়িয়েছিল। একটু দেখেশুনে রাখতে পারলে না তুমি ওকে। 

বলেই ফাহান কে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে এলো মেহেরিন। ফাহান নিশ্চুপ হয়ে রইল। মেহেরিন বলে উঠল,

"ফাহান! অর্ণব একটা বাচ্চা মানুষ। আর বাকি বাচ্চা'র মতো না সে। তুমি কেন ওকে একটু বেশি কেয়ার করতে পারো না বলো। এতোটা কেয়াললেস কিভাবে হয় তুমি!  

ফাহান শব্দ করে শ্বাস ফেলল। বলে উঠল,
"একটা কথা বলো তো মেহেরিন! 

মেহেরিন কিছু বললো না। শুধু বিরক্ত হয়ে দুই হাত বাহুতে গুজল। ফাহান হুট করে এসে মেহেরিন'র দুই বাহু চেপে ধরে তার দিকে ঘুরাল। বলে উঠল,
"আচ্ছা বলোতো, আমাদের সন্তান হলে তখন কাকে তুমি বেশি কেয়ার করবে।‌ অর্ণব কে নাকি তাকে...

মেহেরিন'র কপালে ভাঁজ পড়ল। ফাহানের চোখের দিকেই তাকিয়ে বুঝল সে খুব সিরিয়াস। সে শান্ত গলায় বলল,

"এসব কোন ধরণের কথা ফাহান!

"তুমি উওর দাও।

"অর্ণব আমার সন্তান ফাহান। 

ফাহান বিরক্ত হয়ে গেল। হুট করে ছেড়ে দিল মেহেরিন কে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

"আমি জানতাম, আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে! 

"ফাহান! 

"কি ফাহান‌‌ ফাহান করছো? তুমি বুঝতে পারছো তুমি তোমার পৃথিবী জুড়ে শুধু অর্ণব কে নিয়েই আছো। 

উচ্চস্বরে কথা গুলো বলল ফাহান। তার তার চোখের দিকে তাকাল। নিজেকে শান্ত রেখে ফাহানের দুই গালে হাত রেখে বলল,

"ফাহান শান্ত হও। তুমি তো জানো অর্ণবের আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কে সামলাবে তাকে।

মেহেরিন'র হাত খানা সরিয়ে দিল সে। বলে উঠল,

"আমি জানতাম তুমি এটাই বলবে। এই অর্ণব, অর্ণব আর অর্ণব। মেহেরিন তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাওয়া অবদি অর্ণব। তোমার সব জায়গায় তুমি অর্ণব কে চাও। একবারও ভেবে দেখেছ তোমারও একটা ভবিষ্যত আছে।

"ফাহান আমি বুঝতে পারছি তুমি খুব রেগে আছো। কিন্তু আমার কথা...

"মেহেরিন আমি রেগে নেই। রেগে নেই আমি! যা বলছি সুস্থ আর স্বাভাবিক ভাবেই বলছি। তুমি শুধু এইটা বলো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবছ কখনো। নাকি সারাজীবন ভেবেছ এই অর্ণব নিয়েই কাটিয়ে দেবো।

মেহেরিন হেসে বলল,
"আমার দুই পৃথিবী জুড়ে শুধু তোমরাই আছো ফাহান। আর কে আছে এখানে..

"মেহেরিন, আমার কথা শুনো। ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করো। বলো ভালোবাসো আমাকে।

"খুব! 

"আর কয়েকমাসের মধ্যেই বিয়ে করছি আমরা তাই না বলো। আমি কথা দিচ্ছি খুব খেয়াল রাখবো তোমার। অনেক ভালোবাসবো তোমায়। কিন্তু তুমি..

"আমি..

"তুমি যেকেনো একজন কে বেছে নাও।

"মানে..

ফাহান শ্বাস নিল। অতঃপর ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,

"মানে মেহেরিন! তুমি হয়তো আমার সাথে থাকবে নাহলে অর্ণবের সাথে। আমি আর পারছি টলোরেট করতে।‌

মেহেরিন হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সে কি বলবে তার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। তবুও শান্ত গলায় বলে উঠল,

"ফাহান! তোমরা কেউ আমার কাছে ওপশন নও।

"কিন্তু তোমাকে করতে হবে মেহেরিন। বেছে নাও হয়তো আমি নাহলে অর্ণব! 

মেহেরিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চোখের কোনে অশ্রু জমছে। ফাহান জড়িয়ে ধরল তাকে। তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,

"মেহেরিন আমি জানি তুমি অর্ণব কে খুব ভালোবাসো। কিন্তু আমি চাই না অর্ণবের সাথে আমাদের নতুন জীবন শুরু করতে। তুমি বুঝতে পারছো না আমার ভয় হয়। মনে হয় অর্ণব থাকলে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। মেহেরিন তুমি'ই‌ বলো, আমাদের নতুন জীবনে আমি থাকবো তুমি থাকবে। আর কিসের অভাব করবে তুমি। 

মেহেরিন হেসে বলল,

"অভাব করবো না ফাহান! 

ফাহান ছেড়ে দিল মেহেরিন কে। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মেহেরিন শুধু বলে উঠল,

"তখন আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো, সবকিছুই হারিয়ে যাবে। তখন আর কিসের অভাব থাকবে। 

ফাহান শব্দ করে দম ছাড়ল। মাথায় হাত রেখে বলল,
"তোমাকে বোঝাতে পারবো না আমি, আসলে তুমি বুঝতেই চাইছো না। তোমার কি মনে হয় না অর্ণব আসার আগে তোমার জীবনের সবকিছু ঠিক ছিল। সে আশার পর পর'ই সবকিছু তোমার থেকে হারিয়ে গেল তাই নয় কি! 

মেহেরিন ভ্রু কুঁচকালো। উপহাসের হাসি হেসে বলল,
"ফাহান, ও একটা বাচ্চা। তুমি এমনটা ভাবতে পারো কিভাবে! এতোটা নিম্ন তোমার চিন্তা ধারা। আমি জানি তুমি ওকে পছন্দ করো না তাই বলে এভাবে ওর উপর দোষারোপ দিতে পারো না। 

ফাহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
"আমার চিন্তাধারা নিম্ন! 

"ফাহান..

"মানে তুমি বলতে চাইছো আমার চিন্তা ধারা নিম্ন। অর্ণবের জন্য তুমি আমাকে এই কথা বলছো ( চেঁচিয়ে উঠলো সে ) 

দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
"দেখো মেহেরিন তুমি এভাবে আমাকে বলতে পারো না। একটা কথা শুনে রাখো, আমার অর্ণব কে ভালো লাগে না। সহ্য করতে পারি না আমি ওকে। ওর উপস্থিত আমাকে রাগিয়ে তুলে। আর এতো সিমপ্যাথি তুমি দেখাচ্ছ কেন? ও তো তোমার নিজের সন্তান ও নয়। তোমার মৃত বোনের সন্তা....

বলার আগেই ফাহান চুপ হয়ে গেল। সে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইল মেহেরিন'র দিকে। তার বা গাল'টা এর মাঝেই লাল হয়ে গেছে। কি হয়েছে তা ভাবতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তার। মেহেরিন ঘন ঘন শ্বাস নিতে লাগল। বলে উঠল,

"অর্ণব আমার সন্তান, আমার নিজ সন্তান বুঝলে তুমি! ( চেঁচিয়ে উঠলো ) 

"মেহেরিন তুমি আমাকে..

"আর একটা কথাও না। বের হও! 

"মে..

"আই সে গেট আউট! বের হও। আমি আমার জীবন বেছে নিয়েছি‌। 

ফাহান কঠিন মুখে তাকিয়ে রইল। তার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। কিছু না বলেই বের হয়ে গেল সে। মেহেরিন দ্রুত'ই ধপাস করে বসে পড়ল মেঝেতে। হু হু করে কেঁদে উঠলো সে।
ফাহান দরজা দিয়ে বের হতেই অর্ণব কে দেখতে পেলো। রাগি দৃষ্টি'তে তাকাল তার দিকে। অর্ণব দ্রুত'ই লুকিয়ে পড়ল মিস মারিয়া'র আড়ালে। মিস মারিয়াও কেঁপে উঠলো সাথে সাথে। ফাহান হন হন করে হেঁটে চলে গেল। সে যেতেই অর্ণব দৌড়ে আসল মেহেরিন'র কাছে। সামনে দাঁড়াল তার। ঝাপসা ঝাপসা চোখে অর্ণব কে দেখে জড়িয়ে ধরল সে তাকে। অর্ণব তার গালে চুমু খেল। তার চোখের জল মুছিয়ে দিল। বলে উঠল,

"মাম্মি! 

মেহেরিন তাকিয়ে দেখল অর্ণবের চোখেও পানি জমতে শুরু করেছে। সাথে সাথে নিজের কান্না বন্ধ করে দিল সে। হেসে বলে উঠল,

"আহ আমার অর্ণব কাঁদছে কেন? কি হয়েছে! কিছুই হয় নি। চকলেট কেক খাবে অর্ণব। মাম্মি বানিয়ে দিবে নিজ হাতে। 

ততোক্ষণে অর্ণবের চোখ গড়িয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মেহেরিন তা মুছে দিয়ে তার মাথায় চুমু খেল। অর্ণব তার ছোট্ট কোলখানা দখল করে নিল। গুটিসুটি মেরে বসে রইল তাতে! 

--- 

নিরব হালকা কেশে বলে উঠল,
"শুধু তখন ফোনের লাইনে আমি ছিলাম বলেই সবটা জানতে পেরেছি। নাহলে হয়তো কিছুই জানতাম না আর না কখনো মেহু বলতো। এসব বলার মেয়ে সে না। তবুও নিজের জীবনে একজন কেই ভালোবেসে ছিল। এতো তাড়াতাড়ি ভালোবাসা ভুলে যাওয়া কারো পক্ষে'ই সম্ভব না। ওদের বিয়েটা হবার কথা ছিল ২৭ মে। এই দিন'ই প্রথম দেখা হয়েছিল তাদের। মেহু সেই তারিখ টা চেঞ্জ করে নি। বিয়েটা সেদিন'ই করেছে। তবে ফাহান কে না তোমাকে...

নির্ঝর উঠে দাঁড়াল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ব্যাপার টা এখন পরিষ্কার। এই কারণেই বিয়ের ডেট পিছায় নি নির্ঝর। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়েও যেন শ্বাস নিতে পারছে না সে। মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। নিরব এর মাঝেই উঠে দাঁড়াল। নির্ঝর কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

"আমি একবার তাকে হারিয়েছি, এবার আর না। এক বছরের কন্ট্রাক্ট শেষ হলেই মেহু কে নিজের করে নেবো আমি। 

নির্ঝর নিরবের দিকে ফিরল। শীতল গলায় বলে উঠল,

"সেটা সময় বলবে! 

নিরবের ভ্রু কুঁচকে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে হন হন করে বেরিয়ে গেল সে। নির্ঝর বুকে হাত রেখে ধপ করে বসে পড়ল নিচে। হঠাৎ করেই ব্যাথা হচ্ছে হচ্ছে খুব। নির্ঝর চোখ বন্ধ করে বসে রইল। "আহ" বলে চেঁচিয়ে উঠলো। কোথায় খুব একটা কষ্ট হচ্ছে তার। মেহেরিন'র কি তবে এতোটাই কষ্ট পেয়েছিল নাকি আরো বেশি। তার কষ্টটা অনুভব করার শক্তি নেই তার। ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে লাগল নির্ঝর। চোখ দুটো বন্ধ করতেই মেহেরিন'র হাসি মাখা মুখ ভেসে উঠলো তার সামনে! 

#চলবে....
[+] 1 user Likes Manjarul Haque's post
Like Reply




Users browsing this thread: 1 Guest(s)