image upload
কাবেরী তখন সাগিনার গায়ের চাদরটা টেনে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশে।
সকাল থেকেই একটা পাখি একনাগাড়ে ডেকে চলেছে। পাখিটা ঠিক কোথায় বোঝা যাচ্ছে না। কুছুয়া বৈঠকখানার ঘর থেকে ঢাউস আলমারিটা টেনে সরিয়েছে। আলমারির পেছনে মাকড়সার জালবিন্যাস। কোমরে শাড়িটা বেঁধে ওপাশে ঝাঁট দিতে ব্যস্ত কাবেরী। আজই বৈঠকখানাটা ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে উদগ্রীব সে। কুছুয়া বলল---দিদিমণি কি পাখিটা বইলতে পাইরেন?
---কোনটা? ওই যে ডাকছে?
---হুম্ম।
---কী পাখি বলতো?
---চুনিমুখা।
---ভারী মিষ্টি ডাকতো। এমন ডাক কখনো শুনিনি।
হেমেন রায় আলমারির মধ্যেকার পুরোনো বইটই নেড়ে দেখছিলেন, বললেন--- দেখবি কি করে, কলকাতা শহরে কী আর পাখি দেখা যায়।
কাবেরীর ঝুঁকে ঝাঁট দিতে দিতে কোমর ধরে এলো। কোমরে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল সে---আছে বৈকি, সকালবেলা কাকের উৎপাত তো কম হয় না।
---কাকেদেরও দিনকাল শেষ হবে এবার। হেমেন রায় বই থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন।
---ওমা! কেন! দিব্যি তো আমাদের বাড়ীর ছাদে ওদের দাপাদাপি দেখি। একবার পাপান ঢিল মেরে পেয়ারা গাছটায় ওদের বাসা ভেঙে দিয়েছিল, সে কী রাগ। কোত্থেকে এক ঝাঁক উড়ে এসে ঘিরে ফেলল ছাদটা।
----ওটাই ওদের বাঁচিয়ে রেখেছে খুকী। কাকেরা শুধু সমাজবদ্ধ নয়, ওরা বুদ্ধিতেও মানুষের পরে শিম্পাঞ্জির নিকটবর্তী।
তৎক্ষনাৎ কুছুয়া জানালার দিকে হুঁশিয়ার হয়ে বলল---এই দেইখেন দিদিমণি...চুনিমুখাটা।
কাবেরী দেখল বড্ড রঙচঙে পাখি। নিম গাছের ডালে বসে গলা ফুলিয়ে গান সেঁধেছে। গাঢ় হলুদ গায়ে সবুজ পাখনা। উঁচু জানলায় কুশি কয়েকবার লাফিয়ে দেখবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বললে---আমি দিখতেটা পাই লাই...দিদিমণি আমি দিখব।
কাবেরী কুশিকে কোলে তুলে জানালার কাছে নিয়ে যেতে ও বিস্ময়ে দেখতে লাগলো পাখিটাকে। হেমেন রায় বললেন---পাখিটার নাম আসলে চুনিমুখো মৌটুসী।
কাবেরী বললে---এটাই আসলে মৌটুসী পাখি? বা রে আমি এই নামটা কিন্তু শুনেছি। চুনিমুখো-টুখো বলল বুঝব কী করে।
কাগজে করে ওষুধের নামটা বুধনকে লিখে দিয়েছিল কাবেরী। পারতডিহিতে একটা ছোট ফার্মেসি আছে। সেখান থেকে বুধন কাবেরীকে গোপনে ওষুধটা দিয়ে গেল দুপুর বেলা। হেমেন রায় তখন ভাত ঘুমে। কুন্তী কুশি ওদের ঘরে। বুধন চাইছিল কাবেরীকে পেতে। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বুধনকে ফেরত পাঠিয়েছে কাবেরী। কথা দিয়েছে কাল যাবে বুধনের ঝুপড়িতে। বিকেলটা কাটিয়ে আসবে ওখানে। সুযোগ না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল বুধন। কড়া গলায় তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় বলে গেল---কাল ঝুপড়িতে আইলে এর শাস্তিটা দিব তোরে মাগী। এমন চুদান চুদব তোরে, বুইঝবি মরদের গতরটা কী আছে।
---ইস! লজ্জা পেল কাবেরী। বুধনের মুখের অশালীন ভাষায় বিরক্তি প্রকাশ না করে, প্রশ্রয় দিল লাজুক হাসিতে। কাবেরী জানে ভালগার শব্দ নিম্নবিত্ত পিছিয়ে পড়া জনজীবনে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা বিষয়। কাবেরী যে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, সেই কলেজটা বস্তি লাগোয়া। কথায় কথায় লোকেরা পরস্পরের সাথে সেখানে প্রায়শই গালি আওড়ায়। বস্তির শিশুরা শেখে, মাঝে মধ্যে কলেজের গন্ডির মধ্যেও সহপাঠীদের মধ্যে ঝগড়া-মারামারিতে বলে ফেলে। কাবেরী বকা দেয়। বুধনের মুখের ভাষা যাইহোক, কুন্তী বা কুশিকে কিন্তু কাবেরী এ পর্যন্ত কোনো কুচ্ছিত শব্দ উচ্চারণ করতে দেখেনি।
বিকেল বেলা বন্য প্রান্তরের উল্টো দিকে গেছেন হেমেন রায়। যেদিকটা কাবেরীর কখনো যাওয়া হয়নি। হেমেন দা ডেকেছিলেন কাবেরীকে, বলেছিলেন খুকী ওদিকে গেলে অরণ্যের চেহারা অন্যরকম লাগবে। অত ঘন ঘন শাল-মহুয়ার জঙ্গল নেই। বেশ কিছুটা জুড়ে চিরহরিৎ অরণ্য আছে। সারাবছরের বৃষ্টির জল ওদিকে গড়িয়ে যায় বলেই বোধ হয় এমন ব্যতিক্রমীতা। কাবেরীর ইচ্ছে করেনি আজ যাওয়ার। বড্ড ঘুম ঘুম ভাব চোখে।
বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে নিল কাবেরী। এখনো সন্ধে নামতে বেশ বাকি। কুন্তী, কুশি এখনো ফেরেনি। কাবেরী সিঁড়ির মুখে বড় জানলার পাশে পশ্চিমমুখো চেয়ারে বসল একটা বই নিয়ে, পাপানের গুছিয়ে দেওয়া হিচকক সমগ্রটা শেষ করতে পারেনি।
----দিদিমণি...দিদিমণি ডাকটা দূর থেকে হলেও কুন্তীর বলে চিনতে অসুবিধে হল না। বেশ ভয়ার্ত হয়ে মেয়েটা ডাকছে। কী হল, অমন করে ডাকছে কেন মেয়েটা!
কাবেরী বইটা বন্ধ করে উঠে পড়ল। কুন্তী ততক্ষণে হাঁকডাক করতে করতে বারান্দায় এসে পৌঁছেছে।
---দিদিমণি! হাঁফাতে লাগলো কুন্তী।
কাবেরী ঠিক বুঝতে পারছে না। ঘটনাটা কি, এত উদ্বিগ্ন কেন কুন্তী।
---দিদিমণি মা'টা আমার জ্ঞান হারাইছে, বাপটা কাঠ কাটতে গিছে অনেকক্ষণটা। কি কইরব দিদিমণি? বুড়ি পিসি জল ঢাইলছে তাও জ্ঞানটা আইলো না।
কাবেরীও বুঝতে পারছে না কী করা দরকার। হেমেন দা'ও কাছেপিঠে নেই। এখুনি যে ডাক্তার ডাকা দরকার বেশ বুঝতে পারছে কাবেরী। আলমগীরও ছুটিতে। তা নাহলে পারতডিহি বনবাংলোর অফিসে টেলিফোন করলে একটা ব্যবস্থা করা যেত।
কাবেরী যখন কী করবে, কী করবে না, কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। তখনই হেমেন রায় ঢুকলেন। ঢুকেই বুঝতে পারলেন কিছু একটা ঘটেছে।
হেমেন দার টেলিফোনে পারত ডিহি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবু দেখে গেলেন খানিকক্ষণ আগে। জ্ঞান ফিরলেও কার্যত অসাড় হয়ে রয়েছে সাগিনা। কাঠ কেটে ফিরল বুধন। তাকে দেখে বুড়ি পিসি প্রলাপ বকতে লাগলেন ঝুপড়ির দ্বার গোড়ায়।
কাবেরী তখন সাগিনার গায়ে চাদরটা টেনে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাশে। হেমেন রায় বুধনকে সবটা বললেন খোলসা করে। ডাক্তার কী কী বলেছেন তারও একটা তালিকা করে নিতে বললেন বুধনকে।
সিলিকোসিসের রোগী সাগিনা। খনিতে কাজ করতে করতেই এই রোগের শিকার হয় খনি মজদুররা। ফুসফুস ড্যামেজ হয়েছে অনেকদিন আগেই। চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া বুধনদের মত যে কোনো খনি মজদুর পরিবারের পক্ষে অসম্ভব। ডাক্তার দিবাকর পাসোয়ান এর আগে সাঁওতাল পরগনার এমন বহু খনি শ্রমিকের চিকিৎসা করেছেন। জানেন খনিতে যারা কাজ করে তাদের পক্ষে কতটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় এমন রোগ নিয়ে লড়াই করা। তবু তিনি কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে পরিবারগুলিকে সাময়িক ক্ষান্ত করেন।
দিবাকর পাসওয়ানের মেডিসিনগুলো লক্ষ্য করল কাবেরী। আয় উপার্জনহীন বুধনের পক্ষে তা কেনাও কঠিন। সেদিন নিজের জন্য ওষুধ কিনতে পাঠানোর সময় বুধনকে পয়সা দিতে চেয়েছিল, সাগিনার ওষুধপত্র কেনার জন্য বুধন এক টাকাও নিতে চায়নি। বুধনের আত্মসম্মানবোধ সাংঘাতিক প্রথম থেকেই বুঝেছে কাবেরী। পয়সা দিলেও নেবে না।
সাগিনার মাথার নীচে শক্ত বালিশটা বুধনের বয়স্কা বুড়িদিদি টেনে সোজা করে ধরল। টুনিকে কোলে নিয়েছিল কুন্তী। ক্ষিদেয় বেচারা ততক্ষণ ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ডঃ পাসোয়ান পই পই করে বলে গেছেন সাগিনা যেন এ'সময় বুকের দুধ না দেয় বাচ্চাকে। আট মাসের টুনি মায়ের দুধটুকু ছাড়া বাইরের খাবার বলতে কিছু চেনে না এখনো। ফলে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি মাতৃদুগ্ধ ছাড়া অন্যকিছুতে।
বুধন স্থির হয়ে ছিল এতক্ষণ। ওর চোখ দুটো সাগিনার মুখমণ্ডলের ওপর আটকে আছে, ঠিক যেন বিদ্যুৎ প্রবাহে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে ও। কাবেরী দেখতে পাচ্ছিল বুধনের চোখে এক ফোঁটা জল নেই, অথচ একটা তীব্র বিষাদ আছে।
কুন্তী এসে বাপের কোলে দিল টুনিকে। পরপর তিনটে মেয়ে হওয়ার জন্য টুনিকে জন্মের পর একদিনও কোলে নেয়নি বুধন। এই প্রথমবার মেয়েটাকে কোলে নিল সে। কালো ফুটফুটে পুতুলের মত শিশুটা বাপের কোল বুঝে ওঠার জন্য জেগে নেই। সে ঘুমোচ্ছে ক্ষুধায়। কাবেরীর বড্ড মায়া পড়েছে বাচ্চাটার ওপর।
দিগা বাবা এসে পড়লেন। কাবেরীর চিনতে অসুবিধে হল না এই সাধুকে। তথাকথিত সাধুদের মত লাগে না এই দিগা বাবাকে। হাঁসড়া গ্রামের মানুষদের শ্রদ্ধার পাত্র এই লোকটি যেন একজন দার্শনিকের মত। গ্রামের দু একটা আদিবাসী বউও ভিড়েছে।
বুধনের আস্থার মানুষ এই দিগা। লাল কাপড় থেকে একটা ফুল বার করে সাগিনার মাথায় ছোঁয়ালেন তিনি। টুনিটার ঘুম ভাঙতেই আবার কেঁদে উঠল।
বুড়ি পিসি রুদালী সুরে বলে উঠলেন---মুখপুড়ির নসিবটা দেখরে বুধন, মা'টার দুধটাও পাইল না।
দিগা বাবা গ্রামের আদিবাসী বৌগুলোর দিকে চেয়ে বললেন----তুরা কেউ তো বাচ্চাটারে কয়টা দিন রাইখতে পারিস। দুধটা না পাইলে বাচ্চাটা বাঁচবেক লাই যে।
আদিবাসী বৌগুলো দাঁড়িয়ে রইল যেমন ছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল---চুনু তুর তো বুকে দুধ আছে দ্যা না।
যে বউটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, সেই বউটি মুখটা ঘোমটায় ঢেকে বললে---কুথায় আছে, শুকাই গেছে তো।
আরেকটি বউ বলে উঠল---বাবা, সান্দালের বউর বাচ্চা হছে।
দিগা বাবা বললেন----তারে ডাক দিখি।
বউটা তার সঙ্গে থাকা বাচ্চা ছেলেটাকে পাঠালো সান্দালকে ডাকতে।
কম বয়সী যুবক সান্দাল, দিগা বাবার ডাকে পড়িমরি করে ছুটে এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই---বাবা, ডাইকছেন।
---তোর বউ নাকি বাচ্চা দিছে?
---হ্ বাবা ব্যাটা হছে। মুখে আনন্দের হাসি সান্দালের।
----বুধনের বিটিটা ছোটটা আছে। বউটা অসুখটায় পইড়েছে। কয়টা দিন তোর বউটারে বাচ্চাটারে দুধ দিতে কইস।
সান্দাল কাঁচুমাচু মুখে অসম্মতির ভাব এনে বললে---বউটার ওলানে দুধটা কম হয় বাবা। বাচ্চাটারে ঠিকঠাক দিতে পারে লাই।
ক্ষেপে উঠলেন দিগা সাধু। অমন শান্ত স্নিগ্ধ মানুষটাকে এই প্রথমবার রাগত দেখল কাবেরী। বলল----যা, যা তা হইলে ইখানটা ভিড় কইরিসনি। ই হাঁসড়াটায় আমিও বড়টা হছি। মা-মাউসির দুধটা খায়ে বড় হলি, এখুন তুরা সব অমানুষটা হছিস।
ভীড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে উঠল। টুনির করুন সুরে কান্না বড্ড অস্থির করে তুলল কাবেরীকে। বুধনের কোল থেকে কেড়ে নিল সে টুনিকে। সকলকে বিস্মিত করে টুনির কান্না থেমে গেল আচমকা। মেয়েলি হাতের কোল পেয়ে সে বোধ হয় নিজের মা বলে ভুল করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাত-পা ছুঁড়ে খেলা জুড়ে দিল কাবেরীর কোলে।
হেমেন দা বললেন---ভারী দুস্টু মেয়ে তো খুকী, তোর কোলে যেতেই চুপ করে গেল!
দিগা বাবা স্থিরতা ভেঙে হাসলেন। বললেন---মা, তুই বিটিটাকে তুর কাছটা কয়টা দিন রাইখতেটা পারবি?
---সে হলে তো চিন্তা ছিল না বাবা। কিন্তু খিদে পেলে...ঐটুকু মেয়েকে এখুনি বাইরের খাবারে অভ্যস্ত করানো যায় কী করে?
দিগা বাবার মুখে মৃদু এক অদ্ভুত হাসি। যে হাসির মধ্যে একটা ত্রিকালদর্শীতার ছাপ রয়েছে যেন। কাবেরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন---জেনেটা রাইখ, এই গেরামের পাহাড়, গাছ, জন্তু, জানোয়ার, মানুষ সকলেটা ইতু দেবীর বাচ্চাটা আছে। ইতুদেবীর ওলান খেয়ে বড় হছি আমরা। দেবীর থানের পিছনটা যে খাড়া পাহাড়টা আছে, সিখান থেকে নাইমলে বেণীকুণ্ড। বেণীকুণ্ড হইল ইতু মায়ের ওলান। মুসানী জনম হছে সিখানটা। মুসানী হছে ওলানের দুধ। যে দুধ খায়ে বড় হছে হাঁসড়া। ইতু মায়ের মত তুই হইলি গিয়ে আরেকটা মা। চাসটা যদি পাইরবি বাচ্চাটাকে বাঁচাইতে।
দিগা বাবার মুখে হাঁসড়ার উপকথা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল কাবেরী। এ গ্রামের সবকিছুই প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত। তার জল-হাওয়া কেবল নয়, উপকথা-লোকাচারও প্রকৃতির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু সেই গ্রামের মানুষই কিনা একটা ক্ষুধার্ত শিশুকে কয়েকটা দিন রক্ষা করতে পারবে না! আধুনিকতার সাথে সাথে শহুরে যান্ত্রিকতা, স্বার্থপরতা এখানেও গ্রাস করছে তবে কী?
---কী রে পাইরবি না মা? দিগা বাবার কথায় ছেদ পড়ল কাবেরীর ভাবনায়।
---কী করে পারবো বাবা? ঐটুকু বাচ্চাকে...কী করে...
কথা শেষ হবার আগেই দিগা বাবা বললেন---পাইরবি, পাইরবি। আমি তোরে ওষুধ দিব, তোর ওলানটাতে দুধ আইসবে, তুই ই গেরামের সাক্ষাৎ ইতু দেবী মা, সাক্ষাৎ ইতু দেবী।
কাবেরীর কোলে তখনও ক্ষুধার্ত টুনি হাত-পা ছুঁড়ছে। মুখের দিকে চেয়ে আগুপিছু না ভেবেই কাবেরী বললে---আমি দেবী নই, বাবা। আমি সাধারণ একজন মা। আমারও দুটি ছেলে আছে, যদি বাবা সম্ভব হয়, আমি টুনিকে রাখবো।
হেমেন রায় বিস্ময়ে দেখলেন তার পিসতুতো বোন কাবেরী চক্রবর্তীর এক অনন্য মাতৃত্বের রূপ। হেমেন রায় জানেন না সত্যি সত্যিই জংলী সাধুর ওষুধে কাবেরী দুগ্ধবতী হয়ে উঠবে কিনা। আজকাল হরমোন থেরাপির মাধ্যমে যেভাবে ইন্ডিউস ল্যাক্টেশন হয়, দত্তক শিশুর মুখে মা তার দুধ তুলে দেয় কিংবা আগেকার দিনে কবিরাজের হার্বাল ওষুধের মাধ্যমে স্তনে দুগ্ধক্ষরণ বন্ধ হলে মায়েরা পুনরায় দুগ্ধক্ষরণ চালু করত, তেমনই হয়তো কিছু। কাবেরী তার স্তনদুগ্ধ টুনির মুখে তুলে দিতে পারুক না পারুক, শহুরে শিক্ষিতা একজন কলেজ শিক্ষিকা হয়ে তার মাঝে যেভাবে একজন মাতৃরূপী দেবী স্বত্বা বিরাজ করছে, তা মুগ্ধ করল হেমেনকে।
শুধু একজন নীরবে চেয়ে রইল কাবেরীর দিকে। যার মনের মণিকোঠায় তখন কেবল অনাবিল আনন্দ হচ্ছে। রাজার মত ছুটছে তখন সে ঘোড়া নিয়ে। কাবেরী তার হয়ে উঠছে আরো আপন। আপন রানী।
+++++++
সামান্য নড়াচড়া করল সাগিনা। কাবেরী এখনো বসে রয়েছে পাশে। ঝুপড়ির উঠোনে মাদুর পেতে দিগা বাবা আর হেমেন দা বসে রয়েছেন। চাঁদের আলো মুক্তার মত ছড়িয়ে রয়েছে সেখানে। কতগুলি অনুভূতি বা ধারণাকে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তেমনই এক মরমীয়াবাদী দর্শনের কথা বলছেন দিগা বাবা। হেমেন রায় এই অরণ্য বৃত্তের সাধুর তত্বকথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন।
দিগা বাবার বিশ্বাসে রয়েছে এই জগতের বাইরে অজানা এক বিমূর্ততায় আস্থা। হেমেন রায় বুঝতে পারছেন প্রাচীন গুহাবাসীদের গুহার ভেতরের ছায়ার মত জগতের বাইরে আরেক জগতের অটল বিশ্বাসের মত দিগা সাধুর বিশ্বাসের দৃঢ়তা। অথচ যে জায়গাটায় হেমেন রায়ের আকর্ষণ তৈরী হচ্ছে, সেটা হল দিগা সাধু লোকাচার, মানবজীবন ও মানবতাকে একসূত্রে গেঁথেছেন তাঁর জীবনদর্শনে। কখনো মানুষকে আলগা করেননি।
সাগিনাকে চিড়ে দলা করে খাওয়াতে লাগলো বুধন। কাবেরী লক্ষ্য করছিল স্ত্রীর প্রতি বুধনের মত কঠিন পুরুষের ভালোবাসা। যার সাথে ঘর করল, সুখে দুঃখে একসাথে পথ হাঁটলো তার প্রতি প্রেম-প্রণয়ের নদীতে অবগাহন হতে কোনো বোঝাপড়ার দরকার হয় না, আপসেই হয়ে যায়। হয়ত অরুণাভর সাথেও কাবেরীর সেই প্রেমজ সম্পর্কটা আছে, হয়ত বুধনের সাথেও সেই সম্পর্কটা জোরালো হচ্ছে দিনকেদিন। তা নাহলে স্ত্রী সেবায় রত বুধনকে দেখে এখন তার সাগিনার ওপর ঈর্ষার জন্ম হত না। এই মুহূর্তে যেমন দায়বদ্ধ পুরুষটিকে চিনতে পারছে কাবেরী, তেমন হৃদয় জর্জরিত হচ্ছে সাগিনার প্রতি বুধনের ভালোবাসা দেখে। কোনো নারীই তার প্রেমিককে ভাগ করে নিতে পারে না, সেই নারী যতই পরিণত বয়সের হোক না কেন। যদি না সেখানে ভালোবাসা শর্তাধীন হয়।
দিগা বাবা উঠে এসে বললেন---বাচ্চাটারে আজ লা হয় মা'টার কাছে রাইখিস বুধন। দুধটা খাক।
তারপর কাবেরীর দিকে চেয়ে বললেন--মা বাচ্চাটারে বুকটায় লাগায় রাখিস সবসময়। ওলানটায় মুখ লাগায় রাখিস। মা'টার ওলানে বাচ্চাটা মুখটা দিলে মা'র শরীরটাই চায় দুধটা তুইলে দিতে।
কাবেরী এ কথা জানে সন্তানের কান্না শুনে মা উতলা হয়ে ওঠে। তার শরীরে দুগ্ধ ক্ষরণ হয়। নারী শরীরে প্রোল্যাকটিন হরমোনই হল স্তনে দুধ আসার কারণ। মেয়েরা গর্ভবতী হলে এই হরমোন বেড়ে যায়। সন্তানের জন্মের পরও সঠিক ভাবে এই হরমোন উৎপাদন ব্যাহত হলে কিংবা কোনো কারণ বশতঃ স্তনে দুগ্ধক্ষরণ কিছুকাল বন্ধ হয়ে গেলে, শিশুর জন্য মায়েদের শরীরে কৃত্রিম ভাবে ওষুধের মাধ্যমেও এই হরমোন তৈরী করা যায়। এছাড়া যে নারী কখনো গর্ভবতী হয়নি, কিংবা বহু বছর তার স্তনে দুধ শুকিয়ে গেছে এমনকি মেনোপজের পর, তার পক্ষেও ওষুধ প্রয়োগে এই হরমোনের আধিক্য ঘটিয়ে দুগ্ধ উৎপাদন সম্ভব। তার জন্য নানারকম হার্বাল ওষুধও আছে। কিন্তু তা একটি কঠিন অধ্যবসায়। নিয়মিত স্তনের উদ্দীপনা এক্ষেত্রে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেক্ষেত্রে সময় অনেকখানি লেগে যেতে পারে। কিন্তু কাবেরী এই ক'দিনে কিভাবে শিশুটির মুখে দুধ তুলে দিতে পারবে!
দিগা বাবা অবশ্য ফিরে গিয়েছিলেন খানিক আগে। সন্ধ্যে নামার আগেই পাহাড়ে তার বাসস্থান থেকে নিয়ে এসেছেন এক ধরনের ছোট ছোট গুলি। সঙ্গে কিছু গোলমরিচের মত দানাদার ফল। বলেছেন কাবেরীকে এই গুলিগুলো চারবেলা খেতে, তার সাথে সকালে খালি পেটে দানাদার ফলগুলো বেটে উসুম গরম জলে মিশিয়ে পান করতে। প্রতি চার ঘণ্টা অন্তর শিশুকে তার শুষ্ক স্তন চুষতে দিতে। তাহলেই নাকি কাবেরীর মধ্যবয়স্কা স্তন আবার ভরে উঠবে সুধামৃতে। মরচে পড়া বৃন্তদুটি হতে বইবে ফল্গুধারা। কাবেরী অনিশ্চিত, সে জানে না দিগা বাবার যাদুতে সে আবার স্তন্যদায়িনী হতে পারবে কিনা। তবুও সে উদগ্রীব ক্ষুধার্ত শিশুর ক্ষুধা নিবারণ করতে, অসুস্থ মায়ের বুকের দুধ টুনিকে ক'টা দিন খেতে হবে বলে তার অস্বস্তি হচ্ছে।