Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
22-05-2020, 09:47 AM
(This post was last modified: 05-01-2021, 10:50 AM by Buro_Modon. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
I'm posting a collected story from an unknown author also this is one of my fav story that I have read in some other platform, can anyone help me to get the full story as I get only an incomplete version.
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মত খবরের কাগজটা তন্ন তন্ন করে খুঁজছিলাম। মা বলল, ‘আজ তো খবরের কাগজ দেবে না রে খোকা। কাল যে ছুটী ছিল তোর খেয়াল নেই?’ সত্যি তাই। কাল যে ছুটী ছিল একেবারেই ভুলে গেছি। ২৬শে জানুয়ারী, প্রজাতন্ত্র দিবস। সর্বভারতীয় ছুটী। আগামীকাল এই প্রত্রিকার কোন সংষ্করণ প্রকাশিত হবে না। হেড লাইনটা দেখেছি, কিন্তু একেবারেই মনে নেই।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চা খেতে খেতে খবরের কাগজটা পড়ি। রোজ একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাগজ পড়ার অভ্যাসটা আমার চিরদিনের। রাজনীতি থেকে খেলাধূলা। কোথায় কি ঘটেছে, সব যেন একবার ভাল করে চোখ বুলোনো চাই। কাগজ পড়ে তারপর স্নানে ঢুকি। অফিসে যাওয়ার তাড়া থাকে বলে, লেখালেখিগুলো সকালের দিকে একদমই হয় না। তরকারীর সাথে দুটো রুটি। মুখে কিছু দিয়েই অফিসের জন্য তারপরে আমাকে বেরোতে হয়।
ভাবছিলাম, স্নানটা তাহলে সেরে নেব কিনা? আজ একবার শুভেন্দুর বাড়ী যেতে হবে। কি জানি, এতদিন পরে আমাকে কেন ডেকেছে শুভেন্দু? অফিস থেকে বেরিয়ে পিকনিক গার্ডেনে যেতে একঘন্টা সময় লাগবে। শুভেন্দু বলেছে ‘‘ঠিক সাতটার মধ্যে আসবি। তোর জন্য অনেক সারপ্রাইজ আছে।’’
পুরোন দিনের স্মৃতিগুলো এখনও যখন মনে পড়ে, ভালো লাগে। সেদিনের সেই উচ্ছ্বল, আনন্দমুখর জীবন, আর আজকের কর্মব্যস্ত জীবনের মধ্যে যেন কত ফারাক। কোথায় হারিয়ে গেল সেই দিনগুলো। মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে সেই চেনা পরিচিত মুখগুলো। শুভেন্দু, শুক্লা, সৌগত, মিনু আর রনি। আর সাথে বিদিশা তো আছেই।
জানি না ওরা এখন সব কোথায়। বিদিশা বিয়ে করে মুম্বাই চলে গিয়েছিল। ওর স্বামী ওখানে ভালো কোম্পানীতে চাকরি করে। সৌগতও বিয়ে করল। বউটা ভারী মিষ্টি। মুখটা একেবারে প্রতিমার মত। বিয়েতে আমাদের সবাইকে নেমতন্ন করেছিল। সবাই আমরা গিয়েছিলাম। যাইনি কেবল বিদিশা। সেদিন ওকে খুব মিস করেছিলাম। শেষবারের মতন দেখতে চেয়েছিলাম। সে সুযোগ আর হয় নি। বিদিশা সৌগতকে কথা দিয়েছিল, বিয়েতে আসবে, তাও আসেনি। হয়তো আমারই জন্য। বুকের মধ্যে চাপা এক দূঃখ নিয়ে গুমড়ে গুমড়ে অনেকদিন মরেছি বিদিশার জন্য। ভেবেছিলাম, শেষবারের মতন ওকে একবার দেখব। বিদিশাকে উইশ করব। ওকে বলব, ‘‘বিদিশা, তোমার বিবাহিত জীবন সুখময় হোক। দেবকে চটকরে ভুলে যেতে তোমারও হয়তো কষ্ট হবে জানি। কিন্তু কি করবে? এটাই তো জীবন। আমিও তোমার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে আর বাঁচতে চাই না। যা হয়েছে এটাকেই ভাগ্যের পরিহাস বলে আমি মেনে নেবো। তুমিও তাই মেনে নাও।’’
সেদিন শুভেন্দু আমাকে বলেছিল, ‘‘সত্যি দেব, তোর জন্য আমার দূঃখ হয়। মিনুটা যে কি করল। সবকিছু জেনেও ও তোর ক্ষতিটা করল। বিদিশা তোকে ভুল বুঝল। যখন সত্যিটা জানতে পারল। তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।’’
ভালবাসার খেসারত দিতে দিতে একদিন ভালবাসাটাই এভাবে মিথ্যে হয়ে যায়। জানি বিদিশা আমাকে হয়তো ক্ষমা করে দেবে। কিন্তু ওকে কি আমি সত্যি ভুলে যেতে পারব? কখনই নয়। আমি তো প্রেম কি তাই জানতাম না জীবনে। বিদিশাই শিখিয়েছিল হাতে হাত ধরে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কখনও কলকাতার রাজপথে, কখনও ভিক্টোরিয়ায়, কখনও ইডেন গার্ডেন এ কিংবা গঙ্গার পাড়ে, দুজনের ভালোবাসার একে অপরকে পাওয়ার আনন্দ এক অনুভূতি। যেন এক আচ্ছন্ন করা তীব্র সুখ। সেদিন বিদিশা আমাকে বলেছিল, ‘‘আমাকে ছাড়া ‘দেব’ তুমি কোনদিন সুখী হতে পারবে না জানি। আর আমিও তোমার সঙ্গ ছাড়া কোনদিন সুখে থাকতে পারবো না। জেনে রেখো বিদিশা যদি দেবকে কোনদিন কাছে না পায়, তাহলে বিদিশা মরে যাবে।’’
বিদিশার সেদিনের সেই কথাগুলো আজও আমার মনে আছে। দুনিয়াটা এরকমই। কেউ কারুর জন্য মরে না। অথচ সবাই নাকি মরতে চায়। এই আমি কেমন দিব্যি বেঁচে আছি। বিদিশাও হয়তো তাই। মরার কথা তুলে ভালবাসাটাকে সেদিন হয়তো আরো শক্ত মজবুত করতে চেয়েছিল বিদিশা। কিন্তু ও আর আমি, কেউ আমরা ভালবাসাটাকে ধরে রাখতে পারিনি। সন্দেহ, অবিশ্বাস, বিদিশার মনটাকে ছাড়খাড় করে দিয়েছিল। ভেবেছিল, আমি বুঝি ওর প্রতি আর আসক্ত নই। কলেজে আমাদেরই সহপাঠিনী ‘মিনু’ তখন আমার প্রেমে মত্ত। বিদিশার কাছ থেকে মিনু আমাকে ছিনিয়ে নিতে চায়। যে কোন মূল্যে মিনু হাসিল করতে চায় আমাকে। সেদিনের সেই বর্ষামুখর কালো রাত। মিনু নির্লজ্জ্বের মতন একটা কান্ড করে বসল। আর তা দেখে বিদিশাও হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। হারিয়ে গেল প্রেম। পড়ে রইল কিছু টুকরো স্মৃতি। জীবনের সেই ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যদি অধ্যায়কারে লিখতে বসি, তাহলে একটা বড় উপন্যাস তো হবেই। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ভাবছি, তাহলে শুরু করি আজ থেকে। দেখাই যাক না শেষপর্যন্ত কি হয়।
মা বলল, কি রে খোকা? জল গরম করবি না? নাকি এই ঠান্ডা জলেই চান করবি? সর্দি লেগে যাবে যে। সকালবেলা গানের রেওয়াজে অসুবিধে হবে।
ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিন একঘন্টা গানের রেওয়াজ করি। একথাটা বলা হয় নি। ক্ল্যাসিকাল গানের চর্চাটা যেটা শুরু করেছিলাম। আজও রয়ে গেছে। বাবা বলতেন, পড়াশুনা ছাড়া, একমাত্র গানের মধ্যেই মা সরস্বতীকে পাওয়া যায়। তোর গলা এত ভালো, রেওয়াজ কোনদিন ছাড়িস না। বাবা আজ নেই, কিন্ত তাঁর কথাটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছি। মনে পড়ে বিদিশা, কলেজে আমার গান শুনেই কেমন পাগল হয়ে গিয়েছিল আমার প্রতি। ও বলেছিল,তোমার গলা এত মিষ্টি। মনে হয় ঠিক যেন মধু ঝরে পড়ছে গলা দিয়ে।
শুধু বিদিশা কেন? অনেক মেয়েকেই গান শুনিয়ে তাদের মন জয় করে নিয়েছিলাম। তারা সবাই যে আমার সাথে প্রেম করতে চেয়েছিল তা ঠিক নয়। আসলে বিদিশা জীবনে এসে যাওয়াতে, অন্যকারুর প্রেমিক হতে আমারো ঠিক মন চায়নি। ভালবাসা আর প্রেমটা ছিল স্বচ্ছ, গাঢ়। একে অপরকে অঙ্গীকার করার মতন। একটা মেয়েকে ভালবেসে, তার জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে আমিও চাই নি। প্রেমের মধ্যে কোন দাগ ছিল না। আমার ভালোবাসায় কোন ছল ছিল না। প্রগাঢ় ভালবাসায় কলঙ্ক যেটা এল, সেটা শুধু মিনুর জন্য। মিনুও আমার গানের পাগল ছিল। বিদিশাকে জব্দ করার জন্যই ও এই খেলাটা খেলল।
কলেজের পরে মিনুর সাথে অনেকবারই দেখা হয়েছে। এই কবছরে মিনু যেন আরো অনেক পাল্টে গেছে। ওকে এখন দেখলে মনে হয়, পুরুষ ধরায় ও যেন গিনিসবুকে নাম তুলতে চলেছে। আমার পরেও কত ছেলেকে ফাঁসানোর চেষ্টা করল। সঙ্গী বদলানোর তাগিদে চার চারটে বিয়েও করল। কিন্তু কারুর সাথেই সেভাবে কোনদিন একাত্ম হয়ে ঘর করতে পারল না। মিনু বলতো, আমি এখনও রাইট পার্টনারটাকে খুঁজছি। যেদিন পাবো, সেদিন আমি এই খেলাটা ছেড়ে দেবো। বছর তিনেক আগে মিনুর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। তখন ও যে লোকটার সাথে আমায় আলাপ করিয়েছিল,সেটা ওর ফোর্থ হাজব্যান্ড। ভদ্রলোক নাকি দুবাইতে অনেকদিন ছিলেন। পয়সাওয়ালা। মিনু তাকে ফাঁসিয়েছে এবং দিব্যি ঘর করছে তার সাথে। এরপরে অবশ্য মিনুর খবর আর জানিনা।
শুক্লা মেয়েটা একটু অন্যস্বভাবের। সৌগতর সাথে ও কিছুদিন ভাব করল আমার আর বিদিশার মতন। তারপর সৌগত বিয়ে করল। শুক্লাও বিয়ে করে নিল আরএকজনকে। পরে শুনেছিলাম, সৌগতকে বিয়ে করা নিয়ে নাকি মত দেয়নি শুক্লার বাবা মা। অথচ ভাগ্যের এমনই পরিহাস। একবছর ঘুরতে না ঘুরতেই, শুক্লার সাথে ওর স্বামীর ছাড়াছাড়ি। এখন শুনেছি, শুক্লা নাকি একা থাকে। সল্ট লেকে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। ব্যাঙ্কে ভালো চাকরি করে বলে লোন পেতে নাকি অসুবিধে হয় নি। সৌগতর বিয়েতে শুক্লাও এসেছিল। দেখলাম পুরোনো অ্যাফেয়ারটা ভুলে গেছে ওরা দুজনেই। বিয়েবাড়ীতে শুক্লাকে পেয়ে সৌগত স্বাভাবিক। শুক্লাও তাই। যেন দেখে মনে হবে না। এই দুজনেও আমার আর বিদিশার মতন হাত ধরাধরি করে ভিক্টোরিয়াতে ভিজেছিল একদিন। সেদিন শুভেন্দু আমাদের চারজনকে দেখে হাসতে হাসতে ভিক্টোরিয়ার ভেতরটায় পুকুরটায় পড়ে গিয়ে কিছুতেই আর উঠতে পারে না। পরে জেনেছিলাম, ও জলকে ভীষন ভয় পায়, সাঁতার জানে না। আমাকে বলল, ‘‘কি করব? তোদের যা রকম দেখলাম, হাসতে হাসতে পা পিছলে পুকুরটার মধ্যে পড়ে গেলাম। জলের মধ্যে পড়ে গিয়ে দেখি, আর কিছুতেই উঠতে পারি না।’’
আমি আর সৌগত দুজনে শুভেন্দুর হাত ধরে ওকে টেনে তুলেছিলাম জল থেকে। আসলে বিদিশা বৃষ্টিতে মাথা বাঁচানোর জন্য ওর শালোয়ারের ওড়নাটা আমার মাথায় দিয়েছিল। ওড়নার তলায় আমি আর বিদিশা তখন একটু একে অপরকে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করছি। তাই দেখে সৌগত আর শুক্লাও তাই করতে লাগল। শুভেন্দু গিয়েছিল বাদাম কিনতে। ফেরার পথে ওড়নার তলায় আমাদের চারজনকে চুমোচুমি করতে দেখে ও হেসে অস্থির। প্রথমে আনন্দে কিছুটা নাচতে চেষ্টা করল। তারপর হেসে একেবারে কুতিয়ে পড়ছে। সেই সময়ই পা পিছলে একেবারে পুকুরের জলে। আমি আর সৌগত ছুটে গেলাম। বিদিশা বলল, ধরো ধরো ওকে ধরো। যা আজকে করলো। সব আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল।
মনে পড়ে সেই সব দিন। আজও ভাবি পুরোনো দিনগুলোতে একবার যদি ফিরে যেতে পারতাম। যদি বয়সটা কমে গিয়ে আবার সেই কলেজের দিনগুলোর মতন হৈ চৈ আর মাতামাতিতে মেতে উঠত। আনন্দ আছে, আছে হূল্লোরবাজী, ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যান্টিনে কেটে যাওয়া, কফি হাউসের বড় টেবিলটাকে দখল করে দেদারে ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের প্রানখোলা আড্ডা মারা। এছাড়া প্রতি শুক্রবার নতুন কোন ছবি রিলিজ করলে, অ্যাডভান্স টিকিট কেটে আবার দেখা চাই। হিট ছবির গানগুলো আমি ক্যান্টিনে বসে গাইতাম। মাঝে মাঝে প্রিন্সিপাল ওপর থেকে নিচে নেমে আসতেন। আমাকে বলতেন, ‘‘দেব তোমার গলা ভালো আমি জানি, তা বলে পড়াশুনাটাও তো মন দিয়ে করো। সামনে বি এস সি ফাইনাল পরীক্ষা। তুমি যে কি রেজাল্ট করবে, আমার তোমাকে নিয়ে বড় চিন্তা হচ্ছে।’’
আমি এক চান্সে বি এস সি পাশ করেছিলাম ঠিকই। তবে কলেজ ছেড়ে দেবার পর ক্যান্টিনের ভেতরটা পুরো বদলে গিয়েছিল। সরস্বতী পূজোয় একবার করে যখন যেতাম। তখন দেখতাম ক্যান্টিনের ভেতরে কাঠের টেবিলগুলো আর নেই। ওখানে সব বাঁধানো সিমেন্টের টেবিল হয়ে গেছে। আসলে আমার গানের সাথে টেবিল বাজিয়ে এমন নাচানাচি হত, আওয়াজটা প্রিন্সিপালের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যেত। আমাকে উনি বকা দিতেন, আবার ভালও বাসতেন। কারন কলেজের প্রতিবছরের কালচারাল প্রোগ্রামটা, আমাকে বাদ দিয়ে যে হত না। ঐ প্রোগ্রামে আমি নিজে গাইতাম সবার প্রথমে। ভাড়া করা যারা আর্টিস্টরা আসত। তারা একে একে সব গেয়ে চলে যেত। কিন্তু আমাকে প্রোগ্রামের শেষেও অনেকের আবদার মেটাতে হত। কিসব ছিল সেইসব দিন। পুরোন দিনগুলোর কথা মনে পড়লে বড় অদ্ভূত লাগে। ভাবি মানুষের জীবনটা অনেক স্বল্প দৈর্ঘ্যের। আনন্দটা কম, কষ্টটা বেশী হয়তো সেই জন্যই।
শুভেন্দু বলেছিল, ‘‘তুই বড্ড বেরসিক হয়ে গেছিস দেব। একা একা থাকিস, মাঝে মধ্যে সময় কাটাতে আমাদের কাছে তো আসতে পারিস। কি এক বিদিশাকে তুই ভালবেসে জীবনটা শুধু ওর স্মৃতিতেই কাটিয়ে দিলি। মেয়েদের মন বোঝা যে বড় শক্ত। দেখতো আমাকে, কাউকে ভাল না বেসে কেমন দিব্যি আছি আমি। ভাগ্যিস বিদিশার মত আমার জীবনে কেউ আসেনি। প্রেম যারা করে তারা সব মুর্খ হয়। পৃথিবীতে প্রেমের মত বোকামি আর কিছুতেই নেই। তুই না মানলেও আমি এটা প্রবলভাবে মানি। যারা তোর মত সারাদিন কেবল লেখালেখিতে ডুবে থাকে, তারাও দেখ, হয়তো তোরই মতন। কাউকে ভালবেসে বিফল হয়ে এখন এটাকেই জীবনের সঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়েছে। মাঝে মধ্যে একটু আড্ডাতে তাই আয়। ফুর্তীর আসর জমাই। গল্পগুজব করি। সাথে হূইস্কি কিংবা রাম অথবা ভদকা তো আছেই। তুই এলে আমার রনির দুজনেরই খুব ভালো লাগবে।’’
শুভেন্দুর পিকনিক গার্ডেনের বাড়ীতে বেশ কয়েকবার গেছি। আমার মত শুভেন্দুও এখনো বিয়ে করেনি। প্রতি শনি রবিবার নিয়ম করে ‘রনি’ ওর কাছে যায়। কলেজের সময় থেকেই রনির সাথে শুভেন্দুর একটা আলাদা খাতির ছিল। রনি বিয়ে করেছে শুভেন্দুরই বোন মাধুরীকে। ওদের এখন শালা জামাইবাবুর সম্পর্ক। আমাকে পেলে দুজনেই মিনু আর বিদিশার কথা তুলে প্রথমে একটু হাসি ঠাট্টা মশকরা করত। তারপর আর করে না। বিদিশাকে রনি একবার ঠাট্টা করে কলেজে বলেছিল, ‘‘দেবকে দেখে আমার খুব হিংসে হয়। তুই কি দেখে দেবের প্রেমে পড়লি বলতো? কেন? পাত্র হিসেবে আমি কি খারাপ ছিলাম? তোকে রাজরানী করে রাখতাম। নে এবার দেবকে বাতিল করে দে। কালীঘাটে গিয়ে দুজনে মালা দিই। আর দেবকে বলি, বিদিশা তোর সাথে প্রেম করে ভুল করেছিল, এখন পস্তাচ্ছে। তাই ওকে আমি বিয়ে করে নিলাম।’’
বিদিশাও কম যায় না। রনিকে বলেছিল, ‘‘শুভেন্দুর বাড়ীতে কার টানে তুই যাস, সেকী আমি আর জানি না? শুধু শুধু মেয়েটার মাথা খাচ্ছিস। আগে ওকে যে প্রতিশ্রুতি গুলো দিয়েছিস, সেগুলো পালন করার চেষ্টা কর। তারপর তোকে বলব, কেন আমি দেবের সাথে প্রেম করি। সত্যিকারের ভালোবাসা দেব রাখতে জানে। ও যদি কাউকে কথা দেয়, সেকথা ও রাখতে জানে।’’
রনি বলেছিল, ‘‘দেবকে নিয়ে তুই এত আদিখ্যেতা করিস কেন বলতো বিদিশা। পৃথিবীতে বুঝি দেবই একা ভালবাসতে জানে। আমরা কেউ ভালবাসতে জানি না?’’
বিদিশা বলেছিল, ‘‘মাধুরীকে কি তুই সত্যি ভালবাসিস?’’
রনি বলেছিল, হ্যাঁ।
বিদিশা বলেছিল, ‘‘তাহলে আবার আমার পেছনে পড়ছিস কেন? তার মানে তোর ভালবাসাটা মেকী। ওর মধ্যে কোন স্বচ্ছতা নেই। ঠিক আছে শুভেন্দুকে আমি বলছি, ও ঠিক জুতো পেটা করবে তোকে। বোনের সাথে প্রেম করা। মজা বার করে দেবে তোর।’’
সবই ঠাট্টার ছলনে কথাগুলো বলা। বিদিশা জানতো, রনি ইয়ার্কী মারছে, রনিও তাই। কেউ কারুর কথা গায়ে মাখেনি। শেষ পর্যন্ত শুভেন্দু বোন মাধুরীকে বিয়ে করে রনি প্রতিশ্রুতি পালন করল। আর বিদিশার বলা কথাগুলো আমি রাখতে পারলাম না। জানি না হয়তো আমারই দোষে। মিনুকে বিশ্বাস করেছিলাম। মিনু সেই বিশ্বাসের মর্যাদা আমার রাখতে পারেনি। শুধু কয়েকটা ভুলের দোষে বিদিশা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল।
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
মা বলল, কি রে দেব? তুই কি আজকে অফিস যাবি না? সকালে উঠেই লেখালেখি করতে শুরু করে দিয়েছিস, অফিস যাবি কখন? নটা তো বেজে গেল। এরপরে কখন আর চানে যাবি, আর কখন তৈরী হবি? তোকে তো দেখে মনে হচ্ছে অফিস যাবার তোর আজ কোন তাড়া নেই।
মাকে বললাম, ‘না গো মা। অফিস তো যাবই। তাছাড়া আজ আবার শুভেন্দুদের বাড়ীতেও আমাকে একটু যেতে হবে। ও বলেছে সাতটার পরে আসতে। ভাবছি অফিস থেকে বেরিয়েই তারপর সোজা ওখানেই-
মা বলল, শুভেন্দু? এতদিন পরে? কেনরে? হঠাৎ তোকে ডাকলো?
মাকে বললাম, কারনটা আমিও জানি না মা। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, শুভেন্দু বলেনি। শুধু বললো, তোকে যখন ডেকেছি, ব্যাস তোকে আসতেই হবে। আর আমি কিছু শুনতে চাই না। সাতটার পরে আসবি, আজ তোর জন্য এখানে অনেক সারপ্রাইজ আছে।
শুভেন্দু বলেছে, অথচ আমি ওর ডাকে যাইনি, এমন খুবই কম হয়েছে। শুভেন্দু আমাকে একসময় অনেক হেল্প করেছিল। ব্যাবসা করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতিতে, দেনায় একসময় ডুবে গিয়েছিলাম। শুভেন্দু আমাকে বেশ কিছু টাকা ধার দিয়ে তখন বাঁচিয়েছিল। দেনাগুলো শোধ করেছি, ওকেও একটু একটু করে ওর দেওয়া পুরো টাকাটাই শোধ করেছি। শুভেন্দুর করা উপকার জীবনে কোনদিন ভুলতে পারব না। একমাত্র কলেজের পরে ওই আমার সাথে যোগাযোগটা রেখেছিল। পিকনিক গার্ডেনে চারতলা শুভেন্দুদের বিশাল বাড়ী। শুভেন্দুরা চার ভাই। শুভেন্দু তার মধ্যে ছোট। বড়ভাই ওকালতি করেন, মেজভাই ডাক্তার। আর সেজ ভাইয়ের দীপেন্দুর সাথে শুভেন্দু জয়েন্টলি প্রোমোটারি ব্যাবসা করে। ওদের একটা মাত্র বোন মাধুরীকে বিয়ে করল রনি। এদিক দিয়ে রনি খুব লাকি। আসলে রনিদের আবার বড়বাজারে বিশাল বিল্ডিং মেটারিয়ালের দোকান। রনি যখন কলেজে পড়ে, তখন ওর বাবা দোকানটা চালাতেন। বিশাল ব্যাবসা। রনি দায়িত্ব নিল কলেজ পাশ করার পর। সেজভাই দীপেন্দু আগে থেকেই প্রোমোটারি লাইনে ছিল। শুভেন্দুও এবার তার সাথে যুক্ত হল। এদিকে রনির সাথে শুভেন্দুর ব্যাবসায়িক এবং কলেজের বন্ধুত্বের গাঢ় সম্পর্ক। রনি তখন থেকেই শুভেন্দুর বাড়ীতে যাতায়াত শুরু করল। মাধুরীকে দেখে রনির প্রেম। তারপরেই বিয়ে করল মাধুরীকে। রনির বিয়েতে আমরা সবাই গিয়েছিলাম। বিদিশাও এসেছিল। তার ঠিক পরের দিনই বিদিশা আমাকে ছেড়ে চলে যায়। বৌভাতে বিদিশা যায় নি। বলেছিল, ‘দেব’ যেখানে থাকবে, সেখানে কোনদিন যাব না। ও ভীষন পাপী। মিনুকে নিয়ে যা কান্ডটা ‘দেব’ করেছে, তারপর ওর মুখ দেখাটাও পাপ। আমি কেন যে ওকে ভালবেসে ভুলটা করেছিলাম, সেটাই এখন বুঝতে পারছি। ভগবান আমার চোখ খুলে দিয়েছে।
রনি আর মাধুরীর বৌভাতে আমিও যাইনি। বিদিশার দূঃখে সারারাত অনেক কেঁদেছিলাম। ছেলে হয়ে কোন মেয়ের জন্য কাঁদছি। মা বলেছিল, তুই কি পাগল? যে বিদিশার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছিস?
মাকে বলেছিলাম, মা কষ্ট কেন পাচ্ছি, তুমি বুঝবে না। পৃথিবীতে ছেলেরাই শুধু দোষ করে আর মেয়েরা বুঝি সব ধোয়া তুলসী পাতা। বিশ্বাসটা অর্জন করতে অনেক সময় লেগে যায়, কিন্তু ভাঙতে একদিনও সময় লাগে না এটা যেমন সত্যি। তেমনি সত্যি আর মিথ্যের বিচার না করেই, কেউ কাউকে অবিশ্বাস করতে একমূহূর্তও সময় নেয় না। এটাও কি সহজে মেনে নেওয়া যায়? বিদিশা আমার সাথে কেন এমন করল? ও যদি সত্যিটা একবার অন্তত তখন আমার কাছে জানতে চাইত, তাহলে হয়তো-
যখন জানলো, তখন যে অনেক দেরী হয়ে গেছে।
বিদিশাকে আমার মা যতবারই দেখেছে, বিস্মিত হয়েছে। মা আমাকে বলতো, এই মেয়েটার মুখ চোখ খুব সুন্দর। দেখে মনে হয় ওর স্বভাবটাও কত মিষ্টি। আজকাল এমন মেয়ে তো পাওয়াই যায় না। কি রূপ, সুন্দর মুখশ্রী ওর। ভগবান যেন আলাদা তুলি দিয়ে ওকে গড়েছেন। ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, কলেজে ওই বোধহয় সবচেয়ে সুন্দরী। এত ভালো স্বভাবের মেয়েটা। ওকি তোকে সত্যিই ভালবাসে?
আমি বলতাম, মা, বিদিশা শুধু সুন্দরী নয়। ওর মনটাও খুব ভাল। একেবারে ফুলের মতন নরম। বিদিশার পক্ষে আঘাত সহ্য করা তাই খুব কষ্ট। ও বলে, ‘‘জানোতো ‘দেব’, তোমার কাছ থেকে কোনদিন তো আমি আঘাত পাব না। তাই তোমার সাথে প্রেম করতেও খুব নিশ্চিন্ত বোধ করি। কি জানি অন্যের মনে কি আছে? তুমি খুব সরল। তোমার এই সরল মনটাই আমার সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে। তাই তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি, ভাবি পৃথিবীতে ‘দেব’ বলে বোধহয় একজনই পুরুষ আছে, যে বিদিশার মনটাকে বুঝবে, তাকে ঠকাবে না। কোনদিন বিদিশাকে ছেড়ে দেব চলে যাবে না।’’
কলেজে বিদিশা সবসময় শাড়ী পড়ে আসত। কলেজ ছুটীর পরে আমরা দুজনে ঠিক দুঘন্টা একসাথে ঘুরতাম। কখনও কলেজ স্কোয়ারে, কখনও লেবুতলা পার্কে। এছাড়া ছুটীর দিনগুলোতে ভিক্টোরিয়া, গঙ্গার ঘাট তো আছেই। বিদিশা বেশ কয়েকবার আমার বাড়ীতে এসেছে। মা’র সাথে প্রথম যেদিন আলাপ করালাম। ঢুপ করে মাকে একটা প্রনাম করে বসল। মা ওর থুতনীতে হাত রেখে আশীর্ব্বাদ করে বলল, বাহ্ তোমার মুখটা তো খুব সুন্দর। তুমি কি দেবের বন্ধু? না অন্যকিছু?
বিদিশা মুখ নিচু করে লজ্জায় হেসেছিল। আমাকে পরে বলেছিল, তুমি খুব দুষ্টু। মাকে বলোনি কেন? আমি তোমার কে?
বিদিশার গালে হাত রেখে বলেছিলাম, মা বাবাকে যেচে কখনও কিছু বলতে হয় না। ওনারা দেখলেই সব বুঝতে পারেন। মা যেমন তোমাকে দেখে বুঝে গেছে তুমি আমার কে?
বিদিশা আমাকে একবারই ওর বাসায় যেতে বলেছিল। সেদিন ওর জন্মদিন ছিল। তার আগে জানতাম না বিদিশারা খুব বড়লোক। ল্যান্সডাউনে বিশাল ওদের বাড়ীটা দেখে আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। রনি সেদিন টিপ্পনি কেটে আমায় বলেছিল, ওরেব্বাস, ‘দেব’, তুই কি লাকী রে। বিদিশারা এত বড়লোক, আমরা তো কেউ এটা আগে জানতাম না। কপাল করে তুই ই ওকে শুধু পেলি। না এর জন্য তোকে এবার একটা পার্টী দিতে হবে।
পার্টি আমি দেবো কি? সেদিন যা এলাহী ব্যাপার দেখেছিলাম, আমার মাথার ঠিক ছিল না। লোকে লোকারণ্য। যেন বিয়েবাড়ী। জন্মদিনেও এত অতিথির সমাগম হতে পারে, আমার ধারনা ছিল না। অত বড় বাড়ীতে গাদা গাদা লোকের মধ্যে, আমি যেন নেহাতই এক নগন্য অতিথি। চুপচাপ এক কোনে দাঁড়িয়ে বিদিশাকে একদৃষ্টে দেখে যাচ্ছিলাম। ও ঘোরাঘুরি করছিল, সবাইকে অ্যাটেন্ড করছিল। কিন্তু কিছুতেই একবারও আমার কাছে এসে কথা বলছিল না। কারুর সাথে আমার পরিচয়ও করিয়ে দিচ্ছিল না। হয়তো আমাকে সেদিন পরীক্ষা করেছিল বিদিশা। শুভেন্দুর সাথে একটা সিগারেট টানবো বলে সবে মাত্র বাইরে বেরিয়ে এসেছি। এমন সময় বিদিশাও বাইরে চলে এলো। আমাদেরকে বলল, ‘‘এখানে কি করছ? ও ফোঁকার জন্য বাইরে আসা হয়েছি বুঝি? এই শুভেন্দু চল শীগগীর ভেতরে চল। কেক কাটা হবে। তোদেরকে বাদ দিয়ে আমি কেক কাটতে পারছি না।’’ আমাকে বলল, ‘‘যেই একটু কথা কম বলেছি, অমনি রাগ হয়েছে বুঝি? চলো ভেতরে চলো। বাবা মা দুজনেই তোমাকে দেখেছে দূর থেকে। বলেছি, ‘দেব’ হচ্ছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। দেখোতো ওর সাথে কথা বলে, তোমাদের মেয়ে যাকে পছন্দ করেছে, সে একদম ঠিকঠাক হয়েছে কিনা?’’
বিদিশার বাবা মা আমার সাথে কথা বলবে? তার আগেই আমার হাত পা গুলো কেমন কাঁপছিল। শুভেন্দু বলল, ‘এই দেব, নার্ভাস হয়ে গেলি নাকি? চল চল ভেতরে চল। কেক কাটা হবে। বিদিশা নয়তো আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। মা,বাবা পর তোকেই ও ফার্স্ট কেকটা খাওয়াবে। এমন সুযোগ কিছুতেই মিস করিস না। চল।’’
বিদিশার মা বাবা খুব ভাল। দুজনেই খুব অমায়িক। কেক কাটার পর বিদিশা ঠিক আমার মুখেই প্রথম কেকটা গুঁজে দিল। তাই দেখে রনি আবার বলল, কিরে আমাদেরকেও খাওয়াবি না? শুধু দেবকে খাওয়াবি, আর আমরা বাদ?
সেদিন বিদিশার জন্মদিনে আমরা সবাই গিয়েছিলাম। শুধু মিনু বাদে। শুক্লা এসেছিল একটু রাতের দিকে। সৌগত, শুক্লা আসছে না দেখে ওর জন্য ছটফট করে মরছিল। কারুর সাথে কথা বলছে না, যেন মন মরা হয়ে বসে আছে। শুভেন্দু ওকে জিজ্ঞাসা করাতে বললো, ‘আমার ডারলিংটা আসছে না। খুব চিন্তা হচ্ছে।’
শেষ পর্যন্ত শুক্লা এলো। তবে অনেক দেরীতে। এসে বলল, সরি গাইস্। একটু লেট হয়ে গেল। বাড়ীতে মার শরীরটা খুব খারাপ। হঠাৎই জ্বর। আমি শুধু এলাম, বিদিশার জন্য। ও অনেক করে আসতে বলেছে। আর যাই হোক বিদিশার কথা তো আর চট করে কখনও ফেলা যায় না। পার্টিটা অন্যকারুর হলে হয়তো আসতাম না।
সৌগত তখন একটু মুখটা কাচুমুচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শুক্লা ওর দিকে তাকিয়ে আমাদের কে বলল, আর আমার এই হবু বরটা তো আছেই। ওর জন্য না এসেই বা যাই কোথায়?
সৌগতর মুখে হাসিগুলো কোথায় চলে গিয়েছিল। কথাটা শুনে ফিক করে সবকটা দাঁত একসাথে বের করে ফেললো।
সেদিন অনেক রাত্রি অবধি আমরা বিদিশাদের বাড়ীতে ছিলাম। ফেরার পথে সবাই মিলে আমরা একটা ট্যাক্সি ধরলাম। শুভেন্দু আর রনি এমনই বদমাইশ, সৌগতকেও পটিয়ে নিয়ে, ট্যাক্সিভাড়াটা আমাকে দিয়েই দেয়া করালো। ফেরার পথে আবার দোকান থেকে তিনবোতল বিয়ার কিনলো ওরা তিনজনে। সে পয়সাও আমি দিলাম। আমাকে বলল, ‘‘আজকি শাম, দেব আর বিদিশাকে নাম। এবার থেকে মাঝে মধ্যেই আমরা তোর আর বিদিশার খুশীতে পার্টি দেবো। আর সে খরচা পুরো তুই বীয়ার করবি। বিদিশার সাথে যতদিন তোর বিয়ে না হচ্ছে, এইভাবেই তুই আমাদের খুশি করে যা। বন্ধুদের খুশি করলে, আমরাও তোকে আশীর্ব্বাদ করব। প্রেমটা তাহলে আরও জমাট বাঁধবে। সুখে সংসার করতে পারবি।’’
সংসারটা হয় নি। তবে সত্যি জমাট বেঁধেছিল আমার আর বিদিশার প্রেমটা। প্রথম প্রথম ওকে অবশ্য বেশী পাত্তা দিতাম না। একদিন লাইব্রেরী রুমে বসে আছি। দেখলাম বিদিশা এসে ঢুকলো, তিনটে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। আমি যে টেবিলটায় বসে বায়োলজী পড়ছি, ও ঠিক তার পাশের টেবিলটাতেই বসে পড়ল ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে। আড়চোখে ও আমাকে দেখছে। আমি বইয়ের মধ্যে চোখটাকে নিবদ্ধ করে বসে আছি। কিন্তু বুঝতে পারছি মেয়েটা ঝারি মারছে আমাকে। বিদিশাকে ক্যান্টিনে দেখেছি, বেশ কিছুদিন ধরে। মূগ্ধ হয়ে ও আমার গান শোনে। কিন্তু আজকে হঠাৎ লাইব্রেরী রুমে আমার পাশে বসে এখানে কি করছে? ও এভাবে আড়চোখে দেখছেই বা কেন আমাকে? মনে হল, কিছু একটা মতলব নিয়ে এসেছে মনে হয়। কিছুক্ষণ বসে, আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে তারপর চলে গেল। একটু পরে শুভেন্দু এলো ওখানে। ওকে বললাম, মেয়েটাকে চিনিস?
শুভেন্দু বলল, কোন মেয়েটা বলতো?
-একটু আগে এখানে এসেছিল। আমাকে দেখছিল আড়চোখে। মেয়েটাকে কদিন দেখেছি ক্যান্টিনে। দেখতে বেশ ভালো। স্লিম ফিগার, লম্বা হাইট। চোখ মুখও খুব সুন্দর। কিন্তু আমার প্রতি ওর এত ছোঁক ছোঁক কেন? এত আগ্রহ নিয়ে দেখছিল, মনে হল-
শুভেন্দু বলল, কোন মেয়েটা বলতো? আমাদের ক্লাসের নিশ্চই নয়। তাহলে তুইও বুঝতে পারতিস। এ কলেজে সুন্দরী বলতে তো একজনই আছে। তুই যা বর্ণনা দিচ্ছিস, তাতে মনে হচ্ছে, ফার্স্ট ইয়ারের ওই মেয়েটা। কি যেন নাম। ওকে আমিও দেখেছি একদিন, ক্লাসে এসে তোর খোঁজ করছিল। তুই সেদিন কলেজে আসিস নি।
আমি অবাক হলাম। বললাম, আমার খোঁজ করছিল? কে বলতো? ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। এমন সুন্দরী মেয়ে এ কলেজে কে আছে? তুই কার কথা বলছিস?
শুভেন্দু বলল, প্রেমঘটিত কোন ব্যাপার মনে হচ্ছে। এ মেয়েটা তোর প্রেমে পড়ল না তো? কি রে দেব? এতো ভালোবাসার চক্কর বলে মনে হচ্ছে।
কলেজে এত মেয়ে। আমি তো কারুর সাথে কখনো প্রেম করিনি। শুভেন্দুকে বললাম, হেঁয়ালিটা ছাড়। ব্যাপারটা জানতে হবে। তুই ভাল করে খবর নিয়ে দেখতো মেয়েটা আসলে কে? দেব চটকরে কারুর সাথে ভীড়বে না।
শুভেন্দু আমার কথা মত কাজ করল। আমাকে বলল, তুই এখানেই বস। আমি এখুনি আসছি।
আমাকে লাইব্রেরী রুমে বসিয়ে রেখে ও চলে গেল। ফিরে এল আধঘন্টা পরে। আমাকে এসে বলল, এই ‘দেব’, ও তোকে ডাকছে, চল আমার সঙ্গে একটু তিনতলায় চল। ও সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে বলল, ওকে একটু ডাকবে? বলো, আমি ওর জন্য এখানে অপেক্ষা করছি।
আমি বললাম, মেয়েটা কে?
শুভেন্দু বললো, ওর নাম বিদিশা।
আমি একটু বিরক্ত হলাম। শুভেন্দুকে বললাম, কেন? আমি যাব কেন? কে না কে, বিদিশা আমাকে ডাকছে, আর ওর ডাকে আমাকে যেতে হবে? কিছু বলার থাকলে, ওকে বল, এখানেই আসতে। আমি তো লাইব্রেরী রুমেই বসে আছি।
শুভেন্দু ঠিক বুঝতে পারল না। আমাকে বলল, ‘‘যা বাবা। মহা হ্যাপাতো। তুই তো বললি, আমাকে যেতে। ও তোকে কিছু হয়তো বলতে চায়। চল না আমার সঙ্গে। তাহলেই বুঝতে পারবি।’’
আমি কিছুতেই গেলাম না। শুভেন্দুকে বললাম, ছাড় ওকে। ছেড়ে দে। পরে দেখা যাবে। ওর যদি দরকার থাকে, ও নিজেই আমার কাছে আসবে। আমি যাব না।
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
আসলে বিদিশাকে আমি খেলাতে চাইনি। কিন্তু কেন জানি আমার মনে হয়েছিল, কলেজের মেয়েগুলো সব বন্ধু হিসেবেই মেয়েগুলো সব ঠিক আছে। বেশী প্রেমের খেলা খেলতে গেলে মুশকিল। একেতো কলেজে এসে গান গেয়ে এমনই হীরো বনেছি, তাতেই পড়াশুনার বারোটা বাজছে। তারপরে আবার প্রেমে পড়লে, পড়াশুনা একেবারেই ডকে উঠবে। ভালো চাকরি পাওয়া তো দূর কেরানীর চাকরীও তখন জুটবে না কপালে। অতএব এসব বিদিশা টিদিশাকে যত দুরে রাখা যায় ততই মঙ্গল।
শুক্লা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। সেই শুরু থেকে ক্লাসে ও আর আমি পাশাপাশি বসতাম। শুক্লা আমার কাছ থেকে ফিজিক্স এর নোট নিত। আমার ডায়েরীর পাতাগুলো উল্টে পাল্টে দেখত। ভালো কিছু চোখে পড়লে, সঙ্গে সঙ্গে টুকে রাখতো। এদিকে সৌগত বেশ কিছুদিন ধরেই শুক্লার সাথে লাইন মারার চেষ্টা করছে। আমাকে বারবারই বলছে, দেব তোকে বিরিয়ানি খাওয়াবো। চাউমিন খাওয়াবো। তুই যা খেতে চাইবি তাই খাওয়াবো। শুধু শুক্লাকে তুই আমার হয়ে একবার রাজী করিয়ে দে। তারপর দেখ, তোকে আমি কেমন খুশি করি।
আমি সবই বুঝছি, দেখছি। কিন্তু শুক্লাকে বললেও শুক্লা কিছুতেই সৌগতকে পাত্তা দিচ্ছে না। একদিন কলেজে এসে শরীরটা আমার ভীষন খারাপ হল। গরমে প্রচন্ড বমি হচ্ছে। চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। প্রায় অজ্ঞান হবার মত অবস্থা হল। সবাই চোখে মুখে জল দিয়ে আমাকে ক্যান্টিনে একটু ছায়ার তলায় নিয়ে গেল। শুক্লার কোলে মাথা রেখে আমি তখন শুয়ে আছি। শুক্লা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তাই দেখে বিদিশা বুঝে গেল, আমি বোধহয় শুক্লার সাথে নিশ্চই প্রেম করি। ওর আমার প্রতি জেদটা আরো বেড়ে গেল।
আমি বিদিশাকে সাতদিন, আমার কাছে ভীড়তে দিইনি। লাইব্রেরীতে সেদিন ও আমাকে দেখার পর থেকে আমি দূরে দূরে থাকতাম। ক্যান্টিনে যখন গান গাইতাম, ও দূরে বসে শুনতো। কিন্তু আমি কিছুতেই ওর দিকে তাকাতাম না।
এরপরই এল সেইদিনটা। সেদিন ছিল কলেজে সরস্বতী পূজোর দিন। বিদিশাকে দেখলাম, ঠিক আমার পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে। একটা ঘি রঙের লাল পেড়ে শাড়ী পড়েছে। কপালে লাল টিপ। সরস্বতী পূজোয় মেয়েরা যেমন সাজে, তার থেকেও সুন্দর লাগছে ওকে। ওর হাসিখুশি মার্জিত চেহারায় একটা স্নিগ্ধতার ছাপ। লম্বা, ঈষৎ ভারী গড়ন আর একরাশ কালো চুল। আমাকে বলল, ‘‘তুমি খুব ভালো গাও। তোমার গান শুনেছি, আমি মুগ্ধ। আজকে তো সরস্বতী পুজো। আমাদের গান শোনাবে না?’’
আমি ভাল করে একবার তাকালাম বিদিশার দিকে। ওকে কয়েক পলক দেখলাম। বিদিশার ঠোঁটের কোনে হঠাৎই এক চিলতে হাসি দেখলাম। মনে হল, মেয়েটা যেন কিছু প্রত্যাশা করে রয়েছে আমার কাছ থেকে পাবে বলে। গান শোনাব? না ওর আমাকে ভাললাগাটাকে মেনে নেবো, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার হাতে হঠাৎই একটা চিরকূট গুঁজে দিয়ে বিদিশা বলল, ‘আমি এখানে কিছু লিখে রেখেছি। তোমাকে দেবার জন্য। পড়ে দেখো।’ বলেই এক নিমেষে ছুটে পালিয়ে গেল ওখান থেকে।
আমি ওর গুঁজে দেওয়া কাগজটা হাতে নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পরে শুভেন্দু এল ওখানে। আমাকে বলল, কিরে? কি বলছিল বিদিশা? তোকে কিছু বলল?
আমি বললাম, না সেরকম কিছু না। শুধু একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে গেল হাতে। বলল, তোমার জন্য লিখেছি, এটা পড়ে দেখো।
শুভেন্দু বলল, খুলে দেখ। নিশ্চই আমার মনে হচ্ছে এটা কোন প্রেমপত্র। বিদিশা তোকে মনে হয় এই চিঠির মাধ্যমেই প্রেম নিবেদন করেছে।
এটা ঠিক, আজকাল যেভাবে প্রেম ভালোবাসা হয়, আমাদের সময় প্রেমটা এরকম ছিল না। তখন প্রেমটা দানা বাঁধতে একটু সময় নিত। একটু বোঝাপড়ার জন্য সময় লাগত। বিদিশা আমাকে চিঠিতে দুলাইন লিখেছিল, ‘‘আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমিও কি তাই?’’
মেয়েটাকে যতবারই দেখেছি আমার মন্দ লাগেনি। রূপ আছে, গুনও আছে নিশ্চই। কিন্তু ওকে পাবার জন্য আমার মধ্যে তখনও ব্যাকুলতাটা আসেনি। সেইভাবে ছটফটানিটাও অনুভব করিনি। মনে হয়েছিল এতই কি সহজ? ও বলল, আমাকে মেনে নিতে হবে? সত্যি ভালবাসে কিনা একবার যাচাই করে নেওয়া তো দরকার।
শুভেন্দু বলল, ‘দেব’ তুই না দিনকে দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিস। আরে ও তোকে প্রেম নিবেদন করল। ওর ভালোবাসাটাকে অ্যাকসেপ্ট কর। কলেজে সবাই তোকে নিয়ে মাতামাতি করে বলে, তুই একটু দেমাকী হয়েছিস। দেখতো মেয়েটা কেমন সরল, সুন্দর। পুরুষেরা চিরদিন এমন নারীকেই ভালবেসে এসেছে যার স্নিগ্ধ কোমলতা ব্যাটাছেলেদের শান্তি দিতে পারে। বিদিশার মত মেয়ে আর একটা খুঁজে পাবি তুই?
ঠিক ঐ মূহূর্তে কোন চিন্তা আমার মাথায় এল না। ভাবলাম,শুভেন্দু যা বলছে, তার ঠিক কতটা সত্যি? সুন্দরী নারী বিদিশা। আমার মধ্যে কি এমন ও দেখল, যে আমাকে ওর ভালো লেগে গেল।
শিয়ালদহর কাফেটোরিয়াতে পরের দিন আমরা সবাই বসে আছি। ঠিক ঐ সময়ে বিদিশাও ওখানে এসে উপস্থিত। শুভেন্দু, রনি, সৌগত আর আমি চারজনেই আমরা বিদিশার মুখের দিকে তাকালাম। ওরা তিনজনে বিদিশাকে দেখে খুব খুশি হল। কিন্তু আমি ভীষন অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।
শুভেন্দু বলল, কি রে দেব? তুই কি ওকে খেলাচ্ছিস?
আমি কোন জবাব দিচ্ছি না।
রনি কিছু জানে না, এমন ভাবে শুভেন্দুকে বলল, কি হয়েছে রে শুভ? দেব কাকে খেলাচ্ছে?
শুভেন্দু বলল, ঐ যে মেয়েটাকে দেখছিস, দেবের খোঁজে এখানে পর্যন্ত চলে এসেছে। দেব ওকে খেলাচ্ছে।
আমি রেগে গেলাম। বললাম, কি যাতা বলছিস? আমি কাউকে খেলাচ্ছি না।
রনি বলল, কি হয়েছে ব্যাপারটা? আমাকে খুলে বল দেখি।
শুভেন্দু, বিদিশার চিঠি দেবার ব্যাপারটা ওকে সব খুলে বলল। তাই শুনে রনি বলল, ওরে দেব। এই ছিল তোর মনে? ঠিক আছে তুই যদি ওর সাথে লাইন মারতে না চাস, তাহলে বল, আমিই লাইন মারা শুরু করছি।
বিদিশাকে আমাদের মাঝে রনিই ডেকে বসালো। ততক্ষণে শুক্লাও ওখানে এসে উপস্থিত। বিদিশা আমারই উল্টোদিকের চেয়ারটায় এসে বসেছে। ও মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে। আমি মুখ নিচু করে বসে আছি। রনি বলল, এই যে বিদিশা, আমাদের এই বন্ধু মাননীয় শ্রী দেব মহাশয় কে দেখছো তো। ইনি খুব লাজুক প্রকৃতির। ইনি যখন গান গেয়ে সবাইকে মাতিয়ে রাখেন, তখন ইনার মুখ দিয়ে মধু ঝরে পড়ে। কিন্তু প্রেম নিবেদনে ইনি একটু কাঁচা। ইনার গলা দিয়ে তখন আওয়াজ বেরোয় না। কন্ঠস্বর রোধ হয়ে থাকে। জিভে আড়ষ্ঠতা এসে যায়। তুমি একে বাদ দিয়ে বাকী তিনজনের মধ্যে কাউকে পছন্দ হয় কিনা দেখোতো? দেব মনে হচ্ছে ঠিক খেলতে চাইছে না তোমার সঙ্গে।
ইচ্ছে হচ্ছিল রনির পাছায় ক্যাঁত করে একটা লাথি মারি। ও বিদিশার সামনে আমাকে জেনেবুঝেই বেইজ্জ্বত করছে, সেটাও বুঝতে পারছি। কোন কথা না বলে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বিদিশার হাতটা ধরলাম। ওকে বললাম, এসো তো তুমি আমার সঙ্গে। এসব ফালতু ছেলেদের সাথে মুখ লাগিয়ে কোন লাভ নেই। চলো আমরা বরং আলাদা কোথাও গিয়ে বসি।
বিদিশার হাত ধরে ওকে আমি ক্যাফেটরিয়া থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছি। পেছনে একবার তাকিয়ে দেখলাম, রনি হাসছে। ওকে দেখে বাকীরাও হাসছে। রনি হাসতে হাসতে বলল, এই তো গুরু জেগেছে। কেয়া বাত কেয়া বাত। এই না হলে দেব।
শুভেন্দু হাসতে হাসতে বলল, যাঃ এই বিদিশা এলো। আর অমনি তুই আমাদের ভুলে গেলি? তুই কি স্বার্থপর রে। দেব যাস না আমাদের ছেড়ে। তাকা, একবার তাকা। প্লীজ প্লীজ।
আমরা বাইরে বেরিয়ে এসেছি। ওদের হাসির আওয়াজটা তখনও ভেতর থেকে আসছিল। বিদিশা একটু দূরে গিয়ে বলল, তোমার চিঠিটা আজকেই পেয়েছি। শুভেন্দু আমার হাতে তোমার চিঠিটা দিয়ে বলল, দেব তোমাকে চিঠি দিয়েছে আর কাফেটরিয়াতে আসতে বলেছে। এই নাও দেবের চিঠি।
আমি বললাম, কই দেখি। চিঠি? কই আমি তো চিঠি লিখিনি তোমাকে।
বিদিশা একটা কাগজ দিল আমার হাতে। বলল, যাঃ তা হয় নাকি? তুমিই তো লিখেছ। নইলে কে আবার লিখবে?
খুলে দেখলাম। তাতে আমারই নামকরে বিদিশাকে চিঠিটা লেখা হয়েছে,
বিদিশা,
আমি তোমার চিঠি পড়লাম। জানি না, তোমার ভালবাসাকে আমি কিভাবে গ্রহন করব? আমার মত অতিসাধারন একটা ছেলেকে তুমি ভালবেসে ফেলেছ। মুখ ফুটে আমিও এতদিন বলতে পারিনি। আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি বিদিশা। এ জীবনে কেন, জনমে জনমে আমি তোমাকে চাই। আমার ভালোবাসা তুমিও কি গ্রহন করবে? তাহলে আজকে কাফেটরীয়াতে অবশ্যই এসো। আমি ওখানে তোমার জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করব। ইতি তোমার দেব।
চিঠিটা পড়ার পর আমি আর বিদিশাকে কিছু বলিনি। ওকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলাম কলেজ স্কোয়ারে। দুজনে নিরিবিলিতে বসে অনেক্ষণ কথা বলেছিলাম। ফিরে এসেছিলাম সন্ধে হবার পর। তারপর পরপর দুদিন শুভেন্দু কলেজে আর আসেনি। যেদিন এসেছিল, ওকে খুব তাড়া করেছিলাম। কলেজ গেট থেকে একেবারে বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত। আমার তাড়া খেয়ে কান ধরে শেষ পর্যন্ত হাসতে হাসতে শুভেন্দু বলেছিল। মাফ করে দে বস। এটা তো করতেই হত। নইলে তোদের প্রেম পর্বটা যে শুরু হতে হতেও বাকী থেকে যেত। বিদিশারও আফশোস থাকত না। আর আমাদের তো নয়ই।
আসলে ওরা সবাই এটা জানত। শুভেন্দু সবাইকে বলে রেখেছিল। এমনকি শুক্লাকেও। সেদিন কাফেটরিয়াতে ওরা কেউ বুঝতে দেয়নি আমাকে। এমনকি রনিও নয়। আজ মনে পড়ে সেসব কথা। আর ভাবি বন্ধুত্বটা আমাদের এমনই ছিল।
বিদিশাকে নিয়ে আমি অনেক ঘুরেছি। ওর সাথে বাসে করে যখন ঘুরতাম, বাসের ঝাঁকুনিতে মাঝে মাঝে বিদিশা আমার গায়ের ওপর টলে পড়ত। মজা পেয়ে আমি একহাত দিয়ে ওকে বুকে টেনে নিতাম। বিদিশা আমার কাঁধে মাথা রাখতো। আমার শরীরে হেলান দিয়ে দাঁড়াতো। সারা রাস্তায় আমাকে ওর বড় আপন মনে হত। বিদিশার মনে হত ও যেন আমার ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারে। খুব কাছ থেকে ও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিত। বিদিশার কোমরে হাত দিলে ওর সারা শরীরটা শিরশির করে উঠত। এ যেন এক অদ্ভূত অনুভূতি। বিদিশা বলত, ‘‘তুমিই আমার জীবনের একমাত্র প্রেমিক দেব। প্রেমের মানে কি তা, আমি তোমার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছি।’’ ভিক্টোরিয়ায়, গঙ্গার ঘাটে নিরিবিলিতে যখন ওকে জড়িয়ে ধরতাম, বিদিশা বলত, ‘‘তোমার মধ্যেই আমার শরীর এখন হারাতে চায় দেব। একজন পুরুষের শরীরেই নারী তার নারীত্বকে আবিষ্কার করে। তাই আজ তোমার শরীরের অস্তিত্বের মধ্যে আমার শরীরের উপস্থিতি খুঁজে পাচ্ছি।’’
বিদিশাকে নিয়ে প্রথমে যেটুকু আমার দ্বিধা আর সংকোচ ছিল, বিদিশাই সেটা কাটিয়ে দিল। দূর্বার, দুরন্ত প্রেমের মধ্যে দিয়ে আমরা দিনগুলো অতিবাহিত করছি। একদিন বিদিশা এল বাড়ীতে। সেদিন মা ঘরে ছিল না। আমি কলেজে যাইনি। শরীরটা একটু খারাপ। বিদিশা কলেজে এসে আমাকে দেখতে পাচ্ছে না বলে পাগলের মত খোঁজাখুঁজি করছে। শুভেন্দুর কাছ থেকে ও জানলো, আমার শরীর খারাপ। আমি কলেজে না গিয়ে বাড়ীতেই এখন বসে রয়েছি।
শুভেন্দু বিদিশাকে বলল, দেবকে পেতে গেলে তোকে এখন ওর বাড়ীতে যেতে হবে। যা, দেখ গিয়ে হয়তো তোরই জন্য পথ চেয়ে বসে আছে।
বিদিশা এল। আমি কোনরকমে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুললাম। দেখি বিদিশা দাঁড়িয়ে।
-কি ব্যাপার? তুমি কলেজে যাও নি। শুভেন্দু বলল, তোমার শরীর খারাপ। আশ্চর্য তো তুমি! আমাকে একবারও বলোনি?
বিদিশাকে ঘরের ভেতরে ডেকে নিলাম। ও বলল, মা নেই বুঝি? তুমি একা?
আমার কপালে হাত রাখলো বিদিশা। বলল, জ্বর? সর্দি হয়েছে? ওষুধ খেয়েছ?
আসতে আসতে আমার বুকের কাছে এসে দাঁড়ালো বিদিশা।
আমি বললাম, শরীরটা ভালো নয়। তাই কলেজে যাইনি। একটু জ্বরও জ্বরও এসেছে। মা নেই। আজ সকালেই মাসীর বাড়ী গেছে। তাই আমি একা।
চকিতে মুখ তুললো বিদিশা। তারপর ডায়েরীটা টেবিলের ওপর রেখে, হঠাৎই আছড়ে পড়ল আমার বুকে। সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো। আমি দেখলাম বিদিশা পাগলের মতন আমার কাঁধে গলায় মুখ ঘষছে। পায়ের পাতা থেকে হাতের আঙুল অবধি একটা ‘কি জানি কি’ বিন্দু বিন্দু হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বিদিশার কাঁধে হাত রাখলাম। দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে ও। আমি দাঁড়িয়ে থেকে টলতে লাগলাম। তারপর বিদিশার মুখ দুহাতে অঞ্জলির মত করে ওপরে তুললাম। দেখলাম বিদিশার চোখে জল।
এখন এই নির্জন দুপুরে, আমারই ঘরেতে, চারদেয়ালের মধ্যে বিদিশা আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। আমার সমস্ত ছেলেবেলা, কৈশোর থেকে টেনে এনে ছুঁড়ে দিল যৌবনের রহস্যময় বিস্ময়ে। আমার চোখে চোখ রাখলো বিদিশা। ভিজে চোখের পাতায় এত কথা লেখা থাকতে পারে আমি কখনও জানতাম না। দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। তিল তিল করে বুকের মধ্যে একটা বোধ ছড়িয়ে যাচ্ছে। এরই নাম কি সুখ! একটা ঘোরের মধ্যে চাপা স্বরে আমি বলে উঠলাম, ‘বিদিশা আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি’।
আমার বুকের মধ্যে একটা গাল চেপে বিদিশা বললো, জানি, জানি, জানি!
তুমি কষ্ট করে আমার জন্য এলে?
কেন আসবো না? কেন?
ও যেন একটু একটু করে দুলছিলো। ওর দুহাতের মধ্যে জড়িয়ে থাকা আমার শরীরটায় সেই দুলুনি লাগলো। বিদিশার মসৃণ মুখ, ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসির ঢেউ- আমি মাথা নিচু করলাম, মুখ নামালাম। আমার চোখের সামনে একশ নন্দন কানন। বিদিশা চোখ বুজে ফেললো। মনে হল, ওকি ভয় পাচ্ছে? ও কি চাইছে না? আমি দেখলাম কি একটা আশ্চর্য মায়ায় বিদিশা ক্রমশ সুন্দর থেকে সুন্দর হয়ে উঠছে আরো। বিদিশার ঠোঁটে ঠোঁট রাখছিলাম আমি। বিদিশার গরম নিস্বাস লাগছে মুখে। আর ঠিক সেই সময় এক ঝটকায় মুখ সরিয়ে নিল বিদিশা। তারপর আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে হুহু করে কেঁদে ফেললো। আমাকে বলল, আমি খারাপ, খুব খারাপ। তোমাকে আমি ঠকিয়েছি।
খুব নাড়া খেলে যেমন সাড়া থাকে না আচমকা। আমি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওর কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাতটা রাখলাম। বিদিশাকে বললাম, কি যাতা বলছ?
‘তুমি আমাকে খুব বিশ্বাস করো না? বিদিশা মুখ ফেরাচ্ছিল না।
আমি তোমাকে শুধু বিশ্বাস করি না বিদিশা, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি।
অথচ দেখো, তোমার কাছে আমি সত্যিটা লুকিয়েছি।
কি লুকিয়েছো বলবে তো?
তোমার আগে আমি একটা ছেলেকে ভালবাসতাম দেব, এ সত্যিটা তোমাকে একবারও বলা হয় নি। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করে দেবে ‘দেব’?
সেদিন বিদিশার সরল মুখটা দেখে আমার মনে হয়েছিল, ও তো এই কথাটা আমার কাছে চেপেই যেতে পারতো? সত্যিটা না বললে, কি এমন হত? আমি তো ও না বললে কোনদিন জানতে পারতাম না।
বিদিশাকে বললাম, যাকে ভালবাসতে সে এখন কোথায়?
বিদিশা বললো, সে নেই। আমাকে ছেড়ে সে চলে গেছে।
অবাক হয়ে বললাম, কেন?
বিদিশা বললো, ভালোবাসাটা একতরফা ছিল, তাই। আমি ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু ও আমাকে সেভাবে ভালোবাসেইনি কোনদিন। ছেড়ে যাওয়াতে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমার বিশ্বাসটাকে চূর্ণ করেছিল সে। সেভাবে মর্যাদা দেয় নি আমাকে।
দেখলাম ওর চোখে এবার বেশ খানিকটা জল। বিদিশাকে বললাম, আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যাব না বিদিশা। তুমি আমাকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে পারো।
কথাটা বলার পরই বিদিশাকে দেখলাম, ও দুহাতে শিশুর মতন জড়িয়ে ধরল আমাকে। তারপর আমার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো। যেন চমকে উঠলাম আমি। এরকম হচ্ছে কেন? শরীরের সব রক্ত আচমকা টলে উঠলো কেন? চন্দনের ফোঁটা পড়িয়ে দেবার মত বিদিশা আমার কপালে, চোখের পাতায়, গালে, চিবুকে-এখন সারা মুখে ছোট ছোট চুমু খেয়ে যাচ্ছে। শুধু নিষিদ্ধ করে রাখছে ঠোঁটটা। আমার সমস্ত শরীর শক্ত হয়ে গেলো। অনুভব করলাম, বুকের বাতাস এত ভারী কেন? শেষ পর্যন্ত তিন বছর না খাওয়া কোন ভিখিরীর মত ঝাঁপিয়ে পড়লাম বিদিশার ঠোঁটে। দুটো নরম উষ্ণ অথচ সিক্ত জবাফুলের মত ঠোঁট পাগলের মত নিতে চাইলাম নিজের মত করে। অস্ফুট আওয়াজ করে উঠলো বিদিশা, উঃ একেবারে রাক্ষস। লাগে না বুঝি।’’ একটু থমকে গেলাম আমি। মুখ তুলে দেখলাম বিদিশা হাসছে। আমাকে বলছে, ‘উম আমাকে নাও, নাও, নাও।’
হঠাৎই শরীরে মনে হল, আমার আর জ্বর নেই। অসুস্থ শরীরটাকে যেন সুস্থ করে দিয়েছে বিদিশা। একটা ঝড়ো বাতাসের মত আমি বিদিশাকে বুকে তুলে নিলাম। আমার অগোছালো বিছানায় বিদিশাকে শুইয়ে দিলাম যত্ন করে। ছেলেমানুষের মতন বিদিশা তখন আমায় দেখছিল। খাটের পাশে হাঁটু গে’ড়ে বসে আমি বিদিশার হাতে মুখ রাখলাম। কি নরম জলের মত গন্ধ বিদিশার হাতে, সমস্ত ছেলেবেলা মনে করিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে মুখ নামালাম ওর হাতের ওপরের দিকে, বাজুতে। বিদিশার বুকের কাছে মুখ রেখে ও কৃপণের মত চুপ করে বসে থাকলাম খানিক। আজ অবধি কোন যুবতী মেয়ের বুককে এত কাছ থেকে দেখিনি। বিদিশার বুক কি নরম?
একটা হাত আমার মাথায় রেখেছে বিদিশা। আঙ্গুলগুলো আমার চুলের ভেতরে খেলা করছে। বিদিশার বুকের মধ্যে থেকে মন কেমন করা সুবাস উঠে আসছে আমার নাকে। এই শাড়ী আর অন্তর্বাসের আড়াল খুললেই বিদিশার সমস্ত যৌবনটা আমার সামনে এসে দাঁড়াবে। অথচ ওটা খুলতে আমার কেমন যেন ভয় হচ্ছিলো। একবার আড়াল ঘুচে গেলেই সব যে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিদিশা তখন কি ভাববে?
আমি আসতে আসতে মুখ নামালাম নিচে। বিদিশার কোমর পেট কি নরম-আঃ।
বিদিশা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। এখন ওর ঠোঁটদুটো ঈষৎ খোলা। চিকচিকে কুন্দ ফুলের মত সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে। জিভের ডগা দাঁতের গায়ে সামান্য নড়ছে। বিদিশা আমাকে ডাকলো, ‘এই শোনো।’
মুখ তুললাম আমি। বিদিশার গলার স্বরটা কেমন অনরকম।
‘এখানে আমার পাশে এসে শোও।’ হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকলো বিদিশা। মূহূর্তে পরিবেশটা কেমন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছিলাম আমি। এই বিদিশা কেমন এক আকুতি নিয়ে আমাকে ডাকছে। আমার ভেতরে একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। উঠে গিয়ে আমি বিদিশার পাশে শুয়ে পড়লাম। বিদিশা আরো একটু সরে এলো। তারপর আমার বুকে আঙুলের ডগা দিয়ে কি যেন লিখতে লাগল। চোখ বন্ধ করে আমি লেখাটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম।
এই আমাকে বিয়ে করবে? আজ কিংবা কাল। খুব আস্তে আস্তে বিদিশা বললো।
‘বিদিশা!’ আমি অবাক হয়ে গেলাম।
এখনই বিয়ে?
কেন কিসের অসুবিধা? তুমি তো পাশ করে চাকরি পেয়ে যাবে তাই না?
‘কিন্তু আমার তো একটু সময় দরকার। তুমি তো সবই জানো অনার্সটা পাশ করতে এখনও দেড়বছর। আমিও তোমাকে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু বিয়ে করে তোমাকে আমি খাওয়াবো কি?
‘আমি জানি না। কিছু জানি না। এসব তুমি ভাববে, আমি আমার সবকিছু তোমাকে দিয়ে দিলাম।’ ছেলেমানুষের মত আমার বুকে মুখ ঘষতে লাগল বিদিশা।
বিদিশাকে বললাম, কিন্তু তোমার বাবা মা? তাদের কাছে তো আমাকে যেতে হবে। কথা বলতে হবে। তবে না বিয়ে।
বিদিশা বললো, বাবাকে তো সব বলাই আছে। তুমি বরং যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলো। আমি আর পারছি না।
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি?
প্রেমিক থেকে পতিদেবতা বানাতে চাইছি তোমাকে, তুমি বুঝতে পারছো না?
বিদিশা এরপরে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও তখন চোখ বুজে চিন্তা করছি বিদিশাকে নিয়ে কি করব? ও এত ছেলেমানুষি করছে। এও কি হয় নাকি? বিয়ে, তা বলে এখনই?
চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। সন্ধেবেলা ঘুম ভাঙল আমার। দেখি বিদিশাও চোখ খুলে তাকিয়েছে আমার দিকে, তখনো ও আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছিলো না। আমার বুকের কাছে মুখটা ঘষছে আবার। বিদিশাকে বললাম, ‘বিদিশা এক কাজ করলে হয় না? আমি যদি শুভেন্দু আর সৌগতকে বলি ব্যাপারটা। তুমি তো জানো। ওদের কাছে আমি সব কথা খুলে বলি। কিছু লুকোই না। ওরা যদি আমাকে কিছু হেল্প করে।’
বিদিশা বলল, ‘বিয়ে করবে তুমি। আর ওরা তোমাকে কি হেল্প করবে?’
আমি বললাম, ‘তুমি জানো না। শুভেন্দুরা খুব বড়লোক। ওদের অনেক পয়সা। আমি যদি শুভেন্দুকে বলি আমাকে একটা কাজ জুটিয়ে দিতে, ও ঠিক পারবে। আমার তো সেরকম চেনাপরিচিত কেউ নেই। তোমাকে বিয়ে করবো, তার আগে রোজগার পাতির একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে।
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বিদিশা বললো, ‘এই একটা কাজ করবে? তুমি তো ভালো গান গাও। আমাকে গান শেখাবে?’
অবাক হয়ে বললাম, গান শেখাবো? তোমাকে? কিন্তু এর সাথে বিয়ের বা রোজগারের কি সন্মন্ধ আছে? গান তো এমনি শেখাতে পারি তোমাকে।
বিদিশা আমার গালে একটা টোকা দিয়ে বললো, দূর বোকা। গান কি এমনি শেখাবে নাকি? আমি বাবাকে বলবো, মাসে মাসে এরজন্য দুহাজার টাকা করে দিতে। বাবা না করবেন না।
বিদিশার ছেলেমানুষির মত কথা শুনে আমার খুব হাসি পাচ্ছিলো। বললাম, ‘আমি তোমাকে গান শেখাবো। তোমার বাবা আমাকে টাকা দেবেন। আর সেই টাকায় আমি সংসার চালাবো। বা কি সুন্দর। একেবারে বুদ্ধিমতী মেয়ের মত কথা বলেছো তুমি।
বিদিশা কিছুক্ষণ বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো আমার দিকে। মুখ নিচু করে বললো, হ্যাঁ তাও তো ঠিক। বাবা এভাবে টাকা দেবেই বা কেন? আমি তো তখন তোমার কাছেই থাকবো।
বিছানায় উঠে বসে গালে হাত দিয়ে কি যেন ভাবতে লাগলো বিদিশা। মনে হল, এমন ভাবে আমার জন্য চিন্তা করা শুরু করে দিয়েছে, এবার কিছু একটা ও করেই ছাড়বে।
কিছুক্ষণ ভেবে টেবে এবার নিজেই খুশিতে আমার গালে একটা চুমু খেয়ে বসলো। আমাকে বললো, হয়ে গেছে। আর কোন চিন্তা নেই।
আমি বললাম, কি হয়ে গেছে? কি চিন্তা নেই?
বিদিশা বললো, চাকরি করে কি হবে? তুমি বরং ব্যাবসা করো।
‘ব্যাবসা? সে তো অনেক টাকার ব্যাপার বিদিশা। অত টাকা আমি কোথায় পাবো?’
বিদিশা আবার শুয়ে পড়ে, আমার মুখের কাছে মুখটা এনে বললো, ‘তুমি ব্যাবসা করবে কিনা বলো। টাকার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না।’
যেন লাগলে টাকা দেবে গৌরী সেন। বুঝলাম বাবাকেই গৌরী সেন বানাতে চাইছে বিদিশা। আমার বুকের ওপর আবার আঙুল দিয়ে হিজিবিজি কাটতে কাটতে বললো, কত চাই? দুলাখ, পাঁচলাখ, না আরো বেশী? যা চাইবে, তাই পাবে। আমি আছি না-
‘ও আমার দরদীনি গো। কি বলে কি মেয়েটা? অত টাকা জোগাড় করে দেবে তুমি আমাকে?’
বিদিশা বললো, কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?
আমার বুকের ওপর হাতটা রেখে আস্বস্ত করলো বিদিশা। চোখের পাতাদুটো একবার বুজিয়ে বোঝাতে চাইলো, আমি আছি না?
আমি জানি বিদিশারা খুব বড়লোক। দু পাঁচ লাখ টাকা ওর বাবার কাছে কিছুই নয়। তবু বললাম, ‘বিদিশা, তুমি আমার জন্য এতটা করবে?’
‘কেন করতে পারি না?’ বিদিশা যেন এবার একটু অভিমানি হয়ে গেল। আমাকে বললো, ‘আমি কি তোমার কেউ নই?’
উঠে বসে ওর গাল দুটো দুহাতে ধরলাম। বললাম, তুমিই তো আমার সব কিছু বিদিশা। আমার সাথী তুমি, আমার ভালোবাসা তুমি, আমার প্রেরণা তুমি। আমার জীবনের যা কিছু, সবকিছু তুমি।
বিদিশা চোখে চোখ রেখে বললো, থাক আর কবি হতে হবে না। তাহলে তুমি আমাকে না করবে না বলো।
ঘাড় নেড়ে ওকে জানান দিলাম। বললাম, তোমাকে আমি কি কখনও না করতে পারি?
দেখলাম ওর ঠোঁটদুটো আমার ঠোঁটের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে এবার। চুমুটা খেতেই যাচ্ছিলাম। বিদিশা বললো, মা বাড়ীতে নেই, আমাকে পেয়ে খুব দস্যিপানা করতে ইচ্ছে করছে বুঝি?
আমি ওর কথা শুনে মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম। দেখলাম বিদিশা আবার নিজে থেকেই আমার গালে গাল ঘষছে। যেন রাগ ভাঙাচ্ছে,সেভাবেই আমার থুতনীটা হাত দিয়ে নাড়তে লাগল। আমাকে বললো, কি রাগ আমার পতিদেবতার? আমি বুঝি চুমু খেতে মানা করেছি তোমাকে?
নিজেই নরম ঠোঁটটা আমার কঠিন ঠোঁটের সাথে ডুবিয়ে দিলো। চুম্বনটা গাঢ হচ্ছে, এই প্রথম ভালবাসার গভীরতা অনুভব করছি। আমাকে চুমু খেতে খেতেই বিদিশা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাত দিয়ে আমার পিঠের সবল মাংস পেশীর সাথে খেলা করতে লাগল। সুখটটা যেন ভালবাসার আলিঙ্গনে ক্রমশ আছড়ে পড়ছে। ভাবছি বিদিশার মত মেয়ে আমি পেয়েছি, আমার জীবন ধন্য। আজ যেন বিদিশার মধ্যে এক অনন্য রূপকে আমি দেখলাম। ওকে যেন নতুন করে আমি আবিষ্কার করলাম।
সেদিনের সেই অনুভূতির স্মৃতি আজও আমার মনকে অস্থির করে তোলে। মাঝে মাঝে ভাবি, কেন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে বিদিশা? আমি তো তোমাকে ঠকাতে চাইনি। সত্যিই চাইনি।
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
‘তোর মনে হচ্ছে আজ অফিস যাবার কোনো ইচ্ছে নেই। সকালে উঠেই ডায়েরী খুলে বসে গেছিস লিখতে। ঘড়িতে কটা বেজেছে, খেয়াল করেছিস?’
মাকে দেখলাম আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার পিঠে হাত দিয়ে দেখছে, আমি আপন মনে কিসব লিখে যাচ্ছি। মা বললো, ‘কি লিখছিস? গল্পো?’ হেসে বললাম হ্যাঁ মা গল্পো। তবে জীবনের কিছু পুরোনো কথাও এর মধ্যে আছে। ওগুলো সব মনে পড়ে যাচ্ছে, তাই একটার পর একটা লিখে যাচ্ছি।
‘অফিসে যাবি না?’
‘হ্যাঁ যাবতো। এই আর একটা পাতা লিখে নিই।’
মা জানে লেখার নেশাটা আমার অনেকদিনের। সেই ছোটবেলা থেকে লিখে আসছি। কত কিছু লিখলাম। বিদিশাকেও আমার কতগুলো লেখা পড়িয়েছিলাম। আমার গল্প আর কবিতা গুলো পড়ে বিদিশা বলেছিল, ‘তুমি এত ভালো গান গাও, আবার এত ভালো লেখো, এতসব পারো কি করে? কি প্রতিভা তোমার।’
আমি বলেছিলাম, ‘দূর। এরজন্য আবার প্রতিভার দরকার হয় নাকি? লিখতে লিখতে ওটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। আর গানটা গাইতে গেলে সাধনা করতে হয়। সবই রেওয়াজের ওপর। প্র্যাকটিস না করলে কোনকিছুতেই দক্ষ হওয়া যায় না।
বিদিশা জানতো না ওকে দেওয়া আমার চিঠিটা শুভেন্দু লিখে দিয়েছিল। আমাকে বললো, ‘আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে একটা সুন্দর প্রেমপত্র লিখবে। শব্দের মালা বসিয়ে যেমনটা তুমি লেখো। চিঠিটা পড়ে আমিও আবেগে আপ্লুত হয়ে যাবো। আমার ভেতরের অনুভূতিটা চিনচিন করে উঠবে। তা না। কি একটা লিখলে। ওটা কি প্রেমপত্র হল?’
হেসে বলেছিলাম, ওটা তো আমি লিখিনি। ওটা শুভেন্দু আমার হয়ে লিখে দিয়েছিল।
বিদিশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, কেন? শুভেন্দু লিখবে কেন? তোমার ঠিঠি ও লিখবে কেন?
এই রে বোকার মতন সত্যি কথাটা বলে এখন বিপদে পড়ে গেছি। যাতে ওর রাগ না হয়, বিদিশার গালে হাত রেখে বলেছিলাম, শুভেন্দু তাড়াহূড়ো করে না লিখলে, সেদিন তুমি কি ক্যাফেটরিয়াতে আসতে? না আমরা একে অপরকে ভালবাসতে পারতাম? মিছিমিছি ওর ওপর রাগ করছ। ও তো আমাকে জানিয়েই চিঠি লিখেছে তোমাকে।
একটু যেন মন খারাপ করে ফেলেছিল বিদিশা। ভুলটা আমারই জন্য। রাগ ভাঙাতে আমি কত কিছু করলাম। ওর জন্য মান্না দের গানটা গাইলাম, ‘সুন্দরী গো দোহাই তোমার মান কোরো না। আজ নিশীথে, কাছেই থেকো। না বোলো না। সুন্দরী গো।’
কলেজে গিয়ে বিদিশার ক্লাসে ঢুকে গেলাম সোজা। দেখলাম বিদিশা চুপ করে বসে আছে সিটে। মুখটা ভারভার। উস্কো খুস্কো। ওর পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। বিদিশা লজ্জা পেয়ে গেলো। ওর ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলো আমাকে দেখে বলতে লাগল, ‘আরে গায়ক মশাই যে। তা হঠাৎ আমাদের ক্লাসে পদার্পন। কি মনে করে?’
আমি বিদিশার হাত ধরে টানছি। ‘এই চলো না চলো না।’ ও লজ্জা পেয়ে বললো, ‘ধ্যাত। কি হচ্ছেটা কি? সবাই দেখছে। ছাড়ো বলছি।’
আমিও অগত্যা চুপ করে বসে রইলাম। একটু পরে প্রফেশর এলেন। আমাকে দেখে ভিমরী খেলেন। বললেন, ‘দেব’ তুমি এখানে? কি ব্যাপার? নিজের ক্লাসে না গিয়ে এখানে বসে কি করছ?
আমি নাছোড়বান্দা প্রেমিকের মত জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে আছি। বিদিশা ওই দেখে মুখ টিপে ফিক ফিক করে হাসতে লাগলো। ক্লাসের বাকীরাও সবাই হাসতে লাগল। বুঝলাম জোর ফাঁসা ফেসেছি আজকে। একেবারে বেইজ্জ্বত হয়ে গেছি। আজ আমার রেহাই নেই। সেদিন কলেজে ঢ্যাড়া পিটে গেল, সবাই জেনে গেল, তারমানে আমি বিদিশার সাথে প্রেম করি।
বিদিশা খুব লজ্জ্বা পেয়েছিল সেদিন। ওর রাগ ভাঙাতে আমি যে এতটা করতে পারি, ওর ধারনা ছিল না। বিদিশা কখনও আমাকে ভুল না বোঝে, আমাকে খারাপ না ভাবে আমি সবসময়ই চেষ্টা করতাম। ওর জন্য আমি একটা গান লিখতে চেয়েছিলাম, সেটা লেখা হয় নি। কিন্তু বিদিশা আমাকে বলেছিল, তুমি যেদিন আমাকে নিয়ে কিছু লিখবে, সেদিন বুঝবো, তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। কোন গল্প কাহিনী, কবিতা, উপন্যাস। পারবে আমাদের প্রেম কাহিনী নিয়ে লিখতে?
বিদিশাকে বলেছিলাম, কেন পারবো না? ও তো আমার কাছে জলভাত।
‘তাহলে লিখে দেখাও।’
কলম নিয়ে সেদিন আর কিছু লেখা হয় নি। কিন্তু আজ লিখছি। ‘বিদিশা তুমি জানো না, আমার জীবন কাহিনীর কতটা অধ্যায় জুড়ে তুমি বসে আছো। সব কথা আজ লিখতে চাই, তোমার আর আমার প্রেমকাহিনী নিয়ে সবাইকে সব কথা বলতে চাই। কিন্তু তুমি তো এখন অনেক দূরে। এ লেখা কি শেষ পর্যন্ত তোমাকে পড়াতে পারবো বিদিশা? তুমি তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছো। আর তো ফিরে আসবে না কোনোদিন। তাহলে?
একটু হেসে মা পেছন থেকে বললো, কার কথা লিখছিস?
মাকে কি আর বলতে পারি, বিদিশার কথা। বললাম,ঐ কলেজের সব ঘটনাগুলো লিখছি। যেগুলো যেগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে, সেগুলো।
মা আমার কথাটা শুনে কেমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। বললো, ‘কেন লিখছিস ওসব পুরোনো কথা? কে মনে রাখে? নিজেকে শুধু শুধু কষ্ট দিস। এখনো ভুলতে পারিস নি তুই বিদিশার কথা। তাই না?
‘তুমি কি করে জানলে আমি বিদিশার কথা লিখছি? আমি তো-’
মা বললো, আমার চোখকে তুই ফাঁকি দিতে পারবি? যে মেয়েটা তোকে ছেড়ে চলে গেলো। একবার ফিরেও তাকালো না। ঘর করলো না, তার কথা তোর এখনো মনে পড়ে? কি পেয়েছিস তুই বিদিশার কাছ থেকে? সত্যিকারের ভালবাসা? ও যদি তোকে সত্যি ভালোবাসতো, তাহলে কি এভাবে ছেড়ে যেত?
আমাকে বলে নিজেই একটু বিষন্ন হয়ে পড়লো মা। সেদিন মায়ের চোখে আমিও জল দেখেছিলাম, আজ আবারো দেখলাম। ডায়েরীর পাতাটা বন্ধ করে মাকে বললাম, এই দেখো, তুমি আবার মন খারাপ করছো। তাহলে লেখাটা বন্ধ করে দিই। মা আমার মাথায় হাতটা রাখলো। বললো, না রে বাবা, তুই লেখ। আমি তো এমনি বলছিলাম।
মাকে বললাম, এই দেখো না শুভেন্দু এতদিন বাদে ফোন করলো, আমাকে ওর বাড়ী যেতে বললো, আর আমারো পুরোনো কথা সব মনে পড়ে গেল। তাই ভাবি একটু লিখি। তুমি যখন বলছো, তাহলে লিখবো না।
মা আবারো আস্বস্ত করলো আমাকে। বললো, ‘না তুই লেখ। আমি তোকে বাঁধা দেবো না। আজ অবধি তোর কোনো কাজে বাঁধা দিয়েছি কি? তবে তুই যদি এখন না বেরোস, তাহলে আমাকে বলে দে। আমি একটু স্নানটা সেরে আসি। এসে তাহলে তোর খাবারটা বেড়ে দেবোখনে।
মাকে বললাম, ঠিক আছে তুমি যাও। আমি একটু পরেই লেখালেখি শেষ করছি।
যাবার আগে মা বললো, বিদিশারা এখন কোথায় থাকে রে? বিয়ের পরে তো মুম্বাই চলে গিয়েছিল শুনেছিলাম। এখন কি ওখানেই?
মাকে বললাম, তোমার এখনো মনে আছে তাহলে। মা বললো, কেন তুই তো আমাকে বলেছিলিস। ওর মুম্বাইতে বিয়ে হয়েছে। পয়সাওয়ালা শশুড় বাড়ী পেয়েছে। সুখে ঘর করছে। আর হবে নাই বা কেন? ওরা নিজেরাও তো খুব বড়লোক ছিলো।
মাকে বললাম, এখন আর বিদিশার খবর জানি না মা। আর জানবোই বা কি করে? ও তো পরে আর যোগাযোগ করেনি আমার সঙ্গে। চলে যাবার পরে কোনো ফোনও করেনি আমাকে।
যাবার আগে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মা বললো, ‘ছেলে আমার বিদিশা বিদিশা করেই গেলো। এবার একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে কর। তাহলে আমিও একটু হাল্কা হই।’
মা চলে গেল। আমি আবার ডায়েরীটা খুলে ভাবছি কি লিখবো। কলেজের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আরো লিখতে ইচ্ছে করছে। বিদিশার সাথে আমার প্রেম। নেতাজী ইন্ডোরে অনেক রাত অবধি জলসা দেখতে গিয়ে কি অবস্থা হয়েছিল সেদিন। বিদিশা বাড়ীতে বলে আসেনি। আর প্রোগ্রাম শেষ হবার পর ইন্ডোর স্টেডিয়াম থেকে বেরোনোর সময়ই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টিতে কেউ বেরোতে পারছে না অডিটোরিয়াম থেকে। বিদিশা আমার হাতটা ধরে বললো, কি হবে বলোতো? বাড়ীতে বলে আসিনি। এখন বৃষ্টি। মা আমাকে পুরো খেয়ে ফেলবে। কিছু একটা ব্যবস্থা করো। একটা ট্যাক্সি। যেমন করে পারো।
বিদিশা যাতে সময় মত বাড়ী পৌঁছোতে পারে বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে ভিজে চপচপে হয়ে ওর জন্য ছুটে গিয়ে ট্যাক্সি ধরেছিলাম। বাড়ীতে ওকে ড্রপ করে দিয়ে যখন নিজের বাড়ী ফিরছি, তখন বাজে রাত্রি একটা। মা বসে আছে ঘরে। আমার জন্য প্রবল চিন্তা করছে। আমি ঘরে ঢুকতেই মা বললো, তুই বিদিশা ছাড়া আর কটা মেয়ের সাথে ভাব পাতিয়েছিস?
আমি অবাক। মাকে বললাম, কেন? একথা বলছো কেন?
মা বললো, মিনু বলে একটা মেয়ে এসেছিল সন্ধেবেলা। তোর খোঁজ করছিল। বললো, মাসীমা ‘দেব’ কোথায় গেছে বলতে পারবেন? আজ তো কলেজে দেখলাম না ওকে।
চমকে উঠেছিলাম আমি। মিনু? কেন? ও কেন আমার বাড়ীতে আসবে? আর ওকে বাড়ীর ঠিকানাই বা কে বললো, তাহলে কি সৌগত?
মা বললো, ‘মেয়েটা একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে এসেছিল। আমাকে বললো, আমি দেবের বন্ধু। আর এ হলো সৌগত। আমরা দুজনেই দেবের বন্ধু। দেবকে খুব দরকার। বলুন না ও কোথায় গেছে।
আমি জানি, মা সেদিন সরল মনে মিনুকে সব বলে দিয়েছিল, ‘ও তো ফাংশন দেখেতে গেছে। ফিরবে সেই দেরীতে। আমাকে বলে গেছে ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা হবে।’
মিনুর চোখে মুখে তখন কৌতূহল। মাকে জিজ্ঞাসা করে বসলো, কার সাথে গেছে বলতে পারবেন?
মাও সরল মনে ওকে বলেদিল, ‘ও যে বললো, বিদিশাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। কলেজে ওরা দুজনে কেউ তো যায়নি আজকে। সোজা বাড়ী থেকে চলে গেছে ফাংশনে।’
বাড়ীতে ফেরার পর, মা, মিনুকে সব বলে দিয়েছে দেখে আমি আঁতকে উঠেছিলাম। মিনু কদিন ধরেই আমার পেছনে শুধু পড়ে রয়েছে। খালি জ্বালাতন করছে। ওর ছোটো বোনকে আমায় গান শেখাতে হবে।
আমি রাজী নই। যেটুকু সময় পাই, কলেজ, পড়াশুনা তার বাইরে শুধু বিদিশার সাথে প্রেম। এর মধ্যে মাষ্টারী করার আর আমার সখ নেই। তবু মিনু আমার পেছন ছাড়বে না। একেবারে জোঁকের মতন পেছনে লেগে রয়েছে।
সেদিন মিনুকে কথা দিয়েছিলাম, ওর বাড়ীতে যাব। ঝেমেলাটা সৌগতই আগে পাকিয়ে রেখেছে। ওর হয়ে এমন ভাবে আমাকে সাধাসাধি করতে শুরু করলো, যেন মাথাব্যাথাটা ওর। মিনু সৌগতকে রিকোয়েস্ট করেছে, ‘তুই আমার হয়ে দেবকে রাজী করা। দেব কিছুতেই রাজী হচ্ছে না। তুই বললে হয়তো রাজী হবে।’
সৌগত মিনুর হয়ে আমার কাছে এসে যখন পীড়াপীড়ি করতে শুরু করলো, ওকে বললাম, তোর এখানে কি স্বার্থ আছে বলতো? কেন এই নিয়ে আমাকে বারে বারে ডিস্টার্ব করছিস?
এটা আসলে সৌগতর দোষ নয়। এটা নাকি আমার গলার দোষ। সৌগত বললো, ‘কি করব? যা গানের গলা তোর। মিনু তোর পুরো ফিদা হয়ে গেছে। ওর ছোটবোন বেশ কিছুদিন ধরেই গান শিখছে। মিনুর ধারণা, তোর হাতে পড়লে ও নাকি ভালো গায়িকা হতে পারবে। এখন ধরেছে আমাকে। দেব তুই আমার মানটা রাখ।’
কলেজ থেকে মিনুদের বাড়ীটা খুব কাছে। গলি ধরে শর্টকাটে গেলে পাঁচ মিনিট। আমি জানি, মিনুর স্বভাবটা ভালো নয়। রোজ কলেজ থেকে একটা করে ছেলে ধরে ওর বাড়ী নিয়ে যায়। যেহেতু বাড়ীটা কলেজের খুব কাছে, কেউ নাও করে না। ইদানিং মিনুকে নিয়ে আদিখ্যেতাটা খুব বেড়ে গেছে সকলের। যেন সবার নয়নের মনি। চার পাঁচটা ছেলের সাথে সবসময় বসে আছে। তারা ওর গায়ের যেখানে সেখানে হাত দিচ্ছে, খুনসুটি করছে। দেখতে ভীষন বাজে লাগে এসব। আমি একটু অন্য স্বভাবের। চোখের সামনে বাড়াবাড়িটা বেশী পছন্দ নয়। তাও কাউকে কিছু বলিনা। ওটা যার যার ব্যক্তিগত, মজ্জাগত স্বভাব। অন্যতে যেটা করে আনন্দ পায়, সেখানে আমার হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই।
মিনু কদিন ধরেই ক্যান্টিনে খুব যাতায়াত শুরু করেছে। আগে খুব একটা বেশী আসতো না। কার মুখে শুনেছে, ক্যান্টিনে রোজ একঘন্টা করে আমি গান গেয়ে পুরো ক্যান্টিন মাতিয়ে রাখি। কলেজে আমার এই গুনে সুনাম অনেক। সারা কলেজ আমার গান শোনার জন্য পাগল।
জানি না আমার মধ্যে ও কি পেয়েছিল। মিনুকে প্রথম যেদিন কলেজে দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম ও একটু অন্য টাইপের। বিদিশার মতই মিনুর স্লীম ফিগার। তবে গায়ের রঙটা বিদিশার মত অত ফর্সা নয়। নাকটা একটু চ্যাপটা মতন, চোখ মুখ সুন্দর। তবে বিদিশার মত অতীব সুন্দরী নয়।
কদিন ধরেই মেয়েটাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারটা সেভাবে আসেই নি মিনু। সেসময় নাকি ওর মা মারা গিয়েছিল। কোনরকমে পরীক্ষা দিয়ে সেকেন্ড ইয়ার থেকে আসা শুরু করলো কলেজে। এসেই দেখছে কলেজে আমি তখন খুব ফেমাস। সবাই দেব কে একনামে চেনে। এ কলেজে দেব বলতে একজনই আছে। প্রথমে মিনু আমার গানের ভক্ত হলো। তারপর থেকে যেচে গায়ে পড়ে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করত। আমি খুব একটা পাত্তা দিতাম না। এদিকে কলেজে বিদিশার সাথেও ভালো করে আমি কথা বলতে পারি না। মিনু কাছে থাকলে ছুক ছুক করে। কি যে চায় মেয়েটা আমার ঠিক বোধগম্য হয় না। যখন আমাকে ওর বোনের কথাটা তুললো, তখন ভাবলাম এটা মনে হয় একটা বাহানা। এই সুযোগে আমাকেও বোধহয় ওর বাড়ীতে নিয়ে যেতে চাইছে।
আমি কিছুতেই মিনুর সাথে ভীড়বো না। ওর বাড়ীতেও যাবো না। এরপরে সৌগত যখন এসে আমায় বললো, বিশ্বাসটা কিছুটা হলেও হল। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজী হতে পারছিলাম না। গানের মাষ্টারি করে পয়সা রোজগার করার ইচ্ছা আমার একেবারেই নেই। এটা স্রেফ বন্ধুত্বের খাতিরে আমাকে করতে হবে, আর এর জন্য কিছুটা সময়ও আমার নষ্ট হবে।
আমি সৌগতকে না করে দিয়েছি, কারণ বিদিশাও শুনে আমাকে মানা করে দিয়েছে। ঠিক ফাংশনে যাবার আগের দিন মিনু এসে প্রায় পায়ে ধরে আমাকে সাধাসাধি করতে শুরু করলো। ‘দেব’ তোর পায়ে পড়ছি, তোকে রিকোয়েস্ট করছি, তুই প্লীজ একবার চল। সেরকম হলে সপ্তাহে একদিনের জন্য আসবি। ক্ষতি কি আছে? আমার বোন তাতেই খুশি হবে।
বোনকে খুশি করার জন্য আমাকে যেতে হবে? এতো ভারী আবদার। বললাম, ঠিক আছে কাল একবার যাবো। কিন্তু শেখাবো কিনা বলতে পারছি না। তোর বোনের গলাটা একবার দেখে নেবো। তারপর আমার ভালো ওস্তাদের সাথে জানাশোনা আছে। তোর বোনকে ওখানে পাঠিয়ে দেবো, ভালো তালিম পাবে।
মিনু তাতেই খুশী হল। সেদিন আমার কলেজে গিয়ে, ওখান থেকে মিনুদের বাড়ীতে যাবার কথা। সকালে বিদিশা, ফোন করে বললো, ‘এই আজ একটা ফাংশন দেখতে যাবে? নেতাজী ইন্ডোরে। বোম্বে থেকে ভালো ভালো আটিস্ট আসছে।
আমি বললাম, টিকিট কত করে? বিদিশা বললো, তিনশ টাকা করে। ওই নিয়ে তোমাকে কিছু চিন্তা করতে হবে না। টিকিটের দাম আমি দেবো। তবে আমি বাড়ীতে কিছু বলতে চাই না। বাবা শুনলে যেতে দিতে চাইবে না। কলেজে না গিয়ে আমরা না হয় একটু ঘুরবো, ফিরবো, তারপর বিকেলে পৌঁছে যাবো, নেতাজী ইন্ডোরে।
মিনুকে শেষমেষ কথা দিয়েও কলেজে যাইনি বিদিশার জন্য। বিকেলবেলা আমার বাড়ীতে এসে হাজির। সাথে সৌগতকেও নিয়ে এসেছে। কেন কলেজে যাইনি, সেটা আবার যাচাই করছে এসে। সাংঘাতিক মেয়ে।
বিদিশার মত আমাকে প্রেম নিবেদন করেনি মিনু। কিন্তু ওর ওই একটা আবদার মেটাতে গিয়ে আমাকে কত খেসারত দিতে হয়েছিল, সে কথা বলবো আপনাদের, পরে।
ডায়েরীর কয়েকটা পাতা লেখা শেষ করে এবার আমি উঠে পড়লাম। সত্যি অনেক দেরী হয়ে গেছে। এবার রেডী হয়ে আমাকে বেরোতে হবে। মাও দেখি তখন আমার খাবার বেড়ে দেবার তোড়জোড় করছে। সেলফোনটা হাতে নিয়ে ভাবছি, শুভেন্দুকে একটা ফোন করবো কিনা? আমার যেন আর তর সইছে না। ভাবছি, সাতটা নয়, দুঘন্টা আগেই নয় ওর বাড়ী চলে যাবো। গিয়ে বলবো, ‘দ্যাখ, তুই ডেকেছিস, আমি আগে ভাগেই তাই চলে এসেছি। এবার বল, কি সারপ্রাইজ দিবি আমাকে।’
ব্যাপারটা জানতে খুব ইচ্ছে করছিলো। তখন কত করে জানতে চাইলাম। শুভেন্দু কিছুতেই বললো না আমাকে। ওখানে না যাওয়া অবধি ও কিছুই বলবে না আমাকে। শুভেন্দু বলেছে, সন্ধেবেলা রনিও আসবে ওর বউকে নিয়ে। তিনজনে আমরা গল্প করবো, খুব মজা হবে।
সারপ্রাইজের কথাটা এখনো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জানি, শুভেন্দুর স্বভাবটা বরাবরই এরকমের। ও কিছুতেই আগে থেকে কিছু বলে না। আমাকে যেমন বিদিশাকে চিঠি দেবার ব্যাপারটা লুকিয়েছিল। একবার কাউকে কিছু না বলে কুলুমানালি সিমলা ঘুরে এলো। ফিরে যখন এলো তখন ও খুব অসুস্থ। বাড়ীতে গিয়ে জানলাম ও বেড়াতে গিয়েছিল তারপর ফিরে এসেই এই কান্ডটা বাঁধিয়েছে। অথচ কলেজে আমাদের কাউকেই কিছু বলে যায়েনি ও। বাবু ফিরে এসেছেন ওখান থেকে। সুন্দর সুন্দর কিছু গিফ্ট কিনে এনেছেন বন্ধুদের জন্য। আমাকে বললো, কলেজে যেতে পারছি না, তাই তোদের বাড়ীতে ডেকে গিফ্টগুলো সব দিচ্ছি, এটাও একধরনের সারপ্রাইজ।
শুভেন্দু কখন কি বলে, আর কখন কি করে বসে বোঝা মুশকিল। আমাকে বললো, ভাবছি ‘দেব’ এবার তোদের মত আমিও একটা প্রেম করবো। তোকে আর সৌগত দেখে আমারও লাইন মারতে ইচ্ছে করছে শালা! ভালো জমিয়েছিস তোরা, দুজনে যা শুরু করেছিস, এবার না ইতিহাস রচনা হয়ে যায়।
প্রেমের অনেক ডেফিনেশন আছে। শুভেন্দুকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। শুভেন্দু বলতো, প্রেম হচ্ছে সব বেকার জিনিষ। ওসব মূর্খরা করে। চালু লোকেরা কখনও প্রেম করবে না। দুদিন মেয়েটেয়ে নিয়ে ঘুরবে, তারপর ফুটিয়ে দেবে। ব্যাস।
আমি বলতাম ও তো অসামাজিক প্রেম হয়ে গেল। সামাজিক প্রেমের, সত্যিকারের ভালোবাসার ডেফিনেশনটাই অন্যরকম।
শুভেন্দু বলতো, তুই বোঝা দেখি-
আমি বলতাম, দেখ, তুই প্রেরক হিসেবে বা প্রেরনাদায়ক হিসেবে কাউকে চাস না জীবনে?
শুভেন্দু বলতো, প্রেরণা না হাতি। এখন মেয়েরা শুধু পয়সা চায় পয়সা। বুঝলি? ও তোকে মোটিভেশন দেবে কি? পয়সাটাই ওদের কাছে মোটিভেশন।
-তাহলেও জীবন সঙ্গিনীতো একটা দরকার। যে তোকে অনাবিল এক আনন্দের স্তরে নিয়ে যাবে। তোকে ভালোবাসবে, আদর করবে, সোহাগ করবে, চুম্বন করবে। একাকীত্ব ঘুচিয়ে দেবে। রমনী ছাড়া জীবন কি করে কাটাবি, এ কখনো হয় নাকি?এখন যে যুবতী, সেই তো হবে তোর রমনী।’
আমার কথা শুনে কেমন ভাবুক মত হয়ে গেল শুভেন্দু। শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে বললো, কিন্তু কার সাথে প্রেমটা করা যায় বল দেখি। তুই তো শালা ভালোটাকে নিয়ে বসে আছিস। কলেজে মেয়েগুলো সব ঢোকে, দুদিনের মধ্যেই অন্য ছেলের সাথে ফিট হয়ে যায়। সেরকম কে আছে, যে আমার সাথে প্রেম করবে?
সৌগত শুক্লার পেছনে লাইন দিয়ে বসে আছে। এদিকে শুক্লা তো কিছুতেই রাজী হচ্ছে না। আমাকে শুভেন্দু বললো, ‘তুই তাহলে এক কাজ কর। সৌগতর যখন কোন চান্স নেই, আমাকে শুক্লার সাথে ভিড়িয়ে দে। ওকে আমার জীবন সঙ্গিনী বানিয়ে নিচ্ছি।’
-তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমরা এই চারজনে এত ভালো বন্ধু। শুধু একটা মেয়ের জন্য বন্ধুত্ব খারাপ করবি নাকি?
শুভেন্দু দেখলো না ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ও আশা ছেড়ে দিল। দুদিন বাদে হঠাৎই আমার পাশে বসে বললো, ‘তোদের এই প্রেম টেম কিছু টিকবে না। সব বকওয়াশ জিনিষ। ভেবে দেখলাম, আমি যা আছি ঠিকই আছি। এসব রমনী ভালোবাসার চক্করে পড়ে থেকে লাভ নেই। এই মেয়েগুলো সব দুষ্টু। এরা সব মুখোস পড়ে থাকে। আমার বাবা দুষ্ট গোয়ালের চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো।
কথাটা ইয়ার্কী মেরেই বলেছিল শুভেন্দু। কিন্তু ওর কথাটা সত্যি হয়ে গেল। আমার আর সৌগতর দুজনেরই প্রেম টিকলো না শেষ পর্যন্ত।
স্নান সেরে আমি সবে মাত্র বাথরুম থেকে বেরিয়েছি। মা বললো, দেখতো নিচে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। কে যেন নিচে থেকে ‘দেব” দেব’ বলে ডাকছে। ও তো মেয়ের গলা।
আমি খালি গায়ে পাজামাটা গলিয়ে নিয়ে বারান্দায় গেলাম। দেখলাম এক মহিলা পেছন ফিরে আমার পাড়ার একটা ছেলেকে কি জিজ্ঞাসা করছে। একটু পরেই মহিলা পেছন ফিরলো। আমি দেখে অবাক। দেখি শুক্লা হাত নাড়ছে আমার দিকে রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে।
অবাক হলাম। শুক্লা এসেছে, এতদিন পরে। আমার বাড়ীতে কি মনে করে? সকাল থেকেই পুরোনো বন্ধুরা আমাকে সব স্মরণ করছে একে একে। শুভেন্দুর ফোনের পর শুক্লাও এতদিন পরে হঠাৎ?
নিচে থেকেই শুক্লা বললো, কোনদিক দিয়ে যাবো বলতো? তোদের সিঁড়িটা কোনদিকে?
আমি বারান্দা থেকে ওকে ওপরে ওঠার সিঁড়িটা দেখিয়ে দিলাম। নিচে দাঁড়িয়ে তখনো শুক্লা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। ওর হাসিটা দেখে মনে হল, শুক্লার সেই পুরোনো হাসি। কলেজে ওর হাসি দেখে সৌগত বলতো, ‘মেয়েরা বিয়ের আগে সব হাসে, আর বিয়ের পরে ভালো স্বামী না জুটলে সব কাঁদতে শুরু করে। ওর এই সুন্দর হাসিটা কতদিন থাকবে বলতো ‘দেব’? বলছি আমার অফারটাকে অ্যাকসেপ্ট করে নিতে, কিছুতেই করছে না। আমি ওকে রাজরানী করে রেখে দিতাম, এই হাসিটাও ও সারাজীবনের মত প্রানখুলে হাসতে পারতো। তা না, শুধু শুধু ও জেদ ধরে বসে আছে।’
শুক্লা যখন সৌগতর সাথে প্রেম করা শুরু করলো, তখন আবার সৌগতর মুখে হাসি ধরে না। এমন ভাব করতে লাগলো, তখন আবার আমাকে চেনে না। অথচ একসময় আমার কাছে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো। শুক্লার মন পাচ্ছে না বলে আমার কাছে এসে আফসোস করত। বলতো, ‘মেয়েদের মুখে হাসিটাই কি যথেষ্ট নাকি? ওসব ঢঙ্গী হাসি। আসল হল, মেয়েদের মন। শুক্লার মনটা খুব কঠোর। আমার প্রতি এতটা নির্দয় হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না।’
ওকে বলতাম, ‘তুই এককাজ কর, কালীঘাটে গিয়ে একটা মানত করে আয়। শুক্লার সাথে তোর ফিটিং হয়ে গেলে মাকালীকে খুশি করে আসবি। মানত করলে মা কালী তোর মনবাসনা নিশ্চই পূরণ করবে।’
সৌগত বলতো, ‘তুই হচ্ছিস মহা ঢ্যামনা। বিদিশাকে পেয়ে গেছিস তো, এখন আর আমাকে নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। আমি শালা দেবদাসের মত জ্বলে পুড়ে মরছি, কারুর আমাকে নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই?’
এরপরে এমন কান্ড করে বসলো সৌগত আমার তো মাথায় হাত। দেখি অ্যানুয়াল ফাংশনের দিন সকালবেলাই এক পেট মাল খেয়ে বসে আছে। কলেজে এসে শুক্লাকেও হঠাৎ সামনাসামনি পেয়ে গেল। সৌগতর চোখদুটো তখন এমন টকটকে লাল হয়ে রয়েছে, শুক্লা ওই দেখে ভয় পেয়ে গেলো। সৌগত বললো, তুমি আমার সাথে প্রেম করবে কিনা বলো? নইলে আমি কিন্ত-
শুক্লা প্রথমে ভয় পেয়েছিল, তারপরে একটু সাহসী হয়ে বললো, কি করবে? সোসাইড? শোলের ধর্মেন্দ্রর মত?
আমি সৌগতকে বললাম, এই সৌগত কি হচ্ছে টা কি? সাতসকালে মাল খেয়ে এসব কি করছিস তুই?
হঠাৎ কোত্থেকে তখন শুভেন্দুও ওখানে এসে হাজির। আমাকে বললো, ‘লে হালুয়া এর আবার কি হল?’
আমি শুভেন্দুকে কিছুটা দূরে নিয়ে গেলাম। কানে কানে বললাম, ‘ওকে কিছু বলিস না। তাহলে আরো বামাল করবে। আমি শুক্লাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি।’
শুক্লা তো রেগে অস্থির। আমাকে বললো, ‘মাল খেয়ে আবার চোখ রাঙাচ্ছে আমাকে। কত বড় সাহস ওর। তুই কি ভাবিস? যার তার সাথে শুক্লার মত মেয়ে ভেড়ে না। আগে ওর চরিত্রটাকে ঠিক করতে বল।’ তারপরে ওর সাথে প্রেম করবো কিনা আমি ভেবে দেখবো।’
পাছে সৌগত বেশী হজ্জূতি না করতে পারে। শুক্লা সবসময় আমার পাশেই বসে রইলো। সৌগত তখনো চোখ বড় বড় করে দেখে যাচ্ছে শুক্লাকে দূর থেকে। একটু পরে দেখি সৌগত মাথা নিচু করে হেঁটে চলে যাচ্ছে কলেজ ছেড়ে। শুভেন্দু মাথা নেড়ে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছে মালটা?সুইসাইড করতে নাকি? এই শালাগুলোর ন্যাকামো দেখলে আর বাঁচি না।’
কলেজ ছেড়ে সৌগত চলে গেল। এবার শুভেন্দু শুক্লার কাছে গেল। শুক্লাকে বললো, ‘সৌগতর জন্য আমি এতবড় স্যাক্রিফাইস করলাম, আর তুই কিনা ব্যাচারেকে কষ্ট দিচ্ছিস?’
শুক্লা বললো, ‘মানে?’
শুভেন্দু বললো, ‘দেব’ আমাকে বলেছিলো, ‘বিদিশা আর ওর মত আমাকেও একটা প্রেম করতে। আমি রাজী হয়েছিলাম, শ্র্রেফ তোর জন্য। তোকে আমার মনে ধরেছিল। তারপরে দেখলাম, না কাজটা করা ঠিক হবে না। এটা সৌগতকে দূঃখ দেওয়া হবে। ও এমনি তোকে ভালোবাসে। ব্যাচারাকে কষ্ট দিয়ে আর লাভ নেই। আর তুই কিনা ওকে শেষ পর্যন্ত দেবদাস বানিয়েই ছাড়লি? ‘পার্বতী’ এই ছিল তোর মনে?’
শুক্লা কিন্তু কিন্তু করেও শুভেন্দুর কথাটার শেষ উত্তর দিতে পারেনি। তারপর থেকে সৌগত বেশ কয়েকদিন ধরে কলেজে আর আসছে না। আর শুক্লাও কলেজে এসে খালি আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘সৌগত এসছে? আজও এলো না? পরপর তিনদিন হয়ে গেল ওর দেখা নেই। কোথায় গেল ছেলেটা মনটা খারাপ লাগছে।’
আমি বিদিশাকে যা করতে পারেনি, শুক্লা তাই করে বসলো। যেদিন সৌগত কলেজে আবার এলো। দেখলাম ওর চোখ মুখ শুকনো। যেন শুক্লার জন্য কেঁদে কেঁদে চোখের তলায় কালি পড়ে গেছে। ভালো করে কারুর সাথে কথা বলছে না। মাথা নিচু করে বসে আছে একদম লাস্টের সীটে। শুক্লা সৌগতকে দেখে আমার পাশের সীটটা থেকে উঠে গেল ওর কাছে। সৌগতর পাশে গিয়ে বসলো। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মুখটা নিচু করে সৌগতকে বললো, ‘কি হয়েছে তোমার?কলেজে আসোনি কেন এতদিন?’
সৌগত জবাব দিচ্ছেনা। মুখ নিচু করে তখনো বসে আছে। আমাদের ফিজিক্স এর প্রফেশর নয়নবাবু এলেন, ক্লাস শুরু হলো। আমি নোট নিচ্ছি, স্যারের লেকচার শুনছি। হঠাৎই চোখটা গিয়ে পড়ল পেছনে ওদের সীটে। দেখি শুক্লা তখন মাথাটা এলিয়ে দিয়েছে সৌগতর ঘাড়ে। যেন পার্বতী মাথা গুঁজেছে দেবদাসের শরীরে। অমর প্রেমকথার রেপ্লিকা দেখছি যেন চোখের সামনে। জানতাম যা শুরু করেছে দুজনে, নয়নবাবুর ঠিক চোখে পড়বে। হলও তাই। স্যার, ওদের দুজনের ওই রকম দেখে হঠাৎই ধমক দিয়ে বললেন, ‘সৌগত আর শুক্লা, কি করছো তোমরা পেছনে? বিহেভ ইয়োরসেল্ফ।
শুভেন্দু ফিক ফিক করে হাসছে। আমাকে পরে বললো, ‘দেখলি? শালা কত নাটকই পারে এরা দুজনে।’
সিঁড়ি দিয়ে শুক্লা উপরে উঠে এসেছে দ্বোতলায়। কলেজে যখন পড়তো, কোনদিন আমার এই ফ্ল্যাটে ও আসেনি। দুদুবার মিনু এসেছিল আর বিদিশাতো বেশ কয়েকবার। কিন্তু শুক্লাকে এতদিন পরে আজ প্রথম আসতে দেখে আমি সত্যি অবাক হয়ে গেলাম। ওকে বললাম, আরে ‘শুক্লা? তুই? আমি তো ভাবতেই পারিনি তুই আসবি। এ কাকে দেখছি আমি? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।’
দরজা খুলে ঘরে ঢোকালাম ওকে। শুক্লা বললো, ‘আমি জানতাম তুই অবাক হবি। কেমন যেন পরপর হয়েগেছিস তুই। খোঁজখবরও রাখিস না। ফোন নম্বরটাও সেই যে একবার দিয়েছিলিস, হারিয়ে ফেলেছি। পুরোনো মোবাইলটা জলে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল, আর আমার পুরোনো বন্ধুদের নম্বরগুলোও সব হারিয়ে গেল। কাউকে পাই না। না তোকে, না শুভেন্দুকে, না রনিকে। কাউকেই নয়। শেষমেষে আজ আর থাকতে পারিনি। ট্যাক্সি ধরে তোর কাছে ছুটে এসেছি।’
ওকে বললাম, ‘বেশ করেছিস। এতদিন বাদে আমাকেও যে তোর মনে পড়েছে। আয় ভেতরে আয়।’
আমার বসার ঘরে শুক্লাকে বসালাম, বললাম, কি খাবি বল? ওফ তোকে দেখে আমার যা আনন্দ হচ্ছে না, কি আর বলবো।
শুক্লা বললো, তা গায়কমশাইয়ের খবর কি? বিয়ে থা কি করা হয়েছে? না এখনো সেই-
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। ভাবছি, শুক্লার কথার কি উত্তর দেবো। ওকে বললাম, ‘না আমি ভাবছি চিরকুমারই আমি থাকতে চাই।’
শুক্লা হেসে একটু টিপ্পনি করলো আমাকে। বললো, চিরকুমার না ছাই? বলো, এখনো তোমার বিদিশার জন্য মন পড়ে আছে। তাই না? বিয়ে করে যে তোকে ছেড়ে চলে গেল। আর তুইও পারিস।
মা তখন ঘরে চলে এসেছে। শুক্লা মাকে দেখে বললো, ‘মাসীমা, ছেলের এখনো বিয়ে দেন নি? কি করেছেন কি? আমি তো ভাবলাম, এতোদিন বাদে দেবের বাড়ী যাচ্ছি, নিশ্চই ওর বউটাকেও দেখতে পাবো।’
মা বললো, ‘কি আর করবো বলো? এটা তো আমার ছেলেরই মর্জী সব। আমি তো কবে থেকে ওকে বলছি। উনি শুনবেন, তবে তো কথা।’
মার সাথে শুক্লার আলাপ করালাম। মাকে বললাম, ‘মা, একে তুমি চেনো? এ হল শুক্লা। আমার কলেজের বান্ধবী।’
মা যেন পুরোনো কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। মানে মিনুর চেহারার সাথে শুক্লার চেহারাটা মেলানোর চেষ্টা করছে। ভাবছে আগে ওকে দেখেছে কিনা? আমি ঠিক বুঝে গেলাম, মাকে বললাম, ‘না মা, একে তুমি আগে কখনো দেখো নি। এর নাম শুক্লা। ও আজই প্রথম আমার বাড়ীতে এলো।’
মা এবার বুঝতে পারলো, শুক্লাকে বললো, ‘চা খাবে তুমি? তাহলে চা করে নিয়ে আসি।’
শুক্লা বললো, ‘তা খেতে পারি মাসীমা। তবে আপনি ব্যস্ত হবেন না। আজ আমি দেবের কাছে এসেছি, ওরজন্য একটা বীরাট সারপ্রাইজ আছে বলে। আপনার ছেলে শুনলে একেবারে চমকে যাবে।’
কথাটা এমন ভাবে বললো, আমি সত্যি চমকে গেলাম। এও এতদিন পরে এসে বলে সারপ্রাইজ? কি হচ্ছেটা কি আজকে? সকাল থেকে উঠে খালি সারপ্রাইজের কথা শুনছি। কিসের সারপ্রাইজ?
শুক্লা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আছে আছে বৎস। সাধে কি তোর কাছে আমি এসেছি? এমনি এমনি? খবর তো একটা আছে। ক্রমশ প্রকাশ্য।’
আমার মনে হল, এরা বোধহয় সবকটা এতদিন পরে একজোট হয়েছে আবার। আমার মুখে কি হাসি ফোটাবে কে জানে? কিছুতো একটা ব্যাপার নিশ্চই আছে, যেটা শুভেন্দু, শুক্লা দুজনেই জানে। অথচ আমাকে বলতে চাইছে না।
আমি বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম। মনে পড়লো, শুভেন্দুর কথা। শুভেন্দু বলেছে, আজ ওর বাসায় যেতে। সেখানে রনি থাকবে। আর সাথে রনির বউ থাকবে। কিন্তু শুক্লার কথা তো বলেনি। আবার শুক্লা সাতসকালে আমার বাড়ীতে ছুটে চলে এসেছে। আমাকে সারপ্রাইজের কথা বলছে। তাহলে শুক্লাও নিশ্চই জানে বিষয়টা। আসল ব্যাপারটা কি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
ওকে বললাম, ‘কে বলেছে তোকে? শুভেন্দু?’
শুক্লা যেন আকাশ থেকে পড়লো। আমাকে বললো, ‘শুভেন্দু কেন বলবে? আমার কাছে তো ওর ফোন নম্বরই নেই। একটু আগেই তোকে তো বললাম। সব ফোন নম্বরগুলো হারিয়ে গেছে।’
ঠিক ক্লিয়ার হচ্ছে না। শুক্লাকে বললাম, দাঁড়া, দাঁড়া। তুই বলছিস শুভেন্দুর ফোন নম্বর তোর কাছে নেই। অথচ শুভেন্দুও আমাকে ফোন করে একই কথা বলেছে।
শুক্লা বললো, কি বলেছে?
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
ওই সারপ্রাইজ। তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে। কি সারপ্রাইজ কে জানে। আমাকে বললো, এখানে এলে সব জানতে পারবি। সন্ধেবেলা ওর বাড়ীতে যেতে বলেছে। ওখানে গেলে নাকি সারপ্রাইজটা আমাকে দেখাবে।
শুক্লা বললো, ‘তুইও শুভেন্দুর কথা বিশ্বাস করিস? ও আর্ধেক কথা মুখ দিয়ে বলে। আর আর্ধেক কথা পেট দিয়ে। পট্টী মেরে ওখানে নিয়ে যাচ্ছে তোকে। ও আবার দেবে তোকে সারপ্রাইজ?’
আমার কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সব অদ্ভূতুড়ে লাগছে। এরা সব পুরোনো বন্ধুগুলো আমাকে নিয়ে মজা করছে নাকি? শুক্লাকে বললাম, ‘কি সারপ্রাইজ বলবি তো? তবে তো বুঝবো। তুইও বলবি না। শুভেন্দুও বললো না। তাহলে আমি কোথায় যাই বলতো?’
শুক্লা দেখলাম, ওর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে কি একটা বার করলো। আমার হাতে দিয়ে বললো, এটা দেখতো।
হাতে নিয়ে দেখলাম, ওটা একটা ছোট্টো ভাঁজ করা কাগজ, তাতে হিজিবিজি কিসব লেখা রয়েছে। শুক্লাকে বললাম, ‘এগুলো কি? আমি তো কিছুই ভালো করে বুঝতে পারছি না।
শুক্লা বললো, ‘ভালো করে দেখ। তাহলেই বুঝতে পারবি।’
একটা ছোট্ট চিরকূটের মত কাগজ। তাতে মাঝখানে দুতিন লাইন লেখা রয়েছে। কিন্তু লেখাটাকে পেন দিয়ে হিজিবিজি করে কে যেন কেটে দিয়েছে। ভালো করে লেখাটা পড়া যাচ্ছে না। শুধু ওপরে ছোট্ট একটা নাম। নামটা কষ্ট করে হলেও পড়া যাচ্ছে। ব এ রস্সিকার, দ এ রস্সিকার, তালবশ্য এ আকার। এ কি? এতো বিদিশা। বিদিশাকে লেখা শুভেন্দুর সেই চিঠি। তোর কাছে এলো কি করে? আমার নাম করে বিদিশাকে যে চিঠিটা শুভেন্দু দিয়েছিল। এতো সেই চিঠিটা। তুই এই চিঠিটা কোথায় পেলি?
শুক্লাকে দেখি, একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই পুরোনো দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আবার মনে করাচ্ছে আমাকে। কিছু দূঃখ, কিছু আনন্দ এই নিয়েই তো জীবন। সবাই তো সুখী হতে চায়। তারমধ্যেও কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না। আমাকে বললো, আমিও পারলাম না জীবনে সুখী হতে। আর তুই ও নয়।
কাগজটা হাতে নিয়ে ভালো করে আবার দেখতে লাগলাম। তলার লেখাগুলো সব পেন দিয়ে কাটা। নিজের নামটাই যা কাটেনি বোঝা যাচ্ছে।
শুক্লাকে দেখলাম, কিরকম অদ্ভূত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আমার মনের ভেতরটা বোঝার চেষ্টা করছে। আমাকে বললো, কলেজ ছাড়ার পর তোকে তো কোনদিন বলিনি। ভেবেছিলাম বলবও না কোনোদিন। তুইকি ভেবেছিলিস, বিদিশা এই কান্ড করতে পারে?
আমার মুখে যেন ভাষা নেই, সেভাবেই বললাম, কিন্তু বিদিশার তোকে এই চিঠি?
শুক্লা বললো, ‘হ্যাঁ তোকে না বলেই আমি সেদিন বিদিশাদের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। সেদিন বিদিশাকে আমি অনেক করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। ওকে বলেছিলাম, দেব কে তুই ভুল বুঝছিস বিদিশা। ওর মত ছেলে হয় না। দেব যা করেছে, না বুঝেই করে ফেলেছে। ওকে তুই ক্ষমা করে দে। ছেলেটার কাছে গিয়ে একবার দেখ। তোর জন্য শুধু শুধু ও কত কষ্ট পাচ্ছে।’
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি শুক্লার দিকে। শুক্লা বললো, ‘সেদিন কিছুতেই আমার কথা মানতে চাইল না বিদিশা। অতকরে ওকে বোঝলাম, তাও মানলো না। যখন ফিরে আসছি, আমার হাতে এই কাগজটা দিলো। আমাকে বললো, ‘দেবকে দিও। এটা ওরই চিঠি। মন থেকে যখন মুছে ফেলেছি, তখন চিঠিটা রেখেই বা কি হবে? চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলাম হিজিবিজি করে কেটে দিয়েছে পুরো চিঠিটা। রাগে, ক্রোধে বিদিশা তখন ফেটে পড়ছে। আমি তাও বললাম, এ চিঠি আমি দেবকে দিয়ে কি করবো বিদিশা? তোর যদি রাখতে ইচ্ছে না হয়, তুই চিঠিটা কোথাও ফেলে দে। এ চিঠি আমাকে কেন দিচ্ছিস?’
শুক্লা বললো, সেদিন তোদের দূরন্ত প্রেমটার ইতি সমাপ্তি ঘটলো। চোখের সামনে দেখলাম, ভালোবাসার মৃত্যু ঘটেছে। ভালোবাসাকে নাকি অত সহজে ধরে রাখা যায় না। তুই ও পারলি না। আর আমি তো নই ই।
আমি বললাম, আমাকে তো তুই বলিসনি। কেন গেলি তুই বিদিশার বাড়ীতে?
শুক্লা বললো, ‘তোকে তো আমি চিনি। তোর জন্য শুক্লা যা করতে পারবে। আর কেউ নয়। সেদিন বাড়ী বয়ে ওর কাছে আমি গেছিলাম। অনেক আশা নিয়েই গেছিলাম। কিন্তু বিদিশার মনকে আমি সেদিন ঘোরাতে পারিনি। কেন জানি না, আমার মনে হয়েছিল, মেয়েটার মন বলে কিছু নেই। চট করে যার বিশ্বাস এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারে। সে কি করে তোর মনটা জিততে চেয়েছিল? চিঠিটা আমার হাতে দিতে এতটুকু ওর বাঁধলো না?
শুক্লা বললো, ‘ভাবছিস এতদিন পরে এই চিঠি তোকে কেন আমি এনে দেখাচ্ছি। তাই তো? রাগে ঘেন্নায়, আমারো সেদিন মনে হয়েছিল, ওর কাছে আমি গেলাম, আর ও বলছে এই চিঠিটা তোকে এনে দিতে? বিদিশার মনটা এত নিষ্ঠুর? তোর মনের অবস্থা তখন কি,আমি তো জানি। তোকে এনে বিদিশার চিঠিটা দেখাবো আর বলবো, এই দেখ, কি করেছে বিদিশা, এই দেখ সেই চিঠি। হিজিবিজি করে কেটেছে লেখাগুলোকে। এর জন্য তুই আর কত কষ্ট পাবি? ভুলে যা ওকে। বিদিশার মত মেয়ে তোর যোগ্য নয়।
আমি বললাম, তারপরে?
শুক্লা বললো, ‘তারপরে মন চাইলেও আর আসতে পারিনি তোর কাছে। জানি তুই কষ্ট পাবি। এই চিঠি তোকে কিছুতেই দেখানো যায় না। চিঠিটা তাই নিজের কাছেই রেখেদিলাম। ডায়েরীর পাতার মধ্যে কোথায় যে রেখেছিলাম, মনেও নেই। ঘরের মধ্যে থেকেই চিঠিটা তারপর হারিয়ে গেলো। আর খুঁজেও দেখিনি কোনদিন। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে পুরোনো ডায়েরীগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করছি। হঠাৎই দেখি, পুরোনো একটা ডায়েরীর মধ্যে এই সেই চিঠি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, এতদিন বাদে, তুই চিঠিটা আবার আমার কাছে নিয়ে এলি? কেন হঠাৎ? এ আর দেখে আমি কি করবো?
শুক্লা বললো, যে তোকে কষ্ট দিয়ে চলে গেল, সে অন্তত জীবনে সুখী হোক, তুই তো এটাই চেয়েছিলিস?
আমি বললাম, আমি চাই সবাই ভালো থাকুক। পৃথিবীতে আমিই যদি একমাত্র কষ্ট পাই, তাহলেও কোন দূঃখ নেই। ভগবান সবাইকে সুখ দিক, আমাকে দূঃখ দিলে কোন কষ্ট নেই। ভাগ্যে যা আছে লেখা, সেটা কি আর খন্ডানো যায়? হয়তো এটাই আমার লেখা ছিল জীবনে।
শুক্লা বললো, জীবনটা বড় অদ্ভূত। তাই না দেব?
আমি বললাম, যার যার জীবন যেরকম, সেরকমই তাকে মানিয়ে নিতে হবে। এটাই তো ধ্রুব সত্য।
শুক্লা বললো, ‘বিদিশার জন্য তুই কি এখনো কষ্ট পাস?’
ওকে হেসে বললাম, নিজের কষ্টটা নিজের কাছেই রাখতে হয়। সবাইকে অত বলতে নেই। আমি অন্যের দূঃখটা শুনতে বেশী ভালোবাসি। এই পৃথিবীতে তো আর আমি একা নই। সবার কথাই ভাবতে হবে। ভগবানেরও অনেক দায়িত্ব।
শুক্লা বললো, আমিই না তোকে পরে বলেছিলাম,বিদিশা নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছে।
শুক্লাকে বললাম, হ্যাঁ। তুই ফোন করে আমাকে পরে বলেছিলিস। বিদিশা তোর কাছে পরে দূঃখ করেছে। ও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তখন বিদিশারও আর করার কিছুই নেই। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বিদিশা বিয়ে করে মুম্বাই চলে যাচ্ছে।
শুক্লা অবাক করে আমাকে বললো, বিদিশা, তোকে যদি এতদিন পরে তোকে আবার দেখতে চায়, যাবি না ওর কাছে?
আমি শুক্লার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কি বলছে ও কিছুই বুঝতে পারছি না।
শুক্লা বললো, বিদিশা এখন কলকাতায়। আমি কালকেই ওকে গড়িয়াহাট মোড়ে দেখেছি।
আমি বললাম, হয়তো বাপের বাড়ী এসেছে। তোর সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে গেছে।
শুক্লা বললো, বাপের বাড়ী ও এসেছে ঠিকই। কিন্তু এরপর থেকে এখানেই থাকবে ও। আর ফিরে যাবে না, মুম্বাইতে। বিদিশার স্বামীর সাথে বিদিশার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তাই ও-
আমি বললাম, তোকে কি বিদিশা বললো, এসব কথা?
শুক্লা বললো, হ্যাঁ। অনেক দূঃখ করেই বলছিল। কিন্তু-
কথাটা তখনো শেষ করেনি শুক্লা। আমি যেন কেমন ভাবুক মতন হয়ে গেছি। আপন মনে কি যেন ভাবছি। আর মনে হচ্ছে, পুরোনো দূঃখের স্মৃতিতে দগ্ধ মনটায় হঠাৎই এ যেন এক খুশীর দোলা লাগছে। মরে যাওয়া ভালোবাসাতে নতুন করে আবার প্রাণের স্পন্দন জাগছে। শুনেছি, হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা নাকি কখনো সখনো ঘুরে ফিরে আবার আসে। এটা কি তাহলে তাই? ভগবান কি এইভাবেই প্রেমিক প্রেমিকার পরীক্ষা নেয়? যে দূঃখ দেয়, ভগবান নাকি তাকে কখনো সুখী করেনা। আর যে দূঃখ পায় ভগবান শুধু তার ধৈর্য্যেরই পরীক্ষা নেয়। যেমনটি আমার নিয়েছে ভগবান এই কটা দিন ধরে।
এর থেকেও বড় সারপ্রাইজটা আমার জন্য বোধহয় অপেক্ষা করছিল। শুক্লা যেখানটায় বসে ছিল, ওখান থেকে উঠে এসে আমার পাশে হঠাৎ বসলো। আমার হাত দুটো ধরে বললো, ‘দেব’ তুই কি বিদিশার কাছে আবার ফিরে যাবি?
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কিছু তো ভাবিনি এখনো। তুই বল-
শুক্লা বললো, ‘যাস না দেব, যাস না। আমি বলছি যাস না। বিদিশার কাছে তোর ফিরে না যাওয়াটাই আর ভালো। আমি তোকে-
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
বিদিশার চিন্তাতে আমি কেমন মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম। কি একটা বলতে গিয়ে শুক্লাও হঠাৎই থেমে গেছে। দেখলাম মা, চা নিয়ে ঢুকেছে ঘরে। শুক্লা মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে মা’কে ঢুপ করে একটা প্রনাম করে বসলো। মা, শুক্লার মাথায় দুহাত রেখে বললো, ‘থাক থাক মা, আমাকে আর প্রনাম করতে হবে না। আমি এমনি তোমাকে আশীর্ব্বাদ করছি।’
চায়ের সাথে চানাচুর আর মিষ্টি। শুক্লা বললো, এ কি মাসিমা? দেবকে দিলেন না। শুধুই আমাকে?
মা বললো, ‘ও তো খেয়েছে এই সবে। তুমি খাও। দেব সকালে একবারই চা খায়, তারপরে আর খায় না।’
শুক্লা আমাকে বললো, ‘কলেজে তো খুব চা খেতিস। ঘন্টায় ঘন্টায়। এখন সব কমে গেছে বুঝি?
এক সময়ে চায়ের একটা নেশা ছিল। চায়ের সাথে বিস্কুট আর সিগারেট। বিদিশা বলতো, ‘তোমার এই চায়ের নেশাটা খুব বাজে। আর এত ঘনঘন সিগারেট খাও কেন তুমি? জানো বেশী সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়। গলা খারাপ হয়ে যায়। তোমাকে গলাটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে কিনা?’
আমি বিদিশার জন্য চায়ের নেশা কমিয়ে দিলাম। সিগারেট খাওয়াও ছেড়ে দিলাম। কিন্তু বড়ই অদ্ভূত। বিদিশাই তারপরে আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
শুক্লাকে দেখলাম, চা খাচ্ছে, আর বারে বারেই আমার দিকে তাকাচ্ছে। কি যেন বলতে গিয়ে একটু আগে থেমে গিয়েছিল ও। শুক্লার এমন দৃষ্টি, কলেজে যখন পড়তাম, আগে কখনো দেখিনি। আমার পাশেই বসে রয়েছে ও। অথচ কলেজে যখন পাশে বসতো, কোনদিন এভাবে কখনো তাকাতো না আমার দিকে।
-’কিছু বলবি শুক্লা? কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলি তুই?’
শুক্লা বললো, ‘তোকে যদি কিছু বলি, তাহলে তোর মান হবে। অভিমান হবে আমার ওপর। রাগ করবি না বল?’
শুক্লাকে বললাম, ‘তুই তো আমার ক্ষতি কোনোদিন চাস নি। রাগ করবো কেন? কি বলছিলিস বল?’
চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে, আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সব বলবো তোকে, যদি পারিস, আজ সন্ধেবেলা আসবি একবার আমার ফ্ল্যাটে?’
আমি বললাম, ‘সন্ধেবেলা? আমাকে তো শুভেন্দুও আবার ডেকেছে ওর বাড়ীতে। কি করে যাবো?’
শুক্লা বললো, ‘ওকে বারণ করে দে। বল, শুক্লাও আমাকে ডেকেছে। আমি শুক্লার ফ্ল্যাটে যাচ্ছি।’
শুভেন্দুকে আজ অবধি কোনদিন না করিনি। শুক্লার কথায় না বলবো, মনটা কেমন খচখচ করতে লাগলো। বিদিশার চিন্তাটাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। শুভেন্দু আমাকে সারপ্রাইজের কথা বলেছে, সেটাও আমাকে জানতে হবে। ওকে যদি না বলে দিই।, শুভেন্দু অসন্তুষ্ট হবে, সারপ্রাইজটাও আমার জানা হবে না।
-’কি হল? কিছু বলছিস না যে? বল আজ আসবি কিনা? আমি তো এখন অফিসে যাবো। ওখান থেকে ফিরে সন্ধেবেলা ফ্ল্যাটেই থাকবো। তোর জন্য অপেক্ষা করবো। আসবি তো?’
সল্টলেকের কোয়ালিটি বাস স্টপেজের কাছে শুক্লারা ফ্ল্যাট কিনেছিল আমি জানি। এই শুভেন্দুই আমাকে বলেছিল, ‘জানিসতো দেব, শুক্লারা এখন সল্টলেকে থাকে। আগে থাকতো বেহালায়। এখন ওখানেই রয়েছে মা বাবাকে নিয়ে।’
শুভেন্দু পুরোনো বন্ধু বান্ধবদের সব খবর গুলো কেমন পেয়ে যায়, অথচ আমি পাই না। নিজেকে বেশ কিছুদিন গুটিয়ে রেখেছিলাম, হয়তো সেইজন্য।
শুক্লা বললো, ‘আমার ফ্ল্যাটটাতেও তো তুই কোনদিন আসিস নি। তা একবার এসে দেখে যা। সবাই তো এসেছে। শুধু তুই বাকী।’
আমি বললাম, ‘সবাই বলতে কে কে?’
শুক্লা বললো, ‘কেন শুভেন্দু, রনি। ওরা দুজনেই তো এসেছে।’
-’আর সৌগত?’
নামটা শুনে মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল শুক্লার। আমাকে বললো, ‘কষ্ট দিচ্ছিস?’
ভাবিনি ওর মুখটা এমন করুন হয়ে উঠবে। শুক্লাকে আমি কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। চোখের কোনে জলটা চিকচিক করছিল। রুমাল দিয়ে তাড়াতাড়ি চোখটা মুছে নিয়ে বললো, ‘না তোকে এমনি বললাম, আমি জানি তুই কোনদিন কাউকে কষ্ট দিতে শিখিস নি।’ সৌগত কি করে আসবে? ও তো বিয়ে করে কবেই চলে গেছে আমাদের থেকে অনেক দূরে। মনে নেই? ওর বিয়েতে তো আমিও তো গিয়েছিলাম।’
বললাম, জানিস সৌগত এখন কোথায়?
শুক্লা বললো, ‘শুনেছিলাম তো অ্যামেরিকায়। নিউ জার্সি তে রয়েছে। যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল, কি সুন্দর দেখতে মেয়েটাকে। বিয়ে করার একবছর পরেই অ্যামেরিকাতে চলে গেল। আমাকে একটা বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছিল সৌগত। তখন আমি বেহালাতেই রয়েছি। কার্ডটা পেয়ে যাবো কিনা ভাবছি। তারপরই সৌগত আমাকে ফোন করলো। বললো, কি গো আসবে না? নাকি রাগ এখনো রয়েছে আমার প্রতি? আমি কিন্তু সব কিছু ভুলেই ওর বিয়েতে গিয়েছিলাম।’
শুক্লাকে বললাম, ‘তোকে কিন্তু সেদিন দেখে আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম শুক্লা। পরে ভেবেছিলাম, শুক্লার মনটাও কি তাহলে বিদিশার মত বিষিয়ে গেল। এত সুন্দর গড়ে উঠেছিল তোদের প্রেমটা। অথচ হঠাৎই কোথাথেকে কি যেন হয়ে গেল। তুই আবার সৌগতর বিয়েতেও এসেছিলিস, আমার খুব অবাক লেগেছিল।’
শুক্লা বললো, ‘অবাক তো লাগবেই। তুই যে আমার কথা ভাববি, আমি খুব ভালো করেই জানতাম। এই সৌগতই না কতদিন তোর পেছনে পড়েছিল, আমাকে রাজী করানোর জন্য।’
আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ। মনে পড়ে সেসব কথা। তারপরেই ওকে বললাম, ‘সৌগতর জন্য তোর কোনদিন আফশোস হয় না শুক্লা? দুজনে পৃথিবীর এখন দুই মেরুতে। কখনো মনে হয় না, এই জীবনটা আমরা হয়তো চেষ্টা করলে একসাথেই কাটাতে পারতাম।’
শুক্লা বললো, ‘আফশোস তো হয়। এই যেমন তোরও হয় বিদিশার জন্য। কিন্তু কথায় বলে, আফসোস করে নাকি কিছু হয় না। পৃথিবীতে আমরা কি কেউ পেছনের দিকে তাকিয়ে চলি? বল? সবাই চায়, সামনের দিকে তাকাতে। আমিও তাই-
মনে হল শুক্লা যেন দূঃখ কষ্টটাকে চেপে রেখেছে, আমারই মতন। ভালোবাসা ওরও টেকেনি। পৃথিবীতে আমরা দুজন যেন একই পথের যাত্রী।
শুক্লাকে বললাম, ‘তাহলেও আমার আর তোর ব্যাপারটা তো আলাদা। সৌগতর সঙ্গে তোর বিয়ে দিতে নাকি তোর বাবা মা আপত্তি করেছিল। সৌগতও জেদের বশে বিয়ে করে ফেললো ওই মেয়েটাকে। এটা কি সত্যি?’
শুক্লা বললো, ‘হ্যাঁ বাবা মা আপত্তি করেছিল। প্রথমে মনে হয়েছিল ঠিকই তো করেছে। এটা তো সত্যি। আমিই বা জোর করবো কেন?’
শুক্লাকে বললাম, ‘তুই তো সৌগতকে ভালোবাসতিস। জোর করলি না কেন?’
শুক্লা বললো, ‘আমার ভালোবাসাটা আসলে ঠুনকো ছিল। সেটাই বলতে চাইছিস তো? আমি তো বিদিশার মত অত ওকে ভালোবাসতাম না। যতটা বিদিশা তোকে ভালোবাসতো।’
শুক্লাকে বললাম, ‘আমি বিশ্বাসই করবো না সেকথা। শুধু এটুকু জানতাম, বিদিশা আমাকে যতটা ভালোবাসে, শুক্লা ঠিক ততটাই ভালোবাসে সৌগতকে। বিদিশা আমাকে ছেড়ে গেলেও শুক্লা কিছুতেই ছাড়তে পারে না সৌগতকে।’
আমার দিকে তাকিয়ে অল্প একটু হাসলো শুক্লা। বললো, ‘দেব তুই এখনো কত সরল। সেই আগের মতই রয়ে গেছিস। তোকে দেখে ভাবি, ইস প্রেমটা যদি তখন আমি তোর সাথেই করতাম।’
বলতে বলতেই হেসে ফেললো শুক্লা। ‘আমাকে বললো, ভয় পেলি?’
আমি বললাম, ‘ভয় পাবো কেন? তোর প্রতি আমার সহানুভূতিটা সবসময়ই ছিল। আমি জানতাম শুক্লার মত মেয়ে হয় না। তাও মনটা একটু খচখচ করেছিল সেদিন। বিদিশা তারপরপরেই আমাকে যখন ছেড়ে গেল, তুই আমার প্রতি অনেক সহানুভূতি দেখিয়েছিলিস। অথচ আমি সেটা তোকে দেখাতে পারলাম না। অবাক হলাম, যখন দেখলাম সৌগতও মানিয়ে নিয়েছে ব্যাপারটা। তোদের দুজনের মধ্যে আবার দেখা হল। কিন্তু সেই দূঃখের অনুভূতিটা যেন নেই। কোথায় হারিয়ে গেছে।’
শুক্লা বললো, ‘ওর সাথে আমার পরেও একবার দেখা হয়েছিল। কার যেন বিয়েতে আবার দেখা হল। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। রনির বিয়েতে। সৌগত এসেছিল। সাথে ওর সুন্দর বউটা। আমার সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছিল। বললো, ভালো আছো? আমি বললাম, হ্যাঁ। ওকে বললাম, তুমি? সৌগত বললো, আমি খুব ভালো আছি।’
শুক্লার কথা শুনে আমারো পুরোনো অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। ওকে বললাম, ‘মাঝে মাঝে আমিও ভাবি শুক্লা, এই ভালোবাসাই যদি পরষ্পরকে কাছে আনার জন্য সৃষ্টি হয়, তাহলে এভাবে বিচ্ছেদ কেন শুরুতেই? পুরোনো ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনকে তো প্রভাবিত করবেই। তুই হয়তো ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবি। কিন্তু সত্যিই কি সব ভুলে থাকতে পারবি?’
শুক্লা হঠাৎই আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘সৌগত তখন একটা অবাঙ্গালী মেয়েকে নিয়ে বাইকে করে ঘুরতো, সেটা কি জানতিস?’
আমি অবাক হলাম। বললাম, ‘না, আমি জানতাম না, শুক্লা ছাড়াও সৌগতর অন্য কোনো প্রেমিকা আছে।’
শুক্লা বললো, আমিও জানতাম না। ‘সৌগতকে, বেহালায় যেদিন আমাদের বাড়ীতে নিয়ে গেলাম। বাবা মায়ের সাথে ওর আলাপ করালাম। বাবা বললো, তোমরা সব এক একটা ব্রিলিয়ান্ট বয়। আমি শুক্লার মুখে তোমার কথাও শুনেছি। দেব ছেলেটাও ভালো। আর তুমি তো ভালো অবশ্যই।’
শুক্লাকে বললাম, ‘মেসোমশাই আমার কথা এখনো বলেন? সেই একবারই তোর বেহালার বাড়ীতে গেছিলাম। উনি অনেক্ষণ ধরে আমার সাথে গল্প করেছিলেন।’
শুক্লা বললো, ‘বাবা তোকে খুব পছন্দ করতো। শুধু বলতো, দেবের মত ছেলে হয় না। কিন্তু সৌগতটা যে কি করলো।’
আমি বললাম, ‘তোর বাবা মা কি এটা জানতে পেরেছিলেন? কি করে জানলো? তুই বলেছিলিস?’
শুক্লা মাথাটা একটু নিচু করলো। আমাকে বললো, ‘হ্যাঁ আমিই বলেছি। আমি সৌগতকে একবার নয়, বেশ কয়েকবার ঘুরতে দেখেছি ওই মেয়েটাকে নিয়ে। মনের মধ্যে কষ্টটাকে চেপে রেখেছিলাম। জানিস তো দেব, আমার আবার বিশ্বাস ভাঙতে একটু সময় লাগে। মনে প্রানে যাকে বিশ্বাস করি, চটকরে তার প্রতি বিশ্বাস ভেঙে যায় না। সৌগতকে আমি নিজেই অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছি। ও বলতো, দূর তুমি পাগল নাকি? ও তো আমার শুধু বন্ধু।’
আমি অবাক হয়ে শুনছি শুক্লার কথা। শুক্লা বললো, ‘আমি ভুল করেছি আমি মানি। প্রথম প্রথম আমি সহ্যও করতাম। সৌগত বলতো, ও আমার বন্ধু। এর বেশী কিছু নয়। কিন্তু সৌগতর হাবভাব দেখে মনে হত, এর মধ্যে নিশ্চই কিছু একটা ব্যাপার আছে। আচ্ছা ‘দেব’, মানুষ কাউকে ভালোবাসলে কি আনসোসাল হয়ে যায়? পরষ্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সন্মান অক্ষুন্ন রেখে যদি প্রেম করা যায়, তাতে তো হানিকর কিছু ঘটে না। ভালোবাসার মূলমন্ত্র যদি আন্ডার স্ট্যান্ডিং হয়। তাহলে যেকোনো ব্যাপারই মানিয়ে নেওয়া চলে। আমি প্রথমে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পরে মনে হল সৌগত যে মেয়েটার সাথে ঘুরছে, এটাকি আমাকে অসন্মান করা নয়? আমার কেন জানি না বিশ্বাসটাই চলে গেল সৌগতর প্রতি। মনে হল ও মিথ্যে কথা বলছে আমাকে। তারপরে যখন ওই আবার অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করলো। বুঝলাম সেদিন সত্যি কথাটাই বলেছিল সৌগত। আমারই ওর কথাটা মেনে নেওয়া উচিত ছিল।’
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
শুক্লার কথা শুনে মনে হল, এখনো চরম একটা আফশোস রয়েছে সৌগতর জন্য। সবাই যেন ভুলের খেসারত দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আর এটাই দিয়ে যেতে হবে আজীবন ধরে।
শুক্লা বললো,ছাড়াছাড়ি মানে তো কয়েকটা সম্পর্কের কাটান ছাড়ান। এই যেমন তোর জীবনটাকে নিয়েও কাটাছেড়া করল মিনু আর বিদিশা। আমারো তাই। ওই অবাঙ্গালী মেয়েটাই আমার বিশ্বাসটাকে সেদিন ভেঙে দিলো।
শুক্লাকে বললাম, ‘তুই এখনো দূঃখ পাস?’
শুক্লা বললো, ‘দূঃখ তো আমারই পাবার কথা। ভুলতো আমিই করেছি। সৌগত নয়। যে ভুল করে তারই তো দূঃখ পাওয়া উচিত। অথচ ভগবান বোধহয় তোর বেলায় উল্টোটাই করেছে।’
হেসে বললাম, ‘কেন? একথা বলছিস কেন?’
শুক্লা বললো, ‘ভুল করলো বিদিশা, আর তুই যেমন ওর জন্য শুধু শুধু দূঃখ করে মরলি। কার ভুল কে করলো? আর এখন দেখ, ও কেমন আফসোস করছে তোর প্রতি। এই ভুলের কি কোনো ক্ষমা হয়?
পৃথিবীতে বিদিশাই একমাত্র মেয়ে। যাকে কোনোদিন আমি ক্ষমা করতে পারবো না। এ কখনো হয় না। বিদিশার মনটা ফুলের মত নরম। যে ফুল অল্প আঘাতও সহ্য করতে পারে না। সেদিন হয়তো, অল্প আঘাতেই ওর মনটা ভেঙে গিয়েছিল। বিদিশা আমাকে ভুল বুঝেছিল, তাই বলে কি ওকে আমি ক্ষমা করতে পারি না? নিশ্চই পারি।
শুক্লা হঠাৎই আমার হাতের ওপর হাতটা রেখে বললো, ‘আচ্ছা ‘দেব’, আমি যদি তোকে বলি, তোকে আমি ভালোবাসি। তুই কি প্রমান চাস?
আমি বললাম, ‘আমি যদি কোনো অন্যায় কাজ করি আর এসে তোকে বলি ক্ষমা করে দে। তুই করবি।’
শুক্লা বললো, ‘আমি সেটাকে অন্যায় বলেই ভাববোই না। কারণ তোর প্রতি আমার সেরকমই বিশ্বাস আছে। বিদিশা তাহলে কেন এটা করলো না?’
শুক্লার কথাগুলো আমার কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি না, ও কেন চাইছে না। কেন বলছে, বিদিশার সাথে আমার দেখা না করাই ভালো।
কিছু একটা বলতে গিয়েও শুক্লা আবার থেমে গেল। আমাকে বললো, ছাড় এসব পুরোনো কথা। তুই আসবি কিনা বল?
নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, ও বাবা। কটা বাজে খেয়াল করেছিস? আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে, তোর এখানে এমনিতেই আমি লেট। এরপরে আরো বসলে আরো লেট হবে। এবার আমি উঠবো। বল না যাবি কিনা?
শুক্লাকে বললাম, তোর অফিস মানে তো ব্যাঙ্ক। কোন ব্যাঙ্কে আছিস যেন?
শুক্লা বললো, ‘পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যাঙ্কে আছি। ওই চাকরিটাই তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এখান থেকে সোজা বালীগঞ্জ যাবো। ব্যাঙ্কে সারাদিন ডিউটি দেবো। তারপর খাটাখাটনি করে বাড়ীতে একটু বিশ্রাম।’
শুক্লাকে বললাম, ‘মেসোমশাই, মাসীমা কেমন আছেন? মানে তোর বাবা মা?’
শুক্লা বললো, ‘বাবা তো মারা গেছেই সেই কয়েক বছর আগে। মা হালে মারা গেলেন। ক্যানসার হয়েছিল।’
অবাক হয়ে শুক্লাকে বললাম, তুই তাহলে একা?
শুক্লা বললো হ্যাঁ একা। বড় নিসঙ্গ আমি।
শুক্লা এরপরে উঠি উঠি করছে। মা ঘরে এলো। শুক্লাকে বললো, চলে যাচ্ছো?
শুক্লা বললো, ‘হ্যাঁ মাসিমা। পরে একদিন আসবো। এই আপনার ছেলেকে বলে গেলাম, আমার ফ্ল্যাটে যেতে। বাবু এখন যাবে কিনা আমাকে কথা দিতে পারছেন না। ‘
মা বললো, ‘তা যাবে খন। অসুবিধের কি আছে?’
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। শুভেন্দুর কথাটা একটু আগে মাকে বলেছি। মা বোধহয় ভুলেই গেছে। শুক্লা আমাকে বললো, ‘এই বদমাইশটা। তোর ফোন নম্বরটা আমাকে দে তো। কথা বলতে বলতে আসল কাজটাই ভুলে গেছি।’
আমি শুক্লাকে আমার সেলফোন নম্বরটা দিলাম। শুক্লা সেভ করলো। আমাকে বললো, ‘তুই তাহলে আমাকে কনফার্ম করিস। এখন তো কিছু আমাকে বললি না।’
শুক্লাকে বললাম, ‘দেখছি, আমি শুভেন্দুকে ফোন করে। তোকে বিকেলে আমি ফোন করবো। বলেছিস যখন নিশ্চই যাবো। শুধু আমাকে শুভেন্দুর সাথে একটু কথা বলতে দে।’
আমাকে শুক্লা বললো, ‘তোকে নিচে যেতে হবে না কষ্ট করে। আমি নিজেই চলে যাচ্ছি।’
বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে ওর দিকে হাত নাড়লাম। শুক্লাও হাত নাড়লো। তারপর ওর শরীরটা আসতে আসতে গলির মুখটা থেকে মিলিয়ে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, আমাকে শুক্লা বিদিশার কাছে যেতে মানা করলো। আবার ওর ফ্ল্যাটেও যেতে বলে গেল। কিন্তু কেন বলে গেল? মনে কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে গেল।
কথায় বলে প্রেম ভালোবাসা থেকে নাকি একধরণের শক্তির জন্ম নেয়। জীবনের বাঁচার রসদ খুঁজে পাওয়া যায়। অদ্ভূত এক হতাশায় জীবনটা কেটে গিয়েছিল বেশ কয়েকটা বছর। ভাবলাম, বিদিশার ফিরে আসাটা কি কোনো কিছুর ইঙ্গিত বহন করছে? আমি যেন একটা অবলম্বনের পথ খোঁজারই চেষ্টা করছিলাম। অথচ শুক্লাই এসে আমাকে কেমন দ্বিধায় ফেলে দিল। মন থেকে শুক্লার না চাওয়াটা একটু অবাকই করলো আমাকে। এতদিন পরে চিঠিটাও খুঁজে খুঁজে ঠিক নিয়ে এসেছে আমার কাছে। ও কি বলতে চাইলো ঠিক স্পষ্ট হল না।
মনে পড়ছিল, কলেজে যেকটা দিন আমাদের কেটেছে, শুক্লাকে কোনদিন বিদিশার প্রতি এত বিদ্বেশ করতে দেখিনি। ও কোনদিন বিদিশাকে দেখে হিংসেও করতো না। আমি বিদিশার সাথে চুটিয়ে প্রেম করছি। শুক্লাকে কোনদিন অখুশি হতে দেখিনি। যখন প্রেমটা আমাদের ক্রমেই দানা বাঁধতে শুরু করেছে তখনো শুক্লা স্বাভাবিক। কোনদিন প্রেম ভালোবাসার কথা ও আমাকে বলেনি। আর শুক্লাকেও সেচোখে আমি কোনদিন দেখিনি।
শুক্লা বলতো, ‘দেব’ হচ্ছে এমন একটা ছেলে, যার সাথে যে মেয়ে প্রেম করবে, সেই ধন্য হয়ে যাবে। আমি করিনি তো কি আছে। দেব আমার খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু বিদিশা করেছে। সেই দিক দিয়ে বিদিশাকে আমি খুব লাকি বলেই মনে করবো। সুন্দরী হলেই শুধু হয় না। ভালো ছেলেদের মন পাওয়ার জন্যও মেয়েদের অনেক তপস্যা করতে হয়। বিদিশা করেছে, তাই ও দেবকে পেয়েছে। আমি চাই দেব আর বিদিশা জীবনে আরো সুখী হোক। প্রেম ভালোবাসা দিয়ে ওরা একে অপরকে পাওয়ার আনন্দটা আরো উপভোগ করুক।
নিজেও যখন সৌগতর সঙ্গে প্রেম করা শুরু করলো, তখন আমাকে বললো, ‘তুই ই আমাকে পথ দেখালি দেব। তোকে দেখেই শিখলাম পৃথিবীতে প্রেম জিনিষটা কত সুন্দর। মধুর প্রেমের সত্যিই কোনো বিকল্প হয় না।’
সৌগত আর শুক্লা আমাকে আর বিদিশাকে খুব নকল করতো। বিদিশা আমাকে ভ্যালেনটাইন্স ডে তে কার্ড দিচ্ছে, সাথে ডায়েরী আর পেন। আর সুন্দর কারুকার্য করা একটা রুমাল। শুক্লা তাই দেখে বললো, ‘আমিও সৌগতকে তাহলে এগুলো দিই? শুধু কার্ড কেন দেবো? সাথে ডায়েরী, পেন আর রুমালটাও তো দেওয়া দরকার।’
কলেজস্ট্রীটে গিয়ে সব কিনে নিয়ে এসেছে। আমাকে এনে দেখাচ্ছে, আর বলছে, ‘দেখ, বিদিশার মত কিনেছি সব। ভালো হয়েছে?’
প্রথম প্রথম আমি আর বিদিশা মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে যেতাম। বেশ কয়েকটা নতুন সিনেমাও দেখে ফেলেছি দুজনে। শুক্লা আবদার করে বসলো, ‘এবার থেকে তোরা একা যাবি না। গেলে আমরা চারজনে মিলে যাবো।’
মাঝে মাঝে শুভেন্দুও এসে জুড়ে বসতো আমাদের সাথে। আমাকে আর শুক্লাকে বলতো, ‘এই শোন, তোদের দুজনের এই যে প্রেমটা হচ্ছে না। এসবই আমার বদলৌতে। সেদিন যদি বিদিশাকে আমি চিঠিটা না দিতাম না, তাহলে দেব কোথায় আর বিদিশা কোথায়? আর শোনো, পারুল রানী, তুমি তোমার প্রেমিকের যা অবস্থা করেছিলে, দেবদাস হতে হতে বেঁচে গেছে ব্যাচারা সৌগত। ভাগ্যিস তোর মনটা ঘোরাতে পেরেছিলাম সেদিন। নইলে?
শুভেন্দুর আমাদের সাথে ভিক্টোরিয়াতে গিয়ে যে কি অবস্থা হয়েছিল, সেকথা তো আগেই বলেছি। ও কখনো বোর ফিল করত না। আমরা চারজনে আপন মনে যখন নিজেদের মধ্যে ভাব, ভালোবাসার কথা বলছি, শুভেন্দু তখন আপনমনে বাদাম চিবোতো। আর মুখে বলতো, ‘তোরা প্রেম কর। আমার ভাই বাদামই ঠিক আছে।’
শুক্লা চলে যাবার পরে শুভেন্দুর সেই বিদিশাকে দেওয়া চিঠিটা হাতে নিয়ে অনেক্ষণ ধরে দেখছিলাম, আর পুরোনো কথাগুলো আবার মনে পড়ে যাচ্ছিল।
মা, ঘরে ঢুকে বললো, ‘তোর মনে হচ্ছে কাজে বেরোনোর আজ বারোটা বেজে গেল। কোনো তাড়া নেই, সেই সকাল থেকে লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লি। তারপরে এখন আবার বসে বসে কি ভাবতে শুরু করেছিস?’
আমি বিদিশার কথাই ভাবছিলাম, মাকে সেভাবে বলতে পারলাম না। শুধু বললাম, ‘মা কোনো একটা সিদ্ধান্ত নিতে আমাকে খুব দোটনায় থাকতে হচ্ছে। ভাবছি, কি সিদ্ধান্ত নেবো?’
মা বললো, ‘কি সিদ্ধান্ত?’
– ‘সেটা তোমাকে এখনি বলা যাবে না। আমি পরে বলবো।’
মা বললো, ‘তুই তো সব কথা আমাকে সেভাবে বলিস না। নিজের ভেতরেই লুকিয়ে রাখিস। যদি মনে করিস বলবি না। তাহলে বলিস না। আমি আর কি বলবো?’
মাকে বললাম, ‘তোমাকে আজ অবধি কোনোকিছু কি আমি লুকিয়েছি? তুমি তো সবই আমার পুরোনো কথাগুলো জানো। আমার অতীতে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, সেগুলোই মাঝে মাঝে বসে আমি ভাবি। কলেজের দিনগুলোর কথা এতদিন বাদে মনে পড়ে যাচ্ছিল। তাই সকালে লিখছিলাম। তারপরে শুক্লাও এলো। এতদিন বাদে আমার বাড়ীতে প্রথম এসেছে, ওর সাথে কথা বলে ভালো লাগল। পুরোনো স্মৃতিগুলো মনকে নাড়া দিচ্ছে এই আর কি।
মা বললো, ‘শুক্লা তোকে কিছু বলেছে?’
অবাক হলাম। বললাম, ‘না কই কিছু বলেনি তো। কি বলবে?’
মা বললো, ‘আমি শুনেছি আড়াল থেকে। ও বিদিশার কথা বলছিল। বিদিশা নাকি ফিরে এসেছে কলকাতায়। ওর স্বামীকে ছেড়ে।’
আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, মাও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দেখছে জবাবে আমি কি বলি?
মাকে বললাম, ‘কেন তুমি শুনে খুশি হও নি? বিদিশা ফিরে এসেছে।’
একটা চাপা দূঃখ। ঠিক আমারই মতন। মাকে বরাবরই দেখে এসেছি, আমার জন্য আফশোস করতে। মা আমার এমনই। যখন আমি দূখী তো মা দূখী। আবার আমি সুখি তো মাও সুখী। যেভাবে ছেলের মুখে হাসি ফুটলে মায়েরও মুখে হাসি ফোটে, ঠিক সেভাবেই মা, আমাকে বললো, আমি তোর মুখে হাসিটা দেখে ফেলেছি। এতদিন বাদে তুই খুশী হয়েছিস। আমি কি খুশী না হয়ে থাকতে পারি?
আমি মাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘খুশি হয়েছি মা, খুব খুশি হয়েছি। বিদিশা ফিরে এসেছে, আমার থেকে বড় খুশী বোধহয় পৃথিবীতে আর কেউ নেই।
শুক্লার কথাটা মন থেকে মুছে ফেললাম। মনে মনে বললাম, যে মেয়েটিকে আমি এত ভালোবাসতাম, যার কথা আমি সবসময় ধ্যান করতাম, তাকে যদি এতদিন বাদে আবার দেখতে পাই, চোখ তো ফেরাতে পারবো না। বিদিশা যদি আমার খোঁজ করে, আমি নিশ্চই ওর কাছে যাবো।
মনে মনে বললাম, ভাগ্যিস, এই গল্পটার নাম, একটি ভালোবাসার মৃত্যু দিইনি। তাহলে বিদিশার ফিরে আসাটা একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়তো।
বিকেল হতেই শুভেন্দুর বাড়ী যাব বলে তৈরী হয়ে নিলাম। অফিসে ফোন করে বলে দিয়েছি, ‘আজ আর অফিসে যাচ্ছি না। কিছু কাজ পড়ে গেছে। সুতরাং কালকে আবার আসছি যথারীতি।’
শুভেন্দু বলেছে, সাতটার মধ্যে ওর ওখানে যেতে। আমি যখন বাড়ী থেকে বেরোলাম, তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা বেজে দশ মিনিট। বাড়ী থেকে বেরিয়ে হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে, বড় রাস্তার মোড় অবধি গেলাম। মনে হল, এই যাঃ। কিছু একটা আমি ফেলে এসেছি। খেয়াল হল, বিদিশাকে দেওয়া শুভেন্দুর ওই চিঠিটা বাড়ীতে ফেলে এসেছি। শুক্লা যেটা বাড়ী বয়ে এসে আমাকে দিয়ে গেল। শুভেন্দুকে দেখালে বেশ ভালো হত। বিদিশার কথা আমিও শুভেন্দুকে আগে থেকে বলতে পারতাম।
চিঠিটা তাড়াহূড়োতে আর পকেটে ঢোকানো হয় নি। খেয়াল হলো বসার ঘরের টেবিলের ওপরেই রেখে এসেছি। মা’র চোখে পড়লেও পড়তে পারে। কিন্তু ঐ চিরকূট দেখে মা আর কিছুই বুঝবে না। ওতে হিজিবিজি ছাড়া আর কিছু নেই।
কাঁকুড়গাছি মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, পিকনিক গার্ডেন যাবো। ট্যাক্সিওয়ালা বললো, বাইপাস ধরবো? আমি বললাম, যেদিক দিয়ে খুশি চলুন। আমার পিকনিক গার্ডেন পৌঁছোলেই হল।
ট্যাক্সিওয়ালা ফুলবাগান পেরিয়ে বাইপাশই ধরলো। বুঝলাম রুবী হসপিটাল থেকে তারমানে ডানদিকে টার্ণ নিতে হবে। আমি তাহলে ঠিক ছটার আগেই শুভেন্দুদের বাড়ীতে পৌঁছে যাবো।
ট্যাক্সিতে যেতে যেতে ভাবছি, শুভেন্দুতো বলেছে সারপ্রাইজের কথা। রনিও ওখানে থাকবে। তারমানে রনিও ব্যাপারটা জানে। অথচ শুক্লা বললো, শুভেন্দুর সাথে এ ব্যাপারে নাকি কোনো কথা হয় নি। বিদিশাকে শুক্লাই দেখেছে, কাল গড়িয়াহাটের মোড়ে। শুভেন্দু যে সারপ্রাইজের কথা বলছে, এটা তাহলে কোন সারপ্রাইজ?
কিছুতেই মাথায় কিছু এলো না। কত চিন্তা করলাম। ভাবলাম, বিদিশাকে কি তাহলে শুভেন্দুও দেখেছে শুক্লার মত? কিন্তু আমাকে ও বললো না কেন? অন্তত বিদিশার ব্যাপার হলে শুভেন্দু আমাকে লুকোবে না। এই কবছরে অনেক যন্ত্রণায় মরেছি। অনেক কষ্ট পেয়েছি। শুভেন্দু প্রথম প্রথম সান্তনা দিয়েছে আমাকে। পরে বলেছে, ছেড়ে দে বিদিশাকে। মনে কর, বিদিশা বলে তোর জীবনে কেউ কোনদিন ছিল না। আবার নতুন করে জীবনটাকে শুরু কর। সেই বিদিশাই যখন ফিরে এলো। শুভেন্দুর তো বলা উচিৎ ছিল।
ট্যাক্সিতে যেতে যেতে শুভেন্দুকে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করলাম। এক চান্সেই ওকে পেয়ে গেলাম। শুভেন্দুকে বললাম, ‘আমি কিন্তু তোর ওখানে যাবো বলে রওনা দিয়ে দিয়েছি। ঠিক ছটার মধ্যেই আসছি।’
শুভেন্দু হাসলো। বললো, ‘রনি থাকবে বাড়ীতে। আমি সাড়ে ছটার মধ্যে কাজ সেরে ঢুকবো। আর যে সারপ্রাইজটার কথা তোকে বলেছি, তার জন্য আরো আধঘন্টা তোকে অপেক্ষা করতে হবে।’
মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। ওকে বললাম, ‘হেঁয়ালিটা রাখ না। কি সারপ্রাইজ দিবি, সেটা আগে থেকে বল না?’
শুভেন্দু বললো, ‘সারপ্রাইজ ইজ অলওয়েজ সারপ্রাইজ। আগে থেকে বললে, ওটা আর সারপ্রাইজ থাকে না। তুমি এসো। ধীরে ধীরে সব রহস্য উন্মোচন হবে। একটু অপেক্ষা কর বৎস।’
শুক্লার সকালে আমার বাড়ীতে আসার ব্যাপারটা চেপে গিয়েই ওকে বললাম, ‘তুই কিন্তু যে সারপ্রাইজের কথা আমাকে বলছিস। ওটা আমি আগে থেকেই জানি। আমার জানা হয়ে গেছে, আজ সকালে।’
শুভেন্দু বললো, কি জেনেছিস? আমাকে বল দেখি।
আমি বললাম, না থাক। বলবো না।
শুভেন্দু বললো, ‘বলবি না যখন তুইও চেপে থাক। দেখা যাক তোর জানার সাথে আমার সারপ্রাইজ মেলে কিনা’।
ফোনটা রাখতে রাখতেই আবার বললো, ‘তোর মুখে আমি অনেকদিন হাসি দেখিনি। আজ তোর মুখে আমি হাসি ফোটাবো।’
আমি বুঝে গেলাম, তারমানে বিদিশার কথাই শুভেন্দু আমাকে বলতে চাইছে।
ট্যাক্সির কাঁচ দিয়ে কতগুলো ছেলে মেয়েকে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে ফিরতে দেখছি। আর ভাবছি বয়সটা আমার দশবছর কমে গেছে। কি জানি হয়তো বিদিশারই জন্য।
রনির কথা ভেবে, রনিকেও একটা ফোন লাগালাম। রনি বললো, ‘কিরে দেব? তুই আসছিস তো?’
একটু আগেই শুভেন্দুর সাথে ফোনে কথা হয়েছে রনিকে সেটা বললাম। রনি বললো, ‘তোর জন্য আমি আর শুভেন্দু একটা পাত্রী ঠিক করেছি। তুই এলে, সেই মেয়েটিকে তোকে দেখাবো। শুভেন্দু যে সারপ্রাইজটার কথা বলেছে, ওটা সেই সারপ্রাইজ।’
আমি বললাম, ‘পাত্রীটি কে?’
রনি বললো, ‘ধরে নাও খুব সুন্দরী। তবে এখন একটু বয়স হয়েছে। তবে সৌন্দর্য তার কমে নি। তোমার সাথে ভালো মানিয়েও যাবে, কোনো চিন্তা নেই। এবার একটু ধৈর্য নিয়ে তুমিও এসো। আর হ্যাঁ আজকে কিন্তু খুব সহজে তোমায় ছাড়ছি না। অনেক গান শোনাতে হবে, সেই রাত অবধি। যিনি আসবেন, তিনিও তোমার গান শুনবেন।’
তারপর আবার হেসে রনি বললো, ওফ দেব, কতদিন তোর গান শুনি না। সেই কবে শুনেছিলাম লাস্ট। মনেই নেই। তারপর মনে হয় একযুগ হয়ে গেছে।
মোবাইলটা কানে ধরে নিজের ভেতরের আনন্দটা ওকে প্রকাশ করতে পারছি না। শুধু রনি বললো, আজ তুই মুকেশের ওই গানটা আবার গাইবি। যেটা খুব গাইতিস আগে। বলে নিজেই গাইতে লাগলো -সুহানি চাঁদনী রাতে। হামে শো নেহী দেতে। তুমহারী প্যায়ার কী বাতে, হামে শো নেহী দেতে।
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
আমি ওর রকম দেখে হাসতে লাগলাম।
রনি ফোনটা ছাড়ার পরেই ধরে নিলাম, এ মেয়ে বিদিশা না হয়ে কিছুতেই যায় না। ও যা বলছে, তাতে আর রহস্যের কিছু নেই। শুক্লার মত শুভেন্দুও হয়তো দেখে ফেলেছে বিদিশাকে। রাস্তায় দেখতে পেয়ে ওকে ইনভাইট করেছে বাড়ীতে। আজ সেখানে আমিও যাচ্ছি। সামনা সামনি আজ আমরা আবার দুজনে মুখোমুখি।
বিদিশাকে আমি ভালোবাসতাম। সেই ভালোবাসার মধ্যে কোনো খুঁত ছিল না। জানি, ভালোবাসার মধ্যে যদি সততা থাকে, সে ভালোবাসা কখনো হারিয়ে যায় না। সেদিন বিদিশা আমাকে ভুল বুঝেছিল, তাই আমার জীবন থেকে ও হারিয়ে গিয়েছিলো। বিদিশার যখন ভুলটা ভাঙলো, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। কিন্তু আমার এই স্বচ্ছ ভালোবাসাই ওকে আবার ফিরিয়ে আনলো আমার কাছে। এই পৃথিবীতে দেবকে ছেড়ে বিদিশা আর যাবে কোথায়?
আমার মনে আছে, কলেজে বিদিশার সাথে যখন প্রেম শুরু করলাম, তখন রনি কত পেছনে লেগেছে আমাদের। বিদিশার সাথে ফাজলামী আর খুনসুটি তো করতোই এছাড়া আমাকেও কখনো কখনো ছাড়তো না। একদিন খুব গুরু গম্ভীর ভাবে আমাকে বললো, ‘দেব, একটা কথা খুব সিরিয়াসলি ভাবে তোকে জিজ্ঞাসা করছি। ‘এখনো অবধি বিদিশাকে তুই কটা চুমু খেয়েছিস? গালে, কপাল আর ঠোঁট মিলিয়ে কটা?’
তারপর আবার নিজেই হেসে বললো, ‘গুনে দেখিস নি, তাই না বল?’
রনিকে কোনদিন কাব্যিক হতে দেখিনি, আমাকে বলেছিল,‘প্রেম যখন হৃদয়ে আসে, তখন পুরুষ বা রমনী কি চায় জানিস? সে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়। বাঁচিয়ে রাখতে চায়, লালন করতে চায় তার প্রেমকে। সবার উপরে থাকে সমর্পনের ইচ্ছে।’ একেবারে পি সি সরকারের ম্যাজিকের মতন। এক ঝলক চাহনি, একটু ঠোঁটের কাঁপন, মাথাটা হেলিয়ে রাখা, হাতের আঙুলের নড়াচড়া। এর প্রত্যেকটিই প্রেমকে জাগিয়ে তুলতে পারে। ঠিক ম্যাজিকের মতন। কিন্তু খুব সাধারণ ম্যাজিক।’
রনির কথা ভাবছিলাম আর বিদিশার মুখটাকে চিন্তা করছিলাম, ট্যাক্সিতে যেতে যেতে হঠাৎই আমার মনে হল, বিদিশার মুখটা যেন আমার মুখের খুব কাছে। সেই আগে যেরমকম গরম নিঃশ্বাস ফেলতো আমার ঠোঁটের ওপরে। প্রথমবার চুমু খেতে গিয়ে ওর ঠোঁটটা একটু কেঁপে গিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন ওর ঠোঁটে প্রেমের চিহ্ন এঁকে দিলাম, ও জড়িয়ে ধরলো আমাকে। প্রজাপতির মত বিদিশার আঙুলগুলো আমার পিঠে তখন খেলা করছে। বিদিশার ঠোঁটের ওপর আমার ঠোঁট। বিদিশার পায়ের ওপর আমার পায়ের উষ্ণ চাপ। দ্রুত নিঃশ্বাস একসাথে মিশে যাচ্ছে। আঙুল গুলো দিয়ে বিদিশা আমার পুরো শরীরটাকে এমন ভাবে খেলাচ্ছে, যেন শরীরের প্রতিটি কোনকে জানার জন্য ও কত অধীর। জড়িয়ে ধরে বিদিশাকে আমি বলছি, ‘বিদিশা, ভালোবাসাটাকে আমি অমর করে রাখতে চাই। তুমি আমাকে কোনদিন ভুলে যাবে না তো? বিদিশার মুখ দিয়ে শুধু গোঙানির মত শব্দ। দুটো ঠোঁট তখন ভালোবাসার আলিঙ্গনে আবদ্ধ। আমাকে জড়িয়ে ধরে বিদিশা বলছে, ‘না গো না। আমি কি তোমাকে ভুলে যেতে কখনো পারি?’
ভালোবাসার বেশী সুখ নাকি কপালে কখনো সয় না। মূহূর্তগুলো সব ঝাপসা হয়ে যায়। এই বুঝি শুরু হল। আর কদিন পরেই সব শেষ। মনে হল, বিদিশার মুখটাকে আমি দেখছিলাম এতক্ষণ। তারপরেই ওর মুখটা কেমন ঝাপসা ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল আসতে আসতে। আমার মুখের কাছে বিদিশার মুখটা আর নেই, হঠাৎ দেখছি ওখানে মিনুর মুখটা চলে এসেছে। বিদিশার ঠোঁটদুটোও নেই। ওখানে মিনুর ঠোঁট দুটো চলে এসেছে।
মূহূর্তে মুখটা কেমন পাথরের মত হয়ে গেল আমার। মনে পড়ল, মিনুর বাড়ীতে সেদিন কি ঘটেছিল।
সেদিন ছিল শনিবার। বাবা বলতেন, শনিবার দিনটা আমার কাছে নাকি শুভ নয়। শনি যদি ঘাড়ে চেপে বসে, তাহলে তো আরো মুশকিল। সেদিন মিনু হয়েছিল আমার শনি। তখন ঠিক সন্ধে সাতটা। মিনু আমাকে বাড়ীতে ডাকলো। আগের দিন সৌগতর বিয়েতে গিয়েছিলাম। সারারাত সৌগতর বাসরে জেগেছি। অনেক রাত অবধি হৈহুল্লোর আর গানবাজনা হয়েছে। শরীরটা এমনি খারাপ। মিনুকে বললাম, ‘আজ ছেড়ে দে মিনু, আজ আমার বাড়ী থেকে বেরোনোর একদম ইচ্ছে নেই।’
মিনু শুনলো না। বললো, ‘তোকে কি এমনি এমনি আমি বাড়ীতে ডাকছি? কারন তো একটা আছে। তুই আয়। আমি দশমিনিটের মধ্যে তোকে ছেড়ে দেবো।’
জানতাম না সেদিন বিদিশাও আমার বাড়ীতে এসে হাজির হবে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি, মিনুর বাড়ী যাবো বলে। তার ঠিক একঘন্টা পরেই বিদিশাও আমার বাড়ীতে এসে হাজির। আমাকে দেখতে পাইনি। মা’ বলে দিয়েছে আমি মিনুর বাড়ী গেছি। বিদিশাও আর অপেক্ষা করেনি।
বিদিশার ভীষন রাগ ছিল মিনুর ওপর। কলেজে কোনদিন দাঁড়িয়ে কথা পর্যন্ত বলেনি মিনুর সঙ্গে। মিনুর বাড়ীতে আমি যাই, সেটা ওর বোনকে গান শেখানোর জন্য হলেও বিদিশার একেবারেই পছন্দ হতো না। সৌগতর বিয়ের দিন এই নিয়ে একটু মুখ ভার করেছিল বিদিশা। আমি ওর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছি। বিদিশা বললো, ‘আমি তো বলেছি মেয়েটা ভালো নয়। তুমি তাও শুধু শুধু। কি পাও তুমি ওখানে গিয়ে?’
বিদিশাকে কথা দিয়েছিলাম, আর মিনুর বাড়ীতে যাবো না। কিন্তু সেদিন নিয়তি আমাকে ডেকে নিয়ে গেল মিনুর কাছে।
যখন ওর বাসায় ঢুকলাম, তখন দেখলাম ওর ছোট বোনটা নেই। মিনু একা রয়েছে ঘরে। ওর চোখ দুটো কেমন ঘোলা ঘোলা। ঘরের মধ্যে শাড়ী ছেড়ে নাইটি পড়ে রয়েছে। মুখ চোখ দেখেই মনে হল, যেন শয়তান ভর করেছে ওকে।
শুরুটা করলো ভালোভাবে। আমাকে বললো, ‘সৌগতর বিয়েতে খুব আনন্দ হল। তাই না রে?’
-তুই তো যাসনি। গেলে আনন্দটা বুঝতে পারতিস।
-আমাকে তো সৌগত বলেনি। তোদের বলেছে আমি বাদ।
-তোকে কেন বলেনি, সেটা তো বলতে পারবো না। তবে আনন্দ তো খুব হয়েছে।
-এই দেব, তুই গান গেয়েছিস?
-গেয়েছি অনেক। ওরা ছাড়ছিল না তাই।
-বিদিশা গেছিল কাল?
-হ্যাঁ গেছিল। তাতে তোর কি?
-তুই দিন রাত শুধু বিদিশার কথাই চিন্তা করিস। তাই না?
-কেন ডেকেছিস, সেটাই বল। বিদিশার কথা বলতে ডেকেছিস আমাকে?
-ওফ বড্ড বিদিশা আর বিদিশা করিস তুই।
-কেন, বিদিশাকে বুঝি তোর হিংসে হয়? সহ্য হয় না, তাই না?
-আমার তো মনে হয়, বিদিশা তোর সাথে ঢং করে। ভালোবাসার আবার ও বোঝেটা কি?
-মিনু, তুই এসব কথা বলার জন্য আমাকে বাড়ীতে ডেকেছিস?
-ও তুই রাগ করলি? অত রাগটাক করে না মেরী জান।
-মিনু তুই কিন্তু সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস।
-আচ্ছা দেব, তুই কেন আমাকে এত অবজ্ঞা করিস বলতো? কেন, তোর প্রেমে পড়েছি, এটাই আমার দোষ?
– না তুই ছাড় আমাকে। যেতে দে এখান থেকে।
-যেতে দেবো বলে তো ডাকিনি তোকে। তোর সাথে একটু প্রেমের খেলা খেলবো। মদ না খেয়েই আজকে মাতালিনী হয়ে গেছি।
-তুই মদ খাসনি?
-সত্যি খাই নি। বিশ্বাস কর।
-তুই দিনকে রাত করতে পারিস। নয়কে ছয় করতে পারিস। মিনু তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই।
মিনু এবার একটু খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। আমাকে বললো, -শুধু শুধু আমার ওপরে রাগিস তুই। আমার জীবনের বড় স্বপ্ন তো তুই। আজ বাদে কাল তোরই হাতে হাত রেখে সপ্তবনী প্রহর পার হবো। তুই হবি আমার জীবনের জ্যাকপটের সবচেয়ে দামী ঘোড়া।
-মিনু তুই মদ খেয়েছিস। ইস কি নোংরা তুই। ছাড় আমাকে ছাড়।
-কেন রে দেব? আমাকে কি তোর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বেশ্য মাগী বলে মনে হয়?
-মিনু আই সে স্টপ নাও। লিভ মি।
-উঃ গোঁসা দেখো ছেলের? বিদিশা কে পেয়ে যেন বড় অহঙ্কার তোর। কেন আমাকেও একটু ভালোবাসতে চেষ্টা কর। ‘দেব’ প্লীজ।
-মিনু তুই কিন্তু বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছিস।
মনে হচ্ছিল মিনুর গালে একটা চড় মেরে দিই। তখনো মারতে পারিনি। আমাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে মিনু। মুখটাকে আমার মুখের কাছে নিয়ে এসে মাকালীর মত জিভ বার করে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গী করতে লাগলো।
-আমার জিভটা জ্বলে যাচ্ছে দেব। দেখ একটু আগে লঙ্কা খেয়ে ফেলেছি। প্লীজ্ আমার জিভে তুই জিভ টা ঠেকা। আমাকে একটু আদর কর। বিচ্ছিরি আর বুনো আদর। শুয়োর যেমন শুয়োরের পেছনে পেছন ঠেকিয়ে আদর করে। ঠিক সেইভাবে তুই পারবি তো! আমার বুকের ভেতরে আগুন জ্বলছে, মাইরি দেব, তুই একটা ল্যাদল্যাদে পুতুল হয়ে যা। আমি তোকে ছিঁড়বো, চাটবো, চুষবো। আমি তোকে পায়ের নীচে ফেলে রাখবো পাপোশ করে। আমি তোকে মাথায় বসাবো। তুই হবি আমার গলার হার। তুই হবি আমার অন্তবাস। হবি তো?
-তুই এসব খারাপ খারাপ কথা বলার জন্য আমাকে বাড়ীতে ডেকেছিস?
-ওফঃ। পারি না দেব। তুই যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানিস না। সবই জানিস। অথচ বিদিশার জন্য সব রেখে দিয়েছিস। বিদিশার কি দেখে মজেছিস তুই? বল না রে দেব? যেভাবে ও তোর ঘাড়ে চেপে বসেছে, যেন কচি লেবুর সাথে প্রথম বৃষ্টির মেলামেশা। ও যেন তোর এই ঠোঁটদুটো থেকে মধু চুরি করে নিয়েছে। হ্যাঁ রে দেব? তুই কি অসভ্য মাইরী। তুই কি পুরুষ বেশ্যা নাকি? বিদিশাকে এতসব দিলি কেন? আমার জন্য তো কিছু রাখতে পারতিস।
মিনুর কথা শুনেই বুঝতে পারছিলাম ও আমি আসার আগেই মদ খেয়েছে অনেকটা । অসংলগ্ন কথা বলছে, কথা জড়িয়ে আসছে। পেটের ভেতরে যেন ধাকতিনাকতি ধাকতিনাকতি শুরু হয়েছে। উল্টে আমাকেই বলে বসল। ‘এ আমার কি হল দেব? কথাগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে কেন? তুই আমাকে গুন করেছিস? বল না দেব, তুই কি করেছিস আমার?
আমার মুখটা তখন এত কঠিন হয়ে গেছে, আগে কোনদিন হয় নি।
মিনু বললো, ‘ওহ্ তুই কি কিউট রে? দেখি তোর বুক দেখি। তোর বগল দেখি।’
বলে আমার জামার বোতাম গুলো সব খুলতে লাগলো পট পট করে। মিনু প্রচন্ড আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। আমি ওর সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করবো না ঠেলে দূরে সরিয়ে দেবো বুঝতে পারছি না।
মিনু বললো, ‘দেব তুই কিন্তু স্টেডী থাকবি। আমি তোকে সিডিউস করছি বলে ঘাবড়ে যাস না। তাড়াহূড়োতে তুই আবাব বৃষ্টি ঝরাতে শুরু করিস না। তাহলে কিন্তু আমি খুব রেগে যাবো। তুই তো জানিস, মেয়েদের সেক্স আসতে আসতে ওঠে। একটা বিন্দুতে পৌঁছে যাবার পর অনেক্ষণ স্ট্রে করে। তোদের মতো দুম ধড়াস কেলাস হয়ে যায় না।’
মিনু আমার জামাটা প্রায় খুলে ফেলেছে। বুকে একটা চুমু খেয়ে বললো, দেব, তুই মাইরি দারুন সেক্সী। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। তোর পেছনে এতদিন শুধু ঘুরঘুর করেছি, আমি কিনা সত্যি- দেব আজ তুই আমার সাথে বিট্রে করিস না প্লীজ।’
মিনু আমার মুখের মধ্যে জিভটা ঢুকিয়ে দিল জোর করে। আমাকে বললো, ‘দেখ, আমি কেমন মুখরোচক চানাচুর। আমাকে খেতে তোর দারুন লাগবে।’
ঠিক ঐ মূহূর্তে মিনুকে আমার একটা বেশ্যা বলে মনে হচ্ছিল। গালে একটা চড় মারতে গেলাম। মিনু চড়টা খেলো না। তার আগেই ওর কলিং বেলটা বেজে উঠলো। মিনু আমাকে ছেড়ে দিয়ে নিজেই দরজা খুলতে লাগলো। দরজা খুলতে গিয়ে আবার একটু টলেও গেল। দরজার সামনে বিদিশা দাঁড়িয়ে। আমি হতবাক। স্তম্ভিত হয়েগেছি বিদিশাকে দেখে। বুঝতে পারছি না ও কি করে এখানে এলো?
মিনু বিদিশাকে দেখে বলে উঠল। ‘কি চাই এখানে? ভাগো ভাগো। এটা তোমার জায়গা নয়। আমার দেবের ওপরে গোয়েন্দাগীরি? সারাটা দিন চিপটে বসে আছিস ওর সাথে। এখানেও রেহাই নেই?’
বিদিশার চোখ মুখ দিয়ে তীব্র ঘেন্না ছড়িয়ে পড়ছে। আমি বুঝতে পারছি না, বিদিশা আমার খোঁজে এখানে কি করে চলে এলো?
ভেতরে ঢুকলো না বিদিশা। আমাকেও কিছু বলার সুযোগ দিলো না। মিনুকে বললো, ‘বড্ড ভুল হয়ে গেছে আমার। ভুল জায়গায় এসে পড়েছিলাম। সরি। আমি চলে যাচ্ছি।’
পেছন থেকে বিদিশাকে ডাকছি,’ বিদিশা যেও না। প্লীজ, প্লীজ। আমার কথা শোনো।’
মিনু তখন আমার জামাটা শক্ত করে ধরে রেখেছে, যাতে ছুটে আমি বিদিশার কাছে যেতে না পারি।
কখনো ভাবিনি, একটা ছোট্ট অঘটনই জীবনে বিষাদ ডেকে আনতে পারে। বিদিশা আমাকে ভুল বুঝলো। আমি তো কোনো নোংরামো করিনি মিনুর সাথে। মিনু শেষ চালটা দিয়ে হাসিল করতে চেয়েছিল আমায়। যখন দেখলো ও আর পারলো না। আশা ছেড়ে দিল। অথচ বিদিশা ভুল বুঝে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে বিদিশাকে অনেক ফোন করার চেষ্টা করেছি সেদিন। বিদিশা ফোন ধরেনি। ল্যান্ডফোনের রিসিভার তুলে রেখে দিয়েছিল। আমার মনে হল শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের জন্য শ্বাস নিতেই পারলাম না। পকেট থেকে রুমাল বার করে চোখের ওপর চেপে ধরলাম। নিরুদ্ধ অশ্রু বাঁধ ভেঙে ঝরে পড়তে চাইছে। রুমাল দিয়ে সেটাকে আটকাতে চাইছি। একটা দূঃসহ বেদনার ভারে হৃদয়টা যেন গুঁড়িয়ে দিতে চাইছে। মনে হল, বিদিশা তো আমার কাছে এখন নেই। থাকলে হয়তো বলতো কেঁদো না, তাহলে আমি কষ্ট পাবো।
আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমি আমার কান্নাটাকে রোধ করতে পারলাম না। চোখ থেকে রুমালটা সরিয়ে নিলাম। ধীরে ধীরে আমার চোখ দিয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো। এক একটা করে ফো’টা ঝরে পড়তে লাগলো।
প্রচন্ড একটা ব্রেক কষে ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমার যেন হোশ ফিরলো। কোথায় যেন এতক্ষণ হারিয়ে গিয়েছিলাম এতক্ষণ, সেই অভিশপ্ত দিনটাতে। এমন জোরে ব্রেক কষেছে গাড়ীটা। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ট্যাক্সি ওয়ালা বললো, দেখেছেন, কিভাবে এরা গাড়ী চালায়? আর একটু হলে গাড়ীর তলায় যাচ্ছিল আর কি? আমরা নিজেরাও দুজনে মরতাম সাথে এও।
দেখলাম এক মটর সাইকেল আরোহী খুব জোরে বাইক চালিয়ে একেবারের ট্যাক্সির সামনে চলে এসেছে। ট্যাক্সি ওয়ালা পাশকাটাতে গেলে পাশের লাইটপোষ্টটায় ধাক্কা মারতো। সামনের কাঁচটা গুঁড়িয়ে যেতো। তারপরে কি হত আমি জানি না। ট্যাক্সিওয়ালাকে খুব ভালো বলতে হবে। সময় মত ব্রেক কষে ছেলেটার প্রাণটা বাঁচিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে আমারও। নইলে অকালে চলে যেতো প্রাণটা।
শুভেন্দুর বাড়ীর খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, ‘দাদা আপনি আমার খুব উপকার করলেন আজকে। বেঁচে না থাকার মতই বেঁচেছিলাম এতদিন ধরে। যার সাথে দেখা হবে বলে যাচ্ছি। তারজন্যই বাঁচাটা আমার নিতান্তই দরকার ছিলো।’
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
শুভেন্দুদের বাড়ীর সামনের রাস্তাটা বেশ সরু। ওখানে ট্যাক্সি ঢোকে না। এর আগে যেকবারই ট্যাক্সি চড়ে আমি এসেছি, গলির মুখটায় ট্যাক্সিটা আমাকে ছেড়ে দিতে হত। কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গেলে তারপরেই শুভেন্দুদের বিশাল বাড়ী। পিকনিক গার্ডেনে শুভেন্দুরা খুব বড়লোক। নতুন লোক এলে বাড়ী খুঁজে নিতে তার অসুবিধে হবে না। শুভেন্দুদের নাম বললেই সবাই ওই বাড়ী দেখিয়ে দেবে।
দুর থেকে ওদের বাড়ীর একতলার বারান্দাটা দেখা যায়। বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে দূর থেকেই সেটা চোখে পড়ে। রাস্তাটায় ঢুকেই আমার মনে হল, শুভেন্দুর বোন মাধুরী দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। দূর থেকে ও আমাকে দেখছে।
মাধুরীর স্বভাবটা খুব মিষ্টি। একে তো বড়লোকের একমাত্র মেয়ে। শুভেন্দুরা চারভাই। আর ওদের এই একটিই মাত্র আদরের বোন মাধুরী। খুব প্রানখোলা স্বভাবের মেয়ে মাধুরীর সাথে আমারও গল্প করতে খুব ভালো লাগতো। কলেজে পড়ার সময় শুভেন্দুদের বাড়ীতে যতবারই এসেছি, মাধুরীর সঙ্গেও একটা দাদা বোনের মত সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। মাধুরী, রনির সঙ্গে তখন থেকেই প্রেম করতো, কিন্তু শুভেন্দুর সাথে যেহেতু আমার একটা আলাদা খাতির ছিল, আমি এলে মাধুরী জমিয়ে আড্ডা দিত আমার সঙ্গে। ওর ডাক নাম ছিল ছুড়ী। ওকেও আমি ছুড়ী বলে ডাকতাম।
বয়সে শুভেন্দুর থেকে দু’বছরের ছোটো মাধুরী উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর আর পড়াশুনা করেনি। রনির সঙ্গে কয়েকবছর পরেই ওর বিয়ে হয়ে গেল। মাধুরী আর রনির সুন্দর একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। নাম রেখেছে ‘দেবমাল্য’।
ওর বাচ্চা হবার পর শুভেন্দু আমাকে বললো, এই ‘দেব’ নামটা আমার খুব পছন্দ। তোকেও যার জন্য আমার খুব পছন্দ। মাধুরীর যেহেতু তোকে খুব ভালো লাগে, আমাকে বললো, ‘ছোড়দা, আমার ছেলের নাম, আমি দেব দিয়ে রাখবো। দেবদার মতন। পরে রনিও রাজী হয়ে গেল। তাই ওর নাম রাখা হলো, ‘দেবমাল্য।’
দূর থেকে মাধুরী আমাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললো, ‘এই যে দেবদা, ছোট্টবোনটাকে ভুলে গেছো বুঝি? ওফ কতদিন তোমায় দেখি না। সেই দুবছর আগে একবার তুমি এসেছিলে। আবার এতদিন পর।’
শুভেন্দুর বাড়ীর গেটের সামনে যেতেই মাধুরী হাসতে হাসতে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো। ওর গালটা টিপে দিয়ে বললাম, ‘ও আমার ছুড়ী রে। দাদাটার কথা বুঝি এতদিন বাদে মনে পড়লো?’
মাধুরী বললো, ‘তুমি না কেমন জানি হয়ে গেছো দেবদা। আগে কত আসতে আমাদের বাড়ীতে। এখানে আড্ডা হতো। গান বাজনা হতো। মজা হতো। তা না, সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে, তোমরা সব নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে। আর আমাকেও তুমি ভুলে গেলে।
মাধুরীকে বললাম, ‘তোকে আমি ভুলিনিরে ছুড়ী। শুভেন্দু যতবারই ফোন করেছে, তোর কথা জিজ্ঞাসা করেছি। রনিকে জিজ্ঞাসা করে দেখিস, ওকেও জিজ্ঞাসা করেছি তোর কথা। তোদের যখন ছেলে হল, শুভেন্দু আমাকে বললো, মাধুরী ওর ছেলের নাম রেখেছে দেবমাল্য। দেব নামটা ওর খুব পছন্দ। তোকে তো আমাদের বাড়ীর সবাই খুব পছন্দ করতো, তাই না? মাধুরীও বললো, আমি দেব নামটাই রাখবো। রনিও রাজী হয়ে গেল। তাই-
মাধুরী বললো, তুমি খুশি হয়েছো, ‘আমার ছেলের নাম দেবমাল্য রেখেছি বলে?’
আমি বললাম, বারে? খুশি হবো না? আমি তো তখনই খুশি হয়েছি। খুব খুশি হয়েছি।
মাধুরী বললো, ‘তোমার প্রতি আমার কিন্তু একটা ক্ষোভ আছে দেবদা। আমি খুব রেগে আছি তোমার ওপরে।’
ওর গালটা টিপে দিয়ে বললাম, ‘কেন রে ছুড়ী? রাগ কেন?’
মাধুরী বললো, ‘তুমি তখন আমার ছেলেকে দেখতে আসো নি কেন? জানো তোমায় কত এসপেক্ট করেছিলাম। তুমি এলে না। আর আমিও ছোড়দাকে বললাম, কি রে ছোড়দা? দেবদা তো এলো না? তুই কি কিছু জানাসনি নাকি দেবদাকে? ছোড়দা বললো, সব বলেছি। দেব এখন কাজবাজ নিয়ে ব্যস্ত। ওর এখন তোর ছেলেকে দেখতে আসার টাইম নেই।’
মাধুরীকে বললাম, শুভেন্দু এই কথা বলেছে তোকে? দাঁড়া ওকে আসতে দে। তারপর ওর মজা দেখাচ্ছি। মিথ্যে কথা বলা বের করছি।
মাধুরী মুখটা একটু করুন মত করে, ছেলেমানুষির মত করছিল। বার বার ঘাড় নেড়ে বলতে লাগল, ‘না, না, বলো, তুমি আসোনি কেন?’
মাধুরীকে বললাম, ‘দূর বোকা। আমি তখন ছিলাম না কি কলকাতায়? কোম্পানীর কাজে আমি তখন হায়দ্রাবাদে। একমাস মত ওখানে ছিলাম। কলকাতায় ফিরেই চলে গেলাম, সিঙ্গাপুরে। কোম্পানীর তরফ থেকে ট্রিপ। ফিরে এসেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। একমাস মত বিছানায় শয্যাশায়ী। কাজকর্ম সব ডকে। এমন একটা রোগ বাঁধিয়ে ফেলেছি, ডাক্তার বললো, সাবধানে থাকুন। বাইরের খাবার একদম খাবেন না। আর মিষ্টি খাওয়া তো একদম বন্ধ।’
মাধুরী বললো, ‘কি যেন রোগটা হয়েছিল তোমার?’
আমি বললাম, ‘আলসার কোলাইটিস।’
মাধুরী শুনে বললো, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি। ও তো খুব কঠিন রোগ। ভীষন কষ্ট দেয়। পেটে ব্যাথা করে। রক্ত পড়ে। আমাশার মতন।’
মাধুরীকে বললাম, ‘হ্যাঁ, তারপর থেকেই মিষ্টি খাওয়া একেবারে বন্ধ। মিল্ক প্রোডাক্ট থেকেই না কি রোগটা হয়।’
মাধুরী বললো,তুমি তো আগে খুব মিষ্টি খেতে ভালবাসতে দেবদা। সব বন্ধ হয়ে গেল। তাই না?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
মাধুরী বললো, ‘এ তোমার ভারী অন্যায় দেবদা। মাসীমাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছো। বিয়ে থা তো এবার করো। আর কতদিন একা একা থাকবে? তোমাকে দেখার জন্যও তো কাউকে দরকার?
তরপর নিজেই বললো, অবশ্য এখনকার মেয়েদের মধ্যে ভালো মেয়ে খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। মেয়েরা এখন স্বামীদের কেউ দেখে না।
ওকে বললাম, ‘কেন? তুই মেয়ে দেখেছিস আমার জন্য?’
মাধুরী হেসে ফেললো, আমাকে বললো, ‘আমি যদি মেয়ে দেখি। সে মেয়ে তোমার পছন্দ হবে? সবাই তো আর বিদিশার মত সুন্দরী নয়।’
এই বিদিশা নামটা আমার জীবনের সাথে এমন ভাবে জড়িত। শুধু আমি কেন? অনেকেই ওকে ভুলতে পারেনি। মাধুরীর মুখ দিয়ে বিদিশা নামটা শুনেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন ছটফটানি শুরু হয়ে গেল। ওকে বললাম, ‘হ্যাঁ রে ছুড়ী, তুই কি কিছু জানিস?আমাকে সত্যি করে বলতো?
মাধুরী বললো, ‘কি জানবো? কি বলবো?
ওকে বললাম, ‘আজ এখানে নাকি কারুর আসার কথা আছে। কোনো একটা মেয়ে। শুভেন্দু আর রনি তো সেই কথাটাই বলেছে আমাকে।’
মাধুরী শুনে এমন ভাব করলো, যেন ও কিছুই জানে না। আমাকে বললো, ‘কই সেরকম তো আমি কিছু শুনিনি।’
আমি অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম, তাহলে কি শুভেন্দু আর রনি, মাধুরীকেও ব্যাপারটা বলেনি? না ও সব জানে, রনি আর শুভেন্দুর মত মাধুরীও আমাকে গোপণ করছে।
মাধুরীকে বললাম, ‘কই তোর কত্তা কোথায়? ওকে ডাক দেখি একবার। দেখি জিজ্ঞাসা করে।’
মাধুরী বললো, ‘সে তো একটু আগেই বেরুলো তোমার জন্য।’
রনি আমার জন্য কোথায় গেছে? একটু অবাকই হলাম, ওকে বললাম, ‘কেন রে? আমার জন্য তোর কত্তা বেরিয়েছে? কোথায় গেছে?’
মাধুরী বললো, ‘গেছে হয়তো কিছু কিনতে টিনতে। দুপুর বেলা তো এক পেট ভাত খেয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছিল। তুমি ফোনটা করলে। অমনি বাবু তড়াক করে জেগে উঠলেন। আমাকে বললো, তুমি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থাকো। ‘দেব’ আসছে। আমি ততক্ষণ দোকানটা থেকে চট করে ঘুরে আসছি।
বুঝে নিলাম, রনি কোথায় গেছে। মাল খাওয়ার নেশাটা রনির প্রচুর। তারপরেই আবার ভাবলাম, বিদিশা যদি সত্যি আসে, ওর সামনে এসব খাওয়াটা কি ঠিক হবে?
মাধুরী ভেতরে গিয়ে ওর বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে এলো। আমার সামনে আসতেই খেয়াল হল। ইস তাড়াহুড়োতে ওর জন্য কিছু কিনে আনা হয় নি। পকেট থেকে টাকা বার করতে যাচ্ছিলাম। মাধুরী বললো, ‘তুমি ওর মাথায় হাতটা রেখে আশীর্ব্বাদ করোতো। তাহলেই হবে। টাকা হাতে পেলে এক্ষুনি ওটাকে ছিঁড়ে দেবে। যা দুষ্টু।’
বাচ্চাটাকে দুহাত বাড়িয়ে কাছে ডাকছিলাম। ও ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে দেখছিল, কিন্তু কিছুতেই আসছিল না। মাধুরী ওকে বললো, ‘এটা কে বলোতো? এটা হলো তোমার কাকু।’ যাও কাকু ডাকছে যাও।’
আমি দুহাত বাড়িয়ে মাধুরীকে বললাম, ‘কাকু কি রে? বল, আমি ওর মামা হই। মাধুরী বললো, হ্যাঁ এটা হলো তোমার দেব মামা। যাও মামার কাছে যাও।’
বাচ্চাটা এবার আমার কাছে চলে এলো। মাধুরী ওকে বললো, ‘মামা কিন্তু খুব ভালো গান জানে। তুমি মামার কাছে গান শিখবে?
বাচ্চাটা ঘাড় নাড়লো। দাঁত বার করে হেসে বললো, হাঁ।
মাধুরী বললো, দেবদা, তুমি বসো, আমি তোমার জন্য চা করে নিয়ে আসছি। ততক্ষনে রনিও এসে পড়বে।
আমি মাধুরীকে বললাম, শুভেন্দু কখন আসবে? আমাকে তো বললো, আধ ঘন্টার মধ্যে ঢুকছে।
মাধুরী বললো, ‘ছোড়দা যদি তোমাকে আধঘন্টা বলে থাকে, তাহলে ধরে নাও ওটা একঘন্টা। ওর সব কিছুতেই লেট। আজও অবধি কোনদিন টাইম মত কিছু করেনি। তারপর হেসে বললো, দেখছো না বিয়েটাও করছে না এখনো। এখনো নাকি ওর বিয়ে করার টাইম হয় নি।’
আমি বললাম, শুভেন্দু তো বলেছে, ‘বিয়ে আর করবে না এ জীবনে।’
মাধুরী হেসে বললো, ‘ওর মত তুমিও সেই ভুলটা আর কোরো না।। বিয়ে যদি না করো। সারাজীবনের মত পস্তাতে হবে, এই আমি বলে দিচ্ছি।’
বলেই ও ভেতরে চলে গেল। আমি বসার ঘরটায় বসে একটা ম্যাগাজিন উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলাম। মনে হল, সকালে ডায়েরীতে শুভেন্দুর ব্যাপারে অনেক কথাই লিখেছি, কিন্তু এই কথাটা একবারও লেখা হয় নি। শুভেন্দুর সব কিছুতেই লেট।’
বিদিশা কদিন ধরেই আমাকে বলছে, ‘জানো তো দারুন একটা ছবি রিলিজ করছে আগামী শুক্রবার। ছবির নাম ‘তেজাব।’ ওতে অনিল কাপুর আর মাধুরী দিক্ষিত আছে।’
আমি বললাম, তো?
বিদিশা বললো, তো মানে? দেখতে যাবো না? ওদিন পুরো একটা গ্রুপ যাবে।
আমি বললাম, কে কে?
বিদিশা বললো, তুমি আর আমি। সাথে শুক্লা আর সৌগত। আর রনি আর মাধুরীও থাকবে আমাদের সঙ্গে।
আমি বললাম, আর শুভেন্দু? ও তো না গেলে খেয়ে ফেলবে আমাদের।
বিদিশা বললো, ‘শুভেন্দুই তো দায়িত্ব নিয়েছে সবার টিকিট কাটার। লাইন দিয়ে ও আগে টিকিটটা কাটবে। ও থাকবে না মানে? ও তো থাকছেই।’
বিদিশার কথা শুনে আমিও খুশি হলাম। বললাম, ‘তাহলে ঠিক আছে। সবাই মিলে যাবো। বেশ আনন্দ হবে।’
শুভেন্দু লাইন দিয়ে আমাদের জন্য আগে থেকে টিকিট কাটলো কষ্ট করে। কলেজে এসে বললো, ‘উফ কি মারপিট হচ্ছে রে লাইনে। বই একেবারে সুপারহিট।’
মোট সাতখানা টিকিট যথারীতি ওর কাছেই রেখে দিল। যেদিন আমরা সিনেমাটা দেখতে যাব। শুভেন্দুর আর পাত্তা নেই। এদিকে মাধুরীও চলে এসেছে বাড়ী থেকে। রনি এসে বললো, ও আমাকে বললো, তোরা হলের কাছে গিয়ে দাঁড়া। আমি দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছোচ্ছি। আমরা ছজনে ধর্মতলায় প্যারাডাইস সিনেমা হলে পৌঁছে গেলাম । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবাই ঘড়ি দেখছি। এদিকে শুভেন্দুর আর পাত্তা নেই। তিনটের ম্যাটিনির শো চালু হয়ে গেল। সৌগত, রনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত কামড়াচ্ছে। আমিও তাই। বাবু এলেন ঠিক তার আধঘন্টা পরে। তখন বইটার অনেকগুলো সীন হয়ে গেছে। সৌগত শুভেন্দুকে বললো, হ্যাঁ রে তুই কি? এতো দেরী করে এলি? এই তোর দশ মিনিট?
শুভেন্দু হেসে বললো, ‘আমি টাইমলিই আসছিলাম। বাড়ী থেকে কিছুটা রাস্তা চলে আসার পর দেখি। টিকিটগুলোই সব ঘরের ড্রয়ারে ফেলে রেখে চলে এসেছি। আবার বাড়ী যেতে হলো। তাই দেরী হয়ে গেল।’ বলেই দাঁত বার করে আবার কেলাতে লাগলো। হি হি।
মাধুরী চা নিয়ে এসে ঢুকেছে ঘরে, ঠিক তখুনি রনিও এসে হাজির। দেখলাম, ওর দুহাতে দুদুটো প্যাকেট। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এসে গেছিস বস? বোস তাহলে, আমি একটু ভেতর থেকে আসছি।’
রনি মাধুরীকে সামনে পেয়ে কি মনে করে মাধুরীর হাতেই প্যাকেট দুটো দিয়ে দিলো। বললো, ‘তুমি এই প্যাকেট দুটো ভেতরে রেখে আসো তো। আমি আর যাবো না ভেতরে।’
মাধুরী বললো, কি এগুলো?
রনি বললো, ‘আছে কিছু। তবে এটা আমাকে নয়। তোমার ছোড়দাকে জিজ্ঞেস কোরো।’
মাধুরী একটু মুখ ভেংচি কাটলো। রনিকে বললো, ‘আহা। আমার কর্তাটিও যেন কম যান না। খালি ছোড়দাকে দোষ দিলে হবে? কমপিটিশন করতে আপনিও তো মাষ্টার।’
মাধুরী ভেতরে চলে গেল। রনি আমার সামনের সোফাটায় বসলো। আমাকে হেসে বললো, ‘বউটা আমার খুব ভালো। জানিস তো দেব। নইলে আমার মত ছাগলটাকে ভালোবেসে ফেললো। মাধুরীর অনেক গুন আছে। ঠিক কিনা বল?’
আমি রনিকে বললাম, তুই এখনো মাল খাওয়া চালিয়ে যাচ্ছিস?
রনি বললো, ‘শোন, তোর কথা ভেবে আমি একটা শায়েরী লিখেছি। বলেই শায়েরীটা শোনাতে লাগলো,
পি হ্যায় শরাব, হর গলি কি দুকান সে,
দোস্তি সি হো গয়ী হর শরাব কে জাম সে।
গুজরে হ্যায় হাম কুছ অ্যায়সী মুকাম সে,
কি আঁখে ভর আতী হ্যায় মহব্বত কে নাম সে।
রনির চোখের দিকে তাকালাম, হেসে বললাম, ‘তোর কি শালা আমার মত এত দূঃখ নাকি। যে দূঃখে তুই মদ খাবি।?’
রনি বললো, আমি তো দূঃখে মদ খাই না। আনন্দ করেই খাই। তবে তোর জন্য কি আমাদের দূঃখ হয় না। এই তো শুভেন্দু। তোকে এত জ্ঞান মারে, উপদেশ দেয়, শালা তোর দূঃখে একদিন কেঁদেই ফেললো।
আমি বললাম, সেকীরে তাই নাকি?
রনি বললো, হ্যাঁ সেকী কান্না। তুই যদি একবার দেখতিস।
আমি বললাম, তাহলে মনে হয় একটু বেশী নেশা হয়ে গেছিলো।
রনি বললো, ‘তা ঠিক। তবে ও তোকে খুব ভালোবাসে, জানিস তো দেব? এখনো বলে, বন্ধুদের মধ্যে তোর পরে দেবই আমার খুব কাছের ছিলো। সেই যে কলেজের পর ঘটনা ঘটে গেল। তারপর ও নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিল। শালা হারামী মিনু। শয়তান, মাগীর বাচ্চা। ঢ্যামনা মাগী। বিদিশাকে পুরো চটিয়ে দিলো।’
রনি এমন গালাগাল দিতে শুরু করেছে। মাধুরী ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ওকে বললো, কি হচ্ছেটা কি? কাকে গালাগাল দিচ্ছো এভাবে?
রনি বললো, ‘জানো না? ওই শয়তান মিনু ঢেমনিটাকে। ওই তো দেব আর বিদিশার প্রেমটাকে বরবাদ করে ছাড়লো। ইস কি সুন্দর ছিলো সেই সময়টা। আমরা সবাই মিলে ঘুরতাম, ফিরতাম। তা না আপদটা এসে জুটে বসলো। আর দেবের জীবনটাকে নষ্ট করে দিলো।’
মাধুরী সবই জানে। বললো, ‘ছাড়ো না ওসব পুরোনো কথা। এখন দেবদার কি করা যায় সেটা আগে বলো। আমি কি মেয়ে দেখবো নাকি একটা দেবদার জন্য?’
রনি জোর করে পাশে বসালো মাধুরীকে। ওর গাল টিপে দিয়ে বললো, ‘তাই? তুমিও দেখবে? কিন্তু আজ যে আসছে, তাকে দেখলে, দেবের তো কাউকে আর পছন্দ হবে না।’
মাধুরী কিছুই জানে না। রনি কে বললো, ‘কে আসছে গো?’
রনি বললো, ‘ওটা এখন বলা যাবে না। ক্রমশ প্রকাশ্য।’
মাধুরী বললো, ঢং রাখো দেখি। কি হবে বললে?
রনি বললো, ‘শুভেন্দু আমাকে মানা করেছে। বললে আস্তো রাখবে না। দেবকে তো বলা যাবে না। তোমাকেও নয়।’
মাধুরী বললো, ‘আহা ন্যাকা। কি হবে বললে? আমার ছোড়দাটাও যেমন, আর তুমিও তেমন।’
কানটা রনির মুখের দিকে বাড়িয়ে মাধুরী বললো, ঠিক আছে আমার কানে কানে বলো। দেবদা শুনতে পাবে না।
রনি বললো, ‘না তোমার পেট খুব পাতলা। তুমি ঠিক বলে দেবে দেব কে । আর সব মাটি হয়ে যাবে আজকে।’
মাধুরী রেগে মেগে বললো, ‘ঠিক আছে যাও। বলতে হবে না। কে না কে খেদী পেঁচী আসবে। তারজন্য সব নখরা হচ্ছে।’
আমি ওদের দুজনের রকমটা দেখছিলাম। রনিকে বললাম, আমি সব জানি। কে আসবে তাও জানি। শুধু মজাটা দেখছি। শেষ পর্যন্ত কি হয়।
বলতে বলতে শুভেন্দুও ঠিক তখন এসে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে বললো, ‘দেখলি তো। ঠিক টাইম মত এসেছি। আজ আর দেরী করিনি।’
মাধুরীকে বললো, ‘এই ছুড়ী, এই প্যাকেটটা ভেতরে রেখে দিয়ে আয়।’
দেখলাম শুভেন্দুর হাতেও একটা প্যাকেট। রনির মত ও কিছু কিনে নিয়ে এসেছে। মাধুরী বললো, ‘এটা কি আছে রে ছোড়দা?’
শুভেন্দু বললো, ‘ওর মধ্যে একটা গিফ্ট আছে। একজনকে দেবো। সে আসছে।’
মাধুরী অবাক হয়ে তাকালো শুভেন্দুর দিকে। ওকে বললো, ‘কে আসছে? কাকে গিফ্ট দিবি?’
শুভেন্দু বললো, ‘আমাদের সবার তরফ থেকে এই গিফ্ট। আর কে আসছে? এখুনি তাকে দেখতে পাবি। একটু অপেক্ষা কর।’
মাধুরী যথারীতি ওই প্যাকেটটা নিয়েও ভেতরে চলে গেল। আমি বুঝলাম, বিদিশার জন্য আজ অনেক কিছু অপেক্ষা করছে এখানে। কলেজে দিনগুলো তো আর ভোলার নয়। আমার বন্ধুরা সব, আমার মতন। বিদিশাকে কেউ ওরা ভোলেনি। সামান্য একটা ভুলের খেসারতে বিদিশা সেদিন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। বিদিশার সেদিনের সেই আচরণে সবাই একটু দূঃখ পেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু আজ এতদিন পরে সবাই যেন একটু নড়ে চড়ে বসেছে। বিদিশা, আসবে বলে শুভেন্দু আর রনি বেশ এক্সসাইটেড হয়ে গেছে । ঠিক যেনো আমারই মতন।
আমার সামনে বসেই শুভেন্দু আমাকে বললো, কি ভাবছিস?
আমি বললাম, কই কিছু না তো?
কলেজে যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে শুভেন্দু হাসতো, ওর চেনা হাসিটাকে দেখে বুঝতে পারলাম, আমার মনের ভাবটা বোঝার চেষ্টা করছে। বিদিশাকে দেখলে, আমি হয়তো আত্মহারার মতন হয়ে উঠবো। মনের মধ্যে যে আলোড়নের সৃষ্টি হচ্ছে। সেটা সেভাবে প্রকাশ করতে পারছি না। আনন্দটা চেপে রেখেই বললাম, তোর সারপ্রাইজের জন্যই তো আমি এসেছি। এবার বল, কি তোর সারপ্রাইজ?
শুভেন্দু বললো, আমি যে সারপ্রাইজটা তোকে দেবো, নিতে পারবি তো? পাগল হয়ে যাবি না?
রনি শুভেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল। আমি বললাম, আগে তো শুনি, দেখি। তারপরে দেখা যাবে, পাগল হই কিনা?
একটু রসিকতা করে শুভেন্দু রনিকে বললো, ‘দেব মনে হচ্ছে, আজ আর বাড়ী ফিরতে পারবে না। ওকে সারারাত এখানেই থাকতে হবে।’
আমাকে বললো, ‘তুই এক কাজ কর। মাসীমাকে ফোন করে বলেদে, আজ আমি শুভেন্দুদের বাড়ীতেই থেকে যাচ্ছি। সুতরাং তুমি শুধু শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না।’
আমি বললাম, আগে সারপ্রাইজটা তো বল। তারপরে মা’কে ফোন করছি।
শুভেন্দু, রনি দুজনেই হাসতে লাগলো। আমাকে রনি বললো, ‘ভাবছিস কি সারপ্রাইজ তোর জন্য ওয়েট করছে। তাই না?’
আমি ওদের দুজনকেই হেসে বললাম, সেটা তোরা দুজনেই জানিস। তবে আমিও জানি কিছুটা। তবে এখন সেটা বলবো না।
শুভেন্দু বললো, কি জানিস? কে বলেছে তোকে?
পাছে ওরা কিছু জেনে যায় আমি বললাম, কেউ বলেনি আমাকে। আমি এমনি বলছি।
পকেটে মোবাইলটা ছিল, হঠাৎই দেখি শুক্লা ফোন করেছে আমাকে। খেয়াল হল, শুক্লাকে বলেছিলাম, ফোন করে ওকে জানাবো। ঘর থেকে যখন বেরিয়ে এসেছি, ওকে আর জানানো হয় নি। শুভেন্দুর আর রনির সামনেই শুক্লার ফোনটা রিসিভ করলাম।
ওরা দুজনে বলে উঠলো, কে রে?
আমি বললাম, শুক্লা।
শুক্লা বেশ রেগে রয়েছে আমার ওপরে। আমাকে বললো, কি রে দেব? তুই ফোন করলি না তো? আসছিস তো তাহলে?
শুভেন্দু আর রনি দুজনেই বেশ কৌতূহল চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে। আমি শুক্লাকে বললাম, ‘এই তো শুভেন্দুর বাড়ী এসেছি। তোকেও ফোন করতে ভুলে গেছি। শুক্লা, সরি।
শুক্লা একটু আপসেট হল, আমাকে বললো, এ মা, তুই শুভেন্দুর বাড়ীতে চলে গেছিস? তা আমাকে বলবি তো?
বুঝতেই পারছিলাম, যেন খুব আশা করেছিল ব্যাচারা। ওকে বললাম, ‘শুভেন্দু আমার সামনেই আছে। কথা বলবি?রনিও আছে। নে কথা বল।’
শুভেন্দু এগিয়ে এসে, নিজে থেকেই আমার হাত থেকে ফোনটা নিলো। শুক্লাকে বললো, হায়, সুইট হার্ট! কেমন আছো তুমি?
আমি শুনতে পাচ্ছিনা শুক্লার কথা। বোধহয় ওকে বলেছে, আমার কথা তাহলে তোর মনে পড়লো?
শুভেন্দু বললো, ‘কি করবো বলো? আমি তো তোমার গলায় তখনি মালা দিতে চেয়েছিলাম। দেব বারণ না করলে কি আর শুনতাম? সবই রেডী ছিল, মালা, ফুল, তোমার জন্য আমার উপহার। তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকালে না। সৌগতর দিকেই ভীড়ে গেলে। ভগবান আমাকে সারাজীবন নিঃসঙ্গ করে রাখলো।
শুক্লা ওকে কিছু বলতে চাইছিল, শুভেন্দু ওকে বাঁধা দিয়ে বললো, আরে রাখ, রাখ, ও তো আমি এমনি রসিকতা করছি। জানিস তো ভালো একটা খবর আছে।
শুক্লা বললো, কি খবর?
দেব একটা বড়সড় পার্টী দিচ্ছে আমাদের জন্য। সেই কলেজে মাঝে মাঝে যেমন দিতো।
শুক্লা বললো, পার্টী? কি খুশিতে?
শুভেন্দু বললো, ওটা এখুনি বলা যাবে না। তাহলে দেবকে সারপ্রাইজটা আর দেওয়া যাবে না।
শুক্লা কি একটা বলতে গেলো। শুভেন্দুর মুখটা শুকনো মতন হয়ে গেল। আমাকে বললো, ‘এ আবার কি হল রে? এ যে দেখি উল্টো কথা বলছে।’
সকালে শুক্লা এসেছিল, আমার বাড়ীতে। বিদিশার কথা ওই আমাকে বলেছে। শুক্লা চায় না আমি বিদিশার সাথে আবার দেখা করি। মুখ খানা ফ্যাকাসে মতন হয়ে গেলে মানুষ যেমন কোনো তালগোল খুঁজে পায় না। শুভেন্দু সেভাবেই বললো, ‘আমি তো শুক্লার কিছু তাল খুঁজে পাচ্ছি না। তবে কী?-
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
মনে হল, ভালোবাসা উজাড় করে একদিন নিজেকে নিঃশ্বেস করে দিয়েছিলাম এই বিদিশারই জন্য। দূর আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ভাবতাম, আমার জীবনে বিদিশার উদয় হয়তো আর কোনদিন হবে না। ভালোবাসার কাঙালপনা করেও অজান্তেই আমি নিজের বলি দিয়েছি। নিজের খুশিকে বিসর্জন দিয়েছি। যখন এতদিন পরে আমি আবার বাঁচার একটা তাগিদ খুঁজে পাচ্ছি, তখন শুক্লা যেন ওই মিনুর মতই আমার স্বপ্নগুলোকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিতে চাইছে। কেন সেটা হবে কেন? আমার জীবনে অতীতেই হোক, আর বর্তমানেই হোক, বা আগামীদিনেও হোক। বিদিশা ছাড়া আমার জীবনে কোনদিন কোনো নারী ছিল না, নেই, আর কোনদিন থাকবেও না। আমার জীবনটাই যে এরকম।
শুক্লার সাথে কথা বলে ফোনটা ছেড়ে দেবার পর কেমন থম মেরে গেলো শুভেন্দু। মুখে ওর হাসিটা নেই। চোখের কোনে চিন্তার ভাঁজ। আমাকে শুধু মুখে বললো, স্ট্রেঞ্জ, ভাড়ী অদ্ভূত তো-
আমি বললাম, এত গম্ভীর হয়ে গেলি। কি হয়েছে বলবি তো? শুক্লা কিছু বলেছে তোকে?
শুভেন্দু বললো, দেখ, ‘দেব’ প্রেম আমি জীবনে করিনি। বিয়েও হয়তো করবো না। কিন্তু এই মিয়া যখন কারুর সাথে কথা বলে, বুঝে নিতে তার অসুবিধা হয় না। আমি তো আর অবুঝ বা ছেলেমানুষ নই?
শুভেন্দুকে বললাম, কি হয়েছে বলবি তো?
শুভেন্দু বললো, যে কিনা কলেজে থাকতে থাকতে একটা প্রেম করলো। তাকে বিয়ে না করে, আবার অন্য একজনকে বিয়ে করলো। তার এখনো বাসনা জেগে রয়েছে তোর প্রতি? এটা শুনেও কি তোর বিশ্বাস হচ্ছে না?
শুভেন্দুর কথাটা শুনে এবার আমিও থম মেরে গেলাম। সকালে শুক্লা আমার বাড়ী এসেছিল, আমাকে ওর বাড়ীতে যেতেও ইনভাইট করে গেছে। কিন্তু তা বলে প্রেম ভালোবাসার কথা এখানে আসবে কেন? শুক্লা তো আমাকে কোনদিন ভালোবাসেনি। আমাকে তো কোনদিন এভাবে কামনা করেনি। আমাকে জয় করার কোনো স্বপ্নই সে দেখায়নি। আমি বিদিশাকে ভালোবেসেছিলাম, তার দিকেই শুধু হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ আমাকে বাড়ীতে ডাকার জন্য শুক্লার মনে এত উদ্বেগকূল। এটা কি প্রেম না দেহগত বাসনা?
নিজেকে একটু হাল্কা করার চেষ্টা করলাম। শুভেন্দুকে তাও বললাম, না না শুক্লা এরকম মেয়েই নয়। হয়তো তোর বোঝার ভুল হয়েছে, কিংবা শোনার ভুল।
রনি পাশে বসেছিল চুপ করে। এবার ফোড়ণ কেটে বললো, ‘দেব’ শেষকালে শুক্লাও তোর প্রেমে পড়লো। ব্যাচারা বিদিশার কি হবে রে?
বলেই জিভ কেটে ফেললো রনি। তারপরেই বললো, এই যাঃ। ভুল হয়ে গেছে। হাঁটে হাঁড়ি ফাঁস হয়ে গেছে। যাঃ বলে দিলাম যে।
শুভেন্দু রনিকে বললো, ‘তুই না বললে, আমি তো বলতামই। এবারে দেবকে তাহলে আসল কথাটা বলি।’
বুঝতেই পারছি, শুভেন্দু এবার সারপ্রাইজের উন্মোচন করছে আমার কাছে। আমাকে বললো, শোন, দেব। শুক্লা তোকে কি বলেছে আমি জানি না। তবে গত পরশুই আমার বিদিশার সাথে দেখা হয়েছে। একটা চেনা মেয়েকে এতদিন বাদে দেখলাম, আমার তো বুঝে নিতে কখনো অসুবিধা হয় না। যে বিদিশাকে আমি দেখেছিলাম, সেই বিদিশা এখন আর নেই।
আমি শুভেন্দুর মুখের দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে, ভাবছি বলবো কিনা। বিদিশা কেমন আছে? আমার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করছিল? ও কি আগের মতই ভালোবাসে আমাকে? তাও চুপ করে রইলাম। দেখছিলাম, শুভেন্দু নিজে থেকে কিছু বলে কিনা?
শুভেন্দু আমাকে অবাক করে বললো, শেষ খেলাটা জিততে একটু শক্তি দেখাতে পারবি না? বিদিশার জন্য এটুকু তো তোকে করতেই হবে।
বিদিশাকে পাওয়ার জন্য যদি কোনো শক্তি দেখাতে হয়, নিশ্চই আমি দেখাবো। সেই অদম্য জেদটা নিয়েই তো আজ এখানে এসেছি। তবু বললাম, কি শক্তি দেখাতে হবে বল? বিদিশাকে তো কারুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনার প্রশ্ন নেই। ও তো-
শুভেন্দু বললো, বিদিশা এখন ডিভোর্সী। তাই তো?
আমি বললাম, হ্যাঁ, শুক্লা তো আমাকে সেকথাই বলেছে, ওর স্বামীর সঙ্গে নাকি ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। ও এখন কলকাতায় এসে রয়েছে। বাবা মায়ের কাছে থাকে। আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে, শুক্লা তাই তো বললো ।
শুভেন্দু বললো, তোর জন্য আমার খুব কষ্ট লাগে, জানিস তো দেব। আমি বিদিশাকে বলেছি, কেন শুধু শুধু তুই দেবকে দোষী করলি?মিনুর সাথে দেবকি সেদিন কোনো নোংরামী করতেই গেছিল? নিজের কাছের লোকটাকে বিশ্বাস করতে পারলি না? মিনুর দোষটা তুই দেবের ঘাড়েই চাপালি? এতে কার ভালো হল? তোর না দেবের?
শুভেন্দুকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর সাথে বিদিশার কোথায় দেখা হয়েছিল?
শুভেন্দু বললো, গড়িয়াহাট মোড়ে।
খেয়াল হল, শুক্লাও তাই বলেছে। বিদিশার সঙ্গে শুক্লারও গড়িয়াহাট মোড়েই দেখা হয়েছে।
শুভেন্দু বললো, আমার ধমক খেয়ে ব্যাচারা রাস্তায় হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করেদিল। ওকে বললাম, একী এভাবে কাঁদিস না। লোকে আমাকে খারাপ ভাববে। নে, এবার চোখের জল মোছ। আর আমাকে বল, তোর জন্য আমাকে কি করতে হবে?
চোখের পাতা এক করে আমি শুভেন্দুর কথাগুলো শুনছিলাম। ওকে বললাম, তারপর?
শুভেন্দু বললো, বিদিশার মুখটা দেখেই বুঝলাম, ও খুব কষ্টে আছে। সেই হাসি নেই মুখে। ঝলমলে রূপটাও যেনো কত ম্লান হয়ে গেছে। কলেজে যখন তোদের দুজনকে পাশাপাশি দেখতাম, কি মধুর আর মনোরম লাগতো। সেই বিদিশার চোখের তলায় কালির দাগের মত ছিটছিটে দাগ। মনে হচ্ছিল, বিদিশাকে কেউ খুব কষ্টে রেখেছে। ওর মুখের দিকে তাকাতেই আমার কেমন যেন লাগছিল। মনে হচ্ছিল মেয়েটা, কোনো অন্যায় অবিচার নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। কোনো নারীকে যদি কোনো পুরুষমানুষ পশুর মত আচরণ করে, তাহলে সেই নারীর নারীত্ম বলে তো কিছু আর থাকে না। ভালোবাসার জিনিষকে যত্ন করে রাখতে হয়। তুই তো বলেছিলিস আমাকে, প্রেম করতে করতে মনে নেই? তবে কেন?
আমি বললাম, বিদিশার এমন অবস্থা কে করেছে? ওর স্বামী?
শুভেন্দু বললো, করেনি শুধু। এখনো করছে। রীতিমতন টর্চার করছে ওর সঙ্গে। ওর স্বামীর কবল থেকে ওকে মুক্ত করে আনতে হবে।
আমার মনে হল, ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভূত। সামান্য একটা ঘটনায় বিদিশা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আর ওর স্বামী ওর ওপর এতো অত্যাচার করছে, সেই বিদিশা ওর স্বামীকে ছেড়ে আসতে পারছে না? কেন? কি অসুবিধা রয়েছে?
শুভেন্দুকে বললাম, ডিভোর্স কি তাহলে হয় নি? তাহলে শুক্লা যে বললো-
শুভেন্দু বললো, শুক্লাকে বলতে গিয়েও হয়তো বলতে পারেনি বিদিশা। এই শুক্লাই তো, তোর হয়ে কত করে মিনতি করেছিল বিদিশার কাছে। তুই না জানলেও আমি তো সেটা জানি। নিজের দূঃখ কষ্টের কথা বলতে চায়নি শুক্লার কাছে। মেয়েরা আবার মেয়েদের কষ্টের কথা শুনলে অত দরদী হয় না। যতটা আমাদের মত পুরুষেরা দরদ দেখাতে পারি, মেয়েদের জন্য। তার ওপর শুক্লা যদি তোর ওপর পাগল হয়ে গিয়ে থাকে। তাহলে তো আরোই কোনো লাভ হবে না বললে। আমাকে বিদিশা প্রানখুলে যতটা বলতে পেরেছে, শুক্লাকে সেভাবে হয়তো বলতে পারেনি, মনের দূঃখটা।
প্রায় অথৈ জলে পড়ার মতন আমি বলে উঠলাম, তাহলে কি হবে?
শুভেন্দু বললো, কি হবে তাহলে বল? তুই কিছু কি করতে পারবি?
ভেবে পাচ্ছিলাম না, এমন পরিস্থিতিতে আমার কি করণীয়? শুভেন্দুকে বললাম, তাহলে ওর স্বামী এখন কোথায়?
শুভেন্দু বললো, স্বামী, স্বামীর জায়গাতেই আছে। বিদিশা তো কদিন বাপের বাড়ী থাকবে বলে এখানে এসেছে। কদিন কাটিয়েই আবার ওকে পশুটার কাছে ফেরত চলে যেতে হবে। যাবার আগে, বিদিশার জন্য আমাদের সবাকেই কিছু না কিছু করতে হবে। এখন বল, তুই কি করবি?
মনটা ভীষন বিষন্ন হয়ে গেলো। ভাবছি, সমস্যার সমাধান কি করে করা যায়? তাহলে কি? ওকে-
হঠাৎ দেখলাম, রনি মুখ টিপে টিপে হাসছে। কঠিন একটা পরিস্থিতি। অথচ ওর ওই হাসি দেখে আমার ভীষন গা জ্বালা করছিল।
শুভেন্দু রনিকে গালাগাল দিলো। বললো, এটা হাসার সময়? সিরিয়াস একটা ব্যাপার এসে দাঁড়িয়েছে। আর তুই হাসছিস?
রনি আরও হাসতে লাগলো।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। শুভেন্দু বললো, বিদিশা কিন্তু একটু পরেই আসছে। তোকে কিন্তু তার আগেই সিদ্ধান্তটা নিতে হবে।
আমি মুখ কাচুমুচু করে বললাম, কি সিদ্ধান্ত নেবো? আগে তো বিদিশাকে আসতে দে। ওর সাথে কথা বলি?
শুভেন্দু বললো, যা যা আমি তোকে বললাম, বিদিশা তোকে তাই ই বলবে। এখন তোর ওপর সব কিছু নির্ভর করছে।
রনিকে দেখলাম, এরপরে হো হো করে হাসতে শুরু করেছে। মাধুরী সেইসময় ঘরে ঢুকেছে। বুঝতে পারছে না, ওর কর্তার হাসির কারণটা কি?
আমি দেখলাম, শুভেন্দুও এবার মুচকি মুচকি হাসছে। হাসিটা চেপে না রাখতে পেরে এবার একটু বেশী করেই হাসতে শুরু করলো শুভেন্দু। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুভেন্দু বললো, আসলে আমরা একটু পরীক্ষা করে দেখছিলাম, তুই সত্যি বিদিশাকে আগের মতন ভালোবাসিস কিনা? তোকে একটু পট্টী মারছিলাম। ওসব টর্চার ফর্চার কিছু নয়। বিদিশা ওর স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে এখন এখানেই ওর বাবা মায়ের কাছে রয়েছে। ও দিব্যি আছে। শুধু ভালোবাসার জন্য তোকে শুধু দরকার।
অনেকদিন বাদে মুখ দিয়ে একটা কাঁচা খিস্তী বেরিয়ে গেলো আমার। শুভেন্দুকে বললাম,শালা ঢ্যামনা। এরকম ভাবে কেই ইয়ার্কী মারতে পারে? তুই কি রে শুভেন্দু।
রনি হাসছে, শুভেন্দু হাসছে, মাধুরীও হাসছে। ওদের দেখে আমিও হাসতে লাগলাম। মনে হল, সেই কলেজের আনন্দের দিনগুলোই যেন আবার ফিরে এসেছে নতুন করে।
শুভেন্দু বললো, ‘বিদিশার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাওয়াটা বিরাট একটা ভাগ্যের ব্যাপার, জানিস তো দেব। একে তো আমার ফোন নম্বর বিদিশার কাছে নেই। কলকাতায় এতদিন বাদে ও ফিরে এসেছে, পুরোনো এক কলেজ বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎই গড়িয়াহাট মোড়ে তার দেখা হয়ে যাবে, না বিদিশা ভেবেছিলো, না আমি ভেবেছিলাম।
আমি শুভেন্দুকে বললাম, বিদিশা, তোকে দেখতে পেয়েছিল? না তুই বিদিশাকে?
শুভেন্দু বললো, ‘বিদিশা যখন তোর সাথে প্রেম করতো, তখনো আমি তোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলাম। আর এখনো তোর সাথে আমার সেই সম্পর্কটাই রয়েছে।। আমাকে বিদিশা দেখে স্বভাবতই খুব খুশি। জানে শুভেন্দুর সাথে দেখা হওয়া মানে দেবের খবর শুভেন্দুই তাকে দিতে পারবে। একটা দোকানে দাঁড়িয়ে আমি তখন কিছু জিনিষ কিনছি, হঠাৎই শুনলাম, পেছন থেকে কে যেন আমাকে ডাকছে, গলাটা খুব চেনা চেনা। মনে হল এ ডাক বিদিশার না হয়ে অন্যকারুর হতেই পারে না।’
আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছিলাম শুভেন্দুর কথা। ওকে বললাম, তারপর?
শুভেন্দু বললো, ‘তারপর আর কি? শুরুটা করলো এইভাবে। প্রথমেই আমাকে বললো, ‘কতদিন বাদে তোকে দেখলাম রে শুভেন্দু। আমাকে দেখে চিন্তে পারছিস?
‘আমি তো ওকে দেখে একেবারেই অবাক। ভাবতেই পারিনি বিদিশাকে এতদিন বাদে দেখবো। আমার কাছে এগিয়ে এলো বিদিশা। আমাকে বললো, এই ‘দেব’ কেমন আছে জানিস? আগে যে বাড়ীটায় ওরা থাকতো, দেব কি ওখানেই এখন থাকে? না অন্য কোথাও?
শুভেন্দু বললো, ‘বিদিশার মুখে তোর নামটা শুনে আমি কেমন প্রফুল্ল মতন হয়ে গেলাম। আহা, সেই যে কত মিষ্টি মিষ্টি করে কলেজে তোকে নাম ধরে ডাকতো, একেবারে সেইরকম।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, তারপর?
শুভেন্দু বললো, ‘বিদিশাকে দেখে আমি সত্যি অবাক। এতবছর পরে ওর সঙ্গে দেখা, কিন্তু এখনও ওর সৌন্দর্যে একটুকুও ভাটা পড়েনি, বিদিশার যে রূপ, সেই রূপ তার অক্ষত। কি সুন্দর লাগছিল ওকে দেখতে। আমি তো কোন ছার, যে কেউ প্রেমে পড়বে ওর ওই মিষ্টি হাসিটা দেখলে। মনে হল, আমি কি ঠিক শুনছি? এতদিন বাদে ও তোর কথা জিজ্ঞাসা করছে, তোর খোঁজ খবর নিচ্ছে, বিদিশার কি লাভ এসব জেনে? তারপরেই মনে হল, ‘দেব’ হচ্ছে এমন একটা ছেলে, যাকে ভুলেও কেউ ভুলতে পারবে না সহজে। বিদিশা প্রথমেই আমাকে বলো, এই দেবের ফোন নম্বরটা আমাকে দিবি? ভীষন দরকার।’
শুভেন্দু বললো, ‘আমি তো আরোই অবাক ও তোর ফোন নম্বর চাইছে দেখে। বিদিশাকে বললাম, কি হবে তোর দেবের ফোন নম্বর নিয়ে? তুই তো কবেই ওকে ছেড়ে চলে গেছিস। ব্যাচারাকে ফোন করবি, আর ও আবার তোর কথা ভেবে পাগল হবে।’
মনে হল, শুভেন্দুকে বলি, ‘চাইলো যখন, তুই বিদিশাকে আমার ফোন নম্বরটা দিতে পারতিস। বিরহের জ্বালায় এতদিন মরছিলাম। ফোনটা পেলে মনে একটা শান্তি আসতো।’
শুভেন্দু নিজে থেকেই বললো, আমি জানি, বিদিশাকে তোর ফোন নম্বর না দিলে তুই আবার আমার ওপরে রেগে হম্বিতম্বি করবি। এতদিন ধরে তোকে দেখে আসছি, তোর দূঃখ কষ্টটা বোঝার মতন ক্ষমতা তো আমার হয়েছে, আমি এই ভুলটা কিছুতেই করবো না। ওকে তোর ফোন নম্বরটা দিলাম। আশ্চর্য, বিদিশা তখুনি তোকে ফোন করতে চাইছিল।
আমি শুভেন্দুকে বললাম, তাই? কই এই কথাটাতো তো তুই আমাকে আগে বলিসনি। তাহলে তো আমি আগে থেকেই সব জেনে যেতে পারতাম।
শুভেন্দু বললো, ‘এটার জন্য অবশ্য তুই আমাকে গালাগাল দিতেই পারিস। কারণ আমিই বিদিশাকে তখন বারণ করেছিলাম।’
মনে হল, শুভেন্দুকে কাঁচা গিলে খাই, ওকে বললাম, কেন? তুই ওকে বারণ করলি কেন?
শুভেন্দু বললো, ‘সব কথা বিদিশার মুখ থেকে শোনার পর, আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো, তোর জন্য এটা তাহলে একটা সারপ্রাইজ থাক। বিদিশা তোর কাছে আসবে, কিন্তু একটা চমক হয়ে আসবে। তুই যেন আগে থেকে কিছু জানিস না। আমি ওকে সেইভাবেই রাজী করালাম।
বিদিশাকে বললাম, ‘তোর কথা দেবকে আমি আগে থেকে কিছু জানাবো না। তুইও এখন ফোন করিস না। তুই যে ফিরে এসেছিস, এটা দেব তোকে নিজের চোখেই দেখুক।’
আমাকে অবাক করে দিয়ে শুভেন্দু বললো, ‘আচ্ছা দেব, বিদিশা যদি তোর বাড়ী নিজে থেকে চলে যেতো, তোর কেমন লাগতো? হঠাৎই কলিংবেলের শব্দ শুনে তুই ই দরজাটা খুললি। দেখলি বিদিশা দাঁড়িয়ে আছে তোর সামনে। সেই হারিয়ে যাওয়া মুখ, মনকাড়া চাউনি, সেই আকূলতা। দেবকে পাওয়ার জন্য যার এত ছটফটানি। এতদিন বাদে একেবারে তোর বাড়ীর দোরগোড়ায়। তোর মনে হত না এ আমি কি দেখছি সামনে?’
শুভেন্দু এমন ভাবে কথাটা বললো, আমার মনে হল বিদিশা যেন সত্যি আসতে চেয়েছিল আমার বাড়ীতে। শুভেন্দুকে বললাম, তুই ওকে না করলি কেন?
শুভেন্দু বললো, ‘আমি না করিনি। না করবোই বা কেন? যে মেয়েটার মধ্যে একটা অনুশোচনা রয়েছে। একদিন তোকে ভুল বুঝে সে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, আবার সে ফিরে এসেছে। তোর সাথে দেখা করতে চাইছে। মনের মধ্যে একটু লজ্জ্বাও রয়েছে। কিন্তু তবু যেন তোর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে বলে তারমনে কোনো দ্বিধাবোধ নেই। এতবছর পরে বিদিশার মধ্যে যেন সেই কলেজে পড়ুয়া বিদিশাকেই আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমাকে নির্দ্ধিদায় ও বললো, আমি দেবের বাড়ীতে যেতে চাই, শুভেন্দু। ওর সাথে দেখা করতে চাই। তুই কি আমার মনে একটু সাহস জোগাবি শুভেন্দু? দেব আমাকে দেখলে রেগে যাবে না?’
শুভেন্দু বললো, আমি বিদিশাকে বললাম, ‘এক কাজ কর, তুই বরং আমার বাড়ীতেই চলে আয়। আমি ওখানেই দেবকে ডেকে নিচ্ছি। একসাথে সবাই মিলে আড্ডা দেবো। আবার মজা হবে, সেই কলেজের মতন। রনি আর মাধুরীকেও আসতে বলছি।’
আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুভেন্দুর কথাগুলো শুনছিলাম। মাধুরী একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আমাকে বললো, ‘সত্যি দেবদা। এখনো তুমি বিদিশাকে কত ভালোবাসো। তোমার মত কজনে হয়?’
রনি বললো, ‘দেব হচ্ছে, সত্যিকারের প্রেমিক। ও ব্যর্থ প্রেমিক নয়। বিদিশার কপাল ভালো, দেব ব্যাচারা বিয়ে করেনি। নইলে-‘
শুভেন্দু বললো, ‘দেব হচ্ছে এমন একটা ছেলে, যতক্ষণ নিজে থেকে কেউ ভুলটা না বুঝতে পারছে, ও জোর করে কারুর ভুল ধরাতে যাবে না। এই বিদিশাকেই দেখ, যখন নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।’
আমি বললাম, ছাড় ছাড়। আমার সন্মন্ধে আর অত ভালো কথা বলতে হবে না। বিদিশা কখন আসছে, তাই বল।
শুভেন্দু হেসে বললো, ‘দেখেছিস তো, বিদিশার কথা শুনে এবার তোর কেমন ছটফটানিটা শুরু হয়ে গেছে। আসছে আসছে অত ব্যাকূল হোস না। একটু পরেই এসে পড়বে। বিদিশাকে আমি ফোন করেছিলাম একটু আগে, ও ট্যাক্সি নিয়ে রওনা দিয়ে দিয়েছে। হয়তো এসে পড়বে আর দশ মিনিটের মধ্যেই।’
মাধুরী বললো, ‘এক কাজ করলে হয় না? বিদিশা আসার আগে, আমরা বরং দেবদাকে অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখি। ও এসে দেবদাকে খুঁজে পাবে না। আর দেবদার মত বিদিশাও একটু ছটফট করবে। মজা হবে একটু।’
শুভেন্দু বললো, ‘আইডিয়াটা মন্দ নয়। তবে দেব কি তাতে রাজী হবে? দেখ ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখ। এখনই কেমন ফ্যাকাসে মতন হয়ে গেল। ব্যাচারা বিদিশাকে না দেখতে পেলে, নিজেই যে কষ্ট পাবে।’
ওরা সবাই হাসতে লাগল। শুভেন্দুকে রনি বললো, ‘আজ হচ্ছে ঐতিহাসিক দিন। দুটি প্রেমিক প্রেমিকা এতদিন পরে আবার কাছাকাছি হচ্ছে দুজনে। এই ঐতিহাসিক দিনে আমরাও আজ উপস্থিত। দেব আর বিদিশার পুনর্মিলন কি জয় হোক।’
মাধুরী বললো, ‘হ্যাঁ দেবদা। এবারে কিন্তু বড়সড় একটা পার্টী দিতে হবে তোমাকে। পার্কস্ট্রীট বা বড় কোনো রেস্টুরেন্টে দেওয়া চাই। অনেক নোট খসবে তোমার। তৈরী থেকো।’
মনে হল, দম নিঃশ্বেস হওয়া ঘড়িকে যেমন দম দিয়ে আবার শক্তির যোগান দেওয়া হয়। ঠিক তেমনি বিদিশার আগমনের খবরটাও আমার ভেতরের শক্তিটাকে যেন অনেক বর্দ্ধিত করে দিয়েছে। ঠিক যেন জীবনের মরুভূমিতে বৃষ্টিপাতের মতন। সেই উদ্দামতা, সেই আবেগ আবার ফিরে পাচ্ছি। বিদিশা এখনো এসে পৌঁছোয়নি, কিন্তু ওর উপস্থিতি, ওর আবির্ভাব, শরীরে শরীরের স্পর্ষ আমি যেন আগে থেকেই টের পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, বিদিশা যেন আমার ঠিক পাশেই বসে রয়েছে, আর আমাকে বলছে, ‘কি গো তাকাবে না আমার দিকে? রাগ করেছো বুঝি। দেখো আমি তো তোমার কাছেই আবার ফিরে এসেছি।’
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
জীবন খাতার প্রতি পাতায় বিদিশার নামটা লিখে রাখবো বলে আমি ঠিক করে রেখেছিলাম। আমার জীবন থেকে বিদিশা কোথায় হারিয়ে গেল। পাতাগুলোও সব শূন্য থেকে গেল। আজ আবার বিদিশাকে আমি ফিরে পেলাম। মনে হল শূন্য পাতাগুলোকে ভরাট করার জন্য বিদিশাকে পেয়ে আমি যেন আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠলাম।
শুভেন্দু ঘড়ি দেখছে, রনিও ঘড়ি দেখছে। নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঠিক সাতটা বেজে পঁচিশ মিনিট। বিদিশা আসার কথা ছিল, সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। অথচ এখনো অবধি এসে পৌঁছোলো না। মাধুরী তখন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ছটফটানিটা ধরে ফেলেছে। শুভেন্দুকে বললো, ‘এই ছোড়দা, বিদিশাকে একবার ফোন করে দেখ না, এখনো এসে পৌঁছোলো না কেন?দেবদা চিন্তা করছে।’
শুভেন্দু বকা লাগালো মাধুরীকে। ওকে বললো, ‘ব্যস্ত কেন হচ্ছিস? ও ঠিক এসে পড়বে। বললাম তো, ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। হয়তো রাস্তা জ্যাম আছে। এসে পড়বে এক্ষুনি।’
আমি একটু উতলা মতন হয়ে শুভেন্দুর কাছে একটা সিগারেট চাইলাম। শুভেন্দু বললো, ‘একি রে দেব? তোর টেনশন হচ্ছে না কি? সিগারেট খাওয়া তো তুই কবেই ছেড়ে দিয়েছিস। আবার যে সিগারেট খেতে চাইছিস?
আমি শুভেন্দুর কথা শুনলাম না। জোর করে ওর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে নিয়ে ঠোঁটে গুঁজলাম। একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে আমার এমন অবস্থা হল, যা জীবনে কোনোদিন হয় নি। দেশলাইয়ের সাত আটটা কাঠি নষ্ট হল। শুভেন্দু রনিকে বললো, ‘দেখ দেবের অবস্থা দেখ, এখনো সিগারেট ধরাতে পারছে না। ব্যাচারা।’
রনি বললো, ‘বুঝতে পারছি, বিদিশার আসছে শুনে দেবের ভেতরটা এখন কিরকম তোলপাড় চলছে। যতক্ষণ না ও এসে পৌঁছোবে দেবের এরকমই চলবে।’
জানি এতদিন বাদে বিদিশাকে দেখতে পাবো বলে মনের ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। কলেজের সেই পুরোনো স্মৃতিগুলো বারে বারে মনে পড়ছে আর আমি যেন আরো ব্যাকুল হয়ে উঠছি বিদিশার জন্য। জীবনে প্রেম আমি একবারই করেছি, শুধু এই বিদিশার সঙ্গেই। কলেজে পড়া, বিদিশার সঙ্গে একসাথে ঘোরাঘুরি করা। যখন কোনো তরুনের মন, স্বপ্নময় প্রেমের অজস্র রূপরেখার ভিড়ের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চায়, প্রেমভাবনায় নিজেকে অনুপ্রাণিত করতে চায়, আমি যেন সেভাবেই দিনগুলো অতিবাহিত করেছিলাম ঠিক স্বপ্নের মতই। বিদিশার চিন্তাকে আমি তাই মন থেকে দূর করতে পারিনা। মনে হয় ও নেই। তবুও ও যেন আমার কত কাছেই রয়েছে।
সিগারেটটা ধরিয়ে বেশ কয়েকবার জোরে জোরে টান দিলাম। ধোঁয়াটা গলায় আটকে গিয়ে খুক খুক করে কাশি হলো আমার। শুভেন্দু বললো, ‘এই তুই কি শুরু করলি বলতো? না আমাকে দেখছি, এবার বিদিশাকে একটা ফোন করতেই হবে।’
সেলফোনটা হাতে নিয়ে শুভেন্দু সঙ্গে সঙ্গে কল করলো বিদিশাকে। দু’বার রিং হওয়ার পর, বিদিশাই ধরলো। শুভেন্দু, বিদিশাকে বললো, কিরে বিদিশা? এখনো এসে পৌঁছোলি না? কোথায় তুই?’
বিদিশা বললো, ‘আমি এসে গেছি। আর হয়তো বড়জোড় দশ মিনিট।’
শুভেন্দু বললো, ‘তোর জন্য এখানে একজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, ভীষন উতলা হয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি দেখা দে মা। আর কখন আসবি?’
বিদিশা বুঝতে পেরেছে, শুভেন্দু আমার কথাই বলছে। ওর কথা শুনে আমিও হাসবো না কাঁদবো, তাই ভাবছিলাম। শুভেন্দু বললো, জানিস বিদিশা, দেব আমার ওপরে রেগে কত খাপ্পা হয়ে রয়েছে। আমার দোষ কি? না আমি তোকে দেবকে ফোন করতে বারণ করেছিলাম। তুই শীগগীর আয়। নইলে দেব আর আমাকে আস্তো রাখবে না বলছে।’
বিদিশা কি বলতে চাইছিল, শুভেন্দু বললো, ‘নে তোর এক্সলাভারের সাথে একটু কথা বল। দেবও তোর সাথে কথা বলে একটু শান্তি পাক।’
নিজের সেলফোনটা হঠাৎই আমার হাতে ধরিয়ে দিল শুভেন্দু। আমার বাঁ হাতে তখন জ্বলন্ত সিগারেট। আচমকা ফোনটা ওভাবে বাড়িয়ে দেওয়াতে সিগারেটটা আমার হাত ফস্কে পড়ে গেল হঠাৎই। কোথায় পড়েছে বুঝতে পারছি না। মাধুরী চেঁচিয়ে উঠে বললো, ‘এই দেবদা ওঠো, ওঠো। তোমার জামার ওপরে পড়েছে সিগারেট। এখুনি জামাটা পুড়ে যাবে।’
সোফা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। এবার জামা থেকে সিগারেটটা মাটিতে গিয়ে পড়লো। রনি বললো, ‘বিদিশা আসুক। আজ তোর হবে। যা শুরু করেছিস তুই।’
ফোনটা কানের পাশে নিয়ে বিদিশাকে কি বলবো, তাই ভাবছি। ভাবলাম, শুরুটা এরকম ভাবে করি, বিদিশাকে বলি, ‘তুমি কেমন আছো বিদিশা? বিদিশাও তখন আমাকে বলবে, আগে বলো তুমি কেমন আছো? আমি জবাবে কিছু একটা বলবো। এই ভেবে ফোনটা কিছুক্ষণ কানের পাশেই ধরে রাখলাম। শুভেন্দু বললো, ‘হ্যা রে। আবার ভাবুক হয়ে গেলি তুই? বল কিছু, ও তো ফোনটা ধরেই আছে তোর জন্য।’
অনেকদিন বাদে বিদিশাকে ফিরে পেয়েছি, ভাবলাম, বিদিশাকে বলি, বিদিশা তুমি ফি্রে এসেছো। কত ভালো লাগছে। সেই পুরোনো আনন্দের দিনগুলো, ভালোবাসার মূহূর্তগুলো। বিদিশা কলেজের দিনগুলোর কথা তোমার মনে আছে? তুমি যে আমাকে ভুলে যেতে পারবে না আমি জানতাম, বিদিশা ও বিদিশা। শুনতে পারছো আমার কথা? বিদিশা-
এবার শুভেন্দুর মুখ থেকে একটা বড় ধ্যাতানি খেলাম। চেঁচিয়ে উঠে বললো, ‘কিছু বলবি তো? তখন থেকে ফোনটা কানে ধরে শুধু বসে আছিস। যা বলার বিদিশাকে সব বলে ফেল। মনের মধ্যে কিছু রাখিস না।’
অতজোড়ে ধ্যাতানি খাবার পর আমার যেন চেতনা ফিরলো। মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে এলো, হ্যালো।
বিদিশা বললো, ‘কখন এসেছো?’
-‘এই কিছুক্ষণ আগে।’
-’অনেক কষ্ট পেয়েছো না? এইকটা দিন।? বিদিশাকে শুধু খারাপ ভেবেছো।’
– ‘না ভাবিনি। কেন ভাববো? তুমি তো খারাপ নও।’
-’শুনে খুশি হয়েছো? আমি ফিরে এসেছি বলে।’
-’তা তো হয়েছি কিছুটা।’
-’কিছুটা কেন? অনেকটা নয়?’
-’হ্যাঁ অনেকটাই। আমি ভীষন খুশি হয়েছি।’
-’আমার কথা কেউ বলেছে তোমাকে?’
-হ্যাঁ। শুভেন্দু বলেছে, শুক্লাও বলেছে।’
হঠাৎই ফোনের ও প্রান্তে বিদিশার গলাটা কেমন আস্তে হয়ে গেল। মনে হল বলতে গিয়ে ওর গলাটা অনুশোচনায় কেমন কেঁপে গেলো। আমাকে বললো, ‘দেব’ তুমি কি আমাকে সেই আগের মতই ভালোবাসো? যে ভালোবাসার দাম দিতে না পেরে আমি তোমাকে ছেড়ে একদিন চলে গিয়েছিলাম।’
বিদিশাকে বললাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, এই কথাটা জীবনে কোনদিন তোমাকে ছাড়া আর কাউকে কখনো বলিনি। হয়তো প্রতিদানে যেটা পেতে চেয়েছিলাম, সেটা পাইনি ওটা আমার ভাগ্যের দোষে। কিন্তু তোমাকেও আমি দোষ দিতে চাইনি। ভালোবাসাটাকে বুকের মধ্যেই আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম এতদিন। ভেবেছিলাম, হয়তো যদি তুমি কোনদিন, আমার কাছেই আবার ফিরে আসো। বিদিশার প্রতি দেবের ভালোবাসা এখনো যে তাই মরেনি।’
মনে হল,অনুতপ্ত হয়ে বিদিশা যেন ফোনেই কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। গলাটা ভারী ভারী করে বললো, ‘দেব? তুমি এখনো সেই আগের মতন? তোমাকে যেমনটি আমি দেখে গিয়েছিলাম?
বিদিশাকে বললাম, ‘এই বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন? তাড়াতাড়ি এসো। আমি তো তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।’
বিদিশার সাথে কথা বলার পরে ফোনটা ছেড়ে দিলাম। ঠিক তার পাঁচ মিনিট পরেই শুভেন্দুদের গলির মুখটায় একটা কালো রঙের ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। মাধুরী ট্যাক্সির আওয়াজ শুনেই দৌড় লাগালো। আমাদেরকে বললো, ‘বিদিশা এসেছে মনে হয়। আমি ওকে এখানে নিয়ে আসছি।’
ট্যাক্সি থেকে বিদিশা নামছে। আমি ঘরের জানলা দিয়ে বিদিশাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। একটা ময়ুরকন্ঠী রঙের ছাপা শাড়ী পড়েছে বিদিশা। হাতে ওর সাদা রঙের একটা ভ্যানিটি ব্যাগ। গলির ল্যাম্পপোষ্টের উজ্জ্বল আলোতে বিদিশার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। মাধুরী ঘর থেকে বেরিয়ে ওর সামনে যেতেই বিদিশা ওকে জড়িয়ে ধরলো। দুজনের দুজনকে জড়িয়ে ধরেই কি যেন একটু কথা হল। দুজনে তারপর হেঁটে এগিয়ে আসতে লাগলো শুভেন্দুদের বাড়ীর দিকে।
ঘরের মধ্যে আমি শুভেন্দু আর রনি বসে। শুভেন্দু বললো, শোন দেব, ‘তোকে আর বিদিশাকে কিন্তু আমরা আধঘন্টার জন্য আলাদা ছেড়ে দেবো। তারপরে কিন্তু পুরো সময়টাই আমাদের। আজকে অনেক গল্প হবে, আনন্দ হবে। আর তুই কিন্তু ভালো ভালো কয়েকটা গান গাইবি। নইলে তোকে কিন্তু ছাড়বো না আজকে।’
আমি কিছু বলতে চাইছিলাম। রনি বললো, ‘ভ্যানতারা আর করিস না তো। বিদিশা কি তোর পালিয়ে যাচ্ছে? এই তো এলো। এবারে একেবারে তোর পার্মানেন্ট হয়ে গেলো।’
বারান্দা পেরিয়ে বিদিশা মাধুরীর সঙ্গে ঘরে ঢুকছে। আমি মুখটা একটু নিচু করে নিলাম। মনে হল, এই বুঝি বিদিশা ঘরে ঢুকলো। আর তার আগে থেকেই আমিও কেমন আড়ষ্ট মতন হয়ে গেলাম।
মাধুরী বিদিশাকে ঘরে ঢুকিয়ে বললো, ‘দেখছো তো? ওখানে ওই সোফার ওপরে কে বসে আছে। চেনো লোকটাকে? চিনে বলো দেখি, ওই ভদ্রলোকটি কে?
আমি মুখ তুলে বিদিশার মুখের দিকে তাকাতেই, বিদিশাও আমার মুখের দিকে তাকালো। প্রায় বেশ কিছু বছর পরে বিদিশাকে আবার খুব কাছ থেকে দেখছি, আমার মনে হল, সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরী বিদিশা, চোখ দিয়ে যার সৌন্দর্য ও শরীরটাকে আকন্ঠে পান করা যায়, তাকে আবার এতো কাছ থেকে দেখছি আমি। আমার যেন সব স্বপ্নের মতন মনে হচ্ছে। ঠিক যেন চোখের সামনে এক রূপমাধুরী। অথচ প্রথমদিন ওর এই রূপ দেখে আমি কিন্তু ওর প্রেমে পড়িনি। বিদিশাই আমাকে প্রথম চিঠি দিলো। তারপরেই আমাদের প্রেম শুরু হল। মনের সঙ্গে মন মেলাতে লাগলো, দু একটা দিন। তারপরে যখন ওর রূপের প্রশংসা শুরু করলাম, বিদিশা বললো, ‘তাই বুঝি? আমি এতো সুন্দর? প্রথম দিনতো দেখে বলোনি আমাকে।’
প্রজাপতির মতো কোমল ওর সুন্দর ঠোঁটদুটোকে দেখছিলাম। কলেজে পড়ার সময় ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাসে কতবার যে আমার গলা জড়িয়ে আমার গালে চুমু খেয়েছিল ওই ঠোঁট দিয়ে, তার ইয়ত্তা নেই। মনে হলো সৌন্দর্য ও মনের দিক থেকে বিদিশা যেন এখনো সেই তরুনীই আছে। তরুনী নারীর মতোই ভালোবাসার জন্য উন্মুখ, হয়তো আমাকেই আবার সুখী করার জন্য তার হৃদয় মনে এক উজাড় আকাঙ্খা। এই আকাঙ্খা অতীতের সেই আকাঙ্খার থেকেও তীব্র আরো উত্তপ্ত।
শুভেন্দু রনিকে বললো, ‘এই রনি, এদের দুজনের চোখদুটো যে দুজনের দিকে আটকে গেছে রে। আমরা ঘরে বসে আছি, অথচ এদের দুজনের কারুর খেয়ালই নেই। ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছিস?’
রনি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না রে দেব। বিদিশা আসছে বলে, তোকে আমরা বাড়ীতে ডাকলাম। তাই বলে তুই?-
মাধুরী বিদিশাকে বললো, ‘বসো না বসো। দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ থাকবে? পারো যদি ওই লোকটার পাশে গিয়ে বসো।’ বলে আমার দিকে আঙুল তুলে মাধুরী বিদিশাকে ইশারা করলো।
যেটা হয়তো হবারই কথা ছিল না। শুভেন্দু আর রনি এবার সেটাই করে দেখালো দুজনে। ওরা দুজন এগিয়ে গেলো বিদিশার দিকে। বিদিশার হাত দুটো দুপাশ থেকে দুজনে ধরলো, তারপর দুজনে ওকে টেনে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলো আমার পাশে।
শুভেন্দু বললো, ‘নে, এবার তোরা দুজনে পাশাপাশি। এখন আর দুজনে দুজনের দিকে তাকাবি না। এখন আমাদের দিকেই তাকিয়ে থাকবি, আর আমাদের সাথেই কথা বলবি।’
মাধুরী রনিকে বললো, ‘তুমি আর ছোড়দা, তোমরা দুজনে এত হিংসুটে কেন গো? দেখোতো বিদিশা কি ভাবছে। আর দেবদার মুখটাও কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে।’
শুভেন্দু বললো, ‘এই ছুড়ী, বাজে বকিস না। দেব কে আমি ভালো করেই চিনি। ওকে মানা করলেও ও ঠিক চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিদিশার দিকে তাকাবে। আমাকে সামনে থেকে সব লক্ষ্য রাখতে হবে।’
রসিকতার মানে যে বোঝে, সে জানে। বুঝতেই পারছিলাম, এই শুরু হল এবার। শুভেন্দু আর রনি যা করবে, আমাকে আর বিদিশাকে, দুজনকেই এখন মেনে নিতে হবে।
শুভেন্দু বললো, ‘আচ্ছা দেব, বিদিশা তো ফিরে এলো। বড়সড় করে একটা পার্টী কবে দিচ্ছিস বল? আর বিয়ের ডেটটা যদি এখনি ঠিক করে ফেলিস। তাহলে কিন্তু বৌভাতের রিসেপশনটা ভালো করে দিতে হবে। মেনু কার্ডের আইটেম কি কি করবি, এখন থেকে ঠিক করে ফেল। ক্যাটারিং এর অর্ডারটা রনিকে দিয়ে দিচ্ছি। ও বিজলী গ্রীলের সাথে কথা বলে নেবে।’
মাধুরী বিদিশাকে বললো, ‘এই বিদিশা চা খাবে তো? সবার জন্য তাহলে চা করে আনছি।’
শুভেন্দু মাধুরীকে বললো, ‘এই দেবকেও ভালো করে একবার জিজ্ঞেসে করে নে। বাবু তো একজনের জন্য চা ছেড়ে দিয়েছিলেন অনেকদিন আগে, যার জন্য ছেড়েছিলেন, তিনি এখন তার পাশেই বসে আছেন। দেব এখন আবার তার সামনে চা খাবেন কিনা?
বলেই ও আমার দিকে তাকালো।
বিদিশা একটু লজ্জা করছিল। শুভেন্দু বললো, ‘লজ্জ্বা কোরো না, লজ্জ্বা কোরো না। আমরা সবাই তোমাদের বন্ধু। তোমাদের পুরোনো ইতিহাসটা আমরা তো সবাই জানি। তাই বলছি।’
মাধুরী চুপ করে দাঁড়িয়েছিল হাঁ করে। বিদিশা বললো, ‘তুমি যাও তো মাধুরী। চা করে নিয়ে এসো। তোমার এই দাদার কথা শুনো না। তোমার দাদাটা ভীষন দুষ্টু।’
রনি হাসছিল দাঁত বার করে। শুভেন্দু কে বললো, ‘দেখলি? বিদিশা যেই হ্যাঁ বলে দিলো, অমনি দেবও না করলো না। কি গভীর প্রেম, একেবারে লায়লা মজনুর মতন।’
আমি রনিকে বললাম, ‘চা তো আমি খাই। তবে আগে যেরকম ঘনঘন খেতাম, সেটা এখন খাই না। সকালে একবার খাই। আর এই বিকেল বা সন্ধেবেলাটা একবার।
শুভেন্দু বললো, ‘আগে ঘনঘন যখন খেতিস, তখন সেটাকে কমিয়ে দিলি কেন? কেউ তোকে বারণ করেছিলো। সেটা বল না?’
বলেই ও বিদিশার দিকে তাকালো।
আমি বললাম, বয়স হলে, সবই কমাতে হয় আসতে আসতে। শরীরটার দিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে।
শুভেন্দু বললো, কত বয়স হয়েছে তোর? এমন ভাবে বলছিস, যেন তুই বুড়ো হয়ে গেছিস। এই তো কলেজ পাশ করলাম কয়েক বছর আগে। এখনো দিনগুলো সব মনে আছে। সেই কফি হাউস, শিয়ালদহর কাফেটরিয়া, বসন্ত কেবিন, কলেজ স্কোয়ারের পাশে শরবতের দোকানটা, কি যেন নাম?
রনি বললো, প্যারামাউন্ট। প্যারামাউন্ট। ওখানে দেব, বিদিশাকে নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে যেতো মনে নেই?
শুভেন্দু বললো, হ্যাঁ কি না, বিদিশা শরবত খেতে খুব ভালোবাসে। তারপরে যখন আমরা সবাই মিলে একদিন ওদের পিছু নিলাম, দেবের তারপরের দিন থেকে কলেজ স্কোয়ারে যাওয়াই বন্ধ করে দিলো। ব্যাচারা খুব কষ্ট পেয়েছিল বিদিশার জন্য।’
শুভেন্দু আর রনি দুজনেই হো হো করে হাসতে লাগলো। বুঝলাম, দুটোতে মিলে যা শুরু করেছে, পুরোনো কাসুন্দী সব ঘেঁটে বার করছে। এবার না মিনুর কথাটাও আলোচনার মধ্যে এসে না যায়।
বলতে বলতেই মাধুরী চা নিয়ে ঢুকলো। একটা বড় প্লেটে করে সবার জন্য চা নিয়ে এসেছে। বিদিশা বললো, সেকীরে? এত তাড়াতাড়ি চা হয়ে গেল?
রনি বললো, ও খুব ফাস্ট। সব কিছুই খুব তাড়াতাড়ি করে। রান্নাটাও তাড়াতাড়ি সারে। সেই জন্য আমারো খুব সুবিধে হয়।
থাক আর অত প্রশংসা করতে হবে না। এবার চা’ টা সবাই মিলে হাত বাড়িয়ে ধরো তো দেখি। বলেই মাধুরী সবার দিকে চা বাড়িয়ে দিতে লাগলো। বিদিশা হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলো। কিন্তু কাপটা প্রথমে আমাকেই দিলো। শুভেন্দু উল্টো দিক থেকে সব লক্ষ্য করছিলো। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। তারপরেই বললো, দেব কিন্তু আজ গান শোনাবে বলেছে, তোরা সবাই মিলে ওকে আর একবার বল। আর বিদিশা, তুমিও একটু বলো। নইলে যে বাবু আবার-
চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি। বিদিশা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। আমাকে বললো, কি গাইবে না?
আমি বললাম, হ্যাঁ। গাইবো।
শুভেন্দুদের বাড়ীতে আবার হারমোনিয়াম, তবলা কিছুই নেই। মাধুরী ছোটবেলায় গীটার শিখতো। আমি গীটারটাও বাজাতে পারতাম বলে, মাঝে মাঝে ওর গীটারের সাথে সুর ভাজতাম। মাধুরী বিয়ে করে এ বাড়ী ছেড়ে চলে গেলো, সেই সাথে গীটারও ওর সাথে চলে গেল। আমি অবাক হলাম, যখন দেখলাম, পাশের ঘর থেকে রনি একটা স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়াম নিয়ে এলো। আমাকে বললো, ‘সব ব্যবস্থা করেছি আজকে। তোর কোনো চিন্তা নেই।’
পাশের কোনো বাড়ী থেকে হয়তো হারমোনিয়ামটাকে নিয়ে এসেছে। মাধুরী বললো, ‘এ কি এ কি দাঁড়াও। এতদিন পরে বিদিশা এলো, দেবদার সাথে একটু কথা বলে নিক। তারপরে তো গান বাজনা সব হবে।’
শুভেন্দুদের চারতলা বাড়ীর ছাদটা খুব সুন্দর। চারিদিকে টব দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে একটা দোলনা দুলছে। শুভেন্দুর বাকী দাদারা সব বিবাহিত। সবাই বউ নিয়ে এসে সন্ধেবেলা থেকে একঘন্টা করে ওখানে দোল খেয়ে যায়। আমাকে শুভেন্দু বললো, ‘শোন ছাদটা, তোর আর বিদিশার জন্য আজ আধঘন্টা রিসার্ভ। ওখানে কেউ যাবে না। এই আমরা তিনজনও নয়। কিন্তু আধঘন্টার বেশী দেরী করবি না। তাহলে কিন্তু বামাল করবো গিয়ে। তোর গান শোনবার পর্বটা তারপরে হবে। আমরা ততক্ষণ আমাদের লিকারের ব্যবস্থাটাও সেরে ফেলছি। ‘
চা খাবার পর, মাধুরী আমাকে আর বিদিশাকে ছাদে নিয়ে গেলো। আমাদের দুজনকে বললো, ‘নাও আধঘন্টার জন্য তোমাদেরকে আমি এখানে ছেড়ে গেলাম। ঠিক আধঘন্টা পরেই আমি আসছি। এর মধ্যে দুজনের যা কথা বলবার, সেরে নাও।’
আমার থেকে চার পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে তখন বিদিশা। মনে হচ্ছিলো, ও হয়তা চাইছে, আমি ওকে কাছে ডাকি, নয়তা ওর কাছেই এগিয়ে যাই। বিদিশাকে বললাম, ‘দূরে কেন দাঁড়িয়ে রয়েছো? কাছে এসো।’
বিদিশা একটু এগিয়ে এলো। মনে হল, দূরত্বটা কিছুটা হলেও কমলো। কিন্তু এখন যেন অল্প একটু ফাঁক থেকে গেলো।
দূরের আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে, একটু ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস বইছে। বিদিশা বললো, বেশীক্ষণ কিন্তু ছাদে দাঁড়ানো যাবে না। তাহলে আবার ঠান্ডা লেগে যাবে।’
বিদিশাকে বললাম, ‘তুমি গরম কিছু পড়ে আসোনি? নইলে ফেরার সময় তো ঠান্ডা লেগে যাবে।’
বিদিশা বললো, ‘তুমিও তো কিছু পরে আসোনি। একটা হাফহাতা শোয়েটার অন্তত পড়ে আসতে পারতে। তারপরেই বললো, মাধুরীকে বলবো, যাবার সময় একটা শাল জাতীয় কিছু দিয়ে দিতে। কাল বা পরশু ওকে ফেরত দিয়ে দেবো।’
বিদিশাকে বললাম, তোমার বাবা মা এখন কেমন আছেন?
বিদিশা বললো, ‘ভালো। তবে বাবার ব্যবসা করে অনেক লোকসান হয়ে গেছে। আগের মতন বড়লোকীয়ানা ব্যাপারটা নেই। আমাদের আর্থিক অবস্থা সেই আগের মতন নয়।’
শুনে একটু খারাপ লাগলো। তবু বললাম, ‘তোমার বাবা মা লোক হিসেবেও খুব ভালো ছিলেন। একেবারে মাটীর মানুষ। আমি একবারই গিয়েছিলাম, আর ওনাদের দেখে এটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।’
বিদিশা বললো, মাসীমা কেমন আছেন? আমার কথা কখনো জিঞ্জেস করেন?
বললাম, ‘হ্যাঁ। মা ভালো আছে। মাঝে মাঝে তোমার কথা জিজ্ঞাসা করে তো আমাকে।’
মনে হল, এই আলোচনার বাইরে বিদিশা যেন আরো একটু সপ্রতিভ হতে পারছে না আমার সাথে। ওকে সহজ করে দেবার জন্য বললাম, আমার সাথে তুমি দেখা করতে চেয়েছিলে, আমার বাড়ীতে তুমি আসতেও চেয়েছিলে। শুভেন্দুর মুখে আমি সবই শুনলাম। তবুও আগের মতন পুরো হাসিটা কিন্তু এখনো আমি বিদিশার মুখে দেখতে পাচ্ছি না। তোমার মনে কি কোনো লজ্জ্বা বা দ্বিধা আছে এখনও? সেরকম কিছু থাকলে মন থেকে সেটা দূরে সরিয়ে দাও। পুরোনো কথা আমিও কিছু মনে রাখি না। আর আশা করি তুমিও-
বিদিশা বললো, তুমি বিয়ে করো নি কেন?
মনে হল, মান্না দের গানটা গেয়ে ওকে উত্তরটা দিই আর ওকে বলি, হয়তো তোমারি জন্য, হয়েছি প্রেমে যে বন্য, জানি তুমি অনন্য আশার হাত বাড়াই। যদি কখনো এ প্রান্তে, চেয়েছি তোমায় জানতে, শুরু থেকে শেষ প্রান্তে শুধু ছুটে গেছি তাই। আমি যে নিজেই মত্ত, জানিনা তোমার শর্ত, যদি বা ঘটে অনর্থ, তবু তোমাকে চাই। আমি যে দুরন্ত, দু’চোখে অনন্ত, ঝড়ের দিগন্ত জুড়েই, স্বপ্ন চড়াই। তুমি তো বলনি মন্দ, তবু কেন প্রতিবন্ধ, রেখোনা মনের দ্বন্দ্ব, সব ছেড়ে চল যাই।
বিদিশা চেয়ে আছে আমার মুখের দিকে। যেন অনেক না বলা কথা আমাকে সে বলতে চায়। নিষ্পাপ সরলা যুবতীর মতই সে দেবকে নতুন করে ভালোবাসতে চায়। জীবনের প্রথম প্রেম, প্রেমের সুখানুভূতিতে একসময় শরীরে যেমন শিহরণ জাগতো। অসংখ্য স্বপ্ন আর আনন্দে জেগে উঠতো মনটা। বিদিশা সেইভাবেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমটা সমর্পন করে দিতে চাইছে আমার কাছে।
আমার এবারে খুব কাছে এসে বিদিশা বললো, ‘আমাকে তুমি বিয়ে করবে দেব? আমি কিন্তু সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে তোমার কাছেই আবার ফিরে এসেছি।’
বিদিশার দিকে আমি দু’হাত বাড়ালাম। ও আমার দুহাতের আলিঙ্গনে শরীরের সাথে আবিষ্ট হয়ে গেল। বিদিশার ঠোঁটদুটো আমার খুব কাছে, ইচ্ছে হচ্ছিলো একটা চুমু খাই।
মনে পড়ছিলো, ছোটোবেলার কথা। একটা হলদে প্রজাপতি ঘাসের ওপর দিয়ে নেচে নেচে উড়ে বেড়াচ্ছে। আমি প্রজাপতিটাকে ধরার অনেক চেষ্টা করছি, কিছুতেই ধরতে পারছি না। প্রজাপতিটা সেদিন উড়ে চলে গেলো বলে খুব মন খারাপ হয়েছিল, মা পরে বলেছিলো, ‘প্রজাপতি যেদিন নিজে থেকে তোর গায়ে এসে বসবে, বুঝবি তোর এবার বিয়ে হতে চলেছে।’
শুভেন্দুদের বাড়ীর ছাদে একটা নরম প্রজাপতি অনেকদিন পর আমাকে আবার জড়িয়ে ধরেছে। আমার বুকে মুখ ঘসছে, গলায় মুখ রাখার চেষ্টা করছে, আমিও তাকে আদর করার চেষ্টা করছি। মনে হচ্ছে, এই শীতকালের সন্ধে রাত্রে এ হল সেই উষ্ণতার পরশ। যেটা পেলে শরীর এমনি গরম হয়ে যায়, শোয়েটার বা শাল। হয়তো কোনো কিছুরই প্রয়োজন পড়ে না।
হঠাৎই ছাদের দরজাটা সেইসময় খুলে গেলো। দেখি মাধুরী ওখানে দাঁড়িয়ে। আমাদের দুজনকে বললো, ‘এই যে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক, প্রেমিকা। টাইম হয়ে গেছে। ছোড়দা তোমাদের দুজনকে ডাকছে। এবারে নিচে যেতে হবে।’
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
আচমকা মাধুরীকে আবার ছাদে আসতে দেখে বিদিশা কিছুটা লজ্জ্বায় পড়ে গেছে। আমার বুক থেকে মুখটা তুলে ও তখন নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, মাধুরী অন্ধকারে অত ভালো করে ঠাওর করতে পারে নি আমাদের। তারপরে যখন বুঝলো, বিদিশা আর আমি পরষ্পর দুজনকে জড়িয়ে ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে, ও খিল খিল করে হেসে উঠলো। আমাদেরকে বললো, ধরা পড়ে গেছো তো? ভয় নেই ভয় নেই, আমি নিচে গিয়ে কাউকে কিছু বলছি না। নাও আরো কিছুক্ষণ সময় এখানে থাকো, তারপরে নিচে চলে এসো।
বিদিশা আমাকে বললো, ‘ধ্যাত, তুমি আমাকে বলবে তো? মাধুরী চলে এসেছে, আমি খেয়াল করিনি।
আমি হেসে বললাম, ‘তো কি হল? শুভেন্দু এলে না হয় একটা কথা ছিল। মাধুরী নিচে গিয়ে কিছু বলবে না। আমার ওর ওপরে ভরসা আছে।’
বিদিশা বললো, ‘চলো, চলো, নিচে যাই। নইলে ওরা আবার-’
‘এই তো এতদিন বাদে তোমাকে এত কাছে পেলাম, এখনি চলে যাবো? দাঁড়াও না একটু।’
বিদিশার হাত ধরে টানতে লাগলাম, ওকে আবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম। বিদিশা বললো, ‘এবারে কিন্তু শুভেন্দু ওপরে উঠে আসবে। তোমার আর আমার দফা রফা করবে এসে।’
বিদিশাকে বললাম, ‘কিছু করবে না। তাহলে প্যাঁদানি খাবে আমার কাছে। তুমি শান্ত হও তো।’
আবার কয়েক মূহূর্তের জন্য প্রজাপতিটা কাছে পেয়েছি। বিদিশা বললো, ‘তুমি এরকম ভালোবাসা আগে কখনো বাসো নি। বেসেছো কি?’
বিদিশাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘না বাসিনি তো। সত্যি কথাই বলছি। আসলে তখন আমার বয়সটা কম ছিলো।’
বিদিশা বললো, ‘বয়স কম থাকলে বুঝি ভালোবাসতে নেই?’
বিদিশাকে বললাম, ‘এই বয়সেই তো মানুষ মরীয়া হয়ে কাউকে ভালোবাসতে পারে। দেখছো না কেমন মরীয়া হয়ে উঠেছি এখন তোমার জন্য।’
বিদিশার ঠোঁটে একটা চুমু খেতে যাচ্ছিলাম। ঠোঁটের ওপরে হাত রেখে মুখ চাপা দিয়ে বললো, এই কেউ দেখে ফেলবে।
-কে দেখবে এখন? মাধুরী তো চলে গেছে।
-না, তাও পরের বাড়ীতে লজ্জ্বা করে না বুঝি?
বিদিশাকে বললাম, ‘তোমাকে আর আমাকে নিরিবিলিতে ছাদে কেন শুভেন্দু পাঠিয়েছে, জানো না? যাতে চুমুটা ভালো করে খেতে পারি। পরের বাড়ীতে যখন এ সুযোগ কেউ করে দেয়ে, তখন তাকে সদব্যবহার করে নিতে হয়।’
বিদিশা বুঝতেই পারছিল, আমি এবার সজোরে ওকে চুমুটা খাবো। আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড় লাগালো, ছাদের অন্যদিকে। আমিও ওর পেছন পেছন দৌড়োতে লাগলাম। বেশ লম্বা বড় ছাদ। কিছুটা দৌড়োনোর পর, বিদিশা হাঁপিয়ে গেল। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। আমি সামনে যেতেই বললো, এই আমাকে কিন্ত জোর করে চুমু খেলে, আমি নিচে ছুট্টে চলে যাবো। শুভেন্দু আর রনি এখন নিচে রয়েছে, ওরা তখন দুজনে মিলে জব্দ করবে তোমাকে।’ বলেই হাসতে লাগলো।
কি জ্বালা! পরের বাড়ী আর নিজের বাড়ীর এই হোল তফাৎ। এতদিন বাদে যাও বা চুমুর সুযোগটা এলো। তাও সেটাকে গ্রহন করতে পারবো না? আমি একেবারেই আপসেট। মুখটা ঘুরিয়ে চলে গেলাম ছাদের একপাশটায়। চুমু খাওয়ার সুযোগ যখন হয় নি অগত্যা আকাশের চাঁদ আর তারা দেখতে লাগলাম। সামনে একটা বড় নারকেল গাছ হাওয়াতে দুলছে। মনে হল আমার শরীরেও কেমন একটা দুলুনি লাগছে, কারণ পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বিদিশা। পেছন থেকে আমার কোমরটা দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে। আর আমার পিঠে একটার পর একটা চুমু খেয়ে যাচ্ছে।
আমি বিদিশার দিকে মুখ ঘোরালাম। বিদিশা এবার একটা চুমু খেলো আমার গালে। তারপর আলতো করে চুম্বনের স্পর্ষ দিলো ঠোঁটে। শিশুরা যখন চুম্বন করে তখন তাদের নিঃশ্বাস আলতো ভাবে গায়ে এসে লাগে। তেমনি ভাবে বিদিশার নিঃশ্বাসটাও আমার গায়ে এসে লাগছিলো। ঠোঁটটা বাড়িয়ে ওর ঠোঁটটাকে এবার আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলাম। নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে এবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বিদিশা।
চুমুর পর চুমু দিয়ে বিদিশাকে আমি চুম্বনস্নাত করে দিচ্ছি। হঠাৎই আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিদিশা বললো, ‘ওই মাধুরী এসেছে আবার।’
আমি পেছন ঘুরে তাকালাম, বিদিশাকে বললাম, কোথায় মাধুরী? কই কেউ নেই তো।
দেখি বিদিশা হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। আমাকে বললো, ‘খেলে তো চুমু। চলো এবার নিচে যাই।’
বিদিশা আর আমি নিচে যাবার পর শুভেন্দু বললো, ‘এই তোরা দুজনে এতক্ষণ ধরে কি করছিলিস রে? সেই যে উপরে উঠেছিস নিচে আসার নামই নেই।
দেখি মাধুরী সামনে দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসছে। শুভেন্দু ওর হাসিটা দেখামাত্রই বুঝে গেলো। বললো, ‘ও বুঝেছি বুঝেছি। তোরা তোদের কাজটা করে এসেছিস। আমারই ভুলটা হয়ে গেল। কেন যে চুপি চুপি ছাদে গিয়ে একবার দেখে এলাম না।’
মাধুরী হাসছিল। শুভেন্দুকে বললো, ‘ছোড়দা, তুই না সত্যি, এতো ফাজলামী মারিস না। ‘
শুভেন্দুও তখন হাসছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ঠিক হ্যায় তো বস। তাহলে আমাকেও একটা থ্যাঙ্কু দাও। দেখো, এইজন্যই তোমাকে বলেছিলাম আসতে। সারপ্রাইজ মানে বিদিশার সারপ্রাইজ। তোমার জীবনে বিদিশার থেকে বড় সারপ্রাইজ কি আর কিছু আছে? আই অ্যাম অলওয়েজ উইথ ইউ মাই ফ্রেন্ড। তোমার সুখে দূঃখে সবসময়ই তোমার পাশে ছিলাম। আর ভবিষ্যতেও থাকবো, এটা জেনে রেখো।’
মাধুরী বিদিশাকে নিয়ে একটু অন্যঘরে চলে গেলো। শুভেন্দু বললো, ‘আমার দাদার বৌদের সাথে বিদিশার আলাপ করাবে। মোটামুটি পনেরা কুড়ি মিনিট ধরে নে। বৌদিরা এমনিতেই খুব কথা বলে। তিন তিনটে বউ, সময় তো একটু লাগবে। ও আসার আগে চট করে দুপেগ মেরে নে। সিগনেচার হূইস্কি এনেছে রনি। গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে তারপরে গান শুরু হবে।’
আমি বললাম, করেছিস কি? গানও গাইবো, আবার মদও খাবো?
শুভেন্দু বললো, ‘দূর ব্যাটা আজকেই তো খাবি। আজকে তোর জীবনের স্পেশাল দিন না? বছরে কদিন মাল খাস? হাতে গুনে বলে দিতে পারবো, তুই কদিন খাস। আজ একটু সেলিব্রেট করো বৎস। বুঝতে পারছো না? তোমার জন্য আমাদেরও আজ কত আনন্দের দিন।’
রনি আমার দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে বললো, নে চুমুক দে। কাম অন, চীয়ার্স।
আমি ঢোঁক ঢোঁক করে গ্লাসের অর্ধেক জল মেশানো হূইস্কিটা খেয়ে নিলাম। গলায় একটা আলতো ঝাঁঝ লাগলো। মুখ দিয়ে আওয়াজ করলাম আ-
সঙ্গে সঙ্গে রনি আর শুভেন্দুও গ্লাসে চুমুক দিয়ে মুখ দিয়ে একসাথে আওয়াজ করলো আ- দুজনেই বললো, কি শান্তি আজকে। তাই না? শান্তি শান্তি। আজ যেন অনেক শান্তি।
আমিও বললাম, হ্যা, ভীষন শান্তি।
রনি বললো, ‘দেব’ বাড়ীতে মাসীমাকে একটা ফোন করে বলে দে, তোর কিন্তু ফিরতে ফিরতে আজ দেরী হবে।’
শুভেন্দুও সায় দিলো, আমাকে বললো, ‘হ্যাঁ, শুধু শুধু মাসীমার চিন্তা বাড়িয়ে লাভ নেই। একেবারে রাতের ডিনার সেরেই এখান থেকে বেরোবি। তোর আর বিদিশার জন্য মাধুরী অনেক পদ রান্না করেছে। তোদেরকে ও না খাইয়ে ছাড়বে না আজকে।’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এখন বাজে আটটা। তারমানে গান বাজনা, গল্পগুজব আর খাওয়া দাওয়া সেরে এখান থেকে বেরোতে বেরোতে মোটামুটি রাত এগারোটা হবে। বিদিশাকে যদি ট্যাক্সী করে ওকে ওর বাড়ীতে ড্রপ করে দিই, তাহলে বাড়ী পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত বারোটাতো হবেই। মাকে একটা ফোন করা অবশ্যই দরকার। নইলে মা আবার চিন্তা করবে আমাকে নিয়ে।
ফোনটা করা মাত্রই মা বললো, শুভেন্দুদের বাড়ীতে কি অনুষ্ঠান আছে আজকে? এত দেরী করে ফিরবি, কাল না আবার অফিস আছে তোর?
বিদিশার কথাটা মাকে বলতেই যাচ্ছিলাম, শুভেন্দু ইশারা করলো, বললো, ‘থাক থাক, এখন মাসীমাকে কিছু বলিস না। ওটা পরে হবে। বিদিশাই নিজে থেকেই তোর বাড়ীতে যাবে।’
‘বিদিশা’ নামটা মুখ থেকে বেরোতে গিয়েও শুভেন্দুর জন্য আটকে গেলো শেষ পর্যন্ত। ফোনটা ছেড়ে দিয়ে ওকে বললাম, ‘মা কিন্তু বিদিশার ব্যাপারটা জানে। সকালে শুক্লা যখন এসেছিল, বিদিশার কথা বলছিলো, মা আড়াল থেকে সবই শুনেছে। তবে এখানে যে বিদিশা আসছে, সেটা মা জানে না।’
রনি, শুভেন্দুকে বললো, ‘শুক্লার ব্যাপারটা কি বলতো শুভেন্দু? হঠাৎ এতদিন বাদে ও দেবের বাড়ীতে? ওর যাবার কারণটাই বা কী? আর তোকে যে একটু আগে ফোনে এতোকথা বললো, তাতে তো মনে হচ্ছে কিছু একটা গোলমেলে ব্যাপার আছে নিশ্চই। বিদিশার প্রতি শুক্লার এত বিদ্বেশ, এর কারণটা কি?
শুভেন্দু খুব চালাক। রনিকে বললো, ‘শোন, সবকথা তো আর মেয়েরা কখনো খুলে বলে না। ওটা বুঝে নিতে হয়, আমি বিদিশার সামনে এসব কথা আলোচনা করতে চাই না। তবে বিদিশার প্রতি শুক্লার বিদ্বেশটা শুনে মনে হলো, কিছুটা একটা ব্যাপার কাজ করছে শুক্লার মনেক ভেতরে ভেতরে। হয় দেবের প্রতি ওর কোনো দূর্বলতা তৈরী হয়েছে এতদিন পরে, নয়তো দেবকে ও বিশেষ কোনো কাজে লাগাতে চাইছে, যেটা শুক্লা খুলে বলছে না।’
রনি চোঁ চোঁ করে কিছুটা পেগ মেরে নিয়ে বললো, ‘এই শুক্লাটা বরাবরই অদ্ভূত। কলেজে পড়তে পড়তে সৌগতর সাথে প্রেম করলো, বিনা কারনে সৌগতকে বাতিলও করে দিলো, তারপরে যাকে বিয়ে করে বসলো তার সাথেও ঘর করতে পারলো না। এতদিন বাদে দেবের প্রতি তার প্রেম জেগেছে, বিদিশাকে ছেড়ে দিয়ে দেবও তার সাথে প্রেম শুরু করবে, এও কি সম্ভব নাকি? দরদ যেন উতলে পড়ছে। কেন রে? বিদিশা ফিরে এসেছে বলে? ভালোবাসার কথা এতদিন তাহলে বলিস নি কেন?’
আমি শুনে বললাম, ‘দরদ? দরদ মানে কিসের দরদ? শুক্লা আমার প্রতি দরদ দেখাবেই বা কেন?’
শুভেন্দু বললো, ‘কি জানি? ফোনে তো আমাকে বললো, ‘শোন, তোরা অত বিদিশা বিদিশা করে লাফাস না। বিদিশার দোষগুলো তো দেবতো কোনোদিন দেখবে না। তাই ওকে সেভাবে বলতেও পারি না। তবে তোকে আমি বলছি, এতদিন বাদে বিদিশা যে আবার ফিরে এলো, কি ভালোবাসার মর্যাদা দিয়েছে ও দেবের জন্য?’ একবারও দেবকে ফোন করেছে ও? ছেলেটাকে ছেড়ে যখন বিদিশা চলে গেলো, তখন তো ভালোবাসার কথা একবারও মনে পড়েনি তার। আজ যখন নিজের স্বামীর সাথে বিদিশার আবার বিচ্ছেদ। ঠিক তখনই সুর সুর করে ফিরে এসেছে আবার ওই ভালোমানুষটাকে পাবে বলে। ‘
শুভেন্দু দেখলাম শুক্লার ওপর খুব চটে। একটু বিরক্ত হয়েই আমাকে বললো, তুই বল দেব, এসব কথার কি কোনো মানে হয়? বিয়ে তো তুইও করেছিলি। তোর বরের সাথে, তুই অ্যাডযাস্ট করতে পারিস নি। তাহলে বিদিশাকেই বা শুধু শুধু দোষ দিচ্ছিস কেন? তোর যেমন হয়েছে বিদিশারও তেমনই হয়েছে। এই অবস্থায় দেবের কাছে ফিরে না এসে বিদিশা তাহলে কার কাছে যেতো? ও তো ভালোই করেছে।
রনি বললো, ঠিক ঠিক, এই হল, একদম পারফেক্ট কথা। শুভেন্দু যা বলেছে, এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। আমাকে রনি বললো, শোন দেব, শুক্লাকে অত পাত্তা দেবার দরকার নেই। ও যদি ফোন করে তোকে, বলবি কোনো কথা নেই তোর সাথে। বিদিশার ব্যাপারে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না।’
ঢক ঢক করে একটা সীপ মেরে নিয়ে বললো, আহা রে, কচি খুকী যেনো, এতদিন বাদে দেবের জন্য ভীমরতি জেগেছে।
আমি চুপ করে ওদের কথা শুনিছিলাম। শুভেন্দু রনিকে বললো, এই চুপ চুপ, বিদিশা এসে গেলে সব শুনতে পারবে।
রনি চুপ করে গেলো। শুভেন্দু বললো, তোরা ভাবিস, আমি তো জীবনে কোনোদিন প্রেম করিনি। একবার আমিও একজনের প্রেমে পড়তে যাচ্ছিলাম।
শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে বললাম, তুই? প্রেম? যা বাজে বকিস না।
শুভেন্দু বললো, হ্যাঁ রে আমি সত্যি বলছি। সেকী দৃষ্টি, সেকী চাউনি। নারীর দৃষ্টি মানে মোহিনী শক্তি। পুরুষমানুষের মনের শান্তিকে কিভাবে না ওরা নষ্ট করে দেয়। মনে হয়, তা যেন কত গভীর, কত আস্বাদে ভরা। কি অসীম তার আহ্বান। কেউ কেউ বলে এভাবে তাকিয়ে থেকে নাকি প্রেমিক যুগল পরষ্পরের হৃদয় পড়ে নেয়। এটা অবশ্য আত্মম্ভরিতার কথা। মানুষ যদি সত্যিই অপরের মনের কথা পড়তে পারতো, তাহলে সে কী প্রচন্ড জ্ঞানীই না হত। চোখ দেখেই বুঝে যেতো তার মধ্যে প্রেম আছে না নেই।
আমি বললাম, এটা তো সত্যি কথাই। তুই মেয়েটার দিকে তাকালেই তো বুঝতে পারতিস, ওর মধ্যে প্রেম আছে না নেই।
শুভেন্দু বললো, তাকিয়েছিলাম তো। রোজই আমি ওর দিকে তাকাতাম। ও যেমন তাকিয়ে থাকতো, আমিও তেমন তাকিয়ে থাকতাম।
আমি বললাম, তারপর?
শুভেন্দু বললো, তারপর আর কি? একদিন আমাকে ও বলে বসলো, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।
আমি বললাম, তুই কি বললি তার জবাবে?
শুভেন্দু বললো, আমি বললাম, আমি তো বাসি না।
রনি তাকিয়ে আছে শুভেন্দুর মুখের দিকে। আমিও তাকিয়ে আছি। শুভেন্দুকে বললাম, সেকীরে? তুই এইকথা বললি শেষপর্যন্ত? ওর দিকে এতো তাকিয়েও তোর ওর প্রতি প্রেম জাগলো না? তাহলে আর কি প্রেম ভালোবাসা হলো?
শুভেন্দু বললো, শোন, মুখে ভালোবাসি, এই কথাটা বলতেই যার সাতদিন লেগে যায়, সে আবার কি ভালোবাসবে আমাকে? সাতদিন ধরে তাকিয়েই তাকিয়েই শুধু সময় নষ্ট। ও আবার কি ভালোবাসবে আমাকে?
আমার শুভেন্দুর কথা শুনে হাসতে হাসতে প্রায় পেট ফেটে যাবার মত অবস্থা। ওকে বললাম, কে মেয়েটা? আগে তো এ গল্পটা কোনদিন শুনিনি।
রনি বললো, তুই ওর কথা বিশ্বাস করছিস? বানানো গল্প বলতে শুভেন্দু খুব ভালো পারে। একটার পর একটা বলে যাবে, সত্যি না মিথ্যে তুই ধরতেই পারবি না।
আমি বললাম অনেক ক্ষেত্রে পরষ্পরকে বুঝে নিতে একটু সময় লেগে যায়, মেয়েটা তোকে হয়তো একটু পরখ করে দেখে নিচ্ছিলো। ওই জন্যই হয়তো সময়টা নিয়েছে।
শুভেন্দু বললো, ঠিক বলেছিস, আসলে ও দেখে নিচ্ছিলো আমার মালকড়ি সেরকম আছে কিনা? মেয়েরা যদি দেখে পকেট ভারী, তাহলেই তোকে বলবে আমি তোমার ভালোবাসার নারী। নইলে যাও আড়ি। শালা অমন ভালোবাসার পেছন মারী।
আমি বললাম, এই যাঃ কি হচ্ছে টা কি? ব্যাচারা রনিও তো প্রেম ভালোবাসা করেছে মাধুরীর সঙ্গে। মাধুরী কি তাহলে রনিদের টাকা দেখে ওকে বিয়ে করেছে? সবার ক্ষেত্রে এমনটা হয় না।
শুভেন্দু হেসে বললো, রনি আর মাধুরীর ভালোবাসার একটা কাহিনী শুনবি? তাহলে তোর আরো পেট ফাটবে হাসতে হাসতে।
রনি দেখি, চুপ করে রয়েছে, আর মুচকী মুচকী হাসছে। বুঝতে পারছে শুভেন্দু এবার কি বোমা ফাটাবে।
শুভেন্দু বললো, আমাদের বাড়ীর পেছনটায় কিছুটা এগিয়ে গেলে তুই একটা বাগান দেখতে পাবি। বাগানটা এখন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হয়েছে। আগে ওটা খোলা বাগান ছিলো। রনি যখন প্রথম প্রথম আমাদের বাড়ী আসা শুরু করলো, তখন ও ছুঁড়ি কে নিয়ে ওই বাগানটায় ঘুরতে যেতো। চারিদিকে সুন্দর সুন্দর নারকেল গাছ আর সুপারি গাছে ভর্তি। প্রেমিক প্রেমিকারা যেমন গাছের তলায় ছায়াতে বসে সুন্দর সুন্দর প্রেমের কথা আর মনের কথা বলে, ও আর ছুঁড়ি দুজনে মিলে বসে সেই কথাগুলোই বলতো।
আমি বললাম তো? ভালোই তো। বাড়ীর কাছেই বাগান, আর সেই বাগানে প্রেম। মন্দ কি?
শুভেন্দু বললো, আরে বাবা সে তো বুঝলাম। কিন্তু আসল কথাটা তো তুই শুনলি না।
আমি বললাম, কি আসল কথা?
শুভেন্দু বললো, দুজনে কথা বলবে কি? প্রেমের কথা শুরু করতেই তো একহপ্তা পার। যে জায়গাটা ওরা বসতো, দুজনে শুধু গোল গোল করে ঘাস ছিঁড়ে যেতো। এক হপ্তা পেরিয়ে গেলো। বেশ খানিকটা ঘাস ছিঁড়ে, জায়গাটা ন্যাড়া মতন হয়ে গেলো। এদের প্রেমের কথা আর বলা হল না।
রনি গ্লাসে চুমুক দিয়েছে সবে। এমন ভাবে শুভেন্দু কথাটা বলেছে, হাসিতে ভীষম খেয়ে রনির তখন যাচ্ছেতাই অবস্থা।
হাসি আমিও চেপে রাখতে পারছিলাম না। শুভেন্দু বললো, এটা কিন্তু গুল নয়। একেবারে সত্যি কথা।
বলতে বলতেই মাধুরী ঘরে এসে ঢুকলো বিদিশাকে সঙ্গে নিয়ে। রনির দিকে তাকিয়ে মাধুরী বললো, ও শুরু করে দিয়েছো বুঝি? সত্যি তোমাকে আর ছোড়দাকে কোথায় বাঁধিয়ে রাখবো বলো তো দেখি?
শুভেন্দু বললো, এই ছুঁড়ী, তুই আমাদের গার্জেন না কি রে? আজ শুধু আনন্দ আর ফুর্তী করবো, তবেই না জমবে। দেবকে আমরা কতদিন বাদে পেলাম বল তো?
বিদিশা ঘরে ঢুকে আমার সামনেই বসলো। মাধুরী আমার দিকে তাকিয়ে, চেঁচিয়ে বললো, ও তুমিও শুরু করে দিয়েছো? খাচ্ছো বসে এদের সঙ্গে?
আমি না বলার মত ঘাড় নাড়ছিলাম। মাধুরী বললো, ওই তো খালি গেলাস টা। তোমার পাশেই দেখলাম। বিদিশা তোমার কাছে যাওয়া মাত্রই তুমি ওটাকে সোফার তলায় ঢুকিয়ে দিলে। বিদিশার সামনে বুঝি মদ খাবে না?
বিদিশা তখন তখন সামনে বসে আমাদের তিনজনকেই দেখছে। শুভেন্দু বললো, ব্যাটাছেলেরা চা খাবে না, সিগারেট খাবে না, মদ খাবে না। তো কি খাবে বল দেখি। আমাদের বুঝি সখ আহ্লাদ কিছু নেই?
রনি মাধুরীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো, এই যে সহধর্মিনী আমার। তুমি এখন চুপ করো। দেব এখন গান শুরু করবে।
শুভেন্দু সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে বললো, এই দাঁড়া দাঁড়া। দেবের কিন্তু একটা স্বভাব আছে, সবাই জানিস তো?
রনি সঙ্গে সঙ্গে বললো কি?
শুভেন্দু বললো, ওকে কলেজে তো আমি দেখেছি, শেষের দিকে বিদিশার যে গানগুলো পছন্দ, সেইগুলোই বেশী বেশী করে গাইতো। ব্যাটা এমন ঢ্যামনা। আজ কিন্তু ওসব চলবে না। আমাদের পছন্দের গান তোকে গাইতে হবে।
আমি বললাম, কি গাইবো বল?
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
শুভেন্দু বললো, তুই ওটা দিয়ে শুরু কর। ‘এ রাতে এ মৌসম, নদীকা কিনারা এ চঞ্চল হাওয়া।’
আমি বললাম, এই গানটা কিন্তু বিদিশারও খুব পছন্দ।
সঙ্গে সঙ্গে শুভেন্দু বললো, না, না, তাহলে বরঞ্চ তুই ওটা গা, এ মেরী জোহরা জেবীন, তুছে মালুম নেহী, তু অভীতক হ্যায় হাসীন, অউর ম্যায় জওয়ান, তুঝপে কুরবান মেরী জান মেরী জান।
মাধুরী বললো, ছোড়দা তুই না? কবেকার সেই সেকেলে মার্কা গান, ভালো ভালো কত গান আছে তা না।
রনি মাধুরীকে বললো, তুমি জানো না ডারলিং, দেবের কাছে যা স্টক আছে, গুনে গুনে শেষ করতে পারবে না। নতুন পুরোনো, ক্ল্যাসিকাল, লাভ সঙ সব ও গলায় নিয়ে বসে আছে। খালি একবার করে বিদিশার দিকে তাকাবে, আর মেহেফিল ভরিয়ে দেবে।
বিদিশা চুপ করে বসেছিলো, আমি বললাম, আমি আজ কারুর পছন্দের গান গাইবো না। যে কটা গান গাইবো, তোদের সবারই ভালো লাগবে।
শুভেন্দু বললো, সেই ভালো সেই ভালো। তুই গা।
মাধুরীকে রনি বললো, তুমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন? তুমিও বসো।
বিদিশা যেখানটা বসেছিল, মাধুরী ঠিক তার পাশে গিয়েই বসলো। আমি স্কেল চেঞ্জিং হারমোনিয়ামটা হাতে নিয়ে আঙুলে সুর বেঁধে কিছুক্ষণ হূ হূ করলাম। তারপর গাইতে শুরু করলাম, কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই। কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই। নিখিলেশ প্যারিসে, মঈদুল ঢাকাতে, নেই তারা আজ কোন খবরে। গ্র্যাণ্ডের গীটারিস্ট গোয়ানীস ডিসুজা, ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে। কাকে যেন ভালোবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে, পাগলা গারদে আছে রমা রায়, অমলটা ধুঁকছে দুরন্ত ক্যানসারে। জীবন করে নি তাকে ক্ষমা হায়।……………………. কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই।
গান গাইতে গাইতে আমি সবার দিকেই তাকাচ্ছিলাম একবার করে। দেখলাম ওরা সব আমার গান শুনছে, আর সেই পুরোনো স্মৃতিতে ফিরে যাচ্ছে। মনে পড়ছে কলেজ, কফিহাউস, সেই সোনালী দিনগুলো, যেগুলো কবেই আমরা সবাই হারিয়ে এসেছি।
রনি বললো, তুই তো আজ কাঁদিয়ে ছাড়বি রে।
আমি দ্বিতীয় গানটা ধরলাম, এতো রাগ নয়, এ যে অভিমান, এ শুধু তোমায় চাওয়ার, আরো বেশী কাছে পাওয়ার, ছল ভরা গান, এ যে অভিমান।
দেখলাম বিদিশার চোখটা এবার ছল ছল করছে। হঠাৎ রুমাল দিয়ে চোখটা বারে বারে মুছতে লাগলো। শুভেন্দু বললো, এই বিদিশা তুই কাঁদছিস নাকি?
আমি তৃতীয় গানটা শুরু করলাম, জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই। পাছে ভালোবেসে ফেলো তাই। দূরে দূরে রই।
বিদিশা গানটা দু লাইন গাওয়া মাত্রই উঠে ছুট্টে দূরে কয়েক হাত চলে গেল। দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমি গান থামিয়ে দিয়েছি, শুভেন্দু আর রনি দুজনেই অবাক। মাধুরী কাছে গিয়ে বিদিশাকে জড়িয়ে ধরলো, কি হয়েছে বিদিশা তুমি কাঁদছো কেন?
কোনোরকমে রুমালটা দিয়ে চোখ মুছে বিদিশা বললো, খুব ভুল হয়ে গেছে। দেবের মত নিষ্পাপ ভালো ছেলেকে আমি এভাবে ঠকাতে পারবো না। আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে।
আমি গান থামিয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে আছি বিদিশার দিকে। মনে একটা প্রশ্ন। হঠাৎ বিদিশা একথা বললো কেন?
কাল শুভেন্দু আমাকে শুক্লার ব্যাপারে অনেক কথাই বলেছে। রনি তো বলেই দিয়েছে, ওর ফোন এলে ফোনও ধরবি না তুই। সবাই এখন শুক্লাকে খারাপ চোখে দেখছে। ব্যাচারা শুক্লা। বিদিশার প্রতি কঠোর মনোভাব দেখিয়ে সবার চোখে ঘৃনার পাত্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুক্লারই বা আমার প্রতি এত আগ্রহ দেখানোর কারণটা কি? বিদিশাকে ও সহ্য করতে পারছে না। বারে বারে আমাকে ও ফোন কল করছে, বাড়ীতে যাবার জন্য বলছে। কই এতদিন তো শুক্লার একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?
মনে হল এই মূহূর্তে আমার মনে শক্তি জোগানোর বা মনকে শান্তনা দেবার জন্য এমন কাউকে দরকার। শুক্লা সেই ভূমিকাটা কিছুতেই পালন করতে পারবে না। বরঞ্চ ও যদি বিদিশার ব্যাপারে হতাশাজনক আমাকে কিছু বলে দেয়, তাহলে আমি আরো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ব।
ফোনটা ধরলাম না। সুইচটা অফ না করে সাইলেন্ট মোড করে দিলাম। একটার পর একটা ফোন করে যাচ্ছে শুক্লা। ওর ধৈর্য দেখে, আমিও রীতিমতন অবাক হয়ে যাচ্ছি। ভাবছি, হয় মেয়েটা আমার ভালো চাইছে, সত্যিকারের বন্ধু হয়ে এক বন্ধুর উপকার করতে চাইছে, নয়তো সে নিজের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখছে, আমার স্বার্থটাকে নয়।
‘প্লীজ শুক্লা লিভ মি অ্যালোন। আমাকে একটু একা থাকতে দে। কেন তুই ফোন করে আমাকে বিরক্ত করছিস?’
বাড়ী থেকে বেরুবার সময়ও দেখেছি, শুক্লা আমাকে অনেকগুলো কল করেছিল। আবার এখনও করে যাচ্ছে কনটেনিউসালি। যেন আমাকে ক্ষিপ্ত না করে ও এবারে ছাড়বে না।
অনেক বিরক্ত হয়েই শেষমেষে ওর ফোনটা ধরলাম। ঠিক করে নিলাম, বিদিশার ব্যাপারে শুক্লা যদি কিছু উচ্চবাচ্য করে প্রথমেই ওকে না করে দেবো, কথাই বলব না হয়তো। ফোনের লাইনটাও কেটে দেবো। ঠিক এই মূহূর্তে আমার মনোভাবটা এমনই কঠোর হওয়া দরকার। নিজেকে দূর্বল করলে চলবে না। বিদিশার প্রতি দুদিন অন্তত আমাকে বিশ্বাস রাখতেই হবে।
ফোন ধরলাম, হ্যালোও বললাম। কিন্তু ভেতর থেকে সেই উদ্দীপনাটা এল না। শুক্লা আমাকে অবাক করে প্রথমেই বলল, ‘দেব, আমি কিন্তু মিনু নই। তুই কিন্তু আমাকে শুধু শুধু ভুল বুঝছিস। এতবার করে তোকে ফোন করছি, ফোনটা অন্তত ধরবি তো? না শুক্লা বলে, তোর কেউ কোনদিন ছিল না। কলেজে শুভেন্দু, রনি সবাই তোর বন্ধু। আমি তোর কেউ নই।’
আমি কোন কথা বলছি না। শুক্লা বলল, ‘কি হল জবাব দে। কথা বলছিস না কেন?’
মনে হল, শুক্লা বোধহয় বিদিশার ব্যাপারে এবার কিছু বলবে। হয়তো কাল শুভেন্দুর বাড়ীতে কি হল, সেটাই জিজ্ঞেস করবে। জানতে চাইবে বিদিশা ওখানে এসেছিল কিনা? আমার সাথে বিদিশার কথা হল কিনা? বিদিশার জন্য আমি যে এখনও কাতর। এই ছটফটে মনটা নিয়ে কোথায় যাই? আমার ভালবাসার গভীরতা বোঝার মত ক্ষমতা যদি শুক্লার থাকতো-
ও বলল, ‘শোন, তোকে আমি এখন কিছুই বলব না। তুই শুধু আমার অনুরোধটা রাখবি। কাল যখন আসতে পারিস নি। আজ অবশ্যই আমার ফ্ল্যাটে আসবি। তুই না এলে আমি কিন্তু ভীষন দূঃখ পাবো। যতদূর জানি, দেব কাউকে না বলে না। কাউকে ফেরায় না। অন্তত আমার এই অনুরোধটা তুই ফেলিস না। দেব প্লীজ। তোর পায়ে ধরে তোকে রিকোয়েস্ট করছি।’
আমি বললাম,‘আরে না, না। তুই এতকরে আমাকে রিকোয়েস্ট করছিস কেন বলতো? আমি কি তোকে না বলেছি? কাল তো শুভেন্দুদের বাড়ীতে গিয়েছিলাম বলেই তোর ওখানে যেতে পারিনি। তাই বলে কি আর যাব না কোনদিন? নিশ্চই যাবো।’
শুক্লা বলল, ভাবছিস আমি তোকে বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলব। তাই না?
আমি বললাম, ‘না, না। তা কেন হবে? তুই তো কালকেই-
-’হ্যাঁ। যা বলেছি। ওটার আর পুনরাবৃত্তি আমি করব না। তোকে আমি কথা দিলাম। বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলে, তোর মনকে আমি বিষিয়ে দিতে চাই না। শুক্লা দেবের খুব ভাল বন্ধু হয়েই থাকতে চায়। ব্যাস। আর কিছু নয়। হ্যাপি? বল এবারে আসবি তো?
আমার যেন মনে হল, শুক্লা যেন আমার মনটাকে খুব ভালো করে পড়ে নিয়েছে। বিদিশার ব্যাপারে কিছু বললে, আমি যে ওর বাড়ীতে যেতে আর আগ্রহ দেখাবো না। সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছে। শুক্লা ভাল করেই জানে, এতদিন বাদে বিদিশার পুনরাগমন, আমার কাছে একটা অক্সিজেনের মতন। ওর এই ফিরে আসার মধ্যে যতই রহস্য থাক। যতই বিদিশা আমার কাছে একটু সময় চেয়ে নিক, যতই আমার মনের মধ্যে কষ্টটা বয়ে যাক, একটা আশা নিয়ে দুদিন তো আমাকে ধৈর্য রাখতেই হবে। এই সামান্য বোধটুকু যদি আমার মধ্যে না থাকে, তাহলে বিদিশাই বা কি মুখ নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে? শুভেন্দুকেই বা কি বলব? রনিকেই বা কি বলব তখন? আমি নিজে থেকেই বিদিশার ফিরে আসাটার দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছি। ওকে চির দিনের জন্য বিদায় জানিয়ে দিয়েছি।
একবার মায়ের কথাটা সে সময় খুব মনে হল। মা আমার জন্য খুব ভাবে, কষ্ট পায়। বিদিশাকে অর্জন করে মায়ের মুখেও এবার হাসি ফোটানোটা দরকার।
শুক্লাকে বললাম, ‘যাবো তোর বাড়ী। কবে যেতে হবে বল? অফিস ফেরত একদিন চলে যাব তোর ফ্ল্যাটে।’
শুক্লা বলল, ‘না তুই আজকেই আসবি। আমি আজকেই তোকে আমার এখানে দেখতে চাই।’
ওকে বললাম, ‘আজকেই যাব? তাহলে তো অফিস ফেরত তোর ওখানে যেতে হয়।’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ। তোর বাড়ী থেকে তো আর বেশী দূরে নয়। সল্টলেকে আসতে আর কতক্ষণ লাগবে। একটা ট্যাক্সি নিবি। আর ঝটপট চলে আসবি।’
আমি বললাম, ‘খাওয়া দাওয়ার আবার অ্যারেঞ্জ করবি না তো? মাকে কিন্তু কিছু বলে আসিনি। কাল এমনিতেই শুভেন্দুদের বাড়ীতে অনেক খেয়েছি। আজ তোর ওখানে খেলে, মা বহূত চটে যাবে।’
শুক্লা বলল, ‘দেব, তোর আপত্তি থাকলে আমি তোকে জোর করব না। কিন্তু তুই কিন্তু অবশ্যই আসবি। আমাকে আবার ফোন করতে বাধ্য করিস না।’
যেন নাছোড়বান্দা এক মেয়ে। কিছুতেই আমাকে না নিয়ে গিয়ে ছাড়বে না। আমিও শেষ পর্ষন্ত শুক্লাকে কথা না দিয়ে থাকতে পারলাম না।
অফিস থেকে বেরিয়ে শুক্লার বাড়ীর দিকে যখন আসছিলাম। ট্যাক্সিতে এফ এম এ খুব সুন্দর একটা কিশোর কুমারের গান হচ্ছিল। গানটা আমারও খুব ফেভারিট।
হে প্রিয়তমা, আমি তো তোমায়, বিদায় কখনো দেবো না।
শুনে মনে হল, সত্যি তাই। বিদিশাকে আমি নিজে থেকে কখনও বিদায় দিতে পারি না, এক সে যদি নিজে থেকে না চায়। আমার মনের মধ্যে আশাটা কিছুটা হলেও এখনো যেন বেঁচে আছে। বিদিশাকে আমি চাই। শেষ পর্যন্ত যে করেই হোক বিদিশাকে আমি ফিরে পেতে চাই।
ঠিক তার পরে পরেই কিশোর কুমারের আর একটা গান শুরু হল, গানটা হল, ‘আজ থেকে আর ভালোবাসার নাম নেবো না আমি। যারে দিয়েছিলাম, যা কিছু তা আমার চেয়েও দামী। নাম নেবো না আমি।’
এবার আমার মনটা কেমন বিষন্ন হয়ে গেল। ট্যাক্সিওয়ালা বলল, ‘দাদা এই যে লোকটার গান শুনছেন না? ইনি তো অমর শিল্পী কিশোর কুমার। কিন্তু লোকে বলে ইনি নাকি মরে যাবার আগের দিন পর্যন্ত প্রেমিক ছিলেন। চার চারটে বিয়ে করেছেন, ভালোবাসা ওনার কাছে অফুরন্ত ছিল।
আমি বললাম, কিশোর কুমার সন্মন্ধে আমি যা জানি, তা আর কেউ জানে না। একসময় কিশোরের গান গেয়েও অনেকের প্রশংসা কুড়িযেছি। লোকটার জীবনে প্রেম অনেক ছিল তাও জানি। কিন্তু লোকটার জীবনে একটা ব্যাথাও ছিল। সেটা বাইরে থেকে ওর পাগলামী দেখে কেউ বুঝতে পারত না। কিশোর কুমার নিজেও এমন ছিলেন, কাউকে বুঝতে দিতেন না।
ঠিক সন্ধে সোয়া সাতটা নাগাদ ট্যাক্সিটা শুক্লার ফ্ল্যাটের নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। গাড়ীতে আসতে আসতে এরমধ্যেই শুক্লার ২বার ফোন এসে গেছে আমার মোবাইলে। আমি যে সত্যি আসছি কিনা সেটা ও ফোন করে নিশ্চিত হতে চেয়েছে। যাচাই করে দেখে নিতে চেয়েছে আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি কিনা? আমার কাছ থেকে কনফারমেশন পেয়ে থুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছে শুক্লা। অবাক লাগছে, এতটা আনন্দ পেতে আমি বিদিশাকেও কোনদিন দেখিনি।
কেমন যেন ঘরের মধ্যে একটা স্তব্ধতা বিরাজ করছে। আকস্মিক শুক্লার আচরণে আমি স্তম্ভিত। বুঝতে পারছি শুক্লার মনে এখন শান্তি বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। কিন্তু মানসিক ভাবে আমিও কিছুটা বিপর্যস্ত। যাকে কোনদিন প্রেমিকা হিসেবে আমি ভাবিনি, বিদিশার জায়গায় যাকে কোনদিন চিন্তা করিনি, সে আমাকে এক গভীর সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। শুক্লাকে আমি কি বলব, নিজেই বুঝতে পারছি না।
মানুষ আবেগের বশে অনেক কিছু করে বসে। পরিনতির কথা চিন্তা না করে সে তখন নিজের ইচ্ছেটাকেই বেশী প্রাধান্য দেয়। স্বভাবে, আচরণে তার পরিবর্তন ঘটে। কোন কিছু পাওয়ার আশায় সে ছটফট করে ওঠে। ভেতরে ভেতরে তার অস্থিরতা ফুটে উঠে। শুক্লা মুখে আমাকে সরি বললেও, ওর ভেতরে আমাকে নিয়ে যে একটা প্রবল চিন্তা সেটা আমি ভাল করেই উপলব্ধি করতে পারছি।
কিছুটা দূরে গিয়ে শুক্লা বলল, ‘দেখ, তুই আবার আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলি। এই আমার হয়েছে বড় জ্বালা। কখন কি যে করে বসি। তোকে সব পুরোনো কথা বলতে গিয়ে নিজেই ইমোশনাল হয়ে পড়লাম। এই দেব, কি ভাবছিস? তুই সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেলি নাকি আমাকে নিয়ে?
আমি কোনো কথা বলছি না দেখে শুক্লা বলল, ‘আজ থেকে শুক্লা খারাপ হয়ে গেল তো তোর কাছে? দেখ আমার কিন্তু বন্ধু বলে কেউ আর রইলো না। সবাই আমার থেকে দূরে সরে গেল। তুইও সরে গেলি।’
নিজের মনের মধ্যে কেমন একটা দুশ্চিন্তা তৈরী হচ্ছে শুক্লাকে নিয়ে। ওর কাছে সেভাবে কঠোর হতে পারছি না। কিন্তু নরমও হতে পারছি না। কেমন যেন ডামাডোলে আমি দুলছি।
শুক্লা বলল, ‘বল না দেব? কাল কি হল? বিদিশা এসেছিল?’
আমার ভেতরে তখনো একটা কিন্তু কিন্তু বিরাজ করছে। বিদিশাকে নিয়ে শুক্লার এখনো এত আগ্রহ? ওর মনোভাবটা ঠিক পরিষ্কার হচ্ছে না আমার কাছে।
আমি বললাম, ‘ছাড় না ওসব প্রসঙ্গ। তুই তোর কথা বল। ভালোই তো লাগছিল শুনতে।’
শুক্লা বলল, ‘আমার কথা শুনতে বুঝি তোর ভালো লাগবে? কি একটা জীবন নিয়ে এতকাল অতিবাহিত করে দিলাম। আমার আবার জীবন কাহিনী বলে কিছু বাকী আছে নাকি?’
আমি বললাম, ‘তোর বরের কথা একটু শুনি। বেশ ভালই তো হয়েছিল বিয়েটা। হঠাৎ ভেঙে গেল কেন?’
শুক্লা বলল, ‘জোড়া লাগানোর আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার স্বামী আমাকে সেই সুযোগটা দেয় নি।’
কারণটা জানতে শুক্লা বলল, ‘আসলে আমার হাজব্যান্ড হল, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। জামশেদপুরে ওদের আদী বাড়ী। চাকরীর দরুন, কলকাতাতেই অনেকদিন ছিল। হঠাৎই আমার শাশুড়ী এসে সব গুবলেট করে দিল।’
আমি বললাম, ‘সেটা কিরকম?’
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
শুক্লা বলল, ‘আমি তখন অলরেডী ফ্ল্যাটের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে লোন স্যানকসন্ পেয়ে গেছি। ও আর আমি বিয়ের পর ভাড়াবাড়ীতে থাকতাম। শ্বাশুড়ি মায়ের আপত্তি হল, জামশেদপুরে যখন নিজেদের বাড়ী রয়েছে, তখন লোন টোন নিয়ে আবার এসব ফ্ল্যাট কেনা কেন? তাহলে তো ওই বাড়ীটাও শেষমেষ দেখার কেউ থাকবে না। আমার শশুড় শাশুড়ীর যখন জামশেদপুরে বাড়ী রয়েছে, তখন এসব ফ্ল্যাট ট্যাট কেনার কোন দরকার নেই। আমার বর প্রথমে মায়ের কথাটার কোনো গুরুত্ব দেয় নি। পরে দেখি ও মায়ের কথায় তাল দিচ্ছে। ভীষন রাগ হল আমার। বললাম, আপনারা নিজেদের কথা চিন্তা করেন। আমার বাবা মায়ের জন্যও তো আমাকে কিছু ভাবতে হবে। মা বাবা এতকাল ধরে ভাড়া বাড়ীতে রয়েছেন, তাদেরকে যদি আমি নিজের ফ্ল্যাটে এনে তুলি। অসুবিধেটা কি?’
শাশুড়ী বলল, তার মানে তুমি ফ্ল্যাট নিতে চাইছ নিজের বাবা মায়ের জন্য? নিজেদের কথা ভেবে নয়?
ভীষন রাগ হল আমার। বললাম, বাবা মা কি চিরকাল থাকবেন? তারপর তো ওই ফ্ল্যাট আমাদেরই হবে। এই সহজ কথাটা কেন বুঝতে চাইছেন না?
আমার শাশুড়ী তারপরেও বিশ্রী ভাবে বেঁকে বসলো।
আমি শুক্লাকে বললাম, ‘এটাই কি তোদের বিচ্ছেদের কারণ?’
শুক্লা বলল, না, এরপরেও জল অনেকদূর গড়ালো। ও হঠাৎই জামশেদপুরে চলে গেল কয়েকদিনের জন্য। অফিস থেকে ছুটী নিল। বলল, বাবা মা দুজনেরই খুব শরীর খারাপ। আমাকে ওনাদের পাশে থাকতে হবে। আমি বললাম, আমি কি যাব তোমার সাথে? ও বলল, না তুমি থাকো। তাহলে তোমাকেও তো আবার ছুটী নিতে হবে।
আমি শুক্লাকে বললাম, তারপর?
শুক্লা বলল, সেই যে গেল, তারপরে দেখি আর আসার নামই করে না। আমি এদিকে রোজ ফোন করছি, ওর কাছে খবরাখবর নিচ্ছি। সেই একই কথা। না আমার এখন কলকাতায় ফেরার কোন ইচ্ছা নেই।
আমি বললাম, সেকী? তোর প্রতি ওর টানটা তাহলে চলে গেল? বিয়ে কেন করেছিল?
শুক্লা বলল, সেটাই তো কথা। বাবু চাকরি ছেড়ে একেবারে বাবা মায়ের কাছে গিয়ে হাজির হয়েছেন। ওসব শরীর টরীর খারাপ মিথ্যে কথা। মোদ্দা কথা হল, উনি চাকরী আর করবেন না। জামশেদপুরে দোকান খুলে ব্যাবসা করবেন।
আমি বললাম, তারপর?
শুক্লা বলল, তারপর আর কি? আমার এদিকে চিন্তা বাড়ছে। বাবা মাও চিন্তা করছে আমাকে নিয়ে। ফ্ল্যাটে আমি একা। রোজ শুধু অফিস করছি, কিন্তু মন আমার একেবারেই ভাল নেই। ঠিক করলাম ভাড়া বাড়ীটা আমি ছেড়ে দেবো। বাবা মায়ের কাছেই আবার ফিরে যাব। ততদিনে সল্টলেকের আমার এই নতুন ফ্ল্যাটটাও তখন তৈরী হতে শুরু করেছে। আমি বায়নাও অলরেডী করে দিয়েছি। ঠিক করলাম, ফ্ল্যাট কমপ্লিট হয়ে গেলে বাবা মাকে নিয়ে আমি এখানে চলে আসব।
আমি বললাম আর তোর বর?
শুক্লা বলল, ‘শেষ চেষ্টা একটা করলাম। ওকে ফোন করে আমি ট্রেন ধরে একাই চলে গেলাম জামশেদপুর। ভেতরে ভেতরে রাগটাকেও আমি প্রশমিত করে ফেলেছি। একবার ওকে অন্তত বোঝানোর চেষ্টা করব,এই আশা নিয়ে আমি জামশেদপুর রওনা দিলাম। সারাটা রাত্রি আমার ট্রেনে ঘুম এল না। কি হয় কি হয় একটা দুশ্চিন্তা মনে কাজ করছে। আমার সব আশায় জল ঢেলে দিল, আমার শশুড় শাশুড়ী। আমার বরও তখন তার বাবা মায়ের কবলে। কিছুতেই সিদ্ধান্ত পাল্টাতে রাজী হল না। উল্টে আমাকে বলে বসল, তুমি চলে এসো জামশেদপুরে। দরকার হলে ট্র্যানস্ফার নিয়ে নাও। চাকরী ছেড়ে দাও। কলকাতার প্রতি তোমার অত মায়া কেন?’
আমি চেয়ে আছি শুক্লার মুখের দিকে।
শুক্লা বলল, ‘তুই বল দেব? বাবা মাকে একা ফেলে, ওনাদেরকে ছেড়ে এভাবে কি চলে যাওয়া যায়? বিয়ের আগে আমি শর্তই করে নিয়েছিলাম। বাবা মাকে ছেড়ে আমি অন্য কোথাও কিন্তু যেতে পারব না। সেটা সম্ভব নয়। সব শর্তে রাজী হল। অথচ বিয়ের পর, তিনি একেবারে পাল্টে গেলেন।’
শু্ক্লাকে বললাম, কতবছর ঘর করেছিলিস তোরা?
শুক্লা বলল, মাত্র একবছর।
আমি বললাম, মাত্র একবছরেই সব শেষ হয়ে গেল?
শুক্লা বলল, আমি শেষ করে দিতে চাইনি দেব। ওই আমাকে বাধ্য করল। কোর্ট থেকে আমাদের ছমাস সময় দিল। এই ছমাসেও তিনি মনোভাব চেঞ্জ করলেন না। বাধ্য হয়েই মিউচাল ডিভোর্সটা আমাদের করে নিতে হল।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুক্লা বলল, দেখ, এতকিছু করলাম। সেই বাবা মায়ের জন্যই আমি এত লড়াই করলাম। অথচ বাবা আর মা, দুজনকেই আমি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলাম না। আমার জীবনটা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেল।বাবা মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন।
আমি শুক্লার চোখে আবার জল দেখলাম, যেন ভাঙাচোরা একটা জীবনের মতন জীবনটাকে জোড়া লাগানোর সব প্রচেষ্টাই শুক্লার ব্যর্থ হয়ে গেছে। নতুন ভাবে বাঁচার উৎস খুঁজছে। কিন্তু অসুখী নারীমন তাকে যেন চরম বিশাদে ভরিয়ে তুলেছে।
আমার দিকে চেয়ে অনেক কষ্টে মুখে আবার হাসিটা ফেরত আনার চেষ্টা করল শুক্লা। আমাকে বলল, ‘আমি কিন্তু তোর বিয়েতে খুব আনন্দ করব দেব। বিদিশার সঙ্গে যদি তোর বিয়েটা হয়, তাহলে খুব মজা করব, গাইবো নাচবো। তোকে আর বিদিশাকে নিয়ে খুনসুটী করব। সারারাত হৈ হুল্লোর হবে। বাসরে মজা হবে। এই শু্ক্লাকে দেখে তুই তখন চিন্তেই পারবি না। কি আমি ঠিক বলছি তো দেব?’
আমি অবাক চোখে চেয়ে আছি শুক্লার দিকে। ভাবছি, জীবনের নানা রং দেখতে যারা অভ্যস্ত। তারা কি এই রংয়ের সাথে কোন রংকে মেলাতে পারবে? এ আমি কি দেখছি? ভালোবাসার রং কি এরকমও হয়? না, আমার মাথা আর কোনো কাজ করছে না। এবারে মনে হচ্ছে, শুক্লাকেই আমাকে পরিষ্কার করে আসল কথাটা জিজ্ঞাসা করতেই হবে। শুক্লা তাহলে কি তুই?-
মনে হল, শুক্লা আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ওর প্রতি আমার যে ধারনাটা তৈরী হয়েছে সেটাকে নির্মূল করার। যেন অভিনয় নয়, ভেতর থেকে খুশি আর আনন্দ ফেটে পড়ছে। আমার মনের মধ্যে যাতে কোন আশংকা বাসা না বেঁধে থাকে, তার জন্য নিজেই এবার প্রাণখুলে হাসতে লাগল শুক্লা। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে, আর বলতে লাগল, ‘আমি কিন্তু তোর রকমটা খালি দেখছিলাম। যেই তোকে ভালবাসার কথা বলেছি, অমনি তোর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আরে বাবা। আমি কি অতই বোকা? যে বিদিশার জায়গাটা শুধু শুধু নিতে যাব? তুই বুঝি বিদিশাকে ছেড়ে আমাকে ভালবাসতে শুরু করে দিবি? আর আমার কথাটাও সত্যি মেনে নিবি। ওতো আমি এমনি বলছিলাম। তোকে একটু পরখ করে দেখছিলাম, আর কি? তোর সাথে একটু মজা করব না তো কি করব বল? কলেজের দিনগুলোর কথা কি তুই ভুলে গেলি?’
মনে মনে বললাম, সব কিছু যে মজা করে হয় না শুক্লা। তোর মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি কাজ করছে এখন। তুই যেটা বলতে চেয়েছিলিস, সেটা বলেও তুই কথাটা ঘুরিয়ে নিয়েছিস। তোর মনের ইচ্ছাটা আমি তখুনি বুঝে নিয়েছি।
শুক্লা আবার আমার কাছে এল। আমাকে বলল, ‘বিদিশার কথা কিছু একটু বলবি তো? কাল শুভেন্দুদের বাড়ীতে বিদিশা এসেছিল কিনা তাও বললি না। শুধু এড়িয়ে যাচ্ছিস আমাকে? কেন আমাকে বলতে কি তোর কোন অসুবিধে আছে?’
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। তারপরে বললাম, ‘শুক্লা, আমাকে বড় বিপদে ফেলে দিলি তুই। এ তুই কি করলি বলতো? আমাকে বাড়ীতে ডেকে এনে মনের কথাটা বলে ফেললি। কোনদিন ভেবে দেখেছিস? আমি তোকে সেভাবে, কখনো-
শুক্লা আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘আমি জানি দেব। জোর করে কিছু হয় না। ভালবাসা প্রেম এগুলো তো ছেলেখেলা নয়। এই করলাম, আবার ছেড়ে দিলাম। আবার করলাম, আবার ছেড়ে দিলাম। ওই ভুল আমি জীবনে একবারই করেছি। কিন্তু তুই কেন করতে যাবি দেব? আমার জন্য তুই বিদিশার ভালবাসাটাকে ভুলে যাবি? এতদিন বাদে যে বিদিশা ফিরে এল, তার কি কোন দাম থাকবে না তোর কাছে? ও আমি ভুল করে ফেলেছি, দেব। একেবারে নির্বোধের মতন কাজ করে ফেলেছি। তুই প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি সরি ভীষন সরি। প্লীজ দেব।’
আমি আবার চেয়ে রইলাম শুক্লার মুখের দিকে। শুক্লা বলল, ‘কাল কি জানি কি মনে হল, বোকার মতন শুভেন্দুকেও কিছু খারাপ কথা বলে দিলাম, বিদিশার সন্মন্ধে। পরে নিজেরই আমার অনুশোচনা হল। ভাবলাম, এ আমি কি করলাম? শুভেন্দু নিশ্চই খারাপ ভাবলো আমাকে।’
আমি বললাম, কি বলেছিস তুই শুভেন্দুকে? বিদিশা সন্মন্ধে কিছু বলেছিস?
শুক্লা আবার এড়িয়ে যেতে লাগল, আমার কাছে। আমাকে বলল, ‘না আমি বলব না। কিছুই বলব না। তুই খালি আমাকে খোঁচাচ্ছিস। জানিস তোর মনের কি অবস্থা হবে এটা শুনলে। আমি তোর চোখে আরো খারাপ হবো। এটাই কি তুই চাস?’
এমন একটা শর্তে ফেলে দিল শুক্লা। আমার শোনার আগ্রহটা পুরোপুরি চলে গেল। মনে হল, যে ঝড়টা আমার মনের ভেতর দিয়ে এখন বইছে, আমি সত্যি বিদিশার সন্মন্ধে কোন খারাপ কথা শুনতে পারব না। যেটা সত্যি সেটাও মানতে পারব না। হয়তো মুখ ভার করে এক্ষুনি আমাকে চলে যেতে হবে শুক্লার এখান থেকে। আর কোনদিন শুক্লার মুখদর্শনও আমি করব না।
ও বলল, ‘জেনে রাখ দেব, বিদিশা যতই ভুল করুক। বা যতই তোর ভালবাসাকে ঠুকরে সে চলে যাক। এতদিন বাদে সে যখন ফিরে এসেছে। তাকে তাকে ক্ষমা করে দিতেই হবে। আমি যদি বিদিশার জায়গায় থাকতাম, তুই করতিস না?’
মনে মনে বললাম, কিন্তু তুই তো আমার বাড়ীতে কাল অন্যকথাই-
শুক্লা বলল, ‘বিদিশা ভীষন ভালো মেয়ে। হয়তো পরিস্থিতির চাপেই ওকে বিয়েটা তখন মেনে নিতে হয়েছিল। আমাকে ও সবই বলেছে। তোর ভালবাসার দামও সেভাবে ও দিতে পারেনি। কিন্তু সবাই তো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। এতদিন বাদে যখন তোর কাছেই আবার ফিরে এসেছে। সেই সুযোগ কি তুই ওকে দিবি না, বল?’
মনে মনে বললাম, সুযোগ তো আমি দিতে চাই। কিন্তু বিদিশা নিজেই তো-
কালকের বিদিশার শেষ কথাটা শুক্লাকে বলতে গিয়েও আমি বলতে পারলাম না। শুক্লা বলল, ‘আমি জানি দেব, তোর মনের ভেতরে এখন যে ঝড়টা বইছে। বিদিশার সাথে যতক্ষণ না তোর দেখা হবে এই ঝড় থামবে না। তুই বিদিশাকে একটা ফোন কর। ওকে তোর বাড়ীতে ডেকে নে। নয় তুই ওর কাছে চলে যা।’
মুখটা নিচু করে ঘাড় নেড়ে আমাকে আস্বস্ত করল শুক্লা। বলল, আমি বলছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিদিশা তোর কাছেই আবার ফিরে আসবে। আমার মন তাই বলছে।’
মনে মনে বললাম, তাই যেন সত্যি হয়। শুক্লার কথাটাই মিলে যাক। ভগবান যেন পুরোপুরি বিদিশাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেন।
আরও আধঘন্টা শুক্লার সাথে নানা গল্প করে যখন ওর বাড়ী থেকে বেরুলাম, মনে হল, এতদিন ধরে যাকে শুধু বন্ধু হিসেবেই দেখেছি, সেই শুক্লা আমার কাছে নিজের স্বার্থ ভুলে গিয়ে সত্যিকারের বন্ধু হিসেবেই নিজেকে আবার প্রমান করল। ঠিক এই মূহূর্তে যে নিজের ভালটা না ভেবে আমার ভাল ছাড়া জীবনে আর কিছু চায় না।
বাড়ীতে ফিরছি, ট্যাক্সি চড়ে। আবার সেই চিন্তাটা আমার মনকে ভীষন আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। এবার মনে হল, না, শুক্লা যতই বন্ধুত্বের কথা বলুক। ও যেন ইচ্ছে করেই আমার প্রতি ওর দূর্বলতা আর ভালবাসাটাকে আত্মগোপণ করে নিল। প্রেমের উদ্ভব ঘটাতে গিয়েও ঘটাতে পারল না। এর জন্য দায়ী শুধু আমিই। কারণ আমার মন তো সবসময়ই আচ্ছন্ন হয়ে আছে সেই একই বিদিশার চিন্তায়। জানি না বিদিশার জন্য আমাকে আরো কতদিন প্রতীক্ষা করতে হবে। আমি বোধহয় সেই পুরুষ, যাকে কোন নারী ইচ্ছে করলেও ভালবাসতে পারবে না। যেখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর এক নারী। সে শুধু বিদিশাই আর বিদিশাই। সে আর কেউ নয়।
ঠিক তখন বাজে রাত্রি দশটা। ভাবছি, শুভেন্দুকে একটা ফোন করি। কি হালচাল একটু জিজ্ঞাসা করি। আজকে যে শুক্লার বাড়ীতে গিয়েছিলাম, সেটাও ওকে বলি। শুক্লা আমাকে কি বলেছে, কি কথা হয়েছে, সেটাও ওকে খোলসা করি। তারপরেই ভাবলাম, শুক্লাকে ছোট করে আর কি লাভ? ব্যাচারা যদি কোনদিন জানতে পারে কষ্ট পাবে। শুভেন্দুর মুখ পাতলা। শুক্লাকে বলেও দিতে পারে কথাটা। বিদিশার জন্য যদি স্যাকরিফাইশ করেও থাকে শুক্লা। সেটার আর কোন দাম থাকবে না কারুর কাছে।
তবুও শুভেন্দুকে ফোনটা করলাম। ইচ্ছে হল বিদিশার কথা তুলেই শুভেন্দুর সাথে একটু গল্প করি। কাল মাধুরী আর রনি এসেছিল। ওরা এখনো আছে না চলে গেছে, সেটাও শুভেন্দুর কাছ থেকে খবর নিই। ফোন করলেই শুভেন্দু প্রথমেই আমাকে বিদিশার কথা জিজ্ঞাসা করবে, আজ সারাদিনে বিদিশার কোন খবর এসেছে কিনা সেটাও আমার কাছ থেকে জানতে চাইবে। বিদিশার জন্য আমি যাতে বেশী চিন্তিত হয়ে না পড়ি, সেটাও আমাকে বোঝাতে চাইবে। আমার মনকে শক্ত করতে বলবে শুভেন্দু। হাল যাতে না ছাড়ি, সে আশ্বাসও দেবে হয়তো আমাকে।
ওর মোবাইলের নম্বরটা এনগেজ হচ্ছিল। আমি জানি শুভেন্দুর কাছে দুটো মোবাইল। একটা নম্বরে না পেয়ে যথারীতি আর একটা নম্বরে ওকে ঠিক পেয়ে গেলাম। অন্য নম্বরটায় ঠিক দুটো রিং হবার পরই ফোনটা ধরল শুভেন্দু। আমাকে বলল, দেব, ‘তোকে আমি কল ব্যাক করছি। যাস্ট পাঁচ মিনিট।’
মনে হল, ও বোধহয় কারুর সাথে ফোনেই কথা বলছে এতক্ষণ ধরে। অন্য ফোনটা এনগেজ পাচ্ছিলাম, এই কারনেই। ফোনটা কেটে দিতে গিয়েও আমি কাটতে পারলাম না। পরিষ্কার শুনতে পেলাম, শুভেন্দু কাকে যেন বলছে, তুই কি সত্যি কথাটা বলতে ভয় পাস? এরকম কেন করছিস তুই? দেব কি তোর অসুবিধার কথাটা বুঝবে না? ওকে সব খুলে বল। ওই তো সিদ্ধান্ত নেবে এখানে। দেবের উপরেই সব কিছু নির্ভর করছে।’
আমি দেখলাম শুভেন্দুও ভুলে লাইনটা কাটেনি। আর আমার ব্যাপারেই কারুর সাথে কথা বলছে। যা বলছে আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।
শুভেন্দু বলল, ‘কি হল, চুপ করে গেলি কেন তুই? কিছু তো বল?নাকি আমি তোর হয়ে বলব দেবের কাছে। তোর বলতে কেন অসুবিধা হচ্ছে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
কার সাথে কথা বলছে শুভেন্দু? কি বলবে? কার হয়ে বলবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
কান পেতে শুনতে লাগলাম, অন্য ফোনে শুভেন্দুর কথা। কিন্তু যার সাথে কথা বলছে, তার কথা আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। শুধু শুভেন্দুর কথাটা ভেসে আসছে কানে আর ও যেন ভীষন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে কাউকে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর শুভেন্দু বলল, ‘দেখ দেবকে আমি সত্যি কথাটা বলতে পারতাম। কিন্তু বলিনি, তার কারণ আমি জানি, এই সমস্যাটা হয়তো কিছু দিনের, কিছু মাসের জন্য। চিরকালের জন্য তো তুই এই সমস্যা বয়ে বেড়াবি না? তাহলে অযথা কেন ভয় পাচ্ছিস? ডিভোর্স যখন হয় নি। তখন একদিন না একদিন ঠিক হয়ে যাবে। দেবও আশাকরি বুঝতে পারবে।’
আমি যেন চমকে উঠলাম। কার ডিভোর্সের কথা বলছে শুভেন্দু? কার সাথে কথা বলছে ও? তাহলে কি বিদিশা?
ঠিক সেই মূহূর্তে শুভেন্দু অন্য ফোনে বলে উঠল। এক বছরটা কোনো সময়ই নয় বিদিশা। যে ছেলেটা তোর জন্য এতবছর অপেক্ষা করল, মাত্র একবছর সে ওয়েট করতে পারবে না? তুই কি ভাবিস? দেবের মনটা অত পাথর নয়। তুই কিচ্ছু তাকে ঠকাচ্ছিস না। তোর অসুবিধার কথাটাই তাকে বলছিস।’
ফোনটা কান থেকে নামিয়ে বুকের কাছে ধরে একটা চাপা অস্বস্তি হতে লাগল আমার। ভাবলাম, হায় ভগবান, এ আবার কি পরীক্ষায় ফেললে আমাকে? তবে কি বিদিশার এখনো ডিভোর্সটা হয় নি? কাল তাহলে শুভেন্দু ইয়ার্কী নয়, সত্যি কথাটাই বলতে চেয়েছিল আমাকে। শেষেমেষে ওর ইয়ার্কীটাই এবার সত্যি হয়ে গেল আমার কাছে। ও সব জানতো। তাও গোপন করেছে আমাকে। কিছুই বুঝতে দেয়নি শুভেন্দু। কার কথা ভেবে শুভেন্দু সত্যিটা গোপন করল? বিদিশার কথা ভেবে? না কি এই দেবের কথা ভেবে। ঠিক বুঝতে পারছি না।
ফোনটা তখনও আমি ছাড়িনি। শুভেন্দু বিদিশাকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ওদিক দিয়ে বিদিশাও যেন খুব অসহায়। শুভেন্দু মাঝে মাঝে ওকে বলছে, ‘চিন্তা করিস না বিদিশা। দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এক মূহূর্ত স্তব্ধের মতন হয়ে ফোনটা এবারে আমি ছেড়ে দিলাম। বিদিশার জন্য কষ্টও হল। মনে হল, আমার কাছে ফিরে আসার জন্য ও এতটাই ব্যাকুল। অথচ শেকলটা পায়ে এখনও বাঁধা রয়েছে। কিছুতেই ওটা ছিঁড়ে ও বেরিয়ে আসতে পারছে না। বিদিশা কাঁদছে, চোখের জল ফেলছে। হয়তো আফশোসও করছে। প্রেমের সাথে জড়িয়ে থাকা, স্বপ্ন, আশা আর আকাঙ্খাগুলো এবার ধূলিসাত হতে চলেছে।
শুভেন্দু এবার আমাকে ঘুরিয়ে ফোন করল। ওকে বললাম, ‘কার সাথে তুই কথা বলছিলিস?’
শুভেন্দু বলল, ‘এই আমার এক ক্লায়েন্টের সাথে। ব্যাটা রাত দুপুরে আমাকে ফোন করেছে। বোঝাতে বোঝাতে আমার অবস্থা খারাপ। তাই তোকে বললাম, আমি পরে ফোন করছি।’
ওকে বললাম, ‘শুভেন্দু, বিদিশার জন্য আমার ভীষন চিন্তা হচ্ছে।’
শুভেন্দু বলল, ‘কিসের চিন্তা?’
-এই আমার কাছে কি যেন একটা লুকোলো বিদিশা। হয়তো কোন সমস্যায় আছে। কিন্তু আমার কাছে সত্যিটা বলতেও ওর কি অসুবিধা আছে? বিদিশাতো আমার কাছে বলতেই পারে। অসুবিধাটা। আমি তো-
শুভেন্দু বলল, ‘কিসের জোরে সে তোকে বলবে? তোর জন্য সে কি করেছে?’
আমি বেশ অবাক হলাম। বললাম, ‘তুই একথা বলছিস? তুই না কালকে আমাকে-
শুভেন্দু বলল, ‘হ্যাঁ বলেছিলাম। তোকে আমি সত্যি কথাটাই বলেছিলাম। কিন্তু কালকের সান্ধ্যআসরটা তাহলে মাটী হয়ে যেত। বিদিশার ফিরে আসার আনন্দটা তোর কাছে ম্লান হয়ে যেত। সত্যিটা মেনে নিয়েও, তুই নিজের মনকে অনেক প্রশ্ন করতিস। এই সমস্যা থেকে বিদিশা আদৌ বেরুবে কিনা, তোর মনে অনেক প্রশ্ন থেকে যেতো। আমি তোর মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলাম দেব। তোকে এত চিন্তায় ফেলতে আমিও চাইনি।’
আমি অবাক হলাম, বললাম, ‘তুই বিদিশার এই সমস্যাটার কথাটা জানতিস। জেনেও আমাকে কিছু বলিসনি?’
শুভেন্দু বলল, ‘হ্যাঁ জানতাম। বিদিশাই আমাকে সব বলেছে। আমিই ওকে মানা করেছিলাম। বলেছিলাম, দেবকে এখনই কিছু জানাবার দরকার নেই। তাহলে ওর মনটা ভেঙে যেতে পারে। বিদিশা আমাকে কথা দিয়েছিল, তাও সব শেষে নিজের মনকে ও ঠিক রাখতে পারল না। তোর কাছে ও ভেঙে পড়ল।’
আমি বললাম, ‘আর কি কেউ জানে এই ব্যাপারটা?’
শুভেন্দু বলল, ‘শুক্লা জানে কিনা জানি না। তবে রনি, মাধুরী এই ব্যাপারটা জানে না। আমি ওদেরকে বিদিশার ব্যাপারে কিছু বলিনি।’
শুভেন্দুকে বললাম, ‘বিদিশা তার মানে এক প্রকার ওর স্বামীকে ছেড়েই এখানে চলে এসেছে। ডিভোর্সটা এখনও হয় নি।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শুভেন্দু বলল, ‘তুই ফোনে সব শুনেছিস না দেব? আমি বিদিশার সাথে কথা বলছিলাম।
ওকে বললাম, ‘বিদিশা তো আমার কাছে আসল সত্যিটা কালকেই বলতে পারত। আমি ট্যাক্সিতে আসতে আসতেও ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলল, দুদিন আমাকে অন্তত সময় দাও। আমি তোমাকে ভেবে বলব।’
শুভেন্দু বলল, ‘বিদিশা তোর কাছে এখন অপরাধী। ও নিজে তাই মনে করে। আর কারুর কথা বলতে পারছি না। কিন্তু বিদিশা বলেই নিজের স্বার্থটাকে বড় করে দেখতে পারছে না। তাছাড়া এ সমস্যা থেকে বেরুবার জন্য তোর তো কিছু করার নেই। ডিভোর্স যতদিন না হচ্ছে, তুই ওকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারবি না। ইন্ডিয়ান ম্যারেজ অ্যাক্টতো তাই বলে। অপরের বিবাহিত স্ত্রীকে কাছে রাখাটাও অবৈধ পর্যায়ে পড়ে। তুই ওর সাথে লিভ টুগেদার হয়তো করতে পারবি। কিন্তু সেটা কি তোর মা মেনে নেবে? বিদিশার মনের মধ্যে এখন সেই চিন্তাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। ও শুধু মনে জোর পাচ্ছে না তা নয়। এক প্রকার ভেঙেই পড়েছে বলা যায়। কাল থেকে ওর অবস্থা আরো খারাপ। কাল যদিও সব ভুলে টুলে তোর মুখটা দেখার জন্য ও এখানে এসেছিল। কিন্তু আজ ওর সাথে কথা বলে মনে হল, এই কষ্টভোগের পালা শুরু যখন হয়, তখন সেটাকে সহ্য করা খুব কষ্টকর। একেবারে বিধ্বস্তের মতন হতাশা গ্রস্থ হয়ে আমাকে কথাগুলো বলছিল। বলল, আমার আপেক্ষের আর শেষ নেই শুভেন্দু। তখন যে কেন দেবের কাছে আমি ফিরে গেলাম না। জীবনে এই পরিনামটাই বোধহয় আমার কপালে লেখা ছিল। আমার মনে হচ্ছে, সবকিছু এখন শেষ হয়ে গেছে। সামান্যটুকু সম্ভাবনাটাও এখন আমি দেখছি না। কেননা আমার স্বামী আমাকে বলেছে-
আমি কৌতূহল হয়ে শুভেন্দুকে বললাম, কি বলেছে বিদিশার স্বামী?
শুভেন্দু বলল, ‘বিদিশার স্বামী বলেছে, কিছুতেই ডিভোর্সটা নাকি বিদিশাকে সে আর দেবে না। সারাজীবন এভাবেই স্বামী ছাড়া শুধু কাটাতে হবে বিদিশাকে। কোর্ট কাছারীতে আমরক্ত বেরিয়ে যাবে বিদিশার। উকিলের পেছনে টাকা খরচাটাই শুধু সার। এ জীবনে বিদিশারর দ্বিতীয় বিবাহ আর কোনদিন হবে না।’
ফোনটা ছাড়ার আগে শুভেন্দুকে বললাম, ‘আমি বিদিশার সাথে একবার কথা বলতে চাই। ওর সাথে দেখা করতে চাই।’
শুভেন্দু বলল, আমি তো বিদিশাকে বলেছি। দেখ ও হয়তো ফোন করবে। কিংবা দেখাও হয়তো করবে।’
শেষকালে ফোনটা রাখার আগে শুভেন্দু শুধু বলল, ‘আমারও আফশোসের আর শেষ নেই রে দেব। মাঝে মধ্যে আমিও ভাবছি, তোর আর বিদিশার জীবনটা কি এভাবেই শুধু কেটে যাবে? জীবনে তোরা আর বিয়ে থা কোনদিন করতে পারবি না? এ কী জীবনের মানে? অদ্ভূত এই জীবন। আমি তো কোন তালগোল খুঁজেই কিছু পাচ্ছি না।’
শেষে ও নিজেই বলল, ‘তোকে অবশ্য হাল ছেড়ে দিতে আমি বলছি না। দেখ নিশ্চই কিছু তো রাস্তা বেরোবেই। ভগবান মুখ তুলে চাইবেন। এতটা নিষ্ঠুর কখনো হবেন না।’
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
মাঝে মাঝে জীবনটা বড় অদ্ভূত মনে হয়। কলেজের দিনগুলোর মতন জীবনটা কেন ফিরে আসে না? কেন মনে হয়, এ পৃথিবীতে আনন্দ আর সুখ বলে কিছু নেই। আমারও তো কিছু পাবার ছিল। কিছু প্রত্যাশা ছিল। জীবনকে ঘিরে ধরে শুধু ব্যাথা আর বেদনা। পুরোনো কলেজ জীবনের, বিশ বছরের সেই উদ্দামতাকে যখন ফিরিয়ে আনতে চাই, জীবনকে পরিপূর্ণ করে তুলতে চাই, তখুনি বাঁধা বিপত্তিগুলো আবার ফিরে ফিরে আসে। নারী যেন আমার জীবনে অংশভাগিনী হতে চেয়েও পারে না। কেউ আমাকে ভালবাসতে চায়, সেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় অন্য নারী। আবার যখন সেই নারীকেই আমি ফিরে পেতে চাই, তখন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তার নিজের স্বামী। এ যেন জীবন সঙ্গিনীকে পাবার সমস্ত সুযোগই ব্যর্থ। আমার জীবনকে রমনীয় করে তোলবার জন্য সত্যি বোধহয় কোন নারী নেই। নেই কোন সঙ্গিনী।
পুরোনো দিনের কথা আর বর্তমান এই দুটোকে মেলাতে গিয়ে মনটা ভীষন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিল। নতুন করে কার প্রেমে যে পড়ব, সেটাই ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আবিষ্ট মন, স্পর্ষকাতর মন আমার সিদ্ধান্তকে একজায়গায় এনে ফেলতে পারছে না। কখনো বিদিশার মুখটা আমি চোখের সামনে দেখছি, কখনো শুক্লার মুখটা সেখানে ভেসে উঠছে। দুজনেই যদি আমার প্রেয়সী হয়, তাহলে কাছে পাওয়ার জন্য কার প্রতি আমার সুতীব্র আকুলতা জেগে উঠবে, সেটাই বুঝতে পারছি না। আমি কি শুক্লার আশাটাকে মেনে নেব? না বিদিশাকে এখনো ভরসা দিয়ে যাব। যতক্ষণ না ওর ডিভোর্সটা সম্পন্ন না হচ্ছে, ততদিন অপেক্ষা করে যাব। কোন একজনেরই একনিষ্ঠ প্রেমিক হয়ে ওঠার জন্য আমি এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই দুজনের মধ্যে কোনো একজনকে বেছে নিতে পারছি না। বড্ড কঠিন অবস্থা হয়ে উঠেছে আমার। দুজনের মুখদুটোকে শুধু চিন্তা করে পীড়াদায়ক চিন্তারাশি আমার বুক ঠেলে উঠে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এমন এক দূরঅবস্থা। আমার মনের দুশ্চিন্তাটাকে আমি কাউকে জানাতেও পারছি না। সত্যিই কি করুন এক পরিস্থিতি।
ডায়েরীর পাতাটা খুলে ভাবছিলাম কিছু একটা লিখব। উপন্যাসটা হঠাৎই এমন একটা জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে যেন এগোতেই চাইছে না। অতীত ভুলে এখন বর্তমানটাই আমার চোখের সামনে। শুক্লা বিদিশা দুদুটো মেয়ে হঠাৎই এসে হাজির হয়েছে আমার জীবনে। তারা আমার সান্নিধ্য পেতে চাইছে, অথচ কি করে সমস্যা কাটিয়ে উঠব, ভেবে কোন কূলকিনারা পাচ্ছি না। বিদিশার জন্যও কষ্ট হচ্ছে আবার শুক্লার জন্যও মনটা ভীষন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আমার অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ আমার খেয়াল হল, শুভেন্দু বিদিশাকে বলেছে, ‘দেবের বাড়ীতে এক্ষুনি তুই যাস না। ওর সাথে দেখা করবার জন্য আমার বাড়ীটাই বেস্ট।’ আমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে নিজের বাড়ীতেও ডেকে নিয়ে গেছে। বিদিশাকেও সেখানে আমন্ত্রণ করেছে। তারমানে শুভেন্দু এটা জানতো, ওর বাড়ীতে এসব সমস্যার কথা উঠবে না, বিদিশাও আমাকে কিছু বলবে না। বিদিশাকে শুভেন্দুই হয়তো বারণ করে রেখেছিল আগে থেকেই। ‘এই মূহূর্তে দেবকে এসব কিছু বলার দরকার নেই।’
শুভেন্দু আমার কাছে সত্যি কথাটা বলেও পরে ওটা মিথ্যে বলে আমার মনটাকে হাল্কা করার চেষ্টা করে। শুভেন্দু হয়তো জানতো, আমি চিন্তায় পড়ে যাব বিদিশাকে নিয়ে। মন অস্থির হয়ে উঠবে। বিদিশার ফিরে আসার খবরটা আমার মনকে সেভাবে নাড়া হয়তো দেবে না। ও আমার কাছে ফিরে এলেও, সেটা কোন খুশীর খবর হয়ে উঠবে না।
ভাবছিলাম, শুভেন্দুরই বা বিদিশাকে নিয়ে এত আগ্রহ কেন? ও যখন সব আগে থেকেই জানে। জেনেও বিদিশার সাথে আমাকে আবার মেলানোর চেষ্টা করছে। বিদিশার কথা ভেবে শুভেন্দু এটা করেছে? না আমার কথা চিন্তা করে আমাকে ধৈর্য রাখতে বলছে। অতীতের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল, সেদিন কিন্তু বিদিশার প্রতি শুভেন্দু এতটা দয়ালু হয়নি। মিনুর বাড়ীতে ওই ঘটনাটা ঘটে যাবার পর দোষ দেখেছিল বিদিশারই। আমাকে বলেছিল, ‘বিদিশা এটা ঠিক করেনি। সত্যি মিথ্যে যাচাই না করে তোর দোষ দেখল বিদিশা। এটা কি ও ঠিক করল?’
মিনুর বাড়ীতে হঠাৎই ঘটে যাওয়া সেদিনের সেই ঘটনাটা। আমার বাড়ীতে তার কিছুদিন আগেই সৌগত এসে হাজির। কলিংবেল টিপতেই দেখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, একগাল হাসি। বিয়ের কার্ড নিয়ে এসেছে, বাবুর ফূর্তী যেন আর ধরে না। ওকে বললাম, ‘কি রে সৌগত তুই?
সৌগত বলল, ‘সামনের মাসের দশ তারিখে আমার বিয়ে, তোকে কার্ডটা দিতে দেরী হয়ে গেল। অবশ্য কোন বন্ধুদেরই এখনো কার্ড দিইনি। বলতে পারিস, তোর কাছেই প্রথম এলাম। তুই ফার্স্ট।’
সৌগতকে ঘরে ডেকে বসালাম। বললাম, ‘এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করছিস? তোর কি বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি রে শালা। এই তো সবে আমরা কলেজ পাশ করলাম। ‘
সৌগত বলল, ‘তাও নয় নয় করে তিনবছর তো হয়ে গেল। বাড়ীতে সবাই হূটোপাটি করছে। আমিও তাই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম।’
আমি বললাম, ‘তাও চব্বিশ বছরে বিয়ে? আমি তো ভাবতেই পারছি না।’
সৌগত বলল, ‘সেদিক থেকে বিয়েটা একপ্রকার একটু তাড়াতাড়িই হচ্ছে। আসলে আমার বউটা খুব সুন্দরী। ওদের বাড়ীর লোকেরাও আমাকে পছন্দ করেছে। ওরাই চটজলদি বিয়েটা সেরে নিতে চাইছে। আর আমিও ভেবে দেখলাম, বউ যা সুন্দরী। বিয়ে করে নেওয়াই ভালো। পরে যদি হাত ফসকে ছিটকে যায়।’
বলেই হাসতে লাগল সৌগত।
ওকে বললাম, তোর বউয়ের বয়স কত?
সৌগত বলল,কুড়ি।
আমি বললাম, ‘সেকিরে তাহলে তো একেবারে কচি খুকী।’
সৌগত বলল, চারবছরের ডিফারেন্স, তাই বা কম কি? আমি তো বলব, সেদিক দিয়ে আমি খুব লাকি।’
সৌগতকে উইশ করলাম। বললাম, ভালো ভালো। বিয়েটা তাহলে কর। আমরা সবাই একটু ফূর্তী করি। কলেজ পাশ করার পরে, সেভাবে তো আর কারুর সাথে দেখাই হয় না। তোর বিয়েতে না হয় সবাই মিলে আনন্দ করা যাবে। ’
সৌগত বলল, ‘বিদিশার খবর কি?’
আমি বললাম, ‘ভালোই আছে। মাঝে মধ্যে আসে। দেখা সাক্ষাত হয়। এখনো প্রেম করে যাচ্ছি। তবে তোর মত এত তাড়াতাড়ি বিয়ে? ওটা এখনো ভাবিনি।’
সৌগত বলল, আমি তো বলব, বেশী দেরী করা উচিৎ নয়। জানিস তো, কোথাথেকে কখন কি হয়ে যায়। আজকাল কোন কিছুর উপরেই আমার কোন ভরসা নেই।’
মনে হল, শুক্লার ব্যাপারে সৌগতর মনে হয়তো কিছু খেদ আছে। প্রেমটা ভেঙে গেল বলে, আমাকেও ও সাবধান করছে।
সৌগত নিজেই বলল, ‘আমি কিন্তু শুক্লার সাথে ব্যাপারটা সহজ করে নিয়েছি। ওকে ফোনও করেছি, কথাও বলেছি। বিয়েতেও শুক্লাকে আসতে বলব। আশাকরি ও না বলবে না।’
আমি বললাম, তোর আর শুক্লার ব্যাপারটা বড় অদ্ভূত। কি যে হল তোদের দুজনের মধ্যে। কিছুই বুঝতে পারলাম না। অথচ তোদের প্রেমটা-
সৌগত বলল, ‘প্রেম মানে তো লাভ। আমি মনে করি লাভ ইস নট পার্মানেন্ট। যে কোন মূহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। আমার আর শুক্লার ব্যাপারটাও তাই হয়েছে। এরকম ঘটনা আর কারুর জীবনেও ঘটতে পারে। ভালবাসা, প্রেম, যেকোন মূহূর্তে ভেঙে যেতে পারে।’
কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সৌগত বলল, ‘তোর আর বিদিশার ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। তোদের প্রেম হল, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রেম। একে অপরকে অঙ্গীকার করে বসে আছিস। চটকরে এ প্রেম ভাঙা খুব কঠিন। সেদিক দিয়ে তুই আবার আমার থেকে একটু লাকি বলতে পারিস।’
আমি বললাম, ‘বিদিশা আসলে আমাকে একটু বেশী বিশ্বাস করে। ও জানে চট করে দেব, ওর বিশ্বাসটাকে ভাঙবে না।’
সৌগত এবার আমার মুখের দিকে তাকালো, আমাকে বলল, ‘বিশ্বাস থাকতে থাকতে, তুইও বিয়েটা করে নে দেব। বলাতো যায় না। কখন কি থেকে কি হয়ে গেল। আমার কেন জানি, প্রেমটেম ওগুলোকে আর চিরস্থায়ী বলে মনে হয় না। জীবনে প্রেম ভালোবাসার এগুলোর কোন দাম নেই। সব বেকার জিনিষ।’
-তুই একথা বলছিস সৌগত? তুই না-
সৌগত বলল, ‘হ্যাঁ আমিই বলছি। প্রেম আমার জীবনে টেকেনি বলে বলছি না। মেয়েদের মন বোঝা খুব কঠিন। কখন তোকে কি অবস্থায় ওরা ফেলে দেবে,তুই ঠাওরও করতে পারবি না। লেজে গোবরে এক হয়ে যাবি। শেষ পর্যন্ত হতাশায় তোর চুল ছিঁড়তেও তোকে হতে পারে। এরা ভীষন অবুঝ। সত্যি কথাটা শপথ করে বললেও বিশ্বাস করতে চায় না।’
আমি বললাম, ‘বিয়ে যাকে করছিস, তাকেও তো তোকে ভালবাসতে হবে। নইলে সেটাও তো টিকবে না। প্রেম মানে তো প্রেম। হয় বিয়ের আগে, নয়তো বিয়ের পরে। সেই একই তো কথা।’
সৌগত বলল, ‘জানি, সেটাও জানি। বিয়ের পরে ভালবাসা না টিকলে সেখানেও লবডঙ্কা। সবই জানি। সেই জন্যই তো এবারে একেবারে দেখেশুনেই বিয়ে করছি। একেবারে পার্মানেন্ট হিসেবে টিকে যাবে ও। তোকে গ্যারান্টী দিয়ে বলছি।’
দেখলাম শুক্লার থেকে নিজের বউয়ের ওপরেই ওর ভরসাটা এখন অনেক বেশী। কিভাবে আস্থা অর্জন করল ও, আমার জানতে ভীষন ইচ্ছে করছিল। সৌগত বলল, ভেবে দেখলাম, নিজের প্রেম করার থেকে বাড়ীর লোকজনের পছন্দমত বিয়ে করাই অনেক ভাল। তাছাড়া মেয়েটা সুন্দরী। স্বভাব চরিত্রও ভালো। অন্য মেয়েদের মত অত প্যাঁচালো নয়।’
সৌগত বলল, বিদিশাকে তো আলাদা করেই নেমতন্নটা করতে হবে। তুই বরঞ্চ ওকে একটা ফোন কর। বল সৌগত যাচ্ছে, তোমাকে বিয়ের নেমতন্ন করতে। এখন যদি যাই? বিদিশা বাড়ী থাকবে তো? তুইও আমার সাথে যেতে পারিস।’
বিদিশাদের বাড়ীর ল্যান্ডফোন নম্বরে বিদিশাকে তক্ষুনি পেয়ে গেলাম। সৌগতর বিয়ের খবরটা শুনে ও কিছুটা অবাক হল, আমাকে বলল, তুমি আসছ সাথে? তাহলে দুজনেই এসো। আমি বাড়ীতেই আছি।’
সেদিন বিদিশার বাড়ীতে আমার অবশ্য আর যাওয়া হয় নি। সৌগতর বাড়ী থেকে হঠাৎই তারকিছু পরেই একটা ফোন চলে এসেছিল। ওকে বেরিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। আমাকে বলল, বিদিশাকে আমি কার্ড পৌঁছে দেবো। তুই চিন্তা করিস না। বরযাত্রী হিসেবে তোদের জন্য আলাদা গাড়ীর ব্যবস্থা করেছি। সব কালকে ফোন করে তোকে বলছি। তুই, বিদিশা, শুভেন্দু সব একই গাড়ীতে যাবি। তোদের গাড়ীটা ঠিক আমার গাড়ীর পেছনে পেছনে থাকবে। তোদের কোন অসুবিধা হবে না। ব্যারাকপুরে বিয়ে। কলকাতা থেকে যেতে একঘন্টা মতন লাগবে।’
যতক্ষণ আমার কাছে বসেছিল সৌগত, কথায় কথায় এটাও আমাকে বলেছিল, ‘আমার কেন জানি না দেব, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি যেন একটা খুব ভুল করে ফেলেছি।’
ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কি ভুল করেছিস তুই?’
সৌগত সেই সময় মিনুর প্রসঙ্গটা তুললো। আমাকে বলল, ‘মিনুর জন্য তোকে বোধহয় সেই হ্যাপাটা এখনো পোয়াতে হচ্ছে? সেই ওর বোনকে গান শেখানোর ব্যাপারটা? ভীষন বেয়ারা মেয়ে। একবার কারুর পিছু নিলে, সহজে তাকে ছাড়তে চায় না।’
ওকে হেসে বললাম, ‘না না, সেতো কবেই আমি সেই পাট তুলে দিয়েছি। এখন আর ওর বোনকে গান শেখাতে যাই না। সেই প্রথম প্রথম কদিন গিয়েছিলাম, তারপরে যাওয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি।’
সৌগত বলল, ‘কলেজ ছাড়ার পরে আর মিনুদের বাড়ী আর যাসনি?’
ওকে বললাম, ‘শ্যামল মিত্রর এক ছাত্রের কাছে আমি কিছুদিন তালিম নিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল মিনুর বোন রীনাকে ওখানে পাঠিয়ে দেবার। কিন্তু মিনু রাজী হল না। গোঁ ধরে বসে থাকলো। আমার কি ওখানে যেতে আর ইচ্ছে করে? তুই তো বিদিশার ব্যাপারটা জানিস। ও পছন্দ করে না রীনাকে গান শেখাতে আমি যাই বলে। সেই শেষ দিন থেকে মিনুর প্রতি বিদিশার একটা বিতৃষ্মা। বিদিশা মিনুকে সহ্য করতে পারে না। নাম শুনলেই ক্ষেপে ওঠে। আমি যে মিনুর বাড়ীতে এখন যাই না। সেটা ওকে বললেও অবিশ্বাস করে ওঠে। বলে সত্যি বলছ তো? কি জানি তোমার কথা বিশ্বাস করলেও। মিনুকে আমার একদম বিশ্বাস হয় না।’
সৌগত বলল, ‘লাস্ট কবে গিয়েছিলিস মিনুর বাড়ীতে?’
আমি বললাম, ‘তাও নয় নয় করে মাস ছয়েক তো হয়ে গেল। এখন যাওয়া একদমই বন্ধ করে দিয়েছি।’
সৌগত বলল ভালো, এইজন্যই তো মিনুকে আমি বিয়েতে নেমতন্ন করতে চাই না। ওখানে বিদিশাও আসবে। মিনুকে দেখলে বিদিশা একেবারেই চটে যাবে। কি করতে কি করে বসবে মিনু। ওকে বোঝা খুব মুশকিল।’
সৌগত এরপরে চলে গেল। ভাবিনি মাস ছয়েক পরে হঠাৎই মিনুর আবার দর্শন পাবো। সেদিনই সন্ধেবেলা মিনুর হঠাৎই আবির্ভাব ঘটল আমার বাড়ীতে। সাথে ওর বোন রিনাকেও নিয়ে এসেছে। বেশ সেজেগুজে এসেছে মিনু। আমাকে বলল, দেব, তোর জন্য একবাক্স মিষ্টি নিয়ে এসেছি। রীনা খুব ভালোভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। তুই ওর গানের গুরু। ওকে ভাল করে আশীর্ব্বাদ কর।’
রীনা মাথা হেট করে, ঝুঁকে প্রনাম করল আমাকে। ওকে বললাম, ‘থাক থাক আর প্রনাম করতে হবে না। তা গান টান কি গাইছ? নাকি ছেড়ে দিয়েছে সব?’
রীনা ঘাড় নেড়ে বলল, এখনো গাইছি, ছেড়ে দিই নি এখনো। তবে আপনাকে খুব মিস করি। আপনি তো আর আমাদের বাড়ী আর আসেন না। আসুন না একদিন।’
ঠিক সেভাবে ওকে জোর দিয়ে বলার মতন আমার আর কিছু ছিল না। মিনু আমাকে পটানোর জন্য ওর বোনকে সাথে করে নিয়ে এসেছে, সেটাও বুঝতে পারলাম। পাছে আমি না বলে ফেলি, মিনু আগে থেকেই রীনাকে বলল, ঠিকই যাবে। তুই ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? এখন দেবদার সময়ের খুবই অভাব। দেবদার এখন অনেক দায়িত্ব। চাকরী করতে হবে। বিয়ে করে বউকে খাওয়াতে হবে। তোর জন্য ভাড়ী দেবদার দরদ? তবে তুই বলছিস যখন, ঠিকই যাবে। কি ‘দেব’ যাবি না?’
আমি রীনার সামনে মিনুকে সেভাবে কিছু বললাম না। শুধু বললাম, ‘যাব একদিন। এই সামনে সৌগতর বিয়ে। ওর বিয়েটা হয়ে যাক। তারপরে সময় করে একদিন যাব। তোমাদের বাড়ী যাবার পথে কলেজেও একবার ঘুরে আসব।’
মিনু জানতো, আমি শুধুই ওর বোনকে সান্তনা দিচ্ছি। যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই আমার। আমাকে বলল, সৌগতর বিয়েতে যাবি নিশ্চই? তোকে কার্ড দিয়েছে। কই আমাকে তো দিল না?’
আমি বললাম, ‘হয়তো পরে দেবে। এখনও অবধি আমাকে ছাড়া কাউকেই কার্ড দেয় নি ও।’
মিনু যেন পরিকল্পনা করেই এসেছিল। আমাকে বলল, ‘কাল বাড়ীতে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। তোকে কিন্তু আসতে হবে।’
হঠাৎ কিসের অনুষ্ঠান, কিছুই আমি জানি না। বেশ ভ্যাবাচাকা খেযে গেলাম। মিনু বলল, ‘আসলে রীনা ভালভাবে পাশ করেছে তো। তাই কজন বন্ধুবান্ধবদের বাড়ীতে ডাকছি। তুই ও আসবি, একটু আনন্দ আর হৈহুল্লোর হবে।’
আমি প্রায় মুখের ওপরেই না বলতে যাচ্ছিলাম। মিনু বলল, ‘কেন বিদিশা রাগ করবে তোর ওপর? আমি যদি ওকেও বাড়ীতে ডাকি।’
বেশ অবাক হলাম মিনুর কথা শুনে। বিদিশাকে ও বাড়ীতে আসতে বলবে। আর বিদিশাও ওর কথাশুনে একডাকে ছুটে যাবে। কখনোই সেটা সম্ভব নয়। মিনুকে বললাম, ‘শুধু শুধু বিদিশাকে কেন বলতে যাবি? ও তোর ওখানে যাবে না।’
মিনু একটা গম্ভীর মতন হয়ে গেল। আমাকে বলল, ‘তাহলে তুই আসবি তো?’
আমি বললাম, ‘কথা দিতে পারছি না। তবে চেষ্টা করব।’
রীনাকে নিয়ে মিনু একটু পরে চলে গেল। আমাকে বলে গেল, ‘রীনার কথা ভেবে অন্তত আয়। তোকে কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন তোকে আমার বাড়ীতে আসতে বলব না।’ রীনাও বলল, হ্যাঁ দেবদা আপনি এলে কিন্তু খুব ভাল লাগবে সবার।
আজ মনে পড়ে সেদিন কিন্তু মিনুর বাড়ীতে আমি গিয়েছিলাম। বিদিশা যাইনি। বিদিশাকে বলেই আমি মিনুর বাড়ীতে গিয়েছিলাম। মনে মনে একটু অসুন্তষ্ট হয়েছিল বিদিশা। ওকে বলেছিলাম। বোনটা ভালভাবে পাশ করেছে,তার জন্যই বাড়ীতে একটা পাটি দিচ্ছে মিনু। রীনা যদি আমাকে সেভাবে না বলতো, আমি হয়তো ওর বাড়ীতে যেতাম না।
পরের দিন মিনুর বাড়ীতে বেশ কিছু ঘন্টা আমি ছিলাম। ও কিন্তু একবারও বুঝতে দেয় নি ওর অভিসন্ধিটা। আমার কাছ থেকে বিদিশার ফোন নম্বরটা নিয়েছিল, বিদিশাকে ফোনও করেছিল, অথচ আমাকে বিদিশা সেকথা বললেও মিনু একবারও তা বলেনি।
বিদিশা ভাবতেই পারেনি, মিনু ওকে ফোন করবে। ফোনটা যখন করেছে, বিদিশার মা ধরেছিল। মিনু নিজের পরিচয় দেয় নি। বিদিশা এসে ফোনটা ধরতেই ওকে ঠেস মেরে বলেছিল, ‘কালতো দেব আসছে আমার বাড়ীতে। তুমি আসবে নাকি?’
আমাকে একনাগাড়ে কতকিছু বলে গেল বিদিশা। মিনুর বাড়ী থেকে ফেরার পর ফোন করে আমাকে বলল, ‘সখ মিটেছে তোমার? আঁশ মিটেছে? ধন্যি মেয়ে বাপু। এখনো তোমার পিছন ছাড়ে না।’
সেদিন বিদিশার মুখে ওই কথা শুনে মিনুর ওপরে আমিও খুব চটে গিয়েছিলাম। ভাবিনি আরো কত পরিকল্পনার জাল বিস্তার করে রেখেছে মিনু। তার কিছুদিন পরেই ঘটল আর একটি মারাত্মক ঘটনা।
সেদিন ছিল রবিবার। মা বলল, সোদপুরে আমার বড়মামার বাড়ীতে যাবে। বাড়ীতে রান্না সব করাই আছে। শুধু ভাতটা ফুটিয়ে নিলেই হবে। বিদিশাকে ফোন করলাম। বিদিশা বলল, ‘বাড়ীতে একা রয়েছ বলে আমাকে ডাকছ? কি করবে তুমি?’
আমি বললাম, ‘কেন এর আগে যখন একা ছিলাম, তুমি বুঝি কোনদিন আসোনি আমার বাড়ীতে? মা, এই একটু পরেই বাড়ী থেকে বেরোবে। তারপরে সারাদিন আমি শুধু একা। এই মূহূর্তে একজনকে আমার খুব দরকার। বিদিশা ছাড়া আর কারুর নাম এই মূহূর্তে মনে করতে পারছি না।’
বিদিশা বলল, ‘বাহ্ আমাকেও তো বলে বেরোতে হবে। রবিবারে বাড়ী থেকে বেরুচ্ছি। বাড়ীতে বললেই তো বুঝে যাবে। মা বাবা তো জেনেই গেছে, তোমার বাড়ীতে যাবার জন্য আমি সবসময় পা বাড়িয়ে রয়েছি।’
বিদিশাকে বললাম, ‘শোন বিদিশা। আমি তোমার সাথে ছাড়া আর কারুর সাথে তো প্রেম করিনা। ফুলশয্যার রাতে স্বামী যেটা তার স্ত্রীর সাথে করে, সেটা যদি এই ফাঁকা বাড়ীতে হয়ে যায় মন্দ কি? সুযোগকে কখনো পায়ে ফেলতে নেই। একা একা বাড়ীতে বসে তোমার স্বপ্ন দেখবো, অথচ তুমি আসবে না এটা কি কখনো হয়? কখন আসবে বলো। মা কিন্তু ঠিক এক ঘন্টা পরেই বেরুবে।’
বিদিশা ফোনেই বলল, ‘তুমি কি করবে আমাকে? বিয়ের আগেই ফুলশয্যা সেরে নেবে? দাঁড়াও মাসীমাকে আমি বলছি।’
ওকে বললাম, ‘দেখো সৌগত বিয়েটা সেরে নিচ্ছে। তোমার আমার বিয়েটাও হয়তো হয়ে যাবে আর কিছুদিনের মধ্যে। বিয়ের আগে ফুলশয্যার প্র্যাকটিশটা করে নিতে অসুবিধে কি? মা তো সেই সুযোগই আমাদের করে দিয়ে যাচ্ছেন।’
একটু যেন ঘাবড়ে গেল বিদিশা। আমাকে বলল, এই না। তারপরে কি থেকে কি হয়ে যাবে। মরি আর কি?ওসব সখটক তোমার পূরণ হবে না বাপু। বলোতো এমনি আমি যেতে পারি।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা বিদিশা? তুমি আসবে, আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। তোমার শরীর আমাকে ছুঁয়ে যাবে, আমার হৃদয়কে চঞ্চল করে তুলবে। সেই আশা নিয়েই তো আমি তোমাকে ডাকছি। তোমার কি মনে হয় না প্রেম মানেই একটা নিবিড় মূহূর্ত? যেখানে প্রেমের সাথে থাকবে একটু চুমোচুমি। নারীর সাহচর্য এক মধুর অনুভূতি। এর থেকে আমাকে কেন বঞ্চিত করছ বিদিশা? তুমি কি চাওনা মাঝে মধ্যে এই সখগুলো আমি পূরণ করি। মাঝে মধ্যে গোপণ খেলাটা খেললে অসুবিধা কি বিদিশা? তুমি এখুনি চলে এস। দেরী কোরো না।’
বিদিশা একপ্রকার নাই বলে দিল আমাকে। আমাকে বলল, ‘তোমার গোপণ খেলা আমি বার করছি। আজ তুমি জব্দ। বেশ হয়েছে। আজ বাড়ীতে একা থাকো। আমি আর যাচ্ছি না।’
একটু হতাশই হলাম। ভাবলাম, ঠিক আছে বিদিশা যদি না আসে, ঘুরতে ঘুরতে বিকেলবেলা ওর বাড়ীতেই চলে যাব। সময়টা কিছুটা হলেও অন্তত কাটবে। বিদিশা না থাকলে, কিছুই আমার ভাল লাগে না।
মা একটু আগেই বড়মামার বাড়ীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। ঘড়িতে তখন বাজে সকাল এগারোটা। সারাটা দিন বাড়ীতে বসে কি করব তাই ভাবছি। হঠাৎই দরজায় কলিংবেল। ছুটে গেলাম। ভাবলাম, বিদিশাই এসেছে বোধহয়। আমাকে চমকে দেবার জন্যই না বলেছে তখন ফোনে। আমার সাথে মজা করতে বিদিশাও খুব ভাল পারে।
দরজা খুললাম। দেখি বিদিশা নয়। সামনে মিনু দাঁড়িয়ে। এক গাল হেসে আমাকে বলছে। ‘চমকে গেছিস না? আসলে তোদের বাড়ীর খুব কাছেই একটা দরকারে আমি এসেছিলাম। ভাবলাম, একটু ঢুঁ মেরে যাই। আজ তো রবিবার। তুই নিশ্চই বাড়ী থাকবি। তা আমাকে ভেতরে আসতে বলবি না? নাকি দরজা থেকেই বিদায় করে দিবি।’
মিনু হাসছে। আর আমি ভাবছি, এ আবার অসময়ে কেন এল? কি মুশকিল, বিদিশাও যদি আবার এখন এসে পড়ে?কি হবে তাহলে?
মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়েই ওকে ঘরে ঢোকালাম। আমার মন বলছিল, হঠাৎ মিনুর আগমনটা উদ্দেশ্যপ্রনোদীত। মাঝে মাঝে এত ন্যাকামি করে মিনু, বিরক্তিতে গা জ্বলে যায়। ওর এই গায়ে ঢলানি স্বভাবটা আমি জানি, যতদিন কলেজে পড়েছি, মিনু আমার পিছু ছাড়েনি। এতদিন পরে গায়ে পড়ে এসে আবার মাঝে মধ্যেই আমার বাড়ীতে এসে হানা দিচ্ছে, এটা একধরণের ফন্দী ছাড়া আর কিছুই নয়। আগের দিন ও বাড়ীতে গিয়ে, পুনরায় ওর বোনকে গান শেখানোর জন্য ভীষন কাকুতি মিনতি করছিল মিনু। আমি একপ্রকার না ই করে দিয়েছি। রীনা একটু দূঃখ পেয়েছে, কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমি জানি, যতক্ষণ আমি রীনাকে গান শেখাব,মিনু এসে সামনে বসে থাকবে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে। চোখের পাতা পড়বে না। ওর ওই দৃষ্টিতে আমার ভীষন অস্বস্তি হবে। মনোসংযোগে চীড় ধরবে। বলা যায় না রেগেমেগে ওকে কিছু বলেও দিতে পারি। মিনু অবশ্য এসবে অভ্যস্ত। আমার কাছে না শুনেও সেই একপ্রকার আমার পায়ের উপরেই সে পরে আছে।
মনে পড়ে কলেজে যেদিন মিনুকে প্রথম দেখেছিলাম, ও একটা কালো রঙের শাড়ী পড়ে এসেছিল। বগল কাটা ব্লাউজ। শাড়ীতে যতনা ওকে আকর্ষনীয়া লাগছিল, তার থেকেও বেশি ঠিকরে পড়ছিল ওর নির্লজ্জ্বতা। মিনু বেশ ব্যাটাছেলেগুলোকে ধরে ধরে জবাই করতে পারে। কেন জানি না আমাকেও ও অত চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই সফল হয়ে দেখাতে পারল না। মিনুর বেশ আফশোসও হয়েছিল। বিদিশার জন্যই ওকে এই হারটা স্বীকার করতে হয়েছিল, তাতে অবশ্য ওর কোন দূঃখ নেই। রীনাকে গান শেখাতে রাজী হয়ে যাওয়াটা মিনুর কাছে একপ্রকার মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ার মতন। ঠিক দুদিন আগেই ও আমাকে এসে বলল, দেব, ‘আমার সন্মন্ধে অনেকে বাজে বাজে কথা সবাই বলছে, আমি কিন্তু এতটা নির্লজ্জ্ব নই। নিজের স্বার্থকে আমি কখনই বড় করে দেখিনা। তুই ভাবিস, আমি খুব খারাপ। তাই আমার বাড়ীতে তোর যেতে ইচ্ছে হয় না, তাইতো? আজ থেকে তোকে আমি কথা দিলাম। বিদিশা যেমনটি আছে, ঠিক তেমনটিই তোর থাকবে। আমি তোদের মাঝে আর মাথা গলাবো না।’
তাও মনটা ভীষন খুচখুচ করছিল। শেষে মেষে এই সৌগতই আমাকে ভরসা দিল। বলা যায় ওর কথাতেই শেষপর্যন্ত আমি রীনাকে গান শেখাতে রাজী হয়ে গেলাম।
সেই প্রথমদিন থেকে সপ্তাহে একদিন করে আমি মিনুর বাড়ীতে আমি যেতাম। একঘন্টা রীনাকে গান শেখাতাম। মিনু সামনে এসে বসে থাকতো। আমার গান শুনতো। কিন্তু আমার প্রতি ওর দূর্বলতার কথা কখনো আর বলেনি। কলেজের শেষ কটাদিন, আমার সাথে দেখা হলে শুধু কথা বলত। কিন্তু ওর হাবভাবে, ওর আচরণে সেরকম কিছু আমার চোখে পড়ত না।
কলেজ ছাড়ার দুমাস বাদে আমি যখন মিনুর বাড়ী যাওয়া বন্ধ করে দিলাম, তখন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বিদিশার আপত্তি ছিল, সে কথা আমি আগেই বলেছি। একদিন বিদিশা এল কলেজে মুখ ভার করে। আমার সাথে সেভাবে ভাল করে কোন কথা বলছে না। ভেতরে ভেতরে যেন কোন চাপা রাগ, রাগটা ঠিক আমাকে দেখাতেও পারছে না। অথচ আমি ধরেই নিয়েছি, ওর মনের মধ্যে আমাকে নিয়ে কিছু একটা শঙ্কা রয়েছে।
একটু জোর করতেই বিদিশা বলল, ‘তুমি প্রনব বলে কাউকে চেনো?’
আমি বললাম, ‘প্রনব বলে সেরকম তো আমি কাউকে চিনি না। সে কি আমাদের কলেজে পড়ে?’
বিদিশা বলল, ‘সেভাবে ওকে কোনদিন কলেজে আমিও দেখিনি। কালকে হঠাৎই তোমার সন্মন্ধে আমাকে উল্টোপাল্টা কথা বলল, আমার মনটাকে খারাপ করার চেষ্টা করছিল ছেলেটা। কে ও?’
ওকে বললাম, মুখ না দেখলে কি করে বুঝব? আর আমার সন্মন্ধে খারাপ কথা বলবেই বা কেন সে তোমাকে? কি করেছি আমি? কারুর ক্ষতি করেছি?
বিদিশা বলল, প্রথমেই সে আমাকে বলল, দেব তো গেল ফসকে। এবারে কি করবে তুমি?
আমি বিদিশাকে বললাম, মানে?
বিদিশা বলল, আমার ইচ্ছে করছিল ছেলেটার মুখের ওপরে একটা চড় কসাতে। সবকটা দাঁত বার করে আমার মুখের সামনে এমন বিশ্রীভাবে টোনটিটকিরি কাটছিল ছেলেটা। ভীষন রাগ হচ্ছিল। আমি ওর কোন কথা শুনতে চাই না। তাও জোর করে আমাকে বলল, ‘দেব তোমাকে নিয়েও খেলছে, আবার মিনুকে নিয়েও খেলতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত মিনুরই জয় হবে তুমি দেখে নিও। দেব শীগগীরই তোমাকে টা টা আর বাই বাই করে দেবে। সেদিনটা আসতে আর খুব বেশী বাকী নেই।’
আমি বিদিশার কথায় ভীষন অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। কে এই প্রনব বলে ছেলেটা? বিদিশাকে এই কথাটা বলার কারণই বা কি? মাথামুন্ডু কিছু ভেবে পেলাম না। শুভেন্দুকে ডাকলাম। শুভেন্দু এল। বলল, ‘আমি খবর নিয়ে দেখছি। কে এই প্রনব? দরকার পড়লে মিনুকেও জিজ্ঞাসা করছি। রহস্যটা খুঁজে বার করছি।’
সত্যি কথা বলতে কি, কলেজে আমার শত্রু সেরকম কেউ ছিল না। এখন বিদিশার প্রতি যদি কারুর দূর্বলতা থেকে থাকে, তাহলে সেটা অন্য কথা। আমি যেন বিদিশার কষ্টটা বুঝে ওকে আর সেদিন কিছু বললাম না। মনে হল, মিনুকে নিয়ে বিদিশার দ্বিধা এখনো কাটেনি। মিনু যখন কথা দিয়েছে, আমার প্রতি ওর দূর্বলতাটা আর নেই। তখন প্রনব বলে এই ছেলেটাই বা কেন বিদিশার কান ভাঙাতে যাবে। তাহলে কি মিনুই এই খেলাটা খেলেছে?
পরের দিন মিনু এল কলেজে। প্রথমেই এসে বলল, ‘প্রনব বলে আমি কাউকে চিনি না। আর এ কলেজের যে ছেলে নয়, তাকে এত গুরুত্ব দেওয়া কেন?’
আমাকে বলল, ‘বিদিশাকে এই পরের কথায় কান না দেওয়াটা বলে, একটু তুই বন্ধ কর। সবকিছুতেই তোকে আর আমাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি, আমারও বাপু সহ্য হয় না।’
মিনুর সঙ্গে তারপর থেকে বেশ কয়েকদিন কথা বলা আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। রীনাকেও গান শেখানো বন্ধ করে দিয়েছি। হঠাৎই একদিন আমার পায়ে ধরে আবার সাধা শুরু করে দিল মিনু। আমাকে বলল, যেটা সত্যি নয়, সেটা নিয়ে শুধু শুধু তুই পড়ে আছিস। খামোকা রীনাকেও তুই গান শেখাতে যাওয়া বন্ধ করে দিলি। আচ্ছা আমার কি দোষ বল তো? তুই যেন আমাকেই দোষী সাব্যাস্ত করতে চাইছিস। আমি কি প্রনব বলে ছেলেটাকে বিদিশার কাছে পাঠিয়েছি?
সেদিন বিদিশাকেও অনেক বুঝিয়েছিল শুভেন্দু। ‘এসব কথার কান দেওয়ার কোন দরকার নেই। দেব কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ, নিজে খুব ভালো বোঝে। যেদিন বুঝবে, মিনুর বাড়ীতে ও নিজে থেকেই যাওয়া বন্ধ করে দেবে। তুই কেন এসব কথায় কান দিয়ে মন খারাপ করছিস? কেন দেবের প্রতি কি তোর ষোলো আনা বিশ্বাস নেই?’
এতদিন বাদে সেই মিনুই আবার আমার বাড়ীতে আসা আরম্ভ করেছে। আমি না পারছিলাম ওকে দোড়গোড়া থেকে বিদায় করতে, না পারছিলাম মুখের ওপরে সরাসরি কিছু কটু কথা বলে দিতে। ঘরে ঢুকে প্রথমেই আমার ভুল ধারণাটা ভেঙে দিল মিনু। আমাকে বলল, ‘আমি কিন্তু তোকে আমার বাড়ী যাওয়ার কথা আর বলব না। একবার তুই আমাকে না করে দিয়েছিস। রীনাকেও না বলে দিয়েছিস, সুতরাং গান শেখানোর প্রসঙ্গ আর নয়।’
আমি বললাম, ‘তাহলে তুই হঠাৎ?’
মিনু বলল, ‘কেন তোর কাছে কি এমনি আসতে নেই?’
আমি বললাম, তাও কারণ তো কিছু একটা থাকবেই। সাত সকালে এসে হাজির হয়েছিস। তোর আসার কারণটা কি, খুলে বল।
মিনু বলল, ‘আমার কেন জানি না দেব, তোকে আমার মনের কথাটা বলতে খুব ইচ্ছে করে। এই ধর তোকে যদি আমি বলি, দেব তোকে আমার সেই আগের মতন পেতে খুব ইচ্ছে করে। তুই রেগে যাবি। আমি জানি তোর কানের লতিটাও তখন লাল হয়ে যাবে। প্রেমকে আঁকড়ে ধরে রাখার মতন আমার তো বিদিশার মতন রূপ নেই। যে তোকে বলব, বড় আশা করে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও। আমি আসলে খুব ভুল করেছিলাম। মানুষতো পদে পদে ভুল করে। ধরে নে তোর প্রতি আমার দূর্বলতাটা একপ্রকার ভুল।’
মিনুকে বললাম, ‘ছাড় না ওসব পুরোনো কথা। কি জন্যে এসেছিস তুই বল।’
মিনু বলল, ‘আমি না ঠিক তোর মতই আর একজনের প্রেমে পড়ে গেছি। আজ তোকে সেকথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে।’
আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মিনুকে বললাম, ‘শুনে খুশী হলাম। তা সেই ভাগ্যবান ব্যক্তিটি কে?’
মিনু বলল, ‘ছেলেটির চাউনির মধ্যে কী একটা অদ্ভূত আকর্ষন আছে জানিস তো। কিছু কিছু ছেলেদের চোখ থেকে এমন দুটি ঝরে পড়ে। মনে হয়, তারা যেন হৃদয়ের সবটুকু দেখতে পাচ্ছে। কথার মধ্যেও এক অদ্ভূত কুহক মায়া আছে। মনে হয় ও বুঝি এক জাদুকর। কেমন করে মেয়েদের মন চুরি করতে হয়, সে বিদ্যা ও শিখেছে সযত্নে।’
আমি বললাম, ‘এতদিন ধরে যে মিনুর প্রেমে সবাই পাগল। সেই মিনু কিনা কারুর প্রেমে পড়েছে। ব্যাপারটা তো ইন্টারেস্টিং। তা বিয়েটা কবে করছিস? আর ছেলেটিই বা কে?’
মিনু বলল, ‘বিয়ের দিনখনটা আমি তার উপরই ছেড়ে দিয়েছি। ওখানে আমার কোন তাড়াহূড়ো নেই। শুধু ছেলেটাকে একটা মেয়ে বড় জ্বালাচ্ছে। সে আমারই মতন তাকে ভালবাসে। এখন আমার প্রেমিক কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কাকে ছেড়ে সে কার কাছে যাবে? আমার কাছে না তার কাছে?’
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিনুর মুখটা তখন বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মনে মনে বললাম, এ আবার কি কথা?কাকে না কাকে পছন্দ করে বসে আছে, তাকে আবার অন্য একটি মেয়েও ভালবাসে। তারমানে আবারো সেই নিরীহ কোন ছেলেকে নিয়ে টানাটানি, মিনুর চক্করে পড়ে একটা ভালো ছেলের মাথানষ্ট। নিরীহ ছেলেটা জীবনটা নষ্ট হল, আর কি?
•
Posts: 122
Threads: 2
Likes Received: 175 in 85 posts
Likes Given: 578
Joined: Jun 2019
Reputation:
20
ওকে বললাম, ‘তোর মতলবটা কি বলতো? এতো আমার সাথে বিলকুল মিলে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। কার কথা বলছিস তুই?’
মিনু একগাল হেসে বলল, ‘কারো কথা বলছি নারে বাবা। ওফ, তোকে কিছু বলতে যাওয়াই মুশকিল। সবসময় কিছু একটা ধরে বসে থাকিস তুই। আমি তো এমনি বলছি।’
ভীষন বিরক্তি হচ্ছিল আমার। মনে হল, যতক্ষণ আমার ঘর থেকে ও বিদায় না হচ্ছে রেহাই নেই। কি করে যে ভাগাবো, সেটাও বুঝতে পারছি না। ও আমাকে বলল, এই দেব, চা খাওয়াবি?
আমি বললাম, ‘মা তো ঘরে নেই। তাহলে বস, আমি চা করে নিয়ে আসছি।’
কি বলতে কি বলে বসলাম, মিনুর দেখলাম, মুখটা বেশ খুশী খুশী হয়ে উঠল। মা’র ঘরে না থাকাটা ওর কাছে যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতন। উঠে আমারই পেছন পেছন চলে এল মিনু। আমাকে বলল, ‘তুই একা কেন চা করবি? চল আমিও তোকে সাহায্য করছি।’
আমার রান্নাঘরে যেখানে স্টোভটা রাখা রয়েছে, মিনু আমার পিছন পিছন ঠিক ওখানটাই এসে দাঁড়ালো। অস্বস্তি হচ্ছে আমার। একে মা ঘরে নেই। মিনু জ্ঞানহারা হয়ে হঠাৎ যদি কিছু করে বসে আমার আফশোসের শেষ থাকবে না। বেয়ারাপনা শুরু করলে আর এক কেলেঙ্কারী। সুযোগের সদ্বব্যবহার করতে মিনুর কোন জুড়ি নেই।
হঠাৎই পেছনে দাঁড়িয়ে মিনু বলল, ‘রীনার খুব মন খারাপ। তুই ওকে হ্যাঁ বলে আসিস নি। ও আর গান গাইবে না বলছে। রেওয়াজও বন্ধ করে দিয়েছে। বলছে, দেবদা যতক্ষণ না আমাকে আবার গান শেখাতে না আসছে, আমি আর হারমোনিয়াম ধরব না। এবার থেকে গান গাওয়া আমি ছেড়ে দিলাম।’
আমি বললাম, ‘দেখ, গান তো সেভাবে আমি কাউকেই শেখাই না। তুই জোর করেছিলিস, তাই রীনাকে গান শেখাতে আমি রাজী হয়েছিলাম। ওকে একটু বোঝানোর চেষ্টা কর। মাষ্টারের কি অভাব আছে? বেস টা তো ভালভাবে তৈরী হয়ে গেছে। তাছাড়া রীনার গলায় সুর আছে। গলাও মিষ্টি। আর আমি তো একজনের কাছে ওকে পাঠিয়েছিলাম। সেখানে যাওয়াই বা বন্ধ করে দিল কেন? থাকলে এতদিনে তো ভাল তৈরী হয়ে যেত।’
মিনু বলল, ‘আমি অনেক বুঝিয়েছি। কিছুতেই আমার কথা শুনছে না। তাই তো তোর কাছে ছুটে এলাম।’
মিনুকে এবার মুখের ওপর না ই বলে দিতে হল আমাকে। ওকে বললাম, আমাকে মাফ কর মিনু। আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমার মাথার উপরে এখন অনেক দায়িত্ব। তাছাড়া সময়েরও খুব অভাব। কথা দিয়েও যখন কথা রাখতে পারব না। তখন শুধু শুধু আস্বাস দিয়ে কোন লাভ নেই। আমি পারব না। কিছুতেই পারব না।’
হঠাৎই মিনু আমার হাতটা ধরল। ওর এই হাত ধরার মানেটা আমার কাছে পরিষ্কার হল তখনই, যখন মিনু বলল, তোকে একবার রিকোয়েস্ট করব। তুই একবার অন্তত আমার বাড়ী আয়। রীনাকে তুই ই বোঝা। আমার দ্বারা ওটা সম্ভব নয়।’
আমি মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু বরাতে যে আমার দূঃখ আছে। তখনো জানতাম না। কথায় বলে পৃথিবীর সব থেকে সুখী লোকও যেকোন মূহূর্তে দূঃখী বনে যেতে পারে। হঠাৎই বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে যাবার মতন মিনুকে বলে বসলাম, ‘কবে যেতে হবে বল? আমি গিয়ে বোঝাবো রীনাকে। আশাকরি ও নিশ্চই আমার কথা ফেলবে না।’
মিনুর সঙ্গে আমার ব্যবধানটা যতটাই বেড়েছিল, ঠিক ততটাই আবার কমে গেল সেই মূহূর্তে। ওর ওই আমন্ত্রণের মধ্যে যে একটা রহস্য আছে, তখনো আমি নিশ্চিত নই। ধরেই নিলাম মিনু সত্যি কথাটা বলছে। অন্তত রীনার কথা ভেবে মিনুর বাড়ীতে আমার যাওয়া দরকার।
মিনুকে চা করে খাওয়ালাম। একগাল হেসে মিনু বলল, ‘তোর ভারী ভয় শুধু আমাকে নিয়ে। এতই তুই বিদিশাকে ভালবাসিস, অন্যকোন মেয়েছেলের সংস্পর্ষেও আসতে চাস না। আরে আমরা তো ভাল বন্ধু হতে পারি না কি? মিনু নয় তোর ভালবাসার পাত্রী হতে পারল না। কিন্তু বন্ধু হতে চাইলেও তুই কি না করবি আমাকে? কেন বিদিশার কি ছেলেবন্ধু একেবারেই নেই?’
মিনুকে বললাম, ‘আগে হয়তো ছিল। কিন্ত আমার সঙ্গে প্রেম শুরু করার পর থেকে, যতদূর জানি, বিদিশার কোন ছেলেবন্ধু নেই।’
হো হো করে হেসে উঠল মিনু। আমাকে বলল, তোর সাথে শুক্লারও তো খুব ভাল দোস্তী ছিল। তা বিদিশা সেখানে কোন আপত্তি করেনি?
আমি বললাম, ‘শুক্লা নিজেই তো পরে সৌগতর সাথে প্রেম করেছে। আপত্তি থাকবে কেন? তাছাড়া শুক্লার সঙ্গে সেভাবে তো আমি কোনদিন মিশিনি। বিদিশা প্রথম প্রথম সেটা দেখে একটু অস্বস্তিতে ভুগলেও, পরে খুব সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া শুক্লা, বিদিশা দুজনেই ওরা খুব ভাল বন্ধু। খামোকা বিদিশা রাগ করতে যাবে কেন?
মিনু বলল, ‘এই আমিই কারুর ভাল বন্ধু হতে পারলাম না। তাই না? সবার দুচোখের বিষ হয়ে গেছি। আমার যেন কারুর কাছে মুখ দেখানোর আর জো নেই।’
মিনুকে বললাম, ‘এসব মন খারাপের কথা ছাড়। এবার তুই বল, তুই নিজে বিয়েটা কবে করছিস?’
একটা হতাশা আর আক্ষেপ নিয়ে মিনু যেন আমার মুখের দিকে তাকালো। আমাকে বলল, ‘আমি ভাবছি, এ জীবনে বিয়ে থা আর করব না।
আমি বললাম, কেন রে?
মিনু বলল, ‘আমার তো অনেক বদনাম আছে। বিয়ে করলেই কি বদনাম সব ধুয়ে যাবে? ওসব বিয়ে ফিয়েতে আমার বিশ্বাস নেই। ফটর ফটর করে কটা অজানা সংস্কৃত মন্ত্র পড়লেই কি সব হয়ে যায় নাকি? দাউ দাউ আগুনে হাত রাখলেই কী আর সতী হওয়া যায়? আমাদের এই মেয়েদের শরীরটাকে নিয়ে সব থেকে বড় জ্বালা, মনের অরণ্যে সবসময় জ্বলছে দাউ দাউ আগুন। তোরা যতই বলিস না কেন, মেয়েরা লজ্জ্বাবতী লতা। আমি তো বিশ্বাস করি না। বিধাতা আমাদের ওভাবেই তৈরী করেছে। বিশ্বে এমন কোন পুরুষ আছে কি যে আমাকে সেন্ট পার্সেন্ট খুশি করতে পারবে? আমার মনে হয়, কেউ বোধহয় এমনটা সুখী হয় না। সুখী সুখী মুখ করে বসে থাকে সব। এসব দের ন্যাকামি আমি পছন্দ করি না।’
ভাবছিলাম, আমার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে ওকে হয়তো বলে বসত, জিও বেটি হাজার সাল। তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক। তুই শালি ঠিক কথা জেনেছিস তো। সত্যি এই পৃথিবীতে এমন কোনো আখাম্বা দন্ড নেই যা মেয়েদের একশো ভাগ সুখি করতে পারে। তবুও তো তার মধ্যে সুখ খুঁজে নিতে হয়। এক দন্ড থেকে আর এক দন্ডে নিরন্তর পরিভ্রমণ করতে হয়। দেখতে হয় কে সব থেকে বেশি আনন্দ দিতে পারে।
মিনুকে দেখে আমার ওই মূহূর্তে তাই মনে হল। এ মেয়ে বিয়ে থা সত্যি আর করবে না। শুধু শুধু ঘনঘন বয় ফ্রেন্ড চেঞ্জ করবে।
ভাগ্যিস আমার কপালটা এরকম নয়। আমাকে নিয়ে বিদিশা ছেনাল খেলা খেলবে না কোনদিন। কিছুদিন খেলাটা চলল, তারপর এঁটো পাতার মতো তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল ডাস্ট বিনে। পরে দেখছি, কুকুরের কাড়াকাড়ি।
জীবন নাটকের পরবর্তী অধ্যায় যে শুরু হচ্ছে তার একটু পরেই, তখনো জানি না। মিনু একেবারে হাত পা ছড়িয়ে আমার সাথে বসার ঘরে সোফায় বসে কথা বলছে। ঠিক তখুনি শুনলাম, দরজায় কলিংবেলের শব্দ। চমকে উঠলাম। এই সময় কে এল?
দরজা খুললাম, দেখি বিদিশা দাঁড়িয়ে।
আমার হাট বিটটা একটু বেড়ে গেল। ওর মুখটা দেখে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ যেন ভূত দেখার মতন দেখছি। বিদিশাকে বললাম, ‘তুমি যে বললে বড় আসবে না? হঠাৎই চলে এলে? আমাকে তো জানালে না?’
চিরকালের যারা প্রেমিক প্রেমিকা হয়, জন্মজন্মান্তরেও যারা পরষ্পরকে ভালবাসে। ভগবান কখনো কখনো তাদের মধ্যে বাধার প্রাচীর তৈরী করে দেন। সেই মূহূর্তে বাঁধার প্রাচীরটি কে? সেটা অবশ্য বুঝতে অসুবিধে নেই। কিন্তু আমি চাইলেও, বিদিশা যেন সেটা মন থেকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারল না। ঘরে ঢুকেই আমাকে বলল, ‘মিনু এসেছে, তোমার কাছে, এটাতো তুমি আমাকে আগে বলো নি?’
মিনু ততক্ষনে বিদিশাকে দেখে ফেলেছে। ওকে বলল, ‘এই তো বিদিশা। এতক্ষণ তোমার কথাই হচ্ছিল। অনেক দিন বাঁচবে তুমি। এসো এসো ভেতরে এসো। কতদিন তোমায় দেখি না।’
বিদিশার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। মুখ তুলতে পারছে না। আমি ব্যাপারটা সহজ করে দেবার জন্য বললাম, ‘আসলে মিনু, রীনার জন্যই আমার কাছে এসেছে। রীনা খুব ঝেমেলা পাকাচ্ছে বাড়ীতে। গানটান সব বন্ধ করে দিয়েছে। ওকে আমি যতক্ষণ না বোঝাচ্ছি, মিনু বলছে কোন কাজ হবে না। রীনাকে বোঝানোর জন্য আমাকে একবার অন্তত যেতেই হবে।’
বিদিশা মুখ তুলে একবার আমার মুখের দিকে তাকালো। বুঝতেই পারলাম, কথাটা মনে ধরে নি ওর। যেন মিনুকে আমার ফ্ল্যাটে দেখে হঠাৎই ছন্দোপতন ঘটে গেছে। মনের মধ্যে জমে উঠছে অনিশ্চয়তার ইঞ্চি ইঞ্চি ধুলো। অথচ ওকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। মিনু আর কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসেনি। এসেছে শুধু রীনার জন্যই। বিদিশা হয়তো যেটা ভাবছে, সেটা ভুল।
ঠিক সেই মূহূর্তে মিনু হয়ে গেল বিদিশার কাছে বিভীষিকার মতন। হঠাৎ আমাকে বলে বসল, আমি তাহলে যাই? তুমি মিনুর সঙ্গে গল্প করছ, জানলে আসতাম না।’
মিনু খুব চালাক। সঙ্গে সঙ্গে ও উঠে পড়ল। বিদিশাকে বলল, ‘না, না, একি? তুমি যাবে কেন? এই তো এবার আমিই যাব। টাইম হয়ে গেছে। দেব তাহলে আমি আসি। টা টা বাই। তুই কিন্তু রীনার কথাটা মনে রাখিস। ভুলে যাস না।’
মিনুকে বিদায় দিয়ে আমি এবার বিদিশার মন ঠিক করতে পড়ে গেলাম। ওকে বললাম, ‘কি হয়েছে? মিনুকে দেখে খারাপ ভাবছ? আরে বাবা, আমি তো ওকে ডাকিনি। ও নিজেই এসেছে। হঠাৎ করে দরজা খুলে দেখি মিনু দাঁড়িয়ে। কি করব বল? ঘরে এসে বলল, রীনার জন্য আমাকে একবার নাকি যেতে হবে।’
বিদিশা বলল, এখন কি মনে হচ্ছে জানো? এই পৃথিবীতে আমি বুঝি আর সুখী নই।
আমি বললাম, ‘কেন এ কথা বলছ বিদিশা?
বিদিশা বলল, ‘সুখ নামের একটা সুখপাখীকে হৃদপিন্ডের মধ্য বন্দী করতে চাইছিলাম। সেই পাখিনী ভীষন চালাক। হঠাৎই খাঁচা খুলে ফুড়ুত করে উড়ে যেতে চাইছে নীল আকাশে।’
ভীষন খারাপ লাগল ওর কথা শুনে। বললাম, ‘কেন আমাকে অবিশ্বাস করছ বিদিশা? আমি তো সত্যি কথাই বলছি।’
বিদিশা বলল, ‘তোমাকে বলেছিলাম না। ওকে বেশী প্রশ্রয় দিও না। সাতঘাটে জল খাওয়া একটা মেয়ে। ওকে তুমি বিশ্বাস করো?’
আমি বললাম, ‘আমিও করি না বিশ্বাস। বলছি তো। ও নিজে থেকেই আমার কাছে এসেছে।’
বিদিশা বলল, ‘তাহলে কথা দাও, ওর বাড়ীতে কোনদিন যাবে না। ও ডাকলেও যাবে না।’
বিদিশাকে বললাম, কথা দিলাম।
বিদিশা বলল, ‘আমার মাথায় হাত রেখে বলো, সত্যি।’
আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, সত্যি, সত্যি, সত্যি। এই তিন সত্যি করলাম তোমার কাছে।’
হঠাৎ পুরোনো কথা চিন্তা করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের বারান্দাটায় এলাম। জানি মা ঘুমিয়ে পড়েছে। খাবারটা টেবিলে রাখা রয়েছে। আমাকে খেয়ে নিতে হবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চাঁদটা সরে গেছে। কোথা থেকে একরাশ মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিয়েছে। অসময়ের কুচকুচে কালো মেঘ। এ মেঘকে যে আমি এসময় দেখবো আশাই করিনি। বেচারী চাঁদ হবো হবো সন্ধে থেকেই দুহাতে দু মুঠো জোৎস্না ছড়িয়ে ছিল চারপাশে। চাঁদ বোধহয় অকালেই ঝরে পড়ল। মাঝরাতেই ঢলে পড়েছে চাঁদ। তাহলে কি আমার জীবনটাও তাই?-
মনে পড়ছিল, বিদিশাকে একদিন অনেক রাত অবধি একা পেয়ে একটা গান গেয়েছিলাম, ‘এখনি বিদায়, বোলো না। এখনো আকাশে চাঁদ জেগে আছে। কোন কথা তো এখনো হল না। এখনি বিদায় বোলো না।’
বিদিশা আমাকে বিদায় দিয়ে চলে গেল। আর যখন ফিরেই এল। সেই চাঁদটাকে কিন্তু আমি আর দেখতে পাচ্ছি না।
অসমাপ্ত
Posts: 861
Threads: 1
Likes Received: 802 in 508 posts
Likes Given: 3,199
Joined: Dec 2018
Reputation:
40
যা এরপর কি হলো দাদা ।।। গল্প টা খুব ই সুন্দর ।।।
Posts: 6,495
Threads: 21
Likes Received: 6,865 in 3,657 posts
Likes Given: 12,097
Joined: Feb 2020
Reputation:
237
এটা অন্যতম একটা সেরা উপন্যাস আর কাহিনীটাও আমার বেশ প্রিয়, কিন্তু দুঃখের বিষয় এটা অসমাপ্ত। লেখকের নাম " Lekhak"। উনি অনেক গল্পই এরকম অসমাপ্ত রেখে গেছেন, যেমন "সিরিজা "
•
Posts: 18,183
Threads: 471
Likes Received: 64,066 in 27,383 posts
Likes Given: 23,520
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,244
Xossip er bohu purono ekta classic galpo chilo eta.
LEKHOK suddenly disappeared. Felt very sad ...
|