Thread Rating:
  • 135 Vote(s) - 3.69 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Adultery পদ্ম নাগের বিষ
পর্ব ৭

আজ দু'দিন হল লেক টাউনের বাড়িতে ফিরে এসেছে পিকলু ও রমা। সুন্দরবনের বন্য প্রকৃতি থেকে ফেরা রমার কাছে দীর্ঘ পরিচিত কলকাতা শহর হঠাৎ করে নতুন মনে হচ্ছে। পরিবেশের কৃত্রিমতায় শ্বাস-প্রশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যাবে। পিকলু শুয়ে আছে তার ঘরে, দুপুরবেলাটা অবসন্ন কাটছে রমার। বড্ড ঘুম ঘুম ভাব, আজ রান্নাঘরেও ঢোকেনি ও। সকালে এক ডাক্তার এসে পিকলুকে দেখে গেছেন। একগাদা মেডিসিন লিখে দিয়ে গেছেন তিনি।
পীযুষ কলেজ বেরিয়ে যাবার পর, রমা সেই যে স্নান করে ঘুমিয়েছে আর উঠতে ইচ্ছে করছে না। চাঁপা এখন রান্নাঘরে। রান্না সেরে ও রমাকে ডাকতে রমার মধ্যে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল। বললে---বল, কি বলবি?

---বৌদি আমার কাজটা শেষ হছে। আমি চইললাম। দরজাটা লাগিয়ে লেন।

রমাকে অগত্যা উঠতে হল। বাইরে ভীষণ কড়কড়ে রোদ। কোলাপ্সিবল গেটটায় তালা এঁটে ছাদে এলো ও। পিকলুকে খাইয়ে দিয়েছে সেই সকালে। ছেলেটাও কেমন ঘুমোচ্ছে। ওকে ঘুম থেকে তুলে গা হাত মুছিয়ে দিল রমা। দু'দিন হল পিকলুর মুখে কিছু রুচছে না। তবু জোর করে খাওয়ালো ওকে। তারপর ওষুধ খাইয়ে ছেলের পাশে শুয়ে পড়ল।

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। সবসময় তার একটা ভয়, ডাক্তারের চিকিৎসায় পিকলু উঠে দাঁড়াবে তো! যে চিকিৎসা বিজ্ঞান কার্যত পিকলুর মৃত্যু নিশ্চিত বলেছিল, জ্ঞান ফেরাতে পারেনি, সেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভরসা করতে পারছে না রমা। ছেলের গালে হাত রাখলো সে। পিকলু চায় মায়ের দিকে ঘুরে শুতে। কিন্তু ওর পক্ষে নড়াচড়া করা সম্ভব নয়। রমাই পিকলুকে ঘুরিয়ে দিল নিজের দিকে। মায়ের আদর খাবার শিশুতোষ ইচ্ছে মাঝে মধ্যেই চেপে বসে ছেলেটার মাথায়।
রমা ঠিক ছোটবেলার মত করে পিকলুকে আদর করে ঘুম পাড়াতে লাগলো। ছেলেটার আঙুলগুলো একবার দেখে নিল সচল আছে কিনা। জ্ঞান ফেরার পর এটুকুই তো উন্নতি হয়েছিল, তার আগেই চলে আসতে হল ওদের।

পীযুষ কলেজের ক্লাস সেরে স্টাফ রুমে বসেছিল, চশমা এঁটে একটা মোটা বই খুলে। এখন পরপর দুটো ক্লাস তার নেই। তারপরের ক্লাসটা সেরেই বাড়ি ফিরবে। এরমধ্যে লাইব্রেরি থেকে সে বেশ কয়েকটা বই সংগ্রহ করেছে, যেগুলি মূলত প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসা সম্পর্কে। বিপ্লব আজ কলেজ আসেনি। ওর আজ ক্লাস থাকে না। হিস্ট্রির তথাগত বাবু, মুঘল আমল নিয়ে পিএইচডি করেছেন। ভারী রসিক মানুষ, আবার ধর্মভীরুও। বয়স রিটায়ার্ডমেন্টের দিকে। সবসময় গোঁফ রাখেন, একমাত্র মুঘল সম্রাট আকবরের নাকি গোঁফ ছিল, আর তাতেই তিনি প্রভাবিত হয়ে এমন আকবরসুলভ গোঁফ রাখেন। হাতে আবার গুচ্ছের আংটি। সবকটিরই নাকি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। পীযুষের পাশে বসে বললেন---ছেলে কেমন আছে মিঃ মৈত্র?

পীযুষ চশমার ওপর দিয়ে তথাগত বাবুকে দেখল। বললে----ভালো আছে অনেকটা।

তথাগত মুখার্জী কপালে হাত স্পর্শ করে বললেন---যাক, তবে ভালো খবর।

হাতের বইটা বন্ধ করে পীযুষ বললে---আচ্ছা, তথাগত বাবু, আপনি বলতে পারবেন আপনাদের হিস্ট্রিতে চরক, শুশ্রুত এঁরা যে চিকিৎসা করতেন তা মেডিসিনাল সায়েন্স, কবিরাজি নাকি তন্ত্রমন্ত্রও ছিল?

তথাগত মুখুজ্জে হাসলেন। বললেন---আপনি যুক্তিবাদী মানুষ, হয়ত সেসব গ্রহণ করবেন না। তবে হিস্ট্রিও আবার সোশ্যাল সায়েন্স, যুক্তিবিজ্ঞান ছাড়া গ্রহণ করে না। কাজেই চরক, শুশ্রুত এদের চিকিৎসা পদ্ধতির এই তন্ত্রমন্ত্র বিষয়টাকে ইতিহাস গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তাদের চিকিৎসা কেবল মেডিসিনাল সায়েন্সেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কবিরাজি, আয়ুর্বেদ কিংবা তন্ত্রমন্ত্রও ছিল। আয়ুর্বেদ বলে আজ যা জানেন তা আসলে কবিরাজি, প্রাকৃতিক ঔষধ, যোগ, ইউনানি, সিদ্ধা ও তন্ত্রমন্ত্রের একত্রিকরন। যা তখন আয়ুশ নামে পরিচিত ছিল।

পীযুষ বললে---আপনি বিশ্বাস করেন যে একজন মৃত প্রায় মানুষকে কোনোরকম শল্য চিকিৎসা, স্টেরয়েড, ড্রাগস, মেডিসিন, পেসমেকার, হার্ট কিংবা লাংস ট্রান্সপ্ল্যান্ট, ভেন্টিলেশন ইত্যাদি ইত্যাদি যা যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রযুক্তি ছাড়া বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব?

তথাগত মুখার্জী ঈষৎ হাসলেন। বললেন---আমরা এখন আমাদের চারপাশকে যেটুকু চিনি, তাতে হয়ত না। তবে কি জানেন মিঃ মৈত্র, আমি সম্রাট অশোকের সময়কার চিকিৎসা বিজ্ঞান বলতে পারি, যেখানে ঐতিহাসিক তথ্য সহ বলা যায় পারা যেত। এছাড়া মিশর ভ্রমণে আমি দেখেছি কিভাবে ফারাওদের সময়কালে চিকিৎসা হত, দেখলে আপনি চমকে যাবেন। আমি এক ফারাও বংশদ্ভূত স্বল্পবয়সী কিশোরের মমির ফরেন্সিক রিপোর্ট দেখেছি কায়রোতে। যেখানে বিষাক্ত ইজিপসিয়ান ভাইপারের কামড় খাওয়া এক কিশোরকে দীর্ঘদিন চিকিৎসার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখার নমুনা আছে। অদ্ভুতভাবে যে ভাইপার সাপটির সেকালে তো দূরের কথা আজও কোনো এভিএস নেই। সেই কিশোরের মৃত্যু অবশ্য যক্ষায় হয়েছিল, হয়ত স্বল্পবয়সীদের ধূমপানের প্রচলন ছিল বলে।

---এগজেক্টলি! এটাই বলতে চাইছি তথাগত বাবু। পীযুষ উঠে দাঁড়ালো। আমার ছেলের যে প্রাণ সংশয়ের পরিস্থিতি ছিল, যা খুবই ক্রিটিক্যাল। ফরচুনেটলি একজন বেদে প্রাচীন মেডিসিনাল চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে অনেকখানি সুস্থ করে তুলেছে।

হাসলেন তথাগত মুখুজ্জে। বললেন---আপনার এই কথা হয়ত অন্য কেউ বিশ্বাস করবে না বলেই কি আপনি বাকি কলিগদের মিথ্যে বলেছেন?

খানিক বিব্রত বোধ করল পীযুষ। সত্যিই তো, সে কি করে বলবে তার ছেলের জীবন বাঁচিয়েছে একজন গেঁয়ো অশিক্ষিত বেদে! তাই তাকে বলতে হয়েছে; সাউথে তার বন্ধু চিকিৎসকের তত্বাবধানে থেকেই পিকলুর উন্নতি হয়েছে। অবশ্য তথাগত মুখার্জী মানুষটা একটু অন্যরকম। পীযুষের বিব্রত বোধ কমিয়ে বললেন---মিঃ মৈত্র, আমি কিন্তু আপনার কথাগুলো বিশ্বাস করছি। এবং গোপনও রাখছি। কোনো জনজাতি কেবল তার পেশার ওপর নির্ভর করেই টিকে থাকতে পারে। বনজ শবররা কাঠুরে হয়। জঙ্গল কমছে, জঙ্গলের ওপর অধিকারও কমছে ট্রাইবাল মানুষদের। ফলত অনেক ট্রাইবগুলির মধ্যে শবর জনজাতি সবচেয়ে সঙ্কটাপন্ন উপজাতি। একই চিত্র আপনি টোটো, লেপচাদের ক্ষেত্রেও দেখতে পাবেন। কিন্তু বেদেরা আজও টিকে আছে খুব ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে হলেও। ভবঘুরে বাসস্থানহীন, কোন আধুনিক পেশাহীন এই মানুষগুলোর কমিউনগুলি কত আগে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কোনোদিন সারা বিশ্বে কোনো জনজাতির মধ্যে দেখেছেন সাপ ধরায় এমন অপূর্ব প্রাকৃতিক দক্ষতা? জার্মানিতে আছে বটে একটি প্রাচীন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বেদে জনজাতি, তাছাড়া আর কোথাও তেমন নেই। আপনি যা পাবেন এই ভারত উপমহাদেশেই। এদের এই অপূর্ব দক্ষতা কি কেবল মন্ত্র তন্ত্রে? এরা আসলে সাপেদের খুঁটিনাটি চেনে ওদের মত করেই। সেটাও বিজ্ঞান। যা হয়ত আপনার মতো জীববিজ্ঞানীকে বুঝতে অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। হয়ত বেদেরা যা জানে না, তা যেমন আপনারা জানেন, তেমন আপনারা যা জানেন না, বেদেরা জানে।

পীযুষদের স্টাফ রুমে সিগারেট ধরানোর অনুমতি লাগে না। ও তথাগত মুখুজ্জের হাতে একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে নিজে ধরালো। তারপর হেসে বললে----আমার হাতে এই বইটা দেখছেন। এটা আমার স্ত্রী'র নৃতত্বের মাস্টার ডিগ্রির বই। নোম্যাডস বা যাযাবরদের জীবন শৈলীর কথা যেমন আছে, তেমন এতে ওদের কিছু যাগযজ্ঞ পদ্ধতির বিষয়ে উল্লেখ আছে। তবে যাযাবররা কখনো ক্যানিবালিজম, হলোকাস্ট এসব করেনি।

তথাগত বাবু ধোঁয়া ছেড়ে বললেন---নোম্যাডসরা ভীষণই মানবিক চরিত্রের হয়। ওরা অপরের প্রতি; এমনকি ভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতিও সদয় হয়। আবার গোঁড়াও হয়। ফলত যাযাবরদের মূল স্রোতে আনা কঠিন হয়ে পড়ে। আমার খুব মনে আছে মিঃ মৈত্র, আমাদের বাঁকুড়া জেলার শালতোড়ার মাঠে প্রায়শই গাজনের সময় যাযাবর বেদেদের দল আসতো। ওরা অনেক ওষুধ পত্র বিক্রি করত। সাপের খেলা দেখাতো। দড়ির ওপর শিশুদের হাঁটিয়ে পয়সা উপার্জন করত। গ্রামীন প্রান্তিক মানুষগুলো ঐ ওষুধ কিনেও নিত ভিড় করে। আমার মা'ও ঠাকুমার বাতের ব্যথা কমাতে ঔষধ কিনেছিলেন। বাতের ব্যথা যে সম্পূর্ন সেরে গেছিল এমন নয়, তবে ঠাকুমা বলতেন বেশ উপশম হয়। একে আপনি কি বলবেন? এ কি প্রাচীন ভারতীয় মেডিসিনাল সায়েন্স নয়!

পীযুষ তথাগত বাবুর কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে লাগলো। একটা কৌতূহলী মন তাকে জাগিয়ে রাখছে বারবার। তথাগত বাবুর দেশবাড়ী বাঁকুড়ার প্রসঙ্গে হঠাৎ করে একটা কথা মনে পড়ল পীযুষের। ডঃ পার্থপ্রতীম মাহাতো বাঁকুড়ার এক কিশোরের ঠিক পিকলুর মত সাপে কাটার কথা বলেছিলেন। তার চিকিৎসা কোথায় হয়েছিল বলতে পারেননি ডঃ মাহাতো। ক'দিন আগে রমাও বলেছিল ঐ শম্ভু বেদের বাবা ভীমনাগ যেন কি নাম, তাঁর কাছে বাঁকুড়া থেকে একজন রোগী এসেছিল এমন সাপে কাটা নিয়ে। ব্যাপারটা যে মিলে যাচ্ছে, আগে কখনো পীযুষ ভাবেনি। সবকিছুই স্ট্রেঞ্জ ঠেকছে পীযুষের। আবার ঐ বেদের চিকিৎসার ওপর আস্থাও দৃঢ় হচ্ছে। মনে মনে ঠিক করল সময় করে একবার ডঃ মাহাতোর সাথে এই বিষয়ে কথা বলবে।
++++++
[+] 11 users Like Henry's post
Like Reply


Messages In This Thread
পদ্ম নাগের বিষ - by Henry - 21-10-2023, 11:21 PM
RE: পদ্ম নাগের বিষ - by Henry - 02-12-2023, 11:26 PM



Users browsing this thread: 4 Guest(s)