৪র্থ পর্ব
আদিত্য ভিতরে পা দিতেই উমাদেবী ছেলের উপর হামলে পড়লেন, "কোথায় গিয়েছিলি তুই, রাতে এত বারণ করলাম কথা শোনার প্রয়োজন মনে করিস না"
"মা, আমার কথা শোনো"।
"আগে বল কোথায় গিয়েছিলি আর কেন গিয়েছিলি?"
"আমি একটু বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম সকালের ফ্রেশ হাওয়া খেতে"
"ফ্রেশ হাওয়া খাওয়ার জন্য বাড়িতে অত বড়ো ছাদ রয়েছে, সত্যি বল কোথায় গিয়েছিলি?"
"মা...মা....মা, আগে শান্ত হয়ে বসো নাহলে শরীর খারাপ করবে তোমার"
"করুক মায়ের কথা একটু ভাবিস তুই?"
"তোমার কথাই তো ভাবি, তুমি প্রীতি আর বাবা এছাড়া আর কার কথা ভাববো?"
"তাহলে একা একা কোথায় গিয়েছিলি? রাতে অত বড়ো ফাঁড়া গেল এখনো ঠিক মতো হাঁটতে পারছিস না আর যেই আমি একটু চোখ বুজেছি অমনি'
"একা কোথায়? বাদশা ছিল তো"
এই মূহুর্তে বাদশাও মনিবের সমর্থনে একবার ডেকে উঠলো, সঙ্গে সঙ্গে উমাদেবী আরো রেগে গেলেন "তোর আর ওই হতচ্ছাড়া কুকুর দুটোরই কান টেনে ছিঁড়ে নিতে ইচ্ছা করছে"
"মা..মা ঘর ভর্তি গেস্ট,প্রীতির বন্ধুরা আছে তাদের সামনে.." আদিত্য মাকে ঠাণ্ডা করতে চেষ্টা করে। উমাদেবী কিন্তু শান্ত হননা উল্টে সমানে ছেলেকে ধমকাতে থাকেন "যতদিন না পুরো সুস্থ হচ্ছো ততদিন একা একা তোমার বাইরে যাওয়া বন্ধ"।
"মা, তুমি.."
"ব্যাস,আমি আমার কথা জানিয়ে দিয়েছি এবার তুমি কি করবে সেটা তোমার ইচ্ছা মায়ের কথা শুনবে কি শুনবে না"
"মা, কত কাজ রয়েছে আমি না গেলে.."
"কটা দিন তোমার বাবা ঠিক সামলে নেবে আর যদি না পারেন তাহলে কিছু ক্ষতি হবে কিন্তু তোমার কোনো ক্ষতি আমি সহ্য করতে পারবো না"
"মা শোনো"
"তারমানে তুই আমার কথা শুনবি না তাই তো?"
"মা.."
"ঠিক আছে শুনতে হবে না আমিও এবার থেকে তোর কোনো কথা শুনবো না"
"ঠিক আছে, যতদিন না তুমি পার্মিশন দিচ্ছো আমি বেরোবো না"
"ঠিক তো?"
"ঠিক, এবার খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও আমি জানি তুমি সকালে কিছু খাওনি"।
"তুই কিভাবে জানলি দাদা?"
প্রীতি অবাক হয় কিন্তু আদিত্য উত্তর দেবার আগেই উমাদেবী উত্তরটা দেন,
"আমার ছেলে আমার সম্পর্কে সবকিছু জানে" কথাটা বলে ছেলেকে কাছে টেনে কপালে একটা স্নেহচুম্বন দেন, প্রীতি এবং ওর বন্ধুরা অবাক হয়ে আদিত্যকে দেখতে থাকে ওরা অবাক হয় এটা ভেবে যে এই লোকটা বাড়ির বাইরে একরকম আর ভিতরে একরকম, বাড়ির বাইরে পুরো নর্থবেঙ্গল ভয় পায়, অথচ বাড়ির ভিতরে মায়ের বাধ্য ছেলে, সবাই অবাক হয়ে মা-ছেলেকে দেখতে থাকে কিন্তু কেউ লক্ষ্য করলো না যে সবার মাঝে একজন যুবতীর চোখে অবাক ভাব নেই তার বদলে যেটা আছে সেটাকে অনুরাগ ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না।
আদিত্য যথারীতি ঘরবন্দী এদিকে প্রীতি এলাকার সরকারি হাসপাতালে জয়েন করেছে একদিন ওকে হাসপাতালে ড্রপ করার বাহানায় বেরোনোর পার্মিশন চাইতে গিয়ে আবার মায়ের ধমক খেয়েছে। কিন্তু আদিত্য মাকে কিভাবে বোঝাবে যে সে ঘরে বসে থাকলে হবে না প্রতাপ সরকার যে সোজা লোক নয়, আদিত্য তার বাড়িতে ঢুকে তাকে থ্রেট করে এসেছে এটা যে প্রতাপ সরকার সহজে মেনে নেবে না এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না কিন্তু মা তাকে বেরোতে দেবে না উপায় না দেখে বাদশাকে পাঠিয়েছে অতীন্দ্র বাবুর সাথে আর প্রীতির উপর সর্বক্ষণ নজর রাখার জন্য লোক রাখা হয়েছে লোক অতীন্দ্র বাবুর উপরেও নজর রাখছে কিন্তু তবুও নিশ্চিন্ত হতে পারে না আদিত্য সিংহ রায় একা ঘরের মধ্যে ছটফট করতে থাকে আর ক্ষণে ক্ষণে খবর নিতে থাকে, তার সবচেয়ে চিন্তার কারণ প্রতাপ সরকারের একেবারে শান্ত হয়ে যাওয়া আদিত্য ভালো করেই জানে যে যতই সে প্রতাপ বাবুকে হুমকি দিয়ে আসুক প্রতাপ বাবু সহজে ভয় পাওয়ার লোক নন তাই তার এই শান্তভাবটাকে ঝড়ের পূর্বের শান্তভাব বলে মনে হচ্ছে।
মন জিনিসটা সত্যিই অদ্ভুত সবসময় নিজের খেয়ালে চলে চোখে দেখা যায় না ছোঁয়া যায় না কিন্তু কি চাইছে আর কি চাইছে না সেটা অনুভব করা যায়, মন ভালো থাকলে আনন্দ অনুভব করা যায় কষ্ট পেলে ব্যাথা অনুভব করা যায়, সবাই যেটাকে মন বলে শরীরবিজ্ঞানের ভাষায় সেটা আসলে হৃৎপিণ্ড যার কাজ পুরো শরীরে রক্ত চলাচল ঠিক রাখা, সে তার কাজ বন্ধ করলে জীবনের প্রবাহ থেমে যায়, আবার প্রেমের ভাষায় সেটাকেই মন বলে বড়ো অদ্ভুত তার স্বভাব কখন কাকে তার ভালো লাগে আবার কখন ভালো লাগে না বোঝা দায়, কখন কাকে নিজের ভিতরে আশ্রয় দেয় বোঝা যায় না কিন্তু যখন বোঝা যায় তখন তাকে বার করা শক্ত হয়ে ওঠে। খানিকক্ষণ আগেই যে অপরিচিত ছিল এখন শুধু তার কথাই মনে পড়ে প্রথম আলাপে যাকে খারাপ মনে হয়েছিল যার উপর রাগ হয়েছিল এখন শুধু তার কথাই মনে পড়ে চাইলেও ভুলে থাকা যায় না।
এই যেমন পিয়ালী সরকারের হয়েছে, কদিন আগেও সে আদিত্য সিংহ রায় বলে কাউকে চিনতো না অনেক ছোটো বেলাতেই প্রতাপবাবু তাকে এবং তার দাদাকে ব্যাঙ্গালোরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন পড়াশোনা করার জন্য সম্প্রতি ফিরেছে এখনো এখানে কারো সাথে ঠিক আলাপ হয়নি তাছাড়া তার বাপি তাকে বাড়ির বাইরে খুব একটা বেরোতে দেন না কাজেই আদিত্য সিংহ রায় বলে কাউকে না চেনাটাই স্বাভাবিক কিন্তু সেদিন একেবারে সম্মুখ পরিচয় হলো প্রথমে একটা অচেনা ছেলেকে নিজের বাপির চেয়ারে বসে থাকতে দেখে প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল তরপর ছেলেটা তাকে পাত্তাই দিচ্ছিল না তার কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছিল না এটাই যেন আরও রাগিয়ে দিয়েছিল পিয়ালীকে।
হস্টেলে থেকে কো-এড কলেজে কলেজে পড়াশোনা করেছে সে ছোটো থেকেই বন্ধুদের গ্ৰুপে একাধিক ছেলে ছিল সবাই তাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করতো তার কাছে আসার চেষ্টা করতো এমনকি কখনো কখনো তো কলেজের ইয়াং প্রফেসররা পর্যন্ত দু একটা কমপ্লিমেন্ট দিয়ে খুশী রাখার চেষ্টা করতো ব্যাপারটা উপভোগ করলেও সে নিজে কাউকে পাত্তা দেয়নি, নিজের রূপ নিয়ে একটা চাপা অহংকার ছিল মনে একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সে যে কোনো ছেলেরই মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে।
কিন্তু এই প্রথম কেউ তার সেই অহংকারের দেওয়ালে আঘাত করে ফাটল ধরিয়েছে এবং সেটা অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই, কলেজ কলেজের প্রায় সব ছেলেই যার পিছনে পড়ে থাকতো সেই পিয়ালী সরকারকেই একজন পাত্তা দিল না এমনকি তার দিকে তাকালোই না এই প্রথম কোনো ছেলে তার ইগোতে আঘাত করলো।
বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে ঘটনার কিন্তু এখনো ভুলতে পারছে না পিয়ালী সবসময় তার মাথায়, চোখের সামনে একটা চেহারাই ভাসছে কিন্তু কেন? আদিত্য তার বাবাকে একপ্রকার থ্রেট করে গেছে বাবার শত্রু সে, তার দাদাকে কিডন্যাপ করেছিল তবে, তবে কেন এই মনোভাব? পরক্ষণেই মনে পড়লো তার দাদাই ফিরে এসে বলছিল যে যারা ওকে ধরে নিয়ে গেছে তারা কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি উল্টে ওর সাথে খোশগল্প করছিল চা-বিস্কুট খাইয়ে আড্ডা দিচ্ছিল যদিও ওদের মুখ ঢাকা থাকায় কাউকেই চিনতে পারেনি শত্রু কি কখনো এসব করে?
আদিত্যর উপর রাগ হচ্ছিল সেদিন কিন্তু যাওয়ার আগে যখন সাবধান করে দিল পিয়ালীকে ওর উপর অন্যদের কুদৃষ্টি নিয়ে তখন যেন সেই রাগটা আর থাকলো না, আদিত্য যখন যাওয়ার আগে তার দিকে ফিরে চাইলো তখন ওর গম্ভীর রাগী মুখ আর রাগী চোখদুটো যেন দোলা দিয়ে গেল পিয়ালীকে, এইপ্রথম কোনো ছেলে তার প্রতি নয় সে নিজে কোনো ছেলের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, "আদিত্য সিংহ রায়" নামটা অজান্তেই উচ্চারিত হলো পিয়ালীর মুখে পরক্ষণেই ঠোঁটের কোনে একটু হাসি ফুটে উঠলো নিজের রুমে একাই ছিল সে এবার সজ্ঞানেই উচ্চারণ করলো "আদিত্য সিংহ রায় এণ্ড পিয়ালী সরকার না পিয়ালী সিংহ রায়"।
নিজে নিজেই আবার হেসে ওঠে পিয়ালী একটু যেন লজ্জাও পায় নিজেকেই বলে "ইসস কিসব ভাবছে", কিন্তু নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না অনেক চেষ্টা করেও আদিত্যকে ভুলতে পারে না যদিও সে জানে সে যা ভাবছে সেটা সম্ভব নয় কারণ তার বাবা আর আদিত্য যে একে অপরের শত্রু এটা বুঝতে তার আর বাকি নেই তার বাবা কোনোদিন মেনে নেবে না, আদিত্যই কি মেনে নেবে? বোধহয় না বা কে জানে হয়তো তার জীবনে অন্য কেউ আছে, এই তো সকালেই তাদের বাড়ির কাজের মাসি বলছিল যে পুরো নর্থবেঙ্গলে অনেক মেয়েই আদিত্য সিংহ রায় বলতে অজ্ঞান, সে যখন নিজেদের চাবাগানগুলোতে পরিদর্শন করতে যায় বা আশেপাশের গ্ৰামগুলোতে যায় তখন সেখানকার মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যায়, কিন্তু আদিত্য নাকি ওদের কাউকেই পাত্তা দেয় না কাউকেই নিজের কাছে ঘেঁষতে দেয় না, শুনে যে খুব উৎসাহিত হয়েছিল পিয়ালী তা নয় কারণ হতে পারে ওর জীবনে কেউ আছে তাই অন্য মেয়েদের নিজের কাছে ঘেঁষতে দেয় না কিন্তু সে কি করবে? কিছুতেই আদিত্যকে ভুলতে পারছে না।
"আবার কিসের পূজো?"
কথাটা বলেই ধমকের অপেক্ষায় চুপ করে গেল আদিত্য সে জানে মাকে পূজো নিয়ে কিছু বলতে গেলেই ধমক খাবে তবুও ব্রেকফাস্ট টেবিলে যখন মাকে কিছুই খেতে দেখলো না তখন কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় যখন উমাদেবী বললেন "আজ কোথাও বেরোবি না সবাই আসবে পূজো আছে" তখন কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কিন্তু উমাদেবী ধমক দিলেন না শান্ত কণ্ঠে বললেন "তুমি যাতে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাও তাই মানত করেছিলাম"।
আর কিছু বলে না আদিত্য সেই রাতে হামলার পর একপ্রকার বাড়িতে বন্দী হয়েই ছিল কিন্তু এখন বিগত দু-তিনদিন থেকে বাইরে যাবার অনুমতি মিলেছে কিন্তু সেটাও বেশীক্ষণের জন্য নয়, এই পূজোটুজো একদম পছন্দ নয় আদিত্যর মাকে বলেওছে অনেকবার কিন্তু আজ ঘাঁটাতে সাহস হয় না কি জানি আবার যদি বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেন, আদিত্য মনে মনে হাসে সে এখন যথেষ্ট বড়ো হয়েছে অ্যাডাল্ট কিন্তু তাও তাকে একদম ছোট শিশু মনে করেন উমাদেবী বা হয়তো মায়ের কাছে সন্তানরা চিরকাল ছোটোই থাকে তাইতো ওই একজনের কাছেই সে ঠান্ডা হয়ে যায় পুরো নর্থবেঙ্গল তাকে ভয় পায়, তার মুখের উপর কথা বলার সাহস কারো নেই অথচ সে নিজে মায়ের সামনে একদম অন্য মানুষ হয়ে যায় একদম মায়ের বাধ্য ছেলে।
"আর কে আসবে?" জিজ্ঞেস করে আদিত্য,
"তোর বাবার বন্ধু সুবিমল আঙ্কেল আর চারুলতা আন্টি আসছেন আর অদ্রিজাও, ওরা সবাই সঙ্গে যাবেন"
"সঙ্গে যাবেন কোথায়?"
"নীলকণ্ঠ বাবার মন্দিরে ওখানেই পূজো,যা একখানা গুণধর ছেলে একবার পূজো দেওয়ার সাথে পরের বারের মানত করে আসতে হয় অ্যাডভান্স যাতে বিপদাপদ থেকে দূরে রাখেন"
"মা.."
"একদম চুপ কোনো কথা বলবি না"
আদিত্য চুপ করে যায়, খানিকক্ষণ পরেই সুবিমল বাবু পরিবারসহ চলে আসেন।