Thread Rating:
  • 1 Vote(s) - 5 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
হাতটা রেখো বাড়িয়ে (Writer: ইশরাত জাহান)
#1
Heart 
কবুল বলে ফেলার পরও ধারার ঠিক বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, শুধুমাত্র এইচএসসিতে জিপিএ ফাইভ পায়নি বলে তার বাবা আজ তার সত্যি সত্যিই বিয়ে দিয়ে দিলো। আর তাও নাকি গ্রামের একটা চাষার সাথে। হ্যাঁ, ঠিক এই কথাটাই তো পাশের বাসার এক কাকী বৌ সাজানোর সময় ধারার কানে কানে বলল, ধারার যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে নাকি ক্ষেত খামারে কাজ করে। ধারা আর কিছু ভাবতে পারছে না। তার মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। পাশেই ধারাকে কেন্দ্র করে সবাই হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে। একটুপরই শেরোয়ানী গায়ের একজনকে নিয়ে আসা হলো। বিনা সঙ্কোচে অধিকার প্রাপ্তির সুরে বসিয়ে দেওয়া হলো ধারার পাশে। নতুন জামাইয়ের আগমনে ঠিক তখনই ঘরে থাকা অল্প বয়সী মেয়ে ছেলেদের সে কি হৈ হুল্লোড়! পাশেই একটা শক্তপোক্ত পুরুষ অবয়ব। যে নাকি এখন থেকে ধারার স্বামী নামেই জানা যাবে। অথচ যাকে এখনও এক নজরের জন্য দেখেনিও পর্যন্ত ধারা। তবুও ধারা চোখ তুলে তাকালো না। তাকালো না তো তাকালোই না। একটুপরে একটি সুকারুকার্য আয়না রাখা হলো তাদের সম্মুখে। বর কনের যে এবার পরিপূর্ণ অধিকারের সহিত নিজ নিজ জীবনসঙ্গীর মুখ দেখার পালা। পাশের পুরুষটি হয়তো আয়না মুখে চোখ রেখেছে অনেক আগেই। সময় নিচ্ছে শুধু ধারা। শেষমেশ যখন দাদী খালাদের জোড়াজুড়িতে স্বচ্ছ দর্পণে তার ভেজা পাঁপড়ির আনত দৃষ্টি মেলে ধরলো তখন ঝাপসা চোখে একটা বাদামী মুখের অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছু অবলোকন হলো না।

ধারার বাবা আজিজ তালুকদার। গ্রামের একজন সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি। কথাবার্তা বলেন খুব কম। কিন্তু যা একবার বলেন তা ফিরিয়ে নেওয়ার সাধ্যি কারো নেই। শিক্ষা এবং সমৃদ্ধিতে মধুপুর গ্রামের যে কয়েকটি পরিবার এগিয়ে তাদের মধ্যে ধারাদের পরিবার একটি। আজিজ তালুকদার ইন্টার পাশের পর বিএ তে ভর্তি হয়েছিলেন। দুই বছর যাওয়ার পর কিছু পুঁজি যোগাড় করে নেমে পড়েন ব্যবসায়। এবং সফলও হন। মাঝখান থেকে ছুটে যায় পড়ালেখা। শহরে তার বড় কয়েকটি দোকান আছে। ছোট ভাই শাহেদ মাস্টার্স পাশ। একটুর জন্য বিসিএসে টেকেননি। তারপরও একটা বড় সরকারি চাকরির পদে কর্মরত আছেন। চাকরি সূত্রে বর্তমানে পরিবার নিয়ে আছেন চট্রগ্রামে। ছোট ভাইকে পড়ালেখায় দীক্ষিত করার অবদান সম্পূর্ণ আজিজ তালুকদারের। শাহেদের তাই একান্তই মান্য ব্যক্তি তিনি। শিক্ষিত এবং বড় চাকরিজীবী ছোট ভাইয়ের পড়ামর্শ আজিজ তালুকদারও সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। পরিবারের জন্য কাজের চাপে নিজের শিক্ষা গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়নি। তাই শিক্ষাকে তিনি কদর করেন। চেয়েছিলেন ছেলে মেয়েগুলোকেও একই ভাবে গড়ে তুলবেন। শিক্ষা দীক্ষায় এরা বড় হবে। এবং সেই শিক্ষাটা অবশ্যই হতে হবে সেরা। এ প্লাস পাওয়া ছাড়া শিক্ষার কোন দাম থাকে নাকি! এই চিন্তাটাই ধারার মাথায় নেমে আসে বিশাল চাপ হয়ে। ছোট থেকেই শুনে এসেছে পরীক্ষার ফলাফল মানে অবশ্যই এ প্লাস। আর সেটাও হতে হবে সাইন্স থেকে। বাবার কথা মতই সাইন্স নিয়েছিল ধারা। কিন্তু সাইন্সের সাবজেক্টগুলো একটু কমই বোধগম্য হয় তার। তার উপর বাবার আদেশ ইন্টারে এ প্লাস পেতেই হবে। তিনি গ্রামে সবার কাছে বড় মুখে বলেছেন তার মেয়ে পরীক্ষায় অবশ্যই এ প্লাস পাবে। বিশেষ করে তার সবথেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জয়নাল খাঁ-কে শুনিয়ে। যার ছেলেও কিনা এবার ধারার সাথেই পরীক্ষা দেবে। মেয়ে যেন এ প্লাসই পায় এই জন্য অসুস্থতার বাহানা দিয়ে ইন্টারে এক বছর মেয়েকে গ্যাপও দেওয়ান তিনি। গ্রামে তার মুখটা যে করেই হোক রাখতে হবে। এই সব কিছুই প্রেশার হয়ে উঠে ধারার কাছে। মনে সৃষ্টি করে প্রচন্ড ভয়। এতকিছুর পরও যদি এ প্লাস না পায়! প্রচন্ড ভয়, নার্ভাস আর প্রেশারে পরীক্ষায় খারাপ করে বসে ধারা। একটুর জন্য আসে না কাঙ্খিত ফলাফল জিপিএ ফাইভ। অপরদিকে জয়নাল খাঁ-য়ের ছেলের এ প্লাস পাওয়ার খবর ছড়িয়ে যায় পুরো গ্রামময়। রাগে, ক্ষোভে, অপমানে আজিজ তালুকদার সেদিনই বাড়ির মধ্যে ঘোষণা দেন এই মেয়ের পড়ালেখা দিয়ে কিছু হবে না। একে অতি শীঘ্রই বিয়ে দেওয়া হোক। যেই সম্বন্ধ এরপর আসবে তার সাথেই দিয়ে দেওয়া হবে। গ্রামে মেয়েদের ষোল বছর মানেই প্রাপ্তবয়স্ক। সেদিক বিবেচনায় ধারা বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়েছে আরো আগেই। কিছুদিন পরপরই তাই তাদের বাড়িতে বিয়ের সমন্ধ নিয়ে লোকের আসা যাওয়া চলতো। তাই রেজাল্ট পাওয়ার দু দিন পরই যখন তাদের পাশের গ্রাম রূপনগর থেকে একটা সম্বন্ধ আসে তখন ধারার বাবা জেদের বশবর্তী হয়ে সেটাতেই হ্যাঁ বলে দিয়ে আরো দুই দিন দেখা সাক্ষাৎ, কথা বার্তা চালিয়ে সাত দিনের মাথাতেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। এতদিন তো তিনি সব সম্বন্ধ না বলে রাখতেন কারন মেয়ে নিয়ে তার আশা ছিল। এখন তো অপদার্থ মেয়ে তার সব আশাই ভেস্তে দিল।

এসব ভাবতে ভাবতেই বাসর ঘরে বসে বসে চোখের জলে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে ধারার। অশ্রু যেন থামার নামই নিচ্ছে না। কান্নার দমকে তার ক্লান্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে বারংবার। চোখ মুখ হয়ে উঠেছে রক্তিম। গভীর বেদনায় জর্জরিত ধারা শুধু একটি কথাই ভাবছে, কি থেকে কি হয়ে গেল! এ প্লাস না পাওয়ার এতো বড় শাস্তি যে তার বাবা তাকে দেবে তা হয়তো কখনোই ভাবতে পারেনি সরল মনের ধারা। বাবাকে সে জমের মতো ভয় পায়। তাই তো এর বিপরীতে টু শব্দটিও করতে পারেনি সে। ধারারই বা আর কি করার ছিল! সে তো তার সাধ্য মতোই চেষ্টা করে ছিল। কিন্তু পরীক্ষার হলে অতিরিক্ত নার্ভাসনেসের দরুণ সে ভালো করার মতো প্রশ্নের উত্তরেও ভালো করতে পারেনি। যার পরিবর্তে আজ তার জীবনে এই পরিবর্তন নেমে আসলো। 

দরজা খুলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করতেই শুদ্ধ দেখলো, ফুল দিয়ে সাজানো বিছানার ঠিক মাঝ বরাবর বসে লাল টুকটুকে শাড়ি পরিহিতা তার সদ্য বিবাহিতা নব বধু হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে। কম্পিত শরীরের ভাঁজে তার সুন্দর মুখশ্রীটুকুও ঢাকা পড়ে গেছে। রুমে কারো প্রবেশের আভাস পেতেই চট করে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়িয়ে পড়লো ধারা। খাটের গা ঘেঁষে একদম পাশুটে মেরে দাঁড়িয়ে রইল। ভয়ে আতঙ্কে তার মুখ জমে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখের সামনে দাঁড়ানো সাদা পাঞ্জাবী পরণের এই উজ্জ্বল গাত্রের রোগা, লম্বা ছেলেটাই কি তবে তার স্বামী! ছেলেটা একটু এগিয়ে এসে ভরাট গলায় ধারাকে প্রশ্ন ছুড়লো,

'কি হলো আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন?'

ধারা কিছু বলতে পারলো না। কান্নার চোটে তার গলা হয়ে উঠেছে অবরুদ্ধ। ছেলেটি আবারো বলল,

'কি হলো বলুন।'

ধারা এবারও কিছু বলতে পারলো না। তার কান্নাটা বরঞ্চ আরো একটু যেন বাড়লো। শুদ্ধ বিরক্তবোধ করলো। ভ্রু কুঁচকে চুপচাপ কিছুক্ষণ সন্ধিগ্ন চোখে ধারার দিকে তাকিয়ে থেকে স্পষ্ট স্বরে বলল,

'আপনার কি বিয়েতে মত ছিল না?'

ভয়ার্ত চোখে একবার শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে বহু কষ্টে ধারা কাঁপা কাঁপা শরীরে মাথা দুলালো। ধারার মাথা দুলানো দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেলো শুদ্ধ'র। বলল,

'বিয়েতে মত ছিল না তাহলে বিয়ে করেছেন কেন?'

শুদ্ধর কণ্ঠে স্পষ্ট রাগ। ধারা আরো ঘাবড়ে গেলো। কোনমতে আমতা আমতা করে বলল,

'বাবা বলল তাই...!'

'বাবা বলল তাই মানে? বাবাকে আগে না করেননি?'

কাঁদতে কাঁদতে ধারা আবারো দু দিকে মাথা দুলালো। এবার সত্যিই ভীষণ রাগ লাগছে শুদ্ধ'র। ঝাঁঝালো স্বরে বলল,

'বাবা বলল আর ওমনিতেই বিয়ে করে নিলেন! এখন আবার বিয়ে করে মরা কান্না জুড়ে বসেছেন। এখন কি আশা করছেন, সিনেমার মতো আমি আপনাকে এসে বলবো, 'কোন অসুবিধা নেই। আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। আপনি আপনার মতো থাকবেন, আমি আমার মতো থাকবো।' এই?'

ধারা এমনিতেই ভয় পেয়ে ছিল। শুদ্ধ'র ধমকের চোটে ভয় পেয়ে ও'র কান্না আরো বাড়তে লাগলো। বিরক্ত স্বরে শুদ্ধ বলল, 

'প্লিজ! সর্বপ্রথম আপনার এই কান্নাটা বন্ধ করুন। এই কান্নাটা কি বিয়ের আগে কাঁদতে পারেননি? বিয়ের আগে বাবাকে না করলেন না কেন?'

শুদ্ধ'র কঠিন চোখের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে বাঁচতেই এদিক ওদিক তাকাতেই ধারার হঠাৎ নজর পড়ল পাশের টেবিলে থাকা একটা ল্যাপটপের দিকে। কান্নার মধ্যেই বড্ড অসময়ে এমন অসংলগ্ন চিন্তা আসতেও ধারার দেরি হলো না, আচ্ছা চাষারাও কি আজকাল ল্যাপটপ চালায়?

কোন উত্তর না পেয়ে শুদ্ধ পুনরায় বলল, 'আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞাসা করছি।'

চমকে উঠে ভাবনা থেকে ফিরে এসে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ধারা বলল, 'আমি আমার বাবাকে খুব ভয় পাই তাই আর...!

উত্তর শুনে প্রচন্ড বিরক্ত আর রাগান্বিত শুদ্ধ বলতে লাগলো,

'বাবার কথায় যেহেতু বিয়ে করে ফেলেছেন তাহলে বাবার কথায় নিশ্চয়ই সংসারটাও করে ফেলবেন। তাহলে এখন আমার কাছে আসায় এভাবে কুঁকড়ে যাচ্ছেন কেন?'

কথাটা বলতেই বলতেই ধারার দিকে দ্রুত এক কদম এগিয়ে যায় শুদ্ধ। পিছিয়ে যেতেও ধারা আর পিছুতে পারলো না। তার আগেই শরীরের সমস্ত ভার নিয়ে হেলে পড়ে সামনের ছেলেটার বুকে। ধারার স্পর্শ পেতেই আঁতকে উঠে শুদ্ধ। মেয়েটার গায়ে দেখি সাংঘাতিক জ্বর।

চলবে----

 
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#2
Heart 
 পড়তে থাকুন নতুন কিছু ।
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#3
Heart 
 পড়তে থাকুন নতুন কিছু।
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

[+] 2 users Like Bangla Golpo's post
Like Reply
#4
Eki post 3 bar korsen. But nice story.
[+] 1 user Likes Saj890's post
Like Reply
#5
(26-04-2024, 03:35 PM)Saj890 Wrote: Eki post 3 bar korsen. But nice story.



Oo sorry
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#6
পর্ব -০২

 

অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিক। সকালটা আষ্টেপৃষ্ঠে কুয়াশার চাদরে মোড়া। রাস্তাঘাট শুনশান। থেমে থেমে ডেকে উঠছে পাখিরা। এমনই এক দিনে ধারা যাচ্ছিল কোচিংয়ে। গ্রাম থেকে বেড়িয়ে শহরে প্রবেশমুখে স্টেডিয়ামের পরেই তার কোচিং সেন্টার। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। তাই সকালের হিমবাহুকে ঠেলে সাতটার আগেই বেড়িয়ে পড়তে হয় রাস্তায়। চারিপাশে বিরাজ করছে নিরবতা। মাঝেমধ্যে আবছা ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে টুংটাং করে বেজে উঠছে একটা দু'টা সাইকেলের ঘন্টা। কুয়াশার মধ্যে তাকালেও চোখে পড়ে অস্পষ্ট দৃশ্য। ধারার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের থ্রি পিছ। তার উপরে পেঁচিয়ে নিয়েছে নীল রঙের শাল চাদর। কাঁধে ব্যাগ। মোড়ের মাথাতেই অটোরিকশা ছেড়ে দিয়েছে সে। মোড় থেকে কোচিং সেন্টারের দূরত্ব হাঁটা পথে চার মিনিট। কিন্তু এই চার মিনিটের দূরত্ব গাড়িতে গেলেই হয়ে যায় এক্সট্রা পাঁচ টাকা। গাড়ি চালকদের যতসব টাকা কামানোর ধান্দা। এতটুকু রাস্তার জন্য আবার বারতি পাঁচ টাকা দিতে হবে কেন? অনর্থক খরচ। তাই ধারা প্রতিদিন মোড়ের মাথাতেই নেমে পড়ে। পায়ে হেঁটে চলে যায় বাকি পথ। হাঁটতে হাঁটতে ধারা লক্ষ করলো অন্য দিনগুলোর চাইতে আজ যেন কুয়াশার আধিক্য একটু বেশিই। তার সাথে পাল্লা দিয়ে নিস্তব্ধতাও। পাঁচ হাত দূরত্বের কোন দৃশ্যও স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্তও কোন লোকজনের আলাই বালাই নেই। পিচ ঢালা রাস্তায় পাতা থেকে ঝরে পড়া শিশির বিন্দুর শব্দও যেন কান পাতলে শ্রবণেন্দ্রিয় হয়। ধারার মনে একটু অস্বস্তিপূর্ণ অনুভুতি নাড়া দিল। হাঁটার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিল সে। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে কানে এলো কতগুলো কুকুরের শব্দ। তাদের বিকট ভয়ংকর চিৎকারে মুহুর্তের মধ্যেই যেন খান খান হয়ে ভেঙে গেলো নিরবতা। দল সমেত পায়ের খুড়ের শব্দ জানান দিল এদিকেই দৌড়ে আসছে তারা। শিরদাঁড়া বেঁয়ে একধরণের শীতল শিহরণ নেমে গেল ধারার। কুকুর প্রচন্ড ভয় পায় সে। আতঙ্কিত হয়ে হঠাৎ কি করবে বুঝতে না পেরে সে ফাঁকা প্রশস্ত রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথায় দৌড়ে গেলো। গিয়েই বুঝলো কত বড় ভুলটাই না করে ফেলেছে। ঠিক তখনই কুয়াশা ভেদ করে চার পাঁচ টা কুকুরের হৃষ্ট পুষ্ট শরীর দৃশ্যমান হয়। ধারার দিকেই দুর্নিবার গতিতে ধেয়ে আসছে কুকুরগুলো। আতঙ্কে ধারার শরীর জমে যায়। কোন দিকে সরে যাবার জন্য শক্তিও যেন পায় না সে। কাঁধের ব্যাগ আর চাদর খুলে পড়ে গেছে অনেক আগেই। তবুও এত শীতে ঘাম ছুটে যায় তার। ঘেউ ঘেউ শব্দ করে কুকুরগুলো যখন ধারার অনেক কাছে চলে আসে তখন চোখ বন্ধ করে কানে দু হাত নিয়ে একটা জোরে চিৎকার দিয়েই শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে অবশ হয়ে পড়ে ধারা। ঠিক তখনই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ধারার হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ধারা তখন জ্ঞান শুন্য। কুকুরগুলোও তাকে অতিক্রম করে চলে গেছে অনেক আগেই। শুধু নির্জন রাস্তায় একজন জ্ঞান হারা সুন্দর তরুণীকে নিয়ে বিপাকে পড়ে যায় ছেলেটা। হাতের উপর ভর দিয়ে ধরে রাখা মেয়েটির সুন্দর চেহারা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছেলেটা একবার আশেপাশে ঘুরে তাকালো। সাহায্যের জন্য ডাকার মতো কেউ নেই। এদিকে মেয়েটাকে ছাড়তেও পারছে না। অচেনা একটা মেয়েকে আবার নিশ্চয়ই কোলেও উঠানো যায় না। এখন উপায়? পানি-ই বা কোথায় পাবে? মেয়েটার জ্ঞান যে ফেরাতে হবে। ছেলেটা ধারাকে ধরে রাখা ডান হাত মৃদু ঝাঁকিয়ে এক দুবার ডাকলোও তাকে৷ কাজ হলো না। হঠাৎ ছেলেটার চোখ পড়ল তাদের মাথার উপরের শিউলি গাছটার দিকে। ডালে ডালে শিশির ভেজা অজস্র ফুলের সমারোহ নিয়ে কি সুন্দর নিজেকে সজ্জিত করে রেখেছে গাছটা! কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থেকে ডান হাতেই ধারাকে রেখে বাম হাতটা দিয়ে গাছের একটা ডাল চেঁপে ধরলো সে। হাতের বলপ্রয়োগে মুহুর্তেই আন্দোলন সৃষ্টি করলো পুষ্পশাখায়। একটা মৃদু স্নিগ্ধ ঝঙ্কার তুলে যত্নে জমানো শিশির বিন্দু নিয়ে ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো শুভ্র মাতাল শিউলি ফুলের দল। এ যেন স্নিগ্ধ প্রভাতে মুগ্ধ ছন্দে ঘুমন্ত রাজকন্যার উপর চলছে বিরতিহীন অনিন্দ্য ফুল বর্ষণ। নিজের কোমল মসৃণ ত্বকে বিন্দু বিন্দু জল আর ফুলের শীতল স্পর্শ পেতেই খানিকবাদে কেঁপে উঠে ধারার ঘন চোখের পল্লব। পিটপিট করে চোখের পাতা খুলতেই দেখতে পায় তার মুখের সামনেই কালো জ্যাকেট পরিধেয় করা একটা ছেলের বিরক্তি মাখা মুখ তাকে বলছে,
'এই যে মিস, এবার তো উঠুন। সিনারি টা সিনেমাটিক হলেও সিচুয়েশানটা কিন্তু একদমই সিনেমাটিক না। আমার হাত খুলে পড়ে যাচ্ছে। ট্রাস্ট মি।'

ঝট করে ধারা চোখ মেলে তাকালো। গায়ে তার একটা পাতলা কাঁথা। ঘামে ভিজে শরীরের অবস্থা হয়ে উঠেছে জবজবে। মাথাটা ভীষণ ভার লাগছে। হঠাৎ মাথায় কয়েক মাস আগের একটা স্মৃতি আসলো কেন তার? একটা মুখ কোথাও দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছিল বলে, এই কারণেই কি? ধারা পাশ ঘুরে সোজা হয়ে শুয়ে নিলো। হঠাৎ ঠাওর করতে পারলো না সে আসলে আছে টা কোথায়! বিচলিত দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরতেই হঠাৎ তার নজর একটা ছবির দিকে গিয়ে আটকে গেলো। বিছানা ছেড়ে আস্তে ধীরে নেমে আসলো সে। ধীর পায়ে টিনের বেড়ার গায়ে ঝুলানো ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা ছেলের ছবি। কালো কোট আর ক্যাপ মাথায় দিয়ে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার মুহুর্তের। ছবির নিচে টাইপিং করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা মাহতাব ইসলাম শুদ্ধ। এই ছেলেটাকেই তো কোথায় দেখেছে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে ধারার। হঠাৎ তার মনে পড়লো এটাই সেই শীত সকালে স্টেডিয়ামের কাছে শিউলি গাছের নিচের সেই বিরক্তি মুখো ছেলেটা। এবং ইনি-ই কাল রাতের সেই ব্যক্তি। যার সাথে কিনা ধারার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের কথা মনে পড়তেই ব্যথিত মনে পাশের আয়নায় চোখ পড়তেই ধারা চমকে উঠে। কাল রাতে জ্ঞান হারাবার আগ পর্যন্তও তো তার গায়ে লাল বেনারসি শাড়ি ছিল। সাথে অনেক প্রসাধনীও। কিন্তু এখন তো দেখছি গায়ে শুধু একটা পাতলা সুতি শাড়ি। ধারার শাড়ি পাল্টে দিয়েছে কে? ঐ লোকটাই?

তখনই রুমে গটগটিয়ে প্রবেশ করে শুদ্ধ। ধারার কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখ দেখেই বুঝে যায় কি ভাবছে সে। তাই এসেই বলতে থাকে,
'এতো অবাক হবার কি আছে? আপনার স্বামী তো আপনাকে ছুঁতেই পারে তাই না! নাকি এটাও ভাবেননি। বাবা বলেছে আর ওমনিই বিয়ে করে নিয়েছেন।'

শুদ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ধারা হতবিহ্বল। 
__________________________________________

খোদেজা আজ মহাখুশি। তার একমাত্র ছেলের বিয়ে যে সে এমন ভালো ঘরে দিতে পারবে তা হয়তো কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। 
ছেলের জন্মের আগেই তার স্বামী মারা যায়। স্বামী ছাড়া একা হাতে ছেলেকে মানুষ করা সহজ ছিল না। কিন্তু এই কঠিন কাজটাই তিনি সম্ভব করেছিলেন। বরং ভালো মতোই করেছেন। যুবতী বয়সেই বিধবা হওয়ায় সবাই যখন তাকে দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন তিনি এর পরিবর্তে প্রথম স্বামীর স্মৃতি নিয়েই বাকি জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। তা যতই কঠিন হোক না কেন। এ কারণেই গ্রামের মানুষও তাকে একপ্রকার সমীহ করে। ছেলেকে মানুষ করেছেন এখন একটা ভালো সম্বন্ধ দেখে বিয়েও দিতে পেরেছেন। তিনি এখন দুশ্চিন্তামুক্ত। তার উপর এতো বড় ঘরের মেয়ে! মেয়েটাকে একদিন রাস্তায় অটোর মধ্যে দেখেছিল খোদেজা। দেখেই তিনি মেয়েটাকে পছন্দ করে বসেন তার একমাত্র ছেলের জন্য। মেয়ে তো দেখতে মাশাআল্লাহ! এর পরপরই এই মেয়ের ঠিকানা বের করে ফেলে একটা ঘটকের সাহায্যে প্রস্তাব পাঠিয়ে দেন খোদেজা। তখনও তিনি জানতেন না মেয়েদের অবস্থা এতো ভালো। যখন জানলেন তখন একপ্রকার চমকেই গিয়েছিলেন। আরো বেশি চমকান যখন জানতে পারেন মেয়ের বাবা রাজী হয়ে গেছেন। নয়তো আশা তো একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিল খোদেজা। তাই আর দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন তিনি। গ্রামের কম বেশি সব মহিলারাই আজ তার ছেলের বৌকে দেখতে এসেছে। বৌ দেখে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। খোদেজার বুক গর্বে উঁচু হয়। তখন পাশের বাসার হাসুর মা এসে খোদেজাকে মনে করায় নতুন বৌকে দিয়ে কিছু নিয়ম কানুন পালন করা বাকি আছে। খোদেজার পছন্দ হয় না। এত নিয়ম কানুনের ভারে পাছে তার ছেলের বৌটার কষ্ট না হয়। কিন্তু উপায় নেই। গ্রামের মহিলাদের সামনে একটা কথা বললে দশটা কথা বানাবে। মনের বিরক্তি মনেই রেখে খোদেজা অন্যদের ব্যবস্থা করতে বলে নিজেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

গ্রামের মহিলাগুলো যখন নিয়ম পালনের যোগাড় যন্ত্রে ব্যস্ত তখন এক কোণে একটু হাফ ছেড়ে দাঁড়ায় ধারা। এতক্ষণ একটানা বসে থাকতে থাকতে তার কোমর ধরে এসেছে। পরনে তার একটা সিল্কের কমলা রঙের শাড়ি। মাথার ঘোমটা টা আরো একটু টেনে নিয়ে যখনই একটু সোজা হয়ে দাঁড়ায় তখন হঠাৎ সেখানে এসে দাঁড়ায় শুদ্ধ। কোন হেঁয়ালি না করেই বলে,

'কিছু ভেবেছেন?'

শুদ্ধ'র এমন আকস্মিক আগমনে ধারা চমকে উঠে। এতটুকু সময়ের অভিজ্ঞতাতেই এই লোকটাকে কিছুটা ভয়ই পায় ধারা। আবারও না কিছু বলে বসে তাই দ্রুতই মৃদু স্বরে উত্তর দেয়,

'কি?'

'কি বলবেন?'

ধারা অবাক হয়ে বলে, 'কি বলবো?'

শুদ্ধ ঠান্ডা ভাবেই বলে, 'আপনি তো বিয়েতে রাজি না। তাই আমাদের একসাথে থাকারও কোন মানে হয় না। আজকে তো নিয়ম অনুসারে আপনার সাথে আমার আপনাদের বাড়ি যাবার কথা। আমি ঠিক করেছি আমি এখন কিছু একটা বাহানা দিয়ে যাবো না। আপনি একাই যাবেন। আপনাকে আনতে যেতেও আমি যাবো না। ততক্ষণে নিশ্চয়ই আত্মীয় স্বজনরাও সব কমে যাবে। বিয়ের আগে কিছু বলতে পারেননি, এখন বলবেন। বলবেন, আপনার এই বিয়েতে মত ছিল না। আমার সাথে থাকা আপনার পক্ষে সম্ভব না।'

ধারা স্তব্ধীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শুদ্ধ বলতে লাগলো, 'মনে রাখবেন প্লিজ, আমি কিন্তু আপনাদের বাড়িতে যাবো না। আপনি আপনার বাবাকে আপনার সমস্যাটা খুলে বলবেন।'

মূর্তির মতো অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে ধারা বলার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। যতটা সহজ ভাবে লোকটা বলল পারতপক্ষেই কি ধারার জন্য সবটা এতোটাই সহজ?

চলবে**********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#7
পর্ব-৩


মাটির খোলা পাত্র জুড়ে পানিতে সাঁতরে বেড়াচ্ছে একটা কালসেটে মাঝারি সাইজের মাছ। নিজের ক্ষুদ্র লেজের ক্ষমতা দেখিয়ে কম্পন সৃষ্টি করে তুলছে পানিতে। কখনো পাতিলের এই প্রান্তে দেখা যাচ্ছে তো আবার ছুট দিয়ে নিমিষেই পালিয়ে যাচ্ছে অপর প্রান্তে। এই ক্ষুদ্র পরিসর ভেদ করে বৃহত্তরে গমনের জন্যই যেন তার যত কারসাজি। এর আঞ্চলিক নাম টাকি মাছ। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য পুকুর থেকেই ধরে আনা হয়েছে। আর আনা হবেই বা না কেন! নতুন বৌকে আজ এই মাছ দিয়েই যে ভবিষ্যৎ সংসার পালনের দক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে। ধারা আনত মুখে কলের পুতুলের মতো চুপচাপ বসে আছে মাটির পাতিলটির সামনে। একটা মোটা গড়নের মহিলা তার খসখসে গলায় ধারাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
'শোন বউ, এহন এই মাছটা তোমারে হাত দিয়া ধরতে হইবো। তাও কিন্তু এক খাবায়। এক খাবাতেই যদি তুমি এই মাছরে ধরতে পারো তাইলেই বোঝা যাইবো যে তুমি সংসার খুব ভালো মতো সামলাইতে পারবা। আর যদি না পারো হের মানে হইবো তোমারে দিয়া কিছু হইবো না। 
আমড়া কাঠের ঢেঁকি 
পারে না কিছুই মেকি।'

উপস্থিত সবাই সেখানে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বিরক্তিতে খোদেজার কপাল কুঁচকে গেলো। এইসব কোন কথা! এইসব নিয়ম কানুন পালন হতো তাদের জমানায়। ভুলেও কোনটায় ব্যর্থ হলে একেকজনের কথা শুনতে শুনতে কান পঁচে যেত। এখন কি আর সেই সব দিন আছে। আজকাল মেয়েদের দিয়ে এসব কি না করালেই নয়! কিন্তু কে বলবে এইসব কথা? খোদেজা যদি এখন কিছু বলে সবাই বলবে খোদেজা আদিখ্যেতা করছে। তাই এখন মুখে কুলুপ এটে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। শুদ্ধ সেখানে ছিল না। এই মাত্রই একটা জরুরী কাজের জন্য বাইরে বেড়োবার প্রয়োজনে সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। জোবেদা যেতে দিল না। পথ আটকালো। দু মিনিট দাঁড়িয়ে দেখে যেতে বলল নিয়মটা। এসব কুসংস্কারের প্রতি আগ্রহ শুদ্ধ'র কোন কালেই ছিল না। তবুও দাঁড়াতে হলো মায়ের জোরাজুরিতে। ধারার তখন নার্ভাসে জমে যাবার অবস্থা। কতগুলো চোখ একসাথে বিদ্ধ হয়ে আছে তার দিকে! মহিলাটার কথাগুলো গুরুতর ভাবেই নিয়ে ফেলেছে ধারা। সত্যিই যদি মাছটা প্রথম চেষ্টাতেই ধরতে না পারে! তখন? কপালের কার্ণিশ বেঁয়ে তার এক ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ল। ভীতিগ্রস্ত মুখেই দ্রুত পানিতে একটা থাবা দিয়েই সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। হাতে একধরনের শীতল অস্তিত্বের অনুভূতি পেতেই চোখ খুলে দেখলো তার হাতের তালুর মধ্যেই বদ্ধ হয়ে পড়েছে মাছটা। মাছটা সবার সামনে উঁচু করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ধারা। উপস্থিত সবাইও যেন স্বস্তি পেলো। শুধু সেখানে উপস্থিত একজনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। 
__________________________________________

আসমা সকাল থেকেই ভীষণ ব্যস্ত। মেয়ের বিয়ে মানে যে কত শত কাজ তা গ্রামের মহিলাদের থেকে ভালো আর কে বুঝে। আজকে মেয়ে আর মেয়ের জামাই আসবে তাদের বাড়ি। রান্না বান্নার হিড়িক লেগেছে তাই। নিয়ম অনুযায়ী আজকে বৌ ভাত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ধারার বাবাই বলেছে শুধু শুধু অনর্থক ঝামেলা করার কোন দরকার নেই। আসল কারণ হলো তিনি চান বিয়ের এই হৈ চৈ তাড়াতাড়ি মিটে যাক। যতটুকু করার প্রয়োজন ছিল ততটুকুই তিনি করেছেন। যেগুলো না করলেও হয় সেগুলো বাদ যাক। ধারাকে আনতে যেতে শুধু কিছু লোক পাঠিয়েছেন। বিয়ের পর তো প্রথম মেয়েকে বাবাকেই আনতে যেতে হয়। সেটাও যায়নি আজিজ সাহেব। আসমার চিন্তা হয়। না জেনো ধারার শ্বশুর বাড়ির লোক খারাপ ভেবে বসে! কিন্তু এসব কথা কাউকে বোঝাবে কে? আসমার কথার কোন গুরুত্ব এই বাড়িতে নেই। এই সংসারে আসমার অবস্থান অনেকটা গাছের মতো। যে যা বলবে চুপচাপ শুধু খেটে যাবে। নিজের থেকে কোন মতামত দিবে না। আসমার ভীষণ ক্লান্ত লাগে। সব কিছু এমন ভাবে তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো! ইচ্ছা হয় একটু বসে মেয়ের সাথে কথা বলার। কিন্তু সেই উপায় এই মুহূর্তে নেই। আসমার শ্বাশুড়ি জমিরন বিবি দাওয়ার উপরই বসে আছেন। কোন ভুল হলে তার কথা থেকে ছাড় পাওয়া মুশকিল। জমিরন বিবির বয়স প্রায় আশি'র কোঠায় পৌঁছেছে। তবুও তেজ যেন এতটুকুও কমেনি। এখনও সংসারের ব্যাপারে ছেলেদের পরে তারই একরত্তি শাসন চলে। শ্বাশুড়ির কাছে আসমা এখনও সেই নতুন বৌটির মতোই। আসমা একবার সেদিকে তাকিয়ে বটি নিয়ে কামরাঙা কাটতে বসলো। অর্ধেক কাটা হতেই সেই কামরাঙার উপর এসে হামলা চালায় ধারার ভাই রাতুল। এই বার ক্লাস সেভেনে উঠেছে সে। মেয়েদের মতো টক খাওয়ার ভীষণ পাগল। দাদীর একপ্রকার চোখের মণিই সে। রাতুল যখন একের পর এক কামরাঙার টুকরো মুখে তুলে গোগ্রাসে গিলছে তখন তাতে বাধা দেয় আসমা। বলে,
'সব এখনই খেয়ে ফেলবি! তোর বোনের জন্য কাটতাছি এগুলা। ধারা কত পছন্দ করে! ধারা আগে আসুক। ও'র খাওয়ার পর থাকলে তারপর খাস।'

দাওয়া থেকে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে শুকনো খনখনে গলায় খেঁকিয়ে উঠেন জমিরন বিবি। বলতে থাকে,
'পোলাডা কতখন পর আইয়া একটা জিনিস খাইতে চাইতাছে হেইডাতেও তোমার আপত্তি! কেমন মা তুমি?'

আসমা বলে, 'আম্মা, কামরাঙা আর গাছে নাই। গাছ থেকে মাত্র পাইড়া আনছি। এই চারটাই ছিল।'

'তাতে কি হইছে? মাইয়া কি তোমার দশ বছর পরে আইতাছে? এতদিন খায় নাই। শ্বশুরবাড়ি গেলো তো মাত্র একদিন ধইরা। পোলারেই খাওয়াও। এই পোলাই পরে কামাই কইরা খাওয়াইবো। আমাগো বংশের বাতি। মাইয়া কোন কামে দিবো না। হেরা হলো পরের আমানত। বুঝছো?'

আসমা কি বুঝলো কে জানে! কারণ বোঝার আগেই ভেতর থেকে খবর এলো ধারা এসে পড়েছে। আসমা আর রাতুল দুজনেই খুশি মনে বাড়ির ভেতর ছুটে গেলো। জমিরন বিবিও প্রসন্ন মুখে ভেতর ঘরে উঁকি দিলেন। প্রকৃতপক্ষে ধারার বিয়ে হওয়ায় সবথেকে বেশি খুশি তিনিই হয়েছেন। তার মতে, মাইয়া মানুষ সেয়ানা হইলে কলঙ্ক ছায়ার মতো পেছন পেছন ঘুরতে থাকে। আর একবার যদি কোন কলঙ্ক লাইগা যায় তাইলে সেই মাইয়ার বিয়ে দিতে বাপের দফা রফা অবস্থা হয়। এর জন্য মাইয়া মাইনষের বিয়ে তাড়াতাড়িই হইয়া যাওয়াই ভালো। জমিরন বিবি তো আরো কত আগের থেকেই চাচ্ছিলেন ধারার বিয়ে হয়ে যাক। তার ছেলেগুলা বেশি বোঝে বলেই এতদিন তার কথা শুনেনি। আজ অবশেষে তার প্রার্থনা কবুল হলো। সন্তুষ্টি চিত্তে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি লাঠি হাতে খটখট করতে করতে ভেতরের দিকে চললেন।
_________________________________________

শুদ্ধদের বাড়ির পাশেই একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুরের স্বচ্ছ জল দেখলেই চক্ষু শীতল হয়। পাড় ঘেঁষে চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ বৃক্ষের দল। পানির মাঝখানে কিছু কচুরিপানা নিজেদের মধ্যে বেগুনী রঙের ফুল ধারণ করে হয়ে আছে স্থির ভাসমান। ঘাটের পাশেই একটা হিজল গাছ। ডালের ভারে পুকুরের উপর হেলে আছে যেন। সেই গাছের গুঁড়িতে বসেই আনমনে পানির দিকে তাকিয়ে আছে শুদ্ধ। তার হাতে একটা ছোট্ট তেঁতুল গাছের ডাল। বেখেয়ালি ভাবে সেই ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে পুকুরের পানিতে ফেলছে সে। তখন সেখানে কচুরিপানার উপর দুটো সাদা বক এসে বসলো। দেখে মনে হচ্ছে জোড়া বক। এদিক ওদিক তাকিয়ে মাছের খোঁজ করছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো শুদ্ধ। আর পাঁচটা ছেলেদের মতো বিয়ে নিয়ে তারও অনেক শখ আহ্লাদ ছিল। এই জীবনে কখনো অন্য মেয়েদের দিকে তাকায়নি। এতো এতো সুযোগ পেয়েও জড়ায়নি কোন প্রেমের সম্পর্কে। নিজের সবটুকু ভালোবাসা শুধু স্ত্রীর জন্যই বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। ভেবেছিল বিয়ের পর নিজের বউকে প্রচুর ভালোবাসবে। কখনো কোন অভিযোগের সুযোগ দিবে না। কিন্তু এখন সব ভিন্ন। এ কারণেই ধারার উপর প্রচুর রাগ হয়েছিল তার। ধারার যদি বিয়েতে মত নাই ছিল সেটা সে তার বাবাকে খুলে বলল না কেন? ধরে বেঁধে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া এক কথা। কিন্তু ধারা তো তার বিয়ের জন্য বাবাকে কোন বারণই করেনি। দোষটা তাহলে হলো কার? শুধু ধারার একটু সাহসের অভাবের জন্যই আজ দু দুটো জীবন এলোমেলো হয়ে পড়লো। 

ছেলেকে অন্যমনষ্ক হয়ে ঘাটপারে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে খোদেজা। পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, 'কিরে মাহতাব, এই ভরদুপুর বেলা ঘাটপাড়ে বইসা আছোস কেন?'

শুদ্ধ বলল, 'এমনিই আম্মা।'

'বউ'র সাথে কথা হইছে?'

এই প্রশ্নের উত্তরে শুদ্ধ ঘুরিয়ে বলল, 'তুমি এদিকে কি করো? নামাজ পড়বে না?'

'তা পড়বো। তুই বউ'র সাথে গেলি না কেন বল তো? বউরে একা একাই পাঠায় দিলি। কি ভাববে ঐ বাড়ির লোকজন! বললি যে তোর নাকি দরকারী কাজ আছে। বউ গেছে দু দিন হয়ে গেলো। কই তোর কোন দরকারী কাজ তো দেখতাছি না। বসেই তো আছোস।'

'আমার ওখানে কোন প্রয়োজন নেই। তাই যাই নি।  
কাজ আছে। তুমি বুঝবে না।'

খোদেজা বাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, 'ঠিকই বলছোস। তোদের ব্যাপার স্যাপার আমি আসলেই বুঝি না। কি জানি বাপু!'

খোদেজা চলে যাওয়ার সাথে সাথেই পুকুরের পান্না ঘেঁষে একটা মাছ লাফিয়ে উঠলো। খোদেজাকে দেখার জন্য ডাকতে গিয়েও শুদ্ধ ডাকতে পারলো না। ও'র হঠাৎ ধারার মাছ ধরার কথা মনে পড়ে গেলো। ধারা গ্রামের মেয়ে। মাছ ধরা নিয়ে তার অপটু হবার কথা না। তবুও মাছ ধরার আগে এতোটা নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল কেন সে? আড়াআড়ি ভাবে বুকে দু হাত গুঁজে চিন্তামগ্ন শুদ্ধ ভাবতে লাগলো, ব্যাপারটা কি?
__________________________________________

জমিরন বিবির প্রথম থেকেই খটকা লাগছিল। সময় যতটা গড়াতে লাগলো মনের খুতখুত ভাবটা আরো বাড়তে লাগলো তার। ধারার মতিগতি ঠিক লাগছে না তার কাছে। প্রথমে তো জামাই ছাড়া একা একাই এসে পড়লো শ্বশুড় বাড়ি থেকে। তার উপর মুখটা এই দুই দিন যাবৎ এমন ভাবে ভার করে রেখেছে যেন পৃথিবীর সব দুঃখ তার মাথার মধ্যে এসে ভর করেছে। আজকে তো জামাইয়ের নিতে আসার কথা। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো। কই এখনও তো আসছে না! ব্যাপারটা কি?
শেষের ব্যাপারটা শুধু জমিরনের নয় সকলের মাথাতেই এসেছে। সাঁঝ হয়ে আসছে তবুও তো তাদের মেয়েকে নিতে জামাই আসছে না। একসময় আজিজ তালুকদারকেই বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাতে হলো। মেয়ে দুই দিন ধরে এসেছেন। এখনও পর্যন্ত কোন কথাও বলেননি তিনি মেয়ের সাথে। তার রাগ এখনও কমেনি। কিন্তু এখন কথা আর না বললেই নয়। অগত্যা আর কোন উপায় না দেখে তিনি মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। বাবা ডেকে পাঠিয়েছে শুনেই ধারার ঘাম ছুটে গেলো। এই দুই দিন ধরে এই চিন্তাতেই সারা রাত ঘুম হয়নি তার। লোকটা তো বার বার করে বলেই দিয়েছে সে আসবে না। এখন এই কথাটা বাবাকে কিভাবে বলবে ধারা? তার উপর যদি কেউ শুনে যে ধারার ও বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি করে বিয়েতে রাজী না থাকার কথা বলার জন্যই এসব হচ্ছে তাহলে তো ধারা বোধহয় আজকে আস্তই থাকবে না। ভয়ে ও'র ইচ্ছা করছে কোথাও নির্জনে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে। ছোট থেকেই পড়ালেখার উপরই ছিল ধারা। পড়ালেখা ছাড়া প্রেম, ভালোবাসা, ছেলে কোনকিছুতেই কখনো নজরও দেয়নি। আজ পর্যন্ত কোন রোমান্টিক গান খেয়াল করে শুনেছে কিনা তাতেও সন্দেহ। সব সময় শুধু জানতো ওকে পড়তে হবে, অনেক পড়তে হবে। অন্য কিছু নিয়ে ভাববার আর সময় কই! বিয়ে ব্যাপারটা সব সময়ই ছিল ও'র সমস্ত চিন্তা ভাবনার বাইরে। সাধারণত মেয়েরা চৌদ্দ পনেরো তো পড়লেই বিয়ে নিয়ে তাদের ভাবনা কাজ করে। কত রং বেরঙের স্বপ্নও সাজায়। কিন্তু এসব নিয়ে কখনোই কিছু ভেবে দেখেনি ধারা। তাই জীবনে হঠাৎ করেই এই বিয়ে নামক পরিবর্তনে ধারা ঘাবড়ে যায়। মানতে পারেনি। নেহাৎ সেকারণেই হয়তো বাসর রাতে একটু বেশিই ভেঙে পড়েছিল সে। এ কারণে লোকটা এভাবে বলে দিবে সে আর ধারাকে নিতে আসবে না! ধারাকে সবটা মিটমাট করে নিতে হবে। আদৌও কি এতো ক্ষমতা আছে ধারার? সবার মতো সেও জানে যাই হয়ে যাক তার আশ্রয় এখন ঐ শ্বশুরবাড়িই। তাকে সেখানেই থাকতে হবে। কিন্তু ঐ লোকটা তো ধারাকে নিতেই আসবে না।

নত মুখে আস্তে আস্তে ধারা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গোমড়া মুখে আজিজ সাহেব প্রশ্ন করেন,

'তোমার স্বামী এখনও আসছে না কেন? কারণ কি?'

ধারার গলা শুকিয়ে আসে। এমনিতেও বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক মতো কথাও বলতে পারে না সে। আর আজকে তো...!
অনেকক্ষণ হয়ে যায় ধারা কিছু বলে না। এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে জমিরন বিবি পেছন থেকে খেঁকিয়ে উঠে,
'আমি তোরে আগেই কইছিলাম আজিজ, কিছু একটা ঘাবলা আছে। তোর মাইয়া এমন চুপ কইরা আছে কে জিগা। জামাই আসার সময়ও আসলো না আবার এহনও আসতেছে না এর কারণডা কি?'

ধারা মাথা নিচু করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবা এমনিতেও অনেক রাগী। তার উপর আজকে দাদীও আছে। কি বলবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না সে। আসমা মাথায় ঘোমটা টেনে মেয়ের দিকে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। আসলেই কি কিছু হয়েছে? ধারা এমন করছে কেন? মেয়ের জন্য মনে মনে আসমা আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলো। সব যেন স্বাভাবিকই থাকে। নয়তো আজ তার মেয়ের কপালে কি আছে কেউ জানে না।'

জমিরন বিবি বলেই যেতে লাগলেন, 'আমি আগেই বুঝছি কিছু একটা হইছে। জামাই নাইলে আসবো না কেন? নিশ্চয়ই এই মাইয়াই কিছু করছে। ওরই দোষ। এমন অকর্মা মাইয়া। দুই দিনও সব ঠিক রাখতারলো না! এই ধারা কস না কেন? ঐ বাইত্তে আবার কি কান্ড কইরা আইছোস যে তোরে নিতে পর্যন্ত কেউ আসতাছে না।'

মায়ের কথায় আজিজ সাহেব খুব একটা কান দেন না। তার মায়ের স্বভাবই ছোট খাট বিষয় নিয়ে হৈ চৈ করা। তবে আজকের ব্যাপারটা ফেলে দেবার মতো না। তাই মাকে না থামিয়ে তিনি মেয়েকে শীতল কন্ঠে বললেন,

'তোমাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন আসছে না?'

ধারার শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভয়ের চোটে চোখের কার্ণিশে জলও জমতে শুরু করছে তার। গলা দিয়ে যেন কোন আওয়াজও বের হতে চাচ্ছে না। বার বার হাত দিয়ে ডান চোখের পাশ টা ঘঁষছে ধারা। আজিজ তালুকদার আগের থেকেও গম্ভীর ভাবে বললেন,

'কি হলো বলছো না কেন?

আরো একবার কপালের কার্ণিশটা ঘষে ধারা কাঁপা কাঁপা গলায় কোনমতে বলল,
'বাবা! ঐ...সে...আসলে....আসবে...

ধারাকে চমকে দিয়ে ঠিক তখনই পেছন থেকে স্বল্প পরিচিত একটা স্পষ্ট ভরাট কণ্ঠস্বর হঠাৎ ডেকে উঠলো,

 'ধারা!'

চলবে,
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#8
পর্ব-৪




একটু রাত হতে না হতেই চারিদিক নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। রাস্তাঘাটে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু ধারে ধানের ক্ষেত। তার মধ্যে থেকে মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে একটা দুটো শেয়ালের দল। এমন একটা পরিবেশে গ্রামের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে শুদ্ধ আর ধারা। আজ বিকেলে শুদ্ধকে ও বাড়িতে দেখেই সবাই আনন্দে আটখানা হয়ে যায়। যাক অবশেষে তাদের জামাই এসেছে। আজিজ সাহেব খানিক কুশল বিনিময় করেই সেখান থেকে চলে যান। সবথেকে বেশি খুশি হয় আসমা। জমিরন বিবিও একটু স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলেন। হতভম্ব হয় থাকে তো শুধু ধারা। নিজের চোখকে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্বাসই হয় না তার। আরো বেশি চমকে উঠে যখন শুদ্ধ ধারার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

'যাবেন না ধারা? আপনাকে আমি নিতে এসেছি।'

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য কথাই বন্ধ হয়ে যায় ধারার। হুঁশ তো ফিরে তখন, যখন জামাইকে এখনও বসতে দিচ্ছে না বলে জমিরন বিবি ধমক লাগায়। এরপর শুরু হয় গ্রামীণ সংস্কৃতির জামাই আদর। শুদ্ধকে না খেতে আসতেই দিল না আসমা আর জমিরন। অগত্যা এই অবেলায় খানা পিনার পর্ব সমাধা করতে হয় শুদ্ধকে। খাওয়া দাওয়া করে ফিরতে ফিরতেই হয়ে যায় রাত। সম্ভবত সাতটা আটটা বাজে। কিন্তু গ্রামের রাস্তায় তো এতটুকু রাত মানেই অনেক। তাই রাস্তায় বেড়িয়ে আর কোন গাড়ির দেখা পেলো না তারা। একটা ভ্যান পেয়েছিল সেটা শুধু মেইন রাস্তাটুকুই পার করে দিয়ে গেছে তাদের। এখনও অর্ধেকের মতো পথ বাকি। হয়তো হাঁটা পথেই আজ পার করতে হবে। দুজনেই চুপচাপ। ধারার সমস্ত ধ্যান রাস্তা দেখে হাঁটায়। যেই অন্ধকার! শুদ্ধ খানিকটা অন্যমনষ্ক। কিছু একটা যেন গভীরভাবে মনে মনে ভাবছে সে।

শুদ্ধ'র ভাবনায় ছেদ ঘটে হঠাৎ একটা ধপাস জাতীয় শব্দে। পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে ধারা রাস্তার পাশে বসে আছে। ভালো করে লক্ষ করে দেখলো আসলে বসে আছে না, পড়ে গেছে। রাস্তার পিচ উঠে গর্ত হয়ে ছিল। সেখানে পানি জমে কাঁদার মতো পিচ্ছিল হয়ে আছে। গর্তটা রাস্তার একদম কিনারে। এতো সাবধানে হেঁটেও কিভাবে যেন সেখানেই পা পড়ে যায় ধারার। আর তারপর ধপাস। শুদ্ধ দ্রুত ধারার দিকে এগিয়ে গেলো। ধারা মনে করলো এই বুঝি লোকটা আবারও কথা শুনাবে। কিন্তু ধারার ধারণা ভুল করে শুদ্ধ ঝুঁকে নরম স্বরেই বলল,

'পড়ে গেলেন কিভাবে?'

কাঁচুমাচু মুখে ধারা একবার শুদ্ধ'র দিকে তাকিয়ে উঠার চেষ্টা করে। কিন্তু উঠতে যেতেই আবারও পা পিছলে পড়ে যায়। শুদ্ধ বলে, 

'এভাবে হবে না। দেখি আপনার হাত দিন। আমার হাত ধরুন।'

শুদ্ধ'র বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে ধারা আস্তে করে নিজের হাত দেয়। ধারার হাতও কাঁদায় পড়েছিল বিধায় তার হাতও পিচ্ছিল হয়ে আছে। শুদ্ধ শক্ত করে ধারার হাত চেঁপে ধরে বলল, 'এবার উঠুন।'

এবারও উঠতে যাবার সময় পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে যেতে নিল ধারা। কিন্তু এবার আর শুদ্ধ পড়তে দিলো না। শক্ত করে হাতটা আগলে ধরে রাখলো। 
ধারা উঠে দাঁড়াল। দু পা কাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেছে তার। শাড়ি উঁচু করে একবার পায়ের দিকে তাকালো সে। শুদ্ধ দেখে বলল, 

'এদিকে আসুন।'

রাস্তার ধারেই ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে মাটির আল দিয়ে পানি যাওয়ার জন্য ড্রেনের মতো বানানো হয়েছে। ধারার হাত ধরে শুদ্ধ সাবধানে পা ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে যেয়ে সেখানেই নিয়ে গেলো তাকে। স্বচ্ছ পানির ধারার কাছে ধারাকে দাঁড় করিয়ে বলল, আপনার শাড়ির পাড় উঁচু করুন। ধারা খানিকটা উঁচু করলো। বুঝতে পারলো না লোকটা কি করতে চাইছে। আগ বাড়িয়ে কিছু বললোও না। ধারাকে মাটির আলের উপর দাঁড়া রেখে শুদ্ধ নিজের দু হাত একত্রিত করে পানি তুলে ধারার পায়ে দিতে লাগলো। ধারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শুদ্ধ'র দিকে। এই লোকটাকে একদমই বুঝতে পারছে না ধারা। সাধারণ ব্যাপারে রাগ হয়ে যায় আর এখন রাগ করার ব্যাপারেও রাগছে না। বলল যে, ধারাদের বাড়িতে যাবে না। কিন্তু সঠিক সময়েই গিয়ে উপস্থিত হলো। বাঁচিয়ে দিলো ধারাকে। আল্লাহ রক্ষা করেছে যে গিয়েছে। নয়তো আজ ধারার যে কি হতো! 

আল থেকে নেমে রাস্তায় উঠতে গিয়েই আবার ধারার জুতো ছিঁড়ে গেলো। ধারা থতমত খেয়ে একবার আড়চোখে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। শুদ্ধ ঠায় দাঁড়িয়ে ধারার পায়ের দিকেই তাকিয়ে আছে। ধারা ছেঁড়া জুতো টেনেই হাঁটতে নিলে থামিয়ে বলল, 'নিন, আমার জুতো পড়ুন।'
এই বলে খালি পা হয়ে নিজের জুতো জোড়া খুলে দিল। শুদ্ধ'র বড় বড় জুতোর মধ্যে নিজের ছোট পা গলিয়ে দিয়ে ধারা মনে মনে নিজের ভাগ্যের উপর ভীষণ বিরক্ত হলো। সব দূর্ঘটনা কি আজকেই ঘটতে হলো!  

কিছুটা পথ পেড়িয়ে গিয়ে আবারও শুদ্ধ খেয়াল করলো ধারা পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। জিজ্ঞেস করলো, 'আপনার পায়ে কি হয়েছে? এভাবে হাঁটছেন যে!'
ধারা মনে মনে একটা ঢোক গিললো। পায়ে তার কাঁটা বিঁধেছে অনেক আগেই। হয়তো যখন পড়ে গিয়েছিল তখনই। এতক্ষণ কিছু বলেনি। কি আর বলবে! একটার পর একটা সমস্যা তো তার সাথে লেগেই আছে। শুদ্ধ জিজ্ঞেস করায় মাথা নিচু করে আমতা আমতা করে বলল, 'পায়ে কাটা বিঁধেছে।'
বলেই ভীত ভীত চোখে একবার আস্তে করে শুদ্ধ'র প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টা করলো। শুদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়ে ভ্রু কুঁচকে সোজা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ধারাকে তাকাতে দেখে থমথমে গলায় বলল,

'আমার জুতা খুলুন।'

ধারা ঘাবড়ে গিয়ে ঝটপট জুতা খুলে দিল। তাকে নিয়ে একটু হাঁটতে গিয়েই এতো এতো সমস্যা হচ্ছে। এইবার বুঝি লোকটা নিজের জুতা নিয়ে তাকে মাঝ রাস্তায় ফেলে চলেই যাবে। জুতো খুলে পাশে সরে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল ধারা। শুদ্ধ গটগট করে নিজের জুতো পড়ে নিল। ধারা মাথা নিচু করেই রইলো। হঠাৎ ধারাকে চমকে দিয়ে শুদ্ধ ধারাকে কোলে তুলে নিল। ভূত দেখার মতই চমকে উঠলো ধারা। এরকম কিছু একটা শুদ্ধ করবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। ধারার বড় বড় হয়ে যাওয়া অপলক চক্ষুযুগল এখন শুদ্ধ'র দিকেই নিবদ্ধ। কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই এই একগুঁয়ে, নাক উঁচু লোকটার। কুঞ্চিত ভ্রুদ্বয় সামনের দিকে তাক করেই নিজ গতিতে হেঁটে যাচ্ছে সে। সত্যিই কি এই এতোটা পথ এভাবেই পায়ে হেঁটে ধারাকে কোলে করে নিয়ে যাবে লোকটা?

বাড়ি পৌছাতেই খোদেজা ছেলের সাথে ভীষণ রাগ দেখালো। ধারা নতুন বউ। এভাবে রাত করে বাড়ি ফেরাটা মোটেও ঠিক হয়নি তাদের। বিশেষ করে রাস্তার মাথার ঐ বটগাছটার নিচের জায়গাটা একদমই ভালো না। গতবছর ওখান থেকেই তাদের গ্রামের রহিমার উপর জ্বীনের আছর হলো। শুদ্ধদের বাড়িটা পুরনো দোচালা ঘরের মতো। নিচের তলার চারিপাশে ইট দিয়ে ঘেরাও করা। দু পাশে বারান্দা। মাঝখানে রুম। সাধারণত গ্রামের বাড়িগুলো যেরকম হয়। মাঝের থেকে উপরের দিকে একটা সরু কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে। মাঝখানের বেড়াগুলো টিনের। মেঝে পাকা। আর উপরের তলাটা সম্পূর্ণই টিনের। মেঝে কাঠের। উপরের তলায় বড় অংশ জুরে ঐ একটাই রুম। সেখানেই শুদ্ধ থাকে। রুমের বাইরে কাঠ দিয়েই ঘেরাও করে ছোট বারান্দার মতোই বানানো হয়েছে। সেখানে গাঢ় লাল, হলুদ, সবুজ রং করায় চকচক করছে। খোদেজার শ্বশুরের আমলের ঘর। এককালে তাদের অবস্থাও ভালোই ছিল। তার স্বামী মারা যাবার পরই সব থেমে যায়। এখন আশা আছে তার ছেলে তাদের সংসার বড় করে তুলবে। ধারা খোদেজার রুমে একাই বসা ছিল। খোদেজা গেছে ছেলের পেছন পেছন। তখন সেখানে আসলো পনের বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটার নাম চুমকি। শুদ্ধ'র মামাতো বোন। স্বভাব চঞ্চল। বাবা মা দুজনেই মারা যাওয়ায় এখন শুদ্ধদের সাথেই থাকে। মেয়েটি
এসেই ধারাকে জাপটে ধরে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে, 'কেমন আছো নতুন ভাবী?'

ধারা স্মিত হেঁসে মাথা নাড়িয়ে বলে সে ভালো আছে। হঠাৎ তার চোখ যায় খোদেজার রুমের দেয়ালে। সেখানেও শুদ্ধ'র রুমের মতো কালো কোট, ক্যাপ পড়া শুদ্ধ'র একটা ছবি। ধারা চুমকিকে জিজ্ঞাসা করে, 'আচ্ছা চুমকি ওটা কার ছবি?
চুমকি বলল, 'মাহতাব ভাইয়ের।'
'আসল?'
'হুম।'
'না মানে ছবিটা কি কোন ইডিট করা হয়েছে?'
'না তো। এইটা তো শুদ্ধ ভাইয়ের সেদিনের ছবি যেদিন ভাইয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সব পড়ালেখা শেষ করে ফেলেছিল।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা শুনে ধারা অবাক হয়। বলে, তোমার ভাইয়া পড়ালেখা করেছে? কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে?'

এরপর চুমকির থেকে সে যা শুনতে পায় তার সারমর্ম অনেকটা এই, 'শুদ্ধ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট থেকে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে গ্রাজুয়েশন কম্প্লিট করেছে। গ্রাজুয়েট হওয়ার পর প্রথাগত চাকরীর পেছনে না ছুটে ভিন্ন কিছু করতে চাইছে। সে কৃষি উদ্যেক্তা হতে চায়। পড়ালেখা শেষ করার পর দেঢ় বছর যাবত সে এসব নিয়েই আছে।

চুমকির কথা শুনে ধারা সত্যিই অবাক না হয়ে পারলো না। তাদের গ্রামের মধ্যেও কেউ কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা দিতে পারেনি। আর সেখানে শুদ্ধ....! আর ধারা কিনা ভেবেছিল শুদ্ধ হয়তো কোন অশিক্ষিত মূর্খ চাষা হবে।
ধারাকে ভাবনায় মগ্ন দেখে চুমকি বলল,

'কি হয়েছে ভাবী? খারাপ লাগছে? তোমার শরীর এখন কেমন? জ্বর পুরোপুরি সেড়েছে?'

ধারা অবাক হয়। তার জ্বর এসেছিল সেটা মেয়েটা জানলো কি করে? সেটা মুখ খুলে প্রশ্নও করে সে চুমকিকে। চুমকি বলে, 'আরে! ঐ যে বিয়ের দিন রাতে তোমার জ্বর এসেছিল না? মাহতাব ভাই তো আমাকে মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। বলল যে তোমার শাড়িটা পাল্টে দিতে। বাবা রে বাবা! যে জ্বর তোমার এসেছিল! গায়ে হাত দিলে মনে হচ্ছিল যেন হাত পুড়ে যাবে। তারপর ভাইয়াই তো সারারাত তোমার কপালে জ্বল পট্টি দিয়ে মাথায় পানি ঢেলে রাতের মধ্যেই জ্বর কমিয়েছে। আমি তো ছিলাম অর্ধেক রাত পর্যন্তই। তারপর আমাকে ঘুমানোর জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। আর বলেছে এই কথা যেন কাউকে আর না বলি। বুঝছো ভাবী ভাইয়া এমনিতে খুব ঠান্ডা মেজাজের। সবসময় স্পষ্ট কথা বলে। যা মনে আছে বলে দিবে। হেঁয়ালি কথাবার্তা ভাইয়া একদমই পছন্দ করে না। আর নড়বড়ে স্বভাব তো আরো না। ভাইয়ার মতে সবাইকে নিজের ভেতরে নিজেকে নিয়ে স্ট্রং হতে হবে। নড়বড়ে হওয়া চলবে না। মাহতাব ভাইয়া না খুব ভালো।'

ধারা শুধু অবাকের উপর অবাকই হচ্ছে। শুদ্ধ ওর শাড়ি পাল্টায়নি। তবুও সেদিন সকাল বেলা এমনভাবে বললো যেন সেই পাল্টিয়েছে। আবার ধারাকে টিটকারিও করলো। এতো অদ্ভুত কেন লোকটা?

শুদ্ধ বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকে নিজের রুমের দিকে যেতে নিলেই খোদেজা ডাক দিল। বলল,
'মাহতাব, রুমে যাইসা না। তুই যাওয়ার পর আবুলে তোর রুমের পাশের ওদের গাছের ডালপালা গুলা কাটছিল। একটা ডালে বারি খেয়ে তোর একটা কাঠের জানলা ছুইটা গেছে। গাছে মৌ পোকের বাসা ছিল। রুমে অনেকগুলা ঢুকছে। আজকের রাত নিচেই থাক। বৌ আমার বিছানায় ঘুমাক। তুই বারান্দার ঐ ছোট চৌকিটায় ঘুমাস। কালকে জানলা ঠিক কইরা নিস। শুদ্ধ থেমে গেলো। একবার ধারার দিকে তাকিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে মাঝ রুমের মোড়ায় বসে পড়লো। খোদেজা নিজে নিজেই বিরবির করতে লাগলো,
'উফ! একটা বিয়ের পর কত টুকিটাকি কাজ যে পইরা থাকে। খতম হওয়ার নামই নেয় না। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ে ধারাকে একটা তালা দিয়ে বলে,
'বৌ, তুমি একটু ঐ তালাটা মাইরা রাখো তো। ভালো করে মাইরো। অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস আছে ঐটার মধ্যে। ওগুলা অন্য আরেক সময় ধরবো।'

ধারা গিয়ে দরজা আটকিয়ে তালা মেরে দেয়। তিন চার বারের মতো তালা টেনে চেকও করে যে ভালো মতো লেগেছে কিনা। তারপরও আবার পাশ দিয়ে যাওয়া চুমকিকে ডেকে বলে,
'চুমকি দেখো তো, তালাটা ঠিকমতো লেগেছে কিনা!'
চুমকি একবার হাত দিয়ে তালা টেনে দেখে বলে, 
'হ্যাঁ লেগেছে ভাবী।'

এই পুরো ব্যাপারটাই তীক্ষ্ণ চোখে দূর থেকে পরখ করে শুদ্ধ। তারপর হাতের ল্যাপটপটায় পটাপট টাইপ করে ধারা লিখে নিচে আন্ডারলাইন দিয়ে লেখে,

ধারা:
১. ভীতু।
২. কনফিডেন্স নেই বললেই চলে।
৩. পরনির্ভরশীল।



চলবে*********
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply
#9
পর্ব-৫

    

সকালের সোনালী রোদ্দুর জানালার ফাঁক গলিয়ে ধারার মুখে পড়তেই ধারার ঘুম ভেঙে গেল। ঘন পল্লব বিশিষ্ট চোখজোড়া খুলতেই লাফিয়ে উঠলো। অনেক বেলা হয়ে গেছে! এতক্ষণ কিভাবে ঘুমিয়ে রইলো সে? ঝটপট বিছানা থেকে নেমে মাথার এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিল। ফ্রেশ হয়ে এসে বাইরে বেড়িয়ে দেখলো বাড়িতে কেউ নেই। উঠোনের কোণায় চোখে পড়লো শুদ্ধকে। একটা নাম না জানা গাছের চারা নিয়ে কি যেন করছে সে। শুদ্ধদের বাড়ির সামনেই একটু বা দিকে মাটির রান্নাঘর। রান্নাঘরের সামনেই টিন দিয়ে বেড়া দেওয়া ডিপ কলের গোসলখানা। এর পর থেকে পাশের বাড়িগুলোর সীমানা শুরু। ডান দিকে বড় বড় মেহগনি গাছ দাঁড়িয়ে জঙ্গলের মতো হয়ে আছে। তারপরেই স্বচ্ছ পানির পুকুর। শুদ্ধ সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ধারা একবার রান্নাঘরের ভেতর উঁকি দিল। শুদ্ধ নিজের কাজে মগ্ন থেকেই বলল, 'আম্মা গেছে পাশের বাড়ি। চুমকি গেছে স্কুলে। পাবেন না কাউকে এখন।'

ধারা একটু থতমত খেয়ে গেলো। এই লোকটার কি কোনভাবে মানুষের মন পড়ে ফেলার ক্ষমতা আছে? ধারা যখনই যা ভাবে সবটা কিভাবে ঠিকঠাকই বলে দেয়! ধারা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ ধারাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে চলে গেল। ফিরে এলো একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে। ধারার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, 'এর মধ্যে দুটো থ্রি পিছ আছে। শাড়ি পড়ায় যেহেতু অভ্যস্ত নন পড়তে হবে না।'

ধারা এবারও অবাক হলো। সারাক্ষণ শাড়ি পড়ে থাকতে তার সত্যিই অসুবিধা লাগছিল। বিয়ের আগে তো তেমন পড়া হয়নি। কিন্তু এই কথাটা তো সে কাউকে বলেনি। তাহলে জানলো কি করে? 

শুদ্ধ বলে উঠলো, 'শাড়ি পড়ে যেভাবে হাঁটেন দেখলেই বোঝা যায়। এটা মুখ ফুটে বলতে হয় না।'

ধারা এবার সাংঘাতিক চমকে উঠে ব্যাগটা ধরে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালো। এই লোকটার থেকে সাবধানে থাকতে হবে। এ তো দেখছি সে যা ভাবে সবই ধরে ফেলে। শুদ্ধ চলে যেতে নিয়েও আবার দাঁড়িয়ে ধারাকে বলল, 'গোসলখানা এদিকে। সাবধানে যাবেন। দেখবেন, আবার অজ্ঞান হয়ে যান না যেন! আপনি তো আবার কথায় কথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কুকুর দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তারপর আবার আমাকে আপনার শাড়ি পাল্টে দিতে হবে আর আপনি জ্ঞান ফিরে আকাশ থেকে টপকে পড়ার মতো এক্সপ্রেশন দিবেন।' 

শুদ্ধ চলে যেতে নিল। ধারা ঝট করে ঘুরে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। এই লোকটা এমন কেন? ধারা এখন ভালো মতই জানে সেদিন রাতে শুদ্ধ তার শাড়ি পাল্টায়নি। তবুও এখনও এমন ভাবে বলছে যেন সেই করেছে। ধারা দ্রুত বলে উঠল,
'আমি জানি আপনি সেদিন আমার শাড়ি পাল্টাননি। চুমকি বলেছে।'

শুদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছনে ধারার দিকে ঘুরে ঠোঁটের রেখা প্রসারিত করে মৃদু হাসির ঝলক তুলে বলল,
'বাহ! আপনাকে কেউ বলল আর আপনি সত্যিই নিজের থেকেই বিশ্বাস করে ফেলেছেন! অবিশ্বাস্য! না মানে এইবার আপনাকে কেউ বলে দেয়নি যে এটা বিশ্বাস যায় কি করা যায় না? একা একাই বিশ্বাস করে ফেললেন? ইমপ্রেসিভ!'

শুদ্ধ চলে গেল। আর সেদিকে তাকিয়ে ধারা সরু চোখে তাকিয়ে রইলো। দু তিন বাক্যের একটা কথাতেও ধারাকে কয়বার ঠান্ডা ভাবে খোঁচা মেরে দিল লোকটা। খোঁচা মারার একটা সুযোগও ছাড়তে চায় না। খোঁচা মারার রাজা যেন! এর নাম শুদ্ধ না রেখে খোঁচারাজ রাখা উচিত ছিল। ধারা বিরবির করে বলে উঠলো, 'খোঁচারাজ!'

একটু পর ধারা শুদ্ধ'র দেওয়া একটা থ্রি পিছ পরিধেয় করে আরেকটা থ্রি পিছ আর গামছা হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। সকালে উঠার পর থেকেই কেমন যেন ভ্যাবসা গরম লাগছে। ভাবলো গোসলটা তাড়াতাড়িই করে নেয়া যাক! কিন্তু গোসলখানার সামনে যেতেই ধারা থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। গ্রামের বাড়ির কল। বেড়ার গায়ে দরজায় শুধু একটা কাপড়ের পর্দা ঝুলানো। বাড়ির আশেপাশের মানুষ জন একটু পরপরই এই আসছে আর যাচ্ছে। কেউ খাবার পানি নিতে আসে, কেউ জামা কাপড় ধুতে আসে। ধারার ভীষণ সঙ্কোচ হতে লাগলো৷ গ্রামে হলেও ওদের নিজেদের বাড়িটা পাকা দালানের। ঘরের মধ্যেই পাকা বাথরুম, গোসলখানা। ছোট বেলা থেকেই তাই ব্যবহার করে আসছে সে। এখন হঠাৎ করে এমন খোলা গোসলখানায় গোসল করতে ধারার কেমন যেন লাগছে। গোসল করার সময় যদি কেউ এসে পড়ে! গ্রামের মহিলাদের কাছে এসব তো আবার কোনও ব্যাপারও না। এরা একজনের গোসলের মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে। যদিও মেয়েরা মেয়েরাই। তবুও ধারার তো অভ্যেস নেই এসবের। ও'র ভীষণ অস্বস্তি হয়। শুদ্ধ বাড়ির পাশে ঐ চারাটা লাগিয়ে ক্ষেতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ধারাকে এভাবে কলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হয়তো কিছু বুঝতে পারলো। ক্ষেতে যাওয়া বাদ দিয়ে তাই সে ধারার কাছে এসে বলল, 
'ধারা, কোন সমস্যা?'

হঠাৎ শুদ্ধ'র কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ধারা খানিকটা চমকে উঠলো। তাকিয়ে বলল, 
'না। কিছু না।'

শুদ্ধ একবার গোসল খানার দিকে তাকিয়ে কিছু ভেবে বলল, 'আপনার ওড়নাটা দেখি, দিন তো।'

ধারা ও'র গায়ের ওড়নাটা হাত দিয়ে চেঁপে ধরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, 'কি?'

ধারা কি ভেবেছে বুঝতে পেরে শুদ্ধও একটু লজ্জাবোধ করে দ্রুত বলল, 'আরে! আপনার হাতের ওড়নাটার কথা বলেছি। যেটা গোসলের পর পড়বেন। গায়ের ওড়নার কথা বলিনি।'

ধারা ভীষণ লজ্জা পেলো। আনত মুখে হাতের সুতি ওড়না টা শুদ্ধ'র হাতে দিল। ওড়না নিয়ে শুদ্ধ টিনের বেড়ার পর্দা ভালো মতো টেনে দিয়ে তার উপর আবার ওড়না দিয়ে দিলো। পর্দার কোনা টেনে টিনের বেড়ার গায়ে আটকে দিলো যাতে বাতাসে না উড়ে যায়। তারপর ধারাকে বলল,
'এখন বাইরে থেকে কিছুই দেখা যাবে না। আপনি যান। কেউ আসবে না। আসলে আমি মানা করে দিবো। আপনার গোসল না হওয়া পর্যন্ত আমি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো।'

'না থাক! আপনি শুধু শুধু কষ্ট করে....!'

ধারাকে থামিয়ে দিয়ে শুদ্ধ আবারও বলল,

'আপনি যান।'

ধারা আর কিছু বলল না। গোসলখানার ভেতরে গিয়ে হাতের জামা কাপড় টিনের বেড়ার উপরে রেখে দিল। বেড়া ভালোই উঁচু করে দেওয়া। বাইরে থেকে তাকালে শুধু ধারার চোখ দেখা যাবে এমন। মাথার উপর খোলা আকাশ। দিনের আলোতে ভেতরটা একদম ফকফকে উজ্জ্বল। ধারার জন্য এমন পরিবেশ একেবারেই নতুন। ও'র ভীষণ লজ্জা হতে লাগলো। নিজেকে অনাবৃত করে লাজুক মুখে ওঁ একবার বাইরে শুদ্ধ'র দিকে তাকালো। হাতে একটা ডাল নিয়ে আনমনেই লোকটা নিচের দিকে তাকিয়ে মাটিতে আঁকিবুঁকি করছে। তখন থাকতে মানা করলেও শুদ্ধ থেকে যাওয়ায় ধারার কাছে ভালোই লেগেছে। একটু আশ্বস্ত তো হতে পারলো। এরপর অনেকটা সময়ই কেটে যায়। ধারা যখন বসে বসে বালতি থেকে মগ দিয়ে গায়ে পানি ঢালছিল তখন হঠাৎ ও'র কানে আসে কারো পায়ের শব্দ। মনে হচ্ছে যেন গোসল খানার দিকেই এগিয়ে আসছে সে। ধারা খেয়াল করলো অনেকক্ষণ ধরেই শুদ্ধ'র কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এতক্ষণ তো তবুও গাছের ডালের নাড়াচাড়ার খানিক শব্দ আসছিল। এখন তো ঐ পায়ের শব্দ ছাড়া সবই নিশ্চুপ। শুদ্ধ কি তবে চলে গেল? কে আসছে কে জানে! পায়ের শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে অনেকটাই কাছে চলে এসেছে। আতঙ্কে জমে গিয়ে ধারা সিমেন্টের পাকা থেকে ভেজা জামাটাই গায়ে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক তখনই ও'র কানে আসে শুদ্ধ'র কণ্ঠ। শুদ্ধ কাউকে বলছে,
'ভাবী, প্লীজ এখন যাবেন না। ধারা গোসল করছে। একটু পরে আসুন।'

পাশের বাড়ির বড় বউ নাজমা কাঁধ থেকে কলসিটা নামিয়ে রেখে বলল, 'তাতে কি হইছে ভাই? আমি কি পুরুষ মানুষ নাকি! আমি গেলে কি অসুবিধা? পানিটা যাইয়া নিয়া আসি গা। বেশিক্ষণ লাগবো না।'

কথাটা বলে নাজমা আবারও কলসি নিয়ে এগোতে নিল। শব্দ পেয়ে ধারা জামা পেঁচিয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। শুদ্ধ তাড়াতাড়ি নাজমাকে আটকে বলল, 'না ভাবী। একটু পরে আসুন প্লীজ। ধারা লজ্জা পায়। আসলে ও'র অভ্যেস নেই তো। আপনি না হয় কলসটা রেখে যান। দরকার পড়লে আমি গিয়ে পানি ভরিয়ে আপনাকে দিয়ে আসবো।'

নাজমা ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বলল, ' ও...বুঝলাম এখন ভাই, তুমি তাইলে দাঁড়ায় দাঁড়ায় বউরে পাহাড়া দিতাছো। বউরে একলাই একলাই দেখবা। অন্য কাউরে আর দেখতে দিবা না!'

ভেতর থেকে ওদের কথা শুনে ধারা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। শুদ্ধ আর কি বলবে? এখন যে করেই হোক নাজমার গোসলখানায় যাওয়া আটকাতে হবে। অন্য ভাবে কিছু বললে আবার সেটা নিয়ে মাইন্ড করে বসতে পারবে। তাই নাজমার কথাতেই তাল মিলিয়ে মুখের হাসি প্রসারিত করে লাজুক ভাব ধরলো। নাজমা দুষ্টুমির ছলে বলতেই লাগলো, 
'আচ্ছা তাইলে আমি যাই। তোমার আর আমারে কষ্ট কইরা পানি ভইরা দিতে হইবো না। আমি কলস নিয়াই যাই। দেবর গো দিয়া কি আর এতো কাজ করাইতে পারি! তুমি না হয় তোমার বউরেই পাহাড়া দাও।'

নাজমা চলে যাওয়ার পর আরো দু তিন জন মহিলা এলো। সবাইকেই একইভাবে আটকালো শুদ্ধ। শেষমেশ সবাইকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে শুদ্ধ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ধারা মৃদু হাসলো। না! মানুষটা কথা দিয়ে কথা রাখে। ধারাকে একা ফেলে যায়নি। একে বিশ্বাস করাই যায়।




চলবে*******
===========================
পড়তে থাকুন  চটি গল্প এ-র পাশা-পাশি ভিন্ন ধরনের গল্প ✒।


Keep reading chatty stories as well as different types of stories✒.



( Post By- Kam Pagol) 

Like Reply




Users browsing this thread: 1 Guest(s)