Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
আগের পর্বের কিছু অংশ......
ভাবলাম ও সেই জন্যে ও অনেক দিন থেকে আমার সামনে গালি দেয় না? রাকা শেষ কথাটা বলে খাওয়া হয়ে যাওয়া কাপ টা, ছাদের মাঝে একটা পিলারে রেখে এগিয়ে গেল সামনে দিকে। আমি ওকে দেখছিলাম। আমি ছুটে গিয়ে লাফ মেরে ওর পিঠে চেপে পরলাম।
- আরে কি করছিস? নাম নাম।
আমি ধরে রেখেছিলাম ওকে। ছাড়ছিলাম না । কিন্তু সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মা আসছে। আমাদের দেখে মা থমকে গেল। পরক্ষনেই সামলে নিল। আমি মা কে দেখে নেমে পরলাম। রাকা বেচারী ভ্যাবলাম মতন তাকিয়ে রইল। মা একবার দেখে নিল চারিদিক। কেন কে জানে?
পর্ব আট
সেদিন রাতে খেয়ে দেয়ে, মা আমার ঘরে গিয়ে আমার চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছিল। আমার বেশ ভাল লাগে মা চুলে তেল লাগিয়ে দিলে। আমি চুপ করে বসে ছিলাম। হরমোনাল ইফেক্ট এ মাথায় যন্ত্রণা হয় একটা সব সময়ে। হালকা, কিন্তু খেয়াল করলে দেখি, একটা ব্যাথা থাকেই।তাই বেশ করে টেনে টেনে চুলে তেল দিলে খুব আরাম পাই। আমি মাথাটা পিছনে হেলিয়ে ছিলাম। চোখ বুজে আসছিলো আরামে। চুল টা পিঠ অব্দি লম্বা ও হয়েছে। মা বলেছে পার্লার এ নিয়ে যাবে আমাকে। আমাকে আর বোন কে একসাথে। এই সময়ে মা বলল
- হ্যাঁ রে তুই রাকার পিঠে চেপে ঘুরছিলি কেন?
ভাবলাম তাতে আর কি আছে। কত তো ঘুরেছি ওর পিঠে চেপে। কিছু বললাম না মা কে। কিছু বললেই ঝাড় খাব, সকালে দেখেই বুঝেছিলাম, মা রেগে গেছিল। তার থেকে মা কি বলে শুনি আগে। সাড়া দিলাম না দেখে মা বলল
- তোর এখন ব্রেস্ট বড় হয়ে গেছে না? ও বেচারী অস্বস্তি তে পরে গেছিল। আর যেন না দেখি কোন দিন।
মায়ের কথাটার সাথেই বুকের মধ্যে একটা চিনচিনানি ভাব বুঝতে পারলাম। সকালেই ওর ঘাড়ে ঝাঁপানোর সময়ে ব্যাথা টা পেয়েছিলাম আমি। আর এখন আমার ব্রেস্ট এ সামান্য টোকা লাগলেও মনে হয় প্রান টা বেড়িয়ে আসবে, এতো টন টন করে। আমি বেশী কিছু না বলে শুধু ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম মা কে। আমি ভাবিনি এটা আগে। রাকা কে বলতেই হবে।
মা চলে গেলে আমি রাকা কে ফোন করলাম। বললাম
- কি রে পড়তে বসেছিলি?
- ধুর। সারা দিন এতো পড়েছি আমি, তারপরে ঘুম না এলেও আর পড়তে ভালো লাগছে না। তুই নিশ্চয়ই পড়বি এখন?
- হুম।
- পড়, আমাকে ফোন করলি কি করতে? আমাকে ও কি পড়তে বসতে হবে নাকি এখন? প্লিস ভাই আমাকে ছেড়ে দে আজকে। মাথা ঘুরছে আমার।
আমি ওর কথায় গুরুত্ব দিলাম না। ওকে বললাম
- আজকে মা আমাকে বকল।
- কেন? কি করেছিলি?
- তোর ঘাড়ে চেপেছিলাম বলে।
- তাতে বকলেন কেন কাকিমা?
- বলল আমার নাকি ব্রেস্ট বড় হয়ে গেছে। আর তুই ছেলে। বলে দিল কোন দিন যেন না দেখি এমনি।
খানিক চুপ করে রইল রাকা। তারপরে বলল
- ঠিক ই তো বলেছে। হুড়ুম করে ঘাড়ে চাপতে গেলি কেন?
- এই তুই থাম। বেশ করেছি। আমি তোকে কথাটা জানালাম। কোন মন্তব্য করতে বলিনি।
- আবার বলে? বেশ করেছি কি? ঠিক ই বলেছে কাকিমা। খুব বড় হয়েছে তোর ব্রেস্ট।
- চুপ কর। ফালতু কথা বললে কিন্তু লাথি জুটবে।
- রক্ষে কর। ফুটবল খেলা পায়ের লাথি খেলে আর দেখতে হবে না। এখন জানিস আমি মারতে পারব না , তোকে খিস্তী দিতে পারব না। মারবি বৈকি।
- ঠিক হয়েছে।
- যাক এবারে ঘুমো। ভাই কালকেও কি পড়তে যেতে হবে?
- হ্যাঁ অবশ্যই।
- তুই তো নিজের পড়া পড়িস। আমার দিকে তাকাস ও না। আমাকে বলে দিস কি পড়তে হবে, আমি বাড়িতে পড়ে নেব। তোর সামনে পড়ার কি দরকার?
- না না তুই পড়বি না আমি জানি বাড়িতে। চুপচাপ এখানে চলে আসবি। মনে থাকে যেন। ভুল যেন না হয়।
- হিটলার সালা।
আমি মুখ টা টিপে হেসে ফেললাম। ওকে বললাম
- ওই ,শোন
- কি
- তুই না টেন্থ এর পরে কলকাতা যাবি।
- কোন দুঃখে
- কোনো দুঃখে না। ওখানে ফুটবল কোচিং এ ভর্তি হবি।
- কে বলল?
খেকিয়ে গেলাম আমি
- কে আবার বলবে? আমি বলছি তো।
- বালের কথা বলিস না তো।
- এই খিস্তী মারলি?
- সরি সরি
- না না মেরেই যখন দিয়েছিস তখন অন্যায় করেছিস। আমি আন্টি কে বলে দেব।
- আবার?
- তবে আমার কথা শোন
- কি কথা? কলকাতায় খেলতে যাবার কথা?
- হুম
- যা ভাগ।
- প্লিস
- কি প্লিস। ফোন রাখ।
- প্লিস
- আরে? কোন প্লিস না
- প্লিস প্লিস প্লিস
- আজব ঝামেলা তো। জোর করে পড়াশোনা করাস, ঠিক আছে। কিন্তু এই রকম অত্যাচার করবি না কিন্তু।
- প্লিস প্লিস
- আচ্ছা আচ্ছা
চুড়ান্ত বিরক্ত হয়ে শেষের কথা টা বলল রাকা। আমি তাতেই খুশী হয়ে বললাম
- ঠিক তো? কথা দিলি কিন্তু
- উফফফ। হ্যাঁ রে ভাই। তুই ঘুমো, পড় যা খুশী কর, আমাকে মুক্তি দে। আমাকে ঘুমোতে দে। দয়া কর আমাকে।
- আচ্ছা আচ্ছা ঘুমো। অনেক পড়েছিস সারাদিনে। গুড নাইট। কালকে চলে আসবি। মনে থাকবে?
- হুম গুড নাইট।
রাকা কে এখন বেশ লাগে আমার। না মানে আগেও ভালো লাগত। কিন্তু এখন বেশ অন্য রকম ভালো লাগা। জানিনা হয়ত ইস্ট্রোজেনের প্রভাব। ডক্টর বলেছিল, ছেলেদের ভাল লাগতে পারে। ছেলেদের গন্ধ ভাল লাগতে পারে। আমি পড়তে বসে পড়লাম। শরীরে লাখো সমস্যা কিন্তু মন টা আমার ভালো হয়ে আছে। আমাকে খুব ভালো নাম্বার পেতেই হবে।
পাশ করলাম অনেক নাম্বার পেয়ে। প্রথম হলাম কলেজ থেকে আর রুদ্রপুর থেকে। রাকাও পাশ করল প্রায় ৮৩ পারসেন্ট পেয়ে। আমার থেকেও রাকার নাম্বার এ আমার বেশী আনন্দ হয়েছিল। আমাদের ক্লাসের তথাকথিত ভালো ছেলেরাও রাকার নাম্বার দেখে বেশ অবাক। ততদিনে আমি বেশ ডাকসাইটে সুন্দরী হয়ে গেছি। আমার কনফিডেন্স তখন তুঙ্গে। পাশ করার পরেই আমরা ভর্তি হয়ে গেলাম কলেজে আবার। আমি সায়েন্স নিলাম। আর রাকা নিল কমার্স। আমি জোর করিনি। জানতাম আমি এবারে ওকে কলকাতায় পাঠাব যে করেই হোক। খেলতে গেলে বেশী পড়ার চাপ দিলে চলবে না ওকে। তাই কমার্স এ আপত্তি করিনি। না হলে সায়েন্স তো নেওয়া করাতাম ই আমি।
রাস্তা ঘাটে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা চলে। কিন্তু একবার যে আমাকে সামনা সামনি দেখে সে আর কোন কথা বলতে পারে না। আমার সৌন্দর্যে হারিয়ে যায়। তাই আজকে আমি দাগ হীন এক মেয়ে। এতো দিন সময় লেগেছে রুদ্র পুরের সবার আমাকে চিনতে। আর যেহেতু আমি নিজের ইচ্ছেয় মেয়ের জীবন বেছে নিয়েছি, আমি চেস্টা করি সব সময়েই সফট থাকতে। তাতে যে আমাকে পছন্দ করে তার সাথেও আর যে করে না তার সাথেও। তাই ধীরে ধীরে আমার ও একটা পরিচিতি তৈরী হচ্ছিল রুদ্রপুরে।
একদিন আমি আর রাকা বসে আছি তিন মাথার মোড়ে। আমরা সেদিনে খেতেই গেছিলাম। আর আমাদের হাফ প্লেটে হয় না। ফুল প্লেট লাগে দুজনের ই। টেন্থ পাশ করার পরেই আমার পকেট মানি বেরে গেছিল বেশ কিছুটা। কাজেই সপ্তাহে দু তিন দিন বিকালে দু বন্ধু তে কিছু খাওয়া টা বড় ব্যাপার ছিল না। আমরা কথা বলছিলাম রাকার কলকাতা যাওয়া নিয়ে। রাকা যথারীতি বিরক্ত আমার উপরে। আমি ঠিক করে নিয়েছি, তুই বিরক্ত হ, রাগ কর, আমি কিচ্ছু শুনব না। ওদের বাড়ি গিয়ে আঙ্কল আন্টি দুজনাকেই পটিয়ে এসেছি। ওরা ওদিক থেকে প্রেশার দেয় আর আমি দেখা হলেই প্রেসার দি। বড় মামার সাথে কথা বলে , এ টি কে র ট্রেনিং সেন্টার এ ট্রায়াল এর ব্যবস্থা করেছি আমি। ওর নাম আর আই ডি চলে এসেছে আমার কাছে। বলে না যার বিয়ে তার খোঁজ নেই , পারা পড়শীর ঘুম নেই। আমি তো ওকে, পাঠাবই। সব মিলিয়ে দেড় লাখ লাগবে। না মানে যদি ও ট্রায়াল এ পাশ করতে পারে তবে দেড় লাখ লাগবে দু বছরের ওয়ার্ক শপ এ। সেখান থেকে কোন ভালো জায়গায় খেলতে পেলে আর কে দেখে।
রোজ সকালেই এখন আমি আর ও দৌড়তে বের হই। আট দশ কিমি দৌড়ই দুজনে মিলে। ওর জন্যেই যাই। তারপরে বাপি কে বলে, বাপির বন্ধুর ক্লাব এ প্র্যাক্টিস করার ব্যবস্থা করেছি। ও যায় ওখানে, ঘন্টা তিনেক প্র্যাক্টিস করে। তারপরে দুপুরে খেয়ে দেয়ে আবার যায় ও প্র্যাক্টিস করতে। আমার কলেজ শেষ হলে আমিও চলে যাই গ্রাউন্ড এ। সেখান থেকে ওকে তুলে নিয়ে হয় বাড়ি যাই না হলে এখানে এসে গল্প করি। ওকে ছাড়ি না। ছাড়লেই প্রায়ক্টিস এ ঢিল দেবে। ট্রায়াল এ ওকে পাশ হতেই হবে। কিন্তু ও বড্ড উদাসীন। হলে হবে না হলে আরো ভাল হবে, গোছের ব্যাপার ওর কাছে। সেটাই আমার ভয় লাগে।
সেদিনেও সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আমি বসে আছি। আমি একটা লং ফ্রক পরে আছি। চুল টা খোলা। মাথায় একটা লাল হেয়ার ব্যান্ড। আমি ওর স্কুটার এ বসে আর ও দাঁড়িয়ে গল্প করছি। ও সেই ঘ্যান ঘ্যান করছে।
- ছেড়ে দে ভাই। আমি যাব না কোথাও। কেন এমন শত্রুতা করছিস তুই আমার সাথে?
নানান কথা বলছে। বেশী টাই আমার হিটলারি সংক্রান্ত নানান কথা। অনুযোগ। আমি ওর দিকে কটমট করে তাকাতেই, রেগে চলে গেল অর্ডার টা আনতে। আমি ভেবে যাচ্ছি দেড় লাখ টাকা জোগার হবে কোথা থেকে। আমার কাছে ২১ হাজার জমে ছিল। ভাঁড়ে। আমি সেটা ভেঙ্গে টাকা করিয়ে নিয়েছি। সেটা এখন পঞ্চাশ হাজার। এটা আমাকে বাপি করে দিয়েছে। বাপি আমাকে সেই কোন ছোট বেলায় বলেছিল যে আমি যা জমাবো বাপি সেটা ডবল করে দেবে আমাকে। বাপি কে বলতেই বাপি আমার কথা মেনে নিয়েছিল। মা শুধু বলেছিল, ২১ টা ৪২ হবে। আর আট দিলেই তো মেয়ের আমার পঞ্চাশ হয়ে যায়। বাপি হেসে তাতেই রাজি হয়ে গেছিল।
তাহলে আমার কাছে পঞ্চাশ আছে। রাকার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে পঞ্চাশ ব্যবস্থা করেছি। আন্টি নিজের যা গয়না ছিল সেগুলো বিক্রী করার ব্যবস্থা করেই পঞ্চাশ হয়েছে। করুক, ওদের ছেলে। তবে এখন না, রাকা চান্স পেলে বিক্রী করতে হবে। তাহলে, এক লাখ হচ্ছে। বাকী টা পাই কোথা থেকে? সেই সময়ে একটা বচসার আওয়াজে দেখি, রাকা আর রনি প্রায় হাতাহাতির উপক্রম।
উফফ আর পারি না এদের কে নিয়ে। রনি আবার কোথা থেকে এল। এদের মাঝেও একদুবার মারপিট হয়েছিল। ছুটে গেলাম আমি। রনি কে বললাম,
- ভাই প্লিস। ভুলে যা শত্রুতা। দেখ রাকা কোন দিন ও তোর সাথে কোন ঝামেলা করবে না আমি কথা দিলাম
রাকা তেড়ে এলো আমার দিকে
- তুই কেন বলছিস এই কথা। আমাকে ল্যাজে পা দিলে আমিও ছেড়ে কথা বলব না।
আমি রেগে বললাম রাকাকে
- আমি কথা বলছি তো। তুই থাম। কেন ঝগড়া বাড়াচ্ছিস?
রাকা চুপ করে গেল। আমি রনির দিকে ফিরে বললাম
- প্লিস রনি। ভুলে যা, যা হয়েছে। প্লিস বন্ধুত্ব করে নে ভাই।
রনি আমার দিকে হা করে দেখছে। চোখে প্রশংসা ঝড়ে পড়ছে ওর। আমার কেমন একটা লাগে ইদানীং এ সবে। আমাকে ইম্প্রেস করতে,ঠান্ডা হয়ে বলল
- প্রথমত আপনি মেয়ে। আপনাকে আমি চিনি না। আমাকে তুই তুই বলছেন কেন আপনি?
- আমাকে চিনতে পারলি না? আমি শিবানী। মানে ত্র্যম্বক ছিলাম। এখন শিবানী হয়েছি।
সবাই যাতে শুনতে না পায়, চিবিয়ে চিবিয়ে, ইতস্তত করে কথা গুল আমি রনি কে বললাম। রনি খানিক, ভেবে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
- আরে!!! কি সুন্দরী তুই মাইরি? একেবারে ঝাক্কাস।
বোঝ। ছেলেরা এই রকম হয় জানা ছিল না। এতোক্ষন রেগে ছিল। যেই সুন্দরী দেখল রাগ জল। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে বেশ গর্ব বোধ করলাম আমি। কিন্তু আমাকে ঝাক্কাস বলায় রাকা গেল রেগে। রুখে এলো একেবারে।
- তোর সাহস কি করে হয় শিবের সাথে এই নোংরা টোনে কথা বলার?
উফ আবার শুরু করল এই ছেলেটা। কি করে যে সাম্লাই কে জানে বাবা। রনিও রুখে এল,
- গান্ডু, আমি, কি বলেছি?
তারপরে রনি আমার দিকে চেয়ে নিল একবার। মানে আমার সামনে গান্ডু বললে, আমার ইম্প্রেশন ওর উপরে কেমন হবে সেটা ভেবে একটু গুটিয়ে গেল । তারপরে আমতা আমতা করে বলল,
- না মানে আমি তো কিছু খারাপ বলিনি। - কি সুন্দরী এটা খারাপ কথা না তাই না?
- কিন্তু আরেক টা যেটা বললি? সেটা?
রাকার তেড়েফুঁড়ে উত্তরে আমি রাকার হাত টা চেপে ধরলাম, কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম,
- ঝাক্কাস কথা টাও খারাপ নয়। তুই চুপ কর দয়া করে।
রাকা চুপ করে গেল। আমি বললাম রনি কে,
- ব্যস হয়ে গেল। মিটমাট কেমন?
- না মিটমাট হয় নি এখনো
উফ আবার কি হলো বলতে যাচ্ছি দেখলাম, রনি স্যালুট করার ভঙ্গী নিয়ে রাকার দিকে তাকিয়ে। আমি ভাবছি এ আবার কি নাটক? তখন রনি আমার দিকে ফিরে বলল,
- দ্যাখ ত্র্যম্বক, না না শিবানী, তুই বললি বলে নয়, কিন্তু আজকে বুঝলাম, রাকা এতো দিন কেন তোর সাথে থাকত। তোকে গার্ড দিত। তোর খারাপ সময়ে তোকে নিয়েই ও থাকত। দ্যাখ, রনি খারাপ কাজ করতে পারে, কিন্তু রনি ছেলে ভাল।
তারপরে আবার রাকার দিকে ফিরে স্যালুট এর ভঙ্গী তে পা ঠুকে নিল একবার তারপরে বলল,
- স্যালুট ভাই তোকে । আমি বন্ধুত্বের হাত বাড়ালাম। তুই ভাব কি করবি।
আমি তখন রাকার হাতে চিমটি কেটে ধরেছি। ফিস ফিস করে বলছি
- যাআআআ।
দুজনায় গলাগলি করে নিলো। আমিও হেসে বাঁচি না। নাটকে দুটোই ভাল এক্টিং করতে পারবে। যাই হোক সেই দিনের খাবারের পয়সা রনি ই দিল। প্রথম বার আমি রাকা ছাড়া কোন ছেলের উপরে ইম্প্রেসড হলাম। রনির সাথে আমাদের বন্ধুত্বের শুরু হলো। এখনো রনি আমাকে পাগলের মতন ভালোবাসে। আমি জানিনা রনি সত্যি করেই আমাকে চায় কিনা। নাকি আমাকে শুধুই ভালবাসে। যাই হোক আমার কাছে ও আমার জীবনের সম্পদ।
সেদিন রাতে ভাবছিলাম, আমার তো কিছু নেই আর। যা ছিল সেটা দিয়েও হবে না। ভাবলাম মা কে জপাতে হবে। রান্না ঘরে মায়ের কাছে গেলাম। ইদানীং যাই। এখন পড়ার চাপ কম। মা কে হেল্প করি। সেই কোন ছোট বেলার ইচ্ছে আমার এখন মিটছে। মা ও কিছু বলে না বরং শিখিয়ে দেয়। রুটি করা, রুটি বেলা। এখন ও আমি প্রপার গোল করতে পারি না রুটি কিন্তু অনেকটাই হয়। আমি করেছি বললে বাপিও বেশ উৎসাহ নিয়ে খায়। আমার ভাই বোনেরা তো অজ্ঞান আমার রান্নায়। সবাই উৎসাহ দেয় এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
সেই রকম ই রাতে আমি আটা মাখছি। মা বলে দিচ্ছে,
- হয় নি তো, অল্প অল্প করে জল দে। মাখ। বুঝতে পারবি টান টা। আটায় টান না পেলে আরেক টু জল দে আবার মাখ।
আমি সেই ভাবেই চেস্টা করছি। একটা সময়ে ব্যাপার টা কে বাগে আনলাম। তারপরে মাকে বললাম,
- ও মা একটা কথা বলব?
- কি?
মা তরকারি সাঁতলাচ্ছিল। বললাম, কিছু টাকা আমাকে আরো দেবে?
- মানে? কি করবি?
- আগে বল দেবে কিনা তাহলে বলব।
- না সে দেবার চেস্টা করতে পারি। কারন আমার ও তিন চারটে আর ডি মাচুওর করেছে। তোর বাবার কাছেই আছে। চাইলেই দিয়ে দেবে। কিন্তু কেন?
মনে মনে ভাবলাম বাহ মা তো বেশ ভালো ভাবেই নিল ব্যাপার টা। বললাম মা কে পুরো ব্যাপার টা। শুধু বললাম লাগবে এক লাখ। আমি দেব তিরিশ, রাকার বাবা ষাট। দশ কম পরছে। দশ পেলেও অনেক। মানে যা পাওয়া যায় আরকি। মা শুনে কাজ করতে করতেই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। কি মানে বুঝলাম না আমি সেটার। বলল,
- ঠিক আছে। কবে লাগবে?
- দেরী আছে। আগে ওর ট্রায়াল টা হোক। পাশ করুক।
- তুই ই মামা কে বলেছিলি না ওর কথা?
মাথা নামিয়ে আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম। মা কিছু বলল না।
দুদিন পরে আবার মোড়ের মাথায় বসে আছি। সেদিনে অবশ্য আমি আকাশী সালোয়ার পরেছিলাম। পনিটেল করে রেখেছিলাম চুল টা। একটা সাদা গার্ডার ছিল আটকানো চুলে। রনি এলো। সেদিনে আমি অর্ডার করেছিলাম। তিন প্লেট চিকেন চাউমিন। দু দিন পরেই রাকার ট্রায়াল ছিল। আমার মাথায় চিন্তার আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে ট্রায়ালে রাকা সিলেক্টেড হলে, পুরো টা একসাথে না দিলেও হবে। তিনমাস পরে পঞ্চাশ দিলেও চলবে। কিন্তু আমি ভাবছিলাম জোগাড় করে রাখলে মন্দ কী।
চুপ করে ভাবছিলাম আমি। রনি আর রাকা খানিক কথা বলেই আমার কাছে এলো। দুজনাই তাই। একটু সময় নিয়ে ভাবব। সেটার অবকাশ দেবে না। সারাক্ষন গায়ে গায়ে লেগে না থাকলে হবে না। রনি এসে বলল,
- কি ভাবছিস অতো।
- ছাড় ওর কথা। মারাদোনা করবে আমাকে
রাকার কথায় মাথা গরম হয়ে গেলো আমার। সারা দিলাম না। রনি আবার বলল আমার দিকে তাকিয়ে,
- ভাই বুঝলাম না। কি হয়েছে বলবি।
দেখলাম উপায় নেই। বললাম ওকে সমস্যা টা। আবার মুখ নামিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। বড় মামা কে বলব? নাকি আন্টি কে বলব, যে তুমি গয়না বিক্রী কর আমি ছাড়িয়ে আনব, চাকরি পেলে। মা কে বলা যাবে না। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। নাহ আন্টি কেই বলি। ওদের ছেলে নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করবেন আন্টি। খানিক বাদে রনি বলল,
- ভাই উপায় পেয়েছি।
আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম
- কি বল বল
- আমার খাবারের দোকানের হোটেল করব বলে কিছু টাকা আছে। যা আছে তাতে হবে না এখন দোকান। তোকে দি চল্লিশ?
রাকা সটান না করে দিল। আমরা সবাই জানি, রুদ্র পুরে একটা খাবারের দোকান মানে হোটেল করার স্বপ্ন ওর অনেক পুরোন। আমিও রাজী হলাম না। আমাদের মুখ দেখে বুঝে গেল আমরা চাইছি না। বলল,
- ও আমি তবে কোন বন্ধুই নই। শিব দিতে পারে ষাট হাজার টাকা। আর আমি পারি না।
- না তুই পারিস। একশবার পারিস
- তবে নিচ্ছিস না কেন? আরে ভাই আমি কি এমনি এমনি দিচ্ছি নাকি? তুই ট্রায়াল ক্লিয়ার করতে পারলে তো হয়েই গেল, সারা ভারত থেকে একশ জনের একজন তুই। আমি তো ইনভেস্ট করছি। পরে ফেরত দিস।
- এসব কিছুর কি ঠিক আছে? ধর পারলাম না কিছু করতে। বল?
- আমি কিচ্ছু জানিনা। ব্যস হয়ে গেছে। তুই মহানন্দে যা। খুব ভালো করে ট্রায়াল দে। হয়ে গেলে যখন তুই যাবি ক্যাম্প এ আমিও যাব তোর সাথে টাকা নিয়ে। তোর গার্জেন হয়ে বুঝলি?
ওদের কথা শুনছিলাম আমি। আমি আবারো ইনপ্রেসড হলাম রনির উপরে। সত্যি ও ভালো ছেলে। এমন খোলা মন আমি রাকার ছাড়া কারোর হয় ভাবতেও পারিনি। আমি কিন্তু এতো খোলা মনের নই। আমার কাছে ভালবাসার ভালো লাগার মানুষ গুলো অনেক আগে জায়গা পায়। রাকা বা রনির মতন সবাই কে আপন করে নিতে আমি পারি না ।
যেদিন রাকা ট্রেনে চাপল আমি আর রনি গেছিলাম ওকে তুলে দিতে। মনের মধ্যে একটা ভয় আমার। ও নিশ্চই পারবে। এই ভরসার উল্টো দিকে, যদি না পারে, এই ভয় টাও কাজ করছে। রাকা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। এ মাসের হাত খরচা টা এনেছিলাম, ওকে দেব বলে। এতো দূর যাবে। হাতে টাকা না থাকলে হয় নাকি? আমি ওর পাশে বসে, ওর হাতে টাকা টা গুঁজে দিলাম। ও সেটা দেখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
- এটা কেন?
- রাখ কাছে। পরশু ট্রায়াল, আগের দিনে ভালো মন্দ খাবি। গায়ে জোর লাগবে না?
আমার দিকে চেয়েই রইল রাকা। জানিনা কি ভাবছিল ও। তারপরে ঝপ করে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সজোরে। আমাকে আগেও ও জড়িয়ে ধরেছে আগে। কিন্তু এটা যেন অন্য রকম ছিল। আমার বুক টা ওর বুকের সাথে লেপ্টে গেল। একটা টনটনানি ব্যাথা বুকে। আমার কাঁধে মুখ টা গুঁজে আছে ও। আমার কানে ওর নিঃশ্বাস পরছে। ওর নিঃশ্বাসের হাওয়ায় আমার ঘাড়ের চুল উড়ছে। কেমন একটা শিরশির করছে ওই সময়ে আমার শরীর টা। আমিও খুব ইতস্তত করে আমার দুটো হাত ওর পিঠে রাখলাম। পিছনে দেখছি, সবাই আমাদের দেখছে। জানি সবাই ভাবছে আমরা প্রেম করছি। ভাবুক। সেটা তো সত্যি নয়। আমি কিন্তু ছাড়লাম না ওকে।
পিছন থেকে রনি ফিস ফিস করে বলল,
- ভাল বাসাবাসি হয়ে গেলে এবারে নেমে চল শিব। ট্রেন ছেড়ে দেবে।
রনির কথায় আমাকে ছেড়ে দিলো রাকা। আমিও ছেড়ে দিলাম। নেমে এলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। মিলিয়ে গেল। ও আবার আসবে। কিন্তু মনের মধ্যে ভয় টা লাগল যে, যদি ও ট্রায়ালে পাশ করে যায় তাহলে দু বছর ও আসবে না। আসবে হয়ত মাঝে মাঝে, কিন্তু এই যে রোজ দেখতে পাই দুজন দুজন কে সেটা তো হবে না। এতদিন এতো করে টাকা জোগাড় করলাম। যে ওকে পেতেই হবে চান্স। কিন্তু এটা তো ভাবিনি, গত ছয় বছরের এমন অছেদ্য বন্ধুত্ব আমাকে ওকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা এই ভাবে দেবে। এতদিনে কেউ রাগারাগি করলে, একে অপরের বাড়ি চলে যেতাম। এখন তো সেটার ও উপায় নেই। মন টা ভয়ঙ্কর উদাস ছিল আমার।
The following 11 users Like nandanadasnandana's post:11 users Like nandanadasnandana's post
• Baban, boro bara, ddey333, Kallol, KingisGreat, raikamol, raja05, RockLee, samael, Tiger, Voboghure
Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
(05-02-2022, 11:53 PM)Baban Wrote: উফফফফফ... শুরুতেই বলেছিলাম আমার চিন্তা অনুযায়ী যদি গল্প একটুও মেলে তাহলে এই গল্প অন্য লেভেলে যেতে চলেছে.... মন ১ এর সাথে এর তুলনা করাই উচিত হবেনা ... সে গল্প অমর হয়ে গেছে... এটাও হতে চলেছে।
এক তো এমন গপ্পো তার ওপর নিখুঁত ডিটেলিং..... পারিপার্শিক আর মানুসিক বর্ণনা, বন্ধুত্ব, রাগ, অভিমান, চাহিদা, টান, ইচ্ছে, ভালোলাগা...... ভালোবাসা.... উফফফ এ গল্প ফাটায় দিসে!!!! ❤
লেডি পিনুরাম আমি বলবোনা, সে একজন ছিল.. সে তার মতোই অসাধারণ ছিল।
আমি বলবো- প্রথম নন্দনা যে ফিরে এসেছে আবারো হৃদয় জয় করতে ❤
•
Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
•
Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
•
Posts: 46
Threads: 0
Likes Received: 156 in 67 posts
Likes Given: 312
Joined: Jun 2021
Reputation:
23
(04-02-2022, 09:34 PM)nandanadasnandana Wrote: না না দোষ নেই কারোর। আসলে ভগবান আমাদের মধ্যে, মাঝে মাঝে একটা ব্যেতিক্রম পাঠিয়ে দেন, আমাদের টেস্ট করতে, যে আমরা কত টা মানুষ হয়েছি। নতুন ব্যাপারে ভয় সবার থাকে।
একদম খাঁটি কথা বলেছেন। ইংরেজি কথা alien নিয়ে সকলেরই ভয়।
Posts: 46
Threads: 0
Likes Received: 156 in 67 posts
Likes Given: 312
Joined: Jun 2021
Reputation:
23
06-02-2022, 01:28 PM
(This post was last modified: 06-02-2022, 01:29 PM by raikamol. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
হরমোন থেরাপি না হয় হল। কিন্ত জেনেটিক ব্যাপারটা আমার তেমন ধারণা বা পড়াশুনো নেই। লেখিকা কি বলেন। শিবের কি male XY chromosome ছিল? হরমোনাল treatment এর পরে কি female XX female chromosome হবে? লেখার ছত্রে ছত্রে এত রিসার্চের প্রমাণ, তাই এই কথাটা জানতে ইচ্ছে হল
Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
(06-02-2022, 01:28 PM)raikamol Wrote: হরমোন থেরাপি না হয় হল। কিন্ত জেনেটিক ব্যাপারটা আমার তেমন ধারণা বা পড়াশুনো নেই। লেখিকা কি বলেন। শিবের কি male XY chromosome ছিল? হরমোনাল treatment এর পরে কি female XX female chromosome হবে? লেখার ছত্রে ছত্রে এত রিসার্চের প্রমাণ, তাই এই কথাটা জানতে ইচ্ছে হল
না। সে উল্লেখ ও পরের দিকে আছে। জেন্ডার চেঞ্জ, অ্যানাটমি চেঞ্জ করে মাত্র। জেনেটিক্স বদলায় না। ক্রোমোজম এর ওরিয়েন্টেশন বদল করে না। তাই তো জেন্ডার বদলের পরে , মেয়ে থেকে ছেলে হলে স্পার্ম বের করতে পারে না, আর ছেলে থেকে মেয়ে হলে এগ জেনারেট করতে পারে না মাসের পর মাস। একদিন থেকে দেখতে গেলে, থার্ড জেন্ডার একটা পরিচয় হওয়া দরকার। যাতে কাউকে মেয়ে থেকে ছেলে বা ছেলে থেকে মেয়ে না হতে হয়। বাকি, যৌনতা ইত্যাদি করতেই পারে। ভালো ভাবেই পারে। বা লোকের বউ বা বর হয়ে সংসার ও করছে অনেকেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, সারোগেসির মাধ্যমে বাচ্চা নেয় তারা। উভয়ের মধ্যে যে সঠিক ভাবে ছেলে বা মেয়ে, তার স্পার্ম বা এগ নিয়ে সারোগেসি তে যায়।
Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
প্রথম অধ্যায় এর পর্ব আট এর কিছু অংশ......
রনির কথায় আমাকে ছেড়ে দিলো রাকা। আমিও ছেড়ে দিলাম। নেমে এলাম। ট্রেন ছেড়ে দিল। মিলিয়ে গেল। ও আবার আসবে। কিন্তু মনের মধ্যে ভয় টা লাগল যে, যদি ও ট্রায়ালে পাশ করে যায় তাহলে দু বছর ও আসবে না। আসবে হয়ত মাঝে মাঝে, কিন্তু এই যে রোজ দেখতে পাই দুজন দুজন কে সেটা তো হবে না। এতদিন এতো করে টাকা জোগাড় করলাম। যে ওকে পেতেই হবে চান্স। কিন্তু এটা তো ভাবিনি, গত ছয় বছরের এমন অছেদ্য বন্ধুত্ব আমাকে ওকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা এই ভাবে দেবে। এতদিনে কেউ রাগারাগি করলে, একে অপরের বাড়ি চলে যেতাম। এখন তো সেটার ও উপায় নেই। মন টা উদাস ছিল।
-----------------------------------------------------------------------------------------------
অধ্যায় ২
পর্ব নয়
এই সব কথা আর ভাবতে ভাল লাগে না আমার। আমি আসলে আমার এই জীবনে সেট হয়ে গেছি। স্থির।পাওয়া না পাওয়া সব পিছনে রেখে এসেছি আমি। সবাই বলে এই আঠাশ বছরেই আমার মধ্যে বছর চল্লিশের স্থৈর্য্য। আমি যে কলেজের ছাত্রী ছিলাম, সেই কলেজের হেড মিস্ট্রেস আমি। ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার এর অপশন থাকলেও আমি বাপি আর মায়ের কাছে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই আমার নিজের কলেজে জয়েন করার সিদ্ধান্ত। আজকে কলেজে থাকার সময়েই মনে হয়েছিল, কালকে যেখানে গেছিলাম সেখানে আবার যাব। নিজের পুরোন জীবনের কথা ভাবলে অনেকেই খুশী থাকে, আমার হয় উল্টো। যখন যখন মনে পরে মন টা আমার ব্যাথায় ভরে যায়।
বিকাল বেলায় গেলাম আমি আবার সেই জায়গায়। দেরী করেই গেলাম। আমি পৌঁছে দেখি, শিভ আগের থেকে এসে হাজির। আজকে অবশ্য কালো গাড়ি আর ড্রাইভার আগের থেকেই দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। আমাকে দেখেই ড্রাইভার টা মাথা টা ঝোঁকাল। আমিও গ্রিট করলাম উলটে। সামনে দেখি মাঠে, পুচকু টা বল টা নিয়ে বাঁই বাঁই করে দৌড়ে যাচ্ছে। আমাকে দেখেই বলটা ফেলে ছুটে এলো আমার কাছে। আমাকে বলতে গেলে জড়িয়ে ধরল ছুটে এসে। কোলে তুলে নিলাম। তাকিয়ে দেখলাম ওর দিকে। মনে হল অপেক্ষা করে ছিল আমার জন্য। ইশ ফালতু দেরী করলাম। কাল থেকে আরো তাড়াতাড়ি আসব আমি।
সন্ধ্যে অব্দি দুজনে খেললাম। আজকে দেখলাম ফুটবল জার্সি আর স্পাইক শু পরে এসেছে ও। জার্সি তে নাম লেখা, এস এইচ আই ভি। ইন্ডিয়া জার্সি। ভাবলাম বাবা মায়ের পছন্দ আছে। আমি যেমন জাগ্লিং করি বল নিয়ে, দেখলাম সেও চেস্টা করছে।মন টা ভাল হয়ে গেল আমার। আমি জাগল করে বল টা ওকে দিচ্ছিলাম, আর ও নিজে চেষ্টা করছিল বল টা জাগল করতে। ছোট ছেলে, করতে পারছে না। আমি ওকে বলে চলেছি শেখানোর জন্য,
- শিভ, হোল্ড ইওর টো স্ট্রং। না হলে বল টা উপরে উঠবে না। অ্যান্ড ইউজ ইয়োর মিডল অফ দ্য টো, অ্যান্ড জাগল দি বল। রিল্যাক্স। হলে হবে না হলে না হবে।
ও চেষ্টা করছিল সেই ভাবেই। খুব মজা পাচ্ছিল করতে। হচ্ছিল না একদম ই। কিন্তু দেখলাম স্পাইক পরে দৌড়োতে পারে। এই ভাবে কিছুক্ষন পর, একটা সময়ে তিনবার চার বার অব্দি জাগল করাতে পারল। মনে মনে ভাবছিলাম, এই সব আমি না শেখালেও একদিন ও শিখে যেত নিজে নিজেই। মারাত্মক ব্রিলিয়ান্ট। কথাটা আমি আরেক জন কে বলতাম। কি জানি, রুদ্রপুরেই কি এই সব ট্যালেন্ট আসে নাকি? ওকে শেখালাম, শট নিতে গেলে টো না, পুরো পায়ের পাতা টা ব্যবহার করতে। আর পায়ের সাইড দিয়ে মারতে। বুটের ডগা দিয়ে যে ও মারছিল সেটা কে আটকালাম আজকে।আর তাতেই কিছু টা পরে ওর শট জোরে আসতে লাগল আমার কাছে। বল টা ছোট, তাই মাঝে মাঝে লিফট করে ফেলছিল, জোরে মেরে। বাহ খুব তাড়াতাড়ি শিখে যায় তো ছেলেটা!!
খেলার শেষে দুজনে কিছুক্ষন বসলাম। আমি বাড়ি থেকে জল নিয়ে গেছিলাম। বোতলের মুখ টা বড়, তাই আমি অল্প অল্প করে খাইয়ে দিলাম ওকে। বাচ্চাদের চকোলেট দেওয়া পছন্দ করি না একদম। তাই কিছু খাবার নয়, দুটো আপেল ছিল ব্যাগে। ওকে একটা দিলাম আমি একটা নিলাম। ওকে ওর আপেল টা ধুয়ে ওর হাতে দিতেই, খেতে শুরু করে দিল। এমন ব্যবহার করছে যেন কত দিন আমাকে চেনে ও। এমনি ই হয় বাচ্চা রা? ওকে বললাম,
- কালকে আসবে তো তুমি?
এত্তো বড় ঘাড় নাড়াল। মানে আসবে। অনেক টা আপেল মুখে কামড়ে নিয়েছিল। কথা বলতে পারছিল না। ওর এই সব কান্ড কারখানাই আমার মন টা ভালো করে দেয়। বাইট টা শেষ হবার পরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
- তুমি আসবে তো
- হ্যাঁ আসবো তো। শিভ বাবু আসবে আর আমি আসব না তাই কি হয়। উম্মম্ম কালকে আমিও স্পাইক শ্যু পরে আসব কেমন, আর জার্সি পরে আসব।
- ওয়াও!! – কি যে খুশী হয়ে গেলো ছেলেটা! বলল- দারুন হবে
- হুম হবেই তো। আমি তো জানতাম না , শিভ এতো সেজেগুজে আসবে। জানলে আমি ও সেজেগুজে আসতাম।
- হিহিহি
সন্ধ্যে বেলায় ওকে গাড়ি তে তুলে দিয়ে যখন বাই করলাম, মনে হলো যাহ আজকেও জানা হলো না ও কার ছেলে। এ রুদ্রপুরে আমি বলতে গেলে সবাইকেই চিনি। আমি না চিনলেও সবাই আমাকে চেনে। যাক কালকে জেনে নেব।
আমি বাড়ি ঢুকে দেখলাম, বাপি আর রাকার বাবা গল্প করছে। রাকার বাবা আমাদের বাড়িতে আসেন প্রায় ই। যে সময়ে আমার সাথে রাকার ঝামেলা হয়েছিল, তখন আমার সব থেকে বড় সাপোর্ট রাকার মা আর বাবাই ছিলেন। ওদের কাছে আমার অনেক ঋণ এই ব্যাপারে। রাকার অঞ্জনা কে বিয়ে করে রুদ্রপুর ছেড়ে ব্যাঙ্গালোর শিফট করা কেউ ই মেনে নিতে পারে নি। কিন্তু রাকা তখন ভারতের সেরা প্লেয়ার। ওকে পাবার জন্য সব বড় বড় ক্লাব পাগলের মতন পিছনে।ও বি এফ সি তে সাইন করে নিয়েছিল। এ টি কে অনেক চেষ্টা করেও ওকে রাখতে পারে নি সেই বছর। রাকার কনফিডেন্স তখন তুঙ্গে। ও চলে গেছিল অঞ্জনা কে বিয়ে করে। না তাতে আমার দুঃখ হয় নি। তার থেকেও বড় দুঃখ পেয়েছিলাম, রাকার বাবা মা একা হয়ে গেছিল সেটাও আমার জন্য। বড় কষ্ট করে মানুষ করেছিলেন, আঙ্কল আন্টি রাকা কে। গত মাস খানেক আমি যাই নি। কারন আন্টি বলেছিলেন রাকা আসতে পারে। মাঝেও ও এসেছিল, আমি সযত্নে এড়িয়ে গেছিলাম আন্টি দের বাড়ি সেই সময়ে। যদিও ও একাই আসত। অঞ্জনা আসত না কোনদিন ই। রাকা আসত ঘন্টা খানেকের জন্য। কিন্তু আমি ওই পসিবল দিন কটা এড়িয়ে থাকতাম।
আঙ্কল দেখে আমি হাসলাম। দেখলাম মা আঙ্কল কে চা করে দিয়েছে। ঘেমে গেছিলাম আমি। শাওয়ার নিয়ে যখন এলাম ডাইনিং এ দেখলাম কাকু চলে যাবার মুড এ। মা কে বললাম,
- আঙ্কল কে কিছু খেতে দিয়েছ? ও আঙ্কল তুমি বস না!
মা বলল
- তোর আঙ্কল খেলেন না। বকে দিলাম তোর আঙ্কল কে। এতো বড় একটা দুর্ঘটনা আর আমাদের কিছু বলেন নি বলে।
আমি চুপ করে গেলাম। আন্টি আমাদের বলেন নি। হয়ত ওনারাও জানতেন না। রাকার সাথে সম্পর্ক তো বিশেষ ছিল না আঙ্কল আন্টির। মা বলল আবার,
- শুনলাম, তোর আঙ্কল আন্টি ও জানতেন না। রাকা সব মিটিয়েই খবর দিয়েছে।
আমি আর কিছু বললাম না সেই ব্যাপারে। আঙ্কল কে বসতে বললাম। আমারি ভুল হয়েছে না যাওয়া টা। প্রায় একমাস যাই নি আমি। ফোন ও করিনি। মন টা একদম ভালো ছিল না। জানি আন্টি আমাকে চান। কিন্তু যেখানে নিজেই মনকস্টে থাকি, সেখানে অন্য একজনের মনের কষ্ট কি দূর করতে পারব? তাই যাই নি। আমার কথায় আঙ্কল তাড়াতাড়ি বললেন,
- না রে মা আমার যাবার আছে একটু। আসলে রাকা নেই তো। ওর খেলা আছে কলকাতায়, ইরানের সাথে। ও টিমে আছে। চলে গেছে কালকেই। নাতি টা বাড়িতে আছে। তোর আন্টি ছাড়া কারোর কাছে থাকছে না খাচ্ছে না।
আমি অবাক হলাম। ওর দাদু দিদা মাসী রাও তো আছে। বেশী ইন্টারেস্ট নিলাম না আমি। তাও বললাম
- ও। কিন্তু ওর মামারবাড়ির লোক জন তো আছে।
- হ্যাঁ সে আছে। ওরা আসছেও খুব। ও খেলছে ওদের সাথে, কিন্তু থাকছে না। নিয়ে যেতে গেলেই এমন কান্না কাটি করছে বলার না। রাকার মা ও ছাড়তে চাইছে না ওকে। মা মরা ছেলে, তোর আন্টি বুকে করে আগলে রেখেছে। তোর আন্টি ও কাজে যেতে পারছে না। তাই আমাকেই ওভার টাইম করতে হচ্ছে। তোর আন্টি তো রাকার থেকে কিছুই নেবে না বলে পন করেছে। আর আমার হয়েছে বিপদ।
মনে পড়ল, আন্টি একটা পয়সাও নেন না রাকার থেকে। আমি দিয়ে আসি আমার থেকে। সেটা নেন আন্টি। কিন্তু রাকা র থেকে কিছু নেন না। অদ্ভুত মহিলা। অমন মনের জোর, আর আত্মসম্মানী মহিলা আমি দুটো দেখিনি। যেদিনে রাকা আমাকে অপমান করে ছিল। আন্টি অনেক ঝগড়া করেছিলেন রাকার সাথে। মা ছেলেতে অনেক কথা কাটাকাটি হয়েছিল। আমার সামনেই হয়েছিল। রাকার তখন নাম যশ ভারতের বাইরেও। রাকা সোজা বেরিয়ে গেছিল বাড়ি থেকে। সেই থেকে আন্টি ও রাকার উপার্জিত কিছু নিতেন না। আর এদিকে আমার টাকা আমার বাপি নেয় না। না না অন্য কোন কারন নেই। বাস ওটা আমার। নিজের মেয়েকে বাবা খাওয়াতে পারবে। আমাকে এখনো হাত খরচা দেয় বাপি। আমাদের তিন ভাই বোন কেই দেয়। আমার মাইনে জমেই যায়। মা জানে আমি দি আন্টি কে। আমাকে নিজের সন্তানের থেকে কম কিছু ভালবাসেন না ওরা।তাই আমার ভালো লাগে ওনাদের জন্য কিছু করতে পেরে। ওদের নিজের বাপি মায়ের মতই আমি সম্মান দি। আন্টি নিতে তো চায় না। কিন্তু আমি জোর করে দিয়ে আসি। আমাকে না বলতে পারেন না আন্টি।
আঙ্কল এর কথায় আমি সাড়া দিলাম না। চুপ করে রইলাম। আঙ্কল বললেন আমাকে
- একবার করে যাবি মা? রাকা নেই তাই বলতে এলাম। জানি ও থাকলে তুই যাবি না। তোর আন্টির ভালো লাগবে।
কি বলব এই কথায় আর? আঙ্কল বেশী কথা বলেন না। কারোর কাছে কিছু চাইবার থাকে না আঙ্কল এর। আমাকে বলতে এসেছেন মানে, ব্যাপার গুরুতর। সত্যি বলতে, যেতে তো খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু অপমান টা ভুলতে পারি না আমি। ভাবলেই মনে হয় চাবুক এসে পরছে আমার শরীরে। কেটে যাচ্ছে শরীর টা আমার। জ্বালা করে মারত্মক তখন। হুহু করে মন টা। ভাবলাম যাব। আঙ্কল কে বললাম,
- তুমি অমন করে বোল না আঙ্কল। আমি যাব।যাওয়া হয় নি কিছু দিন। আমি যাব।
রাতে শুয়ে ভাবছিলাম রাকার বাড়িতে যাবার কথা। যেতে তো খুব ইচ্ছে করছে। এই সময়ে ওর পাশে না দাঁড়ানো টা পাগলামি। আর যতই অপমান করুক আমাকে পরবর্তী জীবনে, একটা সময়ে বুকে করে আগলে রেখেছিল ও। সেটা তো ভুলতে পারি না আমি। আর সত্যি তো আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ওকে আমি দোষ দি না। আমি ই ভেবেছিলাম, এতো সুন্দরী আমি আমাকে না করার সাধ্যি ওর হবে না।একটা অহংকার তো ছিলই ভিতরে। ভাবিনি, পুরোপুরি মেয়ে আমি নই। যতই সুন্দরী হই, আমার পরিচয় তো আমি হিজড়ে।
না ওর দোষ ছিল না। বরং আমার বদলে ও অঞ্জনার প্রেমে সাড়া দিয়েছিল, আমি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। কারন আমি সর্বতো ভাবে মেয়ে তো নই। আমার তখন ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি হয়ে গেলেও, আমার মধ্যে কোন জরায়ু নেই। আর থাকলেও, বাচ্চা ফার্টিলাইজ করার এগ আমি কোথা থেকে আনব? সে সব ভগবান ই পারেন। ডক্টর রা আর যাই হোক, ভগবান নন। আমি কোন দিনেই মা হতে পারব না আমি শিওর ছিলাম। আমাকে রাকা মেনে নিলে অনেক প্রশ্নের সামনে আমাকে পরতে হতো। সেদিক থেকে বেঁচে গেছিলাম আমি। কিন্তু আমাকে যে অপমান টা করেছিল সেটা আমাকে আজকেও কাঁদায়।
আমি জীবনের কোন কথা ওর থেকে গোপন করব না ওকে কথা দিয়েছিলাম। তাই যখন আমার মন বুঝতে পারল আমি রাকা কে ভালোবাসি একটা মেয়ে হিসাবে, তখন মনে হয়েছিল ওকে বলা দরকার কথাটা।আমি ভাবিও নি ও বলবে আমাকে নিয়েই থাকবে। আমি জাস্ট বলতে গেছিলাম আমি ওকে পছন্দ করি একটা মেয়ে হিসাবে। কারন তার আগে অব্দি আমি ছেলেদের উপরে ভালো লাগা টা মানতে পারিনি। তাই যখন আমি মানলাম আর সেটাও ওকে ভাললাগে বা ভালবাসি বুঝতে পারলাম, ছুটে বলতে গেছিলাম। ও পুরো টা শুনলই না। যে কথাটা অন্যে বললেই আমি কষ্ট পেতাম, সেই কথাটা বারংবার, অন্যের সামনে আমাকে বলল। উফফ, ভাবতে পারি না। তাই রাকার কথা মনে পরলে সবার আগেই ওই অপমান টা মনে পরে। সব ভালো সুগন্ধ ছাপিয়ে, ওই দুর্গন্ধ টা নাকে আসে প্রথমেই।
রাকার ভালো নাম রাখহরি চ্যাটার্জী। জেনেছিলাম প্রথম যেদিন ও আমার জন্য কলেজের বাইরে মারামারি করেছিল। সেদিনেও আমাকে কলেজের বাইরে, ময়ুর, অনির্বান আর রাগিনী, সুভদ্রা এই চারজন মিলে উতক্ত্য করছিল। আমি সাইকেল নিতেই ওরা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। আমি কেন জেন্টস সাইকেল নিয়ে ঘুরছি। বা আমি বটম হলেও কত টা বটম। নানান কথা। সাড়া দিচ্ছিলাম না আমি। কিন্তু রাকা কোথা থেকে এসে, হাতের স্কেল দিয়ে এমন মারতে শুরু করল, ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাল। ছেলে মেয়ে কাউকেই বাদ দেয় নি ও মারতে। তখন ই ওখানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল
- এবারে আমার সাথে কথা বলিস শালা শুয়োরের দল। আর একটা বাজে কথা বলে দেখিস , এই রাখহরি কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। শালা বাঞ্চোত ।
আর ও কত খিস্তী যে মারল, মনেও নেই আমার। কিন্তু সব ছাপিয়ে রাখহরি টা আমার মাথায় গেঁথে গেল। ওকে বললাম
- থাক থাক, ওরা পালিয়েছে। কই রে? আর গাল দিতে হবে না, থাম এবারে । কেন ওদের জন্য নিজের মুখ খারাপ করছিস?
আমার দিকে তাকাল ও। তখন ও চোখে রাগ ওর। ঘুরছে চোখের মনি বাঁই বাঁই করে। আবার বললাম,
- হয়েছে অনেক। হ্যাঁ রে তোর নাম রাখহরি?
তখনো মেজাজ তুঙ্গে ওর। আমাকে ওই ভাবে জবাব দিল
- হ্যাঁ কেন?
- না এমনি।
দুম করে ঠান্ডা হয়ে গেল রাকা, বলল
- বাজে না?
- হুম। রাকা টাই ভালো।
- হ্যাঁ কেন যে ওই নাম রাখল বাবা কে জানে?
- তুই না ১৮ বছরের পরে, এফিডেবিট করিয়ে নিস। রাকা চ্যাটার্জী করে নিস নাম টা। বুঝলি?
- ভাবছি সেটাই।
সেই দিনেই প্রথম ওর নাম জেনেছিলাম আমি। এই ভাবে হাজার বার আমাকে ও গার্ড করে গেছে। সেই জাগুয়ারের ব্যাপার তো বলেইছি। ওর কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। তাই আঙ্কল যখন বলল যাবার কথা, না বলতে পারিনি আমি। কালকে শনিবার, যাব কলেজের পরে।
পরের দিন কলেজ ছুটির পরে রাকাদের বাড়িতে গেলাম। বাইরে স্কুটি টা দাঁড় করিয়ে যখন ভিতরে ঢুকলাম তখন ভিতরে অনেক লোক। রাকার শশুর শাশুড়ি এসেছে। রাকার শালী ও এসেছে। আমি সবাই কেই চিনি। রাকার শশুর বাদ দিয়ে, রাকার শাশুড়ি আর শালী দুজনাই আমাকে প্রভুত অপমান করেছিল একটা সময়ে। রাকার বাবা ছিলেন না বাড়িতে। আমি ঢোকার সময়েই দাঁড়িয়ে পড়লাম ওদের দেখে। ভাবলাম চলে যাই পরে আসব। আমাকে দেখেই রাকার শাশুড়ি আর শালীর মুখ টা রাগে একেবারে ফেটে পড়ল। একটা ঘেন্না। সেটা বুঝতে পেরেই আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না। মনে মনে ভাবলাম বেকার এলাম। ফোন করে আসলেই ভালো হতো। কালকে আঙ্কল বলে এলেন অতো করে তাই তো এলাম। আমি পিছনে ঘুরে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিতেই, রাকার মা ডাকলেন আমাকে,
- কি রে শিব, চলে যাচ্ছিস কেন?
কি বলব আমি এর উত্তরে। বললাম আস্তে করে,
- না পরে আসব ক্ষন। ব্যাস্ত আছ তুমি।
- একদম ব্যস্ত নেই আমি আয়। কতদিন আসিস নি। জানতে পেরেছিলি রাকা এসেছে, তাই আসিস নি? না হলে তো রোজ ই আসতিস।
বুঝলাম কথা গুলো রাকার শাশুড়ি কে শুনিয়ে বলল আন্টি। আমার আর ভালো লাগছিল না এই সব আলোচনা। রাকার শশুর মুখ টা নামিয়ে আছেন। শাশুড়ি আর শালী আমাকে যেন পুড়িয়ে দেবে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে। বললাম,
- থাক আন্টি ওই সব আলোচনা। আমি বরং পরে আসব। বিকালে একবার জঙ্গলের ধারে যাই। সন্ধ্যের দিকে আসব আমি তবে।
মাথায় ছিল শিভ এসে অপেক্ষা করেছিল কালকে আমি যেতে দেরী করেছিলাম। আজকে আর ছেলেটা কে অপেক্ষা করাব না। আহা খেলতে ভালোবাসে। কিন্তু আন্টি আমাকে বললেন।
- থাক কোথাও যাবি না এখন। এসেছিস যখন থাক আমার কাছে। আমাদের যা ক্ষতি হলো রে মা। ছেলেটার জীবন শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে গেল আমার।
রাকার মা মুখে আঁচল টা চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম। রাকার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করতেই চোখে আমার ও জল এলো। রাকা আর অঞ্জনা কেউ আমার অপ্রিয় ছিল না। মন টা খারাপ তো ছিলই গতকাল থেকে, এখন আন্টি কে কাঁদতে দেখে চোখের জল সামলাতে পারলাম না আমি। কিন্তু রাকার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সামনে কাঁদব না এই পন নিয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারছি না। এখন মনে হয় ইস্ট্রোজেনের একটু বেশি প্রভাব আমার শরীরে পরেছে। রাকার শাশুড়ি প্রায় রুখে এলো এবারে। আমাকে বলল,
- এই যে, তুমি এখানে কেন?
আমি জবাব দিলাম না। কারন আমি তো মানতাম আমার আসা ঠিক হয় নি। আর এই ভয় টাই আমি পাচ্ছিলাম। আমি কেন ওখানে, এর উত্তর তো নেই আমার কাছে। কোন দিন ও থাকবেও না। কিন্তু উত্তর দিল আন্টি। আন্টির এই ব্যাপার টা আমার ভাল লাগে। মানে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। এই কাঁদে। আবার দরকারে পরক্ষনেই চন্ডী হয়ে যায়, একেবারে আমার মায়ের মতন। আন্টি আচলে চোখ টা মুছে রেগেই উত্তর দিলেন,
- এই বাড়িটা, রাকার বাবার। আর আমার ও। আমার বাড়িতে কে আসবে না আসবে, সেটাও কি আপনি ঠিক করবেন বেয়ান? সে আপনি আপনার জামাই এর বাড়িতে যা করার করতেন। আমার ছেলেকে আলাদা করে নিয়েছিলেন। কিন্তু এটা তো আমার বাড়ি। আর আমি আমার ছেলের মতন অতো ভালো নই। দেখুন, আপনারা তো, আপনাদের জগত খ্যাত জামাই কে নিয়ে ছিলেন গত বেশ কয়েক বছর। আমাদের মনে হয় মনেও পরে নি আপনাদের। কিন্তু এই মেয়েটা, রোজ আসত আমাদের কাছে। আমাদের দেখা শোনা, বিপদ আপদ, সবেতেই শিবানী আমার মেয়ের মতই থেকেছে আমার কাছে। কাজেই ওর সাথে এ বাড়িতে, আমার সামনে ,সম্মানের সাথে কথা বলবেন, এইটা আমার আশা। এই কথা টা আপনাকে আমি আগেও বলেছি। আবার ও বলছি, আমার বাড়িতে রাকার থেকেও শিবানীর মূল্য অনেক বেশি। মনে রাখতে পারেন ভালো আর তা না হলে মনে হয়, আমিও কারোর সম্মান রাখতে পারব না।
আমি শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আন্টির দিকে চেয়ে রইলাম। মনে হলো, আমার মা হলেও এই ভাবে আমার সম্মান বাঁচাত। আমার সম্মানের জন্য, নিজের ছেলের সাথেও আন্টি লড়তে দ্বিধা করেন নি। আমি বললাম,
- আন্টি থাক এই সব কথা। ওনাদের ও মন ঠিক নেই। ওনারা নিজেদের মেয়েকে হারিয়েছেন। থাক এই সব কথা এখন।
ততক্ষনে রাকার বাবা বাড়িতে এলেন। আমাকে দেখে খুব খুশী হলেন। কোন সাড়া না দিয়ে চলে গেলেন ভিতরে। হয়ত রান্না ঘরে বা বাথরুম এ। এতক্ষনে, রাকার শশুর কথা বললেন। রাকার শাশুড়ি কে বললেন,
- তুমি কেন এই সব নিয়ে কথা বলছ। শিবানী এখানে এলে তোমার কি সমস্যা? আর সত্যি তো, কেন তুমি পুরোন কথা মাথায় নিয়ে বসে আছ? আর তুমি ভুলে যাচ্ছ, অনা ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল। তাই ওর ছেলের নাম, শিবানীর নামে রেখেছিল। কেন তুমি পুরোন কথা মনে করছ, আজকের দিনেও।
তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন উনি
- কিছু মনে কোর না মা, অনার মায়ের মাথার ঠিক নেই। মাফ করে দিও।
অঞ্জনা কে বাড়িতে অনা বলত আমি জানতাম। অনা আর সোনা, দুই বোন ওরা। ওর নাম টা সামনে আসতেই আমি কেঁদে ফেললাম। আহা মেয়েটার তো কোন দোষ ছিল না। আমার মতই সেও ভালো বেসেছিল রাকা কে। ভগবান ওকে এতো অল্প সুখ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, সেটা কেই বা বুঝতে পেরেছিল। সামনে তাকিয়ে দেখলাম রাকার শাশুড়ি আর শালির চোখে জল। মেয়ের মৃত্যু কেই বা মানতে পারে?কিন্তু আমার নামে ছেলের নাম? তবে কি?......
ঠিক সেই সময়েই একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ঝুঁকে গেলাম সামনের দিকে। একেবারে জাপটে ধরেছে এসে। আমি চমকে উঠলাম একেবারে। শুধু আমি ই না, বাড়ির সবাই অবাক। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। মাথাটা গুঁজে আছে আমার পেটে। জাপটে ধরে আছে আমাকে। বুক টা ধড়াস ধড়াস করছিল আমার। মুখ টা দেখতেও কি মারাত্মক উত্তেজনা হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না আমি। আমি আরো ঝুঁকে বাচ্চা টা কে কোলে তুলে নিলাম। মুখ টা দেখেই , আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল,
- শিভ!!!!!
চোখে জলের বাঁধ মানল না আর। ওকে বুকে নিয়ে নিলাম আমি। চারদিকে সবাই আমার দিকে চেয়ে আছে। এটা কি হলো কেউ বুঝতেও পারছে না। আমিও কি ছাই বুঝছি কিছু। তবে মিলিয়ে নিলাম ব্যাপার টা। হয়ত ভগবান ই আমাকে ওর সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছে। একটা মা মরা ছেলে কে বুকে পেয়ে আর যেন ছাড়তেই ইচ্ছে করছিল না আমার। জানিনা কেন প্রথম দিন থেকেই ও আমাকে ওর কাছে এক্সেপ্ট করে নিয়েছে। ঘটনা টা তে সবাই এতোক্ষন চুপ করেই ছিল। রাকার মা কথা বললেন প্রথম,
- দাদুভাই তুমি চেন আন্টি কে? কই বলনি তো?
এতোক্ষনে, শিভ কথা বলল। কি মিস্টি করে যে বলল
- হ্যাঁ চিনি তো। আমরা ফুটবল খেলি রোজ।
সবাই সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল। আমি কিছু বললাম না কাউকে। শুধু রাকার শালী ছুটে এসে শিভ কে আমার কোল থেকে নামিয়ে নিতে যেতেই শিভ কেঁদে উঠল। যাবে না আমার কোল থেকে ও। আর সুমনা মানে রাকার শালী টেনে ওকে নামানোর চেস্টা করতে লাগল। বুক টা আমার ফেটে যাবে মনে হলো। এ কি দুর্বিপাকে পড়লাম আমি। ওদের ছেলে ওরা আমার বুক থেকে শিভ কে নিয়ে যাচ্ছে আমি বলার কে? কিন্তু ইচ্ছে করছে না ছাড়তে শিভ কে আমার থেকে। মনে হচ্ছে পায়ে পরে যাই সুমনার, আর বলি- দোহাই তোর, একটু থাকুক আমার কাছে।
আমাকে বলতে হলো না কিছু। রাকার শশুর বলল সুমনা কে
- সোনা! বিহেভ ইয়োরসেলফ। শিভ বাচ্চা ছেলে। ওর যাকে পছন্দ হবে, যেখানে ও কম্ফর্টেবল, ও তো সেখানেই যাবে। টেন না ওকে।
সুমনা একটা কঠিন দৃস্টি তে আমাকে দেখে ছেড়ে দিল শিভ কে। শিভ আমার কোলেই রয়ে গেল। ততক্ষনে, রাকার শশুর শাশুড়ি চলে যাবার উদ্যোগ করল। বুঝলাম যেটা আমি আসার আগেই ওনারা উঠছিলেন। রোজ ই আসেন। নাতি কে নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে। ওনারা উচ্চবিত্ত মানুষ। রাকাও তাই। কাজেই তার ছেলে একটু অন্যরকম ভাবে মানুষ হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু শিভের গোঁ, ও ঠাম্মির কাছেই থাকবে। প্রথমবার ঠাম্মি কে দেখেছে ও। কিন্তু তাতেই ও ঠাম্মি কে ছেড়ে থাকবে না। রাকার শশুরবাড়ি মেনে নিতে না পারলেও, শিভের জন্য মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
রাকার মা কে ওনারা নিজেদের বাড়ি তেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যে মা ছেলের টাকা পয়সায় হাত ও লাগায় না, সে যাবে ছেলের শশুরবাড়ি থাকতে? তাই যেমন পারবেন তেমন ভাবেই শিভের খেয়াল রাখবেন । রাকাও চায় নি ছেলে মামার বাড়ি তে গিয়ে থাকুক। তাই কেউ আর জোর করে নি শিভ কে। শিভ রাকার মায়ের কাছেই আছে। কারন মা হীন ছেলে কোথায় থাকবে, কি ভাবে থাকবে কিছুই ঠিক হয় নি এখনো।
যতক্ষন সুমনা ছিল, শিভ আমার কোল থেকে নামা তো দূর, আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল একেবারে। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর ভিতরের ভয় টা। আমিও ধরে ছিলাম ওকে জাপটে। যেই ওরা চলে গেল, শিভ আমার কোল থেকে নেমে, আমাকে টানতে টানতে পিছনের বাগানে নিয়ে এল। ওরা চলে যেতেই আন্টিও পিছনে পিছনে এলেন। বল খেলতে হবে আমাকে এখন। ওর সাথেই খেলতে খেলতে আমি আন্টি কে বললাম, গত দুদিন ওর সাথে তাশির ধারে ফুটবল খেলার কথা। আন্টি খুব খুশী হলেন মনে হলো।
আমরা খেলছি। বল দেওয়া নেওয়া করছি। আর আন্টি বসে রইলেন রান্না ঘরের সামনে। আমাদের দেখছিলেন। আমাকে বললেন,
- ওরা শিভ কে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলাম, ছেলে নিজের থেকে যেতে চাইলে যাক। কিন্তু জোর করে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তোর বন্ধু অবশ্য বলেছে ওর শশুর শাশুড়ি কে, যে শিভের যেখানে ইচ্ছে হবে সেখানেই থাকবে। কেউ যেন জোর না করে।
মনে মনে ভাবলাম, বালের বন্ধু আমার ও। কিন্তু আমি আর কি বলব। মনের মধ্যে একটা ব্যাপার চলছিল, আহা ছোট ছেলে, কত ল্যাভিশলি থাকে হয়ত। আমি ঠিক করে নিলাম, আমি রোজ যাব আসব এবারে। আন্টি তো আমার টাকা নেন। শিভের যেন কিছু কমতি না থাকে। কারন আমি জানতাম আন্টি যেমন কষ্ট করে রাকা কে মানুষ করে ছিলেন, শিভের ও কোন কমতি হবে না। কিন্তু আমাদের ছোট বেলা আর এখন কার ছোট বেলার মধ্যে অনেক ফারাক। এখন কলেজের মাইনে ই কত বেড়ে গেছে তার কি ঠিক আছে? আর আন্টি তো শিভের থেকে কিছুই নেবেন না।
তারপর থেকে রোজ ই যাই আমি। শিভের জন্য। সে ও যেন কেমন জড়িয়ে গেল। এতো দিন ঠাম্মি ছিল ,এখন আমাকে আঁকড়ে ধরল। আমি ওর জন্য কেনাকাটি করতাম। সে খাবার দাবার ই হোক বা জামা কাপড়। কেমন একটা নেশার মতন হয়ে গেল আমার কাছে ও। প্রথম দিকে আমিও কোন ভাবনা চিন্তা করিনি। সকালে বিকালে চলে যাই ওর কাছে। সকাল হবার অপেক্ষা করি কখন যাব ওর কাছে। আর বিকালে কলেজ ছুটির অপেক্ষা তে থাকি। কলেজ ছুটির পরে সোজা ওর কাছে। ওকে খাওয়াই, সাজিয়ে দি, খেলি ওর সাথে ফুটবল। সেই রাত্রি নটা অব্দি থেকে, ওকে খাইয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরি। রবিবার টা প্রায় সারাদিন ই ওর সাথে কাটাই।
মাঝে একদিন শিভের জ্বর হলো। ছিল না বেশি দিন। কিন্তু আমি রয়ে গেলাম ও বাড়িতে। কারন আমাকে ও ছাড়ল না রাতে। আর জ্বর বেশ বেড়েছিল। আন্টি আঙ্কল সামলাতে পারবে না ভেবেই আমি রয়ে গেছিলাম। দুদিনেই ছেলে একেবারে ঠিক হয়ে গেল। তারপরে থাকতাম রাত অব্দি কিন্তু রাতে থাকতাম না। কারন মা রাগ করত। কাকু আমাকে রাতে পৌঁছে দিয়ে আসতেন বাড়ী। ভাগ্যিস রাকা ছিল না। তাহলে সমস্যার অন্ত থাকত না। ও প্রায় হপ্তা দুয়েক নেই। খেলা শুরু হয় নি জানি। ইরানের সাথে ভারতের তিন ম্যাচের ট্যুর চলছে শুনলাম। ইরানের মতন টিমের সাথে খেলতে গেলে অন্তত পনের দিনের প্র্যাকটিস তো লাগবেই। তাই শিভ কে পৌঁছে দিয়ে, দু দিন থেকেই চলে গেছে।
Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
পর্ব দশ
ইতিমধ্যে, একদিন শিভের কাছ থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম, বাপি আর ভাই খেলা দেখছে, ইন্ডিয়া- ইরানের ম্যাচ। তখন প্রায় রাত নটা। শিভ কে খাইয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেছিল কোলে আমার। তাই আমিও চলে এসেছিলাম। আমি আটটার দিকে চলে যাব কালকে সকালে।
আমি বাড়ি ঢুকতেই, আমাকে দেখে ভাই বলল,
- দিদি বস , দ্যাখ ইন্ডিয়া ভালো খেলছে খুব। ১-১ চলছে। রাকা দা দারুন খেলছে।
ভাবলাম মরন নেই আমার!! আমি বললাম
- তুই দ্যাখ। আমাকে বলছিস কেন?
বেচারী ভাই। ঝাড় খেয়েও কিছু বলল না আমাকে। খেলায় মত্ত ছিল। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে ডাইনিং এ বসলাম । রাত হয়েছে। মা খেতে দেবে একটু পরে। চোখ গেল টি ভি তে। খেলা টা দেখতে শুরু করলাম। প্রায় ছয় বছর, ভারতের কোন খেলা আমি দেখিনি। জানিনা না কেন আজকে দেখতে বসে গেলাম। রাকার সাথে হওয়া আমার ওই সব ঘটনার আগে খুব দেখতাম খেলা। রাকার প্রতি টা ম্যাচ দেখতাম। ম্যাচ শেষ হবার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ওর ফোন আসত। জিজ্ঞাসা করত। আমিও বলতাম ওকে অনেক কথা। কিন্তু অনেক দিন আমি ওর খেলা দেখিনি ইচ্ছে করেই। দেখার মন বা ইচ্ছে কোনটাই ছিল না। ওর মুখ তো দুরের কথা নাম শুনলেই গা আমার জ্বলে উঠত অপমানে।
আজ চোখে পরে গেল খেলা টা। বসেই ছিলাম তাই চোখ দিলাম টিভি তে। সেই পুরোন ৭ নাম্বার জার্সি পরেই খেলছে ও। পিছনে লেখা বড় বড় করে- আর এ কে এ। আর নামের নীচে ৭ আর তার নিচে লেখা আই এন ডি আই এ। জার্সি অনেক বদলে গেছে। নীলের সাথে কত রকম কারিকুরি করেছে। ভালো লাগছে জার্সি টা দেখতে। অনেক স্কিন টাইট জার্সি বানায় এখন। দেখলাম ও বেশ ডিপ থেকে অপারেট করছে। দৌড়চ্ছে কম। ওকে ওর কোচ একেবারে মাঝ খানে রেখেছে। পুরো খেলা টা ওর পা থেকেই ডিস্ট্রিবিউট হচ্ছে। ও তো বাঁ পায়ের প্লেয়ার। ওকে একটু ডান দিক থেকে অপারেট করালে ওর খেলা টা খোলে বেশি। বাঁ পায়ের ভাসানো শেষ মুহুর্তে ইনসুইং নেওয়া শট গুলো বরাবর ই বিপজ্জনক হয়। সে গুলো নিতে পারছে না। আর ছটফট করছে।
কিন্তু খেলছে ভালো। হয়ত ফাইনাল পাস দিতে পারছে না। কিন্তু ওপেন করে ফেলছে ও অনেক টা জায়গা, উপরে উঠে আসলেই। কিন্তু ইরানের সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না ওপরে। উপরে লোক না পেলে যা হয়। ইম্ম্যাচ্যুওর এটেম্পট। ডান দিকে রয় বলে একটা একেবারে বাচ্চা ছেলে খেলছে। দেখলাম ওর সাথে তাল মেল ভাল। ইরান দারুন টিম। যখন উঠছে ওরা একেবারে টোটাল উঠছে। তখন ইন্ডিয়া চার নয়তো পাঁচ জনে চলে যাচ্ছে নিচে। কখনো কখনো রাকা নেমে গেলে ছয় বা সাত জনে ডিফেন্ড করছে ইন্ডিয়া। আবার সেখানে বলের পজেশন পেলেই, কাউন্টার এ আসছে। তখন উপরের তিন চার জন প্লেয়ারের উপরে চাপ পরে যাচ্ছে। আর সেই জন্য গোল অব্দি যাচ্ছে না। মনে মনে ভাবছি, তুই একটু বাঁ দিকে চলে আয় রাকা। তোর ক্রস গুলো ইন্স্যুইং করে গোল মুখে যাবে। করিম বলে একটা স্ট্রাইকার খেলছে ৯ নাম্বার জার্সি পরে। খুব ছটফট করছে। রাকার ওই ইনস্যুইং গুলো পেলে ছেলেটা বলে বলে গোল করতে পারবে। করিম কে দেখলাম, জটলা থেকেই শট নিতে। ম্যাচুওর করছিল না ওর শট গুলো। রাকা অনেক টা ডিপ থেকে খেলছে বলে, ওর নেওয়া শট গুলো ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, গোল না হলে ইন্ডিয়ার চাপ আছে। কারন ইরানের আক্রমন তখন বাড়ছে। শক্তির অনেক তফাত দুটো দলে। কোথায় একটা দল বিশ্বকাপ নিয়মিত খেলে আর ভারত প্রথমবার খেলবে হয়ত এবারে।
খেলা টা শেষ হলো, মন টা খারাপ হয়ে গেল, ২ -১ এ হারল ভারত। দেখা যাক আরো দুটো ম্যাচ খেলবে এই সিরিজ এ ভারত, ইরান এর সাথে। যদিও পরের দুটো ম্যাচই ভারত ১ – ১ এ ড্র করল। দুটো খেলা দেখিনি কিন্তু খোঁজ নিয়েছিলাম। মন্দ না। ইরানের মতন শক্তিশালী টিমের সাথে এই রেজাল্ট খারাপ কি?
কিন্তু এদিকে আমি পরে গেলাম মুশকিল এ একটু। আমি একদম ই রাকার জীবনের সাথে জড়াতে চাইনি। শিভের আমার উপরে টান দেখে হয়ত বা ভাল লেগেছিল আমার। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই টান এমন মারাত্মক আকার নেবে আমিও বুঝিনি। সেই টান উপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছিল না আমার পক্ষে। কি করেই বা পারি? ওই টুকু একটা ছেলে আকড়ে ধরলে,কোন মেয়ের পক্ষে সম্ভব না সেই টান কে অগ্রাহ্য করার। যদিও রাকা আমাকে হিজড়ে বলেই সম্বোধন করেছিল, শেষ দেখার সময়ে। মেয়ে তো আমাকে ও ভাবে না। ওই ছক্কা বা হিজড়েই ভাবে ও আমাকে। সেই অপমান আমি গায়ে নিয়েই ঘুরি। রাকা এবং রাকার সম্পর্কিত কাউকে দেখলে সেই অপমান আমাকে প্রতি মুহুর্তে দগ্ধ করে। দাউ দাউ করে আমার মন , মনে ভিতরে আজন্ম লালিত, মায়া মমতা সব পুড়ে ছারখার হতে থাকে। কই তবুও তো পারিনি আন্টি কে ফেলে দিতে। তবুও পারছি না রাকার মা মরা ছেলেকে , নিজের মমতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। এটা বুঝেছি সব ব্যাপার টা নিজের হাতে থাকে না। ভগবান এতো ক্ষমতা তো আমাকে দেন নি । রাকা কে হারানোর যাতনা বুঝি ভগবান আমাকে এই ভাবে মিটিয়ে দিচ্ছেন।
বড্ড দ্রুত জড়িয়ে পরতে থাকলাম আমি। জানি আমার জীবনে অপমান কষ্ট আসবে,কিন্তু শিভ কে ফেলে দিতে পারছি না। আর ও ছেলে যেন আমার মধ্যে কি একটা দেখেছে। রোজ যাওয়া চাই আমার। না গেলে কান্না। মাঝে এমন ও হয়েছে,ওর ঘুম ভেঙ্গে আমাকে না দেখতে পেয়ে কান্না কাটি করেছে আর আমাকে রাতে চলে এসেও যেতে হয়েছে ওর কাছে। না আমার বিরক্ত লাগে নি একদম ই। আমিও ওর সাথে থাকতে পছন্দ করি খুব। কিন্তু ভয় লেগেছিল। কত দিন চলবে এমন? ওর বাবা বিশাল প্লেয়ার। থোড়াই ওকে এখানে রেখে দেবে? নিয়ে যাবে। বড় কলেজে পড়বে। কিন্তু আমাকে রোজ ওকে রাতে খাইয়ে দিয়ে আমাকে ফিরতে হয় বাড়ি। আবার সকালে , তাড়াতাড়ি স্নান করে চলে যাই ওর জন্য রাকার বাড়িতে। ওকে ঘুম থেকে তুলে খাইয়ে তারপরে কলেজ যাওয়া আমার। আমার মা তো গজগজ করে সর্বক্ষন। কিন্তু কি করব আমি? মা এর একদম ভালো লাগছে না ব্যাপার টা। সর্বক্ষন আমাকে বলে চলেছে মা।
- শিক্ষা নেই শয়তান মেয়ের। তোর না হয় মান সম্মান জ্ঞান নেই। আমাদের তো আছে। যে সম্পর্ক চুকে বুকে গেছে, সেই নিয়ে আবার টানা হেঁচড়া কেন? ভালো লাগে না বাবা। পছন্দ করি না আমি এসব একদম।
আমিও ভাবছিলাম কি ভাবে বেরিয়ে আসব শিভের থেকে। ওদের ছেলে, আমি তো দাবী করতে পারব না কোনদিন যে ও আমার ছেলে। এতো কেন জড়িয়ে পরছি আমি? ভাবি যাব না আর ডাকলেও। ও কাঁদলেও যাব না আমি। একদিন কাঁদবে? দুদিন কাঁদবে? তারপরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু থাকতে পারি না আমি। জানিনা ওর কান্নার খবর শুনলেই আমার মন কেমন একটা হয়ে যায়। আমি দামড়ি বুড়ি। বাপি আর মায়ের আদর খাই আর ওই টুকু ছেলে, কোনটাই পাচ্ছে না । তাই হয়ত আমাকে আঁকড়ে ধরে। কি করে ফেলে আসি আমি ওকে? নাহ যাই থাক কপালে। আরো একটু না হয় অপমান জুটবে। কষ্ট জুটবে। ওই টুকু ছেলের অমন টানের কাছে সে সব তো তুচ্ছ। যাই বলুক মা। মায়ের আর কি? মায়ের ছেলে মেয়েরা তো কাছেই। ওর মা বাবা কেউ নেই সাথে। মা বুঝতে পারছে না। বুঝবেও না।
সমস্যা হল তখন যখন রাকা ফিরল ট্যুর টা শেষ করে। ও আসার পরে আমার যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। যাই নি দুদিন কোন কল ও আসে নি আমার কাছে। মন টা খারাপ লাগছিল আমার। যে একবার ও শিভ কাঁদল না আমার জন্য? মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিলাম, ভালই হয়েছে। এবারে এই টান টা কেটে যাবে। আর মা কে চিন্তা করতে হবে না আমার জন্য। মনে মনে মুক্তির স্বাদ। কিন্তু সেই স্বাদ আমি নিতে পারছি না। মেয়েরা কি এমনি ই হয়? মুক্তি নিতে চায় না? কি জানি মা কে জিজ্ঞাসা করব একদিন কথাটা। আমি তো মেয়ে নই। রাকার বলা কথা মনে পরল, আমি তো হিজড়ে। চোখে জল চলে এল আমার।
যাই হোক। সেদিনে রনি এসেছিল সন্ধ্যে বেলায়। সাথে রনির হবু বউ। গল্প করছিলাম আমরা। তখন প্রায় রাত দশ টা হবে। ভাই ও বাড়িতে। আমি রনির জন্য ফ্রায়েড ম্যাগি করেছিলাম। ও খেতে ভালোবাসে। এতোক্ষনে রনি রাও উঠি উঠি করছে। মন টা ঠিক নেই আমার। শিভের জন্য কেমন একটা করছে মন টা। বাড়িতে রাকা আছে যে না হলে যেমন চলছিল চলত। রনি বার বার আমাকে দেখছে। বলল,
- কি রে মন ঠিক নেই মনে হচ্ছে?
- নাহ তেমন কিছু না। তবে ঠিক বলেছিস, ভাল নেই মন টা আমার।
- কি হলো আবার
তাকিয়ে রইলাম। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। রনি কে বললে রনিও আমার উপরে চেঁচামেচি করবে। চুপ করে গেলাম। ঠিক সেই সময়েই ফোন টা এলো আমার ফোন এ। দেখলাম আন্টি মানে রাকার মায়ের ফোন। এতো রাতে?
- হ্যালো
- শিব? আন্টি বলছি বাবা!
গলার মধ্যে একটা ধরা ভাব। ভয় লাগল,
- হ্যাঁ আন্টি বল? কি হয়েছে। গলা টা এমনি শোনাচ্ছে কেন?
- না না তুই তো আসছিস না। আমি তোকে ফোন ও করিনি রাকা এসেছে বলে। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে আর সামলাতে পারছি না
আমি একবার রনি কে আর মা কে দেখলাম। আন্টি কে বললাম,
- কেন কি হল? আমাকে বলো আন্টি
আন্টি চুপ করেই আছে। উফ মা ছেলের এক স্বভাব। কথা বলতে বলতে চুপ করে যায়। আমি আবার বললাম
- আন্টি বল? কি হলো শিভের?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে পরেছিলাম। আন্টি বললেন,
- আরে চারদিন ধরেই ওকে বলছি, কালকে আসবে তোর শিব। এই করতে করতে, আজকে সকাল থেকে আর কিছু খায় নি। সন্ধ্যে থেকেই কাঁদছে। ওর মাসী দাদু দিদা সবাই এল। কিছুতেই কিছু হলো না। ওর বাবা তো খানিক বকে ঝকে বেরিয়ে গেল রেগে শশুর শাশুড়ি আর শালী কে পৌঁছে দিতে। সেই থেকে ছেলে জোরে জোরে কাঁদছে আর হাঁপাচ্ছে। আমি আর তোর আঙ্কল ফোন করলাম তোকে। কি যে করব বুঝতে পারছি না।
থম হয়ে গেলাম। আমি কি করব এখন? জানিনা রনি আর মা শুনলে কি বলবে? যা বলে বলুক আমি আন্টি কে বললাম বেশ জোরের সাথেই,
- সকাল থেকে খায় নি, একবার আমাকে সকালেই কল করতে পারলে না? অতো ছোট ছেলে না খেলে শরীর খারাপ করে যাবে তো।আর হাঁপাচ্ছে কেন ও?
- কি করব? রাকা আছে বাড়িতে। তোকে কল করব মা? তোর সাথে সেই অপমান আমার ও হয়েছিল। কিন্তু এখন ছেলেটার জন্য বাধ্য হলাম কল করতে তোকে।
আমি বেশ উদ্বিগ্ন স্বরেই বললাম আন্টি কে,
- আর পারি না তোমাকে নিয়ে। আমার অপমান টা আগে হলো? ছেলেটা কিছু না?
উফফ ভাল লাগে না আর। ব্যাপারের গুরুত্ব কেউ বোঝে না। কোথায় একটা ফুলের মতন বাচ্চা ছেলের ভালো লাগা মন্দ লাগা। আর কোথায় আমার মতন একটা আধ দামরীর অপমান। ততক্ষনে মা আর রনি একে অপর কে দেখছে। বুঝে গেছে কি হয়েছে। আর আমি কি করতে চলেছি। আমি রেগেই আমি আন্টি কে বললাম,
- আমি আসছি । সন্ধ্যে বেলাতেই যখন কাঁদছিল , ফোন করতে পারতে আমাকে।
মনের মধ্যে থেকে সব ভাবনা উড়ে গেল আমার। যা হয় হবে। আমি ফোন টা রেখে উঠে পড়লাম। স্কার্ট টা পরেইছিলাম। শুধু টপ টা বদলে নিলাম। গলায় একটা ছোট ওড়না নিয়ে নিলাম। পার্স টা নিয়ে স্কুটির চাবি টা নিয়ে আমি ডাইনিং এ আসতেই মা আমার পথ আটকে দাঁড়ালো।
- কোথাও যাবি না তুই। ঠেকা নিয়ে রেখেছিস নাকি? কার না কার ছেলে। ও চলল রাত দুপুরে তার ছেলেকে দেখতে। তুই বল ওদের আমি যাব।
আমার মায়ের সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করছিল না। কি বোঝাবো মা কে। বলতে গেলেই অনেক বাজে প্রসঙ্গ উঠে আসবে। রনিও উঠে এলো। রনির বউ বেচারী কিছু বুঝতে পারছে না। রনি আমাকে বলল।
- কি ছেলে মানুষি করছিস শিব? যাবি না তুই। রাকা একবার ও খবর নিয়েছে তোর?
মা কে কিছু বলতে পারছিলাম না। কিন্তু রনির উপরে রাগে ফেটে পরলাম আমি।
- রনি তুই ও এ কথা বলছিস? ও একটা বাচ্চা ছেলে। খায় নি সকাল থেকে। আর আমি এখানে বসে থাকব? আর রাকা খবর নেয় নি বলে ওর ছেলে তো কোন দোষ করে নি।
রনি টা ঝাড় খেয়ে শুধরে গেল। আমাকে আমতা আমতা করে বোঝানোর চেষ্টা করল,
- না, মানে কি করবি তুই? তুই বুঝতে পারছিস না তুই জড়িয়ে পরছিস? আবার অপমানিত হবি।
- হলে হব। তা বলে আমি এখন দূরে থাকতে পারব না। আর আমার তো রাকার সাথে দেখাও হয় নি। ও একটা চার বছরের বাচ্চা রনি। প্লিস মাকে বোঝা। আমি তো যাবই। তাতে আমাকে এ বাড়িতে ঢুকতে না দিলেও আমি যাব।
শেষের কথায় মা কেঁদে উঠল। আমাকে শুনিয়ে চিৎকার করে উঠল,
- হ্যাঁ এখন , রোজগার করছিস। অনায়াসে তুই এ বাড়িতে না ঢুকতে পারিস।
মা হাঁপাচ্ছে রাগে। আমিও চুপ। যাব তো আমি বটেই। কিছুক্ষন দেখি, বেশী ঝামেলা করলে ঝগড়া করেই যাব। বাপি দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। আমাকে মানা ও করতে পারছে না আর মা কেও কিছু বলতে পারছে না। রনিও আমার এই মুর্তি দেখে একেবারে ব্যোমকে গেছে। মা খানিক চুপ থেকে, বেশ জোরের সাথেই বলল,
- বেশ আমিও যাব সাথে। আমাকে সাথে নিয়ে যেতে মানা করলে আমি এখানে কুরুক্ষেত্র করব বলে দিলাম।
উফ। পারা যায় না আর মা কে নিয়ে। ওখানে গিয়ে ঠিক কিছু না কিছু বলবে। আমি বললাম মা কে,
- বেশ চল। গিয়ে দেখ তোমার মেয়ের রাকার উপরে কোন লোভ আর নেই। সেই দেখতেই তো তুমি যাচ্ছ? চল। কিন্তু বলে দিলাম, ওখানে গিয়ে, আঙ্কল আন্টি কে কোন অপমান জনক কিছু বললে, আমি ওখানে কুরুক্ষেত্র বাঁধাব। আমার একটা সম্মান আছে ও বাড়িতে।
মা শুনল না আমার কথা। মা কে নিয়ে আমি বেরোলাম বাড়ি থেকে। একটু খানি এগিয়েই স্পিড তুললাম আমি জোরে। আমার আর তর সইছে না। সন্ধ্যে বেলায় বললেই আমি তো চলে আসতাম।
মা ভয়ে ভয়ে আমাকে বলল পিছন থেকে,
- আস্তে চালাতে পারছিস না গাড়ী টা। তোর বাবাকে বলে তোকে গাড়ি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। আরে বাবা, এটা গাড়ি, এরোপ্লেন নয়। আস্তে চালানা বাবা?
- উফ চুপ কর তো। আস্তেই তো চালাচ্ছি। ৪০ এর কমে এই গাড়ি চলে না। চুপ করে বসে থাক।
সব থেকে শর্ট কাট এ আমি রাকার বাড়িতে পৌছুলাম। গিয়ে দেখি কাকু কাকিমা বসে আছে দুয়ারে। আমি যেতেই দুজনাই উঠে দাঁড়াল। আমার মা কে আমার পিছনে দেখে খুব অবাক হয়ে গেছে দুজনাই। আমি সে সব আর না দেখে ঘরের মধ্যে ঢুকতে যাব, আর শিভ বিদ্যুৎ গতি তে ছুটে এসে আমাকে জাপটে ধরল একেবারে। আর সাথে ফুঁপিয়ে কান্না। চোখের জল সামলে আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। আমার মা অবাক হয়ে দেখছে, শিভ কে। আমাকে আঁকার করে ধরে শিভের কান্না কে। আমি ওকে ভোলাতে শুরু করলাম,
- কি হয়েছে? শিভ। এস এইচ আই ভি?
সে আমার ঘাড়ে মুখ টা কে গুঁজে ঘাড় নেড়ে জানান দিল আমি ঠিক স্পেলিং টা করেছি।
বোঝ! আমি বললাম,
- কান্না কেন? খাও নি কেন?
ওই ভাবেই আমার কাঁধে মুখ টা গুঁজে জবাব দিল
- আস নি কেন?
- ও এই জন্য খায় নি শিভ বাবু? তা আমাকে ডাকলেই হতো। আমি চলে আসতাম। আমি কি করে জানব আমাকে ছাড়া শিভ বাবু খাবে না কিছূ?
আমার কথাটা শুনে, মুখ টা তুলে বলল আমাকে,
- তোমাকে ডাকলেই তুমি আসতে? কই আমার মম কে কত ডেকেছি, আর তো আসে নি।
কথা টা শুনে আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। ওকে টেনে নিলাম আমার কাছে সজোরে। মাথায় হাত দিয়ে ওর মাথাটা আমার কাঁধে চেপে ধরলাম। মুখ টা ওর গলায় ঢুকিয়ে দিলাম আমি। হয়ত কান্না লোকালাম ওই ভাবে। বললাম,
- আমাকে ডাকলেই পেতে তুমি।
উত্তর দিলো না ও। ভাবে নি হয়ত, যে আমাকে ডাকলেই পাওয়া যায়। সেটা জানলে হয়ত ও আগেই কাঁদত।বাচ্চাদের বিশ্বাস কত সহজে আসে আর কত সহজে মেনে নেয় ওরা। ওর মা কে ডীকে পায় নি বলে ও নিশ্চিন্ত ছিল আমাকেও ডাকলে ও পাবে না। কিন্তু আমাকে আরো আঁকার করে ধরল যেন। যেমন ভয় পেলে আমি মা কে ধরতাম আঁকার করে তেমন করে। ওর চোখের জলে ভিজে গেল আমার কাঁধ। বুঝলাম, আমার না আসা টা ওর মনে বেশ বড় রকমের প্রভাব ফেলছিল।মনে অনেক চিন্তা ছিল আমার, কিন্তু ওই আঁকার করে ধরার জন্য আমার কোন চিন্তা , কোন ভয় আর রইল না , সব চলে গেল। মনে হলো, এতো আঁকার করে তো আমাকে কেউ ধরে নি। এতো বিশ্বাস আমাকে কেউ করে নি। মা কে তার সন্তান মনে হয় এমনি ভাবেই আঁকড়ে ধরে। চোখের জল বেরিয়ে এলো আমার নিঃশব্দে। ধরা গলা তেই ওকে বললাম আমি,
- আচ্ছা আচ্ছা আর কাঁদে না। এবারে আমি তো এসে গেছি। এবারে দুটি খাবে? কি খাবে বল? আমি বানিয়ে দি?
মুখ টা আমার কাঁধের উপরে, আমার অবিন্যস্ত চুলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেই ঘাড় নাড়ল ও খাবে। আমি বললাম
- কি খাবে? দুটি ভাত একটু মাছ? আমি বেছে দি মাছ টা আর খাইয়ে দি?
আবার ঘাড় নারল শিভ ওই ভাবেই। আমার কথা শুনে আন্টি চলে গেল রান্না ঘরে। দুটি ভাত একটু আলু সিদ্দ আর মাছের ঝোল নিয়ে এলো আন্টি। আমি দুয়ারেই ওকে নিয়ে বসে পরলাম। আমার মা বসে আছে কিছু দুরেই। কোন কথা বলে নি। অবাক হয়ে দেখছিল মা আমাদের । আমি মায়ের দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছি। মায়ের চোখে রাগ বিরক্তি কিছুই নেই। শুধু বিস্ময়। আর হয়ত একটা ভালো লাগা।
আঙ্কল আর আন্টি বেশ অবাক মা আমার সাথে আসায়। বুঝতে পারছিলাম আমি সেটা। এখন কিন্তু সবাই হাসি মুখে রয়েছে। শিভের মুখে হাসি আর কেউ ই এখানে কিছু চাইছিল বলে আমার মনে হলো না। শুধু আঙ্কল আন্টি অবাক, যে মা ও আমার সাথে এসেছে। আমি শিভ কে খাওয়াতে খাওয়াতে বললাম আঙ্কল আর আন্টি কে।
- আসলে এতো রাতে একা তো বেরোই না আন্টি। তাই মা সাথে এলো।
- না না ঠিক করেছে। সত্যি তো আমাদের ভুল এতো রাতে খবর দেওয়া ঠিক হয় নি। আসলে সন্ধ্যে অব্দি ,ও ঠিক ছিল। তারপর থেকেই কেঁদে কেঁদে কেমন একটা করছিল। তাই ভয় পেলাম দিদি। কিছু মনে করবেন না
আমার মা মনে হয় তখনো আমাকে আর শিভ কে দেখছিল। আন্টির কথা টা শুনতে পেয়ে বলল
- না না ঠিক আছে। আরো আগে খবর দিলে ও দুপুরেই চলে আসতে পারত।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম মায়ের দিকে। উফ কি পাল্টিবাজ হয়েছে মা টা আমার। আমি আন্টির দিকে মুখের ইশারা তে বললাম একটা ডিম সিদ্দ নিয়ে আসতে। শিভ শুনতে পেলেই বলবে খাব না । মনে হলো ছেলেটা কিছু খায় নি সকাল থেকে। আর একটা ডিম সিদ্দ দেওয়াই যায়। শেষে ঠিক ভুলিয়ে ভালিয়ে খাইয়ে দেব। আন্টি উঠে গেল তাড়াতাড়ি। আন্টি ডিম সিদ্দ চাপিয়ে এসে বসলেন বাইরে।
বাপি ফোন করল মা কে। মা সব ঠিক আছে বলে দিল। দেরী হবে বাপি আর ভাই যেন খেয়ে নেয় সেটাও বলে দিল। আমি মা কে অবাক হয়ে দেখছি মাঝে মাঝেই। কি হলো মায়ের। একেবারে মা সারদা হয়ে গেলো যে। কে বলবে, আধ ঘন্টা আগে আমার সাথে অগ্নিশর্মা হয়ে কি ঝামেলা টাই না করল। মাছের কাঁটা বেছে আমি মুখে পুরে দিচ্ছি শিভের। ও খেয়ে নিচ্ছে। আমি মাঝে মাঝেই ওকে বলছি,
- জানো মা, আন্টি, আমাদের শিভের কি সুন্দর দাঁত। কি যে ভালো করে ও চিবোতে পারে তোমরা জানই না। হ্যাঁ ভালো চিবিয়ে খাও তো সোনা। মাছ খেলেই চিবিয়ে খেতে হয় কেমন?
মা উঠে এসে শিভের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
- দেখি? ওমা তাই তো! দেখি দেখি কেমন চিবিয়ে খায় আমাদের শিব?
চুপ করে ছিল শিভ। মা এর কথা টা শুনেই একেবারে তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়ল আমার কোল থেকে তারপরে বলল,
- আমি এস এইচ আই ভি শিভ। শিব আমি নই ,এস এইচ আই বি , শিব হলো এইটা।
বলে আমার বুকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আবার আমার কোলে মুখ লোকালো। আমরা হেসে উঠলাম। ভাত টা খাইয়ে ওর গা মুছিয়ে দিলাম। বাস ছেলে রেডি। এদিক ওদিক করতে লাগল ও। আমি ততক্ষনে ডিম টা ছাড়িয়ে, হালকা নুন দিয়ে রাখলাম। খেলতে খেলতে কাছে এলেই খাইয়ে দেব একটু একটু করে। ঠিক খেয়ে নেবে ।
আন্টি মা কে বলল
- দিদি দেরী হয়ে গেছে। ভাতে ভাত তুমি আর শিব খেয়ে নাও না এখানেই। বেশী কিছু করব না। ডিম আলু ভাতে, গরম ভাত আর মাছের ঝোল আছে। ভাগ করে হয়ে যাবে।
মা চিন্তায় পরে গেল। দেরী হবে মা বুঝতেই পারছে। আবার রাত ও হয়েছে। মা কিন্তু কিন্তু করতে লাগল। তাতে আন্টি বলল,
- আর না বোল না। তোমাকে আমি যাই খাওয়াই না কেন আমার লজ্জা নেই দিদি। বোস আমি ভাত আর আলু ভাতে চাপিয়ে দিয়ে আসি।
আমি আবার ও মা কে হা করে দেখলাম। পাল্টির শেষ সীমা তে পৌঁছে গেছে আমার মা। মনে মনে খারাপ লাগল। মা কে আমি ভুল বুঝেছিলাম। কিন্তু ওতো রেগে থাকা আমার মা কি করে পালটি খেল আমি এখনো বুঝতে পারছি না। মাঝে পুচকু টা কে আরেক বার ধরে ডিমের একটু খানি খাইয়ে দিলাম। কথা কম বলে খেলে বেশী। কখনো দুয়ারে ছুটছে তো কখন ঘর থেকে কিছু একটা নিয়ে এসে সেটা নিয়ে খেলছে।
ঠিক সেই সময়ে দরজা খুলে রাকা ঢুকল। আমার বুক টা ধক করে উঠল।কি করব বুঝতে পারছিলাম না। ছয় বছর পরে ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে আর আমি ওখান থেকে চলে যাবার রাস্তা খুঁজছি। একটা ভয় মনের মধ্যে। আবার হয়ত হিজড়া শুনব আমি। সেই ঘেন্না মাখানো চোখ আমার মনে আছে। আমি তাকালাম ও না ওর দিকে। মুখ দেখতে চাই না আমি ওর। কি জানি হয়ত নিজের মুখ দেখাতে চাই না আমি ওকে। আমি শিভ কে কোলে নিয়ে ঘরে চলে গেলাম। বাকী ডিম টা খাইয়ে, পিছন দিকের বারান্দায় বেরিয়ে, ছোট বেসিনে ওর মুখ টা ধুইয়ে, বিছানায় নিয়ে গিয়ে ফেললাম। ভাবলাম ঘুম পারিয়ে দি। তারপরে চলে যাব। কালকে সকালে ও কাঁদলে, তখন দেখা যাবে।
আমি যে ঘরে শিভ কে ঘুম পারাচ্ছি, সেই ঘর টা অন্ধকার। বাইরে ওরা আছে। আলো জ্বলছে। পর্দা সরানো। আমি দেখতে পাচ্ছি বাইরে টা । শিভ কে আমার কাছে নিয়ে পিঠে চাপড়াচ্ছি। ও চুপ্টি করে আমার বুকে মাথা টা গুঁজে ঘুমোনোর চেস্টা করছে। বাইরে রাকা কেও দেখছি আমি। মা কে দেখে অবাক হয়ে গেছে। বেশ ভালো রকম অবাক হয়ে গেছে ও। মানে এতো রাতে মা কেন সেই ব্যাপার টা ও বুঝতে পারছে না। অথবা আমরা যে আন্টির ফোন পেয়ে চলে আসব হয়ত ভাবে নি।
কিন্তু ও সামলে নিল। মা কে প্রনাম করল। মা বলল,
- থাক থাক। আর প্রনাম করতে হবে না।
- কেমন আছেন কাকিমা আপনি? কাকু ভালো আছে? গরিমা , পিনাকী এরা কেমন আছে সবাই।
আমার কথা জিজ্ঞাসা করল না। কিন্তু ওর নজর আমাকেই খুঁজছে। বার বার আমি যে ঘরে আছি সেই ঘরের দিকে নজর আসছে ওর। আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ও আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। ও যখন বাড়িতে ঢুকেছিল তখন আমাকে বসে থাকতে দেখেছিল। কিন্তু ওকে দেখেই আমি শিভ কে নিয়ে ঘরে চলে এসেছিলাম। মা বলল,
- সবাই ভাল আছে বাবা। রোগা হয়ে গেছ বেশ।
- কাকিমা আপনি আমাকে তুই তুই বলতেন। এখন তুমি বলছেন।
- এখন কত বড় মানুষ তুমি। সাড়া ভারত জোড়া তোমার নাম। আর কি সেই ছোট টা আছ। যে বকার হলে বকব আবার আদর করে বসিয়ে দুটি খাইয়ে বাড়ি পাঠাবো?
মায়ের উপরে রাগে আমি ফেটে পরছি আমি বলতে গেলে। এতো কথা বলার তো কিছু নেই। আমার থেকেও বেশী মা রাকার উপরে রেগে ছিল। কিন্তু এখন দেখ? একেবারে গলে জল। আমার কিন্তু রাকা কে দেখে মনে হলো, অনেক অনেক ঝড় গেছে ওর উপর দিয়ে। একেবারও যেন কাহিল হয়ে পরেছে। ক্লান্ত শ্রান্ত মনে হচ্ছে ওকে। শিভ কে জড়িয়ে ধরলাম আমি। সেও কেমন আমার ভিতরে ঢুকে এল আমাকে জড়িয়ে ধরে। রাকা খানিক চুপ থেকে বলল,
- হুম। আমি নিজেই অনেক দূরে সরে গেছি তাই না কাকিমা?
পরক্ষনেই কথা ঘুরিয়ে দিল ও,
- মা কাকিমা কে খেতে দেবে না? রাত হয়েছে কিছু নিয়ে আসব? রনি কে ফোন করে দি তবে?
আন্টি তেড়ে গেল রাকার দিকে
- তুই বলবি তার পরে দেব নাকি? ওসব আমার চিন্তা। তুই তোর নিজের টা দেখ গা। মানুষ টা প্রথম বার বাড়ি এসেছে, তাকে কিনে খেতে দেব? বাড়িতে বানিয়ে দেব। তোকে অতো ভাবতে হবে না।
কাকিমার খেঁকানি তে চুপ করে গেল রাকা। বেচারী মা কে চিরকাল ই ভয় পায়। এখন তো আঁকড়ে ধরতে চাইছে মা কে আরো বেশী করে। কিন্তু আন্টি র কাছে এই সবের কোন মূল্য নেই আর। আন্টি কোন আশাই রাখেন না রাকার কাছে থেকে সেটা আমি জানি। আমাকে কথা বলতে হবে আন্টির সাথে। অনেক অনেক রাগ জমে ছিল, কিন্তু ওর এই মুখ টা দেখার পরে মনে হলো, আমার রাগ হয়ত ওকে আরো ক্ষত বিক্ষত করবে। কিন্তু তাতেও ও উদাসীন ই থাকবে। জীবনে কিছু পাবার আশা ও কোন দিন করে নি। আর হারিয়ে যাবার ভয় ও পায় নি। নিজের কষ্ট কাউকেই বলে না কোন দিন ও। ও এক প্রকার জীব। কিন্তু জীবনে সব পেয়েও না কিছু না থাকার যে একটা মুখ হয় সেটা ওকে দেখে আমি বুঝতে পারলাম আজকে।
কিছু বলল না ও আন্টি কে আর। দুয়ারে বসে পড়ল। যে ঘরে আমি আছি সেই ঘরেই হয়ত ওর জামা কাপড় আছে। ও ঢুকতে পারছে না। আর একদিন ছিল, জোর করে আমার ঘরে ঢুকে পরত ও। মনে হলো হয়ত ও চেঞ্জ করবে। আমি বাইরে না গেলে ও আসতে পারবে না। আমি শিভ কে ধরে বুঝলাম ও ঘুমিয়ে গেছে। ওকে ভালো করে শুইয়ে, দু দিকে দুটো বালিশ দিয়ে আমি উঠে আসতে যাব দেখি আমার স্কার্টের দড়ি দুটো তে টান পরল। ভালো করে দেখলাম দেখি, আমার স্কার্টের দড়ি, ও হাতে পাকিয়ে ধরে রেখে দিয়েছে।
আমি দড়ি টা ওর হাত থেকে খুলে ফেলার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু টানাটানি তে ও উঠে পড়ল। আমি আবার পাশে শুয়ে পরলাম ওর। আচ্ছা ঝামেলা তে পরলাম আমি। এখন আমাকে না ছাড়লে তো আরো সমস্যা। ওদিকে বাইরে আন্টি খেতে দিয়েছে। আর আমি না বেরোলে রাকাও ঢুকতে পারছে না ঘরে। আমি শিভ কে কোলে নিয়েই বাইরে গেলাম। কোলে নিয়ে খেয়ে নেব। ততক্ষনে ওর ঘুম টাও ডিপ হয়ে যাবে আরও।
সবাই আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। রাকা হা করে চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমাকে দেখল ও প্রায় ছয় বছর বাদে। আমি মাঝে মাঝে টিভি তে দেখেছি। চোখ পরে গেছে আমার। অ্যাড ও দেয় দু একটা। কাজেই দেখব না বললেও মাঝে মাঝে চোখে পরে যাইয় বৈকি। চোখ সরছে না ওর আমার থেকে। আমি মা কে বললাম,
- আরে , সবাই ওমনি করে তাকিয়ে আছ কেন? উঠে আসার সময়ে দেখলাম, আমার স্কার্টের দড়ি নিজের হাতে পাকিয়ে নিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমি খুলতে গেলাম ও উঠে পরল। আবার শুয়ে ঘুম পারিয়ে একেবারে ওকে নিয়েই উঠে এলাম। না হলে তোমরা সবাই বসে আছ না খেয়ে।
আমার মা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মা কে কি আমি অবাক করছি প্রতি মুহুর্তে? কে জানে? মা আমার উপরে আর কোন ভাবেই রেগে নেই সেটা বুঝতে পারছি। আমি শিভ কে কোলে নিয়ে বাঁ হাতে ওর মাথা টা রেখে খেতে লাগলাম। কেমন একটা লাগছিল। একটা আনন্দ মনে আবার একটা ভয়, যে এই ভাবে নিয়ে খাচ্ছি, ওতে ওর কোথাও ব্যথা লাগছে নাকি। কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও খুব নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। আমি এক গ্রাস করে মুখে ভাত তুলছি, আর ওকে দেখছি। মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি। এখন কেউ আর আমাকে দেখছে না। সবাই নিশ্চিন্ত। শিবের কাছে শিভ আছে। এই নিশ্চিন্ততা , এই ভরসা, এ যে কত বড় পাওয়া বলে বোঝানো যাবে না। খাওয়া হয়ে গেলে, আন্টি আমাকে জল এনে দিলেন, ওখানেই হাত ধুয়ে নিলাম আমি। কারন উঠে হাত ধুতে গেলে, ও ঘুম থেকে উঠে পরবে। এর পরে আসতে আসতে হাত থেকে খুলে নিতে হবে আমার স্কার্টের দড়ি টা।
খেয়ে দেয়ে ওকে শুইয়ে দিলাম। আন্টি শোয় ওর কাছে। আমি ওকে শুইয়ে দিলাম। পাশে শুয়ে আস্তে করে ওর হাত থেকে আমার স্কার্ট এর দড়ি টা খুলে নিয়ে উঠে আসতে যাব, এবারে আমার হাতের আঙ্গুল টা ধরল ও। চমকে ঘুরে তাকিয়ে দেখি ঘুমোয় নি। বড় বড় চোখ দুটো পরিষ্কার ভাবে খোলা। আমার আঙ্গুল টা ধরে টানছে ওর দিকে।
The following 14 users Like nandanadasnandana's post:14 users Like nandanadasnandana's post
• Baban, bad_boy, boro bara, bourses, ddey333, DSaha, Kakashi, Kallol, markjerk, raikamol, raja05, samael, Tiger, Voboghure
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
অসামান্য .... অদ্ভুত ...
Posts: 1,538
Threads: 5
Likes Received: 2,624 in 909 posts
Likes Given: 1,512
Joined: Dec 2018
Reputation:
578
সপ্তম পর্ব অবধি শেষ করতে পারলাম... একটু ধীরে চলছি... কারন এক, নিজের গল্পটাও এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে... আর সেটা ছাড়াও... দুই... এই গল্পটা তাড়াহুড়ো করে পড়ার নয়... স্কিপ করে এগিয়ে গেলে এটার আসল রস থেকে বঞ্চিত থেকে যেতে হবে... সেটা চাই না কোন মতেই...
অভূতপূর্ব... গল্পটা লিখতে গিয়ে যে ভাবে আপনি রীতিমত রিসার্চ ওয়ার্ক করেছেন, তাতে মুগ্ধতা শেষ হচ্ছে না আমার... আপনি নারী... তাই নারী দেহকে আপনি ভালো চিনবেন, সেটাতে আর আশ্চর্যের কি আছে... কিন্তু একটা পুরুষকে নারীতে রূপান্তরিত করার দীর্ঘ প্রসেসকে যে ভাবে আপনি ব্যবচ্ছেদ করে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে চলেছেন... তাতে সত্যিই অভিভূত আমি... হ্যাটস্ অফ টু ইয়ু অ্যান্ড ইয়োর রাইটিং এবিলিটি...
Posts: 46
Threads: 0
Likes Received: 156 in 67 posts
Likes Given: 312
Joined: Jun 2021
Reputation:
23
(07-02-2022, 04:21 PM)bourses Wrote: সপ্তম পর্ব অবধি শেষ করতে পারলাম... একটু ধীরে চলছি... কারন এক, নিজের গল্পটাও এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে... আর সেটা ছাড়াও... দুই... এই গল্পটা তাড়াহুড়ো করে পড়ার নয়... স্কিপ করে এগিয়ে গেলে এটার আসল রস থেকে বঞ্চিত থেকে যেতে হবে... সেটা চাই না কোন মতেই...
অভূতপূর্ব... গল্পটা লিখতে গিয়ে যে ভাবে আপনি রীতিমত রিসার্চ ওয়ার্ক করেছেন, তাতে মুগ্ধতা শেষ হচ্ছে না আমার... আপনি নারী... তাই নারী দেহকে আপনি ভালো চিনবেন, সেটাতে আর আশ্চর্যের কি আছে... কিন্তু একটা পুরুষকে নারীতে রূপান্তরিত করার দীর্ঘ প্রসেসকে যে ভাবে আপনি ব্যবচ্ছেদ করে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে চলেছেন... তাতে সত্যিই অভিভূত আমি... হ্যাটস্ অফ টু ইয়ু অ্যান্ড ইয়োর রাইটিং এবিলিটি...
লেখিকার রিসার্চের কথা বলতে গিয়ে অভূতপূর্ব কথাটিই যথাযথ
Posts: 6,108
Threads: 41
Likes Received: 12,067 in 4,138 posts
Likes Given: 5,306
Joined: Jul 2019
Reputation:
3,734
07-02-2022, 08:06 PM
(This post was last modified: 07-02-2022, 08:41 PM by Baban. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
নয়, দশ একসাথে পড়লাম........ সেই আগের গপ্পের মতো বাঁ দিকে কেমন যেন একটা অনুভব হলো কয়েকটা লাইন পড়ে। ডিটেলিং নিয়ে আমি কিছুই আর বলতে চাইনা.... কারণ সেইটাকেও ছাপিয়ে গেছে এক নারীর এক বাচ্চার প্রতি আবেগ, টান, মাতৃত্বের জাগরণ। কে ওই বাচ্চা শিবানীর? কেউ তো না..... কিন্তু নিজের শরীরের অংশই যে সন্তান হয়না..... অচেনা একটা নিষ্পাপ বাচ্চাও সন্তান হয়ে উঠতে পারে এ গল্প তারই... ঠিক সেইভাবে এক নারীও...( যদিও বিখ্যাত রাকা বাবু তাকে হিজড়া বলেন...বা বলেছিলেন) এখন হয়তো বুঝছেন তিনি যে মা কাকে বলে।
ফাস্ট পার্সনে লেখার একটা বিশেষত্ব হল নিজেকে ওই জায়গায় ফেলে ওই চরিত্রকে নিজের অন্তরে স্থান দিয়ে পুরোটা তার দৃষ্টিতে বলা যায়.. যেটা থার্ড পার্সন হিসেবে ঠিক মানায়না বা ফুটিযেও তোলা যায়না.... যদি না সেই কথক গল্পের সর্বজ্ঞানী জাদুকর না হন.......
অসাধারণ পর্ব। ❤❤
Posts: 7
Threads: 0
Likes Received: 4 in 4 posts
Likes Given: 27
Joined: Mar 2021
Reputation:
0
Posts: 1,538
Threads: 5
Likes Received: 2,624 in 909 posts
Likes Given: 1,512
Joined: Dec 2018
Reputation:
578
আট নয় দশ... পর পর তিনটে পর্ব পড়ে ফেললাম সব কিছু থামিয়ে রেখে...
কি বলবো বুঝে উঠতে পারছি না... সত্যিই... বিশ্বাস করুন... সম্পর্ককে যে ভাবে আপনি আপনার সাবলিল ভাষায় আর অসম্ভব ধৈর্য সহকারে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন একটু একটু করে... তাতে যেন আমি প্রশংসার কোন ভাষাই খুঁজে পারছি না... আর সেই সাথে ছোট ছোট বর্ণনায় গল্পের চরিত্রগুলোকে একেবারে জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন সামনে... যেন মনে হচ্ছে ওদের মধ্যেই দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করে চলেছি ঘটনাপ্রবাহ...
অনবদ্য...
Posts: 657
Threads: 0
Likes Received: 699 in 419 posts
Likes Given: 1,144
Joined: Mar 2021
Reputation:
62
দিদির এই গল্প টা যে পর্যায়ে যাচ্ছে এরপরে এই গল্পের সমালোচনা করা আমার কম্মো নয়। শিভ আর শিব, দুজনের এই বন্ধন বা অদৃশ্য মাতৃত্ব টা অসম্ভব সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পের শেষ টা হয়তো মোটামুটি বুঝে গেছি। লিখতে থাকুন।
PROUD TO BE KAAFIR
Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
•
Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
(07-02-2022, 04:21 PM)bourses Wrote: সপ্তম পর্ব অবধি শেষ করতে পারলাম... একটু ধীরে চলছি... কারন এক, নিজের গল্পটাও এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে... আর সেটা ছাড়াও... দুই... এই গল্পটা তাড়াহুড়ো করে পড়ার নয়... স্কিপ করে এগিয়ে গেলে এটার আসল রস থেকে বঞ্চিত থেকে যেতে হবে... সেটা চাই না কোন মতেই...
অভূতপূর্ব... গল্পটা লিখতে গিয়ে যে ভাবে আপনি রীতিমত রিসার্চ ওয়ার্ক করেছেন, তাতে মুগ্ধতা শেষ হচ্ছে না আমার... আপনি নারী... তাই নারী দেহকে আপনি ভালো চিনবেন, সেটাতে আর আশ্চর্যের কি আছে... কিন্তু একটা পুরুষকে নারীতে রূপান্তরিত করার দীর্ঘ প্রসেসকে যে ভাবে আপনি ব্যবচ্ছেদ করে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে চলেছেন... তাতে সত্যিই অভিভূত আমি... হ্যাটস্ অফ টু ইয়ু অ্যান্ড ইয়োর রাইটিং এবিলিটি...
হ্যাঁ তা করেছিলাম। কিন্তু সব টা দিলে ডকুমেন্টরি হয়ে যেত। তাই যত টুকু প্রয়োজন দিলাম আরকি। এমন প্রশংসা পেলে মন ভাল হয়ে যায়।
•
Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
(07-02-2022, 04:46 PM)raikamol Wrote: লেখিকার রিসার্চের কথা বলতে গিয়ে অভূতপূর্ব কথাটিই যথাযথ অনেক অনেক থ্যাঙ্কস
•
Posts: 717
Threads: 5
Likes Received: 2,105 in 475 posts
Likes Given: 730
Joined: Dec 2021
Reputation:
661
(07-02-2022, 08:06 PM)Baban Wrote: নয়, দশ একসাথে পড়লাম........ সেই আগের গপ্পের মতো বাঁ দিকে কেমন যেন একটা অনুভব হলো কয়েকটা লাইন পড়ে। ডিটেলিং নিয়ে আমি কিছুই আর বলতে চাইনা.... কারণ সেইটাকেও ছাপিয়ে গেছে এক নারীর এক বাচ্চার প্রতি আবেগ, টান, মাতৃত্বের জাগরণ। কে ওই বাচ্চা শিবানীর? কেউ তো না..... কিন্তু নিজের শরীরের অংশই যে সন্তান হয়না..... অচেনা একটা নিষ্পাপ বাচ্চাও সন্তান হয়ে উঠতে পারে এ গল্প তারই... ঠিক সেইভাবে এক নারীও...( যদিও বিখ্যাত রাকা বাবু তাকে হিজড়া বলেন...বা বলেছিলেন) এখন হয়তো বুঝছেন তিনি যে মা কাকে বলে।
ফাস্ট পার্সনে লেখার একটা বিশেষত্ব হল নিজেকে ওই জায়গায় ফেলে ওই চরিত্রকে নিজের অন্তরে স্থান দিয়ে পুরোটা তার দৃষ্টিতে বলা যায়.. যেটা থার্ড পার্সন হিসেবে ঠিক মানায়না বা ফুটিযেও তোলা যায়না.... যদি না সেই কথক গল্পের সর্বজ্ঞানী জাদুকর না হন.......
অসাধারণ পর্ব। ❤❤
না না বেশী মোচরে আর রাখব না। হ্যাঁ প্রথম পুরুষ থুড়ি নারী তে লিখলে এটা সুবিধা। তবে তৃতীয় পুরুষে লিখলে ওই বিবেক হয়ে লিখতে হবে আরকি। অনেক অনেক ভালোবাসা রইল।
•
|