Thread Rating:
  • 153 Vote(s) - 3.39 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Adultery হেমন্তের অরণ্যে
#75
[Image: 99fc563b-3cbe-4732-91c5-51afbe560473.png]
বাপের দিকে তাকাতেই এখন ভয় তার। দৌড়ে আশ্রয় নিল কাবেরীর পেছনে


----এই পাহাড়ের একটা নাম আছে, আড়িরাংবুরু। অসীমকে কথাটা বলেই হাসলেন হেমেন দা।
এমন উদ্ভট নাম শুনে অসীম বললে---এইরকম নাম কেন?
হেমেন দা কাপে চুমুক দিয়ে বললেন---কেন বলতে পারবো না। মুন্ডারী ভাষায় এমন নামের কোনো অর্থ আছে বোধ হয়। এই যেমন মামা-ভাগ্নে।
দক্ষিণের দিকে ইশারা করে অসীম বলল---সে অর্থে ওই দুটো পাহাড়ের নামও তো রাখা যায়, দাদু নাতি। ঠিক যেন বুড়ো পাহাড়টার পাশে ছোট টিলাটা কতকাল হাত ধরে একসাথে রয়েছে।

সাত সকালে চা খেতে খেতে এমন মস্করা চলছে গুরু-শিষ্যের। কাবেরী সেই যে সকাল সকালে চা দিয়ে গেল আর দেখা মিলছে না। অসীম বললে---কাবেরীকে দেখছি না তো?
---ঘরেই রয়েছে বোধ হয়।

বড় বারান্দা থেকে অসীম উঠে কাবেরীর ঘরে গেল। কাবেরী জানালার পাশে চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে একটা মোটা বই পড়ছে। পড়া বললে ভুল হবে, ইতস্তত পাতা ওল্টাচ্ছে। অসীম লক্ষ্য করে দেখল বই বলে এতক্ষণ যেটা ভুল করেছিল, ওটা আসলে টেলিফোন ডিরেক্টরি।
তামাশা করে বলল অসীম---কী এত খুঁজছ? ওটা বেঙ্গলের নয়, ঝাড়খণ্ডের। অরুনাভ দা'র অফিসের নম্বর কী ভুলে গেলে নাকি?
কাবেরী পেন দিয়ে একটা গোল দাগ করে নিল নম্বরটার চারপাশে। তারপর বইটা বন্ধ করে বলল---তোমাদের চা খাওয়া হয়েছে?
---হয়েছে। আজ একবার আমার আর হেমেন দার প্ল্যান আছে ওই আড়িরাংবুরুর দিকে যাবার। যাবে নাকি?
---কি আড়ি...?
---আড়ি-রাং-বুরু।
দুর্বোধ্য নামটি শুনে কাবেরী ভ্রু কুঁচকে বললে---কি বিদঘুটে নাম!
---বাইরে বেরিয়ে দেখো দেখতে পাবে।

বারান্দা থেকে যতগুলো পাহাড় দেখা যায়, তার শেষ যে নীল পাহাড়টা, ওর নাম আড়িরাংবুরু। কাবেরী হতবাক হয়ে দেখল, নামটি যতই বিদঘুটে হোক, সকালের এমন মনোরম দৃশ্য কেবল ওই পাহাড়েই দেখা মেলে। সূর্যের কিরণ পড়ে একপাশ চকচকে রূপালী রাংতায় মোড়া যেন। বলল---আজই যেতে হবে?
---কেন? আমার যে পরশু ট্রেন ধরতে হবে। যতটা ঘোরার ঘুরে নিই। পরে একবার ললিতাকে নিয়ে আসবো।
---আজ না গেলে হবে না? কাবেরী ব্যাজার মুখে বলল কথাটা।
---কেন আজ কি কিছু বিশেষ রান্না করছ?
---না। আজ একটা বিশেষ কর্তব্য আছে। যদিও কর্তব্যটা আমার একান্ত। তোমাদের অত সাহস নেই।

কাবেরীর কথাগুলো হেঁয়ালি মনে হল অসীমের। হেমেন দা আর অসীম বেরোলো ঠিক সাড়ে ন'টায়। কাবেরী ওদের আর আটকালো না। যা করতে হবে তাকেই করতে হবে। এসব পুরুষ মানুষের দ্বারা হবে না, সেটা ও কালই বুঝে গেছে।

আলমগীর গাড়িটা একটা বড় গাছের তলায় রাখলো। হেমেন দা বললেন---এবার হাঁটতে হবে অসীম।
অসীম বড় গাছটা পর্যবেক্ষণ করে বলল---এটা কি গাছ বলুন তো হেমেন দা?
---হিজল।
---তাই বলুন। আমি এটা বাংলাদেশে দেখেছি।
হেমেন দা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে হাসলেন---হিজল দেখতে বাংলাদেশ যেতে হবে নাকি? খোদ কলকাতা শহরেই আছে।

আড়িরাংবুরু দুর্গম পাহাড়। খানিকটা ওঠা যায়, পুরোটা নয়। বয়সের ভারে হেমেন দা আর ওঠেননি। অসীম আলমগীরকে নিয়ে উঠল অনেকটা। খাঁজকাটা পাথরটা ডিঙালেই একটু সমতল। কুছুয়া না? অসীম ঠিকই চিনেছে। কুছুয়া কোমরে গামছা বেঁধে একটা কুড়ুল নিয়ে এক দৃষ্টিতে কোথাও যেন আটকা পড়েছে। অসীম হাঁক দিল--এই যে কুছুয়া? মুখে আঙুল চেপে ইশারা করল কুছুয়া।
অসীম ও আলমগীর দুজনেই থতমত খেয়ে গেল। সামনে একটা দলছুট হরিণ। হরিণটাও বেশ ভয় পেয়েছে। একটু শব্দ পেয়েই লাফ দিয়ে দৌড়ে উঠে গেল পাহাড়ের আরো ওপরে। ঘন জঙ্গলে হারিয়ে গেল নিমেষে। এই জঙ্গলে এসে কাঠবেড়ালি ছাড়া এতদিন অন্য কোনো বন্যপ্রাণ নজরে আসেনি অসীমের। আর ওই আসবার দিন রাতের অন্ধকারে হাতির পাল।

কুছুয়া এবার হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বলল---ধুনুক থাইকলে আজ শিকার হইত।
---তোমরা হরিণ শিকার করো? বনদপ্তর কিছু বলে না?
---বইলে। পরবের সময় ছাড়া মানা আছে। মানা হইলে কি হবে, মুন্ডারা জাতশিকারী। লুকাই লুকাই এক আধবার কইরে থাকে।
---কী কী শিকার করেছ তুমি? কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল অসীম।
কুছুয়া যেন লজ্জা পেল, বলল---আমি তেমুন পারি না। শিকারী হইল বুধন মুন্ডা। বাগে পাইলে শেরও শিকার কইরতে পারে।
বুধন মুন্ডা নামটা কানে বাজলো অসীমের। এই কি সেই কুন্তীর বাবা! কাল রাতে যে শাসিয়ে গেছিল হেমেন দা'কে! অসীম জিজ্ঞেস করলে---তুমি বুধনকে চেনো?
---চিনবক লাই? ই হাঁসড়া গেরামের সক্কলে চিনে। তারে ডরে না কে আছে? খুন কইরা দিত সিদিন পিন্টু যাদবকে।
---কে পিন্টু যাদব?
---খনির ম্যানেজারটা ছিল। সে কি বুধনের সাথে তক্কাতক্কি! হাঁসুয়া লয়ে দিল ঘাড়ে। তবে কি বুধন সেদিন হাড়িয়ার নেশা কইরে ছিল। ভুল জিগায় বুইসে গেল। তা লইলে ম্যানেজার...
----বুধনকে ভয় পায় কেন লোকে?
---রগচটাটা আছে কিনা! গায়ে গতরে জোরও আছে। হাড়িয়া খাই আইসে বউটারে মারলো সিদিন! বোঙ্গা বাবারে পরবে একা লয়ে যায় কাঁধে! হাড়িয়া খাওয়ার লগে একবার সে কী যুদ্ধ। বুধন মুন্ডা হাঁসুয়া লয়ে দিল কোপ!
---সাংঘাতিক লোক তো। খুনী নাকি?
---খুনটা হয় নাই। দিগা বাবা ধইরে লিছে। ওই একটা লোকরে মেনে চলে বুধন।

বুধন মুন্ডার কুকীর্তি শুনতে শুনতে সময়টা দেখা হয়নি অসীমের। নীচে নামতে হেমেন রায় বললেন---কি হল এত দেরী করলি কেন?
---কুছুয়ার সাথে দেখা হল। ওর সাথেই কথা বলতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল।
---ওঃ, কাঠ কাটতে এসেছে বুঝি?
---হেমেন দা এ পাহাড়ে তো হরিণও আছে।
হেমেন দা নীরবে হাসলেন---শীতের সময় রাতে বাড়ির একদম উঠোনে আসতে দেখবে হরিণকে।
আলমগীর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল---বাঘ আছে স্যার?
---ছিল। একসময় বেশ আনাগোনা ছিল। এখন আর দেখা যায় না। বনদপ্তরের নজরে মাঝে মধ্যে চিতা বাঘ দেখা মেলে। আমার থাকাকালীন কোনো দিন চোখে পড়েনি।

বাড়ী ফিরে ওরা দেখল এ ঘর ও ঘর কোথাও কাবেরী নেই। হেমেন দা বললেন---গেল কোথায় মেয়েটা? একা একা, পথ ঘাট চেনে না।
বলতে না বলতেই হাজির হল কাবেরী। পিছনে রঙ চটে যাওয়া ফুল ছিটের সালোয়ার পরা কুন্তী। বিস্ময়ে হেমেন রায় ও অসীম মজুমদার দেখতে লাগলেন। একটা পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। কাবেরী কি কথা বলছে ওদের সাথে।
বিস্ময়ের যেন অন্ত নেই। হেমেন রায় তার পিসতুতো বোনের এমন সাহসিকতার সাথে আগে পরিচিত ছিলেন না। ঘর সংসার আর সকালের স্কুলের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে থাকা মধ্যবয়স্কা হাউসওয়াইফের এ' এক ভিন্ন রূপ।

বুধন মুন্ডার হাত থেকে তার মেয়েকে ছাড়িয়ে আনলো কী করে কাবেরী! এই গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব তারা দুজনেই। কাবেরী স্মিত হাসলো। কুন্তীকে বলল---যা স্নান করে, কিছু মুখে দে।
মেয়েটা এখনো ভয়ে জুবুথুবু।
অসীম বললে---কাবেরী তুমি যে বীরাঙ্গনা! তা কী করে ওই সাংঘাতিক লোকটার কাছ থেকে তার মেয়েকে কেড়ে আনলে।
---বলছি বলছি। সব বলছি। তার আগে হেমেন দা, কুন্তীর একটা স্কুলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি তো বলোনি ও স্কুলে পড়ত রাঁচিতে? যতদিন না স্কুল বাড়ির কাজ শেষ হচ্ছে, ওকে রাঁচিতেই হোস্টেলে রেখে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এটা নিশ্চই করতে পারবে?

হেমেন রায়ের লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেল। যে কাজ সে পারেনি, সে কাজ কাবেরী নিপুণ ভাবে করতে পেরেছে।
খাবার টেবিলে বসে কাবেরী এক এক করে বলতে লাগলো কিভাবে সে জব্দ করেছে হাঁসড়ার ত্রাস বুধন মুন্ডাকে। টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে সংগ্রহ করেছে লোকাল থানার ফোন নম্বর। লোকাল থানা বলতে এখান থেকে প্রায় ষাট কিমি দূরে। থানা প্রথমে বিষয়টিতে ঢুকতে আগ্রহ দেখায়নি। বনদপ্তরের অনুমতি ছাড়া তারা অরণ্যনিবাসীদের জনজীবনে প্রবেশ করবে না। কাবেরী এক্ষেত্রে সাহায্য নিয়েছে অর্জুন কুমারের। হেমেন দা'র মাধ্যমেই যার সাথে পরিচয়, তার সাহায্য হেমেন নয় কাবেরী নিয়েছে। এক্ষেত্রে অর্জুন বাবু পুরোদস্তুর সাহায্য করেছেন।

পুলিশ নিয়ে কাবেরী যখন হাঁসড়া গ্রামে ঢুকল তখন চড়চড়ে রোদ। আদিবাসী এই গ্রাম এমনিতেই বিচ্ছিন্ন কয়েকটি বাড়ীর সমাহার। তার ওপরে মুন্ডারা মূলত খনিতে নতুবা কাঠ কাটার কাজ করে, এখন সকলে কাজে বেরিয়েছে। যারা আছে, পুলিশ ও কাবেরীকে বিস্ময়ে দেখছে তারা। ছোট বাচ্চাও বয়স্কদের ছাড়া কাউকে দেখা মেলা ভার। সব মিলিয়ে কাঠ, বাঁশ দিয়ে মাত্র কয়েকটা ঝুপড়ি। কোনটার চালায় টালি আছে, কোনটার চালাও কাঠের ছোট ছোট গুঁড়ি, ডাল দিয়ে তৈরী। পুলিশের যে কর্তা এসেছেন, তিনি কাবেরীর সাথে বাংলাতেই কথা বলছেন। আসলে জামশেদপুর নিবাসী হলেও পুলিশকর্তা নীতীশ মল্লিক আদ্যোপান্ত বাঙালি। এর আগে খনির ঘটনায় অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেসে বুধনকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনিই। কাজেই বুধনের বাড়ীটা তাঁর জানা আছে।

প্রত্যেকটা বাড়ি একে ওপরের থেকে বিচ্ছিন্ন, বুধন মুন্ডার বাড়িটা যেন সম্পূর্ন পৃথক। হাঁসড়ার সাথে তার কোনো সংযোগ নেই। উঁচু পাহাড়ের ঘন এক অরন্যাবৃত অঞ্চলের মধ্যে এক চিলতে ঝুপড়ি ঘর। বাড়ীর পেছনেই পাহাড়ের খাড়াই ঢাল। বলা যেতে পারে খাদ। খাদের অন্যপ্রান্তের পাহাড় হতে একটি সরু নদী কলকল করে নেমে আসছে।

নীতীশ মল্লিক গমগমে গলায় হাঁক ছাড়লেন---বুধন!

দিনের আলোয় লোকটাকে স্পষ্ট দেখতে পেল কাবেরী। সচরাচর মুন্ডাদের উচ্চতা এত দীর্ঘ হয় না। ছ' ফিট দুই উচ্চতার পিচ কালো অনাবৃত চেহারায় চকচক করছে রূপোলী ঘাম। মাথায় জড়ানো লাল গামছার ওপর থেকে কোঁকড়ানো ধূসর অপরিচ্ছন্ন চুলে এসে পড়ছে হলদে আলো।
----তোর মেয়ে কোথায়?
নীতীশ মল্লিকের এমন তীক্ষ্ণ প্রশ্নের পরে বুঝতে অসুবিধা হল না বুধনের। হাড়িয়া খাওয়া লাল নেশাতুর চোখে তখন যেন অগ্নুৎপাত হচ্ছে কাবেরীর দিকে চেয়ে। মাস্টারমশাই বাড়ীতে আগত এই দিদিমণিই যে মূল পাণ্ডা তা বুধন মুন্ডার আর অনুমান করার দরকার নেই। সজোরে আধফাটা গুঁড়িতে ঘা দিয়ে ছুঁড়ে দিল কুঠারটা। আলগা হয়ে ফালি হয়ে গেল দু' প্রান্ত। মাথার গামছাটা খুলে মুখের ঘাম মুছে কাঁধে রাখলো। কানের ওপর থেকে বিড়িটা টেনে এনে ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিল সে। দেশলাই কাঠি মেরে ধোঁয়া ছাড়লো খানিকটা।

---ছ'মাস জেল খেটেও তুই শুধরালি না বুধন। কোমরে দড়ি বেঁধে শালা তিহার চালান করলে বুঝতে পারবি আজীবন পচা কাকে বলে!

বুধনের চোখ তখন কাবেরীর দিকে। পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করছে সে। কাবেরী বুঝতে পারছে লোকটার ক্রোধ এখন তার ওপরে।

ততক্ষণে নীতীশ মল্লিকের ইশারায় দু'জন কনস্টেবল ঢুকে পড়েছে বুধনের ঝুপড়িতে। কুন্তী বেরিয়ে এসে দেখল মাস্টারবাড়ীর দিদিমণি। বাপের দিকে তাকাতেই এখন ভয় তার। দৌড়ে এসে আশ্রয় নিল কাবেরীর পেছনে।
---জনম দিব আমি। আর কুথাকার মেয়েছেলে আইসে লিয়ে যাবে বিটিরে। বিটির ভাত-কাপড় দিবে কি এই শহরের দিদিমনিটা?
---কথা বাড়াস না বুধন। নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কেস জানিস? এমন কেস দেব...নীতীশ মল্লিকের স্বপ্নে বোঙ্গা দেবতা এসে তোকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে না। হুঙ্কার দিলেন মিঃ মল্লিক।

কুন্তী তখনও ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে। কাবেরীর কানের কাছে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলল--দিদিমণি, বাপ আমারে মাইরে ফেলবে। বিয়ে আমি করবক লাই।
---ভয় পেও না কুন্তী। এখন আর কেউ তোমার বিয়ে দিতে পারবে না। কুন্তীকে অভয় দিল কাবেরী।

ঝুপড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বুধনের অসুস্থ বউ সাগিনা। বেশ রুগ্ন চেহারার, তিল চিটচিটে শাড়িতে, কোলে একটা সাত-আট মাসের বাচ্চা। পাশে কুশি, ফ্যালফেলিয়ে দেখছে কাবেরীকে।

বুধন তার বউর দিকে চেয়ে বলল---দিখেলে মাগী, এমন বিটি জনম দিছিস। বাপের কথাটা শুনল লাই। পুলিশ লিয়েসে বাপরে জেল খাটাইবে।

বুধনের বউ চুপ করে রইল। যেমন নির্বিকার ভাবে বের হয়েছিল, তেমনই নির্বিকার ভাবে বাচ্চা কোলে নিয়ে ঢুকে গেল ঘরে।

জিপে উঠবার আগে বুধন মুন্ডা হুমকি দিল কাবেরীকে---দিদিমণি কামটা ঠিক হল লাই। আমি বুধন মুন্ডা আছি। মনে রাইখবেন।

জিপ চলতে নিশ্চিন্ত হল কুন্তী। কাবেরীও যে একটু আশ্বস্ত হল তা না বললে ভুল বলা হবে। এমন দীর্ঘ কঠোর চেহারার আদিবাসী লোকটাকে যে কেউ দেখলে ভয় পাবে। বিশেষ করে ওই দুটো চোখ। বুধনের চেহারাটা যেন পাথর দিয়ে বানানো। প্রত্যেক পুরুষের মধ্যেও কম বেশী কমনীয়তা থাকে। বুধনের তা ছিঁটেফোঁটা নেই। ওর সর্বাঙ্গ যেন কর্কশ, অমসৃণ একটা রুক্ষ পাহাড়ের ঢালের মত। তার ওপর কাবেরী দু'বার ওর মুখোমুখী হল; দুইবারেই ওর সাথে ধারালো অস্ত্র ছিল। এ বারেরটি যদিও কাঠ কাটা কুঠার। তবুও শেষ ঘায়ে যেভাবে গুড়িটাকে ফালাফালা করল, ধড় থেকে মুন্ডু নামাতে যথেষ্ট।

কুন্তী কাবেরীর গায়ের কাছে এখনো সেঁধিয়ে বসেছে। মৃদু ফুঁপিয়ে চলেছে মেয়েটা।
কাবেরী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল---তুই পড়তে চাস?
ধরা গলায় মেয়েটা বলল----পারতডিহি ইস্কুলটায় পড়বার সময় সিখানটার মাস্টারমশাই রাঁচির ইস্কুলটায় ভর্তি করে দিছিল। আট কেলাসে পড়বার সময় বাপ আইসে লিয়ে গেল। বলল তোর বিয়া দিব। হেমেন মাস্টার আমারে পড়ার লগে বই কিনি দিছিল। আমি বিয়া করবক লাই বলে হেমেন মাস্টারের ঘরে পালাইলি। বাপ তুখন জেলে। মা'টা আমার অসুস্থ আছে। কামটাতে যেতে পারে লাই আর বাপ আইসেই...

যে মেয়েটাকে এ' কদিন কাবেরী লাজুক দেখেছে, কাবেরী যা কাজ বলেছে, বোবার মত করে দিয়েছে, সেই মেয়েটা আজ কাবেরীর ওপর ভরসা করে কত কথা বলে যাচ্ছে। কুন্তী জানে তার বাপ বুধন মুন্ডা সাংঘাতিক লোক, তার মুখোমুখী দাঁড়িয়ে যে দিদিমনি তাকে উদ্ধার করেছে, তাকে ভরসা করা যায়। তবুও ভয় তার পিছু পিছু রয়েছে সবসময়।

---নীতীশ বাবু, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

নীতীশ মল্লিক ড্রাইভারের পাশে বসে জানলা দিয়ে একমনে দেখছেন চারপাশটা। কাবেরীর কথায় হুঁশ ফিরল তার। মৃদু হাসলেন নীতীশ মল্লিক---ধন্যবাদ কেন ম্যাডাম। ধন্যবাদ তো আপনাকেই দেওয়া উচিত। যে সাহসিকতার কাজ আপনি করলেন তার জন্য ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।

----লোকটাকে অ্যারেস্ট করিয়ে কিছুদিন জেলে রাখা যেত না?

এবার শব্দ করে হাসলেন নীতীশ বাবু---দেওয়া যেত নিশ্চিত। তবে তার জন্য আপনাকে একটা এফআইআর করতে হত আগে। তাছাড়া বুধন মুন্ডা সাংঘাতিক লোক। রগচটা, গোঁয়ার। প্রচণ্ড ক্রোধী যেমন, তেমন গায়ে অদম্য শক্তি। সাধারণ মুন্ডাদের থেকে ওর চেহারাটাও অনেক বেশি দীর্ঘ, শক্তপোক্ত। পরবের সময় বোঙ্গা দেবতাকে একা কাঁধে তুলে উঁচু পাহাড়ে অধিষ্ঠান করায়। হাঁসড়ার মানুষ ওর এই ক্ষমতাকে ভয় পায়। তা বলে বুধন মুন্ডা ঠিক ক্রিমিনাল নয়।
কাবেরী প্রতিবাদ করে উঠল----ক্রিমিনাল নয় বলছেন? একটা লোক নিজের নাবালিকা মেয়ের জোর করে বিয়ে দিতে যাচ্ছিল! বাড়ি বয়ে ভদ্রবাড়ীতে রাতের অন্ধকারে অস্ত্র নিয়ে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। খুন পর্যন্ত করেছে যে লোকটা! তাকে আপনি ক্রিমিনাল বলতে রাজি নন?

নীতীশ মল্লিক পুনরায় হাসলেন, তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন---খুনটা যদিও শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে কি জানেন বুধনের আরেকটা দিক আছে, যেটা খুব কম লোকে জানে। বুধন প্রতিবাদী। হাঁসড়া আর পারতডিহি দুটোই আদিবাসীদের গ্রাম। এই দুটো গ্রামের মাঝেই খনিটা। কাজেই দুটো গ্রামের জনজীবন এই খনির ওপর নির্ভরশীল। ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগণার সর্বত্র খনিতে শ্রমিক হিসেবে মূলত আদিবাসী, ভূমিহার শ্রেণীর পিছিয়ে পড়া মানুষেরা কাজ করে। বুধন যে খনিটায় কাজ করত ওটা 'নিকুঞ্জলাল এন্ড সন্স' ও গভর্নমেন্টের আধা শেয়ারাধীন। 'নিকুঞ্জলাল এন্ড সন্স' খনিকে রুগ্ন দেখিয়ে সরকারকে বাধ্য করতে চায় শেয়ারটা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কাজেই উত্তোলন কমাতে হবে। আর উত্তোলন কমানো মানে শ্রমিকের ওপর কোপ পড়া। কোম্পানি সে জন্য পিন্টু যাদব নামে এক উচ্চবর্নীয় ম্যানেজার নিয়োগ করে, যাতে নিম্ন বর্ণের খনি শ্রমিকদের দমন করা যায়। এদিকে অরণ্যের কাঠ কাটা বন্ধ হচ্ছে, আদিবাসীদের জীবন জীবিকার প্রশ্নে নতমস্তক হয়ে থাকা ছাড়া উপায় কী। দৈনিক যে বেতনে মুন্ডাদের পেট চলে তাতেই যদি কোপ পড়ে, চলবে কী করে ওদের। বুধন মুন্ডা মাথা নত করবার লোক নয়। হকের টাকা সে নিয়েই ছাড়বে। এদিকে পিন্টু যাদবও চশমখোর। আদিবাসীরা তার্কিক হয় না, এ কথা পিন্টুর জানা ছিল না। তাছাড়া বুধন মুন্ডা তো নয়ই। হাড়িয়ার নেশায় লুঙ্গির ভেতর থেকে বার করে দিল এক কোপ। ফস্কে যাওয়ায় তেমন মারাত্বক ক্ষতি হয়নি পিন্টুর। ছ' মাস জেল খাটবার পর, পিন্টুর পরিবার কেন কেস তুলে নিল তা বোঝা গেল না। মুন্ডাদের অনেক কুযুক্তি আছে। তারা মনে করে স্বয়ং বোঙ্গা দেবতা স্বপ্নে এসে পিন্টুর পরিবারকে ভয় দেখিয়েছে। বুধনের কাঁধে চড়েই বোঙ্গার পাহাড়যাত্রা হয় কিনা।
কথাগুলো শেষ করেই হেসে উঠলেন নীতীশ মল্লিক। কাবেরী অন্য এক বুধনকে জানলো আজ। বিরসার জনজাতির দেশে এসে কত বিরসাই অন্তরালে রয়ে যায় বলে মনে হল কাবেরীর। আপাদদমস্তক কঠোর পাথর খোদিত চেহারার লোকটার এতক্ষনের খল চরিত্র থেকে কাবেরী খুঁজে পেল অন্য এক মানব।

খাবার টেবিলে বসে অবশ্য বুধনের দ্বৈত স্বত্বা নিয়ে কাবেরী কোনো কথা বলেনি। বুধন মুন্ডার জীবনের অন্য আরেক দিক কাবেরী শুধু নিজের মধ্যেই আবদ্ধ করে রেখে দিল। কুন্তীকে উদ্ধার পর্যন্ত গল্প বলেই সে ক্ষান্ত হল। হেমেন রায় স্থির করলেন গরমের ছুটির মধ্যেই কুন্তীর একটা স্কুলে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
ওপাশ থেকে বারংবার টেলিফোনের শব্দ আসতে থাকায় অসীম উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল---ও হ্যা।বলুন অরুণাভ দা। দিচ্ছি...কাবেরী তোমার ফোন। অরুণাভ দা।

কাবেরী মনে মনে ভাবলো অরুণাভকে সবটা খুলে বলবে এখুনি? সবটা মানে যে কথাগুলো হেমেন দা বা অসীমকে বলা হয়নি সেগুলো?
++++++

[Image: IMG-20221010-144146.png]
কামটা ভালো হলনি দিদিমনি।
Like Reply


Messages In This Thread
RE: হেমন্তের অরণ্যে - by Henry - 10-10-2022, 05:51 PM



Users browsing this thread: 3 Guest(s)