27-08-2023, 08:43 PM
দ্বিতীয় খণ্ড
৩৩তম পর্ব
"কি হলো অনিকেত তুই খাচ্ছিস না কেন? চিকেনটা তানিয়ার রান্না খেয়ে দেখ"
"সেটাই তো চিন্তার"
প্রিয় শিষ্যের পরিচয় পেয়ে সহজে তাকে ছাড়তে চান না সুপ্রতিমবাবু তার কাছে এসে থাকতে বলেন অন্তত পিয়ালীকে তার বাড়িতে রাখতে বলেন যাতে দেখাশোনা ভালো হয় আর ওর সুরক্ষাও হয় কিন্তু উত্তরে আদিত্য জানায় গ্ৰামে তার অনেক কাজ আছে আর গ্ৰামের লোকেরা তাদের খুব ভালোবাসে সবসময় চোখে চোখে রাখে, ওরা এইসময় ওখান থেকে চলে এলে ওরা কষ্ট পাবে তাই সেটা সম্ভব নয়, তখন সুপ্রতিমবাবু আদিত্য ও পিয়ালীকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করেন তাঁর নিজের বাড়িতে এতে অবশ্য আদিত্য আপত্তি করেনি।
সুপ্রতিমবাবুর বাড়ির গেটের সামনে কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে সে,
"কি হলো দাঁড়িয়ে পড়লে?" স্বামীকে এইভাবে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে প্রশ্ন করে পিয়ালী।
"ছোটোবেলার কথা মনে পরছে, আজ কতবছর পরে এই বাড়িতে পা দিচ্ছি একসময়ে এখানে প্রায় পুরো দিনটাই কাটাতাম"।
ভিতরে ঢুকে আদিত্য আর পিয়ালী ড্রয়িংরুমে বসলো, তানিয়া এসেছে ওদের সঙ্গে ও রান্নার ওখানে গেছে পিয়ালী যেতে চেয়েছিল কিন্তু তানিয়া যেতে দেয়নি, সুপ্রতিমবাবু আর দিগন্ত একটু পরে আসবেন একটা কাজ সেরে।
ড্রয়িংরুমে আদিত্য একটা ম্যাগাজিন তুলে পাতা উল্টিয়ে দেখতে লাগলো আর পিয়ালী একদিকের দেওয়ালে কিছু ছবি দেখে সেগুলো দেখতে উঠে গেল।
"এই মেয়েটা তো তানিয়া, ছেলেটা কে? স্যারের ছেলে?"
পিয়ালীর গলা শুনে আদিত্য ম্যাগাজিন থেকে চোখ তুলে দেখে দেয়ালে টাঙানো একটা ছবি দেখিয়ে প্রশ্নটা করেছে পিয়ালী, কিন্তু সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে পিয়ালীর সঙ্গে একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারলো না আদিত্য,
"কেন ছেলেটাকে পছন্দ?"
"সবসময় তোমার ইয়ার্কি? এমনি কৌতূহল হলো তাই জিজ্ঞেস করছি, বলো না স্যারের ছেলে?"
"আগে বলো পছন্দ কি না?"
"না, আমার শুধু আমার বরকেই পছন্দ আর কাউকে না"
"কেন ছেলেটা হ্যাণ্ডসাম না?"
"তুমি না মাঝে মাঝে খুব বাজে বকো, তোমাকে জিজ্ঞেস করাই আমার ভুল হয়েছে"
"এই শোনো, বলো না, ছেলেটাকে হ্যাণ্ডসাম লাগছে কি না?"
"না"
"সত্যি বলছো?"
"হ্যাঁ"
"অবশ্য হ্যাণ্ডসাম লাগলেও তোমার ভাগ্য বদলাতো না"
"মানে?"
"মানে উনি স্যারের ছেলে নন, কিন্তু ছেলের চেয়ে কমও নন। উনি হলেন তোমার বরেরই বাল্য সংস্করণ আইমিন প্লাস্টিক সার্জারির পূর্ববর্তী সংস্করণ"
"এটা তুমি?" পিয়ালীর স্বরে বিস্ময়।
"আজ্ঞে ম্যাডাম, একটা মার্শাল আর্ট কম্পিটিশনে জেতার পরে তোলা। নীচের মেডেল, ট্রফি আর সার্টিফিকেটগুলো দেখো আমার নাম পাবে মানে অনিকেত ব্যানার্জী নামটা"।
"তুমি মার্শাল আর্ট চ্যাম্পিয়ন?"
"ছিলাম, স্যারই শিখিয়েছিলেন"
"উনি মার্শাল আর্ট জানেন?"
"বর্তমানে এই শহরের পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ওনার সমকক্ষ কেউ আছে বলে মনে হয় না"
"একটা কথা বলবো?"
"বলো"
"এখন ছেলেটাকে হ্যাণ্ডসাম লাগছে" ছবিটা আরেকবার দেখে মন্তব্য করে পিয়ালী, কিন্তু আদিত্যর দিকে তাকিয়ে দেখে তার মুখ গম্ভীর, পিয়ালী স্বামীর পাশে এসে বসে,
"কি হয়েছে তোমার? আবার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে?"
"না, আমি অন্য কথা ভাবছি"
"কি কথা জানতে পারি?"
"আজ আমি যা করলাম সেটা ঠিক না ভুল বুঝতে পারছি না, স্বামী হিসেবে আমার কর্তব্য তোমাকে প্রোটেক্ট করা কিন্তু যারা তোমার উপর অ্যাটাক করলো আমি তাদেরই ছেড়ে দিয়েছি"
পিয়ালী আলতোভাবে আদিত্যর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো, "তোমার জায়গায় যে কেউ থাকলে সেও একই কাজ করতো। আর তাছাড়া তুমি ভুল কিছু করোনি বরং আমাদের এইসময়ে মায়ের আশীর্বাদ পেলাম এটাই অনেক, ওনার ছেলেকে জেলে দিলে হয়তো ওর শাস্তি হতো কিন্তু তার সঙ্গে আরও অনেকের কষ্টের কারণ হতাম আমরা তাই ওসব নিয়ে ভেবোনা"
"মাঝে মাঝে আমি ভাবি যে আমি তোমার মতো বুদ্ধিমতী বউ পেলাম কিভাবে?"
"প্রেমালাপটা পরে করে এখন এগুলো খেয়ে ফেল দেখি"
হঠাৎ তানিয়ার গলার আওয়াজে দুজনেই চমকে উঠলো, দেখলো তানিয়া হাতে একটা ট্রে তে কফি আর পকোরা নিয়ে আসছে। ট্রে টা টেবিলে রেখে একটা প্লেট পিয়ালীর হাতে দিয়ে বললো "নাও খাও, আর চিন্তা নেই তোমার হেলথের কথা ভেবে সেরকম কম তেলেই এগুলো ভাজা হয়েছে"
"সে ঠিক আছে কিন্তু স্যার আর দিগন্ত আসুক তারপর একসাথে খাওয়া যাবে"
আদিত্য কথা বললো আর কথা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজার কাছ থেকে সুপ্রতিমবাবুর গলা পাওয়া গেল,
"তুই কবে থেকে এইসব ফর্মালিটি করছিস তাও এই বাড়িতে এসে?"
"ফর্মালিটি নয় স্যার, ভাবছিলাম সবাই একসাথে বসে খাবো, কতবছর পরে এখানে বসে খাবো তাই আরকি, আপনি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন"।
কফি আর পকোরা সহযোগে টিফিন করতে করতে সবাই হাসিঠাট্টা করছিল কিন্তু হঠাৎ সুপ্রতিমবাবুর একটা প্রশ্নে আদিত্য বিষম খেয়ে থেমে গেল,
"এবার বাকি কথা বল, এতবছর কোথায় ছিলি? আর এটা কার চেহারা নিয়ে ঘুরছিস, চেহারা পাল্টালি কেন?"
আদিত্যর বুঝতে বাকি রইলো না যে তার স্যার সবকিছু শুনেই ছাড়বেন তাই সেও জবাব দিতে শুরু করলো,
"একজন ভালো মানুষের বাড়িতে ছিলাম, আর তারপর ওই নারায়ণতলা গ্ৰামে আছি। চেহারা একজন সাহসী ছেলের যে ক্রাইমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে"
"কিন্তু তার চেহারা তুই নিলি কেন?"
"এর দুটো কারণ এক আমি নিজের পরিচয় নিজের অস্তিত্ব ভুলে যেতে চাইছিলাম আর দুই এক মাকে তার পুত্রশোক থেকে বাঁচানোর জন্য, যদিও শেষপর্যন্ত পারিনি"
"যখন বেঁচে গিয়েছিলি তখন কলকাতায় ফিরলি না কেন?"
"ফিরেছিলাম, প্রায় একমাস পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরেছিলাম"
"ফিরেছিলি? তবুও একবার আমার সাথে দেখা করা গেল না তাই তো?"
"অপরাধ নেবেন না স্যার, কিন্তু কোনো ছেলে যদি দেখে তার পরিবার পরিচিত সবাই একমাসের মধ্যে তার মৃত্যুকে ভুলে গিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে মেতে উঠেছে তাহলে সেই ছেলের জীবনে আর কি থাকে বলতে পারেন?, সেইমুহুর্তে আমার মনে হচ্ছিল কেন বেঁচে গেলাম? ইচ্ছা করছিল সবকিছু ছেড়ে কোথাও দূরে চলে যেতে যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না জানবে না"
"কিন্তু আমার কাছে এলি না কেন?"
"বললাম না সেই মুহুর্তে একটাই ইচ্ছা করছিল সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে, এখানে ফিরেও নিজেকে ওই গ্ৰামেই আটকে রেখেছিলাম অনেক পরে পিয়ালীর সাথে দেখা হয়, বলতে পারেন ওই আবার আমাকে স্বাভাবিক করে তোলে"।
"আমার ইচ্ছা করছে এখন তোকে আড়ং ধোলাই দিতে"
"আপনার অধিকার আছে দিতেই পারেন, তবে এটাও ঠিক অনেকবার মনে হয়েছে ফিরে এসে সবাইকে বলি আমি বেঁচে আছি অন্তত আপনাকে বলি কিন্তু তারপর ভেবেছি কি দরকার সবার কাছে অনিকেত তো মরেই গেছে তাকে আবার বাঁচিয়ে তুলে কোনো লাভ নেই, সেদিন ইচ্ছা হচ্ছিল যে আপনি আমাকে চিনতে পারেন কি না দেখার তাই বলে ফেলেছিলাম"
খেতে বসে আদিত্য দেখে সব তার পছন্দের খাবারই তৈরি হয়েছে বিউলির ডাল, আলুপোস্ত, মাছের ডিমের বড়া, চিকেন সামনে আপাতত এটুকুই তবে আদিত্য ভালো করেই জানে শেষপাতে দই, পাঁপড়, চাটনি এগুলো আসবেই। সে কি কি খেতে ভালোবাসে সেটা তার মা শ্রীতমাদেবী জানেন তেমনি জানেন সুপ্রতিম বাবু আর তানিয়া, বেশিরভাগ দিনই সে এখানেই খেত।
নর্থবেঙ্গলে থাকাকালীন আদিত্যর অভিনয় করতে হতো বলে ওর পছন্দের খাবার খেতে হতো তবে মাঝে মাঝে বললে উমাদেবী করে খাওয়াতেন।
খাবার টেবিলে সামনে সুপ্রতিমবাবু টেবিলের একপাশে আদিত্য আর দিগন্ত ওকেও নিমন্ত্রণ করে নিয়েছিলেন সুপ্রতিমবাবু আর অপর পাশে পিয়ালী এবং তানিয়া, ওদের দুজনের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেছে এখন।
"এতকিছু করালেন কখন স্যার?" খাবার টেবিলে মেনু দেখে প্রশ্ন আদিত্যর।
"ফোন করে দিয়েছিলাম একজন আসেন আমাদের রান্না করে দিতে তিনিই করেছেন আর তানিয়া তো এসেই গিয়েছিল চিকেনটা ও করেছে"।
খেতে খেতে টুকটাক কথা হচ্ছে বিশেষ করে তানিয়া এবং পিয়ালীর মধ্যে। আদিত্যর সাথে ওর কিভাবে আলাপ তারপর বিয়ে সবকিছুই তানিয়া জানতে চায় পিয়ালীও মোটামুটি ভাবে বলছে।
খেতে খেতে হঠাৎ চিকেনটা নিতে গিয়েও একটু থেমে যায় আদিত্য যেটা কারোরই চোখ এড়ায় না, সুপ্রতিমবাবু বলেন,
"কি হলো অনিকেত তুই খাচ্ছিস না কেন? বললাম না চিকেনটা তানিয়ার রান্না খেয়ে দেখ"
"সেটাই তো চিন্তার" ছোট্ট উত্তর আদিত্যর।
"তানিয়া কিন্তু সত্যিই খুব ভালো রান্না করে" এতক্ষণে হবু বউএর ওকালতি করার ঢঙে কথা বলে দিগন্ত।
"বিয়েটা হোক, তারপর বুঝবে কত ভালো রান্না করে"
আদিত্যর উত্তর শুনে দিগন্ত প্রথমে আদিত্য তারপর তানিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করে।
"চিন্তা করিস না, ওতে নেই" আদিত্য তখনও দোনোমনো করছে দেখে কথা বলে তানিয়া, "যদিও ভেবেছিলাম দিই কিন্তু পরে ভাবলাম অতিথি হয়ে এসেছিস দরকার কি? তাই ওটা খেতে পারিস?"
"আমাকে অতিথি বানিয়ে দিলি,গ্ৰেট"
"কি করবো বল, তুই তো আর আমাদের আপন ভাবিস না, আমরা তো তোর নিজের কেউ নই এতবছর বেঁচে থেকেও আমাদের জানাসনি এমনকি বিয়ে করলি সেটাতেও ডাকলি না"
"দেখ তুই দরকারে ওটা দে আমি খেয়ে নেবো কিন্তু এরকম কথা শোনাস না"
"কিসের কথা হচ্ছে?" আবার মিনমিন করে জিজ্ঞেস করে দিগন্ত, কিন্তু সুপ্রতিমবাবু "ওদের মাঝে ঢুকো না দিগন্ত, তুমি খেতে থাকো" বলে আবার নিজে খাওয়ায় মন দেন।
"দিগন্ত এখনো খায়নি না?" আদিত্য তানিয়াকে জিজ্ঞেস করে।
"না, এখনো ডোজ দিইনি, তবে কখনো যদি বেশি বাড়াবাড়ি দেখি তাহলে দিয়ে দেবো"
"দিগন্ত ভায়া একটু সাবধানে থেকো"
"আমি কিন্তু সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না" ভয়ার্ত স্বরে কথা বলে দিগন্ত।
"এই তানিয়া কিসের কথা বলছো বলোতো?" পিয়ালীও জিজ্ঞেস করে।
"বলবো?" আদিত্যকে জিজ্ঞেস করে তানিয়া,
"আমি বারণ করলেও তুই যে চেপে রাখবি না সেটা আমি ভালো করে জানি, তবে দিগন্তকে ছেড়ে দে"
"বললাম না দরকার পরলে দেবো নাহলে না"
"ভায়া দিগন্ত, তোমার কপালে শনি আইমিন শনির ফিমেল ভার্সন কি হবে, যাইহোক সেটাই নাচছে যদি বাঁচতে চাও তো বলো টিপস দিতে পারি"
"অ্যাঁ"
"অ্যাঁ করে লাভ নেই, টিপস চাও কি না বলো?"
"চাই"
"প্রথমত, তানিয়ার সঙ্গে কখনও কোনো বিষয়েই লজিক নিয়ে কথা বলবে না, ও জিনিসটা ওর মাথার উপর দিয়ে যায়, দ্বিতীয় কখনো ওকে হারিয়ে সে তর্কে হোক বা অন্য কিছুতে বড়াই করবে না, তৃতীয় ও যদি ভুল করেও তাহলে সেটা তোমার ভুল হবে এটা মেনে নেবে"
"অ্যাঁ"
"আর যদি এগুলো করেছো তাহলে সেইদিন এবং তার পরের কয়েকটা দিন বাইরে খেয়ে থেকো, মানে ঘরে খাবার পেলেও খেতে যেয়ো না"
"কেনো?"
"তোমার ঝাল খাওয়ার অভ্যাস আছে? মানে খুব ঝাল"
"না, আই হেট ঝাল" একটা ঢোঁক গিলে কথা বলে দিগন্ত।
"হয় ঝাল খাওয়া অভ্যাস করো আর নাহলে যেগুলো বললাম মেনে চলো"
"তুমি ওর খাবারে ঝাল দিতে?" হাসতে হাসতে তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলো পিয়ালী।
"কি করবো বলো, আমাকে খুব জ্বালাতো অথচ আমি কাউকে বলে ওর কিছু করতে পারতাম না কি মা কি ড্যাডি কেউই ওকে কিছু বলতো না যা বলার সব আমাকে, তাই বাধ্য হয়ে ওর খাবারে মেশাতাম, আর তুমি জানো ও কি করতো? সেই খাবারের অর্ধেক আমাকে খাওয়াতো"
তানিয়ার কথা শুনে সুপ্রতিমবাবু আর পিয়ালী হো হো করে হেসে ওঠেন দিগন্ত ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার হবু বউএর দিকে তাকিয়ে আছে আর আদিত্য দিগন্তের ভয়ার্ত মুখটা দেখছে। তানিয়া বলতে থাকে,
"তবে এটাও ঠিক আমার সবরকম দরকারে ওকে আমি পাশে পেয়েছি একজন দাদা, একজন বন্ধুর মতো সবসময় ও আমার পাশে থাকতো। যখন আমার মা মারা যায় তখন আমি কাঁদিনি কারণ সবাই ছোটো থেকে শিখিয়েছিল কাঁদলে লোকে দুর্বল ভাববে, আমি কাঁদিনি সবাই সান্ত্বনা দিতে এলে বলছিলাম আমি ঠিক আছি। সব আত্মীয় প্রতিবেশীরা চলে গেলে আমি একা আমার রুমে এসে বিছানায় চুপ করে বসেছিলাম কিন্তু কাঁদিনি, একসময় অনিকেতদা এসে আমার পাশে বসলো আমি ওকেও বললাম আমি ঠিক আছি, ও কি বললো জানো? 'কাঁদতে চাইলে কেঁদে নে, কেউ জানবে না' আমি জানতাম ও কাউকে বলবে না, সেদিন ওর হাত জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে খুব কেঁদেছিলাম কতক্ষণ জানিনা তবে অনেকক্ষণ অনেকক্ষণ, ও পুরোটা সময় চুপ করে আমার পাশে বসেছিল। তারপর যখন আমার কান্না থামলো তখন ও কি করলো জানো? ও প্রথমে জিজ্ঞেস করলো 'হয়েছে না আরও কাঁদবি?' যখন আমি বললাম যে না আর কাঁদবো না তখন উঠে গায়ের শার্টটা খুলে আমার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বলে 'নোংরা করে দিয়েছিস শার্টটা, এটা কেঁচে পরিষ্কার করে আয়রন করে ফেরত দিবি' বলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়"
"এ মা সত্যি?" বিস্ময় প্রকাশ করে পিয়ালী, তানিয়া বলতে থাকে,
"হ্যাঁ, তবে সেই শার্টটা আমি আর ফেরত দিইনি ওটা এখনও আমার কাছে আছে"
"তার মানে ঝগড়া সত্বেও তোমাদের মধ্যে মিল ছিল?" আবার প্রশ্ন পিয়ালীর।
"বললাম না ও আমার দাদা আমার বেস্টফ্রেণ্ড ছিল, সবসময় আমি ওকে পাশে পেতাম শুধু নিজের সময়েই আমাদের পর করে দিল"
"তুই আবার শুরু করলি? চুপচাপ খা। কি করো দিগন্ত একটু শাসন করতে পারো না?" ধমকের সুরে কথা বলে আদিত্য।
"আমি করবো শাসন? তাহলেই হয়েছে" এতটুকু বলে আবার খেতে শুরু করে দিগন্ত।
খাওয়ার পরে চলে আসার সময় সুপ্রতিমবাবু অবশ্য থাকতে বলেছিলেন কিন্তু আদিত্য রিসর্টের কাজ আছে বলে চলে এসেছে যদিও আসার আগে কথা দিতে হয়েছে যে নিয়মিত আসতে হবে, আদিত্য দিগন্তকে লিফট দিতে চেয়েছিল কিন্তু দিগন্ত ক্যাব নিয়ে নেবে বলে আর আসেনি।
নিজের রুমে একাকী ছটফট করছিলেন অভিরূপবাবু সেই ঘটনার পর থেকে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল তিনি আর নারায়ণতলা গ্ৰামে জাননি, আসলে তিনি আদিত্য বা বলা ভালো অনিকেতের মুখোমুখি হতে চাইছিলেন না অথচ তার মন অনিকেতের সঙ্গে একবার কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে, বেশ কয়েকবার ফোন করবেন ভেবে ফোন হাতে নিয়েও আর করেননি বেশ কয়েকবার ভেবেছেন গ্ৰামে গিয়ে দেখা করে আসবেন কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভেবেছেন যদি অনিকেত কথা না বলে? ছেলে যে তাঁর কতটা অভিমানী এটা তো তিনি ভালো করেই জানেন এবং এর প্রমাণও তিনি পেয়েছেন একলা ঘরে ছটফট করছেন।
কোথায় ভেবেছিলেন ছেলেকে বুঝিয়ে ওর রাগ ভাঙিয়ে বৌমা আর নাতি নাতনি সহ একসাথে থাকবেন, কিন্তু এখন বোধহয় মুখ দেখাই হবে না। অভিরূপবাবু ছোটো ছেলের ছবিতে হাত বোলাতে থাকেন সেদিন ঝোঁকের মাথায় ছেলের ছবিটা সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন কিন্তু পরে শ্রীতমাদেবী আর স্বর্ণেন্দু বাবু কোনোমতে তাঁকে নিরস্ত করেন, সেই ছবিটাই এখন তাঁর হাতে।
"জামাইবাবু, কি করছো একা ঘরে চলো একটু হেঁটে আসি"
ঘরে ঢুকেই বললেন স্বর্ণেন্দু বাবু। এমনিতেও এবাড়িতে স্বর্ণেন্দু বাবুর আসা যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই যখন খুশি তিনি আসেন কিন্তু সেদিনের পরে তিনি কদিন আসতে পারেন নি এবার সেটা তাঁর কাজের জন্য না তিনি নিজেই আসেননি সেটা বলা মুশকিল।
আজ এসে প্রথমেই অভিরূপবাবুর কাছে এসে তাকে রুমে একাকী বসে থাকতে দেখে তিনি একটু হেঁটে আসার কথা বললেন,
"চলো জামাইবাবু চলো"
"না, স্বর্ণেন্দু আমার ভালো লাগছে না"
"মন যাতে ভালো হয় সেইজন্যই তো যেতে চাইছি, চলো একটু ঘুরে আসি দেখবে মন ভালো হয়ে যাবে"
স্বর্ণেন্দু বাবু একপ্রকার জোর করেই অভিরূপবাবুকে টেনে ওনার রুম থেকে নীচে নিয়ে এলেন, আর নীচে আসা মাত্রই অরুণাভ তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো,
"তোমার কি হয়েছে বলো তো বাবা, সেদিন থেকে দেখছি কিছু তো হয়েছে নিজেকে ঘরে বন্দী করে রেখেছো" অরুণাভর প্রশ্ন তার বাবাকে,
"তোমার মতো ছেলে থাকলে তাকে ঘরেই থাকতে হয়, কারণ লোককে দেখানোর মতো মুখ তার থাকে না" সোজা জবাব দেন অভিরূপবাবু, উপস্থিত শ্রীতমাদেবী, মৌমিতা মণিদেবী নির্বাক দর্শক।
"কেন কি করেছি আমি?"
"সেটা তুমি ভালো করেই জানো, আমার মুখ থেকে আর নাইবা শুনলে"
"তোমার দেখছি নিজের ছেলের থেকে ওই বাইরের ছেলের উপরে বেশি বিশ্বাস"
"কারণ আমি জানি ও সত্যি কথা বলছিল আর শুধু ওর কথা তো নয় তোমার বিষয়ে আরো অনেক কথা আমি শুনেছি সবাই মিথ্যা বলছে সেটা তো হতে পারে না, কথায় আছে যা রটে তার কিছুটা তো ঘটে"
"সবাই মিথ্যা বলছে"
"তাই নাকি? তা সবার এত কিসের দায় যে তোমার বিরুদ্ধেই মিথ্যা বলতে হচ্ছে?"
"হিংসা, আমি এত বড়ো বাড়ির ছেলে এত বড়ো পরিবারের ছেলে, এত বড়ো বিজনেস আমাদের"
"আমার বিরুদ্ধে তো কেউ বলে না, আমার কথা ছাড়ো অনিকেতের বিরুদ্ধেও কখনো কাউকে খারাপ কিছু বলতে শুনিনি, এমনকি এখনো যারা ওকে চিনতো তারা ওর প্রশংসা করে এবং সেটা ওর নিজের ব্যাবহারের জন্য, ওর বাড়ির পরিচয়ের জন্য নয় ও তো তোমার মতোই বড়ো বাড়ির ছেলে ছিল তাহলে তোমার বিরুদ্ধেই সবার হিংসা কেন?"
"অনি মরে গেছে বাবা"
"মরে গেছে নাকি?" অভিরূপবাবু অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকান তারপর আবার বলতে শুরু করেন, "একটা সত্যি কথা বলোতো অনি কিভাবে খাদে পড়লো?"
অভিরূপবাবুর প্রশ্ন শুনে অরুণাভ এবং ওর কিছুটা পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মৌমিতা দুজনেই চমকে উঠলো যেটা অভিরূপবাবুর দৃষ্টি এড়ালো না।
"তোমাকে তো বলেছি ও ড্রিংক করেছিল তারপর খাদের ধার বরাবর হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেছে"
"তাই?"
"ম..মানে কি বলতে চাইছো তুমি? তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো" অরুণাভ তোতলাতে থাকে,
"করলেই বা কি এখন তো লাভ নেই, এটা সেই সময়ে করা উচিত ছিল এখন আফশোষ হয় সেইসময় যদি পুলিশকে তদন্ত করতে দিতাম তাহলে হয়তো সত্যিটা জানতে পারতাম"
"যবে থেকে ওই আদিত্যর সাথে তোমার পরিচয় হয়েছে তবে থেকে তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না"
"এতদিন অনির উপরে তোমার বিদ্বেষ ছিল এখন আদিত্যর উপরে, কি করবে আবার ওকে মারতে লোক পাঠাবে? সেটা ভুলেও করতে যেও না কারণ সেক্ষেত্রে সুপ্রতিমবাবুর হাত থেকে তোমাকে আমিও বাঁচাতে পারবো না"
"বাঁচাতে পারবে না নাকি বাঁচাতে চাও না?"
"যেটা তুমি মনে করো, কিন্তু কথাটা মাথায় রেখো" অভিরূপবাবু কথাটা বলে স্বর্ণেন্দু বাবুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
"জামাইবাবু মাথা ঠান্ডা করো, তুমি সবসময় শান্ত মাথার লোক তুমি যদি এভাবে রেগে যাও তাহলে তো খুব মুশকিল"
হাঁটতে বেরিয়ে অভিরূপবাবুর রাগী থমথমে মুখ দেখে মন্তব্য করলেন স্বর্ণেন্দু বাবু।
"তুমি আমার মনের অবস্থাটা বুঝতে চাইছো না স্বর্ণেন্দু, সেদিন থানায় অনির কথাগুলো শুনেছিলে তো তুমি, ওর মনে কত অভিমান জমে আছে আন্দাজ করতে পারো? আমি তো ভেবে পাচ্ছি না ওর সামনে দাঁড়াবো কিভাবে?"
"সত্যি বলতে সেটা আমিও ভাবছি"
"স্বর্ণেন্দু পিয়ালী প্রেগনেন্ট ওর গর্ভে যে আছে সে আমাদের নিজেদের রক্ত, আমাদের পরিবারের সদস্য আর ওকেই মারার জন্য লোক পাঠিয়েছিল অরু আর আমরা কি করলাম ওকে ছাড়িয়ে আনলাম"
"জামাইবাবু যা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই ,এর থেকে অনিকে কিভাবে বোঝাবে সেটা ভাবলে ভালো হয়"
"তুমি বলো আমার তো কিছুই মাথায় আসছে না এখন তো মনে হচ্ছে আমি অনির সন্তানের মুখও দেখতে পারবো না"
"এরকম কেন বলছো?"
"স্বর্ণেন্দু কোন বাবা চাইবে যে, যে তার স্ত্রী আর সন্তানকে মারতে চেয়েছিল তার বাবাকে নিজের সন্তানের মুখ দেখাতে?"
"জামাইবাবু, অনি আর যাই করুক এটা করবে না, ও আমাদের উপরে রেগে থাকতে পারে কিন্তু এতটাও নয় যে ও ওর সন্তানের মুখই দেখতে দেবে না"
"না দিলেও ওকে কিছু বলার নেই স্বর্ণেন্দু, ওর জায়গায় ও ঠিক"
"আমি ভাবছিলাম যদি আমরা গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করি তাহলে হয়তো ওর সঙ্গে কথা বললে ও হয়তো বুঝবে আমাদের অবস্থাটা"
"আর ওকে গিয়ে কি বলবে? অরুণাভ আমাদের ছেলে তাই ওর সাত খুন মাফ, এবং ও যদি আবার একই অন্যায় করে তাহলেও ওকে ছেড়ে দিতে হবে এই বলবে?"
"জামাইবাবু এরকম কেন বলছো? চলো না একবার গিয়ে দেখা করিই না"
"বেশ যাবো তাহলে"।
"রেডি থেকো যেকোনো দিন কিন্তু ছুটতে হতে পারে"
বিকেলে বাড়ির বাগানে বসার জায়গায় একটা মোড়ায় বসা পিয়ালীর পেটে হাত বোলাতে বোলাতে মন্তব্য করে আদিত্য, তার গলার স্বরে খুশী এবং উত্তেজনা দুটোই স্পষ্ট, আদিত্য পিয়ালীর সামনে নীচে বসে আছে কখনো সে পিয়ালীর পেটে হাত বোলাচ্ছে আবার কখনো কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছে, যেটা দেখে পিয়ালী হেসেই অস্থির।
বাদশা এতক্ষণ চুপচাপ পিয়ালীর পাশে বসে ছিলহ পিয়ালী মাঝে মাঝে একটা হাত ওর মাথায় বুলিয়ে আদর করছিল আর সারমেয়টা মনিব পত্নীর এই আদরটা উপভোগ করছিল হটাৎ সে বাইরের গেটের দিকে তাকিয়ে গর্জন করে ওঠে, এই গর্জন শুনে পিয়ালী কিছুটা অবাক হলেও আদিত্য গর্জনের মানে বুঝতে পারে সে বাদশার দৃষ্টি অনুসরণ করে গেটের দিকে তাকিয়েই অবাক বিস্ময়ে বলে ওঠে "আপনি?"।
অভিরূপবাবু ও শ্রীতমাদেবী গ্ৰামে এসেছেন স্বর্ণেন্দু বাবু সঙ্গে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু কয়েকটা কাজ এসে যাওয়ায় আসেননি তবে হাতের কাজগুলো সেরেই চলে আসবেন বলেছেন, গ্ৰামে আসা ইস্তক অভিরূপবাবু অনেক চেষ্টা করেও অনিকেতের মুখোমুখি হতে সাহস পাননি, তিনি জানেন অনিকেত তাকে অপমান করবে না কিন্তু তার সেই অভিমানে পূর্ণ দৃষ্টি তিনি সহ্য করতে পারছেন না।
তিনি ঠিক করলেন স্বর্ণেন্দু বাবু এলে একসাথে যাবেন কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে অরুণাভ সপরিবার এসে গেল, অভিরূপবাবুর অবাক হবার যথেষ্ট কারণ আছে কিন্তু তিনি মনের ভাব গোপন করার চেষ্টাও করলেন না গাড়ি থেকে নামতেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমরা এখানে?"
"ভাবলাম উইকেণ্ডটা তোমাদের সাথে এই গ্ৰামে কাটানো যাক"
"নাকি আমাদের উপরে গোয়ান্দাগিরি করতে এসেছো যে আদিত্যর সাথে আমাদের কি কথা হয় সেটা জানতে?"
সত্যিটা ধরা পরে যাওয়ায় অরুণাভ কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেল কিন্তু মৌমিতা কথা ঘোরানোর জন্য বলে "না বাবা, আপনাকে তো আগের বার এসেও বললাম এই গ্ৰামটা আমার সত্যিই ভালো লেগেছে তাই আমিই বললাম এখানে এসে থাকতে"
"থাকতে চাও ভালো তবে কারো সঙ্গে ঝামেলা কোরো না"
"না বাবা চিন্তা নেই কারো সঙ্গে ঝামেলা করবো না"
মৌমিতা আশ্বাস দিল বটে তবে ওর কথা বলার ঢঙটা অভিরূপবাবুর ভালো লাগলো না যদিও তিনি মুখে আর কিছু বললেন না।
বিকেলে গ্ৰাম দেখার নাম করে মৌমিতা বেরিয়ে পরলো একাই বেরোলো উদ্দেশ্য যদিও গ্ৰাম দেখা নয় আদিত্যকে দেখা। বাড়িটা চেনাই ছিল তাই অসুবিধা হলো না কাউকে জিজ্ঞাসা করারও দরকার হলো না, বাড়ির গেটের সামনে আসতেই থমকে দাঁড়িয়ে পরলো সে, যা দেখলো তাতে তার পুরো শরীর জ্বলে উঠলো। গেট থেকে ভিতরে পোর্টিকো এবং লন এবং বাগানের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে।
স্পষ্টতই আদিত্য আর পিয়ালীকে একসাথে দেখতে পেল মৌমিতা দুজনে হেসে হেসে কথা বলছে, মাঝে মাঝে আদিত্য মেয়েটার পেটে হাত দিচ্ছে আবার কান পাতছে, স্বভাবতই দৃশ্যটা সহ্য হলোনা মৌমিতার, রাগে হিংসায় তার হাত নিশপিশ করতে থাকে কি করবে ভাবতে গিয়ে পায়ের কাছে একটা পায়রার ডিমের সাইজের পাথর পরে থাকতে দেখে সেটা হাতে তুলে নেয় সে ঠিক করে এটা দিয়েই মেয়েটার মাথা ফাটিয়ে দেবে সেইমতো পাথরটা ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুতও হয় কিন্তু মোক্ষম সময়ে মেয়েটির পাশে বসা কালো কুকুরটা তার দিকে মুখ ফেরায় এবং গর্জন করে ওঠে ফলে দ্রুত হাত থেকে পাথরটা মাটিতে ফেলে দেয় মৌমিতা।
আদিত্য বাদশার দৃষ্টি অনুসরণ করে গেটের দিকে তাকিয়েই অবাক বিস্ময়ে বলে ওঠে "আপনি?"। এবার পিয়ালীও গেটের বাইরে দাঁড়ানো মৌমিতাকে দেখে সেও অবাক হয়।
"এসেছিলাম গ্ৰামে তাই ভাবলাম একটু ঘুরে দেখি" মৌমিতা আমতা আমতা করে জবাব দেয়।
"গ্ৰাম দেখতে বেরিয়েছিলেন ভালো" আদিত্য শান্ত স্বরে কথা বলে যদিও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মৌমিতাকে জরিপ করতে থাকে।
"অ্যাক্চুয়ালি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম বললেও ভুল বলা হবে না" গেট থেকে ভিতরে ঢুকে আদিত্য এবং পিয়ালীর কাছে এসে উত্তর দেয় মৌমিতা।
"আমার সাথে?" আদিত্য আরও অবাক হয়।
"সেদিন তোমাকে দেখেছিলাম খালি গায়ে মাটি কোপাতে, মানতেই হবে এখনো সেই জিনিসটা আছে তোমার মধ্যে যেটা কলেজ লাইফেও ছিল, মেয়েরা ঘুরঘুর করতো তোমার আশেপাশে"
মৌমিতার কথা শুনে আদিত্য এবং পিয়ালী পরস্পরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করে, মৌমিতা সেটা লক্ষ্য করেই আবার ঠেস দেওয়া স্বরে বলতে শুরু করে "তোমার ওয়াইফ জানে সেটা? আইমিন তোমার অতীতের কথা, তোমার আসল নাম" এতটুকু বলে মৌমিতা একটু থেমে আদিত্য এবং পিয়ালীর মুখের ভাবটা বোঝার চেষ্টা করে তারপর আবার বলতে শুরু করে "তুমি বলোনি ওকে যে তোমার সাথে আরো একজনের আইমিন একটা মেয়ের রিলেশন ছিল? এগুলো তো বলতে হয় আদিত্য নাকি আমি তোমাকে বলবো অনিকেত"।
মৌমিতার মুখে নিজের আসল নামটা শুনে আদিত্য কিছুটা চমকে উঠলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিল, নিজের নাম শুনে তার চকিত দৃষ্টি মৌমিতার দৃষ্টি এড়ায়নি সে ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি নিয়ে বলতে থাকে "এবার এটা বোলো না যে তুমি অনিকেত না, আদিত্য কারণ আমি জানি যে তুমি অনিকেত আর আমি কিভাবে জানলাম সেই প্রশ্নে বলি তোমাকে আমি যতটা চিনি ততটা বোধহয় তোমার এই ওয়াইফও জানে না, ইনি ওয়াইফ তো নাকি অন্য কিছু"
"মিসেস ব্যানার্জী" প্রায় গর্জন করে ওঠে আদিত্য, "ডোন্ট ক্রশ ইওর লিমিটস" কিন্তু পিয়ালী তার কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্ত হতে ইশারা করে নিজে মুখ খোলে,
"আমার আর ওর মধ্যে কি রিলেশন সেটা যদিও আপনাকে বলার কোনো বাধ্যবাধকতা আমাদের নেই তবুও বলি ও আমার হাজবেন্ড। আর আমার হাজবেন্ড আমাকে সব বলেছে ওর অতীতের কথা"
"তাই নাকি? কি কি বলেছে জানতে পারি?"
"নিশ্চয়ই, ওর সাথে একটা মেয়ের সম্পর্ক ছিল সেই মেয়েটি ওকে চিট করে ওর দাদার সাথে রিলেশনে জড়ায় শুধু তাই নয় সেই মেয়েটি ওর দাদার সাথে মিলে ওকে মারার জন্য খাদ থেকে ফেলে দেয়, আর কিছু শুনতে চান?"
এতক্ষণ মৌমিতার মুখে একটা শয়তানি হাসি ছিল কিন্তু এখন পিয়ালীর উত্তর শুনে রাগে লাল হয়ে গেল চোখ থেকে হিংস্রতা ঠিকরে বেরোচ্ছে পারলে সে এখনই পিয়ালীকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে, কিন্তু আশ্চর্যভাবে নিজেকে সামলে রেখেছে কিন্তু রাগ সামলাতে পারছে না, চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, "যা বলছো সেটা প্রমাণ করতে পারবে?"
"কোনটা? ওকে খুন করতে চাওয়ার টা? বাবা আইমিন অভিরূপ ব্যানার্জী যদি জানতে পারেন যে ওনার ছেলে বেঁচে আছেন তাহলে কি আর কিছু প্রমাণের দরকার হবে? তখন ওর মুখের কথাই যথেষ্ট নয় কি? আর ও ওনার ছেলে কি না এটা জানার জন্য শুধু একটা ডিএনএ টেস্ট দরকার আর কিছু না"
রাগের মাঝেও মৌমিতার মুখে আবার একটু হাসি দেখা যায় সে বলে, "তোমার কি মনে হয় অভিরূপ ব্যানার্জী তাঁর বড়ো ছেলে অরুণাভর কথা বিশ্বাস না করে তোমাদের কথা বিশ্বাস করবে? সেদিন থানায় কি হয়েছে মনে নেই? ওনার কাছে ওনার বড়ো ছেলে সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের প্রতিরূপ উনি সর্বদা ওকেই বিশ্বাস করেন"
"তাহলে দেখাই যাক উনি কার কথা বিশ্বাস করেন? ওনাকে গিয়ে সবটা বলি তাহলে?"
পিয়ালীর এই কথায় চকিতের জন্য মৌমিতার মুখে একটা ভয়ের রেখা এসেই মিলিয়ে গেল সেটা লক্ষ্য করছি বোধহয় আদিত্য এবার মুখ খুললো,
"আমাদের কথা উনি বিশ্বাস করবেন কি না সেটা পরের কথা কিন্তু প্রমাণ পেলে পুলিশ নিশ্চয়ই করবে আর সেই প্রমাণ আমার কাছে আছে"
মৌমিতার মুখে ভয়ের রেখা আরও স্পষ্ট হলো আদিত্য মনে মনে খুশী হলো সেটা দেখে সে বলতে থাকে,
"এবং সত্যি বলতে আমি যদি চাইতাম তাহলে আপনাদের সত্যিটা দশবছর আগে আপনার আর অরুণাভ ব্যানার্জীর বিয়ের দিনেই সবার সামনে আনতে পারতাম তখন হয়তো আপনাদের ওয়েডিং নাইট টা জেলে কাটাতে হতো অবশ্যই আলাদা আলাদা কারণ জেলে জেন্টস এবং লেডিসদের আলাদা রাখা হয়, কিন্তু আমার সেরকম কোনো ইচ্ছা নেই তার থেকে আপনারা আপনাদের মতো থাকুন আর আমরা আমাদের মতো থাকি।"
মৌমিতা একবার আদিত্য আর একবার পিয়ালীকে দেখতে থাকে আদিত্য আবার বলে, "আরেকটা কথা কেউ যদি আমার আর পিয়ালীর ক্ষতি করতে চায় তাহলে তাকে আমার এই বাদশা খুব একটা পছন্দ করে না কাজেই পরের বার থেকে আমাদের পাথর ছোঁড়ার চেষ্টা করার আগে একটু সাবধান থাকবেন বলা তো যায় না হয়তো বাদশা সেই হাতটাই কামড়ে শরীর থেকে আলাদা করে দিল, নমস্কার"
মৌমিতা আর দাঁড়ালো না দুজনের দিকে আরও একবার হিংস্র দৃষ্টি দিয়ে বেরিয়ে গেল।