22-02-2021, 05:03 PM
(This post was last modified: 22-02-2021, 05:08 PM by অনঙ্গপাল. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
স্বীকারোক্তি
(পূর্বতন ক্সসিপে প্রকাশিত 'স্বীকারোক্তি' উপন্যাসের দ্বিতীয় ভাগ)
।। ১।।
আজ তো ছুটির দিন, আর এসব মশলা কলকাতায় বাড়িতে থাকলে পাওয়া খুব সহজ, পাড়াতেই দুটো স্টেশনারি দোকান, আমাদের বাড়ির একটা গলি পরে... কিন্তু এখানে... এরা কি আর ওসব খায়, নিরামিষাশী নির্লোভ মানুষজন! নির্ঘাত পেতে দেরী হবে, সেই ফাঁকে দেখি যদি... ঘরদোরের কী যে অবস্থা, একটু গোছগাছ করে রাখতে এত আলসেমি কীসের বুঝি না বাপু... এদিকে বাইক নিয়ে টো টো করতে বলো! বান্দা এক পায়ে খাড়া। আমি বলিওনি গরম মশলাটা আনতে, অথচ যেই শুনেছে মা ওটা দিয়ে ছাড়া কষা চিকেনের এই রেসিপিটা করে না, অমনি হাজার দোকান ঢুঁড়ে আনতে ছুটল। গল্প শুনেই মায়ের ফ্যান হয়ে গেছে, সেদিন তো দিভাইয়ের বিয়ের ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলেই ফেলল, "শি ইজ স্টিল সো প্রিটি, ইভন মোর দ্যান ইউ"... মাথায় দু' একটা কলকব্জা নির্ঘাত ঢিলে আছে!
হঠাৎই খেয়াল হল খাটের পাশের জানলার গ্রীলটা ধরে দাঁড়িয়ে আপনমনে ফিকফিক করে হাসছি। পাশের বাড়ির বউটা নিজের বাচ্চাটাকে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাখি চেনাচ্ছে আর আড়চোখে আমায় মেপে নিচ্ছে। কী যে ভাবছে কে জানে... সঞ্জুর ফ্ল্যাটে বোধহয় আগে কখনও কোনও মেয়ে পদার্পণ করেনি?
মনে সংশয়ের কাঁটা বিঁধতেই অজান্তে জানলা ছেড়ে ভিতরের দিকে চলে এসেছি। গুটিগুটি পায়ে বসলাম স্বল্প পরিসর খাটটায়। চাদরটা কবে কেচেছে শেষ কে জানে, কেমন একটা বুনো পুরুষালি গন্ধ উঠে আসছে, চারিয়ে যাচ্ছে ঘরের বদ্ধ বাতাসে। নারীসুলভ প্রতিবর্তে বুক ভরে ঘ্রাণ নিতেই মস্তিষ্কে দ্রিমিদ্রিমি মাদলের ছন্দ... আহ্, পঁচিশ পার হওয়া দামাল পৌরুষের গন্ধ বুঝি এমনই হয়, গ্রাস করে নেয় সত্তার একাংশ!
শরীরের কোষে কোষে প্রাকৃতিক আহ্বানের উদ্বেলতা। সযত্নে চোরকুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা ইচ্ছেগুলোর মত হরমোনগুলোও আজকাল বড্ড অবাধ্য, একটুতেই সীমা অতিক্রম করতে চায়...
ঘোর লাগা চোখেই উপুড় হয়েছি শয্যায়, ক্ষণিক নাকটা ডুবিয়ে রইলাম চাদরের ভাঁজে। এ অবধারিত সঞ্জুর শরীরের উৎসারিত ফ্র্যাগ্রেন্স, সাথে হালকা বডি স্প্রের মিশেল। সেপ্টেম্বর উপান্তের শেষ বিকেলের সূর্য ম্রিয়মান আভা ছড়াচ্ছে, পর্দার আড়াল বেয়ে খানিকটা কিরণ লুকোচুরি খেলতে খেলতে এসে পড়েছে ওদের ফ্যামিলি অ্যালবামটার উপর। হাত বাড়িয়ে টেনে নিই, পাতা ওল্টাচ্ছি... মেলে থাকা ফ্রেমের ভিতর একসারি হাস্যোজ্জ্বল মুখ, কখনও কেউ আপন খেয়ালে হাসতে ভুলে গেছে। কিন্তু সেই ছবিটা কোথায়?
আপনা থেকেই টের পাই--- নিজের কমনীয় চিবুকে কাঠিন্যের আভাস। অযথা ভ্রুকুঞ্চনের তিরতিরে বেদনার অনুভব কপালে, স্ফুরিত নাসারন্ধ্র বেয়ে অভিমানেরা আহত নাগিনীর নিঃশ্বাসের হল্কার মত আছড়ে পড়তে থাকে অ্যালবামের নিশ্চল মুখগুলোর উপরে... এই তো, এই তো সেই ছবি! সত্যান্বেষীর অধ্যবসায় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি, অন্তরাত্মা বুঝি পুড়তে আরম্ভ করেছে। কেন এই নিষ্ফলা ঈর্ষা! ছবিতে সঞ্জুর পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো এই নারীটি তো আমার কোনও ক্ষতি করেনি, তাও কেন ওর সাথে তার নিজ দেবরের এই নৈকট্যে ছারখার হয়ে যাচ্ছি আমি! কী এমন আছে ওর মত একটা সাধারণ আনপড় মরাঠি রমণীর মধ্যে? সৌন্দর্য? হ্যাঁ, একটা মেঠো আলগা শ্রী চোখে মুখে ঝিলিক দিয়ে যায় বটে, কিন্তু সে তো... তবে কি, তবে কি শরীর? চোখের একদম সামনে এনে পাগলিনীর মত খুঁজে চলি, আর ঠিক তখনই...
হৃৎপিণ্ডে একটা বিস্ফোরণ হয় যেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, এও কি সম্ভব? মন্ত্রমুগ্ধের মত অ্যালবাম ফেলে উঠে যাই আলমারিটার কাছে, সামনে মানুষপ্রমান আয়না। অস্থির হাত সরায় টপের আবরণ, আর উন্মোচিত হয় সেই গোপন সত্য, আজ পর্যন্ত একজন, না না... দু'জন পুরুষ যাকে প্রত্যক্ষ করেছে।
হাপরের মত বুক ওঠানামা করছে, ঘরে কি অক্সিজেন কমে গেল? বাঁদিকের বুকের কণ্ঠার হাড়ের নীচে বুকের চাতালের মাঝবরাবর অবস্থিত ঘন বাদামী রঙা তিলটায় আঙুলগুলো আপনা থেকেই ছুঁয়ে যায়, যেন যাচাই করে নিচ্ছি ওর অস্তিত্ব। ঠিক যেখানে সঞ্জুর ভুলতে না পারা পুনম ভাবিরও... তফাৎ শুধু বর্ণে, ওরটায় সবুজ আভা।
এই তবে সঞ্জুর টপ সিক্রেট?
বিকেলের আলো ফিকে হয়ে সাঁঝের কালো মিশতে থাকে। যেন প্রকৃতির প্যালেটে হঠাৎ চলকে পড়েছে কাজললতার বিন্দু। স্ট্রিটল্যাম্পগুলো একে একে জ্বলে ওঠে। এদিকটায় প্রচুর গাছগাছালি, পাশেই একটা ছোটদের পার্ক-কাম-বড়দের মর্নিং-ইভনিং ওয়াকের চত্বর। বড় বড় ঝুম হয়ে থাকা গাছগুলোয় পাখিদের একটা আস্ত মিনি সাম্রাজ্য। গোধূলির আলো ফুরোলেই সব ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরতে থাকে নীড়ে। পাখসাটের সম্মিলিত কলতানে কান পাতা দায়।
ইলেকট্রিসিটি আর কেবলের তারের জটলা ভেদ ক'রে সামনের সাঁঝবাতিটার আলো চুঁইয়ে এসে পড়েছে জানলার গ্রীলে। পর্দাটা একটু ফাঁক করে থুতনিতে ভর দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছি... কতক্ষণ খেয়াল নেই। আনমনে কখন যেন বিনুনির আলগা হয়ে আসা বাঁধন খুলতে শুরু করেছি। যান্ত্রিকভাবে অভ্যস্ত আঙুলের কারসাজিতে একটু একটু করে শিথিল হচ্ছে বিসর্পিল দীর্ঘ বেণী, তারই মাঝে দেখলাম সঞ্জু আবাসনের নীচে বাইকটা পার্ক করল। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে আসার সময় চকিতে একবার মুখ তুলে দেখল, অবহেলাভরে চাইলামও না ওর দিকে। দেখেও না দেখার ভান। দরজাটা একটু আগেই খুলে এসেছি, ও বাইরে থেকে ল্যাচ খুলে ঢুকে আসতে পারবে।
মগ্ন নিজের জটিল ভাবনার অন্ধগলিতে। একা একা, প্রেতিনীর মত। বুকের মধ্যে যে ঝড় বইছে তার সামান্যতম আভাসও আমার মুখের আবহাওয়া অফিসে নেই।
খুট করে একটা আওয়াজ, টেবিলে কী সব রাখল বুঝতে পারলাম। বাইরের আলো আঁধারি থেকে চোখ না ফিরিয়েও বুঝতে পারছি সঞ্জু ইতস্তত করছে কাছে আসতে। এই নাকি পুরুষ মানুষের সাহস! ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে ওর দৃষ্টি এখন আমাতেই নিবদ্ধ। বিস্রস্ত চুলের ট্র্যাফিক জ্যাম ছাড়ানোর মাঝে দেহ আরও এলিয়ে দিই জানালাতে, আপনা থেকেই নিতম্বের ডৌল বিভঙ্গ ছড়িয়ে মুচকি হাসে অসহায় পুরুষের দিকে চেয়ে। ঘরে এখন শুধু সঞ্জুর গভীর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ।
ক্রমশ সে শব্দ ঘনিয়ে আসে কাছে, ঠিক ঘাড়ের উপর এসে থিতু হয়। উন্মুক্ত নেকলাইনে উষ্ণতার প্রলেপে আমারও কি বুকের লাবডুব গতিময়? উঁহু, এই মুহূর্তে, সন্ধের অন্ধকারে জমাট এই চলমান ফ্রেমের আমিই নিয়ন্ত্রক... এখন ভেসে গেলে চলবে না। কন্ট্রোল ইয়োরসেলফ অবন্তিকা...
নিস্পৃহ মুখে ঘুরে তাকাই, চোখে নীরব জিজ্ঞাসা। যার কোনও সদুত্তর সঞ্জুর কাছে নেই, ও শুধু শরাহত হরিণের মত কণ্ঠার একটু নীচে তাকিয়ে... শরীরের সামান্য দোলায় টপটা আবারও সরে গেছে, ঠিক যেখানে যতটুকু সরা দরকার... ততটুকু। এবারে ওর বুকের গভীর থেকে উন্মথিত বাতাস তার সমস্ত বিপন্নতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমার শরীরের ঐ একচিলতে বাদামী রঙা কলঙ্কের তটে।
নিঃসংকোচে এগিয়ে যাই, পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ঘুচে গেছে। ওর বুকের কাঠিন্যে সন্তর্পণে মিশিয়ে দিই নিজেকে, নিজের বুকের সবটুকু ভার... এবার ও বহন করুক। সারল্য মিশিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ি,
"পেয়েছ, যা খুঁজছিলে?"
সঙ্কোচ আর জিজ্ঞাসা একাকার ক'রে সঞ্জু তাকায় আমার চোখের গভীরে, যেন ডুবতে থাকা নৌকোর ছেঁড়া পাল, খাবি খেতে খেতেও যে উত্তর খুঁজে চলে...
"হ্যাঁ, এখানে কোথাও পেলাম না, বাইক নিয়ে সেই জলাহাল্লি ছুটতে হল..."
উত্তরের মাঝেই অবহেলাভরে আবার জানলার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, নিবিষ্টমনে দেখতে থাকি পাখসাটের দুর্বোধ্য ঐকতান। নৈঃশব্দ্যকে বিরক্ত না করে সঞ্জুও এসে দাঁড়ায় আমার ঠিক পিছনে, নীরবে নাক ডুবিয়ে দেয় আমার উন্মুক্ত চুলের সমুদ্রে। ধীরে, বিলম্বিত লয়ে ওর আলিঙ্গন অধিকার করে আমায়। ঘাড়ের পেলব মসৃণতায় ওর দু'দিনের না কাটা দাড়ির কর্কশ স্পর্শ। অব্যক্ত ভাললাগায় তলিয়ে যেতে থাকি আমি, তাও খড়কুটোর সম্বল নিয়ে ছাড়া পেতে চাই,
"রান্না করতে হবে এবার, অ্যাপার্টমেন্টের গেট ন'টায় বন্ধ। ফ্ল্যাটে ঢুকতে না দিলে থাকব কোথায় রাতে?" বলি আর ওর বলিষ্ঠ শরীরের ওম আষ্ঠেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে, ফিসফিস ক'রে কে যেন মন্ত্রণা দেয় ওকে আরও নিবিড় করে বেঁধে নেওয়ার... সম্মোহিতের মত হাতদুটো পিছন দিকে অব্যর্থ নিশানায় বাড়িয়ে ওর ঘাড়-গলা বেষ্টন করি সাপিনীর মত। সঞ্জুর অধৈর্য আঙুলগুলো একে একে মুক্ত করে আমার টপের বাঁধন, খসে পড়ে লজ্জার এক স্তর। শঙ্খ লাগার মুহূর্ত আসন্ন জেনেও বাধা দিতে পারি না। ও আমায় ঘুরিয়ে নেয় নিজের দিকে, আমার মাধবীলতার মত কাঁপন জাগা ঠোঁট দেখে সতৃষ্ণ ঠোঁট নামিয়ে আনে একবুক পিপাসা ভরে। চোখ না খুলেও সব ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে। জিভ, মুখের নরম জমি আচ্ছাদিত হয়, পিষ্ট হয় পুরুষ অধরের আগ্রাসনে। ভিতরে গলতে থাকি আমি, নারীত্বের সব মধু জমা হয় অধররেখায়, উন্মুখ বোঁটায় ঝাপটা মারে কামনার হল্কা। সঞ্জুর ইতস্তত হাত খুঁজে ফেরে বক্ষবন্ধনীর দ্বারের আগল আর আমার যুক্তিবাদী মন ভাবতে থাকে 'পুনম ভাবী কখনও ব্লাউজের নীচে কিছু পরেছিল কি'?
ঈর্ষাদগ্ধ হৃদয়ে ক্ষতবিক্ষত যে নারী একটু আগেও অ্যালবামের পাতা উল্টে দীর্ণ হয়েছে প্রতিশোধস্পৃহার আগুনে, ভালবাসার স্পর্শে সেই যেন আহুতি দিয়ে জন্ম নিয়েছে এক অন্য মানবী। পুরুষের আনাড়িপনায় যে স্মিত হেসে কৌতুক আর লাস্য মেশানো অভ্যস্ত টানে এক লহমায় খুলে নিল ব্রায়ের হুক। বুকের শিকলি অভিকর্ষজ টানে মিশে যায় মাটিতে, জেগে থাকে শুধু দর্পিনী নারীত্বের দুই চূড়া...
আপনা থেকেই চোখ বুজে আসে মৌন অহংকারে। সঞ্জু এখন পুড়বে কামনার আগুনে, পুড়তে পুড়তে ছাই হয়ে যাবে তবু হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইবে আগুনের উৎস। ততক্ষণ আমি অপেক্ষা করে থাকব, ওর হাতের স্পর্শের...
নিরন্তর অপেক্ষাই বুঝি নারীজন্মের নিয়তি!