Thread Rating:
  • 135 Vote(s) - 3.69 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Adultery পদ্ম নাগের বিষ
#2
পদ্ম নাগের বিষ
[Image: 8c1c078c-f9b8-4313-84b0-119218575b7a.png]
24 images

পদ্ম নাগের বিষ (১৮+)

প্রেম রহস্যময়। প্রেম উতল হওয়া, প্রেম অতল সমুদ্র। প্রেম বয়স, সময় কিছুই মানে না। কখন যে আসে কেউ কি জানে। প্রেম বৈধ, প্রেম অবৈধ। শরীরবিহীন প্রেম? সে তো সোনার পাথরবাটি। প্রেম হতে পারে বিষময়, হতে পারে অমৃত সুধা। প্রেমের এমনই দ্বিচারিতা। প্রেম মনস্তাত্বিক, প্রেম বিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন, প্রেম আধ্যাত্মিক ঈশ্বরের দান। প্রেম কখনো উচ্চকিত নয়। সে তো কখনো গোপন দাসত্ব, কখনো উন্মুক্ত, স্বাধীন।

পর্ব ১

'হারপেটোলজি' শব্দটি শিক্ষিত বাঙালির জীবনে খুব একটা পরিচিত নয়। যার মানে দাঁড়ায় সরীসৃপ ও উভচরদের উপর অধ্যয়ন। জীববিজ্ঞানের শাখায় এই হারপেটোলজিস্টদের কাজ হল নানাবিধ সরীসৃপ প্রাণী যেমন কুমির, গিরগিটি, স্যালামান্ডার, গোসাপ, ব্যাঙ ও সাপেদের উপর গবেষণা করা। ডঃ পীযুষ মৈত্র পেশায় একজন জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও, তার গবেষণার বিষয় এই সরীসৃপ প্রাণী। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পীযুষ যখন এই বিষয়টিকে বেছে নেয় সকলে অবাক হয়েছিল। বিশেষ করে পীযুষের মা। ছেলে কিনা বিষাক্ত সাপ, ব্যাঙ নিয়ে গবেষণা করবে; এটাতে শঙ্কিত হয়েছিলেন তিনি। পীযুষের বাবা ছিলেন প্রচন্ড বিজ্ঞানমনস্ক। বাবার প্রশ্রয় খানিকটা পেলে মা আর বাধা দিতে পারেননি।
আজ পীযুষ খানিকটা ক্লান্ত অনুভব করছিল। চেন্নাইতে চন্দ্রবোড়ার হেমাটোটক্সিন বিষের বিষয়ে দুদিনের এক সেমিনার থেকে গতকাল রাতে ফিরে আজ কলেজ জয়েন করতে হয়েছে। স্টাফরুমে ফোনটা চার্জে বসিয়ে ক্লাসে গেছিল পীযুষ। ফিরে দেখল চারটে মিসডকল। রমা ফোন করেছিল। আজ শুক্রবার, শুক্রবার আবার একটু বেশিই ক্লাস থাকে পীযুষের। কি আবার দরকার পড়ল, যে চারবার ফোন করল রমা। রমা সচরাচর পীযুষ কলেজে থাকাকালীন ফোন করলে ছুটির সময়েই ফোন করে। তবে এমন চারটে মিসড কল কেন!

ফোনটা রিসিভ করেই রমা তড়িঘড়ি বলে উঠল---ক্লাসে ছিলে? ফোন করলাম এতবার।

---লাস্ট পিরিয়ড, অনার্সের ছিল। বলো।
কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে পার্কিং লটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল পীযুষ।

---বারাসত থেকে মিঠুদি'রা এসেছে। তোমার সঙ্গে দেখা করে যাবেন। আসার সময় একটু মিষ্টি কিনে এনো। বয়স্ক মানুষ, নিশ্চই সুগার ফ্রি খান। আর হ্যা ফ্রিজ ফাঁকা, আজ সকালে তো বাজার গেলে না। দেখো আমি হোয়াটস অ্যাপে লিস্ট করে দিয়েছি।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল রমা। পীযুষ অবশ্য এতক্ষণ জিজ্ঞেস করবারই সুযোগ পেল না এই মিঠুদিটা কে, তার আগেই ফোনটা কেটে দিল ও। হবে হয়ত রমার কোনো মাসতুতো-পিসতুতো দিদি। রমার অবশ্য নিজের বলতে এক দাদা। সেও অবশ্য বিদেশি মেমকে বিয়ে করে নিউ জার্সিতে সেটল। ঐ ফোনে যতটুকু যোগাযোগ রাখে। আর রমার এক বোন ছিল, ও নাকি ছোটবেলাতেই মারা গেছে। তবে বারাসত জায়গাটা খটকা লাগছে পীযুষের। ওখানে তো রমার কোনো আত্মীয় থাকার কথা নয়।

হোয়াটস অ্যাপ দেখার সময় হয়নি পীযুষের। স্মার্ট ফোন ব্যবহারে রমা মোটেই দক্ষ নয়। পিকলু শিখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে হোয়াটস অ্যাপ করতে হয়। আর তারপর থেকেই এটা এনো, ওটা এনোর লিস্ট পীযুষের মোবাইলে দিয়ে যায় রমা। পীযুষের ব্যাপারটা মন্দ লাগে না। রমার হোয়াটস অ্যাপ করবার মত তিনজন রয়েছে। তার মধ্যে একটা পিকলু, একটা ওর প্রবাসী দাদার মেয়ে ঐন্দ্রিলা, অপরটা পীযুষ। এর মধ্যে আবার যত মেসেজ ওর পীযূষকেই। তবে ওতে ভালোই হয়, লিস্ট দেখে বাজার থেকে সব ঠিকঠাক জিনিস কিনে নিয়ে যেতে পারে পীযুষ। নাহলে তো প্রায়শই দিন এটা ওটা ভুল হত। তখন আবার জামাকাপড় না ছাড়তেই থলে হাতে বেরোতে হত।

কলেজের মেইন গেটের বামদিকে পার্কিং লট। কয়েকটা গাড়ি এমন এলোমেলো করে লাগানো থাকে যে পীযুষকে গাড়ি বার করতে বেগ পেতে হয়। ফাইভ সিটার নীল আইটেন গাড়িটা ও নিজে চালায়। আসলে অন্যসব ব্যাপারে রমা খুঁতখুঁতে হলেও, গাড়ির ব্যাপারে ভীষন খুঁতখুঁতে পীযুষ। নিজে একসময় সাইকেলটুকু চালাতে পারতো না। ক্লাস টেন পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল হোস্টেলে থেকেছে। ওর জ্যাঠা সুবোধ রঞ্জন মৈত্র ছিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের শিক্ষক। একদিকে জ্যাঠার কড়া অনুশাসন, অপর দিকে হোস্টেলের বইমুখো কৈশোর পর্যন্ত বহিঃ জগতের কিছুই শেখা হয়নি ওর। বাবা অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন, পরে ছেলেকে দাদার থাবা থেকে বার করে কলকাতা নিয়ে চলে আসেন। বাবা প্রাণরঞ্জন মৈত্র ছিলেন হাইস্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক। দাদা সুবোধ রঞ্জনের ঠিক উল্টো ছিলেন প্রাণরঞ্জন। যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমুখী, শিক্ষক আন্দোলনের নেতাও ছিলেন পীযুষের বাবা। তারপর পীযুষ যখন কলেজে তখন অকস্মাৎ তিনি মারা গেলেন। কলকাতায় তখন ওরা ভাড়াবাড়িতে থাকতো। লেকটাউনে জমিটা কিনলেও বাড়িটা করতে পারেননি প্রাণরঞ্জন মৈত্র। অবশেষে পীযুষের চাকরী, বাড়ি, বিয়ে সব কেবল মা'ই দেখে গেলেন। বাবা সেসব দেখে যেতে পারেননি।

কলেজে অধ্যাপনা হয়ে গেল প্রায় সতেরো বছর। এর বেশিরভাগ সময় পীযুষ বাসে কিংবা ট্যাক্সিতেই কর্মস্থলে এসেছে। কিন্তু ইদানিং দু' বছর হল ধকলটা আর সইতে পারা যাচ্ছে না। তাছাড়া কলকাতা শহরে যানজটে বাস বা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে পড়লে রক্ষে নেই। ইতিমধ্যেই একবছর হল গ্যাস অম্বলের সমস্যা দেখা দিয়েছে পীযুষের। ডাক্তারের নির্দেশে খানিক ধূমপান কমাতে হয়েছে।
একটা গাড়ি কেনার শখ ছিল ওর প্রথম থেকেই। কিন্তু বাধ সাধত রমা। ওর মতে খালি খালি টাকা খরচ করে এখন গাড়ি কেনার কি দরকার। পীযুষের কলিগদের মধ্যে হিস্ট্রির তাপস সবচেয়ে কম বয়সী। ইতিমধ্যেই দু দুটো গাড়ি কিনেছে। সেক্ষেত্রে পীযুষের চাকরী হল সতেরো বছর। একটা দামী না হোক, চলার মত গাড়ী দরকার ছিল। রমার কথা অমান্য করেই পীযুষ গাড়িটা কিনে ফেলল একদিন।
গাড়ির বিষয়টা ভালো বোঝে পীযুষের কলিগদের মধ্যে ঘনিষ্ট রসায়নের বিপ্লব মজুমদার। বিপ্লব পীযুষেরই বয়সী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওরা দুজনে একই বছরই মাস্টার্স করেছে। বিপ্লবই বলেছিল হুন্ডাই এর আইটেনটা মন্দ নয়। আর এই নীল রঙটা রমার পছন্দের রঙ। প্রথম দিকে একটা বিহারী ছেলেকে ড্রাইভারও রেখেছিল পীযুষ। একে তো কামাই, তার ওপরে ড্রাইভারের ওপরে নিজের গাড়ির ভার ছেড়ে দেওয়া পছন্দ নয় পীযুষের। নিজে শিখে নিয়েছিল ড্রাইভিং। এরপর গত দেড় বছর ও নিজেই ড্রাইভিং করছে। ছোটখাটো এক আধবার ঠোকাঠুকি ছাড়া তেমন কখনো কিছু ঘটেনি এখনো। তবু রমা পীযুষের এই গাড়ি চালানোটায় বড্ড ভয় পায়।

লেক টাউনের বাজারটা বেশ বড় নয়। নিকটে গলি রাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা নেই। পীযুষ বরং হেঁটে যাওয়াই পছন্দ করে। যশোর রোডের ধারে গাড়ি পার্কিং করে হাঁটা দিল। সামনে উৎপলের গুমটি দোকান দেখেই মনে পড়ল সিগারেটের প্যাকেট নেবার কথা। উৎপল হে হে করে হাসিমুখে বললে---স্যার, অনেকদিন পর। ভালো আছেন?

পীযুষ হেসে বললে---ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? তোমার মেয়েটি কলেজে ভর্তি হল।

---আজ্ঞে, হ্যা স্যার। ঐ ইংরেজীতে অনার্স নিয়ে। গোল্ড ফ্লেক তো?

পীযুষ টের পেল মেয়ের কলেজে অনার্স নিয়ে পড়ার বিষয়টি বলবার সময় উৎপলের মুখে বেশ একটা আনন্দঘন উত্তাপ। এই আনন্দ পিতার অহংকারের। স্বাভাবিকই এই গরীব মানুষগুলো যেখানে হয়ত কোনোদিন স্কুল-কলেজের মুখ দেখতে পারেনি, সেই তাদের ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করলে এমন আনন্দতো হবেই।

---কোন কলেজে?

---জয়পুরিয়া স্যার।

---সে তো অনেক দূর।

উৎপল পীযুষের হাতে এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক দিয়ে বললে---কি আর করা যাবে স্যার। সব জায়গায় যে পরিমান টাকা লাগে। কাউন্সিলর সাহেব পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে ওখানে ভর্তি করে দিলেন।

পীযুষ সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে রেখে বললে---দু প্যাকেট দিও।
নিজের কলেজেও ভর্তির এই ঘুষঘাষের খবর পীযুষের কানেও আসে। অধ্যাপকদের কিছু করার থাকে না। পলিটিক্যাল পার্টির কথাতেই সব চলে। তবু ভালো উৎপল মেয়েটার পড়া বন্ধ করে দেয়নি।

উল্টো দিকে জটলা পাকিয়ে দাঁড়ানো কয়েকটা বখাটে কম বয়সী ছেলে ঠাট্টা মস্করা করছে। রাস্তা দিয়ে এক সালোয়ার পরিহিতা ভদ্রমহিলা হেঁটে যেতেই শীষ দিয়ে উঠল একটা ছেলে। কটূক্তি ভেসে এলো---কি ঠাসা মাইজোড়া মাইরি, দেখলেই হাত নিশপিশ করে।
ভদ্রমহিলার কথাটা কানে গেল কিনা বোঝার উপায় নেই। ভ্রূক্ষেপ না করেই তার বছর দশেকের ছেলের হাত ধরে পাশ কাটিয়েই চলে গেলেন।

আজকাল রাস্তাঘাটে বাসে ট্রেনে মহিলাদের প্রতি এমন কটূক্তি হামেশাই হয়। বিরক্তি উৎপাদন হলেও কিছুই করার থাকে না। এই বৃহত্তর কলকাতা শহরে যে যার পরিবার ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যাস্ত। কেবল আপন স্ত্রী সন্তানকে নিরাপদে রাখাটাই সকলে দায়িত্ব মনে করে। ঠিক যেমন এই মুহূর্তে পীযুষ এবং উৎপল উভয়ের কানে গেলেও তারা কেবল মুখ চাওয়াচায়ি করে নীরব থাকলো। যদিও এই রাস্তায় মাঝে মধ্যে পুলিশকে পেট্রোলিং করতে দেখে যায়। তবু এমন ইতরতা এর আগেও নজরে পড়েছে পীযুষের। আসলে পীযুষ বোঝে নৈতিকতা সবসময় সাহস যোগায় না। সাহস জোগালেও সব সময় তা ক্ষমতার আয়ত্তে থাকে না।

মাছের বাজারের দিকটা বেশ কাদা। কলেজ থেকে সরাসরি ফেরত বুট মোজা পরে বাজার করলে কাদা জড়ে যায়। কাছে একটা মল আছে। মলে ট্রলি বয়ে বাজার করার চেয়ে পীযুষের মাছ টিপে কেনা বড্ড পছন্দের। এসব বাবার কাছ থেকে শেখা সেই কৈশোর থেকে। বাবা মারা যাবার পর মা ছেলের সংসারে পীযুষকে বাজার করতে হত। তখন সংসার চলত মায়ের প্রাপ্তি বাবার পেনশনের টাকায়। জ্যাঠা কিছু পাঠাতেন অবশ্য। কিন্তু প্রাণরঞ্জনের মৃত্যুর দেড় বছরের মাথায় হঠাৎ স্ট্রোকে চলে গেলেন সুবোধ রঞ্জনও। পীযুষ তখন কলকাতা নিবাসী এক দক্ষিণ ভারতীয় জীব বিজ্ঞানীর আন্ডারে পিএইচডি করছে। ছেলে সাপখোপ নিয়ে গবেষণা করে, ভবিষ্যৎ নিয়ে আর পাঁচজনের মত সন্দিহান ছিলেন পীযুষের মা'ও। একসময় তো পীযুষের মা ভেবেছিলেন লেক টাউনের এই জমিটা বেচে দেবেন। অবশ্য কিছুদিনের মধ্যেই অধ্যাপনার চাকরিটা পেয়ে গেল পীযুষ। আসলে পীযুষের চাকরিটা এমন দ্রুততার সাথে হয়েছিল রমাকে খবর দেওয়া যায়নি। এদিকে রমার বাবাও রমার বিয়ে দেবার জন্য অস্থির সে সময়। আসলে রমাদের পরিবারের রীতি নাকি মেয়েদের বেশিদিন বাড়িতে বসিয়ে রাখতে নেই। রমা তখন নৃতত্বে মাস্টার্স করছে। একদিন ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে নিয়ে হুট করে চলে এলো পীযুষদের ভাড়া বাড়িতে। পীযুষের মা আগে থেকেই জানতেন ওদের সম্পর্কটা। বুঝিয়েবাঝিয়ে বাড়ি পাঠালেন রমাকে, সেই সঙ্গে রমার পিতাকে চিঠি লিখেছিলেন পীযুষের মা। তখন পীযুষ চাকরীতে জয়েন করেছে। কাজেই রমার বাবার আর আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু এই সাপখোপের ব্যাপারটায় মৃদু আপত্তি ছিল রমার পিতা অর্ধেন্দু রায়ের।

রমা দুর্গাপুরের মেয়ে। যখন বিয়ে হয়ে এলো তখনও পীযুষদের ভাড়া বাড়ী। রমার বাবা দূর্গাপুরে ডাক বিভাগে কর্মরত ছিলেন। মোটামুটি অবস্থাপন্ন বাড়ি। তিন ভাইবোনের মধ্যে রমার দাদা ছিল অত্যন্ত মেধাবী। বিদেশে গবেষণার কাজে গিয়ে সেটল হয়ে গেল। এক কানাডিয়ান মেয়েকে বিয়ে করার পর মাস মাইনে পাঠানো ছাড়া আর কোনো যোগাযোগ থাকলো না বাড়ির সাথে। রমার মা এতে সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলেন। ছেলেকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন তিনি। এছাড়া রমার বোন সুষমার ক্লাস সিক্সে পড়বার সময় ক্যানসার ধরা পড়ে। মাত্র এক বছরের মাথায় চলে যায় ও। সেই ক্ষত তো ছিলই, তারপর ছেলের এমন বিদেশে বসতি মানতে পারেননি নরম মনের মহিলা রমার মা। রমার মায়ের মৃত্যুর পর রমার জন্য পাত্র দেখার তোড়জোড় শুরু হল। তখন রমা আর পীযুষের প্রেম প্রায় সাড়ে তিন বছর গড়িয়েছে। রমার রঙটা ফর্সা, পীযুষেরই মত। বরং পীযুষের চেয়ে বেশি। মুখে একটা কোমল লাবণ্য আছে। যেটা পীযুষের মায়ের প্রথমদিনই মনে ধরেছিল। কিন্তু পীযুষের চাকরী না হওয়ায় বাবার কানে কথা তুলতেই পারছিল না রমা। বাড়িতে একমাত্র দাদার কাছেই সব কথা বলতে পারতো সে। সেই দাদা কিনা এখন বিদেশে নিজ জীবনে ব্যস্ত। তারপর একদিন চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল রমা। কাউকে না বলে বাড়ি ছাড়ল।

কলকাতায় পীযুষের বাড়িতে এর আগেও বহুবার এসেছিল রমা। ওরা তখন শ্যামবাজারে ভাড়াবাড়িতে থাকতো। পীযুষের মা ছিলেন আশ্চর্য রকমের একজন শান্ত বুদ্ধিদীপ্ত নারী। রমাকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু চাকরীর কথাটা পীযুষের ইচ্ছেতেই লুকিয়েছিলেন পীযুষের মা। পীযুষ আসলে রমাকে চমকে দিতে চেয়েছিল। বাবার কাছে চিঠিতেই জানতে পারলো রমা, পীযুষের চাকরীর কথা। বড্ড রাগ হয়েছিল সেদিন রমার। যে সুখবরটার জন্য সে এতদিন অপেক্ষায়মান তা'ই কিনা লুকোলো পীযুষ ওর কাছে। বিয়ের দিন পর্যন্ত সেই অভিমান ছিল রমার। বিয়েটা ওদের দুর্গাপুরেই হয়।
লেক টাউনের জমিটার ওপর বাড়িটা গড়ে তুলতে আরো সাড়ে তিন বছর লেগে গেল। ততদিনে পিকলু দেড় বছরের। আজ সতেরো বছর হল পীযুষ চাকরী জীবনে। এখন কোঁকড়া কালো চুলে সামান্য পাক ধরার ইঙ্গিত। হবেই না কেন, পিকলুই পা দিল চোদ্দ বছরে। পীযুষের এখন পঁয়তাল্লিশ।


লেক মার্কেট থেকে বেরিয়ে মনে পড়ল পিকলুর কথা। আজ রমার জন্মদিন। পিকলুই মনে করিয়ে দিয়েছিল। পীযুষের আজকাল এসব জন্মদিন-টিন মনে থাকে না। বড় মলটার উল্টো দিকেই চন্দ্রানী পালসের দোকান। সেবার পুজোর সময় এখানেই মুক্তোর হার নেড়ে রমা বলেছিল ওর মায়ের নাকি এরকম একটা ছিল। বড্ড পছন্দ হয়েছিল ওর। তাড়াহুড়োতে আর নেওয়া হয়নি।

বাড়ির সামনে গলিটা বড্ড সরু। একটা গাড়ি ঢুকলে তাকে পাশ কাটিয়ে বেরোনো কঠিন। তবু এ পাড়ায় বেশিরভাগ বাড়িতেই গাড়ি আছে। তবু ভালো পীযুষদের বাড়িটা বড় রাস্তার মুখ থেকে সামান্য। দোতলা বাড়িটা ওদের একটু লম্বাটে ধরনের। বাড়ির নীচ তলায় বড় গেটটা খুলে গাড়ি ঢোকালো পীযুষ। বেল দেবার আগেই নিচের কোলাপ্সিবল গেট খুলে দিল চাঁপা।
পীযুষের হাত থেকে বাজার ব্যাগটা নিয়ে হাসি হাসি মুখে চাঁপা বললে---দাদা, বৌদি বলসে নীচে পা ধুয়ে আইসতে।

পীযুষ বিরক্ত হয়ে বলল---তোর বৌদিকে বলিস, এর পর থেকে আমি লোটা কম্বল নিয়ে নীচতলাতেই থাকব।

পায়ের মোজা, জুতো খুলে ধুয়ে নিল পীযুষ। নীচতলায় একটা বড় ঘর, ঐ ঘরটা পীযুষের পোষা সরীসৃপদের ডেরা। ঘরের মধ্যে আলাদা আলাদা কাচের বাক্সে আছে নানা জাতের সাপ। পীযুষই ঐ ঘরে কেবল ঢোকে। রমা তো কখনোই নীচতলার ঐ ঘরমুখো হয়না। বিয়ের এত বছর পরেও পীযুষের সঙ্গে থেকে সাপের ব্যাপারে ওর একবিন্দু সাহস হয়নি। পিকলুকে ঢুকতে বারণ করে রমা। ঘরটাতে তাল দেওয়া থাকে। পীযুষই প্রতিদিন সময় মত খাবার দিতে তালা খোলে। এছাড়া বাকি দুটি ঘর বড় নয়। একটাতে বাইরে থেকে কেউ এলে বসবার জন্য, অপরটায় ভাঙা আসবাব, বাতিল জিনিসপত্র, ঘর হবার সময়কার অতিরিক্ত চুন সিমেন্টের বস্তা, রঙের ডিবে, এসব রাখা।

এ বাড়িতে দোতলার সর্বত্র রমার হাতের ছোঁয়া। টেবিল কভার থেকে, শোকেস, চীনা মাটির পুতুল, বইপত্র সবেতেই টিক টিক করে রমার হাতে গোছানো। একটু এলোমেলো হবার জো নেই। বাপ-ছেলেতে তাই সাবধানে থাকতে হয়।

রমা পীযুষের কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললে---মিঠু দি, এসেছে প্রণাম করবে।

একটু বিদঘুটে লাগলো ব্যাপারটা পীযুষের। প্রথমত এখনো ও জানেই না কে এই মিঠু দি, অপরদিকে প্রণাম-টনামের বালাই নেই পীযুষের। পীযুষের বাবা ছাত্রদের বলতেন শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য পায়ে মাথা ঠেকানো কু প্রথা। তিনি বলতেন 'শ্রদ্ধা আর আনুগত্য পৃথক বিষয়। যদি কারোর প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, তবে আনুগত্যের প্রশ্ন ওঠে না।'

একমাথা পাকা চুলের সাদা ঝকঝকে দাঁতের হাসি হাসি ফর্সা বয়স্কা মহিলাকে দেখে চিনতে ভুল হল না পীযুষের। নিজের উপর লজ্জা হল তার। মিঠু দি আসলে রমার কোনো দিদি নয়। পীযুষের পিসতুতো দিদি মিঠু দি, যার কাছে ছোটবেলায় যত আদর আবদার ছিল পীযুষের।
মিঠু দি'র বয়স অনেক হয়েছে। কত হবে? সত্তর, নাকি আরো বেশি? মিঠু দির এক ছেলেই তো পীযুষের চেয়ে বছর দশেকের ছোট হবে। পীযুষের গাল চেপে ধরলেন দুই হাতে বয়স্কা মহিলা। পীযুষ আনন্দে বলে উঠল---মিঠু দি? কতদিন পর?

---আর বলিস না, এখন কি আর হাঁটা চলা তেমন হয়। অতীনের শ্যালকের বিয়েতে এসেছিলাম। ভাবলাম তোর বাড়ি ঘুরে যাই। এলাম যখন তোর সাথে দেখা করেই যাবো।

---অতীন কোথায়?

---ওর এখানে কে বন্ধুর বাড়ি। ওখানে গেছে। আটটার দিকে নিয়ে যাবে তো বলল।

রমা বলল---হয়েছে, যাও আগে জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, তারপর দিদি-ভাইতে গল্প করো যতখুশি।

পীযুষ রমার দিকে চেয়ে তাকালো খানিকক্ষণ। রমা বিস্মিত হয়ে বলল---কি?

পীযুষ হেসে বলল---কিছু না।

আসলে রমারই আত্মীয় ভেবে পীযুষ কতটাই না বিরক্ত হয়েছিল রমার ওপর। মনে করছিল ছেলের সাথে রমাকে জন্মদিনে সারপ্রাইজ দেবার প্ল্যানটা পণ্ড হয়ে গেল বুঝি। আর শেষে কিনা আত্মীয়টি রমার নয়, ওর।

জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসল পীযুষ। হাঁক দিল---রমা, লক্ষীটি চা দিয়ে যাও।

রমা চাঁপার হাতে চা দিয়ে পাঠালো। মিঠু দি বললেন---এই পীযুষ, তোর নাকি কোনো এক বন্ধু স্টেট ব্যাংকে বারাসত শাখায় আছে?

পীযুষ ভ্রু কুঁচকে বললে---স্টেট ব্যাংকে? কে বলল?

মিঠু দি খানিক ইতস্তত করে বলল---অতীন বলল। ও নাকি লোনের জন্য গিয়েছিল। কথায় কথায় জানতে পারে ভদ্রলোক নাকি তোর বন্ধু হন।

পীযুষ চুপ করে গেল। হবে হয়ত। স্কুলজীবন থেকে কলেজ; কম তো আর বন্ধু হল না।

রমা প্লেটে মিষ্টি সাজিয়ে টি টেবিলটা টেনে মিঠুদির সামনে রাখলো। মিঠু দি এক গাল হাসি নিয়ে বললে---এসব আবার কেন বৌমা।

রমা বললে--সুগার ফ্রি দিদি। আর এই যে বাবান, কোথায় গেল এদিকে এসো।

এতক্ষন পর ছেলেটির দিকে নজর পড়েনি পীযুষের। পিকলুর চেয়ে বছর দুয়েক ছোট হবে মনে হয়। গোলগাল চেহারা। শ্যামলা রঙ, মুখটা যেন অতীনের কেটে বসানো। পীযুষ বললে---অতীনের ছেলে নাকি?

মিঠু দি বলল---হ্যা। যা দুরন্ত কল্পনা করতে পারবি না।

রমা ছেলেটির চিবুক ধরে আদর করতে করতে বললে---বাচ্চারা একটু দুরন্ত হবেই। আমাদের পিকলু কি কম?

পীযুষ রমাকে জিজ্ঞেস করল---পিকলু ফেরেনি?

পিকলুর আজ সুইমিং ক্লাস থাকে। যশোর রোডের দিকে সুইমিং ক্লাবটা। খুব একটা দূরে নয়। প্রতি শুক্রবার বিকেলে ওখানে ট্রেনার আসে। আগে ওর মা নিয়ে যেত। এখন পাশের বাড়ির ছেলেটার সাথে ও একা চলে যায়। ওর সাথেই ফেরে। রমা বলল---ক'টা বাজলো। সাড়ে পাঁচটা। এখন তো ক্লাস শেষ হওয়ার সময়। এত দেরী করছে কেন কে জানে।

তারপর ও ফ্রিজ থেকে একটা চকোলেটের আইসক্রিমের বাক্স বার করে বাবানের হাতে দিয়ে বললে---তোমার ভালো নামটা বললে না তো?

আইসক্রিমের দিকেই গভীর মনোযোগী হয়ে ছেলেটা বললে---দত্তাত্রেয় সান্যাল।

ঐটুকু বাচ্চার এত বড় নাম দেখে রমা খানিকটা চমকে উঠল। ইংরেজীতে দত্তাত্রেয় নামটি শিখতেই নিশ্চই বাচ্চাটিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। পিকলুর নাম সে অর্থে খুব সহজ। রমাই রেখেছে পীযুষের সাথে মিলিয়ে 'পরশ'।

মিঠু দি বললেন---ওর এখন একটা ছোট বোন হয়েছে। তাই ওর মনে বড্ড দুঃখ। আদরটা ভাগ হয়ে যাচ্ছে কিনা।

পীযুষের মনে পড়ল এই মিঠুদির যখন বিয়ে হল, তখন পীযুষই গেছিল সঙ্গে। বারাসতেই ছিল পিসির বাড়ি, মিঠুদির বিয়েও হল বারাসতে। তারপর অতীনের জন্মের পর মিঠু দি যখন অতীনকে নিয়ে ব্যস্ত তখন খুব ঈর্ষা হত পীযুষের। সে সব শৈশবের দিন। বারাসতে মিঠুদির বাড়িতে কত হুটোপুটি হত কালি পুজোর সময়। পিসের কাঁধে উঠে ঘোড়াগ্রামের কালি মন্দির পর্যন্ত যেত ও।

বাইরে বেল পড়তেই রমা বলল---ঐ যে পিকলু এলো। চাঁপা দেখ দেখি।

পিকলু ঢুকল সাড়ে ছ' টা নাগাদ। ছেলেটা বেশ পাতলা চেহারার। এসময়ই ওর গলার স্বর পরিবর্তন হচ্ছে। একটু বড় বড় ভাব আসছে। ট্রাউজার আর স্পোর্টস টি শার্ট পরেছে ও। কাঁধের কিটস ব্যাগ নামিয়ে রেখে বলল---মা, খিদে পেয়েছে।

রমা বললে---এই যে এসে গেছে আমার রাজপুত্তুর।

মিঠু দি বললে---কাছে আয় বাপ, দেখি পীযুষের ছেলেটাকে।

পীযুষ চায়ে চুমুক দিয়ে শেষটুকু শেষ করে বললে---মিঠু দি, ও কিন্তু ছোটবেলার আমার মত লাজুক নয়।

রমা পিকলুকে বলল---কি রে দাঁড়িয়ে রইলি কেন, যা, পিসি ডাকছে।

বাবার যে কোনো এক দিদি আছে একথা কোনো দিন পিকলু শোনেনি। এই প্রথম শুনল বলে চমকে উঠল। খানিকটা ইতস্তত হয়ে কাছে গেল। আসলে মিঠু দি যখন শেষবার এসেছিল, তখন পিকলু দু-আড়াই বছরের।

পিকলুর চিবুকটা ধরে মিঠুদি বললেন---সত্যি রে পীযুষ, তোর ছেলে যে রাজপুত্তুর।

নানা পুরোনো দিনের কথার মাঝেই অতীনের আগমন ঘটল। পীযুষের চেয়ে বছর দশেকের ছোট অতীন। তাহলে অতীনের এখন পঁয়ত্রিশ হবার কথা। অথচ কাঠখোট্টা চেহারায় কেমন একটা রুক্ষ ভাব। কিছুক্ষনের মধ্যেই পীযুষ বুঝতে পারল, মিঠুদির আগমনের পেছনে একটা উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা অতীনের। মাকে ব্যবহার করেই পীযুষের কাছে আগমন। পীযুষের এক কলেজ জীবনের বন্ধু সুব্রত দাস এখন বারাসতের স্টেট ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। পীযুষ যদি অতীনের হয়ে সুপারিশ করে দেয় অতীন লোনটা পাবে। অতীন নাকি এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর সাথে শেয়ারে প্রাইভেট স্কুল খুলতে চায়। তার জন্যই লোন। যদিও অতীনের হাবভাব পীযুষের পছন্দ হল না। শেষবার অতীনকে দেখেছিল শিশু বয়সে। এই অতীনকে দেখে মনে হল, ব্যবসা এর আগেও মার গেছে ওর। তাছাড়া সুব্রত কেবল পীযুষের সহপাঠী। তেমন ঘনিষ্ট বন্ধুও ছিল না ওর। হয়ত কোনো কারণে পরিচয় দিয়েছে বলেই দীর্ঘদিন জোগাযোগহীন একটা লোকের কাছে পিসতুতো দিদির ছেলের জন্য সুপারিশ চাওয়াটা বেমানান ঠেকল পীযুষের কাছে।


ওরা চলে গেল আটটার দিকে। টিভিতে ন'টার সিরিয়ালটা দেখেই চাঁপা বাড়ি যায়। ও থাকে কেষ্টপুরের কাছে বস্তিতে। রাতে আহারের আগে পিকলুকে ইশারা করল পীযুষ। রমা তখন রান্না ঘরে খুঁটখাট কাজ করছে। পিকলু গিয়ে ডাক দিল---মা, শিগগিরি এসো। চাঁপা মাসি, তুমিও এসো।

চলবে
Like Reply


Messages In This Thread
পদ্ম নাগের বিষ - by Henry - 21-10-2023, 11:21 PM
RE: পদ্ম নাগের বিষ - by Henry - 21-10-2023, 11:26 PM



Users browsing this thread: 10 Guest(s)