Thread Rating:
  • 65 Vote(s) - 3.34 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Romance শেষের পাতায় শুরু (Completed)
পর্ব নয় – (#6-51)

 
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে শালিনীর কাঁধে হাত রেখে বলে, “দেখো আর মাত্র দুই দিন পরে আমার সেমিনার আর ওয়ার্কশপ, আমাকে লন্ডন যেতে হবে। একটা পেপার তৈরি করতে কতটা পরিশ্রম লাগে সেটা তোমাকে নতুন করে তো বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। আমি বাড়িতে একটু শান্তি চাই তাই দিয়াকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

শালিনী, ঘাড় ঘুরিয়ে ঝিনুক আর ঝিলিকের দিকে দেখে রিশুকে প্রশ্ন করে, “তুমি কি ভাবতে পারছ, এইভাবে ওদের পাঠিয়ে দিলে আন্টির কি অবস্থা হবে?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিশু উত্তর দেয়, “আমি মাম্মাকে বুঝিয়ে বলে দেব।”
 
ওর চোখে চোখ রেখে শেষ বারের মতন প্রশ্ন করে, “এটাই তাহলে তোমার ফাইনাল ডিসিসান?”

মাথা নাড়ায় রিশু, “জানি না, তবে বর্তমানে আমি একটু একা থাকতে চাই। বাকি সিদ্ধান্ত আমি লন্ডন থেকে ফিরে আসার পরে নেবো।” ছোট একটা শ্বাস ছেড়ে বাঁকা হেসে ইন্দ্রজিতকে বলে, “তোকে সেদিন বলেছিলাম, ইচ্ছে করেই কি আর কেউ কাউকে ছাড়তে চায় রে।” কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে শালিনীকে বলে, “অনেক রাত হয়েছে তোমরা বাড়ি যাও।”
 
অগত্যা ইন্দ্রজিৎ মাথা দোলায়, রিশুকে টলানো অসম্ভব ব্যাপার। শোয়ার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে শালিনী। একবার ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে দেখে একবার রিশুর দিকে তাকিয়ে দেখে। ঝিনুক মাথা নিচু করে সোফায় বসে, কোলের কাছে হাত দুটো জড় করে রাখা। ফর্সা নাকের লালচে ডগা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে আশ্রু ওর হাত জোড়া ভিজিয়ে দিয়েছে। ঝিলিক বাকরুদ্ধ হয়ে একবার দিদির দিকে একবার শালিনীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
 
শালিনী ঝিনুকের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর গালে হাত জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি আমাদের সাথে আমার বাড়ি যাবে?”

মৃদু মাথা নাড়ায় ঝিনুক, অস্ফুট ধরা গলায় উত্তর দেয়, “না।”
 
মাথা নাড়িয়ে অগত্যা শালিনী উঠে পরে, রিশুর দিকে হাত নাড়িয়ে বিদায় নেয় ইন্দ্রজিৎ আর শালিনী। দিয়া দরজা বন্ধ করে দিতেই ঘরের ভেতরটা আরো বেশি শীতল হয়ে যায়। দিয়া ছোট পায়ে ঝিনুকের সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরে ঝিনুকের অশ্রু ভেজা নরম হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে তুলে নেয়। দিয়ার দিকে জল ভরা রাঙ্গা চোখে তাকায় ঝিনুক, ঠোঁট জোড়া অব্যাক্ত বেদনায় কেঁপে ওঠে ওর।
 
দিয়া, ঝিনুককে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “ওঠো, চোখ মুখ ধুয়ে নাও।”

বান্ধবীর দেখা দেখি ঝিলিকও দিদির হাত দুটো ধরে বলে, “ওঠ, যা হওয়ার সেটা হয়েই গেছে।”

শুন্য দৃষ্টি নিয়ে দিয়ার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে ঝিনুক। তারপরে ঝিলিকের দিকে তাকিয়ে ভগ্ন হৃদয় নিয়েই বলে, “আমার কপালে জানিস সুখ শান্তি বলে কিছুই নেই।”
 
রিশু ওর জামা কাপড় নিয়ে ততক্ষণে বাথরুমে ঢুকে পড়েছে। বেশ কিছুক্ষন সোফার ওপরে চুপচাপ বসে থাকার পরে, ঝিনুক সোফা ছেড়ে উঠে শোয়ার ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়। বাথরুম থেকে বেড়িয়ে রিশু দিয়াকে আর ঝিলিককে হাত মুখ ধুয়ে নিতে বলে। পাশের ছোট শোয়ার ঘরের মধ্যে ঢুকে ল্যাপটপ খুলে বসে পরে। রাত বারোটা বাজে, এতরাতে মাকে ফোন করা ঠিক হবে কি হবে না সেটা চিন্তা করে। সকাল বেলা এয়ারপোর্টে গাড়ি না আসলে ভীষণ মুশকিল, কিন্তু হটাত এত রাতে কি বলবে মাকে, সেই চিন্তায় পরে যায়। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত পরেরদিন সকালের ফ্লাইটের তিনটে টিকিট কেটে ফেলে রিশু।
 
শোয়ার ঘরের বিছানার ওপরে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকে ঝিনুক। ওর চিন্তা শক্তি সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গেছে, মাথা একদম খালি, মনের মধ্যে শুধু একটি মাত্র চিন্তা, বাড়িতে মায়ের সামনে বাবার সামনে কি করে মুখ দেখাবে? সব রাগ গিয়ে পরে ছোট দুটো মেয়ের ওপরে। সুখে থাকতে ভুতে কিলায় বলে সেটাই হয়েছে, রিশু সেমিনারের জন্য লন্ডন চলে যেত, ঝিনুক কয়েক দিনের জন্য কোলকাতা চলে যেতে পারত। দিন কয়েক মামনির সাথে কাটিয়ে আসতে পারত, বাবা মায়ের সাথে কাটিয়ে আসতে পারত। রাগটা ঘুরে ফিরে আবার নিজের ওপরে এসে পরে, কি দরকার ছিল মামনির নাম তোলার? ঠাস ঠাস করে নিজের গালে চড় মারে ঝিনুক। চড়ের আওয়াজ পেয়েই দিয়া আর ঝিলিক দৌড়ে শোয়ার ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখে যে ওদের ঝিনুক দিদি বিছানায় হাঁটু মুড়ে জুবুথুবু হয়ে বসে হাত দুটো মুঠো করে সমানে কপালে করাঘাত করে চলেছে।
 
ঝিলিক সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত ধরে ফেলে বলে, “এই কি করছিস?”

ঝিনুক শুন্য চোখে বোনের দিকে আর দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি বাড়ি যাবো না। আমায় একটু বিষ দিবি?”

দিয়া ওকে বলে, “ঝিনুকদি এমন করে না প্লিজ।”

ঝিলিক ওর দিদিকে বলে, “প্লিজ পাগলামি করিস না দিদি। একটু শান্ত হ।”

শান্ত হওয়ার কথা কানে যেতেই সব রাগ ওই দুই মেয়ের ওপরে পরে ঝিনুকের। দাঁতে দাঁত পিষে দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “সব তোদের জন্য হয়েছে।” বোনের সামনে আঙ্গুল নাড়িয়ে বলে, “আমি আগে থেকে সাবধান করে দিয়েছিলাম তোদের। তোর জিজু জানতে পারলে আমাকে কেটে ফেলবে।” কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে প্রশ্ন করে, “ওরা কি করে জানলো আমরা কোথায় পার্টি করতে যাবো?”

ঝিলিক অপরাধীর মতন দিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। দিয়া আমতা আমতা করে বলে, “আমরা মেসেজ করেছিলাম।”

ঝিনুক থাকতে না পেরে ঠাস করে ঝিলিকের গালে সজোরে একটা চড় কষিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “আমার সুখ তোর সহ্য হয় না তাই না?”

গালে হাত দিয়ে ঝিলিক দিদির দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, আমতা আমতা করে বলে, “সরি দিদি।”

ঝিনুক চেঁচিয়ে ওঠে, “সরি, এখন আর সরি বলে কি হবে? হ্যাঁ? যা হওয়ার সব শেষ করে দিয়েছিস তোরা।” দুই হাতে মাথার চুল আঁকরে ধরে বলে, “আমার পোড়া কপাল।”
 
নিস্তব্দ বাড়িতে পাশের ঘরের সব আওয়াজ পরিস্কার রিশুর কানে যায়। ঠিক তখনি ওদের বাড়ির দরজায় কলিং বেল বেজে উঠতেই ওরা সবাই চুপ করে যায়। রিশু উঠে দরজা খুলে খাবারের ডেলিভারি নিয়ে খাওয়ার টেবিলে রেখে শোয়ার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখে। রিশু ঝিনুকের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। জল ভরা আঁখি দুটো ভীষণ ভাবেই বেদনায় ভরা। ওর দিকে কাতর অব্যাক্ত ভাষা নিয়ে চেয়ে রয়েছে, প্লিজ শেষ বারের মতন।
 
রিশু সেই ব্যাথাভরা আঁখি উপেক্ষা করে দিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোদের সুটকেস গুছানো হয়েছে কি? কাল সকাল সাতটার ফ্লাইট। ভোর সাড়ে চারটের মধ্যে আমাদের বেড়িয়ে যেতে হবে।” ঝিলিকের দিকে দেখে বলে, “তাড়াতাড়ি তোর সুটকেস গুছিয়ে নে, তারপরে খেয়ে একটু রেস্ট নে।”
 
দিয়া দাদার আদেশ অমান্য করতে পারতে না। গুটি পায়ে উঠে গিয়ে সুটকেস খুলে নিজের জামা কাপড় গুছাতে শুরু করে দেয়। জিজুর হিম শীতল কন্ঠস্বর শুনে ঝিলিকের বুক পুনরায় কেঁপে ওঠে। দিদির দিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিজের সুটকেস ঘুছাতে চলে যায়। রিশু চুপচাপ হাতে ফোন নিয়ে বসার ঘরের সোফায় বসে পরে। বেশ কিছুক্ষন পরে ঝিনুক নিজের জামা কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়।
 
বাথরুমে ঢুকে শেষ বারের মতন আয়নায় নিজের মুখ দেখে ঝিনুক। মনে পরে যায় সেই প্রথম রাতে কথা, একটা তোয়ালে জড়িয়ে কোন রকমে সেই শীতে দরজা খুলে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। যদিও সেই মানুষটা আজও ওই দরজার বাইরে ঠিক সেইদিনের মতন সোফায় বসে আছে কিন্তু ভেতরের মানুষটা বদলে গেছে। মনে হল কেউ যেন দরজায় ঠক ঠক করল, গম্ভির এক কন্ঠস্বর, গিজার চালিয়ে নাও না হলে এই ঠান্ডায় হাইপোথারমিয়া হয়ে যাবে। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে সেই আওয়াজ, না ওর চারপাশে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। গলার আওয়াজ দরজার বাইরে নয়, ওর বুকের ভেতরে বেজে ওঠে। পরনের জামা কাপড় গুলো যেন ওর চামড়া জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে উদ্যত। একটানে গায়ের থেকে খুলে ফেলে বডিকন ড্রেসটা। টেনে খুলতে গিয়ে জামার বুকের জায়গাটা একটু ছিঁড়ে যায়। বিতৃষ্ণায় রিরি করে জ্বলে ওঠে ঝিনুকের সারা শরীর। এক টানে চরচর করে ছিঁড়ে ফেলে এক সময়ের সাধের বডিকন ড্রেসটা। গলায় ওর দেওয়া মোটা সোনার হার ভীষণ জ্বলজল করছে, নীলচে স্বচ্ছ বক্ষবন্ধনীর মাঝে আটকে থাকা পীনোন্নত স্তনের গভীর খাঁজে আটকে রয়েছে বড় মুক্তোর লকেট। চোখে মুখে জলের ছিটা দিয়ে একটা টপ আর ঢিলে একটা প্যান্ট পরে মাথা নিচু করে বেড়িয়ে আসে বাথরুম থেকে। সোফার দিকে না তাকালেও ওর সজাগ ষষ্ট ইন্দ্রিয় ভীষণ ভাবেই জানে যে সোফায় বসা মানুষটা ওর দিকেই নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
 
ফর্সা সরু গোড়ালিতে বাঁধা রুপোর পাতলা নুপুরের নিক্কন কানে যেতেই সম্বিত ফিরে পায় রিশু। ওর দৃষ্টি ভীষণ ভাবেই আটকে যায় ওই রাঙ্গা চরনে। রিশু নিস্পলক চোখে ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে থাকে, ভীষণ ভাবেই ভালোবেসে ফেলেছিল মেয়েটার ভাসা ভাসা কাজল কালো আঁখি জোড়া। ভীষণ কথা বলে ওই দুই চোখ, আগে ছিল ব্যাথার ছবি। সেই ছবি বদলে ফিরে পেয়েছিল উচ্ছল উজ্জ্বল দুরন্ত এক ছবি। গালের হাতের আঁচড়ের দাগ দেখে ভীষণ ভাবেই সেদিন কাতর হয়ে পড়েছিল। ভেবেছিল ধিরে ধিরে মেয়েটা হয়ত ওর পরিস্থিতি বুঝবে ওর সাথে মানিয়ে নিতে পারবে। ওর দেরি করে আসা, কোন কোন দিন ভীষণ ভাবেই চুপ করে থাকা, কখন সারা রাত বই নিয়ে পরে থাকা। ওর বন্ধুদের দেখেছে, যাদের স্ত্রী অথবা স্বামী পেশায় ডাক্তার নয় সেই পরিবারে মাঝে মাঝেই একটু আধটু এইসব নিয়ে মনোমালিন্য হয়েই থাকে। সেই নিয়ে ওর দুঃখ নেই, ওর দুঃখটা শুধু মাত্র এক জায়গায়, মা। হাত মুঠো করে মুখের সামনে চেপে ধরে বুকের পাঁজর আর্ত চিৎকার করে ওঠে ওই বাথরুমের বন্ধ দরজার পেছনের ললনার দিকে, কেন কেন তুমি মাকে নিয়ে কথা উঠালে? বিতৃষ্ণায় পুনরায় ওর বুকের ভেতরটা জ্বলে ওঠে। 
 
নিজের সুটকেস গুছিয়ে দিয়া ছোট শোয়ার ঘরে শুতে চলে যায়। রিশু উঁকি মেরে ওদের শোয়ার ঘরের মধ্যে দেখে। বিছানার ওপরে ঝিনুক হাঁটু মুড়ে হাঁটুর ওপরে থুঁতনি রেখে জুবুথুবু হয়ে বসে। ওর সামনে সুটকেস খুলে নিজের জামা কাপড় গুছাতে ব্যাস্ত ওর বোন। কানে ভেসে আসে ঝিলিকের গলা, কি নিবি? মাথা নাড়ায় ঝিনুক, কিছু না। তুই শুতে যা। ঝিলিক সুটকেস বন্ধ করে বসার ঘরে উঁকি মারতেই রিশুর সাথে চোখাচুখি হয়ে যায়। চোখাচুখি হতেই চোখ নামিয়ে নেয় ঝিলিক। মাথা নিচু করে শোয়ার ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পাশের ঘরে ঢুকে দিয়ার পাশে চুপচাপ শুয়ে পরে। সারা রাত কেটে যায়, শোয়ার ঘরের বিছানায় জলে ভরা চোখ নিয়ে ঠায় বসে থাকে ঝিনুক আর বসার ঘরের সোফায় বসে থাকে রিশু। শেষ রাতের দিকে ঝিনুকের চোখে ক্লান্তি নেমে আসে, ওর শরীর এলিয়ে পরে বিছানায়। হাত পা অবশ হয়ে এসেছে। কোন রকমে গায়ে লেপ টেনে চোখ বুজে চুপ করে পরে থাকে। খাওয়ার টেবিলে ল্যাপটপ খুলে বসে পরে রিশু, নিজের দুশ্চিন্তা ঢাকার জন্য একটা মেডিকেল জার্নাল খুলে পড়তে বসে যায়।
 
কখন যে ওর চোখ লেগে যায় তার খেয়াল নেই। খট করে একটা কিছু আওয়াজ হতেই চোখ মেলে তাকায় রিশু। চোখের সামনে খুব চেনা পরিচিত ফর্সা গোল হাতের কব্জি, কব্জিতে বাঁধা সোনায় বাঁধানো শাঁখা পলা। অতি পরিচিত একটা চায়ের কাপে ওর অতি পরিচিত গ্রিন টি। কখন ঝিনুকের ঘুম ভেঙ্গেছে সেটা টের পায়নি রিশু। মুখ তুলে সেই পরিচিত মুখের দিকে তাকাতেই মুখটা ওর কাছ থেকে সরে যায়। ঝিনুকের পরনে ওর দেওয়া সেই তুঁতে রঙের সালোয়ার কামিজ। সারা রাত ঘুমায়নি ঝিনুক সেটা ওর চোখে মুখে ভীষণ ভাবেই ফুটে উঠেছে। ধির পায়ে ছোট শোয়ার ঘরে ঢুকে ঝিলিকের গায়ে হাত দিয়ে জাগিয়ে দেয়। ল্যাপটপের ডান পাশের নিচের কোনায় সময় দেখে রিশু, চারটে দশ বেজে গেছে। গরম চায়ে কয়েক বার চুমুক দিয়ে রেখে দেয়। ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘরে ঢুকে পরে। আলমারি খুলে নিজের জামা কাপড় বের করতে গিয়ে চোখ পরে ঝিনুকের জামা কাপড়ের দিকে। বলতে গেলে সব কিছুই আলমারিতে সেই ভাবেই গুছিয়ে রাখা, সাজার বাক্স, জিন্স গুলো, এক গাদা টপ এমন কি ওর সাথে মার্কেটে গিয়ে যে দুটো জ্যাকেট কিনেছিল সে গুলো পর্যন্ত আলমারিতে রয়েছে, কিছুই নেয়নি। জামা কাপড় পরে বাথরুমে ঢুকে ব্রাশ করে নেয় রিশু।
 
দিয়া আর ঝিলিক উঠে পরে। এক এক করে মুখ ধুয়ে জামা কাপড় পরে তৈরি হয়ে নেয়। কারুর মুখে কোন কথা নেই, সবাই চাবি দেওয়া কলের যন্ত্রের মতন কাজ করে চলেছে। গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে বসার ঘরে বসে ক্যাব বুক করে। দিয়া আর ঝিলিক হাতে সুটকেস নিয়ে তৈরি, শুধু মাত্র ঝিনুকের হাতে কিছুই নেই। গায়ে ওর দেওয়া সেই গাড় নীল রঙের ভারী ওভারকোট আর নিজের ল্যাপটপের ব্যাগ আর একটা কাঁধে ঝোলান ব্যাগ ছাড়া আর কিছুই নেয়নি সাথে। হয়ত ঝিলিকের সুটকেসে মধ্যে কিছু নিয়ে নিয়েছে।
 
কিছুক্ষনের মধ্যে ক্যাব এসে ওদের ফ্লাটের সামনে দাঁড়ায়। নিস্তব্দ রাতে গাড়ির আওয়াজ পেতেই সবার কান সজাগ হয়ে ওঠে। এবারে বেড়িয়ে পড়তে হবে। দিয়ার বুক দুরুদুরু করে ওঠে। ঝিলিক দিদির হাত চেপে ধরে। রিশু ঘাড় ঘুরিয়ে ঝিনুকের দিকে একবার তাকায়। লম্বা চুল একটা এলো হাত খোঁপা করে মাথার পেছনে বাঁধা, গলায় জ্বলজ্বল করছে ওর দেওয়া সোনার হার, মেয়েটার সর্বাঙ্গে যেন ওর ছোঁয়া। দরজা খুলে দিয়ার আর ঝিলিকের সুটকেস হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পরে রিশু। দরজায় তালা মেরে দিয়ার হাতে চাবি ধরিয়ে দেয় ঝিনুক। সিঁড়ি বেয়ে সবাই নিচে নেমে ট্যাক্সিতে উঠে বসে। ট্যাক্সি ছেড়ে দেয়।
 
শীতকালের ভোর রাতের অন্ধকার চিড়ে হুহু করে এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে চলে ট্যাক্সি। কারুর মুখে কোন কথা নেই। ঝিনুক জানালার বাইরে একভাবে তাকিয়ে দেখে। মাঝখানে ঝিলিক মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে। অন্য পাশে দিয়া চুপ করে বসে প্রমাদ গোনে, যদিও ওর একটাই ভরসা দাদাভাই হয়ত বাড়িতে কিছুই বলবে না। সামনের সিটে বসে ঘড়ি দেখে রিশু, পাঁচটা বাজে, এতক্ষনে মা উঠে পড়েছে।
 
হাতে ফোন নিয়ে কয়েকবার নড়াচড়া করার পরে শেষ পর্যন্ত মাকে ফোন করে, “কি করছ?”

এত ভোরে ছেলের ফোন পেয়ে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে যায় আম্বালিকা, “কি রে কি হয়েছে? এত সকালে ফোন করেছিস? সব ঠিক আছে তো? তোর গলা এমন কেন শুনাচ্ছে? রাতে ঘুমাস নি?”

পাঁজর দুমড়ে গলার কাছে ঠিকরে আসে, শুধু মাত্র “কি করছ” শুনে কি করে ওর মা এত কিছু জেনে ফেলে? একটা ঢোঁক গিলে মৃদু হেসে বলে, “না না কিছু হয়নি আমি ঠিক আছে। গতকাল রাতে দিয়া আর ঝিলিক পার্টি করে শরীর খারাপ করে ফেলেছে।” বলেই হেসে ফেলে।

হাঁপ ছাড়ে আম্বালিকা, হেসে ফেলে ওর কথা শুনে, “ওহ তাই নাকি? তা বাবা, তুই এত সকালে ফোন করলি?”

ট্যাক্সির রিয়ার ভিউ আয়নায় তাকাতেই ঝিনুকের সাথে চোখা চুখি হয় ওর। ওর দিকে অবাক দৃষ্টি নিয়ে একভাবে তাকিয়ে রয়েছে। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মাকে জানায় রিশু, “ওরা আজ সকালের ফ্লাইটে বাড়ি যাচ্ছে।”

অবাক হয়ে যায় আম্বালিকা, “কি বলছিস?”

হাসতে হাসতে মাথা দোলায় রিশু, “আরে আর বল না, কাল রাতে পার্টিতে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে বাঁদর দুটো আর কি। সারা রাত ঘুমায়নি, বমি করে করে একসা হয়ে গেছে। এই আমি ওষুধ দিয়েছি তবেই একটু নরম হয়েছে। তারপরে ভাবলাম এরপরে আমি থাকবো না, লন্ডন চলে যাবো। আমার অবর্তমানে কি না কি করে বসবে তাই আজকেই ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

আম্বালিকা বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কখন ফ্লাইট?”

রিশু উত্তর দেয়, “সাতটার ফ্লাইট, এই ধর ন’টার মধ্যে কোলকাতা পৌঁছে যাবে।”

ছোট একটা উত্তর দেয় আম্বালিকা, “হুম” কন্ঠের স্বরে অপ্রত্যয়, “দিয়া কোথায়?”

উত্তর দেয় রিশু, “এই তো পেছনের সিটে বসে আছে।”

আম্বালিকা প্রশ্ন করে, “ঝিনুক?”

ছোট উত্তর দেয় রিশু, “এই ভাবে একা একা তো আর ছাড়তে পারি না, তাই ও ওদের সাথেই যাচ্ছে।”

আম্বালিকা ছেলেকে বলে, “দিয়াকে ফোন দে।” মায়ের কন্ঠের স্বরে একটু অবিশ্বাস ফুটে উঠেছে সেটা বুঝতে পারে রিশু।

রিশু হেসে বলে, “আরে বাবা না না, তুমি আবার এই সাত সকালে বকাঝকা করতে শুরু করে দেবে। তুমি ও না...”

আম্বালিকা শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলে, “তোর জন্য তোর বোন বাঁদর হয়ে গেল।”

হেসে ফেলে রিশু, “আচ্ছা শোনও না, গাড়িটা পাঠিয়ে দিও।”

আম্বালিকাও হেসে ফেলে, “আচ্ছা বাবা।”

ফোন রাখার আগে রিশু মাকে বলে, “ওদের ফ্লাইটে চড়িয়ে দিয়ে তোমাকে ফোন করছি।”
 
রিশুর কথা শুনে সবাই ভীষণ ভাবেই আশ্চর্য হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্যাক্সি এয়ারপোর্টে পৌঁছে যায়।
 
ট্যাক্সি থেকে নেমেই দিয়া দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরে থমথমে মুখে বলে, “সরি দাদা ভাই।” সেই ছোট বেলায় দাদার খাতা ছিঁড়ে দিলে যেমন ভাবে কান ধরত তেমন ভাবে কান ধরে কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, “আর করব না।”

বোনকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলে, “ভালো ভাবে পড়াশুনা করিস।” নাকের ওপরে তর্জনী দিয়ে ঘষে মৃদু হেসে বলে, “লিভাইসের জিন্স।” চোখের কোল মুছে হেসে ফেলে দিয়া।
 
ওদের একটু তফাতে ঝিলিক আর ঝিনুক দাঁড়িয়ে। ক্যাবের ড্রাইভার গাড়ির ডিগি খুলে সুটকেস নামিয়ে দেয় ওদের সামনে। রিশু ঝিনুকের দিকে তাকাতেই ঝিনুকের ঠোঁট জোড়া অল্প কেঁপে ওঠে, কাজল কালো চোখ জোড়া প্লবিত হয়ে যায়। রিশু ঝিলিকের দিকে দেখে মৃদু হেসে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায়। ঝিনুক মাথা নিচু করে এয়ারপোর্টের গেটের দিকে হেঁটে চলে যায়, ওর একটু পেছনে দিয়া আর ঝিলিক নিজেদের সুটকেস নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়। বুকের ওপরে হাত ভাঁজ করে চোয়াল চেপে সুন্দরী প্রেয়সীকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে দেখে রিশু। পার্স খুলে আইডি কার্ড বের করে তিনজনে এয়ারপোর্টে ঢোকার গেটের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে পরে। রিশু ওদের দেখে একটু হাত নাড়ায়, সেই উত্তরে দিয়াও ওর দিকে দেখে হাত নাড়ায়। ঝিনুকের পা কেউ যেন পেরেক দিয়ে গেটের সামনের মেঝেতে গেঁথে দিয়েছে। রিশু ওর চোখের দিকে আর তাকাতে পারে না, চুপ করে মাথা নিচু করে চোখ বুজে নেয়।
 
হটাত করে ওর কানে ভেসে আসে “রুশুউউ...” চোখ মেলে তাকায় সেই চেনা গলার স্বরের দিকে। মাথা দোলায় রিশু, না ওর কান ভুল শুনেছে, ঝিনুক দিয়ার হাত ধরে তখন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। ঝিলিক ওর দিকে প্রানপন জোরে দৌড়ে আসছে, “জিজুউউউউ...” প্রানপন দৌড়ে রিশুর বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পরে শরীরের সব শক্তি নিঙরে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বুকের ওপরে মাথা গুঁজে কেঁদে ফেলে। “জিজু আই এম সরি, জিজু।”

রিশু ঝিলিকের মাথা বুকের ওপরে চেপে ধরে আদর করে বলে, “কাঁদিস না। যাওয়ার সময়ে এই ভাবে কাঁদতে নেই।”

ঝিলিক কিছুতেই রিশুকে ছাড়বে না, বুকের ওপরে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বারেবারে বলে, “জিজু আই এম সরি, জিজু।”

ঝিলিকের হাত ধরেই শেষ পর্যন্ত গেটের দিকে এগিয়ে যায় রিশু। ওর গালে আদর করে হাত বুলিয়ে বলে, “সাবধানে যাস, আর বাড়ি পৌঁছে একটা ফোন করিস।”
 
ওরা তিনজনে গেটের ভেতরে না ঢুকে যাওয়া পর্যন্ত রিশু ওইখানে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকে। গেটের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার পরেও, কাঁচের দরজা দিয়ে বাইরে দাঁড়ানো শেষ ভালোবাসার একমাত্র পুরুষের দিকে নিস্পলক বাষ্পীভূত কাজল কালো নয়ন মেলে তাকিয়ে থাকে ঝিনুক। রিশুর বুকের ওপরে ভাঁজ করা হাত খুলে যায়, আপনা হতেই ওর ডান হাতের তর্জনী মধ্যমা অনামিকা কনিষ্ঠা দুলে উঠে বিদায় জানায় কাঁচের দরজার ওইপাশে দাঁড়ানো প্রেয়সীকে।


================= পর্ব নয় সমাপ্ত =================
[Image: 20210115-150253.jpg]
Like Reply


Messages In This Thread
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 18-10-2020, 01:30 PM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 21-10-2020, 04:16 PM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 22-10-2020, 03:41 AM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 21-10-2020, 04:13 PM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 22-10-2020, 02:49 PM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 27-10-2020, 02:59 AM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 28-10-2020, 12:21 PM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 28-10-2020, 10:20 PM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 29-10-2020, 01:29 AM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 30-10-2020, 11:22 AM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 01-11-2020, 01:37 AM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by TheLoneWolf - 02-11-2020, 12:51 PM
পর্ব আট – (#2-38) - by pinuram - 08-12-2020, 05:19 PM
RE: পর্ব আট – (#2-38) - by pinuram - 09-12-2020, 06:58 PM
Block Guest Users! - by pinuram - 09-12-2020, 11:47 PM
RE: Block Guest Users! - by dreampriya - 10-12-2020, 09:46 AM
RE: Block Guest Users! - by pinuram - 10-12-2020, 12:18 PM
পর্ব আট – (#6-42) - by pinuram - 14-12-2020, 11:37 PM
পর্ব আট – (#7-43) - by pinuram - 14-12-2020, 11:38 PM
পর্ব আট – (#8-44) - by pinuram - 14-12-2020, 11:38 PM
RE: শেষের পাতায় শুরু - by pinuram - 21-12-2020, 12:08 PM



Users browsing this thread: 24 Guest(s)