30-01-2019, 03:17 PM
Daily Passenger
এক
অনেক দিন আগের কথা। ওকে আমি প্রথমবার দেখেছিলাম এক গয়নার দোকানে। কেন সে কথা জিজ্ঞেস করা বোকাবোকা শোনাবে। গয়নার দোকানে মেয়েরা কি করতে যায়! গয়না কিনতে, আর কি! অনেক গয়না দেখে দোকানদারকে রীতিমত বিরক্ত করে সব শেষে নিজের পছন্দ মত একটা গয়না কেনা, আর ভুললে চলবে না যে বাজেটের কথা মাথায় রেখে সব দিক বিবেচনা করে শেষমেশ একটা কিছু খরিদ করে নেওয়া। এই আর কি। আমিও অনেক বছর হয়ে গেল কোনও গয়না কিনি নি। আর সত্যি কথা বলতে হাতে টাকা জমতে শুরু করেছে অনেক দিন ধরে, কিন্তু আমার কাছে ভাল গয়না একটাও যে নেই। অনেক দিনের পরিকল্পনা, যে এইবার পূজার আগে একটা ভাল দেখে নেকলেস আর না নিলেই নয়। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এখানে আসা। আজ আমার দুপুরের পর অফ,তাই চলে এলাম। একাই এসেছি। আমার হবু বর আমার সাথে দোকানে আসতে রাজি না হওয়ার কারণ অবশ্য আমার অযথা সময় লাগানো জিনিস পছন্দ করায়, সে শাড়িই হোক বা গয়নাই হোক বা জিন্স টপই হোক। একটু দেখে শুনে না নিলে কেমন করে হবে। মেয়েদের শাড়ি আর বাজারের ইলিশ মাছ একই রকম মেপে ঝেঁকে না কিনলে শপিঙ্গে আসাটাই তো মাঠে মারা গেল। দোকানে অবশ্য অনেক মহিলা ছিলেন। অল্প বয়সী মেয়েরাও ছিল। কোনও কোনও মহিলা ওনাদের বরের সাথে এসেছেন, ওনাদের বররা কোনটা পরলে ওনাদের ভাল লাগবে সে সব উপদেশ দিয়ে ওনাদের সাহায্য করে চলেছেন। একজন কে দেখে বুঝলাম ওনার সাথে ওনার বরের একটা ঠাণ্ডা ঝগড়া হয়ে গেল দোকানের ভেতরেই। যদিও দোকানদার বা ওনার কর্মচারীদের সেই ব্যাপারে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। বোধহয় এত বড় দোকানে এত দিন ধরে কাজ করে করে এই সব ছ্যানালি নাটক এর আগে অনেক দেখেছে ওরা। পছন্দ মিল খায় নি, আর কিছুই নয়। দু একটা অল্প বয়সী মেয়েকে দেখলাম তাদের হবু বর বা বয় ফ্রেন্ডকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। মোটামুটি সবাই পূজার আগে কিছু একটা কিনতে চায়। হয়ত বা কারোর নিজের বাড়িতেই পূজা হবে। অনেক আত্মীয় আসবেন সেখানে। ভালো শাড়ি আর নতুন গয়না না পরতে পারলে বোধহয় ফ্যাশন দাঁড়াবে না। অনেক কথা হবে পিছনে। বাঙালিদের মধ্যে গয়না আর শাড়ি যেন একটা স্ট্যাটাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার কথা লিখতে বসেছি তার কথায় আসি। ওনাকে আমার চোখে পড়ার কারণ মাত্র দুটো, না প্রধানতও তিনটে, কিন্তু আসলে চারটে।
কারণ একঃ দেখলাম জলের মতন টাকা উড়িয়ে দিলেন মিনিট দশেকের মধ্যে। আমি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরেও এটা সেটা দেখে ঠিক পছন্দ করে উঠতে পারছি না। কারণ অবশ্য একটাই। সেই যে বললাম বাজেট সমস্যা। না হলে সব কটাই হয়ত কিনে নিতাম। (মাঝে মাঝে এই সব দোকানে এসে নিজেকে ভীষণ গরীব মনে হয়। কিন্তু, কিছু করার নেই।) উনি গোটা দুই সোনার আংটি(এবং রীতিমত দামী) একটা রীতিমত ভারী সোনার নেকলেস (রীতিমত দামী যে হবে সেটা বলাই বাহুল্য), আর এক জোড়া মোটা সোনার ওপর আধুনিক ডিজাইন করা ভারী হাতে পরার বালা কিনে নিলেন, মানে বুক করে দিলেন। (মনে মনে হিংসাই হল। নিশ্চই কোনও বড়লোক ব্যবসায়ীর গিন্নি। তাই এত উদ্যাম বেপরোয়া ভাব।) জিনিস যা কিনলেন রীতিমত চোখ ধাঁধিয়ে যাবার মতন। পরে খেয়াল করে দেখলাম শুধু আমি কেন, আমার মতন অনেকেই মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওনাকে দেখছেন।
কারণ দুইঃ ওনার পরিধানের পোশাকআশাক। আর কথা বলার ভঙ্গিমা। সময়ের সাথে সাথে আমরা বাঙালি মেয়েরা অনেক অগ্রসর হয়েছি। শুধু কাজে কর্মেই নয়। পোশাকআশাকেও। আমরা এখন অনেক ক্যাজুয়াল থাকি। কিন্তু ওনাকে দেখলাম উনি যেন সমস্ত মহিলা খরিদ্দারদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম। যে শারিটা পরেছেন সেটা ঠিক বেনারসি না হলেও, বেনারসি গোত্রীয় তো বটেই। এরকম বস্ত্র পরিহিতা আজকের দিনে কলকাতার রাস্তায় খুব একটা দেখা যায় না, আর তাও এই ব্যস্ততার সময়ে, যখন ভারী শাড়ি পরে রাস্তায় প্রতিযোগিতা করতে নামলে শাড়িতে পা আঁটকে পড়ে গিয়ে প্রচণ্ড একটা বিপদ ডেকে আনার সম্ভাবনা। লাল শাড়ির সাথে ম্যাচ করা ছোট হাতা কাঁচুলির মতন লাল রঙের ব্লাউজ যেন ওনার পোশাকি আভিজাত্য অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। সঠিক বলতে পারব না, তবে দেখে মনে হল, পরিষ্কার ওয়াক্স করা হাত। শাড়িটা যেন নাভির একটু নিচেই পরা। যদিও নাভি শাড়ির নিচে ঢাকা। গলার স্বর গম্ভীর অথচ মধুর। অনেকের গলায় একটা সুরেলা ভাব থাকে। এনারও তাই। স্বল্পভাষী। কথা বার্তায় একটা ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্য ফুটে ওঠে।
কারণ তিনঃ ওনার চেহারা, স্বাস্থ্য আর গায়ের রঙ। অনেকের কথাবার্তা আর পোশাকে ব্যক্তিত্য প্রকাশ পেলেও, চেহারা অনেক সময় বেমানান লাগে। মনে হয় কোথাও যেন কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কিন্তু ওনার ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। আমার আন্দাজ ঠিক হলে উচ্চতায় পাঁচ আটের কম হবেন না। এরকম উচ্চতা সচরাচর বাঙালি মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় না। মেয়ে ছেড়ে দিন, ছেলেদের মধ্যেই বিরল। মুখে একটা অদ্ভুত লাবণ্যর ছটা, সুন্দরী বলে ওনাকে ছোট করব না, সুন্দরীর থেকে একটু নয় অনেকটাই বেশী, মানে আমরা যাদের চলতি কথায় সুন্দরী বলে থাকি। সব থেকে দেখার মতন হল গায়ের রঙ, ফর্সা আর সোনালি রঙের মিশ্রনে যেন কেউ একটা গোলাপি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। এরকম গায়ের রঙ নিজের চোখে না দেখলে কারোর বিশ্বাস করার কথা নয়। আমাদের মতন মেয়েদের তো রোদে পুড়ে পুড়ে গায়ের রঙের সব লাবণ্য আর ছটা শেষের পথে। মুখে এক ফোঁটাও প্রসাধন নেই, একটু হালকা লিপস্টিক ছাড়া, আর তাও বেশ রুচি সম্মত আর সম্ভ্রান্ত। ফিগার এমন, যেন ওনার সেই বনেদী টাইপের বেশভূষার মধ্যে থেকেও সেটা ফুটে বেরোচ্ছে। ঘাড় থেকে কোমর অব্দি যেখানে ঠিক যতটা মাংস লাগার কথা ঠিক ততটাই দিয়ে পাঠিয়েছেন ওঁকে ভগবান। পিছনে ফিরলে মনে হল শরীরের পেছন ভাগেও ভগবান কোনও কার্পণ্য করেন নি। যেখানে ঠিক যতটুকু দেওয়ার ঠিক ততটাই মেপে মেপে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বয়স বোধ করি ত্রিশের সামান্য উপরে হবে।
কারণ চারঃ আমি ওনার পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নেকলেস পছন্দ করছিলাম। যতক্ষণ ওনার কেনা কাটা সম্পূর্ণ হয় নি ততক্ষণ যেন ওনার চারপাশে কি ঘটে যাচ্ছে সেই দিকে ওনার কোনও খেয়াল নেই। নিজের জিনিস পছন্দ করে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে দুটো মোটা টাকার বান্ডিল বিলে পাঠানোর পর প্রথমবার আমার দিকে ওর নজর পড়ল। আমি তখন আমার সাত নম্বর নেকলেসটা গলার সামনে বিছিয়ে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি মানানসই হবে কি না, আর মাথায় ঘুরছে একটাই প্রশ্ন যে দামটা দোকানদারের সহকারী আমাকে বলেছে সেটা দেওয়া ঠিক হবে কি না। উনি এক পলক ঘুরে আমাকে দেখে নিয়েই বললেন, “ এটা নিও না। আগেরটাই তো ভালো ছিল।“ তারপর একটু থেমে ইতস্তত করে বললেন “ দাম টা যদিও এটার থেকে একটু বেশী হবে। “ আবার আরেকটু থেমে বললেন “বয়স কম ওইটাই নাও। পয়সা তো পরেও রোজগার করে নিতে পারবে।“
এর পরের ঘটনা। বুঝলাম আমি যেমন আড়চোখে ওনাকে লক্ষ্য করছিলাম, উনিও নিশ্চই আমাকে লক্ষ্য করেছেন। সহকারী ভদ্রলোক যেন ওনার কথারই অপেক্ষা করছিল। সাথে সাথে আমার হাত থেকে এই নেকলেসটা ছিনিয়ে নিয়ে আগেরটা আবার আমার হাতে দিয়ে আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। জিনিসটা সত্যি ভালো। ওনাকেও একবার সামনা সামনি পরে দেখালাম। উনি হেঁসে বুঝিয়ে দিলেন ভাল দেখাচ্ছে। নেকলেস ঘাঁটা শেষ করে ওটাই নেব মনস্থির করে সহকারী ভদ্রলোককে বলে দিলাম। আমার হাত থেকে নেকলেসটা ছিনিয়ে নিয়ে (মনে হয় যাতে আর মত পরিবর্তন করতে না পারি) বিল করতে চলে গেল। আমি ওনার দিকে এই প্রথম সরাসরি একটু হাসিহাসি মুখ নিয়ে তাকালাম। ওনার মুখেও একটা সাবলীল অকৃত্রিম হাঁসি। বললেন “এসো, ওইখানে গিয়ে একটু বসি। বিল করতে সময় লাগাবে। এখন প্রচুর ভিড়, আর সবাই খুব ব্যস্ত।“ সময় যে লাগবে সেটা আমারও মনে হয়েছিল। আমিও তাই আর কথা না বাড়িয়ে ওনার নির্দেশিত ক্রেতাদের জন্য বরাদ্দ সোফার একাংশে গিয়ে বসে পড়লাম। শরীরটা যেন একটু ছেড়ে দিল। না পরিশ্রম তেমন কিছু হয়নি আজ সারা দিন। কিন্তু পকেট থেকে এতগুলো টাকা এক ঝটকায় বেড়িয়ে যাবে ভেবে মনটা একটু বিষিয়ে উঠেছিল যেন। অবশ্য কয়েক মুহূর্তেই সেটা কেটে গেল, কারণ ওখানে বসেই উনি আমার সাথে সুরেলা কন্ঠে গল্প জুড়ে দিলেন। বেশ মিশুকে কিন্তু ভদ্রমহিলা। অবশ্য ওনার কথা বার্তায় একটা আভিজাত্য আর বনেদী গৃহিণীর ছাপ স্পষ্ট।
বিল হতে সত্যিই অনেক সময় নিল ওরা, আর সময় যত বাড়ছে দোকানে খরিদ্দারের ভিড়ও যেন ততই বেড়ে চলেছে। ধীরে ধীরে আমরা বন্ধু সুলভ কথাবার্তা শুরু করলাম। মেয়েরা বন্ধু সুলভ কথাবার্তা বলতে কি বোঝায় সেটা কার অজানা এই দুনিয়ায়। অর্থাৎ, এক কথায় আমরা একে ওপরের হাঁড়ির খবর একে ওপরের সামনে পাড়তে শুরু করে দিলাম। আমার বাড়ি, হসপিটাল সব খবর বললাম, এমন কি আমার একজন পাণিপ্রার্থী আছে সেটাও উগড়ে দিলাম। ওনার বিষয়েও অনেক কথা জানলাম। ওনার বাড়ি কলকাতা থেকে প্রায় একশত পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে একটা বনেদী গ্রামে। গ্রাম না বলে মফস্বল বললে ঠিক হবে। কিন্তু বেশ জনবসতি বিরল একটা জায়গায়। আমার আন্দাজ ঠিকই ছিল। বনেদী জমিদার বংশের বড় ছেলের গৃহবধূ। তবে ওনার শশুর নাকি আর বেঁচে নেই। ওনার স্বামী ওনার সাথে বন্ধুর মতন মেশে, আর পূজার আগে কোলকাতায় ওনাকে প্রায় নাকি জোর করে শাড়ি গয়না ইত্যাদি কিনতে পাঠান। ওনার স্বামী নাকি ওইখানকার একটা এবং একমাত্র বড় চালের গুদামের মালিক। বেশ কিছুক্ষণ খোশগল্প হওয়ার পর উনি যেন একপেশে ভাবেই আমাকে ওনাদের গ্রামে আর ওনাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে বসলেন। আমি প্রথমে ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দি নি। কিন্তু, এক সময় মনে হল যে উনি আমাকে বেশ জোর দিয়েই ওনার বাড়ি যেতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। উনি নাকি খুব একলা থাকেন কারণ ওনার স্বামী সারা দিন বাইরে থাকেন ব্যবসার কাজে। আর ওনার কোনও বাচ্চা হয় নি। তাই ওনার নিঃসঙ্গতা আরও অনেক বেড়ে গেছে। ওনার স্বামী একদম রাতের দিকে বাড়ি ফেরেন। তাই পূজার সময় কটা দিনের জন্য ওনার বাড়িতে আমার পায়ের ধূলা পড়লে উনি যারপরনাই খুশি হবেন। আমাদের বিল চলে এসেছিল, আমি তখনকার মতন এই সংলাপে ইতি টানবার জন্য বললাম “আচ্ছা বেশ আমারও অনেক দিন বাইরে যাওয়া হচ্ছে না। একটু ভেবে দেখি। ওর সাথে একটু কথা বলে নি। তারপর জানাচ্ছি।“ মোবাইল নম্বর আদান প্রদান হয়ে গেল। বুঝলাম গ্রামে মোবাইল টাওয়ার পৌঁছেছে। বাইরে বেরোতেই দেখলাম একটা ভারী বনেদী ধপধপে সাদা অ্যাম্বাস্যাডার গাড়ি এসে থামল। যেন গারির চালক জানত যে উনি ঠিক এই মুহূর্তেই বাইরে বেরবেন। চালক গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকল। এই জনভর্তি রাস্তায় ফুটপাথের ধারে বেশীক্ষণ ধরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখলে পুলিশ এসে কেস দেবে। তাই ওনার ইচ্ছা থাকলেও উনি দাঁড়াতে পারলেন না। গাড়িতে ওঠার আগে আমার দুটো হাত ওনার কোমল হাতের মধ্যে নিয়ে আমাকে বললেন “তুমি আসলে সত্যিই আমি খুব খুশি হব। আর জেনে রেখ এটা আমার অন্তরের কথা।“ দরজা বন্ধ করতেই চালক লাফিয়ে গিয়ে সামনের সিটে উঠে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করে দিল। উনি গাড়ি শুরু হওয়ার এক মুহূর্ত আগে চালককে চাপা গলায় কি একটা বলতে গাড়িটা চলতে গিয়েও যেন দাঁড়িয়ে পড়ল কয়েক মুহূর্তের জন্য। জানলার কাঁচ নামিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “তুমি ডাক্তার তো?” মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম হ্যাঁ। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “তুমি অনেক পড়াশুনা করেছ। আবারও বলছি, তুমি এলে সত্যি ভালো লাগবে। আশা করি তোমারও ভালো লাগবে। এসো কিন্তু, হ্যাঁ? “ গাড়ি ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করে দিয়েছে। ওনার শেষ কথাটা কানে এল, অনেকটা যেন দীর্ঘশ্বাস মেশানো আছে সেই স্বরে, “ ষষ্ঠীর দিন সকাল সকাল চলে এসো। ষষ্ঠীর দিনই এসো কিন্তু।(কেন এত জোর দিলেন জানি না) অমুক নম্বর ট্রেনে উঠলে বেশীক্ষণ লাগবে না...” বাকি কথাটা মিলিয়ে গেল রাস্তার কোলাহলে আর ইঞ্জিনের শব্দে। মনে মনে ভাবলাম সত্যি ভদ্রমহিলা বড়ই একা। বোধহয় কথা বলার লোক নেই। ওনার স্বামী ব্যবসা নিয়ে এতটা মেতে আছে যে উনি নিজের একাকীত্বে হাঁপিয়ে উঠেছেন আর তাই এই একদিনের ক্ষণিকের আলাপেই আমাকে নিজেদের বাড়িতে পূজায় যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন। বড়লোক বাড়িতে এমনটাই হয়ে থাকে। আমি আমার পথে পা বাড়ালাম।
রাতে খাবার টেবিলে ***কে কথাটা পাড়লাম। যদিও আমি যে যাব বা যেতে চাই তেমন কথা বলিনি। আমার হবু স্বামী আর আমি এক সাথে একই ফ্ল্যাটে ভাড়া করে আছি। এতে নাক কুঁচকানোর মতন কিছু নেই। অনেকেই থাকে আজকের দিনে। ও আমাকে উৎসাহ দিল বেড়িয়ে পড়তে। ও নিজে আসতে পারবে না বলে দুঃখ প্রকাশ করল, কারণ ওঁকে একটু পড়াশুনার কাজে দিল্লি রওয়ানা হতে হবে দিন পাঁচেকের মধ্যে। সেটা অবশ্য আগে থেকেই স্থির ছিল। ফিরবে সেই প্রায় দুই মাস কাটিয়ে। তাই বোধহয় পূজার কটা দিন আমাকে সময় দিতে পারবে না বলে আমাকে ওখানে যাওয়ার জন্য উস্কে দিতে চাইছে। মনে মনে হেঁসে ফেললাম। ছেলেগুলো সেই ছেলেমানুষই রয়ে গেল। আমি যেন ওর কোনও সমস্যা বুঝি না। আর একজন ডাক্তার আরেকজন ডাক্তারের ব্যথা না বুঝলে আর কে বুঝবে। তবে ওর কথায় যে খানিকটা কাজ দিয়েছে সেটা বুঝলাম দুদিন পর। আর তাছাড়া আরেকটা ব্যাপারে একটা ক্ষীণ দুঃখ ছিল, কেন আমাকে পূজায় একা ফেলে রেখে দিয়ে যাচ্ছে, যদিও স্বেচ্ছায় যাচ্ছে না। আমি একমাত্র পূজার এই কটা দিনই ওঁকে নিজের মতন করে সব সময় পাই, সে বাড়িতেই হোক বা বাইরে হোক। বেশ হাত ধরে হাঁটা যায়, ঠাকুর দেখা যায়। আমার জন্ম দিনে আমার সাথে না থাকলেও তেমন দুঃখ হয় না, কারণ ব্যস্ততা আজ কার জীবনে নেই, কিন্তু এই কটা দিন যেন ঠিক হানিমুনের মতন। আগের বার আমরা বাইরে কাছাকাছির মধ্যে বেড়াতেও গেছিলাম। এইবার কিছুই হবে না। তবে সেটা অনেক আগে থেকেই স্থির করা ছিল। আর আমি মত দিয়েছি বলেই না ও বাইরে যাচ্ছে মাস দুয়েকের জন্য।
হাঁসপাতালে যাবার জন্য তখনও তৈরি হয়নি। ও তখনও রেডি হয়নি পুরোপুরি। আমি দুজনের ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে ব্যস্ত। এমন সময় বেজে উঠল আমার মোবাইল। সেই মহিলা। প্রথমে দুএকটা সৌজন্যসূচক কথা বলার পরই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমি ষষ্ঠীর দিন সকালে যাচ্ছি কিনা। আমি একটু আশ্চর্য হয়েছি বুঝে আমাকে একটু জোর দিয়েই বললেন “একবার এসেই দেখো। খারাপ লাগবে না। ভোর বেলায় উঠে প্রথম ট্রেনটা নিয়ে নিও। গাড়ি পাঠিয়ে দেব স্টেশনে। স্নান খাওয়া সব কিছু এখানে এসে আমার সাথে করবে। তোমার যত্নের কোনও ত্রুটি রাখব না এই যেন।“ ওনার কথায় যেন একটা অসহায় অথচ দৃঢ় আহ্বানের সুর ছিল যেটা মনের মধ্যে দাগ কেটে গেল। ব্রেকফাস্টের টেবিলে ***কে ওনার ফোনের কথা বলতেই ও আমাকে বলল “বলছি তো, যাও গিয়ে ঘুরে এস। জমিদার বাড়িতে থাকার সুযোগ আর কোনও দিন পাবে কি না বলতে পারি না। “ আমি তখন মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে ওখানে যাওয়ার জন্য রাজি আর তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম। ষষ্ঠীর দিন খুব কাক ডাকা ভোরে উঠেই রওয়ানা দিলাম অজানাকে পাড়ি দিতে। বেরোনোর আগে শুধু গলায় এক কাপ গরম কফি ঢালার সুযোগ পেয়েছিলাম। ব্যস। ট্যাক্সি আমার সধর্মীই ঠিক করে গিয়েছিল দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার আগে। পাড়ার ট্যাক্সি, মুখ চেনা, সে ঠিক সময়েই হাজির ছিল সেই কাক ডাকা ভোরে। সমস্ত ট্রেনটা প্রায় ঘুমিয়েই ছিল। আমিও উঠে ঘুমিয়ে পড়লাম বসে বসেই। গন্তব্য স্থলে পৌঁছানোর পর দেখলাম সত্যি সেই দিনকার সেই সাদা রঙের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য। আর ওই তো সেই দিনের চালকটা গাড়িতে তে হ্যালান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে। সামনে এগিয়ে আসতেই হাতের বিড়ি ফেলে আমার দিকে এগিয়ে এসে পিছনের দরজা খুলে হাঁসি মুখে আমাকে ভেতরে বসার জন্য আহ্বান জানাল। গাড়ি ছুটে চলল জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সত্যি বেশী লোকজন নেই এই তল্লাটে। এখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। কিন্তু সমস্ত রাস্তায় খুব কম লোকজনের দেখা পেলাম। কলকাতা এতক্ষনে কল্লোলিনী হয়ে উঠেছেন নিশ্চিত।
ওনার বাড়ি যখন পৌঁছালাম তখন হাত ঘড়িতে এগারোটা বেজে তেত্রিশ মিনিট হয়ে গেছে। মাথার উপর চড়া রোদ। নাকে যদিও একটা সোঁদা গন্ধ আসছে, বোধ করি গতকাল রাত্রে বা আজ ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়ে গেছে। ওনার বাড়িটাকে ঠিক বাড়ি না বলে মহল বললে ঠিক শোনাবে। কি বিশাল জায়গা জুড়ে যে এই প্রাচীন জমিদার বাড়ির ব্যাপ্তি সেটাও নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হবে। গাড়ির শব্দ শুনে এই জনমানবহীন মহল থেকে উনি নিজেই বেড়িয়ে এলেন। একটা সবচ্ছল হাঁসি মুখে আমাকে স্বাগত জানালেন। উনি যে সত্যিই আমাকে দেখে খুশি হয়েছেন সেটা ওনার ব্যস্ততা আর দৌড়াদৌড়ী দেখেই বোঝা যায়। আমাকে কপট রাগ দেখিয়ে বললেন যে আমার আসতে দেরী হয়ে গেছে কারণ উনি অনেকক্ষণ ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
এক
অনেক দিন আগের কথা। ওকে আমি প্রথমবার দেখেছিলাম এক গয়নার দোকানে। কেন সে কথা জিজ্ঞেস করা বোকাবোকা শোনাবে। গয়নার দোকানে মেয়েরা কি করতে যায়! গয়না কিনতে, আর কি! অনেক গয়না দেখে দোকানদারকে রীতিমত বিরক্ত করে সব শেষে নিজের পছন্দ মত একটা গয়না কেনা, আর ভুললে চলবে না যে বাজেটের কথা মাথায় রেখে সব দিক বিবেচনা করে শেষমেশ একটা কিছু খরিদ করে নেওয়া। এই আর কি। আমিও অনেক বছর হয়ে গেল কোনও গয়না কিনি নি। আর সত্যি কথা বলতে হাতে টাকা জমতে শুরু করেছে অনেক দিন ধরে, কিন্তু আমার কাছে ভাল গয়না একটাও যে নেই। অনেক দিনের পরিকল্পনা, যে এইবার পূজার আগে একটা ভাল দেখে নেকলেস আর না নিলেই নয়। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এখানে আসা। আজ আমার দুপুরের পর অফ,তাই চলে এলাম। একাই এসেছি। আমার হবু বর আমার সাথে দোকানে আসতে রাজি না হওয়ার কারণ অবশ্য আমার অযথা সময় লাগানো জিনিস পছন্দ করায়, সে শাড়িই হোক বা গয়নাই হোক বা জিন্স টপই হোক। একটু দেখে শুনে না নিলে কেমন করে হবে। মেয়েদের শাড়ি আর বাজারের ইলিশ মাছ একই রকম মেপে ঝেঁকে না কিনলে শপিঙ্গে আসাটাই তো মাঠে মারা গেল। দোকানে অবশ্য অনেক মহিলা ছিলেন। অল্প বয়সী মেয়েরাও ছিল। কোনও কোনও মহিলা ওনাদের বরের সাথে এসেছেন, ওনাদের বররা কোনটা পরলে ওনাদের ভাল লাগবে সে সব উপদেশ দিয়ে ওনাদের সাহায্য করে চলেছেন। একজন কে দেখে বুঝলাম ওনার সাথে ওনার বরের একটা ঠাণ্ডা ঝগড়া হয়ে গেল দোকানের ভেতরেই। যদিও দোকানদার বা ওনার কর্মচারীদের সেই ব্যাপারে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। বোধহয় এত বড় দোকানে এত দিন ধরে কাজ করে করে এই সব ছ্যানালি নাটক এর আগে অনেক দেখেছে ওরা। পছন্দ মিল খায় নি, আর কিছুই নয়। দু একটা অল্প বয়সী মেয়েকে দেখলাম তাদের হবু বর বা বয় ফ্রেন্ডকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। মোটামুটি সবাই পূজার আগে কিছু একটা কিনতে চায়। হয়ত বা কারোর নিজের বাড়িতেই পূজা হবে। অনেক আত্মীয় আসবেন সেখানে। ভালো শাড়ি আর নতুন গয়না না পরতে পারলে বোধহয় ফ্যাশন দাঁড়াবে না। অনেক কথা হবে পিছনে। বাঙালিদের মধ্যে গয়না আর শাড়ি যেন একটা স্ট্যাটাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার কথা লিখতে বসেছি তার কথায় আসি। ওনাকে আমার চোখে পড়ার কারণ মাত্র দুটো, না প্রধানতও তিনটে, কিন্তু আসলে চারটে।
কারণ একঃ দেখলাম জলের মতন টাকা উড়িয়ে দিলেন মিনিট দশেকের মধ্যে। আমি প্রায় আধ ঘণ্টা ধরেও এটা সেটা দেখে ঠিক পছন্দ করে উঠতে পারছি না। কারণ অবশ্য একটাই। সেই যে বললাম বাজেট সমস্যা। না হলে সব কটাই হয়ত কিনে নিতাম। (মাঝে মাঝে এই সব দোকানে এসে নিজেকে ভীষণ গরীব মনে হয়। কিন্তু, কিছু করার নেই।) উনি গোটা দুই সোনার আংটি(এবং রীতিমত দামী) একটা রীতিমত ভারী সোনার নেকলেস (রীতিমত দামী যে হবে সেটা বলাই বাহুল্য), আর এক জোড়া মোটা সোনার ওপর আধুনিক ডিজাইন করা ভারী হাতে পরার বালা কিনে নিলেন, মানে বুক করে দিলেন। (মনে মনে হিংসাই হল। নিশ্চই কোনও বড়লোক ব্যবসায়ীর গিন্নি। তাই এত উদ্যাম বেপরোয়া ভাব।) জিনিস যা কিনলেন রীতিমত চোখ ধাঁধিয়ে যাবার মতন। পরে খেয়াল করে দেখলাম শুধু আমি কেন, আমার মতন অনেকেই মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওনাকে দেখছেন।
কারণ দুইঃ ওনার পরিধানের পোশাকআশাক। আর কথা বলার ভঙ্গিমা। সময়ের সাথে সাথে আমরা বাঙালি মেয়েরা অনেক অগ্রসর হয়েছি। শুধু কাজে কর্মেই নয়। পোশাকআশাকেও। আমরা এখন অনেক ক্যাজুয়াল থাকি। কিন্তু ওনাকে দেখলাম উনি যেন সমস্ত মহিলা খরিদ্দারদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম। যে শারিটা পরেছেন সেটা ঠিক বেনারসি না হলেও, বেনারসি গোত্রীয় তো বটেই। এরকম বস্ত্র পরিহিতা আজকের দিনে কলকাতার রাস্তায় খুব একটা দেখা যায় না, আর তাও এই ব্যস্ততার সময়ে, যখন ভারী শাড়ি পরে রাস্তায় প্রতিযোগিতা করতে নামলে শাড়িতে পা আঁটকে পড়ে গিয়ে প্রচণ্ড একটা বিপদ ডেকে আনার সম্ভাবনা। লাল শাড়ির সাথে ম্যাচ করা ছোট হাতা কাঁচুলির মতন লাল রঙের ব্লাউজ যেন ওনার পোশাকি আভিজাত্য অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। সঠিক বলতে পারব না, তবে দেখে মনে হল, পরিষ্কার ওয়াক্স করা হাত। শাড়িটা যেন নাভির একটু নিচেই পরা। যদিও নাভি শাড়ির নিচে ঢাকা। গলার স্বর গম্ভীর অথচ মধুর। অনেকের গলায় একটা সুরেলা ভাব থাকে। এনারও তাই। স্বল্পভাষী। কথা বার্তায় একটা ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্য ফুটে ওঠে।
কারণ তিনঃ ওনার চেহারা, স্বাস্থ্য আর গায়ের রঙ। অনেকের কথাবার্তা আর পোশাকে ব্যক্তিত্য প্রকাশ পেলেও, চেহারা অনেক সময় বেমানান লাগে। মনে হয় কোথাও যেন কিছু একটা গণ্ডগোল হয়ে গেছে। কিন্তু ওনার ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। আমার আন্দাজ ঠিক হলে উচ্চতায় পাঁচ আটের কম হবেন না। এরকম উচ্চতা সচরাচর বাঙালি মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় না। মেয়ে ছেড়ে দিন, ছেলেদের মধ্যেই বিরল। মুখে একটা অদ্ভুত লাবণ্যর ছটা, সুন্দরী বলে ওনাকে ছোট করব না, সুন্দরীর থেকে একটু নয় অনেকটাই বেশী, মানে আমরা যাদের চলতি কথায় সুন্দরী বলে থাকি। সব থেকে দেখার মতন হল গায়ের রঙ, ফর্সা আর সোনালি রঙের মিশ্রনে যেন কেউ একটা গোলাপি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। এরকম গায়ের রঙ নিজের চোখে না দেখলে কারোর বিশ্বাস করার কথা নয়। আমাদের মতন মেয়েদের তো রোদে পুড়ে পুড়ে গায়ের রঙের সব লাবণ্য আর ছটা শেষের পথে। মুখে এক ফোঁটাও প্রসাধন নেই, একটু হালকা লিপস্টিক ছাড়া, আর তাও বেশ রুচি সম্মত আর সম্ভ্রান্ত। ফিগার এমন, যেন ওনার সেই বনেদী টাইপের বেশভূষার মধ্যে থেকেও সেটা ফুটে বেরোচ্ছে। ঘাড় থেকে কোমর অব্দি যেখানে ঠিক যতটা মাংস লাগার কথা ঠিক ততটাই দিয়ে পাঠিয়েছেন ওঁকে ভগবান। পিছনে ফিরলে মনে হল শরীরের পেছন ভাগেও ভগবান কোনও কার্পণ্য করেন নি। যেখানে ঠিক যতটুকু দেওয়ার ঠিক ততটাই মেপে মেপে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বয়স বোধ করি ত্রিশের সামান্য উপরে হবে।
কারণ চারঃ আমি ওনার পাশেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নেকলেস পছন্দ করছিলাম। যতক্ষণ ওনার কেনা কাটা সম্পূর্ণ হয় নি ততক্ষণ যেন ওনার চারপাশে কি ঘটে যাচ্ছে সেই দিকে ওনার কোনও খেয়াল নেই। নিজের জিনিস পছন্দ করে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে দুটো মোটা টাকার বান্ডিল বিলে পাঠানোর পর প্রথমবার আমার দিকে ওর নজর পড়ল। আমি তখন আমার সাত নম্বর নেকলেসটা গলার সামনে বিছিয়ে দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি মানানসই হবে কি না, আর মাথায় ঘুরছে একটাই প্রশ্ন যে দামটা দোকানদারের সহকারী আমাকে বলেছে সেটা দেওয়া ঠিক হবে কি না। উনি এক পলক ঘুরে আমাকে দেখে নিয়েই বললেন, “ এটা নিও না। আগেরটাই তো ভালো ছিল।“ তারপর একটু থেমে ইতস্তত করে বললেন “ দাম টা যদিও এটার থেকে একটু বেশী হবে। “ আবার আরেকটু থেমে বললেন “বয়স কম ওইটাই নাও। পয়সা তো পরেও রোজগার করে নিতে পারবে।“
এর পরের ঘটনা। বুঝলাম আমি যেমন আড়চোখে ওনাকে লক্ষ্য করছিলাম, উনিও নিশ্চই আমাকে লক্ষ্য করেছেন। সহকারী ভদ্রলোক যেন ওনার কথারই অপেক্ষা করছিল। সাথে সাথে আমার হাত থেকে এই নেকলেসটা ছিনিয়ে নিয়ে আগেরটা আবার আমার হাতে দিয়ে আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। জিনিসটা সত্যি ভালো। ওনাকেও একবার সামনা সামনি পরে দেখালাম। উনি হেঁসে বুঝিয়ে দিলেন ভাল দেখাচ্ছে। নেকলেস ঘাঁটা শেষ করে ওটাই নেব মনস্থির করে সহকারী ভদ্রলোককে বলে দিলাম। আমার হাত থেকে নেকলেসটা ছিনিয়ে নিয়ে (মনে হয় যাতে আর মত পরিবর্তন করতে না পারি) বিল করতে চলে গেল। আমি ওনার দিকে এই প্রথম সরাসরি একটু হাসিহাসি মুখ নিয়ে তাকালাম। ওনার মুখেও একটা সাবলীল অকৃত্রিম হাঁসি। বললেন “এসো, ওইখানে গিয়ে একটু বসি। বিল করতে সময় লাগাবে। এখন প্রচুর ভিড়, আর সবাই খুব ব্যস্ত।“ সময় যে লাগবে সেটা আমারও মনে হয়েছিল। আমিও তাই আর কথা না বাড়িয়ে ওনার নির্দেশিত ক্রেতাদের জন্য বরাদ্দ সোফার একাংশে গিয়ে বসে পড়লাম। শরীরটা যেন একটু ছেড়ে দিল। না পরিশ্রম তেমন কিছু হয়নি আজ সারা দিন। কিন্তু পকেট থেকে এতগুলো টাকা এক ঝটকায় বেড়িয়ে যাবে ভেবে মনটা একটু বিষিয়ে উঠেছিল যেন। অবশ্য কয়েক মুহূর্তেই সেটা কেটে গেল, কারণ ওখানে বসেই উনি আমার সাথে সুরেলা কন্ঠে গল্প জুড়ে দিলেন। বেশ মিশুকে কিন্তু ভদ্রমহিলা। অবশ্য ওনার কথা বার্তায় একটা আভিজাত্য আর বনেদী গৃহিণীর ছাপ স্পষ্ট।
বিল হতে সত্যিই অনেক সময় নিল ওরা, আর সময় যত বাড়ছে দোকানে খরিদ্দারের ভিড়ও যেন ততই বেড়ে চলেছে। ধীরে ধীরে আমরা বন্ধু সুলভ কথাবার্তা শুরু করলাম। মেয়েরা বন্ধু সুলভ কথাবার্তা বলতে কি বোঝায় সেটা কার অজানা এই দুনিয়ায়। অর্থাৎ, এক কথায় আমরা একে ওপরের হাঁড়ির খবর একে ওপরের সামনে পাড়তে শুরু করে দিলাম। আমার বাড়ি, হসপিটাল সব খবর বললাম, এমন কি আমার একজন পাণিপ্রার্থী আছে সেটাও উগড়ে দিলাম। ওনার বিষয়েও অনেক কথা জানলাম। ওনার বাড়ি কলকাতা থেকে প্রায় একশত পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে একটা বনেদী গ্রামে। গ্রাম না বলে মফস্বল বললে ঠিক হবে। কিন্তু বেশ জনবসতি বিরল একটা জায়গায়। আমার আন্দাজ ঠিকই ছিল। বনেদী জমিদার বংশের বড় ছেলের গৃহবধূ। তবে ওনার শশুর নাকি আর বেঁচে নেই। ওনার স্বামী ওনার সাথে বন্ধুর মতন মেশে, আর পূজার আগে কোলকাতায় ওনাকে প্রায় নাকি জোর করে শাড়ি গয়না ইত্যাদি কিনতে পাঠান। ওনার স্বামী নাকি ওইখানকার একটা এবং একমাত্র বড় চালের গুদামের মালিক। বেশ কিছুক্ষণ খোশগল্প হওয়ার পর উনি যেন একপেশে ভাবেই আমাকে ওনাদের গ্রামে আর ওনাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে বসলেন। আমি প্রথমে ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দি নি। কিন্তু, এক সময় মনে হল যে উনি আমাকে বেশ জোর দিয়েই ওনার বাড়ি যেতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। উনি নাকি খুব একলা থাকেন কারণ ওনার স্বামী সারা দিন বাইরে থাকেন ব্যবসার কাজে। আর ওনার কোনও বাচ্চা হয় নি। তাই ওনার নিঃসঙ্গতা আরও অনেক বেড়ে গেছে। ওনার স্বামী একদম রাতের দিকে বাড়ি ফেরেন। তাই পূজার সময় কটা দিনের জন্য ওনার বাড়িতে আমার পায়ের ধূলা পড়লে উনি যারপরনাই খুশি হবেন। আমাদের বিল চলে এসেছিল, আমি তখনকার মতন এই সংলাপে ইতি টানবার জন্য বললাম “আচ্ছা বেশ আমারও অনেক দিন বাইরে যাওয়া হচ্ছে না। একটু ভেবে দেখি। ওর সাথে একটু কথা বলে নি। তারপর জানাচ্ছি।“ মোবাইল নম্বর আদান প্রদান হয়ে গেল। বুঝলাম গ্রামে মোবাইল টাওয়ার পৌঁছেছে। বাইরে বেরোতেই দেখলাম একটা ভারী বনেদী ধপধপে সাদা অ্যাম্বাস্যাডার গাড়ি এসে থামল। যেন গারির চালক জানত যে উনি ঠিক এই মুহূর্তেই বাইরে বেরবেন। চালক গাড়ি থেকে নেমে পিছনের দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকল। এই জনভর্তি রাস্তায় ফুটপাথের ধারে বেশীক্ষণ ধরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখলে পুলিশ এসে কেস দেবে। তাই ওনার ইচ্ছা থাকলেও উনি দাঁড়াতে পারলেন না। গাড়িতে ওঠার আগে আমার দুটো হাত ওনার কোমল হাতের মধ্যে নিয়ে আমাকে বললেন “তুমি আসলে সত্যিই আমি খুব খুশি হব। আর জেনে রেখ এটা আমার অন্তরের কথা।“ দরজা বন্ধ করতেই চালক লাফিয়ে গিয়ে সামনের সিটে উঠে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করে দিল। উনি গাড়ি শুরু হওয়ার এক মুহূর্ত আগে চালককে চাপা গলায় কি একটা বলতে গাড়িটা চলতে গিয়েও যেন দাঁড়িয়ে পড়ল কয়েক মুহূর্তের জন্য। জানলার কাঁচ নামিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “তুমি ডাক্তার তো?” মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম হ্যাঁ। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন “তুমি অনেক পড়াশুনা করেছ। আবারও বলছি, তুমি এলে সত্যি ভালো লাগবে। আশা করি তোমারও ভালো লাগবে। এসো কিন্তু, হ্যাঁ? “ গাড়ি ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করে দিয়েছে। ওনার শেষ কথাটা কানে এল, অনেকটা যেন দীর্ঘশ্বাস মেশানো আছে সেই স্বরে, “ ষষ্ঠীর দিন সকাল সকাল চলে এসো। ষষ্ঠীর দিনই এসো কিন্তু।(কেন এত জোর দিলেন জানি না) অমুক নম্বর ট্রেনে উঠলে বেশীক্ষণ লাগবে না...” বাকি কথাটা মিলিয়ে গেল রাস্তার কোলাহলে আর ইঞ্জিনের শব্দে। মনে মনে ভাবলাম সত্যি ভদ্রমহিলা বড়ই একা। বোধহয় কথা বলার লোক নেই। ওনার স্বামী ব্যবসা নিয়ে এতটা মেতে আছে যে উনি নিজের একাকীত্বে হাঁপিয়ে উঠেছেন আর তাই এই একদিনের ক্ষণিকের আলাপেই আমাকে নিজেদের বাড়িতে পূজায় যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন। বড়লোক বাড়িতে এমনটাই হয়ে থাকে। আমি আমার পথে পা বাড়ালাম।
রাতে খাবার টেবিলে ***কে কথাটা পাড়লাম। যদিও আমি যে যাব বা যেতে চাই তেমন কথা বলিনি। আমার হবু স্বামী আর আমি এক সাথে একই ফ্ল্যাটে ভাড়া করে আছি। এতে নাক কুঁচকানোর মতন কিছু নেই। অনেকেই থাকে আজকের দিনে। ও আমাকে উৎসাহ দিল বেড়িয়ে পড়তে। ও নিজে আসতে পারবে না বলে দুঃখ প্রকাশ করল, কারণ ওঁকে একটু পড়াশুনার কাজে দিল্লি রওয়ানা হতে হবে দিন পাঁচেকের মধ্যে। সেটা অবশ্য আগে থেকেই স্থির ছিল। ফিরবে সেই প্রায় দুই মাস কাটিয়ে। তাই বোধহয় পূজার কটা দিন আমাকে সময় দিতে পারবে না বলে আমাকে ওখানে যাওয়ার জন্য উস্কে দিতে চাইছে। মনে মনে হেঁসে ফেললাম। ছেলেগুলো সেই ছেলেমানুষই রয়ে গেল। আমি যেন ওর কোনও সমস্যা বুঝি না। আর একজন ডাক্তার আরেকজন ডাক্তারের ব্যথা না বুঝলে আর কে বুঝবে। তবে ওর কথায় যে খানিকটা কাজ দিয়েছে সেটা বুঝলাম দুদিন পর। আর তাছাড়া আরেকটা ব্যাপারে একটা ক্ষীণ দুঃখ ছিল, কেন আমাকে পূজায় একা ফেলে রেখে দিয়ে যাচ্ছে, যদিও স্বেচ্ছায় যাচ্ছে না। আমি একমাত্র পূজার এই কটা দিনই ওঁকে নিজের মতন করে সব সময় পাই, সে বাড়িতেই হোক বা বাইরে হোক। বেশ হাত ধরে হাঁটা যায়, ঠাকুর দেখা যায়। আমার জন্ম দিনে আমার সাথে না থাকলেও তেমন দুঃখ হয় না, কারণ ব্যস্ততা আজ কার জীবনে নেই, কিন্তু এই কটা দিন যেন ঠিক হানিমুনের মতন। আগের বার আমরা বাইরে কাছাকাছির মধ্যে বেড়াতেও গেছিলাম। এইবার কিছুই হবে না। তবে সেটা অনেক আগে থেকেই স্থির করা ছিল। আর আমি মত দিয়েছি বলেই না ও বাইরে যাচ্ছে মাস দুয়েকের জন্য।
হাঁসপাতালে যাবার জন্য তখনও তৈরি হয়নি। ও তখনও রেডি হয়নি পুরোপুরি। আমি দুজনের ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে ব্যস্ত। এমন সময় বেজে উঠল আমার মোবাইল। সেই মহিলা। প্রথমে দুএকটা সৌজন্যসূচক কথা বলার পরই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমি ষষ্ঠীর দিন সকালে যাচ্ছি কিনা। আমি একটু আশ্চর্য হয়েছি বুঝে আমাকে একটু জোর দিয়েই বললেন “একবার এসেই দেখো। খারাপ লাগবে না। ভোর বেলায় উঠে প্রথম ট্রেনটা নিয়ে নিও। গাড়ি পাঠিয়ে দেব স্টেশনে। স্নান খাওয়া সব কিছু এখানে এসে আমার সাথে করবে। তোমার যত্নের কোনও ত্রুটি রাখব না এই যেন।“ ওনার কথায় যেন একটা অসহায় অথচ দৃঢ় আহ্বানের সুর ছিল যেটা মনের মধ্যে দাগ কেটে গেল। ব্রেকফাস্টের টেবিলে ***কে ওনার ফোনের কথা বলতেই ও আমাকে বলল “বলছি তো, যাও গিয়ে ঘুরে এস। জমিদার বাড়িতে থাকার সুযোগ আর কোনও দিন পাবে কি না বলতে পারি না। “ আমি তখন মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে ওখানে যাওয়ার জন্য রাজি আর তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম। ষষ্ঠীর দিন খুব কাক ডাকা ভোরে উঠেই রওয়ানা দিলাম অজানাকে পাড়ি দিতে। বেরোনোর আগে শুধু গলায় এক কাপ গরম কফি ঢালার সুযোগ পেয়েছিলাম। ব্যস। ট্যাক্সি আমার সধর্মীই ঠিক করে গিয়েছিল দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার আগে। পাড়ার ট্যাক্সি, মুখ চেনা, সে ঠিক সময়েই হাজির ছিল সেই কাক ডাকা ভোরে। সমস্ত ট্রেনটা প্রায় ঘুমিয়েই ছিল। আমিও উঠে ঘুমিয়ে পড়লাম বসে বসেই। গন্তব্য স্থলে পৌঁছানোর পর দেখলাম সত্যি সেই দিনকার সেই সাদা রঙের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য। আর ওই তো সেই দিনের চালকটা গাড়িতে তে হ্যালান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে। সামনে এগিয়ে আসতেই হাতের বিড়ি ফেলে আমার দিকে এগিয়ে এসে পিছনের দরজা খুলে হাঁসি মুখে আমাকে ভেতরে বসার জন্য আহ্বান জানাল। গাড়ি ছুটে চলল জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে। সত্যি বেশী লোকজন নেই এই তল্লাটে। এখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। কিন্তু সমস্ত রাস্তায় খুব কম লোকজনের দেখা পেলাম। কলকাতা এতক্ষনে কল্লোলিনী হয়ে উঠেছেন নিশ্চিত।
ওনার বাড়ি যখন পৌঁছালাম তখন হাত ঘড়িতে এগারোটা বেজে তেত্রিশ মিনিট হয়ে গেছে। মাথার উপর চড়া রোদ। নাকে যদিও একটা সোঁদা গন্ধ আসছে, বোধ করি গতকাল রাত্রে বা আজ ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়ে গেছে। ওনার বাড়িটাকে ঠিক বাড়ি না বলে মহল বললে ঠিক শোনাবে। কি বিশাল জায়গা জুড়ে যে এই প্রাচীন জমিদার বাড়ির ব্যাপ্তি সেটাও নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হবে। গাড়ির শব্দ শুনে এই জনমানবহীন মহল থেকে উনি নিজেই বেড়িয়ে এলেন। একটা সবচ্ছল হাঁসি মুখে আমাকে স্বাগত জানালেন। উনি যে সত্যিই আমাকে দেখে খুশি হয়েছেন সেটা ওনার ব্যস্ততা আর দৌড়াদৌড়ী দেখেই বোঝা যায়। আমাকে কপট রাগ দেখিয়ে বললেন যে আমার আসতে দেরী হয়ে গেছে কারণ উনি অনেকক্ষণ ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।