28-06-2022, 02:26 PM
#শ্বশুর_জামাই_ষষ্ঠী
#শুভ্র_কিশোর_বসু
শ্বশুরকে ফোন করে বললাম, "হাই পপস।" শ্বশুরমশাই -- রং নাম্বার বলে, ফোনটা কেটে দিলেন। উফফ, এরা বোধহয় আর কোনোদিন ইন্টার-ন্যাশানাল হবে না, সেই ভেতো বাঙালি হয়েই জীবন কাটিয়ে দেবে।
আবার ফোনে, ধরলাম। "বাবা, আমি সূর্য বলছি।"
"সূর্য কে !" শ্বশুরমশাই, আবার বিচলিত।
"আরে আপনার একমাত্র জামাই, আপনিও না ! তিনমাস হয় নি, নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন -- এর মধ্যে ভুলে গেলেন ! পারেনও বটে !"
"কিন্তু আমি তো যতদূর জানি, আমার জামাইয়ের নাম -- রৌদ্র মিত্র !" শ্বশুর মশাই, ঘেঁটে ঘ !
"আরে ওই হল, সূর্য না থাকলে, রৌদ্র আসবে কোথা থেকে ! শর্ট-এ সারলাম।"
"উফফ, তুমি তো দেখছি আমার হার্টফেল করিয়ে দেবে ! জানো, অলরেডি একবার আমার বাইপাস হয়ে গ্যাছে, উফ্ফ। বুকটা এখনও দ্রুম দ্রুম করছে !" মনে হল, উনি এখনও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেন নি।
এই রে ! কেলেঙ্কারি করেছে। ওনার এই বাইপাসের খবরটা আমি খালি ভুলে যাই। আমার দশটা ডাকনাম আছে। বিয়ের পরের সপ্তাহে, ভুল করে নিজের আর একটা ডাকনাম শুনিয়ে দিয়েছিলাম। উনি চিনতে না পেরে, প্রেসার ট্রেসার বাড়িয়ে, যায় যায় অবস্থা। বউ তো সব শুনে, আমাকে আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে -- যদি আমার কারণে, শ্বশুর মশাই মারা যান, তবে আমার বিরুদ্ধে খুনের ধারা দেবে। আর আমি যেন, কোনোদিনও ওনাকে ফোন না করি।
করতাম-ও না। যদি না, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ থাকত। কী দরকার ছিল, জামাই ষষ্ঠী আর পাকিস্তানের সাথে ম্যাচ, একদিনে ফেলার ! সব ঢপের চপ লোকজন । হতভাগাদের তো আর জামাই ষষ্ঠী নেই। লে হালুয়া, ফেলে দে খেলা ! জামাইগুলোর কী হবে ! শান্তিতে দু- দণ্ড খেলা দেখতে পাবে না। তাই, ফন্দি বের করে, শ্বশুরকে ফোনে ধরলাম। "বাবা, সামনের শনিবার জামাই ষষ্ঠী, শুনেছেন তো ! মালপত্র যা দেবেন, বগলদাবা করে নিয়ে চলে আসুন, জামাইয়ের বাড়িতে।"
"মালপত্র যা দেবেন, মানে ...! এই তো তিনমাস হয়নি, দিলুম !"
"লে হালুয়া, আমি কী জানি ! আপনার মেয়েই তো হাত পা ছড়িয়ে, কালকে হিসেব করছিল। সে যাই হোক, ওসব আপনার মেয়ে আর বউয়ের ব্যাপার, আমার ঢুকে কাজ নেই। আমি শুধু চাই, আপনি জামাই ষষ্ঠীর দিন, আমাদের বাড়িতে এসে, খেলা দেখুন। লম্বা পঞ্চান্ন ইঞ্চির টিভি কিনেছি, এ.সি লাগিয়েছি, পা ছড়িয়ে খেলা দেখবেন। ব্যস। আপনিও খুশ, আমিও খুশ।" এক নিঃশ্বাসে, ঝাক্কাস অফার দিয়ে -- মুক্তি পেলাম।
"এই শোনো, টিভি আর এ.সি -- তুমি কবে কিনলে খোকা ! সব তো আমিই দিলুম।" শ্বশুর মশাই জামার কলার তুললেন, মনে হল।
তা, নিজের মেয়েকে ছোট থেকে এ.সি-র হাওয়া খাইয়ে, কে মানুষ করতে বলেছিল শুনি ! আমি ! অত বড় ধাড়ি মেয়ে, যেই কোলে বসে বলল, বাবা, "আমাকে কিন্তু এত্ত বড় টিভি দিতে হবে, হুমম ..." , অমনি সুরসুর করে পঞ্চান্ন ইঞ্চির টিভি আর একখান দেড় টনের একখান ঢাউস এ.সি -- জামাইয়ের পেছনে গুঁজে দিতে হল ! নে, এবার বোঝ। মাসে দু-হাজার টাকার বিল, কে দেয় শুনি ! এমনিতে আমার মাইনে, প্রাগ-ঐতিহাসিক হয়ে গ্যাছে। ডি.এ নেই, পে কমিশন মমি হয়ে গ্যাছে। ওসব ফালতু ঝামেলা না দিয়ে, টাকাটা ...
"তোমায় দিলে, জম্পেশ করে মাল খেতে বুঝি... ! আর তাছাড়া, আমি মেয়েকে কী দেব, তার জন্য তোমার। অনুমতি নেব !" শ্বশুর মশাই দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন। "ধুৎ, আমি আপনার টাকা নেব কেন ! বরং ফালতু খরচ না করে, নিজের ব্যবসায় খাটালে, কিছু রিটার্ন পেতেন। আর শুনুন, একটা বড় হুইস্কির পেটি তুলব ঠিক করেছি, ডক থেকে, বিদেশি -- টানা মাল। হেব্বি টান। এক পেগ খেলে, চব্বিশ ঘন্টার গ্যারান্টি। আমি খুলে ফেললে, কতক্ষণ থাকবে জানি না। একটা বোতলের খরচা আমার, বাকিগুলোর আপনার। খালি হাতে আসবেন না। ব্যবসায়ী মানুষ। বুদ্ধিমান। একগাদা শাড়ি, ব্লাউজ , প্যান্ট , শার্ট ওসব কাইন্ডে ফালতু খরচা করবেন না । সলিড আনলে, আপনিই প্রফিটেড । বাকিটা, আপনি বুঝুন।"
আসলে গুল মারলাম। আমার শ্বশুরের, ওটুকুই যা দুর্বলতা। এর টানে তিনি, জামাই ষষ্ঠীর দিন, নিজের মেয়ের তো বটেই -- এমনকি অন্যের মেয়ের শ্বশুর বাড়ি-ও চলে যেতে পারেন। সেই টানেই হয়তো, সকাল সকাল এসে হাজির। পইপই করে নিষেধ করেছিলাম, হাতে করে কিছু না আনতে। কিন্তু বিধি বাম। সেই, দু-হাত ভর্তি করে, সব নিয়ে এসেছেন। বাঙালি স্রেফ অপত্য স্নেহে -- নিজেদের ভবিষ্যৎ, নিজের হাতে নষ্ট করে দেবে। নিজের জন্য কিছুই রাখবে না। বুড়ো বয়সে, হাতে ব্যাঙ্কের শূন্য পাসবুক ছাড়া কিছুই থাকবে না।
আমার মাইনে হতে, এখনও দু'দিন বাকি। মালের টাকা পকেটে রেখে, বন্ধুর কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ধার করলাম। আফটার অল, শ্বশুর-শাশুড়ি বলে কথা। জমিয়ে বাজার করতে হবে। জানিনা, এই কটা টাকায় হবে কিনা। বাঙালির তো উৎসব আর পার্বণ ছাড়া কিছু পড়ে নেই। পুরো জাতটা গিলে আর গিলিয়ে ফতুর হয়ে গেল। যাক গে। সব জাতেরই কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তাই নিয়েই বেঁচে থাকা উচিত।
সমস্যা হল, শাশুড়ি কিছু একটা সন্দেহ করেছেন। সমানে শ্বশুর মশাইকে গাল পাড়ছেন। এ ক্যামন কথা বাপু। লোকলজ্জা ভুলে, জামাই ষষ্ঠীর দিন, জামাইয়ের বাড়িতে এসে, পেট পুরে খাওয়া ! আমাকে ডেকে বললেন -- "রত্ন (আমার আরেক নাম), তোমরা কী কোনও স্কীমে আছো !" মানুষের জীবনটাই তো স্কীম। নতুন করে বলার কিছু নেই। "নাহ" -- বলে, ঠোঁট উল্টে কেটে পড়লাম।
শাশুড়ির কড়া ম্যান মার্কিং এড়িয়ে, শ্বশুরমশাইকে নিয়ে, ছাদের ঘরে আসর বসালাম । দু-পেগ পান করেই, ওনার হালকা নেশা হল। আমি অনেকরকম নেশারু দেখেছি। নেশা হলে কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, কেউ আবেগী হয়ে জীবনের সব দুঃখ উগড়ে দেয়। আমার শ্বশুর মশাই, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করলেন। ওনার প্রেম করে বিয়ে । শ্বশুরবাড়ি মানে নি। উনিও কোনোদিন যান নি সেভাবে। নিজের পায়ে কষ্ট করে দাঁড়িয়েছেন। জীবনের সব সুখ আর আহ্লাদ , ওই ব্যবসা আর হুইস্কির বোতলের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। কিছু মানুষ আছেন। সারাজীবন শুধু কষ্ট করেন। জীবিকার জন্য। পরিবারের জন্য। অন্যের জন্য। যে সুখ, আরাম অন্যকে দেন, তার কণামাত্র নিজেকে দেন না। " জানো রৌদ্র, আমি কোনও দিন জামাই আদর পেলাম না। শ্বশুর বাড়ি কী জিনিস, বুঝলামই না। অথচ দ্যাখো, যে শাশুড়ির দেমাকের অন্ত ছিল না, তিনিই আমার বাড়িতে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়ে গেলেন। তিন ছেলের কেউ, সেভাবে দেখল না। আমি তখনই ঠিক করেছিলাম, আমি শ্বশুরের কর্তব্যে কোনওদিন ভুলচুক করবো না। আমি পাইনি তো কী হয়েছে -- আমার জামাই যেন শ্বশুর বাড়ির মর্ম বোঝে। তুমি সেয়ানা হলেও, ভালো ছেলে। ছোটো থেকে একা হাতে লড়ে -- বড় হয়েছ। যখনই কিছু লাগবে বোলো। কুণ্ঠা রেখো না।"
খারাপের যেমন সেয়ানা হয়, ভালো-র ও হয়। শ্বশুর মশাই, আমার থেকেও সেয়ানা বেরোলেন। কিন্তু আমি তো হারতে পছন্দ করি না। শ্বশুরের ঝুলে যাওয়া চিবুক, আঙুল দিয়ে ওপর দিকে ঠেলে বললাম। "একটু ঘুমিয়ে নিন। আমি আসছি।"
নীচে এসে বউকে বললাম, "তোমার বাবার বয়স কত এখন !"
বউ বলল, পঞ্চাশ। ঢপ। মেয়েদের কাছ থেকে, বাবার বয়স বার করা মুশকিল। বললাম, "তোমার বয়সই পঁয়ত্রিশ হয়ে গ্যালো..." বউ হিসহিস করে উঠল, "বাজে বকবে না, আমার বয়স জাস্ট টোয়েন্টি ফাইভ!" আমি বললাম, "আমি তো আর বিয়ের সময় তোমার বার্থ সার্টিফিকেট চেক করিনি, জাল ও হতে পারে... তবে তোমায় দেখলে, তো ..." "তো ! কী, কত মনে হয় !" বউ খচে লাল... "জাস্ট টোয়েন্টি..." বলেই জড়িয়ে ধরে, ঝকাস করে একটা চুমু খেয়ে নিলাম... এবার বললাম "বলো!", বউ লাজুক লাজুক মুখ করে বলল, "গত জুনে ষাট হয়েছে।" বললাম, হাজার টাকা দাও।" বউ অবাক হয়ে বলল, "কোথায় পাব ! আমি কি চাকরি করি নাকি ?" একটু চমকালাম, "গত পরশু আমার মানি ব্যাগ থেকে হাজার টাকা সরিয়েছ। কি ভাবো ! কিছু বুঝি না ! টাকাটা দাও। মাইনে পেলে দিয়ে দেব।" "হাজার টাকা নিয়ে কী করবে !" বাড়িতে বউ থাকা আর গোয়েন্দা থাকা একই ব্যাপার। "তোমার বাবার ভোগে লাগবে" -- ব'লে, টাকাটা ছিনিয়ে নিলাম।
জামাইয়ের বয়স ষাট হলে, শাশুড়ির বয়স কত হওয়া উচিত ! মিনিমাম পঁচাশি। নিচের ফ্ল্যাটের দত্তগুপ্তর মা'কে ধরলাম। "মাসিমা, আপনার বয়স কত !" "হবে, সত্তরের মতন !" নারীদের নিয়ে এই এক মুশকিল। বুড়ি হোক বা ছুঁড়ি, কেউ আসল বয়স বলবে না। টোপ ফেললাম । "মাসিমা আপনার আশি বছর হলে, একটা অফার দিতাম। পুণ্যি হত। আমার শ্বশুর মশাইকে জামাই হিসেবে আশীর্বাদ করতে হবে।" বুড়ির আবার পুণ্যি লাভের হেভি বাতিক। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, "আমার মনে হয় আশি-ই হবে।"
তারপর আর কি ! হাজার টাকা দিয়ে শ্বশুরের জন্য, ধুতি পাঞ্জাবি কিনলাম। অনেক নাটকের পর, জোর করে ওনাকে সেগুলো পরালাম। আর দুপুরবেলা দুই জামাই, নতুন ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে, ফুলবাবু সেজে, কপালে চন্দনের তিলক কেটে , মাথায় ঘাস দুর্বা গুঁজে, মিষ্টি আর হাতপাখা আর উলু, শঙ্খধ্বনি সহযোগে , পাশাপাশি বসে, দুই শাশুড়ির আশীর্বাদ নিয়ে -- জীবনে প্রথম বারের মতন, জামাই ষষ্ঠীর প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করতে শুরু করলাম।
আমি গোগ্রাসে গিলছিলাম। একটু পরেই ম্যাচ শুরু হবে। হঠাৎ শুনলাম, বউ শ্বশুর মশাইকে প্রশ্ন করছে -- "বাবা, আমার রান্না কেমন লাগছে ! )" শ্বশুরমশাই স্তিমিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, "কেন জানি না, নোনতা লাগছে।" কথাটা কানে লাগল। কই, আমার তো স্বাদ ঠিকই লাগছে ! চমকে উঠে, শ্বশুর মশাইয়ের দিকে, তাকালাম। উনি ঘাড় নিচু করে একমনে, ধীরে ধীরে খাচ্ছেন। আর চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে, ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল, খাবারের ওপর ঝরে পড়ছে ... নিঃশব্দে... সকলের অলক্ষ্যে...
বুঝলাম আনন্দের, সুখের আর প্রাপ্তির স্বাদ কেন, নোনতা হয় ! ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনি, হু হু করে কেঁদে ফেললেন...
-- সমাপ্ত --
#শুভ্র_কিশোর_বসু
শ্বশুরকে ফোন করে বললাম, "হাই পপস।" শ্বশুরমশাই -- রং নাম্বার বলে, ফোনটা কেটে দিলেন। উফফ, এরা বোধহয় আর কোনোদিন ইন্টার-ন্যাশানাল হবে না, সেই ভেতো বাঙালি হয়েই জীবন কাটিয়ে দেবে।
আবার ফোনে, ধরলাম। "বাবা, আমি সূর্য বলছি।"
"সূর্য কে !" শ্বশুরমশাই, আবার বিচলিত।
"আরে আপনার একমাত্র জামাই, আপনিও না ! তিনমাস হয় নি, নিজের একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন -- এর মধ্যে ভুলে গেলেন ! পারেনও বটে !"
"কিন্তু আমি তো যতদূর জানি, আমার জামাইয়ের নাম -- রৌদ্র মিত্র !" শ্বশুর মশাই, ঘেঁটে ঘ !
"আরে ওই হল, সূর্য না থাকলে, রৌদ্র আসবে কোথা থেকে ! শর্ট-এ সারলাম।"
"উফফ, তুমি তো দেখছি আমার হার্টফেল করিয়ে দেবে ! জানো, অলরেডি একবার আমার বাইপাস হয়ে গ্যাছে, উফ্ফ। বুকটা এখনও দ্রুম দ্রুম করছে !" মনে হল, উনি এখনও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেন নি।
এই রে ! কেলেঙ্কারি করেছে। ওনার এই বাইপাসের খবরটা আমি খালি ভুলে যাই। আমার দশটা ডাকনাম আছে। বিয়ের পরের সপ্তাহে, ভুল করে নিজের আর একটা ডাকনাম শুনিয়ে দিয়েছিলাম। উনি চিনতে না পেরে, প্রেসার ট্রেসার বাড়িয়ে, যায় যায় অবস্থা। বউ তো সব শুনে, আমাকে আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে -- যদি আমার কারণে, শ্বশুর মশাই মারা যান, তবে আমার বিরুদ্ধে খুনের ধারা দেবে। আর আমি যেন, কোনোদিনও ওনাকে ফোন না করি।
করতাম-ও না। যদি না, ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ম্যাচ থাকত। কী দরকার ছিল, জামাই ষষ্ঠী আর পাকিস্তানের সাথে ম্যাচ, একদিনে ফেলার ! সব ঢপের চপ লোকজন । হতভাগাদের তো আর জামাই ষষ্ঠী নেই। লে হালুয়া, ফেলে দে খেলা ! জামাইগুলোর কী হবে ! শান্তিতে দু- দণ্ড খেলা দেখতে পাবে না। তাই, ফন্দি বের করে, শ্বশুরকে ফোনে ধরলাম। "বাবা, সামনের শনিবার জামাই ষষ্ঠী, শুনেছেন তো ! মালপত্র যা দেবেন, বগলদাবা করে নিয়ে চলে আসুন, জামাইয়ের বাড়িতে।"
"মালপত্র যা দেবেন, মানে ...! এই তো তিনমাস হয়নি, দিলুম !"
"লে হালুয়া, আমি কী জানি ! আপনার মেয়েই তো হাত পা ছড়িয়ে, কালকে হিসেব করছিল। সে যাই হোক, ওসব আপনার মেয়ে আর বউয়ের ব্যাপার, আমার ঢুকে কাজ নেই। আমি শুধু চাই, আপনি জামাই ষষ্ঠীর দিন, আমাদের বাড়িতে এসে, খেলা দেখুন। লম্বা পঞ্চান্ন ইঞ্চির টিভি কিনেছি, এ.সি লাগিয়েছি, পা ছড়িয়ে খেলা দেখবেন। ব্যস। আপনিও খুশ, আমিও খুশ।" এক নিঃশ্বাসে, ঝাক্কাস অফার দিয়ে -- মুক্তি পেলাম।
"এই শোনো, টিভি আর এ.সি -- তুমি কবে কিনলে খোকা ! সব তো আমিই দিলুম।" শ্বশুর মশাই জামার কলার তুললেন, মনে হল।
তা, নিজের মেয়েকে ছোট থেকে এ.সি-র হাওয়া খাইয়ে, কে মানুষ করতে বলেছিল শুনি ! আমি ! অত বড় ধাড়ি মেয়ে, যেই কোলে বসে বলল, বাবা, "আমাকে কিন্তু এত্ত বড় টিভি দিতে হবে, হুমম ..." , অমনি সুরসুর করে পঞ্চান্ন ইঞ্চির টিভি আর একখান দেড় টনের একখান ঢাউস এ.সি -- জামাইয়ের পেছনে গুঁজে দিতে হল ! নে, এবার বোঝ। মাসে দু-হাজার টাকার বিল, কে দেয় শুনি ! এমনিতে আমার মাইনে, প্রাগ-ঐতিহাসিক হয়ে গ্যাছে। ডি.এ নেই, পে কমিশন মমি হয়ে গ্যাছে। ওসব ফালতু ঝামেলা না দিয়ে, টাকাটা ...
"তোমায় দিলে, জম্পেশ করে মাল খেতে বুঝি... ! আর তাছাড়া, আমি মেয়েকে কী দেব, তার জন্য তোমার। অনুমতি নেব !" শ্বশুর মশাই দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন। "ধুৎ, আমি আপনার টাকা নেব কেন ! বরং ফালতু খরচ না করে, নিজের ব্যবসায় খাটালে, কিছু রিটার্ন পেতেন। আর শুনুন, একটা বড় হুইস্কির পেটি তুলব ঠিক করেছি, ডক থেকে, বিদেশি -- টানা মাল। হেব্বি টান। এক পেগ খেলে, চব্বিশ ঘন্টার গ্যারান্টি। আমি খুলে ফেললে, কতক্ষণ থাকবে জানি না। একটা বোতলের খরচা আমার, বাকিগুলোর আপনার। খালি হাতে আসবেন না। ব্যবসায়ী মানুষ। বুদ্ধিমান। একগাদা শাড়ি, ব্লাউজ , প্যান্ট , শার্ট ওসব কাইন্ডে ফালতু খরচা করবেন না । সলিড আনলে, আপনিই প্রফিটেড । বাকিটা, আপনি বুঝুন।"
আসলে গুল মারলাম। আমার শ্বশুরের, ওটুকুই যা দুর্বলতা। এর টানে তিনি, জামাই ষষ্ঠীর দিন, নিজের মেয়ের তো বটেই -- এমনকি অন্যের মেয়ের শ্বশুর বাড়ি-ও চলে যেতে পারেন। সেই টানেই হয়তো, সকাল সকাল এসে হাজির। পইপই করে নিষেধ করেছিলাম, হাতে করে কিছু না আনতে। কিন্তু বিধি বাম। সেই, দু-হাত ভর্তি করে, সব নিয়ে এসেছেন। বাঙালি স্রেফ অপত্য স্নেহে -- নিজেদের ভবিষ্যৎ, নিজের হাতে নষ্ট করে দেবে। নিজের জন্য কিছুই রাখবে না। বুড়ো বয়সে, হাতে ব্যাঙ্কের শূন্য পাসবুক ছাড়া কিছুই থাকবে না।
আমার মাইনে হতে, এখনও দু'দিন বাকি। মালের টাকা পকেটে রেখে, বন্ধুর কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ধার করলাম। আফটার অল, শ্বশুর-শাশুড়ি বলে কথা। জমিয়ে বাজার করতে হবে। জানিনা, এই কটা টাকায় হবে কিনা। বাঙালির তো উৎসব আর পার্বণ ছাড়া কিছু পড়ে নেই। পুরো জাতটা গিলে আর গিলিয়ে ফতুর হয়ে গেল। যাক গে। সব জাতেরই কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তাই নিয়েই বেঁচে থাকা উচিত।
সমস্যা হল, শাশুড়ি কিছু একটা সন্দেহ করেছেন। সমানে শ্বশুর মশাইকে গাল পাড়ছেন। এ ক্যামন কথা বাপু। লোকলজ্জা ভুলে, জামাই ষষ্ঠীর দিন, জামাইয়ের বাড়িতে এসে, পেট পুরে খাওয়া ! আমাকে ডেকে বললেন -- "রত্ন (আমার আরেক নাম), তোমরা কী কোনও স্কীমে আছো !" মানুষের জীবনটাই তো স্কীম। নতুন করে বলার কিছু নেই। "নাহ" -- বলে, ঠোঁট উল্টে কেটে পড়লাম।
শাশুড়ির কড়া ম্যান মার্কিং এড়িয়ে, শ্বশুরমশাইকে নিয়ে, ছাদের ঘরে আসর বসালাম । দু-পেগ পান করেই, ওনার হালকা নেশা হল। আমি অনেকরকম নেশারু দেখেছি। নেশা হলে কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, কেউ আবেগী হয়ে জীবনের সব দুঃখ উগড়ে দেয়। আমার শ্বশুর মশাই, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করলেন। ওনার প্রেম করে বিয়ে । শ্বশুরবাড়ি মানে নি। উনিও কোনোদিন যান নি সেভাবে। নিজের পায়ে কষ্ট করে দাঁড়িয়েছেন। জীবনের সব সুখ আর আহ্লাদ , ওই ব্যবসা আর হুইস্কির বোতলের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। কিছু মানুষ আছেন। সারাজীবন শুধু কষ্ট করেন। জীবিকার জন্য। পরিবারের জন্য। অন্যের জন্য। যে সুখ, আরাম অন্যকে দেন, তার কণামাত্র নিজেকে দেন না। " জানো রৌদ্র, আমি কোনও দিন জামাই আদর পেলাম না। শ্বশুর বাড়ি কী জিনিস, বুঝলামই না। অথচ দ্যাখো, যে শাশুড়ির দেমাকের অন্ত ছিল না, তিনিই আমার বাড়িতে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়ে গেলেন। তিন ছেলের কেউ, সেভাবে দেখল না। আমি তখনই ঠিক করেছিলাম, আমি শ্বশুরের কর্তব্যে কোনওদিন ভুলচুক করবো না। আমি পাইনি তো কী হয়েছে -- আমার জামাই যেন শ্বশুর বাড়ির মর্ম বোঝে। তুমি সেয়ানা হলেও, ভালো ছেলে। ছোটো থেকে একা হাতে লড়ে -- বড় হয়েছ। যখনই কিছু লাগবে বোলো। কুণ্ঠা রেখো না।"
খারাপের যেমন সেয়ানা হয়, ভালো-র ও হয়। শ্বশুর মশাই, আমার থেকেও সেয়ানা বেরোলেন। কিন্তু আমি তো হারতে পছন্দ করি না। শ্বশুরের ঝুলে যাওয়া চিবুক, আঙুল দিয়ে ওপর দিকে ঠেলে বললাম। "একটু ঘুমিয়ে নিন। আমি আসছি।"
নীচে এসে বউকে বললাম, "তোমার বাবার বয়স কত এখন !"
বউ বলল, পঞ্চাশ। ঢপ। মেয়েদের কাছ থেকে, বাবার বয়স বার করা মুশকিল। বললাম, "তোমার বয়সই পঁয়ত্রিশ হয়ে গ্যালো..." বউ হিসহিস করে উঠল, "বাজে বকবে না, আমার বয়স জাস্ট টোয়েন্টি ফাইভ!" আমি বললাম, "আমি তো আর বিয়ের সময় তোমার বার্থ সার্টিফিকেট চেক করিনি, জাল ও হতে পারে... তবে তোমায় দেখলে, তো ..." "তো ! কী, কত মনে হয় !" বউ খচে লাল... "জাস্ট টোয়েন্টি..." বলেই জড়িয়ে ধরে, ঝকাস করে একটা চুমু খেয়ে নিলাম... এবার বললাম "বলো!", বউ লাজুক লাজুক মুখ করে বলল, "গত জুনে ষাট হয়েছে।" বললাম, হাজার টাকা দাও।" বউ অবাক হয়ে বলল, "কোথায় পাব ! আমি কি চাকরি করি নাকি ?" একটু চমকালাম, "গত পরশু আমার মানি ব্যাগ থেকে হাজার টাকা সরিয়েছ। কি ভাবো ! কিছু বুঝি না ! টাকাটা দাও। মাইনে পেলে দিয়ে দেব।" "হাজার টাকা নিয়ে কী করবে !" বাড়িতে বউ থাকা আর গোয়েন্দা থাকা একই ব্যাপার। "তোমার বাবার ভোগে লাগবে" -- ব'লে, টাকাটা ছিনিয়ে নিলাম।
জামাইয়ের বয়স ষাট হলে, শাশুড়ির বয়স কত হওয়া উচিত ! মিনিমাম পঁচাশি। নিচের ফ্ল্যাটের দত্তগুপ্তর মা'কে ধরলাম। "মাসিমা, আপনার বয়স কত !" "হবে, সত্তরের মতন !" নারীদের নিয়ে এই এক মুশকিল। বুড়ি হোক বা ছুঁড়ি, কেউ আসল বয়স বলবে না। টোপ ফেললাম । "মাসিমা আপনার আশি বছর হলে, একটা অফার দিতাম। পুণ্যি হত। আমার শ্বশুর মশাইকে জামাই হিসেবে আশীর্বাদ করতে হবে।" বুড়ির আবার পুণ্যি লাভের হেভি বাতিক। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, "আমার মনে হয় আশি-ই হবে।"
তারপর আর কি ! হাজার টাকা দিয়ে শ্বশুরের জন্য, ধুতি পাঞ্জাবি কিনলাম। অনেক নাটকের পর, জোর করে ওনাকে সেগুলো পরালাম। আর দুপুরবেলা দুই জামাই, নতুন ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে, ফুলবাবু সেজে, কপালে চন্দনের তিলক কেটে , মাথায় ঘাস দুর্বা গুঁজে, মিষ্টি আর হাতপাখা আর উলু, শঙ্খধ্বনি সহযোগে , পাশাপাশি বসে, দুই শাশুড়ির আশীর্বাদ নিয়ে -- জীবনে প্রথম বারের মতন, জামাই ষষ্ঠীর প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করতে শুরু করলাম।
আমি গোগ্রাসে গিলছিলাম। একটু পরেই ম্যাচ শুরু হবে। হঠাৎ শুনলাম, বউ শ্বশুর মশাইকে প্রশ্ন করছে -- "বাবা, আমার রান্না কেমন লাগছে ! )" শ্বশুরমশাই স্তিমিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, "কেন জানি না, নোনতা লাগছে।" কথাটা কানে লাগল। কই, আমার তো স্বাদ ঠিকই লাগছে ! চমকে উঠে, শ্বশুর মশাইয়ের দিকে, তাকালাম। উনি ঘাড় নিচু করে একমনে, ধীরে ধীরে খাচ্ছেন। আর চোখ দিয়ে টুপ টুপ করে, ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল, খাবারের ওপর ঝরে পড়ছে ... নিঃশব্দে... সকলের অলক্ষ্যে...
বুঝলাম আনন্দের, সুখের আর প্রাপ্তির স্বাদ কেন, নোনতা হয় ! ওনাকে জড়িয়ে ধরলাম। উনি, হু হু করে কেঁদে ফেললেন...
-- সমাপ্ত --