16-11-2022, 12:23 PM
(This post was last modified: 16-11-2022, 12:24 PM by Fardin ahamed. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
ডঃ জে. সি. মারদ্রুস
↓
→সহস্ৰ এক আরব্য রজনী
অসংক্ষেপিত পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ
প্রথম খণ্ড
↓
ভাষান্তর : ক্ষিতীশ সরকার
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : সত্য চক্রবর্তী
↓
ভূমিকা
‘সহস্র এক আরব্য রজনী' বিশ্বের এক শ্রেষ্ঠ সাহিত্য
সম্পদ। পৃথিবীর প্রায় সব প্রধান ভাষাতেই এর অনুবাদ
প্রকাশিত হয়ে রস পিপাসু পাঠকের সমাদর লাভ
করে আসছে। কালে আর জলে ধুয়ে এ-গ্রন্থ আজও
চির অম্লান। শাশ্বত সাহিত্যের এই-ই সবচেয়ে বড়
প্রমাণ। অদ্যাবধি অগণিত প্রকাশক ‘আরব্য রজনী’র
কিছু কিছু অংশ অতি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করে
আসছেন। কিন্তু সেগুলি সবই ছোটদের জন্য লেখা
কিছু কিছু গল্পাংশ মাত্র। সে-সব ‘গপ্প’ পড়ে ‘সহস্র এক
আরব্য রজনী’র অপার সাহিত্য-সৌন্দর্য অনুমান করা
সম্ভব নয়। আরবী ভাষায় রচিত মূল গ্রন্থ ‘আলিফ
লায়লা’ কিন্তু আদৌ ছোটদের জন্য রচিত নয়।
সারা পৃথিবীতে এ-গ্রন্থ যত ভাষায় অনূদিত
হয়েছে তার মধ্যে ড: জে. সি. মারদ্রস-এর অনুবাদই
শ্রেষ্ঠ। স্পেক্টেটর পত্রিকার মতে The Nursury
version of the 'Arabian Nights' serve their pur-
pose, but very pale shades of their originals;
prudery Prevented Lane's version for adults
form being substantially better, and Burton's
was still far from being a complete success.
Dr. Mardrus's translation into French was the
first European rendering which faithfully re-
flected its original.
ভাষান্তর করার জন্য আমি ড: মারদ্রুসের
অনুবাদই আদর্শ বলে গ্রহণ করেছি। এই প্রথম ‘সহস্ৰ
এক আরব্য রজনী’র পূর্ণাঙ্গ বাংলা সংস্করণ প্রকাশ
করা হচ্ছে।
বাংলা ভাষায় আমরা আরবী ফার্সী হিব্রু
প্রভৃতি বিদেশী বহু শব্দ আকছার ব্যবহার করি।
বহুকালের ব্যবহারে সেগুলো আজ আর বিদেশী বলেও
মনে হয় না। এই গ্রন্থে আমি সেইসব শব্দের যথাযোগ্য
ব্যবহার করে তৎকালীন আরবীয় সৌরভে পরিবেশ
গড়ে তোলার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি।
বিনীত
ক্ষিতীশ সরকার।
↓
তো শুরু করা যাক
↓
এক সময়ে শসন বংশের এক প্রবল পরাক্রান্ত শাহেনশা প্রাচ্যের এক বিশাল সন্তানিয়তের
শাসক ছিলেন। তাঁর ছিলো বিরাট সৈন্যবাহিনী, অগণিত ক্রীতদাস, আর ছিলো পেয়ারা প্রজাবৃন্দ।
তাঁর দুই পুত্র।
বড়টি দীর্ঘকায়, সুঠামদেহী, যোদ্ধা। আর ছোটটি ছিলো বেঁটে-খাটো, কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায়
জাঁদরেল। দু’জনেই দুর্ধর্ষ ঘোড়সোয়ার। বড়টির তাগদ আর বুদ্ধি ছোটর তুলনায় কিছু বেশী।
হুকুমতে তার জুড়ি ছিলো না কেউ। প্রজাদের সুখ-দুঃখ, অভাব অভিযোগ দরদ দিয়ে বুঝতো।
সেই কারণে, প্রজারাও তাকে জান প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো। তার নাম ছিলো বাদশাহ শারিয়ার।
আর ছোট ভাইয়ের নাম বাদশাহ শাহজামান। সে শাসন করতো সমরখন্দের আল্-আজম প্রদেশ।
সেও ভারি পাক্কা শাসক—প্রজারা খুব ভালোবাসতো তাকে।
এই ভাবে বছর কুড়ি কেটে গেছে। খ্যাতি প্রতিপত্তিতে দু'জনেই তখন শীর্ষে। অনেককাল
ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা নাই। বাদশাহ শারিয়ারের মন উতলা হয়ে উঠলো ভাইকে দেখার জন্য।
উজিরকে ডেকে ফরমাশ করলো, একবার শাহজামানের কাছে যাও। গিয়ে বলো, আমি একবার
দেখতে চাই তাকে। কেন জানি না, মনটা আমার অস্থির হয়ে উঠেছে, তাকে দেখার জন্যে।
তাড়াতাড়ি যাবার ব্যবস্থা করে নিয়ে এসো তাকে।
উজির করজোড়ে বললো, যো হুকুম, জাঁহাপনা।
লোকলস্কর নিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত করে রওনা হয়ে গেলো উজির। দু'দিনের পথ। আল্লাহর
দোয়ায় নিরাপদে শাহজামানের দরবারে পৌঁছে বাদশাহ শারিয়ারের অভিপ্রায় পেশ করলো।
শাহজামান বললো; আমি আজই সব ব্যবস্থা করে রওনা হচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
বাদশাহের প্রাসাদে সাজো সাজো রব পড়ে গেলো। ভালো ভালো তাঁবু, দামি দামি উট, গাধা,
খচ্চর নেওয়া হলো। বাছাই করা হলো ক্রীতদাস, পালোয়ান। তারপর উজিরকে শাসকের
ক্ষমতায় বসিয়ে রওনা হলো দাদার দেশে।
বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। রাত্রি তখন দ্বিতীয় প্রহর। শাহজামানের হঠাৎ মনে
পড়লো, দাদাকে যে জিনিসটা উপহার দেবে ভেবেছিলো, সেইটেই সঙ্গে নিতে ভুল হয়ে গেছে।
তাই আবার ফিরতে হলো প্রাসাদে। হারেমে ঢুকেই সোজা চলে এলো খাস বেগমের ঘরে। কিন্তু
ঘরে ঢুকেই থমকে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। মাথাটা বোঁ বোঁ করে
ঘুরতে লাগলো। সারা দুনিয়া আঁধার হয়ে গেলো তার সামনে। তার খাস বেগম একেবারে বিবস্ত্রা,
একটা আবলুস-কালো নিগ্রো ক্রীতদাসের সঙ্গে জড়াজড়ি করে অকাতরে ঘুমুচ্ছে। হায় খোদা,
একী দেখালে আমাকে? আমার এতোদিনের এতো ভালোবাসা, সব কি মিথ্যে? মাত্র কয়েকঘণ্টা,
প্রাসাদ ছেড়ে গেছি আমি, তার মধ্যে এই কাণ্ড! না জানি, বড়ভাইয়ের কাছে থাকার কালে,
আরও কত কী ঘটতো! খাপ থেকে তলোয়ার খুলে, প্রচণ্ড এক কোপে দু'জনকেই দু'খানা করে
ফেললো শাহজামান।
আর কালবিলম্ব না করে আবার দাদার উদ্দেশ্যে
পথে বেরিয়ে পড়লো। দু'দিন দু’রাত্রি চলার পর
বড়ভাইয়ের শহরে পৌঁছলো সে।
ভাইকে পেয়ে বাদশাহ শারিয়ার আনন্দে
আত্মহারা। সারা প্রাসাদে হৈচৈ পড়ে গেলো।
ভাইকে বুকে জড়িয়ে আদর করলো। কতকাল
পরে দেখা। কত কথা জমা হয়ে আছে। সব
যেন একনাগাড়ে বলতে চায় শারিয়ার।
কিন্তু শাহজামানের মুখে কোনও হাসি নাই। বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে তার দেহে, মনে।
বড় ভাইয়ের আনন্দে তাল দিতে পারলো না সে। কোনরকমে হুঁ, না বলে কথার জবাব দিতে
থাকলো। তার মনে তখন সেই একই প্রশ্ন। এতো প্রেম, ভালোবাসা পায়ে দলে, কী করে সে
পরপুরুষের সঙ্গে ব্যভিচার করতে পারলো? দুনিয়ায় কি ভালোবাসা, বিশ্বাসের কোনও দাম
নাই?
চিন্তায় চিন্তায় চোয়াল দু'টো তুবড়ে ঝুলে পড়েছে। সারা দেহটা যেন বৈশাখী ঝড়ে বিধ্বস্ত
এক শাল গাছ। শাহজামানকে চিন্তাক্লিষ্ট দেখে শারিয়ার ভাবে, নিজের দেশ ছেড়ে এসে ভাই বোধ
হয় স্বস্তি পাচ্ছে না। নানা চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সেদিন আর কথা না বাড়িয়ে বিশ্রাম করতে
বলে চলে গেলো। পরদিন সকালে আবার এলো ভাইকে দেখতে। দেখলো, সেই একই অবস্থা।
খানাপিনা প্রায় করেনি বললেই চলে। শারিয়ার জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে তোমার, ভাই? কাল
থেকে লক্ষ্য করছি, তুমি ভীষণ চিন্তিত। তোমার মুখে হাসি দেখিনি একবারও। কী ব্যাপার, খুলে
বলো তো।
শাহজামান বললো, বুকের ভেতরটা হু হু করে পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন, সেকথা বলতে
পারবো না এখন।
↓
বেগমের সেই জঘন্য ব্যভিচারের কথা বলবেই বা কী করে?
শারিয়ার বুঝলো, নেহাতই ব্যক্তিগত ব্যাপার। সে প্রসঙ্গে আর না গিয়ে বললো, চলো,
শিকারে যাই। দেখবে দেহমন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
শাহজামান বললো, তুমি একাই যাও, দাদা। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। শিকারে
গেলেও ভালো লাগবে না। বরং তোমার আনন্দ মাটি করে দেবো।
শারিয়ার আর ঘাঁটাঘাঁটি করলো না তাকে। একাই বেরিয়ে পড়লো শিকার সন্ধানে। সঙ্গে
গেলো লটবহর, লোক-লস্কর। এলাহি ব্যাপার।
প্রাসাদের যে ঘরে শাহজামানকে থাকতে দেওয়া হয়েছিলো, সে ঘরের জানালা দিয়ে
ওপাশের বাগিচা দেখা যায়। নানা ফুলের গাছে ভরা। মাঝখানে সান বাঁধানো বিরাট এক
চৌবাচ্চা। তার মাঝখানে এক জলের ফোয়ারা। অবিরাম ধারা-বর্ষণ করে চলেছে। বড় সুন্দর,
বড় মনোরম।
প্রাসাদের পিছনের দরজা খুলে গেলো। আর সঙ্গে সঙ্গে কিলবিল করে বেরিয়ে এলো কুড়িটা
ক্রীতদাসী আর কুড়িটা ক্রীতদাস। আর তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিলো স্বয়ং বেগম সাহেবা। সবাই
বিবস্ত্র, নগ্ন হয়ে জোড়ায় জোড়ায় গিয়ে বসলো—বাগিচার নানা জায়গায়। হঠাৎ কঁকিয়ে
বেগম, মাসুদ ও মাসুদ।
উঠলো
একটা দৈত্যের মতো নিগ্রো ছুটে গেলো বেগমের দিকে। দু হাতে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে
এসে আলতোভাবে ঘাসের
ওপর শুইয়ে দিলো বেগমকে। তারপর নিগ্রোটার এই বিশাল বপুর
উথাল পাথাল পেষণে পিষ্ট হতে থাকলো বেগমের কুসুম-কোমল দেহটা এইভাবে চলতে থাকে
সুরত সারা রাত ধরে। বেগমের ইঙ্গিতে তার দাসদাসীরাও একই রঙ্গে
ওঠে।
দাদার দুর্ভাগ্য তো
এই দৃশ্য দেখে নিজের মনে খানিকটা সান্ত্বনা পায় শাহজামান,
দেখছি আমার চেয়েও বেশী। বুকটা ঈষৎ হাল্কা বোধ করলো। একটু সরাব নিলো, একটু খানা
খেলো। ধীরে-ধীরে চাঙ্গা হতে লাগলো দেহ-মন।
এদিকে বাদশাহ শারিয়ার শিকার শেষে, প্রাসাদে ফিরে ভাইয়ের কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে
গেলো। দেখে খুশি হলো, ভাই তার বিষণ্নদশা কাটিয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
পরদিন সকালে এসে শারিয়ার প্রশ্ন করে, কেমন করে আবার খুশ মেজাজ ফিরে পেলে,
ভাই?
শাহজামান বললো, তবে বলি শোনো, কেন আমি অমন বিষাদে ডুবে গিয়েছিলাম। যখন
তুমি তোমার উজিরকে পাঠালে আমার কাছে, আনন্দে নেচে উঠলো আমার মন। কতকাল বাদে
তোমার সাথে মিলবো, খুশি না হয়ে পারি! লোকলস্কর সঙ্গে করে তোমার শহরের পথে পা
বাড়ালাম। কিন্তু কিছু দূর আসার পর মনে পড়লো, একটা দরকারি জিনিস সঙ্গে নিতে ভুলে
গেছি। আবার ফিরতে হলো প্রাসাদে। কিন্তু প্রাসাদে এসে, হারেমে ঢুকে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে
তামাম দুনিয়া বরবাদ হয়ে গেলো আমার কাছে। আমার খাস বেগম, আমাকে ছেড়ে একটা দিন
সে থাকতে পারতো না। আমার অদর্শন সইতে পারতো না একদম। সেই বেগমকে দেখলাম,
বিবস্ত্রা, উলঙ্গ হয়ে এক নিগ্রো ক্রীতদাসকে জড়িয়ে ধরে আমারই পালঙ্কে শুয়ে ঘুমুচ্ছে। মাথায়
খুন চেপে গেলো। তলোয়ারের এক কোপে দু’জনকে দু'খানা করে দিয়ে এসেছি।
কেন এতো ভেঙে পড়েছিলাম আমি, সেকথা শুনলে। কিন্তু কী করে সব শোক তাপ ভুলে
আবার খোশ-মেজাজ ফিরে পেলাম সেকথা আমাকে জিজ্ঞেস করো না, দাদা। বলতে পারবো
না।
শাহজামানের এ কথা শুনে অধৈর্য হয়ে পড়লো শারিয়ার। হায় আল্লাহ, তোমাকে এতো করে
বলছি, তবু কেন বলতে চাইছো না? সঙ্কোচ করার কোনো কারণ নাই, তুমি খুলে বলো, দেখি।
শাহজামান খুলে বললো সব। শুনে অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইলো শারিয়ার। তারপর
বললো, নিজের চোখে দেখতে চাই আমি। তুমি হয়তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খোয়াব দেখেছো, ভাই।
শাহজামান হেসে বলে, না দাদা, ঘুম আমার ছিলো না চোখে। ওই ঘটনার পর, নাওয়া খাওয়া
ঘুম কিছুই করিনি আমি। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তবে নিজের চোখে একদিন দেখো।
আবার তুমি ঢ্যাড়া দিয়ে দাও, তুমি আবার শিকারে যাবে। আসলে কিন্তু যাবে না। আমার ঘরে
এসে লুকিয়ে থাকবে। দেখো, যেন কেউ টের না পায়। তারপর নিজের চোখেই দেখতে পাবে,
ওদের সব কাণ্ডকারখানা।
তিল মাত্র দেরী না করে তখুনি ঢ্যাড়া পিটিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হলো। বাদশাহ যাবেন
শিকারে। আবার সাজো সাজো রব। লটবহর, লোকলস্কর নিয়ে রওনা হলো বাদশাহ শারিয়ার।
বাদশাহর খাস নোকর ছিলো দু'টি। খুব বিশ্বাসী। ওদের বললো, আজ রাতে আমি তাঁবুর বাইরে
যাবো। কিন্তু সাবধান, কাকপক্ষীও যেন জানতে না পারে। যদি কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে
চায়, স্রেফ ভাগিয়ে দিবি। বলবি, বাদশাহর তবিয়ৎ আচ্ছা নাই, দেখা হবে না। তার বারণ আছে।
তা সে স্বয়ং উজিরও যদি আসে, তাকেও এই একই কথা বলে ফিরিয়ে দিবি, বুঝলি?
রাত যখন ঘনিয়ে এলো, এক ফকিরের ছদ্মবেশে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়লো শারিয়ার হন
হন করে হেঁটে চলে এলো প্রাসাদের খিড়কীর দরজার কাছে। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে, টুক করে
ঢাক পড়লো। তারপর সোজা শতভামালের ঘরে। সেই জানালার পাশে বসে অপলক চোখে
তাকিয়ে রইলো বাগিচার দিকে।
শানিয়ারী
পলক চোখে
করে বেড়িয়ে এলো
ঘণ্টাখানেক বাদে হারেমের পিছনের দরজা খুলে গেলো। আর হুড়
কুড়ি জোড়া দাসদাসী। আর এলো বেগম। আবার সেই ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি। হুবহু
এক। শারিয়ার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এই ব্যভিচারিণীকে সে এতোকাল
বিশ্বাস করেছে, ভালোবেসেছে! ঘৃণায় রিরি করে ওঠে সারা শরীর।
রাত্রি শেষ হয়ে আসে, ওরা আবার ঢুকে পড়ে হারেমে। ইত্যাকার দৃশ্য দেখে শারিয়ারের
পায়ের তলার মাটি সরে যেতে থাকে। শাহজামানকে বললো, ঢের হয়েছে, চলো ভাই
nota Boo
এই নরক থেকে, এই পাপপুরী থেকে আমরা কেটে পড়ি। এমন দেশে যেতে
চাই, যেখানে এই সব অনাচার, ব্যভিচার নাই, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা নাই।
আমাদের মতো আর কোন হতভাগ্যের সন্ধান মেলে কিনা তাও একবার খুঁজে
পেতে দেখি।
শাহজামানেরও সেই কথা। এই বিশ্বাসঘাতকতা, এই প্রতারণার দুনিয়ায়
বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুও অনেক ভালো।
সেই রাতেই প্রাসাদের খিড়কীর দরজা দিয়ে নিরুদ্দেশের
পথে বেরিয়ে পড়লো তারা। দিনের পর দিন রাতের পর
রাত চলতে থাকে। অবশেষে একদিন এক সমুদ্রের
উপকূলে এসে হাজির হলো। নির্জন সৈকত। কাছের
এক বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করতে থাকে তারা।
ঘণ্টাখানেক কেটেছে। হঠাৎ নজরে পড়লো, দূরে সমুদ্রের মাঝখানে এক ধোঁয়ার কুণ্ডলী
ক্রমশ আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে ঐ কুণ্ডলীটা এক বিকটাকার আফ্রিদি দৈত্যের রূপ
ধারণ করলো। এই না দেখে দু'ভাইয়ের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। দৈত্যটা কূলের দিকে এগিয়ে
আসছে। উপায়ন্তর না দেখে গুঁড়ি বেয়ে গাছের ডালে গিয়ে বসলো দু’জনে। লম্বা লম্বা পা ফেলে
ওদের গাছের দিকেই এগিয়ে আসতে লাগলো আফ্রিদি। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেলো। আরো কাছে
আসতেই নজরে পড়লো, তার মাথায় বিরাট একটা বাক্স। গাছের তলায় এসে বাক্সটা নামিয়ে
বসে পড়লো সে। বাক্সটার ভেতর থেকে একটা লোহার সিন্দুক বের করলো। সিন্দুকটা খুললো।
কী আশ্চর্য! তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো বেহেস্তের পরীর মতো পরমা সুন্দরী এক যুবতী। কী
তার রূপের ছটা ! গাছের তলাটা আলোয় ঝলমল করে উঠলো। কাব্য করে বলতে গেলে বলা
যায়
তার রূপের আলো সকালবেলার সূর্য ওঠার মতো।
আঁধার রাতেও আসে যদি, দিনের আলো দেখি।
দেহটা কি সূর্যকণায় গড়া?
মরি মরি, ধার করা রহস্যের ওড়নায় ঢাকা,
তার চোখের হাসির ঝিলিকে,
নিরন্তর বন্দী হয়ে আছে বুঝি চাঁদ।
তামাম দুনিয়ার যত পৌরুষপ্রেম পায়ে থাকে তার!
↓
গল্পটা অনেক আগে পড়ছিলাম বই থেকে
ভাবছি এখানে গল্প দিব??
কোনো সমস্যা হবে কি????
↓
→সহস্ৰ এক আরব্য রজনী
অসংক্ষেপিত পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ
প্রথম খণ্ড
↓
ভাষান্তর : ক্ষিতীশ সরকার
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : সত্য চক্রবর্তী
↓
ভূমিকা
‘সহস্র এক আরব্য রজনী' বিশ্বের এক শ্রেষ্ঠ সাহিত্য
সম্পদ। পৃথিবীর প্রায় সব প্রধান ভাষাতেই এর অনুবাদ
প্রকাশিত হয়ে রস পিপাসু পাঠকের সমাদর লাভ
করে আসছে। কালে আর জলে ধুয়ে এ-গ্রন্থ আজও
চির অম্লান। শাশ্বত সাহিত্যের এই-ই সবচেয়ে বড়
প্রমাণ। অদ্যাবধি অগণিত প্রকাশক ‘আরব্য রজনী’র
কিছু কিছু অংশ অতি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করে
আসছেন। কিন্তু সেগুলি সবই ছোটদের জন্য লেখা
কিছু কিছু গল্পাংশ মাত্র। সে-সব ‘গপ্প’ পড়ে ‘সহস্র এক
আরব্য রজনী’র অপার সাহিত্য-সৌন্দর্য অনুমান করা
সম্ভব নয়। আরবী ভাষায় রচিত মূল গ্রন্থ ‘আলিফ
লায়লা’ কিন্তু আদৌ ছোটদের জন্য রচিত নয়।
সারা পৃথিবীতে এ-গ্রন্থ যত ভাষায় অনূদিত
হয়েছে তার মধ্যে ড: জে. সি. মারদ্রস-এর অনুবাদই
শ্রেষ্ঠ। স্পেক্টেটর পত্রিকার মতে The Nursury
version of the 'Arabian Nights' serve their pur-
pose, but very pale shades of their originals;
prudery Prevented Lane's version for adults
form being substantially better, and Burton's
was still far from being a complete success.
Dr. Mardrus's translation into French was the
first European rendering which faithfully re-
flected its original.
ভাষান্তর করার জন্য আমি ড: মারদ্রুসের
অনুবাদই আদর্শ বলে গ্রহণ করেছি। এই প্রথম ‘সহস্ৰ
এক আরব্য রজনী’র পূর্ণাঙ্গ বাংলা সংস্করণ প্রকাশ
করা হচ্ছে।
বাংলা ভাষায় আমরা আরবী ফার্সী হিব্রু
প্রভৃতি বিদেশী বহু শব্দ আকছার ব্যবহার করি।
বহুকালের ব্যবহারে সেগুলো আজ আর বিদেশী বলেও
মনে হয় না। এই গ্রন্থে আমি সেইসব শব্দের যথাযোগ্য
ব্যবহার করে তৎকালীন আরবীয় সৌরভে পরিবেশ
গড়ে তোলার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি।
বিনীত
ক্ষিতীশ সরকার।
↓
তো শুরু করা যাক
↓
এক সময়ে শসন বংশের এক প্রবল পরাক্রান্ত শাহেনশা প্রাচ্যের এক বিশাল সন্তানিয়তের
শাসক ছিলেন। তাঁর ছিলো বিরাট সৈন্যবাহিনী, অগণিত ক্রীতদাস, আর ছিলো পেয়ারা প্রজাবৃন্দ।
তাঁর দুই পুত্র।
বড়টি দীর্ঘকায়, সুঠামদেহী, যোদ্ধা। আর ছোটটি ছিলো বেঁটে-খাটো, কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায়
জাঁদরেল। দু’জনেই দুর্ধর্ষ ঘোড়সোয়ার। বড়টির তাগদ আর বুদ্ধি ছোটর তুলনায় কিছু বেশী।
হুকুমতে তার জুড়ি ছিলো না কেউ। প্রজাদের সুখ-দুঃখ, অভাব অভিযোগ দরদ দিয়ে বুঝতো।
সেই কারণে, প্রজারাও তাকে জান প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো। তার নাম ছিলো বাদশাহ শারিয়ার।
আর ছোট ভাইয়ের নাম বাদশাহ শাহজামান। সে শাসন করতো সমরখন্দের আল্-আজম প্রদেশ।
সেও ভারি পাক্কা শাসক—প্রজারা খুব ভালোবাসতো তাকে।
এই ভাবে বছর কুড়ি কেটে গেছে। খ্যাতি প্রতিপত্তিতে দু'জনেই তখন শীর্ষে। অনেককাল
ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা নাই। বাদশাহ শারিয়ারের মন উতলা হয়ে উঠলো ভাইকে দেখার জন্য।
উজিরকে ডেকে ফরমাশ করলো, একবার শাহজামানের কাছে যাও। গিয়ে বলো, আমি একবার
দেখতে চাই তাকে। কেন জানি না, মনটা আমার অস্থির হয়ে উঠেছে, তাকে দেখার জন্যে।
তাড়াতাড়ি যাবার ব্যবস্থা করে নিয়ে এসো তাকে।
উজির করজোড়ে বললো, যো হুকুম, জাঁহাপনা।
লোকলস্কর নিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত করে রওনা হয়ে গেলো উজির। দু'দিনের পথ। আল্লাহর
দোয়ায় নিরাপদে শাহজামানের দরবারে পৌঁছে বাদশাহ শারিয়ারের অভিপ্রায় পেশ করলো।
শাহজামান বললো; আমি আজই সব ব্যবস্থা করে রওনা হচ্ছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
বাদশাহের প্রাসাদে সাজো সাজো রব পড়ে গেলো। ভালো ভালো তাঁবু, দামি দামি উট, গাধা,
খচ্চর নেওয়া হলো। বাছাই করা হলো ক্রীতদাস, পালোয়ান। তারপর উজিরকে শাসকের
ক্ষমতায় বসিয়ে রওনা হলো দাদার দেশে।
বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। রাত্রি তখন দ্বিতীয় প্রহর। শাহজামানের হঠাৎ মনে
পড়লো, দাদাকে যে জিনিসটা উপহার দেবে ভেবেছিলো, সেইটেই সঙ্গে নিতে ভুল হয়ে গেছে।
তাই আবার ফিরতে হলো প্রাসাদে। হারেমে ঢুকেই সোজা চলে এলো খাস বেগমের ঘরে। কিন্তু
ঘরে ঢুকেই থমকে গেলো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না। মাথাটা বোঁ বোঁ করে
ঘুরতে লাগলো। সারা দুনিয়া আঁধার হয়ে গেলো তার সামনে। তার খাস বেগম একেবারে বিবস্ত্রা,
একটা আবলুস-কালো নিগ্রো ক্রীতদাসের সঙ্গে জড়াজড়ি করে অকাতরে ঘুমুচ্ছে। হায় খোদা,
একী দেখালে আমাকে? আমার এতোদিনের এতো ভালোবাসা, সব কি মিথ্যে? মাত্র কয়েকঘণ্টা,
প্রাসাদ ছেড়ে গেছি আমি, তার মধ্যে এই কাণ্ড! না জানি, বড়ভাইয়ের কাছে থাকার কালে,
আরও কত কী ঘটতো! খাপ থেকে তলোয়ার খুলে, প্রচণ্ড এক কোপে দু'জনকেই দু'খানা করে
ফেললো শাহজামান।
আর কালবিলম্ব না করে আবার দাদার উদ্দেশ্যে
পথে বেরিয়ে পড়লো। দু'দিন দু’রাত্রি চলার পর
বড়ভাইয়ের শহরে পৌঁছলো সে।
ভাইকে পেয়ে বাদশাহ শারিয়ার আনন্দে
আত্মহারা। সারা প্রাসাদে হৈচৈ পড়ে গেলো।
ভাইকে বুকে জড়িয়ে আদর করলো। কতকাল
পরে দেখা। কত কথা জমা হয়ে আছে। সব
যেন একনাগাড়ে বলতে চায় শারিয়ার।
কিন্তু শাহজামানের মুখে কোনও হাসি নাই। বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে তার দেহে, মনে।
বড় ভাইয়ের আনন্দে তাল দিতে পারলো না সে। কোনরকমে হুঁ, না বলে কথার জবাব দিতে
থাকলো। তার মনে তখন সেই একই প্রশ্ন। এতো প্রেম, ভালোবাসা পায়ে দলে, কী করে সে
পরপুরুষের সঙ্গে ব্যভিচার করতে পারলো? দুনিয়ায় কি ভালোবাসা, বিশ্বাসের কোনও দাম
নাই?
চিন্তায় চিন্তায় চোয়াল দু'টো তুবড়ে ঝুলে পড়েছে। সারা দেহটা যেন বৈশাখী ঝড়ে বিধ্বস্ত
এক শাল গাছ। শাহজামানকে চিন্তাক্লিষ্ট দেখে শারিয়ার ভাবে, নিজের দেশ ছেড়ে এসে ভাই বোধ
হয় স্বস্তি পাচ্ছে না। নানা চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সেদিন আর কথা না বাড়িয়ে বিশ্রাম করতে
বলে চলে গেলো। পরদিন সকালে আবার এলো ভাইকে দেখতে। দেখলো, সেই একই অবস্থা।
খানাপিনা প্রায় করেনি বললেই চলে। শারিয়ার জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে তোমার, ভাই? কাল
থেকে লক্ষ্য করছি, তুমি ভীষণ চিন্তিত। তোমার মুখে হাসি দেখিনি একবারও। কী ব্যাপার, খুলে
বলো তো।
শাহজামান বললো, বুকের ভেতরটা হু হু করে পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন, সেকথা বলতে
পারবো না এখন।
↓
বেগমের সেই জঘন্য ব্যভিচারের কথা বলবেই বা কী করে?
শারিয়ার বুঝলো, নেহাতই ব্যক্তিগত ব্যাপার। সে প্রসঙ্গে আর না গিয়ে বললো, চলো,
শিকারে যাই। দেখবে দেহমন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
শাহজামান বললো, তুমি একাই যাও, দাদা। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। শিকারে
গেলেও ভালো লাগবে না। বরং তোমার আনন্দ মাটি করে দেবো।
শারিয়ার আর ঘাঁটাঘাঁটি করলো না তাকে। একাই বেরিয়ে পড়লো শিকার সন্ধানে। সঙ্গে
গেলো লটবহর, লোক-লস্কর। এলাহি ব্যাপার।
প্রাসাদের যে ঘরে শাহজামানকে থাকতে দেওয়া হয়েছিলো, সে ঘরের জানালা দিয়ে
ওপাশের বাগিচা দেখা যায়। নানা ফুলের গাছে ভরা। মাঝখানে সান বাঁধানো বিরাট এক
চৌবাচ্চা। তার মাঝখানে এক জলের ফোয়ারা। অবিরাম ধারা-বর্ষণ করে চলেছে। বড় সুন্দর,
বড় মনোরম।
প্রাসাদের পিছনের দরজা খুলে গেলো। আর সঙ্গে সঙ্গে কিলবিল করে বেরিয়ে এলো কুড়িটা
ক্রীতদাসী আর কুড়িটা ক্রীতদাস। আর তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিলো স্বয়ং বেগম সাহেবা। সবাই
বিবস্ত্র, নগ্ন হয়ে জোড়ায় জোড়ায় গিয়ে বসলো—বাগিচার নানা জায়গায়। হঠাৎ কঁকিয়ে
বেগম, মাসুদ ও মাসুদ।
উঠলো
একটা দৈত্যের মতো নিগ্রো ছুটে গেলো বেগমের দিকে। দু হাতে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে
এসে আলতোভাবে ঘাসের
ওপর শুইয়ে দিলো বেগমকে। তারপর নিগ্রোটার এই বিশাল বপুর
উথাল পাথাল পেষণে পিষ্ট হতে থাকলো বেগমের কুসুম-কোমল দেহটা এইভাবে চলতে থাকে
সুরত সারা রাত ধরে। বেগমের ইঙ্গিতে তার দাসদাসীরাও একই রঙ্গে
ওঠে।
দাদার দুর্ভাগ্য তো
এই দৃশ্য দেখে নিজের মনে খানিকটা সান্ত্বনা পায় শাহজামান,
দেখছি আমার চেয়েও বেশী। বুকটা ঈষৎ হাল্কা বোধ করলো। একটু সরাব নিলো, একটু খানা
খেলো। ধীরে-ধীরে চাঙ্গা হতে লাগলো দেহ-মন।
এদিকে বাদশাহ শারিয়ার শিকার শেষে, প্রাসাদে ফিরে ভাইয়ের কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে
গেলো। দেখে খুশি হলো, ভাই তার বিষণ্নদশা কাটিয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
পরদিন সকালে এসে শারিয়ার প্রশ্ন করে, কেমন করে আবার খুশ মেজাজ ফিরে পেলে,
ভাই?
শাহজামান বললো, তবে বলি শোনো, কেন আমি অমন বিষাদে ডুবে গিয়েছিলাম। যখন
তুমি তোমার উজিরকে পাঠালে আমার কাছে, আনন্দে নেচে উঠলো আমার মন। কতকাল বাদে
তোমার সাথে মিলবো, খুশি না হয়ে পারি! লোকলস্কর সঙ্গে করে তোমার শহরের পথে পা
বাড়ালাম। কিন্তু কিছু দূর আসার পর মনে পড়লো, একটা দরকারি জিনিস সঙ্গে নিতে ভুলে
গেছি। আবার ফিরতে হলো প্রাসাদে। কিন্তু প্রাসাদে এসে, হারেমে ঢুকে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে
তামাম দুনিয়া বরবাদ হয়ে গেলো আমার কাছে। আমার খাস বেগম, আমাকে ছেড়ে একটা দিন
সে থাকতে পারতো না। আমার অদর্শন সইতে পারতো না একদম। সেই বেগমকে দেখলাম,
বিবস্ত্রা, উলঙ্গ হয়ে এক নিগ্রো ক্রীতদাসকে জড়িয়ে ধরে আমারই পালঙ্কে শুয়ে ঘুমুচ্ছে। মাথায়
খুন চেপে গেলো। তলোয়ারের এক কোপে দু’জনকে দু'খানা করে দিয়ে এসেছি।
কেন এতো ভেঙে পড়েছিলাম আমি, সেকথা শুনলে। কিন্তু কী করে সব শোক তাপ ভুলে
আবার খোশ-মেজাজ ফিরে পেলাম সেকথা আমাকে জিজ্ঞেস করো না, দাদা। বলতে পারবো
না।
শাহজামানের এ কথা শুনে অধৈর্য হয়ে পড়লো শারিয়ার। হায় আল্লাহ, তোমাকে এতো করে
বলছি, তবু কেন বলতে চাইছো না? সঙ্কোচ করার কোনো কারণ নাই, তুমি খুলে বলো, দেখি।
শাহজামান খুলে বললো সব। শুনে অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রইলো শারিয়ার। তারপর
বললো, নিজের চোখে দেখতে চাই আমি। তুমি হয়তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খোয়াব দেখেছো, ভাই।
শাহজামান হেসে বলে, না দাদা, ঘুম আমার ছিলো না চোখে। ওই ঘটনার পর, নাওয়া খাওয়া
ঘুম কিছুই করিনি আমি। আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তবে নিজের চোখে একদিন দেখো।
আবার তুমি ঢ্যাড়া দিয়ে দাও, তুমি আবার শিকারে যাবে। আসলে কিন্তু যাবে না। আমার ঘরে
এসে লুকিয়ে থাকবে। দেখো, যেন কেউ টের না পায়। তারপর নিজের চোখেই দেখতে পাবে,
ওদের সব কাণ্ডকারখানা।
তিল মাত্র দেরী না করে তখুনি ঢ্যাড়া পিটিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হলো। বাদশাহ যাবেন
শিকারে। আবার সাজো সাজো রব। লটবহর, লোকলস্কর নিয়ে রওনা হলো বাদশাহ শারিয়ার।
বাদশাহর খাস নোকর ছিলো দু'টি। খুব বিশ্বাসী। ওদের বললো, আজ রাতে আমি তাঁবুর বাইরে
যাবো। কিন্তু সাবধান, কাকপক্ষীও যেন জানতে না পারে। যদি কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে
চায়, স্রেফ ভাগিয়ে দিবি। বলবি, বাদশাহর তবিয়ৎ আচ্ছা নাই, দেখা হবে না। তার বারণ আছে।
তা সে স্বয়ং উজিরও যদি আসে, তাকেও এই একই কথা বলে ফিরিয়ে দিবি, বুঝলি?
রাত যখন ঘনিয়ে এলো, এক ফকিরের ছদ্মবেশে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়লো শারিয়ার হন
হন করে হেঁটে চলে এলো প্রাসাদের খিড়কীর দরজার কাছে। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে, টুক করে
ঢাক পড়লো। তারপর সোজা শতভামালের ঘরে। সেই জানালার পাশে বসে অপলক চোখে
তাকিয়ে রইলো বাগিচার দিকে।
শানিয়ারী
পলক চোখে
করে বেড়িয়ে এলো
ঘণ্টাখানেক বাদে হারেমের পিছনের দরজা খুলে গেলো। আর হুড়
কুড়ি জোড়া দাসদাসী। আর এলো বেগম। আবার সেই ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি। হুবহু
এক। শারিয়ার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এই ব্যভিচারিণীকে সে এতোকাল
বিশ্বাস করেছে, ভালোবেসেছে! ঘৃণায় রিরি করে ওঠে সারা শরীর।
রাত্রি শেষ হয়ে আসে, ওরা আবার ঢুকে পড়ে হারেমে। ইত্যাকার দৃশ্য দেখে শারিয়ারের
পায়ের তলার মাটি সরে যেতে থাকে। শাহজামানকে বললো, ঢের হয়েছে, চলো ভাই
nota Boo
এই নরক থেকে, এই পাপপুরী থেকে আমরা কেটে পড়ি। এমন দেশে যেতে
চাই, যেখানে এই সব অনাচার, ব্যভিচার নাই, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা নাই।
আমাদের মতো আর কোন হতভাগ্যের সন্ধান মেলে কিনা তাও একবার খুঁজে
পেতে দেখি।
শাহজামানেরও সেই কথা। এই বিশ্বাসঘাতকতা, এই প্রতারণার দুনিয়ায়
বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুও অনেক ভালো।
সেই রাতেই প্রাসাদের খিড়কীর দরজা দিয়ে নিরুদ্দেশের
পথে বেরিয়ে পড়লো তারা। দিনের পর দিন রাতের পর
রাত চলতে থাকে। অবশেষে একদিন এক সমুদ্রের
উপকূলে এসে হাজির হলো। নির্জন সৈকত। কাছের
এক বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করতে থাকে তারা।
ঘণ্টাখানেক কেটেছে। হঠাৎ নজরে পড়লো, দূরে সমুদ্রের মাঝখানে এক ধোঁয়ার কুণ্ডলী
ক্রমশ আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে ঐ কুণ্ডলীটা এক বিকটাকার আফ্রিদি দৈত্যের রূপ
ধারণ করলো। এই না দেখে দু'ভাইয়ের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। দৈত্যটা কূলের দিকে এগিয়ে
আসছে। উপায়ন্তর না দেখে গুঁড়ি বেয়ে গাছের ডালে গিয়ে বসলো দু’জনে। লম্বা লম্বা পা ফেলে
ওদের গাছের দিকেই এগিয়ে আসতে লাগলো আফ্রিদি। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেলো। আরো কাছে
আসতেই নজরে পড়লো, তার মাথায় বিরাট একটা বাক্স। গাছের তলায় এসে বাক্সটা নামিয়ে
বসে পড়লো সে। বাক্সটার ভেতর থেকে একটা লোহার সিন্দুক বের করলো। সিন্দুকটা খুললো।
কী আশ্চর্য! তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো বেহেস্তের পরীর মতো পরমা সুন্দরী এক যুবতী। কী
তার রূপের ছটা ! গাছের তলাটা আলোয় ঝলমল করে উঠলো। কাব্য করে বলতে গেলে বলা
যায়
তার রূপের আলো সকালবেলার সূর্য ওঠার মতো।
আঁধার রাতেও আসে যদি, দিনের আলো দেখি।
দেহটা কি সূর্যকণায় গড়া?
মরি মরি, ধার করা রহস্যের ওড়নায় ঢাকা,
তার চোখের হাসির ঝিলিকে,
নিরন্তর বন্দী হয়ে আছে বুঝি চাঁদ।
তামাম দুনিয়ার যত পৌরুষপ্রেম পায়ে থাকে তার!
↓
গল্পটা অনেক আগে পড়ছিলাম বই থেকে
ভাবছি এখানে গল্প দিব??
কোনো সমস্যা হবে কি????