21-10-2020, 06:29 PM
কিন্তু এতকিছুর মধ্যে কেউ কি রিঙ্কির দিকে একবারও তাকিয়েছে? মায়ের মুখ থেকে কথাটা শোনার পর কেউ কি ওকে নড়তে অবধি দেখেছে? দেখবে কি করে, রিঙ্কির শরীরের সমস্ত স্নায়ু আর পেশী যে জমে থাকা বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে ! আর সেই হিমশীতলতার মধ্যে চারপাশের দেওয়াল আলমারি আসবাবপত্র সব যেন জ্বলন্ত মোমবাতির মোমের মতো গলে গলে পড়ছে ধীরে ধীরে | কেমন আবছা হয়ে আসছে দৃশ্যপট | চোখ দিয়ে যেন জল নয়, অঙ্গার গড়াচ্ছে |....ও ;.,ের বীজ ! ওর মা'কে ;., করেছিলো ওর বাবার এই বন্ধুটা ! এই লোকটা ওর আসল বায়োলজিক্যাল বাবা | এই লোকটাই ওর মা'কে নরকে টেনে নামিয়েছে, সাথে আজ নামিয়ে এনেছে ওকেও | ওই যে এগিয়ে আসছে লোকটা ! ওর সম্পর্কে কি হয় এখন লোকটা? কি বলে ডাকবে ওনাকে? বাবা....কাকু.... রাক্ষস....?
বিছানার পাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা রিঙ্কির সামনে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালেন মৃণাল বাবু | দু'চোখ ওনার জলে ভর্তি, মুখের বলিরেখাগুলো কুঁচকে গেছে অনুশোচনায় | কৃতকর্মের চরম শাস্তি পেয়েছেন আজ উনি | এখন শুধু ক্ষমা চেয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন | মেয়ের পরনের জামাটা এগিয়ে দিলেন ওর দিকে, ওর নগ্নতা হঠাৎ করেই ভয়ানক অসহ্য লাগছে দুই চোখে ! "আমাকে ক্ষমা করে দে মা | আমি তো.... আমি তো বুঝতে পারিনি ! না জেনে কত বড় ভুল করে ফেলেছি রে ! জামাটা পড়ে নে | আয় মা... কোলে আয় আমার?"....
"থুহহহঃ !"... একদলা থুতু ছিটিয়ে দিলো রিঙ্কি মৃনাল বাবুর সারামুখে, ওর ঘৃণার বিষ গড়িয়ে পড়তে লাগল ওর হতভম্ব 'প্রকৃত' বাবার গাল বেয়ে |.... ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলো রিঙ্কি | ভীষণ অচেনা লাগছে, আবছা লাগছে মুখগুলো | চোখের জলের জন্য কি?... একপাশে অবহেলায় পড়ে থাকা ছোটবেলার সঙ্গী টেডি-বিয়ারটা হাতে তুলে নিল রিঙ্কি, তারপর ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে | নগ্নপায়ে, নগ্নশরীরে | ইডেন থেকে নির্বাসিত প্রথম মানবীর মত, যে বিধাতার নিষেধ সত্ত্বেও খেয়ে ফেলেছিল জ্ঞানবৃক্ষের ফল | গোটা ঘর তখন থমকে দাঁড়িয়ে বিগব্যাংয়ের পূর্বমুহূর্তের নিস্তব্ধতায় |....
সেদিন কোচিংয়ে রিঙ্কি ঢুকলো সবার শেষে, স্যার ততক্ষনে পড়ানো শুরু করে দিয়েছে | চুপচাপ একটা কোনায় গিয়ে থম মেরে বসে রইল ও | মাথায় ঘুরতে লাগলো হাজারো কথা | এক লাইনও নোটস লিখলো না, বারবার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে লাগল ঋতমের দিকে | ঋতমও ওর মুখ দেখে বুঝতে পারল সিরিয়াস কিছু একটা নিশ্চই হয়েছে |
কিন্তু কি হয়েছে সেটা কোচিং ছুটির পরে জানতে পেরে ঋতমের মুখের অবস্থাটা হলো রিঙ্কির চেয়েও শোচনীয় !
"বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি আমি, পার্মানেন্টলি |"
"বাড়ি ছেড়ে? মানে?"
"ছেড়ে মানে ছেড়ে ! আর কখনও ব্যাক করবো না |"...
"আর ইউ ক্রেজি? কি বলছ কি তুমি?"... প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে ঋতম |
"নো, আয়াম কমপ্লিটলি ফাইন | বাট এভরিথিং ইজ অপোজিট টু ফাইন ইন মাই হাউস | আই ক্যান্ট লিভ দেয়ার ঋতম, আই ক্যান্ট !".... হতাশা ভেঙে পড়ে রিঙ্কির কণ্ঠস্বরে |
"কি হয়েছে আমাকে বলবে তো !"...রিঙ্কিকে দু'হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল ঋতম |
"কিছু না | আমি তোমাকে সব বলতে পারব না | শুধু এটুকু জেনে রাখো ওই বাড়িতে থাকলে তোমার রিঙ্কি দমবন্ধ হয়ে মরেই যাবে !"...
"কি হয়েছে সোনা? তোমাকে কেউ খারাপ কিছু বলেছে? গায়ে হাত তুলেছে? বলো আমাকে? আমি আছি তো তোমার সাথে | সামান্য কারনে হুট করে এত বড় স্টেপ নিতে নেই ! বাড়ি ফিরে যাও লক্ষীটি |"...ঋতম আদরমাখা স্বরে বোঝানোর চেষ্টা করে রিঙ্কিকে |
"তুমি বুঝতে পারছ না | ফিরে যাবো বলে বেরোইনি আমি ! তুমি তো আমাকে ভালোবাসো, আমারও তুমি ছাড়া আর কেউ নেই | চলো আমরা আজকেই বিয়ে করে নিই ঋতম | আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে চলো | আমার বাড়িতে আমি আর ফিরবো না |".... ব্যাকুলকন্ঠে বয়ফ্রেন্ডের জামা খামচে এতদিনের ভালবাসার প্রতিদান চাইল ওর কিশোরী প্রেমিকা |
কিন্তু চাইলেই তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না !... "কিহ? বিয়ে? আজকেই বিয়ে করতে হবে? হ্যাঁহহ্?".... দৃশ্যতই আকাশ থেকে পড়ল ঋতম |
"হ্যাঁ আজকেই ! বিয়ে তোমার বাবা-মা যবে বলবে তবেই করব, কিন্তু তোমার বাড়িতে আজকে নিয়ে চলো | আমার বাড়িতে আমার ভয় করছে থাকতে !"...
"কিন্তু আমার বাবা-মা যদি মেনে না নেয়? আর তোমার বাবা-মা? ওনারা কি বলবেন?"
"বললাম তো, আই ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট মাই প্যারেন্টস ! তোমার বাবা-মাকে আমরা দুজনে মিলে বোঝাবো | ভালো করে বোঝালে ওনারা ঠিক বুঝতে পারবেন দেখো !".... ডেস্পারেট গলায় বলল রিঙ্কি |
"আরে আমরা তো লিভ-ইন করবো ঠিক করেছিলাম | তার কি হবে?"
"চলো তাহলে সেটাই করবো ! এক্ষুনি যেতে হবে | বলো রাজি আছো?"
"ওহ রিঙ্কি, ডোন্ট বি সো নাইভ ! ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড |"
"হোয়াট শ্যুড আই আন্ডারস্ট্যান্ড ঋতম? যে যখন আমার তোমাকে সবচেয়ে বেশি করে দরকার ঠিক তখনি তুমি আমার হাত ছেড়ে দেবে? আমি যাকে ভালোবাসি এতটুকুও সাহস নেই তার মধ্যে?"... দু'চোখে আগুন জ্বলে ওঠে রিঙ্কির |
"ওহঃ প্লিজ রিঙ্কি ! এটা সাহসের কথা হচ্ছেনা | ভালো আমিও তোমাকে কম বাসিনা | কিন্তু বাবা-মায়ের এগেইনস্টে কি করে যাব?"
"এগেইনস্টে যেতে তো বলিনি | তুমি বোঝাবে তোমার বাবা-মাকে | আমিও ওনাদের ছেড়ে নয়, ওনাদের সাথেই থাকতে চাই, তোমার বাবা-মায়ের সেবা করতে চাই | সারাজীবন তোমার সাথে সুখে থাকতে চাই | তোমাকে বদলে মাত্র এইটুকু সাহস আজ দেখাতেই হবে | নাহলে আমি শেষ হয়ে যাবো ঋতম !"...
"রিঙ্কি, একটু বোঝার চেষ্টা করো লক্ষীটি?"
"তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো ঋতম !"...চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে রিঙ্কির |
"আরে কি বুঝবো? হঠাৎ করে এরকম সম্ভব নাকি? আমরা এখনও এতটা বড় হইনি | আমি এখনো পড়াশোনা করছি, জব না ! কোন মুখে বাবাকে বলবো তুমিই বলো?"...
"প্লিজ ঋতম প্লিজ !"... ইনসিকিওরিটিতে ডুবে যেতে যেতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রিঙ্কি |
"হোয়াট প্লিজ?"...ঋতমের গলায় কিন্তু শুধুই বিরক্তি !
"প্লিজ আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে চলো !"...
"উফ্ফ ! এইসব পাগলামি বন্ধ করো | আমি পারবো না | ব্যাস ! তাতে রিলেশান রাখতে হয় রাখো, না ইচ্ছা করে তো রেখোনা !"...
আর সহ্য করতে পারলোনা রিঙ্কি | রাগের বশে মারলে মেয়েমানুষের নরম হাতের থাপ্পড়ও অন্য স্বাদের লাগে ! ওর ঠাস করে একটা চড়ে গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঋতম | "ইউ স্পাইনলেস ! অপদার্থ... কাওয়ার্ড ! ফাকিং সেলফিস !... ডোন্ট এভার ট্রাই টু কন্ট্যাক্ট মি এগেইন !"....চোখের জল মুছতে মুছতে ওখান থেকে বেড়িয়ে আসে রিঙ্কি | হাঁটতে থাকে বাড়ির রাস্তার উল্টোদিকে |
"চেপে যা ভাই | তোর জন্যই বাড়িতে কেস খেয়েছে মনে হচ্ছে | ঘাঁটাতে গেলে তুইও কেস খাবি !"....ভাবলো পরে মানিয়ে নেবে ওর রাগ কমে গেলে, 'বুদ্ধিমান' বন্ধুদের পরামর্শে তখনকার মত রিঙ্কির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কোচিংয়ের পিছনে ওদের সিগারেট খাওয়ার গলিতে সুখটান মারতে চলে গেলো ঋতম |
ওদিকে কোচিং থেকে দূরে, আরও দূরে চলে যেতে লাগলো রিঙ্কি | কতটা দূরে গেলে বাবা-মা ওকে আর কখনও খুঁজে পাবেনা? হাঁটতে হাঁটতে চেনা রাস্তাগুলোও অচেনা ঠেকে ওর ঘোর লাগা চোখে | একমাত্র যার উপর ভরসা করা যায় ভেবেছিল, সেই বয়ফ্রেন্ডও নিজের আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে !... এবারে ও কি করবে? কার কাছে যাবে? কে এমন আত্মীয় আছে ওর যে ওকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেবে, কক্ষনো বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে হবেনা? এমনকি ওনারা ফিরিয়ে নিতে এলেও রিঙ্কিকে আড়াল করবে, রিঙ্কির হয়ে লড়াই করবে? নাহ, কেউ করেনা এরকম ! অন্তত কারণ না জেনে | আর রিঙ্কি দরকার হলে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেবে, কিন্তু পরিবারের ওই নোংরামির কথা নিজের মুখে বলতে পারবেনা বাইরের কাউকেই !... আত্মীয়র বাড়ির রাস্তা তাহলে বন্ধ | কোনো বান্ধবীর বাড়ি যাবে? বান্ধবীদের বাড়ি টেম্পোরারি সল্যুশন হতে পারে, পার্মানেন্ট কখনোই নয় | কিন্তু নিজের বাড়ির ওই পাপের নরককুন্ডে আর কিছুতেই ফিরে যাবেনা ও.... কিছুতেই না !... তাহলে কি করবে ও? দু'হাতে মাথার চুল খামচে রাস্তার পাশের ফুটপাথেই একটা বাড়ির বন্ধ দরজার সিঁড়িতে বসে পড়ে রিঙ্কি |
শেষে কি পতিতা-পাবন মা গঙ্গাই ওর ভরসা? নদীর অতলে চিরদিনের মত তলিয়ে গিয়ে ওর সব জ্বালা জুড়াবে? নাকি ও বাড়ি ফিরে যাবে, আর তারপরে আজ রাতেই গলায় দড়ি দেবে? জঘন্য মানুষ তিনটে তাহলে ভীষণ সমস্যায় পড়বে কিন্তু ! রক্তের সম্পর্ক থাকলেও কেউ নয় ওরা ওর....কেউ নয় ! হে ভগবান, এ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছো আমায়?... কোনোদিকেই দিশা খুঁজে পায়না মিষ্টি লংফ্রক পড়া অপ্রাপ্তমনের মেয়েটা | দু'হাতে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাতের তালু ভিজে ওঠে রিঙ্কির |
ঠিক তখনই বিদ্যুৎচমকের মত একটা মুখ ভেসে ওঠে ওর মনে | বান্টিদা ! পাড়ার বখাটে, রকবাজ বান্টিদা | ভালো নামও অবশ্য একটা আছে, আবির ঘোষ | কিন্তু ওটা আছে শুধু কলেজ-কলেজের খাতায় | এলাকার সবাই একডাকে বান্টি নামেই চেনে | ও হ্যাঁ, আরও একটা নাম আছে ওর, 'জুনিয়ার যুবরাজ' | না, বাই লুকস নয় | বান্টিকে দেখতে খুবই সাধারণ, এমন নয় যে দেখলেই প্রেমে পড়ে যাবে মেয়েরা | কিন্তু লম্বা ছিপছিপে চেহারায় বাঁহাতে টাঙিয়ে টাঙিয়ে ছয়গুলো মারে একদম যুবরাজ সিংয়ের মতো স্টাইলে | টুর্নামেন্ট থাকলে বান্টিদার ডাক পড়বেই | গুণের অবশ্য খামতি নেই ! পার্টি অফিসেও নিয়মিত যাতায়াত আছে | মদ গাঁজা বিড়ি সিগারেট, হেন কোনো নেশা নেই করেনা | মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার বদনাম অবশ্য নেই, তবে সবাই জানে বান্টি রিঙ্কিকে ভালোবাসে | ওই যে হয়না, পাড়ার দাদা গোছের ছেলেগুলোর পাড়ার মধ্যেই কোনো একটা মিষ্টি মেয়েকে অকারণেই দারুন ভালো লেগে যায়, তার সাথে মনে মনে প্রেম-ট্রেম করে সংসারই বসিয়ে ফেলে ! আর তারপরে বাকি কেউ সেই মেয়ের দিকে এগোয় না, ভাবখানা এমন যেন ওই মেয়ে ওই দাদারই সম্পত্তি ! কেউ জানতেও চায় না মেয়েটা মনে মনে কি ভাবছে, কতটা বিরক্ত হচ্ছে !... এটাও সেরকম ব্যাপার | রাস্তাঘাটে চলার সময় রিঙ্কিকে দেখলেই বান্টির বখাটে বন্ধুদের মধ্যে থেকে আওয়াজ ওঠে, "বান্টি....এ বান্টিইইই...." করে | এমনকি রিঙ্কির বান্ধবীরাও মাঝেমাঝে বান্টির নাম করে ওকে খচায় ! যথেষ্ট বিরক্ত ফীল করতো রিঙ্কি ওকে নিয়ে |
একদিন তো সাহস করে প্রপোজও করতে এসেছিল গ্রিটিংস কার্ড হাতে ! কিন্তু একে তো বয়সে প্রায় বছর দশেকের বড়, তার উপরে বাড়ির স্ট্যাটাসও রিঙ্কিদের থেকে খানিকটা নীচু | তাছাড়া ঋতমের সঙ্গে প্রেমটাও তখন সবে শুরু হয়েছে | কার্ড ফিরিয়ে দিয়ে রিঙ্কি ওকে মিষ্টিমুখেই অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল | তারপর থেকে আর কখনো কথা বলার চেষ্টা করেনি বটে, কিন্তু বান্টির ভালোবাসার জুনুন তাতে একটুও কমেনি ! কলেজে যাওয়ার সময় সেই নিয়ম করেই বাইক নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে বন্ধুদের সাথে, ক্যাবলার মত ঝাড়ি মারে রিঙ্কিকে | রিঙ্কি ইরিটেশানে মুখ ঘুরিয়ে নেয় | গটগট করে সামনে দিয়ে চলে যায় | পিছন থেকে আওয়াজ আসে, "বান্টি রে... আজকেও হলো না রেএএএ... !"... আর বান্টি ওদের মুখ চাপা দিয়ে থামানোর চেষ্টা করতে থাকে, "চুপ কর...আস্তে ! শুনতে পাচ্ছে !"...
"একটু এদিকে শুনবে? তোমার সাথে আমার দরকারি কথা আছে |"... ক্লাবের মাঠের এককোনায় সন্ধ্যার নেশার আড্ডার সামনে রিঙ্কিকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল বান্টি | মদের গ্লাস আধখাওয়া রেখেই ধড়মড় উঠে এলো | বন্ধুদের থেকে কিছুটা দূরে এসে ওদের শুনতে না পাওয়ার মতো গলায় হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "তুমি? এখানে? হঠাৎ?"...
"তুমি তো আমাকে ভালোবাসো বান্টিদা, তাইনা?"
"সবাই জানে | বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করো আমার বন্ধুদের !"
"তোমার বন্ধুদের কথা জানতে চাইনি, আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছি |"
"হ্যাঁ, খুব ভালোবাসি | তুমিও তো জানো !"... মাথা নিচু করে বলল বান্টি |
চোখ ছোট করে ওর মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে রিঙ্কি জিজ্ঞেস করল,"সবকিছু করতে পারবে আমার জন্য? যেকোনো কিছু?"
"নিজের বাড়ির লোককে দুঃখ না দিয়ে যা যা করা যায় সবকিছু !"... দৃপ্ত শোনালো বান্টির গলা |
"বিয়ে করতে পারবে আমাকে? আজকে, এক্ষুনি?"
"হ্যাঁ পারবো !"
"আমি কিন্তু আমার বাড়িতে আর ফিরে যাব না | বিয়ে করে তোমার বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে |"
"সেটাই তো স্বাভাবিক !"... সংকল্পবদ্ধ নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দিল বান্টি |
অবাক হওয়ার পালা রিঙ্কির | বান্টিদা দু'বার ভাবল পর্যন্ত না, জানতেও চাইল না, 'কেন' ! জিজ্ঞেস করল না, 'আগেরবারে কি দোষ করেছিলাম' | এককথায় ওকে সারাজীবনের জন্য আপন করে নিতে রাজি হয়ে গেল | সময় পর্যন্ত চাইল না এত বড় একটা ডিসিশন নেওয়ার আগে | এটাও তাহলে ভালোবাসা ! চোখের জলটা কোনরকমে সামলে রিঙ্কি ওকে জিজ্ঞেস করল, "কিন্তু বাড়িতে তোমার বাবা-মা কি মেনে নেবেন? ওরা যদি রাগ করে?"
"আমার তো বাবা নেই | মা'ই সব সংসারে | দাদা-বৌদিও খুব ভালো মনের মানুষ | রাগ করবে কেন? এমনিতেই মা না থাকলে আমি কি করবো সেই চিন্তায় মায়ের নাকি রাতে ঘুম আসেনা ! ওরা তোমাকে পেলে ভীষণ খুশি হবে দেখো !"... বান্টির মুখে নির্মল হাসি |
"কিন্তু তোমাকে এই সবকিছু ছেড়ে দিতে হবে | ভালো হয়ে যেতে হবে | বলো পারবে? দেখো, না পারলেও এখনই বলে দাও | পরে কষ্ট দিওনা আমার বাবা-মায়ের মত |"
"তোমার জন্য আমি সবকিছু করতে পারবো | এ আর এমন কি? যাও আজ থেকেই ছেড়ে দিলাম | আর কখনও যাবোনা ওখানে |"... রিঙ্কির হাত শক্ত করে চেপে ধরে বান্টি, না..... আবির | কিন্তু এই ধরা নারীর উপরে পুরুষমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য নয়, এই বন্ধন ভালোবাসার, মমতার, ভরসার | চোখে চোখ রেখে রিঙ্কির কাজলকালো চোখের গভীরে ডুবে গাঢ় গলায় ওর প্রেমিক বলল সেদিনের না বলতে পারা কথাটা, "আই লাভ ইউ রিঙ্কি | আমি কক্ষনো তোমাকে কষ্ট দেবো না, দেখো তুমি !"...
আবার আগেরদিনের মত বৃষ্টি নেমেছে ঝিরিঝিরি | আজকেও ছাতা নিয়ে বেরোয়নি রিঙ্কি | বৃষ্টির মধ্যে ঝাপসা দৃশ্যপটে দুটো মূর্তি পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যেতে যেতে ক্লাবের অন্ধকার প্রাঙ্গন থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলো ভবিষ্যতের পানে |
ওদিকে সেইমুহূর্তে তখন নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে তেপায়া টুলের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে একটা লোক | হাতে তার একগাছা নাইলনের দড়ি | কারণ কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে এসেছিল লোকটার অবৈধ মেয়ে, ওনার বউয়ের সঙ্গে সামনাসামনি কিছু কথা বলতে !....
******* সমাপ্ত *******
ভালো লাগলে সামান্য লাইক, রেপুটেশন আর মতামতের প্রত্যাশা রাখলাম প্রিয় পাঠকদের কাছে | কারণ ওটুকুই হবে আমার এই গল্পের পারিশ্রমিক আর পরবর্তী গল্প শুরু করার পাথেয় |
বিছানার পাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকা রিঙ্কির সামনে পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালেন মৃণাল বাবু | দু'চোখ ওনার জলে ভর্তি, মুখের বলিরেখাগুলো কুঁচকে গেছে অনুশোচনায় | কৃতকর্মের চরম শাস্তি পেয়েছেন আজ উনি | এখন শুধু ক্ষমা চেয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন | মেয়ের পরনের জামাটা এগিয়ে দিলেন ওর দিকে, ওর নগ্নতা হঠাৎ করেই ভয়ানক অসহ্য লাগছে দুই চোখে ! "আমাকে ক্ষমা করে দে মা | আমি তো.... আমি তো বুঝতে পারিনি ! না জেনে কত বড় ভুল করে ফেলেছি রে ! জামাটা পড়ে নে | আয় মা... কোলে আয় আমার?"....
"থুহহহঃ !"... একদলা থুতু ছিটিয়ে দিলো রিঙ্কি মৃনাল বাবুর সারামুখে, ওর ঘৃণার বিষ গড়িয়ে পড়তে লাগল ওর হতভম্ব 'প্রকৃত' বাবার গাল বেয়ে |.... ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলো রিঙ্কি | ভীষণ অচেনা লাগছে, আবছা লাগছে মুখগুলো | চোখের জলের জন্য কি?... একপাশে অবহেলায় পড়ে থাকা ছোটবেলার সঙ্গী টেডি-বিয়ারটা হাতে তুলে নিল রিঙ্কি, তারপর ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে | নগ্নপায়ে, নগ্নশরীরে | ইডেন থেকে নির্বাসিত প্রথম মানবীর মত, যে বিধাতার নিষেধ সত্ত্বেও খেয়ে ফেলেছিল জ্ঞানবৃক্ষের ফল | গোটা ঘর তখন থমকে দাঁড়িয়ে বিগব্যাংয়ের পূর্বমুহূর্তের নিস্তব্ধতায় |....
সেদিন কোচিংয়ে রিঙ্কি ঢুকলো সবার শেষে, স্যার ততক্ষনে পড়ানো শুরু করে দিয়েছে | চুপচাপ একটা কোনায় গিয়ে থম মেরে বসে রইল ও | মাথায় ঘুরতে লাগলো হাজারো কথা | এক লাইনও নোটস লিখলো না, বারবার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে লাগল ঋতমের দিকে | ঋতমও ওর মুখ দেখে বুঝতে পারল সিরিয়াস কিছু একটা নিশ্চই হয়েছে |
কিন্তু কি হয়েছে সেটা কোচিং ছুটির পরে জানতে পেরে ঋতমের মুখের অবস্থাটা হলো রিঙ্কির চেয়েও শোচনীয় !
"বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি আমি, পার্মানেন্টলি |"
"বাড়ি ছেড়ে? মানে?"
"ছেড়ে মানে ছেড়ে ! আর কখনও ব্যাক করবো না |"...
"আর ইউ ক্রেজি? কি বলছ কি তুমি?"... প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে ঋতম |
"নো, আয়াম কমপ্লিটলি ফাইন | বাট এভরিথিং ইজ অপোজিট টু ফাইন ইন মাই হাউস | আই ক্যান্ট লিভ দেয়ার ঋতম, আই ক্যান্ট !".... হতাশা ভেঙে পড়ে রিঙ্কির কণ্ঠস্বরে |
"কি হয়েছে আমাকে বলবে তো !"...রিঙ্কিকে দু'হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করল ঋতম |
"কিছু না | আমি তোমাকে সব বলতে পারব না | শুধু এটুকু জেনে রাখো ওই বাড়িতে থাকলে তোমার রিঙ্কি দমবন্ধ হয়ে মরেই যাবে !"...
"কি হয়েছে সোনা? তোমাকে কেউ খারাপ কিছু বলেছে? গায়ে হাত তুলেছে? বলো আমাকে? আমি আছি তো তোমার সাথে | সামান্য কারনে হুট করে এত বড় স্টেপ নিতে নেই ! বাড়ি ফিরে যাও লক্ষীটি |"...ঋতম আদরমাখা স্বরে বোঝানোর চেষ্টা করে রিঙ্কিকে |
"তুমি বুঝতে পারছ না | ফিরে যাবো বলে বেরোইনি আমি ! তুমি তো আমাকে ভালোবাসো, আমারও তুমি ছাড়া আর কেউ নেই | চলো আমরা আজকেই বিয়ে করে নিই ঋতম | আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে চলো | আমার বাড়িতে আমি আর ফিরবো না |".... ব্যাকুলকন্ঠে বয়ফ্রেন্ডের জামা খামচে এতদিনের ভালবাসার প্রতিদান চাইল ওর কিশোরী প্রেমিকা |
কিন্তু চাইলেই তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না !... "কিহ? বিয়ে? আজকেই বিয়ে করতে হবে? হ্যাঁহহ্?".... দৃশ্যতই আকাশ থেকে পড়ল ঋতম |
"হ্যাঁ আজকেই ! বিয়ে তোমার বাবা-মা যবে বলবে তবেই করব, কিন্তু তোমার বাড়িতে আজকে নিয়ে চলো | আমার বাড়িতে আমার ভয় করছে থাকতে !"...
"কিন্তু আমার বাবা-মা যদি মেনে না নেয়? আর তোমার বাবা-মা? ওনারা কি বলবেন?"
"বললাম তো, আই ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট মাই প্যারেন্টস ! তোমার বাবা-মাকে আমরা দুজনে মিলে বোঝাবো | ভালো করে বোঝালে ওনারা ঠিক বুঝতে পারবেন দেখো !".... ডেস্পারেট গলায় বলল রিঙ্কি |
"আরে আমরা তো লিভ-ইন করবো ঠিক করেছিলাম | তার কি হবে?"
"চলো তাহলে সেটাই করবো ! এক্ষুনি যেতে হবে | বলো রাজি আছো?"
"ওহ রিঙ্কি, ডোন্ট বি সো নাইভ ! ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড |"
"হোয়াট শ্যুড আই আন্ডারস্ট্যান্ড ঋতম? যে যখন আমার তোমাকে সবচেয়ে বেশি করে দরকার ঠিক তখনি তুমি আমার হাত ছেড়ে দেবে? আমি যাকে ভালোবাসি এতটুকুও সাহস নেই তার মধ্যে?"... দু'চোখে আগুন জ্বলে ওঠে রিঙ্কির |
"ওহঃ প্লিজ রিঙ্কি ! এটা সাহসের কথা হচ্ছেনা | ভালো আমিও তোমাকে কম বাসিনা | কিন্তু বাবা-মায়ের এগেইনস্টে কি করে যাব?"
"এগেইনস্টে যেতে তো বলিনি | তুমি বোঝাবে তোমার বাবা-মাকে | আমিও ওনাদের ছেড়ে নয়, ওনাদের সাথেই থাকতে চাই, তোমার বাবা-মায়ের সেবা করতে চাই | সারাজীবন তোমার সাথে সুখে থাকতে চাই | তোমাকে বদলে মাত্র এইটুকু সাহস আজ দেখাতেই হবে | নাহলে আমি শেষ হয়ে যাবো ঋতম !"...
"রিঙ্কি, একটু বোঝার চেষ্টা করো লক্ষীটি?"
"তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো ঋতম !"...চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে রিঙ্কির |
"আরে কি বুঝবো? হঠাৎ করে এরকম সম্ভব নাকি? আমরা এখনও এতটা বড় হইনি | আমি এখনো পড়াশোনা করছি, জব না ! কোন মুখে বাবাকে বলবো তুমিই বলো?"...
"প্লিজ ঋতম প্লিজ !"... ইনসিকিওরিটিতে ডুবে যেতে যেতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রিঙ্কি |
"হোয়াট প্লিজ?"...ঋতমের গলায় কিন্তু শুধুই বিরক্তি !
"প্লিজ আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে চলো !"...
"উফ্ফ ! এইসব পাগলামি বন্ধ করো | আমি পারবো না | ব্যাস ! তাতে রিলেশান রাখতে হয় রাখো, না ইচ্ছা করে তো রেখোনা !"...
আর সহ্য করতে পারলোনা রিঙ্কি | রাগের বশে মারলে মেয়েমানুষের নরম হাতের থাপ্পড়ও অন্য স্বাদের লাগে ! ওর ঠাস করে একটা চড়ে গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঋতম | "ইউ স্পাইনলেস ! অপদার্থ... কাওয়ার্ড ! ফাকিং সেলফিস !... ডোন্ট এভার ট্রাই টু কন্ট্যাক্ট মি এগেইন !"....চোখের জল মুছতে মুছতে ওখান থেকে বেড়িয়ে আসে রিঙ্কি | হাঁটতে থাকে বাড়ির রাস্তার উল্টোদিকে |
"চেপে যা ভাই | তোর জন্যই বাড়িতে কেস খেয়েছে মনে হচ্ছে | ঘাঁটাতে গেলে তুইও কেস খাবি !"....ভাবলো পরে মানিয়ে নেবে ওর রাগ কমে গেলে, 'বুদ্ধিমান' বন্ধুদের পরামর্শে তখনকার মত রিঙ্কির চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কোচিংয়ের পিছনে ওদের সিগারেট খাওয়ার গলিতে সুখটান মারতে চলে গেলো ঋতম |
ওদিকে কোচিং থেকে দূরে, আরও দূরে চলে যেতে লাগলো রিঙ্কি | কতটা দূরে গেলে বাবা-মা ওকে আর কখনও খুঁজে পাবেনা? হাঁটতে হাঁটতে চেনা রাস্তাগুলোও অচেনা ঠেকে ওর ঘোর লাগা চোখে | একমাত্র যার উপর ভরসা করা যায় ভেবেছিল, সেই বয়ফ্রেন্ডও নিজের আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে !... এবারে ও কি করবে? কার কাছে যাবে? কে এমন আত্মীয় আছে ওর যে ওকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেবে, কক্ষনো বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে হবেনা? এমনকি ওনারা ফিরিয়ে নিতে এলেও রিঙ্কিকে আড়াল করবে, রিঙ্কির হয়ে লড়াই করবে? নাহ, কেউ করেনা এরকম ! অন্তত কারণ না জেনে | আর রিঙ্কি দরকার হলে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেবে, কিন্তু পরিবারের ওই নোংরামির কথা নিজের মুখে বলতে পারবেনা বাইরের কাউকেই !... আত্মীয়র বাড়ির রাস্তা তাহলে বন্ধ | কোনো বান্ধবীর বাড়ি যাবে? বান্ধবীদের বাড়ি টেম্পোরারি সল্যুশন হতে পারে, পার্মানেন্ট কখনোই নয় | কিন্তু নিজের বাড়ির ওই পাপের নরককুন্ডে আর কিছুতেই ফিরে যাবেনা ও.... কিছুতেই না !... তাহলে কি করবে ও? দু'হাতে মাথার চুল খামচে রাস্তার পাশের ফুটপাথেই একটা বাড়ির বন্ধ দরজার সিঁড়িতে বসে পড়ে রিঙ্কি |
শেষে কি পতিতা-পাবন মা গঙ্গাই ওর ভরসা? নদীর অতলে চিরদিনের মত তলিয়ে গিয়ে ওর সব জ্বালা জুড়াবে? নাকি ও বাড়ি ফিরে যাবে, আর তারপরে আজ রাতেই গলায় দড়ি দেবে? জঘন্য মানুষ তিনটে তাহলে ভীষণ সমস্যায় পড়বে কিন্তু ! রক্তের সম্পর্ক থাকলেও কেউ নয় ওরা ওর....কেউ নয় ! হে ভগবান, এ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছো আমায়?... কোনোদিকেই দিশা খুঁজে পায়না মিষ্টি লংফ্রক পড়া অপ্রাপ্তমনের মেয়েটা | দু'হাতে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাতের তালু ভিজে ওঠে রিঙ্কির |
ঠিক তখনই বিদ্যুৎচমকের মত একটা মুখ ভেসে ওঠে ওর মনে | বান্টিদা ! পাড়ার বখাটে, রকবাজ বান্টিদা | ভালো নামও অবশ্য একটা আছে, আবির ঘোষ | কিন্তু ওটা আছে শুধু কলেজ-কলেজের খাতায় | এলাকার সবাই একডাকে বান্টি নামেই চেনে | ও হ্যাঁ, আরও একটা নাম আছে ওর, 'জুনিয়ার যুবরাজ' | না, বাই লুকস নয় | বান্টিকে দেখতে খুবই সাধারণ, এমন নয় যে দেখলেই প্রেমে পড়ে যাবে মেয়েরা | কিন্তু লম্বা ছিপছিপে চেহারায় বাঁহাতে টাঙিয়ে টাঙিয়ে ছয়গুলো মারে একদম যুবরাজ সিংয়ের মতো স্টাইলে | টুর্নামেন্ট থাকলে বান্টিদার ডাক পড়বেই | গুণের অবশ্য খামতি নেই ! পার্টি অফিসেও নিয়মিত যাতায়াত আছে | মদ গাঁজা বিড়ি সিগারেট, হেন কোনো নেশা নেই করেনা | মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার বদনাম অবশ্য নেই, তবে সবাই জানে বান্টি রিঙ্কিকে ভালোবাসে | ওই যে হয়না, পাড়ার দাদা গোছের ছেলেগুলোর পাড়ার মধ্যেই কোনো একটা মিষ্টি মেয়েকে অকারণেই দারুন ভালো লেগে যায়, তার সাথে মনে মনে প্রেম-ট্রেম করে সংসারই বসিয়ে ফেলে ! আর তারপরে বাকি কেউ সেই মেয়ের দিকে এগোয় না, ভাবখানা এমন যেন ওই মেয়ে ওই দাদারই সম্পত্তি ! কেউ জানতেও চায় না মেয়েটা মনে মনে কি ভাবছে, কতটা বিরক্ত হচ্ছে !... এটাও সেরকম ব্যাপার | রাস্তাঘাটে চলার সময় রিঙ্কিকে দেখলেই বান্টির বখাটে বন্ধুদের মধ্যে থেকে আওয়াজ ওঠে, "বান্টি....এ বান্টিইইই...." করে | এমনকি রিঙ্কির বান্ধবীরাও মাঝেমাঝে বান্টির নাম করে ওকে খচায় ! যথেষ্ট বিরক্ত ফীল করতো রিঙ্কি ওকে নিয়ে |
একদিন তো সাহস করে প্রপোজও করতে এসেছিল গ্রিটিংস কার্ড হাতে ! কিন্তু একে তো বয়সে প্রায় বছর দশেকের বড়, তার উপরে বাড়ির স্ট্যাটাসও রিঙ্কিদের থেকে খানিকটা নীচু | তাছাড়া ঋতমের সঙ্গে প্রেমটাও তখন সবে শুরু হয়েছে | কার্ড ফিরিয়ে দিয়ে রিঙ্কি ওকে মিষ্টিমুখেই অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল | তারপর থেকে আর কখনো কথা বলার চেষ্টা করেনি বটে, কিন্তু বান্টির ভালোবাসার জুনুন তাতে একটুও কমেনি ! কলেজে যাওয়ার সময় সেই নিয়ম করেই বাইক নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে বন্ধুদের সাথে, ক্যাবলার মত ঝাড়ি মারে রিঙ্কিকে | রিঙ্কি ইরিটেশানে মুখ ঘুরিয়ে নেয় | গটগট করে সামনে দিয়ে চলে যায় | পিছন থেকে আওয়াজ আসে, "বান্টি রে... আজকেও হলো না রেএএএ... !"... আর বান্টি ওদের মুখ চাপা দিয়ে থামানোর চেষ্টা করতে থাকে, "চুপ কর...আস্তে ! শুনতে পাচ্ছে !"...
"একটু এদিকে শুনবে? তোমার সাথে আমার দরকারি কথা আছে |"... ক্লাবের মাঠের এককোনায় সন্ধ্যার নেশার আড্ডার সামনে রিঙ্কিকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল বান্টি | মদের গ্লাস আধখাওয়া রেখেই ধড়মড় উঠে এলো | বন্ধুদের থেকে কিছুটা দূরে এসে ওদের শুনতে না পাওয়ার মতো গলায় হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "তুমি? এখানে? হঠাৎ?"...
"তুমি তো আমাকে ভালোবাসো বান্টিদা, তাইনা?"
"সবাই জানে | বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করো আমার বন্ধুদের !"
"তোমার বন্ধুদের কথা জানতে চাইনি, আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছি |"
"হ্যাঁ, খুব ভালোবাসি | তুমিও তো জানো !"... মাথা নিচু করে বলল বান্টি |
চোখ ছোট করে ওর মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে রিঙ্কি জিজ্ঞেস করল,"সবকিছু করতে পারবে আমার জন্য? যেকোনো কিছু?"
"নিজের বাড়ির লোককে দুঃখ না দিয়ে যা যা করা যায় সবকিছু !"... দৃপ্ত শোনালো বান্টির গলা |
"বিয়ে করতে পারবে আমাকে? আজকে, এক্ষুনি?"
"হ্যাঁ পারবো !"
"আমি কিন্তু আমার বাড়িতে আর ফিরে যাব না | বিয়ে করে তোমার বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে |"
"সেটাই তো স্বাভাবিক !"... সংকল্পবদ্ধ নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দিল বান্টি |
অবাক হওয়ার পালা রিঙ্কির | বান্টিদা দু'বার ভাবল পর্যন্ত না, জানতেও চাইল না, 'কেন' ! জিজ্ঞেস করল না, 'আগেরবারে কি দোষ করেছিলাম' | এককথায় ওকে সারাজীবনের জন্য আপন করে নিতে রাজি হয়ে গেল | সময় পর্যন্ত চাইল না এত বড় একটা ডিসিশন নেওয়ার আগে | এটাও তাহলে ভালোবাসা ! চোখের জলটা কোনরকমে সামলে রিঙ্কি ওকে জিজ্ঞেস করল, "কিন্তু বাড়িতে তোমার বাবা-মা কি মেনে নেবেন? ওরা যদি রাগ করে?"
"আমার তো বাবা নেই | মা'ই সব সংসারে | দাদা-বৌদিও খুব ভালো মনের মানুষ | রাগ করবে কেন? এমনিতেই মা না থাকলে আমি কি করবো সেই চিন্তায় মায়ের নাকি রাতে ঘুম আসেনা ! ওরা তোমাকে পেলে ভীষণ খুশি হবে দেখো !"... বান্টির মুখে নির্মল হাসি |
"কিন্তু তোমাকে এই সবকিছু ছেড়ে দিতে হবে | ভালো হয়ে যেতে হবে | বলো পারবে? দেখো, না পারলেও এখনই বলে দাও | পরে কষ্ট দিওনা আমার বাবা-মায়ের মত |"
"তোমার জন্য আমি সবকিছু করতে পারবো | এ আর এমন কি? যাও আজ থেকেই ছেড়ে দিলাম | আর কখনও যাবোনা ওখানে |"... রিঙ্কির হাত শক্ত করে চেপে ধরে বান্টি, না..... আবির | কিন্তু এই ধরা নারীর উপরে পুরুষমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য নয়, এই বন্ধন ভালোবাসার, মমতার, ভরসার | চোখে চোখ রেখে রিঙ্কির কাজলকালো চোখের গভীরে ডুবে গাঢ় গলায় ওর প্রেমিক বলল সেদিনের না বলতে পারা কথাটা, "আই লাভ ইউ রিঙ্কি | আমি কক্ষনো তোমাকে কষ্ট দেবো না, দেখো তুমি !"...
আবার আগেরদিনের মত বৃষ্টি নেমেছে ঝিরিঝিরি | আজকেও ছাতা নিয়ে বেরোয়নি রিঙ্কি | বৃষ্টির মধ্যে ঝাপসা দৃশ্যপটে দুটো মূর্তি পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যেতে যেতে ক্লাবের অন্ধকার প্রাঙ্গন থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলো ভবিষ্যতের পানে |
ওদিকে সেইমুহূর্তে তখন নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে তেপায়া টুলের উপর উঠে দাঁড়িয়েছে একটা লোক | হাতে তার একগাছা নাইলনের দড়ি | কারণ কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে এসেছিল লোকটার অবৈধ মেয়ে, ওনার বউয়ের সঙ্গে সামনাসামনি কিছু কথা বলতে !....
******* সমাপ্ত *******
ভালো লাগলে সামান্য লাইক, রেপুটেশন আর মতামতের প্রত্যাশা রাখলাম প্রিয় পাঠকদের কাছে | কারণ ওটুকুই হবে আমার এই গল্পের পারিশ্রমিক আর পরবর্তী গল্প শুরু করার পাথেয় |