26-04-2020, 04:05 AM
শেষমেষ অনিরুদ্ধ স্যারের মাধ্যমেই হোক না কেন আমি যে কলেজে পড়ছি পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে একটা স্বপ্নের মত | হ্যাঁ নতুন কলেজটা বাড়ি থেকে একটু দূরে হলেও, অনিরুদ্ধ স্যার যেন আমাকে নিরাপত্তায় মুড়ে কলেজে পাঠান | এমনকি কোনো কোনো দিন তো সময় হলে নিজেই আমাকে কলেজে পৌঁছতে বা নিতে চলে যান | হ্যাঁ এতে অবশ্য পাড়ার লোকেরা একটু সন্দেহের চোখে দেখে ঠিকই এবং সে কথা একদিন ওনাকে বলায় উনি বললেন........
- তুমি নিজের পড়াশোনায় মন দাও, লোকে কি বলবে কি ভাববে সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে | তাদের ভাবনা তাদেরই ভাবতে দাও | কারণ লোকের স্বভাবই হচ্ছে নিজের ঘর পর্দায় ঢেকে লোকের ঘর বে-আব্রু করা | তাই তুমি যত আড়ষ্ঠ হয়ে থাকবে, ওরা তত তোমাকে আরও আড়ষ্ঠতার বাঁধনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে দেবে |
ওনার মুখের ওপর কোনো কথা বলার সাহস আজও হয়ে ওঠেনি | অগত্যা আজকাল চোখ কান বুজেই চলাফেরা করি | অবশ্য ওনার কথাটাও খুব একটা ভুল ছিল না | ওনাদের বাঁকা চাহনি তে নি:স্পৃহ হয়ে থাকি বলেই হয়ত আজকাল আর তেমন খারাপ লাগে না | আর ওই বাঁকা চোখ গুলোও আস্তে আস্তে কেমন যেন ফিকে হয়ে এসেছে |
*************************************
একে তো দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা, তার পড়াশোনার চাপ, তারপর আবার কলেজে নবীন বরণের অনুষ্ঠান আর রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান একসাথেই করার পরিকল্পনা করা হয়েছে | তা নিয়ে ব্যাস্ততাও চূড়ান্ত | পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করায় ইদানিং বাড়ি ফিরতেও একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে | সেদিন তো ফিরতে ফিরতে প্রায় আটটা বেজে গিয়েছিল | ভাগ্যিস অয়ন ওর বাইকে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল নাহলে যে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কটা বাজত কে জানে |
সাধারণত একটু দেরি হলে উনি কিছু বলেন না ঠিকই, কিন্তু আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল | না জানি কি বলবেন!!! বেলটা বাজাতে অনিরুদ্ধ স্যারই দরজাটা খুলে দিলেন | এক মুহূর্ত আমার দিকে থমকে তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলেন | ওনার ওই থমথমে মুখটা দেখে ওনার মনের অবস্থাটা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে | আমি আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে চলে এলাম | আজ আবার রান্নার দিদি আসতে পারবে না বলেছিল | সারাদিন কলেজ করে এসে মানুষটার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়ে গিয়েছে, সুতরাং রাগ তো হতেই পারে আর আজই আমার এতটা দেরি হয়ে গেল | আসলে নাচ টা তুলতে তুলতে সময়ের খেয়ালই ছিল না | কখনও তো তেমন কিছু শিখে উঠতে পারি নি, ওই যা লুকিয়ে লুকিয়ে একটু আধটু টিভি দেখে দেখে শেখার চেষ্টা করতাম | আর তাইই আজ নাচ টা তুলতে গিয়ে ফেরার কথাটা খেয়ালই ছিল না |
রান্নাটা বসাতে এসেই দেখি আগে থেকেই সমস্ত রান্না করা | অতিরিক্ত বাসন গুলো পর্যন্ত ধুয়ে মুছে রান্না ঘরটা সুন্দর করে গোছানো | এখন শুধু খাবারটা........ কিন্তু এত সব করলো কে??!! মাসি যে বলেছিল আসবে না, তাহলে কি স্যার, এমা!!!! তবে দেখে তো মনে হচ্ছে রান্না হওয়ার পর এগুলো কেউ ছুঁয়েও দেখিনি, কিন্তু সব রান্না যখন হয়েই গিয়েছিল তাহলে উনি খান নি কেন?? আমার জন্য না বসলেও হত, উফফফফ কি যে করি না ওনাকে নিয়ে!!!! আমি তাড়াতাড়ি খাবার গুলো গরম করে গুটি গুটি পায়ে ওনার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম | আজ কেন জানি না ওনার সামনে যেতে একটু বেশিই সঙ্কোচ হচ্ছে | তবু ডাকতে তো হবেই, তাই গলাটা একটু ঝেড়ে বললাম.........
- আসব??
- হুমমম |
- সরি |
- কিসের জন্য?
- না মানে আজ আসতে এতটা দেরি হয়ে গেল তো, আর আপনাকে বলাও হয় নি যে.........
- না না আমাকে বলার কি আছে, আসলে ভুলটা আমারই | এতটা তাড়াতাড়ি তুমি এতটা ব্যাস্ত হয়ে পড়বে বুঝে উঠতে পারি নি |
- এমন করে বলছেন কেন??!!! আসলে একটু কলেজের কাজে ব্যাস্ত, আর সত্যিই বুঝতে পারিনি আপনি এতটা চিন্তা.........
- হ্যাঁ সেই, খুব ব্যাস্ত ছিলে | এতটাই ব্যাস্ত ছিলে যে আমাকে একটা ফোন করে জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে কর নি | এমন কি আমি যে এতবার ফোন করলাম একবার রিসিভ পর্যন্ত করলে না | একবারও মনে হল না আমার কথা, এদিকে আমি তোমার জন্য তোমার পছন্দের খাবার বানিয়ে বসে আছি একসাথে....... কিন্তু তুমি তো নতুন মানুষজন নিয়ে এতটাই ব্যাস্ত হয়েছিলে যে বাড়ির কথা, আমার কথা ভাবার সময়ই পাও নি |
আমার কাছে এসে কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন.........
- অথচ একবারও ভেবে দেখেছ তোমার কোনো খবর না পাওয়ায় আমার যে কি অবস্থা হচ্ছিল??? অবশ্য সেটা বোঝার মত বুদ্ধি যদি তোমার থাকত...... দেরি হচ্ছে বলে যে তোমায় গাড়ি নিয়ে আনতে যাব তারও উপায় নেই | কারণ আমি তো ভেবেই পাচ্ছিলাম না তুমি কলেজে আছো, না বাড়ির পথে বেরিয়ে পড়েছ | কোন রাস্তা দিয়ে আসছ, কোনো বিপদ হল কিনা!!! কিন্তু তুমি তো এসব বুঝবে না | তোমার এখন নতুন কলেজ, পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব হাজার রকম ব্যাস্ততা | অবশ্য ভুলে গিয়েছিলাম আজকাল তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার মত এখন অনেকে আছে | তোমার আর আমাকে প্রয়োজন নেই | সুতরাং আমায় সরি বলার কোনো দরকার নেই, আমার কথা না ভাবলেও চলবে |
- আপনি এভাবে আমাকে কথা গুলো বলতে পারলেন?? হ্যাঁ আমি আপনাকে ফোন করে জানাই নি, আপনার ফোন ধরে উঠতে পারিনি ঠিকই এবং এটা আমার খুব খুব ভুল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে আপনাকে আমার আর প্রয়োজন নেই এই কথাটা আপনি ভাবতে পারলেন??? একবারও জিজ্ঞেস করলেন না এতক্ষণ আমি কোথায় ছিলাম, কি করছিলাম, কেন করছিলাম, কার জন্য করছিলাম |
আর কি বললেন নতুন মানুষ, ব্যাস্ত জীবন..... আসলে এই মানুষ গুলো, এই ব্যাস্ত জীবন যে আপনারই উপহার দেওয়া | তাকে তো মাথায় করে রাখতেই হবে | শুধু কষ্ট একটাই রয়ে গেল, আপনিও বাকিদের মত আমায় চিনতে পারলেন না | এত কাছ থেকে দেখার পর, জানার পরও বুঝতে পারলেন না | একটা কথা বলুন তো, আপনিই তো প্রথমদিন আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন আপনার বাড়িতে থাকলেও, সবকিছু নির্দ্ধিদায় ব্যবহার করতে পারলেও, আপনার ও আপনার ব্যক্তিগত জীবন থেকে যেন দূরে থাকি | আমি যদি আপনার পছন্দের খাবার বানাই বা খাবার টেবিলে যদি আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করি, তাতে আপনি আমায় বকেন | বলেন যে নিজের কাজ ছেড়ে এসব করার প্রয়োজন নেই | তাহলে বলতে পারেন আজ কেন আপনি আমার জন্য এগুলো করলেন??!!! আমি তো আপনার থেকে কোনোদিনও এমন কিছু আশাও করতে পারি না | কারণ সে অধিকার যে আমার নেই সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি | তবুও আপনি আমাকেই দোষারোপ করছেন |
আমার সমস্ত অপরাধ আমি স্বীকার করলাম | আপনার সমস্ত দোষারোপ আমি মাথা পেতে নিলাম | শুধু অনুরোধ করলাম, বেশিক্ষন না খেয়ে থাকলে আপনার শরীর খারাপ করবে | তাই আমার মত একজনের ওপর রাগ করে নিজের শরীর খারাপ করবেন না | টেবিলে সমস্ত খাবার গরম করে রাখা আছে | আপনি তো আবার আমার বেড়ে দেওয়া পছন্দ করেন না, তাই দিলাম না | আর আমার পেট ভর্তি, খিদে নেই | ঘরে গেলাম | আপনি কিন্তু অবশ্যই খেয়ে নেবেন |
- আঁখি, আঁখি শোনো..... দাঁড়াও......
ধুরররর, আজ যে কি হল আমার!!! উফফফ, এমন ভাবে আমি কোনো দিন কারোর সাথে কথা বলি নি | ইসসসস, ওর নিশ্চয়ই খুব খারাপ লেগেছে!!! আর ও তো ঠিকই বলেছে, আমিই তো ওকে রান্না করতে, আমার জন্য অপেক্ষা করতে না করি | তাহলে বুঝবে কি করে যে আজ আমি ওর জন্য অপেক্ষা করবো | কিন্তু আজ হঠাৎ আমার কি হল, আগেও তো দেরি করে এসেছে | হ্যাঁ তবে ভুল তো ওর ও হয়েছে, ফিরতে যখন এত দেরি হচ্ছে তখন একবার আমাকে ফোন করে জানাতে পারল না | অয়নের বাইকে বসে চলে এল | এত বড় হয়ে গিয়েছে তবু যদি একটু বুদ্ধি হয়, যে যার তার বাইকে হঠাৎ করে বসাটা ঠিক না | আজকাল সময় ভালো না, কার মনে যে কি আছে বোঝার উপায় নেই | কিন্তু মহারানী শুনলে হয়, বললেই বলবে বন্ধু তো | আচ্ছা কি এমন আছে ওই অয়নের মধ্যে, যে সারাদিন ওর গুনগান করতে হবে | হ্যাঁ ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো, কলেজ মিস করলে নোটস দিয়ে সাহায্য করে, ব্যবহারটাও খারাপ না, দেখতে শুনতেও বেশ, তাই বলে এত রাতে ওর বাইকে চড়ে ফেরার কি....... উফফফফফ!!!!
আবার বাড়ি ফিরে আমাকে বোঝাচ্ছে এতক্ষন খালি পেটে থাকবেন না, শরীর খারাপ করবে | এতই যদি চিন্তা একটু আগে ফিরলেই হত | না অপেক্ষা করছিলাম না, মানে এমন বাইরে কেউ থাকলে কি শান্তিতে খাওয়া যায়?? আর রোজ একসাথেই খাই তাই..... এদিকে আমাকে খালি পেটে না থাকার বড়বড় কথা বলে নিজে কেমন খিদে নেই বলে ঘরে চলে গেল | আমি বুঝি চোখ মুখ দেখে কিছু বুঝি না??? দেরি হয়েছে বলে না হয় একটু বকেইছি, তাতে এতটা রেগে যাওয়ার কি আছে?? স্যারটা কে শুনি?? এইটুকু বকার অধিকারও কি আমার নেই??
ঠিক আছে খাবে না খাবে না, আমিও মান ভাঙাতে যেতে পারব না | একটু কিছু বললেই মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে আর আমাকে বারবার গিয়ে বুঝিয়ে নিয়ে আসতে হবে নাকি, পারব না | আমিও আমার মত খেয়ে শুয়ে পড়ব | ডাইনিং টেবিলে গিয়ে থালায় খাবারটা বেড়ে দাঁড়িয়ে আছি, কিছুতেই বসতে পারছি না | বারবার আঁখির বড় বড় ছলছলে চোখ দুটো থালায় ভেসে উঠছে | দেরি করে এসেছে তাতে কোথায় ও আমার সাথে কথা বলতে আসবে, তা না এখন আমায় যেতে হবে মহারানীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে আসতে | না খেয়ে থাকলে আবার যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, এমনিই দুর্বল বলে ডাক্তার নিয়ম মেনে সব কিছু করতে বলেছে | তা যদি মহারানীর খেয়াল থাকে | শুধু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব বললে দুদিন নিয়ম মেনে চলে, তারপর আবার যে কে সেই | তবে আজই শেষ, আমি পরিষ্কার করে বলে দেব যে কথায় কথায় এত রাগ হলে আমি বারবার বোঝাতে আসতে পারব না কিন্তু |
যথারীতি গিয়ে দেখি ঘর অন্ধকার করে বালিশে মুখ গুঁজে বিছানায় বসে আছে | এদিকে যে বারান্দার দরজাটা খোলা, হাওয়ায় ঘরের পর্দাটা, বাকি জিনিষ গুলো যে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই | আমি আস্তে করে পর্দাটা সরিয়ে দিতে আঁখি যখন মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো, তখন চাঁদের আলোয় ওর ওই মুখের দিকে তাকিয়ে এতক্ষনের সমস্ত রাগ অভিমান যেন গলে হল হয়ে গেল | হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া কোমড় ছাপানো একঢাল লম্বা চুল, জল টুপটপ কালো গভীর দুটো চোখ, মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ওঠা ওর ওই গোলাপি ঠোঁট দুটোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংবরণ করা যে কি কঠিন কাজ, সেটা একমাত্র আমিই জানি আর ভগবানই জানেন | এই, এই কারণের জন্যই তো আমি ওকে এতটা দূরে সরিয়ে রাখি | প্রয়োজন না হলে সামনে আসতে না করি |
নিজের অনুভূতি গুলোর সাথে আপ্রাণ লড়াই করতে করতেই গম্ভীর স্বরে বললাম...........
- খাবার দেওয়া হয়ে গিয়েছে, খেতে চল না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে |
- না আমি খাব না, খিদে নেই | আপনি খেয়ে নিন |
- তোমার কি আমার কথার বিরোধিতা না করলে রাতে ঘুম আসে না?? যখন আমি খাব না বলে শুয়ে পড়ি ঠিক আমাকে টেনে নিয়ে যাবে খেতে, অথচ যখন আমি বলছি তখন খিদে নেই বলে এখানে বসে আছো |
মানছি দেরি করে এসেছো বলে একটু বকেছি, তার জন্য না খেয়ে থাকার কি আছে?? তোমাকে ওটুকু বকার অধিকারও কি আমার নেই??
আমার সব অধিকার তো আপনাকেই দিতে চাই কিন্তু আপনিই যে দূরে সরিয়ে রেখেছেন | নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছেন কাঠিন্যের আবরণে | কিন্তু এই আবরণ যে আমি ভাঙবই, ঘোঁচাবই এই দূরত্ব |
- কি হল, বসে বসে কি ভাবছ?? যেতে বলছি না??
- না ভাবছিলাম ওটাকে যদি একটু বকা বলেন তাহলে বেশিটা কাকে বলবেন!!!
- হুমমম, অনেক ভাবাভাবি হয়েছে | বাকিটা খেয়ে এসে ভেবো |
- না স্যার, আমার খিদে নেই | বললাম না পেট ভর্তি |
- দেখো আমার থেকে মিথ্যা বলে যখন কিছু লোকাতে পারো না, তখন বৃথা কেন চেষ্টা কর?? দেখো ভালো করে বলছি আমার খুব খিদে পেয়েছে, তাও যদি তুমি না আসো তাহলে আমি কিন্তু না খেয়েই ঘরে চলে যাব | তখন কিন্তু হাজার ডাকলেও আসব না | তুমি আমায় ভালো করেই চেনো | যাবো চলে??
- এই না না এমন করবেন না, আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যান, আমি আসছি |
- কেন আমার সাথেই চল |
- আরে বাবা মুখ চোখটা একটু ধুতে দেবেন তো নাকি?? এমন ভুতের মতই যাবো??
- ওহ: হ্যাঁ হ্যাঁ, তবে তাড়াতাড়ি আসবে, আমায় বেশিক্ষন যেন অপেক্ষা না করতে হয় |
- জো হুকুম মহারাজ |
- কি, কি বললে??
- কই কিছু না তো, আপনি চলুন, আমি আসছি |
- হুমমমম |
- তুমি নিজের পড়াশোনায় মন দাও, লোকে কি বলবে কি ভাববে সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে | তাদের ভাবনা তাদেরই ভাবতে দাও | কারণ লোকের স্বভাবই হচ্ছে নিজের ঘর পর্দায় ঢেকে লোকের ঘর বে-আব্রু করা | তাই তুমি যত আড়ষ্ঠ হয়ে থাকবে, ওরা তত তোমাকে আরও আড়ষ্ঠতার বাঁধনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে দেবে |
ওনার মুখের ওপর কোনো কথা বলার সাহস আজও হয়ে ওঠেনি | অগত্যা আজকাল চোখ কান বুজেই চলাফেরা করি | অবশ্য ওনার কথাটাও খুব একটা ভুল ছিল না | ওনাদের বাঁকা চাহনি তে নি:স্পৃহ হয়ে থাকি বলেই হয়ত আজকাল আর তেমন খারাপ লাগে না | আর ওই বাঁকা চোখ গুলোও আস্তে আস্তে কেমন যেন ফিকে হয়ে এসেছে |
*************************************
একে তো দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা, তার পড়াশোনার চাপ, তারপর আবার কলেজে নবীন বরণের অনুষ্ঠান আর রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান একসাথেই করার পরিকল্পনা করা হয়েছে | তা নিয়ে ব্যাস্ততাও চূড়ান্ত | পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করায় ইদানিং বাড়ি ফিরতেও একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে | সেদিন তো ফিরতে ফিরতে প্রায় আটটা বেজে গিয়েছিল | ভাগ্যিস অয়ন ওর বাইকে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল নাহলে যে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কটা বাজত কে জানে |
সাধারণত একটু দেরি হলে উনি কিছু বলেন না ঠিকই, কিন্তু আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল | না জানি কি বলবেন!!! বেলটা বাজাতে অনিরুদ্ধ স্যারই দরজাটা খুলে দিলেন | এক মুহূর্ত আমার দিকে থমকে তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলেন | ওনার ওই থমথমে মুখটা দেখে ওনার মনের অবস্থাটা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে | আমি আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে চলে এলাম | আজ আবার রান্নার দিদি আসতে পারবে না বলেছিল | সারাদিন কলেজ করে এসে মানুষটার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়ে গিয়েছে, সুতরাং রাগ তো হতেই পারে আর আজই আমার এতটা দেরি হয়ে গেল | আসলে নাচ টা তুলতে তুলতে সময়ের খেয়ালই ছিল না | কখনও তো তেমন কিছু শিখে উঠতে পারি নি, ওই যা লুকিয়ে লুকিয়ে একটু আধটু টিভি দেখে দেখে শেখার চেষ্টা করতাম | আর তাইই আজ নাচ টা তুলতে গিয়ে ফেরার কথাটা খেয়ালই ছিল না |
রান্নাটা বসাতে এসেই দেখি আগে থেকেই সমস্ত রান্না করা | অতিরিক্ত বাসন গুলো পর্যন্ত ধুয়ে মুছে রান্না ঘরটা সুন্দর করে গোছানো | এখন শুধু খাবারটা........ কিন্তু এত সব করলো কে??!! মাসি যে বলেছিল আসবে না, তাহলে কি স্যার, এমা!!!! তবে দেখে তো মনে হচ্ছে রান্না হওয়ার পর এগুলো কেউ ছুঁয়েও দেখিনি, কিন্তু সব রান্না যখন হয়েই গিয়েছিল তাহলে উনি খান নি কেন?? আমার জন্য না বসলেও হত, উফফফফ কি যে করি না ওনাকে নিয়ে!!!! আমি তাড়াতাড়ি খাবার গুলো গরম করে গুটি গুটি পায়ে ওনার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম | আজ কেন জানি না ওনার সামনে যেতে একটু বেশিই সঙ্কোচ হচ্ছে | তবু ডাকতে তো হবেই, তাই গলাটা একটু ঝেড়ে বললাম.........
- আসব??
- হুমমম |
- সরি |
- কিসের জন্য?
- না মানে আজ আসতে এতটা দেরি হয়ে গেল তো, আর আপনাকে বলাও হয় নি যে.........
- না না আমাকে বলার কি আছে, আসলে ভুলটা আমারই | এতটা তাড়াতাড়ি তুমি এতটা ব্যাস্ত হয়ে পড়বে বুঝে উঠতে পারি নি |
- এমন করে বলছেন কেন??!!! আসলে একটু কলেজের কাজে ব্যাস্ত, আর সত্যিই বুঝতে পারিনি আপনি এতটা চিন্তা.........
- হ্যাঁ সেই, খুব ব্যাস্ত ছিলে | এতটাই ব্যাস্ত ছিলে যে আমাকে একটা ফোন করে জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে কর নি | এমন কি আমি যে এতবার ফোন করলাম একবার রিসিভ পর্যন্ত করলে না | একবারও মনে হল না আমার কথা, এদিকে আমি তোমার জন্য তোমার পছন্দের খাবার বানিয়ে বসে আছি একসাথে....... কিন্তু তুমি তো নতুন মানুষজন নিয়ে এতটাই ব্যাস্ত হয়েছিলে যে বাড়ির কথা, আমার কথা ভাবার সময়ই পাও নি |
আমার কাছে এসে কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন.........
- অথচ একবারও ভেবে দেখেছ তোমার কোনো খবর না পাওয়ায় আমার যে কি অবস্থা হচ্ছিল??? অবশ্য সেটা বোঝার মত বুদ্ধি যদি তোমার থাকত...... দেরি হচ্ছে বলে যে তোমায় গাড়ি নিয়ে আনতে যাব তারও উপায় নেই | কারণ আমি তো ভেবেই পাচ্ছিলাম না তুমি কলেজে আছো, না বাড়ির পথে বেরিয়ে পড়েছ | কোন রাস্তা দিয়ে আসছ, কোনো বিপদ হল কিনা!!! কিন্তু তুমি তো এসব বুঝবে না | তোমার এখন নতুন কলেজ, পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব হাজার রকম ব্যাস্ততা | অবশ্য ভুলে গিয়েছিলাম আজকাল তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার মত এখন অনেকে আছে | তোমার আর আমাকে প্রয়োজন নেই | সুতরাং আমায় সরি বলার কোনো দরকার নেই, আমার কথা না ভাবলেও চলবে |
- আপনি এভাবে আমাকে কথা গুলো বলতে পারলেন?? হ্যাঁ আমি আপনাকে ফোন করে জানাই নি, আপনার ফোন ধরে উঠতে পারিনি ঠিকই এবং এটা আমার খুব খুব ভুল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে আপনাকে আমার আর প্রয়োজন নেই এই কথাটা আপনি ভাবতে পারলেন??? একবারও জিজ্ঞেস করলেন না এতক্ষণ আমি কোথায় ছিলাম, কি করছিলাম, কেন করছিলাম, কার জন্য করছিলাম |
আর কি বললেন নতুন মানুষ, ব্যাস্ত জীবন..... আসলে এই মানুষ গুলো, এই ব্যাস্ত জীবন যে আপনারই উপহার দেওয়া | তাকে তো মাথায় করে রাখতেই হবে | শুধু কষ্ট একটাই রয়ে গেল, আপনিও বাকিদের মত আমায় চিনতে পারলেন না | এত কাছ থেকে দেখার পর, জানার পরও বুঝতে পারলেন না | একটা কথা বলুন তো, আপনিই তো প্রথমদিন আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন আপনার বাড়িতে থাকলেও, সবকিছু নির্দ্ধিদায় ব্যবহার করতে পারলেও, আপনার ও আপনার ব্যক্তিগত জীবন থেকে যেন দূরে থাকি | আমি যদি আপনার পছন্দের খাবার বানাই বা খাবার টেবিলে যদি আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করি, তাতে আপনি আমায় বকেন | বলেন যে নিজের কাজ ছেড়ে এসব করার প্রয়োজন নেই | তাহলে বলতে পারেন আজ কেন আপনি আমার জন্য এগুলো করলেন??!!! আমি তো আপনার থেকে কোনোদিনও এমন কিছু আশাও করতে পারি না | কারণ সে অধিকার যে আমার নেই সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি | তবুও আপনি আমাকেই দোষারোপ করছেন |
আমার সমস্ত অপরাধ আমি স্বীকার করলাম | আপনার সমস্ত দোষারোপ আমি মাথা পেতে নিলাম | শুধু অনুরোধ করলাম, বেশিক্ষন না খেয়ে থাকলে আপনার শরীর খারাপ করবে | তাই আমার মত একজনের ওপর রাগ করে নিজের শরীর খারাপ করবেন না | টেবিলে সমস্ত খাবার গরম করে রাখা আছে | আপনি তো আবার আমার বেড়ে দেওয়া পছন্দ করেন না, তাই দিলাম না | আর আমার পেট ভর্তি, খিদে নেই | ঘরে গেলাম | আপনি কিন্তু অবশ্যই খেয়ে নেবেন |
- আঁখি, আঁখি শোনো..... দাঁড়াও......
ধুরররর, আজ যে কি হল আমার!!! উফফফ, এমন ভাবে আমি কোনো দিন কারোর সাথে কথা বলি নি | ইসসসস, ওর নিশ্চয়ই খুব খারাপ লেগেছে!!! আর ও তো ঠিকই বলেছে, আমিই তো ওকে রান্না করতে, আমার জন্য অপেক্ষা করতে না করি | তাহলে বুঝবে কি করে যে আজ আমি ওর জন্য অপেক্ষা করবো | কিন্তু আজ হঠাৎ আমার কি হল, আগেও তো দেরি করে এসেছে | হ্যাঁ তবে ভুল তো ওর ও হয়েছে, ফিরতে যখন এত দেরি হচ্ছে তখন একবার আমাকে ফোন করে জানাতে পারল না | অয়নের বাইকে বসে চলে এল | এত বড় হয়ে গিয়েছে তবু যদি একটু বুদ্ধি হয়, যে যার তার বাইকে হঠাৎ করে বসাটা ঠিক না | আজকাল সময় ভালো না, কার মনে যে কি আছে বোঝার উপায় নেই | কিন্তু মহারানী শুনলে হয়, বললেই বলবে বন্ধু তো | আচ্ছা কি এমন আছে ওই অয়নের মধ্যে, যে সারাদিন ওর গুনগান করতে হবে | হ্যাঁ ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো, কলেজ মিস করলে নোটস দিয়ে সাহায্য করে, ব্যবহারটাও খারাপ না, দেখতে শুনতেও বেশ, তাই বলে এত রাতে ওর বাইকে চড়ে ফেরার কি....... উফফফফফ!!!!
আবার বাড়ি ফিরে আমাকে বোঝাচ্ছে এতক্ষন খালি পেটে থাকবেন না, শরীর খারাপ করবে | এতই যদি চিন্তা একটু আগে ফিরলেই হত | না অপেক্ষা করছিলাম না, মানে এমন বাইরে কেউ থাকলে কি শান্তিতে খাওয়া যায়?? আর রোজ একসাথেই খাই তাই..... এদিকে আমাকে খালি পেটে না থাকার বড়বড় কথা বলে নিজে কেমন খিদে নেই বলে ঘরে চলে গেল | আমি বুঝি চোখ মুখ দেখে কিছু বুঝি না??? দেরি হয়েছে বলে না হয় একটু বকেইছি, তাতে এতটা রেগে যাওয়ার কি আছে?? স্যারটা কে শুনি?? এইটুকু বকার অধিকারও কি আমার নেই??
ঠিক আছে খাবে না খাবে না, আমিও মান ভাঙাতে যেতে পারব না | একটু কিছু বললেই মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে আর আমাকে বারবার গিয়ে বুঝিয়ে নিয়ে আসতে হবে নাকি, পারব না | আমিও আমার মত খেয়ে শুয়ে পড়ব | ডাইনিং টেবিলে গিয়ে থালায় খাবারটা বেড়ে দাঁড়িয়ে আছি, কিছুতেই বসতে পারছি না | বারবার আঁখির বড় বড় ছলছলে চোখ দুটো থালায় ভেসে উঠছে | দেরি করে এসেছে তাতে কোথায় ও আমার সাথে কথা বলতে আসবে, তা না এখন আমায় যেতে হবে মহারানীকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে আসতে | না খেয়ে থাকলে আবার যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, এমনিই দুর্বল বলে ডাক্তার নিয়ম মেনে সব কিছু করতে বলেছে | তা যদি মহারানীর খেয়াল থাকে | শুধু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব বললে দুদিন নিয়ম মেনে চলে, তারপর আবার যে কে সেই | তবে আজই শেষ, আমি পরিষ্কার করে বলে দেব যে কথায় কথায় এত রাগ হলে আমি বারবার বোঝাতে আসতে পারব না কিন্তু |
যথারীতি গিয়ে দেখি ঘর অন্ধকার করে বালিশে মুখ গুঁজে বিছানায় বসে আছে | এদিকে যে বারান্দার দরজাটা খোলা, হাওয়ায় ঘরের পর্দাটা, বাকি জিনিষ গুলো যে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই | আমি আস্তে করে পর্দাটা সরিয়ে দিতে আঁখি যখন মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো, তখন চাঁদের আলোয় ওর ওই মুখের দিকে তাকিয়ে এতক্ষনের সমস্ত রাগ অভিমান যেন গলে হল হয়ে গেল | হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া কোমড় ছাপানো একঢাল লম্বা চুল, জল টুপটপ কালো গভীর দুটো চোখ, মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে ওঠা ওর ওই গোলাপি ঠোঁট দুটোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংবরণ করা যে কি কঠিন কাজ, সেটা একমাত্র আমিই জানি আর ভগবানই জানেন | এই, এই কারণের জন্যই তো আমি ওকে এতটা দূরে সরিয়ে রাখি | প্রয়োজন না হলে সামনে আসতে না করি |
নিজের অনুভূতি গুলোর সাথে আপ্রাণ লড়াই করতে করতেই গম্ভীর স্বরে বললাম...........
- খাবার দেওয়া হয়ে গিয়েছে, খেতে চল না হলে ঠান্ডা হয়ে যাবে |
- না আমি খাব না, খিদে নেই | আপনি খেয়ে নিন |
- তোমার কি আমার কথার বিরোধিতা না করলে রাতে ঘুম আসে না?? যখন আমি খাব না বলে শুয়ে পড়ি ঠিক আমাকে টেনে নিয়ে যাবে খেতে, অথচ যখন আমি বলছি তখন খিদে নেই বলে এখানে বসে আছো |
মানছি দেরি করে এসেছো বলে একটু বকেছি, তার জন্য না খেয়ে থাকার কি আছে?? তোমাকে ওটুকু বকার অধিকারও কি আমার নেই??
আমার সব অধিকার তো আপনাকেই দিতে চাই কিন্তু আপনিই যে দূরে সরিয়ে রেখেছেন | নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছেন কাঠিন্যের আবরণে | কিন্তু এই আবরণ যে আমি ভাঙবই, ঘোঁচাবই এই দূরত্ব |
- কি হল, বসে বসে কি ভাবছ?? যেতে বলছি না??
- না ভাবছিলাম ওটাকে যদি একটু বকা বলেন তাহলে বেশিটা কাকে বলবেন!!!
- হুমমম, অনেক ভাবাভাবি হয়েছে | বাকিটা খেয়ে এসে ভেবো |
- না স্যার, আমার খিদে নেই | বললাম না পেট ভর্তি |
- দেখো আমার থেকে মিথ্যা বলে যখন কিছু লোকাতে পারো না, তখন বৃথা কেন চেষ্টা কর?? দেখো ভালো করে বলছি আমার খুব খিদে পেয়েছে, তাও যদি তুমি না আসো তাহলে আমি কিন্তু না খেয়েই ঘরে চলে যাব | তখন কিন্তু হাজার ডাকলেও আসব না | তুমি আমায় ভালো করেই চেনো | যাবো চলে??
- এই না না এমন করবেন না, আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যান, আমি আসছি |
- কেন আমার সাথেই চল |
- আরে বাবা মুখ চোখটা একটু ধুতে দেবেন তো নাকি?? এমন ভুতের মতই যাবো??
- ওহ: হ্যাঁ হ্যাঁ, তবে তাড়াতাড়ি আসবে, আমায় বেশিক্ষন যেন অপেক্ষা না করতে হয় |
- জো হুকুম মহারাজ |
- কি, কি বললে??
- কই কিছু না তো, আপনি চলুন, আমি আসছি |
- হুমমমম |