Posts: 6,494
Threads: 21
Likes Received: 6,992 in 3,702 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
239
পর্ব ২৯ (#০৩)
দেবায়নের অতি সঙ্গীন শারীরিক অবস্থা দেখে অনুপমার খুব ভয় হয়। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি খুব ধীরে ধীরে চলছে, মাথায়, হাতে পায়ে সব জায়গায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ওর চঞ্চল পুচ্চুকে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। অনেকক্ষণ দেবায়নের ঠাণ্ডা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে পাশে বসে থাকে। পরাশর ততক্ষণ রঞ্জিত আর বাড়ির কর্তার সাথে কথাবার্তা সেরে ফেলে। বাড়ির কর্তা ওদের জানায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেবায়নকে কোন বড় হসপিটালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করে দিতে। রঞ্জিত জানায় দেরাদুনে ভালো হসপিটাল আছে সেইখানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেবায়নকে নিয়ে ওদের রওনা হওয়া উচিত। অনুপমা আর দেরি করেনা, রঞ্জিত দেরাদুনের একটা বড় হসপিটালের সাথে কথাবার্তা সেরে ফেলে। ওদের সঙ্গের যে গাড়ি ছিল সেই গাড়িতে দেবায়নকে নিয়ে ওরা দেরাদুনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সামনের সিটে পরাশর আর রঞ্জিত পেছনে দেবায়নের মাথা কোলে অনুপমা। বাড়ির কর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা চারজনে দেরাদুনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
অসাড় দেবায়নের মাথা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে অনুপমা চাপা আশঙ্কায় প্রহর গুনতে গুনতে দেরাদুনের দিকে যাত্রা শুরু করে। পথে যেতে যেতে পরাশরকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেয়, “শোন এই খবর যেন কোন মতে কোলকাতা না পৌঁছায়, বুঝলি।”
পরাশর জিজ্ঞেস করে, “কেন রে, দেরাদুনে কেমন চিকিৎসা হবে সেটা ঠিক জানি না। কোলকাতা নিয়ে গেলে ভালো হত না? আর কাকিমাকেও এই বিষয়ে জানাতে হবে ত নাকি?”
অনুপমার গলা ধরে আসে, বুকের কাছে দেবায়নের মাথা চেপে ধরা গলায় পরাশরকে বলে, “খুব ভয় লাগছে রে, কি করব?”
পরাশর ওকে অভয় দিয়ে বলে, “কিছু হবে না। অত ওপর থেকে পরে যখন বেঁচে গেছে তখন ওর জীবন অনেক শক্ত। তুই চিন্তা করিস না দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”
দেবায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে পরাশরকে উত্তর দেয়, “জানিনা রে, ওকে চোখের আড়াল করতে একদম ইচ্ছে করছে না। তুই একটা কাজ করবি?” পরাশর মাথা দুলিয়ে জানায় সব কিছু করতে রাজি। অনুপমা ওকে বলে, “ওকে হসপিটালে ভর্তি করে তুই কোলকাতা চলে যাস। মামনিকে বিশেষ কিছু এখন জানাস না। তুই প্লিস কিছু করে মামনিকে নিয়ে দেরাদুনে চলে আসিস।” কিছুক্ষণ থেমে বলে ভাবুক কণ্ঠে ওকে বলে, “কে আসল আততায়ী সেটা না জানা পর্যন্ত আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। দেবায়ন বেঁচে আছে জানতে পারলে আততায়ী সতর্ক হয়ে যাবে, দ্বিতীয় বার ওর ওপরে হামলা করতে পারে। আমরা এখন জানিনা আততায়ী আমাদের নিজেদের কেউ না বাইরের কেউ সুতরাং এই খবর কোন মতেই যেন কোলকাতা না পৌঁছায়। আততায়ী নিশ্চয় আমাদের ওপরে কড়া নজর রেখে চলেছে না হলে আততায়ী এত দুর এসে দেবায়নকে মারতে চেষ্টা করত না। সুতরাং শ্রেয়া পায়েলকেও এই খবর জানানো যাবে না। ওরা জানতে পারলে নিশ্চয় এইখানে আসতে চাইবে আর ওদের পিছু নিয়ে আততায়ী এইখানে এসে পৌঁছে যাবে।”
পরাশর বলে, “কিন্তু সেটা কাকিমার ক্ষেত্রেও হতে পারে। আমি যদি কাকিমাকে নিয়ে বের হই তাহলে আততায়ীর সন্দেহ হতে পারে। তার চেয়ে ভালো আমি এইখানে থাকি আর তুই কোলকাতা ফিরে যা। তোকে একা কোলকাতা ফিরতে দেখলে আততায়ীর সন্দেহ দুর হয়ে যাবে যে দেবায়ন আর বেঁচে নেই। আর কাকিমাকে বলে বুঝিয়ে আনা একমাত্র তোর পক্ষেই সম্ভব। এরপরে দেবায়নকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারলে খুব ভালো হয়, মানে কোলকাতার বাইরে কোথাও যদি কোন বিস্বস্ত লোক থাকে তার কাছে হলে ভালো হয়।”
কিছুক্ষণ ভেবে অনুপমা ওকে বলে, “হ্যাঁ তুই ঠিক বলেছিস। দেখি একবার ব্যাঙ্গালোর ফোন করে। আমাদের এক হোটেলের মালিক দিলিপ বাবু নিশ্চয় আমাদের এই অবস্থায় সাহায্য করবেন।”
পরাশর ওকে বলে, “ঠিক আছে তুই দিলিপ বাবুকে ফোন করে দে আর আমি কাকুকে একটা ফোন করে দেই। আততায়ীকে খুঁজতে কাকুর সাহায্য আমাদের খুব দরকার পরবে।”
অনুপমা মাথা দোলায়, পরাশরের কাকা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইনস্পেকটর নিরঞ্জন বাবু, পায়েলের সময়ে ওদের খুব সাহায্য করেছিল। পরাশর সঙ্গে সঙ্গে কাকাকে ফোনে দেবায়নের নিরুদ্দেশের বিষয়ে কিঞ্চিত খবর দিয়ে বলে এই বিষয়ে যেন কাউকে না জানায়। নিরঞ্জন বাবু ওদের জানায়, সব রকমের সাহায্য করবেন তিনি।
অনুপমা দিলিপ বাবুকে ফোন করে বিস্তারে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে দিলিপ বাবু খুব ব্যাস্ত হয়ে পরেন, তিনি জানিয়ে দেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি দেরাদুনে পৌঁছে যাবেন। এক সময়ে অনুপমা আর দেবায়ন তাঁর জন্য যা করেছিল তাঁর প্রতিদান এখন শোধ করা হয়নি। দেরাদুনে পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। হসপিটালে আগে থেকে কথা বলা ছিল তাই ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি ওদের।
ডাক্তার দেবায়নকে পরীক্ষা করে জানায়, বেশ কয়েক জায়গায় হাড় ভেঙ্গে গেছে, চার পাঁচ দিন ঠাণ্ডা জলে থাকার ফলে হাইপোথারমিয়া আর ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়েছে। লিভারে আর ফুসফুসে জল ঢুকে গেছে। হৃদয় খুব ধীরে ধীরে চলছে। মাথার পেছনে আর ঘাড়ে বেশ জোর আঘাত পেয়েছে। দেবায়নকে বেশ কিছুদিন আই.সি.ইউ তে পর্যবেক্ষণের জন্য রাখতে চায়, জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত অথবা বাহাত্তর ঘন্টা না যাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা অসম্ভব। সব শুনে অনুপমার কেঁদে ফেলে, দাঁতে দাঁত পিষে ছলছল চোখে দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ওর পাশে বসে পড়ে।
পরাশরের সাথে ডাক্তারের কথাবার্তা হয়। অনুপমা চুপচাপ আই.সি.ইউ তে বসে থাকে। ওইদিকে ওর ফোনে শ্রেয়া, পায়েল জারিনা রূপক এরা সবাই ফোন করে করে হয়রান। পরাশর ভেবে পায় না কি উত্তর দেবে। কাঁচের ঘরের মধ্যে শায়িত অচৈতন্য দেবায়ন আর তার পাশে কঠিন রক্তশূন্য থমথমে চেহারা নিয়ে বসে অনুপমা। পরাশর সবাইকে এক কথা জানায় ওরা এখন দেবায়নের খোঁজ করছে। দেবশ্রীর খবর জানতে চাইলে সবাই জানায়, কেউই আর ভয়ে দেবায়নের বাড়ি যায়নি।
পরেরদিন বিকেল নাগাদ দিলিপ বাবু দেরাদুনে এসে হাজির হন। পরাশর সংক্ষেপে দেবায়নের দুর্ঘটনার বিষয়ে জানায়। দেবায়নকে নিস্তেজ নির্জীবের মতন পরে থাকতে দেখে ওনার মাথায় রক্ত উঠে যায়। দেবায়নের চোখ আর খোলে না দেখে অনুপমা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। ডাক্তারেরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যায় দেবায়নের জ্ঞান ফেরাবার জন্য কিন্তু দেবায়নের শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হয় না।
দিলিপ বাবুকে দেখে অনুপমার মনে কিঞ্চিত শক্তির সঞ্চার হয়, ছলছল চোখে দিলিপ বাবুর হাত ধরে অনুরোধ করে, “আমার খুব ভয় করছে। কার কাছে যাবো কিছুই ঠিক করতে পারছি না, একটু সাহায্য করবেন?”
দিলিপ বাবু ওর হাত ধরে অভয় দিয়ে বলে, “এই ভাবে কেন বলছ? আমার ওপরে তোমার অধিকার আছে, তুমি একবার আদেশ কর, সব কিছু করতে রাজি আছি আমি।”
পরাশর ওর হাত ধরতেই অনুপমা ভেঙ্গে পড়ে, “কি হবে রে, দুই দিন হয়ে গেল পুচ্চু যে চোখ খুলছে না।”
পরাশর ওকে জড়িয়ে ধরে অভয় প্রদান করে বলে, “এই মেয়ে, তুই চোখের জল ফেললে হবে কি করে? তোর বিয়ের পিঁড়ি উঠানো বাকি, ওর বিয়েতে নাচতে বাকি। এত তাড়াতাড়ি তুই ভেঙ্গে পড়লে কি করে হবে?”
অনুপমা কাতর কণ্ঠে দিলিপ বাবুকে বলে, “আপনি প্লিস দেবায়ন কে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যান, ওইখানে ওর চিকিৎসা করাতে শুরু করুন। আমি ওর মামনিকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে যাবো।”
সারাটা রাত কঠিন চাপা উৎকণ্ঠায় আর বিনিদ্র রজনী কেটে যায়। অনুপমা ক্ষণিকের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারে না। দেবায়নের পাশে ঠায় বসে থাকে, এই অপেক্ষায় কখন চোখ খুলবে। ভোরের দিকে অনুপমার চোখে একটু তন্দ্রা ভাব লেগেছিল কিন্তু ওর তন্দ্রার ঘোর একটা যান্ত্রিক আওয়াজে কেটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নার্সদের ডাক দেয় অনুপমা। নার্স এসে যন্ত্র দেখে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে। ডাক্তার নার্সদের দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে অনুপমা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। অনুপমাকে বলা হয় রুমের বাইরে যেতে। ডাক্তারেরা বেশ কিছুক্ষণ অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধ পত্র ইত্যাদি চালিয়ে দেবায়নকে নিয়ে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে যায়। চাপা উৎকণ্ঠায় অনুপমার প্রান ওষ্ঠাগত। হটাত দেবায়নের কি হল? অপারেশান থিয়েটাররে সামনে পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকে অনুপমা। একজন ডাক্তার বেশ কয়েক ঘণ্টা বাদে অপারেশান থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে এসে ওদের খবর দেয় দেবায়ন কোমায় চলে গেছে। সেই খবর শুনে অনুপমা চোখে অন্ধকার দেখে। তিন রাত ঠিক ভাবে ঘুমায়নি, ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া হয়নি। এমনিতে নিজে খুব ক্লান্ত আর দুর্বল ছিল। তাই ওই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। পরাশর ওকে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে।
জ্ঞান ফেরার পরে অনুপমা চোখ খুলে দেখে নিজেই একটা হসপিটালের বিছানায় শুয়ে। চোখ খুলেই দেখে ওর পাশে মাথা নিচু করে পরাশর আর দিলিপ বাবু বসে। ওদের এইভাবে নত মস্তক হয়ে থমথমে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। পরাশর কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। একা একা কত দিক সামলাবে কিছুই ঠিক করতে পারে না।
অনুপমা ছলছল চোখে পরাশরকে জিজ্ঞেস করে, “ডাক্তারেরা কি বলছে রে?”
পরাশর আর দিলিপ বাবু দুই জনেই মাথা নিচু করে থাকে। ওদের ওইভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুপমা নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।
পরাশর ওকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে, “এখন আমাদের হাতে বিশেষ কিছু নেই রে অনুপমা।”
অনুপমা বুক ভাঙ্গা চিৎকার করে ওঠে, “না……”
দিলিপ বাবু ওর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে প্রবোধ দিয়ে বলেন, “এইখানে এই অবস্থায় দেবায়নকে রেখে লাভ নেই। আমি তোমাদের ব্যঙ্গালোর নিয়ে যেতে চাই। ওইখানে ভালো ডাক্তার আছে, ওইখানে না হলে বাইরে যাওয়া যাবে। তুমি চিন্তা কর না, দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”
অনুপমা মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে। সবার মুখে এক কথা দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু দেবায়ন যে কোমায় চলে গেছে। মামনিকে কি উত্তর দেবে, কতদিন পরে দেবায়ন চোখ খুলবে, আদৌ কি আর চোখ খুলবে?
অনুপমা অনেকক্ষণ পরে চোখের জল মুছে পরাশরকে বলে, “আমি একাই আততায়ীকে এর শাস্তি দেব।”
পরাশর প্রমাদ গোনে, এই অবস্থায় অনুপমার পক্ষে একা সব দিক সামলানো অসম্ভব ব্যাপার, নিজেও একা কি ভাবে কি সামলাবে ঠিক করে উঠতে পারে না। পরাশর ওকে শান্ত করে বলে, “মাথা ঠাণ্ডা কর। তুই একা নস, আমি ও তোর পাশে আছি। যা হবার দেখা যাবে। আততায়ীর যদি সূর্য অথবা ধৃতিমান হয় তাহলে পরের আঘাত কাকিমার ওপরে আসবে। যত তাড়াতাড়ি কাকিমাকে কোলকাতা থেকে সরিয়ে ফেলা ভালো। আর আততায়ী যদি অন্য কেউ হয় তাহলে পরের আঘাত তোর ওপরে হানবে, সেই মতন আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।”
অনুপমা দাঁতে দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “এর শেষ কোথায় দেখতে চাই।”
দিলিপ বাবু হসপিটাল কত্রিপক্ষের সাথে কথাবার্তা বলে, আলোচনা সেরে দেবায়নকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে নেন। দিলিপ বাবু জানান ব্যাঙ্গালোরে তাঁর অনেক চেনাজানা ডাক্তার আর হসপিটাল আছে। সেখানে নিয়ে নিজেস্ব তত্তাবধনে দেবায়নের চিকিৎসা শুরু করবেন।
পরেরদিন সকালে প্লেনে দেবায়নকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায় সবাই। দিল্লী হয়ে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। ব্যাঙ্গালোরে দিলিপ বাবুর চেনাশোনা একটা বড় হসপিটালে দেবায়নকে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করা হয়। এই কয়দিনে দেবায়নের আর অনুপমার খবর নেওয়ার জন্য সবাই কোলকাতা থেকে ফোন করে, কিন্তু অনুপমার নির্দেশ অনুযায়ী পরাশর সবাইকে এক কথা জানায়, যে এখন ওরা দেবায়নকে খুঁজে পায়নি। পারমিতা, সোমেশ বাবু মেয়ের জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন, কিন্তু অনুপমা কারুর সাথে কথা বলে না। ওর মাথায় শুধু একটা চিন্তা, এই দুর্ঘটনার পেছনে আসল দোষী কে আর কি তার উদ্দেশ্য।
পরেদিন চাপা উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে পরাশরকে সঙ্গে করে অনুপমা কোলকাতার উদ্ধেশ্যে রওনা দেয়। বুকের মধ্যে চাপা ভয়, এই খবর শুনে ওর মামনির কি অবস্থা হতে পারে। ব্যাঙ্গালোর থেকে প্লেনে চড়ার আগেই ফেরার টিকিট কেটে নিয়েছিল পরাশর, জানে, একবার এই খবর দেবায়নের মায়ের কাছে পৌঁছালে তৎক্ষণাৎ এক মা তাঁর ছেলের কাছে আসতে চাইবে। প্লেনে ওঠা মাত্রই অনুপমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে। কোলকাতা নেমে মামনিকে কি বলবে, কি ভাবে মামনির সামনে দাঁড়াবে, কি বলে মামনিকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে আসবে, এই ভাবতে ভাবতে ওদের প্লেন কোলকাতা এয়ারপোর্টে নামে। পরাশর শুধু মাত্র জারিনাকে জানিয়ে রেখেছিল যে ওরা কোলকাতা আসছে। তাই জারিনা তার বাবাকে নিয়ে ওদের জন্য কোলকাতা এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিল। পরাশরের মুখে দেবায়নের বিষয়ে সব কিছু শোনার পরে জারিনার বাবা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি জানান তাঁর জানাশোনা ডাক্তার দের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করবেন।
গাড়িতে উঠে লেকটাউনে দেবায়নের বাড়ির সামনে আসতেই অনুপমার হৃদপিণ্ড গলায় এসে আটকে যায়। বাড়ির মধ্যে মামনি নিশ্চয় নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজে ব্যাস্ত। ছেলে বেড়াতে গেছে, যেখানে গেছে সেখানে মোবাইল টাওয়ার পাওয়া যায়না। ওদের কথা ছিল, খাটলিং থেকে ঘুট্টু ফিরে প্রায় দশ দিন পরে সবাই বাড়িতে ফোন করবে। ইতিমধ্যে যে এত কান্ড ঘটে গেছে সেই খবর দেবায়নের মাকে জানানোর সাহস কারুর মধ্যে কুলায়নি। পরাশর আর অনুপমা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
পরাশর ওর কাঁধে হাত রেখে সাহস দিয়ে বলে, “ভেতরে যা, আমি পেছনে আছি।”
অনুপমা চোখ বুজে একবার দেবায়নের নির্জীব চেহারা বুকের মধ্যে এঁকে নেয় তারপরে কলিং বেল বাজিয়ে চাপা উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দরজা খোলার অপেক্ষায়।
এই অসময়ে কলিং বেল বেজে উঠতে দেবশ্রী তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে অনুপমা কে দেখে বিস্মিত হয়ে যায়। স্মিত হেসে ওর গালে হাত দিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস, “কেমন ঘুরলি রে তোরা? শরীর খারাপ করেনি তো?” তারপরে পেছনে পরাশরকে দেখে কিঞ্চিত অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁরে বাকিরা কোথায়?”
মামনির মিষ্টি হাসি আর মাতৃসুলভ আচরন দেখে অনুপমার চোখ ফেটে জল চলে আসে। সেই মুক বেদনা দেবশ্রীর চোখ এড়াতে পারে না। বুক কেঁপে ওঠে দেবশ্রীর কম্পিত কণ্ঠে অনুপমা আর পরাশরকে প্রশ্ন করে, “দেবু কোথায় রে? তোদের সাথে আসেনি কেন?”
বুক ভরে শ্বাস নেয় অনুপমা, এইবারে ওকে গভীর জলে ঝাঁপ দিতে হবে। কি ভাবে শুরু করবে, কোথা থেকে শুরু করবে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারে না অনুপমা। মামনির দুই হাত ধরে বসার ঘরের সোফায় বসিয়ে বলে, “দেবায়ন কিছু কারনে আসতে পারেনি, মামনি।”
অনুপমার ধরা গলা আর ছলছল চোখ দেখে দেবশ্রীর সন্দেহ হয়, ওকে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে দেবায়নের?”
মামনির প্রশ্নের সঠিক উত্তর অনুপমার অজানা তাই চোয়াল চেপে অশ্রু সংবরণ করে চুপচাপ মাথা নিচু করে মামনির হাত ধরে বসে থাকে।
পরাশর বুক ঠুকে দেবশ্রীকে বলে, “তোমাকে আমাদের সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।”
শূন্য চোখে একবার পরাশরের দিকে তাকায় একবার অনুপমার দিকে তাকায় দেবশ্রী। ওর চোখের সামনে সারা পৃথিবী নড়তে শুরু করে দেয়। দেবশ্রী কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আমার দেবু, ঠিক আছে না…..?”
আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না দেবশ্রী। মায়ের হৃদয় ফাঁকা হয়ে যায় সামনের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। খুব কম বয়সে নিজের স্বামীকে হারিয়েছে, এক মাত্র ছেলেকে বুকে করে ধরে মানুষ করেছে। চোখ বন্ধ করে ইষ্ট নাম নিয়ে কাতর প্রার্থনা জানায়, এক মাত্র সন্তানের চিতায় অগ্নি প্রদানের শাস্তি যেন ভগবান ওকে না দেয়।
পরাশর দেবশ্রীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাত ধরে বলে, “তুমি গেলে দেবায়ন নিশ্চয় ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চল আমাদের সাথে।”
দেবশ্রীর প্রশ্ন করার মতন কোন শক্তি ছিল না। চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করে দেয়। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে অনুপমার কোলে ঢলে পরে। পরাশর রান্না ঘর থেকে জল এনে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিয়ে জ্ঞান ফেরায়। শূন্য চাহনি নিয়ে অনুপমা আর পরাশরের দিকে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে দেবশ্রী, ওর পৃথিবী খন্ড খন্ড হয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে ওর চোখের সামনে।
অনুপমার হাত ধরে দেবশ্রী প্রশ্ন করে, “সত্যি বল কি হয়েছে দেবুর?”
অনুপমার জানে ও ভেঙ্গে পড়লে ওর মামনি ভেঙ্গে পরবে তাই অশ্রু রুদ্ধ কণ্ঠে অভয় দিয়ে বলে, “তুমি চল না আমাদের সাথে, তুমি গেলেই দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”
দেবশ্রী আর কথা বাড়ায় না, মেয়েটা ওকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে না। কোন রকমে একটা ব্যাগ গুছিয়ে ওদের সাথে বেড়িয়ে পরে। আসার সময়ে রাতের প্লেনে ব্যাঙ্গালোর ফিরে যাওয়ার টিকিট কাটা হয়েছিল। প্লেনে ওঠার আগেই পরাশর দিলিপ বাবুকে জানিয়ে দেয় যে ওরা দেবায়নের মাকে নিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে যাবে। ওদের নির্দেশ অনুযায়ী দিলিপ বাবু গাড়ি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি করে সোজা হসপিটালে নিয়ে যায় দেবশ্রীকে। একমাত্র ছেলেকে নির্জীবের মতন বিছানায় পরে থাকতে দেখে দেবশ্রীর পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। ছলছল চোখে শুধু মাত্র অনুপমার রক্ত শূন্য বেদনা যুক্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। অনুপমা এক এক করে সবিস্তারে দেবায়নের দুর্ঘটনা মামনির সামনে তুলে ধরে।
অনুপমার সাহস আর অনুপমার ধৈর্য শক্তি দেখে দেবশ্রী অবাক হয়ে যায়, ওকে প্রশ্ন করে, “তুই কি করে নিজেকে সামলে রেখেছিস?”
অনুপমা আর নিজেকে সামলাতে পারে না, “তোমার সামনে কি করে…..” মামনিকে জড়িয়ে ধরে শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে পরে অনুপমা। ওর আশা ওর ভরসা ওর সব কিছু যেন জলে ভেসে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
পরেরদিন সকালে দিলিপ বাবু আর তাঁর স্ত্রী কণিকার তত্বাবধানে মামনি আর দেবায়নকে রেখে অনুপমা আর পরাশর আততায়ীর খোঁজে বেড়িয়ে পড়ে। কোলকাতা ফিরে আসার আগে দিলিপ বাবু ওদের জানিয়ে দেয় আর কোন সাহায্যের দরকার হলে যেন তাঁকে জানাতে না ভোলে।
যাওয়ার আগে দেবশ্রীর পায়ে হাত দিয়ে সংকল্প করে অনুপমা, “আমি কথা দিচ্ছি মামনি…..”
দেবশ্রী ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ছেলের কি হবে জানিনা তবে তোকে হারাতে আমি চাই না রে।”
পরাশর দেবশ্রীকে অভয় দিয়ে বলে, “আপনার ছেলেও হারাবে না আর অনুপমাও হারাবে না। দুই জনেই ভালো হয়ে ফিরে আসবে কথা দিলাম।”
প্লেনে উঠে অনুপমাকে প্রশ্ন করে পরাশর, “এই বারে কি করনীয়? কাকিমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর ফলে তোর ওপরে আততায়ীর নজর আরো বেড়ে যাবে। যেভাবে আততায়ী জঙ্গলের পথে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে পালিয়ে গেছে তাতে মনে হয় ওই আততায়ী এক নয় ভাড়া করা পাহাড়ি লোক না হয় অনেকদিন থেকেই দেবায়ন কে মারার ষড়যন্ত্র করেছে।”
•
Posts: 6,494
Threads: 21
Likes Received: 6,992 in 3,702 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
239
অনুপমা ভাবতে বসে, “ঠিক বলেছিস, যে ভাবে আততায়ী সোজা রাস্তা না ধরে পাহাড়ি জঙ্গল ধরে পালিয়েছে তাতে দুটো তথ্য আমাদের সামনে আসছে। এক, আততায়ী ভাড়া করা পাহাড়ি লোক যে ওই এলাকা ভালো করে চেনে আর দ্বিতীয়, আততায়ী নিজেই ওই পাহাড়ে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু এইভাবে ঘুরে বেড়াতে হলে আততায়ী নিশ্চয় অনেকদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে। কোলকাতা ফিরে সব থেকে আগে আমাদের এইটা দেখতে হবে কে কে কতদিন ধরে বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে। আর তাঁর সাথে সাথে আমাদের দেখতে হবে দেবায়নকে খুন করার পেছনে আসল কি কি কারন হতে পারে। কয়েকটা কারন অবশ্য আমাদের জানা কিন্তু কয়েকটা বিষয় আমাকে নিজেই একবার খুঁজে বের করতে হবে।”
পর্ব ২৯ (#০৪)
এয়ার হোস্টেস এসে খাবার দিয়ে গেল, কিন্তু সেই খাবার কিছুতেই আর অনুপমার গলা দিয়ে নামতে চায় না। ওর মন পরে থাকে ব্যাঙ্গালোরে, ওর দেবায়নের পাশে আর ওর মামনির পাশে। কোলকাতা ফিরে নিজের বাড়িতে না দেবায়নের বাড়িতে, কোথায় উঠবে সেটা এখন ঠিক করে উঠতে পারেনি। চুপচাপ বসে খাবার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে উদাস চাহনি নিয়ে বাইরের কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পরাশর ওর মনের অস্থিরতা বুঝতে পেরে ওকে বলে, “এই ভাবে খাওয়া দাওয়া যদি ছেড়ে দিস তাহলে কি হবে বল। কোথায় যাবি কিছু ঠিক করলি? এখন পর্যন্ত কাউকে জানানো হয়নি যে আমরা কোলকাতা ফিরছি।”
শূন্য চোখে পরাশরের দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করে অনুপমা, “হ্যাঁ রে, দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে তো?”
পরাশর ওর হাতের ওপরে হাত রেখে শক্তি দিয়ে বলে, “হ্যাঁ ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ কর, আজকে আমার বাড়িতে চল। কাল সকালে দেখা যাবে কি করা যায়।” কিছুক্ষণ থেমে কিছু চিন্তা করে ওকে বলে, “আমি বলছিলাম যে…..” অনুপমা ওর দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে। পরাশর ওকে বলে, “কোন নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে তদন্ত করালে ভালো হয়, মানে কাকুকে বলে। আমরা এমনিতে এফ.আই.আর করে এসেছি। এইবারে ক্রাইম ব্রাঞ্চ অনায়াসে সেই তদন্তের ভার নিতে পারবে।”
কঠিন কণ্ঠে অনুপমা জানায়, “না, আমি একাই খুনিকে শাস্তি দেব।”
পরাশর ওকে বলে, “এতে অনেক ঝুঁকি আছে অনু। হিতে বিপরিত হতে পারে। আর সব থেকে বড় ব্যাপার, আমরা হয়ত এমন আসল লোককে এড়িয়ে যেতে পারি। হয়ত আততায়ী আমাদের খুব কাছের মানুষ যার ওপরে আমাদের সন্দেহ একদম হচ্ছে না।”
অনুপমা প্রশ্ন করে, “কি বলতে চাইছিস একটু খুলে বল।”
পরাশর উত্তরে বলে, “না মানে, এই দেখ। দেবায়ন কার পথ থেকে সরে গেলে সে বেশি লাভবান হবে।”
“বাবা” বলতে গিয়েও থেমে গেল অনুপমা, উল্টে প্রশ্ন করে, “কেন, ওকে সরাবার উদ্দেশ্য অনেকের থাকতে পারে। এই যেমন, ধৃতিমান, সূর্য, ইন্দ্রনীল, অনিমেশ, রজত পানিক্কর এরা।”
পরাশর ঠোঁটের কোনে বাঁকা হেসে বলে, “আরো একজন হতে পারে, রূপক আর শ্রেয়া।”
অনুপমা আঁতকে ওঠে, “না না, ওরা কখনই হতে পারে না। শ্রেয়া আমার সব থেকে ভালো বান্ধবী আমার জন্য অনেক করেছে।”
পরাশর ওকে বলে, “জানি, কিন্তু সেটা একটা গভীর ষড়যন্ত্রের একটা চাল হতে পারে। একটু ভালো ভাবে চিন্তা করে দেখ। এই খাটলিং গ্লেসিয়ার যাওয়ার পরিকল্পনা কার? রুপকের। আর কি কেউ জানত যে আমরা খাটলিং গ্লেসিয়ার যাচ্ছি? হয়ত নয়।”
মাথা নাড়ায় অনুপমা, সত্যি, ওদের এই ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে শুধু মাত্র ওর বাবা আর রূপক জানে। অন্য কেউ হয়ত জানেই না এই বিষয়ে।
পরাশর আরো বলে, “কে সব থেকে বেশি লাভবান হল? রূপক আর শ্রেয়া। একটু ভালো ভাবে চিন্তা কর। তুই আসার আগে ওদের হাতে কোম্পানির ভার তুলে দিয়ে এলি। দেবায়ন না ফিরলে তোর কি হত সেটা অবশ্য জানা নেই। পায়েল প্রচন্ড শান্ত প্রকৃতির মেয়ে হয়ে গেছে আর অঙ্কন অনেক ছোট। ওদের অতি সহজে হাত করে নিতে পারবে রূপক আর শ্রেয়া। যদি বলি, ওরা এটাই চেয়েছিল?”
বাকশুন্য হয়ে যায় অনুপমা, এত গভীর দুরাভিসন্ধি করবে ওর বিরুদ্ধে? অনুপমা মাথা ঝাঁকায়, “না না, এটা হতে পারে না। শ্রেয়া আমার সাথে এত বড় প্রতারনা করতে পারে না। কিন্তু দেবায়নের দুর্ঘটনার সময়ে, রূপক আর শ্রেয়া আমাদের সাথেই ছিল। ওদের চেহারা…..”
পরাশর ওকে বলে, “আমি বলছি না যে এটাই হয়েছে, তবে এটা হতে পারে। সুতরাং সর্ব প্রথম ওদের ওপরে আমাদের খুব কড়া নজর রাখতে হবে। নিজে হাতে করেনি তবে টাকা দিয়ে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে এই কাজ অনায়াসে করা যেতে পারে।”
অনুপমা চিন্তায় পরে যায়, “তাহলে কাকে বিশ্বাস করব, বল?”
পরাশর স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “কাউকে নয়, এমন কি আমাকেও নয়।” ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে ইয়ার্কির সুরে বলে, “দেবায়ন সরে গেলে আমার বড় লাভ হত, তোকে একা পেয়ে একটু প্রেম করতে পারতাম।”
অনুপমার চোখে অনেকদিন পরে খানিক হাসির ঝিলিক দেখা দেয়। পরাশরের কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “হ্যাঁ, আর বলিস না তুই শয়তান ছেলে…..”
অনেকদিন পরে অনুপমার চেহারায় হাসি দেখে পরাশরের বেশ ভালো লাগে, ওর হাতের ওপরে হাত রেখে মনে সাহস দিয়ে বলে, “এই হাসিটাকে আর লুকাস না প্লিস, দেবু বড় কষ্ট পাবে।”
চোখ জোড়া ছলকে ওঠে অনুপমার, “বলছিস? কিন্তু কোলকাতা নামলে আমাদের চেহারার অভিব্যাক্তি একদম বদলে ফেলতে হবে। দেবায়ন যে নেই এটা সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে।”
পরাশর স্মিত হেসে বলে, “এই হাসি ভেতরে রাখ সেটাই অনেক কাজে দেবে। মন মরা হয়ে থাকলে উৎসাহ খুঁজে পাবি না।”
কোলকাতা নেমেই ব্যাঙ্গালোরে ফোন করে দেবশ্রীকে জানিয়ে দেয় ওরা ঠিক ভাবে পৌঁছে গেছে, সেই সাথে দেবায়নের বিষয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে এখন ওর শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। ডাক্তারেরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তবে….. বাকিটা আর শুনতে ইচ্ছে হল না অনুপমার। ওইদিকে মামনির ভাঙ্গা কণ্ঠ এদিকে ওর ভগ্ন হৃদয়। অনুপমা ঠিক করে রাতে দেবায়নের বাড়িতে কাটাবে। দেবায়ন না থাকুক, ওর বিছানায় শুয়ে ওর জামা পরে ওর ছোঁয়া গায়ে মেখে এক রাতের জন্য দেবায়নের শরীরের পুরাতন ঘ্রাণ নিতে চায়।
দেবায়নের বাড়ির দরজা খুলে ফাঁকা ঘর দেখে অনুপমার হৃদয় হুহু করে কেঁদে ওঠে, কিন্তু নিজেকে শক্ত করে নেয় অনুপমা। আলো জ্বালিয়ে দেবায়নের ঘরে ঢুকে ওর জামা পরে চুপচাপ ওর বিছানার ওপরে শুয়ে ভাবতে বসে। সত্যি কি শ্রেয়া আর রূপকের চাল এটা না বাবার কোন ষড়যন্ত্র। দেবায়ন সরে গেলে শ্রেয়া আর রূপক সব থেকে বেশি লাভবান হবে অথবা হয়েছে। বাবাও প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ওরা যে খাটলিং যাবে এই কথা শুধু মাত্র বাবার আর রূপকের পক্ষেই জানা সম্ভব। কিন্তু বাবা কি শুধু প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে দেবায়নকে সরিয়েছে না এর পেছনে আরো কোন গভীর কারন আছে? হয়ত বাবার কোন গোপন কথা দেবায়ন জেনে ফেলেছে আর তাই হয়ত বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে দেবায়ন যার ফলে ওর বাবা দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু যদি দেবায়ন ওর বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করে থাকে তাহলে তার পরিবর্তে কি চেয়েছে? টাকা পয়সা, সম্পত্তি? দেবায়নের দুটো ব্যাংক একাউন্ট আছে যার মধ্যে একটা দেবায়নের নিজের। ল্যাপটপ খুলে সেই একাউন্ট চেক করে দেখে তাতে এমন কিছু টাকা নেই অথবা টাকার লেনদেন হয়নি। দ্বিতীয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ওর সাথে জয়েন্ট, সেই ব্যাঙ্ক একাউন্ট বেশির ভাগ সময়ে নিজেই চালায়। দেবায়নের টাকার দরকার পড়লে ওর কাছ থেকে চেয়ে নেয়। তাহলে কি সম্পত্তি চেয়েছে দেবায়ন? এতটা নীচ কাজ কি দেবায়ন করবে? ভাবতেই ওর শরীর ঘৃণায় শিউরে ওঠে। না, এতটা নীচ দেবায়ন হয়ত হবে না। আসল কারন জানতে হলে বাবার ওপরে আর রূপকের ওপরে কড়া নজর রাখা দরকার।
সারাটা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারে না অনুপমা, ওর মাথা আর কাজ করছে না। আলমারি খুলে কাগজ পত্র ঘেঁটে দেখে যদি কিছু তথ্য পাওয়া যায় এই সম্পত্তির বিষয়ে। কাগজ পত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হটাত একটা ফাইলে ওর নজর পরে যায়। হলদে ফাইল, ওপরে লেখা “অফিস ওয়ার্কস” ভেতরে অজস্র কাগজ পত্র। ফাইল হাতে নিয়ে বিছানায় ছড়িয়ে বসে পড়ে। কাগজ গুলো সব ব্যাবসা সংক্রান্ত। একটা কাগজ হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যায়। পুনের হোটেলের কাগজ। রজত পানিক্করের দুটো হোটেলের মালিকানার কাগজের জেরক্স। বহুদিন আগে মেহেকের সাহায্যে একটা হোটেল দেবায়ন হাতিয়ে নিয়েছিল কিন্তু তারপরে আরো একটা হোটেল কি ভাবে করায়ত্ত করেছে সেই খবর জানার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। হতে পারে সেই প্রতিশোধে রজত পানিক্কর দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে এর সদুত্তর পাওয়া যাবে, কিন্তু বাবাও সন্দেহের ঘেরে রয়েছে।
কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পরে অনুপমা ঠিক করে একবার নিজের পরিচয় দিয়ে হোটেলে ফোন করবে। হোটেলের রিসেপশানে ফোন করে ম্যনেজারের সাথে কথা বলে অনুপমা জানতে পারে যে রজত পানিক্কর দুই মাস আগেই দেহ রক্ষা করেছেন। তাঁর দুই ছেলে রজত পানিক্করের দুটো হোটেল মিস্টার সোমেশ সেন কে বিক্রি করে দেন। এই খবর ওর জানা ছিল না, দেবায়ন অথবা ওর বাবা ব্যাবসার বেশির ভাগ খবর ওকে জানায় না। ওর সন্দেহের তালিকা থেকে রজত পানিক্করকে বাদ দিতে হয়।
কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরো একটা কাগজ উদ্ধার করে। ওদের কন্সট্রাকশান কোম্পানির একটা ইনিসিয়াল ড্রাফট। কাগজ খানা পড়ার পরে আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে যায়। নিবেদিতার কন্সট্রাকশান কোম্পানির সাথে ওদের কন্সট্রাকশান কোম্পানি মিলিত হয়ে একটা কোম্পানি হয়ে যাবে, এবং সেই কোম্পানির কর্ণধার স্বয়ং নিবেদিতা। যদিও ওই কোম্পানি ওদের গ্রুপ কোম্পানির অধীনে থাকবে কিন্তু সিংহ ভাগ মালিকানা, সত্তর শতাংশের মালিকানা নিবেদিতার হাতে। হঠাৎ দেবায়ন নিবেদিতার ওপরে এতটা সহৃদয় কেন? ওর পেছনে কি নিবেদিতার সাথে দেবায়নের কোন গোপন সম্পর্ক গঠন হয়েছে? দুই কম্পানিকে মিলিত করার আসল চিন্তা ধারা কি নিবেদিতার না দেবায়নের? ওর বাবা কি আদৌ জানেন এই বিষয়ে? হয়ত এই বিষয়ে জেনে গেছেন ওর বাবা আর সেই জন্যেই দেবায়নকে সরিয়ে দিয়েছে। বহু প্রশ্ন ওর মাথার মধ্যে ভর করে আসে, কিন্তু সঠিক উত্তর কিছুতেই খুঁজে পায় না। দেবায়নের এই পরিনতির পেছনে কি আসলে দেবায়ন নিজেই দায়ী? ওর পুচ্চু কি সত্যি এক খলনায়ক? উত্তর গুলো ওকে জানতে হবেই।
•
Posts: 6,494
Threads: 21
Likes Received: 6,992 in 3,702 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
239
সকাল বেলা পরাশরের ফোনে ওর ঘুম ভাঙ্গে। অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছিল, তাই ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায়। পরাশর জানায় গত রাতে কাকুর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। ওর কাকা একবার অনুপমার সাথে দেখা করতে চায়। অনুপমা জানিয়ে দেয়, বিকেলের দিকে দেখা করবে। এখন নিজের বাড়িতে যেতে চায়। নিজের ব্যাগ গুছিয়ে, ব্যাঙ্গালোর ফোন করে মামনি আর দেবায়নের খবর নিয়ে নেয়। তারপরে বাড়িতে প্রথমে মাকে ফোন করে।
পারমিতা ওর ফোন পেয়েই প্রশ্ন করে, “এতদিন একটা খবর নেই। পরাশরকে ফোন করলে ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া যায়না, তুই আমাদের কি ভেবেছিস? আমরা কি তোর পর যে আমাদের ফোন উঠাস না?”
মায়ের এই উদ্বেগজনিত কণ্ঠস্বরকে ক্ষান্ত করে উত্তর দেয়, “পর নয়, তবে…..” মনে পড়ে যায়, কেউ জানে না দেবায়নের বিষয়ে সুতরাং সেই বেদনা ভাঙ্গা হৃদয় সবার সামনে প্রস্তুত করতে হবে। ধরা গলায় বলে, “মা….. ওকে…..”
পারমিতা আশঙ্কা ব্যাক্ত করে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে? তুই কোথায়? দেবায়ন…..”
অনুপমা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলে, “না খুঁজে পাইনি। আমি এয়ারপোর্টে, একটু পরেই বাড়ি আসছি।”
পারমিতা মেয়েকে কি সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায়না, “আচ্ছা….. আয়….. মনে হয় এটা আমাদের অদৃষ্টে ছিল, হয়ত আমাদের পাপের ফল যে ছেলেটা এইভাবে চলে গেল।”
দাঁতে দাঁত পিষে নিজের মনের ভাব সংবরণ করে নেয় অনুপমা, কার পাপের ফল জানা নেই তবে যদি বাবা অথবা রূপক দোষী হয় তাহলে ওর অনুপমা মরেও শান্তি পাবে না। তবে এই দুইজনার দিকে আঙ্গুল তোলার আগে ভালো ভাবে খুঁটিয়ে বিচার করে দেখতে হবে।
সকালের দিকেই ট্যাক্সি ধরে সোজা বাড়ি পৌঁছায় অনুপমা। ওকে দেখে পারমিতা, পায়েল অঙ্কন সবাই দৌড়ে আসে। ওর বাবা সেদিন আর অফিসে যায়না। মেয়েকে এই ভাবে ভেঙ্গে যেতে দেখে পারমিতার বুক ফেটে যায়। অনুপমা কি করবে ভেবে পায় না। বাবার চেহারায় কঠিন চিন্তার ছাপ, মেয়ের এই অভাবনীয় কষ্ট দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করে। মনের এক কোনায় প্রশ্ন জাগে, বাবাও কি ওর মতন মুখোশ এঁটে না সত্যি মেয়ের জন্য চিন্তিত।
সবাই ওকে চেপে ধরে জানার জন্য। অনুপমা মিথ্যে গল্প বানিয়ে ওদের জানায় ঘুট্টুতে, ঘনসিয়ালিতে বিভিন্ন জায়গায় অনেক খুঁজেছে, এমন কি রেপ্লিং করে খাদের মধ্যে নেমে নদীর দুই পাড়ে অনেকদিন ধরে তল্লাসি করেও দেবায়নের সন্ধান পাওয়া যায়নি, এমন কি আততায়ীর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে ঘনসিয়ালির পুলিসের কাছে এফ.আই.আর করা আছে, পুলিস আস্বাস দিয়েছে যে সেই ছেলেটার খোঁজ পেলে ওদের খবর দেবে।
এই গল্প বলার সময়ে বারেবারে ওর সাথে পায়েলের চোখাচুখি হয়ে যাচ্ছিল। মনে হয় পায়েল কিছু বলতে চায় অথবা পায়েল হয়ত ওর মিথ্যে গল্প ধরে ফেলেছে। শ্রেয়া যে ইন্দ্রনীলের সাথে ছলনার খেলা খেলেছিল সেটা পায়েল জানত কিন্তু ওকে বলেনি, হতেও পারে এইবারে পায়েল অনেক কিছু জানে কিন্তু ওকে বলার কিছু সময় পায়নি। বাবা, মাকে সব ঘটনা বলার পরে পায়েল কে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে অনুপমা। ওকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়েই পায়েল ওকে জড়িয়ে ধরে দুঃখ প্রকাশ করে কেঁদে ফেলে। অনুপমা কাকে সান্ত্বনা দেবে ঠিক করে উঠতে পারে না, পায়েল কে সত্যি বলবে কি না সেটাও ভেবে উঠতে পারে না।
পায়েল ওকে বলে, “তুই চলে যাওয়ার পর থেকে শ্রেয়া আর রূপক বসে নেই জানিস।”
আবার ওর অবাক হওয়ার পালা, প্রশ্ন করে অনুপমা, “মানে?”
পায়েল উত্তর দেয়, “তুই ঘুট্টু চলে গেলি, আর শ্রেয়া আর রূপক সোজা জলপাইগুড়ি গিয়েছিল সূর্যের খবর নেওয়ার জন্য।”
অনুপমা মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে, “এত কিছু করেছে ওরা?”
পায়েল আরো জানায়, “জলপাইগুড়িতে ওদের না পেয়ে আশে পাশের লোক জনের কাছ থেকে খবর যোগাড় করে জানতে পারে যে সূর্য আর মনিদিপা কোলকাতা চলে এসেছে। তারপরে শ্রেয়া আর রূপক দুইজনে সূর্যের বাড়ি যায়। তুই নাকি কয়েকদিন আগে ওদের টাকা দিয়েছিলি?”
বুক ভরে শ্বাস নেয় অনুপমা, “হ্যাঁ।”
পায়েল ওকে বলে, “রূপকের রুদ্র মূর্তি দেখে সূর্যের অবস্থা খারাপ।”
অবাক অনুপমা ওকে জিজ্ঞেস করে, “সূর্যের সাথে আর কি করেছে ওরা?”
পায়েল মাথা নাড়ায়, “না না, মারপিট এই সবে যায়নি, শুধু মাত্র খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কবে কোথায় ছিল, ইত্যাদি। তবে ওরা দেবায়নকে মারেনি, ওদের সেই ক্ষমতা নেই। সূর্যের উপরে রূপকের সন্দেহ ইন্দ্রনীল আর ওর বাবার ওপরে পড়ে। টালিগঞ্জে ওদের ফ্লাটে গিয়ে দেখে মিস্টার অনিমেশ শ্রেয়ার ওই ঘটনার পরে ফ্ল্যাট বিক্রি করে জার্মানি চলে গেছে। সত্যি মিথ্যে যাচাইয়ের জন্য শ্রেয়া সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার হেরজোগকে ফোন করে। মিস্টার হেরজোগকে শ্রেয়া সবিস্তারে সব কিছু খুলে বলে। মিস্টার হেরজোগ খবর লাগিয়ে ওদের জানায় যে ইন্দ্রনীল স্থায়ী ভাবে লন্ডনে চলে গেছে আর ওর বাবা মিস্টার অনিমেশ আবার ব্যাঙ্কে চাকরি করছে।”
অনুপমা শূন্য চাহনি নিয়ে পায়েলের দিকে তাকিয়ে থাকে। এতদিন ধরে যাদের যাদের সন্দেহের তালিকাভুক্ত করেছিল তাদের সবাই সন্দেহের ঘের থেকে পার পেয়ে গেল। নিজের বান্ধবী শ্রেয়া, ওর সন্দেহের তালিকা থেকে মুক্তি পায়নি। শ্রেয়া আর রূপককে ওর বিষয়ে এতটা চিন্তিত জানতে পেরে ওর দুই চোখ ছলছল করে ওঠে। বাকি থাকে শুধু মাত্র একটা প্রশ্নের উত্তর। আততায়ী কি তাহলে আসলে ওর বাবা?
•
Posts: 6,494
Threads: 21
Likes Received: 6,992 in 3,702 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
239
পর্ব ২৯ (#০৫)
অনুপমার চিন্তার গতিতে বাধা প্রাপ্তি হয় পায়েলের হাতের ছোঁয়ায়, “কোথায় হারিয়ে গেলিরে? খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি রে। আমারো খুব দুঃখ লাগছে, কিন্তু কি করতে পারি বল। পুলিস কি কিছু করছে?”
অনুপমা ছলছল চোখে পায়েলের দিকে তাকিয়ে থাকে, একে কি দেবায়নের বিষয়ে বলা ঠিক হবে? শ্রেয়া আর রূপকের ওপরে সন্দেহ করেছে ভেবেই মনের ভেতরে কুণ্ঠাবোধ জেগে ওঠে। মন পরে থাকে নির্জীব শায়িত দেবায়নের পাশে। চোখ মুছে বহু কষ্টে হাসি টেনে বলে, “না রে, হারিয়ে যায়নি আমি। তোর সাথে একটু গোপন কথা আছে। ভাই ছাড়া আর কাউকে বলসি না যেন।”
পায়েল অধীর চিত্তে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুপমা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ধরা গলায় বলে, “পুচ্চুকে খুঁজে পেয়েছি।”
কথাটা কানে যেতেই দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পায়েলের, অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কোথায় কেমন আছে, আমাকে এখুনি নিয়ে চল আমি ওকে দেখতে চাই।”
নির্জীব দেবায়নের মুখ মনে পড়তেই কেঁদে ফেলে অনুপমা, “কোমায় চলে গেছে রে আমার পুচ্চু…..”
আঁতকে ওঠে পায়েল, “না…..” বলেই ওকে জড়িয়ে ধরে।
ধীরে ধীরে এক এক করে সব ঘটনা ব্যাক্ত করে পায়েলের কাছে। পায়েল ওকে প্রবোধ দেয় যে একদিন দেবায়ন ঠিক হয়ে ওর কাছে ফিরে আসবে। এই প্রবোধ নিশ্চিত কিনা জানা নেই তাও বান্ধবীর মুখে সান্ত্বনা বাক্য শুনে অনুপমার মনে কিঞ্চিত আশার সঞ্চার হয়। শ্রেয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে, পায়েল জানায়, অনুপমার নির্দেশ মতন ওদের দেখাশোনার ভার শ্রেয়া করে। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাড়িতে এসে পায়েলকে সঙ্গে নিয়েই অফিসে যায়। নিজেকে অনুপমার স্থানে বসাতে চেষ্টা করেনি অবশ্য কিন্তু বেশ ভালো ভাবেই অফিস আর পায়েল অঙ্কনকে সামলে রেখেছে।
রোজদিনের মতন একটু পরেই শ্রেয়া ওদের বাড়িতে আসে। অনুপমাকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কিরে তুই এলি আর আমাদের খবর পর্যন্ত দিলি না? কি হয়েছে? কেমন আছিস? দেবুকে খুঁজে পেলি?”
ঝড়ের মতন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অনুপমা উত্তরের খেই হারিয়ে ফেলে। শ্রেয়ার ওপরে অহেতুক সন্দেহ করেছিল ভাবতেই ওর চোখে জল চলে আসে। কোনরকমে নিজেকে সামলে শেষ পর্যন্ত দেবায়নের বিষয়ে বিস্তারে সব কথা জানায়। সব কিছু শোনার পরে শ্রেয়াও পায়েলের মতন অধৈর্য হয়ে ওঠে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার জন্য। অনুপমা জানায় এখন ওর কোলকাতায় কিছু কাজ বাকি আছে। ওরা জানতে চাইলে সত্য লুকিয়ে জানায় যে ধৃতিমানের বিষয়ে বিস্তারে খোঁজ নিতে চায়। এখুনি সবাই মিলে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে কিছুই করার নেই। পায়েল আর শ্রেয়াকে অফিসে চলে যেতে বলে।
পায়েল আর শ্রেয়া অফিসে বেড়িয়ে যাওয়ার পরে অনুপমা ব্যাগ খুলে দেবায়নের বাড়ি থেকে আনা ফাইল খুলে বসে পড়ে। কন্সট্রাকশান কোম্পানির কাগজ খানা বারেবারে পড়ে দেখে। এই কাগজের মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। এই কাগজের আসল অর্থ বের করতে পারলে দেবায়নের আসল উদ্দেশ্য অথবা খুনির আসল উদ্দেশ্য হয়ত জানা যাবে। দেবায়ন বিশেষ কিছুই জানায়নি নিবেদিতার সম্পর্কে। যদিও ওর বাবার সাথে নিবেদিতার অনেকদিনের পরিচয় কিন্তু কোনোদিন ওদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিল না নিবেদিতার। আর তার আসল কারন, মায়ের আর নিবেদিতার মনোমালিন্য। কি কারনে এই মনোমালিন্য, আর কি কারনে বাবার সাথে এত সুহৃদ সম্পর্ক। নিবেদিতার বিষয়ে বিস্তারে জানা দরকার। নিবেদিতার বিয়ে চোদ্দ বছর আগে একজন এন.আর.আইয়ের সাথে হয়েছিল, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওদের ডিভোর্স হয়ে যায়। নিবেদিতার ছেলে, অঙ্কুশের জন্ম ডিভোর্সের এক দেড় বছর পরে হয়। অঙ্কুশের পিতার পরিচয় অনুপমার অজানা, হয়ত এই পৃথিবীর অজানা। কোন গুপ্ত প্রেমের ফল স্বরূপ অঙ্কুশের জন্ম। হয়ত দেবায়ন এই বিষয়ে জেনে গিয়েছিল আর নিবেদিতাকে ব্ল্যাকমেিল করেছে। তাই কি নিবেদিতা ওকে সরিয়ে দিয়েছে? কিন্তু কোম্পানির কাগজ অন্য কথা বলছে। এই কাগজ অনুযায়ী, দুটি কন্সট্রাকশান কোম্পানি মিলিত করে একটা বড় কোম্পানির মালিক হতে চলেছে নিবেদিতা। কিন্তু কন্সট্রাকশান কোম্পানি মালিকানা নিবেদিতার নামে তাহলে দেবায়নের কি লাভ এইখানে?
ভাবতে ভাবতে হটাত মাথায় ঝিলিক খেলে যায় অনুপমার। অঙ্কুশ অবিকল ভাইয়ের ছোট বেলার মতন দেখতে, ঠিক সেই নাক সেই রকম কোঁকড়ানো চুল, গাল দুটো টোপাটোপা আর চেহারায় বুদ্ধিদীপ্তের ছটা। বাবার সাথে নিবেদিতার বেশ ভালো সম্পর্ক। অঙ্ক মেলাতে অসুবিধে হয় না। অঙ্কুশের পিতার সম্বন্ধে জানা দরকার। এই উত্তর পেয়ে গেলে ওর কাছে অনেক কিছুর উত্তর পাওয়া যাবে।
মা নিবেদিতাকে দেখতে পারে না। মানুষ বন্ধুর চেয়ে শত্রুর খবর বেশি রাখে। নিবেদিতার সম্বন্ধে মায়ের কাছ থেকে হয়ত অনেক কিছু জানা যেতে পারে ভেবেই অনুপমা কাগজ হাতে পারমিতার কাছে যায়।
পারমিতার ঘরে ঢুকে অনুপমা মাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
মেয়েকে ওইভাবে বিদ্ধস্ত রূপে ঘরে ঢুকতে দেখে পারমিতা প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ, বল কি হয়েছে?”
অনুপমা একটু খানি থেমে জিজ্ঞেস করে, “নিবেদিতার সম্বন্ধে কিছু জানার ছিল। তোমার সাথে নিবেদিতার কেন বনিবনা হয়না, তার কারন কি জানতে পারি?”
পারমিতা মেয়ের এই প্রশ্ন শুনে তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েকে জরিপ করে উত্তর দেয়, “হঠাৎ নিবেদিতার সম্বন্ধে প্রশ্ন করছিস কেন? নিবেদিতার ওপরে কি তোর সন্দেহ হচ্ছে নাকি?” একটু থেমে, ওকে বসতে বলে, “দেখ অনু, পায়েলের কাছ থেকে এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে আমি সব শুনেছি। আমি জানিনা আততায়ী কে। কিন্তু আর যাই হোক নিবেদিতা এই কাজ করতে পারে না ও সেই রকমের মেয়ে নয়।”
অনুপমা মাথা নাড়ায়, “না মা, আমি শুধু জানতে চাইছিলাম বাবার সাথে নিবেদিতার বেশ ভালো সম্পর্ক কিন্তু তোমার সাথে নিবেদিতার কেন বনে না?”
পারমিতা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, নিবেদিতার সাথে কোনোদিন আমার সুহৃদ সম্পর্ক ছিল না। তোকে শুরু থেকে বলি তাহলে। শ্বশুর মশায় মানে তোর ঠাকুরদা বেঁচে থাকার সময় থেকেই নিবেদিতার বাবা, মিস্টার চৌধুরী আর তোর জেঠু, রাজেশ এই কোম্পানি চালাত। তারপরে এই কন্সট্রাকশান কোম্পানি সম্পূর্ণ রূপে আমার হাতে চলে আসে। কি ভাবে আসে সেটা তোর অজানা নয়।”
কথাটা বলার সময়ে কুণ্ঠাবোধে পারমিতার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায়। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, “ততদিনে নিবেদিতার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরে নিবেদিতার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়। তারপরে নিবেদিতার ডিভোর্স হয়ে যায় আর নিবেদিতা কোলকাতা ফিরে এসে কোম্পানির ভার সামলায়। আমার মাথায় এই ব্যাবসার প্যাঁচ কলাকৌশল কোনোদিন ঢুকত না তাই আমি বিশেষ কোনোদিন অফিসে যেতাম না। আমার কাজ ছিল অন্য, ক্লায়েন্ট ধরার জন্য আমি কি করতাম সেটাও তোর অবিদিত নয়। তোর বাবা নিজের অফিস আর এই কন্সট্রাকশান কোম্পানি নিয়েই পড়ে থাকত। তবে তোর বাবার চেয়ে নিবেদিতা নিজের ঘাড়ে পুরো কন্সট্রাকশান কোম্পানির তত্তাবধনের ভার তুলে নেয়। এত কিছু করার পরেও ওর অংশ খুব কম ছিল আর সেই নিয়ে অখুশি ছিল। মাস গেলে আমার একাউন্টে মোটা টাকা আর তার তুলনায় যে সব কাজ করে তার একাউন্টে আমার চেয়ে অনেক কম টাকা। আমি অফিসে গেলেই আমার থেকে দূরে থাকত, আমার দিকে এক ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকাত। এই নিয়ে অবশ্য আমাদের মধ্যে কোনোদিন কোন বচসা হয়নি কিন্তু নিবেদিতা আমাকে দেখতে পারত না। আমি অফিসের মালিক হয়েও কর্মচারীদের মধ্যে আমার বিশেষ কোন স্থান ছিল না। ওর এই নাক উঁচু ভাব, অফিসে সবাই ওকে সমীহ করে, সেই হিংসা, এইসব আমি সহ্য করতে পারতাম না। তবে নিবেদিতা খুব কর্মঠ মেয়ে, মার্জিত কিন্তু কঠোর, সুনিপুণ দক্ষতায় কোম্পানি দাঁড় করিয়েছে।”
মায়ের মুখে নিবেদিতার স্তুতি শুনতে পাবে সেটা অনুপমার পক্ষে আশাতীত ছিল। ভেবেছিল হয়ত মা, নিবেদিতাকে সন্দেহের চোখে দেখবে, কিন্তু নিবেদিতার চরিত্রে কোন খুঁত ওর মা ওকে জানাতে পারল না। সব শুনে অনুপমা একটু চিন্তায় পরে যায়, “হুম, বুঝলাম সব কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে যার উত্তর পাচ্ছি না। নিবেদিতার বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে চোদ্দ বছর আগে, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল, তাই না?”
পারমিতা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ।”
অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “ডিভোর্সের এক থেকে দেড় বছর পরে অঙ্কুশের জন্ম। অঙ্কুশের পিতা কে, সেই নিয়ে তোমার মনে কোনোদিন প্রশ্ন জাগেনি?”
পারমিতার চেহারা হঠাৎ করে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে আসে। বার কতক ঢোঁক গিলে মেয়েকে প্রশ্ন করে, “হঠাৎ এই নিয়ে প্রশ্ন করলি কেন? কি জানিস তুই?”
মায়ের চেহারার এই ফ্যাকাসে রঙ অনুপমার তীক্ষ্ণ চাহনি এড়াতে পারে না। মায়ের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি জানো, অঙ্কুশের বাবা কে?”
পারমিতা কঠিন ভাবে অনুপমার দিকে তাকিয়ে উল্টে প্রশ্ন করে, “এই খবর তোর জেনে কি লাভ? অঙ্কুশের পিতার পরিচয়ের সাথে দেবায়নের এই দুর্ঘটনার কি সম্পর্ক?”
পারমিতার চোখের এই কঠোর চাহনির পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে। এর উত্তর জানার জন্য ওকে শেষ পর্যন্ত কোম্পানির কাগজ বের করতে হয়। কোম্পানির কাগজ হাতে নিয়েই পারমিতা রুদ্ধশ্বাসে অনুপমার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ জোড়া ছলকে ওঠে পারমিতার, অস্ফুট কণ্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করে, “এই কাগজ কোথা থেকে পেয়েছিস তুই?”
অনুপমা মায়ের হাতের ওপরে হাত রেখে প্রশ্ন করে, “আমি শুধু এর উত্তর জানতে চাই মা। আততায়ী যেই হোক কিন্তু এই কাগজ পড়ার পরে আমার মনে একটা সন্দেহ হয়েছে। কে আসল দোষী। এই দেবায়ন কি আসলে আমার ভালোবাসার পুচ্চু নয়?”
পারমিতা মুখে হাত চাপা দিয়ে অস্ফুট আঁতকে ওঠে, “না, হ্যান্ডসামের মতন ছেলে হয় না। তোর পুচ্চু তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে রে অনু।”
ওর দেবায়ন যে ওকে খুব ভালোবাসে সেটা জানে কিন্তু সেই কথা মায়ের মুখ থেকে শোনার পরে ওর চোখ জোড়া ভেসে যায়। পারমিতা মেয়ের মুখ আঁজলা করে ধরে মনে শক্তি জুগিয়ে বলে, “হ্যান্ডসাম ওর বিশাল হাতের মাঝে সবাইকে আগলে রাখতে চায়। সবাইকে মানে, তোকে, আমাকে, তোর বাবাকে পায়েল অঙ্কন সব্বাইকে। কোন কিছু ভেঙ্গে যাক সেটা কিছুতেই হ্যান্ডসাম চায় না। এই সম্পর্কের সম্বন্ধে আর এই কাগজের ব্যাপারে কিছু নাই বা জানলি।”
মায়ের চোখের জল দেখে অনুপমার বুঝতে দেরি হয় না, অঙ্কুশ কেন অবিকল ওর ভাইয়ের মতন দেখতে। মায়ের হাত ধরে প্রশ্ন করে, “তাহলে তুমি জানতে আগে থেকে?”
সম্মতি জানিয়ে মৃদু মাথা দোলায় পারমিতা, “হ্যাঁ, আমি সব জানি তবে আগে জানতাম না। দেবায়ন কি ভাবে যেন এই সব কিছু জেনে গিয়েছিল আর সেই আমাকে বুঝিয়ে বলে। প্রথমে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম কিন্তু হ্যান্ডসামের কথা শুনে মনে হল, ভালো কি শুধু একটা মাত্র মানুষ কেই বাসা যায়? তোর বাবা আগে আমাকে সেই ভাবে ভালবাসত না, আর সেই কারনেই নিবেদিতাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আমি এতদিন তোর বাবার ভালোবাসা পাইনি। আমি এতদিন এরতার বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছি। নিবেদিতা আর তোর বাবা একসাথে প্রচুর সময় কাটিয়েছে আর এই দীর্ঘ সময় একসাথে কাটাতে কাটাতে সাথে তোর বাবার সাথে নিবেদিতার প্রেম হয়ে যায়। আর…..”
অনুপমা ছলছল চোখে কম্পিত কণ্ঠে মাকে জিজ্ঞেস করে, “অঙ্কুশ তাহলে আমার ভাই?”
পারমিতা সম্মতি জানিয়ে মাথা দোলায়, “হ্যাঁ, অঙ্কুশ তোর ভাই, তোর রক্ত।”
অনুপমার মাথার শিরা ঝনঝন করে ওঠে। পারমিতা মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “তবে দেবায়ন কাউকে আঘাত করতে চায়নি তাই তোকে ধীরে ধীরে নিবেদিতার সাথে পরিচয় করায়। শুরুতেই যদি দেবায়ন তোকে সব কিছু বলে দিত তাহলে তুই কাউকেই ঠিক ভালো চোখে দেখতিস না তাই তোর সাথে নিবেদিতার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠুক সেটাই চেয়েছিল হ্যান্ডসাম। তুই যেমন আমাকে ভালবাসিস, দেবায়ন চেয়েছিল অন্তত নিবেদিতার সাথে তোর বান্ধবীর মতন সম্পর্ক গড়ে উঠুক। অঙ্কনকে যেমন ভালবাসিস, দেবায়ন চেয়েছিল ঠিক সেই ভাবে অঙ্কুশের ওপরে তোর যেন সেই স্নেহ গড়ে ওঠে। তারপরে তোর হাত ধরে নিবেদিতার সাথে পায়েল আর অঙ্কনের সুহৃদ সম্পর্ক গড়ে উঠত। এই গ্রুপ কোম্পানি আমাদের পরিবারের মধ্যেই রয়েছে। নিবেদিতাকে কন্সট্রাকশান কোম্পানির সম্পূর্ণ ভার দেওয়া দেবায়নের মাথার উপজ। তোর বাবা আর দেবায়ন হোটেল নিয়ে থাকবে এই ঠিক হয়, আর তুই পায়েল আর অঙ্কন তোর আই.টি কোম্পানি নিয়ে থাকবি। এই ভাবেই দুই পরিবার এক করতে চেয়েছিল হ্যান্ডসাম। তোর বাবা সব শুনে সেদিন দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। সেই প্রথম সোমেশকে ওই ভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম। ভালোবাসা বড় কঠিন বস্তু, তাই নয় কি অনু?”
সব কিছু শোনার পরে অনুপমা চোখ বন্ধ করে বসে পরে। ওর দুই চোখ বেয়ে অঝোর ঝারায় অশ্রুর বন্যা বয়ে চলে, এত ভালোবাসা রাখবে কোথায়? একটি মাত্র জীবন ওর কাছে। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায়, অবুঝের মতন কিছু না জেনেই বাবাকে, নিবেদিতাকে, রূপককে সন্দেহ করেছিল। এরা সবাই ওর জন্য ভাবে, ওর জন্য চিন্তা করে, ওর দুঃখে দুঃখিত হয়, ওর হাসিতে হাসে।
পারমিতা মেয়ের মুখ আঁজলা করে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “জানি দেবায়ন চলে যাওয়াতে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। জানি তোর জীবনে দেবায়নের জায়গা আমরা কেউই পূরণ করতে পারব না তবে আমরা সবাই তোর পাশে আছি রে অনু।”
অনুপমা ফুঁপিয়ে ওঠে, মায়ের সান্ত্বনা বাক্য শোনার পরে মনে হয় মাকে সত্যি বলা ভালো, “পুচ্চুকে খুঁজে পেয়েছি। তবে…..”
পারমিতা ওই শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “এই কথা কেন আমাদের জানাস নি?”
অনুপমা ধরা গলায় উত্তর দেয়, “তখন ঠিক বুঝতে পারিনি কে আসল দোষী তাই।”
পারমিতা ওকে প্রশ্ন করে, “দেবায়ন কোথায়, কেমন আছে?”
অনুপমা ছলছল চোখে ধরা কণ্ঠে উত্তর দেয়, “খুব খারাপ অবস্থায় আছে মা। জানি না কি হবে। ওর অনেক হাড় ভেঙ্গে গেছে। দেবায়ন কোমায় চলে গেছে, মা। আমি কি করব মা?” বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনুপমা।
মেয়ের মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে পারমিতা। মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “দেবায়নকে যখন খুঁজে পেয়েছিস তখন কোমায় থাকুক আর যেখানেই থাকুক ও তোর কাছে ফিরে আসবেই। তুই চিন্তা করিস না। দেবশ্রীদি এই বিষয়ে জানে?”
অনুপমা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ জানে। মামনি খুব ভেঙ্গে পড়েছে।”
পারমিতা জিজ্ঞেস করে, “দেবশ্রীদি কোথায়, দেবায়ন কোথায়?”
চোখের জল মুছে অনুপমা উত্তরে বলে, “দেবায়নকে আমি দিলিপ বাবুর কাছে ব্যাঙ্গালোরে পাঠিয়ে দিয়েছি। মামনি দেবায়নের কাছে।” তারপরে মাকে সব কথা বিস্তারে জানায় অনুপমা।
সব কিছু শোনার পরে পারমিতা ব্যাস্ত হয়ে যায়, ওকে বলে, “আমি এখুনি তোর বাবাকে ফোন করছি। আমরা থাকতে এই সময়ে দেবশ্রীদি একা থাকতে পারে না। আমি এখুনি তোর বাবাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর যেতে চাই।”
পারমিতা সঙ্গে সঙ্গে, সোমেশ বাবুকে ফোন করে সব কিছু জানিয়ে দেয়। অনুপমার বাবা সব কিছু শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের টিকিট কেটে বাড়িতে পৌঁছে যান। বাবাকে সন্দেহ করেছিল বলে বাবার সামনে যেতে দ্বিধা বোধ করে অনুপমা। কিন্তু ওর মা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, এই কথা ওর বাবা জানতে পারবে না। পারমিতা ওকে সঙ্গে নিতে চায় কিন্তু অনুপমা জানায় ওর বদলে পায়েলকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যাক। অনুপমা একটা শেষ চেষ্টা করতে চায়। ওর সন্দেহের তালিকার শেষ ব্যাক্তি, ধৃতিমানের বিষয়ে কিছুই তল্লাসি করা হয়নি। হয়ত এইবারে ওর তীর সঠিক স্থানে লাগবে।
•
Posts: 6,494
Threads: 21
Likes Received: 6,992 in 3,702 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
239
পর্ব ২৯ (#০৬)
ঠিক সেই সময়ে পায়েল অফিস থেকে একাই ফিরে আসে। ওকে দেখে অনুপমা ওকে মা বাবার সাথে ব্যাঙ্গালোর যেতে বলে। পায়েল সেই শুনে খুব খুশি হয় সেই সাথে অনুপমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে যে দেবায়ন নিশ্চয় ঠিক হয়ে ওর কাছে ফিরে আসবে। শ্রেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে পায়েল ওকে জানায়, কিছু আগে রূপকের নামে অফিসে কুরিয়ারে একটা চিঠি আসে। সেই চিঠি পড়ে রূপক আর শ্রেয়া তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে যায়। খবর শুনে অনুপমা ওকে ওই চিঠির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে।
পায়েল ওর হাতে একটা সাদা খাম দিয়ে জানায়, “এই খামটা আসার পরেই শ্রেয়া আর রূপক বেড়িয়ে পড়েছে। তুই অহেতুক চিন্তা করে শরীর খারাপ করবি তাই রূপক তোকে জানাতে বারন করেছিল। তুই চিন্তা করসি না, রূপক ঠিক ওই আততায়ীকে খুঁজে বের করবে। তুই আমাদের সাথে ব্যাঙ্গালোর চল।”
সাদা খামের মধ্যে কাগজটা হাতে ধরে দেখে অনুপমা। একটা সাদা কাগজে ইংরেজি হরফে কম্পিউটার প্রিন্টে লেখা, “যদি দেবায়নের আততায়ীর খবর জানতে চাও তাহলে পঞ্চাশ লাখ টাকা নিয়ে কাল ভোরের মধ্যে লাভা পৌঁছাও। একা আসবে, কাউকে সাথে নিয়ে এলে বিপদ।”
অনুপমা চোখের জল মুছে দৃঢ় কণ্ঠে ওকে বলে, “না আততায়ীকে খুঁজে ওকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না রে।” ওর হাতে হাত রেখে বলে, “আমার কিছু কাজ আছে পায়েল। তুই মায়ের সাথে ব্যাঙ্গালোর যা। আমি একটা শেষ চেষ্টা করে দেখি যদি আততায়ীর আসল পরিচয় জানা যায়।”
অঙ্কন বাড়ি এলে, বিকেলের মধ্যে সোমেশ বাবু পারমিতা, পায়েল আর অঙ্কনকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ফাঁকা বাড়িতে থাকতে একদম ভালো লাগে না অনুপমার। ধৃতিমানের বিষয়ে এখন কোন খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। নিবেদিতার ওপরে সন্দেহ করেছিল ওর কাছে একবার যাওয়া উচিত। সাত পাঁচ ভেবে গাড়ি নিয়ে নিবেদিতার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে অনুপমা।
পথে যেতে যেতে রূপককে ফোন করে, “তুই কোথায়?”
রূপক গাড়ি চালাচ্ছিল তাই শ্রেয়া ফোন উঠিয়ে উত্তর দেয়, “কেমন আছিস তুই?”
অনুপমা ওকে জিজ্ঞেস করে, “তোরা কোথায়?”
শ্রেয়া উত্তর দেয়, “এই একটু বেড়িয়েছি, কাল বিকেলের মধ্যে ফিরে আসব।”
অনুপমা ধরা গলায় বলে, “আমাকে জানাতে দোষ? পায়েল আমাকে সব বলেছে।”
শ্রেয়া ওকে উত্তর দেয়, “নারে সোনা, তুই একা নস। আমরা সবাই মিলে ঠিক দেবায়নের আততায়ীকে খুঁজে বের করব। তুই একটু বিশ্রাম কর আমরা কাল বিকেলের মধ্যে কোলকাতা ফিরে এসে তোকে সব কিছু জানাব।”
অনুপমা ওদের সাবধানে যেতে বলে দেয় আর লাভা পৌঁছে যেন একটা ফোন করে বলে জানিয়ে দেয়। শ্রেয়া জানিয়ে দেয় ওরা সাবধানেই যাবে বলে ফোন রেখে দেয়। অনুপমা ভাবতে বসে কি ভাবে নিবেদিতার সামনে যাবে। বাবা আর নিবেদিতার সম্পর্কের বিষয়ে জানার পরে ওর সামনে দাঁড়ানো ওর পক্ষে যথেষ্ট কষ্টকর। নিবেদিতা এতদিন হাসিমুখে ওর সাথে বান্ধবীর মতন ব্যাবহার করে গেছে। এর মূলে দেবায়নের মাথা ছিল সেটা অনুপমা এতদিন জানত না, আর অহেতুক দেবায়ন আর নিবেদিতার মাঝের এক বিতর্কিত সম্পর্কের আভাস খুঁজে বেড়াচ্ছিল বলে নিজেকে ধিক্কার দেয়।
এমন সময়ে ওর কাছে পরাশরের ফোন আসে, “তুই কোথায়? আজকে আমার বাড়িতে আসার কথা ছিল তোর। বেশ কিছু খবর পাওয়া গেছে।”
অনুপমা উৎসুক হয়ে ওঠে, “কি খবর?”
পরাশর উত্তর দেয়, “আজকে কাকা ঘনসিয়ালির পুলিস ইনস্পেকটর রোহনকে ফোন করেছিল। যে ছেলেটা সেই রাতে দেবায়নকে ডাকতে এসেছিল, সেই ছেলেটার লাশ পাওয়া গেছে জঙ্গলের মধ্যে। তবে ওই ছেলেটার পরিচয় পাওয়া গেছে কিন্তু তাতে বিশেষ কিছুই লাভ হয়নি। ওই ছেলেটা ওই এলাকার ছেলে। রঞ্জিতের সাথেও কথাবার্তা বলেছে কাকু। আমরা যে সব জিনিস পত্র ওই জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছিলাম সেই গুলো নিয়ে তুই যদি একবার বাড়িতে আসিস তাহলে বেশ ভালো হয়।”
অনুপমা ওকে বলে, “আচ্ছা ঠিক আছে আমি এখুনি তোর বাড়িতে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ এইদিকে আরও একটা ব্যাপার হয়েছে। কেউ একজন আজকে অফিসে রূপকের নামে একটা কুরিয়ার করে চিঠি পাঠিয়ে বলেছে যে সে নাকি দেবায়নের আততায়ীর খবর জানে। তাই শ্রেয়া আর রূপক লাভার জন্যে বেড়িয়ে গেছে।”
পরাশর খানিকক্ষণ ভাবার পরে বলে, “রূপকের নামে চিঠি? ঠিক মিলছে না। হঠাৎ রূপকের নামে কেন চিঠি পাঠাতে যাবে? তুই কি সেই চিঠি দেখেছিস?”
অনুপমা উত্তরে জানায়, সেই চিঠি ওর হাতে। বাড়ি ফিরে যে সব জিনিসপত্র জঙ্গল থেকে উদ্ধার করেছিল সেই সব নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের বাড়ি পৌঁছে যাবে। গাড়ির ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলে। বাড়ি থেকে প্লাস্টিক ভর্তি জিনিসপত্র গুলো নিয়ে পরাশরের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। নিবেদিতার বাড়ি আর এই যাত্রায় যাওয়া হয় না।
পরাশরের বাড়ি যাওয়ার পথে নিজেই একবার সেই চিঠি খুলে দেখে। বারেবারে পড়েও বিশেষ কিছুই উদ্ধার করতে পারে না। তারপরে ওর মনে হয়, হঠাৎ এই চিঠি রূপকের নামে কেন এসেছে? আততায়ী কি রূপককে চেনে? যদি আততায়ী রূপক আর দেবায়ন দুই জনকে চেনে তাহলে ওদের অফিসের লোক ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। কারন রূপক যাদবপুর থেকে পাশ করেছে আর দেবায়ন অন্য একটা কলেজ থেকে পাশ করেছে। দুইজনের দেখা সাক্ষাৎ শুধু মাত্র এই অফিস ছাড়া আর কোথাও নয়। আততায়ী নিশ্চয় এই দুইজনার ওপরে প্রতিশোধ নিতে চায়। সেই রকম হলে একমাত্র ইন্দ্রনীলকে সন্দেহ হয় কিন্তু ইন্দ্রনীল অনেকদিন থেকেই দেশে আসেনি আর মিস্টার হেরজোগ খবর নিয়েছেন যে ইন্দ্রনীল বর্তমানে লন্ডনে। ইন্দ্রনীল ছাড়া দ্বিতীয় ব্যাক্তি যার সাথে দেবায়ন আর রূপকের শত্রুতা হতে পারে সে মানুষ সূর্য। কিন্তু রূপক খবর নিয়ে দেখেছে যে সূর্য সেই সময়ে কোলকাতায় ছিল আর ওর এই কাজ করার ক্ষমতা নেই।
খাম খানা উল্টে পাল্টে দেখে অনুপমা। কোথা থেকে এসেছে সেটা একমাত্র অফিসের রেজিস্টারে খুঁজে পাওয়া যাবে। রাত হলেও সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ড্রাইভারকে অফিসে নিয়ে যেতে বলে। অত রাতে অফিসে শুধু মাত্র নেটওয়ার্কের ছেলেরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। গার্ড ওকে দেখে রীতিমতন অবাক হয়ে যায়। অনুপমা রিসেপসানে বসা গার্ডের কাছে কুরিয়ারের রেজিস্টার চেয়ে ওই চিঠির ঠিকানা খুঁজে বের করে। চিঠিটা দুই দিন আগে, লাভা থেকে রূপকের নামে পাঠানো হয়েছে। এই চিঠি আততায়ী নিজেই পাঠিয়েছে, নিশ্চয় এইবারে রূপকের ওপরে হামলা করবে। খাটলিং, লাভা সব পাহাড়ি এলাকা খুঁজেছে আততায়ী। বেশ বুদ্ধি ধরে যাতে নির্জনে আততায়ী নিজের কাজ হাসিল করতে পারে। অফিসের কারুর সাথে দেবায়ন আর রূপকের একত্রে শত্রুতা হতে পারে না তবুও একবার সন্দেহ দুর করার জন্য মনীষাকে জিজ্ঞেস করা। সঙ্গে সঙ্গে অনুপমা মনীষাকে ফোন করে জানতে চায় ওদের অফিসের কেউকি লম্বা ছুটিতে গেছে? মনীষা উত্তর দেয়, কেউই লম্বা ছুটিতে যায়নি। আরো জানায় যেদিন দেবায়নের এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল সেদিন অফিসে সবাই এসেছিল।
সঙ্গে সঙ্গে অনুপমা, আবার শ্রেয়াকে ফোন করে। বার কতক ফোন বেজে যাওয়ার পরে শ্রেয়া ফোন উঠিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি রে কি হয়েছে?”
অনুপমা উদ্বেগজনিত কণ্ঠে ওকে বলে, “তোরা এখন কোথায়?”
শ্রেয়া বলে, “এই বহরমপুর পেরিয়েছি। কেন কি হয়েছে?”
অনুপমা উত্তর দেয়, “তোরা লাভা যাস নে। ওই চিঠি আততায়ী নিজে লিখেছে যাতে রূপককে মারতে পারে। তোরা ফিরে আয় এখুনি ফিরে আয়।”
শ্রেয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “মানে? না আমরা এর শেষ দেখে তবেই ফিরব। যদি আততায়ী নিজেই দেখা করতে চেয়েছে তাহলে ওকে শেষ করেই ফিরব। তুই চিন্তা করিস না অনু…..”
অনুপমা কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করে, “প্লিস শ্রেয়া, আমার কথা শোন। আমি জানি তোরা সবাই দেবায়নের জন্য চিন্তিত কিন্তু এই আততায়ী দেবায়ন আর রূপক, দুইজনের শত্রু। আততায়ী দুইজনকে মারতে চায় তাই ত আর কারুর নামে চিঠি পাঠায়নি শুধু মাত্র রূপকের নামে পাঠিয়েছে। প্লিস আমার কথা শোন তোরা ফিরে আয়।”
শ্রেয়া উত্তর দেয়, “ঠিক আছে আমরা ফিরে আসছি। কাল সকালে দেখা হবে।”
কিছুক্ষণ ভেবে অনুপমা বলে, “না তোরা আমার জন্য বহরমপুরে অপেক্ষা কর। আমি আসছি আর দেরি করলে চলবে না, হাতেনাতে আততায়ীকে ধরতে হবে এইবারে।”
শ্রেয়া জানিয়ে দেয় ওরা অনুপমার জন্য বহরমপুরে অপেক্ষা করে থাকবে। অনুপমা সঙ্গে সঙ্গে পরাশরকে ফোন করে জানিয়ে দেয় যে ও বহরমপুরের জন্য যাত্রা করছে। পরাশর সঙ্গে যেতে চাইলে জানায় ওকে পথে উঠিয়ে নেবে। পরাশরকে উঠাতে গিয়ে ওর কাকা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইনস্পেক্টর নিরঞ্জন বাবুর সঙ্গে দেখা হয়। নিরঞ্জন বাবু জানিয়ে দেন তিনি তার টিম নিয়ে ওদের পেছনে থাকবে। অনুপমা আর পরাশর গাড়িতে উঠে যাত্রা শুরু করে দেয়। ওদের অনেকদিনের ড্রাইভার, কমল এতদিনে বুঝে গেছে দেবায়নের কি হয়েছে। গাড়ির ড্রাইভার তীর বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দেয়।
অনুপমা পরাশরকে বলে, “আমরা এতদিন ভুল পথে তদন্ত করছিলাম। আমাদের শেষের দিক থেকে তদন্ত না শুরু করে শুরুর দিক থেকে তদন্ত শুরু করা উচিত ছিল। আসল তদন্তের সব কিছু তোমার হাতের কাছে। দেখা যাক আমরা কি কি খুঁজে পেয়েছি।”
অনুপমা সিটের ওপরে প্লাস্টিকের ব্যাগ রেখে জঙ্গল থেকে আনা জিনিস পত্র গুলো এক এক করে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে দেয়। সিগারেট প্যাকেট দেখে পরাশরকে বলে, “আততায়ী বেশ বড়লোক না হলে ক্লাসিক রেগুলার খায় না।” কয়েকটা কাগজের টুকরো ঘেঁটে দেখে বলেন, “আততায়ী এই কোলকাতার লোক, এই দেখ।” বলে একটা খবরের কাগজের টুকরো পরাশরের হাতে ধরিয়ে কোনার দিকে দেখিয়ে বলে, “এটা স্টেটসম্যান কাগজ। গ্রামের লোকটা বলেছিল যে আততায়ী পাঞ্জাবী কিন্তু আততায়ী বাঙ্গালী আর নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য পাঞ্জাবী সেজেছে। আততায়ী আমাদের ওই খাটলিং যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করেছিল। রূপকের ইমেল গুলো যদি চেক করা যায় তাহলে আই পি এড্রেস পাওয়া যাবে।” কুরিয়ারের চিঠিটা হাতে নিয়ে ভালো ভাবে দেখে বলে, “হুম, এই চিঠি লাভা থেকে পাঠানো হয়েছে। ওইখানে এই কুরিয়ার কোম্পানির আউটলেট খুব কম হবে নিশ্চয়। এই চিঠির ডকেট নাম্বার দেখালে অনায়াসে দুই দিন আগে কে এই চিঠি পাঠিয়েছে সেটা জানা যাবে। আততায়ীর একটা চেহারা পাওয়া যাবে। লাভা খুব ছোট জায়গা, আততায়ীকে দিনের আলোতে খুঁজে বের করতে আমাদের বিশেষ অসুবিধে হবে না।”
পরাশর অবাক হয়ে অনুপমার তারিফ করে বলে, “তুই একেবারে শার্লক হোমস হয়ে গেছিস দেখছি।”
অনুপমা স্মিত হেসে মাথা দোলায়, “না রে অতদুর সাগর পাড়ে কেন যাচ্ছিস। আমাদের গড়পার ফেলুদা হতে একটু চেষ্টা করছি আর তুই আমার তোপসে।”
কমল হুহু করে গাড়ি চালিয়ে রাত বারোটার মধ্যে বহরমপুরে পৌঁছে যায়। ওদের দেখে রূপক আর শ্রেয়া ওদের থেমে যাওয়ার কারন জিজ্ঞেস করে। অনুপমা বিস্তারে সব কিছু খুলে বলার পরে ওরা সবাই আবার যাত্রা শুরু করে দেয়। কমল, রূপকের গাড়ি চালায় আর ওরা চারজনে অনুপমার গাড়ি করে লাআভ্র উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পেছনে নিরঞ্জন বাবু একটা গাড়িতে কয়েক জন সাদা পোশাকের পুলিস নিয়ে ওদের অনুসরন করেন। সবার মধ্যে টানটান চাপা উত্তেজনা কারুর চোখে মুখে ক্লান্তির লেশ মাত্র নেই। রূপক চরম ক্ষোভে এক প্রকার গজগজ করতে করতে দ্রুত বেগে গাড়ি চালায়।
অনুপমা শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করে, “তুই অত টাকা পেলি কোথা থেকে রে?”
শ্রেয়া স্মিত হেসে বলে, “সেটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন। তোর জন্য সব কিছু দিতে রাজি।”
অনুপমার দুই চোখ ছলকে ওঠে, “একবার আমাকে জানাতে পারলি না?”
শ্রেয়া ওর গালে আলতো চাপড় মেরে বলে, “তুই ও আমাদের দেবুর ব্যাপারে জানাস নি তাই না? তোর মাথার অবস্থা আমি বুঝি রে অনু। ছাড় সেই সব কথা এখন ওই আততায়ীকে ধরাটা আমাদের আসল উদ্দেশ্য।”
ভোরের দিকে জলপাইগুড়ি হয়ে ওদের গাড়ি লাভার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। শিলিগুরি থেকে সেবক রোড ধরে। কমল জানায়, কালিম্পং হয়ে লাভা যাওয়ার চেয়ে গরুবাথান হয়ে লাভা পৌঁছাতে অনেক সহজ তাই ওরা মালবাগান টি এস্টেটের রাস্তা ধরে গরুবাথান হয়ে সকাল এগারোটা নাগাদ লাভা পৌঁছে যায়। এই লাভাতেই ওদের জন্য আততায়ী অপেক্ষা করে আছে। গাড়ি থেকে নেমে ওরা চারপাশ ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে এগোতে থাকে। সাদা পোশাকে নিরঞ্জন বাবু ওদের সাথে থাকেন। আড়াল থেকে নিশ্চয় আততায়ী ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। কেননা ওই চিঠিতে লাভার কোথায় দেখা করতে হবে সেটা কিছুই জানায় নি আততায়ী। তার অর্থ, আততায়ী নিশ্চয় এইবারে ওদের সাথে যোগাযোগ করে জানাবে কোথায় দেখা করতে চায়। কিন্তু ওদের দেরি দেখে নিশ্চয় আততায়ী সতর্ক হয়ে গেছে।
কুরিয়ার কোম্পানির আউটলেট খুঁজে পেতে ওদের বেশি দেরি লাগে না। চিঠি আর ডকেট নাম্বার দেখতেই কুরিয়ার নেওয়ার মেয়েটা খাতা দেখে জানায় যে তিন দিন আগে একজন এই চিঠিটা দুপুর বেলায় কুরিয়ার করেছে। নিরঞ্জন বাবু মেয়েটাকে বলেন এটা খুনের কেস এবং নিজের পরিচয় দিয়ে ওই লোকটার বিষয়ে জানতে চান। মেয়েটা জানায় যে লোকটা কোন পাঞ্জাবী নয়, তিনি দাড়ি গোঁফ ওয়ালা একজন বাঙ্গালী '., নাম মহম্মদ ইকবাল হোসেন। রেজিস্টার খুঁজে ইকবালের মোবাইল নাম্বার ওদের লিখে দেয়। নিরঞ্জন বাবু ওই মোবাইল নাম্বারে ফোন করে দেখেন মোবাইল নাম্বার ভুয়ো। তার অর্থ এই নাম এই বেশ ভুষা সব মেকি। মেয়েটা আরো জানায় যে আগন্তুকের বয়স পঞ্চাসের কাছাকাছি, মাঝারি গড়ন, ঘন ঘন সিগারেট খান। ওদের কুরিয়ার কোম্পানির সামনে একটা চায়ের দোকানে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিল তারপরে এদিক ওদিক দেখে অনেক ওরে ওদের দোকানে কুরিয়ার করতে ঢুকেছিল। মেয়েটার দেওয়া আগন্তুকের বিবরন অনুযায়ী একটা ছবি আঁকে রূপক। সেই ছবি দেখে মেয়েটা জানায় যে আগন্তুক অনেকটা এই ছবির মতন দেখতে। একটা ছবি যখন পাওয়া গেছে তাহলে এইখানে খুঁজে বের করতে বিশেষ অসুবিধে হবে না ওদের। ওই ছবিটার বেশ কয়েকটা জেরক্স করিয়ে নিয়ে নিরঞ্জন বাবু তার সাথে আসা সাদা পোশাকের অফিসারদের হাতে দিয়ে আশে পাশের হোটেল গুলোতে খোঁজ নিতে বলেন।
খুঁজতে খুঁজতে একটা হোটেলের লোকের কাছ থেকে জানতে পারে যে এই রকম দেখতে একজন দুই দিন আগে ওদের হোটেল ছিল। তবে সেই আগন্তুকের নাম মহম্মদ ইকবাল নয়, তার দাড়ি গোঁফ ছিল না, তিনি একজন বাঙ্গালী, নাম রাজেশ সেন। অনুপমা চমকে ওঠে, এই নাম ওর প্রয়াত জেঠুর নাম। কিন্তু জেঠু প্রায় কুড়ি বছর আগে মারা গেছেন।
নিরঞ্জন বাবু অনুপমাকে শান্ত করে বলেন, “অত চমকে যাওয়ার কিছু নেই অনুপমা। এটা নিতান্ত কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। এখন পর্যন্ত যা যা নামধাম পাওয়া গেছে তার সবটাই ভুয়ো, সুতরাং এই হোটেলে যে ঠিকানা অথবা নাম আগন্তুক লিখিয়ে গেছে সেটাও ভুয়ো হবে। তবে লাভা বেশি বড় জায়গা নয় আততায়ীকে খুঁজে বের করতে আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হবে না।”
হোটেলের লোকের কাছ থেকে আগন্তুকের ছবি চায় নিরঞ্জন বাবু। ছবি দেখে চমকে যাওয়ার পালা এইবারে নিরঞ্জন বাবুর। ছবি হাতে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখার পরে তিনি অবাক হয়ে বলেন, “এই লোক?” এই বলে তিনি অনুপমার হাতে ছবি ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “চিনতে পারছ একে?”
অনুপমা মাথা নাড়ায়, “না, এই ব্যাক্তিকে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।”
নিরঞ্জন বাবু স্মিত হেসে বলেন, “হুম, তোমার না চেনার কথা তবে রূপক আশা করি চিনতে পারবে।” বলে রূপকের হাতে ছবি ধরিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কি রূপক চিনতে পারছ?”
রূপক মাথা নাড়ায়, “ঠিক মনে পড়ছে না।”
নিরঞ্জন বাবু বলেন, “ভুলে গেলে একে? তোমাকে আর দেবায়নকে খুন করার এনার কাছে সব থেকে বড় উদ্দেশ্য রয়েছে। তোমাকে এই আগন্তুক রাস্তায় মেরে ফেলতে চেয়েছিল এই লাভাতে নয়। তাই ওই চিঠিতে লাভার কোথায় দেখা করতে হবে সেটা লেখা নেই। তোমাকে সকালে এই জায়গায় আসতে বলার একটা মাত্র কারন কেননা সকালের দিকে রাস্তায় কুয়াশা হয়, পাহাড়ি রাস্তায় কুয়াশার মধ্যে গাড়ি চালানো দুঃসাধ্য। তোমার গাড়িকে খাদে ফেলে দুর্ঘটনার রূপ দিয়ে দিত আততায়ী, তুমি জানতে পারতে না কে তোমাকে মারল। আমি হলফ করে বলতে পারি আততায়ী আমাদের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করেছিল কিন্তু সাধারণত সব মানুষ কালিম্পং হয়ে লাভা আসে। যেহেতু আমরা গরুবাথান হয়ে লাভা এসেছি সেই জন্য আততায়ী আর সুযোগ পায়নি আক্রমন করার। চল এইবারে আআদের বেড়িয়ে পড়তে হবে। আততায়ী ট্রেনে করে ফিরবে বলে মনে হয় না, নিশ্চয় প্লেন ধরবে। বাগডোগরা গিয়ে প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখলেই বোঝা যাবে।”
রূপক বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পরে চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বলে, “আচ্ছা এইবারে চিনেছি কে। শালা এইবারে আর আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না।”
অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “কে এই লোক?”
•
Posts: 1,886
Threads: 6
Likes Received: 6,324 in 1,869 posts
Likes Given: 2,644
Joined: Jun 2019
Reputation:
739
ইসসসসস অনুপমা রে, যে তোকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিন থেকে আমি তোর প্রেমে পাগল (এই গপ্পটা লেখার সময়ে পরীর কাছে কম ধ্যাতানি খেতে হয়নি) আই মিন যেদিন এই গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম সেদিন থেকে !!!!!!!!
Posts: 6,494
Threads: 21
Likes Received: 6,992 in 3,702 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
239
(08-10-2020, 01:35 AM)pinuram Wrote: ইসসসসস অনুপমা রে, যে তোকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিন থেকে আমি তোর প্রেমে পাগল (এই গপ্পটা লেখার সময়ে পরীর কাছে কম ধ্যাতানি খেতে হয়নি) আই মিন যেদিন এই গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম সেদিন থেকে !!!!!!!!
পুচ্চি সোনাকে কি ভালো না বেসে থাকা যায়
সর্বগুণসম্পন্না রমণী একেবারে !
আর তাহলে তো তোমার অন্যান্য গল্পের নায়িকাদের নিয়ে লেখার সময়তেও বোধহয় পরী দিদির ধ্যাতানি খেতে হয়েছে
Posts: 6,494
Threads: 21
Likes Received: 6,992 in 3,702 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
239
জানতে পারতে না কে তোমাকে মারল। আমি হলফ করে বলতে পারি আততায়ী আমাদের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করেছিল কিন্তু সাধারণত সব মানুষ কালিম্পং হয়ে লাভা আসে। যেহেতু আমরা গরুবাথান হয়ে লাভা এসেছি সেই জন্য আততায়ী আর সুযোগ পায়নি আক্রমন করার। চল এইবারে আআদের বেড়িয়ে পড়তে হবে। আততায়ী ট্রেনে করে ফিরবে বলে মনে হয় না, নিশ্চয় প্লেন ধরবে। বাগডোগরা গিয়ে প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখলেই বোঝা যাবে।”
রূপক বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পরে চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বলে, “আচ্ছা এইবারে চিনেছি কে। শালা এইবারে আর আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না।”
অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “কে এই লোক?”
পর্ব ২৯ (#০৭)
রূপক উত্তর দেয়, “অগ্নিহোত্রীর বাবা, সমীর বাবু।”
অনুপমার মনে পড়ে যায় পায়েলের অপহরনের ঘটনা। পায়েলের পিসির ছেলে, বিনয় আর তার বন্ধু অগ্নিহোত্রী পায়েলকে অপহরন করে নৈহাটি নিয়ে গিয়েছিল। রূপক দেবায়ন দলবল নিয়ে গিয়ে পায়েলকে বাঁচিয়ে এনেছিল, কিন্তু অগ্নিহোত্রীর বাবা কেন ওদের মারতে চায় সেটা ঠিক বুঝতে পারে না তাই জিজ্ঞেস করে, “সমীর বাবু কেন তোদের মারতে চায়?”
রূপক উত্তর দেয়, “আসলে সেদিন অগ্নিহোত্রী আর বিনয় পালায়নি। দেবায়ন সেইদিন ওদের খুন করে দিত। কিন্তু আমরা সবাই বাধা দিয়েছিলাম তাই আর দেবায়ন খুন করেনি। কিন্তু অগ্নিহোত্রী বেঁচে যাবে সেই দেখে আমার আর দেবায়নের খুব দুঃখ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একটা নকল পলাতকের ঘটনা তৈরি করা হয় আর ফাঁকা মাঠে ওদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওরা যখন পালাতে যায় তখন নিরঞ্জন বাবু ওদের পলাতক ঘোষণা করে গুলি করেন। যাকে পুলিসের ভাষায় এনকাউন্টার বলে।”
অনুপমার কাছে এইবারে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। নিরঞ্জন বাবু বলেন, “এইবারে সমীর বাবুকে হাতেনাতে ধরতে হবে। এখন পর্যন্ত ওনার বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমান পাওয়া যায়নি। আর সমীর বাবু সেই ছেলেটাকেও খুন করেছে সুতরাং এই কেস উত্তরাখন্ড পুলিসের কাছেও যাবে। আমি একবার রোহনকে ফোন করে দিচ্ছি আর সেই সাথে বাগডোগরা গিয়ে ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখলে সব পরিস্কার হয়ে যাবে।”
রূপক জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু কি করে ধরব?”
অনুপমা খানিক চিন্তা করে বলে, “এইবারে আমাদের চাল চালতে হবে, ফাঁদ আমাদের পাততে হবে। তোর কাছে যে ইমেল গুলো এসেছিল সেই ইমেল গুলোর সেন্ডার আই.পি. এড্রেস দেখ। মনে হয় ওই আই.পি. অ্যাড্রেস থেকে সার্ভিস প্রোভাইডারের খবর পাওয়া যাবে, সেই থেকে অনায়াসে আমরা ওই আই.পি. অ্যাড্রেসের লোকেসান বের করে নিতে পারব। এর পরে তুই ওই ইমেলে একটা উত্তর দে, যে কোন এক দুর্ঘটনা জনিত কারনে তোদের খাটলিং ভ্রমন সুখকর হয়নি। সমীর বাবু তাহলে ধরতে পারবেন না যে আমরা তাকে সন্দেহ করেছি। তুই ধন্যবাদ জানিয়ে লেখ যে তুই ওর সাথে দেখা করতে চাস। আমি হলফ করে বলতে পারি একা একা দেখা করার কথা শুনে এই ফাঁদে সমীর বাবু পা দেবেন আর তিনি তোকে মারার জন্য তৈরি হয়েই আসবেন।”
শ্রেয়া আঁতকে ওঠে, “না ও একা যাবে না আমিও যাবো।”
নিরঞ্জন বাবু হেসে বলেন, “ও অথবা তুমি কেউই একা যাবে না। আমি নৈহাটি থানায় ফোন করে বলে দিচ্ছি সমীর বাবুর ওপরে নজর রাখার জন্য। যদি সমীর বাবু ফাঁদে পা দেয় তাহলে আমরা সবাই ওর পিছু নেব। হাতেনাতে ধরতে পারলে ওর বিরুদ্ধে আর বেশি প্রমানের দরকার নেই। একবার আমার হাতে পরুক তারপরে ওর মুখ থেকে কি করে কবুল করাতে হয় সেই উপায় আমাদের বেশ ভালো ভাবেই জানা আছে।”
নিরঞ্জন বাবু নৈহাটি থানায় ফোন করে সমীর বাবুর বাড়ির ওপরে নজর রাখতে বলে দেয়। সেই সাথে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে ফোন করে এয়ারপোর্ট ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ফ্লাইটের লিস্ট জানতে চান। তিনি জানান সকালের ফ্লাইট সব চলে গেছে এরপরের ফ্লাইট বিকেল পাঁচটায়। নিরঞ্জন বাবু ওদের বলেন তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়লে এয়ারপোর্ট পৌঁছান যাবে, কিন্তু প্রমান ছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না। সুতরাং ওদের শুধু মাত্র অনুসরন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। লাভা থেকে গাড়ি নিয়ে সবাই কোলকাতার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। বাগডোগরাতে নিরঞ্জন বাবু একজন অফিসারকে নামিয়ে দিয়ে ফ্লাইটে করে সমীর বাবুকে অনুসরন করতে বলে দেন। তারপরে ওরা সবাই কোলকাতার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। পথে যেতে যেতে ল্যাপটপ খুলে রূপক ওর ইমেল দেখতে বসে যায়। ইমেল থেকে সেন্ডার আই.পি. এড্রেস বের করে ট্রেস করে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের নাম বের করে ফেলে। নিরঞ্জন বাবু সেই সারভিস প্রোভাইডারকে ফোন করে নিজের পরিচয় আর খুনের তদন্ত করছেন জানিয়ে আই.পি. এড্রেসের ঠিকানা জানতে চায়। সার্ভিস প্রোভাইডার জানায়, এই আই পি এড্রেস ডাটা কার্ডের, ওদের ডেটাবেস খুঁজে সমীর বাবুর নাম ঠিকানা পেয়ে নিরঞ্জন বাবুকে জানায়। রূপক সাথে সাথে একটা ইমেল করে দেয় যে এক দুর্ঘটনার জন্য ওদের ট্রেকিং সুখকর হয়নি, কিন্তু সুন্দর একটা জায়গার খবর দিয়েছে বলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। সেই সাথে আরো লেখে যে রূপক এই আগন্তুকের সাথে দেখা করতে চায়। ওইদিকে যে অফিসার বাগডোগরা এয়ারপোর্টে থেকে গিয়েছিল সে ফোন করে জানিয়ে দেয় ওদের ধারনা অনুযায়ী সমীর বাবু ফ্লাইটে করেই কোলকাতা ফিরছে। ওদের কোলকাতা ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে, তাই সেই অফিসারকে ফ্লাইটে করেই সমীর বাবুকে অনুসরন করে কোলকাতা ফিরতে নির্দেশ দেয়।
কোলকাতা ফিরতে ওদের মধ্যরাত হয়ে যায়। অনুপমাকে একা বাড়িতে ফিরতে দেয় না শ্রেয়া। ওকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে যায়। ব্যাঙ্গালোরে ফোন করে মামনিকে মাকে বাকি সবাইকে জানিয়ে দেয় যে আততায়ীকে খুঁজে পাওয়া গেছে। সেই শুনে সবাই বেশ খুশি কিন্তু দেবায়নের শারীরিক অবস্থার উন্নতির খবর নেই শুনেই অনুপমা মুষড়ে পড়ে। রূপক, শ্রেয়া আর অনুপমাকে ব্যাঙ্গালোর দেবায়নের কাছে চলে যেতে অনুরোধ করে। এবারে যখন আততায়ীর আসল পরিচয় জানা গেছে আর নিরঞ্জন বাবু সাথে আছেন তাহলে সমীর বাবুকে ধরতে ওদের কোন অসুবিধে হবে না। শ্রেয়ার সাথে থাকলেও ওর মন পড়ে থাকে দেবায়নের কাছে।
রাতের বেলা চোখের পাতা এক করতে পারে না অনুপমা। একা বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে নীরবে বুকের অশ্রু ঝরায়। কি পাপ করেছে দেবায়ন যে ওকে এই মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যে পড়তে হল? দেবায়ন কখন দোষ করেনি, বরং সবার ভালোই চেয়ে এসেছে। ওদের পরিবারের মধ্যে, বাবা মায়ের মধ্যে, ওর আর মায়ের মধ্যে যে কঠিন দেয়াল এতদিনে গড়ে উঠেছিল সেটা ভেঙ্গে দিয়েছে। ওর সব থেকে ভালো বান্ধবী পায়েলকে বাঁচিয়ে এনেছে। একটা হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে চাগিয়ে তুলেছে। ওর এক ভাই আছে সেটা জানত না, তাকেও খুঁজে বের করেছে আর অতি সুকৌশলে ওর সাথে নিবেদিতার বন্ধুত্ব করিয়েছে যাতে ভবিষ্যতে ওদের মাঝে কোন দ্বন্দ না হয়। তাহলে কোন পাপের শাস্তি পেয়েছে ওর পুচ্চু।
সকাল বেলায় শ্রেয়া আর নিজের জন্য ব্যাঙ্গালোরের টিকিট কাটে। খাবার টেবিলে শ্রেয়ার বাড়ির লোকের সাথে দেখা হয়। সবাই দুঃখ ব্যাক্ত করে। শ্রেয়া সবাইকে জানিয়ে দেয় কেউ যেন কোন দুঃখ না প্রকাশ করে, দেবায়ন ভালো আছে, দেবায়ন ভালো হয়ে আবার অনুপমার কাছে ফিরে আসবে।
অনুপমা আর শ্রেয়া দুপুরের পরে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। রূপক ওদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে এসেছিল।
গাড়িতে যাওয়ার সময়ে অনুপমা শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, ওই পঞ্চাশ লাখ টাকা কোথা থেকে যোগাড় করলি বললি না তো?”
শ্রেয়া স্মিত হেসে বলে, “তোর জেনে কি দরকার।”
অনুপমার জোরাজুরির পরে শ্রেয়া উত্তর দেয়, “রূপক আর আমি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম আততায়ীর খবর জানার জন্য কিন্তু আমাদের হাতে অত টাকা নেই। ফোন করলাম সব বন্ধু বান্ধবীদের, যার যতটা ক্ষমতা সে ততটা দিল, ধীমান, প্রবালের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা, সঙ্গীতা আর তনিমা এক লাখ করে দিল। আমার কাছে তিন সাড়ে তিনের মতন ছিল কিন্তু তাতেও কুলায় না।”
কথা গুলো শুনতে শুনতে অনুপমার চোখে জল চলে আসে। ওর পাশে সত্যি অনেকে দাঁড়িয়ে কিন্তু এত ভিড়েও যে অনুপমা একা, বড় একা। দেবায়ন পাশে না থাকলে এই ভিড় এই বন্ধু বান্ধবী এই সুখ দিয়ে কি করবে? শ্রেয়া তারপরে বলে, “রূপকের কাছে পাঁচ লাখ টাকা ছিল কিন্তু সব মিলিয়ে পঞ্চাসের কাছাকাছিও যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত রূপক একজনের কাছে হাত পাতে। সেই অবশ্য আমাদের সবার টাকা ফেরত দিয়ে নিজেই পঞ্চাশ লাখ টাকা আমাদের দেয়।”
অনুপমা উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে, “কে দিয়েছে?”
রূপক স্মিত হেসে বলে, “না রে নাম বলা বারন, তাই বলতে পারছি না। তবে ওই নিয়ে চিন্তা করিস না, তুই নিশ্চিন্ত মনে ব্যাঙ্গালোর যা আর দেবায়নকে ফিরিয়ে নিয়ে আয়। এইবারে তোদের বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তোদের চোখে চোখে রাখব, যেমন ভাবে বেহুলা লক্ষিনদরকে আটকে রাখা হয়েছিল ঠিক সেই মতন এক বাড়ি বানিয়ে তোদের রেখে দেব।”
অনুপমার চোখ জোড়া ছলকে ওঠে, শ্রেয়া ওকে প্রবোধ দিয়ে বলে, “প্লিস সোনা কাঁদিস না আর, আমার মন বলছে দেবু এইবারে ঠিক উঠে দাঁড়াবে।”
অনুপমা ধরা কণ্ঠে বলে, “এইবারে না ওঠা পর্যন্ত আর আমি ওর পাশ ছাড়ব না।”
ব্যাঙ্গালোর পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। দিলিপ বাবু ওদের জন্য গাড়ি পাঠিয়েছিল, এয়ারপোর্টে অঙ্কন ওদের নিতে এসেছিল। অঙ্কনের মুখে জানতে পারে যে দেবায়নের অবস্থা এখন আগের মতন, নাকে অক্সিজেনের নল, ওষুধপত্র সব কিছু আই.ভি. করে দেওয়া হচ্ছে, শ্বাসের গতি অতি ধীরে। পারমিতাকে কাছে পেয়ে দেবশ্রী একটু সুস্থ হয়েছেন না হলে এই কয়দিনে ছেলের এই অবস্থায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলেন। দিলিপ বাবুর বাড়ি আর বাড়ি নেই, ছোট খাটো নার্সিং হোম হয়ে গেছে, সকাল বিকেল ডাক্তারদের আনাগোনা, সর্বদার জন্য তিনটে নার্স মোতায়ন করা।
বাড়িতে ঢুকে ওকে দেখে সবাই শুকনো মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুপমা সোজা দেবায়নের ঘরে ঢুকে পড়ে। বিছানায় শায়িত নিস্তেজ একটা শরীর, কোন সারা শব্দ নেই, নড়ন চড়ন নেই, দুই চোখ বোজা, সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা। দিলিপ বাবু জানালেন, কোমা থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত ডাক্তারেরা অপারেশান করতে পারছে না। সবাই বড় চিন্তায়, কেউ কিছু বুঝতে পারছে না কি ভাবে দেবায়নের জ্ঞান ফিরিয়ে আনবে। প্রেমিকার চেয়ে বেশি এক মায়ের হৃদয় তার এক মাত্র ছেলের জন্য বেশি ভেঙ্গে পড়েছে। তাও দেবশ্রী মন শক্ত করে অনুপমাকে শক্তির জোগান দেয়।
দেবশ্রী অনুপমাকে বলে, “এইবারে ওকে বাড়িতে নিয়ে যাবার ব্যাবস্থা করো। এইখানে দিলিপ বাবুর কাছে কত দিন রাখা যায় বল।”
অনুপমা মাথা দোলায়, হ্যাঁ এইবারে দেবায়নকে কোলকাতা নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করা দরকার। সেই খবর শুনে দিলিপ বাবু জানিয়ে দিলেন যে ব্যাঙ্গালোরের ডাক্তারদের যখন শুরু থেকে দেখান হচ্ছে তখন দেবায়ন ঠিক না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার বাড়িতে রেখে দেওয়া হোক। সোমেশ বাবু বলেন, যে দেবায়ন কবে এই কোমা থেকে চোখ খুলবে….. কথাটা বলে ফেলে বুঝতে পারলেন যে বড় ভুল করছেন। দেবশ্রী ছলছল চোখে ছেলের বিছানার এক পাশে বসে অন্যপাশে অনুপমা দেবায়নের নিস্তেজ হিমশীতল হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে বসে। দিলিপ বাবু জানিয়ে দেন, যতদিন না দেবায়ন চোখ খুলবে ততদিন তার সেই সামরথ আছে যে অনুপমা, দেবশ্রী দেবায়ন আর ওর চিকিৎসা সব করাতে পারবেন। দিলিপ বাবু আর কণিকা দেবী কিছুতেই ওদের যেতে দিতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত সবাই হাল ছেড়ে দেয়।
দেবশ্রী বাদে বাকি সবার জন্য হোটেলে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়। হোটেল অবশ্য বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় তাই সকালে উঠেই সবাই বাড়িতে চলে আসে। সারা রাত অনুপমা দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। সবাই যে যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে, রাতের ডিউটির জন্য যে নার্স কে রাখা হয়েছিল সে বসার ঘরে বসে একটা গল্পের বই পড়ছিল।
Posts: 6,494
Threads: 21
Likes Received: 6,992 in 3,702 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
239
অনুপমা, দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে আলতো করে নিস্তেজ হাতের মধ্যে হাতে বুলাতে বুলাতে কাতর কণ্ঠে কেঁদে ওঠে, “পুচ্চু, তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না…..” বারেবারে বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত বিছানায় উঠে ওর বুকের ওপরে আছড়ে পড়ে। বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে ডুকরে কেঁদে ওঠে, “পুচ্চু প্লিস সোনা একবার চোখ খোল…..” বুকের ওপরে কান চেপে অতি ধীরে চলা হৃদপিণ্ডের ধ্বনি একমনে শোনে, হুপ হুপ হুপ হুপ….. ভয় হয় যদি এই শব্দ থেমে যায়।
কতক্ষণ ওইভাবে দেবায়নের বুকের ওপরে মাথা গুঁজে একমনে ওর হৃদয়ের ডাক শুনছিল সঠিক মনে নেই অনুপমার। তবে হটাত দেবায়নের হৃদয়ের ধ্বনি বেড়ে যাওয়াতে ওর সম্বিত ফেরে, সেই সাথে একটা যান্ত্রিক টিঁ টিঁ টিঁ আওয়াজে বেজে। হৃদয়ের ধুকপুকানির শব্দ বেড়ে উঠতেই অনুপমা সতর্ক হয়ে দেবায়নের বুক থেকে উঠে ওর মুখের দিকে তাকায়। বন্ধ চোখের পাতা ঝরা পাতার মতন ধীরে ধীরে নড়ে ওঠে। হিমশীতল শরীরে উত্তাপের সঞ্চার হয়।
অনুপমা ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে, “কাবেরি” নার্সের নাম কাবেরি।
ওর ডাক শুনে সঙ্গে সঙ্গে নার্স, দেবশ্রী দিলিপ বাবু কণিকা দেবী সবাই দৌড়ে আসে। কাবেরি, সঙ্গে সঙ্গে দেবায়নকে পরীক্ষা করে, দেবায়নের হাত একটু একটু করে নড়ে ওঠে, চোখের পাতা নড়ে ওঠে। অনুপমার চোখ জোড়া ভরে আসে জলে। অবশেষে ওর হৃদয় ডানা মেলেছে। নার্সের চেহারায় উদ্বিগ্ন ভরা। দেবায়ন বহু কষ্টে চোখ খুলে সবার দিকে তাকায়। দেবশ্রী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে। দেবায়ন আলতো মাথা দুলিয়ে মাকে কাছে ডাকে। দেবশ্রী দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।
বহু কষ্টে দেবায়ন মায়ের কানে কানে বলে, “মা,” ছেলের মুখে অনেক দিন পরে “মা” ডাক শুনে দেবশ্রী কেঁদে ফেলে, “হ্যাঁ বাবা বল, এই তো আমি।”
দেবায়ন অতি কষ্টে ফিসফিস করে মায়ের কানে বলে, “বাবা চকলেট দিতে চেয়েছিল মা, কিন্তু তোমাকে একা ফেলে যেতে পারলাম না মা।”
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলে দেবশ্রী।
সবার চোখে জল চলে আসে। অনুপমা ওর পাশে বসে ওর হাত ধরে কেঁদে ফেলে, “পুচ্চু…..”
নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হয় দেবায়নের তাও বহু কষ্টে অনুপমার কানেকানে বলে, “তুই…..”
অনুপমা ধরা কণ্ঠে বলে, “আর তোকে ছেড়ে যাবো না কোথাও।”
কাবেরি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদের ফোন করে দেয়। সেই রাতেই ডাক্তারেরা দিলিপ বাবুর বাড়িতে ওকে দেখতে চলে আসে। দিলিপ বাবু সোমেশ, পারমিতাকেও ফোন করে জানিয়ে দেয় যে দেবায়নের জ্ঞান ফিরে এসেছে। রাতের মধ্যে দিলিপ বাবুর বাড়িতে লোক জনের সমাগম বসে যায়, খুশির ছোঁয়া লাগে সবার বুকে। অবশেষে দেবায়ন আবার ওদের মাঝে ফিরে এসেছে। ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে জানায়, এইবারে অপারেশান করা যেতে পারে। দেবায়নের ডান পায়ের হাড় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। হাড়ের বদলে স্টিল রড অথবা টাইটেনিয়াম রড বসাতে হবে, না হলে দেবায়ন আর কোনোদিন হাঁটতে পারবে না। সেই শুনে সবাই চিন্তিত হয়ে পরে। টাইটেনিয়াম রড বসাতে অনেক খরচ পরে যাবে বলে ডাক্তারেরা জানায়। টাকার ব্যাপারে সেই সময়ে কারুর মাথা ব্যাথা ছিল না। দিলিপ বাবু, সোমেশ বাবু স্বমস্বরে জানিয়ে দেয় টাকার চেয়ে দেবায়নের উঠে দাঁড়ানো ওদের কাছে বেশি জরুরি। বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করার পরে দেবশ্রী জানায় হাড়ের বদলে টাইটেনিয়াম রড বসানোর জন্য। দিন দুইয়েক পরে দেবায়নের পায়ের অপারেশান করা হয়। তারপরে ওর শরীরে বেশ কয়েক জায়গায় অপারেশান করা হয়, শিরদাঁড়ার, হাতের। এই অপারেশান করতে করতে আরও বেশ কয়েকদিনে লেগে যায়। ডাক্তারেরা জানায়, দেবায়নের উঠে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগবে। কোলকাতা ফিরে যেন এক ফিজিওথেরাপিস্ট নিযুক্ত করে যাতে দেবায়ন আবার চলাফেরা করতে পারে। দেবায়ন চোখ খোলার পরেরদিন শ্রেয়া কোলকাতায় খবর দিয়ে জানিয়ে দেয়।
সোমেশ বাবুর অফিস আর অঙ্কনের কলেজের পড়াশুনার ব্যাঘাত ঘটার জন্য অনুপমা ওদের বাড়ি ফিরে যেতে বলে দেয়। সোমেশ বাবু, অঙ্কন আর পায়েলকে নিয়ে কোলকাতা ফিরে আসে।
Posts: 6,494
Threads: 21
Likes Received: 6,992 in 3,702 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
239
পর্ব ২৯ (#০৮)
বেশ কয়েকদিন পরে রূপক ব্যাঙ্গালোর চলে আসে। ততদিনে দেবায়ন বেশ সুস্থ হয়ে ওঠে কিন্তু তাও শয্যাশায়ী। দেবায়ন অনুপমাকে একদিন জিজ্ঞেস করে, “আমাকে কে ঠেলে দিয়েছিল রে, জানিস?”
অনুপমা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ, আততায়ী এতদিনে ধরা পড়েছে। অগ্নিহোত্রীর বাবা সমীর বাবু।”
রূপক উত্তরে জানায়, আততায়ী শেষ পর্যন্ত ওদের জালে ধরা দেয়। রূপক ইমেল করে উত্তরে জানিয়েছিল যে কোন এক কারনে ওদের ট্রেকিং সুখকর হয়নি, কিন্তু ওই জায়গার সম্বন্ধে আগন্তুক ওদের খবর দিয়েছিল বলে রূপক ওর সাথে দেখা করে ধন্যবাদ জানাতে চায়। সমীর বাবু ভাবতে পারেনি যে রূপক ওকে চিনে ফেলবে তাই রূপকের ইমেলের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন যে দেখা করবেন। সেই সাথে তিনি জানান যে তিনি বাঙালী নয়, উত্তর ভারতের লোক তাই মুসৌরির কাছে ধনোল্টি নামক এক জায়গায় দেখা করার কথা ব্যাক্ত করেন। রূপক, পরাশর, নিরঞ্জন বাবু, ঘন সিয়ালির ইনস্পেকটর রোহন সবাই তক্কেতক্কে ছিল। ওদের পরিকল্পনা মাফিক আগে থেকে নিরঞ্জন বাবু আর রোহন ধনোল্টি পৌঁছে যায় আর জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। রূপক একাই ধনোল্টি যায় সমীর বাবুর সাথে দেখা করতে। সমীর বাবু, গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে, নিজের পরিচয় লুকিয়ে পাঞ্জাবী সেজে ওর সাথে দেখা করতে আসে। সেইখানে রূপককে দেখে সমীর বাবু ছুরি বের করে রূপক কে আক্রমন করতে যায় আর সেই সময়ে রোহন আর নিরঞ্জন বাবু ওকে ধরে ফেলে। ধরা পড়ে যাওয়াতে সমীর বাবু মুষড়ে পরে। ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়া আর হল না। নিরঞ্জন বাবু বলেন, সমীর বাবুর ছেলে নিজের দোষে নিজের পাপে প্রান হারিয়েছে। অগ্নিহোত্রী পাপী, অগ্নিহোত্রী দোষী, দেবায়ন আর রূপক নয়।
ধরা পড়ার পরে সমীর বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে সমীর বাবু জানান, ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই সমীর বাবু ফাঁক খুঁজছিলেন কি করে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। তিনি কাউকে না জানিয়ে একাই এক বিশাল ষড়যন্ত্র রচনা করেন। নির্জন স্থান খোঁজার জন্য এক বছর ধরে বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়ে কাটিয়ে দেন। তারপরে কম্পিউটার, ইন্টারনেট শেখেন যাতে রূপক অথবা দেবায়নের সাথে নিজের পরিচয় লুকিয়ে ইমেল করতে পারে। এই ট্রেকিং বিষয়ের বেশ কয়েকটা ইমেল দেবায়ন কে প্রথমে পাঠিয়েছিলেন সমীর বাবু, কিন্তু দেবায়ন তার কোন উত্তর দেয়নি দেখে পরে রূপকের কাছে পাঠায়। রূপক তার জালে ফেঁসে যায় আর উত্তরে জানায় ট্রেকিঙ্গে যেতে রাজি। ইমেলের মাধ্যমে রূপকের সাথে প্রথমে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আলোচনা চলে সমীর বাবুর, শেষ পর্যন্ত একটা ট্রেকিংয়ের সাইটের খবর দেয় সমীর বাবু। আগে থেকে সমীর বাবু সেই অয়েব সাইটে লগিন করে একটা ভুয়ো নামের একাউন্ট বানিয়ে রেখেছিলেন। রূপকের সাথে সেই ভুয়ো নামের একাউন্ট থেকে চ্যাটিং করেন আর এই ভাবে জানতে পারেন যে রূপক ঠিক কোথায় ট্রেকিংয়ে যাবে। সমীর বাবু ওদের ওপরে নজর রেখেছিল, আর আগে থেকেই একা একাই ঘুট্টু পৌঁছে গিয়েছিল। গা ঢাকা দেওয়ার জন্য তিনি জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
নিউ তেহেরিতে, কুমার নামের পাহাড়ি ছেলেটার সাথে আলাপ হয়। তিনি কুমারকে সঙ্গে নিয়ে বলেছিলেন যে খাটলিং যেতে চায়। কুমারকে আসল উদ্দেশ্য জানায়নি সমীর বাবু, দেবায়ন আর রূপকের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন যে এদের একজনকে ডেকে আনতে আর ডেকে আনার পরে যেন পালিয়ে যায়। কুমার ওদের তাঁবুর কাছে গিয়ে দেবায়নকে ডাকে। সমীর বাবু ভেবেছিলেন, যেহেতু রূপক আর দেবায়ন ভালো বন্ধু সুতরাং দুইজনে একসাথেই আসবে। সমীর বাবু চেয়েছিলেন দুইজনকে একসাথে সেদিন রাতে খুন করবেন কিন্তু দেবায়ন একাই কুমারের সাথে আসে। তাই ওকেই প্রথমে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়। খুন করার আগে সব কিছু খুলে বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার আগেই দেবায়ন ওই খাদের মধ্যে হারিয়ে যায়। তারপরে সমীর বাবু, জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসেন। কোলকাতা ফিরে খবরের কাগজে দেবায়নের নিখোঁজ হওয়ার খবর পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যান।
এরপরে তক্কে থাকেন কি ভাবে রূপকের ওপরে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত একদিন রূপককে চিঠি পাঠিয়ে জানায় যে তিনি দেবায়নের আততায়ীর খবর জানেন। রূপক সেই ফাঁদে পা দেবে সেটা নিশ্চিত ছিলেন। সমীর বাবু চেয়েছিলেন রাস্তার মধ্যেই রূপকের গাড়ির এক্সিডেন্ট ঘটাতে। সাধারনত লাভা যেতে সবাই কালিম্পং হয়েই যায় আর ভোরের দিকে রাস্তায় কুয়াশা থাকে। কিন্তু রূপক কালিম্পং হয়ে লাভা যায়নি দেখে মুষড়ে পড়েন। তিনি কোলকাতা ফিরে এসে আবার সুযোগের অপেক্ষা করেন। তারপরে রূপক ইমেল করে জানায় সে দেখা করতে চায়। ইমেল পড়ে সমীর বাবুর প্রত্যয় হয় যে রূপক এখন আসল আততায়ীকে চিনতে পারেনি। তাই তিনি নিজের পরিচয় একজন পাঞ্জাবী হিসাবে দিয়ে নির্জন ধনোল্টিতে দেখা করার কথা জানায়। তিনি ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেন নি যে ওরা আগে থেকেই ওর পরিচয় জেনে ফেলেছে। কুমারকে হত্যা করার দায়ে আর দেবায়নকে খুন করার দায়ে রোহন সমীর বাবুকে গ্রেফতার। এই কেস উত্তরাখন্ডে ঘটেছে তাই উত্তরাখণ্ডের আদালতে এই মামলা চলবে।
পঞ্চাশ লাখ টাকার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, রূপক কিছুতেই জানাতে নারাজ কোথা থেকে ওই টাকা যোগাড় করেছে। অনুপমার দৃঢ় প্রত্যয়, এক কথায় পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে দেবে এমন মানুষ শুধু মাত্র দুইজন আছে, এক ওর বাবা, কিন্তু বাবা দিলে ওর মা ওকে জানিয়ে দিত, আর দ্বিতীয় নিবেদিতা। কিন্তু অনুপমা যেটা বুঝে উঠতে পারে না, রূপক কেন নিবেদিতার কাছে গেল।
অনুপমা শেষ পর্যন্ত রূপককে বলে, “আমি জানি কে তোকে টাকা দিয়েছে।” রূপক জিজ্ঞেস করাতে অনুপমা উত্তর দেয়, “নিবেদিতা তোকে টাকা দিয়েছে, তাই না। কিন্তু নিবেদিতাকে তুই কোথায় পেলি?”
শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া ওর হয়ে উত্তর দেয়, “আমাদের আর কিছু মাথায় আসছিল না, কোথায় যাবো কি করব কিছুই ভেবে উঠতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত নিবেদিতার কথা মনে পরে গেল। তুই অ্যানুয়াল মিটে সবার সামনে জানালি যে নিবেদিতা তোর ভালো বন্ধু। তাই ওর কাছে গিয়ে সব কিছু খুলে বলাতে সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে দিলেন আর সেই সাথে আমরা যারা যারা টাকা দিয়েছিলাম তাদের টাকা ফেরত দিয়ে দেওয়া হল।”
সব কিছু বলার পড়ে শায়িত দেবায়নকে দেখে রূপক ওকে বলে, “শালা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়া, বিয়ে করতে হবে না?”
দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে অনুপমা স্মিত হেসে বলে, “আর ওকে চোখের আড়াল করছি না।”
************ সমাপ্ত ************
Posts: 1,886
Threads: 6
Likes Received: 6,324 in 1,869 posts
Likes Given: 2,644
Joined: Jun 2019
Reputation:
739
Posts: 776
Threads: 0
Likes Received: 1,584 in 919 posts
Likes Given: 1,439
Joined: Jan 2021
Reputation:
187
অনেক আগেই অন্য সাইটে পড়েছি গল্পটা. আমি নিশ্চিত যে পিনুরাম দা কোনো এক ছদ্মবেশী সাহিত্যিক, নাহলে এমন অভিজ্ঞ হাতে এক যৌন সাহিত্য এমন সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়!
একসাথে ভালোবাসা, প্রেম, বন্ধুত্ব সেইসাথে কিঞ্চিৎ অজাচার......... নাহ এমন গল্প লেখা যার তার পক্ষে সম্ভব নয়.
Posts: 6,494
Threads: 21
Likes Received: 6,992 in 3,702 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
239
(05-02-2021, 09:11 PM)a-man Wrote: অনেক আগেই অন্য সাইটে পড়েছি গল্পটা. আমি নিশ্চিত যে পিনুরাম দা কোনো এক ছদ্মবেশী সাহিত্যিক, নাহলে এমন অভিজ্ঞ হাতে এক যৌন সাহিত্য এমন সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়!
একসাথে ভালোবাসা, প্রেম, বন্ধুত্ব সেইসাথে কিঞ্চিৎ অজাচার......... নাহ এমন গল্প লেখা যার তার পক্ষে সম্ভব নয়.
পিনুরাম যদি মূল ধারার গল্প লিখতেন তাহলে সাহিত্য জগতে শোরগোল পড়ে যেত
Posts: 776
Threads: 0
Likes Received: 1,584 in 919 posts
Likes Given: 1,439
Joined: Jan 2021
Reputation:
187
(05-02-2021, 10:56 PM)Mr Fantastic Wrote: পিনুরাম যদি মূল ধারার গল্প লিখতেন তাহলে সাহিত্য জগতে শোরগোল পড়ে যেত
কোনোই সন্দেহ নেই. অথবা কে জানে তিনি হয়তোবা লেখেনও কোনো ছদ্দনামে এবং সেসব সাহিত্য বই বেস্ট সেলার........
Posts: 34
Threads: 0
Likes Received: 25 in 22 posts
Likes Given: 75
Joined: Jan 2022
Reputation:
0
•
Posts: 77
Threads: 0
Likes Received: 40 in 36 posts
Likes Given: 37
Joined: Jan 2024
Reputation:
2
•
Posts: 52
Threads: 0
Likes Received: 84 in 41 posts
Likes Given: 10
Joined: Feb 2024
Reputation:
4
পারমিতা .....
•
|