01-01-2019, 04:43 PM
কোর্ট থেকে বেরিয়ে মনে হোলো কেমন বিচ্ছিরি রিএক্ট করলাম। বাংলা সিনেমার গরিব নায়কের মতন। বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে সেটা বিচ্ছেদের পথে, আর নায়ক তার রাগি কিন্তু ছোটলোক ইমেজ বজায় রাখলো, নায়িকাকে মা বাবার সামনে বেইজ্জত করে। কিন্তু সিনেমার শেষে তো নায়ক নায়িকার মিল হয়, মেরা কেয়া হোগা। পিকচার তো খতম হো চুকে হ্যায়।
আবার নতুন ডেট পেলাম। সেই মহিলা জাজ। আজ ওই উকিলকে ভিতরে থাকতে দেয়নি উনি। এদের ও দল হাল্কা আজকে। শুধু রাজুর বাপ এসেছে। তাও উদাস থাকার চেষ্টা করছে। ধন্য মা বাপ এরা। ছেলের বায়না মেটাতে কিই না করছে।
আমি জানি তুলি কিছু বলবে না। তাই আমিই বলে গেলাম।
কিন্তু আটকে গেলাম পিয়ালের দাবিতে।
আইন অনুযায়ি নাবালক সন্তান মায়ের কাছে থাকবে, মা অন্য বিয়ে করা না পর্যন্ত সন্তান আর মায়ের দায়িত্ব বাপের।
শুরু হোলো টানাপোরেন। আমি বাঁধা দিলাম। বললাম ‘সন্তান জন্মে বাবার যেমন ভাগ আছে, সেরকম ছেলেকে কাছে পাওয়ার দাবিও আমার আছে। আমি কেন বঞ্চিত হবো?
তুলি এই প্রথম মুখ খুললো ‘না ছেলে আমার কাছে থাকবে তাহলে ভালো থাকবে’
-আমার কাছে কেন ভালো থাকবে না? ছেলের মা তো আরেকবার বিয়ে করবে, তখন সেই ঘরের সন্তান হলে একে কে দেখবে?
-আমি অন্য বিয়ে করবো না।
-সেটা তর্কের খাতিরে বলা হচ্ছে, কিন্তু সত্যি না। সবাই এই বিচ্ছেদের দিকে তাকিয়ে আছে, ওর হবু শশুর মশাই বাইরেই দারিয়ে আছে ছেলের জন্যে সোনার হরিন খাঁচায় পুরবে বলে, নাহলে কার ঠেকা পরেছে, জানা নেই শোনা নেই অন্যের মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ করানোর জন্যে, তাকে অবৈধ ভাবে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিতে।’
-দেখুন মিঃ মুখার্জি, আইনতঃ শিশু সন্তানের প্রধান দাবিদার তার মা, কারন শিশু বলে তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছের কথা কোর্ট শোনেনা, সেটাও এই কারনেই যে ওরা ভালো মন্দ বোঝেনা। আইনগত ভাবে আমরা একটা কথা বলতে পারি যে আপনার সাথে ওর সপ্তাহে বা মাসে একবার করে দেখা করার কথা।
-সেটা ঠিক আছে আমি আদালতের নির্দেশ মেনে নিলাম, কিন্তু ওর যখন বিয়ে হয়ে যাবে, ও কি সেই মা হয়ে থাকতে পারবে?
তুলি ঝাজিয়ে উঠলো ‘সেটা যখন হবে তখন দেখা যাবে? দরকার হলে ওকে বোর্ডিং কলেজে দিয়ে দেওয়া হবে? কিন্তু পরে কি হবে সেটা এখানে আলোচ্য না।’
-উনি ঠিক বলেছেন, সেরকম কিছু হলে আপনি ভবিষ্যতে আবার এপিল করতে পারেন ছেলেকে নিজের কাছে রাখবেন বলে, আদালত এখন এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারবেনা। বড় জোর সপ্তাহে বা মাসে একবার দেখা করার সুযোগ করে দিতে পারা যেতে পারে, সেই সু্যোগ রয়েছে।
আমি টেবিলের ওপরই মাথা ঝুকিয়ে দিলাম। আটকাতে পারলাম না কেঁদে দিলাম। বাইরের জগত এই প্রথম আমার চোখের জল দেখতে পেলো।
-নিজেকে ঠিক রাখুন মিঃ মুখার্জি, এখনো বেশ কিছু কাজ বাকি আছে।
আমি নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। চোখের জল মুছে নিয়ে বললাম ‘দিন কাগজ দিন কোথায় সই করতে হবে বলুন?’
সই করতে করতেই জাজ বললেন, পুরো ফরমালিটী সম্পুর্ন হোতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। আপনাদের উকিল কে বলবেন খোঁজ রাখতে। ওরা জানে কি করতে হয়।
-এর মাঝে কি আমি আমার ছেলের সাথে দেখা করতে পারবো?
-হ্যাঁ হ্যাঁ কেন পারবেন না। নিশ্চয় পারবেন।
-সেটা কি আমি ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসতে পারবো?
-সেটা আপনারা ঠিক করে নিন নিজেদের মধ্যে। আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। আপনি যদি দেখা করতে না পারেন তাহলে আবার আপনাকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে।
-দয়া করে আমার প্রাক্তন ম্যাডাম কে বলে দিন যেন আমার সাথে ছেলের একটু দেখা করতে দেয়, আর কোথায় যাবো ওকে দেখতে বা আনতে সেই ঠিকানা যদি দেয়।
-নিশ্চয় দেবেন, দেবেন না কেন? এরকম ভাবছেন কেন? আনি যেমন বাবা, উনিও তো মা। কি দেবেন না নাকি।
তুলি চুপ করেই রইলো। চোখে অদ্ভুত শুন্যতা।
আমি এগিয়ে গেলাম ওদের তিনজন কে ফেলে। চারিদিকে কেমন শুন্যতা। বাবা আবার চলে গেছে বাইরে। কবে ফিরবে কোন ঠিক নেই। আবার চারদেওয়ালের মাঝে বন্দি আমি। নাঃ কাল থেকে অফিস শুরু করবো। এই নিস্তব্ধতা আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।
মনের মধ্যে থেকে এই ব্যাপার টা ঝাঁটা দিয়ে তাড়াতে হবে। ভুল করেছি শাস্তি পেয়েছি। মানুষের জীবন সবসময় একই খাতে বয়ে চলেনা। আবার আমাকে জিবনে ফিরতে হবে।
কোথায় জীবন, এই মনের জোর খুব ক্ষণস্থায়ী। আবার স্বজনহারা আমির হাহাকার চারিদিকে প্রতিফলিত থাকলো। হেরে গেলাম আমি। সাজানো ফুলের বাগানে কার নজর পরলো যে আমি এখন সর্বহারা।
পিয়াল কে দেখতে যাওয়ার দিন এখন আমার বাঁচার প্রেরনা। কিন্তু ওখান থেকে আগের দিনই খবর এলো পিয়ালের খুব জ্বর ও দেখা করার সুযোগ পাবেনা। সুস্থ হলে আমাকে খবর দেওয়া হবে।
এভাবে দুতিন বার প্রত্যাখাত হওয়ার পরে ওদের ডেরাতেই হানা দেবো ঠিক করলাম। ল্যাংটার নেই বাটপারের ভয়।
সিকিওরিটী আর আমার কাছে কি এমন ব্যাপার। কুড়ি টাকা করে গুজে দিলাম, বললাম, বন্ধু, গিয়ে চমকে দেবো তাই লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছি।
অনেক বড় যায়গা বাড়ীতে। ধিরে ধিরে আমি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। পিয়ালের আওয়াজ পাচ্ছি। প্রচন্ড খেলছে। দস্যিপনা করে বেরাচ্ছে। আমাকে দেখে কি করবে কি জানি। কারা মনে হয় আসছে।
একটু লুকিয়ে পরলাম। লুকানোর অনেক জায়গা।
সুমতিদি মনে হোলো কাজের লোকের টিমটা লিড করছে।
-কি দস্যি ছেলেরে বাবা। চুলের মুঠি ধরে কেমন টান দিলো দেখলি। মা বাপের ছারাছারি হয়ে গেলো কোন বিকার নেই। বাব্বাঃ যে পারে সে খেলুক ওর সাথে। আর ওর মাকে দেখেছিস, এখন থেকে শাড়ি গয়না পছন্দ করতে শুরু করে দিয়েছে। সেই কবে বিয়ে তার ঠিক নেই। কেউ বলবে বর ছেরে দিয়েছে, এক বাচ্চার মা। কোন বিকার আছে...।
দলটা ধিরে ধিরে মিলিয়ে গেলো। পিয়ালের আওয়াজে গম গম করছে বাড়ি।
আমি শব্দের উৎসের সন্ধানে আস্তে আস্তে পৌছে গেলাম গন্তব্যে। দরজা ঠেললেই পিয়াল কে দেখতে পাবো।
মুখোমুখি হোলাম তুলির। সেই ঘরে তুলিও রয়েছে। হাতে একটা বিদেশি মেয়েদের ম্যাগাজিন, সম্ভবত রুপ চর্চার। নতুন জীবন শুরুর প্রস্তুতি চলছে।
-তুমি? তুমি এখানে কেন?
-আমি পিয়াল কে দেখতে এসেছি। তোমাকে না।
-এ ভাবে চোরের মতন? কেউ তো খবর দেয়নি?
পিয়াল ফুটবলে লাথি মারা থামিয়ে আমাকে আর তুলিকে দেখছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। তুলি বলে উঠলো। ‘দাড়াও ও সুস্থ না, তোমাকে বলা হয়েছে আগেই’
-ও সুস্থ কি অসুস্থ সেটা তো আমি দেখতে পাচ্ছি। কোর্ট থেকে তো বলেইছে যে আমার দেখার অধিকার আছে।
-সেটা এভাবে চোরের মতন না।
-চোরের মতন?
-না তো কি?
- কি বলছো তুমি তুলি?
-আমাকে তুমি নাম ধরে ডাকবে না। সেই অধিকার তোমার নেই। আর শুনে রাখো আমরা কাগজ হাতে পেয়ে গেছি। গতকালই।
-আমিতো পাইনি।
-সেটা তো আমি বলতে পারবো না।
-তুলি আমি তো তোমাকে আটকাইনি, শুধু পিয়াল কে দেখতে চেয়েছি। সেই অধিকার তো কোর্ট আমাকে দিয়েছেই কিন্তু এছারাও তো আমার একটা অধিকার আছে।
-চুপ করো তুমি? অধিকার ফলাতে এসোনা। তুলি দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল।
পিয়াল দৌড়ে তুলির কাছে চলে গেলো। ‘মা মা কাঁদছো কেন? বাপিটা সত্যি পঁচা, খালি তোমাকে কাঁদায় তাই না? যাও আমি গেট আউট করে দিচ্ছি। গেট আউট গেট আউট গেট আউট।’
ঝাপ্সা চোখে বেরিয়ে আসছি। পা টলমল করছে। মাথা ঘুরছে। মাথা ঘুরে ওই সর্পিল রাস্তায় পরে গেলাম জ্ঞ্যান হারিয়ে।
জ্ঞ্যান ফিরলো যখন তখন দেখি সরকারি হাস্পাতালের বেডে। ভালো করে খেয়াল করে দেখি হাতে হাতকড়া।
হাল্কা মনে পরছে, পিয়ালের গলা তন্দ্রার মধ্যেই পাচ্ছিলাম ‘মা দেখো বাবা দুষ্টূ করেছে বলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, এবার মজা টের পাবে, আর তোমাকে কাঁদাবে না’ সত্যি কি শুনেছিলাম?
কয়েকদিন পরে জামিন পেয়ে বাড়ি যখন ফিরলাম, দেখলাম অফিস থেকে চিঠি এসেছে। চুরির দায়ে অভিযুক্ত অভিষেক মুখার্জি বহিষ্কৃত। সল্টলেকের গুপ্তা ম্যানশানে চুরি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পরা অপরাধি। বহুমুল্য দ্রব্য উদ্ধার হয়েছে আমার থেকে।
কোন শর্তেই বেরোনোর ইচ্ছে ছিলোনা আমার, ভেবেছিলাম ভালোই তো এখানেই থেকে যায়। দাগি অপরাধিদের সাথে থেকে যদি কিছু সেখা যায় এই লাইনে।
কিন্তু বাবা কিভাবে খবর পেয়ে কাকে ফোনটোন করে আমাকে ছারিয়ে দিলো। আমার সাথে ফোনে কথা হোলো বাবার। আমি সব খুলে বললাম।
আমাকে উপদেশ দিলেন এইভাবে নিজের জীবন শেষ না করতে। জীবন অনেক পরিক্ষা নেবে আমার থেকে।
আমি কোথায় শেষ করছি। কিন্তু এখন কি করবো। লড়তে পারি। সুনাম চাকরি অনায়াসে ফিরে পেতে পারি। রাজুদের শিল্পর নামে ফোলানো বেলুনটা ফট করে ফাটিয়ে দিতে পারি। কারন রাজ্যের দেশের অনেক দণ্ডমুণ্ডের অধিকর্তাদের আমি কাকু বা জেঠু ডাকি।
কিন্তু কেন করবো। আমি তো শাস্তি পেতে চাই। আমার উচিৎ নির্বাসনে যাওয়া।
তাই আসবাবপত্র সব পরিস্কার করে চাদর দিয়ে ঢেকে, শেষ বারের মতন ইন্টারনেট খুললাম। চেন আমার পুরানো চিনা বন্ধু ওর সাথে যোগাযোগ করলাম।
ভিসা পেতে কয়েকদিন সময় লাগলো।
এই সুযোগে ঘরের থেকে পিয়াল আর তুলির সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেললাম। রাগে নয়। যাতে করে এই স্মৃতি ওদের ভবিষ্যতের কাঁটা হয়ে না দাঁড়ায়।
সেই উকিলের সাথে দেখা হোলো। অনেক ক্ষমা চাইলো সব কিছুর জন্যে। ঠাড়েঠোড়ে তুলি আর রাজুর রেজিস্ট্রির দায়িত্বও যে ও পেয়েছে সেটা জানিয়ে দিলো।
আমি এখন এসব কিছুর উর্ধ্বে। আমি স্বেচ্ছা নির্বাসনে চললাম। বাবাকে বলেছি খোঁজ কোরোনা। হয়তো এ জিবনে আর দেখা হবেনা। আর যদি হয় সেটা আমাদের পরম আনন্দের দিন হবে। সেদিন তুমি তোমার বিশুদ্ধ ছেলেকে পাবে। সেদিন হয়তো আমাদের জিবনে আর ফিরে আসবেনা। তবুও এক সন্তানহারা পিতা কি আরেক পিতাকে দুঃখ দিতে পারে।
এই বলে আমি আমার সুদির্ঘ্য বক্তব্য শেষ করলাম।
আবার নতুন ডেট পেলাম। সেই মহিলা জাজ। আজ ওই উকিলকে ভিতরে থাকতে দেয়নি উনি। এদের ও দল হাল্কা আজকে। শুধু রাজুর বাপ এসেছে। তাও উদাস থাকার চেষ্টা করছে। ধন্য মা বাপ এরা। ছেলের বায়না মেটাতে কিই না করছে।
আমি জানি তুলি কিছু বলবে না। তাই আমিই বলে গেলাম।
কিন্তু আটকে গেলাম পিয়ালের দাবিতে।
আইন অনুযায়ি নাবালক সন্তান মায়ের কাছে থাকবে, মা অন্য বিয়ে করা না পর্যন্ত সন্তান আর মায়ের দায়িত্ব বাপের।
শুরু হোলো টানাপোরেন। আমি বাঁধা দিলাম। বললাম ‘সন্তান জন্মে বাবার যেমন ভাগ আছে, সেরকম ছেলেকে কাছে পাওয়ার দাবিও আমার আছে। আমি কেন বঞ্চিত হবো?
তুলি এই প্রথম মুখ খুললো ‘না ছেলে আমার কাছে থাকবে তাহলে ভালো থাকবে’
-আমার কাছে কেন ভালো থাকবে না? ছেলের মা তো আরেকবার বিয়ে করবে, তখন সেই ঘরের সন্তান হলে একে কে দেখবে?
-আমি অন্য বিয়ে করবো না।
-সেটা তর্কের খাতিরে বলা হচ্ছে, কিন্তু সত্যি না। সবাই এই বিচ্ছেদের দিকে তাকিয়ে আছে, ওর হবু শশুর মশাই বাইরেই দারিয়ে আছে ছেলের জন্যে সোনার হরিন খাঁচায় পুরবে বলে, নাহলে কার ঠেকা পরেছে, জানা নেই শোনা নেই অন্যের মেয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ করানোর জন্যে, তাকে অবৈধ ভাবে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিতে।’
-দেখুন মিঃ মুখার্জি, আইনতঃ শিশু সন্তানের প্রধান দাবিদার তার মা, কারন শিশু বলে তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছের কথা কোর্ট শোনেনা, সেটাও এই কারনেই যে ওরা ভালো মন্দ বোঝেনা। আইনগত ভাবে আমরা একটা কথা বলতে পারি যে আপনার সাথে ওর সপ্তাহে বা মাসে একবার করে দেখা করার কথা।
-সেটা ঠিক আছে আমি আদালতের নির্দেশ মেনে নিলাম, কিন্তু ওর যখন বিয়ে হয়ে যাবে, ও কি সেই মা হয়ে থাকতে পারবে?
তুলি ঝাজিয়ে উঠলো ‘সেটা যখন হবে তখন দেখা যাবে? দরকার হলে ওকে বোর্ডিং কলেজে দিয়ে দেওয়া হবে? কিন্তু পরে কি হবে সেটা এখানে আলোচ্য না।’
-উনি ঠিক বলেছেন, সেরকম কিছু হলে আপনি ভবিষ্যতে আবার এপিল করতে পারেন ছেলেকে নিজের কাছে রাখবেন বলে, আদালত এখন এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারবেনা। বড় জোর সপ্তাহে বা মাসে একবার দেখা করার সুযোগ করে দিতে পারা যেতে পারে, সেই সু্যোগ রয়েছে।
আমি টেবিলের ওপরই মাথা ঝুকিয়ে দিলাম। আটকাতে পারলাম না কেঁদে দিলাম। বাইরের জগত এই প্রথম আমার চোখের জল দেখতে পেলো।
-নিজেকে ঠিক রাখুন মিঃ মুখার্জি, এখনো বেশ কিছু কাজ বাকি আছে।
আমি নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। চোখের জল মুছে নিয়ে বললাম ‘দিন কাগজ দিন কোথায় সই করতে হবে বলুন?’
সই করতে করতেই জাজ বললেন, পুরো ফরমালিটী সম্পুর্ন হোতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। আপনাদের উকিল কে বলবেন খোঁজ রাখতে। ওরা জানে কি করতে হয়।
-এর মাঝে কি আমি আমার ছেলের সাথে দেখা করতে পারবো?
-হ্যাঁ হ্যাঁ কেন পারবেন না। নিশ্চয় পারবেন।
-সেটা কি আমি ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসতে পারবো?
-সেটা আপনারা ঠিক করে নিন নিজেদের মধ্যে। আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। আপনি যদি দেখা করতে না পারেন তাহলে আবার আপনাকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে।
-দয়া করে আমার প্রাক্তন ম্যাডাম কে বলে দিন যেন আমার সাথে ছেলের একটু দেখা করতে দেয়, আর কোথায় যাবো ওকে দেখতে বা আনতে সেই ঠিকানা যদি দেয়।
-নিশ্চয় দেবেন, দেবেন না কেন? এরকম ভাবছেন কেন? আনি যেমন বাবা, উনিও তো মা। কি দেবেন না নাকি।
তুলি চুপ করেই রইলো। চোখে অদ্ভুত শুন্যতা।
আমি এগিয়ে গেলাম ওদের তিনজন কে ফেলে। চারিদিকে কেমন শুন্যতা। বাবা আবার চলে গেছে বাইরে। কবে ফিরবে কোন ঠিক নেই। আবার চারদেওয়ালের মাঝে বন্দি আমি। নাঃ কাল থেকে অফিস শুরু করবো। এই নিস্তব্ধতা আমি আর সহ্য করতে পারছিনা।
মনের মধ্যে থেকে এই ব্যাপার টা ঝাঁটা দিয়ে তাড়াতে হবে। ভুল করেছি শাস্তি পেয়েছি। মানুষের জীবন সবসময় একই খাতে বয়ে চলেনা। আবার আমাকে জিবনে ফিরতে হবে।
কোথায় জীবন, এই মনের জোর খুব ক্ষণস্থায়ী। আবার স্বজনহারা আমির হাহাকার চারিদিকে প্রতিফলিত থাকলো। হেরে গেলাম আমি। সাজানো ফুলের বাগানে কার নজর পরলো যে আমি এখন সর্বহারা।
পিয়াল কে দেখতে যাওয়ার দিন এখন আমার বাঁচার প্রেরনা। কিন্তু ওখান থেকে আগের দিনই খবর এলো পিয়ালের খুব জ্বর ও দেখা করার সুযোগ পাবেনা। সুস্থ হলে আমাকে খবর দেওয়া হবে।
এভাবে দুতিন বার প্রত্যাখাত হওয়ার পরে ওদের ডেরাতেই হানা দেবো ঠিক করলাম। ল্যাংটার নেই বাটপারের ভয়।
সিকিওরিটী আর আমার কাছে কি এমন ব্যাপার। কুড়ি টাকা করে গুজে দিলাম, বললাম, বন্ধু, গিয়ে চমকে দেবো তাই লুকিয়ে লুকিয়ে যাচ্ছি।
অনেক বড় যায়গা বাড়ীতে। ধিরে ধিরে আমি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। পিয়ালের আওয়াজ পাচ্ছি। প্রচন্ড খেলছে। দস্যিপনা করে বেরাচ্ছে। আমাকে দেখে কি করবে কি জানি। কারা মনে হয় আসছে।
একটু লুকিয়ে পরলাম। লুকানোর অনেক জায়গা।
সুমতিদি মনে হোলো কাজের লোকের টিমটা লিড করছে।
-কি দস্যি ছেলেরে বাবা। চুলের মুঠি ধরে কেমন টান দিলো দেখলি। মা বাপের ছারাছারি হয়ে গেলো কোন বিকার নেই। বাব্বাঃ যে পারে সে খেলুক ওর সাথে। আর ওর মাকে দেখেছিস, এখন থেকে শাড়ি গয়না পছন্দ করতে শুরু করে দিয়েছে। সেই কবে বিয়ে তার ঠিক নেই। কেউ বলবে বর ছেরে দিয়েছে, এক বাচ্চার মা। কোন বিকার আছে...।
দলটা ধিরে ধিরে মিলিয়ে গেলো। পিয়ালের আওয়াজে গম গম করছে বাড়ি।
আমি শব্দের উৎসের সন্ধানে আস্তে আস্তে পৌছে গেলাম গন্তব্যে। দরজা ঠেললেই পিয়াল কে দেখতে পাবো।
মুখোমুখি হোলাম তুলির। সেই ঘরে তুলিও রয়েছে। হাতে একটা বিদেশি মেয়েদের ম্যাগাজিন, সম্ভবত রুপ চর্চার। নতুন জীবন শুরুর প্রস্তুতি চলছে।
-তুমি? তুমি এখানে কেন?
-আমি পিয়াল কে দেখতে এসেছি। তোমাকে না।
-এ ভাবে চোরের মতন? কেউ তো খবর দেয়নি?
পিয়াল ফুটবলে লাথি মারা থামিয়ে আমাকে আর তুলিকে দেখছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। তুলি বলে উঠলো। ‘দাড়াও ও সুস্থ না, তোমাকে বলা হয়েছে আগেই’
-ও সুস্থ কি অসুস্থ সেটা তো আমি দেখতে পাচ্ছি। কোর্ট থেকে তো বলেইছে যে আমার দেখার অধিকার আছে।
-সেটা এভাবে চোরের মতন না।
-চোরের মতন?
-না তো কি?
- কি বলছো তুমি তুলি?
-আমাকে তুমি নাম ধরে ডাকবে না। সেই অধিকার তোমার নেই। আর শুনে রাখো আমরা কাগজ হাতে পেয়ে গেছি। গতকালই।
-আমিতো পাইনি।
-সেটা তো আমি বলতে পারবো না।
-তুলি আমি তো তোমাকে আটকাইনি, শুধু পিয়াল কে দেখতে চেয়েছি। সেই অধিকার তো কোর্ট আমাকে দিয়েছেই কিন্তু এছারাও তো আমার একটা অধিকার আছে।
-চুপ করো তুমি? অধিকার ফলাতে এসোনা। তুলি দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল।
পিয়াল দৌড়ে তুলির কাছে চলে গেলো। ‘মা মা কাঁদছো কেন? বাপিটা সত্যি পঁচা, খালি তোমাকে কাঁদায় তাই না? যাও আমি গেট আউট করে দিচ্ছি। গেট আউট গেট আউট গেট আউট।’
ঝাপ্সা চোখে বেরিয়ে আসছি। পা টলমল করছে। মাথা ঘুরছে। মাথা ঘুরে ওই সর্পিল রাস্তায় পরে গেলাম জ্ঞ্যান হারিয়ে।
জ্ঞ্যান ফিরলো যখন তখন দেখি সরকারি হাস্পাতালের বেডে। ভালো করে খেয়াল করে দেখি হাতে হাতকড়া।
হাল্কা মনে পরছে, পিয়ালের গলা তন্দ্রার মধ্যেই পাচ্ছিলাম ‘মা দেখো বাবা দুষ্টূ করেছে বলে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, এবার মজা টের পাবে, আর তোমাকে কাঁদাবে না’ সত্যি কি শুনেছিলাম?
কয়েকদিন পরে জামিন পেয়ে বাড়ি যখন ফিরলাম, দেখলাম অফিস থেকে চিঠি এসেছে। চুরির দায়ে অভিযুক্ত অভিষেক মুখার্জি বহিষ্কৃত। সল্টলেকের গুপ্তা ম্যানশানে চুরি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পরা অপরাধি। বহুমুল্য দ্রব্য উদ্ধার হয়েছে আমার থেকে।
কোন শর্তেই বেরোনোর ইচ্ছে ছিলোনা আমার, ভেবেছিলাম ভালোই তো এখানেই থেকে যায়। দাগি অপরাধিদের সাথে থেকে যদি কিছু সেখা যায় এই লাইনে।
কিন্তু বাবা কিভাবে খবর পেয়ে কাকে ফোনটোন করে আমাকে ছারিয়ে দিলো। আমার সাথে ফোনে কথা হোলো বাবার। আমি সব খুলে বললাম।
আমাকে উপদেশ দিলেন এইভাবে নিজের জীবন শেষ না করতে। জীবন অনেক পরিক্ষা নেবে আমার থেকে।
আমি কোথায় শেষ করছি। কিন্তু এখন কি করবো। লড়তে পারি। সুনাম চাকরি অনায়াসে ফিরে পেতে পারি। রাজুদের শিল্পর নামে ফোলানো বেলুনটা ফট করে ফাটিয়ে দিতে পারি। কারন রাজ্যের দেশের অনেক দণ্ডমুণ্ডের অধিকর্তাদের আমি কাকু বা জেঠু ডাকি।
কিন্তু কেন করবো। আমি তো শাস্তি পেতে চাই। আমার উচিৎ নির্বাসনে যাওয়া।
তাই আসবাবপত্র সব পরিস্কার করে চাদর দিয়ে ঢেকে, শেষ বারের মতন ইন্টারনেট খুললাম। চেন আমার পুরানো চিনা বন্ধু ওর সাথে যোগাযোগ করলাম।
ভিসা পেতে কয়েকদিন সময় লাগলো।
এই সুযোগে ঘরের থেকে পিয়াল আর তুলির সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেললাম। রাগে নয়। যাতে করে এই স্মৃতি ওদের ভবিষ্যতের কাঁটা হয়ে না দাঁড়ায়।
সেই উকিলের সাথে দেখা হোলো। অনেক ক্ষমা চাইলো সব কিছুর জন্যে। ঠাড়েঠোড়ে তুলি আর রাজুর রেজিস্ট্রির দায়িত্বও যে ও পেয়েছে সেটা জানিয়ে দিলো।
আমি এখন এসব কিছুর উর্ধ্বে। আমি স্বেচ্ছা নির্বাসনে চললাম। বাবাকে বলেছি খোঁজ কোরোনা। হয়তো এ জিবনে আর দেখা হবেনা। আর যদি হয় সেটা আমাদের পরম আনন্দের দিন হবে। সেদিন তুমি তোমার বিশুদ্ধ ছেলেকে পাবে। সেদিন হয়তো আমাদের জিবনে আর ফিরে আসবেনা। তবুও এক সন্তানহারা পিতা কি আরেক পিতাকে দুঃখ দিতে পারে।
এই বলে আমি আমার সুদির্ঘ্য বক্তব্য শেষ করলাম।